Bangla - ছোটদের গল্প

পেপার প্লেনস ওভার পার্ক স্ট্রিট

Spread the love

তনিশা দে


The Boy with Paper Wings

অর্ণব গুহকে কেউ ঠিকভাবে মনে রাখে না।

সে ঠিক সেই ছেলেটা যে স্কুল অ্যানুয়াল ফটোর এক কোনায় দাঁড়ায়, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পড়ার আগেই চোখ বুজে ফেলে। তার নাম ভুল করে টিচাররা উচ্চারণ করেন “অর্ণব” নয়, “অরনভ”, আর তাতে সে শুধরে দেওয়ার চেষ্টাও করে না। ক্লাসে কেউ পেন ভুলে গেলে তার কাছে চায় না, ল্যাব পার্টনার হলে অন্যজন মুখ বাঁকায়, আর লাঞ্চ ব্রেকে সে ক্যান্টিনের পিছনের সিঁড়িতে বসে চুপচাপ খায়—একটা ছ্যাঁদা টিফিনবক্স থেকে।

সে এই শহরের এক আনকোরা ছায়া।

কিন্তু এক জিনিসে সে আলাদা।

অর্ণব কাগজের প্লেন বানায়।

না, খেলনার মত না। প্রতিটা প্লেন হয় একখানা কাগজের আত্মজীবনী। সে কেটে ফেলা খাতা, পুরোনো পরীক্ষার স্ক্রিপ্ট, কখনও একটা ভাজ করা পাতার শেষের কোণে লেখা মাকে উদ্দেশ্য করে ফেলে দেওয়া চিঠি—এই সব দিয়ে বানানো হয় তার প্লেন।

আর প্রতিটা প্লেনের গায়ে লেখা থাকে কিছু—একটা incomplete গান, একটা অদ্ভুত প্রশ্ন, একটা বাক্য যা হয়তো সে কাউকে বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।

আজ যেমন লেখা আছে:

“If I disappear tomorrow, would anyone notice?”

এই প্লেনটা সে রেখে দিয়েছে পকেটে। দুপুর লাঞ্চের পর ছাদে গিয়ে ফেলে দেবে।

বেল বাজলে সে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। কেউ তাকে লক্ষ্য করল না। করবেই বা কেন?

স্কুল বিল্ডিংয়ের ছাদে ওঠার রাস্তাটা আর কেউ ব্যবহার করে না। পুরোনো দোতলার এক কোনায় একটা ঢালু দরজা, জং ধরা কব্জা, কাঠের মধ্যে আঁকা ‘অবাঞ্ছিত প্রবেশ নিষেধ’—তবে অর্ণব তাতে পাত্তা দেয় না।

ওইখানে দাঁড়িয়ে, মাথার ওপর আকাশ, সামনে স্কুলের খেলার মাঠ, নিচে কলকাতার ভাঙাচোরা ছাদ—এই জায়গাটাই তার নিজস্ব পৃথিবী।

সে পকেট থেকে প্লেনটা বার করল।

একটা শ্বাস। একটা হালকা ছুড়ে দেওয়া।

প্লেনটা ভেসে চলে গেল, ঘুরে ঘুরে, যেন কারও উদ্দেশ্যে এক চুপচাপ বার্তা নিয়ে।

অর্ণব হাসল।

তারপর ফিরে আসার জন্য ঘুরতেই কানে এল কারও কাশির শব্দ।

সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে।

নতুন মুখ। মেটালিক গ্রিন ব্যাকপ্যাক, পনিটেল বাঁধা চুল, চোখে একরাশ অবাক ভাব। তার হাতে একটা কাগজ—আর প্লেনটা সে ধরেই ফেলেছে।

“তুমি ছুড়েছিলে এটা?” মেয়েটি প্রশ্ন করল।

অর্ণব থমকে দাঁড়াল। প্রথম প্রতিক্রিয়া: পালাও।

কিন্তু কিছু একটা আটকে দিল তাকে।

সে শুধু মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ।”

মেয়েটা হাসল। “লিখেছও তুমিই, না কি প্লেন-ডেলিভারি বয়?”

এইবার একটু হেসে ফেলল অর্ণব। “দুটোই। কে তুমি?”

“ইরা সেন। নিউ স্টুডেন্ট। আজ প্রথম দিন। তোমার ওই প্লেনটা একদম আমার ব্যাগে এসে পড়েছে।”

অর্ণব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। “ওহ… দুঃখিত। আমি… আমি শুধু এমনিই করি।”

“এমনিই করো? মানে, existential paper flight therapy?”

“না… মানে… ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারি না।” সে ঘাড় নিচু করল।

ইরা একটু কাছে এল। “তুমি জানো? এই কথাটা—‘If I disappear tomorrow, would anyone notice?’—আমি ঠিক গত সপ্তাহে ডায়েরিতে লিখেছিলাম। তুমি তো আমার মাইন্ড তো পড়তে পার না, তাই না?”

অর্ণব ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “তুমি ডায়েরি লেখো?”

“সাধারণভাবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে, যখন মাথার ভেতর আওয়াজ বেশি হয়।”

একটা নিঃশব্দ সংযোগ তৈরি হলো।

অর্ণব জানত না, এই ইরা সেন নামের মেয়েটা কারা। সে জানত না, এই কথোপকথনের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের অজস্র পাতা।

সে শুধু জানত, তার বানানো একটা কাগজের প্লেন, প্রথমবার কারও হাতে পৌঁছেছে।

Notes Between the Lines

ইরা চলে যাওয়ার পরে অর্ণব আর ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। মেয়েটার কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছিল—“তুমি জানো? এই কথাটা আমি ঠিক গত সপ্তাহে ডায়েরিতে লিখেছিলাম।” ব্যাপারটা যতই কাকতালীয় হোক, এক অজানা রোমাঞ্চ, একধরনের চিমটি কাটা বাস্তব অনুভব তাকে ঘিরে ধরেছিল। বাড়ি ফেরার সময় বাইপাসের ধারে রোদ নেমে এলে সে একটা ফুডট্রাকের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। তার চোখে পড়ল দুই কিশোর, এক ছাতা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—একজন আরেকজনকে কিছু বলছে, হেসে ফেলছে। অর্ণবের মনে হলো, তারা যেন কাকতালীয় ভাবেই কোনো কাগজের প্লেন ছুঁড়ে ফেলবে এখনই আকাশে।

সে বাড়ি ফিরে মায়ের দিকে একবার চেয়ে দেখল—মা রিক্রুটমেন্ট রিপোর্ট টাইপ করছেন, একটা সাদাটে ঘরে, স্টিলের চেয়ার আর নীল প্লাস্টিকের টেবিলে। মাকে বিরক্ত না করে, সে নিজের ঘরে চলে এল। তার ডেস্কে একটা ছোট্ট কাগজের বাক্স—তার সব পুরোনো প্লেন রাখা আছে সেখানে। কতগুলো লেখা ফিকে হয়ে গেছে, কতগুলো ছিঁড়ে গেছে ভাঁজ করতে করতে।

সে একটা নতুন প্লেন বানাল। আজকের তারিখ লিখে নিল উপরে:
13th July.

প্লেনের ডানায় লিখল—

“Sometimes, strangers know your truth better than your friends.”

সেইদিন রাতে ঘুমের আগে সে জানালার পাশে বসে কানের হেডফোনে শুনল Nick Drake-এর Place to Be। বাইরের রাস্তায় ট্র্যাফিকের শব্দ ভেসে আসছে—এই শব্দে সে অনেকবার ঘুমিয়েছে, অনেকবার জেগে থেকেছে। কিন্তু আজকে তার ঘুম এল না। ইরা সেনের মুখে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল—তবে সেটা বন্ধ দরজার মতো, ভিতরে কি আছে বোঝা যায় না।

পরদিন স্কুলে অর্ণব তার প্লেনটা নিয়ে গেল, কিন্তু ছাদে যায়নি। দুপুরে সে ক্যান্টিনের উলটো দিকের করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল যখন হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলা ভেসে এল—“আজ কি কোনো ফ্লাইট উড়বে না?” সে ঘুরে দেখল—ইরাই দাঁড়িয়ে আছে, হাতে হরলিক্সের বোতল, চোখে মুচকি হাসি।

অর্ণব একটু চমকে গেল। “তুমি… আমাকে খুঁজে বের করেছো?”

“তা তো করতেই হলো,” ইরা হেসে ফেলল। “শুনেছি, তুমি বেশি কথা বলো না, তাই ভাবলাম আমিই শুরু করি।”

অর্ণব বলল, “তোমার সাহস আছে, আমি বলব।”

“ধন্যবাদ। তবে, তোমার প্লেনগুলো নিয়েই আমার একটা আইডিয়া আছে,” ইরা একটু গম্ভীর গলায় বলল। “স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য একটা প্রোজেক্ট করছি আমি—শিরোনাম ঠিক করেছি: ‘Voices We Don’t Hear’। ভাবছি, তোমার প্লেনগুলো নিয়ে একটা সিরিজ করি। ছবিও থাকবে, কাগজের প্লেন, তার লেখা, কোথা থেকে পেয়েছি, কাকে ছুঁয়ে গেছে—এই সব।”

অর্ণব মাথা নাড়ল। “আমি কখনও আমার লেখা কারও সামনে আনিনি। এটা… খুব ব্যক্তিগত।”

ইরা শান্তভাবে বলল, “আমি বুঝি। কিন্তু জানো, খুব ব্যক্তিগত জিনিসগুলোই তো সবচেয়ে বেশি রিলেটেবল হয়ে ওঠে। তুমি জানো না, কে কোথায় তোমার কথার সঙ্গে কানেক্ট করছে।”

অর্ণব চুপ করে গেল।

ইরা হাত বাড়িয়ে বলল, “চলো, ছাদে যাই। আজ আমি একটা প্লেন ছুড়ব।”

ওরা দুজনে একসাথে ছাদে উঠল। অর্ণবের মনে হচ্ছিল, সে কারও সঙ্গে এই জায়গাটায় আগে কখনও ওঠেনি। ছাদে বাতাসটা আজ একটু বেশি বয়ে চলেছে। ইরা একটা ছেঁড়া পুরনো খাতার পাতা বের করল, তাতে কিছু একটা লেখা ছিল।

“তুমি কি এটা লিখেছো?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল।

ইরা মাথা নাড়ল। “না, আমার ছোটবেলার এক বন্ধু লিখেছিল। ও এখন অন্য শহরে চলে গেছে, কথা হয় না। কিন্তু এই লাইনটা আমি আজও মনে রেখেছি।”

প্লেন বানিয়ে ইরা সেটা ছুড়ে দিল।

ওরা দেখল—কাগজটা ঘুরে ঘুরে দূরে চলে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে যেন কলকাতার সব ট্র্যাফিক থেমে গেছিল, সব আওয়াজ চুপ হয়ে গেছিল।

অর্ণব প্রথমবার নিজের বুকের মধ্যে কিছু একটা কাঁপতে অনুভব করল—ভয়, একরকম ছুঁয়ে ফেলার ভয়।

তারপর, নিচে নামার আগে, ইরা হঠাৎ পিছন ফিরে বলল, “অর্ণব, একটা কথা বলি? তুমি হয়তো জানো না, তুমি একটা চরিত্র, ঠিক গল্পের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছো। তুমি শুধু নিজের পাতাগুলো দেখতে পাও না বলেই বুঝছো না।”

অর্ণব কিছু বলল না। কিন্তু তার ডায়েরির পাতাগুলো যেন হঠাৎ জেগে উঠল ভিতরে।

A Message Left Under the Desk
ইরার বলা কথাটা—“তুমি একটা চরিত্র, ঠিক গল্পের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছো”—অর্ণবকে সারাদিন কেমন যেন ভেতর থেকে অস্থির করে রেখেছিল। ক্লাসে তার সামনে বসে থাকা ছাত্রীর চুলে একটা সাদা চুল ক্লিপ, একেবারে ডানদিকের জানালা দিয়ে আসা বিকেলের আলো, স্যার-এর চক দিয়ে বোর্ডে লেখা “Integration of Life with Learning”—সব কিছু যেন অন্যভাবে চোখে পড়ছিল।

ক্লাস শেষে সে ধীরে ধীরে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে উঠল। আজ ইরা আর কিছু বলেনি। ওদের মধ্যে কোনো প্ল্যান হয়নি, কিন্তু একটা আশ্চর্য নিরবতা, যেন শব্দ ছাড়াই একরকম যোগাযোগ ছিল।

তবে বেরোনোর সময় অর্ণব লক্ষ্য করল—তার ডেস্কের নিচে কিছু একটা রাখা আছে।

সে নিচু হয়ে একটুকরো কাগজ তুলে নিল। ভাঁজ করা, পেন দিয়ে টিপে টিপে লেখা। খুলে দেখল:

“If we are all invisible, maybe we need to see each other more clearly.
—P.”

এইবার সে একটু থমকে গেল। “P”? ইরার নাম তো P দিয়ে শুরু হয় না। তবে কি অন্য কেউ? কেউ তার প্লেনগুলো পড়ছে? কেউ কি তার ভাষায় উত্তর দিচ্ছে?

সেই রাতে সে বাড়ি ফিরে তার ডেস্কের পাশে রাখা পুরোনো কাগজগুলোর খোঁজে বসে গেল। এতদিন সে শুধু নিজের কথা লিখেছে। আজ সে একটা নতুন কাগজে লিখল:

“Who are you? And why does your line feel like mine?”

এইবার সে কোনো প্লেন বানাল না। শুধু ভাঁজ করে রাখল স্কুল ব্যাগের চটের সাইড পকেটে।

পরদিন স্কুলে গিয়ে, ক্লাস শুরুর আগে সে গোপনে নিজের ডেস্কের নিচে সেই কাগজটা রেখে দিল। এরপর সারাদিন কোনো কিছুতে মন বসাতে পারল না।

লাঞ্চের সময় ইরার দেখা পেল না সে। ক্যান্টিন, লাইব্রেরি, করিডোর—সব জায়গায় খুঁজেও মেয়েটি নেই। মনে হচ্ছিল কেউ হঠাৎ তার গল্পের মাঝখান থেকে পাতাটি ছিঁড়ে ফেলেছে।

তবে দিন শেষে, যখন ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজে উঠল আর সবাই বেরিয়ে গেল, অর্ণব নিজের ডেস্কে ফিরে দেখল সেই কাগজটা নেই।

তার বদলে রাখা আছে নতুন একটা ছোট্ট নোট।
এইবার লেখা:

“Because sometimes, we write to the person we were.
—P.”

এবার অর্ণবের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
সে জানে না, কে এই ‘P’।
ইরা তো নয়। তাহলে কে?

নাকি ইরাই, কিন্তু একটা নতুন দিক?
নাকি আরেকজন, তার মতোই কেউ—অদৃশ্য, নীরব, গল্পহীন এক চরিত্র?

সেই রাতে সে আরেকটা কাগজে লিখল:

“Then let’s be co-authors. I’ll write a line, you write the next.”

এইবার সে প্লেন বানাল না।
এই নোট হবে ভাঁজ করে রাখা মেঘ—যার ভেতর জমে আছে সম্ভাবনার বৃষ্টি।

পরবর্তী কয়েকদিন, সেই ডেস্কের নিচে চলে চলল লুকিয়ে রাখা বার্তার খেলা।
প্রতিদিন একেকটা লাইন, একেকটা ভাঁজে একেকটা আভাস।

“Love is not always romantic.”
“Scars don’t always show.”
“I once tried to vanish. It didn’t work.”
“You’re the first person I wrote to in years.”

অর্ণব বুঝতে পারল, এই কথাগুলো যে-ই লিখছে, সে ভেতর থেকে কষ্টে ভরা। শব্দগুলো হাওয়ার মতো, কিন্তু ভারী। কথাগুলো শুধু লেখা নয়, যেন রক্ত দিয়ে আঁকা।

তবে একই সঙ্গে সে অনুভব করল, তার নিজের ভাষাও পাল্টাচ্ছে। সে আগের মতন চুপচাপ থাকে না, ক্লাসে দুই একবার কথা বলে, স্যারকে প্রশ্ন করে। লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নেড়েচেড়ে দেখে, জানালার ধারে বসে একবার ইরার দিকে তাকিয়ে হাসে।

আর একদিন, সে সাহস করে একটা প্লেন বানিয়ে ইরাকে দিয়ে দিল।
এইবার মুখোমুখি।

ইরা প্লেনটা খুলে দেখল, আর চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এটা আমাকেই দিচ্ছ?”

অর্ণব মাথা নাড়ল। “না। তুমি এটা পৌঁছে দেবে।”

ইরা কিছু না বলে প্লেনটা ব্যাগে রেখে দিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তুমি জানো না, তুমি কে। কিন্তু আমি জানি। তুমি একটা জানালা, যেটা ভিতরে বাতাস ঢুকতে দেয়।”

অর্ণব হেসে ফেলল। “তুমি সবসময় এত… কবিতার মতো কথা বলো?”

ইরা মুচকি হাসল। “তোমার মতো লোকের জন্যই তো লেখাটা বেঁচে থাকে।”

সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে অর্ণব তার পুরোনো বাক্সটা খুলে ফেলল। সব পুরোনো প্লেনগুলো লাইন করে সাজিয়ে রাখল। তারপর বুঝতে পারল, সে অনেকগুলো প্রশ্ন রেখেছে পৃথিবীতে, কিন্তু আজকে কেউ প্রথমবার উত্তর দিচ্ছে।

কাগজে লেখা কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে তার জীবন একটা নতুন মাত্রা পাচ্ছে।
ভাষাহীন বন্ধুত্ব, মুখহীন লেখক, আর কলকাতার এক স্কুলের শেষ বেঞ্চ—সব মিলে তৈরি হচ্ছে এক নতুন গল্প।

The City That Watches Quietly
কলকাতার বর্ষাকাল এমন এক আবহ তৈরি করে, যেন শহরটাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। রাস্তায় পা দিলে জলে ডুবে যাওয়া টাইলসের ফাঁকে ঘুরে বেড়ায় কাগজের নৌকা। কিন্তু কেউ জানে না, সেই নৌকাগুলোর পেটের ভেতরে হয়তো লুকিয়ে থাকে কারও চিঠি, যা পৌঁছায় না, হারিয়ে যায় কোনো চোরাবালির আবেগে।

অর্ণব সেই দিন বিকেলে পার্ক স্ট্রিট লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ইরা তাকে বলেছিল, “চলো, আজ একটু বাইরে যাই। তুমি যেখান থেকে কাগজ জোগাড় করো, আমি সেটা দেখতে চাই।”
সে হেসে বলেছিল, “আমি কি কাগজের ডিলার?”
ইরা মুচকি হেসেছিল, “তুমি কাগজ নয়, অনুভূতির কারিগর। তবে হ্যাঁ, কিছু স্পট তো নিশ্চয়ই আছে।”

এইভাবেই তারা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়িয়েছিল শহরের পুরোনো বইপাড়ায়। ফুটপাথে রাখা পুরোনো ম্যাগাজিন, অর্ধেক ছেঁড়া জার্নাল, বিদেশি বইয়ের ভাঁজে থাকা বেনামী হ্যান্ডনোটস—এই সবই যেন অর্ণবের গুপ্তধন।

ইরা একটি মলিন পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো তো, এখানে লেখা আছে: ‘To the one I couldn’t say sorry to…’ কী গভীর এই লাইনটা। ভাবা যায়?”

অর্ণব বলল, “এই শহরে অনেক কথা বলা হয় না। কেবল লেখা হয়ে পড়ে থাকে।”

ইরা কাগজটা কিনে ফেলল দশ টাকায়। তারপর বলল, “আমরা একটা প্রজেক্ট করব—এই শহরের হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো নিয়ে। প্লেন বানিয়ে ছড়িয়ে দেব। হয়তো কেউ পড়ে পাবে। হয়তো কোনো পুরোনো কথা কেউ নতুন করে খুঁজে পাবে।”

অর্ণব তাকিয়ে থাকল মেয়েটার চোখের দিকে। ইরার চোখ দুটো অদ্ভুতভাবে কুয়াশায় ঢাকা—যেন ও দেখছে এমন কিছু যা অর্ণব নিজে এখনও ভাবেনি।

তারা ফেরার পথে ফুটপাত থেকে দুটো চা খেল, আর ঠিক সেই সময়ই ইরা বলল, “তুমি জানো, এই শহরটারও একটা গল্প আছে। একদম আমাদের মতোই। মাঝেমধ্যে আলো জ্বলে, মাঝেমধ্যে নিভে যায়। কিন্তু কিছু শব্দ কখনও মুছে যায় না।”

পরদিন স্কুলে গিয়ে অর্ণব বুঝতে পারল, তার ডেস্কের নিচে ‘P’ আবার একটা নোট রেখে গেছে।

“One day I almost ran away. Took the train till Bardhaman. But then I realised, no place is far enough from yourself.”

এই লাইনটা পড়ে অর্ণবের বুক ধক করে উঠল। এই কথাটা শুধুই শব্দ নয়—এ যেন কোনো ব্যথার ফাঁকা গর্ত। Bardhaman—এই জায়গাটা যেমন তেমন নয়। অর্ণবের ছোটবেলা কেটেছে সেখানে। পিসির বাড়ি, ঠাকুরদার পুরোনো বাগান, আর ছোটবেলায় প্রথম হারিয়ে যাওয়ার ভয়—সব মিলিয়ে এই জায়গার নামটা তাকে এক মুহূর্তে থমকে দিল।

সে বুঝল, এই ‘P’ শুধু কল্পনার কেউ নয়। এই কেউ একজন তার জীবনের ছায়ার ভেতরেই হাঁটছে।

সে সিদ্ধান্ত নিল—এবার তাকে খুঁজে বার করতে হবে।

লাঞ্চ ব্রেকে অর্ণব লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে রইল। সব ছেলেমেয়ের দিকে এক এক করে তাকাল। কেউ কি তাকাচ্ছে তার দিকে? কেউ কি কিছু লিখছে? কেউ কি মনে মনে বলছে—”আমি ‘P’?”

ঠিক তখনই, লাইব্রেরির এক কোণে বসা এক মেয়ে উঠে গিয়ে ডেস্কে কিছু জমা দিল। অর্ণব তার দিকে তাকাল—মেয়েটির মুখ তার চেনা লাগল না। ছোট করে কাটা চুল, চোখে গোল চশমা, এক হাতে স্কার্ফ জড়ানো।

এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে চোখ পড়ল। মেয়েটি একটু মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেল।

অর্ণব বুকের মধ্যে ধ্বনি শুনল—”ওই তো, হয়তো এই মেয়েটিই…”

কিন্তু সে নিশ্চিত না।

এতকিছুর মধ্যেও ইরার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বাড়ছে। তারা বিকেলে একসাথে নেমে আসে স্কুলের সামনের গলিতে। একসাথে হেঁটে যায় ফ্ল্যাটের দিকে। ইরা প্রায়ই বলে, “তুমি এত কম কথা বলো কেন, অর্ণব?”

সে উত্তর দেয়, “তোমার জন্যই হয়তো কিছু কথা জমে আছে।”

ইরা চুপ করে থাকে।

তবে সেই রাতে, হঠাৎ করে একটা মেসেজ আসে ইরার থেকে:

“If I told you I’m broken too, would you still sit next to me during lunch?”

অর্ণবের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে ওঠে। সে টাইপ করে:

“I’d bring two cups of tea and my worst poem.”

একদিন স্কুল শেষে ইরা তাকে বলল, “চল, আজ একটা অদ্ভুত জায়গায় নিয়ে যাবো।”
তারা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাল একটা পুরোনো বাড়ির ছাদে—একজন পুরোনো গৃহশিক্ষিকার বাড়ি। তিনি ইরার মায়ের বান্ধবী ছিলেন। এখন কেউ থাকে না।

ছাদে দাঁড়িয়ে ইরা বলল, “তুমি কোনোদিন কারও জন্য কাঁদোনি, তাই না?”

অর্ণব বলল, “আমি কাঁদলেও কেউ দেখতে পায়নি।”

ইরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার গলায় কাঁপন ছিল। বলল, “আমার বাবা চলে গেছে আমাদের ফেলে। মা এখনও নিজেকে বলে, এটা ঠিক ছিল। কিন্তু আমি জানি, এটা ছিল একটা ছুরি। কোনো শব্দ ছাড়াই কাটা যায়, জানো?”

অর্ণব তার কাঁধে হাত রাখল না। কিছু বলল না। কেবল পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।

ওই মুহূর্তে কলকাতার আকাশটা হঠাৎ বৃষ্টির মতোন ঝরল—নীরব, অথচ সম্পূর্ণ।

Echoes of Unseen Stories
পরদিন স্কুলে পৌঁছে অর্ণব বুঝতে পারল যে তার জীবনের মতোই শহরটা একটা বৃত্তাকার পাখা বেয়ে ঘুরছে—একই জায়গায় আসছে, নতুন দিক থেকে দেখে, পুরনো স্মৃতির ভেতর দিয়ে হাঁটছে। ক্লাসের শেষে সবাই চলে গেছে, তখন সে দেরি করে লাইব্রেরির দিকে এগোলো।

ল্যাম্পের নিচে, পুরোনো বইয়ের গন্ধ আর পাতা উল্টে যাওয়ার শব্দে ভরে থাকা লাইব্রেরিতে এক কোণে বসে ছিল ইরা। সে এক হাতে কাপে চা নিয়ে অন্য হাতে তার ছোট্ট ডায়েরি খুলে রেখেছিল। অর্ণবকে দেখে তার মুখে এক ছোট্ট হাসি ফুটল।

“দেখো, আমি একটা নতুন প্লেন বানিয়েছি,” সে বলল। ডায়েরির পাতা থেকে কাগজটা তুলে ধরে যা অর্ধেক ভাঁজ করা, একটু মলিন কিন্তু পরিষ্কার হাতের লেখা।

অর্ণব সেটি হাতে নিয়ে পড়ল:

“Somewhere between the pages of yesterday and the words of tomorrow, we find the courage to write our own story.”

“তুমি কি এই সব সত্যিই মনে করো?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল, চোখে একটু অবাক ভাব।

ইরা মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, কিন্তু আমি চাই, আমরা যেন সেটা বিশ্বাস করতে পারি। কারণ, অনেক সময় আমরা নিজেদের গল্পটার লেখক হতে চাই না, শুধু কেউ সেটা লিখে দিয়ে যায়, আর আমরা শুধু পড়ে থাকি।”

অর্ণব কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে থাকল।

“তুমি জানো?” ইরা হঠাৎ মৃদু গলায় বলল, “আমার বাবার চলে যাওয়ার পর আমার মা খুব পরিবর্তিত হয়েছে। সে আর আগের মায়ের মত নেই। সে রাতের অন্ধকারে চুপচাপ কাঁদে, আর সকালে মুখে হাসি আনে যেন কিছুই হয়নি। আমি ভাবি, মা আমার জন্য কতটা টিকে আছে।”

অর্ণব সেই কথাগুলো শুনে চুপচাপ থাকল। সে জানত, কথাগুলো ভেতর থেকে ভাঙা মনের প্রতিফলন। কিন্তু সে কী বলবে? কি বলার আছে তার নিজের জীবনের সেই বিচ্ছিন্ন দিনগুলো ছাড়া?

“আমার একবার এক নোট পড়েছিলাম,” অর্ণব বলল, “যেখানে লেখা ছিল, ‘একজন মানুষ যতই চুপ থাকুক না কেন, তার ভেতরে একটা কাঁপন থাকে, যা কেউ দেখে না।’ আমি জানি, তুমি বুঝছো সেটা কেমন।”

ইরা হেসে বলল, “হ্যাঁ, বুঝি।”

দুজনেই বুঝতে পারছিল, তাদের মধ্যে যে বন্ধন তৈরি হচ্ছে, তা শুধু কথার দ্বারা নয়, মনের গভীরে থাকা নিরব কষ্টের মাঝেও একটা আলোর স্পর্শ।

বছরের সেই গ্রীষ্মকালীন দুপুরগুলোতে, তারা যখন ক্যান্টিনের পাশের ছাদে বসে কথা বলত, তখন শহরের শব্দগুলো যেন দূরে সরে যেত। গাছের পাতায় ভেজা জলখাবারের গন্ধ, দূর থেকে বাজে কোনো গান, আর তাদের নিজেদের নিঃশব্দ হাসি—এই মুহূর্তগুলো তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।

একদিন, ইরা তার ব্যাগ থেকে একটি মোটা ফাইল বের করল, যার ভেতর ছিল একদশকের পুরনো স্কুল ম্যাগাজিন। সে বলল, “আমরা এই ম্যাগাজিন থেকে কিছু লেখা তুলে নিয়ে আমাদের প্লেনগুলোতে লিখবো, যেন পুরনো শহরের হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠগুলো ফিরে আসে।”

অর্ণব ঐদিন একটা প্লেন বানাল, তার হাতে থাকা ভাঙা খাতা থেকে একটি লেখার লাইন নিয়ে:

“Silent whispers of forgotten streets,
Memories wrapped in faded sheets.”

এক বিকেলে, স্কুলের খেলার মাঠের পাশে একেবারে গাছের নিচে তারা বসে ছিল। ইরা হঠাৎ বলল, “তুমি কি জানো, আমারা যারা চুপচাপ থাকি, তাদের কথা অনেক সময় হারিয়ে যায়? কেউ শুনতে চায় না।”

অর্ণব মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, “তাই হয়, তাই হয়।”

“তবে আমি চাই,” ইরা বলল, “আমরা যেন আমাদের ছোট ছোট শব্দগুলো একসাথে মিলিয়ে একটা বড় সুর তৈরি করতে পারি। এমন একটা সুর, যা কেউ শুনতে বাধ্য হয়।”

তারা দুজনেই জানত, এই কথাগুলো শুধু স্বপ্ন নয়, একটা সংকল্প।

কিছুদিন পর, অর্ণব একটা বিশেষ সিদ্ধান্ত নিল—স্কুল ম্যাগাজিনের সম্পাদককে তাদের প্রোজেক্টের ব্যাপারে জানাবে। সে জানত, এটা ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ অনেকেই বুঝবে না এই ‘পেপার প্লেন’ কী; আবার কেউ কেউ হাসিও পেতে পারে।

কিন্তু ইরার বিশ্বাস এবং নিজের ভেতর থেকে আসা চাওয়া তাকে সাহস দিচ্ছিল।

স্কুলের সম্পাদক মহাশয় যখন প্রথমে একটু সন্দেহ করেছিল, পরে তাদের প্রেজেন্টেশন শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল। প্রোজেক্টটি কেবলমাত্র একটা সাহিত্য কাজ নয়, বরং একটা মেন্টাল হেলথ মুভমেন্টের সূচনা—যেখানে তরুণরা তাদের মনের কথা লুকিয়ে রাখে না, প্রকাশ করে।

এমন এক রাতে, যখন তারা পার্ক স্ট্রিটের এক ছোট্ট ক্যাফেতে বসে গল্প করছিল, ইরা বলল, “আমরা কখনো ভেবেছি, এই প্লেনগুলো কেমন করে অন্য কারো জীবনেও পরিবর্তন আনতে পারে?”

অর্ণব হাসল, “আমি তো মনে করি, প্রতিটা প্লেন একটা নতুন আশা দেয়।”

ইরা বলল, “তাহলে চল, আগামী সপ্তাহ থেকে আমরা প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচটা প্লেন ছুড়ব শহরের বিভিন্ন জায়গায়।”

অর্ণব বলল, “একটা চুক্তি করি—যে কেউ সেগুলো পড়ে, তার মনে একটু হলেও আলো জ্বলে উঠুক।”

অর্ণব এবং ইরা তাদের প্লেন ছোঁড়ার রুট প্ল্যান করল, জায়গাগুলো ঠিক করল—স্কুল, লাইব্রেরি, ক্যাফে, পার্ক, মেট্রো স্টেশন। তারা বুঝতে পেরেছিল, ছোট ছোট কাজের মধ্য দিয়ে বড় কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।

একদিন অর্ণব তার ডায়েরির পাতা থেকে একটা লেখা তুলে নিয়ে ইরাকে দেখালো—

“We are all stories in the making,
With pages yet to be turned.”

ইরা বলল, “ঠিক বলেছো। আর আমরা যারা লিখছি, আমরা একে অপরের পৃষ্ঠা।”

শহরের ধূলোমাখা রাস্তায়, নীরবতার মাঝে, তারা দুজন বসে থাকত।
একটু বৃষ্টি ঝরে, একটু সূর্যের আলো ফুটে ওঠে, আর তারা লিখতে থাকে, প্লেন বানায়, আকাশে ছুড়ে দেয়।

শহরটা তাদের গল্পের সাক্ষী।
আর তাদের পেপার প্লেনগুলো হয়ে উঠেছে বন্ধুত্বের ডোর।

Paper Planes Over Park Street
By Tanisha Dey
Part 6: Flights Over Forgotten Streets
বৃষ্টি থেমে গেছে, মেঘ ভেঙে গেছে, আর কলকাতার পুরনো রাস্তাগুলো আবার যেন জীবন্ত হয়েছে। পার্ক স্ট্রিটের ভিড় থেকে দূরে, ছোট্ট অলিগলির শেষ মাথায়, যেখানে কাঁটাতারের বেড়া আর পুরনো দোকান, সেখানে অর্ণব আর ইরা দাঁড়িয়ে আছে।

“আজকের রুটটা একটু আলাদা,” ইরা বলল, চোখে একটা উজ্জ্বলতা। “এই জায়গায় মানুষের জীবনের গল্পগুলো মুছে যেতে বসেছে। আমরা চাই সেই গল্পগুলো ফিরে পাক।”

অর্ণব মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সে জানত, এই ছোট্ট প্লেনগুলো শুধু কাগজের টুকরো নয়, এইগুলো এখন একেকটা আশা, একেকটা কান্না, একেকটা ভালোবাসার আভাস।

দুজন কাঁটাতারের পাশে বসে প্লেন বানাতে লাগল। অর্ণব তার ডায়েরির পাতা থেকে এক লাইন তুলে নিয়ে ইরার কাছে দিল—

“Every scar is a story untold,
Hidden beneath layers of old.”

ইরা হেসে বলল, “খুব সুন্দর।”

অর্ণব একটু লাজুক হয়ে বলল, “তুমি মনে করো কেউ এটা পড়বে?”

ইরা বলল, “যারা পড়ে, তারা হয়তো নিজেদেরই খুঁজে পাবে।”

প্লেনগুলো ছুড়ে দিয়ে তারা পার্ক স্ট্রিটের এক পুরনো কফি শপের সামনে এসে দাঁড়াল। দোকানিরা প্লেনগুলো নিয়ে কৌতূহলী চোখে তাকাল। এক মুঠো কার্ড ছুঁড়ে দেওয়া মানুষ দেখতে আশ্চর্য।

“এই শহরের সবাই কি জানে তাদের কথা কেউ লিখছে?” অর্ণব মৃদু গলায় বলল।

ইরা উত্তর দিল, “না, তারা জানে না, কিন্তু তারা অনুভব করে।”

স্কুলে ফিরে এসে, তাদের প্রোজেক্টের জন্য ফিডব্যাক আসতে লাগল। অনেকেই ভালো লাগা জানিয়েছে, আবার কিছু মানুষ অপ্রত্যাশিত সমালোচনা করেছে। কেউ কেউ বলেছে, “এগুলো শুধু কাগজের প্লেন, কি হবে এইসব লেখার?”

তবে অর্ণব জানত, প্রতিটি প্লেন একটা ভালোবাসার বার্তা, আর প্রতিটি বার্তা কারো ভেতরে আলোর একটা রেখা তৈরি করছে।

এক বিকেলে, ইরা অর্ণবকে নিয়ে নিয়ে গেল শহরের এক পুরনো লাইব্রেরি যেখানে বছরের পর বছর ধরেই বইয়ের গন্ধ আর নীরবতা থাকে। সেখানে একটি ছোট ঘরে তারা বসে তাদের পেপার প্লেনের গল্পগুলো লিখতে লাগল।

ইরা বলল, “আমাদের এই ছোট্ট কাজটা একটা বড় আন্দোলনের শুরু হতে পারে।”

অর্ণব হাসল, “হয়তো।”

এক রাতে, ইরা হঠাৎ বলল, “আমি তোমাকে একটা কথা বলব, যা আগে কাউকে বলিনি।”

অর্ণব আগ্রহ নিয়ে তাকাল।

“আমি ছোটবেলায় একবার আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়েছি। ও একটা দুর্ঘটনায় চলে গেছে। ওর স্মৃতি আমার ভেতরে আজও বেঁচে আছে, কিন্তু আমি জানি না, কীভাবে ওর জন্য প্লেন বানাব।”

অর্ণব বলল, “তুমি জানো, স্মৃতি আর গল্প একই জিনিস। আমরা যদি গল্প লিখি, স্মৃতিও জীবিত থাকবে।”

ইরা কাঁদতে লাগল, আর অর্ণব হাত দিয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করল।

 

দিনগুলো কেটে যাচ্ছে, তারা আরও বেশি করে বুঝতে পারছে যে, এই ছোট্ট পেপার প্লেনগুলো শুধু একত্রিত নয়, বরং এক একটি মানুষের জীবনের অংশ।

তারা সিদ্ধান্ত নিলো আগামী সপ্তাহে স্কুলে একটা প্রদর্শনী আয়োজন করবে যেখানে প্লেনগুলো, লেখা, ছবি সব কিছু থাকবে।

পর্বের শেষে, অর্ণব ও ইরা একসাথে বসে ভাবছিল, কীভাবে তাদের এই ছোট্ট উদ্যোগ আরও বড় হবে, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে।

শহরটা তাদের কাহিনী শুনছে, সে নিশ্চিত।

Whispers on the Wind
স্কুলের প্রদর্শনী ঘরটা আজ অন্য রকম ছিল। ছাদ থেকে ঝুলে থাকা কাগজের প্লেনগুলো বাতাসে নাচছিল, যেন একেকটা স্মৃতি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। দেয়ালে লাগানো ছবিগুলো আর লেখা পাতাগুলো একসঙ্গে মিশে শহরের গল্প বলে যাচ্ছিল।

অর্ণব আর ইরা সেই ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে নতুন করে সব অনুভব করছিল। অনেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক, এবং বাবা-মা আসছিলেন, কেউ কেউ প্লেন ছুঁয়ে নিচ্ছিলেন, কেউবা লেখা পড়ছিলেন। এক বয়স্ক মহিলা অর্ণবের কাছে এসে বলল, “এই প্লেনটা আমার ছোটবেলার দিনের কথা মনে করিয়ে দিল।”

ইরা গর্বিতভাবে বলল, “এইটাই আমাদের উদ্দেশ্য, মানুষ যেন তাদের হারানো কাহিনী ফিরে পায়।”

একটু সুনসান কোণে দাঁড়িয়ে অর্ণব খেয়াল করল, কয়েকজন ছাত্রছাত্রী প্লেন নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছে। কেউ একজন বলল, “আমি যখন প্লেন পড়েছি, মনে হয়েছে কেউ আমার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারছে।”

অর্ণবের মনে হল, তার লেখা আসলে পৌঁছে গেছে কারো হৃদয়ে। সেটা বুঝতেই তার মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে ইরা অর্ণবকে মেসেজ করল, “আজ ভালো লাগল। আমরা শহরের চুপ থাকা গল্পগুলোকে কথা বলতে শিখিয়েছি।”

অর্ণব উত্তর দিল, “তোমার সঙ্গে এই যাত্রা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর গল্প।”

রাতের আকাশে তারা দুজন একসঙ্গে ভাবছিলো আগামী দিনের জন্য। তারা জানতো, তাদের গল্প এখন শুরু হয়েছে।

The Letters We Never Sent
দীর্ঘ সেই গ্রীষ্মের বিকেলে, যখন কলকাতার রাস্তায় রোদ ম্লান হয়ে আসছিল, অর্ণব আর ইরা শহরের এককোণায় পৌঁছেছিল যেখানে পুরানো দালানগুলো একে অপরকে চুপ করে স্পর্শ করছিল। এই স্থানটা কেউ খুব একটা আসে না। ভাঙাচোরা দেয়াল আর ঘুমন্ত গাছগুলো যেন অতীতের গল্প গোপনে ফিসফিস করছিল।

“এই জায়গাটা তোমার কেমন লাগছে?” ইরা কৌতূহলী চোখে জিজ্ঞেস করল।

অর্ণব নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এখানে একটা অদ্ভুত সুর ছড়িয়ে আছে। যেন কাহিনী গুলো বাতাসের সাথে মিলেমিশে গেছে।”

“ঠিক বলেছো,” ইরা বলল। “আমাদের প্লেনগুলো শুধু এখনই নয়, অতীতেরও বার্তা বহন করে।”

তারা সাথেই বসে পড়ল এবং প্লেন বানানো শুরু করল। কিন্তু আজকের প্লেনগুলো একটু আলাদা ছিল। তারা কেবল নিজেরা নয়, হারানো মানুষদের জন্যও চিঠি লিখছিল।

ইরা প্রথম প্লেনে লিখল,

“To the friend I never said goodbye to,
Your laughter still echoes in my heart’s quiet hallways.”

অর্ণব তার প্লেনে লিখল,

“To the dreams I left behind,
I’m still trying to find you in these endless streets.”

এই চিঠিগুলো তারা একে অপরকে দেখাল, তারপর ধীরে ধীরে বাতাসে ছুঁড়ে দিল। প্রত্যেক প্লেন যেন একটা বিষণ্ণ প্রেমের গান, যা কখনো গাওয়া হয়নি।

তারা ভাবল, এই চিঠিগুলো যেন তাদের অতীতের বোঝা হালকা করে, এবং নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বের নতুন দিক তৈরি করে। ইরা জানাল, ছোটবেলায় একবার তার বাবার সঙ্গে অনেকদিন কথা হয়নি, আর আজও সেই নীরবতা তার ভেতরে দাগ কেটেছে।

অর্ণব বলল, “আমারও মা মাঝে মাঝে কেমন একটা অদৃশ্য বেদনার আওয়াজ বের করে, যা আমি বুঝতে পারি না।”

দুজন চুপ করে থাকল, তাদের মনের ভিতর পুরোনো যন্ত্রণা আস্তে আস্তে কোমল হয়ে উঠল।

কয়েক দিন পর তারা শহরের এক কমিউনিটি সেন্টারে গিয়েছিল। সেখানে তারা একটি ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করল যেখানে ‘পেপার প্লেন প্রোজেক্ট’ এর গল্প শোনানো হলো। ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মানুষ পর্যন্ত সবাই এসে তাদের গল্প শোনালো, যাদের জীবনে প্লেনগুলো স্পর্শ করেছে।

এক বুড়ো লোক বলল, “এই ছোট্ট প্লেনগুলো আমাকে আমার মেয়ে মনে করিয়ে দিল, যে বহু বছর আগে চলে গেছে।”

অন্য কেউ বলল, “আমি প্রথমবার নিজের অনুভূতিগুলো এমনভাবে প্রকাশ করতে পেরেছি, যা আমি আগে বুঝতে পারিনি।”

অর্ণব আর ইরা বুঝতে পারল, তাদের ছোট্ট উদ্যোগ একটা বড় আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে। তারা একসাথে স্থির করল, এই কাজটা তারা চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না শহরের প্রতিটি নিঃশ্বাসে তাদের গল্প বাজে।

একদিন সন্ধ্যায়, ইরা অর্ণবকে বলল, “তুমি কি জানো, আমি আজ এক অচেনা মানুষের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম।”

অর্ণব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি লেখা ছিল?”

ইরা কপাল টেনে বলল, “লেখাটি ছিল, ‘তুমি আমার জীবনের সেই অজানা হিরো, যাকে আমি কখনো জানতাম না।’”

অর্ণবের চোখে আলো জ্বলে উঠল। “আমাদের প্লেনগুলো শুধু আমাদের নয়, অন্য অনেকের জীবনও স্পর্শ করছে।”

রাতের আঁধারে তারা দুইজন মিলে নতুন নতুন চিঠি লেখার জন্য বসেছিল। তাদের হাতে এখন শুধু কাগজ আর কলম নয়, হৃদয়ের একেকটা টুকরো।

তারা জানত, এই যাত্রাটা শুধুমাত্র শুরু। আর তারা দুজন মিলে এই শহরের হারানো কণ্ঠগুলোর জন্য নতুন জীবন দিতে চায়।

Shadows Behind the Words
শহরের নীচে, যেখানে আলো পৌঁছায় কম, সেখানে অনেক কথা জমে থাকে চুপচাপ। অর্ণব আর ইরা সেই অন্ধকার কোণগুলোয় ঢুকে পড়েছে তাদের কাগজের প্লেন আর লেখা দিয়ে আলো জ্বালাতে। তাদের যাত্রা যত এগোচ্ছে, ততই তারা বুঝছে, কথাগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকে অজানা আঘাত, অজানা আশঙ্কা।

একদিন অর্ণব বাসে করে বাড়ি ফিরছিল। তার পাশের আসনে বসা এক বৃদ্ধাকে দেখল, যার হাতে ছিল একটি ছোট্ট পেপার প্লেন। সে প্লেনের ওপর অর্ণবের লেখা লাইনটি দেখা গেল—“Sometimes the quietest voices shout the loudest in the heart.” বৃদ্ধা সেই প্লেনটা কোমলভাবে চেপে ধরে রেখেছিল, চোখে এক অজানা উষ্ণতা।

অর্ণব মনে মনে ভাবল, “আমার লেখা কত দূর ছুঁয়ে গেছে কেউ জানে না।”

স্কুলে ইরা অর্ণবকে বলল, “তোমার লেখা আর আমার লেখা মিলেমিশে একটা নতুন গল্প তৈরি করছে, কিন্তু এই গল্পটার মাঝে কি আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলছি না?”

অর্ণব কাঁধ ঝাপটিয়ে বলল, “শুধু লেখা নয়, আমাদের জীবনও একটা গল্প। হারিয়ে যাওয়া চরিত্রগুলো ফিরে পাওয়ার জন্য আমাদের এই যাত্রা।”

একদিন তারা স্কুলের বাগানে বসে নতুন প্লেন বানাচ্ছিল। ইরা হঠাৎ থেমে গেলো, “আমি ভয় পাই, এই চিঠিগুলো পড়তে পড়তে আমরা নিজেরাই কষ্টে ভেঙে পড়বো।”

অর্ণব ধীরে ধীরে বলল, “কষ্ট ছাড়া কখনো ভালবাসার প্রকৃত অর্থ বোঝা যায় না।”

তাদের প্রোজেক্ট স্কুলে ব্যাপক পরিচিতি পেলো। অনেক শিক্ষার্থী লিখতে শুরু করল নিজেদের অনুভূতির কথা, হারানো স্মৃতির কথা, পছন্দ-অপছন্দের কথা। প্লেনগুলো শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল, আর সেই প্লেনগুলো ধীরে ধীরে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করল।

রাতের নির্জনতায়, অর্ণব তার ডায়েরির পাতায় লিখল,

“In a city full of noise, our silent words become the loudest song.”

ইরা তাকে দেখে বলল, “তুমি বুঝতে পারো? আমরা শুধুই লেখক না, আমরা আলো ছড়ানো মানুষ।”

একদিন স্কুলে নতুন একজন শিক্ষক এলো, যিনি মেন্টাল হেলথ নিয়ে গভীর আগ্রহী। তিনি অর্ণব ও ইরার প্রোজেক্টের প্রশংসা করে বললেন, “তোমাদের কাজ তরুণদের জন্য এক আশার আলো।”

এ কথা শুনে অর্ণবের মন ভরে গেল।

তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হলো, কিন্তু কখনো কখনো কিছু কথা এখনও অজানাই থেকে যায়। অর্ণব জানে, ইরার জীবনের গভীর কিছু দাগ এখনও বন্ধ থাকে সে জানে না।

এক সন্ধ্যায়, ইরা হঠাৎ বলল, “তুমি জানো, এই প্লেনগুলো হয়তো শুধু কাগজ নয়, তারা আমাদের জীবনের অংশ।”

অর্ণব মাথা নাড়িয়ে বলল, “আর আমাদের জীবনের অংশ হয়ে থাকবে যতক্ষণ আমরা লিখব।”

শহরের আকাশের নিচে, তারা দুজন আবার নতুন নতুন প্লেন বানিয়ে ছুড়ে দিলো, যাদের ভেতর লুকিয়ে আছে একেকটা গল্প, একেকটা আশা, আর একেকটা স্বপ্ন।

Wings That Carry Us Home
শহরের আকাশ আজ স্বচ্ছ, মেঘ নেই। পার্ক স্ট্রিটের গলিগুলোতে হালকা হাওয়া বইছে, আর অর্ণব ও ইরা জানে, আজকের দিনটা তাদের জন্য বিশেষ। দশটি পেপার প্লেন, দশটি গল্প, আর এক দশকের অপেক্ষার পর, তাদের যাত্রার শেষ পর্ব।

প্রদর্শনীর শেষ দিন স্কুলের সবাই এসেছে। সবাই তাদের প্লেনগুলো দেখে, পড়ে, স্পর্শ করে, নিজেকে খুঁজে পায়। অর্ণবের চোখে কিছুটা গর্ব, কিছুটা আবেগ। ইরাও পাশে দাঁড়িয়ে তার হাতে হাত রেখে হাসছে।

“আমাদের শুরুটা একটা ছোট্ট কাগজের প্লেন দিয়ে হয়েছিল,” অর্ণব বলে, “এখন আমরা জানি, সেই প্লেনগুলো কত দূর যেতে পারে।”

ইরা মাথা নাড়িয়ে, “আর কত দূর যাবে, সেটা এখন আমাদের হাতে না। কিন্তু আমরা শিখেছি, ছোট কাজও বড় পরিবর্তন আনতে পারে।”

তাদের গল্প শুনতে এসেছে স্কুলের নতুন ছাত্ররা, শিক্ষকরা, অভিভাবকরা। কেউ বলল, “এই প্রোজেক্ট আমার জীবন বদলে দিয়েছে।”
অন্য কেউ বলল, “আমরা সবসময় ভাবতাম, আমাদের কথা কারো কাছে পৌঁছায় না, এখন বুঝেছি, ভুল ছিল।”

রাতের শেষ আলো ফুটে ওঠার আগে, অর্ণব আর ইরা পার্ক স্ট্রিটের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। তারা জানে, এই যাত্রা শেষ হয় নি— এটা শুরু মাত্র।

অর্ণব তার ব্যাগ থেকে ছোট একটি প্লেন বের করল। বলল, “চল, এই প্লেনটা ছুঁড়ে দিই, আমাদের নতুন গল্পের শুরু হোক।”

ইরা হাসল, “আমাদের গল্প কখনো শেষ হয় না।”

অর্ণব প্লেনটা ছুঁড়ে দিল, প্লেনটা বাতাসে উড়ে গেল, দূরে কোথাও হারিয়ে গেল। তারা দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখল, যে কল্পনাগুলো কাগজের প্লেনে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবের আকাশ ছুঁয়ে চলেছে।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-06-27-at-6.17.29-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *