Bangla - প্রেমের গল্প

পুরোনো বইয়ের ভাঁজে

Spread the love

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়


 

কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ভাট্টা সবসময় একইরকম থাকে। পুরোনো বইয়ের গন্ধ, চায়ের ভাঁড় হাতে ছাত্রদের ঝাঁক, ফুটপাতের দোকানগুলোয় বইয়ের পাহাড়—সব মিলিয়ে শহরের একটুকরো জাদুর মতো লাগে। অর্ণব সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ধীরপায়ে হাঁটছিল। বই কেনা তার আসল উদ্দেশ্য ছিল না, বরং মনে মনে একটা অজানা টান তাকে এখানে টেনে এনেছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে অন্য কোনোদিন সে সোজা বাড়ি ফিরলেও আজকে কেন যেন এই রাস্তার টানে চলে এসেছে।

দোকানদাররা গলা উঁচিয়ে ডাকছিল—“সেকেন্ড হ্যান্ড, সস্তার দামে, বিরল সংস্করণ!” অর্ণব এক-দুটি দোকানে থামল, বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখল। তার চোখে হঠাৎ পড়ল এক পুরোনো ধূলো ধরা বই—চামড়ার মলাট ছেঁড়া, কাগজগুলো হলুদ হয়ে গেছে, তবু অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল ভেতরে। হাতের কাছে তুলে নিয়ে সে বইটা খুলতেই একটি শুকনো ফুল বুকমার্কের মতো চাপা দেওয়া পড়ে গেল মেঝেতে। ফুলটা যেন বহুদিন আগেকার, তবু রঙের হালকা আভা রয়ে গেছে।

আর তার সঙ্গে একটি কাগজের টুকরো—একটি কবিতার লাইন লেখা আছে তাতে, অচেনা হস্তাক্ষরে।

“যে কথা মুখে বলা যায় না, বইয়ের পাতায় সে চিরকাল বেঁচে থাকে।”

অর্ণব অবাক হয়ে চেয়ে রইল কাগজটার দিকে। মনে হলো যেন কেউ ইচ্ছে করেই এখানে লুকিয়ে রেখে গেছে। তার বুকের ভেতর হঠাৎ কৌতূহল আর অজানা আবেগ মিলেমিশে একটা অস্থিরতা তৈরি করল।

সে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই বইটার মালিক কে ছিল জানেন?”

দোকানদার, পাকা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ, চোখের চশমা নামিয়ে হাসলেন। “বাবা, এত পুরোনো বই, মালিকের খোঁজ কে রাখে? তবে মনে হয় এক মেয়ের বই ছিল। মাঝে মাঝে এমন ফুল, কাগজ চাপা পাওয়া যায়। কেউ হয়তো প্রেমপত্র লিখেছিল।”

অর্ণব বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপন অনুভব করল। কে সেই মেয়ে? আর কে লিখেছিল এই লাইন? কেনই বা বইয়ের পাতায় ফুল আর কবিতা চাপা দিল?

সেদিন রাতে সে বাড়ি ফিরে বইটা টেবিলের ওপর রাখল। কিন্তু ঘুম এল না। জানলার বাইরে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছিল। বুকমার্কের মতো সেই শুকনো ফুলটা খাতার ভেতর রেখে দিয়েছিল সে, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছিল অচেনা মেয়ের মুখ—যেন ফুলের গন্ধ আর কবিতার অক্ষরের মধ্যে সে লুকিয়ে আছে।

অর্ণব পরদিন অফিসে বসেও মন দিতে পারল না কাজে। খাতার ভাঁজে রাখা কবিতার লাইনটা বারবার মনে পড়ছিল। বিকেলে হঠাৎ আবার ফিরে গেল কলেজ স্ট্রিটে, একই দোকানে।

বৃদ্ধ দোকানদার তাকে দেখে হেসে বললেন, “এত তাড়াতাড়ি আবার?”

অর্ণব একটু ইতস্তত করে বলল, “এই বইটার সম্পর্কে আর কিছু জানেন? আগের মালিক কে ছিলেন, কোনো নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি?”

দোকানদার আঙুলে গোঁফ ঘুরিয়ে বললেন, “একটা নাম মনে আছে বটে… রেজিস্টারে হয়তো লেখা আছে।”

তারপর দোকানের ভেতরের আলমারি থেকে একটা পুরোনো খাতার পাতা উল্টাতে উল্টাতে তিনি থামলেন। “হ্যাঁ, এখানে আছে। নাম—অর্পিতা দত্ত। বছর দশেক আগে বইটা দিয়েছিল বেচে। তখন ও নিয়মিত আসত এখানে।”

অর্ণব নামটা পড়েই চমকে উঠল। অর্পিতা দত্ত! নামটার মধ্যে যেন এক অদ্ভুত সুর বাজল। সে নাম সে আগে কখনো শোনেনি, তবু কেন যেন মনে হলো অনেকদিনের চেনা।

তারপর থেকে শুরু হলো খোঁজ—কে এই অর্পিতা? কেন সে বইয়ের পাতায় চাপা দিল শুকনো ফুল? আর সেই কবিতার লাইন লিখল কে?

অর্ণব জানত না এই অনুসন্ধান তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। শুধু জানত, তার নিজের জীবনের গল্প হয়তো এখান থেকেই অন্য রকম হতে চলেছে।

অর্ণবের দিনগুলো যেন হঠাৎ করেই বদলে গেল। অফিসের কাজের ফাঁকে, বাসে ফেরার পথে, এমনকি সকালের কফির সময়ও মাথায় শুধু একটি নাম ঘুরছিল—অর্পিতা দত্ত। নামটা অচেনা, অথচ অদ্ভুতভাবে পরিচিত মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন কোথাও শুনেছে আগে, হয়তো কোনো গানে, হয়তো কোনো গল্পে।

দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায়ও সে দাঁড়াল কলেজ স্ট্রিটের সেই পুরোনো দোকানে। বৃদ্ধ দোকানদার তখন চায়ের ভাঁড় হাতে বসে ছিলেন। অর্ণব কাছে যেতেই তিনি হাসলেন, “মেয়েটার খোঁজ এখনও ছাড়োনি বুঝি?”

অর্ণব একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “জানি, অদ্ভুত শোনাবে। কিন্তু নামটা মনে ধরেছে। জানেন কোথায় থাকে এখন?”

দোকানদার কাঁধ ঝাঁকালেন, “বাবা, বছর দশেক আগের কথা। তখন প্রায়ই আসত, বই কিনত, আবার বই বেচেও দিত। সাহিত্য পড়ত কলেজে। তারপর একদিন আর আসেনি। শুনেছিলাম, খুব বড় ধাক্কা খেয়েছিল জীবনে। কারও সঙ্গে ঝগড়া, না প্রেম ভেঙে যাওয়া—কিছু একটা।”

অর্ণবের বুকটা যেন কেঁপে উঠল। ফুল চাপা দেওয়ার মতোই কোনো ভাঙা গল্প কি চাপা ছিল তার জীবনে? কবিতার সেই লাইন কি তার নিজের লেখা ছিল, নাকি অন্য কারও স্মৃতিচিহ্ন?

সে রাতে অর্ণব বইটা আবার হাতে নিল। পাতার ভাঁজে ভাঁজে খুঁজে দেখল, হয়তো কোথাও নাম লেখা আছে। সত্যিই এক জায়গায় অতি সূক্ষ্ম করে লেখা—“অ.দ.”। কালি ঝাপসা হয়ে গেছে, তবু স্পষ্ট বোঝা যায় নামের আদ্যক্ষর। অর্ণব বারবার নামটা লিখল নিজের খাতায়—অর্পিতা দত্ত। নামটা যেন ধীরে ধীরে বই থেকে উঠে এসে তার জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠছে।

পরদিন দুপুরে অফিস থেকে বেরিয়ে সে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো রেজিস্ট্রি অফিসে। কলেজ স্ট্রিট থেকে বেশি দূরে নয়। বহু পুরোনো নাম, ঠিকানা খুঁজে বের করা সহজ নয়, তবু সে চেষ্টা চালাল। এক বৃদ্ধ কর্মচারী পুরোনো খাতা উল্টাতে উল্টাতে নামটা পেয়ে গেলেন।

“অর্পিতা দত্ত,” বৃদ্ধ চশমা চোখে নাম পড়ে বললেন, “ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করেছিল। স্নাতক শেষ করে সম্ভবত দক্ষিণ কলকাতায় থাকত।”

অর্ণব একগাদা তথ্য পেলেও ঠিকানা পেল না। তবু মনে হলো সে একটু করে কাছে চলে এসেছে।

সেদিন রাতে বৃষ্টির শব্দে জানলা কাঁপছিল। অর্ণব বইটা টেবিলে রেখে ডায়রি খুলল। অচেনা মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে লিখল—

অর্পিতা, তুমি হয়তো জানোই না তোমার বই আজ আমার হাতে। তোমার ফুল শুকিয়ে গেছে, কিন্তু গন্ধ এখনও রয়ে গেছে পাতার মধ্যে। তোমার লেখা লাইনটা আমার ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। কে তুমি? তুমি কি এখনও কবিতা লেখো?”

লেখা শেষ করে অর্ণব ডায়রির পাতায় হাত রাখল, যেন কোনো উত্তর পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে শহরের অন্য প্রান্তে, এক অচেনা ঘরে হয়তো অর্পিতাও তার নিজের জীবনের খাতা উল্টে দেখছিল—অতীতের চাপা দেওয়া ফুলগুলো এখনও শুকিয়েই আছে, না কি আবার জীবনের ভাঁজে নতুন আলো খুঁজে পাওয়া যাবে।

অর্ণবের কৌতূহল দিন দিন বেড়েই চলছিল। অর্পিতা দত্ত যেন এখন তার কাছে শুধু একটি নাম নয়, বরং এক রহস্যময় ধাঁধা, যা না মেলানো পর্যন্ত শান্তি নেই। অফিসের কাজ, বন্ধুদের আড্ডা, এমনকি রাতের ঘুম—সব কিছুর মধ্যেই এক অদৃশ্য টান টের পাচ্ছিল সে।

একদিন অফিসের পর সাহস করে গেল দক্ষিণ কলকাতার লেক মার্কেটের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রি থেকে পাওয়া সামান্য ইঙ্গিতই তার ভরসা। চারদিকে গলি, পুরোনো বাড়ি, ভিড়—সব যেন একইসঙ্গে চেনা আবার অচেনা। একটা চায়ের দোকানে বসে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, “অর্পিতা দত্ত নামে কাউকে চেনেন? সাহিত্য পড়েছিল, প্রায় দশ বছর আগে।”

বেশ কিছু মাথা নেড়ে ‘না’ বলল, আবার কেউ হেসে উড়িয়ে দিল। শেষমেশ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, “হয়তো বলতে পারব। এখানে একসময় দত্ত পরিবার থাকত। বড় মেয়ে ছিল অর্পিতা। কিন্তু অনেক বছর হলো তারা বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছে। শুনেছিলাম, মেয়েটার জীবনে কিছু অঘটন ঘটেছিল।”

অর্ণবের বুকের ভেতর কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল। অঘটন? কী হয়েছিল অর্পিতার জীবনে?

সে ভদ্রলোকের দেওয়া ঠিকানা ধরে পৌঁছল এক ভগ্নপ্রায় বাড়ির সামনে। দরজা বন্ধ, জানলায় ধুলো জমে আছে। বাড়ির পাশের মুদি দোকানদার বলল, “ওই পরিবার তো অনেক আগেই চলে গেছে। মেয়ে নাকি খুব ভালো কবিতা লিখত। কিন্তু একদিন হঠাৎ সব ছেড়ে দেয়।”

অর্ণব বাড়ির দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করছিল, যেন পুরোনো দেওয়ালগুলো উত্তর দেবে। কিন্তু সাহস পেল না।

সেদিন রাতে অর্ণব আবার বইটা খুলল। পাতার ভাঁজ থেকে শুকনো ফুলটা আঙুলে নিয়ে আস্তে আস্তে ছুঁল। মনে হলো অর্পিতা যেন নিঃশব্দে পাশে বসে আছে।

তারপর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। বইয়ের ভেতরের একটি পাতায় সে হঠাৎ খুঁজে পেল হালকা করে পেন্সিলে লেখা একটি লাইন, যেটা আগের বার খেয়াল করেনি—

“যদি কোনোদিন আমার গল্প কেউ খুঁজে পেতে চায়, তবে তাকে ফিরে আসতে হবে বইয়ের শহরে।”

অর্ণব যেন শিউরে উঠল। বইয়ের শহর—অর্থাৎ কলেজ স্ট্রিটই কি সেই ঠিকানা? তবে কি অর্পিতা ইচ্ছে করেই এই সূত্র রেখে গিয়েছিল?

অর্ণব বুঝল, এই রহস্যের শুরু ও শেষ দুটোই কলেজ স্ট্রিটেই বাঁধা। আর তার নিজের জীবনের নতুন অধ্যায় হয়তো ঠিক সেখানেই লেখা হতে চলেছে।

অর্ণব আবার ফিরল কলেজ স্ট্রিটে। এবার শুধু কৌতূহল নয়, বুকের ভেতর অদ্ভুত এক টান। মনে হচ্ছিল, এই বইয়ের শহরের প্রতিটি ইট, প্রতিটি দোকান, প্রতিটি গলিই অর্পিতার ছায়া বহন করছে।

সে আবার দাঁড়াল সেই পুরোনো দোকানে। বৃদ্ধ দোকানদার তখন খাতা গুটোচ্ছিলেন। অর্ণব ভদ্রলোককে সেই পেন্সিলে লেখা লাইনটা দেখাল। বৃদ্ধ অবাক হয়ে বললেন, “আরে, এটা তো অর্পিতার হাতের লেখা। ও মাঝে মাঝে এমন লাইন লিখে বই ফেরত দিত। যেন বইকে চিঠির মতো ব্যবহার করত। অনেকেই বই কিনে এসব লাইন খুঁজে পেত, অবাক হত।”

অর্ণব থমকে গেল। বইকে চিঠি হিসেবে ব্যবহার করা! অর্থাৎ অর্পিতা হয়তো নিজের না বলা কথা বইয়ের পাতায় লিখে যেত, আর কোনো অচেনা পাঠক সেই চিঠি খুঁজে পাবে ভেবেই আনন্দ পেত।

সে জিজ্ঞেস করল, “এমন কোনো বই এখনো আছে কি? যেগুলো অর্পিতা দিয়েছিল?”

বৃদ্ধ দোকানদার একটু ভেবে দোকানের কোণ থেকে কিছু বই টেনে আনলেন। মলাটগুলো পুরোনো, ধুলো জমে আছে। একে একে বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখল অর্ণব। প্রথমে কিছুই পেল না, কিন্তু শেষের দিকের এক খণ্ড কবিতার বই খুলতেই আবার পড়ল এক লাইন—

“যে আমাকে খুঁজবে, তাকে শব্দের ভেতরেই খুঁজে পেতে হবে।”

অর্ণবের বুকের ভেতর যেন হাহাকার ভরে উঠল। অর্পিতা কী আসলেই চাইছিল কেউ তাকে খুঁজে পাক? নাকি এ শুধু নিজের নিঃসঙ্গতার প্রকাশ ছিল?

হঠাৎ বৃদ্ধ দোকানদার বললেন, “শুনেছি, অর্পিতা মাঝে মাঝে এক কবি সমাবেশে যেত, এখানকার কফিহাউসেই হতো। হয়তো সেখানে খোঁজ নিতে পারো।”

অর্ণবের ভেতর এক ঝলক আশার আলো জ্বলে উঠল। কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস—শহরের বুকের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা ইতিহাসের অংশ। হয়তো অর্পিতার পায়ের ছাপ এখনো আছে সেখানে।

সন্ধ্যার দিকে অর্ণব গেল কফিহাউসে। ভিড়, ধোঁয়া, কাপে কাপে চা, টেবিল ভরা আড্ডা। চারদিকে কবিতার লাইন, রাজনীতির তর্ক, প্রেমের ফিসফিসানি। সে চুপচাপ এক কোণে বসে রইল। হয়তো এখানেই কোনোদিন অর্পিতা বসত, কোনো বই খুলে নিজের মনের ভেতরের কথা লিখে রাখত।

অর্ণব অর্ডার দিল কফি। টেবিলের কাঠের ওপর আঙুল ঘষতে ঘষতে মনে হলো যেন কোথাও নাম খোদাই করা আছে—অর্পিতা। চোখের ধাঁধাঁয় খুঁজল সে, কিন্তু পেল শুধু ফিকে আঁকিবুঁকি।

তবু মনে হলো, এই ভিড়ের মাঝেই অর্পিতা কোথাও আছে। হয়তো পরের টেবিলে বসে চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। হয়তো জানলার ওপাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিভেজা রাস্তায় তাকিয়ে আছে।

অর্ণব বুঝতে পারল, সে এখন আর শুধুই অর্পিতাকে খুঁজছে না। সে খুঁজছে নিজের ভেতরে জমে থাকা কোনো শূন্যতার উত্তর।

আর ঠিক তখনই, পাশের টেবিলে রাখা একটি বই খুলতেই হাওয়ার ঝাপটায় একটি কাগজ উড়ে এসে পড়ল তার টেবিলে। অর্ণব কাগজটা তুলে নিল। তাতে লেখা—

“যে খোঁজে, সে কোনোদিন একা থাকে না।”

অর্ণবের আঙুল কাঁপছিল। এ কি কেবল কাকতাল, নাকি সত্যিই অর্পিতার রেখে যাওয়া কোনো চিহ্ন আবার তার কাছে এসে পৌঁছল?

অর্ণবের হাতে ধরা কাগজটা যেন বুকের ভেতর বজ্রপাতের মতো বাজল। যে খোঁজে, সে কোনোদিন একা থাকে না।” অচেনা হস্তাক্ষর, অথচ অদ্ভুতভাবে পরিচিত মনে হচ্ছিল। কাগজটা সে বুকের কাছে চেপে রাখল। যেন এক মুহূর্তে সময় আর বাস্তবতার সীমানা মুছে গেল।

সে চারদিকে তাকাল। কফিহাউসের টেবিলগুলো ভর্তি, লোকেরা গল্প করছে, হাসছে, কারও কারও মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে রাজনীতির তর্কে। কিন্তু অর্ণবের চোখ শুধু খুঁজছিল একটিমাত্র মুখ—অর্পিতা দত্ত। মনে হচ্ছিল, এই ভিড়ের মধ্যেই কোথাও সে লুকিয়ে আছে, হয়তো দাঁড়িয়ে আছে ছায়ার মতো।

কাগজটা সে পকেটে রেখে সোজা চলে গেল দোকানদারের কাছে। বৃদ্ধ তখন দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অর্ণব হাত বাড়িয়ে কাগজটা দেখাল। বৃদ্ধ চশমার ওপার থেকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “হাতের লেখা চেনা লাগছে… হ্যাঁ, অর্পিতার লেখার মতোই। তবে এটা এখানে এল কীভাবে, কে জানে!”

অর্ণব হতবাক। দশ বছর পরও কি অর্পিতার ছায়া এই শহরে রয়ে গেছে? নাকি কেউ ইচ্ছে করেই তার জন্য এই সূত্র রেখে যাচ্ছে?

পরের কয়েকটা দিন যেন অর্ণবের জীবনে দমবন্ধ করা অনুসন্ধান হয়ে দাঁড়াল। অফিস থেকে বেরিয়ে সে ছুটত কলেজ স্ট্রিটে, কফিহাউসে, পুরোনো লাইব্রেরিতে। প্রতিটি কোণায় যেন অর্পিতার নিশ্বাস লেগে আছে। বইয়ের পাতায়, টেবিলের আঁকিবুঁকিতে, এমনকি গলির দেওয়ালে লেখা কবিতার টুকরোতেও।

এক বিকেলে হঠাৎ সে পুরোনো লাইব্রেরির কোণে একটি ডায়েরির মতো বই পেল। তাতে কোনো নাম নেই, শুধু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কবিতার খসড়া। পাতার ভাঁজে আবার সেই আদ্যক্ষর—“অ.দ।”।

অর্ণব সেদিন বাড়ি ফিরে আলো নিভিয়ে বসে রইল সেই খাতা হাতে। পড়তে পড়তে মনে হলো, প্রতিটি লাইন যেন তার নিজের হৃদয়ের কথাই বলা—

“যে ফুল শুকিয়ে যায়, সে-ও গন্ধ ফেলে যায়।
যে প্রেম ভেঙে যায়, সে-ও শব্দ ফেলে যায়।”

অর্ণব বুঝল, অর্পিতা শুধু একজন মানুষ নয়, সে এক অদৃশ্য কবিতা, যাকে খুঁজে পাওয়া মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া।

সেই রাতে সে ডায়েরির খালি পাতায় লিখল—
অর্পিতা, যদি তুমি কোথাও থাকো, আমি খোঁজা থামাব না। তুমি যদি বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে থেকেও থাকো, আমি পাতায় পাতায় ছুঁয়ে যাব।”

কলম থামিয়ে জানলার বাইরে তাকাল সে। বৃষ্টিভেজা আকাশে হালকা চাঁদ উঠেছে। আর অর্ণবের মনে হলো, শহরের ওপরে কোথাও, কলেজ স্ট্রিটের ছায়ার ভেতরেই অর্পিতা তাকে দেখছে।

হয়তো সত্যিই, যে খোঁজে, সে কোনোদিন একা থাকে না।

অর্ণবের জীবন এখন আর আগের মতো নেই। সকাল হলে অফিসে গেলেও মন বসে না, ফোনে কাজের মেইল এলেও উত্তর দিতে দেরি হয়। চারপাশের সবকিছু যেন ঝাপসা হয়ে গেছে, শুধু একটা নামই স্পষ্ট হয়ে জেগে আছে—অর্পিতা দত্ত।

কলেজ স্ট্রিটে তার প্রতিদিন যাওয়া এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। দোকানদার বৃদ্ধও আর অবাক হন না, শুধু মুচকি হেসে বলেন, “আজ আবার নতুন কিছু খুঁজতে এসেছ তো?” অর্ণব মাথা নেড়ে বই উল্টে দেখেন। আশ্চর্যের বিষয়, প্রায়ই সে অর্পিতার রেখে যাওয়া কোনো না কোনো চিহ্ন খুঁজে পায়—কোনো পাতার ভাঁজে অর্ধেক লেখা লাইন, কোথাও শুকনো ফুলের গুঁড়ো, আবার কোথাও ফিকে আঁকিবুঁকি।

একদিন একটি বইয়ের পেছনের পাতায় সে পড়ল—

“যদি সত্যিই আমাকে জানতে চাও, তবে কবিতার শহরে আসবে।”

অর্ণব প্রথমে বুঝতে পারল না। কবিতার শহর মানে কী? পরে বৃদ্ধ দোকানদার ইঙ্গিত দিলেন—“হয়তো শান্তিনিকেতনের কথা বলছে। ওখানেই তো ও একসময় যেত কবিতা পড়তে, কবিদের সঙ্গে মিশতে।”

এই সূত্র শুনেই অর্ণবের বুকের ভেতর অস্থিরতা বাড়ল। সে কি সত্যিই শান্তিনিকেতনে যাবে? কাজের চাপ, শহরের দায়ভার সব ফেলে অচেনা এক মেয়ের খোঁজে?

কিন্তু ভেতরের টান তাকে ছাড়ল না। শনিবার ভোরে সে ট্রেনে চেপে বসল। জানলার বাইরে শ্যামল বাংলার মাঠ-ঘাট ছুটে যাচ্ছে, আকাশে ভেসে যাচ্ছে তুলোর মতো মেঘ। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি গাছপালা, প্রতিটি হাওয়া যেন তাকে ডাকছে—“এসো, এখানে তোমার উত্তর লুকিয়ে আছে।”

শান্তিনিকেতনে পৌঁছে সে প্রথমেই গেল রবীন্দ্রভবনের লাইব্রেরিতে। শান্ত নীরবতা, গন্ধমাখা বই, ছাত্রছাত্রীদের ভিড়—সবকিছুই যেন অন্যরকম। অর্ণব ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুরোনো কবিতার পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে খুঁজতে থাকল।

হঠাৎ এক কোণে চোখে পড়ল একটি চিরকুট, হয়তো কোনো বইয়ের ভেতর থেকে খসে পড়েছে। তাতে লেখা—

“আমি যদি আর কখনও এই পৃথিবীতে না ফিরি, আমার কবিতাই আমার নাম হয়ে থাকবে।”

অর্ণব চিরকুটটা হাতে নিয়ে নিঃশ্বাস আটকে ফেলল। আবার সেই অচেনা অথচ চেনা হস্তাক্ষর।

কোথাও না কোথাও অর্পিতা আছেন। হয়তো একেবারেই কাছে, হয়তো আঙুল বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।

রাত নামল শান্তিনিকেতনের আকাশে। তালগাছের ছায়ার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অর্ণবের মনে হলো—সে হয়তো খুব শিগগিরই তাকে খুঁজে পাবে।

শান্তিনিকেতনের আকাশে তখন শরতের মৃদু হাওয়া। গাছের পাতায় কাঁপন, দূরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ভেসে আসছে কোনো ছাত্রীর গলায়। অর্ণব হাঁটছিল আশ্রমের রাস্তা ধরে। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ইট যেন কবিতায় ভরে আছে। অথচ তার চোখ খুঁজছিল কেবল একটি নাম—অর্পিতা।

দিনভর ঘোরাঘুরির পর সন্ধ্যায় সে বসল খোলা প্রাঙ্গণে, যেখানে স্থানীয় কবি আর ছাত্রছাত্রীরা একত্রিত হয়ে কবিতা পাঠ করছিল। চারদিকে ছড়িয়ে ছিল চায়ের গন্ধ, করতালির শব্দ, আলো-আঁধারি। অর্ণব এক কোণে চুপচাপ বসে রইল।

একজন ছাত্রী মঞ্চে উঠে কবিতা পড়তে শুরু করল। তার গলায় অদ্ভুত সুর, কিন্তু অর্ণবের মন অন্যত্র। তখনই মঞ্চের পাশে রাখা একটি খাতা চোখে পড়ল। অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলে গেলে, কৌতূহল তাকে টেনে নিল সেই খাতার দিকে। পাতাগুলো উল্টাতেই হঠাৎ চোখ আটকে গেল।

পাতায় লেখা—

“যদি কেউ আমার ফুল খুঁজে পায়, যদি কেউ আমার শব্দ খুঁজে পায়, তবে সে আমাকে খুঁজে পাবে।”

আবার সেই অচেনা অথচ পরিচিত হস্তাক্ষর! অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। খাতার নিচে ছোট করে লেখা আদ্যক্ষর—“অ.দ।”

অর্ণব চারদিকে তাকাল, যেন ভিড়ের মধ্যে কোথাও অর্পিতা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চারপাশ তখন প্রায় ফাঁকা। কেবল গাছের ছায়া আর অন্ধকারের ভেতর ঝিঁঝিঁর ডাক।

হঠাৎ তার কাঁধে হাত রাখল এক বৃদ্ধ অধ্যাপক। তিনি খাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা কার হাতে এল?”

অর্ণব তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আমি… আমি খুঁজছি অর্পিতা দত্তকে। জানেন কিছু?”

অধ্যাপক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “অর্পিতা… হ্যাঁ, তাকে চিনি। বহু বছর আগে এখানে আসত, কবিতা লিখত, পাঠ করত। কিন্তু একদিন হঠাৎ সব ছেড়ে চলে গেল। বলেছিল, শব্দই তার একমাত্র আশ্রয়। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাইনি।”

অর্ণব ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। এত কাছে এসে আবার হারিয়ে গেল সূত্র। তবু এবার যেন একটা দৃঢ় বিশ্বাস জমে উঠল—অর্পিতা কোথাও আছেন। আর তিনি ইচ্ছে করেই পথ দেখাচ্ছেন, খাতার ভাঁজে, কবিতার রেখায়।

রাত গভীর হলো। অর্ণব আশ্রমের গেস্টহাউসে ফিরল। খাতাটা বালিশের নিচে রেখে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু ঘুম এল না।

তার কানে যেন ভেসে এল অদৃশ্য কণ্ঠস্বর—
যে খোঁজে, সে শেষ পর্যন্ত পৌঁছয়।”

অর্ণব বুঝল, তার যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। বরং আসল অধ্যায় এখনই শুরু হচ্ছে।

শান্তিনিকেতনে কাটানো রাতটা অর্ণবের মনে গভীর ছাপ রেখে গেল। ঘুম ভেঙে সকালে উঠেই সে ছুটে গেল আশ্রমের পেছনের বাগানের দিকে, যেখানে ছায়ার মতো শান্তি নেমে আসে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছিল মাটিতে, পাখির ডাক ভরে রেখেছিল চারপাশ।

অর্ণব খাতাটা আবার বের করল। পাতায় লেখা অর্পিতার লাইনগুলো চোখের সামনে নাচছিল। মনে হচ্ছিল, এই জায়গাটাই যেন অর্পিতা একসময় নিজের শব্দ রেখে গিয়েছিল।

হঠাৎ পাশের বেঞ্চিতে বসা এক বৃদ্ধা মহিলার দিকে তার দৃষ্টি গেল। সাদা শাড়ি, চোখে পুরু চশমা, হাতে একটা পুরোনো বই। অর্ণব হঠাৎ অকারণ টান অনুভব করল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“মাফ করবেন, আপনি কি এখানে পড়াতেন আগে?”

বৃদ্ধা মৃদু হেসে মাথা নেড়েছিলেন। “পড়াতাম, অনেক আগে। এখন শুধু আসি পুরোনো দিনের টানে।”

অর্ণব সাহস সঞ্চয় করে বলল, “অর্পিতা দত্ত নামে কাউকে চিনতেন?”

মহিলা বই বন্ধ করে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “অর্পিতা… হ্যাঁ, চিনি। ও খুব সংবেদনশীল মেয়ে ছিল। কবিতা লিখত, সবার সামনে পড়তও। কিন্তু জীবনে এমন কিছু ঘটেছিল যে, সে ভেঙে পড়ে। হঠাৎ একদিন সব ছেড়ে চলে গেল। আর কোনো খোঁজ পাইনি।”

অর্ণবের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। “আপনি জানেন কোথায় গিয়েছিল?”

বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন। “না। তবে মনে আছে, শেষবার যখন তাকে দেখেছিলাম, ও বলেছিল—‘আমি হারিয়ে গেলেও আমার শব্দ রয়ে যাবে।’”

অর্ণবের চোখে জল চলে এল। সত্যিই তো, শব্দের ভেতরেই তো সে বারবার অর্পিতাকে খুঁজে পাচ্ছে।

বৃদ্ধা হঠাৎ বইয়ের ভাঁজ থেকে একটা কাগজ বের করে অর্ণবের হাতে দিলেন। “এটা একদিন মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। মনে হয় অর্পিতার লেখা।”

অর্ণব হাত কাঁপতে কাঁপতে কাগজটা খুলল। তাতে লেখা—

“যদি কেউ সত্যিই আমার জন্য অপেক্ষা করে, তবে একদিন আমিই তাকে খুঁজে নেব।”

অর্ণব যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। এটা কি তবে ইঙ্গিত? অর্পিতা কি কোথাও থেকে তাকে দেখছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ জানছে?

শান্তিনিকেতনের আকাশে তখন ভেসে বেড়াচ্ছিল সাদা মেঘ। অর্ণব বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা অনুভব করল। এবার সে জানে, এই পথ তাকে আরও দূরে নিয়ে যাবে।

সে ঠিক করল, কলকাতায় ফিরে গিয়ে আবার বইয়ের শহরে ফিরবে। কারণ অর্পিতার প্রতিটি উত্তর লুকিয়ে আছে সেখানেই—পাতার ভাঁজে, অক্ষরের ফাঁকে, হয়তো এক অদৃশ্য দৃষ্টির ভেতরে।

অর্ণব কলকাতায় ফিরে এসেছিল শরতের এক সন্ধ্যায়। কলেজ স্ট্রিটের বাতাস তখনও আগের মতোই ধুলো-মাখা, কোলাহলভরা। কিন্তু তার কাছে রাস্তার প্রতিটি দোকান, প্রতিটি বই এখন যেন একেকটা চাবিকাঠি—যার ভেতর লুকিয়ে আছে অর্পিতার ছায়া।

সে আবার গেল বৃদ্ধ দোকানদারের কাছে। বৃদ্ধ তাকে দেখে অবাক হলেন না, বরং চোখ টিপে বললেন, “খোঁজ শেষ হলো?”

অর্ণব হেসে মাথা নাড়ল। “শেষ হয়নি, আরও জটিল হলো।” তারপর শান্তিনিকেতনের কথা, বৃদ্ধা শিক্ষিকার দেওয়া চিরকুটের কথা সব খুলে বলল।

বৃদ্ধ দোকানদার কিছুক্ষণ চুপ করে শুনলেন। তারপর দোকানের কোণের আলমারি থেকে একটি ছোট্ট কাঠের বাক্স বার করলেন। ধুলো মুছে বললেন, “অনেক দিন ধরে এটা রেখে দিয়েছি। ভেবেছিলাম, একদিন হয়তো অর্পিতা ফিরে আসবে। কিন্তু যখনই কেউ অর্পিতার খোঁজ করত, মনে হতো—হয়তো তারই জন্য রেখে দিই।”

অর্ণব বাক্সটা খুলতেই ভেতরে পাওয়া গেল কয়েকটা চিঠি আর কয়েকটা কবিতার খাতা। কাগজগুলো পুরোনো, কিছুটা ছেঁড়া, কিন্তু অর্পিতার হস্তাক্ষর স্পষ্ট।

প্রথম চিঠিতেই লেখা ছিল—

“আমি জানি একদিন কেউ আমাকে খুঁজবে। হয়তো অচেনা কেউ, হয়তো চেনা। আমি চলে গেলেও আমার শব্দ রয়ে যাবে। যদি সে সত্যিই খোঁজে, তবে এই পাতাগুলো তাকে পথ দেখাবে।”

অর্ণবের বুকের ভেতর যেন তোলপাড় করে উঠল। সে ধীরে ধীরে একে একে চিঠিগুলো পড়তে শুরু করল। প্রতিটি চিঠি ছিল একেকটি নিঃসঙ্গতার কাহিনি, ভাঙা প্রেমের ইতিহাস, আবার নতুন করে শুরু করার আশা।

এক জায়গায় অর্পিতা লিখেছিল—

“যে আমাকে ছেড়ে চলে গেল, সে-ই আমাকে কবিতায় বাঁচতে শিখিয়ে দিল। এখন আর ফিরে যেতে চাই না। চাই কেবল শব্দ হয়ে থাকি।”

অর্ণব দীর্ঘক্ষণ বাক্সটা বুকে চেপে ধরে রইল। তার মনে হচ্ছিল, অর্পিতা শুধু একজন মানুষ নন, তিনি এক রহস্য, যাকে ছুঁতে হলে শব্দের ভেতর ডুবে যেতে হবে।

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে অর্ণব আলো নিভিয়ে বসে রইল চিঠিগুলো টেবিলে ছড়িয়ে। অর্পিতার প্রতিটি শব্দ যেন তাকে নিজের ভেতরে নতুন আলো দেখাচ্ছে।

কিন্তু সেই আলো শুধু কাগজের নয়। অর্ণব অনুভব করল, কোথাও না কোথাও একজন মানুষ এখনও বেঁচে আছে, এখনও তাকিয়ে আছে।

হয়তো অর্পিতা সত্যিই প্রতিশ্রুতি রেখেছে—যদি কেউ সত্যিই আমার জন্য অপেক্ষা করে, তবে একদিন আমিই তাকে খুঁজে নেব।”

অর্ণব জানত, খোঁজ এখনো শেষ হয়নি। বরং শেষ অধ্যায়ের ঠিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সে।

কলেজ স্ট্রিটের আকাশে তখন শীতের হালকা কুয়াশা। বিকেলের ভিড় ক্রমশ পাতলা হচ্ছে, দোকানদাররা বই গুটোচ্ছে, বাতাসে চায়ের ধোঁয়া আর পুরোনো কাগজের গন্ধ ভাসছে। অর্ণব সেই ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুকের কাছে আঁকড়ে রেখেছিল কাঠের বাক্সটা—যেখানে অর্পিতার লেখা চিঠি আর খাতাগুলো লুকিয়ে আছে।

চিঠিগুলো পড়ার পর তার ভেতর এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছিল। যেন অর্পিতা ধীরে ধীরে তার সঙ্গে কথা বলছে, প্রতিটি শব্দে। কিন্তু সেই শান্তির মাঝেই এক প্রশ্ন তাকে পীড়া দিচ্ছিল—অর্পিতা কি সত্যিই কোথাও আছে? নাকি কেবল শব্দ হয়ে মিলিয়ে গেছে সময়ের ভাঁজে?

ঠিক তখনই কলেজ স্ট্রিটের গলির ভেতর থেকে হালকা সুর ভেসে এল—কারও কণ্ঠে কবিতার পাঠ। অর্ণব চমকে উঠে সেদিকে হাঁটল। গলির শেষে একটি ছোট্ট পাঠসভা বসেছে। কয়েকজন ছাত্রী কবিতা পড়ছে, চারপাশে মৃদু করতালি। অর্ণব চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল।

হঠাৎ এক কণ্ঠ তার বুক কাঁপিয়ে দিল। সেই সুর, সেই ভঙ্গি, যেন কোথাও শোনা… যেন চিঠির অক্ষরগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল। মঞ্চে এক মহিলা দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ছেন। বয়স চল্লিশের কোঠায়, কিন্তু চোখে-মুখে গভীর শান্তি। শাড়ির আঁচল উড়ে গিয়ে বইয়ের পাতায় লেগে যাচ্ছে।

অর্ণবের মনে হলো, এ-ই অর্পিতা।

পাঠ শেষ হলে সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। মহিলা তখন বই বন্ধ করছেন। অর্ণব কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কি… অর্পিতা দত্ত?”

মহিলা মাথা তুললেন। চোখে বিস্ময়ের ঝলক। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বললেন, “হ্যাঁ… আপনি আমাকে চেনেন?”

অর্ণব বুকের ভেতর থেকে বাক্সটা বার করল। “এগুলো আপনার লেখা। আমি আপনার বইয়ে চাপা ফুল, কবিতার লাইন খুঁজে পেয়েছি। তারপর থেকে… আপনাকে খুঁজছিলাম।”

অর্পিতা বাক্সটা দেখে নিঃশ্বাস আটকে ফেললেন। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে বললেন, “আমি ভেবেছিলাম, কেউ কোনোদিন এগুলো খুঁজে পাবে না। অথচ তুমি… সত্যিই খুঁজেছ।”

অর্ণবের চোখ ভিজে উঠল। “আপনার প্রতিটি শব্দ আমাকে টেনেছে। মনে হয়েছে, আমার নিজের জীবনও যেন আপনার কবিতার ভেতরে বাঁধা।”

অর্পিতা দীর্ঘক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদু হাসলেন। “তাহলে বুঝি সত্যি হয়েছিল আমার লেখা—‘যে খোঁজে, সে কোনোদিন একা থাকে না।’”

ভিড়ের কোলাহল মিলিয়ে যাচ্ছিল, সময় থেমে গিয়েছিল যেন। কলেজ স্ট্রিটের আকাশে আলো জ্বলতে শুরু করেছে, বইয়ের দোকানগুলো বন্ধ হচ্ছে। অথচ অর্ণব আর অর্পিতার চোখের ভেতর তখন খুলে যাচ্ছে এক নতুন গল্পের দরজা।

অর্ণব বুঝল, তার খোঁজ শেষ হয়নি। বরং শুরু হলো নতুন অধ্যায়—যেখানে শব্দের ভাঁজ থেকে উঠে আসা এক প্রেম আবার শ্বাস নিতে শুরু করবে।

আর অর্পিতা? তিনি ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিলেন অর্ণবের দিকে।
“চল, এবার আমরা নিজেরাই নিজেদের গল্প লিখি।”

***

67bb286b-fefc-4f45-b2e4-7953e326833b.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *