সুস্মিতা লাহা
পর্ব ১: জানালার ধারে
বৃষ্টিটা সন্ধ্যা ছ’টার পর থেকেই নেমেছে, একটানা। জানালার কাঁচে ছোট ছোট ফোঁটা গলে পড়ছে, আর তৃষা একমনে তাকিয়ে আছে বাইরে। ফ্ল্যাটটা নিস্তব্ধ, অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ঘরের ভেতরে হালকা হলুদ আলো জ্বলছে, কিন্তু তাতে মন ভরে না আজকাল। ঘড়িতে সাতটা পঁচিশ। অফিস থেকে ফেরার ট্রেনটা আজও মিস করেছে অমিত—এটা আর অবাক করে না তৃষাকে। বরং সে ধরে নিয়েছে, এসএমএসটা কখন আসবে, কখন শুনবে “আজ একটু দেরি হবে”—সে তো জানা কথাই।
তৃষা জানে কাজ নয়, কাজের নামে অনন্যা। অমিতের সহকর্মী, ঝকঝকে স্মার্ট, নিখুঁত ঠোঁটের হাসি আর স্মোকি চোখের মেয়ে। সে মেয়েটাকে কখনো দেখেনি, শুধু অনুভব করেছে ফোনকলের অপর প্রান্তে, ভিন শহরের কোনো হোটেল রুমের নীরবতায়।
আজ তৃষার মনে হলো, এই সম্পর্কটা সে যতটা আগলে রাখতে চেয়েছে, অমিত ততটাই নির্লিপ্ত ছিল। তৃষার ত্রিশের কোঠায় পৌঁছোনো জীবন, সংসার আর সন্তানের মধ্যখানে আটকে পড়া নারীত্ব—সেটাকে কেউই গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি তৃষা নিজেও না।
তৃষা ধীরে ধীরে চা বানাতে যায়। রান্নাঘর থেকে ফোটার শব্দ আসে, আর সেই সঙ্গে এক চেনা আওয়াজ—একতলার ঘরের দরজা বন্ধ হচ্ছে। শুভ ফিরেছে। ছেলেটা নতুন ভাড়াটে, আর্ট কলেজে পড়ায়। ছাঁটা দাড়ি, চোখে চশমা, হালকা চুল এলোমেলো—কিন্তু চোখে একটা চঞ্চল প্রশান্তি। দু’একবার সিঁড়িতে দেখা হয়েছে, তৃষার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন চোখের ভেতর সব পড়ে ফেলতে পারে।
সেদিনের কথা মনে পড়ে—তৃষা ভিজে জামা নিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল, ছাতা ভাঙা, চুল ভেজা। শুভ এসে বলেছিল, “বৃষ্টিতে চা খাওয়া হয়েছে?”—তৃষা হেসে বলেছিল, “চা তো বানানো হয়, খাওয়া হয় না আর।” শুভ কিছু বলেনি, শুধু তাকিয়েছিল। সেই তাকানোয় অনুরোধ ছিল না, দাবি ছিল না—শুধু একটা দীর্ঘ নীরবতা।
কয়েকদিন পর চিঠি এসেছিল। না, মোবাইলের মেসেজ না, ঠিক খাঁটি কাগজে লেখা—
“তুমি নিশ্চয় জানো না, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তুমি কেমন লাগো। তোমার চোখের ক্লান্তি পড়ে ফেলেছি আমি। একদিন যদি চাও, তোমার মুখে না বলা গল্পগুলো শুনতে চাই আমি।”
তৃষা পড়ে থেমে গেছিল। চিঠিটা রেখে দিয়েছিল একটা বইয়ের পাতায়। তারপর ভেবেছিল, একটা চিঠি কি সবকিছু বদলে দিতে পারে? কিন্তু যখন নিজের স্বামীর চোখে আর নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না, তখন একটা অপরিচিত দৃষ্টিই হতে পারে আশ্রয়।
সেদিন অমিত ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। চুপচাপ খেয়ে শুয়ে পড়ে। তৃষা তখন একা বসে থাকে বারান্দায়। মাথায় হালকা চাদর জড়ানো, কোলের ওপর সেই চিঠি। কাঁচের বাইরে বৃষ্টি পড়ছে তখনও।
ঠিক তখনই—এক অদ্ভুত সাহসে, এক অভিমানী অভিলাষে তৃষা উঠে দাঁড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে নামে একতলার দিকে। শুভর ঘরের দরজা হালকা খোলা, আলো জ্বলছে। দরজায় টোকা না দিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। শুভ দরজা থেকে উঠে আসে।
“তুমি এসেছো?”—ওর গলায় প্রশ্ন নয়, যেন স্বস্তি।
তৃষা কিছু বলে না। চোখের ভেতর যেন হাজারটা শব্দ, অথচ ঠোঁট বন্ধ। শুভ সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। তৃষা নিরবধি সেই হাতে নিজের হাত রাখে। কোনো নাটক নেই, কোনো দায় নেই—শুধু দুটো শরীর, দুটো চাওয়া, এক অব্যক্ত দুর্বলতা।
শুভ বলে, “আজ শুধু গল্প হবে। তুমি বলবে, আমি শুনব। কিন্তু গল্পটা শুরু হোক তোমার ত্বকের ছোঁয়া থেকে।”
তৃষা ঘরের ভেতরে পা রাখে। জানালার পাশেই বসে শুভ, তৃষার জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়।
ঘরটা হালকা ধূপের গন্ধে ভরে আছে, জানালার কাঁচ ভেজা, বাইরের আলো-ছায়া ভিতরে ঢুকে পড়ছে। শুভ এক কাপ চা এগিয়ে দেয়। তৃষা প্রথম চুমুক দেয়, তারপর চোখ বন্ধ করে বলে, “অনেক বছর পর মনে হচ্ছে, আমি বেঁচে আছি।”
শুভ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তৃষা বলে, “আমার নামের মানে জানো? তৃষা—মানে তৃষ্ণা। অথচ এতো বছর ধরে তৃষ্ণাই রয়ে গেছি। কেউ আমায় পূর্ণ করতে চায়নি।”
শুভ ধীরে এগিয়ে এসে বলে, “তুমি জানো, বৃষ্টির মতো কিছু অনুভূতিও আসে, যাকে থামানো যায় না। তাকে শুধু ছুঁয়ে দেখা যায়।”
সেই রাতে কোনো প্রতিজ্ঞা ছিল না, কোনো প্রতারণাও নয়—শুধু একটা নতুন করে জন্ম নেয়া অনুভব, শরীর আর আত্মার মিলনবিন্দুতে দাঁড়িয়ে এক অস্থায়ী ভালোবাসা।
আর জানালার বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছিল—অবিরত, নীরব, তবুও সব বলেই যাচ্ছিল।
পর্ব ২: পিছুটান
তৃষার ঘুম ভাঙে ভোরের হালকা আলোয়। পাশের ঘর থেকে অমিতের ঘড়ির অ্যালার্ম বাজছে—প্রতিদিনকার মতোই ছয়টা পঁচিশে। তৃষা উঠে যায় না। বিছানার চাদরে এখনও গতরাতের ধূপের গন্ধ, শুভর গলার নরম তাপ লেগে আছে কোথাও। ওর শরীরের পেশিগুলো আজ যেন অন্যরকম আলগা, হালকা। ঘুমের ভেতরেও তৃষা বুঝতে পেরেছে—গতরাতের অভিসার শুধু শরীরের ছিল না। ছিল এক অনুচ্চারিত মুক্তি।
ও উঠে চা বানায়, জানালাটা খুলে দেয়। বাইরে আবছা রোদ, গাছের পাতাগুলো টপটপ করে ঝরছে। মনে হয় যেন প্রতিটি পাতায় লেখা আছে একটি করে না বলা কথা, দীর্ঘদিন জমে থাকা অভিমান।
অমিত ঘুম থেকে উঠে বলে, “তুমি চা বানিয়ে দিলে? ভালো তো।”
তৃষা একবার তাকায়, হাসে না, কিছু বলে না। মুখ গম্ভীর।
অমিত আয়নায় নিজের মুখ দেখে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, “তুমি ঠিক আছো তো আজকাল? খুব চুপচাপ লাগছে।”
তৃষা বলে, “সবাই তো আজকাল চুপচাপ। কথাগুলো ফুরিয়ে গেছে।”
অমিত শোনে, কিন্তু কিছু জবাব দেয় না। ডাইনিং টেবিলে বসে মোবাইলে স্ক্রল করতে করতে বলে, “আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোবো। অনন্যার সঙ্গে একটা প্রেজেন্টেশন আছে।”
‘অনন্যা’—এই নামটার উচ্চারণে তৃষার বুকের ভেতর কেমন একটা পাথর পড়ে যায়। অথচ মুখে সেই ছায়াও পড়ে না। অনেক অভিমান, সন্দেহ, ব্যথা, কান্না মিশে তৃষা শিখে গেছে—কীভাবে স্থির মুখে নিজের ভেতরের জোয়ারকে চাপা দিতে হয়।
অমিত বেরিয়ে গেলে তৃষা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। বাচ্চা স্কুলে গেছে আগেই। কাজের মেয়ে বাসন ধুয়ে চলে গেছে। বাড়িটা নিঃশব্দ।
তৃষা উঠে আসে বারান্দায়। জানালার ধারে বসে থাকে। মাথায় একগোছা প্রশ্ন, কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজতে চায় না।
হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেট করে ওঠে। এসএমএস—
“ঘুম ভালো হয়েছে? আজ জানালার ধারে বসে আছো বুঝি।”
শুভ।
তৃষার ঠোঁটে একটুখানি হাসি আসে। না, প্রেম নয়—এই অনুভূতির সংজ্ঞা অন্যরকম। একরকম উপলব্ধি, কেউ বুঝতে পারছে, কেউ পড়ে ফেলছে ওকে। অনেক বছর পর কেউ তৃষাকে শুধু ‘একজন স্ত্রী’ বা ‘একজন মা’ হিসেবে দেখছে না—একজন নারী হিসেবে, যে হাসতে জানে, দুঃখ পুষে রাখে, শরীরকে নিয়ে সংকোচ করে, আবার সাহস করে হারিয়ে যেতে চায়।
তৃষা রিপ্লাই দেয় না। শুধু ফোনটা ধরে রাখে। তারপর ধীরে ধীরে একটা মেসেজ লেখে—
“আমি এখনও জানালার ধারে। তুমি কী জানো, বৃষ্টির পরের বাতাসে তোমার গলার গন্ধ লেগে থাকে?”
সেই মুহূর্তে তৃষার মন টালমাটাল। ভালোবাসা নয়—শুধু একরাশ স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা।
দুপুর গড়িয়ে যায়। শুভ আর মেসেজ করে না। কিন্তু তৃষার মনে হয়, কোথাও থেকে যেন ওর দৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
বিকেলে তৃষা একা বেরিয়ে পড়ে। সোজা চলে যায় গঙ্গার ধারে। পাড়ের ধাপগুলো একা একা পেরিয়ে বসে পড়ে এক কোণায়। চোখের সামনে জল, অথচ তৃষার মন যেন কোনও এক অদৃশ্য আগুনে পুড়ছে।
স্মৃতির খাতায় ফিরে আসে প্রথম যৌবনের দিনগুলো। তখন তৃষা কবিতা লিখত, আঁকত, বৃষ্টির জলে ভিজে ঘরে ফিরলে মা বকত—আর তাও হেসে হেসে হাত চেপে বলত, “এমন বৃষ্টিতে মন খুলে না ভিজলে চলবে?”
তারপর একদিন হঠাৎ বিয়ে। বাবা-মায়ের পছন্দে। অমিত ভাল ছেলে, চাকরি করে, মফস্বলের মেয়ে হিসেবে ওর জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু সেই বিয়ের পর থেকে তৃষা বুঝেছিল, ভালোবাসা আর ঘর—দুটো সমার্থক নয়।
কখন যেন সে তৃপ্তির বদলে অভ্যাসে জড়িয়ে পড়েছে।
শুভর মতো কেউ হয়তো সেই অভ্যাসের মধ্যে একটু আলো ফেলেছে।
সন্ধ্যার আগেই তৃষা বাড়ি ফেরে। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ওর হাত থমকে যায়। ভিতরে যাব কি না—এই প্রশ্ন এক মুহূর্তের জন্য ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। যেন এই ঘরে ঢুকলেই আবার সেই নিঃশব্দ সংসার, সেই গুমোট দম বন্ধ করা দেওয়াল।
ঠিক তখনই ফোন বাজে। শুভ।
তৃষা ধীরে ধীরে কলটা ধরে। শুভর গলা নরম, থেমে থেমে বলে,
“আজ কিছু বলনি। আমি বুঝি, কিন্তু জানি না তুমি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছো।”
তৃষা বলে, “একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভিতরে যাব কি না বুঝতে পারছি না।”
শুভ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “যদি মনে হয় জানালার আলোটা একটু বেশিই ঘন হয়ে গেছে, আমার দরজাটাও কিন্তু খোলা।”
এই কথাটা তৃষার ভেতরের সমস্ত লজ্জা, দ্বিধা, অপরাধবোধ ভেঙে দেয় না, কিন্তু একটা আশ্রয় দেয়।
তৃষা চুপ করে যায়, কিন্তু মনে মনে জানে—এখানেই গল্প শেষ হবে না।
এই সম্পর্ক পাপ হতে পারে, কিন্তু সেই পাপে কখনও কখনও মানুষের মুক্তি থাকে।
পর্ব ৩: শরীরের ভাষা
রাত দশটা। জানালার কাচে রোদ নেই, বৃষ্টি নেই—শুধু প্রতিফলিত আলো আর অন্ধকারের লুকোচুরি খেলা। ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে তৃষা তাকিয়ে আছে সেই জানালার দিকেই, যেখান থেকে একটা ঘরের আলো দেখা যায়, শুভর ঘর। ওর জানালায় এখনও আলো জ্বলছে। কখনও আলোটা দুলে ওঠে, মনে হয় কেউ হয়তো হেঁটে যাচ্ছে ঘরের ভেতরে, কখনও নিঃশব্দে থেমে থাকে—ঠিক যেমন থেমে আছে তৃষার বুকের ভিতরের জোয়ার।
অমিত আজ ফেরেনি। ফোনে শুধু জানিয়েছে, “আজ অনন্যার সঙ্গে একটা ক্লায়েন্ট মিটিং শেষে হোটেলেই থেকে যাব। কাল ফিরব।”
তৃষার উত্তর ছিল একটিমাত্র শব্দ—”ঠিক আছে।”
কিন্তু তৃষা জানে, ওর ভিতরে সেই শব্দটা কতটা অস্ফুট আর গর্জনময় ছিল।
রাত এগিয়ে যায়। ঘরের বাতাস ভারি। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে তৃষা একভাবে তাকিয়ে থাকে ছাদের দিকে। হঠাৎ এক মুহূর্তে সে উঠে পড়ে। পায়ে চুপচাপ স্যান্ডেল গলিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি নামতে থাকে। গায়ে একটা হালকা শাল জড়ানো। নিঃশব্দে, নিঃশ্বাস গুনে গুনে শুভর দরজায় এসে দাঁড়ায়।
দরজাটা খোলা। আলোর রেখা গিয়ে পড়েছে বারান্দার দেয়ালে। ভিতর থেকে জ্যাজ মিউজিকের মৃদু সুর ভেসে আসছে। তৃষা থামে, দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
শুভ ঘরের ভিতরে বসে ছিল, খেয়াল করেই উঠে আসে। চোখে চোখ পড়ে। না, সেখানে কোনো বিস্ময় নেই। শুধু একরকমের বোঝাপড়া।
“তুমি এসেছো?”—শুভ জিজ্ঞেস করে না, বলে।
তৃষা মাথা নাড়ে। “আজ ঘরে ফিরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না,” বলে।
শুভ একটুও ঘাবড়ায় না। সামনে এগিয়ে এসে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। “এসো।”
তৃষা ঘরে পা রাখে। চেনা ধূপের গন্ধ, হালকা মদের গ্লাস, কিছু বই ছড়ানো, আর এক কোণায় শুভর ক্যানভাস—আধা আঁকা একটা নারীপ্রতিমা।
“কে ও?”—তৃষা কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না।
শুভ হেসে বলে, “তুমি, হয়তো। বা তুমি যেভাবে নিজেকে ভাবো, ঠিক তেমন।”
তৃষা চমকে তাকায়। কে যেন একবার সত্যি করে ওকে দেখে ফেলেছে।
শুভ চুপ করে এসে তৃষার সামনে দাঁড়ায়। খুব ধীরে এক চুলের গোছা কানে সরিয়ে দেয়। তৃষা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ওর গায়ে লাগা শুভর আঙুল যেন বিদ্যুতের মত খেলে যায়। শরীরটাকে বোঝাতে হয় না কিছুই। শরীর নিজেই বুঝে ফেলে ভাষাহীন সেই টান, সেই তৃষ্ণা, সেই স্পর্শের মর্ম।
তৃষা বলে, “আমি জানি এটা ভুল। তবু ভুলের মধ্যেও একরকম মুক্তি আছে, তাই না?”
শুভ জবাব দেয় না। শুধু ওর হাত দু’খানা তৃষার কাঁধে রাখে। একটানা তাকিয়ে থাকে, তারপর ওকে ধীরে ধীরে নিজের কাছে টেনে আনে।
তৃষা ধীরে ধীরে চোখ খোলে। সেই চোখে জল নেই, কিন্তু জমে আছে কত শত নিঃসঙ্গ রাতের ভার।
“তুমি জানো শুভ,” ও ফিসফিস করে, “বিয়ে মানে আমি ভেবেছিলাম একসঙ্গে পথ হাঁটা। কিন্তু পথে আমি একাই চলেছি এতগুলো বছর।”
শুভ বলে, “তোমার হাঁটায় কেউ একবার থেমে দাঁড়াবে, সেটা হয়তো দরকার ছিল।”
তৃষা নিজের শরীরের ভেতরে শুভর উষ্ণতা টের পায়। ওর বুকের ওপর মাথা রেখে ভাবে, এই ছেলেটা ওর স্বামী নয়, কোনও প্রতিশ্রুতি দেয়নি, কিন্তু ওর শরীরটাকে শ্রদ্ধা করে ছুঁয়েছে। কোনও মালিকানাহীন স্পর্শ, কোনও দায়হীন আদর।
শুভ তৃষার মুখে ঠোঁট রাখে, ধীরে ধীরে, যেন প্রশ্ন করে—”তোমার সম্মতি আছে তো?”
তৃষা নিজের ঠোঁট তুলে দেয়—সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে।
বিছানার চাদরে গলে যায় সমস্ত সমাজ, সমস্ত পাপপুণ্যের ধারণা। শুধু দুটো মানুষের মাঝখানে জেগে থাকে একটুকরো জেগে ওঠা শরীর, একটুকরো জীবিত অনুভব।
কয়েক ঘণ্টা পর, শুভ ঘুমিয়ে পড়ে। তৃষা চুপ করে তার পাশে বসে থাকে, ওর চুলে আঙুল বুলিয়ে দেয়। মাথার ভিতরে তখনো বাজছে সেই একটাই সুর—স্বাধীনতা।
এই সম্পর্কের কোনও নাম নেই, কোনও আগামী নেই। তবু এখনকার এই মুহূর্তটা তার নিজের।
শুভর বুকের উপর মাথা রেখে তৃষা চোখ বন্ধ করে। জানালার বাইরে একটানা বৃষ্টি নেই, কিন্তু মেঘ জমেছে। আকাশের মতো ওর ভিতরটাও ভারী, তবু হালকা।
পর্ব ৪: এক রাতের পর
ভোরের আলো জানালার কাঁচে ধীরে ধীরে খেলা করছে। শহরটা তখনও জেগে ওঠেনি, কিন্তু পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে। শুভর ঘরে একটা হালকা ধোঁয়া-ধোঁয়া গন্ধ, ধূপ আর শরীরের উত্তাপ মিশে তৈরি করেছে এক আশ্চর্য বাতাবরণ। তৃষা ধীরে ধীরে উঠে বসে। শুভ ঘুমিয়ে, নিঃশ্বাস ভারী আর স্থির। তৃষা ওর মুখের দিকে তাকায় কিছুক্ষণ, তারপর নিঃশব্দে উঠে পড়ে।
ওর শাড়িটা ভাঁজ করে রাখা ছিল চেয়ারে। ওটা তুলে পরতে পরতে এক মুহূর্ত থেমে যায়—যেন নিজের চেনা পরিচিতিকে আবার গায়ে চাপাতে একটু দম নিতে হচ্ছে। একটা রাত, একটুকরো ভুল, একটুকরো স্পর্শ—এতটাই কি বদলে দিতে পারে একজন নারীকে?
তৃষার মনে পড়ে, বিয়ের প্রথম বছরগুলোতে অমিত এমনভাবে ওকে ছুঁত, যেন ছোঁয়ার মাঝেও গল্প ছিল। এখন তো শুধু শরীরটাই থাকে, চোখের মধ্যে আর কোনো আশ্চর্যতা নেই। ও বুঝে গেছে, শরীর ছুঁয়ে মন পাওয়া যায় না, কিন্তু কারও মন ছুঁলে শরীর আপনাআপনি সাড়া দেয়।
শাড়ি পরে তৃষা ধীরে ধীরে দরজা খোলে। শুভ ঘুমিয়েই। ওকে জাগায় না। বাইরে বেরিয়ে পড়ে সিঁড়ি বেয়ে। একতলার বারান্দা দিয়ে দেখলে কেউ কিছু টের পেত না—এই ভোরে সে শুধু যেন হাঁটতে বেরিয়েছে, যেমন অন্যান্য বহু ভোরে বেরিয়েছে হাঁটতে, বাজার করতে, কিছু ভাবতে।
কিন্তু আজ তৃষার পায়ে যেন এক অদৃশ্য পিছুটান। পেছন ফিরে তাকায় না, কিন্তু মনে হয় কেউ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বলছে—”তুমি আমার কিছু হয়ে গেলে?”
বাড়ি ফিরে গিয়ে দরজা খোলে চাবি দিয়ে। ঘরটা অন্ধকার। সন্তানের ঘরে তখনও নিঃশব্দ ঘুম। নিজের ঘরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় তৃষা। চোখের নিচে হালকা ক্লান্তি, ঠোঁটের কোণে একটু শুকনো হাসি, আর শরীরের খাঁজে এখনও টের পাওয়া যায় রাতের উষ্ণতা।
নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে—”আমি কি বদলে গেছি?”
না, বদলাইনি। বরং ফিরে পেয়েছি সেই নারীটিকে, যে শুধু সংসারের দায়ে নয়, নিজের চাওয়াতেও জেগে আছে।
তৃষা চুপচাপ একটা পাখির কাকলিতে আবার ঘর সাজিয়ে তোলে। চা বানায়। ছেলেকে স্কুলে তৈরি করে দেয়। প্রতিদিনকার মতোই, যেন কিছুই বদলায়নি।
দুপুরে, রান্না সেরে তৃষা জানালার ধারে বসে। রোদ পড়ছে কাঁচে, বাতাসে একটা শান্ত গন্ধ। ওর ফোনে একটা মেসেজ আসে—শুভ।
“তুমি চলে গেলে?”
তৃষা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে। তারপর উত্তর দেয়—
“চলে আসতে হয়। তুমি জানো না, এই সমাজে এক রাত্রির স্বাধীনতা বহুবার নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।”
শুভ রিপ্লাই দেয়—
“তুমি যদি মনে করো, সেটা এক রাত ছিল, তাহলে আমি কিছু বলবো না। কিন্তু আমি ভাবি, সেটা আমাদের নতুন করে বাঁচার একটা শুরু ছিল।”
তৃষা জানে, শুভ যা বলছে তা আবেগের বশে বলা। ওকে বুঝতে হবে, এই সমাজে একজন বিবাহিত নারীর জীবন শুধু নিজের চাওয়ার ওপর দাঁড়ায় না। এখানে প্রতিটি মুহূর্তে তাকে ন্যায়, অন্যায়, দায়িত্ব আর অপরাধবোধের কাঠগড়া পেরোতে হয়।
কিন্তু তবুও শুভর কথা মনে হয় তৃষার মনে একরকমের পরশ বুলিয়ে দেয়। ও ভাবে, এমন একটা পুরুষ, যে ওর চোখে তাকিয়ে বলে, “তুমি যথেষ্ট”—এই বাক্যটাই তো বহুদিন কেউ বলে না।
সন্ধ্যায় অমিত ফিরে আসে। দরজা খোলার শব্দে তৃষা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ওর মুখে ক্লান্তির ছাপ, গলায় কৃত্রিম অনুশোচনা।
“সরি তৃষা, হোটেলের ইন্টারনেট কাজ করছিল না, তোমাকে মেসেজও দিতে পারিনি পরে। কনফারেন্সটা অনেক লম্বা হয়েছিল।”
তৃষা চুপ করে থাকে। কোনো অভিযোগ নেই মুখে।
“তুমি কিছু বলছো না?”—অমিত জানতে চায়।
“বলার আর কিছু বাকি আছে?”—তৃষার গলায় ঠান্ডা অথচ ধারালো স্বর।
অমিত থেমে যায়। তারপর বলে, “তুমি কি কাঁদছিলে?”
তৃষা প্রথমবারের মতো ওর চোখে চোখ রাখে। “তুমি তো কখনও জিজ্ঞেস করোনি আমার চোখ লাল কেন। আজ হঠাৎ এত কৌতূহল?”
অমিত জবাব খুঁজে পায় না। তৃষা ধীরে সরে যায়। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মন চায়, চিৎকার করে বলতে—“তুমি আমায় হারিয়ে ফেলেছো, অমিত!” কিন্তু মুখ খোলে না।
রাত হয়। বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে থাকে দুজন। মাঝখানে এক হাত ফাঁকা, অথচ অদৃশ্য দূরত্ব যেন কয়েক মাইল।
তৃষা জানে, কিছু গল্প এক রাতে শেষ হয় না, আবার শুরুও হয় না ঠিকভাবে। মাঝখানে ঝুলে থাকে। কিন্তু এই ঝুলে থাকার মধ্যেই যদি পাওয়া যায় নিজের মতো করে শ্বাস নেওয়ার অধিকার—তবে সেই অপরাধই হোক বাঁচার একমাত্র উপায়।
পর্ব ৫: ছায়া হয়ে থাকা
তৃষা আজকাল অনেক কিছু দেখে, কিন্তু দেখে না। অনেক কিছু শোনে, কিন্তু শোনে না। যেন কোনো এক স্বচ্ছ আচ্ছাদনের নিচে ঢেকে ফেলেছে নিজেকে। বাইরে থেকে সে এখনও সেই আগের তৃষা—সাজানো সংসার, ছেলের স্কুলে যাওয়া-আসা, বাজার করা, অফিসের কাজ সামলানো সবই ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু ভেতরের তৃষা? সে এখন অদৃশ্য, এক ছায়ার মতো।
এই ছায়া হওয়া কষ্টের না, বরং মুক্তির মতো। এই ছায়া হয়ে থাকাতেই সে নিজেকে জড়িয়ে ধরতে পারে।
শুভর সঙ্গে সেই রাতের পর তাদের আর দেখা হয়নি। মেসেজে কথা হয়, মাঝে মাঝে ফোন আসে, তৃষা ধরে না। শুধু একবার মেসেজে লিখেছিল—
“এই যা ঘটেছে, তা এক রাতের নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি ভাঙতে চাই কিছু। আমি শুধু নিজের মতো বাঁচতে চাই।”
শুভও জবাব দেয় না। শুধু একদিন লিখেছিল—
“তুমি যেমন করে বাঁচতে চাও, আমি তেমন করেই তোমার পাশে থাকবো। ছায়া হয়ে। যদি কখনও আলোয় দাঁড়াতে চাও, আমি থাকবো ঠিক পাশেই।”
তৃষার মনে হয়েছিল, কোনো কবি হয়তো এইরকম কথা বলে, কোনো প্রেমিক না। কিন্তু তবুও, এই ছায়া হয়ে থাকা লোকটা যেন ওর পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিদিন, যখন রাত গভীর হয়, যখন অমিতের শরীর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে, যখন ঘরের আলো নিভে যায় কিন্তু ঘরের নীরবতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
একদিন বিকেলে, তৃষা বারান্দায় বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ নিচের ফ্ল্যাট থেকে দরজার শব্দ। শুভ বেরোচ্ছে। সাদা টি-শার্ট, কাঁধে একটা স্কেচপ্যাড ঝুলছে। এক ঝলক চোখাচোখি। শুভ তাকিয়ে রইল। তৃষা কিছু বললো না, শুধু একটুকরো দৃষ্টি ছুঁয়ে দিল ওকে।
তৃষা জানে, ওর মনে আর আবেগের ঝড় নেই। এখন শুভর দিকে তাকালে একটা আশ্রয় খুঁজে পায়, ঠিক যেভাবে কোনো তৃষ্ণার্ত পথিক খুঁজে পায় ছায়া, জল নয়।
পরদিন সকালে, ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তৃষা ফিরে আসে। দরজার সামনে শুভ দাঁড়িয়ে। হাতে একটা খাম।
“তোমার জন্য,” শুভ বলে।
তৃষা দ্বিধা নিয়ে খামটা নেয়। কিছু বলে না। ঘরে ঢুকে ধীরে ধীরে খামটা খোলে। ভিতরে একটা পেন্সিল স্কেচ। তৃষা—জানালার ধারে বসে আছে, মুখে হালকা হাসি, চোখ দুটো ভরা বিষণ্নতিতে। নিচে লেখা—
“একটা চুপ থাকা ভালোবাসা।”
তৃষার বুকের ভেতর থরথর করে কেঁপে ওঠে। এই তো সে, যে কথা বলে না, কিন্তু ভেতরে বয়ে নিয়ে চলে এক সমুদ্র।
দুপুর গড়িয়ে যায়। তৃষা স্কেচটা তাকের ভেতরে রেখে দেয়, যেটা অমিত কোনোদিন খুঁজবে না। এই ভালোবাসার কোনো দাবি নেই, কোনো গহনা নেই, শুধু নিজের ভিতরে বাঁচার অধিকার আছে।
সন্ধ্যাবেলা অমিত ফিরে আসে। অফিস থেকে ক্লান্ত, চোখ লাল, মুখে বিরক্তি।
“ঘরে আবার রান্না করা হয়নি?”—অমিত বলে।
তৃষা বলে, “তুমি খেয়েই তো আসো বাইরে থেকে।”
অমিত মুখ বেঁকিয়ে চলে যায়। ছেলের সঙ্গে খেলা করে না, খাওয়া শেষ করে মোবাইলে চোখ গুজে থাকে। তৃষা জানে, এটা এখন রুটিন।
রাতে বিছানায় শুয়ে অমিত জিজ্ঞেস করে, “তোমার কী হয়েছে আজকাল? তুমি আগের মতো নেই।”
তৃষা ধীরে উত্তর দেয়, “তোমারও তো আগের মতো থাকা হয়নি।”
অমিত চুপ করে যায়। ঘরের ভেতর একটা গুমোট নিঃশব্দতা জমে থাকে।
তৃষা জানে, এই সম্পর্কের ভিতরে যা ছিল, তা এখন ছায়া। সে নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে, কিন্তু হৃদয়টা একা হয়ে পড়েছে। আর এই একাকীত্বে শুভর ছায়া, নরম স্পর্শ, নিরব সঙ্গ—সব একে একে জায়গা করে নিয়েছে।
তৃষা জানে, সে অন্যায় করেছে। কিন্তু সেই অন্যায় কি এতটাই বড়, যে তার ভিতরের সব তৃষ্ণা, সব বেঁচে থাকার ইচ্ছা অস্বীকার করে দিতে হবে?
কোনো একদিন সে হয়তো কিছুই বলবে না। শুধু এক চিলতে জানালার আলোয় বসে, চোখ বন্ধ করে, শুভর আঁকা সেই স্কেচটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করবে—এই সম্পর্কের কোনো গায়ে পেন নয়, কিন্তু মন ছোঁয়।
একটা ভুল কি একটা মানুষের সত্তা বদলে দেয়?
না। বরং একটা ভুলই তাকে চিনিয়ে দেয়—সে আসলে কে।
আর তৃষা, সে এখন জানে—সে শুধু কারও স্ত্রীর পরিচয়ে আটকে নেই। সে একজন মানুষ, একজন নারী, যার ভালোবাসা জেগে থাকে ছায়ার মতো, স্পর্শ না করেও পাশে থেকে যায়।
পর্ব ৬: হৃদয়ের হোটেলঘর
তৃষা সেই দিনটার কথা কখনও ভোলে না। দিনের বেলায় স্বাভাবিক অফিসের কাজ, দুপুরে বাসার নির্জনতা, আর সন্ধ্যা নাগাদ হঠাৎ এক কল—শুভর।
“আজ একটু দেখা করা যাবে?”
তৃষা প্রথমে চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “কোথায়?”
শুভ বলে, “তুমি ঠিক করো। কিন্তু আজ আর জানালার ছায়া নয়, একটু খোলা আলোয় বসতে চাই।”
তৃষা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, “হোটেল হরিণী। তৃতীয় তলা, ঘর নম্বর ৩০৭। সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা।”
ফোন কেটে যায়। তৃষার বুকের মধ্যে একরকম ঘূর্ণি উঠে আসে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে—এটা কি আবার সেই রাত্রির পুনরাবৃত্তি? না, এটা শুধু একটা বোঝাপড়া?
হোটেল হরিণী, দক্ষিণ কলকাতার পুরনো একটা বোর্ডিং হাউস। জীর্ণ কাঠের সিঁড়ি, দেয়ালে বিবর্ণ রঙ, করিডোরে ধুপের গন্ধ মেশানো সোঁদা বাতাস। ঘরটা মাঝারি, জানালা দিয়ে গাছের ডালপালা দেখা যায়, যেগুলো বাতাসে দুলে দুলে যেন পিছুটানের মতো চুমু খাচ্ছে কাঁচে।
শুভ পৌঁছায় একটু আগে। সাদা শার্ট, নীল ডেনিম, হাতে একগুচ্ছ বকুলফুল।
তৃষা ঢুকে বলে, “ফুল কেন?”
শুভ মুচকি হাসে, “তোমার জন্য নয়, সেই মেয়েটার জন্য, যে একদিন জানালার পাশে বসে বলেছিল—‘আমি বাঁচতে চাই।’”
তৃষা কোনো কথা বলে না। একটা চুপচাপ ঘনতা জমে ওঠে ঘরের মধ্যে।
তারা দু’জন বসে থাকে কিছুক্ষণ। চুপ করে। মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকায়। কোনো আলাপ নেই, কোনো হাত ছোঁয়া নেই, শুধু জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাসে দুটো নিঃশ্বাস ধাক্কা খায়, একে অন্যের বুকে এসে থেমে যায়।
শুভ প্রথম বলে, “তোমার চোখে একটা অন্য আলো ফুটেছে তৃষা। তুমি জানো?”
তৃষা বলে, “হয়তো জানি। হয়তো জানি না। নিজের চোখে তো আর নিজেকে দেখা যায় না। কেউ যদি সত্যি করে দেখে, তবেই বোঝা যায়।”
শুভ ধীরে তৃষার হাতটা ধরে। এবার স্পর্শে শরীরের উত্তেজনা নেই, বরং একরকম স্বস্তি, বিশ্বাস, বোঝাপড়া। তৃষা বলে, “তুমি কি জানো, এই স্পর্শটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে?”
শুভ হাসে, “তবে সেই স্পর্শের বিনিময়ে যদি সমাজ তোমাকে পাথর ছুঁড়ে মারে?”
তৃষা মৃদু হেসে বলে, “তারা তো বহু আগেই ছুঁড়েছে। শুধু আমি সরে গিয়েছিলাম।”
একটা দীর্ঘ নিঃশব্দতা জমে ওঠে। ঘরের ঘড়িতে টিকটিক শব্দ। বাইরের হর্ন। দূরের মসজিদের আজান।
হঠাৎ শুভ বলে, “তুমি কি চলে যেতে চাও?”
তৃষা চমকে ওঠে। “মানে?”
“মানে,” শুভ বলে, “এই শহর, এই সংসার, এই গুমোট, এই সবকিছু থেকে। তুমি কি চাও, একদিন সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে?”
তৃষা জানে, এই প্রশ্নটাই তার দীর্ঘদিনের অনুচ্চারিত ইচ্ছা। কিন্তু বাস্তবের ভার এত ভারী যে তাতে পা তোলে না সহজে।
সে ধীরে বলে, “চাই। কিন্তু পারি না।”
শুভ তৃষার দিকে এগিয়ে আসে। বলে, “পারো না, না পারতে দেওয়া হয় না?”
তৃষা চোখ বন্ধ করে। বুকের ভিতর সেই পুরনো দরজা খুলে যায়—যেখানে সে একদিন গান গাইত, আঁকত, লিখত, বিয়ের পর ফেলে রাখা সব কিছুর স্তূপ জমে আছে।
সে ধীরে ধীরে বলে, “আমি পালাতে চাই না। আমি শুধু একটু জায়গা চাই, যেখানে আমি আমার মতো থাকতে পারি।”
শুভ মাথা নোয়ায়, “তবে এই ঘরটা আমরা রোজ বানাব। হৃদয়ের হোটেলঘর। বাইরে যা কিছু, তা থাকুক। এখানে তুমি, আমি, আর আমাদের বোঝাপড়া। স্পর্শ নয়, অধিকার নয়, শুধু একটুকরো অবকাশ।”
তৃষা হঠাৎ অনুভব করে, তার বুকের ভিতর একটা নরম পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। চোখে জল আসে না, কিন্তু ঠোঁট কাঁপে।
শুভর বুকে মাথা রাখে, ধীরে বলে, “আমার কোনোদিন কেউ এমন করে কিছু বলেনি।”
সেদিন রাতে তারা কাছাকাছি আসে না। কোনো শরীরী উষ্ণতা নেই। শুধুমাত্র দু’টি মানুষ, যাদের বুকের ভেতরে ঝড়, আর বাইরে এক গভীর শান্তি।
ঘর ছেড়ে বেরোবার সময় তৃষা পেছন ফিরে তাকায়। হোটেলের খাট, জানালা, স্কেচপ্যাডে আঁকা একটা অসম্পূর্ণ রেখা। মনে হয়, এই ঘরটা রেখে গেল একটা কবিতা, যেটার শেষ লাইন লেখা হয়নি।
পর্ব ৭: থেমে থাকা সকাল
সকালের ঘড়িতে ঠিক সাতটা বাজে। রান্নাঘর থেকে চাপা শব্দ আসে—চায়ের জল ফুটছে। ছেলেটার স্কুলবাস আসবে আটটায়। অমিত স্নানঘরে, শেভ করছে, রেডিওতে বাজছে ট্রাফিক আপডেট।
তৃষা দাঁড়িয়ে থাকে বেসিনের সামনে, মুখ ধোয়া শেষ করেও আয়নার সামনে অনেকক্ষণ। আয়নার পেছনের দেয়ালে লেপ্টে থাকা ধোঁয়াটে গন্ধটা আজ স্পষ্ট—নিজের গায়ে আর কারও স্পর্শের প্রতিফলন কি এতদিন ওর চেহারায় লুকিয়ে ছিল?
অথচ কিছুই তো বদলায়নি বাইরের দুনিয়ায়। চা যেমন ফুটছে, ছেলের ব্যাগ যেমন গুছিয়ে দিতে হচ্ছে, তেমনি অফিসের ছুটির জন্য ইমেইল লিখতে হচ্ছে। তবু ভিতরের ভিতর, একটা কিছুর ছায়া ওকে হালকা করে দিয়েছে। ঠিক যেন শরীরের একটা ভার ঝরে পড়েছে—না আত্মগ্লানির, না অপরাধবোধের, বরং বহুদিনের অভিমান, জমে থাকা না-বলা কথার।
অমিত খাবার টেবিলে বসে বলে, “আজ অফিসে একটু দেরি হতে পারে। ক্লায়েন্ট আসছে।”
তৃষা বলে, “আমি ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরব। তুমিই বুঝে নিও কখন আসবে।”
অমিত একবার তাকায়। কিছু বলতে চায়, বলে না। কেমন যেন অস্বস্তি। যেন তৃষার মধ্যে কিছু একটা বদল ঘটেছে, কিন্তু সে তা ধরতে পারছে না।
ছেলেকে বিদায় জানিয়ে তৃষা বারান্দায় দাঁড়ায়। সোনালি রোদের মাঝে গাছের পাতা ঝিমোচ্ছে, দূরে হালকা কুয়াশার রেখা। ওর মনে পড়ে শুভর কথা—“এই ঘরটা আমরা রোজ বানাব।”
একটা হোটেলঘর, যেখানে কেউ কাউকে দায়বদ্ধ করে না, যেখানে কোনো অজুহাত থাকে না, থাকে শুধু স্পর্শের বাইরেও এক নিঃশব্দ বোধ।
হঠাৎ ফোনটা বাজে। শুভ।
তৃষা ধরার আগে থেমে যায়। পরক্ষণেই মেসেজ আসে—
“আজ জানালার পাশে বসে আছো কি?”
তৃষা উত্তর দেয় না। শুধু ফোনটা বুকের কাছে চেপে রাখে। যেন ও জানে, কেউ কোথাও থেকে ওকে অনুভব করছে, বোঝার চেষ্টা করছে।
দুপুর গড়িয়ে যায়। তৃষা আজ আর রান্নাঘরে যায় না। দুপুরের খাবার ডেলিভারি অর্ডার করে। নিজেকে নিয়ে একটু যত্ন করে—চুল বাঁধে, হালকা কাজল দেয়, এক জোড়া টিপ পরে। এতদিন নিজেকে সাজানোর ইচ্ছেটাও ভুলে গিয়েছিল।
হঠাৎ দরজায় টোকা। ডেলিভারি বয় নয়। নিচের ফ্ল্যাটের কাজের মেয়ে বলে, “ম্যাডাম, শুভ স্যারের পাসে কেউ এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে গেল ওনার ঘরে।”
তৃষার বুকটা ধক করে ওঠে। কেউ এসেছে? কে? মেয়ে? বন্ধু?
সে জানে, সে শুভর কোনো কিছুতেই দখল চায় না। তাদের সম্পর্ক দখল কিংবা দাবি ছাড়াও দাঁড়াতে চেয়েছিল। তবুও বুকের ভেতর হালকা টান লাগে—যা একসাথে শুরু হয়, তার মাঝখানে যদি তৃতীয় কেউ আসে, তবে সম্পর্কের স্বচ্ছতা কি ভেঙে যায়?
কিছু না বলে জানালার ধারে আসে। নিচে তাকায়। শুভর ঘরে আলো জ্বলছে। জানালার পর্দা টানা। কিছুই দেখা যায় না।
তৃষা চুপ করে বসে থাকে। বইয়ের পাতা খুলে, এক লাইনও পড়তে পারে না। কানের কাছে বাজতে থাকে হাজার শব্দ—কেউ কি ওর মতোই একা ছিল? কেউ কি ওর আগেই এসে পড়েছে শুভর জীবনে?
মনে পড়ে, সেই হোটেলঘরে শুভ বলেছিল—“এই ঘরটা রোজ বানাব। শুধু তোমার জন্য।”
তৃষা ভাবে, কথাগুলো কি শুধু বাতাসে উড়ে যাওয়ার মতো? না কি অনুভবের কোনো সীমা আছে?
অন্ধকার ঘনাতে থাকে। ছেলেকে নিয়ে তৃষা ব্যস্ত থাকে কিছুক্ষণ। খাওয়ায়, হোমওয়ার্ক করে, শুইয়ে দেয়।
রাত দশটা। তৃষা বারান্দায় দাঁড়ায়। নিচের ঘরে এখনও আলো। শুভ এখনও ঘুমায়নি।
হঠাৎ ফোনে মেসেজ আসে—
“আজ একটু দেরি হবে। পুরোনো বন্ধু এসেছে। সন্ধ্যায় ওর সঙ্গে কিছু ছবি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তুমি ঠিক আছো তো?”
তৃষার ঠোঁটে একটা হালকা হাসি আসে। অকারণ চিন্তা, অকারণ দুর্বলতা—এইসবই তো মনের খেলা। শুভ কোনো প্রশ্ন তোলেনি, কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, শুধু জেনে নিতে চেয়েছে—“তুমি ঠিক আছো তো?”
তৃষা মনে মনে ভাবে, একজন মানুষের পাশে থাকা মানেই হয়তো সব জানার অধিকার নয়, বরং না জেনেও নির্ভরতার জায়গা বানিয়ে নেওয়া।
সে লিখে—
“ঠিক আছি। আজ থেমে ছিলাম কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে আবার খুঁজে পেলাম।”
শুভ উত্তর দেয়—
“থেমে যাওয়া খারাপ নয়। থেমে থাকলে কখনও কখনও নিজেকে স্পষ্ট দেখা যায়। তোমাকে ভালোবাসা, সেই চুপ থাকা ভালোবাসা রইলো।”
তৃষা জানে, ভালোবাসা বলে কিছু নেই তাদের মধ্যে—যা আছে তা অন্যকিছু। সমাজ হয়তো এর নাম দেবে—পাপ, অন্যায়, বা পরকীয়া। কিন্তু তৃষার কাছে এটা মুক্তি, এই সম্পর্ক তাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
এই থেমে থাকা সকাল থেকে শুরু হয় আরেক দিনের খোঁজ। আর তৃষা জানে, যতদিন শুভ সেই হোটেলঘর কিংবা জানালার আলোয় তার পাশে থাকবে—সে হারিয়ে যাবে না।
পর্ব ৮: শীতল দুপুর, নরম চিঠি
দুপুরটা আজ যেন একটু বেশি নিঃশব্দ। জানালার কাচে সূর্যরশ্মির আলো ফোটে না আগের দিনের মতো। শীতকাল বলে হয়তো, হালকা কুয়াশা ঘিরে রেখেছে বারান্দা, গাছে পাতাগুলো নিস্তেজ।
তৃষা বসে আছে ডাইনিং টেবিলের এক কোণে, সামনের কাপে ধোঁয়া ওঠা চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বইটা খোলা, তবু পাতাগুলো না-পড়া।
ঘরের মধ্যেও হালকা শূন্যতা জমে উঠেছে আজ।
তৃষা আজ সকালেই বুঝেছে—এই সম্পর্ক, এই ‘চুপ থাকা ভালোবাসা’, যতই নরম হোক, তার ভিতরেও একটা অস্থায়িত্ব আছে। শুভর সঙ্গে প্রতিটি দেখা, প্রতিটি স্পর্শ যেন ক্ষণিকের পরশ, ঠিক যেমন পাতার ওপর ভোরের শিশির—উঠে গেলে আর ফেরে না।
সকালবেলা রান্নাঘর গুছোতে গিয়ে, খাটের নিচে একটা খাম পেয়েছিল তৃষা। কোনো ডাক নয়, কোনো বিল নয়—একটা চিঠি। শুভর হাতের লেখা।
শুরুতে কিছুটা দ্বিধা ছিল পড়বে কি না। তবে পরে নিজেকে আটকাতে পারেনি। পড়েছিল।
“তৃষা,
এই চিঠিটা তোমার কাছে হয়তো অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। আমরা যেভাবে কথা বলি, যেভাবে চুপ করে থাকি, তার মধ্যে এই চিঠি কেমন যেন বেমানান। তবু লিখছি। কারণ মুখে বলা যায় না কিছু কিছু কথা।
তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ককে আমি কোনো নাম দিতে পারি না। পাপ বলেও না, ভালোবাসা বলেও না। বরং এক ধরনের গভীর বোঝাপড়া, যেটা প্রতিদিনের সংলাপ ছাড়াও বাঁচে। তুমি জানো, আমি প্রথম দিনই দেখেছিলাম তোমার চোখে এক রকম ক্লান্তি, যেটা আমি অনেক মেয়ের চোখে দেখেছি, কিন্তু কোনোদিন অনুভব করিনি। তোমার চোখে তাকিয়েই বুঝেছিলাম—তুমি চাও না কেউ তোমার জন্য চিৎকার করুক, বরং এক নিঃশব্দ পাশে দাঁড়িয়ে থাকুক।
তুমি যে কখনও আমার হয়ে যাবে, সেটা চাইনি কখনও। শুধু চেয়েছি, আমার পাশে তুমি যেন নিজের মতো করে হাঁটো। আমার ছায়া পড়ুক তোমার পথের পাশে, ঠিক যেমন জানালার আলো পড়ে দেয়ালে, নরম, নিঃশব্দ।
এই যে আমাদের হৃদয়ের হোটেলঘর—যেখানে আমরা দু’জন নিজেদের খুঁজে পাই—আমি জানি, সেটা চিরকালের নয়। আমি জানি, একদিন হয়তো তুমি এই চিঠিটা পড়ে উঠে দাঁড়াবে, দরজা খুলে যাবে তোমার সংসারে, আর আমি জানালায় দাঁড়িয়ে দেখব তোমার চলে যাওয়া। আমি কিছু বলব না।
তবুও, এই কিছু মাস, এই কিছু স্পর্শ, এই কিছু চোখের গভীরতা—সব আমার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমি এগুলো বুকে করে রাখবো।
তোমাকে ভালোবাসা—যেমন তুমি চাইলে তেমন করে, কোনো দাবি ছাড়াই।
—শুভ”
তৃষা চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। চোখে জল আসেনি, কিন্তু বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা নীরব কাঁপন চলছিল। শুভ, যে এতদিন নীরবে ওর পাশে থেকেছে, ওকে ভালোবেসেছে বিনা দাবিতে, সেই মানুষটাই যেন আজ এক ধরনের বিদায়ের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে।
তৃষা ভাবে, কি করবে এখন? সেই চিঠির জবাবে কি কোনো মেসেজ? ফোন? না কি আরও একটা চিঠি?
অথচ কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। শুধু নিজের ভেতরে ফিরে যেতে চায়। কারণ শুভর এই চিঠি ওর কাছে প্রেমের শেষ পর্ব নয়, বরং নিজের ভিতর থেকে উঠে আসা সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সময়।
দুপুরে তৃষা ছাদে ওঠে। জানে, শুভ নিচে নেই—স্কুলে ক্লাস আছে। তারপর হয়তো সে বেরিয়ে পড়বে, হয়তো আর কোনোদিন ফিরবে না।
ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে তৃষা চোখ বন্ধ করে। বাতাসে এখনও শুভর শরীরের হালকা গন্ধ টের পায় যেন—ধূপ, আঁকা কাগজের গন্ধ, আর সেই চেনা নিঃশ্বাস।
তৃষা মনে মনে বলে—“তুমি যদি চলে যাও শুভ, আমি তোমায় থামতে বলব না। কারণ তুমিও তো কখনো আমাকে আটকে রাখতে চাওনি। শুধু জানবে, আমি যে নিজেকে আবার চিনতে পেরেছি, সেটা শুধু তোমার জন্য। আমি এখন জানি—আমি কেবল কারও স্ত্রী নই, কেবল কোনো মায়ের নাম নয়। আমি একজন নারী, যার ভেতরে এখনও কবিতা জেগে ওঠে।”
নিচে নেমে এসে চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে দেয় একটা পুরনো ডায়েরির পাতায়। সেই পাতাটির ওপরে পেন্সিলে লেখে—
“ভালোবাসা মানেই অধিকার নয়।”
বিকেল গড়িয়ে যায়। ফোনে কোনো মেসেজ নেই, কোনো কলও না। শুভ কি সেই চিঠির মাধ্যমে বিদায় নিয়ে নিয়েছে?
তৃষা কাঁদে না। শুধু ঘরের মধ্যে আলো জ্বালায় না। চুপচাপ বসে থাকে অন্ধকারে, যেমন করে একাকীত্ব আপন মনে গল্প বলে।
রাত গভীর হলে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ চোখ যায়—শুভর ঘরের আলো নিভে গেছে। ঘরটা খালি? না কি, শুধু নিভে থাকা?
তৃষা জানে না। জানে না ভবিষ্যতে কী আছে। শুধু জানে, একদিন একজন এসেছিল, কিছু চায়নি, তবু অনেক কিছু দিয়ে গেছে।
এই শীতল দুপুর, এই নরম চিঠি—সব মিলিয়ে এক পর্ব শেষ। কিন্তু তৃষা জানে, কোনো শেষ মানেই শেষ নয়। অনেক সময় শেষ হলেই শুরু হয় নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া।
পর্ব ৯: ফিরে দেখা অন্ধকার
রাতটা ছিল অন্যরকম। তৃষা অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বারবার শুভর চিঠিটার কথা মনে পড়েছে—সেই শব্দগুলো, যেগুলো কোনও দাবি তোলে না, তবু বুকের ভিতরে অজস্র প্রশ্ন ফেলে রেখে যায়।
শুভ কি সত্যিই চলে গেল? না কি তৃষার চুপ থাকা তাকে ধীরে ধীরে সরে যেতে শিখিয়ে দিল?
অমিত পাশেই ঘুমিয়ে ছিল, মুখে ক্লান্তির ছাপ, নাক দিয়ে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস। তৃষা তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ—এই মানুষটার সঙ্গে যে একদিন বৃষ্টির ভেজা রাতে হাত ধরেছিল, প্রথম চুমুতে কেঁপে উঠেছিল, সেই মানুষটা এখন কেবল একটি অভ্যাস। অভ্যাসের মতো থাকা, অভ্যাসের মতো ছোঁয়া, অভ্যাসের মতো সহবাস।
তৃষা জানে, অমিত হয়তো কোনোদিন ওকে ক্ষমা চাইবে না, কারণ ও তো জানেই না যে ক্ষমার প্রয়োজন আছে। এই দাম্পত্যের মধ্যে ভালোবাসা কবে উবে গেছে, তা কেউ জানে না।
ভোররাতে ঘুম আসে হালকা। তৃষা চোখ মেলে দেখে, জানালার বাইরে আলো ফুটেছে, কিন্তু নিজের ভিতরে এক অদ্ভুত অন্ধকার ঘন হয়ে আছে।
সকালে উঠে কাজের রুটিন চলে—ছেলেকে স্কুলে পাঠানো, অমিতকে রুটি বানিয়ে দেওয়া, নিজের ঘর গোছানো, চা তৈরি। কিন্তু প্রতিটি কাজ যেন যন্ত্রচালিত। সেই পুরনো সুরে চলতে চলতে এবার যেন এক বাঁধভাঙা নৈঃশব্দ্য ওর ভিতর থেকে চিৎকার করে ওঠে—এই তো আমি, এই তো আমার হারিয়ে যাওয়া আমি!
বেলা দশটা নাগাদ তৃষা বেরিয়ে পড়ে। শুভর ঘরে আলো জ্বলছে না, দরজায় তালা। কাজের মেয়েটা বলে, “স্যার গতকাল রাতে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিলেন। আজ আসেননি।”
তৃষার বুকের ভিতর ফাঁকা হয়ে যায়। শুভ চলে গেছে। বলা হয়নি, বিদায় জানানো হয়নি, শুধু রেখে গেছে একটা চিঠি।
শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তৃষার মনে পড়ে সেই প্রথম সন্ধ্যা, যখন সিঁড়ির মোড়ে শুভ বলেছিল, “তুমি কি জানো জানালার পাশে বসে তুমি কেমন লাগো?”
সে জানে, শুভ তাকে ভালোবেসেছিল নিজের মতো করে। তাকে ছুঁয়েছে এমনভাবে, যেন সেই ছোঁয়ায় শরীরের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে হৃদয়ের ভাষা।
একটা পুরোনো ক্যাফেতে ঢোকে তৃষা। চারকোনা টেবিল, কাঠের চেয়ার, জানালার পাশে বসে থাকে। ওয়েটার এসে চা নিতে চায়। তৃষা বলে, “দুধ ছাড়া লিকার, কম চিনি।” শুভর মতো।
টেবিলের কোণায় টিস্যুতে লেখা কিছু শব্দ চোখে পড়ে—
“বুকের ভেতর এই যে স্নিগ্ধতা, এটা তুমি রেখে গেলে।”
তৃষা হাত বুলিয়ে দেয় লেখাটার উপর। যেন সেই অচেনা হাতে লিখে রাখা কথা আজ ওর হৃদয়ের কথা বলছে।
চা খেতে খেতে তৃষা ভাবে, প্রেম যদি এত সহজে ভেঙে যাওয়ার মতো হত, তবে শুভর উপস্থিতি এত গভীরভাবে ওর ভিতরে বাসা বাঁধত না। এই ভালোবাসা অন্যরকম—এমন ভালোবাসা যা প্রতিদিন চোখে পড়ে না, কেবল অনুভবে বাঁচে।
ঘরে ফিরে এসে ও সেই ডায়েরিটা খোলে, যেখানে শুভর চিঠি রাখা। পাশেই পেন। অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করে—
**“শুভ,
তোমার চিঠি পড়েছি। একবার নয়, অনেকবার। প্রতিটি শব্দ আমার ভিতরে বাজতে থেকেছে। আমি কখনও ভাবিনি, কেউ আমাকে ছুঁয়ে যাবে এমনভাবে, যে ছোঁয়ায় আমি নিজেকে নতুন করে চিনব।
তুমি হয়তো চলে গেছো, অথবা সরে দাঁড়িয়েছো। হয়তো এই চিঠির উত্তর তুমি পাবে না কখনও। তবু লিখছি, কারণ আমার নিজের কাছেও কিছু স্পষ্ট করে বলা দরকার।
আমি জানি, তুমি আমার জীবনে এসেছিলে একটুখানি ছায়া নিয়ে, আলো দিয়ে যাওনি। অথচ তোমার ছায়াটাই ছিল আমার কাছে আলো। আমি অনেকটা পথ হেঁটেছি—অসুখী, অথচ মুখে হাসি ধরে রেখেছি, স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে, মেয়ে হিসেবে নিজের কর্তব্য করেছি। কিন্তু সেই দায়িত্বের ফাঁকেই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
তুমি আমায় সেই হারানো আমিটার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলে।
তাই তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, আর ভালোবাসা? আমি জানি না ভালোবাসা মানে কী, কিন্তু যেটা তোমার জন্য আমার ভিতরে রয়ে গেছে, সেটা কোনো নাম চায় না। শুধু চায়, তুমি যেন সুখে থাকো।
যদি কখনও ফিরে আসতে চাও, আমি জানি না তোমায় স্বাগত জানাতে পারবো কি না, কিন্তু তোমার জন্য একটুকরো চুপ থাকা জায়গা আমার জানালার পাশে রয়ে যাবে।
—তৃষা”**
চিঠিটা লিখে তৃষা এক গ্লাস জল খায়। বাইরের আকাশ ধূসর। বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
চিঠিটা ভাঁজ করে সে রাখে সেই পুরনো ডায়েরিতে। জানালার ধারে এসে বসে থাকে চুপ করে।
আর তখনই হঠাৎ দরজার বেল বাজে। তৃষা ধক করে ওঠে। এত সকালে কে?
পায়ে পায়ে গিয়ে দরজা খোলে।
সামনে দাঁড়িয়ে শুভ। সাদা শার্ট, চোখে ক্লান্তি, হাতে কিছু নেই।
তৃষা কিছু বলতে পারে না। শুভ ধীরে বলে, “একবার তোমার পাশে বসতে চাই, সেই জানালার ধারে।”
তৃষার চোখ ভিজে আসে। শুধু মাথা নাড়ে। ঘরের মধ্যে তারা আবার বসে—যেখানে ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা নেই, শুধু ফিরে আসা আছে।
পর্ব ১০: জানালার ধারে, একদিনের জন্য চিরকাল
ঘরের মধ্যে নেমে এসেছিল এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। শব্দহীনতা, তবু তা কোনো অস্বস্তি নয়। বরং যেন বহুদিন পর একেকটা নিঃশ্বাস নিজেদের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। শুভ জানালার ধারে এসে বসে পড়েছে। তৃষা সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
অনেক প্রশ্ন, অনেক জবাব—সব জমে রয়েছে চোখের গভীরে। তবু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না। কারণ তারা দু’জনেই জানে, এই ফিরে আসা কোনো নাটক নয়, কোনো প্রেমের বড় ঘোষণা নয়। এ কেবল একটা অসম্পূর্ণ গানের শেষ কলি খুঁজে পাওয়ার মতো।
শুভ বলল, “চিঠিটা পড়েছিলাম। তুমি জানো, আমি আসব?”
তৃষা মাথা নাড়ল, “জানি না। আবার জানতেও চেয়েছিলাম না। আমি শুধু চেয়েছিলাম তুমি জেনে যাও, যে তুমি আমাকে কী দিয়েছো। একটা নামহীন অনুভব, যা আমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনেছে।”
শুভ ধীরে বলল, “আমি ভেবেছিলাম চলে যাব। সত্যি। কিন্তু গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়ে মনে হল—তোমার জানালার পাশের আলোটা না দেখে গেলে আমার ভেতরের আলো নিভে যাবে।”
তৃষা ধীরে এসে পাশে বসে। মাথা হালকা করে হেলিয়ে দেয় শুভর কাঁধে। শুভর হাত ওর আঙুল ছুঁয়ে থাকে। কোনো টান, কোনো জোর নেই, শুধু একটা স্নেহ, যেন বলছে—”তুমি এখন নিরাপদ।”
ঘরের এক পাশে রাখা ফুলদানিতে শুকিয়ে যাওয়া বকুলফুলগুলোর গন্ধ এখনও থেকে গেছে। শুভ হেসে বলে, “এই ফুলগুলোও তো চিরকাল টেকে না। তবু একটা দুপুরে কেউ কাউকে দিয়ে রাখে, সেটা কি কম কিছু?”
তৃষা বলে, “সব সম্পর্ক কি চিরকাল থাকতে পারে? না কি আমাদের উচিত, শুধু সেইটুকু যত্নে রাখা, যেটা ছিল সুন্দর, যেটা ছিল সত্যি?”
শুভ একবার তাকায়। “আমরা তো চিরকালের গল্প নই। কিন্তু আমরা একদিনের জন্য চিরকাল হতে পারি, তাই না?”
তৃষা চোখ বন্ধ করে, মাথা নাড়ে। ঠিক তাই। একটা সকাল, একটা জানালার পাশে বসা, একটা চিঠি, একটা ফিরে আসা—এই কয়েক মুহূর্ত যদি সত্যি হয়, তাহলে পুরো জীবন জুড়ে থাকা মিথ্যাগুলো একটু নরম হয়ে যায়।
তৃষা বলে, “আমার ফিরে যাওয়া দরকার। সংসার আছে, সন্তান আছে, দায়িত্ব আছে। তুমি জানো।”
শুভ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “আমি চাই না তুমি পালিয়ে এসো। আমি শুধু চাই তুমি নিজের ভিতরটায় ফিরে যাও নিজের মতো করে। আর যদি কোনোদিন আবার মনে হয় জানালার পাশে বসে কিছু চুপ করে কাটাতে চাও, আমি থাকব।”
তৃষা হাসে। সেই চেনা নরম হাসি। বলে, “তুমি সত্যি বুঝেছো, শুভ। এই সম্পর্ক আমি রাখতে চেয়েছিলাম নিজের মতো করে। কারণ তুমি আমায় কোনোদিন বাধা দাওনি। নিজের করে নাওনি। শুধু পাশে থেকেছো। একটা ছায়া হয়ে, একটা আলো হয়ে।”
তারা দুজন অনেকক্ষণ বসে থাকে জানালার ধারে। বাইরের আকাশ ধূসর। সন্ধ্যা নামছে। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে শীতের ঘন আলসেমি।
হঠাৎ তৃষা উঠে দাঁড়ায়। “আমায় যেতে হবে,” বলে।
শুভ কিছু বলে না। শুধু মাথা নোয়ায়।
তৃষা দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার সময় থেমে যায় এক মুহূর্ত। পেছন ফিরে বলে, “আমার নাম তৃষা। কিন্তু তুমি আমাকে তৃষ্ণা করে রেখেছিলে।”
শুভ বলে, “তুমি জানো, বৃষ্টির ফোঁটার মতো তুমি আমার সমস্ত খরার দিনে নেমে এসেছিলে।”
তৃষা হেসে বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে নামে ধীরে, অথচ একরকম দৃঢ়তায়। মনে হয়, বহুদিন পর ওর পায়ে নিজস্ব শব্দ ফিরে এসেছে।
বাড়ি ফিরলে ছেলেটা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। অমিতও টেবিলে বসে, ফোন ছুঁয়ে বলে, “আজ এত দেরি?”
তৃষা চুপ করে হাসে। বলে, “একটা পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করছিলাম।”
অমিত অবাক হয় না। কিছু বলে না।
রাতে তৃষা জানালার ধারে বসে। হাতে এক কাপ চা। ঠোঁটে সেই চেনা হাসি। বাইরে ধীরে ধীরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, মোবাইলে একটিমাত্র শব্দে একটি মেসেজ আসে—
“আজ জানালার ধারে বসে আছো?”
তৃষা টাইপ করে—
“হ্যাঁ। আজ চিরকালের মতো।”
—
সমাপ্ত
ধন্যবাদ, পাঠক। এই গল্পে থেকেছেন বলে। এই ভালোবাসা ছিল নীরব, তবুও অসীম।
—সুস্মিতা লাহা