Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - নারীবিষয়ক গল্প

পূর্ব পাকিস্তানে এক মহিলার গোপন রেডিও

Spread the love

রুবিনা মাহমুদ


রাতটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। এমন শান্ত যে খুলনার বাতাসেও যেন শব্দ ঢুকতে সাহস পায় না। কিন্তু এই নিশুতি রাতেই শব্দ জন্ম নিচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে এমন এক তরঙ্গ, যা ভবিষ্যতের কান্না বা বিজয়—দুটোর একটিকে জাগিয়ে তুলবে।

রওশন আরা জানালার পর্দাটা সরিয়ে একবার বাইরে তাকালেন। তামাটে চাঁদের আলোয় গাছের ছায়া লম্বা হয়ে উঠেছে। একটা কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠলো দূরে, যেন ইশারা দিচ্ছে—“সব ঠিক নেই।”

ঘরের কোণার ছোট মেজেতে পাতলা লেপ, একটা সেলাই মেশিন আর একটা কাঠের বাক্স। কিন্তু বাক্সটা ছিল আলাদা। সাধারণ কাঠের নয়, ভিতরে ছিল রেডিও ট্রান্সমিটার, নিজ হাতে বানানো। ধীরে ধীরে মুখের চশমাটা খুলে রাখলেন রওশন। চুলের খোঁপা টেনে ধরলেন শক্ত করে, আর তারপর আলতো হাতে খুলে ফেললেন ট্রান্সমিটারের ঢাকনা।

এই ঘরটাই তার যুদ্ধক্ষেত্র। স্বামী ওয়াহিদ সাহেব যখন ঘুমিয়ে পড়েন, তিনি তখন জেগে ওঠেন। শুধু ঘুম নয়—উঠে পড়েন ইতিহাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম এই যন্ত্রের সঙ্গে তার পরিচয়। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ চলাকালীন এক ভারতীয় রেডিও স্টেশন হঠাৎ ধরা পড়েছিল রেডিওতে, রওশন শুনতে পেয়েছিলেন এমন কিছু শব্দ যা ছিল কোডেড সিগন্যাল।
তিনি স্বশিক্ষিত, কলেজে পড়েননি ঠিকই, কিন্তু ছোটবেলায় তার এক মামা তাঁকে ইলেকট্রনিক সার্কিট বোঝাতেন পুরনো রেডিও ভেঙে ভেঙে। সেই জ্ঞানটাই কাজে লাগল এই যুদ্ধকালে।

আজ, ১৯৭০-এর শেষ দিক। রওশন এখন পুরোপুরি একজন ‘শব্দ গোয়েন্দা’।

রাতের নির্জনতায় রেডিওর সুইচ টিপতেই এক শোঁ শোঁ শব্দ উঠল। হালকা হালকা ফ্রিকোয়েন্সি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর ধরা পড়ল।
—“ডেল্টা থ্রি রেডি, ওভার।”
—“কন্ট্রোল রেসপন্ডিং, ওভার।”

রওশন জানতেন, এই ‘ডেল্টা থ্রি’ মানে খুলনার ক্যাম্প। কন্ট্রোল মানে চট্টগ্রাম বেস। মাঝে মাঝে তারা নাম ধরে না, শুধু সংকেত। প্রতিটি কথার পেছনে থাকে গোপন বার্তা।

সে সব শুনে লিখে রাখেন খাতায়, পাতায় পাতায় যেন আগুন লুকানো। নীল কালির মধ্যে যেন লুকিয়ে থাকে শহরের ভবিষ্যৎ।

এই কাজের মধ্যে যে ভয় নেই তা নয়। ভয় তো প্রতিদিন তার চা-এর কাপের পাশেই বসে থাকে। স্বামী অফিস থেকে ফেরার সময় ব্যাগটা একটু এদিক-ওদিক হলেই রওশন ঘামতে থাকেন। কিন্তু তার চোখে যে আগুন, তা নিভে যায় না সহজে।

এই রাতেও, বারান্দার লাইট নিভিয়ে, ঘরের পর্দা টেনে, সে সংকেত ধরছিল। হঠাৎ…

টক…টক…টক।
দরজায় কড়া নেড়ে উঠল কেউ।
রওশন শিউরে উঠলেন। রাত সাড়ে বারোটা বাজে। এমন সময় কে?

— “আপা, আমি নাসির। বই আনছি কালকের। দরজা খুলি?”

রওশন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
নাসির তার বইওয়ালা। তবে বাইরের পরিচয় তা হলেও, ভিতরে ভিতরে সে ভারতের মেঘনা সীমান্তের গোয়েন্দা সংযোগ।

রওশন দরজা খুললেন। ছেলেটির হাতে পত্রিকায় মোড়া একটি পুরনো বই—“পান্ডুলিপি থেকে পদ্মা”।
রওশন জানতেন, এই বইয়ের মাঝখানেই থাকে পরবর্তী বার্তার কাগজ।

নাসির ফিসফিস করে বলল,
— “আগামী সপ্তাহে ক্যাম্পে আসবে নতুন অফিসার। নাম সলমান। খুব সন্দেহপ্রবণ। শুনেছি ট্রান্সমিটার খোঁজা শুরু করেছে।”

রওশন কেমন যেন চুপ মেরে গেলেন। তার হাত তখনও বইয়ের মোড়কের উপর, কিন্তু ভিতরে ভিতরে শিরায় রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে।

“তাহলে কি ওরা টের পেয়েছে?”
তার ঠোঁট শুকিয়ে গেল।

নাসির ধীরে ধীরে চলে গেল। কিন্তু রওশনের ঘর যেন হঠাৎ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে উঠল।

তিনি বই খুলে ভাঁজে রাখা কাগজটা পড়লেন।

“ডেল্টা থ্রি ক্যাম্পে নতুন সংহতি আসছে। নাম—অপারেশন সন্ধ্যা। টার্গেট: ডিইউর ৭ জন ছাত্র। গ্রেফতার ১৫ ডিসেম্বর।”

রওশন আর এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। খাতা টেনে নিলেন, বার্তা রেডি করলেন:

“অপারেশন সন্ধ্যা। ৭ ছাত্র। গ্রেফতার পরিকল্পিত। খুলনা ক্যাম্প। কোড শনাক্ত: D3–1215।”

ট্রান্সমিটার অন করলেন। সংকেত পাঠাতে গিয়ে দেখতে পেলেন—ফ্রিকোয়েন্সি ব্লক হচ্ছে!

জ্যামড!

এটা আরও ভয়ংকর সংকেত। মানে কাছাকাছি কেউ সক্রিয় ভাবে তার ফ্রিকোয়েন্সি অনুসরণ করছে। তার বার্তা পৌঁছতে না দেওয়ার চেষ্টা করছে।

সে তাড়াতাড়ি যন্ত্র খুলে ভেতরের কয়েল বদলাল। আরেকটা বিকল্প তরঙ্গ ব্যবহার করলেন—পূর্ব প্রস্তুতি ছিল।

কিন্তু ততক্ষণে ঘরের বাইরে কারা যেন কথা বলছে।

— “ঘরটা ওইদিকে। ওই বাড়িতে কিছু অস্বাভাবিক সিগন্যাল ধরা পড়েছে।”

রওশন দাঁতে দাঁত চেপে সংকেত শেষ করলেন, কাগজ ছিঁড়ে আগুনে ফেললেন।
রেডিও খুলে তোষকের নিচে ঢুকিয়ে রাখলেন।

দরজার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে বুঝলেন—এই রাতটা তার জীবন বদলে দেবে।

কাঠের দরজার ওপাশে যে ছায়াগুলো নড়ছিল, সেগুলোর স্পষ্ট রূপরেখা ফুটে উঠছিল জানালার ফাঁকে আসা আধো আলোয়। দুইজন লোক, একজনের হাতে ছোট টর্চ, আরেকজনের কণ্ঠস্বর কেমন কড়া—সেনা অফিসার হলে এরকমই হয়।

রওশন নিঃশ্বাস ফেললেন না। বুকের মধ্যে শব্দ হচ্ছিল, কিন্তু ঠোঁটে কোনও শব্দ ফোটাতে পারছিলেন না। তোষকের নিচে ঢুকানো ট্রান্সমিটারটা যেন তাপ ছড়াচ্ছিল, যেমন আতঙ্ক ছড়ায় আগুন ধরা সুতোর মতো।

একজন বলল, “সিগন্যাল এখান থেকেই এসেছে। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে স্পাইক ধরা পড়েছিল। একবার ভেতরে দেখলেই পরিষ্কার হবে।”

রওশন পেছন থেকে দরজার হ্যান্ডেল শক্ত করে চেপে ধরলেন। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ নয়, ভেতর থেকে আটকানো। তিনি কিছু বলার আগে দরজায় ধাক্কা পড়ে।
— “ম্যাডাম, খুলুন। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন চলছে। কয়েকটা প্রশ্ন আছে।”

তিনি গলা পরিষ্কার করে বললেন,
— “এত রাতে? আমার স্বামী ঘুমাচ্ছেন। কিসের প্রশ্ন?”

— “আপনার বাড়ি থেকে অবৈধ সংকেত পেয়েছি। ট্রান্সমিশনের অভিযোগ আছে।”

এই একটা বাক্যে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল রওশনের ওপর।
সে জানত, এবার কোনও ভুলচুকের সুযোগ নেই। এই মুহূর্তে ওয়াহিদ সাহেব জেগে উঠলে, তার সামনে ধরা পড়ে যাবে সে। অথচ স্বামীকেও এখনও সে বোঝাতে পারেনি কেন সে এই পথ বেছে নিয়েছে।

দরজা খুলে দিলেন। সামনে দুইজন, একজনের পোশাকে পাকিস্তান সেনার সিল, আরেকজন সাদা পোশাকে—সামরিক গোয়েন্দা।

— “আপনি রওশন আরা?”

— “জি।”

— “আপনার ঘরের ভেতরে একটা ট্রান্সমিশন টাওয়ার শনাক্ত হয়েছে। আজ রাত ১২টা ৪০ মিনিটে একটা সংকেত গিয়েছিল পূর্ব দিকে।”

রওশন চুপ করে রইলেন। এক মুহূর্তে চোখ গেল বারান্দার কোণে রাখা গৃহস্থালী জিনিসের দিকে—ট্রান্সমিটার এখন ওখানেই। ওরা হয়তো খুঁজে পাবে।
কিন্তু তখনই ওয়াহিদ সাহেব ঘুমচোখে দরজায় এলেন।

— “কি হয়েছে? এত রাতে হট্টগোল কেন?”

গোয়েন্দা অফিসার নরম গলায় বলল,
— “স্যার, আমরা কেবল রুটিন ইনভেস্টিগেশনে এসেছি। আপনার বাড়ি থেকে কিছু অস্বাভাবিক রেডিও তরঙ্গ ধরা পড়েছে। দয়া করে আপনার স্ত্রীর ঘরটা একবার দেখতে চাই।”

ওয়াহিদ একঝলকে তাকাল রওশনের দিকে।
— “আমার স্ত্রী তো সারাদিন ঘরে থাকে। রান্না করে, বই পড়ে। সে আবার রেডিও চালাবে কেন?”

রওশন ভেতরে কেঁপে উঠলেন। তার স্বামী তাকে বিশ্বাস করে, অথচ সে এই বিশ্বাসের ফাঁকেই লুকিয়ে রেখেছে এক গোপন যুদ্ধ।

ঘর তল্লাশি শুরু হল। জানালার পাশে তাক, সেলাই মেশিনের নিচে, বইয়ের তাকে—সবখানে চোখ বুলাল অফিসার। কিন্তু ট্রান্সমিটার ছিল বারান্দার কোণে রাখা পুরনো চালডাল রাখার টিনের ড্রামে। আর ওরা বারান্দা অব্দি গেল না।

একজন অফিসার পকেট থেকে একটা ছোট যন্ত্র বের করল—“সিগন্যাল স্নিফার”।
রওশন জানে, এই যন্ত্র কাছাকাছি রেডিও তরঙ্গ থাকলে শব্দ করবে।
যখন ওটা চালু হল, তখন একটা ধাতব শব্দ এল—বিপ… বিপ…—কিন্তু তারপর থেমে গেল।

— “ম্যাম, আপনি নিশ্চিত আপনি কিছু করেননি?”

রওশন মাথা নেড়ে বললেন,
— “আমার তো এইসবের কিছুই জানি না। আমি তো শুধু আমার ফুলগাছ আর বই নিয়ে থাকি।”

ওয়াহিদ হেসে বলল,
— “মাই ওয়াইফ ইজ অলওয়েজ ইন দ্য গার্ডেন। ও একাই খুলনা শহরের অর্ধেক ফুলের নাম জানে।”

অফিসারদের চেহারায় আর সন্দেহ রইল না।
— “ঠিক আছে, যদি কিছু জানতে পারি, যোগাযোগ করব। আমাদের ইনফরমেশন হয়তো ভুল ছিল।”

তারা বেরিয়ে গেল।

দরজা বন্ধ হতেই রওশন মাটিতে বসে পড়লেন। বুকের মধ্যে এতক্ষণ যে পাথর ছিল, সেটা যেন পড়ে গেল।

ওয়াহিদ এসে বলল,
— “তুমি ঠিক আছো?”

— “হ্যাঁ। একটু ভয় পেয়েছিলাম শুধু। এত রাতে…”

ওয়াহিদ আবার ঘুমাতে গেল। রওশন জানল, এবার তাকে অনেক বেশি সাবধান হতে হবে।

সকালবেলা সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাঁটলেন খালের ধারে, যেখানে পুরনো সেতুর নিচে নাসিরের সঙ্গে দেখা হয় প্রায়ই।
নাসির এসে বলল,
— “আপা, সংকেত পৌঁছে গেছে ঠিকমতো। ওরা অপারেশন বন্ধ করেছে। কিন্তু শুনেছি ক্যাপ্টেন সলমান খুলনায় এসে গেছে গতকালই।”

রওশন বলল,
— “তোমাকে একটা জিনিস করতে হবে। আমার ট্রান্সমিটারটা সরিয়ে ফেলতে হবে। নতুন সার্কিট বানাতে হবে—জ্যামিং এড়ানোর জন্য।”

নাসির চোখ কুঁচকে বলল,
— “আপা, আপনি একা কতদূর যাবেন? ওরা যদি এবার পেয়ে যায়…”

রওশন তাকালেন পদ্মার ওপারে, যেন জল কুয়াশার মধ্যেও তিনি স্পষ্ট দেখতে পান ভবিষ্যৎ।
— “তারা যদি আমার কণ্ঠ চায়, আমি আমার নীরবতাও দেব না।”

সেদিন সন্ধ্যায় রওশন নতুন করে খাতায় লিখলেন তার সংকেত পদ্ধতি। এইবার থেকে তিনি শুধুমাত্র শব্দ নয়, সংগীতের সুরে লুকিয়ে বার্তা পাঠাবেন।

একটি নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে—
‘রেডিও’ নয়, ‘রাগ’ হবে তার অস্ত্র।

খুলনার আকাশটা ভোরের দিকে ঝাপসা হয়ে থাকে, যেন মেঘ নয়, কুয়াশা নয়—একটা জমাট আতঙ্ক ভেসে বেড়ায় বাতাসে। এই শহরের মানুষ যুদ্ধের শব্দ চেনে না তখনও, কিন্তু রওশন আরা জানেন—শব্দের মতোই নীরবতাও এক অস্ত্র হতে পারে।

তিনি আজ সকালের রুটিন বদলে ফেললেন। সেলাই না করে, বাগানে জল না দিয়ে উঠে পড়লেন ছাদে। ছাদের এক কোণে পুরনো হারমোনিয়ামটা ছিল, একসময় তার শ্বশুর বেনারস থেকে এনেছিলেন, কিন্তু বহু বছর আর বাজে না।

রওশন হারমোনিয়ামের ঢাকনাটা খুললেন। ভিতরে ধুলো, এক কোণে সাদা রঙের নোটবুকে কিছু পুরনো সুরলিপি লেখা। তিনি শুদ্ধ করে হাত দিলেন রিড-গুলোয়, কিছুক্ষণ কেশে গলা পরিষ্কার করে বসে পড়লেন।

তাঁর এবারকার সংকেত পাঠানোর পদ্ধতি—রাগ হেমন্তীতে লুকোনো বার্তা।
প্রতিটি সুরে আলাদা কম্পন, প্রতিটি স্থায়ীতে গোপন সংকেত।
যারা বোঝে না, তাদের কানে এ কেবল হালকা বাজনা। কিন্তু দূর থেকে কেউ যদি এই সুরের ফ্রিকোয়েন্সি ধরে, সে বুঝবে—কোথায় বিপদ, কোথায় নিস্তার।

এই নতুন পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে নিখুঁতভাবে। কেবল রওশন জানেন, খুলনার সীমান্ত ঘেঁষে বসে থাকা ভারতীয় কিছু তাত্ত্বিক সংগীতজ্ঞ এই সংকেত বুঝতে সক্ষম।

তিনি মৃদু স্বরে গাইতে শুরু করলেন:
“সাম গ ম প ধ ন, ধ প গ ম র স”
এই সুরের প্রতিটি ‘ম’ শব্দের মধ্যে লুকানো কোড ছিল—‘মুক্তি’, ‘মিছিল’, ‘মৃত্যু’।
আর প্রতিটি ধ্বনির দোলায়—তার নিজের ভয়।

ঘরেই বসে সব রেকর্ড করলেন একটি ছোট টেপ-রেকর্ডারে। এখন সেটা যাবে নাসিরের হাত ধরে সীমান্তে, আর সে বুঝে যাবে কারা কোথায় মার খাচ্ছে, আর কোথায় লুকিয়ে আছে আশা।

সন্ধ্যায় নাসির এলো। চুপচাপ একটা চায়ের কাপ হাতে বসে থাকল বারান্দায়। কারও মুখে কিছু নেই, তবু ঘরে শব্দ গুনগুন করে উঠছে।

রওশন বলল,
— “এই ক্যাসেটটা ‘জগন মোহন পাল’ নামে একটা পুরনো দোকানে পৌঁছে দিও। সেখান থেকে ওরা তুলে নেবে।”

নাসির মাথা নাড়ল।

তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “আপা, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই… ক্যাপ্টেন সলমান খোঁজ নিয়েছে আমার দাদার দোকানেও। নাকি ‘তরঙ্গ চোর’ আছে খুলনায়।”

রওশনের ঠোঁট শক্ত হল।
— “তরঙ্গ চোর নয়, তরঙ্গ বাঁচানো মানুষ।”

নাসির চলে গেল। রওশন জানতেন, দিন শেষ হচ্ছে, রাত বড় হচ্ছে। সেই রাত যার বুক চিরে কণ্ঠ ভেসে উঠবে।

ওইদিকে, খুলনা সেনা ঘাঁটির ভেতরে বসে ক্যাপ্টেন সলমান রেকর্ডিং শুনছিল। গত রাতের ফ্রিকোয়েন্সিতে ধরা পড়েছে একটি সুরেলা রাগ।

— “Interesting,” বলল সে।
— “কেউ একজন রাগ হেমন্তীতে সংকেত পাঠাচ্ছে। কিন্তু খুব সাবধানে। এ শুধু সঙ্গীত নয়, এ কোনো ম্যাপ বা কোড। ব্যতিক্রমী।”

সে নির্দেশ দিল, “এই গান যে ঘর থেকে এসেছে সেটা চিন্হিত করো। সাউথ ইস্ট দিক, জলাধার ঘেঁষা।”

ফলাফল আসতে বেশি সময় লাগল না। লোকেশন আবার সেই বাড়ি—ওয়াহিদ ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি।

সলমান এবার আর দেরি করল না। নিজেই যাবেন।

রওশন তখন ঘরের কোণে হারমোনিয়াম মুড়িয়ে রাখছেন। হঠাৎ গাড়ির শব্দ, আবার কড়া নাড়া।

এইবার সাদা জিপ থেকে ক্যাপ্টেন সলমান নামলেন। পেছনে একজন সহকারী।

— “গুড ইভিনিং, মিসেস ওয়াহিদ,” বললেন সে।

রওশন ঠাণ্ডা মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,
— “গুড ইভিনিং। কোনও সমস্যা?”

— “আসলে একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। গতকাল একটা সুরেলা রাগ বাজছিল আমাদের ট্রান্সমিশন ফ্রিকোয়েন্সিতে। আমরা তো অবাক—এ তো যেন সংগীত নয়, সংকেত!”

রওশন কিছু না বলেই শুধু চোখের পাতা নামালেন।
সলমান ঘরে ঢুকে হারমোনিয়ামটা দেখল।
— “আপনি কি সঙ্গীত চর্চা করেন?”

— “আমি তো শখে করি, পেশাদার না।”

সলমান হাসল।
— “আপনার হারমোনিয়াম বেশ পুরনো, তবু ধ্বনি পরিষ্কার। আপনি তো অনেক কিছু বোঝেন।”

— “যতটা বোঝা যায় ফুলগাছ দেখে।”

সেই রাতে তারা ঘর থেকে কিছু পেল না, কিন্তু ক্যাপ্টেন সলমান এক গোপন প্রশ্ন নিয়ে ফিরে গেল: “এই নারী কি শুধু গৃহবধূ?”

রওশন রাতে খাতায় লিখলেন:

“আজ আমার গলা ছুঁয়ে গেছে আগুন। সে আগুনে আমি দগ্ধ হব, কিন্তু ছাই হয়ে যাব না।
কারণ আমি কেবল গাই না—আমি কণ্ঠে একদেশ বাঁচাই।”

এরপর দিন, টেপ-রেকর্ডার আর রাগ হেমন্তীর কণ্ঠ পেরিয়ে যায় নদী। ওপারে এক কণ্ঠস্বর বলে উঠে—

— “বার্তা পৌঁছেছে। অপারেশন বাতিল। খুলনা আবার বাঁচল।”

রওশন জানেন না, কতদূর তিনি যেতে পারবেন। কিন্তু তিনি জানেন—যতদিন তার গলায় সুর আছে, ততদিন কেউ তাকে থামাতে পারবে না।

ক্যাপ্টেন সলমান এবার আর কৌতূহলী নন—তিনি নিশ্চিত। খুলনার এই শান্তপাড়া, ফুলে ভরা বাড়ি, পুরনো হারমোনিয়াম, আর সেই ধীরকণ্ঠী গৃহবধূ—সবই যেন সাজানো পর্দা।
তাঁর কাছে সব তথ্য এসে গিয়েছে। এক টেলিগ্রাম বার্তায় HQ জানিয়েছে:

“Transmission bearing same frequency as suspected East border signal originated from residence of Eng. Wahid, Khulna. Verify and intercept.”

সুতরাং, সময় এসেছে দৃশ্যের পেছনের মুখোশ সরানোর।

কিন্তু সমস্যা হল—এই নারীকে ধরে ফেলার কোনো ‘প্রমাণ’ নেই। কেবল সন্দেহ দিয়ে রাষ্ট্র চলে না। কাজেই, তাকে তার ছায়া থেকে টেনে আনতে হবে, উল্টে দিতে হবে তারই তৈরি তরঙ্গ।

রওশন আরা তখন খাতায় নতুন সংকেত রচনা করছিলেন। রাগ মালকোষ।
মধ্যসপ্তকের গ, ম, ধ এই তিনটি স্বর ব্যবহার করে কোড বানাচ্ছেন—মিলিয়ে দিলে দাঁড়ায়:
“G-M-D = Ground Movement Detected”
এটা ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে নতুন বার্তা—ক্যাম্প ৪-এ রাতের অন্ধকারে সেনা সরানো হচ্ছে।

কিন্তু এবার সে অন্য এক আশঙ্কায় ভুগছে। সলমানের চোখে যে সন্দেহ, তা সামান্য নয়। সেই চোখে প্রশ্ন আছে, চাপা আগুন আছে।
রওশন জানেন—সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু সেই, যে মুগ্ধ হয় তোমার সাহসে।

সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন সলমান আবার আসে—এবার এক কাপ চা নিয়েই বসে পড়ে বারান্দায়।

— “আপনার চায়ের স্বাদ দারুণ, কিন্তু সংগীতটা আরও বেশি আকর্ষণীয়।”

রওশন হাসলেন।
— “সুর ছাড়া তো দিন কাটে না। আপনি বুঝেন?”

সলমান একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল,
— “আমি বিশ্বাস করি, সংগীত একটা ভাষা। আর ভাষা হল অস্ত্র। যেমন আপনি যখন গাইলেন রাগ হেমন্তী, ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতীয় রেডিওতে একই তরঙ্গ পাওয়া গেল। এটা কি কাকতালীয়?”

রওশন চুপ করে রইলেন। সলমান তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
— “আপনি কি জানেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে নারীর কণ্ঠ ব্যবহার করে সংকেত পাঠাচ্ছে? তারা জানে, নারীর ওপর সহজে সন্দেহ পড়ে না।”

রওশন মাথা নত করে হাসলেন।

— “আমি কেবল একজন স্ত্রী। আমি তো জানি না কোথায় যুদ্ধ হচ্ছে, কোথায় কথা ফোটে। আমি শুধু আমার সুরে আশ্রয় খুঁজি।”

সলমান উঠে দাঁড়াল। তার চোখে এবার আর মুগ্ধতা নেই, আছে প্রতিজ্ঞা।

— “আচ্ছা, আপনার স্বামীকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারি?”

— “তিনি অফিস গেছেন। ফিরতে দেরি হবে।”

সলমান চলে গেল, কিন্তু চলে যাওয়ার আগে বলল,
— “মনে রাখবেন, সত্য কখনও সুরে ঢাকা থাকে না। একদিন সে নিজের স্বরেই ফিরে আসে।”

ওই রাতে রওশন বুঝলেন, সময় এসেছে নিজের ছায়া সরিয়ে নতুন পথ খোঁজার।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার ফ্রিকোয়েন্সি বদলাবেন।
ট্রান্সমিটার নতুনভাবে সার্কিট করলেন, স্প্রেড স্পেকট্রাম মডিউলেশনে। এতে করে সংকেত আর এক জায়গায় ধরা পড়বে না—সব তরঙ্গে ছড়িয়ে যাবে।
তবে এজন্য লাগবে কিছু ‘ডিস্ট্র্যাকশন’—একটা ছায়া সংকেত, যেটা সলমানের নজর ঘোরাবে।

পরদিন সকালে খুলনার স্টেশন রোডের এক পুরনো মুদি দোকানের পেছনের ঘরে বসে নাসির ক্যাসেট বাজাচ্ছিল।

রেডিওতে চলছিল গান—এক পুরনো পল্লীগীতি।
কিন্তু তার মাঝখানে একটুখানি থেমে গিয়ে এল এক পুরনো কণ্ঠ:

“ডেল্টা ফোরের পাশে শিবপুর গ্রামে সৈন্য জমায়েত। সংকেত – গ্রাম্য গানের শেষে মালকোষ ধ্বনি।”

এইবার সুর আর শব্দ একসাথে লুকিয়ে গেলো সাধারণ পল্লীগীতির ভেতরে।

রওশন জানেন, সলমান এইবার ভুল পথেই ছুটবে।
কিন্তু তিনি জানেন না, সলমান আরেকটি তথ্য পেয়েছে—নাসির বইওয়ালার নাম।

সলমান তার সহকারীকে নিয়ে এক সন্ধ্যায় ধরা দেয় সেই মুদির দোকানে।

— “তুমি কি নাসির?”

— “জি… বই ফেরি করি আমি।”

— “তুমি কি কখনও এই বাড়িতে গেছো?”
ছবিতে দেখানো হয় ওয়াহিদের বাড়ি।

নাসির মাথা নিচু করে বলে,
— “ওনার গিন্নি বই পড়েন, আমি পুরনো কবিতার বই দিই।”

সলমান চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে,
— “তুমি জানো, কিছু বইয়ের পাতায় শুধু কালি থাকে না, থাকে রক্ত। আর কিছু সুর শুধু কানেই নয়, ফাটে বন্দুকের মতো।”

নাসির এবার বুঝে যায়—বড় কিছু আসতে চলেছে।

সেদিন রাতে রওশন ট্রান্সমিটার ছুঁয়ে থাকেন দীর্ঘ সময়। জানেন না কতদিন বাকি আছে, কত রাত আর কথা বলবে তার যন্ত্র।
তবু তিনি একটা সংকেত পাঠান, ছোট্ট, কিন্তু গভীর:

“সফর দীর্ঘ। ভয় গভীর। কিন্তু কণ্ঠ থাকলে দেশ হারায় না।”

আর ওপারে, ক্যাপ্টেন সলমান একটা সিদ্ধান্ত নেন—

তিনি এবার ওয়াহিদের অফিসে যাবেন, জানতে চান তার স্ত্রী কোথা থেকে এই সব শেখে, কেন এত ফুলগাছের মাঝেও থাকে রহস্য।

ওয়াহিদ সাহেব যখন অফিস থেকে ফিরলেন, তখন সূর্য ডুবে গিয়েছে অনেকক্ষণ। তার চোখে অবসাদ, কিন্তু মুখে এক চাপা উত্তেজনা—আজ খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরে এসেছিলেন এক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। চা-চক্র ছিল, কিন্তু সে চায়ের স্বাদেই ছিল কিছু জিজ্ঞাসার গন্ধ।

রওশন রান্নাঘরে চায়ের কাপ সাজাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ওয়াহিদ এসে বলল,
— “আজ ক্যাপ্টেন সলমান এসেছিলেন। তোমার নাম শুনেই বললেন—‘রওশন আরা? ফুল ভালোবাসেন?’”

রওশনের হাতের কাপ হালকা কেঁপে উঠল। গরম চায়ের ছিটে পড়ল আঙুলে। তবু মুখে হাসি রেখে বললেন,
— “তাহলে তো উনি খুব স্মার্ট। চা-চক্রে ফুলের কথা বলেই মন জয় করতে জানেন।”

ওয়াহিদ বসে গেলেন।
— “তবে একটা কথা বলি, তার চোখে সন্দেহ ছিল। কেমন যেন ঘুরেফিরে তোমার দিকেই যাচ্ছিল কথা। আমি বলেছি—তুমি স্রেফ আমার শান্ত স্বভাবের স্ত্রী, যার দিন কাটে বাগানে আর বইয়ে।”

রওশন হাসলেন, কিন্তু সেই হাসির নিচে চাপা পড়ে থাকল ভয়।
এতদিন ধরে যে গল্প রচনা করেছিলেন তিনি, তার বুননের মধ্যে ফাঁক গজিয়ে উঠছে।

চায়ের ট্রে সামনে রেখে বললেন,
— “আমার সম্পর্কে এত কথা বলার কী আছে? আমার তো নিজেকে নিয়েই সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে। আমি কি আদৌ কিছু করি?”

ওয়াহিদ চা হাতে বললেন,
— “আজকাল সবকিছুতেই সন্দেহ। পাকিস্তান এখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বিশ্বাসের থেকেও তথ্য জরুরি।”

রওশন আর কিছু বলেন না। তিনি জানেন, তথ্যই এখন নতুন মুদ্রা, আর সত্য কখনো কখনো হয়ে যায় সবচেয়ে বড় অপরাধ।

ক্যাপ্টেন সলমান সেদিন রাতে ঘরে বসে একটা ফাইল খুললেন—রওশন আরার অতীত।
জন্ম: ১৯৪৩, ফরিদপুর
বাবা: আবদুল গাফফার, স্কুল শিক্ষক
ব্যক্তিগত জীবন: কলেজে যাওয়া হয়নি, বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে
হবিগুলি: কবিতা, রসায়ন, পুরনো রেডিও

সলমান থেমে গেলেন—“পুরনো রেডিও”?

তিনি জানেন, পাকিস্তানে মেয়েদের মধ্যে এমন প্রযুক্তি-ভিত্তিক আগ্রহ বিরল। ফাইলের এক কোণে একটা ক্লিপিং—একবার রওশনকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল ‘ফুলপ্রদর্শনী’র বিশেষ পুরস্কারে, কিন্তু সেই ছবি দেখে সলমান লক্ষ করলেন—তাঁর পাশে দাঁড়ানো একজন ভারতীয় রেডিও প্রকৌশলী।

তিনি বুঝে গেলেন—রওশন আরা ফুলের পরিচর্যার পাশাপাশি হয়তো শব্দের চাষও করেন।

সেই রাতেই সলমান সিদ্ধান্ত নেন, রওশনের সঙ্গে আরেকবার দেখা করবেন—এইবার চা নয়, থাকবে শুধুই প্রশ্ন।

পরদিন সকাল। বারান্দায় রওশন গাছগাছালি পরিস্কার করছেন। একটা গোলাপ গাছে কাঁটা হাতে বিঁধতেই তিনি চমকে গেলেন—গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন সলমান।

সঙ্গে আজ কোনো সহকারী নেই, কেবল একটি চিঠি হাতে।

— “গুড মর্নিং, ম্যাডাম। আজ চা চাই না, একটু সময় চাই।”

রওশন ভিতরে বসতে বললেন। মুখে শান্তি, মনে টানটান স্নায়ু। সলমান ঘরে ঢুকে চারদিকে তাকাল—আজ ঘরে হারমোনিয়াম নেই, সেলাই মেশিন নেই, যেন ঘরটাই অন্য কারও।

— “আপনার জন্য এক নোটিস এনেছি,” বললেন সলমান, কাগজটা সামনে রেখে।

নোটিসটি ছিল সামরিক নজরদারির আওতায় আনুষ্ঠানিক জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি। তবে তাতে রওশনের নাম নেই, লেখা আছে ‘সংগীত সংশ্লিষ্ট নারীদের জিজ্ঞাসাবাদ’।

রওশন বললেন,
— “তাহলে আপনি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত—আমি কিছু করছি?”

সলমান একটু থেমে বললেন,
— “আমি নিশ্চিত নই। তবে আপনার কণ্ঠ আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আপনি হয়তো গাইছেন, কিন্তু আমার মনে হয়, আপনি ইতিহাস লিখছেন।”

রওশন এবার ধীরে ধীরে বললেন,
— “আমি যে ইতিহাস লিখি না, আমি শুধু তার পাশে দাঁড়াই। বাকিদের মতো চুপ থাকতে পারি না।”

সলমান জিজ্ঞেস করলেন,
— “আপনার ভয় করে না?”

— “করত। এখন আর করে না। কারণ আমি জানি, যদি ভয় জিতেও যায়, তবুও একটা ছোট্ট শব্দ বেঁচে থাকবে। আমি শুধু সেই শব্দের আশ্রয়।”

সলমান এবার উঠে দাঁড়ালেন।
— “আমার চোখ আপনাকে বিশ্বাস করে না, কিন্তু হৃদয় চুপ করে যায়। আপনি আমাকে যেন বোকা বানিয়ে একটা আয়নায় দাঁড় করান, যেখানে আমি নিজেকেই দেখতে পাই না।”

রওশন বললেন,
— “আপনি যেদিন বুঝবেন—সংগীত কেবল বিনোদন নয়, প্রতিরোধ—সেদিন আপনি আর কখনো প্রশ্ন করবেন না।”

সলমান এবার বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু যাবার আগে বললেন,
— “আপনার রাগগুলো আমি শুনি। আপনার সংকেত বোঝার চেষ্টা করছি। একদিন হয়তো বুঝে ফেলব, একদিন হয়তো আপনাকে থামাবো। তবে তার আগে—আপনি থেমে যাবেন না, জানি।”

রওশন সেদিন রাতে অনেকক্ষণ বসে থাকেন বারান্দায়। এক নতুন রাগের খোঁজে, এক নতুন সংকেতের জন্য, যা শুধু খবর নয়—একটা ঘুমন্ত জাতির ডাক।

তিনি জানেন, এই যুদ্ধে রক্ত নেই, বুলেট নেই, কিন্তু আছে তপ্ত চা আর ঠান্ডা প্রশ্ন—যেখানে প্রতিটি চুমুকের মাঝে লুকিয়ে থাকে এক বিপ্লব।

খুলনায় সেই রাতে ঝড় উঠেছিল হঠাৎ করেই। কালো মেঘ নেমে এসে যেন গোটা শহরের মাথায় এক অদৃশ্য ছাতা মেলে ধরেছিল, যার নিচে বৃষ্টি পড়ছিল অনবরত, ঠকঠক করে। রওশন আরা জানালার কাঁচে হাত রাখলেন। কাঁচের ওপাশে গলির বাতিগুলো ধুয়ে যাচ্ছে, আর তার মনটাও যেন ধুয়ে যাচ্ছে চাপা কান্নায়।

এদিন দুপুরে খবর এসেছে—শিবপুর ক্যাম্পে ধরা পড়েছে তিনজন ছাত্র।
তাদের একজন ছিল সোহেল—নাসিরের চাচাতো ভাই, যে কিছুদিন আগে খুলনায় এসেছে আত্মগোপনে। রওশন তাকে একদিন চুপচাপ খাবার দিয়েছিলেন, তার চেহারায় ছিল ক্লান্তি আর আশা—দুটো পাশাপাশি হাঁটছিল।

কিন্তু এখন সে আর নেই। সেনাবাহিনী তাকে নিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে, আর কেউ জানে না সে কবে ফিরবে।

রওশনের বুকের মধ্যে যেন একটা পাথর বসে গেছে। তিনি নিজেকে বললেন,
— “তারা তোমার কণ্ঠ শুনেছে, কিন্তু শব্দ পৌঁছায়নি ঠিক সময়ে। দেরি হয়ে গেছে রওশন… তুমি দেরি করে ফেলেছো।”

এই প্রথম তিনি নিজেকে ব্যর্থ মনে করলেন।

বৃষ্টির শব্দ তখন বাইরের সব আওয়াজ ঢেকে দিচ্ছে। এই সুযোগে তিনি আবার হারমোনিয়ামের সামনে বসলেন। আজ তিনি আর কণ্ঠ নরম রাখবেন না। আজ তিনি রক্তের রাগ গাইবেন।

রাগ চারুকেশী।
প্রাচীন দক্ষিণ ভারতীয় রাগ। তার মধ্যে বিষাদের তীক্ষ্ণতা, প্রতিজ্ঞার অমোঘতা।
তিনি জানতেন—এই রাগে সংকেত পাঠালে ওপারেও বোঝা যাবে—এটা কেবল তথ্য নয়, এটা হুঁশিয়ারি।

“পরে না যেন দেরি হয়ে যায়…
আমার রাগ আজ আর রাগ নয়—
এটা এক মা’র কান্না, এক প্রেমিকার প্রতীক্ষা, এক যোদ্ধার হাহাকার।”

তিনি রেকর্ডার চালু করলেন। গাইতে গাইতে তাঁর গলা কেঁপে উঠছিল। শব্দ গুলো ভিজে যাচ্ছিল বৃষ্টির মতো, কিন্তু তার মাঝেও এক অদ্ভুত জ্যোতির মতো জ্বলছিল প্রতিটি স্বর:

“ন ধ স গ র, ম প ধ নিসা”
এ সুরে লুকিয়ে ছিল—”নেভিগেট দ্যা রেইন – সেভ দ্য কোড – গ্রুপ বিটেন”

এই সুর রেকর্ড করে তিনি ভাঁজ করে রাখলেন সেই পুরনো পত্রিকার মধ্যে, যেটা দাগি ছিল অজস্র খবরের ছাপায়।
নাসির আসবে, তিনি জানেন। ওর ভাই ধরা পড়েছে—ও আর কিছুতেই চুপ করে থাকবে না।

ক্যাপ্টেন সলমান সেই রাতে নিজের ঘরে বসে নতুন পাওয়া ক্যাসেট শুনছিল। খুলনার রেডিও তরঙ্গ ধরে আবার ধরা পড়েছে এক গান—রাগ চারুকেশী।

গানটি শুনতে শুনতে তার চোখ কেমন যেন কাঁপল। তার মনে হল, এই গান কেবল তথ্যবাহী নয়—এটা একজন নারীর ক্রন্দন। একজন এমন নারীর, যাকে সে চিনে, কিন্তু ঠিক চিনতে চায় না।

সে সহকারীকে ডেকে বলল,
— “সেনা ক্যাম্পে যে তিনজন ধরা পড়েছে, তাদের সম্পর্কে ফিল্ড রিপোর্ট এনে দাও। বিশেষ করে নাম—সোহেল। আমি নিশ্চিত সে শুধু ছাত্র নয়।”

সহকারী বলল,
— “স্যার, ছেলেটির ফাঁকা পকেটে এক পুরনো কবিতার খাতা পাওয়া গেছে। তাতে একাধিক সংকেত চিহ্ন পাওয়া গেছে—সবগুলোই সংগীত-ভিত্তিক।”

সলমান চুপ করে গেল। সে বুঝে গেল, এখন আর সংগীত শুধু সন্দেহ নয়—এটা প্রমাণ।

নাসির এলো সেই রাতে। মুখ শুকনো, চোখে হাহাকার।

— “আপা, ওরা সোহেলকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আমি নিশ্চিত।”

রওশন তখন ট্রান্সমিটার জড়ো করছিলেন নতুন এক কাঠের বাক্সে। আজ তিনি সরিয়ে ফেলবেন এই ঘর থেকে। আজ আর এ বাড়ি নিরাপদ নয়।

— “আমাকে একটা কাজ করতে হবে নাসির। এই টেপ, এই যন্ত্র—সব পৌঁছে দেবে সীমান্তে। এবার আমি নিজেই নেমে যাবো ‘ছায়া সংকেত’-এর নতুন পদ্ধতিতে। ওরা আমার ফ্রিকোয়েন্সি ধরেছে—এবার আমি ওদের ধরব।”

নাসির কেঁদে ফেলল,
— “আপা, আপনি মরবেন। আপনি জানেন না, ক্যাপ্টেন সলমান এখন একেকটা শব্দ বিশ্লেষণ করছে যন্ত্রে বসে। আপনি তার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছেন।”

রওশন বলল,
— “আমি মরতেও রাজি, যদি আর কোনো মা’র বুক খালি না হয়।”

রওশন সেদিন রাতে একটা কাজ করলেন, যা তিনি কখনও ভাবেননি। তিনি একটি চিঠি লিখলেন ক্যাপ্টেন সলমানকে।

চিঠিতে কিছু কথা:

“আপনি তো বলেছিলেন—সত্য একদিন নিজের স্বরে ফিরে আসে।
আমি সেই স্বর। আমি রওশন আরা। আমি একজন স্ত্রী, মা, মেয়ে, আর আমি একজন শব্দ সংগ্রামী।

আপনি যদি সত্যিই শুনতে চান—তাহলে আসুন একদিন আমার গানের সামনে। আমার হারমোনিয়ামের পাশে বসুন, তারপর প্রশ্ন করুন।

যদি সুর আপনাকে বিভ্রান্ত করে, জানবেন—আমার শব্দ আপনার চেয়েও গভীর।

– রওশন”

চিঠিটি সাদা খামে ভরে পাঠালেন সলমানের হেডকোয়ার্টারে, কোনো নাম ঠিকানা ছাড়া।

তিনি জানেন না, সে পড়বে কিনা, উত্তর দেবে কিনা।
কিন্তু তিনি জানেন, প্রতিটি কণ্ঠের একটা বিপরীত তরঙ্গ থাকে,
আর সলমান—হয়তো সেই তরঙ্গ।

বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ে। জানালার কাঁচ ঘাম জমেছে।
রওশন হারমোনিয়াম খুলে একটা লাইন গাইলেন:

“জলে জ্বলে রে রাগ, চোখে ডোবে না আর।”

ক্যাপ্টেন সলমান সকালে যখন নিজের চেয়ারে বসে কাগজপত্র উল্টে দেখছিলেন, তখন ক্লার্ক রফিক একটা খাম এগিয়ে দিল।

— “স্যার, কোনো প্রেরকের নাম নেই। কিন্তু আপনার নামে এসেছে।”

সলমান খানিকক্ষণ খামটা হাতে ধরে রইলেন। খামের গায়ে পরিচিত হাতের লেখা—তাঁর দেখা না-চেনা গৃহবধূর মতো শান্ত কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। চশমার কাঁচে আলোর ঝিলিক পড়ল, তিনি চিঠিটা খুললেন।

অক্ষরগুলো নরম, কিন্তু কথাগুলো ধারালো।

“আপনি তো বলেছিলেন—সত্য একদিন নিজের স্বরে ফিরে আসে।
আমি সেই স্বর।

আমি রওশন আরা।

আমি একজন স্ত্রী, মা, মেয়ে, আর আমি একজন শব্দ সংগ্রামী।

আপনি যদি সত্যিই শুনতে চান—তাহলে আসুন একদিন আমার গানের সামনে।

যদি সুর আপনাকে বিভ্রান্ত করে, জানবেন—আমার শব্দ আপনার চেয়েও গভীর।”

সলমান এই চিঠি তিনবার পড়লেন। এরপর চোখ বুজলেন, যেন কিছু একটা ঠিক করতে চাইছেন মনের মধ্যে। তারপর সহকারীকে ডাকলেন।

— “আজ বিকেলে, আমি নিজে যাব মিসেস ওয়াহিদের বাড়ি। কোনও সেনা থাকবে না সাথে। শুধু একটা প্রশ্ন থাকবে—শব্দের বিচার সত্যিই হয় কি না।”

রওশন তখন বারান্দায় বসে বাগানের শেষ গোলাপ গাছটাকে ছাঁটছিলেন। আজকের সকালটা যেন অন্য রকম। মেঘ নেই, হাওয়া নেই, কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন এক অজানা গতি।

তিনি জানতেন—চিঠির উত্তর আসবে। হয়তো বন্দুক হাতে, হয়তো চোখে জল নিয়ে।

আর ঠিক তখনই গেট খুলে ঢুকল সলমান।

সে একা। পোশাকে সেনা অফিসার, কিন্তু চোখে যুদ্ধ নেই।

— “আমি এসেছি,” বলল সে।

রওশন হাসলেন না, ভয় পেলেন না। শুধু বললেন,
— “হারমোনিয়ামটা ভেতরে রাখা আছে। আসুন।”

ঘরের ভেতর আলো নিভু নিভু। হারমোনিয়ামের ওপর ধুলো নেই। পাশে চায়ের কাপ দুটো সাজানো।

সলমান বসে বলল,
— “আপনি আপনার পরিচয় দিয়েছেন। এখন আমি চাই, আপনি একটা সুর শোনান—যেটা সংকেত নয়, সত্য।”

রওশন চমকে গেলেন। এই প্রথম কেউ তাঁর গান শুনতে চাইল, সংকেত খোঁজার জন্য নয়, হৃদয়ের জন্য।

তিনি হারমোনিয়াম চালালেন। আজ কোনও রাগ নয়, কোনও কোড নয়। তিনি গাইলেন রাগ ভৈরবী—ভোরের সেই শান্ত সুর, যা দিয়ে নতুন সূর্য ওঠে।

“সা গ ম প ধ নিসা…
আমার দেশ, আমার শব্দ, আমার প্রাণ।”

সলমান চোখ বন্ধ করে শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে বসে গান শুনছে—যেখানে কেউ গাইছে না, কেউ রক্তাক্ত হয়ে উঠছে না, শুধু শব্দ দিয়ে তৈরি হচ্ছে একটা ভবিষ্যৎ।

গান থেমে গেলে সে বলল,
— “আপনি জানেন, আপনি অপরাধী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, বাহিনীর বিরুদ্ধে। আমি আপনাকে এখনই গ্রেফতার করতে পারি।”

রওশন শান্ত গলায় বললেন,
— “তবু আপনি গান শুনলেন। কেন?”

সলমান এবার চুপ করে থাকল।
তারপর বলল,
— “কারণ আমি বুঝতে চেয়েছি—আপনার শব্দ যদি অস্ত্র হয়, তাহলে সেটা কী ধ্বংস করে? আমার জাতিকে, নাকি আমাকে প্রশ্নহীন করে তোলা আমার নিজের চিন্তাকে?”

রওশন চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “আপনি তো বলেছিলেন—আপনার চোখ আমাকে বিশ্বাস করে না, কিন্তু হৃদয় থেমে যায়। আজ আপনার হৃদয় কী বলছে?”

সলমান উঠে দাঁড়াল।
চোখে জল নেই, মুখে উত্তেজনা নেই, কিন্তু কণ্ঠে ছিল সবচেয়ে বড় স্বীকারোক্তি।

— “আজ আমার ভেতরের সৈনিক আর মানুষের মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে। আমি জানি না কে জিতবে, কিন্তু আমি চাই—আপনার এই সুর থামুক না কখনও।”

সে চলে গেল।
কোনও গ্রেপ্তারি হল না, কোনও জিজ্ঞাসাবাদ নয়।
শুধু চলে গেল এক মানুষ, যে ভুলে যেতে পারল না সেই রাগ ভৈরবীর নরম ধ্বনি।

তিন দিন পর নাসির এল।

— “আপা, খবর এসেছে। ভারতীয় সীমান্তে আপনার সুর বাজানো হয়েছে টহল ক্যাম্পে। সিগন্যাল পৌঁছেছে।
আর একটা কথা—আপনার বিরুদ্ধে ছিল যে নজরদারি, সেটা বাতিল হয়েছে। কোনও ফাইল আর নেই।”

রওশন থেমে গেলেন।
— “সলমান?”

নাসির মাথা নেড়ে বলল,
— “কে জানে। শুধু শুনেছি, তাকে বদলি করা হয়েছে ঢাকা ক্যাম্পে। আর যাওয়ার আগে তার ডেস্কে ছিল একটা খোলা খাম—তার ভেতরে আপনার চিঠি।”

রওশন এবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন।
তারপর বললেন,
— “তাহলে শব্দের বিচার হয়েছিল। আর রায়? শব্দটাই জয়ী হয়েছে।”

সেই রাতে তিনি হারমোনিয়াম বন্ধ করলেন।
ট্রান্সমিটার খুলে ফেললেন শেষবারের মতো।

এখন আর দরকার নেই। কারণ এবার মানুষ নিজের গলায় বলছে—“বাংলা আমার ভাষা, আমার অধিকার।”
এবার আর সংকেত নয়, এবার ঘোষণা।

রওশন নিজের খাতার শেষ পাতায় লিখলেন—

“আমি কণ্ঠ দিয়েছি, তার মানে এই নয় যে আমি কথা থামিয়েছি।

আমি শুধু প্রমাণ করে গেলাম—একটা নারীর কণ্ঠও একটা দেশের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

মার্চ মাস। ১৯৭১।

খুলনার আকাশ জ্বলছে, বাতাসে কাঁপছে পলাশ ফুলের মতো লাল রঙ। শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে শব্দ—এই শব্দ বুলেটের, বিস্ফোরণের, আর নিঃশব্দ কান্নার।
রওশন আরার জানালার ওপাশে যা দেখছিলেন, তা ইতিহাস নয়, তা ছিল এক ভয়ঙ্কর বাস্তব।
একটা ভোরে তারা দেখল, সেনাবাহিনী ঢুকছে পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে লাল চিহ্ন আঁকা হচ্ছে। কাদের বাঁচানো হবে, কাদের নিধন—সব আগেই ঠিক হয়ে গেছে।

প্রতিদিন রওশন ভাবতেন, “আজ কি ওরা আসবে আমার দরজায়?”
কিন্তু এই ভয়ও তাকে দমাতে পারল না। তিনি জানতেন, এবার কণ্ঠ নয়, এবার গান নিজেই যুদ্ধ হবে।

বাঙালিদের গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। রওশন বুঝতে পারছিলেন, রেডিওর তরঙ্গে আর কেবল সংকেত পাঠালে চলবে না। এবার চাই প্রচার, আন্দোলনের জ্বলন্ত স্বর।

তাই তিনি ঠিক করলেন—এবার তৈরি করবেন এক গান, যা হবে মুক্তির গান।
যেটি কেবল গোপন বার্তা নয়, ওপার বাংলা, ওপার ভারত, এমনকি বিশ্বকেও বোঝাবে—বাঙালি মরে না, বাঙালি গায়।

তিনি শুরু করলেন একটি নতুন সৃষ্টির কাজ—
‘আগুনের আকাশ’ নামে একটি সংগীতচক্র।
একটি কবিতা লিখলেন, যার প্রতিটি পঙ্‌ক্তি যেন বুলেটের থেকেও বেশি তীক্ষ্ণ—

“যখন আগুন নামে আকাশে,
তখন কান্নাও পুড়ে যায়—
রক্ত দিয়ে লেখা হয় গান,
যার ছায়াও ফেরে না ফিরে।”

এই কবিতাকে রূপ দিলেন সুরে। রাগ শঙ্করায়ণ—যা সাধারণত বিপদের প্রতীক। সেই রাগেই বাঁধলেন নতুন যুদ্ধের গান।

নাসির তখন সম্পূর্ণ দলে দলে কাজ করছে। সে রওশনকে যুক্ত করল একটি গোপন সাংস্কৃতিক সেলের সঙ্গে, যারা ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে সাংস্কৃতিক অস্ত্র ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ায়।

রওশন এবার চাইলেন—এই গান পৌঁছাক সীমানা পেরিয়ে।
তিনি নিজের ভয় সরিয়ে রেখে বাংলাদেশ বেতারের মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী দল-এর কাছে বার্তা পাঠালেন।

নাসিরের হাত ধরে সেই বার্তা চলে গেল কলকাতার বালিগঞ্জের সেই ঘরে, যেখানে তখন তৈরি হচ্ছে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র”।

এক সপ্তাহ পর খবর এলো—রওশন আরার লেখা ও সুর করা গান ‘আগুনের আকাশ’ স্বাধীন বাংলা বেতারে সম্প্রচারিত হবে।

তিনি কেঁদে ফেললেন। নয় শুধুমাত্র আনন্দে, নয় কেবল স্বীকৃতিতে—বরং তীব্র ভালোবাসা ও গর্বে।
এ গান কেবল তার নয়—এ গান তার সন্তান, তার ভাষা, তার জাতির।

এই সময়েই খুলনায় রক্তপাত ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ঘরে ঘরে ধরপাকড়, নির্যাতন, গণহত্যা। একদিন এক প্রতিবেশী এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল—

— “আপা, আপনারা পালান। ওরা আসছে। তালিকায় আপনার স্বামীর নাম। ও ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু বাঙালি।”

রওশন এবার আর থামলেন না।
রাতের অন্ধকারে নাসিরের সহায়তায় এক লঞ্চে উঠে পড়লেন তিনি, সঙ্গে ওয়াহিদ সাহেব ও তাদের দুই ভাগ্নে।
গন্তব্য—ভারতের সীমান্তবর্তী শরণার্থী ক্যাম্প।

লঞ্চ যখন পদ্মা পেরিয়ে যাচ্ছিল, রওশন তখন নদীর দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন ছায়ায় ভরা দিগন্ত।

— “এ নদীই দেখেছে আমার প্রথম গান, এই নদীই দেখবে মুক্তির সূর্য। আমি আবার ফিরব—যখন গানের মতো দেশ হবে স্বাধীন।

সীমান্ত পার হয়ে যখন তারা পৌঁছালেন ভারতের এক ছোট্ট শিবিরে, তখন চারদিকে শুধু ক্লান্তি, শোক, ভাঙা পরিবার।
কিন্তু এর মাঝেই রওশন তার খাতা খুলে বসেন।
সেই ক্যাম্পেই তিনি প্রথমবার “আগুনের আকাশ” গান গেয়ে শোনান সরাসরি কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে।

গান শুনে কয়েকজন যুবক কেঁদে ফেলে।
একজন বলে,
— “আপা, যুদ্ধ তো আমরা চালাচ্ছি বন্দুক দিয়ে। আপনি চালাচ্ছেন শব্দ দিয়ে। আপনি না থাকলে, আমরা হয়তো ভেঙেই পড়তাম।”

এরপর একদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একজন প্রতিনিধি এসে রওশনকে অনুরোধ করে—
— “আপনার গান আমরা আবার সম্প্রচার করতে চাই। আপনি কি চাইবেন, আপনার কণ্ঠ অক্ষয় হয়ে থাকুক এই সংগ্রামে?”

রওশন বলে,
— “আমার কণ্ঠ নয়, আমার দেশ অক্ষয় হোক। গান তো কেবল সেই পথ দেখায়।”

১৯৭১-এর ডিসেম্বর।

যখন বিজয়ের পতাকা উড়ল ঢাকায়, রওশন ছিলেন কলকাতার আশপাশে।
রেডিওতে ভেসে এল “বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।”
ওই মুহূর্তে রওশন হারমোনিয়াম ছুঁয়ে বললেন—

— “এই যন্ত্রটা আর কেবল সংগীতের না—এটা একটা দেশের জন্মের সাক্ষী। আগুনে পুড়ে নতুন সুরে জন্ম নিয়েছে আমার মাতৃভাষা।”

এক মাস পরে, জানুয়ারিতে, রওশন আরা ফিরে এলেন খুলনায়।
তাঁর সেই পুরনো বাড়ি অনেকটাই পোড়ানো, কিন্তু বারান্দার এক কোণে তখনও একটা গোলাপ গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।

ওই গাছের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি মনে করলেন—
সেই ট্রান্সমিটার, সেই সুর, সেই চিঠি…

আর সলমান?

তাঁর খবর আর রওশন জানেন না। হয়তো কোথাও, কোনও যুদ্ধবিধ্বস্ত মনকে প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছেন, “শব্দ সত্যিই কি থামাতে পারে ইতিহাসকে?”

রওশন নিজের খাতায় লিখলেন শেষ লাইন:

“এই দেশের জন্ম কণ্ঠের আগুনে, আর আমি ছিলাম সেই অগ্নিস্নানের একটি শব্দ। আজ আমি চুপ, কারণ আমার গান এখন সবার মুখে।”

খুলনায় জানুয়ারির বাতাস কেমন আলগা, গরম আবার ঠান্ডার মাঝামাঝি। সূর্য ঢলঢলে রোদের মতো পাতা ছুঁয়ে থাকে, আর মানুষ বাড়ির ধ্বংসাবশেষের ভেতর দাঁড়িয়ে নতুন ভবিষ্যতের খোঁজে।

রওশন আরা যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁর বাড়ির ছাদে একটা চুনকালি লেখা ছিল—“দেশদ্রোহীর ঘর।”

ওয়াহিদ সাহেব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সেটা দেখে।
কিন্তু রওশন হেঁটে গিয়ে নিজের হাত দিয়ে সেটা ঘষে তুলতে তুলতে বলেছিলেন,
— “এটা চিহ্ন নয়, এটা ইতিহাস। যারা লিখেছে, তারাই জানে না শব্দ কখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে।”

বারান্দার কোণে এখনও ছিল সেই গোলাপগাছ—বাঁচা আর ভাঙার মাঝের এক অলিখিত দলিল। রওশন ধীরে ধীরে গিয়ে সেই মাটি ছুঁয়ে বললেন,
— “তুমি তো সব দেখেছো, শুনেছো, সইেছো। এবার আমার সঙ্গেই ফের গান শুরু করো।”

রওশন এবার খুলনায় একটা ‘সাংগীতিক পুনর্গঠনের দল’ গঠন করলেন।
তাঁর প্রথম উদ্যোগ: খুলনার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও যুদ্ধাহত যুবকদের নিয়ে একটি কোরাস দল গঠন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল—শুধু গান গাওয়া নয়, স্মৃতি ফিরিয়ে আনা।
কারণ, ইতিহাস শুধু পুস্তকে নয়, সে বসে থাকে কণ্ঠে।

তিনি বলতেন,
— “দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এখনো পুরোটা বলা হয়নি। আমাদের সুরের পাঁজর ভেঙে পড়েছে, আবার জোড়া লাগাতে হবে।”

এই দলের নাম রাখা হয়—‘স্বরস্বিতা’।
প্রথম অনুষ্ঠান হয় শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত মিলনায়তনের পেছনে, খোলা মাঠে। সেখানে রওশন গাইলেন তাঁর সেই গান—“আগুনের আকাশ।”

শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন শহীদ ছাত্র সোহেলের মা।
তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তিনি শুধু বললেন,
— “আপনার গান আমার ছেলের মুখ। সে আর নেই, কিন্তু তার স্বপ্ন আপনি গেয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।”

এভাবেই গান হয়ে উঠল শহরের পুনর্জন্মের ভাষা।
কিন্তু এর মধ্যেই একটা চিঠি এল রওশনের নামে—ঢাকা থেকে, সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেনের নামাঙ্কিত খামে।
চিঠি খুলতেই একবারে বসে পড়লেন তিনি।

“রওশন আরা,

আমি এখন আর ক্যাপ্টেন নই। আমার পদের তকমা চলে গেছে, কিন্তু আমার কণ্ঠ এখনও তবু প্রশ্ন তোলে।

সেই রাতে আপনার রাগ ভৈরবী আমার ভিতরটা উল্টে দিয়েছিল। আপনি আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন, অথচ আমি কিছু করিনি আপনাকে থামাতে।

আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে পারিনি। এখন পারছি।

আপনার সেই গানের কপি আমি দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বাজিয়েছি—‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সাহসী নারীদের’ শিরোনামে।

আপনি জানেন না, আপনি কী রেখে গেছেন আমার জীবনে।

– সাবেক ক্যাপ্টেন সলমান”

রওশন চিঠি শেষ করে চোখ বন্ধ করলেন। মনে পড়ল সেই সন্ধ্যা, যখন সে হারমোনিয়ামের সামনে বসেছিল আর এক শত্রু দাঁড়িয়ে ছিল শ্রোতার ভূমিকায়।

তিনি জানতেন, ইতিহাস বড় অদ্ভুত। সে শত্রুকে বন্ধু, বন্ধুকে ইতিহাসের সাক্ষী বানিয়ে দেয়।

তিনি তাঁর খাতায় লিখলেন—

“আমি তাকে থামাতে চেয়েছিলাম। সে থেমেছিল।
কিন্তু সে আমার গানও থামায়নি।

তাই আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।”

এরপর দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল এক শান্ত পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে।
রওশন সুর দিচ্ছিলেন নতুন প্রজন্মকে, গল্প বলছিলেন শহরের গান হয়ে ওঠা পথে।
নাসির এখন শহরের সাংস্কৃতিক কর্মী, সে রওশনকে বলে,
— “আপা, আপনি তো আমাদের ইতিহাসের সেই পাতার নাম, যেটা কেউ বইয়ে লেখেনি, কিন্তু যার মুখে আমরা মুক্তির গান শিখেছি।”

একদিন ঢাকার ‘শব্দমঞ্চ’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়।
তাদের এক প্রজেক্ট: ‘জীবন্ত ইতিহাস’—যেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাংস্কৃতিক সৈনিকদের কণ্ঠ ধারণ করা হয়।

রওশন ঢাকায় যান। সেই রেকর্ডিং স্টুডিওতে গাইতে গাইতে তিনি থেমে যান।
তিনি বলেন—
— “আজ আমি একটাই লাইন গাইব। বাকিটা তোমরা গাবে।”

তিনি হারমোনিয়ামে আঙুল রাখেন, তারপর বলেন,

“এই শব্দ আমার নয়। এই শব্দ আমাদের।”

ঢাকার অনুষ্ঠান শেষে তিনি খুলনায় ফেরেন। রেলস্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে কিছু তরুণ-তরুণী।
একজন এগিয়ে এসে বলে,
— “আপনি কি রওশন আরা? আগুনের আকাশ আপনি লিখেছিলেন তো?
আমরা আপনার গান স্কুলে শেখি। আপনি কি একবার আমাদের স্কুলে আসবেন?”

রওশন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন,
— “তোমরা জানো, এই শব্দ একসময় ছিল বিপজ্জনক?
তোমরা জানো, এই গান লিখতে গিয়ে আমি নিজেকে হারাতে বসেছিলাম?”

তরুণীরা মাথা নেড়ে বলল,
— “তাই তো আপনি এখন ইতিহাস।”

রওশন তাকিয়ে রইলেন পূর্ব দিগন্তে।
তার বুকের ভেতর তখনও বাজছিল সেই হারমোনিয়ামের সুর,
সেই ট্রান্সমিটারের কম্পন, সেই কণ্ঠের অস্থিমজ্জা।

তিনি খাতার একেবারে শেষ পাতায় লিখলেন—

“আমি গানে গেছি, ফিরে এসেছি।
ইতিহাসের কোনো পাতায় আমি নেই,
কিন্তু প্রতিটি মুক্ত মানুষের কণ্ঠে আমি আছি।

আমি—একটি সুরের পাঁজরভাঙা শব্দ।

আমি—রওশন আরা।”

১০

বছর কুড়ি পেরিয়েছে। সময়ের নদী বয়ে গেছে পদ্মার মতো—মাটি ভেঙেছে, আবার জোড়া লেগেছে।
খুলনার সেই বারান্দা আজও দাঁড়িয়ে, কিন্তু গোলাপগাছে এখন সাদা ফুল ফুটেছে। রওশন আরার বয়স বেড়েছে, চোখে চশমা ভারি হয়েছে, কিন্তু তার কণ্ঠে সেই স্পষ্টতা রয়ে গেছে—যেটা দিয়ে একদিন তিনি রাষ্ট্রের শব্দবিন্যাস বদলে দিয়েছিলেন।

তিনি আজকাল খুব একটা গান করেন না। হারমোনিয়ামটিও এখন খাপছাড়া সময়েই খুলে।
তবে প্রতি মাসের একদিন, বাড়ির পেছনের ঘরে তিনি বসেন, সাদা কাপড় পরে, পেন দিয়ে লেখেন তার ডায়েরির নতুন অধ্যায়।

শিরোনাম থাকে সব সময় একটাই—
“সংকেত”
কারণ তিনি জানেন, জীবনের প্রতিটি দিন আসলে একেকটি সংকেত—কখনও ব্যক্তিগত, কখনও রাষ্ট্রীয়, কখনও শুধুই নিঃশব্দ।

আজ তার ঘরে এসেছে এক তরুণ সাংবাদিক—নাম রাশিদ।
সে বলে,
— “আপা, আমি আপনার গল্প নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র বানাতে চাই। তরুণ প্রজন্ম জানে না আপনি কে। তারা শুধু জানে, ‘আগুনের আকাশ’ গানটা কে যেন লিখেছিল।”

রওশন চুপচাপ তাকান ছেলের দিকে। এক সময় বলেন,
— “তোমরা কি সত্যিই জানতে চাও, কেমন করে শব্দ বাঁচায়? কেমন করে কণ্ঠ গুলি ঠেকায়?”

রাশিদ মাথা নাড়ে।
— “আমি চাই, আপনার বলা শেষ সংকেতটা আমরা শুনি। আপনি যা আমাদের রেখে যেতে চান—শেষ কথাটা।”

রওশন উঠে দাঁড়ান। ধীরে ধীরে গিয়ে হারমোনিয়ামের ঢাকনা খুলে বলেন,
— “তোমাদের জন্য আমি গাই না। আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আমার অস্ফুট, অসমাপ্ত গলা।
তোমরা এটাকে যেমন পারো, বহন কোরো।
কারণ আমি জানি, কিছু শব্দ থামে না।
তারা শুধু ফিরে আসে—নতুন কণ্ঠে, নতুন মুখে।”

তিনি বাজাতে শুরু করেন রাগ দেশ—বাংলা মাটির নিজস্ব ঘ্রাণবাহী রাগ।
তার মধ্যে মিলেমিশে থাকে স্নেহ, দ্রোহ, বৃষ্টি আর বিদ্রোহ।

তারপর তিনি গাইলেন—

“এই দেশ আমার, এই সুর আমার
রক্ত দিয়ে বানানো পথের ওপার—
যদি আমি না থাকি, তবু আমার গান
তোমার বুকের নিচে বাঁচবে প্রাণপ্রাণ।”

রাশিদের ক্যামেরা চলতে থাকে। কিন্তু চোখের ফ্রেম ধুয়ে যায় কাঁপা আলোয়, কারণ গলার প্রতিটি রন্ধ্র দিয়ে বেরিয়ে আসে ইতিহাস।

সেই রেকর্ডিং-এর কয়েক মাস পর, রওশন আরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বার্ধক্য, রক্তচাপ, এবং হৃদরোগ মিলিয়ে তাঁকে ভর্তি করা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজে।

ডাক্তারেরা বলেন,
— “তাঁর শ্বাস ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয়—তিনি ঘুমের মধ্যেও গান গাইছেন। তার ঠোঁটে এখনও ছন্দ রয়ে গেছে।”

ওই সন্ধ্যায় এক সময় তিনি চোখ খুলে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন,
— “আমার হারমোনিয়াম আছে তো?”

ডাক্তার অবাক হয়ে যান।
— “হ্যাঁ, আপনার ছেলেরা এনেছে।”

তিনি বলেন,
— “আমি আবার গাইব না। আমি শুধু ছুঁয়ে দেখতে চাই, শব্দ ফিরে আসে কিনা।”

মৃত্যুর ঠিক আগের দিন রওশন আরা শেষবারের মতো তার খাতাটি টানেন।
একটি মাত্র বাক্য লেখেন—

“আমি থেমে গেলাম, কারণ আমি ফিরে আসতে চাই।

আমি আর কণ্ঠ নয়—
আমি কণ্ঠ হয়ে ওঠা একটি জাতির শব্দ।”

সেই রাতেই, নিঃশব্দ ঘুমে, তিনি চলে যান।

কোনও অ্যালার্ম বাজেনি, কোনও মেশিন শব্দ করেনি।
তবে নার্স বলে—
— “তিনি চোখ বন্ধ করার আগে বলেছিলেন, ‘শব্দ এসেছে। এবার আমি যাই।’”

রওশন আরার মৃত্যুর কয়েকদিন পর তাঁর বাসায় একটি ডাক আসে—স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে।

তাদের চিঠি:

“আমরা রওশন আরাকে মরণোত্তর ‘বাংলা কণ্ঠ সম্মান’ প্রদান করছি।

তিনি ছিলেন প্রথম নারী, যিনি সংগীতকে সংকেত বানিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি, যিনি রাষ্ট্রের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে গান গেয়েছিলেন ইতিহাস হয়ে।

তাঁর রেখে যাওয়া হারমোনিয়াম, ক্যাসেট, ডায়েরি—সব আমরা সংরক্ষণ করব স্বাধীন বাংলা জাদুঘরে।”

চিত্রনির্মাতা রাশিদ পরে তাঁর প্রামাণ্যচিত্রে একটা দৃশ্য রাখেন—

রওশন আরার খালি বারান্দা। বাতাসে কাপড় ওড়ে। হারমোনিয়ামের ওপর একটা সাদা ফুল রাখা। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে তার কণ্ঠ—

“যেখান থেকে শব্দ ফিরে আসে,

সেখানেই আমি থাকি।
আমি চুপ করে থাকি না,
আমি শব্দের মতো ফিরে ফিরে আসি।”

গল্প শেষ নয়।

কারণ যখনই কেউ ‘আগুনের আকাশ’ গানটা গাইবে,
তখনই একজন নারী—যিনি একা, নীরবে, একটা দেশকে শব্দের ভেতর দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন—
তিনি ফিরে আসবেন।

তার নাম রওশন আরা।

 সমাপ্ত 

 

 

1000025173.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *