অনির্বাণ দাস
অধ্যায় ১: অপরিচয়ের শুরু
প্রথম দেখা ছিল হঠাৎ, একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায়। কলেজের প্রথম দিন, সকালবেলার আকাশে হালকা মেঘ আর বাতাসে অদ্ভুত একটা শীতলতা ছিল। নতুন পরিবেশে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হচ্ছিল, সবকিছুই অচেনা, সবকিছুই কেমন যেন কৌতূহলের আড়ালে ঢাকা। অনেকগুলো নতুন মুখ, কারও চোখে আত্মবিশ্বাস, কারও চোখে অচেনা ভয়ের ছায়া। ঠিক সেখানেই সে চোখে পড়ল—একটি পরিচিত অথচ অপরিচিত মুখ, যেন ভিড়ের ভেতর থেকে আলাদা হয়ে ওঠা কোনো আলো। মেয়েটির গায়ের রঙে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, চুলে অগোছালো ঢেউ, চোখে গভীর শান্তি। সে ছিল না অতিরিক্ত সাজানো বা চটকদার, বরং একদম সহজ, সরল, অথচ তীব্রভাবে আকর্ষণীয়। ছেলেটির মনে হলো, তার আশেপাশের সমস্ত শব্দ হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে গেছে, কেবল ওই মেয়েটির হাঁটার শব্দ, তার হালকা হাসি, তার চোখের নির্ভেজাল স্বচ্ছতা যেন কানে বাজছে। প্রথমবারেই তার মনে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগল, যা আগে কোনোদিন অনুভব করেনি। বুকের ভেতর কেমন যেন ঢেউ উঠল, নিজের অজান্তেই দৃষ্টি বারবার সেই মেয়েটির দিকে চলে যাচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল—এই ভিড়ভাট্টার ভেতরেও যেন কেবল তার সঙ্গেই কথা বলতে পারলেই সমস্ত অচেনা ভয় মিলিয়ে যাবে।
ক্লাসের ভেতরেও মেয়েটি বারবার নজরে আসছিল। সে খুব মনোযোগ দিয়ে লেকচার শুনছিল, কলম দিয়ে খাতায় অক্ষরে অক্ষরে নোট নিচ্ছিল, আর মাঝেমধ্যেই বন্ধুর দিকে ফিরে কিছু ফিসফিস করছিল। ছেলেটি সবকিছুই লক্ষ্য করছিল, অথচ নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছিল যাতে অন্যরা বুঝতে না পারে। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল—একদিকে ভয়, যদি কথা বলতে যায় তবে মেয়েটি বিরক্ত হয়, অন্যদিকে আকাঙ্ক্ষা, অন্তত একবার চোখে চোখ রেখে হাসতে পারলে হয়তো তার অস্থিরতা কমে যাবে। দিনটা কেটে গেল নানা অচেনা মুখ আর নতুন পাঠ্যসূচির ভেতর দিয়ে, কিন্তু সারাক্ষণই তার মনে হচ্ছিল সেই একটিমাত্র মুখ যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। কলেজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে জানালার পাশে বসে ছেলেটি দেখছিল শহরের ব্যস্ত রাস্তা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বারবারই মেয়েটির হাসি আর চোখের চাহনি তাকে ঘিরে ধরছিল। তার মনে হচ্ছিল, হয়তো এই মেয়েটিই সেই মানুষ যার সঙ্গে প্রথমবারের মতো সে নিজের হৃদয়ের কাঁপন অনুভব করছে। রাত গভীর হলো, খাতার পাতায় অসমাপ্ত লেখাগুলো পড়ে রইল, কিন্তু তার চিন্তায় ভেসে উঠছিল কেবল সেই অচেনা মিষ্টি মুখ, যার জন্য বুকের ভেতর কেমন যেন অদ্ভুত এক নরম উষ্ণতা জমে উঠছে।
পরের দিন সকালেও একই রকম অস্থিরতা নিয়ে সে কলেজে গেল। মনে মনে প্রার্থনা করছিল, আবার যেন মেয়েটিকে দেখতে পায়, হয়তো আজ কথা বলার কোনো সুযোগ মিলবে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার নজরে পড়ল—সে এসেছে, সাদা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরে, চুল খোলা, আর মুখে সেই একই স্বচ্ছ হাসি। ছেলেটির হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, হাত কাঁপতে লাগল, ঠোঁট শুকিয়ে গেল। কতবার ভেবেছে, কীভাবে প্রথম কথা বলবে—“হ্যালো”, “তুমি কেমন আছো?” নাকি একেবারেই অন্য কোনো অজুহাতে? কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই তার মনে হলো, ভাষার সব শব্দ যেন গলা শুকিয়ে কোথাও আটকে গেছে। মেয়েটি পাশ কাটিয়ে চলে গেল, তবে মুহূর্তের জন্য তার চোখে চোখ পড়ল। সেই এক সেকেন্ড যেন এক অনন্ত সময়ের মতো দীর্ঘ হয়ে গেল। মনে হলো, মেয়েটির চোখের গভীরতায় একটা নীরব প্রশ্ন আছে, আবার একটা নীরব উত্তরও আছে। সেদিন আর কোনো কথা হয়নি, তবে ছেলেটি বুঝে গিয়েছিল—তার জীবনে কিছু একটা নতুন শুরু হতে চলেছে। এক অচেনা টান, এক অচেনা ভয়, আর এক অচেনা ভালোলাগা মিলেমিশে তৈরি হলো একদম ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা, যা সে এর আগে কোনোদিনও অনুভব করেনি। সেই দিন থেকেই তার ভেতরে প্রথম ভালোবাসার কৌতূহল আর আবেশ আস্তে আস্তে জন্ম নিতে শুরু করল।
অধ্যায় ২: বন্ধুত্বের অজুহাত
পরের কিছুদিন ধরে ছেলেটির মন একেবারেই পড়াশোনায় বসছিল না। প্রতিদিন সকালে কলেজে যাওয়ার আগেই তার মনে হতো—আজ হয়তো নতুন কিছু ঘটবে, আজ হয়তো সেই মেয়েটির সঙ্গে হঠাৎ করে কথা হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে সে নিজেকে কেবল ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেলত, দূর থেকে তাকিয়ে থাকত, আবার হঠাৎ করে চোখ সরিয়ে নিত, যেন কেউ বুঝতে না পারে। তার ভেতরে তখন চলত এক অদ্ভুত টানাপোড়েন—মনে মনে সে কথা বলার সাহস খুঁজত, অথচ বাস্তবে দাঁড়িয়ে কেবল নীরব হয়ে যেত। একদিন ক্লাসে হঠাৎ করে শিক্ষক একটি গ্রুপ প্রজেক্টের দায়িত্ব দিলেন। ভাগ্য যেন হেসে উঠল—ছেলেটি আর মেয়েটি একই গ্রুপে পড়ে গেল। মুহূর্তেই তার বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হলো। প্রজেক্ট মানে আলোচনা, কাজের পরিকল্পনা, একসঙ্গে সময় কাটানো—যা এতদিন কেবল কল্পনায় দেখত, এখন বাস্তবে ঘটতে চলেছে। প্রথমবার যখন সে মেয়েটির সঙ্গে গ্রুপে বসে কাজ শুরু করল, তখন গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়েটির সরল ভঙ্গি, বন্ধুসুলভ স্বর, আর স্বাভাবিকভাবে হাসিমুখে কথা বলার ভঙ্গি দেখে ছেলেটির অস্থিরতা কিছুটা কমে এলো। মনে হচ্ছিল, হয়তো এই মেয়ে এতটা অচেনা নয়, হয়তো তাকে ধরা যায়, বোঝা যায়।
প্রথম কয়েকদিনের আলোচনার মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগল। মেয়েটি সবসময় খেয়াল রাখত, ছেলেটি যেন কোনো জায়গায় পিছিয়ে না পড়ে, আর ছেলেটি চেষ্টা করত যতটা সম্ভব দায়িত্ব নিয়ে কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট আলাপ জমতে শুরু করল—প্রথমে পড়াশোনা, তারপর শখ-আহ্লাদ, সিনেমা, গান, বই, এমনকি পরিবার নিয়েও। ধীরে ধীরে ছেলেটির মনে হচ্ছিল, তার ভেতরের ভয়গুলো যেন গলে যাচ্ছে, আর জায়গা নিচ্ছে এক ধরনের অদ্ভুত আরাম। যখন মেয়েটি মন দিয়ে তার কথা শুনত, হাসত, বা হালকা প্রশ্ন করত, তখন মনে হতো সে আর ভিড়ের একজন নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ। একদিন প্রজেক্টের কাজ শেষে লাইব্রেরিতে বসে ছিল তারা। মেয়েটি একসময় হেসে বলল, “তুমি আসলে অনেক চুপচাপ, তবে মনোযোগী। এটা ভালো দিক।” কথাটা শুনে ছেলেটির বুক ভরে গেল এক ধরনের আনন্দে, মনে হলো এতদিনের নীরবতা ভেঙে এক ছোট্ট স্বীকৃতি পেল। সেই মুহূর্ত থেকে সে বুঝল, এই অজুহাতেই হয়তো বন্ধুত্বের দরজা খোলা হচ্ছে। বন্ধুত্ব—যা হয়তো পরে আরও গভীর কিছু হয়ে উঠবে।
দিন যেতে যেতে তাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে লাগল। ক্লাস শেষে মাঝে মাঝে তারা একসঙ্গে ক্যাম্পাসের মাঠে হাঁটত, কখনো চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিত, আবার কখনো প্রজেক্টের নাম করে পড়াশোনার বাইরে নানা গল্পে মেতে উঠত। একদিন মেয়েটি বলল, “তুমি জানো, প্রথম দিন তোমাকে দেখে মনে হয়েছিল খুব গম্ভীর ধরনের, হয়তো কথা বলতেই চাও না। এখন মনে হচ্ছে, তুমি আসলে অনেক ভেতরের কথা লুকিয়ে রাখো।” ছেলেটি লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল, তবে ভেতরে ভেতরে তার মনে হলো—সে ধীরে ধীরে তাকে চিনতে শুরু করেছে। এই বন্ধুত্বই যেন তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক সেতু তৈরি করল, যেখানে ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে মিলেমিশে এক নতুন অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। মেয়েটি ছেলেটিকে তার ছোটখাটো স্বপ্নের কথা বলত, প্রিয় রঙ, প্রিয় গান, এমনকি একদিন খোলাখুলি বলল, “আমার সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা হলো বিশ্বাসভঙ্গ।” এই কথাটা শুনে ছেলেটির মনে হলো, সে প্রতিজ্ঞা করতে পারে যে কখনোই তাকে আঘাত করবে না। ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের আড়ালে প্রেমের বীজ বোনা শুরু হলো, যদিও কেউই তখনো স্বীকার করছিল না। কিন্তু চোখের ভাষা, ছোট ছোট যত্ন, আর একসাথে থাকার অজুহাতগুলো প্রমাণ করছিল—এটা শুধু প্রজেক্টের সম্পর্ক নয়, এর ভেতর আরও গভীর কিছু জন্ম নিচ্ছে।
অধ্যায় ৩: প্রথম কাঁপুনি
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাদের সম্পর্ক এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিল, যেখানে প্রতিদিন একে অপরকে না দেখলে দিনটাই যেন অসম্পূর্ণ মনে হতো। ছেলেটি বুঝতে পারছিল, বন্ধুত্বের আড়াল ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে, আর তার ভেতরে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ জমে উঠছে। মেয়েটি তার সঙ্গে যখন কথা বলত, তখন তার চোখে এক ধরনের উজ্জ্বলতা দেখা যেত, যা ছেলেটিকে অন্যরকমভাবে ছুঁয়ে যেত। একদিন ক্লাস শেষে তারা লাইব্রেরি থেকে বের হচ্ছিল, তখন হঠাৎ করেই ভিড়ের মধ্যে মেয়েটির হাত কাঁধে ছোঁয়া দিল। খুব স্বাভাবিকভাবে হলেও ছেলেটির বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, মনে হলো রক্ত হঠাৎ করেই শরীর জুড়ে ছুটে গেল। এতদিন দূর থেকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর, এতদিন শুধু কথার আড়ালে আবেগ লুকিয়ে রাখার পর সেই প্রথম স্পর্শ যেন পুরো পৃথিবীটা বদলে দিল। সে কিছু বলল না, তবে তার শরীরের ভেতর কাঁপুনি থামছিল না। মেয়েটিও যেন একটু থমকে গেল, কিন্তু মুখে স্বাভাবিক ভঙ্গি ধরে রাখল। তাদের দু’জনের চোখ কয়েক মুহূর্তের জন্য এক হয়ে গেল, আর সেই দৃষ্টি যেন এক নীরব ভাষায় বলে দিল—“হ্যাঁ, আমিও টের পাচ্ছি।”
এরপর থেকে প্রতিটি দেখা করার মুহূর্তেই যেন সেই ছোঁয়ার কথা মনে পড়তে লাগল। ছোট ছোট কারণে হাতের আঙুল ছোঁয়া লাগা, হাঁটার সময় একসঙ্গে কাঁধ মিলে যাওয়া—এসব জিনিস ছেলেটির মনে এক নতুন উত্তেজনা জাগাতে লাগল। আগে যেখানে কথোপকথন সীমাবদ্ধ থাকত পড়াশোনা বা হালকা আড্ডায়, এখন সেখানে যুক্ত হলো নীরবতা, অস্বস্তি আর তীব্র অনুভূতির এক মিশ্রণ। ছেলেটি খেয়াল করল, যখনই তাদের চোখ হঠাৎ করে এক হয়, মেয়েটি হেসে ফেলতে চায় কিন্তু চোখ নামিয়ে নেয়, আর সেই দৃশ্য তার মনে হাজারো প্রশ্ন জাগায়। সে ভাবতে লাগল, এটা কি শুধু বন্ধুত্ব? নাকি এর ভেতরে অন্যকিছু জমে উঠছে? একদিন ক্যাম্পাসের বাগানে বসে মেয়েটি যখন হঠাৎ করে ছেলেটির খাতার ওপর হাত রেখে বলল, “চল, আজকের কাজটা এখানেই শেষ করি, একটু গল্প করি,” তখন মনে হলো, চারপাশে এত ভিড় থাকলেও কেবল তারা দু’জনই আলাদা এক জগতে বসে আছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে হালকা হাওয়ায় মেয়েটির চুল উড়ে গিয়ে ছেলেটির গালে ছুঁয়ে গেল। সে মুহূর্তে যেন হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল দ্বিগুণ। চুলের সেই নরম ছোঁয়া তার শরীরজুড়ে যে শিহরণ তুলল, তা সে কোনোভাবেই লুকোতে পারল না।
দিনগুলো যত এগোতে লাগল, ছেলেটির ভেতরের অনুভূতি ততই তীব্র হয়ে উঠছিল। একদিন হঠাৎ বৃষ্টি নামল, আর তারা দু’জন মিলে কলেজের পুরনো ভবনের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে কেবল বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের শীতলতা আর ভেজা মাটির গন্ধ। ছেলেটি বুঝতে পারছিল, এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও কিছু বলতে পারছে না। মেয়েটির চোখে জলবিন্দু জমে উঠেছিল, আর তার ঠোঁটে হালকা কাঁপুনি ছিল। সেই মুহূর্তে ছেলেটির হাত অজান্তেই মেয়েটির হাতের কাছে চলে গেল। তাদের আঙুল যখন একসঙ্গে জড়াল, তখন মনে হলো শরীরের ভেতর এক অদ্ভুত আগুন জ্বলে উঠেছে। মেয়েটি চোখ তুলে তাকাল, তারপর কিছু না বলে হালকা হেসে ফেলল। কোনো শব্দ হয়নি, কোনো স্বীকারোক্তি হয়নি, কিন্তু সেই প্রথম কাঁপুনিই তাদের সম্পর্কের ভেতর এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। সেই স্পর্শ, সেই অদ্ভুত শিহরণ, সেই নীরব ভাষাই তাদের হৃদয়ে লিখে দিল—এটা আর শুধু বন্ধুত্ব নয়, এটা কিছু অন্যরকম, কিছু গভীর, কিছু যা প্রথম ভালোবাসার নিঃশব্দ ঘোষণা।
অধ্যায় ৪: স্বীকারোক্তি
দিনের পর দিন ছোট ছোট ছোঁয়া, অচেনা দৃষ্টি আর নীরবতার ভেতরে জমতে থাকা আবেগ অবশেষে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়াল, যেখানে আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ছেলেটি বুঝতে পারছিল, তার ভেতরে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব দিয়ে বোঝানো যায় না। মেয়েটির প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কথা, এমনকি তার উপস্থিতিই যেন তাকে অদ্ভুতভাবে টেনে রাখছিল। একদিন ক্লাস শেষে মেয়েটি হঠাৎ বলল, “আজ বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না, একটু হাঁটবি?” ছেলেটি দ্বিধা না করেই রাজি হলো। তারা হাঁটতে হাঁটতে কলেজ ক্যাম্পাসের পাশের ফাঁকা মাঠে গিয়ে বসলো। চারপাশে তখন গোধূলির আলো, আকাশে লালচে আভা, আর বাতাসে হালকা ঠাণ্ডা। মুহূর্তটা এমন ছিল, যেখানে মনে হচ্ছিল পৃথিবী যেন তাদের জন্যই থমকে আছে। ছেলেটি প্রথমে চুপচাপ বসে রইল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুকের ভেতর এমনভাবে ধড়ফড় করছিল যে মনে হচ্ছিল শব্দটা মেয়েটিও শুনতে পাচ্ছে। অনেক ভেবে সে সাহস জোগাড় করল, তারপর আস্তে করে বলল, “তোমার সাথে থাকলে আমি অন্যরকম হয়ে যাই। আমি জানি না এটা কীভাবে বোঝাবো, কিন্তু তোমাকে ছাড়া এখন আর কিছুই ভালো লাগে না।” কথাটা বলেই সে চোখ নামিয়ে নিল, যেন আকাশ ফেটে গেলেও দেখবে না।
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর হালকা হেসে বলল, “তুমি এতদিনে বললে?” ছেলেটি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল। মেয়েটির চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন সে অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল এই মুহূর্তের। “আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো কখনোই বলবে না,” মেয়েটি বলল, “কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম। তোমার চোখে, তোমার আচরণে, সবকিছুতেই বোঝা যেত।” সেই মুহূর্তে ছেলেটির মনে হলো, তার বুক থেকে যেন এক পাহাড় নেমে গেল। এতদিনের ভয়, সংকোচ, অস্থিরতা সব এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল, তাদের চোখ আবার এক হলো, আর সেই চোখের ভেতর তারা দু’জনেই খুঁজে পেল একই অনুভূতির প্রতিফলন। পৃথিবী যেন তখন নিঃশব্দ হয়ে গেল, কেবল তাদের দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিল। তাদের ভেতরকার আবেগ তখন আর কেবল অচেনা টান ছিল না, বরং স্পষ্ট এক স্বীকারোক্তি।
সেদিন থেকেই তাদের সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা পেল। আর কোনো ভান, আর কোনো আড়াল থাকল না। তারা যখন একসঙ্গে হাঁটত বা গল্প করত, তখন আর কেবল বন্ধু হিসেবে থাকত না, বরং প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবে নিজেদের অনুভূতিকে প্রকাশ করত। একদিন মেয়েটি ছেলেটিকে বলল, “আমি ভয় পাই, যদি একদিন এই সম্পর্ক হারিয়ে ফেলি।” ছেলেটি তার হাত ধরে বলল, “আমি কখনোই তোমাকে হারাতে দেব না।” সেই প্রতিশ্রুতি যেন তাদের বন্ধনকে আরও গভীর করে দিল। তারা বুঝতে পারল, ভালোবাসা মানে শুধু হাসি-খুশির মুহূর্ত নয়, বরং ভয়, কৌতূহল আর বিশ্বাসের একসাথে বোনা জটিল অনুভূতি। প্রথমবার যখন তারা নিজেদের মনের কথা খোলাখুলি বলে ফেলল, তখন তাদের হৃদয়ের ভেতরে জমে থাকা চাপা কাঁপুনি মিলেমিশে তৈরি করল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। সেই দিন থেকেই তারা জানত, তাদের যাত্রা আর থেমে থাকবে না—প্রথম ভালোবাসা একবার শুরু হলে তা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ছাপ রেখে যায়।
অধ্যায় ৫: প্রথম ডেট
প্রেমের স্বীকারোক্তির পর তাদের প্রতিটি দিন যেন নতুন রঙে রাঙানো হয়ে উঠল। পড়াশোনার ফাঁকে, ক্লাসের মাঝখানে কিংবা সন্ধ্যার আড্ডায়—সব জায়গাতেই তারা নিজেদের আবেগে ডুবে থাকত। তবে এতদিন সবকিছুই ছিল ক্যাম্পাস বা প্রজেক্টের অজুহাতে একসঙ্গে থাকা, এবার তাদের মনে হলো একটু বাইরে বেরোনো দরকার। প্রথমবার সত্যিকারের ডেটে যাওয়ার প্রস্তাব দিল ছেলেটি, আর মেয়েটিও হালকা লাজুক হাসি দিয়ে রাজি হয়ে গেল। দিনটা ছিল ছুটির, শহরে তখনো সকালের ভিড় জমেনি। তারা দু’জন নদীর ধারের এক পুরোনো পার্কে দেখা করার ঠিক করল। ছেলেটি আগেভাগেই পৌঁছে গিয়েছিল, হাতে একটা ছোট্ট ফুল তুলে এনেছিল, যদিও সেটা দেওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি এল, হালকা নীল রঙের পোশাক পরে, মুখে মৃদু হাসি, আর চোখে যেন লাজুক আলো। ছেলেটির মনে হলো, এ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সকাল।
পার্কের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে তারা নিজেদের ছোট ছোট গল্প শেয়ার করতে লাগল। মেয়েটি বলছিল তার শৈশবের দুষ্টুমি, পরিবার নিয়ে মজার ঘটনা, আর ছেলেটি শুনছিল মুগ্ধ হয়ে। মাঝে মাঝে দু’জনেই একসঙ্গে হেসে উঠছিল, আর সেই হাসির শব্দ যেন বাতাসে বাজতে থাকা সুরের মতো লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে তারা একসময় নদীর ধারে গিয়ে বসল। চারপাশে ছিল গাছের ছায়া, পানির মৃদু ঢেউ, আর দূরে ভেসে আসছিল পাখির ডাক। ছেলেটি সাহস করে ফুলটা মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিল। মেয়েটি অবাক হয়ে তাকাল, তারপর লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল, “এটা রাখব?” ছেলেটি হেসে বলল, “এটা তোমার জন্যই এনেছি।” মেয়েটি ফুলটা হাতে নিয়ে চোখে এমন এক দৃষ্টি দিল, যা ছেলেটির বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। তাদের মধ্যে কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু সেই নীরবতা যেন হাজারো ভালোবাসার কথা বলে দিল।
দিনটা কেটে গেল অনেক গল্প, অনেক হাঁটা আর নীরব মুহূর্তে ভরা। তারা একসঙ্গে আইসক্রিম খেল, বইয়ের দোকানে ঢুঁ মেরে প্রিয় লেখকদের নাম বলল, আবার ছোটখাটো জিনিসপত্র কেনাকাটায় হাসাহাসি করল। ছেলেটি খেয়াল করছিল, মেয়েটি যতটা সহজভাবে নিজেকে প্রকাশ করছে, তার ভেতরে ততটাই কোমল এক আবেগ লুকিয়ে আছে। ফেরার পথে সন্ধ্যার আলো নেমে এসেছিল, রাস্তার বাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠছিল। মেয়েটি বলল, “আজকের দিনটা আমি কোনোদিন ভুলব না।” ছেলেটিরও একই অনুভূতি হচ্ছিল, তবে সে কিছু বলল না, শুধু মেয়েটির হাতটা আলতোভাবে ধরে রাখল। মেয়েটিও হাত ছাড়াল না, বরং আঙুলগুলো শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। সেই প্রথম ডেটের শেষে তারা দু’জনেই বুঝে গেল, এই সম্পর্ক শুধু কথার বা স্বীকারোক্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই, বরং বাস্তবের প্রতিটি মুহূর্তে তা আরও গভীর হচ্ছে। প্রেমের এই যাত্রা এখন একেবারেই তাদের নিজস্ব, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপেই ভয়, কৌতূহল আর ভালোলাগা একসঙ্গে মিশে আছে।
অধ্যায় ৬: প্রথম আলিঙ্গন
প্রথম ডেটের স্মৃতি দু’জনের মনেই এত গভীর ছাপ ফেলেছিল যে, এরপর থেকে তাদের প্রতিটি দেখা করার মুহূর্ত আরও বিশেষ হয়ে উঠতে লাগল। ক্লাস শেষে একসঙ্গে হাঁটা, লাইব্রেরির নির্জন কোনায় বসে গল্প করা কিংবা ক্যাম্পাসের মাঠে বসে নিছক নীরবতা ভাগ করে নেওয়া—সবকিছুই যেন তাদের সম্পর্ককে আরও গাঢ় করছিল। কিন্তু যতই তারা একে অপরকে চিনতে লাগল, ততই ভেতরে ভেতরে একটা টান জমতে থাকল, যা শুধুমাত্র কথায় বা চোখের দৃষ্টিতে প্রকাশ করা যাচ্ছিল না। ছেলেটি প্রায়ই খেয়াল করত, মেয়েটি কথার মাঝখানে থেমে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু বলতে চায়, আবার সাহস করে বলে না। একদিন বিকেলে বৃষ্টি থেমে যাওয়া শহরের আকাশে হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল, আর তারা দু’জন কলেজের পুরোনো ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। বাতাসে ভেজা গন্ধ, দূরে পাখির ডাক আর আকাশের রঙে এক অদ্ভুত মায়া ছিল। হঠাৎ মেয়েটি হালকা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তুমি কি জানো, কখনো কখনো মনে হয় আমি তোমার কাছে থাকলে সবকিছু সহজ হয়ে যায়।” ছেলেটি চমকে তার দিকে তাকাল, তারপর নিজের ভেতরে জমে থাকা আবেগ আর আটকে রাখতে পারল না। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সে মেয়েটিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল।
সে মুহূর্ত যেন সময়কে থামিয়ে দিল। মেয়েটি প্রথমে অবাক হয়ে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বন্ধ করে মাথা রাখল ছেলেটির বুকে। দু’জনের হৃদস্পন্দন তখন এক হয়ে গিয়েছিল, যেন একে অপরের বুকের ভেতর দিয়ে ছন্দ বাজছে। ছেলেটির মনে হচ্ছিল, সে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, আর মেয়েটির কাছে সেই উষ্ণতা যেন ছিল হাজারো আশ্বাসের মতো। এতদিনের ভয়, দ্বিধা, কৌতূহল সব মিলেমিশে এক গভীর প্রশান্তি এনে দিল সেই প্রথম আলিঙ্গনে। চারপাশে ছিল কেবল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর তাদের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা। মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি জানো, আমি অনেকদিন ধরে চাইছিলাম এই মুহূর্তটা আসুক।” ছেলেটির চোখ ভিজে উঠল আবেগে, সে শুধু আরও শক্ত করে তাকে আঁকড়ে ধরল, যেন পৃথিবীর সব ভয়কে সে তার বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে চায়।
সেই প্রথম আলিঙ্গনের পর তাদের সম্পর্ক যেন আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। পরের দিনগুলোতে যখনই তারা দেখা করত, নীরব মুহূর্তে হাত ধরা কিংবা হালকা করে জড়িয়ে ধরাটা স্বাভাবিক হয়ে উঠল। কিন্তু প্রত্যেকবারই সেই অনুভূতি নতুন, প্রত্যেকবারই যেন ভেতরের কাঁপুনি অন্যভাবে ধরা দিত। মেয়েটি একদিন বলল, “তুমি জানো, আলিঙ্গনে একটা অদ্ভুত শক্তি আছে, মনে হয় সব ভয়, সব ক্লান্তি, সব দুঃখ গলে যায়।” ছেলেটি হেসে জবাব দিল, “হয়তো সেই কারণেই আমি চাই তোমাকে প্রতিবারই কাছে টেনে রাখতে।” তাদের প্রেম তখন এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিল, যেখানে আবেগ আর শারীরিক টান মিলেমিশে একে অপরকে আরও গভীরভাবে বাঁধছিল। প্রথম আলিঙ্গন শুধু একটি মুহূর্ত ছিল না, বরং সেই মুহূর্ত থেকেই তাদের ভালোবাসার শরীরী প্রকাশ শুরু হয়েছিল, যা ধীরে ধীরে আরও অনেক নতুন অভিজ্ঞতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
অধ্যায় ৭: নিষিদ্ধ আকর্ষণ
প্রথম আলিঙ্গনের পর তাদের সম্পর্ক যেন নতুন এক আবেশে ঢেকে গেল। প্রতিটি দেখা করার সময়েই তারা আগের থেকে আরও বেশি কাছে আসতে চাইত, আর সেই টান যেন থামানো যাচ্ছিল না। ক্লাসের ফাঁকে, করিডরের ভিড়ে, কিংবা লাইব্রেরির নির্জন জায়গায় তাদের চোখ যতবার এক হতো, ততবারই ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত এক আগুন জ্বলে উঠত। ছেলেটি টের পেত, মেয়েটি তার কাঁধে হালকা ভর দিলে তার শরীরের ভেতর কেমন এক অচেনা কম্পন ছড়িয়ে পড়ে, আর মেয়েটি বুঝত ছেলেটির নিঃশ্বাসে লুকানো অস্থিরতা। দু’জনের মনের মধ্যে তখন একটা দ্বন্দ্ব চলছিল—একদিকে সমাজ, ভয়, আর নিষেধের বেড়াজাল, অন্যদিকে প্রবল কৌতূহল আর আকর্ষণের টান। তারা দু’জনেই বুঝতে পারছিল, তাদের শরীরের ভেতরে যে কাঁপুনি জমছে তা আর কেবল আলিঙ্গন বা হাত ধরা দিয়ে আটকে রাখা যাবে না। কিন্তু তবুও তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, কেবল প্রতিটি মুহূর্তে নিজেদের ভেতরের দ্বিধা আর টানাপোড়েনের সঙ্গে লড়াই করছিল।
একদিন বিকেলে ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে এলে তারা গোপনে পুরোনো অডিটোরিয়ামের পেছনের নির্জন জায়গায় গিয়ে বসল। চারপাশে ছিল কেবল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর দূরে গাড়ির শব্দের মৃদু প্রতিধ্বনি। মেয়েটি তখন ছেলেটির কাঁধে মাথা রেখেছিল, আর দু’জনেই চুপচাপ বসে ছিল। কোনো কথা হচ্ছিল না, কিন্তু সেই নীরবতা ভেতরে ভেতরে তীব্র হয়ে উঠছিল। ছেলেটি অনুভব করল, তার হাত ধীরে ধীরে মেয়েটির আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরছে, আর মেয়েটির নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। সে মুহূর্তে তারা দু’জনেই জানত, যে আকর্ষণ তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা হয়তো সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ, কিন্তু হৃদয়ের ভেতরে তা দমন করা অসম্ভব। মেয়েটি আস্তে করে বলল, “আমরা কি ভুল করছি?” ছেলেটি উত্তর দিল না, শুধু তার চুলে হাত বুলিয়ে দিল। সেই স্পর্শে মেয়েটির চোখ বন্ধ হয়ে গেল, আর ছেলেটির বুকের ভেতর আরও প্রবল কাঁপুনি তৈরি হলো। তারা জানত, এই পথে এগোলে আর পেছনে ফেরার উপায় নেই, কিন্তু অদৃশ্য শক্তি তাদের ঠেলে দিচ্ছিল আরও গভীর ঘনিষ্ঠতার দিকে।
সেই দিন থেকে তাদের দেখা হওয়ার ধরনই বদলে গেল। আগের মতো শুধু হাঁটা, গল্প বা হাসাহাসি নয়, এখন প্রতিটি মুহূর্তে তারা আরও বেশি শারীরিকভাবে কাছে আসার অদৃশ্য আকাঙ্ক্ষা অনুভব করতে লাগল। হাত ধরা থেকে আলিঙ্গন, আলিঙ্গন থেকে দীর্ঘ সময় একে অপরের গায়ে মাথা রেখে বসে থাকা—সবকিছুই যেন সীমারেখা ভেঙে দিচ্ছিল। তবুও তারা একে অপরকে প্রশ্ন করত, “আমরা কি সঠিক করছি?”—আবার উত্তর খুঁজে পেত একে অপরের চোখে। তাদের ভেতরে ভয় ছিল, যদি একদিন কারও নজরে পড়ে যায়, অথবা যদি এই সম্পর্ক ভেঙে যায়। কিন্তু ভয়কে ছাপিয়ে আকর্ষণই যেন জিতছিল প্রতিদিন। এই নিষিদ্ধ টান তাদের ভেতরে একদিকে অস্থিরতা বাড়াচ্ছিল, আবার অন্যদিকে তৈরি করছিল গভীর এক বিশ্বাস—যতই ভয় থাকুক, তারা একে অপরকে ছাড়তে পারবে না। তাদের কৌতূহল আর আবেগ তখন এক অদৃশ্য স্রোতের মতো বইছিল, যা শীঘ্রই নিয়ে যাবে তাদের আরও ঘনিষ্ঠতার দিকে।
অধ্যায় ৮: প্রথম চুম্বন
দিনের পর দিন জমে থাকা আবেগ, হাতের আলতো ছোঁয়া আর দীর্ঘ আলিঙ্গনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আকাঙ্ক্ষা অবশেষে একদিন এমন এক মুহূর্তে এসে পৌঁছাল, যেখানে তাদের আর কোনো আড়াল থাকল না। সেদিন বিকেলে তারা দু’জনই কলেজ শেষে শহরের বাইরে একটা পুরোনো লাইব্রেরির নির্জন বারান্দায় বসেছিল। চারপাশে নীরবতা, শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসছিল শীতল বাতাস আর দূরে কারও পড়ার শব্দ। তারা দু’জনেই চুপচাপ ছিল, যেন কথার দরকার নেই, শুধু একে অপরের উপস্থিতিই যথেষ্ট। ছেলেটি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ, তারপর হঠাৎ করে সাহস সঞ্চয় করে তার হাত ধরল। মেয়েটি কিছু বলল না, কেবল দৃষ্টি সরাল না। সেই নীরব চোখের ভাষা ছিল এমন শক্তিশালী যে, ছেলেটির বুক কাঁপছিল অস্থিরতায়। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আস্তে করে ফিসফিস করল, “তুমি কিছু বলতে চাইছো না?” ছেলেটি উত্তর দিল না, বরং অজান্তেই তার মুখটা আরও কাছে নিয়ে এলো।
মুহূর্তটা যেন এক অদ্ভুত যাদুতে ভরে উঠল। তাদের নিঃশ্বাস মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল, আর চারপাশের পৃথিবী যেন থেমে গিয়েছিল। মেয়েটি প্রথমে চোখ নামিয়ে নিল, তারপর হঠাৎ আবার তাকাল, আর সেই দৃষ্টি এতটাই আন্তরিক ছিল যে ছেলেটি আর নিজেকে থামাতে পারল না। সে আস্তে করে ঠোঁট রাখল মেয়েটির ঠোঁটে। প্রথম চুম্বন—কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই, কেবল আবেগের তীব্রতায় ভরা। দু’জনের শরীর কেঁপে উঠল, বুকের ভেতর দম আটকানো এক শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটি প্রথমে অবাক হলেও ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে নিল, আর তার হাত শক্ত করে ছেলেটির হাতে চেপে ধরল। তাদের ঠোঁটের সেই স্পর্শে ভয়, লজ্জা, কৌতূহল আর ভালোলাগা একসাথে মিশে এমন এক অনুভূতি তৈরি করল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মনে হচ্ছিল, এতদিনের সব আবেগ যেন এই মুহূর্তেই একসাথে মুক্তি পেল।
চুম্বনের পর দু’জনেই অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। মেয়েটির গাল লাল হয়ে উঠেছিল, চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক, আর ঠোঁটে লাজুক হাসি। সে আস্তে করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম এটা কখনো ঘটবে না।” ছেলেটি হাসল, তারপর উত্তর দিল, “আমি তো অনেকদিন ধরেই চাইছিলাম, শুধু সাহস হচ্ছিল না।” তাদের ভেতরের সমস্ত দ্বিধা সেই মুহূর্তে ভেঙে গিয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিটি দেখা করার সময়েই তাদের মধ্যে নতুন এক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলো। আগের মতো কেবল আলিঙ্গন বা হাত ধরা নয়, এখন তাদের ঠোঁটও বারবার একে অপরের কাছে চলে আসত। তবে প্রতিবারই সেই চুম্বন ছিল নতুন, প্রতিবারই ভিন্ন শিহরণ, প্রতিবারই যেন প্রথমবারের মতো। তাদের প্রথম চুম্বন শুধু একটি মুহূর্ত ছিল না, বরং তাদের ভালোবাসার ইতিহাসে এমন এক অধ্যায়, যা তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করল, আরও স্পষ্ট করে দিল—তারা একে অপরের জন্যই জন্মেছে।
অধ্যায় ৯: গোপন প্রতিশ্রুতি
প্রথম চুম্বনের পর তাদের সম্পর্ক যেন একেবারেই নতুন রূপ নিল। এখন আর শুধু নীরব দৃষ্টি বা আলিঙ্গনের ভেতরে লুকানো টান নয়, বরং প্রতিটি মুহূর্তে তাদের ভেতরের আবেগ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ছেলেটি প্রায়ই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভাবত, সে-ই তার জীবনের সবকিছু, আর মেয়েটিও মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল, এ মানুষটাকেই সে চায়। তবুও বাস্তবতার একটা ভয় সবসময় তাদের মনে ছিল—পরিবারের অনুমতি, সমাজের বাঁধা আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। এক বিকেলে তারা কলেজ শেষে নদীর ধারে গিয়ে বসেছিল। চারপাশে গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়েছিল, পানির ঢেউয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল সূর্যের শেষ আলো। মেয়েটি তখন অনেকক্ষণ নীরব ছিল, যেন মনে কিছু লুকিয়ে রেখেছে। ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবছ?” মেয়েটি আস্তে করে বলল, “যদি কোনোদিন আমরা আলাদা হয়ে যাই?” ছেলেটির বুক কেঁপে উঠল, সে এক মুহূর্তও সেই সম্ভাবনা ভাবতে চায়নি।
ছেলেটি মেয়েটির হাত শক্ত করে ধরে বলল, “তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?” মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় হয়।” তখন ছেলেটি দৃঢ় স্বরে বলল, “তাহলে শোনো, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—যা-ই হোক না কেন, আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না।” মেয়েটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, চোখ ভিজে উঠল আবেগে। সে ধীরে ধীরে বলল, “আমিও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তোমার সাথেই থাকব, যত কষ্টই আসুক।” দু’জনের সেই প্রতিশ্রুতি ছিল নীরব, কোনো সাক্ষী ছাড়া, কিন্তু তবুও যেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত বন্ধন হয়ে গেল। তাদের চোখে তখন ভবিষ্যতের ভয় মিলিয়ে গিয়ে জায়গা করে নিল এক অদ্ভুত শান্তি। তারা বুঝল, ভালোবাসা শুধু আবেগ বা আকর্ষণের নাম নয়, বরং গভীর বিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
সেই গোপন প্রতিশ্রুতির পর তাদের সম্পর্ক আরও পরিণত হয়ে উঠল। প্রতিবার দেখা করার সময় এখন শুধু হাসি-ঠাট্টা নয়, বরং ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়েও তারা কথা বলতে লাগল। কে কোথায় কাজ করবে, পরিবারকে কিভাবে বোঝাবে, আর কেমন করে একসাথে জীবন কাটাবে—এসবই ছিল তাদের আলোচনার বিষয়। তবুও, সেই আলোচনার ভেতরে সবসময় এক ধরনের লুকানো ভয় থাকত। কিন্তু যখনই তারা একে অপরের চোখের দিকে তাকাত, মনে হতো, সব বাধা জয় করা সম্ভব। তাদের প্রথম ভালোবাসা তখন শুধু একে অপরকে পাওয়ার তৃষ্ণা নয়, বরং একে অপরের জীবনের সঙ্গে গাঁথা এক দীর্ঘ যাত্রার শুরু। সেই দিন নদীর ধারে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি হয়ে উঠল তাদের ভালোবাসার সবচেয়ে বড় শক্তি—একটি গোপন প্রতিজ্ঞা, যা কেবল তারা দু’জন জানত, আর যা চিরদিনের জন্য তাদের হৃদয়ে খোদাই হয়ে রইল।
অধ্যায় ১০: প্রথম মিলন
প্রেম, আলিঙ্গন, চুম্বন আর গোপন প্রতিশ্রুতির বাঁধনে বাঁধা পড়ে তারা বুঝতে পারছিল, তাদের ভেতরে জমে থাকা আকাঙ্ক্ষা আর আবেগ প্রতিদিন আরও গভীর হচ্ছে। কিন্তু সেই আকর্ষণকে তারা এতদিন কেবল নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে—ভয়, দ্বিধা আর সমাজের নিয়ম তাদের পিছিয়ে দিয়েছিল। তবুও, একসময় ভালোবাসা আর আকাঙ্ক্ষার স্রোত এত প্রবল হয়ে উঠল যে, তারা আর তা আটকে রাখতে পারল না। সেদিন সন্ধ্যায় শহরের ভিড় থেকে দূরে, এক বন্ধুর খালি ফ্ল্যাটে তারা গিয়েছিল পড়াশোনার অজুহাতে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, জানালা দিয়ে আসা আলো আর হালকা বাতাসে তৈরি হচ্ছিল অন্যরকম এক আবহ। ছেলেটি মেয়েটির হাত ধরল, আর মেয়েটির চোখে ছিল একই সঙ্গে ভয় আর কৌতূহল। দু’জনের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল, বুকের ভেতর কাঁপুনি থামছিল না। তারা জানত, আজ হয়তো কিছু বদলে যাবে, কিন্তু তবুও একে অপরের প্রতি টান এত প্রবল ছিল যে, তাদের থামানোর মতো আর কোনো শক্তি রইল না।
মুহূর্তের ভেতরেই তাদের মধ্যে নীরবতা ভেঙে গেল। ছেলেটি মেয়েটিকে কাছে টেনে নিল, আর দু’জনের ঠোঁট এক হয়ে গেল দীর্ঘ এক চুম্বনে। সেই চুম্বনে জমে থাকা সব ভয়, লজ্জা আর আকাঙ্ক্ষা একসাথে মিশে যাচ্ছিল। মেয়েটি চোখ বন্ধ করে ছেলেটির বুকে আশ্রয় নিল, আর ছেলেটি ধীরে ধীরে তার চুলে, কপালে, গালে স্পর্শ করতে লাগল। প্রতিটি স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠছিল, শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। তারা একে অপরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছিল, প্রতিটি ছোঁয়ায় যেন খুলে যাচ্ছিল এক অচেনা জগতের দরজা। মেয়েটির ভয় ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, জায়গা নিচ্ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, “ভয় পেয়ো না, আমি আছি।” আর সেই আশ্বাসে মেয়েটি নিজেকে আরও বেশি ভরসা করতে পারল। তারা বুঝল, এই মিলন কেবল শারীরিক টান নয়, বরং একে অপরকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি।
সেই রাতে তারা প্রথমবার সম্পূর্ণভাবে মিলিত হলো। প্রতিটি মুহূর্তে তাদের মনে হচ্ছিল, ভালোবাসা আসলে কীভাবে শরীর আর আত্মাকে এক করে দেয়। তাদের কৌতূহল, ভয়, লজ্জা সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠছিল। কোনো তাড়াহুড়া ছিল না, কোনো জোর ছিল না—ছিল কেবল ভালোবাসার ধীর আবেগ, বিশ্বাস আর একে অপরের ভেতরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। মিলনের পর যখন তারা একে অপরের পাশে নিঃশ্বাস ফেলছিল, মেয়েটি ছেলেটির বুকে মুখ গুঁজে আস্তে করে বলল, “আজ মনে হচ্ছে আমি সম্পূর্ণ তোমার হয়ে গেছি।” ছেলেটি তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি সবসময়ই আমার ছিলে, আজ শুধু তা প্রমাণ হলো।” জানালার বাইরে তখন রাত গভীর হচ্ছিল, কিন্তু তাদের ভেতরের আলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। প্রথম মিলনের সেই অভিজ্ঞতা শুধু এক রাতের ঘটনা ছিল না, বরং তাদের ভালোবাসার গল্পে সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে গভীর অধ্যায় হয়ে রইল।
সমাপ্ত