এক
দুপুরটা আজ যেন একটু বেশি নিস্তব্ধ। বাইরের রাস্তায় ছায়া পড়েছে সামনের অশ্বত্থ গাছের পাতায়; বাতাস নেই, শুধু একটা অনুজ্জ্বল আলো জানালার কাচে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। অদ্রিজা কোলের উপর রাখা বইটার পাতায় চোখ রেখে বসে আছে, অথচ পড়া নয়, সে দেখছে পাশের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির ছায়া—যেখানে ছেলেটি, অনির্বাণ, ঠিক দুপুর বারোটা নাগাদ এসে দাঁড়ায় একটা মগ হাতে। প্রতিদিনের মতো আজও সে এসেছে। হালকা নীল শার্ট, খোলা চুলের মধ্যে একটুখানি এলোমেলোতা—যা দেখে অদ্রিজার মনে হয়, ছেলেটি বুঝি কোনও কল্পনার বই থেকে উঠে এসেছে। ছেলেটির চোখ থাকে নিচে, কিংবা দূরে কোথাও—তাকে দেখে না ঠিক, কিন্তু অদ্রিজার মনে হয়, ওর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা আসলে একটা ইঙ্গিত, একটা অদৃশ্য ডাকে সাড়া দেওয়া। ছেলেটি জানে না, পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটা প্রতিদিন তার আগমনের প্রতীক্ষায় জানালার ধারে বসে থাকে, নিঃশব্দে চা খেতে খেতে তার দিকে তাকায়, প্রতিদিন নতুন নতুন গল্পের সূচনা করে।
অদ্রিজার দিন কাটে এক নির্দিষ্ট ছকে—ভোরবেলা উঠে একটু হাঁটা, তারপর পড়াশোনা, মায়ের পাশে বসে দুপুরের রান্না দেখা, আর সবশেষে বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার আগে জানালার ধারে বসে অনির্বাণকে দেখা। সে ভাবে, ছেলেটির নাম হয়তো এমনই কিছু হবে—অরণ্য, অরিত্র, অথবা অনির্বাণ। সেই নামটুকুও জানা নেই, তবু তার চেনা হয়ে গেছে প্রতিটি ভঙ্গি, হাঁটার ধরণ, মোবাইলে কথা বলার সময় ঠোঁট নাড়ানোর ছন্দ। কখনো কখনো অদ্রিজা নিজের মনে বলে ওঠে—“আজকে হয়তো বলবে, ‘তুমি গান গাও?’” অথচ জানালার এপারে কোনো প্রশ্ন আসে না, কোনো সাড়া মেলে না। তবু সে ভাবে, সে তো বলতেই পারত, অনির্বাণ তো জানতেই পারত না—তবে ভাবতে তো দোষ কী? এই ভাবনার জগতে, যেখানে কোনো প্রত্যুত্তরের দরকার নেই, অদ্রিজা নিজেই গল্পের লেখক, নিজেই পাঠক। তার প্রতিটি ভাবনা অনির্বাণকে ঘিরে, অথচ এক পা-ও বাইরে ফেলা হয় না। কল্পনার দড়িতে বাঁধা তার মন, অথচ সেই বন্ধনেই যেন সবচেয়ে বেশি মুক্ত।
সেদিন দুপুরেও এমনই ছিল। চুপচাপ জানালার ফাঁকে বসে অদ্রিজা দেখল—অনির্বাণ তার ল্যাপটপ নিয়ে ব্যালকনিতে বসেছে। হয়তো কাজ করছে, কিংবা অফিসের মিটিং। অথচ তার মুখে এমন এক নিষ্পাপ ধ্যানে ভরা একাগ্রতা, যা অদ্রিজার হৃদয়কে ধীরে ধীরে পিঙ্গল করে দেয়। সে চোখ সরাতে পারে না। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে, যেন এই ছোট্ট মুহূর্তের মধ্যেই জীবনের এক বিশাল রসদ লুকিয়ে আছে। পাশের রুম থেকে মা ডাকেন—“অদ্রিজা, দুপুরের খাওয়া হবে না?” সে সাড়া দেয় না, কিংবা দিতে চায় না। তার চোখ আটকে আছে এক জানালার ফ্রেমে, যেখানে একটা ছেলেকে সে ভালোবেসে ফেলেছে নিঃশব্দে, নিঃস্বরে, নিঃশর্তে। সে জানে না, এই ভালোবাসা কোনোদিন পৌঁছোবে কিনা ছেলেটির হৃদয়ে, জানে না, প্রতিদিনের এই দেখা-না-দেখার খেলায় শেষ কোথায়। শুধু জানে, এই একপেশে প্রতিধ্বনি তার জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি—যা সে হারাতে চায় না, আর পেতেও চায় না কোনো পরিবর্তনে। সে শুধু চায়—অনির্বাণ প্রতিদিন আসুক, দাঁড়াক ব্যালকনিতে, আর জানালার কাচের ওপারে তার অস্তিত্বে প্রতিধ্বনি তুলুক নিঃশব্দে।
দুই
জানালার কাঁচের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে ঘিরে অদ্রিজার জীবনে এক নিঃশব্দ সংলাপ তৈরি হয়ে গেছে। অনির্বাণ যখন ব্যালকনিতে দাঁড়ায়, অদ্রিজার মনে হয়, সে যেন চোখে চোখ রাখছে, অথচ বাস্তবে দু’জনের দৃষ্টি কোনোদিন মিলেও মেলে না। অদ্রিজা প্রতিদিন নিজের কল্পনার মধ্যে অনির্বাণকে প্রশ্ন করে—“তুমি কি বুঝতে পারো, আমি তাকিয়ে থাকি?” সে নিজেই জবাবও দেয়—“হ্যাঁ, আমি জানি।” এই একতরফা কথোপকথনের মধ্যেই সে তৈরি করে চলেছে একটা নিখুঁত সম্পর্কের কাঠামো। যেখানে ঝগড়া আছে, অভিমান আছে, ক্ষমা চাওয়া আছে, আবার ভালোবাসার স্বীকারোক্তিও আছে—সবই নিঃশব্দে। কখনো কখনো ছেলেটিকে দেখে মেজাজ গরমও হয়। কেউ একজন এসেছে তাকে খুঁজতে—এক মেয়ে, বেশ চেনা ভঙ্গিতে ডাকছে ব্যালকনিতে দাঁড়ানো ছেলেটিকে। অদ্রিজার মন ভার হয়ে যায়। “তোমার তো কেউ আছে, তাই না?”—এই প্রশ্নটা সে মনে মনে বারবার করে, অথচ প্রতিবারই তার উত্তরটা হয় নিজস্ব সান্ত্বনা—“তবে কেন প্রতিদিন ঠিক বারোটা নাগাদ তুমি এসে দাঁড়াও? কেন জানালার দিকে একবার তাকাও না—একবারও?”
একদিন খুব অল্প কিছুক্ষণ, হঠাৎ মনে হলো, অনির্বাণ তার দিকেই তাকিয়ে রইলো কিছু মুহূর্ত। অদ্রিজা থমকে গেল। তার হৃদপিণ্ড যেন দাঁড়িয়ে থাকা সেকেন্ড-হ্যান্ড ঘড়ির কাঁটার মতো ধীরে ধীরে টুকরো করে মুহূর্ত কাটাতে লাগল। কিছুই বলা হয়নি, কিন্তু এই তাকিয়ে থাকাটাই যেন এক পূর্ণ সংলাপ হয়ে গেল তার জন্য। সে মনে মনে বলল, “তুমি কি বুঝতে পারছো, আমি কেমন অনুভব করছি এখন?” জানালা বন্ধ করেও সেদিন তার মুখের লাজুক হাসি আটকানো যায়নি। তার মনে হয়েছিল—হয়তো এটাই সেই সুর, যা প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরে। হয়তো এই চুপচাপ ভালোবাসা একতরফা নয়। হয়তো শব্দ ছাড়াও কিছু সম্পর্ক গড়ে ওঠে—যেখানে চাহনি-ভরা কথোপকথনই যথেষ্ট।
দিনগুলো কেটে যায়। অনির্বাণ অফিস যায়, ফিরে আসে, ছুটির দিনগুলোতে হেডফোনে গান শুনতে শুনতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো তার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে অদ্রিজা অনুমান করে—সে কী গান শুনছে। সেদিন সে নিজের ঘরে বসে গুনগুনিয়ে গাইল—”তোমার নাম লিখে রাখি সূর্য ডোবার আগে…”। গাইতে গাইতেই তার চোখ জানালার ফাঁকে অনির্বাণকে খুঁজে পায়—সে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো ফোনে কথা বলছে, হয়তো কেবল কিছু ভাবছে। কিন্তু অদ্রিজা ঠিক সেই মুহূর্তে অনুভব করে—অনির্বাণের ঠোঁটও একটু না একটু নড়ছে, ঠিক একই গানের সুরে। তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। মনে হয়, এ তো কাকতালীয় হতেই পারে না! তার গান শুনতে পেয়েছে সে? তাহলে সে কি প্রতিদিনই শুনে? না কি সেই জানালার অন্য প্রান্তেও তৈরি হয়ে গেছে আরেকটি নিঃশব্দ জগৎ—যেখানে অদ্রিজার প্রতিধ্বনি পৌঁছায়, ঠিক যেমন করে অনির্বাণের প্রতিটি উপস্থিতি পৌঁছায় অদ্রিজার হৃদয়ে?
তিন
স্বপ্নের একটা সীমা থাকা দরকার—মা মাঝে মাঝে বলে ওঠেন, “অত্যাধিক ভাবা ঠিক নয়।” কিন্তু অদ্রিজার ভাবনাগুলো এমনই যে, কোনো প্রাচীর তাকে আটকাতে পারে না। অনির্বাণকে নিয়ে তার প্রতিদিনকার কল্পনা এখন ছোট গল্পের মতো আকার নিচ্ছে—সকালে অনির্বাণ অফিস যাবার সময় সে টিফিন দিতে এসে হাত ছুঁয়ে ফেলে, রাতে ছাদে উঠে তারা দেখে, মাঝেমাঝে ঝগড়া করে—“তুমি তো এখন আর আগের মতো জানালার দিকে তাকাও না।” এসব দৃশ্য যেন বাস্তব নয়, অথচ অনুভবটা এত তীব্র যে, বাস্তব আর কল্পনার মাঝখানে রেখাটি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে। একদিন সে খেয়াল করে, সে নিজের মুখে কথা বলছে—ফিসফিস করে, নিজের মনেই, এমনকি অনির্বাণের জন্য চিরকুট লিখেও রাখে ডায়েরির পাতায়। সেখানে সে লিখেছে—“আমি আছি, পাশের ফ্ল্যাটেই। যেদিন চোখে চোখ পড়বে, সেইদিন বলবো—তুমি অনেক দিন ধরে আমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছ।”
কিন্তু বাস্তবে কখনো সেই চোখে চোখ পড়া হয় না। অনির্বাণ নিজের জগতে বিভোর থাকে, অফিস যায়, ট্যাক্সি ডাকায়, মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। অথচ কোনোদিনই একবার জানালার দিকে না তাকিয়ে অদ্রিজার অস্তিত্ব টের পায় কি না—তা অদ্রিজা জানে না। সে শুধুই অনুভব করে, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি ছায়া যেন অনির্বাণ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। একদিন সে ভুল করে জানালার কাচ একটু খোলা রেখেছিল, আর ঠিক তখনই বাতাসে ভেসে এসেছিল তার গাওয়া গানের সুর। তখন হঠাৎ অনির্বাণ থমকে দাঁড়ায়, কানের হেডফোন খুলে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিন অদ্রিজার মন বলেছিল—সে শুনেছে। হয়তো গানের সুরে লুকোনো তার মনের কথাও শুনেছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হয়—এও কি হতে পারে? এই কি কেবল তার মনের বানানো গল্প? স্বপ্নের আবরণে সে বাস্তবকে ঘিরে ফেলেছে, না বাস্তবই স্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে?
তার দিনরাত্রি চলতে থাকে এই প্রশ্নের ভিতরে। নিজের মনেই সে একটা খাতা খুলেছে—নাম রেখেছে ‘প্রতিধ্বনি’। প্রতিদিন অনির্বাণকে নিয়ে তার কল্পনার ছোট ছোট টুকরো গল্প সেখানে লেখা থাকে। যেমন—“আজকে তুমি অফিস থেকে ফিরলে ভিজে চুলে। হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে গেছ। আমি জানালার আড়াল থেকে দেখলাম, তুমি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছো। আমি ভাবলাম, যদি এক প্যাকেট বিস্কুট আর একটা চা নিয়ে তোমার কাছে যাই, তুমি কি নিতে?” প্রতিটি গল্পই অদ্রিজার মনের খেলা, কিন্তু সেগুলো যেন বাস্তবতাকেও ছুঁয়ে যেতে চায়। সে ভাবে, যদি একদিন সত্যিই এসব ঘটে! যদি অনির্বাণ একদিন সত্যিই বলে বসে—“তুমি কি জানালে দাঁড়িয়ে থাকো প্রতিদিন?” সেই সম্ভাবনার জন্যই তার মন বাঁচে, তার দিন কেটে যায়। সে জানে, বাস্তব বড় নির্মম, কিন্তু এই কল্পনার ভিতর সে যা খুশি হতে পারে—অনির্বাণের প্রেমিকা, তার বন্ধু, অথবা নিঃশব্দ সাথী। বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে নিজেই কখন যেন হারিয়ে গেছে।
চার
পিয়ালী সেনগুপ্ত অনেকটা বুঝতে পারছেন, মেয়েটা কোথাও যেন ধীরে ধীরে গা ঢাকা দিচ্ছে—এক অদৃশ্য জগতে। অদ্রিজা আগেও একটু স্বপ্নবিলাসী ছিল ঠিকই, কিন্তু এখনকার মত এতটা নিঃশব্দ হয়ে যাওয়া তার নতুন। পড়াশোনা করছে ঠিকই, খাচ্ছে-দাচ্ছে, কথাও বলছে, কিন্তু কোথাও যেন তার মন পড়ে আছে নিরন্তর এক চোখের কোণে। একদিন তিনি খেয়াল করলেন, বিকেলবেলা যখন ব্যালকনির দিকটা আলোয় স্নান করছে, অদ্রিজা তখন কাঁচের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে, নিষ্পলক। হাতে ধরা খাতায় কলম চলছে বটে, কিন্তু সেই লেখা যেন বাইরের দৃশ্যকেই অনুবাদ করছে। মা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—“কি দেখিস ওখানে রোজ?”
অদ্রিজা একটু চমকে উঠে বলল—“না… কিছু না, হাওয়া দেখছিলাম।”
পিয়ালী ঠোঁট টিপে হাসলেন। বুঝলেন—হাওয়া নয়, কারও উপস্থিতির প্রতীক্ষা।
এই ফ্ল্যাটবাড়ির সবাই সবাইকে চেনে না ঠিকই, তবে কিছু চেনা মুখ আছে যারা নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে। যেমন, শশাঙ্ক মুখার্জি—অর্থাৎ ‘মুখার্জি কাকু’, যিনি তিনতলার এক কোনা ফ্ল্যাটে থাকেন। সারা জীবন ব্যাঙ্কে চাকরি করে অবসরে এসেছেন। চা নিয়ে বারান্দায় বসে থাকাই তার অভ্যেস, আর সেই সূত্রেই বহু জিনিসই তাঁর চোখে পড়ে যায়—যেগুলো অন্য কেউ বুঝেও বোঝে না। তিনিও খেয়াল করেছেন, পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটা প্রতিদিন এক নির্দিষ্ট সময়ে জানালার ফাঁকে আসে। আবার এক ছেলেও ঠিক ওই সময়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। কোনওদিন কথা হয় না, কোনওদিন চিঠি নয়, হঠাৎ একটানা নিঃশব্দ দৃশ্য দেখে মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের সিনেমার মতো কিছু। শশাঙ্কবাবু মৃদু হেসে বলেন নিজের মনেই—“ভালোবাসা কি এতটাই শব্দহীন হয়? নাকি এখনকার প্রজন্ম চুপচাপেই ভালোবাসতে শিখে গেছে?”
একদিন বিকেলে শশাঙ্ক মুখার্জি নিচে নামছিলেন চা খেতে। পথে দেখা হয়ে যায় পিয়ালীর সঙ্গে। কথায় কথায় উঠে আসে ছেলের ফ্ল্যাট ছেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ।
“অনির্বাণ নাকি খুব শিগগিরই বদলি হয়ে যাবে বেঙ্গালুরু,” মুখার্জি কাকু বললেন।
পিয়ালীর চোখে ছায়া পড়ে। “তাই নাকি? ও ছেলে তো বেশ চুপচাপ গোছের… কিন্তু ভালো। অদ্রিজারও তো চোখে পড়েছে বোধহয়…”
মুখার্জি কাকু মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, “চোখে পড়েছে শুধু নয়, সম্ভবত হৃদয়েও ঢুকে পড়েছে। তবে শব্দ ছাড়া প্রেম গড়া যায় কি?”
পিয়ালী কিছু বলেন না। ভাবেন—যদি সত্যিই ছেলেটি চলে যায়, মেয়েটা তাহলে কীভাবে মেনে নেবে? যাকে সে দিনের পর দিন কল্পনায় লালন করেছে, তার হঠাৎ চলে যাওয়া কি তাকে ভিতর থেকে ভেঙে দেবে না?
পাঁচ
সেই সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য রকম এক শব্দে—বাক্স সরানোর শব্দ, গাড়ির হর্ণ, ফ্ল্যাটের করিডোরে অচেনা পুরুষ কণ্ঠের ব্যস্ত হাঁকডাক। অদ্রিজা নিজের ঘরেই ছিল, চোখে বই ছিল বটে, কিন্তু মন যেন বাতাসে ভেসে থাকা শব্দের গতিপ্রকৃতি গুনছিল। অল্প কিছুক্ষণ পর, জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল—অনির্বাণের ফ্ল্যাটের সামনে ত্রিপল মোড়ানো একটা বড় ট্রাভেল ব্যাগ রাখা, আর এক লোক বারবার ডাকে, “স্যার, এটা নিচে নামাব?” অদ্রিজার বুকের ভেতর যেন কিছু একসাথে গুঁড়িয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়ায়, জানালার পাশে যায়, এবং হঠাৎ বুঝতে পারে—এই ছেলেটি চলে যাচ্ছে। সত্যিই চলে যাচ্ছে! যাকে প্রতিদিন নিজের চোখ দিয়ে মাপত, কল্পনায় সাজাত, নিঃশব্দে ভালোবেসে উঠেছিল—সে আজ বাড়ি ছাড়ছে।
তারপর সবকিছু যেন অস্পষ্ট হয়ে যায়। অনির্বাণ বেরিয়ে আসে, হাতে একটা ব্যাগ, চোখে কালো চশমা, মুখে সেই চিরচেনা নিরাসক্ত অভিব্যক্তি। তার পাশে এক বৃদ্ধ লোক—সম্ভবত বাবা—চুপচাপ দরজা তালা দিচ্ছে। অদ্রিজা থেমে যায়, এক বিন্দু শব্দ ছাড়াই তার মন যেন চিৎকার করে ওঠে। “তুমি চলে যাচ্ছো? আমি তো কিছু বলিনি এখনও… তোমাকে জানাতে পারিনি—তুমি আমার জীবনের প্রতিটি দিনের প্রতিধ্বনি হয়ে গেছ।” চোখ ভিজে ওঠে। সে মাথা ঘুরিয়ে জানালা থেকে সরে যেতে চায়, কিন্তু পা যেন বাঁধা পড়ে যায়। আর একবার তাকায়—অনির্বাণ হঠাৎ সামনের ফ্ল্যাটগুলোর দিকে একবার চোখ বোলায়, যেন শেষবারের মতো কিছু খুঁজছে। মুহূর্তটা থমকে যায়। কিন্তু সে কিছু দেখে না, কিছু বলেও না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়, চাবি ঘোরার শেষ শব্দটুকু যেন একটা যন্ত্রণার ছুরির মতো কানে বাজে।
অদ্রিজা সারা বিকেল একটানা বিছানায় শুয়ে থাকে। ডায়েরির পাতাগুলো খুলে রেখে দেয় চোখের সামনে। সেখানে সে লিখে রেখেছিল অসংখ্য মুহূর্ত, প্রতিটি দিন, প্রতিটি অনুভব, যা তার মনের একচেটিয়া প্রেমের আখ্যান। এখন মনে হচ্ছে, সেসব সবই কি তবে নিজের একক নাটক ছিল? তার হৃদয়ের প্রতিধ্বনি কি কেবল একতরফা প্রতিচ্ছবি? জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে শুধু দেখেছিল ছেলেটিকে—আর এখন সেই জানালার বাইরে শূন্যতা। বাতাস থেমে গেছে, বারান্দা এখন আর কারও ব্যালকনি নয়, শুধু এক ফাঁকা ফ্রেম—যার ভিতর থেকে কেউ চলে গেছে, নীরবে, একবিন্দু শব্দ ছাড়াই। অদ্রিজা কেবল জানে, আজ থেকে তার প্রতিদিনের কল্পনার গল্পগুলো লেখা হবে না আর। আর কেউ জানালার সামনে দাঁড়াবে না ঠিক বারোটা নাগাদ। তার জীবনের নিঃশব্দ সংলাপ আজ শেষ হয়ে গেল, অথচ সে এখনো একটাই প্রশ্নে আটকে আছে—”তোমার চোখে কি কোনোদিন আমার ছায়া পড়েছিল?”
ছয়
দুপুরের আলো জানালার কাচ ছুঁয়ে পড়ছে মেঝের ওপরে, কিন্তু এখন আর সেই আলোয় কোনও প্রতিফলন নেই। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার কেউ নেই, জানালার গ্লাসে আর কেউ ছায়া ফেলে না। অনির্বাণের ফ্ল্যাট এখন বন্ধ, তালাবন্ধ দরজার গায়ে এক চিলতে ধুলো জমেছে। অদ্রিজা সকালে উঠে সেই ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকে—যেন কোনো অলৌকিক ভরাট মুহূর্ত খুঁজছে যা এক সময় ছিল। তবু আশ্চর্যভাবে, অনির্বাণ চলে যাওয়ার পরও অদ্রিজার দিনযাপন যেন একইভাবে চলছে। জানালার ধারে বসা, চুপ করে লেখা, সেই নির্দিষ্ট সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের দিকে তাকানো—সবই অব্যাহত, যেন অনির্বাণ নেই, কিন্তু তার ছায়া ঠিক পাশেই কোথাও রয়ে গেছে। প্রতিদিন অদ্রিজা ভাবে, “আজ যদি হঠাৎ দরজাটা খুলে যায়?” কিন্তু জানে, কেউ ফিরবে না।
সে আবার খুলে ফেলে সেই পুরনো ডায়েরি—‘প্রতিধ্বনি’। তার ভেতরে লেখা শেষ বাক্যটি ছিল: “আজ তোমার ব্যালকনিতে বৃষ্টির জল পড়ছিল, তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে ছাতা ছাড়াই, আমি ভেবেছিলাম—যদি ছুটে যাই আর বলি, ‘ভিজে পড়বে তো’, তুমি কি শুনতে?” এখন সেই লেখা পড়ে মনে হয়, যেন কোনো পুরনো চিঠি, যা কোনোদিন পাঠানো হয়নি। সে নতুন একটা পৃষ্ঠা খুলে লিখে—“আজ তুমি নেই। কিন্তু আমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক আগের মতো। তুমি চলে গেলে, অথচ তোমার অনুপস্থিতি আমার চারপাশে এমনভাবে জড়িয়ে আছে, যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসে তুমি ফিরে আসো।” তার লেখাগুলোর মধ্যে ক্রমেই বাস্তব ঢুকে পড়ছে, তবু সেসব লেখায় এখনো স্বপ্নের রং রয়ে গেছে। সে ভাঙা মনে নিজেকেই বোঝায়—যা ছিল, তা ছিলই। তার কল্পনা ছিল সত্যিকারের অনুভব।
একদিন বিকেলে শশাঙ্ক কাকু নীচে থেকে উঠে এসে দরজায় নক করেন। অদ্রিজা দরজা খোলে। হাতে ধরা একটা পাতলা খাম এগিয়ে দেন কাকু। বলেন, “অনির্বাণ গিয়েছিল হঠাৎ করেই। যাওয়ার আগে ফ্ল্যাট ছাড়ার সময় একটা খামে কিছু লিখে রেখে গিয়েছিল, দারোয়ান নাকি আমাকে দিয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম তোমার কাছে দেওয়াটাই ঠিক।”
অদ্রিজা অবাক হয়ে খামটা নেয়। তাতে নাম লেখা নেই, শুধু লেখা—”তুমি জানালায় ছিলে প্রতিদিন। আমি শুনতাম।”
তার বুক কেঁপে ওঠে। হাত কাঁপে। ধীরে ধীরে খাম খুলে, ভিতরের কাগজে চোখ রাখে—
“তুমি জানালার ধারে গাইতে গাইতে বসে থাকতে, আমি শুনতাম। জানি না তুমি জানো কি না, আমি তোমাকে অনেকবার দেখতে গিয়েছি, অনেক কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু ওই জানালার ফাঁকের নিরবতায় তুমি এতটা নিখুঁত ছিলে যে, কোনো শব্দে তা নষ্ট করতে চাইনি।”
“তুমি হয়তো ভাবো, আমি কিছুই বুঝিনি। কিন্তু প্রতিদিন আমি শুনতাম তোমার প্রতিধ্বনি।”
অদ্রিজা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে জল জমে। সমস্ত জগতের শব্দ থেমে যায় সেই মুহূর্তে। জানালার কাচে এক ঝলক আলো পড়ে, এবং সেই প্রতিফলনে সে নিজেকে দেখে—একটি মেয়ে, যাকে কেউ সত্যিই দেখেছিল, শুনেছিল, ভালোবেসেছিল—নীরবে, তার মতোই।
সাত
চিঠিটা অদ্রিজার বিছানার পাশে টেবিলটায় পড়ে আছে, কিন্তু তার প্রভাব যেন পুরো ঘরটাকেই নীরব আলোয় ভরিয়ে রেখেছে। সে বারবার পড়ে সেই অল্প কিছু শব্দ—প্রতিটি লাইনে এক অচেনা স্পর্শ, যেটা কোনোদিন ছিল না, অথচ আজ এত স্পষ্ট। এতদিন ধরে যে ভালোবাসা কেবল তার মনেই ছিল বলে ভেবেছিল, সেই ভালোবাসা আসলে দু’জনের মাঝেই গড়ে উঠেছিল—শব্দ ছাড়া, সংলাপ ছাড়া, কেবল অনুভবের স্তরে। চিঠিতে অনির্বাণ যেভাবে লিখেছে, “তোমার গান শুনে দিন শুরু করতাম। জানতাম, তুমি আছো—জানালার ওপারে, নিঃশব্দে। তাই কথা বলিনি। কারণ, তোমার নীরবতাই সবচেয়ে সুন্দর ছিল,”—এই লাইনগুলো যেন অদ্রিজার হৃদয় জুড়ে প্রতিধ্বনির মতো ঘুরতে থাকে।
সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। এখন আর জানে, অনির্বাণ শুধু ওকে দেখেনি, শুনেছিল। প্রতিটি মুহূর্তে, যখন সে কল্পনায় অনির্বাণকে খুঁজত, তখন অনির্বাণও একইভাবে তার প্রতিধ্বনিতে কান পাতত। শুধু তারা কেউ শব্দ করেনি, কেউ দুঃসাহস দেখায়নি। কেউ প্রেমে পড়েছিল, কেউ প্রেমে লুকিয়েছিল। অদ্রিজা এবার নিজেকে দোষ দেয় না। সে জানে, তার প্রতিদিনের ভাবনা, ছোট ছোট অভিমান, গান গেয়ে অনির্বাণকে শোনানো—সব কিছুই প্রতিফলিত হচ্ছিল সেই নীরব ছেলেটির ভিতরেও। যে কখনো কিছু বলেনি, কিন্তু প্রতিদিন শুনেছে, অনুভব করেছে। তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এক পলকের চোখাচোখি নয়, বরং না দেখা, না বলা, নিঃশব্দ সংলাপে।
চিঠি পড়ে শেষ করার পর, অদ্রিজা প্রথমবার ডায়েরির পাতায় লিখল একটিই লাইন:
“আমার প্রতিধ্বনি শুনেছিলে তুমি—তাই আমি এখন নিশ্চিন্ত।”
তারপর জানালার কাচে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল। তার মনে হচ্ছিল, অনির্বাণ যেন ঠিক পাশেই আছে—একটি সমান্তরাল সময়ে, একটি ভিন্ন বাস্তবতায়। সে আর মনখারাপ করে না। কোনো আফসোস নেই—কারণ ভালোবাসার প্রকাশ না থাকলেও, তার উপস্থিতি ছিল, গভীরভাবে। সে জানে, কিছু সম্পর্ক শব্দ ছাড়াই জন্মায়, বাঁচে, এবং থেকে যায়—একটি চিঠি, একটি প্রতিধ্বনি, অথবা জানালার কাচে পড়া আলোয়।
আট
অনির্বাণ চলে যাওয়ার পর কেটে গেছে বহুদিন। ফ্ল্যাটের নতুন বাসিন্দা এসেছে—এক নবদম্পতি। জানালার কাঁচে নতুন পর্দা, ব্যালকনিতে শোভা পাচ্ছে দুটো সাদা নরম চেয়ার আর গাছের টব। অদ্রিজা এখন আর রোজ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে না, কিন্তু জানালাটা ঠিক আগের মতোই খোলা থাকে, যেন স্মৃতির বাতাস ঢুকতে পারে। প্রতিদিনকার সেই সময়ে, যখন সে আগে জানালায় বসে অনির্বাণকে দেখত, এখন সে বই পড়ে বা চুপ করে গান শোনে—তবে মাঝে মাঝে, হঠাৎ করে যেন মনে পড়ে যায় কিছু একটা। অল্প হাওয়া বয়ে গেলে জানালার কাচে পড়ে এক চেনা ছায়া। তার মনে হয়, এখনও যেন কেউ প্রতিধ্বনি দিচ্ছে—একটা দীর্ঘ নীরবতা থেকে উঠে আসা ডাক।
অদ্রিজা এখন অনেকটাই বদলে গেছে। তার ভেতরটা আগের মতো নরম রয়ে গেলেও, সে বুঝে গেছে—ভালোবাসা সবসময় প্রকাশের দাবি করে না। ভালোবাসা শব্দ চায় না, চায় উপস্থিতি। অনির্বাণ তার জীবনে যে নীরব প্রেম রেখে গেছে, তা আজও অদ্রিজাকে উষ্ণ করে। সে আজও ডায়েরিতে লেখে, মাঝে মাঝে সেই পুরনো পাতাগুলো পড়ে, আর মৃদু হাসে। তার সেই কিশোরী সত্তা, যে ভাবত—ভালোবাসা মানে হাত ধরা, চোখে চোখ রাখা—আজ জানে, ভালোবাসা মানে কখনও কখনও জানালার কাচের দু’প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মানুষ, যারা কথা না বলেও প্রতিদিন একে অপরকে জানায়, “আমি আছি। আমি শুনছি।”
একদিন বিকেলে, অদ্রিজা আবার সেই পুরনো চিঠিটা খুলে পড়ে। পড়তে পড়তেই হঠাৎ তার মনে হয়, এই নীরবতা শুধু একসময়ের নয়—এটা আজও চলমান। হয়তো কোথাও, অন্য কোনো শহরে, অন্য কোনো জানালার পাশে অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছে, চোখ বন্ধ করে শুনছে বাতাসে মিশে থাকা কোনো সুর, যে সুর একদিন তার সকাল শুরু করত। অদ্রিজা ধীরে পায়ে এগিয়ে যায় তার জানালার ধারে। সন্ধ্যার আলো মিশে যাচ্ছে গোধূলির আকাশে। সে জানালার কাচে আঙুল দিয়ে একটা অদৃশ্য রেখা টেনে দেয়, যেন স্মৃতির ক্যানভাসে অনির্বাণের প্রতিচ্ছবি আঁকে। তারপর নিচু গলায় বলে—
“আমি এখনো আছি। যদি কোনোদিন ফিরে আসো, জানালার এই পাশে তোমার প্রতিধ্বনি ঠিকই অপেক্ষা করছে…”
সমাপ্ত



