অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
কলকাতার গরম রোদের মধ্যে দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এক সাদা রঙের সেকেন্ড হ্যান্ড জিপ গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে দীপ, চশমার কাচে ঘাম জমে গেছে, কপালে টপটপ করে ঘামের ফোঁটা পড়ছে। পাশে বসে অমিত, রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় কাপড়ের ফেট্টি বেঁধেছে। ওদের দুজনের মুখেই রোমাঞ্চ আর উত্তেজনার ছাপ।
“আর কত দূর, দীপ?” অমিত হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে।
“আর বেশি না। এই বুঝি মদনপুর পৌঁছে গেলাম,” দীপ বলে।
রাস্তা সরু হয়ে এসেছে। দুপাশে বিস্তৃত ধানের মাঠ, মাঝে মাঝে নারকেল আর তালগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। একপাশ দিয়ে সরু খাল বয়ে চলেছে। হালকা বাতাসে ধানের শীষ দুলছে, যেন প্রকৃতির মৃদু স্বর।
দু’জনেই শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে এমন নির্জন গ্রামে এসেছে। তবে শুধু মুক্তিই নয়, রহস্যের হাতছানি ওদের এখানে টেনে এনেছে। মদনপুরের পোড়োবাড়ির গল্প কলকাতার এক বইমেলায় পুরনো বইয়ের দোকানে বসে প্রথম শোনে দীপ। সেই বইয়ে লেখা ছিল — “মদনপুরে তালগাছের ছায়ায় এক পোড়োবাড়ি, যেখানে নিশির ডাক শোনা যায়। সাহস থাকলে যাও, অভিশপ্ত বাড়ির কাহিনি জানতে।”
ওরা দুজনেই ছাত্রজীবন থেকে রহস্য আর ভুতুড়ে গল্পের বড় ভক্ত। সুযোগ পেলেই ভ্রমণ আর রহস্য মিলিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়ে।
মদনপুর গ্রামে ঢোকার সময় ওরা টের পেল পরিবেশটা কেমন যেন নিস্তব্ধ। দুপুর হলেও গ্রামের রাস্তায় খুব বেশি লোকজন নেই। দু’একজন কৃষক দূরে মাঠে কাজ করছে। এক বৃদ্ধ নদীর ঘাটে বসে জাল সেলাই করছে। ছোটো ছোটো কুঁড়েঘর, কিছু পাকা বাড়ি। দূরেই দেখা যাচ্ছে সেই তালগাছের সারি আর ভাঙা পোড়োবাড়ি।
“ওই যে দীপ! দেখ, ওটাই বোধহয় সেই পোড়োবাড়ি,” অমিত আঙুল তুলে দেখায়।
দীপ জিপ থামিয়ে দেয় রাস্তার ধারে। গাড়ি থেকে নেমে দুজনেই একদৃষ্টে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। দিনের আলোয় বাড়িটা বেশি ভুতুড়ে না হলেও একরকম মনখারাপ করা নিঃসঙ্গতা জাগায়। কালো হয়ে যাওয়া দেওয়াল, ছাদ ভাঙা, জানালার গরাদ বেঁকে গেছে। দেওয়ালে লতাপাতা জড়িয়ে আছে। বাড়িটার চারপাশে ঘন ঘাস আর ঝোপঝাড়।
“দেখলিই তো, অমিত। এটাই আমাদের অভিযান শুরুর জায়গা,” দীপ হাসল। কিন্তু সেই হাসির মধ্যে একটু স্নায়ুচাপ লুকানো ছিল।
গ্রামের এক ছেলেকে ডেকে ওরা জিজ্ঞেস করল, “বাবু, এখানকার অতিথিশালাটা কোথায়?”
ছেলেটি প্রথমে ভয়মিশ্রিত চোখে ওদের দেখে, তারপর হাত তুলে বলে, “ওদিকে পাকুড় গাছের পাশে আছে দাদু। ওখানেই থামেন। তবে ওই বাড়ির কাছে বেশি যাইয়েন না, হে।”
দীপ হেসে বলে, “কেন রে? ওখানে কী আছে?”
ছেলেটি আর কিছু বলে না। দ্রুত চলে যায়।
পাকুড় গাছের নিচে গ্রামের এক ছোটো অতিথিশালা — কাদা মাটি আর টালির ছাদের তৈরি। এক বৃদ্ধ মানুষ দরজায় বসে বিড়ি খাচ্ছিলেন। দীপ-অমিত গিয়ে তাকে নমস্কার জানায়।
“নমস্কার কাকা। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। দুদিনের জন্য থাকতে চাই।”
বৃদ্ধ হালকা হাসলেন। “কলকাতা থেকে? এখানে কি কাজ আপনাদের?”
দীপ হেসে বলে, “ভ্রমণ আর… শুনেছি আপনাদের গ্রামে এক পুরনো পোড়োবাড়ি আছে, সেটাও দেখতে চাই।”
এই কথা শোনা মাত্রই বৃদ্ধের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি বিড়িটা ফেলে পায়ের তলায় পিষে দিয়ে বলেন,
“ওসব বাড়ির কথা মুখেও আনবেন না। সেই বাড়ির নাম মুখে আনলেই নাকি অমঙ্গল হয়। থাকবেন তো থাকুন বাবু, কিন্তু রাত হলে ঘরের বাইরে বের হবেন না।”
অমিত আর দীপ মুচকি হাসে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অজানা শিহরণ বয়ে যায় দুজনের মনে।
ঘর পেতে দেয় বৃদ্ধ। মাটির ঘর, একপাশে কাঠের খাট, ছিটে দেওয়া মশারি, এক কোণে মাটির প্রদীপ রাখার জায়গা। ঘরের জানালা দিয়ে দূরে সেই পোড়োবাড়ি দেখা যায়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। অতিথিশালার উঠোনে বসে চা খেতে খেতে দুজনেই সেই পোড়োবাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে আলো কমে আসে। তালগাছগুলো অন্ধকারে ছায়ার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাসে তালপাতার সোঁ সোঁ শব্দ হয়। দূরের কুকুরগুলো হঠাৎ করে চিৎকার করে ওঠে।
গ্রামের এক বুড়ো লোক সেই সময় অতিথিশালার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। অমিত ডেকে বলে, “দাদু, একটু বসুন না। আপনার কাছ থেকে গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে।”
বুড়ো লোকটি বসেন, নাম বলেন — নৃপেন দাশ।
দীপ জিজ্ঞাসা করে, “নৃপেন দাদু, ওই পোড়োবাড়ির গল্পটা বলবেন? সত্যি কি ভুত থাকে ওখানে?”
নৃপেন দাশ দীপের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলেন —
“ও বাড়ি অভিশপ্ত। সেই বাড়িতে নিশি থাকে। রাত বারোটার পর যদি কেউ ডাকে, তাকালে আর রক্ষে নেই। এই গ্রামে কত লোক উধাও হয়েছে জানো? নিশির ডাক শুনে ভুল করে সাড়া দিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তারা।”
অমিত চমকে ওঠে।
“কিন্তু দাদু, সত্যিই কি এসব হয়? আমরা তো জানতে চাই, আসল রহস্যটা কী।”
নৃপেন দাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“যা ইচ্ছে করো বাপু, তবে সাবধান থেকো। নিশির সাথে খেলা করো না।”
এই বলে তিনি ধীরে ধীরে অন্ধকারে হারিয়ে যান।
রাতে ঘরে ফিরে দীপ আর অমিত শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। সেই পোড়োবাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক অজানা টান অনুভব করে তারা।
সেই রাতেই সিদ্ধান্ত হয় — পরের রাত বারোটায় ওরা পোড়োবাড়িতে ঢুকবে।
***
গ্রামের সেই গভীর নীরব রাত, তালপাতার ফাঁক দিয়ে হালকা চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে মাঠের ওপরে, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অমিত আর দীপ দেখছে সেই পোড়োবাড়িকে। পোড়োবাড়িটার দেওয়ালগুলো যেন অন্ধকারে আরও কালো আর রহস্যময় হয়ে উঠেছে, লতাপাতা জড়িয়ে তার শরীর, ফাটল ধরা জানালাগুলো ভাঙা দাঁতের মতো তাকিয়ে আছে অন্ধকারে। দুজনেই অতিথিশালার ছোট উঠোনে বসে আছে, হাতে ধরা কাঁচের গ্লাসে চা, যা ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। দীপ ফিসফিসিয়ে বলল, “অমিত, এই বাড়িটা না অদ্ভুত টানছে যেন। দিনের বেলা যেমন দেখে মনে হয়েছিল একটা ভাঙা কাঠামো ছাড়া কিছু না, এখন মনে হচ্ছে এর দেয়ালগুলো আমাদের দিকে চেয়ে আছে।’’ অমিত সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ দীপ, আমি বুঝতে পারছি। ওই বাড়িটার মধ্যে এক অদ্ভুত গুমোট ভাব আছে, যেটা দূর থেকেও টের পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে কোনো এক আশ্চর্য কষ্ট আর কান্না যেন সেই বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে।’’ সেই মুহূর্তে অতিথিশালার বাইরে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন গ্রামের এক বৃদ্ধ — কুঁজো পিঠ, লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে চলেছেন, গায়ে ধুতি, গলায় এক সময়ের উজ্জ্বল ছিল এমন এক গেরুয়ার উত্তরীয়। দুজনেই ডেকে বলল, “দাদু, দাঁড়ান না একটু।’’ বৃদ্ধ থেমে দাঁড়ালেন, তার চোখদুটি যেন আলো-অন্ধকার মিশ্রিত রাতের মধ্যেও জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে অতিথিশালার পাটের খাটিয়ায় বসে পড়লেন। দীপ আর অমিত একসাথে বলল, “দাদু, আপনি কি এই গ্রামের সব কথা জানেন? আমরা ওই পোড়োবাড়ির গল্প শুনতে চাই।’’ বৃদ্ধ একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। কপালের কুঁচকানো ভাঁজগুলো স্পষ্ট দেখা গেল চাঁদের আলোয়। “ওই বাড়ি নিয়ে কথা বলো না বাবা, ওই বাড়ি অভিশপ্ত।’’ অমিত আর দীপ চমকে উঠল। দীপ বলল, “অভিশপ্ত? কীভাবে দাদু? কী হয়েছে ওখানে?” বৃদ্ধ লাঠি হাতে মাটিতে আলতো ঠুকতে ঠুকতে বলতে লাগলেন, “শুনো বাপু, অনেক বছর আগে, হয়তো আজ থেকে পঁচাত্তর-আশি বছর আগে, এই গ্রাম তখনও অনেক ছোট, মানুষজনও সরল, সহজ। তখনও মদনপুরের প্রান্তে ওই বাড়ি নতুন। গাঁয়ের সবচেয়ে বড় জায়গীর ছিলেন রাজনারায়ণ মুখুজ্জে, বড় জমিদার। তাঁর বাড়ি ছিল ওই পোড়োবাড়ি, তখনকার দিনে বড় পাকা বাড়ি ছিল ওটা। রাজনারায়ণ বাবুর একমাত্র ছেলে হরিহরবাবু বিয়ে করল কলকাতার এক অভিজাত পরিবারের মেয়েকে — সরলা নাম তার। সরলা ছিল খুবই সুন্দরী, লাজুক আর ভদ্র। গলায় মুক্তোর মালা, হাতে শাখা-পলা, চোখে বড় বড় স্বপ্ন। কিন্তু জানো বাপু, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বিয়ের ক’দিনের মধ্যেই সরলা বুঝে গেল তার শ্বশুরবাড়ি অভিশপ্ত। রাজনারায়ণ ছিল নিষ্ঠুর, তার পুত্র হরিহর বাবু ছিল পিতার পুতুল, আর ঘরে ছিল অশান্তি আর হিংসা। সরলার মায়ের মতো জীবন কাটল না, সে দিনের পর দিন নিপীড়নের শিকার হতে থাকল। গ্রামের মানুষরা রাতের বেলা ওই বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ শুনত, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পেত না।’’
“তারপর এক অমাবস্যার রাত। সেই রাতে নাকি কালো মেঘে আকাশ ঢাকা ছিল, তালগাছের মাথা ঝড়ো হাওয়ায় দুলছিল। সরলার নিঃশব্দ কান্না গিলে খাচ্ছিল পোড়োবাড়ির দেয়ালগুলো। হঠাৎ ভোর রাতে গ্রামের মানুষ শুনল এক হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল না, শাসকের ভয়ে। সকালে গুজব রটে গেল — সরলা নেই, সে নাকি পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। রাজনারায়ণ লোক সাজিয়ে বলল — ‘বউমা পাগল হয়ে গিয়েছিল, তাই নিজের প্রাণ নিল।’ কিন্তু গ্রামের মানুষ জানত, সে নিজের প্রাণ নেয়নি, তাকে বলি দেওয়া হয়েছে। লোককথায় শোনা যায়, ওই রাতেই নাকি সরলার আত্মা বন্দী হয় ওই বাড়ির ভেতর। তখন থেকে রাত হলেই ও বাড়ি থেকে ভেসে আসে এক নারীর কান্না, ফিসফিসানি — ‘আমায় বাঁচাও, আমায় মুক্তি দাও।’ যারা সেই ডাক শুনে তাকিয়েছে বা সাড়া দিয়েছে, তারা আর বাঁচেনি। কেউ বনে গিয়ে নিখোঁজ, কেউ পাগল হয়ে গেছে। গ্রামের লোক ও বাড়ির পাশ দিয়ে রাতের বেলা যায় না। দিনের বেলায়ও সেই বাড়ির ছায়া পড়া মাটিতে পা রাখে না।’’ বুড়ো পণ্ডিত থেমে গেলেন কিছুক্ষণ, চোখে জল জমে উঠেছিল হয়তো বা আলো-ছায়ার খেলায় মনে হলো। দীপ আর অমিত নিঃশব্দে শুনছে, গলার স্বরও কাঁপছে যেন ভয়ে, না কৌতূহলে বোঝা মুশকিল। দীপ ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “দাদু, সরলার আত্মা কি আজও আছে সেখানে?” পণ্ডিত মশাই মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ বাপু, আছে। ও মুক্তি চায়, কিন্তু ওর কান্না কেউ শোনে না, আর যারা শোনে তারা আর ফিরে আসে না। গ্রামের কত ছেলে হারিয়ে গেছে জানো? নিশির ডাক মানে মৃত্যু ডাক, বাপু। তাই বলি, যদি জান বাঁচাতে চাও, ওই বাড়ির ধারেকাছেও যেয়ো না।’’ অমিত ধীরে ধীরে বলে, “কিন্তু দাদু, আমরা তো সত্যি জানতে চাই। ভয়কে জয় করতে চাই। যদি ওখানে কিছু থাকে, তাহলে তার কারণ তো খুঁজে বের করা দরকার।’’ বুড়ো পণ্ডিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাপু, মানুষের বুদ্ধি অনেক কিছু বোঝে, কিন্তু আত্মার কান্না বোঝে না। অতএব সাবধান।’’ তিনি উঠে দাঁড়ালেন, লাঠি ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে যেতে শেষ কথাটা বললেন, “যদি নিশির ডাক শোনো, চোখ তুলবে না। ডাক শোনার পর চোখ তুলে তাকালে, সে তোমার প্রাণ নিয়ে নেবে।’’
বৃদ্ধ চলে যাওয়ার পর রাতটা আরও গা ছমছমে হয়ে উঠল। বাতাস যেন স্তব্ধ, তালগাছগুলো থম মেরে গেছে। দূর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। দীপ আর অমিত নীরবে বসে রইল অনেকক্ষণ, গায়ে হালকা কাঁপুনি অনুভব করছিল দুজনেই। শেষমেশ তারা ঘরে ফিরে এল। ঘরের ভেতরে সেই পোড়োবাড়ি অন্ধকারে কালো ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছিল। মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে দীপ ফিসফিসিয়ে বলল, “অমিত, তুই কী ভাবছিস?” অমিত বলল, “আমি ভাবছি কাল রাতেই ঢুকতে হবে ওই বাড়িতে। এত দূর এসে পিছিয়ে যাব? রাজনারায়ণ আর সরলার কাহিনি যদি সত্যিই হয়, তাহলে সেই সত্যি আমাদের সামনে আসতে হবে। আমাদের সাহসিকতার প্রমাণ দিতে হবে।’’ দীপ কাঁপা গলায় বলল, “দেখ ভাই, আমি তোর সাথে আছি, কিন্তু সতর্ক থাকব। আমরা আমাদের সরঞ্জাম ঠিক রাখব — টর্চ, লণ্ঠন, রেকর্ডার, ক্যামেরা — সব নিয়ে যাব।’’ অমিত বলল, “ঠিক আছে, কাল সারাদিনে আমরা ঘুরে দেখে নেব বাড়ির চারপাশ। তারপর রাত বারোটার পর ঢুকব।’’ দুজনেই তখন জানত না, সেই রাত তাদের জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। তারা জানত না, সেই নিশির কান্না আর ডাক তাদের ঘুম কেড়ে নেবে, তাদের মনোজগতের গভীরে অমোচনীয় দাগ ফেলে দেবে। গ্রামের সেই রাত চুপচাপ ছিল, কিন্তু বাতাসে ভেসে আসছিল এক নারীর কান্নার মৃদু ধ্বনি — হয়তো বা কল্পনা, হয়তো বা বাস্তব।
***
পরের দিন সূর্য উঠে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। মদনপুর গ্রামে ভোরের আলো যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখনও দীপ আর অমিতের ঘুম ভাঙেনি ঠিকমতো। রাতের সেই আলো-অন্ধকারের ভয়াল গল্প, বুড়ো পণ্ডিত মশাইয়ের সতর্কবার্তা আর নিজেরাই নিজের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি — সব মিলে তাদের মনে এক অদ্ভুত দোলাচল কাজ করছিল। দীপের ঘুম ভাঙল প্রথমে। সে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দূরের তালগাছগুলো সকালবেলার মিষ্টি হাওয়ায় দুলছে, আর তার ফাঁক দিয়ে সেই পোড়োবাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দিনের আলোয় বাড়িটা রাতের মতো অত ভয়ঙ্কর লাগছিল না, কিন্তু এক ধরনের নিঃসঙ্গতা আর শূন্যতা যেন এখনও মুড়ে রেখেছে বাড়িটার চারপাশ। ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে লতাগুল্ম জড়িয়ে আছে, আর দূর থেকে কাকগুলো ছাদে বসে আঁকাবাঁকা ডানা মেলে বসে আছে। দীপ একবার চোখ বন্ধ করে রাতের সেই বুড়ো পণ্ডিতের গলা মনে করার চেষ্টা করল — “যদি নিশির ডাক শোনো, চোখ তুলবে না। ডাক শোনার পর চোখ তুলে তাকালে, সে তোমার প্রাণ নিয়ে নেবে।” তার গায়ে হালকা কাঁপুনি বয়ে গেল। সেই সময় অমিতও ঘুম থেকে উঠে পড়ল। “দীপ, আজ আমাদের সাহসিকতার দিন। আজই আমরা দিনের আলোয় ওই বাড়িটা ঘুরে দেখব। আমি আর এইভাবে কল্পনায় ভয় পেতে চাই না,” বলল অমিত, তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, যদিও দীপ বুঝতে পারছিল সেই কণ্ঠের নিচে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত শঙ্কা। দুজনে দ্রুত তৈরি হল। সঙ্গে নিল ছোটো একটা ব্যাগ — তাতে রাখা হল একটি টর্চলাইট, একটি রেকর্ডার, এক জোড়া মোটা দড়ি, নোটবুক আর পেনসিল। দীপ তার পকেটে ছোট্ট কম্পাস আর পকেট নকশাটা গুঁজে নিল, যা আগের রাতেই অতিথিশালার বুড়ো ম্যানেজারকে দিয়ে অঙ্কন করিয়েছিল। তারা অতিথিশালার বারান্দা পেরিয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করল। গ্রামের কিছু লোক তাদের কৌতূহলভরা চোখে দেখল, আর কয়েকজন ফিসফিস করে কিছু বলল, যা তারা স্পষ্ট শুনতে পেল না। গ্রামের এক বালক এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তাদের দেখল, যেন দুজনেই কোনও পরপারের পথিক।
তাদের পায়ের নিচে শুকনো পাতা কড়কড়িয়ে ভাঙছিল, আর সকালবেলার হালকা রোদে তালপাতার ছায়া নাচছিল তাদের গায়ে। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই তারা টের পেল, বাতাসের এক অদ্ভুত শীতলতা রয়েছে ওই বাড়ির চারপাশে। বাড়ির সামনে এক পুরনো পাথরের পুকুর, যার জলে শেওলা আর কিছু ভাঙা কাঁথা ভেসে আছে। পুকুরপাড়ে এক বুনো গাছ, তার শিকড় পুকুরের জলে নেমে গেছে। অমিত পুকুরের দিকে আঙুল তুলে বলল, “দীপ, বুড়ো পণ্ডিত বলছিলেন না, সরলা নাকি এই পুকুরেই ঝাঁপ দিয়েছিল? এখানেই তার সেই রাতের কাহিনি শেষ হয়েছিল!” দীপ কিছু বলল না, চুপচাপ পুকুরের জলে চোখ রাখল। সেই জলে যেন এক মরা নদীর শোক, এক থমকে যাওয়া কান্না লুকিয়ে আছে। দুজনেই এবার সাহস করে পোড়োবাড়ির ভেতরে পা রাখল। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই তারা বুঝতে পারল, বছরের পর বছর ধরে এই বাড়ির দেয়ালগুলো শুধু ভাঙেনি, ওরা যেন হাহাকার গিলেছে। এক সময়ের জাঁকজমকপূর্ণ বারান্দা, যা আজ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানে সময়ের পেছনে ফেরা। জানালার লোহার শিকগুলো মরচে ধরে খসে পড়ার মুখে, ঘরের ভেতর মেঝেতে শুকনো পাতা আর ধুলো জমেছে। পায়ের শব্দে সেই পাতা কড়কড় করে উঠে যাচ্ছে। অমিত তার রেকর্ডার অন করে বলল, “দিনের আলোয় পোড়োবাড়ি অভিযান। আমরা এখন বারান্দা পেরিয়ে মূল ঘরে ঢুকছি।” ঘরের ভেতর ছাদ ভাঙা, আকাশ দেখা যাচ্ছে। পাখির বাসা এক কোণে। ঘরের একপাশে পড়ে আছে ভাঙা পালঙ্কের কাঠ। হঠাৎ একটা কাক সেই বাসা থেকে উড়ে বেরিয়ে এলো, তার ডানার শব্দে দীপ চমকে উঠল। “কোনও ভুত নয়, কাক, দীপ,” অমিত হাসল। কিন্তু সেই হাসি এক অজানা অস্থিরতা লুকিয়ে রাখছিল।
দীপ ঘরের দেয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে দেখতে লাগল। দেয়ালে এক জায়গায় অদ্ভুত কিছু দাগ চোখে পড়ল — যেন কারও নখের আঁচড়, যা দেওয়ালের প্লাস্টার চিরে ফেলেছে। দীপ ফিসফিসিয়ে বলল, “অমিত, দেখ তো — এ দাগগুলো মানুষের নখের হতে পারে?” অমিত কাছে এসে দেখল, আর বলল, “এগুলো কেমন যেন বিশ্রী। নখের আঁচড় হলে ভয়ঙ্কর ব্যাপার। কার নখ, কীভাবে, কেন?” ঘরের ভেতর হঠাৎ বাতাসটা যেন ভারী হয়ে এল। সেই বাতাসে ধুলো উড়ে ঘরের কোণে জমা হতে থাকল। আর সেই ধুলোয় যেন অদৃশ্য পায়ের ছাপ তৈরি হল কিছুক্ষণ, যা অমিত আর দীপ দুজনেই দেখল। তারা দুজনেই স্তব্ধ, চেয়ে রইল সেই পায়ের ছাপের দিকে, যা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে গেল। অমিত কাঁপা গলায় বলল, “দীপ, এটা কী হল? আমাদের চোখে ধুলো পড়ছে, নাকি সত্যিই কিছু…?” দীপ বলল, “আমাদের চোখে ধুলো নয়। আমি নিশ্চিত, কিছু একটা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে।” তারা এবার আস্তে আস্তে ভেতরের আরেকটা ঘরে ঢুকল। সেই ঘর মনে হচ্ছিল কারও শোবার ঘর ছিল একদিন। মেঝেতে ভাঙা চৌকি পড়ে আছে, আর দেয়ালে এক কোণে কালো হয়ে যাওয়া আলপনা দেখা যাচ্ছে। আলপনার রঙ প্রায় মিলিয়ে গেছে, কিন্তু তাতে এখনো কিছু অক্ষর আর ছবি বোঝা যাচ্ছিল। দীপ নোটবুকে সেই অক্ষরের ছবি আঁকতে শুরু করল। অমিত লণ্ঠন জ্বালিয়ে ঘরটা আরও ভালো করে দেখতে লাগল। তখনই সে টের পেল মেঝের এক কোণে কিছু শুকনো লালচে দাগ আছে — খুব পুরনো রক্তের দাগ হতে পারে। সেই দাগের চারপাশে নাকি এক সময়ে শিকল বাঁধা ছিল, তার চিহ্নও মেঝেতে অদৃশ্য নয়। অমিত দীপকে দেখিয়ে বলল, “দেখ, ওখানে কী লালচে দাগ। সরলার সেই রাতের স্মৃতি কি এখানেই লুকিয়ে আছে?” দীপ ফিসফিসিয়ে বলল, “হয়তো… হয়তো ওইখানেই শেষবার সে লড়েছিল বেঁচে থাকার জন্য।” বাইরে তখন বাতাসে তালপাতার সোঁ সোঁ শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে শেয়ালের হালকা ডাক ভেসে এলো। দিনের আলোয় হলেও যেন সেই বাড়িটার ভেতর অন্ধকার আরো ঘন হয়ে উঠল। অমিত ঘরের এক কোণে পাথরের ছোট পিড়ি দেখল, যেখানে কিছু শুকনো ফুলের পাঁপড়ি ছড়ানো, আর তার ওপরে মাটির ছোট প্রদীপ পড়ে আছে, যা অনেক বছর আগেই নিভে গেছে। সেই প্রদীপ যেন সাক্ষী ছিল সেই রাতের কান্নার। দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল আস্তে আস্তে, আর শেষবারের মতো পোড়োবাড়ির ছাদহীন আকাশের দিকে তাকাল। তারা বুঝল — দিনের আলোয় বাড়িটা শুধু ইট-কাঠের ধ্বংসাবশেষ নয়, এখানে লুকিয়ে আছে এক যন্ত্রণার ইতিহাস, এক অমোচনীয় অভিশাপ। তারা বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে, কিন্তু তাদের মনে স্থির হয়ে বসে রইল সেই পায়ের ছাপের স্মৃতি, সেই নখের আঁচড়, আর সেই লালচে দাগের অভিশপ্ত ইতিহাস। তারা জানত, রাত বারোটার পর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেই নিশির কান্না আর ডাক।
***
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মদনপুর গ্রাম যেন আরেক রূপ নিল। দিনের আলোর সাহসিকতা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল, চারপাশে নেমে এলো এক অজানা ভয়ের আবরণ। দীপ আর অমিত অতিথিশালার ঘরে বসে চুপচাপ রাতের নামা দেখছিল। দূরে শেয়ালের ডাক, পাখিদের ডেরায় ফেরার ব্যাকুলতা, আর গ্রামের মানুষেরা যেন দরজায় ঝুলিয়ে দিল শেষ প্রদীপের আলো। অতিথিশালার বুড়ো ম্যানেজার এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “বাবু, রাতে বাইরে যাবেন না। এই গ্রামে চাঁদের আলোও ভয়ে কাঁপে।” বুড়োর কথা শেষ না হতেই হালকা শীতল বাতাস জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে দীপের গায়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। সে জানালার বাইরে তাকাল — দূরের সেই পোড়োবাড়ির কালো অবয়ব যেন আরও কালো, আরও গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছে। অমিত একটা সিগারেট ধরিয়ে নিঃশব্দে ধোঁয়ার পাক তুলল। দীপ বলল, “আজ রাতেই বোঝা যাবে বুড়োর কথার সত্যতা। যদি নিশির ডাক আসে, আমরা শুনব। আর যদি না আসে, কাল সকালেই ফিরে যাব।”
রাত বারোটা বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। ঘড়ির কাঁটার শব্দ যেন কানের পর্দা চিরে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। দীপ আর অমিত টর্চ, ক্যামেরা আর রেকর্ডার তৈরি করে রাখল। ঘরে বসে তারা কেবল নিশ্বাসের শব্দ আর ঘড়ির টিকটিক শুনছিল। হঠাৎ, বাইরে তালগাছের পাতা সোঁ সোঁ করে নড়ে উঠল। জানালার বাইরে থেকে এল এক মিহি, বিষাদময় নারী কণ্ঠের সুর — যেন কারও করুণ আর্তি ভেসে এলো অন্ধকার ভেদ করে। “অমিত… দীপ… বেরিয়ে এসো… আমার সঙ্গে এসো…” সেই ডাক যেন সরলার শোকমিশ্রিত আত্মার কান্না। দুজনেই স্তব্ধ। অমিত টর্চটা শক্ত করে ধরল, দীপ ফিসফিসিয়ে বলল, “শুনছ অমিত? আমাদের নাম ধরে ডাকছে!” সেই কণ্ঠ আরও একবার ডাকল, এবার যেন কিছুটা কাছ থেকে — “আমার সঙ্গে এসো… আমি একা…”। কণ্ঠের মধ্যে অদ্ভুত এক আকুলতা, এক অসহায়তা মিশে ছিল, যা মনের ভিতর ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বুড়ো পণ্ডিতের কথা মনে পড়ল দীপের — “যদি নিশির ডাক শোনো, চোখ তুলবে না। ডাক শোনার পর চোখ তুলে তাকালে, সে তোমার প্রাণ নিয়ে নেবে।” দীপ কাঁপা গলায় বলল, “অমিত, আমরা জানালা দিয়ে তাকাব না। যেটুকু দরকার, রেকর্ডারে ধরব।” অমিত রেকর্ডার চালু করল, সেই কণ্ঠের আওয়াজ তাতে ধরা পড়ছিল। কিন্তু সেই ডাক থামল না, বরং ধীরে ধীরে আরও কাছে আসতে লাগল। বাইরে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের মধ্যে সেই নারীকণ্ঠ মিশে গিয়ে যেন ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ বাইরে ঝোড়ো হাওয়া বইল, জানালার কপাট সজোরে ধাক্কা খেল। সেই আওয়াজে অমিত আর দীপ চমকে উঠল। অমিতের হাতের টর্চ মাটিতে পড়ে গেল, টর্চের আলোতে জানালার ফাঁক দিয়ে কিছু একটার ছায়া দেখা গেল — এক লম্বা নারী অবয়ব, ভিজে চুল, আর সাদা ছেঁড়া শাড়ি পরা। মুখ অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু তার শরীরের আকার স্পষ্ট। কাঁপা কাঁপা গলায় দীপ বলল, “চোখ তুলিস না অমিত… যেটুকু দেখা গেছে, তাতেই যথেষ্ট…” কিন্তু অমিতের কৌতূহল প্রবল, সে এক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলল। আর ঠিক তখনই সেই কণ্ঠ বদলে গেল — আর্তি মিশ্রিত কণ্ঠ হঠাৎ রূপ নিল তীক্ষ্ণ, বিভীষিকাময় চিৎকারে। সেই চিৎকারে যেন পুরো পোড়োবাড়ি কেঁপে উঠল। অমিত দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরল, মাটিতে বসে পড়ল। দীপ ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্ধ করল জানালার কপাট। ঘরের ভেতর বাতাস যেন ঘুরপাক খেতে লাগল, প্রদীপের আলো নিভে গেল। বাইরে থেকে ভেসে এলো সেই নারীর কান্না — সে যেন বলছে, “আমার কষ্ট… কেউ বোঝে না… আমি মুক্তি চাই…”। সেই কণ্ঠ মিলিয়ে গেল দূরের বাতাসে, তালপাতার ফাঁক গলে হারিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। ঘরে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। দীপ ধীরে ধীরে অমিতকে উঠে বসতে বলল। অমিত কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “দীপ… আমি ওর চোখ দেখেছিলাম। ওর চোখে শুধু অশেষ যন্ত্রণা আর প্রতিশোধের আগুন।” তারা বুঝল, এই ডাক শুধু ডাক নয়, এটা এক অবরুদ্ধ আত্মার আর্তনাদ — আর সেই আত্মা তাদের দিয়ে কিছু বলাতে চাইছে, কিছু করতে চাইছে। কিন্তু কী? সেই উত্তর খুঁজতে তারা শপথ নিল — যাই হোক, সরলার কাহিনি শেষ না করে তারা মদনপুর ছাড়বে না।
***
ভোরের প্রথম আলো মদনপুর গ্রামে এসে পৌঁছাল, কিন্তু সেই আলো যেন দীপ আর অমিতের মনে কোনো প্রশান্তি আনতে পারল না। রাতের সেই বিভীষিকাময় ডাক, নারীর আর্তি, সেই অশরীরী ছায়া — সবকিছু যেন এখনও তাদের চারপাশে জড়িয়ে আছে। অতিথিশালার ঘরের জানালা দিয়ে তারা বাইরে তাকিয়ে দেখল, গ্রামের মানুষজন আবার নিজেদের কাজকর্মে নেমে পড়েছে। গোরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে এক কৃষক, বউঝিরা কুঁড়েঘরের সামনের উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে, কিন্তু তাদের মুখে এক অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ, যেন সবাই অদৃশ্য কারও ভয়ে চুপ করে আছে। দীপ বলল, “আর নয়, অমিত। আজ আমরা গ্রাম্য পণ্ডিতের কাছে যাব। সরলার আসল কাহিনি জানতেই হবে। না জেনে আমরা কিছুতেই শান্তি পাব না।” অমিতও মাথা নাড়ল। রাতের সেই নারীকণ্ঠ তার কানে এখনও বাজছে — “আমার কষ্ট… কেউ বোঝে না…”। দুজনে অতিথিশালার বুড়ো ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল, পণ্ডিত মশাই কোথায় থাকেন। বুড়ো চুপচাপ একটা দিক দেখিয়ে বলল, “পূর্বদিকে বড় বটগাছটার পাশে কুঁড়েঘর আছে। সকাল সকাল গিয়ে দেখা করুন বাবু। উনি আপনাদের পথ দেখাতে পারবেন।”
সকালের নরম রোদ আর কুয়াশার মিশেলে তারা পৌঁছাল সেই কুঁড়েঘরে। পণ্ডিত মশাই বয়সে নব্বইয়ের কাছাকাছি, কুঁজো শরীর, হাতে এক পুরনো লাঠি, আর চোখে ঘোলাটে চশমা। তারা প্রণাম করল, পণ্ডিত মশাই তাদের বসতে বললেন। দীপ সব খুলে বলল — রাতের সেই ডাক, ছায়া, চিৎকার, অমিতের চোখে পড়া সেই দৃষ্টি। পণ্ডিত মশাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমরা যা দেখেছ, তা সরলার আত্মা। সে শান্তি পায়নি। তার কাহিনি এই মদনপুরের বুকে অভিশাপ হয়ে রয়েছে। আজ তোমাদের বলছি, শোনো।” বুড়ো কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলেন — “সরলা ছিল এই গ্রামেরই মেয়ে। খুব সুন্দরী, গুণবতী। এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম, কিন্তু তার রূপ আর স্বভাবের কথা আশেপাশের দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামের জমিদারের ছেলে রঘুনাথ তার রূপে মুগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু রঘুনাথ ছিল অত্যাচারী, উন্মাদ স্বভাবের। সরলা তাকে ঘৃণা করত। সে এক গরিব কৃষকের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হয়। কিন্তু বিয়ের আগের রাতে, রঘুনাথ তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সরলাকে অপহরণ করে সেই পোড়োবাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে সরলার উপর অমানবিক অত্যাচার চলে। কাঁদতে কাঁদতে, লড়তে লড়তে সরলা সেই পুকুরে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু গ্রামের লোকে বলে, রঘুনাথের লোকেরা তাকে পুকুর থেকেও টেনে বের করে আবার বন্দি করে। সেই রাতেই সরলার মৃত্যু হয়। কেউ বলে সে আত্মহত্যা করে, কেউ বলে রঘুনাথের হাতে খুন হয়।”
পণ্ডিত মশাই একটু থামলেন। বাইরে বাতাসে বটগাছের পাতা সোঁ সোঁ করে নড়ল। অমিত আর দীপ নিঃশব্দে শুনতে লাগল। পণ্ডিত আবার বললেন, “তারপর থেকে সেই পোড়োবাড়ি অভিশপ্ত। যারা সেই বাড়ির কাছে যায়, তারা রাতের বেলা সরলার ডাক শোনে। কেউ কেউ বলে, সরলা নাকি মুক্তি চায়। কেউ বলে, সে প্রতিশোধ চায়। গ্রামের লোকজন রাত হলে বাড়ি থেকে বেরোয় না। রঘুনাথও অদ্ভুতভাবে মারা যায় — পোড়োবাড়ির ভেতরে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। সেই রাতের পর থেকে ও বাড়িতে আর কেউ পা রাখে না। সরলার আত্মা এখনও সেই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। তার শাপ এই গ্রামে জড়িয়ে আছে।” দীপ পণ্ডিত মশাইকে জিজ্ঞেস করল, “কেউ কি কোনও দিন সরলার আত্মাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে?” পণ্ডিত বললেন, “অনেক তান্ত্রিক, কবিরাজ এসেছিল। কেউ সফল হয়নি। সরলার কষ্টের পরিমাণ এত বেশি যে, তার আত্মা সহজে মুক্তি পাবে না। তবে শোনা যায়, কেউ যদি সত্যি হৃদয় দিয়ে তার কষ্ট বুঝতে পারে, তার মৃত্যুর ইতিহাসের ন্যায়বিচার করতে পারে, তাহলে হয়তো সে শান্তি পেতে পারে।” দীপ অমিতের দিকে তাকাল। তারা দুজনেই বুঝে গেল — এই রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত তাদের কাজ শেষ নয়। তারা সিদ্ধান্ত নিল, আজ রাতেই তারা পোড়োবাড়িতে পা রাখবে, সরলার আত্মার সঙ্গে শেষবারের মতো মুখোমুখি হবে।
***
রাত নামতে মদনপুরের আকাশে নেমে এল এক অজানা শীতলতা। চাঁদের আলো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে, যেন সে-ও সেই রাতের রহস্যের সাক্ষী হতে চায় না। দীপ আর অমিত অতিথিশালার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। হাতে টর্চ, পকেটে রেকর্ডার, আর বুক ভরা সাহস। গ্রামের শেষপ্রান্তের তালগাছ পেরিয়ে তারা পৌঁছাল সেই পোড়োবাড়ির সামনে। দূর থেকে যে বাড়ি দিনের বেলায় জীর্ণ ও পরিত্যক্ত মনে হয়েছিল, রাতের অন্ধকারে সেই বাড়ি যেন দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল শত্রুর মতো — নীরব, অথচ ভয়ঙ্কর। পোড়োবাড়ির দেয়ালে লতাপাতা জড়িয়ে আছে, ভাঙা দরজার কপাট বাতাসে ঠুকঠুক শব্দ করছে। দীপ ফিসফিসিয়ে বলল, “এটাই সেই জায়গা, অমিত। এখানেই সরলার আত্মা বন্দি।” অমিত ঘাড় নাড়ল। টর্চের আলো বাড়ির ভিতরে ফেলতেই দেখা গেল ভাঙা চৌকাঠ, মাটিতে ছড়ানো শুকনো পাতা, আর ঘরের কোণে কোণে জং ধরা লোহার ফ্রেম। বাতাস যেন ঘরের মধ্যে ঢুকে শিস দিচ্ছে, আর সেই শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে আরও ভয়ানক করে তুলছে।
দীপ আর অমিত ঘরের ভেতরে পা রাখল। তাদের প্রতিটি পা ফেলার শব্দ যেন ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ঘরের মেঝেতে চাঁদের ক্ষীণ আলো এসে পড়েছিল জানালার ফাঁক গলে। হঠাৎ সেই আলোয় স্পষ্ট হল কিছু চিহ্ন — যেন পায়ের ছাপ! কিন্তু সেই ছাপ কোথা থেকে এসেছে? কে দিয়েছে? পায়ের ছাপগুলো ভিজে জলমাটির মতো দেখতে, যা আসলে সম্ভব নয় কারণ চারপাশ একদম শুকনো। দীপ টর্চের আলো সেই ছাপের উপর ফেলল। ছাপগুলো সিঁড়ির দিকে উঠছে — সেই সিঁড়ি যেটা উপরের ঘরে নিয়ে যায়, যেখানে সরলাকে শেষবার জীবিত দেখা গিয়েছিল। অমিত থরথর করে বলল, “দীপ, আমরা কি যাচ্ছি ওদিকে?” দীপ শক্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ অমিত, আমাদের যেতে হবে। আমরা এখানেই থেমে গেলে সব ব্যর্থ হবে।” তারা সিঁড়ি বেয়ে উপরের ঘরে উঠল। ঘরটি অন্ধকার, কেবল চাঁদের ক্ষীণ আলো জানালার ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকছে। হঠাৎ কানের কাছে এক মিহি কণ্ঠ — “আমার কষ্ট… বোঝো আমাকে…”। কণ্ঠটা যেন ঘরের কোণ থেকে আসছে। অমিত রেকর্ডার অন করে সেই কণ্ঠ ধারণ করতে লাগল। দীপ জানালার কাছে গিয়ে বলল, “সরলা, তুমি যদি সত্যিই এখানে থাকো, আমাদের তোমার কথা শোনাও। আমরা তোমাকে মুক্তি দিতে চাই।”
কথা শেষ হতে না হতেই হাওয়ার ঘূর্ণি ঘরের ভেতর উঠল। জানালার কপাট প্রচণ্ড শব্দে ধাক্কা খেল, আর ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতা ঘুরতে ঘুরতে ঘরের মাঝখানে এক ঘূর্ণির আকার নিল। সেই ঘূর্ণির ভেতর থেকে গড়িয়ে এলো সরলার করুণ মুখচ্ছবি — লম্বা চুল মুখের চারপাশে এলোমেলো, চোখে অশেষ যন্ত্রণা, ঠোঁটে কাঁপুনি। দীপ আর অমিত হতবাক হয়ে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সরলার আত্মা যেন দুহাত বাড়িয়ে বলল, “আমার কাহিনি সকলকে বলো… ন্যায় দাও আমাকে… আমি শান্তি চাই…”। তারপর সেই মুখ মিলিয়ে গেল বাতাসে। ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দীপ ফিসফিসিয়ে বলল, “সে আমাদের সাহায্য চায়, অমিত। আমাদের তার হত্যার ন্যায়বিচার করতে হবে। তার আত্মা বন্ধনমুক্ত হবে তখনই।” অমিত মাথা নাড়ল। তারা নিচে নেমে এলো, পোড়োবাড়ি ছাড়ল। কিন্তু জানত — আসল লড়াই শুরু এখন। গ্রামের মানুষকে সত্যি কথা জানানো, রঘুনাথের পাপের ইতিহাস প্রকাশ করা — এটাই হবে তাদের পরবর্তী লক্ষ্য।
***
পরদিন সকাল হতেই দীপ আর অমিত মদনপুর গ্রামের মাঝখানে বিশাল বটগাছের নিচে দাঁড়াল। গ্রামের বয়স্ক থেকে কিশোর, সকলেই তাদের চারপাশে ভিড় জমিয়েছে। এমন দৃশ্য মদনপুরে বহু বছর দেখা যায়নি। দীপ মৃদু গলায় বলতে শুরু করল, “গত দুই রাত ধরে আমরা যে অভিজ্ঞতা করেছি, তা শুধু আমাদের নয়, গোটা মদনপুরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সরলার আত্মা শান্তি চায়, সে চায় ন্যায়বিচার। আর এই ন্যায়বিচার পেতে হলে আমাদের মুখোমুখি হতে হবে সত্যের।” ভিড়ের মধ্যে ফিসফাস শুরু হল। কারও চোখে বিস্ময়, কারও চোখে আতঙ্ক। বৃদ্ধ পণ্ডিত মশাইও এসে ভিড়ের এক পাশে বসে শুনছিলেন। দীপ বলল, “আমরা পোড়োবাড়িতে গিয়েছিলাম। সরলার আত্মা আমাদের ডেকেছে, তার দুঃখের কথা বলেছে। সে বলেছে, তার হত্যার কথা সবাইকে জানাতে। তাই আজ আমি এবং অমিত সেই সত্য তোমাদের সামনে আনছি।”
দীপ এক নিঃশ্বাসে বলল, “সরলাকে অত্যাচার করে হত্যা করেছিল জমিদার রঘুনাথ। সেই রাতের ঘটনা লুকিয়ে রাখতে গ্রামের অনেকেই চুপ থেকেছিল ভয়ে। কিন্তু এখন সময় এসেছে সেই পাপের ইতিহাস সামনে আনার। সরলার আত্মা বলেছে — যদি গ্রামের মানুষ একসাথে তার মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করে, তার জন্য প্রার্থনা করে, আর সেই পোড়োবাড়িকে শুদ্ধ করে তার স্মৃতি রক্ষা করে, তাহলে সে শান্তি পাবে।” অমিত পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল। সে তাদের রেকর্ডারে ধারণ করা সেই নারীকণ্ঠ বাজিয়ে দিল — “আমার কষ্ট… বোঝো আমাকে… ন্যায় দাও…”। সেই কণ্ঠ শুনে গ্রামের মানুষেরা স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেকের চোখ ভিজে উঠল। একজন বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও মুখ খুলি নি, সেই জন্য সরলার আত্মা আজও কাঁদছে। আমরা পাপ করেছি।” বয়স্করাও মাথা নিচু করল। পণ্ডিত মশাই বললেন, “এবার সময় হয়েছে, আমরা সকলে মিলে তার শান্তির জন্য যজ্ঞ করব, পোড়োবাড়িকে শুদ্ধ করব।”
গ্রামের মানুষ সেই দিনই কাজ শুরু করল। সেই পোড়োবাড়ির চারপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা হল, ঘরের ভেতর থেকে শুকনো পাতা, ভাঙা কাঠ, পচা মাটির স্তূপ সরানো হল। বটগাছের নিচে বসে সরলার আত্মার শান্তির জন্য মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন পণ্ডিত মশাই। দীপ আর অমিত সেই যজ্ঞের সমস্ত আয়োজনের মধ্যে থেকে সরলার আত্মার প্রতিটি ডাক মনে করে শিহরিত হচ্ছিল। সেই রাতেই, যজ্ঞের পর গ্রামের মানুষ পোড়োবাড়ির দিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রণাম জানাল। বাতাসে যেন হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, যেন সরলার আত্মা প্রথমবারের মতো হালকা নিশ্বাস ফেলল। আর কোনও নিশির ডাক শোনা গেল না, আর কোনও অশরীরী ছায়া সেই বাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিল না। দীপ আর অমিত বুঝল — সত্যকে সামনে আনার মধ্যে দিয়েই তারা এক অভিশপ্ত আত্মাকে শান্তি দিতে পেরেছে।
***
সকাল হতে না হতেই মদনপুরের বাতাসে যেন অদ্ভুত এক হালকা ভাব নেমে এলো। যেন অজানা কোনো ভার নেমে গেছে গ্রামের বুক থেকে। চড়াইভাটা পার হওয়া নদীর মতো শান্ত হয়ে এল গ্রামের সকাল। ভোরের প্রথম আলোয় দূরের বাঁশবন ঝিকিমিকি করছে, বটগাছের পাতার ফাঁক গলে সূর্যের লাল আভা গ্রামের মাটিতে সোনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। যজ্ঞের ধোঁয়ার গন্ধ, মন্ত্রোচ্চারণের প্রতিধ্বনি আর মানুষের প্রার্থনার সুর মিলিয়ে যেন পুরো গ্রাম এক নতুন প্রাণ ফিরে পেল। বউঝিরা কুয়ো থেকে জল তুলছে, ছেলেরা খেলছে, বৃদ্ধেরা বটগাছের নিচে বসে সকালবেলার পাখির ডাক শুনছে।
দীপ আর অমিত সারারাত জেগে থেকেছে। অতিথিশালার বারান্দায় বসে দুজনে সেই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত মনে করার চেষ্টা করছে। দীপ চায়ের কাপ হাতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। কুয়াশার পর্দা সরে গিয়ে দূরের পোড়োবাড়ি অল্প দেখা যাচ্ছে। বাতাসে জোনাকির আলো টিম টিম করছে। সেই পোড়োবাড়ি আর রাতের সেই কান্নার শব্দ যেন এখন কেবলই অতীত। অমিত বলল, “দীপ, শেষ পর্যন্ত আমরা পারলাম। সরলার আত্মা শান্তি পেয়েছে, তাই না?” দীপ এক চুমুক চা খেয়ে বলল, “হ্যাঁ অমিত, সরলার কান্না থেমেছে। গ্রামের মানুষ সেই অন্যায়ের ইতিহাসকে স্বীকার করেছে। কিন্তু জানো, আমার মন বলছে এ কেবল শুরু। মদনপুরের মাটির তলায় লুকিয়ে আছে আরও কিছু, যা রাতের বাতাসে কানাকানি করে যাচ্ছে।”
ঠিক তখনই অতিথিশালার সামনের রাস্তা ধরে হাপাতে হাপাতে ছুটে এলো এক যুবক — সনৎ। তার মুখে ঘাম, চোখ বড় বড়, মুখ দিয়ে কথাই যেন বেরোতে চায় না। দীপ এগিয়ে গেল, বলল, “সনৎ, কী হয়েছে? এমন করে ছুটে আসছ কেন?” সনৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বাবু, পুকুরপাড়ে অদ্ভুত জিনিস দেখা গেছে। পোড়োবাড়ির পাশের পুকুরের কাদায় অর্ধেক ঢাকা কিছু একটা। মনে হচ্ছে পুরনো দিনের মন্দিরের চূড়া বা তেমন কিছু! চলুন, একবার দেখে যান।” দীপ আর অমিত আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। তারা তৎক্ষণাৎ ব্যাগ কাঁধে ফেলে সনতের সঙ্গে পুকুরপাড়ের দিকে ছুটল।
পুকুরপাড়ে পৌঁছাতেই তারা দেখল, কয়েকজন গ্রামের মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে পুকুরের ধারে। পুকুরের ঘোলা কাদার মধ্যে অর্ধেক ডুবে আছে একটা রূপালী রঙের ধাতব চূড়া। চূড়াটার গায়ে সূক্ষ্ম খোদাই করা আছে কিছু প্রতীক — কিন্তু সেই প্রতীক দীপের কাছে একেবারেই অজানা। প্রচলিত মন্দিরের শিখরচূড়ার মতো নয়, বরং যেন এক অজানা সভ্যতার নিদর্শন। দীপ তা হাতে তুলে নিতেই কাদা গড়িয়ে পড়ল। ঠান্ডা বাতাস হঠাৎ বইতে শুরু করল। পুকুরের জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠল। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু পাখির ডাক দূরে শোনা যাচ্ছে। অমিত বিস্মিত চোখে বলল, “দীপ, এটা কী হতে পারে? এতদিন মাটির নিচে লুকিয়ে ছিল, আর আজ রাতেই বেরিয়ে এল? সরলার ঘটনা শেষ হতে না হতেই এমন এক রহস্য!”
দীপ মনোযোগ দিয়ে চূড়ার প্রতীকগুলো দেখতে দেখতে বলল, “এই চিহ্নগুলো আমাদের চেনা ধর্ম বা শিল্পের নয়। এটা হয়তো আরও পুরনো কোনও কালের নিদর্শন। সরলার আত্মার শান্তির মধ্য দিয়ে হয়তো আরেক ইতিহাসের দ্বার খুলে গেছে। এই গ্রাম, এই মাটি হয়তো এমন অনেক সত্য লুকিয়ে রেখেছে।” সনৎ বলল, “বাবু, পুকুরের পাড়ে কাদা কিছুটা ধসে গিয়েছিল। তখনই এটা দেখা যায়। আমরা তো ভেবেছিলাম মাটির নিচে পাথর বা কিচ্ছু হবে, কিন্তু এমন জিনিস…” তার গলায় বিস্ময় আর আতঙ্ক স্পষ্ট।
দীপ চূড়াটা ব্যাগে রাখল। বলল, “এটা আমাদের নিয়ে যেতে হবে। খোদাইগুলো পরীক্ষা করতে হবে, ইতিহাস খুঁজতে হবে। মদনপুরের অতীত শুধু সরলার কান্না নয়, আরও অনেক গোপন কাহিনি লুকিয়ে আছে এখানে।” অমিত কৌতূহল মেশানো গলায় বলল, “দীপ, তাহলে এবার কী হবে?” দীপ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “এবার আমাদের সেই প্রতীকগুলোর মানে বের করতে হবে, পুস্তকে, ইতিহাসবিদদের কাছে খুঁজতে হবে সেই অজানা অধ্যায়ের সন্ধান। সরলার ইতিহাস শেষ, কিন্তু নতুন এক ইতিহাসের ছায়া আমাদের ডেকে নিয়ে চলেছে।”
সেই সন্ধ্যা নেমে এলে গ্রামের মানুষ পোড়োবাড়ির সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে আরেকবার প্রণাম জানাল। সরলার আত্মার জন্য গ্রাম একযোগে প্রার্থনা করল, আর পুকুরপাড়ে সেই নতুন রহস্যের প্রতীক যেন অন্ধকারে টিম টিম করে নতুন এক গল্প বলার ইঙ্গিত দিল। রাতের বাতাসে, জোনাকির মৃদু আলোয় দীপ দূরের পোড়োবাড়ির দিকে তাকিয়ে অনুভব করল — সে আর অমিত এবার এক নতুন অভিযানে নামছে, যেখানে মদনপুরের অতীত আবার কথা বলবে, আর অজানা ইতিহাসের ধূলিঝড় উড়িয়ে আনবে নতুন রহস্যের পরত।
***
পুকুরপাড়ের সেই রূপার চূড়া যেন অজানা এক জাদুতে দীপের হাতে শীতলতার শিহরণ বইয়ে দিল। রাতে ফিরে এসে দীপ আর অমিত বসেছিল অতিথিশালার বারান্দায়। গ্রামের নিস্তব্ধ রাত, দূরের বাঁশবনে শিয়ালের ডাক, আর কেবল পোড়োবাড়ির অবয়বটি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। দীপ চূড়াটার খোদাই দেখতে দেখতে বলল, “অমিত, এই প্রতীকগুলো সাধারণ কিছু নয়। দেখ, এখানে কীভাবে বৃত্তের ভেতরে সূক্ষ্ম রেখা টানা হয়েছে, আর এখানে একটা চাঁদের মতো আকৃতি — এমনটা কোনো ধর্মীয় মন্দিরে দেখেছ?” অমিত মাথা নাড়ল, “না দীপ। যেন বহু প্রাচীন কোনো জনজাতির চিহ্ন। কিন্তু এই মাটির নিচে এমন নিদর্শন থাকল কীভাবে?”
দীপ ধীরে বলল, “মদনপুরের ইতিহাস অনেক পুরনো। সরলার কান্না এক অধ্যায়, এই প্রতীক হয়তো আরেক অধ্যায়ের দরজা খুলে দিচ্ছে। আমি ভেবেছি, কালই আমাদের কলকাতায় ফিরতে হবে। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে কিছু পরিচিত প্রত্নতত্ত্ববিদ আছেন — ওদের দেখাতে হবে এই চূড়া।” অমিত বলল, “ঠিক বলেছ। আর সেই সঙ্গে গ্রামবাসীদেরও সতর্ক করতে হবে। যেন পুকুরপাড়ে কেউ কাদা খোঁড়াখুঁড়ি না করে।” দীপ ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ, কারণ অজানার মধ্যে বিপদ লুকিয়ে থাকে।”
পরদিন সূর্য ওঠার আগে দীপ আর অমিত বেরিয়ে পড়ল মদনপুর থেকে। গ্রামের মানুষ ভোরবেলা তাদের বিদায় জানাল। অনেকেই বলল, “বাবু, আপনি না থাকলে আমরা হয়তো কখনও সত্যের মুখ দেখতাম না। এবার আবার আসবেন।” দীপ হাসল, “অবশ্যই আসব। মদনপুরের গল্প শেষ হয়নি।” তারা বাস ধরে প্রথমে শহরের দিকে রওনা দিল। বাসের জানালা দিয়ে দীপ দূরের পোড়োবাড়ি দেখতে দেখতে ভাবল — “এই পোড়োবাড়ি শুধু ভাঙা ইট কাঠ নয়, এ যেন অজানা কোনো অতীতের সাক্ষী, যার ধুলা এখন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।”
কলকাতায় ফিরে তারা সোজা গেল ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক অধ্যাপকের কাছে — ড. অনিরুদ্ধ নন্দী। অধ্যাপক বহু পুরনো নিদর্শনের ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞ। চূড়াটা দেখে তিনি প্রথমে অবাক, তারপর মাইক্রোস্কোপে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নানা কোণ থেকে খোদাই দেখা শেষে তিনি বললেন, “দীপ, তুমি যা এনেছ তা অসাধারণ। এ ধরনের চিহ্ন আমি কেবলমাত্র পড়েছি — বাংলার অতি প্রাচীন সভ্যতা, যেটা খ্রিস্টপূর্ব যুগের হতে পারে। এই চূড়ার ধাতু পরীক্ষা করতে হবে, তবে অনুমান করছি অন্তত ২৫০০ বছরের পুরনো। এবং এর প্রতীকগুলো সেই সভ্যতার ধর্মীয় বা জাদু-প্রথার অংশ।”
অমিত চমকে বলল, “তাহলে সেই পোড়োবাড়ির পাড়ে এমন প্রাচীন নিদর্শন এল কীভাবে?” ড. নন্দী গভীর গলায় বললেন, “সম্ভবত ওই পোড়োবাড়ি এলাকায় একসময় জনপদ ছিল। হয়তো কোনো সভ্যতা, যার নাম আজ আমরা ভুলে গেছি। তবে সাবধান, যেখানে এমন নিদর্শন পাওয়া যায়, সেখানে আরও নিদর্শন, এমনকি বিপদও লুকিয়ে থাকে।” দীপ বলল, “আমরা আবার মদনপুরে যাব। এই রহস্যের শেষ না দেখে থামা যাবে না।” ড. নন্দী বললেন, “যাবেই। তবে এই চূড়াটার একটা নকল তৈরি করতে দাও, মূলটা এখানে থাকুক। তুমি নকলটা নিয়ে ফিরে যাও।” দীপ রাজি হল।
এরপর দিন কয়েক কাটল পরীক্ষার মধ্যে। চূড়ার ধাতু পরীক্ষা করে জানা গেল — এটি এক ধরনের প্রাচীন রূপা-মিশ্র ধাতু, যা বঙ্গভূমির প্রাচীন উপজাতিরা ব্যবহার করত। দীপ ও অমিত তৈরি হল ফের মদনপুরে ফেরার জন্য। রাতে কলকাতা স্টেশনের ট্রেনে উঠতে উঠতে দীপ বলল, “অমিত, আমি জানি, এবারের যাত্রা আরও ভয়ঙ্কর হবে। কারণ যা আমরা খুঁড়তে যাচ্ছি, তা শুধু ইতিহাস নয়, কোনো অজানা অশুভ শক্তিও হতে পারে।”
মদনপুরে ফিরে তারা গ্রামের প্রান্তে ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে উঠল। রাতে সেই কুঁড়েঘর থেকে দূরের পোড়োবাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু এবার অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেল দীপের মনের ভেতর। চাঁদের আলোয় পোড়োবাড়ি যেন জীবন্ত মনে হচ্ছিল। রাত গভীর হলে পুকুরপাড় থেকে হঠাৎ যেন চাপা গুঞ্জন শুনতে পেল অমিত। সে দীপকে ডাকল, “শোন! এই শব্দ!” দীপ কানে হাত রেখে শুনল — দূর থেকে যেন বহু মানুষের ফিসফিসানি, পায়ের আওয়াজ, আর শিঙা বাজানোর মতো এক গম্ভীর সুর ভেসে আসছে। তারা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল পুকুরপাড়ের দিকে।
পুকুরের ধারে গিয়ে তারা থমকে দাঁড়াল। পুকুরের জলে চাঁদের আলো পড়ে এক অদ্ভুত প্রতিবিম্ব তৈরি করছে। মনে হচ্ছে জলের নিচে কোনও প্রাচীন স্তম্ভ, কোনো পাথরের কাঠামো লুকিয়ে আছে। অমিত কাঁপা গলায় বলল, “দীপ, জলের নিচে কিছু আছে! একেবারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!” দীপ বলল, “হ্যাঁ, এখন স্পষ্ট। এই পুকুর তৈরি হয়েছিল সেই প্রাচীন কাঠামোর উপর। আমাদের ডুবুরির দরকার, সেই জলের নিচের রহস্য উন্মোচন করতে হবে।”
সেই রাত শেষ না হতেই দীপ ঠিক করল, পরের দিন কাছের শহর থেকে ডুবুরি আর প্রত্নতত্ত্ববিদদের আনাবে। মদনপুরের ইতিহাসের পরতের পরত এবার খুলে পড়বে — সেই ইতিহাস যেখানে সরলার কান্না মিলিয়ে যাবে, আর উঠে আসবে আরও গভীর, অজানা রহস্য, যার শিকড় সময়ের অনেক গভীরে প্রোথিত।
***
সকাল হতেই মদনপুরের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। দূর থেকে সূর্যরশ্মি ভেদ করে আসা আলো পুকুরের জলে পড়ে অদ্ভুত এক দীপ্তি ছড়াচ্ছিল। গ্রামের মানুষ উৎসুক হয়ে পুকুরপাড়ে জড়ো হতে শুরু করল। সবাই বুঝতে পারছিল, আজ তাদের গ্রামে এমন কিছু ঘটতে চলেছে যা অনেক যুগের ইতিহাসকে উল্টেপাল্টে দিতে পারে। দীপ আর অমিত দাঁড়িয়ে রইল পুকুরের পাড়ে। তারা দূরে তাকিয়ে দেখল, শহর থেকে আসা একটি জিপগাড়ি ধুলো উড়িয়ে গ্রামের রাস্তায় ঢুকছে। জিপগাড়ি থেকে নামল তিনজন ডুবুরি আর এক জন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অফিসার, অজয় মুখার্জি।
অজয় এগিয়ে এসে দীপের সঙ্গে হাত মেলাল। বলল, “আপনার কথা শুনে আসতে হল। এমন রহস্যময় কাহিনি আর প্রাচীন নিদর্শনের হাতছানি উপেক্ষা করা যায় না।” দীপ হালকা হাসল, “আমরা সত্যিই নিশ্চিত যে পুকুরের তলায় এমন কিছু আছে যা ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করবে।” ডুবুরিরা প্রস্তুতি নিল। পুকুরের ঘোলা জল পেরিয়ে তারা জলের তলায় নামতে শুরু করল। আশেপাশের মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। এক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থেমে গেল — শুধু জলের ঢেউয়ের শব্দ আর বকের ডাক শোনা গেল।
প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেল। ডুবুরিরা যখন উঠে এল, তাদের চোখে বিস্ময় আর কণ্ঠে উত্তেজনা। প্রধান ডুবুরি বলল, “স্যার, জলের নিচে বড় পাথরের স্তম্ভ দেখা গেছে। খোদাই আছে, ঠিক আপনার দেওয়া চূড়ার মতো চিহ্ন। মনে হচ্ছে কোনও প্রাচীন মন্দির বা স্থাপনা ছিল যা কাদার নিচে চাপা পড়ে গেছে।” অজয় মুখার্জি সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিল, “আরও খোঁজ চালাও। যদি সম্ভব হয় পাথরের কিছু অংশ তুলে আনো।” ডুবুরিরা আবার নামল জলে। দীপের বুকের মধ্যে ধুকধুকানি বাড়তে থাকল। যেন অজানা অতীতের হাত তার হৃদয় স্পর্শ করছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। ডুবুরিরা জলের নিচ থেকে তুলে আনল একটি পাথরের ফলক। সেই ফলকে খোদাই করা এক বিশাল বৃক্ষের প্রতীক, যার শাখায় শাখায় ছোট ছোট চিহ্ন, আর তলার দিকে কিছু অদ্ভুত অক্ষর। অক্ষরগুলো দীপ চিনতে পারল না। অজয় মুখার্জি বলল, “এগুলো ব্রাহ্মীলিপির মতো, কিন্তু একেবারেই মেলে না। হয়তো এ আমাদের অজানা কোনও লিপি, যেটা বঙ্গভূমির কোনো বিলুপ্ত জনজাতি ব্যবহার করত।” দীপ ধীরে বলল, “এবার সত্যিই আমরা ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়ছি।”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। পুকুরপাড়ে এক আশ্চর্য আবহ তৈরি হল। গ্রামের বৃদ্ধা মধুমতি দিদা ধীরে ধীরে পুকুরপাড়ে এলেন। তার কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “বাবুরা, সাবধান। আমার ঠাকুমা বলত, এই পুকুর আর পোড়োবাড়ির মাটির নিচে শুয়ে আছে এক অভিশপ্ত দেবতা। সেই মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ কেউ না খোঁড়ে, তাই প্রাচীন কালে পুকুর খুঁড়ে জল ঢেলে তা ঢেকে রাখা হয়েছিল। শুনেছি, সেই দেবতার অভিশাপে গোটা গ্রাম এক সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আজ তোমরা আবার সেই প্রাচীন কাহিনি জাগিয়ে তুলছ।”
দীপ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী অভিশাপ ছিল, দিদা?” বৃদ্ধা দিদা দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যে দেবতার নাম ভুলে গেছে মানুষ, যে দেবতা লিপিবদ্ধ হয়নি কোনও শাস্ত্রে, তার মন্দির ধ্বংস করেছিল লোভী রাজা। সেই দেবতা শপথ নিয়েছিলেন, যে এই মাটিকে খুঁড়বে, তার ঘর-সংসার তছনছ হয়ে যাবে, আর অশুভ শক্তি তার পিছু নেবে।” অমিত উদ্বিগ্ন মুখে দীপের দিকে তাকাল। দীপ শক্ত কণ্ঠে বলল, “দিদা, আমরা ইতিহাস উদ্ধার করছি, লোভ নয়। সত্যকে জাগানো অভিশাপ নয়, এ আশীর্বাদ।”
কিন্তু সেই রাতেই অদ্ভুত ঘটনা শুরু হল। বাতাসে শিসর মতো আওয়াজ, পুকুরের জলে ঢেউ উঠতে লাগল যেখানে বাতাস নেই। পোড়োবাড়ির দিক থেকে ভেসে এল চাপা গর্জনের মতো শব্দ। দীপ আর অমিত জেগে রইল। তারা স্পষ্ট শুনল — রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে সেই প্রাচীন শিঙা বাজানোর সুর, যেন অজানা কোনো যুদ্ধের ডাক। দীপ ফিসফিসিয়ে বলল, “অমিত, আমরা এমন কিছুর সামনে দাঁড়িয়ে যা মানুষের ইতিহাসের চেয়ে পুরনো।”
পরদিন সকালেই অজয় মুখার্জি স্থির করলেন, পুকুরের পানি ধীরে ধীরে সেচে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে, পুরো কাঠামো স্পষ্ট দেখতে। কিন্তু দীপের মনে কেবল অজানা শঙ্কা। সে জানত, এই অভিযান হয়তো শুধু ইতিহাস উদ্ধার নয়, লড়াইও — অজানা অতীত আর অশুভ শক্তির সঙ্গে। আর মদনপুরের নিস্তব্ধ রাত সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতিস্বরূপ আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
***
সকাল থেকেই মদনপুর যেন নিস্তব্ধতার এক ভিন্ন চাদরে ঢাকা পড়েছিল। গ্রামের মানুষ ঘরবন্দি। কেউ জানালা ফাঁক করে পুকুরপাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখছে, কেউ মন্ত্রপূত চালে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরের কোণায় রেখেছে। পুকুরের জল সেচে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। অজয় মুখার্জির তত্ত্বাবধানে কয়েকজন শ্রমিক বড় বড় পাইপ বসিয়ে জল টেনে ফেলার ব্যবস্থা করছে। জল আস্তে আস্তে নামছে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের তলা থেকে এক অজানা কাঠামোর অবয়ব স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
দীপ, অমিত আর অজয় মাটির উপর দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। পাথরের স্তম্ভ, ভাঙা মূর্তি, আর কিছু অর্ধনিমগ্ন ফলক স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই ফলকের প্রতিটি ইঞ্চি জুড়ে অদ্ভুত অক্ষর আর প্রতীক খোদাই করা। অজয় মুখার্জি বললেন, “এ যেন এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, যেটা ইতিহাসের বইয়ে নেই। হয়তো এই মন্দিরের কাহিনি মিশে গেছে লোককথায়, আর বেঁচে আছে কেবল অভিশাপের আখ্যান হয়ে।”
কিছুক্ষণ পরেই জল পুরোপুরি নামল। পুকুরের তলায় এক বিশাল চতুর্ভুজাকৃতি মন্দিরভগ্নাংশ স্পষ্ট হল। মাঝখানে বড় একটি গর্ভগৃহ, যার ছাদ ভেঙে পড়ে আছে। দীপ আর অমিত ধীরে ধীরে সেই গর্ভগৃহের দিকে এগিয়ে গেল। চারপাশে পাথরের মূর্তিগুলো এমনভাবে বসানো, যেন তারা এক অজানা শক্তির উপাসনা করছিল। প্রতিটি মূর্তি বিকৃত, মুখচ্ছবি ভীতিকর। অমিত ফিসফিসিয়ে বলল, “এত ভয়ানক দেবমূর্তি কখনও দেখিনি, দীপ। এরা কী উপাসনা করত?”
দীপ মাটি থেকে একটা ছোট পাথরের টুকরো তুলল। তাতে সেই বৃক্ষ প্রতীকের খোদাই। বৃক্ষের শাখায় অদ্ভুত সব জীবজন্তুর মুখ, যেন তারা মানুষ আর পশুর সংমিশ্রণ। দীপ বলল, “অমিত, এই মন্দির ছিল এক প্রাচীন গোষ্ঠীর — যারা প্রকৃতি আর অশুভ শক্তির মিশ্র উপাসনা করত। হয়তো সেই গোষ্ঠীকে রাজারা নির্মূল করে দেয়, আর মন্দির ডুবিয়ে দেওয়া হয়। অভিশাপের গল্প তখন তৈরি হয় মানুষের মুখে মুখে।”
কিন্তু সেই মুহূর্তেই বাতাসে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। পুকুরের তলা থেকে হঠাৎ ধুলো উড়ে উঠল, আর সেই ধুলোর ঘূর্ণিতে গর্ভগৃহের ফাটল দিয়ে এক অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে এল। যেন কারও চাপা ক্রন্দন, কারও হাহাকার। শ্রমিকরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। অজয় মুখার্জি চিৎকার করলেন, “সবাই সরো! কারও কিছু স্পর্শ কোরো না!” কিন্তু দীপ আর অমিত দাঁড়িয়ে রইল।
গর্ভগৃহের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল এক কালো ধোঁয়ার মতো ছায়া। তার আকার ছিল অস্পষ্ট — কখনও মানুষের মতো, কখনও বাঘের মতো, কখনও অজানা কোনো প্রাণীর মতো। সেই ছায়া যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার সঙ্গে সারা চতুর্দিকে ভয়ঙ্কর কাঁপুনি শুরু হল। মাটিতে ফাটল ধরল। পোড়োবাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখা গেল, ভেঙে পড়া দেওয়ালের গায়ে লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ছে।
দীপ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “অমিত, মনে হচ্ছে অভিশপ্ত শক্তি মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু একে আবার বেঁধে রাখতে হবে। পুকুরপাড়ে সেই চূড়াটাকে মনে আছে? ওটা সেই মন্দিরের প্রতীক। চলো, ওটাকে গর্ভগৃহের ভেতর বসাই।” অজয় মুখার্জি বিস্মিত হয়ে বললেন, “এত বড় ঝুঁকি নেবে?” দীপ বলল, “এখন আর পথ নেই। একমাত্র ঐ প্রতীকই হয়তো এই শক্তিকে আবার বন্দি করতে পারে।”
অমিত আর দীপ পাথরের চূড়াটির নকলটি হাতে নিয়ে গর্ভগৃহের ভেতরে ঢুকল। ভেতরে চারপাশে অন্ধকার আর গুমোট। মাটির নিচ থেকে ঠান্ডা বাতাস উঠছে। গর্ভগৃহের মধ্যখানে এক প্রাচীন বেদি দেখা গেল, ধুলো আর শ্যাওলায় ঢাকা। দীপ সেই বেদির উপর প্রতীকটি বসিয়ে দিল। মুহূর্তেই এক প্রচণ্ড ঝড় উঠল, বাতাসে চারপাশের ধুলো উড়ে গিয়ে গর্ভগৃহের ভেতর উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ল। সেই কালো ছায়া আবার ফিরে এসে চূড়াটির চারপাশে পাক খেতে খেতে ধীরে ধীরে বেদির নিচে মিশে যেতে লাগল।
মুহূর্তে চারদিকের কাঁপুনি থেমে গেল। বাতাস স্থির হল। পুকুরপাড়ে দাঁড়ানো মানুষজন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অজয় মুখার্জি এগিয়ে এসে দীপের কাঁধে হাত রাখলেন, “তুমি যা করলে, ইতিহাস তা মনে রাখবে।” দীপ ক্লান্ত গলায় বলল, “অভিশাপের গল্প আর মিথ নয়, প্রকৃত ইতিহাসেরই এক অধ্যায় শেষ হল আজ। কিন্তু এই মন্দির আর কাঠামো সংরক্ষণ করতে হবে — যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানে, কতটা গভীরে আমাদের শিকড় প্রোথিত।”
এরপর কয়েক দিনের মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ আর গবেষণার কাজ শুরু করল। মদনপুরের মানুষ আবার স্বস্তি ফিরে পেল। পোড়োবাড়ি আর পুকুরপাড়কে ঘিরে তৈরি হওয়া আতঙ্ক কেটে গেল, আর সেই স্থানে শুরু হল ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। দীপ আর অমিত কলকাতায় ফিরে এল, কিন্তু মনের ভেতর তারা জানত — মদনপুরের পুকুরতলা তাদের জীবনে এমন এক অধ্যায়ের সাক্ষী রেখে গেল, যা ভোলা যাবে না কোনোদিন।
—