তিয়াসা বণিক
প্রথম পর্ব: প্রথম দিন, প্রথম চোখে দেখা
নতুন কলেজ, নতুন শহর, নতুন চুলের কাটিং—সব মিলিয়ে তিথির ভিতরে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ কাজ করছিল। প্রথম বর্ষের বাংলা বিভাগের ক্লাসটা শুরু হচ্ছে সকাল আটটায়। বাবা নিজে এসে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গতকাল ফিরেছেন হাওড়ায়, আর আজ সকাল থেকেই তিথি একা। একা, কিন্তু তেমন একা নয়, বুকের ভিতরে একটা আলগা ঢেউ উঠছে, যেন কিছু একটা ঘটবে।
কলেজের গেট পেরিয়ে যখন প্রথমবার ক্লাসরুমে ঢুকল, তখন প্রায় সব ছাত্রছাত্রী ঢুকে গেছে। একটা কোণার বেঞ্চে জায়গা খুঁজে নিয়ে বসতেই পাশের জন একটু সরে এসে বলল, “তুমি নতুন? আমি রুদ্র।” একটা হালকা হাসি, চুলগুলো এলোমেলো, কিন্তু চোখে খুব শান্ত একটা আলোর রেখা। তিথি মৃদু হাসল, “হ্যাঁ, আমি তিথি। হাওড়া থেকে এসেছি।” রুদ্র বলল, “আমি এখানকারই, কলেজপাড়ার পাশেই থাকি।” কথাটা এত স্বাভাবিকভাবে বলল, যেন বহুদিনের চেনা।
প্রথম ক্লাসে অধ্যাপক যখন ‘আদর্শ প্রেম’ নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ব্যাখ্যা করছিলেন, তিথির খেয়াল ছিল না। জানলার বাইরে হালকা রোদ পড়ছে আর পাশে বসে থাকা ছেলেটার আঙ্গুলে একটা লাল কালির কলম ঘোরাফেরা করছে। জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে, তিথির কপালের চুল উড়ছে, সে ভাবছে—এই তো কলেজ লাইফ শুরু, আর প্রথম দিনেই কেন যেন মনটা একটু কেঁপে উঠছে।
ছুটির ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই রুদ্র বলল, “চলো, ক্যানটিনে চা খাবে?” তিথি একটু দ্বিধায় পড়ল, আবার নিজেকে বলল—একটু আলাপ করতেই বা ক্ষতি কী? দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে ক্যানটিনে এল। রুদ্র বলল, “এখানকার লেবু চা আর সামোসা—দারুণ!” তিথি চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিল। কথা হচ্ছিল হালকা গল্পে, বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা। একটা জায়গায় এসে তিথি বুঝতে পারল—এই ছেলে খুব সাধারণ, কিন্তু চোখে একটা গভীরতা আছে, যেটা সে এতদিন খুঁজছিল।
রুদ্র বলল, “তুমি কি কবিতা লেখো?” তিথি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি জানলে কী করে?” রুদ্র একটু হেসে বলল, “তোমার চোখের চাহনি বলল। যারা শব্দে মনের কথা বলে, তাদের চোখে কিছু না কিছু থেকে যায়।”
তিথি একটু লাজুক হেসে বলল, “তুমি নিজেও তো মনে হচ্ছে লেখো কিছু।”
রুদ্র চোখ সরিয়ে বলল, “লিখতাম একসময়, এখন আর সেভাবে লিখি না।”
তিথি অনুভব করল—এই ছেলে একদিন তার মনের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে পড়বে।
ফিরে আসার সময় দু’জনে হাঁটছিল ধীর পায়ে। কলেজের রাস্তার পাশ দিয়ে নীল শার্ট পরা স্কুল পড়ুয়ারা যাচ্ছে, কেউ কেউ ফুটপাথে বই বিক্রি করছে, একটা রঙচটা পানের দোকান থেকে ভেসে আসছে আধা-শুনতে পাওয়া প্রেমের গান—“তুমি যাকে ভালোবাসো, সে কি জানে?”
তিথির মনে হল, আজকের দিনটা শুধু কলেজের প্রথম দিন নয়। এ এক নতুন পরিচয়ের, নতুন অনুভূতির সূচনা। একটা সূর্য উঠছে তার ভিতরে—আলতো, রাঙা, অল্প কাঁপা আলোয়।
শেষে রুদ্র বলল, “কাল আবার দেখা হবে তো?”
তিথি কিছু না বলে মাথা নাড়ল। কিন্তু তার মুখের হাসিই বলে দিচ্ছিল—হ্যাঁ, এই তো শুরু।
দ্বিতীয় পর্ব: বইয়ের ভাঁজে রাখা ভালোবাসা
পরদিন ক্লাসে তিথি একটু আগে পৌঁছে যায়। জানলার পাশে সেই বেঞ্চটাই বেছে নেয়, যেখানে গতকাল রুদ্র বসেছিল। সে জানে না, রুদ্র আসবে কিনা, কিন্তু মনে মনে চায়, হোক দেখা। কাকভোরের মেঘে ঢাকা কলেজ চত্বরে একটা নতুন রঙ মিশেছে—তিথির অপেক্ষা। ঠিক তখনই দরজার পাশে হালকা শব্দ, তিথি তাকিয়ে দেখে—রুদ্র, হাতে একটা খাতা, চোখে সেই চেনা শান্ত হাসি।
রুদ্র এসে বসতেই বলল, “আজকে একটু দেরি হয়ে গেল, মা আজ ভেতো খিচুড়ি করেছিল, না খেয়ে আসা যেত না।” তিথি হেসে ফেলল, “খিচুড়ি শুনলেই আমারও মন খারাপ হয়, হাওড়ায় থাকতেও এমন আবহাওয়ায় মা খিচুড়ি করত।” রুদ্র বলল, “তাহলে একদম ঠিক হয়েছে, আগামী বার আমি বানিয়ে নিয়ে আসব, তুমিও খাবে।” তিথির গাল লাল হয়ে ওঠে। হঠাৎ যেন খুব চেনা হয়ে উঠছে রুদ্র—যেন বহু বছর আগে কোথাও দেখা হয়েছিল।
ক্লাস শুরু হলেও মন ছিল না কারো। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, কুন্তক, নব্য কাব্যতত্ত্ব—সব মিলেমিশে এক আলগা শব্দে ভেসে যাচ্ছিল মাথার ওপর দিয়ে। ক্লাসের ফাঁকে তিথি তার খাতায় ছোট করে কিছু লিখে রাখছিল—হয়তো চারলাইন কবিতা, নয়তো কিছু না বলা কথা। হঠাৎ সে খেয়াল করল, পাশ থেকে রুদ্র তার খাতা দেখতে চাচ্ছে। তিথি একটু থেমে ওর দিকে এগিয়ে দিল পাতাটা।
রুদ্র পড়ল, তারপর একটু নিচু গলায় বলল, “তুমি জানো, তোমার লেখায় গন্ধ আছে। ঠিক যেন ভিজে মাটির গন্ধ, পড়তেই মন চায়।”
তিথি কিছু বলল না, শুধু চোখ নামিয়ে আনল। ভেতরে কোথাও যেন পাখা মেলছে এক অজানা অনুভূতি।
রুদ্র তার খাতা খুলে তিথির সামনে রাখল। ভাঁজ করা একপাতা কাগজ, যেখানে একটি কবিতা লেখা—
“তোমার চোখে আমি যে গল্প দেখি
তা বইয়ে লেখা নেই,
যে পথ তুমি হেঁটে চুপিচুপি যাও
সে পথ আমি হই।”
তিথি এক মুহূর্তে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। এই কবিতা কি রুদ্র ওর জন্য লিখেছে? মুখ তুলে চাইতেই রুদ্র বলল, “এই কবিতাটা অনেকদিন আগে লিখেছিলাম, কিন্তু কেন জানি আজ তোমাকে না পড়িয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না।”
তিথির বুক কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে কিছু বলে না, শুধু সেই পাতাটা আলতো করে নিজের খাতার মাঝখানে রেখে দেয়। যেন সেই মুহূর্তেই একটা ‘প্রথম চিঠি’ লেখা হয়ে গেল।
দিনের শেষে কলেজ ছুটির ঘণ্টা বাজে। কিন্তু আজকে তারা ক্যানটিনে যায় না। রুদ্র বলে, “চলো একটু পেছনের গাছটার নিচে বসি। ভিড় নেই, গল্প করতে ভালো লাগবে।”
তিথি ধীরে ধীরে হাঁটে, পাশে রুদ্র। পেছনের আমগাছটার নিচে ছায়া পড়েছে, একটু ঠান্ডা বাতাস বইছে। রুদ্র বলে, “তোমার মত করে কেউ কথা বলে না, তিথি। তুমি কথা বলো শব্দের বাইরে। কবে থেকে অপেক্ষা করছিলাম এমন একটা মানুষের জন্য, জানো?”
তিথি কিছু বলে না, শুধু বাতাসে হাত ছুঁইয়ে দেয়, যেন ওর মধ্যে ওর নিজের কথা খুঁজে পায়।
হঠাৎ একটা শুকনো পাতা এসে তিথির চুলে আটকে যায়। রুদ্র আলতো করে সেটা সরিয়ে দেয়। তিথির গা কাঁপে। প্রথম স্পর্শ, প্রথম অনুভব। তার মনে হয়, সে কোনও স্বপ্নে হাঁটছে, যেটা কবিতার চেয়েও নরম।
ফিরে যাওয়ার সময় রুদ্র বলে, “তোমার খাতার ভাঁজে একটা পাতার জায়গা চিরদিন থাকবে কি?”
তিথি মুখ তুলে হেসে বলে, “থাকবে, যদি তুমি লেখো।”
রুদ্র হাসে না, শুধু চোখে একটুকরো অচেনা আলো নিয়ে চুপ করে থাকে।
সেদিন বাড়ি ফিরে তিথি খাতাটা বের করে, রুদ্রের কবিতার পাতাটা ছুঁয়ে দেখে, তারপর পেছনের পৃষ্ঠায় লেখে—
“তোমার জন্য একটা ভাঁজ রাখলাম, যেখানে ভালোবাসা থামে, একটুখানি…”
তৃতীয় পর্ব: বৃষ্টিভেজা প্রথম হাত ধরা
সকালের আকাশটা ছিল অদ্ভুত। সূর্য যেন ক্লাসে ঢোকার আগে আলসেমি করছিল, আর বাতাসে ঘোরাফেরা করছিল একরকম কুয়াশাভেজা ঘ্রাণ। তিথি জানত, আজ বৃষ্টি আসবেই। কিন্তু সে জানত না, সেই বৃষ্টি তার জীবনের পাতায় একটা অক্ষর এঁকে দিয়ে যাবে।
কলেজে ঢুকতেই রুদ্র বলে, “আজকে ক্লাসের পর কোথাও চলো না?”
তিথি বলে, “কোথায়?”
রুদ্র হাসে, “শুধু হাঁটব। কোথাও না, অথচ কোথাও।”
তিথি মাথা নেড়ে রাজি হয়। তার চোখে মুখে হালকা জিজ্ঞাসা, আবার একটা না বলা প্রত্যাশা।
ক্লাস শেষ হতেই আকাশ কালো হয়ে আসে। তারা দুজনে হাঁটতে থাকে কলেজের পাশের সরু রাস্তা ধরে, যেখানে ফুটপাথ নেই, কিন্তু দুপাশে বড় গাছ, আর গন্ধ—ভিজে মাটির, কচি পাতার, আর বৃষ্টির আসার আগে যে ঘ্রাণ বাতাসে ঘুরে বেড়ায়, তার। হঠাৎ হালকা বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। তিথি বলল, “আমার তো ছাতা নেই।”
রুদ্র হেসে বলে, “তাহলে আজ ভিজে যাই একসাথে।”
তিথির বুক কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে কিছু বলে না। তারা ধীরে ধীরে হাঁটে, রুদ্র মাঝে মাঝে পাতার ফাঁক থেকে বৃষ্টির ফোঁটা সরিয়ে দেয় তিথির গাল থেকে। সেই মুহূর্তগুলো যেন কোনও সিনেমার দৃশ্য।
তিথি ভাবে, এই অনুভূতি সে আগে কখনও পায়নি। স্কুলে কারো প্রতি একটু ঝোঁক হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আজকের এই হাঁটা, এই নীরবতা, এই বৃষ্টিভেজা বিকেল—সব মিলিয়ে একটা একান্ত গল্প হয়ে যাচ্ছে। এমন গল্প, যা হয়তো কারো কাছে ছোট, কিন্তু যার প্রতিটা শব্দ তিথির কাছে মূল্যবান।
বৃষ্টি একটু বাড়তেই, রুদ্র হঠাৎ থেমে যায়। বলে, “চলো ওই ছাতিম গাছটার নিচে দাঁড়াই।”
গাছের পাতায় ফোঁটা পড়ছে, কিন্তু নিচে একটু শুকনো। রুদ্র তিথির দিকে তাকিয়ে বলে, “জানো, আমার জীবনে খুব বেশি কিছু ঘটেনি। কিন্তু তুমি আসার পর সবকিছু একটু একটু করে রঙিন হতে শুরু করেছে।”
তিথি কিছু বলছে না, শুধু নিচে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ একটা ফোঁটা ঝরে পড়ে তিথির কপালে। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
ঠিক তখনই রুদ্র আলতো করে তিথির হাত ধরে ফেলে।
তিথি চমকে ওঠে না। কোনও রকম জড়তা ছাড়াই তার হাত রুদ্রের হাতের মধ্যে জায়গা খুঁজে নেয়। তারা কিছু বলে না। শুধু হাত ধরা থাকে।
বৃষ্টির শব্দ, গাছের পাতার ফাঁক গলে আলো, আর সেই নীরবতার মধ্যেই যেন একটা কবিতা জন্ম নেয়।
তারপর রুদ্র বলে, “তুমি জানো, এই মুহূর্তটা আমি চিরকাল মনে রাখব।”
তিথি বলে, “আমি চাই না এই মুহূর্তটা কখনও ফুরিয়ে যাক।”
রুদ্র হেসে বলে, “তাহলে লিখে রাখো খাতার পাতায়। যেমন আমি রেখেছিলাম কবিতা। এবার তোমার পালা।”
বৃষ্টি থেমে গেলে, তারা আবার হাঁটা শুরু করে। রাস্তায় কিছু জলকাদার ধারা বয়ে যাচ্ছে, ফুটপাথে ছোট বাচ্চারা কাগজের নৌকা ভাসাচ্ছে। রুদ্র আর তিথি সেই দৃশ্য দেখে হেসে ওঠে, যেন নিজেরাই সেই নৌকার মতো, অল্প ভেসে যাওয়া, অল্প দুলে ওঠা, কিন্তু দু’জনে একসাথে।
হোস্টেলের গেটে পৌঁছে তিথি বলে, “আজ একটা কবিতা জন্মাল জানো?”
রুদ্র বলে, “কী নাম রাখবে?”
তিথি হেসে বলে, “হয়তো, ‘তোমার হাতে আমার আকাশ’।”
রুদ্র চোখে প্রশ্রয় নিয়ে মাথা নাড়ে।
ঘরে ফিরে তিথি নিজের খাতাটা খোলে। প্রথম পাতায় রুদ্রের কবিতা। মাঝের পাতায় তার নিজের ভাঁজ করা উত্তরের কবিতা। আর আজকের পাতায় সে লেখে—
“হাত ধরার মানে শুধু আঙুল জড়িয়ে যাওয়া নয়,
তোমার আকাশে নিজের রোদ গুঁজে দেওয়া।”
চতুর্থ পর্ব: প্রেমের গান, ঈর্ষা আর এক কাঁচা কাঁপুনি
কলেজজুড়ে হইচই পড়ে গেছে। ফেস্ট আসছে—‘রবির আলোয় বসন্ত’। সবাই নাচ, গান, নাটক নিয়ে ব্যস্ত। বাংলা বিভাগের ছেলে-মেয়েরা এবার কবিতা আবৃত্তি আর রবীন্দ্রসংগীতের এক বিশেষ পরিবেশনার দায়িত্ব পেয়েছে। তিথি একটু চুপচাপ, সে জানে না এত ভিড়ে নিজেকে ঠিক কোথায় রাখবে, কিন্তু রুদ্র যেন তাকে ছায়ার মতো নিয়ে চলে।
“তুমি গান গাও না?” হঠাৎ একদিন ক্লাসের পর রুদ্র জিজ্ঞেস করে।
তিথি একটু হেসে বলে, “ভয় পাই… তবে মাঝে মাঝে নিজের মনে গাই।”
রুদ্র বলে, “তাহলে এবার একটু সাহস করো। ফেস্টে একটা গান গাও, আমার জন্য।”
তিথি হেসে চোখ নামিয়ে বলে, “তোমার জন্য?”
রুদ্র মুখে কিছু না বললেও চোখে একটা আলো জ্বলে ওঠে।
রিহার্সাল শুরু হয়। তিথি গান বেছে নেয়—“তুমি রবে নীরবে”। গানটা গাইবার সময় তার গলায় একটা কাঁপুনি লেগে থাকে, কিন্তু চোখে রুদ্রের মুখ। সে চায়, এই গানটা শুধু রুদ্র শুনুক, সবাই থাকলেও যেন শুধু একজনের জন্য গাওয়া হয়।
কিন্তু ফেস্ট যত এগিয়ে আসে, তিথির মনে এক অজানা অস্বস্তি জমতে থাকে। রুদ্র এখন অনেকের সঙ্গে ব্যস্ত, বিশেষ করে নাটকের দলের মেয়েটা—দিয়া। পাতলা ফ্রেমের চশমা, খোলা চুল, আর সহজস্বভাবী দীয়া যেন হঠাৎ করেই রুদ্রের চারপাশে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। তারা একসঙ্গে স্ক্রিপ্ট রিহার্স করত, হাসত, কখনও মাঝে মাঝে কলেজ ক্যান্টিনে চুপিচুপি বসত।
তিথি বাইরে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে একটা নতুন অনুভব পেকে উঠতে থাকে—ঈর্ষা। সে জানে না, এই প্রথমবার তার মন কেন এমন করে পুড়ছে, অথচ চোখে জল আসে না। রুদ্র তার সঙ্গে আগের মতোই কথা বলে, হাসে, গান শুনতে চায়। কিন্তু তিথির বুকের ভিতর একটা চাপা গুমোট ভাব—যেন কিছু একটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
একদিন রিহার্সাল শেষে রুদ্র তিথিকে বলে, “দিয়া তো দারুণ অভিনেতা, না?”
তিথি মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, অনেক ভালো।”
কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে হাসি আসে না। রুদ্র বলে, “তুমি ঠিক আছো তো?”
তিথি উত্তর দেয় না, শুধু বলে, “আজ আর থাকছি না, একটু মাথা ধরেছে।”
রুদ্র কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।
রাতে, তিথি তার খাতার একটা ফাঁকা পাতায় লেখে—
“ভালোবাসা যখন শুধু আমার ছিল, তখন নিঃশব্দ ছিল।
এখন যদি অন্য কারো চোখে আলো পড়ে, আমি নিঃশব্দেই ছায়া হয়ে যাই।”
ফেস্টের আগের দিন রুদ্র তিথিকে একটা ছোট্ট খাম দেয়। বলে, “কালকের জন্য।”
তিথি খামটা হাতে নিয়ে চুপ করে যায়। রাতে ঘরে ফিরে খামটা খুলে দেখে, ভিতরে একটা চিরকুট—
“তুমি যখন গান গাও, আমি কাঁপতে থাকি।
তোমার কণ্ঠে আমার বুকের গল্প শুনি।
কাল তুমি শুধু গান গাইবে,
আমার মনটাকে জয় করার জন্য।”
তিথির চোখ ছলছল করে ওঠে। সে বোঝে, ভালোবাসার ভাষা একেক সময়ে একেকভাবে প্রকাশ পায়। রুদ্র হয়তো সবার সঙ্গে থাকে, কথা বলে, কিন্তু তার ভালোবাসার ঠিকানা তিথির মধ্যেই খুঁজে পায়।
তিথি খাতার এক কোণে লেখে—
“ভালোবাসা কেবল নিজের করে রাখার নাম নয়,
ভালোবাসা বিশ্বাস করার সাহস,
যে তুমি ফিরে আসবেই,
যদি সত্যি ভালোবাসো।”
পঞ্চম পর্ব: থেমে যাওয়া সুর, একজোড়া হাত আর ভালোবাসার উঠে দাঁড়ানো
ফেস্টের দিন সকাল থেকেই কলেজজুড়ে যেন এক রঙিন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। গেটের বাইরে ফেস্টের বড় ব্যানার, ক্যাম্পাস জুড়ে আলোর মালা, আর মঞ্চের সামনে সাজানো চেয়ারগুলো যেন অপেক্ষা করছে একটার পর একটা গল্পের জন্ম নেওয়ার জন্য। তিথি আজ একটু অন্যরকম—লাল কাজ করা কুর্তির ওপর সাদা ওড়না, চোখে হালকা কাজল, আর ঠোঁটে একটুকরো সংকোচ। সে জানে আজকের দিন তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ—কেবল একটা গান গাইবে বলে নয়, সে জানে আজ সে নিজেকে প্রমাণ করবে, নিজের অনুভূতিকে গানের সুরে মেলে ধরবে।
ব্যাকস্টেজে বসে সে বারবার নিজের কণ্ঠে গানটা গুনগুন করে। “তুমি রবে নীরবে”—গানটা এখন তার হৃদয় হয়ে গেছে। কিন্তু তার বুকের ভেতর একটা আশঙ্কা হেঁটে বেড়াচ্ছে—যদি কণ্ঠ কেঁপে যায়, যদি ভুল হয়ে যায়, যদি সবার সামনে আটকে যায়!
সে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়, ঠিক তখনই পাশে এসে দাঁড়ায় রুদ্র।
সে আস্তে বলে, “তিথি, আজকের দিনটা শুধু তোমার। সবাই শুনবে ঠিকই, কিন্তু আমি তো তোমাকেই শুনতে এসেছি।”
তিথির গলায় ফাঁপা কণ্ঠ, “আমার ভয় করছে।”
রুদ্র এক হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরে ফেলে, “তুমি যেদিন আমায় কবিতা শোনালে, সেদিন আমি জানতাম—তোমার সুরেও আমার জন্য কিছু লেখা আছে। ভয় পেও না। তুমি পারবে।”
তিথির ঠোঁটে একটুকরো হালকা হাসি খেলে যায়।
ডাক আসে। স্টেজের আলো নিভে যায়। সঞ্চালক তিথির নাম বলে। সবাই করতালি দেয়। তিথি মঞ্চে ওঠে। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে যখন প্রথম চোখ বুলিয়ে নেয় দর্শকসারির ওপর, তখন তার বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। কত মুখ! কত চোখ! কিন্তু সে খোঁজে শুধু একজোড়া চোখ—রুদ্র।
তাকে দেখতে পায়, সামনের সারিতে বসে। চোখে একরাশ শান্তি আর উৎসাহ।
তিথি গলা খোলে—“তুমি রবে নীরবে…”
কিন্তু প্রথম লাইনেই গলাটা কেঁপে যায়। কান যেন গুঞ্জন করে ওঠে। সে থেমে যায়। একটা মুহূর্ত—সমস্ত দর্শক চুপ। তিথির হাত কাঁপে, গলা শুকিয়ে আসে। মঞ্চের আলো মাথার ওপর, ঘাম কপালে জমে ওঠে। সে বোঝে, আরেকটু হলেই সে দৌড়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাবে।
ঠিক তখন, সামনের সারি থেকে রুদ্র উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে নিশ্চিন্ত ভরসা। সে ঠোঁটে কেবল বলে—“শোনাও। আমি আছি।”
তিথি আবার চোখ বন্ধ করে। মনে পড়ে, প্রথম বৃষ্টির দিন, প্রথম হাত ধরা, কবিতার পাতায় লেখা ভালোবাসা। হঠাৎ তার গলায় কাঁপুনি কমে যায়, সুরে ফিরে আসে ছন্দ।
সে গায়—
“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম…”
এবার গলা থামে না, শুধু সুরে ভেসে যায় এক একটা অনুভব, এক একটা চেনা বিকেল, রুদ্রের চাওয়া, দৃষ্টির কাঁপুনি, আর তার নিজের না বলা শব্দগুলো।
পুরো কলেজ মুগ্ধ হয়ে শুনে। গান শেষ হতেই করতালিতে ফেটে পড়ে সভা। তিথির চোখ ভিজে যায়, কিন্তু সে হাসে—খাঁটি, নিঃশব্দ, তৃপ্ত এক হাসি।
স্টেজ থেকে নামার সময় রুদ্র এসে দাঁড়ায় সামনে। কোনো কথা বলে না, শুধু হাতটা এগিয়ে ধরে।
তিথি এক মুহূর্ত চুপ থেকে ওর হাতে নিজের হাতটা রাখে।
আলোর ভেতর, সবার সামনে, আজ তিথি একেবারে নিজের হয়ে ওঠে।
ভালোবাসা আর গান—দুটো আলাদা নয়, একই খাতার পাতায় লেখা হয়ে যায়।
ষষ্ঠ পর্ব: লাস্ট বেঞ্চ, শীতের সকাল আর একটা সাহসী ‘ভালোবাসি‘
শীত পড়েছে শহরে। ভোরের কুয়াশা যেন কলেজ চত্বরে এক নিঃশব্দ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ার অনেক আগে তিথি এসে বসে পড়েছে তাদের নির্দিষ্ট লাস্ট বেঞ্চে। জানলার পাশে সেই পুরনো জায়গাটা—যেখান থেকে গাছের পাতার ফাঁক গলে রোদ এসে পড়ে খাতার পাতায়। তার গায়ে নীল সোয়েটার, গলায় উলের মাফলার, আর বুকের মধ্যে একরাশ নতুন কিছু বলার তাড়া।
রুদ্র একটু দেরি করে আসে, কিন্তু চুপ করে পাশে বসে। একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, “তুমি এত সকালে?”
তিথি হেসে বলে, “তুমি না এলে আজ ক্লাসটাই বাদ পড়ত।”
রুদ্র হেসে চোখ সরিয়ে জানলার বাইরে তাকায়। তারপর বলে, “তোমার গানটা সেদিন আমার মনটা একেবারে থামিয়ে দিয়েছিল, জানো?”
তিথি মাথা নিচু করে বলে, “ভয় পেয়েছিলাম খুব।”
রুদ্র বলে, “ভয় থাকেই। কিন্তু সাহস শুধু তখনই আসে, যখন পাশে কেউ থাকে। আমি চেয়েছিলাম তোমার সাহস হতে।”
তিথি আজ অনেকদিন ধরে প্রস্তুত—তার খাতার এক কোণে একটা পুরনো চিঠির খাম, তার ভিতরে অল্প কিছু শব্দ, কিন্তু অনেক সাহস। সে আস্তে করে ব্যাগ থেকে খামটা বের করে রুদ্রের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
রুদ্র একটু অবাক হয়, বলে, “এটা কী?”
তিথি বলে, “তোমার জন্য। এখন না পড়লেও চলবে, বাড়ি গিয়ে পড়ো।”
রুদ্র খামটা হাতে নিয়ে একটু থেমে থাকে, তারপর পকেটে রেখে দেয়।
ক্লাসে পড়া শুরু হলেও তিথির মন পড়ে আছে রুদ্রের পাশে রাখা খামে। প্রথমবার সে এত স্পষ্ট করে লিখেছে—”ভালোবাসি”। না কবিতার ছায়ায়, না ইঙ্গিতের আড়ালে। শুধু সরাসরি, সোজাসাপটা, সাহসিক এক স্বীকারোক্তি।
সেদিন দুপুরে রুদ্র আর কোনো কথা না বলে কলেজ থেকে বেরিয়ে যায়। তিথির বুকটা একটু ধক করে ওঠে। তবে সে জানে, অপেক্ষা করতে হয়। ভালোবাসার কথাগুলো পৌঁছতে সময় লাগে।
রাত ন’টার সময় ফোনে একটা মেসেজ আসে—
“তুমি জানো, আমি পড়েছি। পড়ে চুপ করে গিয়েছিলাম। এত সহজ করে কেউ কোনওদিন আমায় ‘ভালোবাসি’ বলেনি।”
তারপর আরেকটা মেসেজ—
“তিথি, আমিও তোমায় ভালোবাসি। প্রথমদিন থেকে, জানলার পাশে বসে, যখন তুমি শুধু চোখ ঘুরিয়ে চেয়েছিলে আমার দিকে।”
তিথির চোখ বেয়ে নেমে আসে একটা শান্ত অশ্রু। সে খাতার পাতায় লিখে রাখে—
“ভালোবাসা মানে শুধু বলে ফেলা নয়,
ভালোবাসা মানে সাহস,
ভালোবাসা মানে—তুমি পড়েছ, বুঝেছ,
আর আমি অপেক্ষা করেছি।”
সপ্তম পর্ব: হাত ধরে হেঁটে যাওয়া, একটা অভিমানের চিঠি, আর ফেলে আসা সন্ধে
শীতের ছুটির পর কলেজে যখন সবাই ফিরছে, তখন যেন একটা নতুন ঢেউ এসেছে তাদের মধ্যে। এখন তারা শুধু সহপাঠী নয়, এখন তারা ‘তিথি আর রুদ্র’—কলেজের সকলের জানা একজোড়া নাম। লোকে চুপিচুপি বলে, “ওদের প্রেমটা যেন কবিতার মতন”—আর তিথির মুখে তখন একটুকরো স্নিগ্ধ লাজ।
সেই বিকেলটা ছিল একেবারে অন্যরকম। ক্লাস শেষে রুদ্র বলল, “চলো আজ একটু হাঁটি, পুরো কলেজটা ঘুরে দেখি।” তিথি হেসে বলল, “তুমি তো কলেজেই বড় হওয়া ছেলে, তুমি আবার ঘুরবে?”
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আজ ঘুরব তোমার চোখ দিয়ে।”
তারা ধীরে ধীরে লাইব্রেরির পেছনের পথ দিয়ে হাঁটছিল। রুদ্র মাঝে মাঝে পাতা কুড়িয়ে তিথিকে দিত, বলত, “এই পাতায় তোমার চুলের গন্ধ আছে।” তিথি হেসে বলত, “এগুলো রাখবে?”
রুদ্র বলত, “তুমি দিলে সবই রাখি।”
একটা বাঁধানো বেঞ্চে বসে রুদ্র ব্যাগ থেকে বের করল ছোট্ট একটা খাম। তিথি অবাক, “এটা কী?”
রুদ্র হেসে বলল, “তোমার জন্য একটা হ্যান্ডমেড কবিতার বই। সাতটা কবিতা, সাতটা দিন, সাতটা কথা—সব তোমার নামে।”
তিথি চুপ করে বইটা ধরে রাখল বুকে। এই ছেলেটা তার জন্য এত ভাবনা রাখে, এত শব্দ রচনা করে—সে বিশ্বাস করতে পারে না।
কিন্তু সেই সন্ধে নামার আগেই হালকা মেঘ জমে উঠল। ক্যানটিনে বসে তারা যখন গল্প করছিল, তখন দিয়া এসে জিজ্ঞেস করল, “রুদ্র, কালকে তো আমার রিহার্সাল, ভুলে যেও না।”
তিথি চুপ করে রইল, রুদ্র একটু অস্বস্তিতে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে।”
তিথি তখন বলল, “তুমি তো এখন অনেক ব্যস্ত, আমি বরং বেরোই।”
রুদ্র টের পেয়েও কিছু বলেনি, শুধু বলল, “বুঝতেই পারছো তো…”
তিথি মাথা নাড়ল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল কিছু।
রাতে রুদ্র বারবার কল করেও ধরতে পারল না। তিথি কোনও উত্তর দিল না। সে তার খাতার এক কোণে লিখল—
“ভালোবাসা যখন ভাগ চায়,
আমি চুপ করে দূরে সরে যাই।
তোমার শব্দে আমি ছিলাম,
এখন তোমার নীরবতায় জেগে আছি।”
পরদিন সকালে তিথি কলেজে এল না। রুদ্র বুঝতে পারল কিছু হয়েছে। দুপুরে সে একটা চিঠি রেখে গেল হোস্টেলের দারোয়ানের কাছে। চিঠিতে লেখা ছিল—
“তিথি, আমি সব বুঝি। তুমি রাগ করেছো, হয়তো ঠিকই করেছো। কিন্তু দিয়া শুধু একজন বন্ধু। ভালোবাসা তুমি, শুধুই তুমি। আমি যদি সবসময় সবটা প্রকাশ করতে না পারি, তাও বিশ্বাস কোরো—আমার প্রতিটা অনুভবে তুমিই আছো।
রুদ্র।”
সেই চিঠিটা পড়ে তিথির চোখ ভিজে গেল। সে জানে, অভিমান ভালোবাসারই আরেক রং। সে ধীরে ধীরে ফিরে এল সেই লাস্ট বেঞ্চে। পরদিন সকালে ক্লাসে ঢুকে দেখে, রুদ্র পেছনের সারিতে একা বসে আছে, চোখে ক্লান্তি আর অপেক্ষা।
তিথি কিছু না বলে পাশে বসে, ওর হাতের মুঠোয় নিজের হাত রাখে।
রুদ্র তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ফিসফিসিয়ে বলে, “তুমি ফিরেছো?”
তিথি মৃদু হাসে, “ভালোবাসা কোথাও যায় না, শুধু একটু দূরে সরে দাঁড়ায়।”
অষ্টম পর্ব: দূরত্বের হাওয়া, চাকরির স্বপ্ন আর ভালোবাসার নতুন প্রতিশ্রুতি
তৃতীয় বর্ষে পা দিতেই কলেজ যেন একটু বদলে গেল। পুরনো ক্লাসরুম, চেনা বেঞ্চ, পরিচিত চা-কাপ—সবই আছে, কিন্তু কোথাও একটা অদৃশ্য চাপ নেমে এসেছে। চারদিকে চাকরির কোচিং, মাস্টার্সের ফর্ম, রেজাল্ট নিয়ে উৎকণ্ঠা। রুদ্র এখন অনেকটা ব্যস্ত, সকাল থেকে বিকেল একাধিক চাকরির প্রস্তুতি ক্লাস, আবার সন্ধে হলে কোচিং সেন্টার। তিথি একদিন মজা করে বলল, “তোমার কি এখন বইই প্রেমিকা?”
রুদ্র হাসল, কিন্তু চোখে ক্লান্তি। “না রে, কিন্তু এই টেনশনটা তোমায় না বুঝলে হয়তো একদিন আমাদের মাঝেই ফাটল পড়ে যেত।”
তিথি বুঝে, কিন্তু ভিতরে কোথাও খচখচ করে। আগের মতো আর বিকেলের গল্প হয় না, ক্যানটিনে বসে গান গাওয়া হয় না, কবিতার খাতা আজকাল প্রায় বন্ধই থাকে।
তবুও একদিন সে বলে, “তুমি যদি সফল হও, আমি জানি আমাদের গল্পটাও সফল হবে।”
রুদ্র মাথা নিচু করে বলে, “তুমি থাকলে তবেই তো লড়াইটা সহজ হয়।”
কিন্তু সহজ কিছুই হয় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে একটু একটু করে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
রুদ্রের ফোন এখন অনেক সময় নিঃশব্দে থাকে, মেসেজের উত্তর আসে দেরিতে, কথা হয় ছোট ছোট বাক্যে। তিথি ভাবে, এটা কি শুধুই চাপ, না কি ধীরে ধীরে তার উপস্থিতি রুদ্রের জীবনে গৌণ হয়ে যাচ্ছে?
একদিন রুদ্র বলল, “তিথি, আমি একটা বড় কোম্পানির জন্যে ফর্ম ফেলেছি, যদি ওদের অফিসার ট্রেনিং-এর জন্য ডাক পাই, দিল্লি যেতে হবে।”
তিথির গলা শুকিয়ে গেল। সে শুধু বলল, “তুমি যদি যাও, তাহলে?”
রুদ্র একটু চুপ করে বলল, “তুমি থাকলে আমি যেকোনো দূরত্ব মেনে নিতে পারব। তুমি পারবে তো?”
তিথি জানে, উত্তরটা খুব সহজ নয়। প্রেমের শুরুতে তারা ছিল একসাথে ক্লাস, ছায়া, গান, কবিতা। এখন যদি দূরত্ব এসে পড়ে, সবই কি আগের মতো থাকবে?
রাতে সে খাতার পাতায় লেখে—
“ভালোবাসা যদি পরীক্ষায় বসে, আমি চুপ করে বসে থাকব,
কেননা আমি জানি, উত্তরপত্রে তোমার নামটাই আমার সব উত্তর।”
দিন পেরিয়ে যায়। হঠাৎ একদিন রুদ্র জানায়, সে নির্বাচিত হয়েছে। এক মাসের মধ্যে দিল্লি যেতে হবে।
তিথি প্রথমে কথা বলতে পারে না। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই প্রথম ক্লাস, জানলার ধারে বসা দুজন, প্রথম ছোঁয়া, সেই বৃষ্টির বিকেল, মঞ্চে থেমে যাওয়া সুর—সব যেন বাতাসে ভেসে যায়।
বিদায়ের দিন রুদ্র তিথিকে নিয়ে যায় কলেজের লাইব্রেরির পেছনের সেই ছায়াঘেরা জায়গায়। বলে, “তুমি জানো, এই গাছটার নিচেই আমি বুঝেছিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
তিথি বলে, “তুমি দূরে গেলে আমার কবিতা ফাঁকা হয়ে যাবে।”
রুদ্র তার হাতে একটা ছোট খাতা দেয়—তাদের ‘প্রথম ভালোবাসার নোটবুক’।
বলে, “এই খাতায় তুমি লিখে যাবে তোমার দিনগুলো, আর আমি ফিরেই পড়ে নেব। এটা হবে আমাদের গল্পের সেতু।”
তিথি খাতাটা বুকে রাখে, আর বলে, “তুমি শুধু যাও না, ফিরে এসো।
ভালোবাসা দূরে গেলে কাঁদে ঠিকই, কিন্তু সত্যি হলে অপেক্ষা করে।”
নবম পর্ব: দূরত্ব, চিঠি আর ভালোবাসার পরীক্ষার মুখোমুখি
রুদ্র চলে গেছে দিল্লি। স্টেশনের শেষ বাঁকে দাঁড়িয়ে তিথি তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ, যতক্ষণ না ট্রেনটা হাই তুলে অদৃশ্য হয়ে যায়। শহরটা যেন একটু কেঁদে উঠেছিল সেদিন, হাওয়ার গায়ে ছিল একটুকরো না বলা বিদায়। তিথি কলেজে ফিরে এল, প্রতিদিন ক্লাস করে, সেই পুরনো লাস্ট বেঞ্চে বসে, কিন্তু পাশে আর কেউ নেই। শুধু একটা খাতা—‘প্রথম ভালোবাসার নোটবুক’।
প্রথমদিকে সব ঠিক ছিল। রুদ্র প্রতিদিন ফোন করত, রাত বারোটার সময় “ঘুমিয়ে পড়েছো?” লিখে মেসেজ দিত, সকালে “শুভ সকাল, পাখিটা আজও ডাকছে তোমার জন্য” বলে গলা ভাঙা গানে কল করত। তিথি সেই কথাগুলোর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করত, আর খাতায় লিখে রাখত—
“তুমি দূরে, কিন্তু প্রতিটা শব্দে আমি তোমায় ছুঁয়ে থাকি।”
হঠাৎ একটা সময় থেকে ফোন কমে গেল। কল ব্যাক আসতে দেরি হতে লাগল, মেসেজে ‘seen’ লেখা থাকলেও উত্তর এল না। তিথির মনটা খচখচ করতে লাগল। নিজেকে বোঝাত, “ও ব্যস্ত… নতুন শহর… নতুন জীবন…” কিন্তু মন কি আর সবসময় যুক্তির কথা শোনে?
একদিন গভীর রাতে হোস্টেলের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে তিথি হঠাৎ একটা ছবি দেখল—রুদ্র, আর তার পাশে এক মেয়ে, হাসিমুখে। ক্যাপশনে লেখা—“Delhi winters and coffee with the right company.”
তিথির চোখ জ্বলে উঠল, বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল।
সে সারা রাত ঘুমোতে পারল না। খাতাটা খুলে বসে, কিন্তু শব্দ আসে না। কেবল একটা লাইন কাঁপতে থাকে—
“আমার কথা কি তোমার শীতের কফির থেকেও হালকা হয়ে গেল?”
পরদিন সকালে ক্লাসে মন দিতে পারল না। ক্যানটিনে বসেও চুপ করে থাকল। রুদ্রের ফোন এল সন্ধের দিকে। তিথি ধরল না। আবার এল—এবার কল ধরে গলা কঠিন করে বলল, “তুমি খুব ব্যস্ত, না?”
রুদ্র একটু থেমে বলল, “তিথি, তুমি কি রাগ করেছো?”
তিথি বলল, “না… শুধু ভাবছিলাম, দেরি হলে কফি ঠান্ডা হয়ে যায়, আর মানুষ?”
রুদ্র বলল, “ও আমার সহকর্মী, তুই জানিস তো—”
তিথি বলে, “সব জানি। শুধু এখন নিজেকে আর বোঝাতে পারি না।”
রুদ্র একটু কাঁপা গলায় বলল, “তুই বিশ্বাস করিস না আর?”
তিথি ফিসফিস করে বলল, “বিশ্বাস করতে চাই… কিন্তু বিশ্বাসও তো যত্ন চায়, ঠিক আমার মত।”
সেদিন রাতে রুদ্র একটা লম্বা মেসেজ পাঠাল—
“তিথি, আমি ভুল করিনি, শুধু বোকা হয়েছি। তোমায় না জানিয়ে কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া, সেটা যতই নির্দোষ হোক, তোমার বিশ্বাসে আঘাত করেছে। আমি দূরে আছি ঠিক, কিন্তু আমার মন এখনও তোর খাতার পাতায় আটকে আছে।”
তিথি সেই মেসেজটা পড়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে। চোখে জল আসে না, কেবল একটা ভার বুকের ওপর চেপে থাকে। তারপর খাতার পেছনের পাতায় সে লেখে—
“ভালোবাসা একটা শহর, যেটা দূরে থেকেও চেনা থাকে। কিন্তু সেই শহরে যদি রাস্তা হারিয়ে ফেল, তখন বিশ্বাসই তোমার মানচিত্র।”
পরদিন সকালে সে রুদ্রকে একটা চিঠি পাঠায়—
“আমি আছি, শুধু চাই তুমি থাকো।
আমাদের গল্পটা থেমে গেলে নয়,
থেমে গিয়ে আবার শুরু হলে—
তবেই তো ভালোবাসা সত্যি হয়।”
দশম পর্ব: ছাদের সন্ধ্যা, পুরনো গান আর নতুন করে ভালোবাসার শুরু
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে হঠাৎ একদিন ফোন এল—রুদ্র আসছে কলকাতায়, কেবল তিন দিনের জন্য। সরকারি ট্রেনিংয়ের মাঝে একটি ব্রেক পেয়েছে। খবরটা শোনার পর তিথি অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারেনি। তার বুকের ভেতর যেন ঝড় বয়ে গেল, অথচ মুখে এক ফোঁটা হাওয়া লাগল না। তিনদিন—সেই পুরনো শহর, পুরনো মানুষ, আর একটুখানি নতুন সময়।
সেই সন্ধ্যেটা ছিল ছাদের, যেখানে তাদের কলেজের পুরনো বন্ধুরা একটি ছোট রিইউনিয়ন রেখেছিল। কলেজ ভবনের চতুর্থ তলার ছাদে ল fairy light ঝুলছে, একটা স্পিকার থেকে বাজছে পুরনো গান—“তুমি কে, আমি কে, বাঁধন ছিঁড়ে দেখা দেয় কেউ…” তিথি একটু দেরি করেই এল। ছাদের কোণার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল রুদ্র, হালকা দাড়ি, চোখে ক্লান্তি আর আশার ছায়া।
তিথি যখন চোখে চোখ রাখল, তখন আর কোনো কথার দরকার পড়ল না। একটা দীর্ঘ চাহনি যেন সব অভিযোগ, অভিমান মুছে দিল। তবুও রুদ্র ধীরে ধীরে কাছে এসে বলল, “তুই আসবি ভেবেছিলাম না।”
তিথি মুচকি হেসে বলল, “তুই এলি ভেবেছিলাম না।”
দুজনেই হাসল—একটা পুরনো অভিমান যেন গলে গেল।
তারা দু’জনে এক কোণে বসে। মাঝে মাঝে চেনা মুখরা এসে গল্প করছে, হাসছে, ছবি তুলছে। তবু তিথি আর রুদ্র যেন এক অন্য জগতে—যেখানে শুধু হাওয়া, স্মৃতি আর না বলা ভালোবাসা।
রুদ্র বলল, “তুই জানিস, আমি তোর পাঠানো চিঠিটা আমার ট্রেনিং ফাইলের মধ্যে রেখে দিয়েছি। যখনই কষ্ট হয়, সেই লাইনগুলো পড়ি।”
তিথি একটু নিচু গলায় বলে, “আমি আর খাতা লিখিনি, অপেক্ষা করে রেখেছিলাম তোকে ফিরে আসার জন্য।”
রুদ্র আস্তে হাত বাড়ায়, তিথির আঙুলে ছুঁয়ে যায়।
“আমি ফিরেছি, তোর জন্যই। যদি তুই না বলতিস ‘থেমে গিয়ে আবার শুরু হলে ভালোবাসা সত্যি হয়’—আমি হয়তো হারিয়েই যেতাম।”
বাতাসে হালকা ঠান্ডা, ছাদের ওপরে পূর্ণিমার আলো। রুদ্র বলল, “তুই এখনও গাস না?”
তিথি হাসল, “মাঝে মাঝে গুনগুন করি, তোকে না শুনিয়ে।”
রুদ্র বলল, “তাহলে আজ গা, শুধু আমার জন্য।”
তিথি একটু ইতস্তত করে, তারপর চোখ বন্ধ করে ধীরে গাইতে শুরু করল—
“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম…”
রুদ্র চুপ করে শুনছিল, সেই প্রথম মঞ্চের সন্ধ্যার মতই।
তারা দু’জন আজ আর কলেজে নেই, কিন্তু ভালোবাসার সেই প্রথম সুরটা যেন এখনও বাজছে, স্পষ্ট, কোমল আর স্থির।
গান শেষে তিথি বলল, “জানিস, আমি ভয় পেতাম—দূরত্ব আমাদের গিলে ফেলবে।”
রুদ্র বলল, “ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তাহলে সে কোনও দূরত্বে মরে না। সে শুধু অপেক্ষা করে… একদিন ছাদের সন্ধ্যায় আবার গানের ছায়ায় ফিরে আসার জন্য।”
তারা দু’জনে তখন একসঙ্গে দাঁড়ায়, ছাদে হাওয়া বইছে, শহরের আলো দূরে মিটিমিটি জ্বলছে, আর তাদের মধ্যে গোপনে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন প্রতিশ্রুতি—
এইবার আর দূরত্ব নয়,
এইবার থেকে—একসঙ্গে, সবটা।
একাদশ পর্ব: শেষ পাতার শুরু
বছর গড়িয়ে গেছে। কলেজের গেট এখন পুরনো হয়ে এসেছে, ক্যানটিনে নতুন টেবিল, আর সেই লাস্ট বেঞ্চে অন্য কেউ বসে আজকাল। তিথি এখন স্কুলে বাংলা পড়ায়, আর রুদ্র এক বহুজাতিক কোম্পানির প্রজেক্ট ম্যানেজার। শহর বদলেছে, সময় বদলেছে, জীবন অনেকটাই অন্যরকম। কিন্তু যেটা বদলায়নি, সেটা সেই খাতা—প্রথম ভালোবাসার নোটবুক।
প্রতিটা পাতায় এখনও শব্দ গাঁথা আছে, মুছে যাওয়া কফির দাগ, ফুল শুকিয়ে হলুদ হয়ে যাওয়া, মাঝেমাঝে পেন্সিল দিয়ে লেখা একটা প্রশ্ন—“আজও কি আমায় ভালোবাসো?” আর ঠিক তার নিচেই রুদ্রের হস্তাক্ষরে উত্তর—“প্রতিদিন, একটু করে বেশি।”
রুদ্র এখন আবার কলকাতায়, অনেক লড়াইয়ের পর ট্রান্সফার হয়েছে। সন্ধে নামলে তারা একসাথে হাঁটে শহরের পুরনো গলি ধরে—যেখানে একদিন গল্প হত, স্বপ্ন বাঁধা হত, আর যেখানে এক সময় দুঃখ গোপন করে বসে থাকত তিথি, জানত না রুদ্র ফিরবে কিনা।
একদিন তারা কলেজে গেল—পুরনো বেঞ্চে, পুরনো ছায়ায় দাঁড়িয়ে তিথি বলল, “তোর মনে আছে, আমি প্রথম চিঠি দিই সেই দিন?”
রুদ্র বলল, “চিঠিটা এখনও আমার জ্যাকেটের ভিতরের পকেটে। তোর লেখা ‘ভালোবাসি’—আমার পৃথিবীর মানচিত্র।”
সেদিন বিকেলে ছাদে বসে চা খেতে খেতে রুদ্র খাতাটার পেছনের খালি পাতায় একটা নতুন কবিতা লেখে—
“ভালোবাসা শুরু হয় ক্লাসরুমে,
থাকে ফেস্টের মঞ্চে,
হাঁটে কফির কাপে, ঝগড়ার ফাঁকে,
আর একদিন এসে থামে
একটা খাতার শেষ পাতায়,
যেখানে শেষ মানে শেষ নয়,
শুরু। আবার।”
তিথি তাকিয়ে থাকে পাতাটার দিকে, তারপর বলল, “তাহলে? খাতার পর কি হবে?”
রুদ্র হেসে বলল, “নতুন খাতা, নতুন গল্প, কিন্তু লেখক দুজনেই থাকবে—তুই আর আমি।”
সেদিন সন্ধেবেলায় হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, ঠিক সেই প্রথম বৃষ্টির মত। তিথি আর রুদ্র হাতে হাত ধরে হাঁটছিল, কাঁপা আলোয় ভিজছিল শহর।
তিথির মুখে ছিল নিঃশব্দ হাসি।
রুদ্রের চোখে ছিল সেই একই স্পষ্ট ভালোবাসা।
আর খাতার সেই শেষ পাতায় লেখা রইল—
“আমাদের গল্প শেষ নয়। শুধু নতুনভাবে শুরু।”
শেষ।




