সুবীর পাল
কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো এক পরিত্যক্ত সংগ্রহশালার দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ধুলোর এক নিঃশব্দ ঝড় যেন আছড়ে পড়ল অরিত্র মুখার্জীর চোখে-মুখে। দিনের আলো সেখানে পৌঁছায় না, আর বিদ্যুৎ সংযোগও প্রায় নিস্ক্রিয়— কেবল মাঝেমধ্যে পুরোনো টিউবলাইটগুলো একটানা ঝিম মেরে জ্বলে ওঠে আবার নিভে যায়, যেন জীর্ণ শরীরের মাঝে অসহায় প্রাণের শেষ ছটফটানি। অরিত্রর বয়স বয়াল্লিশের কোঠায়, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর কপালের মাঝে গাঁথা একটা হালকা কাটা দাগ, যেটা অতীতের কোনো দুর্ঘটনার স্মারক। তিনি কলকাতা হেরিটেজ মিউজিয়ামের প্রধান কিউরেটর, তবে তার আসল পরিচয় একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে— যিনি ইতিহাসের গায়ে জমে থাকা ধুলো সরিয়ে মৃত কালচক্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পান না। সেই দিনের সকালটা শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত ফোন কল দিয়ে— মিউজিয়ামের সাবেক রক্ষক হরেকৃষ্ণ পাল হঠাৎ করে খবর পাঠান, কলেজ স্ট্রিটের লালবাড়ির বেজমেন্টে নাকি এক রহস্যময় ধাতব যন্ত্র পাওয়া গেছে, যেটি তার বিশ্বাস অনুযায়ী উনিশ শতকের এক নিষিদ্ধ তান্ত্রিক সাধকের তৈরি। অরিত্র, সঙ্গী করে তাঁর এক ইন্টার্ন মেয়ে কৃত্তিকা পালকে, তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যান সেই অন্ধকার জাদুঘরে— দরজা খুলেই তার চোখে পড়ে যন্ত্রটি, আধচাপা ধুলোর স্তরে ঢাকা, অথচ এক আশ্চর্য আলো যেন তার মধ্যখান থেকে নিঃসরণ হচ্ছিল, অব্যক্ত স্পন্দনের মতো।
যন্ত্রটা ছিল একটা ধাতব চক্রাকৃতি গঠন, মাঝখানে কাচ দিয়ে ঘেরা উজ্জ্বল এক বিন্দু, যেন এক মৃত চোখ এখনও চারপাশে তাকিয়ে আছে— জীবনের অভিশাপ বয়ে বেড়ানো আত্মা। কৃত্তিকা যন্ত্রটিকে পরিষ্কার করার জন্য হাতে দস্তানা ও ব্রাশ নিয়ে কাজ শুরু করে, আর অরিত্র তার ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটি প্রতিচ্ছবি ও খোদাই করা শ্লোক রেকর্ড করতে থাকেন। যন্ত্রটির গায়ে সংস্কৃত ও ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা ছিল— “প্রেতবাহুঃ স্পন্দতঃ সর্বলোকযন্ত্রঃ”, যার অর্থ দাঁড়ায়, “যন্ত্রটি সমস্ত মৃতলোকের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে সক্ষম।” অরিত্র প্রথমে সেটাকে একটা ধর্মীয় অলঙ্কার বা প্রতীক বলেই ধরে নেন, কারণ অতিপ্রাকৃত ব্যাপারে তার মনোভাব সর্বদা যুক্তিবাদী এবং কঠিন বাস্তবতায় ভরপুর। কিন্তু তারপর ঘটে অপ্রত্যাশিত ঘটনা— কৃত্তিকার অনিচ্ছাকৃত হাত লাগায় ঘূর্ণায়মান চক্রটা একবার ঘোরে, আর মুহূর্তের মধ্যে যন্ত্রটি কাঁপতে শুরু করে। চারপাশের বাতাস যেন ঘন হয়ে আসে, ধুলো বাতাসে উড়তে থাকে ছায়ার মতো, আর একটি মৃদু গর্জনের মতো শব্দ শোনা যায় যন্ত্রের অন্তর্গত দিক থেকে, যেটা কোনোভাবে প্রাচীন কোনো ঘুমন্ত যন্ত্রাংশের জাগরণের প্রতিধ্বনি হতে পারে। অরিত্র তৎক্ষণাৎ কৃত্তিকাকে পিছিয়ে আসতে বলেন, কিন্তু তখনই হঠাৎ যন্ত্রের মাঝখানের আলোটা লালচে আভায় জ্বলে ওঠে— এমনভাবে যেন কারও চোখ জ্বলছে, আর সেই চোখের দৃষ্টিপথ যন্ত্রের গা ঘেঁষে অরিত্রর মুখের ঠিক দিকে চলে আসে।
সন্ধ্যার পর কলেজ স্ট্রিট থেকে একটু দক্ষিণে, গোপালনগর লেনে প্রথম অস্বাভাবিক ঘটনাটা ঘটে। এক ৬৫ বছরের বৃদ্ধা, শান্তিদেবী, যিনি প্রতিদিন ঠিক সন্ধ্যা ছয়টার সময় পুকুর ঘাটে পায়চারি করতেন, নিখোঁজ হয়ে যান। রাত ৯টার দিকে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় ঘাটের পাশেই— মুখ ও চোখ কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, শরীর জলে আধভেজা, আর গলায় কিছু অদ্ভুত লালচে দাগ। আশেপাশের লোকজন জানায়, তারা কেউ কোনো চিৎকার বা হাহাকার শোনেনি, যেন মৃত্যু এসেছিল নিঃশব্দে, ছায়ার মতো। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে আত্মহত্যা বলা হলেও রিপোর্টে লেখা ছিল— শরীরে কোনও জোরপূর্বক আঘাতের চিহ্ন নেই, কিন্তু এক অজানা ঠান্ডা স্পর্শের উপস্থিতি শরীরের চারপাশে টের পাওয়া গেছে। পরদিন সকালে রায়না সেন নামের এক প্যারাসাইকোলজিস্ট সেই ঘটনার খবর পেয়ে সংবাদপত্রে দেখে পৌঁছে যান মিউজিয়ামে, আর সরাসরি অরিত্রর সামনে গিয়ে প্রশ্ন করেন— “আপনি কি ‘প্রেতযন্ত্র’ সচল করেছেন?” অরিত্র বিরক্ত হন, কিন্তু রায়নার চোখে যে আতঙ্ক ছিল তা যুক্তি দিয়ে অস্বীকার করা কঠিন। তিনি বলেন, “এটা কোনো সাধারণ ধাতব বস্তু নয়, এটা আত্মার তরঙ্গ ধরে রাখতে পারে— এটা যদি সত্যিই চালু হয়ে থাকে, তবে কারও আত্মা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরের গায়ে ছায়ার মতো।” অরিত্র প্রথমে অবিশ্বাস করলেও, যন্ত্রের গায়ে তার নিজের ধারণার বাইরের যে গাণিতিক গঠন ও তান্ত্রিক চিহ্ন খোদাই করা ছিল, তাতে তিনি ধীরে ধীরে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। রায়না তখন বলেন— “এই যন্ত্র একবার জাগলে শুধু আত্মা নয়, আত্মাতীত শক্তিকেও ফিরিয়ে আনতে পারে। এবং আপনি যদি সত্যিই যন্ত্রটা চালু করে থাকেন, তাহলে হয়তো আমরা কেউই এখন আর নিরাপদ নই।”
–
রাতটা কলকাতার জন্য স্বাভাবিক ছিল না। শ্যামবাজার থেকে ভবানীপুর, কলেজ স্কোয়ার থেকে টালিগঞ্জ— কিছু অদ্ভুত ছায়া, অস্বস্তিকর ঠান্ডা বাতাস আর নিঃশব্দ চিৎকার যেন শহরের বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। পরদিন সকালে স্থানীয় সংবাদপত্রে তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়— তিনজন মানুষ, তিনটি আলাদা এলাকা, কিন্তু মৃত্যু একেবারে একরকম: মুখ এবং চোখ পাটির মতো সাদা কাপড়ে জড়ানো, শরীরে জখমের চিহ্ন নেই, তবে রক্তের ধমনী থেকে প্রবাহ প্রায় শূন্য। অরিত্র মুখার্জী সেই সকালে নিজ বাসভবনে বসে পেপারের হেডলাইন দেখে স্থবির হয়ে যান: “কলকাতা শহরে রহস্যময় মৃত্যু— আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ছায়ামৃত্যুর গুজব।” তিনি খবরটা কাট করে রাখেন, আর তখনই রায়না সেন ফোন করেন। কণ্ঠে দৃঢ়তা— “অরিত্রবাবু, সময় কম। প্রেতযন্ত্র চালু হয়ে গেছে, আর এর তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে, মৃত আত্মারা সাড়া দিচ্ছে। আপনি আজই আমার সঙ্গে আসুন— একজন আছেন, যিনি জানেন এই যন্ত্রের ইতিহাস।” অরিত্র একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলেও তার অভ্যন্তরীণ কৌতূহল, কিংবা অপরাধবোধ, তাকে রায়নার সঙ্গে যেতে বাধ্য করে।
দুপুরের পর তারা পৌঁছায় ভবানীপুরের এক পুরোনো, প্রাচীন বটগাছে ছাওয়া বাড়িতে— মণিমালা দেবীর বাসভবন। বাড়িটা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে, অন্ধকার উঠোনে কাকেরা ডাকছে, বাতাসে ধূপ-চন্দনের পুরোনো গন্ধ, আর দরজার গায়ে তালা নয়— একটা ভাঙা কপালের তাবিজ ঝোলানো। মণিমালা দেবী একসময় ছিলেন শ্মশানতান্ত্রিক পরিবারের শেষ জীবিত উত্তরসূরি। কপালে সিঁদুরের গোল টিপ, চোখে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও জ্ঞানের ভারে ভারাক্রান্ত। তিনি প্রথমেই অরিত্রকে দেখে বলেন, “তুমি যন্ত্র জাগিয়েছো, তাই তো? এখন নিজেই বুঝবে আত্মা কাকে বলে!” অরিত্র কিছু বলতে যান, কিন্তু রায়না তাকে থামিয়ে মণিমালার সামনে বসিয়ে দেন। বৃদ্ধা বলেন, “এই যন্ত্র তৈরি হয়েছিল প্রাচীনকালে এক প্রেততান্ত্রিক সাধকের দ্বারা— নরসিংহ নামে তার পরিচিতি, কিন্তু তিনি ছিলেন এক আত্মাহন্তা, যিনি জীবিত মানুষের আত্মাকে যন্ত্র দিয়ে ধরে রাখতে পারতেন, শুধু তাদের দেহ নয়, তাদের ইচ্ছাও। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রেতরূপ শীলিত হয়েছিল যন্ত্রের কেন্দ্রে।” অরিত্র চমকে ওঠেন— “মানে আপনি বলছেন, কেউ ওখানে রয়েছে?” মণিমালা শান্তভাবে মাথা নাড়েন, “না, কেউ নেই… ছিলো, আর এখন… আছে।”
সন্ধ্যা নামার আগে তারা ফিরে আসে, কিন্তু শহর তখন যেন পাল্টে যেতে শুরু করেছে। শ্যামবাজার মোড়ের চায়ের দোকানগুলোতে আলোচনা— “কাল রাতে কে যেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল, মাথায় লাল পাগড়ি, চোখে আলো, কাচের মতো। তার দিকে তাকাতেই মনে হল মাথার ভেতর কেউ কথা বলছে!” কলেজ স্কোয়ারের পুকুরপাড়ে এক যুবক বলে, সে দেখেছে ছায়ার মতো কিছু একটা ঘুরছে, ছায়ার মুখে মানুষ নেই, কিন্তু গলায় রক্তমাখা কাপড় বাঁধা। পুলিশ সেসব গুজব বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু লালবাজারে এক নির্লিপ্ত কিন্তু চিন্তিত অফিসার বসে আছেন— আইপিএস অর্ণব ব্যানার্জি। এই তিনটি মৃত্যুর তদন্তে তিনিই নিযুক্ত হয়েছেন। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তার চোখ স্থির হয়ে যায়— একটি ছায়ামূর্তি, মানবদেহের গঠন অনুরূপ, ধাতব বা কঙ্কালসদৃশ, ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিটের এক দিক থেকে— সোজা সংগ্রহশালার দিকে। রাতের শহর ঘুমিয়ে থাকলেও কোনো কিছু জেগে আছে, এবং তার পায়ের শব্দ হয় না, তবে তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়— এক অদৃশ্য প্রেতের পদধ্বনি যেন শূন্যে ভেসে আসে, ধাতব গর্জনের মতো। অরিত্র জানেন, এবার সবকিছুর শুরু হয়েছে। এখন যা ঘটছে, তার কাছে ইতিহাস শুধুই এক নতজানু অনুচার।
–
লালবাজারের অন্ধকার কনফারেন্স রুমে বসে অর্ণব ব্যানার্জি নিঃশব্দে চায়ের কাপ হাতে ধরে ক্যামেরার ফুটেজের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার চোখের পাতা একবারও পড়ছে না, যেন পর্দার মধ্যেকার কোনো অদৃশ্য গতিপ্রকৃতি বুঝে নিতে চাইছেন। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে— কলেজ স্ট্রিটের প্রাচীন সংগ্রহশালার ধারে রাত ২:১৬ মিনিটে এক ছায়ামূর্তি ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনও মানুষ নয়, তবু মানুষের মতো চলাফেরা, একধরনের ভারী গঠন; ক্লিপটি দেখে বোঝা যায় না, সেটি ধাতব না কঙ্কালসদৃশ, তবে এক অস্বস্তিকর কম্পন ফুটেজের প্রতি ফ্রেমে ছড়িয়ে রয়েছে। হেডফোনে সংযুক্ত করা সাউন্ড এমপ্লিফায়ারে শুধু ধাতব ঘষার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, যেন মৃত ইতিহাস কোনো যন্ত্রের ভিতর ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। সাইবার সেলের প্রধান রাহুল মিত্র এসে অর্ণবকে বলেন, “স্যার, এই ফাইলটা রাতেই কেউ হ্যাক করে মুছে দিতে চেয়েছিল। আমরা ব্যাকআপ থেকে তুলেছি, কিন্তু কেউ যেন চায় না আপনি এটা দেখুন।” অর্ণব সজোরে চায়ের কাপ নামিয়ে বলেন, “মানে কেউ জানে এই ছায়া কী? কেউ চায় না আমরা জানি?” রাহুল চুপ করে থাকে। ফুটেজের পাশে জ্বলজ্বল করছে সময়ের গোঁড়ালি— ২:১৬। এবং যন্ত্রটি সক্রিয় হয়েছিল সেই সময়েই, যখন অরিত্র মুখার্জী এবং কৃত্তিকা পাল ভুলবশত ঘুরিয়েছিলেন সেই রহস্যময় ধাতব চক্র।
অর্ণব ঠিক করেন— এবার সরাসরি ড. অরিত্রর মুখোমুখি হতে হবে। তিনি এক অফিসারকে পাঠিয়ে কলেজ স্ট্রিটের সংগ্রহশালায় ডেকে পাঠান অরিত্র এবং রায়নাকে। তারা হাজির হলে অর্ণব প্রথমে কড়া কণ্ঠে প্রশ্ন করেন, “গত এক সপ্তাহে এই জায়গায় কি কোনও যন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন, যা চালু হতেই এত মৃত্যু ঘটতে শুরু করেছে?” অরিত্র প্রথমে না বলতে চাইলেও, রায়না সরাসরি বলে ফেলেন, “হ্যাঁ, একটা প্রাচীন যন্ত্র পাওয়া গেছে। যেটা ভুল করে সক্রিয় হয়ে গেছে, এবং যেটার সঙ্গে মৃত আত্মার সংযোগ থাকতে পারে।” অর্ণব হেসে ফেলেন— “তাহলে আপনাদের মতে ভূত এই খুনের জন্য দায়ী?” রায়নার চোখে তখন আগুন, সে চুপচাপ অরিত্রর ব্যাগ থেকে একটি খয়েরি খাতা বের করে এগিয়ে দেন, যাতে প্রেতযন্ত্রের প্রথম নকশা ও মন্ত্রলিপি আঁকা ছিল। অর্ণব তা দেখে মুখ গম্ভীর করেন। কিছু একটা যেন তার অভ্যন্তরে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝখানে ফাটল ধরায়। রায়না তখন বলেন, “আমরা যন্ত্রটা বন্ধ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সময় কম। আগামী পূর্ণিমায় এর কম্পাঙ্ক তুঙ্গে উঠবে, তখন আর থামানো যাবে না।” অর্ণব স্পষ্ট বুঝতে পারেন— এই দুই মানুষ হয় বিকারগ্রস্ত, অথবা এমন কিছু জানে যা সাধারণ যুক্তি বোঝাতে পারছে না। তিনি তাদের না আটকিয়ে বলেন, “তিন দিনের সময় দিলাম। যদি এরমধ্যে আরও মৃত্যু হয়, আমি কিন্তু সরাসরি তোমাদের গ্রেপ্তার করব।”
তাদের বেরিয়ে যাবার পরপরই শহরের দক্ষিণ প্রান্তে ঘটে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা। একটি চালাঘরে একা থাকতেন ৭৫ বছরের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, নির্মল দত্ত। প্রতিবেশীরা জানান, মধ্যরাতে তার ঘর থেকে এক অদ্ভুত ধাতব শব্দ ও দীর্ঘশ্বাসের মতো কিছু আওয়াজ শোনা যায়। সকালে দেখা যায়, নির্মলবাবুর দেহ ঘরের কোণায় কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে রয়েছে— তাঁর চোখ ও ঠোঁট একসাথে সাদা কাপড়ে সেলাই করা, এবং তাঁর দেহের ছায়া কিছুটা বাঁকানো, যেন কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি দেহ থেকে আত্মাকে টেনে বের করে নিয়ে গেছে। ঘটনাস্থলে এসে অর্ণব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি জানেন— এটা স্বাভাবিক খুন নয়, এখানকার ভয় একধরনের অন্তর্লীন নীরবতা থেকে জন্ম নিচ্ছে। রায়নার কথা বারবার মনে পড়ে— “ছায়ারাও কখনও কখনও আত্মার চেয়ে শক্তিশালী হয়।” অর্ণব এবার সত্যিই ভাবতে শুরু করেন— সম্ভবত তিনি এক অদৃশ্য যুদ্ধের মাঝে দাঁড়িয়ে, যেখানে অস্ত্রের বদলে আছে মন্ত্র, আর গোয়েন্দাগিরির বদলে চাই তান্ত্রিক চেতনা। শহরের আকাশে তখন ধোঁয়াশার মতো ছায়া জমে উঠছে, আর অন্ধকার জানলায় যেন কেউ তাকিয়ে আছে— একজন নয়, অনেকেই… তারা প্রত্যেকে কারও এক সময়কার পরিচিত, এখন শুধু অচেনা প্রেত।
–
ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার ওপর, কিন্তু সংগ্রহশালার ভেতরের পরিবেশ এখনও থমথমে। অরিত্রর চোখে ঘুম নেই, তার চারদিকে ছড়ানো পুরনো স্ক্রল, প্রাচীন মুদ্রা, পাণ্ডুলিপি—সবই যেন এখন একটার পর একটা সংকেত দিচ্ছে। কালরাত্রির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। যন্ত্রটা এখন বন্ধ, নিস্তব্ধ, কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভবযোগ্য। টেবিলের উপর রাখা সেই ধাতব প্রেতযন্ত্র যেন নিঃশব্দে নিশ্বাস ফেলছে, প্রতিটি মুহূর্তে আশপাশের আকাশকে ভারী করে তুলছে। “এই যন্ত্রটা শুধু এক প্রাচীন বস্তু নয়,” নিজের মনে বলল অরিত্র, “এ এক প্রবেশদ্বার।” তার চোখের কোণায় একটা স্পন্দন দেখা গেল, খুব ক্ষণিকের জন্য। মেঝেতে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি হঠাৎ উঠে এল টেবিলের পাশে। অরিত্র চমকে উঠলেও নিজের জায়গা থেকে সরল না। ছায়াটি নড়ল না, শুধু এক ঝাপসা মুখ যেন তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। তার মুখে ছিল না চোখ, নাক বা ঠোঁট—কেবল অস্পষ্ট এক কুয়াশা।
দ্রুতই সে যোগাযোগ করল নীলা সেন-এর সঙ্গে—এক সময়ের অতিপ্রাকৃত গবেষক, বর্তমানে লিটল ম্যাগাজিনে লেখেন প্রাচীন হিন্দু তন্ত্র ও উপনিষদ বিষয়ক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। নীলা প্রথমে কিছুটা অবিশ্বাস প্রকাশ করলেও অরিত্র যখন যন্ত্রটির গঠন ও ঘটনার বিবরণ দিল, তখন সে যেন চুপ হয়ে গেল। “তুমি বলছ লোহা দিয়ে তৈরি, অথচ তাতে কপালবিন্দুর মতো আকৃতি?” নীলা প্রশ্ন করল, “এটা কালবিন্দু-যন্ত্র হতে পারে, যেটা একসময় প্রেততন্ত্রের অনুশীলনে ব্যবহৃত হত—বিশেষত শ্মশানতন্ত্রের সন্ন্যাসীদের মধ্যে।” অরিত্রর গলা শুকিয়ে এল, কারণ সে আগেই ‘শ্মশান’ শব্দটা শুনেছিল কাল রাতে সেই কণ্ঠস্বরে। “যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে তুমি যা খুলেছ তা শুধু এক যন্ত্র নয়—তুমি এক প্রবাহমুখ খুলে দিয়েছ,” নীলা বলল, “আর যদি সেই প্রবাহ থেকে ফিরে আসে প্রাচীন কোনও প্রেতাত্মা, তবে সে এত সহজে যাবে না।” তার পরামর্শ অনুযায়ী, তারা দুজনেই ঠিক করল পরদিন রাতেই যন্ত্রটিকে আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে—তবে এইবার কিছু বিধান মেনে।
পরদিন রাত আটটার সময় তারা আবার সংগ্রহশালায় হাজির হল। জানালাগুলো কাপড়ে ঢেকে রাখা, মোমবাতির আলোয় ঘর আবছা। নীলা তার সঙ্গে এনেছে কিছু বৈদিক মন্ত্র, কিছু ধুনো এবং কিছু লাল রঙের সুতো যা ‘নির্বাসন’ রীতি অনুসারে ব্যবহৃত হয়। তারা যন্ত্রটি ঘিরে বসল। নীলা শুরু করল ‘রুদ্রাভিষেক মন্ত্র’ আর অরিত্র যন্ত্রের পাশের ঘড়ির সুইচ টিপে যন্ত্রটিকে আবার চালু করল। মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের তাপমাত্রা কমে গেল, মোমের আলো কাঁপতে লাগল, আর বাতাসে ভেসে উঠল ধাতব গন্ধ। হঠাৎ করে যন্ত্রটি কেঁপে উঠল, আর নীলার উচ্চারণ থেমে গেল। ঠিক তখন, তাদের সামনে হঠাৎ করে ফুটে উঠল এক অর্ধস্বচ্ছ চেহারা—একটা কঙ্কালসদৃশ মুখ, মাথায় তিলক, হাতে খড়্গ। নীলা ফিসফিস করে বলল, “এ প্রেতরাজ, যিনি স্বয়ং মৃত্যুর পরে নিজের রাজত্ব গড়েন কণ্ঠহীনদের নিয়ে।” মুখে কথা নেই, কিন্তু তার চোখ দিয়ে যেন ছুটে আসছে হাজার বছরের বিদ্বেষ। যন্ত্রটা যেন তার প্রবেশপথ, আর তার ইচ্ছা—আবার দখল নেওয়া মর্ত্যভূমির। অরিত্রর পা যেন জমে গিয়েছে। এই মাত্র শুরু হল এমন এক ভয়াবহ রাত, যা বদলে দেবে শুধু অরিত্র আর নীলার নয়, গোটা শহরের পরিণতি।
–
ভোরের আলো সবে কলকাতার প্রাচীন বুকে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু রাজন দত্তর চোখে সেই আলো যেন কোনো অর্থ বহন করছিল না। টানা তিন রাত ধরে ঘুম নেই তার। যন্ত্রটি সক্রিয় করার পর থেকে বাড়ির ভিতর এমন সব শব্দ শোনা যাচ্ছে, যা কোনও মানুষের কান সহজে মেনে নিতে পারে না। রাতে দরজার ওপাশে টান, বারান্দায় ভারী কিছু টানার আওয়াজ, আর মাঝে মাঝেই একটা ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ—যা যেন কারো অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করেই অস্তিত্ব জাহির করে। আজ সকালে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রাজন যখন জানালার ধারে দাঁড়িয়েছিলেন, ঠিক তখনই পাশের দেওয়ালের আয়নায় সে দেখতে পেল পেছনে একটা ছায়ামূর্তি—দীর্ঘদেহী, মাথা নিচু করা, আর চোখে কেবল জ্বলন্ত অন্ধকার। সে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ছায়াটি মিলিয়ে গেল। রাজনের দমবন্ধ লাগতে থাকে। ছুটে এসে ডায়েরিতে লিখে রাখে ঘটনার বিবরণ, কারণ এই ডায়েরিই এখন একমাত্র সাক্ষী তার মানসিক যুদ্ধের।
বিকেলের দিকে রাজনের দরজায় আবারও কড়া নাড়ে কেউ। এবার দরজায় দাঁড়িয়ে অচেনা এক পুরুষ, পরনে কালো কোট আর মাথায় পুরনো ধাঁচের হ্যাট। তার মুখখানা যেন অতীতের কোনও সিনেমা থেকে উঠে আসা চরিত্র—শুষ্ক, সাদা গাল, আর ঠোঁটে এক অস্পষ্ট হাসি। তিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন—শ্রীমান ভাস্কর সান্যাল, আত্মা গবেষক এবং তান্ত্রিক প্রেততত্ত্ববিদ। রাজন সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেও ভদ্রলোক একেবারে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বললেন, “আপনি যন্ত্রটি চালু করেছেন, তাই এখন সময় এসেছে প্রকৃত সত্য জানার।” রাজন যেন ঘোরের মধ্যে বসতে বলল তাঁকে। ভাস্কর সান্যাল ধীরে ধীরে খুললেন তার চামড়ার ব্যাগ থেকে এক পুরনো তালপাতার পুঁথি, যার পাতাগুলোতে আঁকা অদ্ভুত সব চিহ্ন—জ্যামিতিক কাঠামোর মাঝে লুকিয়ে ভয়ানক মুখাবয়ব। তিনি জানালেন, এই যন্ত্র একপ্রকার ‘আহ্বান-যন্ত্র’—যা একটি নির্দিষ্ট তামসিক তরঙ্গে সক্রিয় হয় এবং মৃত আত্মাদের পৃথিবীতে টেনে আনে, বিশেষত সেইসব আত্মা যারা কোনো কারণে অসমাপ্ত ইচ্ছা নিয়ে মারা গিয়েছে।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার যেন বাড়ির ভিতর আরও গাঢ় হতে লাগল। ভাস্কর সান্যাল রাজনের স্টাডি রুমে সেই যন্ত্রের সামনে ধ্যানস্থ হয়ে বসলেন, চারপাশে একগুচ্ছ ধূপকাঠি, পঞ্চমুণ্ডি আসনের মত পাঁচটি পুরোনো কাঠের টুকরো, আর একটি কঙ্কালের খুলি রেখে যন্ত্রটিকে ঘিরে তৈরি করলেন এক ত্রিকোণিক বৃত্ত। বৃত্তের ঠিক বাইরে রাজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল—তাঁর চোখে আতঙ্ক, অথচ অদ্ভুতভাবে মুগ্ধতা। আচমকাই ঘরে বাতাসের গতি বেড়ে গেল, জানালার পর্দা উঠে গিয়ে জানালার গ্লাস ভেঙে পড়ল মেঝেতে, আর সেই মুহূর্তে যন্ত্র থেকে বেরোল এক অশরীরী গর্জন। কুয়াশার মত এক শীতল ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল ঘরে, আর সেই ধোঁয়ার মধ্যে থেকে ক্রমে গড়ে উঠল এক ছায়ামূর্তি—যার গায়ে শিকল প্যাঁচানো, চোখ দু’টো একেবারে খালি গহ্বর। সে যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে শতাব্দীপ্রাচীন নিদ্রা থেকে। রাজনের বুক ধকধক করে ওঠে। ভাস্কর সান্যাল চোখ বন্ধ করেই বললেন, “এ হল প্রেতরাজ—যার আত্মা বহু বছর আগে এই শহরে বিসর্জিত হয়েছিল। এখন সে খুঁজছে… প্রতিশোধ।”
–
এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছিল সংগ্রহশালার গোটা চত্বরটিকে। বাইরের রাস্তায় গাড়ির শব্দ, কলকাতার ব্যস্ততা – সব যেন দূরে কোথাও মুছে গিয়েছিল। অভিষেক বসু হাতে করে সেই পুরোনো নীলচে বাদামি পাণ্ডুলিপির পাতাগুলি উল্টাচ্ছিলেন, যার প্রতিটি লাইনে খচিত ছিল বৈরাগ্য, তন্ত্র, আর মৃত্যুর বর্ণনা। হঠাৎ একটা পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেল তাঁর—“যে যন্ত্র পিতৃলোককে ছোঁয়, তার বর্ণনা দেবো না, কেবল একটিই শর্ত—যে হৃদয়ে ভয় নেই, সেই মাত্র সে যন্ত্র ছুঁতে পারে।” অভিষেকের গা শিউরে উঠল। এও কী সম্ভব? যে যন্ত্র তারা চালু করে ফেলেছেন, তা কি সত্যিই মৃতদের জগতে দরজা খুলে দিয়েছে? ঠিক তখনই সংগ্রহশালার নিচের তল থেকে একটা তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করলেন তিনি। যেন মাটি নিজেই আন্দোলিত হচ্ছে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলেন তিনি – সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন একাকী রেখা ঘোষাল, যিনি মোহিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন সেই যন্ত্রের দিকে। যন্ত্রের মধ্যখানে লালচে এক জ্যোতির আভাস, যেন প্রাণ পেয়েছে যন্ত্রটি। “এটা নিশ্বাস নিচ্ছে, অভিষেক,” রেখা ফিসফিস করে বললেন।
ঠিক তখনই আবার ঘটল সেই অস্বাভাবিক কাণ্ড। বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। যন্ত্রের পেছন থেকে ধোঁয়ার মত কুয়াশা ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। সেই কুয়াশার মধ্যে, যন্ত্রের ছায়ার মধ্যে থেকে দেখা গেল এক অন্ধকার ছায়া – মানুষের মতো, কিন্তু তার মুখ ছিল না। একরাশ কুয়াশার মতো মিশে থাকা মুখ, চোখ দুটো শুধু জ্বলছিল লাল আগুনের মতো। রেখা তখন হাঁটুতে বসে পড়েছেন, ঠোঁট কাঁপছে তাঁর—”ও-ই… প্রেতরাজ!” অভিষেক পেছনে তাকাতেই অন্ধকারের মধ্যে সেই ছায়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল একটি কঙ্কালের মতো অবয়ব। তার গলায় ঝুলছে কিছু ধাতব পুঁতির মালা, আর চোখে সেই অনন্ত মৃত্যুর দৃষ্টি। যন্ত্রটি এবার স্পষ্ট গর্জন করে উঠল – এক আত্মঘাতী প্রাচীন সুর, যা প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোকের মতো গম্ভীর। অবচেতনেই অভিষেকের মনে পড়ে গেল তার ঠাকুরদার লেখা ডায়েরির কথা—‘প্রেতরাজ কখনো একা আসে না। সে আত্মাদের টানে, আর কেবল রক্তই পারে তাকে থামাতে।’
তৃতীয়বারের মতো বিদ্যুৎ কাঁপিয়ে দিয়ে পুরো সংগ্রহশালা নিঃসাড় হয়ে গেল। পুলিশ অফিসার শৌর্য সেন তখন নিচে নেমে এলেন, হাতে টর্চ আর একে-৪৭। চোখে অবিশ্বাস, কপালে ঘাম। “এটা… এটা তো যন্ত্র নয়, এটা তো এক জ্যান্ত অস্ত্র, যা মৃতদের ডাকে।” ঠিক তখনই যন্ত্রের পেছনে থাকা দেওয়াল ভেঙে পড়ল। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আরও তিনটি ছায়া – তন্ত্র-মন্ত্রের পোশাকে আবৃত, তাদের চোখেও সেই অগ্নিস্রষ্টা রূপ। অভিষেক বুঝতে পারলেন—এই যন্ত্র কেবল প্রেতরাজকেই জাগায়নি, সঙ্গে ফিরিয়ে এনেছে তার পুরোনো অনুগামীদের, যারা যুগ যুগ ধরে চুপচাপ অপেক্ষা করছিল এই জাগরণের জন্য। এবার শুরু হতে চলেছে যুদ্ধ—জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর, ইতিহাসের সঙ্গে প্রেততন্ত্রের। এখন আর পেছনে ফেরার সময় নেই।
–
পুরনো সংগ্রহশালার সেই গোপন ঘরে ঢোকার আগে বিভাসের বুক যেন দুলছিল অজানা আশঙ্কায়। বৃষ্টির শব্দ যেন ঘরের ভিতর ঢুকে এক অদ্ভুত ঘনঘটায় পরিণত হয়েছে। বাইরে কলকাতার আকাশ লালচে—একপ্রকার অস্বাভাবিক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বিভাস জানে, আজ রাত্রে যন্ত্র ফের সক্রিয় হবে। কিন্তু সে জানে না, আজ সেই যন্ত্র কাকে ডেকেছে। সহায়ক হিসেবে তার সঙ্গে ছিল গবেষণাকারী স্নেহা, যার মুখেও ভয় আর কৌতূহলের মিশেল। ঘরের এক কোণে রাখা প্রেতযন্ত্র এখন নিঃশব্দে জ্বলছে—লালচে আভা ছড়াচ্ছে তার বুক থেকে। হঠাৎ এক মুহূর্তে, সারা ঘর অন্ধকার। ঝড়ের শব্দ যেন এক মুহূর্তে থেমে গিয়ে আবার তীব্র আকারে ফিরে এল। আর সেই সঙ্গেই শোনা গেল, একটা গভীর আর্তনাদ—যেন শতাব্দী পেরিয়ে আসা কষ্টের চিৎকার।
আর্তনাদের সেই শব্দ যেন ঘরের দেওয়াল কাঁপিয়ে দিল। প্রেতযন্ত্র এবার নিজে থেকেই ঘুরছে—এক অজানা ছন্দে। বিভাস আগেও একাধিক বার যন্ত্রটি সক্রিয় হতে দেখেছে, কিন্তু এবার… এবার কিছু আলাদা। যন্ত্রের চারপাশে ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে, আর সেই ধোঁয়ার ভিতরেই যেন ক্রমে গঠিত হচ্ছে এক ছায়ামূর্তি। মুখে সেলাই, চোখে দাহ—এ এক ভয়ঙ্কর প্রেত, কিন্তু তার শরীর থেকে বেরোচ্ছে অন্যরকম এক আকুতি। স্নেহা চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু বিভাস বলে, “চুপ! এ শুধু আত্মার আর্তনাদ নয়… ও কিছু বলছে!” সেই ছায়ামূর্তিটি এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, তারপর নিজের বুকের ওপর সোজা হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে বলে, “মুক্তি চাই… যন্ত্র বন্ধ করো…” এই প্রথম, কোনো আত্মা প্রেতযন্ত্র থেকে ডেকে কোনো ক্লান্তি প্রকাশ করল। এতদিন যেসব আত্মা এসেছিল, তারা ছিল রাগ, প্রতিহিংসা বা পাপে ভরপুর। কিন্তু এ এক বিধ্বস্ত, আত্মগ্লানিতে ভরা আত্মা। বিভাস অনুভব করে, এই আত্মা কোনো যুদ্ধের বলি—কোনো এক মিথ্যে অভিযুক্ত প্রেত, যাকে শতাব্দী ধরে ডাকা হচ্ছে ভুলভাবে।
স্নেহা ধীরে ধীরে যন্ত্রের পাশে গিয়ে বসে পড়ে, মুখ তুলে দেখে বিভাসের দিকে। তার চোখে জল, মুখে উদ্বেগ। “বিভাসদা, ও তো আমাদের কাকাবাবুর মতোই দেখাচ্ছে… আপনি তো বলেছিলেন, আপনার ঠাকুর্দার ভাই ১৯০৫ সালে নিখোঁজ হয়েছিলেন এক সন্ধ্যায়?” বিভাস স্তব্ধ। হ্যাঁ, এ সত্যি… তার ঠাকুর্দার ভাই, সুরেশ চক্রবর্তী, এক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে বেরিয়ে ফেরেননি। বহুদিন ধরে পরিবারে সেই গল্প রয়ে গিয়েছিল, একটি অভিশপ্ত যন্ত্র ও সুরেশবাবুর অন্তর্ধান। তাহলে কি এই আত্মা… বিভাস ছুটে যায় প্রেতটির কাছে, আর জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কি সুরেশ?” ছায়ামূর্তি হঠাৎ এক ম্লান হাসি দেয়। “শেষে… কেউ চিনল…” তার কণ্ঠ যেন ক্ষীণ হয়ে আসে। যন্ত্র থেমে যায়। ধোঁয়া হালকা হয়। আর তার ভেতর থেকে খসে পড়ে একটি ধাতব পুঁথি—তাতে উৎকীর্ণ নাম: Suresh Chakraborty, 1905. বিভাস আর স্নেহা স্তব্ধ হয়ে যায়। আজ প্রেতযন্ত্র প্রথম কাউকে মুক্তি দিল। অথচ, এর অর্থ কী? এটা কি কেবল আত্মার মুক্তি, না কি আরও কোনো গভীর সত্য প্রকাশ পেতে চলেছে?
–
দরজার গর্জনে জাদুঘরের কাচ ভাঙার শব্দ ছড়িয়ে পড়ল সারা প্রাঙ্গণে। ধোঁয়ার মধ্য থেকে উঠে এল এক দৈত্যাকার, কঙ্কালসার অবয়ব—চোখ দু’টি লাল অগ্নিশিখায় জ্বলছে, পেছনে গা ঘেঁষে কয়েকশো অতৃপ্ত আত্মা। সে-ই “প্রেতরাজ”। তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি যেন গম্ভীর শঙ্খধ্বনির মতো—এক ঝাঁক পাখির মতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। অরিত্র, দীপা, ও অচিন্ত্য তখনই বুঝে গেল—যন্ত্রতন্ত্র শুধুই এক প্রাচীন বস্তু নয়, বরং একটি আত্মিক সেতু, যে সেতু এক যুগের প্রেতসমাজকে বর্তমানের হাড়ে-মাংসে ফিরে আসার পথ দেখায়। অরিত্র চিৎকার করে বলল, “আমাকে সময় দাও! আমাকে ওই যন্ত্রটা আবার বন্ধ করতে হবে!” কিন্তু প্রেতরাজ তখন ছড়িয়ে দিচ্ছে তার মৃত্যুচুম্বন, যার স্পর্শে ছাই হয়ে যাচ্ছে মাটির বস্তু। ধ্বংস আসন্ন, প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু দীপা, যিনি নিজেই বহুদিন ধরে তন্ত্রশাস্ত্রের ছাত্র, জানতেন—প্রেতযন্ত্র যতটা বিজ্ঞান, ততটাই মনস্তত্ত্ব ও তন্ত্র। তিনি রক্তে আঁকা প্রাচীন রক্ষাচক্রটি খুঁজে বের করলেন, যা আগে ছিল জমে যাওয়া রক্তের নিচে। সেই চক্রে দাঁড়িয়ে তিনি মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন—প্রাচীন মিত্রতন্ত্রের জ্ঞান, যা একমাত্র “মহাপ্রেতের” প্রবেশ রোধ করতে পারে। অচিন্ত্য, নিজের সীমাহীন ভয় নিয়েও, দীপার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন তার উপস্থিতিই এক অভেদ্য বলয়। প্রেতরাজ ক্রমশ উন্মত্ত হয়ে উঠল, কিন্তু তার ছায়াগুলি রক্ষাচক্রে প্রবেশ করতে পারল না। অরিত্র ওই ফাঁকে ছুটে গিয়ে যন্ত্রের কাঁটা আবার পেছন দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করল। প্রতিটি ঘূর্ণনের সাথে সাথে আত্মারা একে একে উধাও হতে লাগল, তাদের মুখে শুধু কৃতজ্ঞতা আর মুক্তির আর্তি। সময় শেষ হয়ে আসছে, যন্ত্র যদি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না হয়, তাহলে এই পৃথিবী হবে এক মরণভূমি।
শেষ মুহূর্তে অরিত্র যন্ত্রের কেন্দ্রচক্রে তার রক্তের একটি ফোঁটা ফেলে দিল—এটাই ছিল প্রেতযন্ত্রের শুদ্ধিকরণ। মুহূর্তের মধ্যে এক বিস্ফোরণ ঘটল, যেন সময় নিজেই এক ফাটলে ছিঁড়ে যাচ্ছে। প্রেতরাজ এক বিদ্যুৎরেখার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, আর চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল, শুধু বাতাসে ভেসে থাকল পুরনো সুগন্ধি ধূপের গন্ধ। সূর্য ওঠার ঠিক আগে জাদুঘরের সব ঘড়ি একসঙ্গে থেমে গেল—৩:৩৩, সেই মুহূর্ত যাকে তান্ত্রিকেরা বলে “মৃত্যুর দোরগোড়া”। দীপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অচিন্ত্য ছিটকে পড়ল এক কোণে। আর অরিত্র? সে বসে আছে যন্ত্রের সামনে, রক্তাক্ত কিন্তু শান্ত, যেন বোঝাতে চাইছে—যন্ত্রটিকে ঘুম পাড়ানো গেছে, আপাতত। কিন্তু তাদের কেউই বুঝতে পারেনি, যন্ত্রের ভেতরে এখনো টিকে আছে এক অদৃশ্য বীজ—যা পরবর্তী আহ্বানের অপেক্ষায়, যেন মৃত্যুও একদিন আবার জীবন দাবি করে নিতে পারে।
___




