সুদীপ দে
শাল, শিমুল আর পলাশের ঘন জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গ্রামটির নাম রামচক। গ্রামের চারপাশ যেন এক অদৃশ্য পর্দায় ঢাকা—দিনে শান্ত, অথচ রাতে গোপনে কেঁপে ওঠে। এখানে বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসছে এক ভয়াল কাহিনি, যা শোনার পর শিশুদের চোখ ভিজে যায় আর প্রৌঢ়দের মুখে ছায়া নেমে আসে। বলা হয়, প্রতি বছর এক বিশেষ পূর্ণিমার রাতে, যখন আকাশে চাঁদ যেন দগ্ধ প্রদীপের মতো জ্বলতে থাকে আর মাটির ধুলো রূপালি আলোয় ভিজে ওঠে, তখন গ্রামে অদ্ভুত ঢাকঢোল বাজতে শুরু করে। শোনা যায়, শঙ্খধ্বনি, বংশীর আওয়াজ আর মেয়েলি হাসির কোলাহল—যেন কোনো অচেনা উৎসব শুরু হয়েছে। অথচ সেই রাতেই গ্রামবাসীরা ভয়ে নিজেদের ঘরে তালা মেরে, কপালে গঙ্গাজল ছিটিয়ে, প্রদীপ জ্বেলে এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। কারও সাহস হয় না জানলার ফাঁক দিয়েও বাইরে তাকানোর। সবার মনে প্রশ্ন—কারা বাজায় সেই ঢাক, কারা গায় সেই গান, আর কারা হাসে সেই অদৃশ্য মেয়েলি হাসি? এই প্রশ্নের উত্তর আজও কেউ খুঁজে পায়নি, তবে মানুষ জানে—যে সাহস করে বাইরে যায়, সে আর কোনোদিন ফিরে আসে না।
এই কাহিনি গ্রামে নতুন নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দাদুরা, ঠাকুমারা, শীতের রাতে আগুন পোহাতে বসে শিশুদের শোনায় এই গল্প। তারা বলে, বহু বছর আগে এই গ্রামের এক বধূর বিয়ে পূর্ণ হয়নি। বর আসার আগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে, তার চোখে ঝরে পড়া জল মাটিকে ভিজিয়ে রেখে যায়। সেই অসমাপ্ত বিয়ের ক্রোধ আর হাহাকারই নাকি আজও প্রতি বছর রাতের আঁধারে ফিরে আসে। তবে এ শুধু গল্প নয়, অনেকেই দাবি করে তারা নিজের কানে শুনেছে ঢাকের আওয়াজ, শঙ্খের ধ্বনি আর বধূর করুণ কান্না। গ্রামের মানুষ তাই রাতে কেউ শ্মশানের দিকে যায় না, জঙ্গলের ধার ঘেঁষে হাঁটে না। অথচ গ্রামের তরুণদের মনে এক অন্যরকম কৌতূহল, বিশেষ করে যারা জন্ম থেকেই এসব কাহিনি শুনে এসেছে। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে—সত্যিই কি এসব ঘটে, নাকি এসব পুরোনো প্রজন্মের বানানো কল্পকাহিনি? এ দ্বন্দ্বই প্রতিবার পূর্ণিমার আগের দিন থেকে গ্রামকে এক অদ্ভুত ভয়াল ছায়ায় মুড়ে ফেলে।
প্রতি বছর রাতটি ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে যেন অদৃশ্য আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই সবাই কাজ শেষ করে, গোরুর গাড়ি, ধান মাড়াই, কুয়ো থেকে জল তোলা—সবকিছু থেমে যায়। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের পথ অন্ধকারে ডুবে যায়, কোথাও প্রদীপের ক্ষীণ আলো, কোথাওবা কুকুরের আতঙ্কিত ডাক। বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে মায়েরা তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে, যেন বাইরের অজানা ভয়কে আটকে রাখতে পারে। বৃদ্ধরা মন্ত্র জপ করে, কেউ কেউ গঙ্গাজল ছিটিয়ে দরজার দোর বাঁধে, আবার কেউ আতঙ্কে নিঃশব্দে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তবুও ভয় কাটে না, কারণ সবাই জানে যে মুহূর্তে ঢাকের আওয়াজ শুরু হবে, তখন গ্রামের বুক কেঁপে উঠবে। ঢাকের সঙ্গে মিশে যাবে নারীকণ্ঠের হাসি—যা শুনলে শরীর শিউরে ওঠে, কানে বাজে এক অচেনা ব্যঙ্গের সুর। যেন কেউ বলছে—“আমরা এসেছি, আবারও এসেছি।”
কিন্তু ভয় যতই তাড়া করুক, কৌতূহলও ততই বেড়ে ওঠে। গ্রামের প্রতিটি কিশোর-যুবকের মনে সেই প্রশ্ন—সত্যিই কী ঘটে ওই রাতে? মানুষ কোথায় হারিয়ে যায়? কিসের বিয়ে হয়, আর কে সেই বধূ? প্রবীণরা যতই বলুক, “ওই সব নিয়ে ঘাঁটিও না, জানলে জান প্রাণ যাবে,” তবুও তরুণ রক্তে কৌতূহলের ঢেউ থেমে থাকে না। অনেকে জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোয় অচেনা ছায়া দেখেছে বলে দাবি করেছে, কেউ বলেছে দূরে ধোঁয়া উঠতে দেখেছে, আবার কেউ বলেছে কানে এসেছে কোলাহলের মাঝখানে বধূর অশ্রুসিক্ত হাহাকার। এইসব টুকরো গল্প আরও রহস্য বাড়িয়ে তোলে। আর তাই, গ্রামের প্রতিটি নতুন প্রজন্ম ঠিক করে, এবার তারা সত্য জানবেই। কিন্তু সত্য জানার পথে যারা গেছে, তারা আর কোনোদিন ফেরেনি। তাদের অনুপস্থিত মুখই যেন নিঃশব্দে সাক্ষী থেকে গেছে—পেত্নীর বিয়ের অভিশপ্ত রাতে।
***
রামচকের গল্প শুনতে শুনতে রূপেশ বড় হয়েছে। ছোটবেলায় ঠাকুমার মুখে শুনেছিল “পেত্নীর বিয়ে”-র কাহিনি, কেমন করে ঢাক বাজে, কেমন করে শঙ্খধ্বনি কানে ভেসে আসে, আর কেমন করে কেউ ফিরে আসে না। তখন হয়তো ভয় পেত, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয় ভেঙে কৌতূহল দানা বাঁধতে থাকে। রূপেশ গ্রামের মাঠে মেহনত করে, কখনো মাটির কাজ, কখনো ধান কাটা—জীবন তার একঘেয়ে হলেও মনটা চঞ্চল। তার বন্ধু বিক্রম, সঞ্জয়, রাজীব আর ছোটু—সবাই সমবয়সী, আর সবাই একইভাবে এই গল্প শুনে বড় হয়েছে। প্রতিবার পূর্ণিমার আগে গ্রামের ভেতরে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তখন তারা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে, হাসাহাসি করে—“আরে এসব বুড়োদের বানানো গল্প, ভয় দেখানোর জন্য। আমরা গেলে তো সব ফাঁস হয়ে যাবে।” সেই সাহস দেখাতেই এবার তারা সিদ্ধান্ত নিল—এই পূর্ণিমার রাতে তারা জঙ্গলের ধারে যাবে, আর নিজেদের চোখে দেখবে আসলে কী ঘটে।
তাদের এই দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তের কথা প্রথমে কানে আসে সাবিতার। সাবিতা রূপেশের বাল্যবন্ধু, তার চোখে রূপেশ শুধু সাহসী যুবক নয়, বরং এমন একজন, যে প্রয়োজনে সবার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে তার বুক কেঁপে ওঠে। সন্ধ্যার পর নদীর ধারে যখন রূপেশদের আড্ডা হয়, সাবিতা হঠাৎ সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। কণ্ঠ কাঁপা, চোখে আতঙ্ক—“তোমরা কি জানো, কী করতে যাচ্ছ? যারা গেছে তারা তো আর ফেরেনি। তোমাদের যদি কিছু হয়?” রূপেশ হেসে বলে, “এসব শুধু ভয় দেখানোর গল্প। আমরা গিয়ে দেখে আসব, তারপর সবাইকে বলব সত্যি। তখন গ্রামবাসীও ভয় পাবে না।” কিন্তু সাবিতা হাল ছাড়ে না, বারবার বোঝায়—“ভয় যদি না-ও পাও, অন্তত আমার কথা শোনো। আমি জানি এই গল্প শুধু গল্প নয়। আমার দাদু নিজের চোখে ঢাকের শোভাযাত্রা দেখেছিল, তারপর অসুস্থ হয়ে মারা গেল। তুমি কেন বুঝতে চাইছ না?” তবুও কেউ শোনে না। রূপেশের চোখে একরাশ দুঃসাহস, বন্ধুদের চোখে উচ্ছ্বাস। সাবিতার চোখে জল জমলেও সে কিছু করতে পারে না, কারণ তরুণ রক্তে কৌতূহলের জোয়ার বয়ে গেছে।
পূর্ণিমার আগের সন্ধ্যাগুলোতে গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মানুষজন যখন আগেভাগেই ঘরে ঢুকে দরজা-জানলা বন্ধ করে দেয়, তখন রূপেশ আর তার বন্ধুরা উল্টোটাই করে। তারা ঠিক করে, রাত গভীর হলে সবাই একসাথে বেরোবে, মশাল নিয়ে যাবে, যদি কিছু অদ্ভুত দেখেও ফেলে, তবে গ্রামে ফিরে প্রমাণ হিসেবে কিছু চিহ্ন আনবে। বিক্রম বলে, “যদি ঢাক-ঢোল বাজে, তবে অন্তত আমরা তো দেখতে পাব কে বাজাচ্ছে। মানুষই হবে, আর কিছু নয়।” সঞ্জয় বলে, “যদি সত্যিই বিয়ে হয়, তবে আমরা হব সাক্ষী, গ্রামের ইতিহাসে প্রথম। সবাই আমাদের নাম নেবে।” এই গর্ব আর দুঃসাহসই তাদের অন্ধ করে রাখে। তারা জানত না, অজানা জগতে পা বাড়ানো মানে নিজের জীবনকে বাজি রাখা। শুধু সাবিতা নয়, গ্রামের আরও কয়েকজন বয়স্ক মানুষ তাদের কানে কানে সাবধান করে, কিন্তু হাসতে হাসতেই তারা সব কথা উড়িয়ে দেয়।
সেই রাতে, চাঁদ উঠতে না উঠতেই গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। দূরে কুকুরের ডাক শোনা যায়, মাঝে মাঝে হঠাৎ বাতাস বইতে শুরু করে। মানুষরা ঘরে আলো নিভিয়ে বসে আছে, ভয়ে শ্বাসও ফেলে চুপচাপ। ঠিক তখনই রূপেশ আর তার বন্ধুরা গোপনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। হাতে মশাল, কোমরে দা, চোখে আগুন—তারা প্রস্তুত অজানা রহস্য উন্মোচন করার। পায়ে পায়ে তারা এগোতে থাকে জঙ্গলের দিকে। চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা, যেন পুরো পৃথিবী নিঃশ্বাস আটকে আছে। তাদের বুকের ভেতর ধকধক শব্দ উঠছে, তবুও কারও পিছু হটার নাম নেই। রূপেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, বুক ফুলিয়ে বলছে—“আজ আমরা জানব, আর কাউকে ভয় পেতে হবে না।” দূর থেকে হঠাৎ করেই ভেসে আসে মৃদু ঢাকের আওয়াজ। সবাই থেমে যায়, কানে শোনে। আওয়াজ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, সঙ্গে শঙ্খের ধ্বনি, আর নারীকণ্ঠের অচেনা হাসি। রূপেশের চোখে কৌতূহলের ঝিলিক, বন্ধুদের ঠোঁটে আতঙ্কের ছাপ। কিন্তু এবার আর পিছু ফেরার উপায় নেই—কারণ তারা প্রতিজ্ঞা করেছে, সত্য জানবেই।
***
গ্রামে এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি সবসময় এই ভয়াল রাতের কথা উঠলে গম্ভীর হয়ে যেতেন। তিনি হলেন হরিদাস ওঝা। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, চুলের অর্ধেক সাদা, মুখে গভীর দাগ, চোখে সবসময় অদ্ভুত এক তেজ। জীবনে অনেক তন্ত্র-মন্ত্র, পূজা-পার্বণ আর শ্মশানসাধনার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ছোটবেলা থেকেই অদ্ভুত কাহিনি আর ভয়ানক ঘটনার সাক্ষী তিনি, আর সেই কারণেই গ্রামের মানুষ তাকে একইসঙ্গে ভয় পায় ও বিশ্বাসও করে। পূর্ণিমার রাত ঘনিয়ে আসতেই তিনি গ্রামের চৌপাটিতে বসে এক অগ্নিকুণ্ডের পাশে ধূপ জ্বালিয়ে বসেন, ঠোঁটে বিড়ি ঝুলে থাকে, চোখে যেন অদৃশ্য ছায়ার প্রতিফলন। যুবকেরা যখন সাহস দেখিয়ে জঙ্গলের ধারে যাওয়ার কথা ঘোষণা করল, তখন গ্রামের কয়েকজন ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ ছুটে গিয়ে হরিদাসকে জানাল। খবর শুনে ওঝা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, ঠোঁট চেপে হাসলেন না, বরং গভীর গলায় বললেন—“মূর্খেরা, ওই রাতের বিয়ে কোনো আনন্দ নয়, কোনো উৎসব নয়। ওটা অভিশপ্ত আত্মার ক্রোধ। যেদিন সেই বধূর মৃত্যু হয়েছিল, সেদিন তার অপূর্ণ বিয়ের ক্ষোভ এই মাটিতে বেঁধে গেছে। আর তোমরা যদি সেখানে যাও, তোমাদের নামও গ্রামের ইতিহাসে শুধু নিখোঁজদের তালিকায় লেখা থাকবে।” তার কণ্ঠ এত দৃঢ় ছিল যে আশেপাশের লোকজন শিউরে উঠল।
কিন্তু এই কথায় যুবকরা হাসাহাসি শুরু করল। বিক্রম হেসে বলল, “ওঝা কাকা, আপনি তো সবকিছুতেই ভূত দেখেন। আপনার কাজই হলো ভয় দেখানো, না হলে আপনার ঝাড়ফুঁক চলবে কী করে?” সঞ্জয় যোগ করল, “এই সব গল্পই তো বানিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ আপনাকে টাকা দেয়, পূজা করায়। আসলে কিছুই নেই। আমরা গিয়ে প্রমাণ করে দেব।” হরিদাসের চোখ জ্বলে উঠল। সে মাটিতে বসা ধোঁয়া উড়তে থাকা ধূপে হাত নেড়ে বলল, “তোমরা ভাবছ আমি ভয় দেখাচ্ছি? তবে শোনো, আমার নিজের চোখে দেখা। আমি একবার যুবক বয়সে সাহস করে বেরিয়েছিলাম। ঢাকের শব্দ, শঙ্খের ধ্বনি কানে আসতেই শরীর জমে গিয়েছিল। আমি দূর থেকে লাল শাড়ি পরা এক বধূকে দেখেছিলাম। তার চোখে রক্তের মতো জ্যোতি, তার ঠোঁটে মৃত্যুর মতো হাসি। সেই রাতের পর থেকে আমি তিন দিন জ্ঞান ফেরেনি। আমার গুরু আমাকে বাঁচিয়েছিল। তাই বলছি, ওই পথে যেয়ো না।” তার গলা কেঁপে উঠল, কিন্তু চোখে কঠোর সতর্কবাণী রয়ে গেল।
তবুও যুবকেরা অনড়। রূপেশ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “কাকা, আপনি নিজেই বলেন আপনি নাকি গিয়েছিলেন। তাহলে তো আপনি বেঁচে আছেন। যদি এত ভয়ানক হতো, তবে আপনিও ফেরত আসতেন না। আমরা যাব, আমরা সবকিছু দেখব।” রাজীব চ্যালেঞ্জের সুরে বলল, “আপনার কথার সত্যতা যাচাই করাই আমাদের কাজ। আমরা যদি না যাই, তবে সত্য জানব কী করে?” হরিদাস ওঝা এবার আর রাগ করলেন না, বরং গভীর দুঃখে মাথা নাড়লেন। ধীরে ধীরে বিড়িতে টান দিয়ে বললেন, “তোমরা মনে করছ আমি মিথ্যে বলছি। কিন্তু মনে রেখো, অভিশপ্ত আত্মার সঙ্গে ছেলেখেলা নয়। ওই বিয়ে কখনও পূর্ণ হয়নি, আর তাই প্রতি বছর সে তার বর খোঁজে। তোমরা যদি কাছে যাও, তবে তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে সে তার বর করে নেবে। তখন আর ফিরে আসার পথ থাকবে না।” কথাগুলো শেষ করে তিনি আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে কিছু মন্ত্র জপতে লাগলেন, যেন অদৃশ্য অশুভ শক্তিকে থামানোর চেষ্টা করছেন। আশেপাশের ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা হাত জোড় করে প্রার্থনা করল, কিন্তু যুবকেরা বিদ্রূপের হাসি ছাড়া আর কিছু দিল না।
সেই রাতেই ওঝার সতর্কবাণী গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই ছেলেদের বাড়িতে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল, মায়েরা কান্নাকাটি করে ছেলেদের আঁকড়ে ধরল, কিন্তু দুঃসাহসী তরুণদের রক্তে তখন কেবল উত্তেজনা। তারা মনে করল, যদি ফিরে এসে বলে দিতে পারে যে কিছুই হয়নি, তবে গ্রামের মানুষ আর কখনও ভয় পাবে না। সাবিতা আবারও গিয়ে রূপেশকে বলল—“তুমি কেন শুনছ না? ওঝা কাকার চোখে মিথ্যে নেই। আমি চাই না তুমি যেও।” কিন্তু রূপেশ কেবল হাসল, তার চোখে একরাশ আত্মবিশ্বাস। “সাবিতা, ভয় পেও না। আমি আছি তো। কাল সকালে ফিরে এসে তোমাকেই প্রথম সব বলব।” কথাগুলো শুনে সাবিতার বুক হাহাকার করে উঠল, কারণ সে বুঝতে পারল—ভয়, সতর্কবাণী, কাকুতি-মিনতি, কিছুই এই ছেলেদের থামাতে পারবে না। ওঝার সতর্কবাণী আকাশে ভেসে থাকল, কিন্তু তরুণদের কানে সেটা যেন বাজেনি। তারা তো ঠিক করে ফেলেছে—এই পূর্ণিমার রাতে তারা হবে রামচকের ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী সাক্ষী। অথচ তারা বুঝতে পারল না, সেই সাক্ষ্যই তাদের জীবন থেকে আলো মুছে দেবে।
***
পূর্ণিমার রাত ঘনিয়ে আসছিল, আর সেই সঙ্গে গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল এক অদৃশ্য চাপা ভয়। দিনের আলোয় মানুষজন যতই স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করুক, সূর্য ডোবার পরই সেই আতঙ্ক যেন ঘন কুয়াশার মতো নেমে আসত প্রতিটি উঠোনে। কুকুরেরা হঠাৎ করেই চিৎকার জুড়ে দিত, মোরগেরা অকারণে ডেকে উঠত, আর বাতাসে এক ধরনের গুমোট অস্থিরতা ভেসে বেড়াত। গ্রাম্য বৃদ্ধরা বারবার বলছিলেন—”পূর্ণিমার রাতেই সর্বনাশ হয়।” এমনকি মহিলারা দরজা-জানালা আটকে রাখছিলেন, শিশুদের কোলে জড়িয়ে দিচ্ছিলেন যেন বাইরের ভয়ের কোনো আঁচ ভেতরে না আসে। অথচ এই ভয়ের মাঝেই রূপেশ আর বিক্রমের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল অন্যরকম এক জেদ—যে আতঙ্ককে এতদিন গ্রামের সবাই এড়িয়ে এসেছে, আজ তারা সেই অদৃশ্য ছায়ার মুখোমুখি হবে। বিকেলের পর থেকেই তারা মশাল, লাঠি আর কাঁচা সাহস নিয়ে কিছু যুবককে একত্র করছিল। রূপেশ সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভয় পেলে হবে না। যদি আমরা মুখোমুখি না হই, এই অশরীরী ভয় চিরকাল আমাদের গ্রাস করবে।” তার কথায় কেউ তেমন সাড়া দিল না, কিন্তু তাদের চোখে ফুটে উঠল ভয় মেশানো দৃঢ়তা।
রাত নামতেই গ্রামের প্রতিটি দিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চাঁদের আলো তখনও পূর্ণতা পায়নি, কিন্তু তার ফ্যাকাশে আভা ইতিমধ্যেই ঝরে পড়ছিল কাঁচা মাটির পথের ওপর। রূপেশ আর বিক্রম মশাল জ্বালিয়ে সেই পথেই নামল। তাদের সঙ্গে আরও ছয়জন যুবক ছিল, কেউ লাঠি হাতে, কেউ স্রেফ পাথর কুড়িয়ে নিয়েছিল আত্মরক্ষার জন্য। চারদিকে ঘন অন্ধকার, শুধুই মশালের আলোয় দেখা যাচ্ছিল ঝোপঝাড়ের ছায়া। তাদের পদশব্দ যেন হাড় হিম করে দেওয়া নীরবতার মধ্যে আরও প্রবল হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক, কিংবা দূরে শিয়ালের হুক্কাহুয়া আওয়াজ যেন বুকের ভেতর কাঁপন ধরাচ্ছিল। বিক্রম নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি মনে করো সত্যিই কোনো প্রেতশক্তি আছে এখানে?” রূপেশ কঠিন চোখে চারপাশ দেখে উত্তর দিল, “যা-ই হোক, আজ প্রমাণ হবেই। হয় আমরা ভয়কে হারাব, নয়তো ভয় আমাদের গিলে ফেলবে।” তার কথায় অন্যরা গা শিউরে উঠলেও কেউ আর পিছু হটল না।
ধীরে ধীরে তারা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে মাঠের দিকের পথ ধরল। পূর্ণিমার আলো তখন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অপেক্ষা করছে। বাতাস হঠাৎ করেই ঠান্ডা হয়ে উঠল, আর দূরে কাশবনের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল কিছু ছায়া যেন নড়ছে। যুবকেরা থমকে দাঁড়াল। মশালের আলো সামনের দিকে ফেলে তারা চেষ্টা করল ছায়াগুলোকে স্পষ্টভাবে দেখার, কিন্তু চোখ যতই কষাকষি করে তাকানো যাক না কেন, সেই ছায়া আরও দূরে সরে যাচ্ছিল। বিক্রমের বুক কেঁপে উঠল, তবে রূপেশ লাঠি হাতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। “পিছিয়ে যেও না,” সে গর্জে উঠল, “এখন যদি আমরা ভয় পাই, তবে আর কোনোদিন এই গ্রামে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।” তার সেই দৃঢ় কণ্ঠে বাকিদের শরীরে অদ্ভুত সাহস জেগে উঠল। তারা দল বেঁধে এগিয়ে গেল কাশবনের ভেতরে। মশালের আগুনে শুকনো ঘাসে সিঁসিঁ শব্দ উঠল, বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে এলো—পোড়া মাটির সঙ্গে মিশে থাকা যেন রক্তের কটু গন্ধ।
অবশেষে তারা পৌঁছল সেই পুরোনো পাথরের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কাছে, যেখানে বছরের পর বছর ধরে কেউ যেত না। পূর্ণিমার আলোয় সেই ভাঙাচোরা স্থাপত্যটা যেন আরও রহস্যময় লাগছিল। ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে যেন কেউ তাকিয়ে আছে, আর মেঝেতে শুকনো পাতার ওপর হালকা হাওয়ায় সাঁই সাঁই শব্দ উঠছিল। রূপেশ মশাল উঁচিয়ে বলল, “এই জায়গাতেই অভিশপ্ত শক্তি লুকিয়ে আছে।” হঠাৎ করেই এক অদৃশ্য ঝোড়ো হাওয়া এসে সব মশাল প্রায় নিভিয়ে দিল। যুবকেরা চিৎকার করে উঠল, ভয়ে কেউ পিছু হটল, কেউ আবার আঁকড়ে ধরল একে অপরকে। বিক্রম কাঁপা গলায় বলল, “এটা বাতাস নয়, এটা অন্য কিছু…” আর সেই মুহূর্তেই ভাঙা দেওয়ালের গা থেকে শীতল এক ছায়া নেমে এল তাদের সামনে। কারও চোখে সেটি ধোঁয়ার মতো, কারও চোখে মানুষের ছায়ার মতো। ঠান্ডা বাতাস তাদের বুকের ভেতর কেটে যাচ্ছিল। সবাই আতঙ্কে থমকে গেলেও রূপেশ দাঁতে দাঁত চেপে মশালটা আবার জ্বালানোর চেষ্টা করল। তার চোখে ভয়ের সঙ্গে এক অদম্য লড়াইয়ের আগুন জ্বলছিল—আজই সেই পূর্ণিমার রাতে তিনি ভয়কে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত।
***
রাত তখন গভীর হতে শুরু করেছে। শাল-সেগুনের ঘন জঙ্গল চারপাশে নিস্তব্ধ, কেবল কোথাও কোথাও নিশাচর পাখির ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারা, অভিরূপ আর বাকি দুই সঙ্গী ক্লান্ত শরীরে ধীরে ধীরে পথ খুঁজে এগোচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ বাতাসে এক অদ্ভুত সুর ভেসে এল। প্রথমে তারা ভেবেছিল কানে ভুল শুনছে, কিন্তু কিছুটা মনোযোগ দিতেই বোঝা গেল সেটা ঢাকের শব্দ। দূরে কোথাও যেন ঢাকের তালে গানের সুর মিশে বাজছে, তাতে একধরনের অদ্ভুত ছন্দ, যেন লোকগান আবার তেমন নয়। আগুনের আলো ঝিলমিল করে উঠছে গাছের ফাঁক দিয়ে, মনে হচ্ছে শোভাযাত্রার মশাল জ্বলছে। তারা অবাক হয়ে বলল, “এই জঙ্গলের মধ্যে বিয়ের শোভাযাত্রা! এটা কি সম্ভব?” অভিরূপ কপাল কুঁচকে বলল, “গ্রাম এত দূরে, এদিকে কারা আবার বিয়ে করছে?” অথচ শব্দ যত বাড়তে লাগল, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল সেই সঙ্গীত আর ঢাকের তালে কণ্ঠ মেলানো এক অদ্ভুত গান, যার ভাষা তারা কেউ বোঝে না।
সতর্ক হয়ে সবাই ধীরে ধীরে এগোতে লাগল আলো আর শব্দের দিকে। যতই কাছে যাচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে সেটা সত্যিই একটা শোভাযাত্রা—আগুনের মশাল জ্বলছে, ধূপ-ধুনোর গন্ধ ভেসে আসছে, আর সঙ্গীতের তালে তালে অদ্ভুত এক মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো—তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন, সেই শোভাযাত্রায় কোনো মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে না। ঢাক বাজছে, শঙ্খ ধ্বনি উঠছে, নারীকণ্ঠে গাওয়া হচ্ছে বিয়ের গান, তবুও চোখে ধরা পড়ছে না একটিও মানুষ। শুধু মশালের আলো আর অদৃশ্য ছায়ার মতো ভেসে বেড়ানো গানের সুর। তারা আতঙ্কিত গলায় বলল, “এটা তো অদ্ভুত! এত কাছে থেকেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন?” অভিরূপ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, চোখে ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র ছাপ। সঙ্গীরা একে অপরের হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল, যেন নড়তে ভুল করলে অচেনা এই জগতের অংশ হয়ে যাবে তারাও।
হঠাৎ শোভাযাত্রার ঢাকের শব্দ থেমে গেল। মুহূর্তের জন্য জঙ্গলের মধ্যে এমন নিস্তব্ধতা নেমে এল যে, নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও বড় মনে হতে লাগল। ঠিক সেই সময় এক অদৃশ্য নারীকণ্ঠ ভেসে এল—গভীর, করুণ অথচ শক্তিশালী সুরে। তারা কেঁপে উঠল, গলা শুকিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল সেই গান যেন শুধু শোনার জন্য নয়, বরং ডাকছে, টেনে নিচ্ছে ওদের ভেতরে। আগুনের আলো একসময় ওদের চারপাশ ঘিরে ধরল, কিন্তু এখনো একটিও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গীরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু পা যেন জমে গেছে। তারা হঠাৎ খেয়াল করল—গাছের গায়ে গায়ে লাল-সাদা আলপনা আঁকা, যেন কেউ অনেক আগেই এখানে কোনো প্রাচীন বিয়ের আয়োজন করেছিল। ঢোল আবার বেজে উঠল, এবার আরও জোরে, আর অদৃশ্য শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে তাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল। আগুনের মশালের আলোয় গাছপালা কাঁপতে লাগল, যেন জঙ্গল নিজেই এই অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে গেছে।
যখন শোভাযাত্রা সামনে এগিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, তখনো কিছুক্ষণ ধোঁয়া, ধূপের গন্ধ আর গানের ভাঙা ভাঙা সুর ভেসে আসছিল। তারা-রা একে অপরের দিকে তাকাল, কেউ কোনো কথা বলতে পারছিল না। অবশেষে অভিরূপ ফিসফিস করে বলল, “এগুলো মানুষ নয়… এরা অন্য কিছু। হয়তো বহু বছর আগে এখানে কারো বিয়ে অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল, আর সেই আত্মারা আজও ঘুরে বেড়ায়।” তাদের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল, কাঁপতে কাঁপতে তারা সেই জায়গা ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরের দিকে, কিন্তু প্রত্যেকের মনের ভেতর একটা প্রশ্নই ঘুরতে লাগল—যদি এই অদৃশ্য শোভাযাত্রা আসলে কোনো অশরীরী অভিশাপের অংশ হয়, তবে সামনে আরও কী ভয়ঙ্কর ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে? সেই রাতের অভিজ্ঞতা তাদের হৃদয়ে চিরদিনের জন্য এক ভৌতিক ছাপ ফেলে দিল, যেন জঙ্গল তাদের সতর্ক করে দিল, “এখনো সময় আছে, ফিরে যাও…” কিন্তু তাদের যাত্রা তখনও শেষ হয়নি।
***
গ্রামের রাত নেমে এসেছে নিঃশব্দে। চারদিক যেন হঠাৎ থমকে গেছে। বাতাসে অস্বাভাবিক এক শীতলতা, যেন অমাবস্যার আঁধার অকালেই গ্রাস করেছে চেনা পরিবেশ। সেই আঁধারের ভিতরেই ধীরে ধীরে ভেসে উঠল এক বধূর ছায়া—গায়ে রক্তলাল শাড়ি, হাতে-পায়ে ভারী সোনার গয়না, অথচ চোখ দুটো শূন্য, যেন জীবনের কোনো আলো নেই। গ্রামের মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো প্রথমে ভাবল হয়তো কেউ হঠাৎ এসে পড়েছে, কিন্তু পর মুহূর্তেই বুকের ভিতর এক শীতল স্রোত বইয়ে দিল তার উপস্থিতি। বাতাস জমাট বেঁধে গেল, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক থেমে গেল, এমনকি গাছের পাতার মর্মর ধ্বনিও স্তব্ধ হয়ে গেল। কেবল সেই পেত্নীর শাড়ির আঁচল হালকা বাতাসে দুলে উঠছিল, আর প্রতিটি শব্দ যেন মৃত্যুর আগমনী বার্তা শুনিয়ে দিচ্ছিল।
গ্রামবাসীরা একে অপরের দিকে তাকাল, কিন্তু কেউ সাহস করে সামনে এগোল না। কারও ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, কারও আবার বুক ধড়ফড় করছে, তবু চোখ ফেরাতে পারছে না। বধূর মুখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, ঠোঁটে নেই কোনো হাসি কিংবা কান্নার রেখা—শুধু মৃত্যুর অমোঘ ছাপ। মনে হচ্ছিল, সে যেন জীবন্ত নয়, মৃতদের ভিড় থেকে উঠে এসে হঠাৎ মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কেউ ফিসফিস করে বলল, “ওই যে, বহু বছর আগে যে কনের শবদেহ বৌভাতের রাতে হারিয়ে গিয়েছিল, এ কি তবে সেই?” কথাটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়তেই কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল জনতার মধ্যে। অন্ধকারে খামচে ধরল ভয়ের অদৃশ্য হাত, শিশুদের কেঁদে ওঠা থেমে গেল হঠাৎ, যেন তারাও এই অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করেছে।
ধীরে ধীরে বধূ এগোতে লাগল। তার প্রতিটি পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মাটি যেন কেঁপে উঠছিল, আর চারপাশের গাছপালা কেমন করে শুকিয়ে যাচ্ছিল মুহূর্তে। ফুলের কুঁড়িগুলো হঠাৎ মরে গেল, শীতল বাতাস তীব্র হয়ে উঠল। গ্রামের প্রবীণরা কাঁপা গলায় বলল, “এ যে অভিশপ্ত পেত্নী… যাকে অকালমৃত্যু ঠকিয়েছে, যার আত্মা শান্তি পায়নি। সে এখন প্রতিশোধ চাইছে।” কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, আর মানুষজন একে একে পিছিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু যত তারা সরে যায়, ততই মনে হচ্ছিল, বধূর সেই শূন্য চোখ তাদের খুঁজে ফিরছে, টেনে নিচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তিতে।
অবশেষে পেত্নী মাঝখানে দাঁড়াল, মাটির দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ তার ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। তার চোখ দুটো হঠাৎ রক্তাভ হয়ে উঠল, যেন দগ্ধ আগুনের মতো জ্বলছে। চারদিকে ভয়াল নিস্তব্ধতা নেমে এল—গ্রামের মানুষ বুঝতে পারল, মৃত্যুর ছায়া নেমে এসেছে তাদের উপর। কেউ সাহস করে তাকে প্রশ্ন করল না, কেউ এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াল না। বরং সবাই মনে মনে প্রার্থনা করল—এই অশুভ আগমন যেন যত দ্রুত সম্ভব সরে যায়। কিন্তু বধূর মুখের দিক থেকে ছড়িয়ে পড়ল অশান্তির বার্তা, আর সবাই টের পেল, এটি কেবল একটি শুরু। পেত্নীর আগমন মানেই গ্রামে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটবে, আর কোনো এক লুকোনো অভিশাপ ফিরে আসবে তাদের জীবনে। সেই রাত থেকে শুরু হল এক ভয়ঙ্কর সময়—যেখানে ঘুম হারাম, শান্তি নিঃশেষ, আর মৃত্যুর ছায়া প্রত্যেককে ছুঁয়ে যাবে একে একে।
***
মণ্ডপ সাজানো হয়েছে গ্রামের পুরোনো পুকুরপাড়ের বিশাল বটগাছের নীচে। লাল আলপনা, কলাপাতা, প্রদীপ আর গাঁদার ফুলের মালা দিয়ে তৈরি সেই অস্থায়ী মণ্ডপটি দেখতে যেন আসল বিয়ের মতোই। গ্রামবাসীরা ভিড় করেছে চারপাশে, কৌতূহল আর ভয়ে মিশ্রিত চোখে তারা তাকিয়ে রয়েছে। সামনে বসে আছে পেত্নী—তার পরনে কাঁচা লাল শাড়ি, কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা, ঠোঁটে যেন রক্তের ছাপ লেগে আছে। কিন্তু যা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, তা হলো—তার পাশেই সাজানো আছে বরপক্ষের আসন, অথচ সেখানে কেউ দৃশ্যমান নয়। তবুও সবাই অনুভব করছে, ওখানে কেউ বসে আছে, হালকা বাতাসে আলপনার মাটির গুঁড়ো কেঁপে উঠছে, মাটির প্রদীপের শিখা হঠাৎ দুলে যাচ্ছে। যুবকেরা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে, ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে—“বর কোথায়?”—কেউ বলে—“হয়তো অদৃশ্য!”—কেউ আবার কাঁপা গলায় বলে—“পেত্নীর বিয়েতে কি কখনো মানুষ বর হয়?”
বিক্রম প্রথমে সবার মতোই বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু হঠাৎ তার চোখ যেন অন্য এক দিগন্তে চলে গেল। সে লক্ষ করল, পেত্নীর পাশে বসে থাকা শূন্য চেয়ারটা ফাঁকা নয়—বরং সেখানে এক অদ্ভুত ছায়ার আকার দেখা যাচ্ছে। ছায়াটি মানুষের মতো, কিন্তু পুরোপুরি গঠিত নয়; যেন আধখানা আঁকা ছবি, অশরীরী অথচ স্পষ্ট উপস্থিত। তার চোখ নেই, তবুও শূন্য দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে চারপাশে, আর তার ভঙ্গি এমন, যেন সত্যিই বিয়ের জন্য বসা হয়েছে। বিক্রমের বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো, সে এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করতে পারল না—এটা কি কেবল আলো-আঁধারির খেলা, নাকি সত্যিই কোনো অশরীরী বর বসে আছে? গ্রামবাসীরা কিছুই বুঝতে পারছে না, তারা শুধু মণ্ডপ থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসে শরীর কাঁপছে, কারও মনে হচ্ছে কারও অদৃশ্য হাত গায়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পেত্নীর ঠোঁট বাঁকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল, আর সেই হাসি যেন চারদিকের আলো শুষে নিল।
ধীরে ধীরে গ্রামের লোকেরা ভয় আর কৌতূহলের মধ্যে আরও কাছে সরে এল। তখনই পেত্নী তার কর্কশ গলায় গান গাইতে শুরু করল, যেটি অচেনা অথচ মায়াবী সুরে ভরা। সেই গানের তালে তালে অদৃশ্য বর যেন মাথা নাড়ল, হাতের আঙুল নড়ল—যেন সত্যিই বিয়ের রীতিনীতি পালন করছে। উপস্থিত যুবকেরা দমবন্ধ করে তাকিয়ে আছে, তাদের চোখে ভয়, বিস্ময় আর বিভ্রান্তি। গ্রামের বুড়ো একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—“ওই ছায়াটাই তো! অশরীরী বর!” তার গলা কেঁপে গেল, আর বাকিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। তবুও কেউ পালাল না, বরং আরও বেশি করে দেখতে চাইলো। বিক্রম নিজের ভেতরে ভয় সামলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট—বর সত্যিই অদৃশ্য নয়, বরং ছায়ার মতো এক আত্মা, যেটি মানুষের রূপ নিয়েছে। তার ঠান্ডা দৃষ্টি বিক্রমের দিকে ফিরে এল, আর সেই মুহূর্তে বিক্রমের মনে হলো, পুরো শরীর জমে গেছে—যেন সে শূন্যতার গভীর খাদে টেনে নেওয়া হচ্ছে।
মণ্ডপের প্রদীপগুলো হঠাৎ কেঁপে উঠল, শিখাগুলো নিভে যেতে যেতে আবার জ্বলে উঠল। সেই আলো-অন্ধকারের খেলায় ছায়া বর আরও স্পষ্ট হলো, যেন এক মৃত যুবকের রূপে বসে আছে পেত্নীর পাশে। গ্রামের মহিলারা কান্নাজড়ানো গলায় নাম জপতে শুরু করল, কেউ কেউ চোখ বুজে প্রণাম করল—ভয়ে, যেন অশরীরী বর তাদের ক্ষতি না করে। আর পেত্নী তখন বরকে গলায় মালা পরিয়ে দিল—একই সঙ্গে গাঁদার ফুলের মালা অদৃশ্য আকারে ঝুলে গেল, যদিও সেখানে কারও শরীর নেই। সেই দৃশ্য দেখে লোকজনের গা শিউরে উঠল। বিক্রম অনুভব করল, তার চোখের সামনে অন্য জগতের খেলা চলছে—যেখানে মৃত্যুও জীবনের মতো বাস্তব। তার মনে হলো, এই বিয়েটা শেষ হলে গ্রামে আর কোনোদিন শান্তি থাকবে না। সে দাঁতে দাঁত চেপে শপথ নিল, যেভাবেই হোক তাকে এই অদৃশ্য বর আর পেত্নীর রহস্যের মোকাবিলা করতেই হবে। কারণ ছায়ার এই উপস্থিতি গ্রামকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। আর সেই রাত থেকেই বিক্রম জানল, তার জীবনের লড়াই এখন শুধু মানুষের সঙ্গে নয়, বরং অশরীরী শক্তির সঙ্গেও শুরু হলো।
***
মণ্ডপের চারদিকে তখন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে। কিছুক্ষণ আগেও ঢাকের তালে তালে গমগম করছিল চারপাশ, গায়ে লাগছিল গানের মায়াবী সুর। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু থেমে গেল—ঢাকের কাঁসার শব্দ থেমে গেল, গায়কদের কণ্ঠ হঠাৎ গিলে ফেলল গভীর অন্ধকার, আর প্রদীপগুলো একে একে নিভে গেল যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি ফুঁ দিয়ে দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে ভেসে উঠল এমন এক নিস্তব্ধতা, যা কেবল শ্মশানের নীরবতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। সেই নীরবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল পেত্নী, লাল শাড়ির আঁচল হাওয়ায় দুলছে, গলার হার কাঁপছে, কিন্তু তার চোখে আগুনের শিখা। ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়াল, আর তার ঠোঁট থেকে বেরোল বজ্রনিনাদের মতো ডাক—“বর চাই!” সেই এক ডাক যেন রাতের আকাশ ছিঁড়ে দিল, যেন মাটির তলা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। মানুষজনের বুক কেঁপে উঠল, কারও মাথা ঘুরে গেল, কেউ আবার কেঁদে ফেলল আতঙ্কে।
সেই ডাকে বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে গেল। গ্রামের ছেলেরা, যারা এতক্ষণ কৌতূহলী চোখে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু একে একে তাদের চোখ ঝাপসা হয়ে এল, বুকের ভেতর শ্বাসরোধ হতে লাগল। রূপেশ প্রথমে টের পেল—তার কানে অদ্ভুত গুঞ্জন বাজছে, মাথার ভেতর কেউ যেন ভারি হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সে বুঝতে পারল, এই ডাক কেবল শব্দ নয়, এ এক মৃত্যু-আহ্বান, যা আত্মাকে টেনে নিচ্ছে অদৃশ্য অন্ধকারে। রূপেশ চেষ্টা করল দাঁড়িয়ে থাকতে, কিন্তু চোখের সামনে অদ্ভুত সব দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল—শ্মশানের আগুন, কঙ্কাল, মৃতদেহের শোভাযাত্রা। তার দেহ শিউরে উঠল, আর মুহূর্তের মধ্যে সে অচেতন হয়ে পড়ল মাটিতে।
বিক্রমও টালমাটাল হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। তার বুক ধড়ফড় করছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কিন্তু যখনই সে চোখ তুলল, দেখল পেত্নী তার দিকে তাকিয়ে আছে—আগুনে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে, যেন তাকে বেছে নিচ্ছে। সেই দৃষ্টি এমনই ভয়ংকর যে, মনে হচ্ছিল তার সমস্ত রক্ত হিম হয়ে যাবে। বিক্রম পেছনে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু পায়ে যেন শেকল বাঁধা, শরীর জমে গেছে। তার পাশের বন্ধু দীপক হঠাৎ কর্কশ আওয়াজ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তারপর একে একে আরেকজন, তারপর আরেকজন—সবাই যেন মৃত্যুর ডাক শুনে প্রাণ হারাতে বসেছে। কেবল মাটির ওপর ছড়িয়ে পড়া নিস্তব্ধ অচেতন দেহগুলোই প্রমাণ দিচ্ছিল, এই রাত সাধারণ রাত নয়। চারপাশের গ্রামবাসীরা চিৎকার করতে চাইলেও গলা দিয়ে শব্দ বেরোল না—যেন বাতাস তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিয়েছে।
পেত্নীর মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল। তার গলার হার যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, চোখে শিখা নেচে উঠল। সে আবারও গর্জে উঠল—“বর চাই!” সেই ডাকের পর হঠাৎ অদৃশ্য বরের ছায়া নড়ল, যেন শূন্যতার ভেতর থেকে এক অশরীরী হাত বাড়িয়ে দিল পেত্নীর দিকে। বাতাস আরও ঠান্ডা হয়ে গেল, গাছপালার পাতাগুলো কাঁপতে কাঁপতে ঝরে পড়ল। যারা অচেতন হয়নি, তারা প্রাণপণে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু চারপাশে যেন অদৃশ্য প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে—কেউ এগোতে পারছে না। সেই মুহূর্তে গ্রামের সবচেয়ে অন্ধকার রাত শুরু হলো। মৃত্যুর ছায়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, আর বেঁচে থাকা প্রত্যেকের বুকের ভেতর গেঁথে গেল আতঙ্ক—আজকের রাত শুধু এক পেত্নীর বিয়ে নয়, আজকের রাত মৃত্যু-আহ্বানের উৎসব।
***
সকালের কুয়াশা যখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তখনই গ্রামের কয়েকজন মানুষ আতঙ্কিত মুখে দৌড়ে এসে ডাকাডাকি শুরু করল। মন্দিরপাড়ার কালীচরণ, শীতল আর ভোলানাথ মিলে প্রথম বনের ধারে গিয়ে দেখল, আগের রাতের মশালগুলো সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি একসাথে নিভিয়ে ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো—যেসব যুবকেরা সাহস করে রাতে বনের ভেতরে ঢুকেছিল, তাদের কারোরই দেখা নেই। মাটির ওপর পড়ে আছে কেবল তাদের পায়ের দাগ, যা বনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেছে। যেন তারা হাওয়ার মতো উবে গেছে। ভোলানাথ ভয়ে কাঁপা গলায় বলল, “এমন তো কখনো হয়নি… মানুষ তো মাটির নিচে হঠাৎ মিলিয়ে যেতে পারে না!” কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিল না, শুধু নিস্তব্ধ বাতাসে ভেসে আসা অদ্ভুত সুরে সবাই কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই দূরের বনের গভীর থেকে ভেসে এলো এক অদ্ভুত কান্নার শব্দ—না একেবারে মানুষের, না একেবারে পশুর, কিন্তু এতটা মর্মান্তিক যে শুনে শরীরের রক্ত যেন জমে যায়। কান্নার মধ্যে ভেসে আসছিল কারো ডাক, “বাঁচাও… বাঁচাও…”। গ্রামের মহিলারা তখন দূরে দাঁড়িয়ে কান ঢেকে কাঁপছিল, আর পুরুষেরা একে অপরের চোখে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না যে ভেতরে যাবে, না গ্রামে ফিরে আসবে।
যারা কিছুটা সাহসী, তারা বনপথে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল, কিন্তু কয়েক কদম যেতেই কেমন যেন অদৃশ্য শক্তি টেনে ধরে পেছনে ফিরিয়ে আনল। অচেনা শীতলতা যেন পা জড়িয়ে ধরল, আর বুকের ভেতর নিঃশ্বাস কেমন আটকে গেল। তাদের মনে হলো, বনের ভেতর কোনো অজানা জগতের দরজা খোলা, যেখানে প্রবেশ করলেই আর ফেরা যায় না। এক বৃদ্ধা হঠাৎ হাহাকার করে উঠলেন, কারণ নিখোঁজ যুবকদের মধ্যে তার একমাত্র ছেলে ছিল। তিনি ছুটে গিয়ে পড়ে গেলেন বনের ধারে, চিৎকার করে বললেন, “ফিরে আয় রে গো… একবার হলেও ফিরে আয়।” কিন্তু বনের ভেতর থেকে তার উত্তর এলো না। শুধু গাছের ডালে হাওয়া দুলে উঠল, আর কাকের কর্কশ ডাক কানে বাজল। গ্রামের পুরোহিত মদনমোহন মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললেন, “ওরা চলে গেছে… শ্মশানের আত্মারা ডাক দিয়েছে।” কথাটা শুনে সবাই কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। কারণ, এই বনের সাথেই এক পুরোনো কবরস্থান মিশে আছে, যেখানে একসময় অজস্র অকালমৃত মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছিল। অনেকে বলত, রাতের বেলা সেই মৃতেরা মশাল হাতে বের হয়, আর কাউকে ডাকতে ডাকতে নিয়ে যায়।
দিন বাড়ার সাথে সাথে গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। নিখোঁজ যুবকদের বাড়িতে শুরু হলো কান্না, শোক, আর অস্থিরতা। তাদের মায়েরা, বোনেরা পাগলের মতো কাঁদছিল, বাবারা হতভম্ব মুখে চুপ করে বসে ছিল। গ্রামের মাঝপথে মিটিং ডাকল প্রধান। সবাই এসে জড়ো হলো, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না। অবশেষে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে বললেন, “এ অভিশপ্ত বন, এখানে আর কেউ যাবে না। যারা গেছে, তারা আর ফিরবে না।” কিন্তু তরুণদের কয়েকজন প্রতিবাদ করল। তারা বলল, “বন্ধুরা নিখোঁজ, আমরা কি তাদের খুঁজব না? যদি তারা বেঁচে থাকে?” কিন্তু এই যুক্তি শোনার পরও কারো মন থেকে ভয় কাটল না। কারণ সবাই জানত, কাল রাতেই একই কথা ভেবে পাঁচজন যুবক গিয়েছিল, আর আজ তারা নেই। মাঝে মাঝে দূরের বন থেকে আবার সেই কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল, আর গ্রামবাসীরা স্তব্ধ হয়ে তা শুনছিল। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য কারাগারে আটকে আছে তারা, আর মুক্তির জন্য চিৎকার করছে। কিন্তু গ্রামবাসীরা জানত না, সেই ডাকের উত্তর দেওয়া মানেই নিজের জীবন বাজি রাখা।
রাত নামার সাথে সাথে ভয় যেন আরও বেড়ে গেল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই গ্রামের প্রতিটি ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ সাহস করে বাইরে বেরোতে পারল না। বাতাসে কেমন একটা ভারী গন্ধ ছড়িয়ে ছিল—পচা মাটি, শুকনো পাতার গন্ধ, আর কোথাও যেন অদ্ভুত ধূপ-ধোঁয়ার আভাস। হঠাৎ দূরে আবার শোনা গেল সেই কান্না—এবার আরও কাছে, আরও স্পষ্ট। কিছু মহিলা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল, পুরুষেরা ভেতরে মন্ত্র পড়তে শুরু করল। গ্রামের কুকুরগুলো হু হু করে ডাকতে লাগল, আর একসময় সব কুকুর একসাথে চুপ করে গেল, যেন তারা কোনো অদৃশ্য ভয়ঙ্কর উপস্থিতি টের পেয়েছে। সেই মুহূর্তে সবাই বুঝে গেল, নিখোঁজ যুবকেরা আর ফিরে আসবে না। তারা হয়তো বনের অভিশপ্ত ছায়ার অংশ হয়ে গেছে। শুধু থেকে যাবে তাদের অসহায় চিৎকার, যা রাতের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে আবার ভোরের কুয়াশায় মিলিয়ে যাবে।
***
ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের মানুষজন আবার একত্র হলো। কারও চোখে ঘুম নেই, কারও কণ্ঠে আশা নেই। চারদিকে শোকের ছায়া, যেন গোটা গ্রামটাই এক অদৃশ্য মৃত্যুচক্রে বন্দি। সেই সময় গ্রামের প্রাচীনতম সাধক মাহাত্মা কালীনাথ মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে সমবেত জনতার সামনে দাঁড়ালেন। তার চেহারায় ক্লান্তি, চোখে অভিজ্ঞতার ছাপ। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “শোনো, এই বন কোনো সাধারণ বন নয়। বহু শতাব্দী আগে এখানে এক অকালমৃত কনের আত্মা বন্দি হয়েছে। তার বিয়ে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, আর সেই অসম্পূর্ণতা থেকেই জন্ম নিয়েছে অভিশাপ। প্রতি বছর পূর্ণিমার রাতে সে তার বিয়ে পুনর্নির্মাণ করে, কিন্তু কখনও সম্পূর্ণ হয় না। তাই সে বারবার বর খোঁজে, আর বর পেতে হলে তাকে টেনে নিয়ে যায় আমাদের মধ্য থেকেই। যতদিন তার আত্মা মুক্তি না পাবে, এই অভিশাপ চলতেই থাকবে।” জনতা স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ চিৎকার করে কেঁদে ফেলল, কেউ আবার মাথা নিচু করে হাঁটুতে হাত রেখে বসে পড়ল। কারণ, এর মানে দাঁড়ায়—রূপেশ আর তার বন্ধুরা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।
কালীনাথের কথার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল এক ভয়ানক সত্য। গ্রামের প্রবীণরা ফিসফিস করে বলতে লাগল, এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আসলে বহু পুরোনো। তারা মনে করতে পারল—প্রতি কয়েক দশক অন্তর অন্তর গ্রামের কয়েকজন যুবক হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যেত। সেই সময় সবাই বলত, হয়তো বাঘে টেনেছে, হয়তো ডাকাত ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু সত্যি কথা কেউ জানত না। এখন স্পষ্ট হলো, এসবই ছিল সেই অভিশপ্ত চক্রের অংশ। গ্রামের মানুষরা বুঝে গেল, তারা এমন এক অভিশাপে আটকে পড়েছে যার কোনো সহজ সমাধান নেই। কেউ যদি এই গ্রামে জন্ম নেয় আর বড় হয়, তবে একদিন না একদিন তাকে সেই আত্মার হাতে উৎসর্গ হতে হবে। এই উপলব্ধি যেন কারও বুকের ভেতর আগুনের মতো জ্বলে উঠল। শিশুদের মায়েরা তাদের আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল, যুবকেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, আর বৃদ্ধরা নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “এ অভিশাপ থেকে বাঁচা যাবে না।”
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েছিল সাবিতা। রূপেশের জন্য তার হৃদয় ছটফট করছিল। সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে রূপেশ আর কখনো ফিরে আসবে না। গত রাতে সে বারবার বারণ করেছিল, কেঁদে মিনতি করেছিল, কিন্তু রূপেশ শোনেনি। আজ তার বুকের ভেতর শুধু শূন্যতা। গ্রামের মহিলারা যখন ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, সে তখন নির্বাক চোখে শূন্যে তাকিয়ে ছিল। কান্না আসছিল না, চিৎকার আসছিল না—শুধু অশ্রু ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছিল গাল বেয়ে। তার ভেতরে এক গভীর যন্ত্রণা জন্ম নিল—একদিকে প্রিয়জনের হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে এই ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তির কোনো উপায় না থাকার যন্ত্রণা। তার নিঃশব্দ কান্নাই যেন গ্রামের প্রতিটি মানুষের হতাশার প্রতিচ্ছবি। কারণ তারা জানত, আগামী বছর আবার কারও ছেলেকে, কারও ভাইকে হারাতে হবে।
দিন শেষে গ্রামের মানুষজন মন্দিরের আঙিনায় প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করল। তারা দেবতার কাছে মুক্তি চাইলো, কিন্তু মনের গভীরে জানত, এই মুক্তি সহজ নয়। অশরীরী কনের আত্মা বহু যুগ ধরে তার বিয়ের অপেক্ষায় আছে, আর সে তার স্বপ্ন পূর্ণ না করা পর্যন্ত থামবে না। কালীনাথ আবার বললেন, “এ অভিশাপ ভাঙতে হলে আত্মার বিয়ে সম্পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু কে সেই বর হবে? কে তার কাছে আত্মবলিদান দেবে?” এই প্রশ্নের কোনো উত্তর কারও কাছে ছিল না। সবাই নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, ভয় আর হতাশা মিলেমিশে যেন গ্রামের আকাশ আরও ভারী করে তুলল। সেই মুহূর্তে সবাই বুঝে গেল—এ অভিশপ্ত চক্র চলতেই থাকবে। প্রতি বছর পূর্ণিমার রাতে ঢাক-ঢোল বাজবে, কান্নার সুর ভেসে আসবে, আর কোনো না কোনো যুবক চিরদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাবে। সাবিতা মন্দিরের সিঁড়িতে বসে নির্বাক চোখে প্রদীপের শিখার দিকে তাকিয়ে থাকল, মনে মনে ফিসফিস করে বলল—“রূপেশ, তুমি আর ফিরবে না।” তার নিঃশব্দ সেই আর্তি যেন পুরো গ্রামটাকেই আবৃত করল এক গভীর হতাশার অন্ধকারে।
___




