নির্মলেন্দু বিশ্বাস
শীতকালের শুরুটা কলকাতায় যতটা না কাঁপুনির, তার চেয়েও বেশি স্মৃতির। সকালবেলায় ঠান্ডা আলো, শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো মায়েরা, আর গরম চায়ের কাপ হাতে ভাঙা কাঁচের জানালা দিয়ে সূর্যের কুয়াশা-বাঁধা হাসি ঢুকে পড়ে ঘরে। এই শহরের অভিজাত বসতিপাড়ায় একটি তিনতলা বাড়ির প্রথম তলায় বসু পরিবার শীতের আগমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বসুদের ছেলে, আর্য, বয়স চৌদ্দ—তাকে কেউ দেখলে বলবে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা কোনো শান্ত স্বভাবের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র। তার গায়ে তখন স্কুল ইউনিফর্মের গন্ধ, মাথার চুলে ঠিকঠাক জেল, হাতে একটি কমিক্স আর টেবিলের কোণে পড়ে থাকা আধখাওয়া স্যান্ডউইচ। মা রিমা বসু, সমাজসেবায় যুক্ত, কিন্তু সামাজিক অবস্থান বজায় রেখে। সেই সকালে, শীতের হিম হাওয়ার ভেতরে রিমা কাপড়ের আলমারি খুলে পুরনো সোয়েটারগুলো নামাচ্ছিলেন। “এসব তো আর তোকে লাগবে না, আর্য,”—বলে এক নীল উলের সোয়েটার তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন, “গৃহকর্মী হামিদকে দিয়ে দিস, ওর ছেলের কাজে লাগবে।” সোয়েটারটা হাতে নিয়ে আর্য কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। এটা তার পছন্দের সোয়েটার ছিল একসময়, তার দাদু লন্ডন থেকে এনেছিলেন। এখন হয়তো টাইট হয়ে গেছে, কিন্তু স্মৃতি থেকে কি এত সহজে মুক্তি পাওয়া যায়? তারপরেও সে সেটা ভাঁজ করে রেখে দিল সাইড টেবিলের ওপর, ঠিক হামিদের হাতে দেওয়ার জন্য।
সন্ধ্যাবেলায় হামিদ এসে ঘর গুছিয়ে দিচ্ছিল, আর্য টেবিলে বসে হোমওয়ার্ক করছে, ঘরের ভেতর ফ্যান বন্ধ, কিন্তু কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে শীতের বাতাস ঢুকছে—সেই আবহে রিমা সোয়েটারটা এগিয়ে দিলেন হামিদের হাতে। “তোমার ছেলেটার গায়ে তো আজকাল খুব পাতলা জামা দেখি। ওকে এটা দিয়ে দিও।” হামিদ ধন্যবাদ জানিয়ে নিল, কিন্তু চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি একটি আশঙ্কার রেখা ছিল। সাহেব, তার ছেলে, ক্লাস সেভেনে পড়ে। খুব মেধাবী হলেও কখনো কোনো অভিজাত কিছু পরার সুযোগ পায়নি। হামিদ জানত, এটা তার জন্য একটা ‘উপকার’ হলেও, সমাজ সেটা ‘ঋণ’ হিসেবে দেখবে। পরদিন সকালে সাহেব সেই সোয়েটার পরে তার স্কুলে গেল। কিন্তু আসল ঘটনা ঘটে যখন সে তার বাবার সঙ্গে বসুদের বাড়িতে আসে—আর্যর স্কুলে কিছু জিনিস দিয়ে আসতে হবে, আর সেদিন স্কুল ছুটি ছিল বলে সাহেবও সঙ্গে এসেছিল। গেটের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায়, স্কুলের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী, বিশেষ করে নেহা ও রোহিত তাকে দেখে বলে ওঠে, “এইটা তো আর্যর সোয়েটার না?”—তারপর হাসাহাসি। একজন তো বলে বসে, “হ্যান্ড-মি-ডাউন ক্লাব!” সাহেব প্রথমে বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে তার মুখ থমকে যায়, চোয়াল শক্ত হয়। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আর্য দূর থেকে সব দেখে, কিন্তু সাহস করে কিছু বলে না। সাহেবের চোখে একটা অপরাধবোধও নেই, লজ্জাও নেই—কেবল এক অদ্ভুত নিরবতা। সে যেন বুঝে গেছে, এখানে তার কোনো সম্মানের জায়গা নেই, এই সোয়েটারটা যেন তার গায়ে ‘দয়া’র লেবেল লাগিয়ে দিয়েছে। আর্যর মুখ লাল হয়ে ওঠে, কিন্তু সে তখনও বোঝে না কীভাবে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
রাতে আর্যর ঘুম আসছিল না। সোয়েটারটা সে দেয়নি কোনো অহংকারে, কিন্তু তবু যেন আজ তার মনের ভেতর একটা ভার বসে গেছে। সেই ভারটা দয়ার সঙ্গে গর্বের টানাপোড়েন—সে কি সাহেবকে সাহায্য করেছিল, না নিজের অবস্থান থেকে নিচু একজনকে কিছু দিয়ে নিজেকে মহান ভাবছিল? অন্যদিকে সাহেব বাড়ি ফিরে সোয়েটারটা তুলে রাখে চুপচাপ। তার মাও দেখে, ছেলের চোখে আলো নেই। “কি হইছে, পছন্দ হয় নাই সোয়েটার?”—সাহেব মাথা নাড়ে, “ভালো, কিন্তু আমার গায়ে মানায় না।” সেই রাতে দুই ছেলের ঘুম হয়নি। একজন প্রশ্ন করছিল—সে কি সত্যি বন্ধু হতে পারত, না কি জন্মসূত্রে দেয়াল পেরোনোই অসম্ভব? আরেকজন ভাবছিল—মানুষ কি গায়ের পোশাকেই ছোট হয়? গল্পের প্রথম শীতে, একটি সোয়েটার হয়ে ওঠে দুই শ্রেণির মাঝে টানটান দড়ির মতো, যেখানে মানবতা, শ্রদ্ধা আর দয়া—তিনটি শব্দের মানে ভিন্ন ভিন্ন চোখে প্রতিফলিত হয়। আর্য জানতো না, সামনে এমন এক সময় আসবে, যখন এই সোয়েটারই একদিন বন্ধুত্বের সেতু হয়ে দাঁড়াবে, শ্রেণির সব ভেদাভেদ ছাপিয়ে—আর সাহেব? সে শুধু জানতো, নিজের আত্মমর্যাদা কখনো পোশাক দিয়ে মাপা যায় না।
***
সকালের আলোয় শহরের চেনা ছন্দে ভিড় জমায় বাস-অটো, স্কুলভ্যান আর ব্যস্ত অফিসপাড়ার মানুষজন, কিন্তু সাহেবের মনে সেদিন ছিল এক অদ্ভুত চাপা অস্বস্তি। আগের দিনের অপমান তাকে নিঃশব্দে নাড়িয়ে দিয়েছিল—সোয়েটারটা যেন এখন আর জামা নয়, একটা কাঁটা, যেটা গায়ে থাকলেই সে অনুভব করে কারও করুণা, আর না থাকলেই ঠান্ডা হাড়ে গিয়ে বিঁধে। কিন্তু সে তো জানত না এই সোয়েটারটা কেবল জামা নয়, এক চোখ রাঙানির চিহ্ন হয়ে থাকবে তার চারপাশে। সেই সকালে সাহেব তার নিজের স্কুলে যায়, কিন্তু মন পড়ে থাকে অন্য জায়গায়। সরকারি স্কুলের বন্ধুরা তার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়, কেউ কেউ বলে, “কিরে, দারুণ লাগছে তো আজ!” সাহেব শুধু হেসে যায়, কিছু বলে না। ভেতরে একরাশ মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সে দিনটা কাটায়। কিন্তু গল্প এগোয় যখন দুইদিন পর সে আবার আর্যদের স্কুলে আসে বাবার সঙ্গে, কারণ হামিদ সেদিন দুপুরবেলা স্কুলের ক্যান্টিনে ডেলিভারির কাজে ছিল, আর সাহেব স্কুল ছুটি থাকায় তাকে নিয়েই এসেছিল। গেটের সামনে দাঁড়ানো সাহেব এবার খুব সাধারণভাবে গায়ের সোয়েটারটা সামলে রাখতে চেষ্টা করে—যেন কেউ না দেখে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা তখনই হাসে, যখন ক্লাস সেভেনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন ছাত্র তাকে দেখে থমকে যায়। “এইটা তো বসুর সোয়েটার না?”—বলেই একজন বলে ওঠে, “দ্যাখো দ্যাখো, আমাদের স্কুলের ব্র্যান্ডেড সোয়েটার পরা বাবুর ছেলে।” চারপাশে টিপ্পনী পড়ে যায়। সাহেব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, পাশে আর্যও দাঁড়িয়েছিল, সে কিছু বলার আগেই রোহিত বলে ওঠে, “ও তো দারোয়ানের ছেলে, আর এখন আমাদের মতো দেখতে চায়!” হেসে ফেলে কয়েকজন, কেউ কেউ ছবি তুলতে চায়। সাহেব আর দাঁড়ায় না, দ্রুত সরে পড়ে।
আর্য কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকে, তার মুখ লাল হয়ে যায়, কিন্তু সে কথা বলে না। তার পায়ে যেন শেকল পড়ে গেছে, সমাজের নিয়মে বাঁধা এক ছেলের নিঃশব্দতা। স্কুলের মধ্যেই এই রকম নির্মম হাসাহাসি দেখে তার কিশোর মন বুঝে না—সে সাহেবকে সাহায্য করেছিল, না তাকে সবাইকে সামনে এনে ছোট করেছিল? সেই রাতে আর্য মায়ের সঙ্গে ডিনার টেবিলে বসে, কিন্তু কথা বলে না। রিমা বসু বুঝতে পারেন, কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করেন না, কারণ তিনি জানেন, সন্তান যখন নিজের ভিতরের প্রশ্নে ডুবে যায়, তখন উত্তর খোঁজার সময় তাকে একা থাকতে দিতে হয়। সেই রাতে আর্যের ঘুম আসে না, সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সাহেবের মুখ মনে করে—চোখের কোণে এক ধরনের লজ্জা ছিল না, ছিল এক নীরব আত্মসম্মান, যা আর্য নিজে কখনো অনুভব করেনি। অন্যদিকে সাহেব বাড়ি ফিরে সোয়েটারটা খুলে দেয়, নিজের ব্যাগের নিচে চাপা দিয়ে রাখে। সে মায়ের চোখে চোখ রাখে না, কারণ সে বুঝেছে, এই সমাজে কেউ কিছু দান করলে তাকে তা নিতে হয় মাথা নিচু করে, না হলে অপমানের দাগ লাগে। সে রাতে তার বাবাও চুপচাপ, শুধু খাবার শেষে পানির গ্লাসটা টেবিলে রাখার সময় বলেন, “মানুষের আত্মসম্মান থাকলে জগতের কোনো দান লাগে না।” সাহেব কিছু বলে না, কিন্তু তার চোখে সেই মুহূর্তে একটা প্রতিজ্ঞা জন্ম নেয়—সে আর ওই সোয়েটার পরবে না, আর কারও দয়ার বস্তু হবে না, এমনকি আর্যরও না।
পরদিন স্কুলে আর্য নিজেকে অপরাধী মনে করে। তার বুকের ভেতরে দগদগে অনুভূতি, সে চায় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে, ক্ষমা চাইতে, কিন্তু পরিস্থিতি আর সাহস তাকে কিছু করতে দেয় না। স্কুলের করিডোরে নেহা আর রোহিত আবার ঠাট্টা করে, আর্য শুনেও চুপ করে থাকে, কারণ সে বোঝে, এই সমাজ শুধু গরিবদের নয়, বিত্তবানদেরও বেঁধে রাখে অদৃশ্য শৃঙ্খলে। সে চাইলেও সব কিছু বদলাতে পারে না। সাহেব সেইদিন আর আসেনি, তবে তার অনুপস্থিতিই আর্যকে আরো বিচলিত করে তোলে। সোয়েটারটা এখন আর আর্যর কাছে পোশাক নয়, একটা বোঝা, যা তার শ্রেণি, সচেতনতা আর মনুষ্যত্বের সীমারেখা চিনিয়ে দিয়েছে। সে প্রথমবার নিজেকে জিজ্ঞেস করে—মানবতা যদি সত্যিই শ্রেষ্ঠ হয়, তবে কেন শ্রেণি অনুযায়ী আমাদের আচরণ বদলে যায়? তার বন্ধুদের চোখে সাহেব ‘অন্য’ কেন, আর সে নিজে ‘নিজের মতো’ হয়ে থাকে কেন? সেই প্রশ্ন তাকে নিয়ে যায় গল্পের মোড় ঘুরানোর পথে, যেখানে একদিন সেই সাহেবই তাকে শেখাবে, কে কাকে সাহায্য করছে, সেটা গায়ে দেওয়া পোশাকে নয়, মনের সাহসে বোঝা যায়। সোয়েটারটি তখন নতুন এক পরিচয়ের গল্প বলবে, যা কোনো ব্যঙ্গ নয়, বন্ধুত্বের অনুবাদ হয়ে উঠবে—শুধু সময়ের অপেক্ষা।
***
সেই সপ্তাহটা সাহেবের জীবনে নীরব অভিমান আর অদৃশ্য প্রতিবাদের সঙ্গে কেটেছিল। সে আর সোয়েটারটি ছুঁয়েও দেখেনি, এমনকি বস্তা ভরা পুরনো জামার ভেতর তাকে এমনভাবে গুঁজে রেখেছিল যেন তার অস্তিত্বও মুছে ফেলতে চায়। স্কুলে প্রতিদিন সাহেব পুরনো ছেঁড়া হালকা জামা পরে গিয়েছিল, যদিও শীত বেড়ে যাচ্ছিল দিন দিন। সহপাঠীরা কেউ কেউ খেয়াল করেছে, কেউ করেনি, কিন্তু সাহেবের ভেতরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা জন্ম নিচ্ছিল—সে কাউকে কিছু বলবে না, কাউকে কিছু বোঝাতে চাইবে না, শুধু নিঃশব্দে নিজের অবস্থানটা বুঝে নিতে চাইবে। তার মনে হচ্ছিল, সে আর কারও দয়ার বস্তু হতে চায় না, এমনকি আর্যর মতো কারোও না, যাকে সে শ্রদ্ধা করত, মনের গভীরে বন্ধু ভাবত। সেই শ্রদ্ধা ভেঙে না পড়লেও, তার অবস্থান বদলে গিয়েছিল। সাহেব এখন বোঝে, সমাজ দয়া নেয় না—দয়া কেড়ে নেয় আত্মমর্যাদা, যতটা না দেয় স্নেহ বা সাহায্য। আর্যও কিছু বলার চেষ্টা করেনি, কারণ তার মধ্যেও একটা টানাপোড়েন চলছিল। সে সাহেবকে ফোন করতে চেয়েছিল, কিন্তু সাহেবের তো স্মার্টফোন নেই, এমনকি বাড়ির ল্যান্ডলাইনের খোঁজও সে জানে না। স্কুলে রোহিত আর নেহার হাসাহাসি আগের মতোই চলছে, কিন্তু এবার আর্য হাসে না, বরং তার মুখে একটা অস্থির বিরক্তি স্পষ্ট হয়। তবু সে কিছু বলে না—ভয়, সামাজিক পরিচয়ের সংকোচ, কিংবা নিজের অক্ষমতার দায়ে আটকে পড়ে সে।
হামিদ কিন্তু সবই বুঝেছিলেন, চুপচাপ ছেলে দেখে উপলব্ধি করেছিলেন ঘটনাটা কতটা গাঢ়। সাহেব আর খেতে চায় না, মা জোর করলে বলে, “খিদে নেই।” চোখের পলক পড়ে ধীর, মুখের ভাষা শুকিয়ে যায়। একদিন রাতে হামিদ ছেলের মাথায় হাত রেখে বলেন, “মানুষের পোশাক বড় না, মানুষ বড়। যাদের গায়ে দামি জামা থাকে, তাদের মনেও দামি কিছু থাকে না সবসময়।” সাহেব সেই রাতে কিছু না বললেও, তার চোখে পানি জমে। সে জানে, তার বাবার চেয়ে বড় শিক্ষক এই জীবনে কেউ নেই। পরদিন সকালে সাহেব স্কুলে যাবার সময় সোয়েটারের জায়গায় একটা পাতলা ফতুয়া পরে নেয়, ঠান্ডায় কাঁপলেও মুখে একটা দৃঢ় অভিব্যক্তি থাকে। সে নিজের মেরুদণ্ডকে নত হতে দেবে না—এই তার সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে আর্য সেই সপ্তাহে প্রচণ্ড অস্থিরতায় ভুগছিল। তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—সে কি বন্ধু হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে? তার দান কি সত্যিই উপকার ছিল, না কি একটা প্রভুত্বের প্রকাশ? সে এবার সাহেবের কাছ থেকে কিছু শিখতে চাইছিল—নীরব সম্মানের পাঠ, যা সে কোনও বইয়ে শেখেনি, কোনও শিক্ষকও শেখায়নি। একদিন ক্লাসে মিস সেন যখন “মানবিক শিক্ষা” নিয়ে আলোচনা করছিলেন, আর্য তার মধ্যে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু গলার কাছে এসে থেমে গিয়েছিল শব্দগুলো।
সপ্তাহ শেষে সাহেব আর্যদের বাড়ি এলো না, হামিদ একা এসে কাজ সেরে চলে গেলেন। আর্য কেমন যেন ফাঁকা অনুভব করছিল, যেন কেউ একজন দূরে সরে যাচ্ছে, অথচ সে কাছে আসার সুযোগ পায় না। একদিন সন্ধ্যায় সাহেব বাড়ির ছাদে উঠে বসে থাকে, ঠান্ডা বাতাসে তার চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় আর্যর মুখ—যে মুখে ছিল একসময় বন্ধুত্বের ছায়া, এখন কেবল অপরাধবোধের রেখা। সে ভাবতে থাকে, “আর্য কি সত্যিই খারাপ ছেলে? নাকি ও-ও এই সমাজের নিয়মে বেঁধে পড়ে গেছে, যেমন আমি পড়ে গেছি আমার দৈন্যে?” সেই রাতে সাহেবের চোখে প্রথমবার ক্ষমা আসে—আর্যর জন্য নয়, নিজের জন্য। সে নিজেকে ক্ষমা করে, কারণ সে বুঝেছে, অপমানটা সে সহ্য করলেও নিজের অস্তিত্বে কোনও ফাটল ধরেনি, বরং নিজেকে চিনতে শিখেছে। অন্যদিকে আর্য একদিন সাহস করে বাবার সামনে এসে বলে, “বাবা, তুমি কি জানো, সাহেবকে আমি সোয়েটারটা দিইনি দান করে, আমি ওকে সত্যি ভালোবাসি একজন বন্ধু হিসেবে।” তার বাবা চমকে ওঠেন, বলেন, “বন্ধুত্ব শ্রেণি দেখে হয় না রে বাবা, হয় মনের সংযোগে।” সেই কথাগুলো আর্যের মনে গেঁথে যায়। সে ঠিক করে, পরের বার সাহেব আসলে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে সব বলবে, সব ব্যাখ্যা করবে, এবং বলবে—সে বন্ধুত্ব চায়, করুণা নয়। গল্প এখানেই নেয় এক ধীর গতির বাঁক, যেখানে দুই ছেলেই নিজেদের মধ্যেকার অদৃশ্য দূরত্ব বুঝতে শুরু করে, এবং এই বোঝার ভেতর দিয়েই জন্ম নেয় এক নতুন সম্ভাবনা—নতুন সংযোগ, যা সোয়েটারের চেয়ে অনেক গভীর, অনেক উষ্ণ।
***
শহরের শীত তখন আরও জাঁকিয়ে বসেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই কুয়াশা-ছাওয়া জানালার কাচে ঠোঁট ঠেকিয়ে নিঃশ্বাস ফেললে জলীয় বাষ্প জমে ভেতরের আঙুল দিয়ে কিছু লেখার মতো হয়ে যায়। কিন্তু আর্যর মনের কাচে যেন কেবল একটাই শব্দ জমা হয়েছে—সাহেব। স্কুলে যাবার সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বাবার বাইকে বসে সে আনমনা হয়ে পড়ে, সহপাঠীরা যখন মাঠে ক্রিকেট খেলছে তখন সে মাঠের এক কোনায় বসে থাকে। কেউ কেউ বলে, “আর্য ঠিক আছে তো?”—কেউ হয়তো খেয়াল করে না, তার চোখে চিন্তার রেখা, গলায় অপরাধবোধের ছায়া। আর্য সাহেবের সঙ্গে দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার সময় হয়ে উঠেনি। হামিদ কেবল বলে, “সাহেব ব্যস্ত স্কুলের পড়াশোনায়।” কথাটা কেমন যেন কৃত্রিম শোনায় আর্যের কাছে। সাহেব তাকে এড়িয়ে চলছে—এই অনুভবটা প্রথমবার তাকে ভিতর থেকে একটু কাঁপিয়ে তোলে। বন্ধুত্ব যে এত সহজ নয়, সেটা বুঝতে শুরু করে সে। তার মধ্যে একটা অদ্ভুত দ্বিধা কাজ করতে থাকে—সে কী করেছিল ভুল? একটা পুরনো সোয়েটার, যেটা সে ভালোবেসে দিয়েছিল, সেটা কেন অপমানের কারণ হয়ে উঠল? তার দান কি বন্ধুত্বের প্রকাশ ছিল, না শ্রেণিগত ঊর্ধ্বতাবোধের অনিচ্ছাকৃত প্রকাশ? প্রশ্নগুলো তার ভেতরে তালগোল পাকাতে থাকে। মিস সেন একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, “মানবিকতা তখনই সত্যিকারের হয়, যখন তা বিনিময়ের কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই করা হয়।” এই লাইনটা তার মাথায় বাজতে থাকে। সে কি সাহেবকে কিছু দিয়ে বন্ধু ভাবতে চেয়েছিল? তাহলে কি তার বন্ধুত্বের মানে আসলে অসম?
তবে দ্বিধার মধ্যেও আর্য ধীরে ধীরে নিজের ভেতর বদলাতে শুরু করে। সে সাহেবের অবস্থান বুঝতে শেখে, একবার রাস্তার মোড়ে ফুটপাতের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা জুতা কিনছিল, পাশেই কয়েকটা ছোট ছেলেমেয়ে বসে শীতের রাতের ঠান্ডায় কাপড় জড়ানো অবস্থায় পাঁউরুটি খাচ্ছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, তাদের গায়ের জামাগুলো পলিথিনে মোড়া, কাঁধে শীতের ছোঁয়া যেন হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তার নিজের দামী সোয়েটারের ভিতরেও একটা অস্থিরতা ঢুকে পড়ে। বাড়ি ফিরে সে একবার তার পুরনো আলমারি খুলে দেখে—কত পুরনো জামা, জুতা, জ্যাকেট, যা পড়ে না সে, শুধু জায়গা দখল করে রেখেছে। হঠাৎ এক অদ্ভুত অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করে—কেন এই সব সে নিজে রাখে, যখন কোনো একজন সাহেব তা না পেয়ে অপমানিত হতে পারে? সে চায় সবকিছু বদলে ফেলতে, কিন্তু জানে শুধু জিনিস দিয়ে বন্ধুত্ব হয় না। সত্যিকারের বন্ধুত্ব হয় চোখে চোখ রেখে বলা কথায়, যা সে এখনো বলেনি। সে সাহেবকে একদিন মুখোমুখি দেখতে চায়, কেবল বলার জন্য—“আমি ভুল করেছিলাম, আমি বন্ধু হতে চাই। তুমি কি পারো আমাকে আবার বিশ্বাস করতে?” কিন্তু সেই কথাগুলো সে গিলে ফেলছে প্রতিদিন, কারণ ভয়—যদি সাহেব মুখ ফিরিয়ে নেয়? যদি সে বলে, “আমার কোনো বন্ধুর দরকার নেই”? এই ভয়ই তাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। সাহেবকে কাছে পাওয়ার চেয়ে তার হারিয়ে যাওয়ার ভয়টাই বড় হয়ে উঠেছে।
ঠিক সেই সময় এক সন্ধ্যায় রিমা বসু, আর্যের মা, জানালার পাশে বসে চা খাচ্ছিলেন। তার চোখ পড়ে ছেলের মুখে—কোনো কিশোরের মুখে এতটা চিন্তা তার ভালো লাগে না। তিনি একটানা তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেন, “তুই ঠিক আছিস তো, আর্য?” আর্য মাথা নাড়ায়, কিন্তু কিছু বলে না। তার মা বুঝে যান, কিছু একটা ভেতরে চলছে, যা মুখে আসছে না। তিনি কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখেন, “যদি মনে করিস তুই কোনো ভুল করেছিস, তাহলে ভয় পাস না—মানুষ ভুল করবেই। কিন্তু ক্ষমা চাইতে শিখতে হয়, ক্ষমা চাইলে মানুষ ছোট হয় না। বরং তখনই বড় হয়ে ওঠে।” আর্য কেঁপে ওঠে ভেতরে ভেতরে, মনে মনে ভাবে, “তাহলে কি আমি সাহেবের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে পারি?” কিন্তু সেদিনও সে সাহস করে না। তার মধ্যে দ্বিধা বেড়েই চলে, সাহেব তাকে কী চোখে দেখে এখন? সেই পুরনো সোয়েটার আর কেবল একটা পোশাক নয়—তা যেন এক অদৃশ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মাঝখানে। তবে সেই দেয়াল ভাঙার সময় আসছে দ্রুত, এমন এক ঘটনার মাধ্যমে যা গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। সেই আগত ঝড়ের আগে দুই বন্ধু যেন তাদের ভেতরের ঝড়েই চুপচাপ, কিন্তু গভীরভাবে প্রস্তুত হচ্ছে, একে অপরের গল্পকে নতুন করে জানার জন্য।
***
সকাল থেকেই আকাশটা ভারী ছিল, যেন শহরের ওপরে কেউ ঠেলে রেখেছে এক ছাইমেঘে ঢাকা ছাতা। হাওয়া বইছিল অদ্ভুত ছন্দে—না গরম, না ঠান্ডা, কেবল অস্থির। আর্য স্কুলে যাবার আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার মনে হচ্ছিল—আজকের দিনে কিছু হবে, কিন্তু ঠিক কী হবে তা বোঝা যাচ্ছিল না। মা বারবার বলছিলেন, “গাড়ি দিয়ে যাস, হেঁটে যাবি না আজ।” কিন্তু আর্য, তার অভ্যাস মতো, রাস্তার মোড় থেকে বাস ধরেছিল। স্কুলে দিনটা মোটামুটি ঠিকঠাকই কাটছিল, ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতে একটু দেরি হয়ে যায়, আর সেই সময়েই ঝড় নেমে আসে হঠাৎ করে। সাদা সাদা পাতলা কুয়াশার মতো মেঘ, সঙ্গে দমকা হাওয়া আর বিদ্যুৎ চমক। শহরের রাস্তাগুলো যেন এক নিমেষে অচেনা হয়ে ওঠে। বাস স্টপ থেকে আর্যকে অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছিল, কারণ তাদের গলির মধ্যে গাড়ি ঢোকে না। সেই গলির কোণার দিকেই ঘটে ঘটনাটা—দুজন লোক, মুখে গামছা বাঁধা, তার পথ আটকায়। “ফোনটা দে, ব্যাগ নামা।” আর্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, বুঝে ওঠার আগেই তার কাঁধে টান, পেছনের ব্যাগ মাটিতে পড়ে যায়। সে একপা পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু কণ্ঠ আটকে আসে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, যেন অন্ধকার থেকে আলোর মত, সাহেব ছুটে আসে। হাতে একটা কাঠের ছোট বাটাম, কোনো কিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনতাইকারীদের ওপর। হাওয়া আর বৃষ্টির গর্জনের মধ্যে লড়াইটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের হলেও, সাহেবের সাহস ছিল অগাধ। এক ছিনতাইকারী বাটামটা কেড়ে নিতে চাইলে সাহেব পা দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারা দু’জনেই ভয় পেয়ে দৌড় দেয়—কেউ একজন রাস্তা থেকে হয়তো চেঁচিয়েছিল। আর্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে, ভিজে গা, চোখে জল আর বৃষ্টির মিলেমিশে বোঝাই যায় না—সে ভয় পেয়েছিল নাকি আবেগে কেঁদেছিল। সাহেব তখন দাঁড়িয়ে, হাফাতে হাফাতে বলে, “সব ঠিক তো?” আর্য শুধু মাথা নাড়ে। বৃষ্টির মধ্যে দু’জনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই প্রথম সাহেবের দিকে তাকিয়ে আর্য কোনো শ্রেণি, কোনো দয়া, কোনো ‘উপকার’ দেখতে পায় না—সে দেখে একজন সত্যিকারের বন্ধু। তাকে বাঁচাতে ঝুঁকি নেওয়া সাহসী এক মুখ। আর্য একপা এগিয়ে এসে সাহেবকে জড়িয়ে ধরে। “আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই, সাহেব,”—তার গলা ভিজে ভিজে কাঁপছিল, “আমি বুঝিনি তুমি কেমন মানুষ। এখন বুঝেছি। সোয়েটারটা নয়, তুমি অনেক বড়ো।” সাহেব কিছু বলে না, কেবল মাথা নিচু করে থাকে, যেন সমস্ত অপমান, দুঃখ, প্রতীক্ষা আর সংকোচ সেই拥抱-এর মধ্যেই গলে যাচ্ছে।
তারা ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে—আর্যর বাসার দিকেই। রাস্তায় তখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি, বাতাসে কুয়াশা আর ভেজা মাটির গন্ধ। আর্যর মা দরজা খুলে আঁতকে ওঠেন, “কি হয়েছে?”—আর্য কিছু না বলে হাত ধরে সাহেবকে ভেতরে আনে। গায়ে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে দেয়। সেদিনের রাতটা কেবল ঘটনা নয়, ছিল এক পরিবর্তনের ঘূর্ণি। রাতের খাবারের টেবিলে সাহেব প্রথমবার বসে আর্যর পাশে। আর্যর মা চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন, তারপর হাসেন—মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু চোখে বোঝা যায়, তিনি অনেক কিছু বুঝেছেন। সাহেবের পাতে খাবার বাড়িয়ে দিতে দিতে বলেন, “খুব সাহসী তুমি।” সাহেব প্রথমে মাথা নিচু করে, তারপর ধীরে ধীরে হাসে। সেই হাসি বহুদিনের ক্লেদ ভুলিয়ে দেওয়া এক অদ্ভুত মায়া। আর্য তার পাশে বসে থাকে, আর মনে মনে ভাবে—আজ যে ঝড় উঠেছিল, সেটা কেবল আকাশে নয়, তার ভিতরেও। সাহেব সেই ঝড় থেকে তাকে বাঁচিয়েছে, কেবল দুঃখ থেকে নয়, আত্মঅহঙ্কার, শ্রেণিচেতনা আর সংকীর্ণতার মায়াজাল থেকে। পুরনো সোয়েটার আর একটা পোশাক নয়—তা এখন এক নিঃশব্দ বন্ধনের গল্প।
***
পরদিন সকালের আলোটা ছিল অন্যরকম, যেন দীর্ঘ শীতের এক কুয়াশাভেজা রাত শেষে সূর্য নিজেই জানত—আজ কারও জীবনে কিছু বদলে গেছে। রিমা বসু সকালের চা হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর্য আর সাহেব তখন একই সোফায় বসে কমিক পড়ছিল। তেমন কোনো বড়ো কথা হয়নি, তবু এক অদৃশ্য আলাপে ঘরটা যেন শান্তিতে পূর্ণ ছিল। রিমা ধীরে ধীরে ভেতরে গিয়ে আলমারির ভেতর থেকে সেই পুরনো নীল সোয়েটারটি বের করলেন—যেটা সাহেব নেনি পরে, যেটা নিয়ে এত কাহিনি—আজ সেটা আর্যর হাতে তুলে দিলেন। “সাহেবকে দে এবার নিজে থেকে। এবার যেন সত্যি বন্ধুর মতো।” আর্য চুপচাপ সোয়েটারটা নিয়ে আসে, কিন্তু দেয় না সঙ্গে সঙ্গেই। দুপুরবেলা সাহেব বাড়ি চলে যাবার আগে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, পিঠে ব্যাগ, চোখে একরাশ কৃতজ্ঞতা। আর্য এগিয়ে এসে সোয়েটারটা তার হাতে দেয়, কিন্তু এবার তার চোখে ছিল অন্যরকম দৃঢ়তা। “এইটা তোকে আমি বন্ধু হিসেবে দিচ্ছি, দয়া করে না। এটা পরে আমি খুব ভালো সময় কাটিয়েছি, চাই তুইও কাটাস। এটা আমার প্রিয়, তাই তোকে দিচ্ছি।” সাহেব প্রথমে কিছু বলে না, শুধু সোয়েটারটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে আর্যর চোখে। এবার আর মাথা নিচু নয়, চোখে চোখ রেখে—সমান থেকে সমানে।
সাহেব বাড়ি ফিরে সেই সোয়েটারটা নিজের ঘরের হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখে। সে এটাকে পরার আগে এবার ঠিক করে, নিজের মতো করে ব্যবহার করবে। সন্ধ্যায় বাইরে বের হয়, আর প্রথমবার সেটা গায়ে চড়িয়ে, আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে যায়—সেই পুরনো সাহেব আর নেই, এই এক নতুন সাহেব, যে কারও দয়ায় বাঁচে না, যে নিজের সম্মান নিজের হাতে গড়ে নেয়। সোয়েটারটা গায়ে দিলে এবার আর কোনো কষ্ট আসে না—বরং এক উষ্ণতা, এক বন্ধুত্বের নির্ভরতা। পরদিন সে স্কুলে গিয়েই সবাইকে চমকে দেয়। রোহিত দেখে বলে, “আরে, আবার সেই সোয়েটার?” সাহেব এবার চুপ করে থাকে না, বলে, “হ্যাঁ, আমার বন্ধু দিয়েছে। কোনো সমস্যা?” তার স্বর এতটাই দৃঢ় ছিল, যে রোহিত একটু পিছিয়ে যায়, ঠোঁট কুঁচকে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে। নেহাও কিছু বলে না, শুধু চোখ ছোট করে তাকায়। ক্লাসে ঢুকে সাহেব নিজের ডেস্কে বসে, আর্য পাশে বসে হেসে বলে, “দারুণ লাগছে।” সাহেব হেসে ফেলে, বলে, “তুই তো বলেছিস এটা তোর প্রিয়।” সেই মুহূর্তে সোয়েটারটা হয়ে ওঠে দুই ছেলের জীবনের সবচেয়ে নির্ভেজাল সেতু—ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানের ওপারে দাঁড়িয়ে, দুটি মন একসাথে এগিয়ে চলার প্রতীক।
সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই সাহেব আর আর্য একসঙ্গে স্কুল প্রজেক্টে অংশ নেয়। তারা স্কুলের দেওয়ালে “বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধা” নিয়ে একটি চার্ট বানায়—যেখানে একপাশে ছিল পুরনো জামা, অন্যপাশে লেখা: “গায়ে যা থাকে, তা নয় মানুষের পরিচয়। সম্পর্কটাই আসল।” শিক্ষকরা অবাক হয়ে যান, সহপাঠীরাও যেন একটু নড়ে চড়ে বসে—এই দুই ছেলের মধ্যেকার বন্ধন অদ্ভুতরকম গভীর, যার শুরু হয়েছিল একটি পুরনো সোয়েটার দিয়ে, আর শেষ হলো হৃদয়ের জোড়া লাগায়। সেই সোয়েটার এখন আর একটুকরো কাপড় নয়—সেটা হয়ে উঠেছে এক পরিবর্তনের দলিল, শ্রেণীভেদের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। সাহেব আজ আর সেই বোকা ছেলেটা নয় যাকে ব্যঙ্গ করা যায়, আর্যও আর সেই নিরীহ বিত্তশালী নয় যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারা এখন একে অপরের সাহস, একে অপরের সম্মান। আর শহরের আকাশ, যা একদিন ঝড়ের দিনে সাক্ষী হয়েছিল বন্ধুত্বের জন্মের, এখন তার রোদে আলতো করে বিছিয়ে দেয় উষ্ণতা—যেখানে সোয়েটারটার আর একটাই পরিচয় থাকে: ভালোবাসা।
***
শীত ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে কলকাতা থেকে, কিন্তু আর্য আর সাহেবের বন্ধুত্ব যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠছে প্রতিদিন। তারা এখন শুধু স্কুলের বন্ধু নয়—স্কুলের বাইরেও তাদের দেখা-সাক্ষাৎ, কথা, পরিকল্পনা, এমনকি ছোট ছোট স্বপ্ন ভাগ করে নেওয়ার সম্পর্ক। সাহেব আর এখন আগের মতো চুপচাপ ছেলেটি নেই, সে প্রশ্ন করে, যুক্তি দেয়, হাসে—আর আর্য তার পাশে থেকে বুঝতে পারে, একজন বন্ধু কেবল সহানুভূতির জন্য নয়, তার নিজের উন্নতিও এনে দেয় জীবনে। স্কুলে এখন তারা বেশ পরিচিত জুটি—যেমন কেউ বললে, “প্রজেক্ট মানেই আর্য-সাহেব,” বা “এই আইডিয়াটা নিশ্চয় ওদের দুজনের মাথা থেকে এসেছে।” কিন্তু সব সম্পর্কেরই একদিন পরীক্ষা আসে—সেই পরীক্ষা এল এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে। তাদের স্কুলে একদিন হঠাৎ একটা ব্র্যান্ড স্পনসর্ড ইভেন্ট হয়—‘Winter Style Champs’ নামে। ছাত্রদের নিজেদের স্টাইল, রুচি, আর পোশাকের অভিব্যক্তির মাধ্যমে একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। যারা সেরা হবে, তাদেরকে শহরের এক বিখ্যাত ম্যাগাজিনে তুলে ধরা হবে। আর্য প্রথমে আগ্রহ দেখায়নি, কিন্তু শিক্ষকরা বললেন, “তুমি আর সাহেব তো একসাথে ভালো কাজ করো—তোমরাই পারবে।” সাহেব একটু ইতস্তত করছিল, কারণ সে জানত, এই ধরনের প্রতিযোগিতায় ‘চেহারা’র গুরুত্ব অনেক বেশি হয় ‘চরিত্র’ বা ‘বুদ্ধি’র চেয়ে। তবু তারা রাজি হয়।
প্রেজেন্টেশনের দিন তারা দু’জন মিলে তৈরি করে এক অভিনব উপস্থাপনা—যেখানে সাহেব নিজের গায়ের সেই পুরনো সোয়েটার পরে দাঁড়ায়, আর্য তার পাশে। প্রেজেন্টেশনের মূল কথা ছিল—”Fashion is not about labels, it’s about stories.” তারা বোঝায় কীভাবে এক সোয়েটার থেকে জন্ম নিয়েছে এক সম্পর্ক, কীভাবে দয়া আর শ্রেণিভেদ ছাপিয়ে দুই মানুষের মধ্যে তৈরি হতে পারে বন্ধুত্ব, আর কীভাবে পোশাক নয়, বরং সাহস, শ্রদ্ধা ও মানবতা আসল পরিচয়। প্রেজেন্টেশনের সময় দর্শক স্তব্ধ হয়ে শোনে, শিক্ষকরা মাথা নাড়েন। কিন্তু কিছু সহপাঠী—বিশেষ করে রোহিত—এবারেও হাসাহাসি থামায় না। সে বলে, “সব স্টাইল ফ্যাশনে চলে না, কিছু জায়গায় pedigree লাগে।” এই কথা শুনে আর্য দাঁড়িয়ে বলে, “তোমরা pedigree খোঁজো, আর আমরা মানুষ খুঁজি।” পুরো অডিটোরিয়ামে মুহূর্তের নীরবতা নেমে আসে। বিচারকেরাও বুঝে যান, আজকের এই দুই ছাত্র কেবল পোশাকের কথা বলেনি, তারা সমাজকে প্রশ্ন করেছে। সেই দিন বিকেলে স্কুলে ফলাফল প্রকাশ হয়—প্রথম হয় রোহিতদের দল, কিন্তু বিশেষ ‘Humanity & Innovation’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় আর্য-সাহেবকে। এই পুরস্কার কাগজে ছাপা হয়নি, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় তাদের হাসিমুখ দুটো ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল।
সেই দিন সন্ধ্যায় তারা দু’জনে বসেছিল স্কুলের মাঠে, যেখানে পুরনো বটগাছটা দাঁড়িয়ে আছে অনন্তকাল ধরে, সে জানে এই শহরের বহু গল্প। আর্য হেসে বলে, “তুই তো দেখি আমার চেয়েও ভালো বক্তা!” সাহেব বলে, “তোকে পাশে না পেলে বলতে পারতাম না।” তারা অনেক কথা বলে, কিন্তু একটা সময় চুপচাপ হয়ে যায়। নীরবতার মধ্যেও সেখানে ছিল এক গভীর সুর—মাঝে মাঝে কিছু অনুভব বলে বোঝানো যায় না, কেবল ছুঁয়ে বোঝা যায়। সাহেব তার সোয়েটারের হাতা গুটিয়ে বলে, “জানি না, এটাই কতদিন টিকবে…কিন্তু মনে হয়, আজ থেকে এই সোয়েটারটা আর ‘পুরনো’ নয়।” আর্য হেসে ফেলে, বলে, “হ্যাঁ, এটা এখন একটা ইতিহাস।” তারা যখন ঘরে ফিরছিল, শহরের বাতাসে তখন আর শীত ছিল না—কিন্তু মনের ভেতর উষ্ণতার ঢেউ ছিল। সেই উষ্ণতাই তাদের পরীক্ষায় পাস করায়—বন্ধুত্বের পরীক্ষায়, যেখানে জয় হয় হৃদয়ের, না পোশাকের; সম্মানের, না ব্র্যান্ডের। আর সেই পরীক্ষার ফল হিসেবে পুরনো সোয়েটারটা এখন হয়ে ওঠে গল্পের ‘মৌন নায়ক’—যার চুপচাপ উপস্থিতি বদলে দেয় দুই কিশোরের জীবনের ভাষ্য।
***
বর্ষা নামার ঠিক আগের সময়টায় শহরের রং বদলায়। আকাশের নীল মুছে গিয়ে ধূসরতা নামে, আর সেই ধূসরতার মাঝে যেন কোথাও লুকিয়ে থাকে নতুন শুরুর সম্ভাবনা। আর্য আর সাহেব তখন ক্লাস এইটে উঠেছে। নতুন ক্লাস, নতুন বই, নতুন কিছু মুখ, আর সেই পুরনো বন্ধুত্ব—যেটা এখন আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। স্কুলে যারা আগে ঠাট্টা করত, এখন তাদের অনেকেই সাহেবকে আলাদা চোখে দেখে—কারণ সাহেব নিজেকে প্রমাণ করেছে নিজের শক্তিতে, নিজের ভাষায়, নিজের উপস্থিতিতে। একদিন স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের সময় সাহেব নাটকে অভিনয় করে—‘একটি সোয়েটারের গল্প’—নিজের লেখা ছোট স্ক্রিপ্টে। সেখানে তার নিজের জীবনের ছায়া ছিল, কিন্তু কেউ সেটা খেয়াল করে না। নাটকের শেষে আর্য এসে মঞ্চে উঠে বলে, “এই সোয়েটার একদিন আমাকে অন্য চোখে দেখতে শিখিয়েছে। ধন্যবাদ সাহেব, আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষার জন্য।” পুরো অডিটোরিয়াম তখন করতালিতে ফেটে পড়ে। সাহেব দাঁড়িয়ে থাকে আলোর নিচে, তার গায়ে সেই পুরনো নীল সোয়েটার—যেটা এখন প্রতীক, যেটা এখন গল্পের কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু তার মুখে কোনো গর্ব নেই, আছে এক গভীর বিনয়। অনুষ্ঠানের পর সাহেবের বাবা হামিদ প্রথমবার স্কুলে আসেন ছেলের সাফল্য দেখতে, আর্যর বাবা-মায়ের সঙ্গে করমর্দন করেন। এই দৃশ্য যেন এক নতুন সমাজের ছবি—যেখানে শ্রেণি, পদবি, বাহ্যিকতা—all dissolve করে দেয় আন্তরিকতা।
এরপরের দিনগুলোতে বন্ধুত্বের ভাষা বদলায় না, শুধু বদলায় পরিবেশ। সাহেব সপ্তাহান্তে আর্যদের বাড়িতে পড়ে, তাদের আলমারিতে এখন তার জন্য আলাদা একটা বইয়ের তাক রাখা হয়। রিমা বসু তাকে ডাকেন “ছেলে” বলে। আর্য আর সাহেব একসাথে স্কুল ম্যাগাজিনের সহ-সম্পাদক হয়, তারা তাদের প্রথম যৌথ প্রবন্ধ লেখে: “কীভাবে একটা সোয়েটার বন্ধুত্ব গড়তে পারে”। সে লেখা পড়ে এক শিক্ষক মন্তব্য করেন, “এই দুই ছেলে আমাদের শেখাল, কীভাবে সমাজ বদলানো যায় কেবল একটি ইশারায়।” শহরের স্থানীয় পত্রিকাতেও একটি ছোট প্রতিবেদন বেরোয়—’Two boys, One sweater, and a bond beyond class’. একদিন রোদের দুপুরে সাহেব স্কুলের করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকে, দেয়ালে লাগানো পুরস্কার তালিকায় তার নাম দেখে। পাশে দাঁড়িয়ে আর্য বলে, “তুই কি বুঝতে পারিস, তুই আজ আমাদের স্কুলের মুখ?” সাহেব একটু হাসে, তারপর বলে, “না, আমি বুঝতে পারি আমি কার বন্ধু।” তারা হাসে, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে থাকে আত্মবিশ্বাস, যেটা কোনো সার্টিফিকেটে লেখা যায় না। তারা জানে না ভবিষ্যৎ কী নিয়ে আসবে—কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ লেখক বা শিক্ষক—but তারা জানে, যেখানেই যাক, এই সোয়েটার আর এই গল্প তাদের সঙ্গে যাবে।
এভাবেই একদিন, এক পুরনো সোয়েটার, যেটা একসময় ঠাট্টা আর অপমানের প্রতীক ছিল, হয়ে ওঠে দুই কিশোরের জীবনের দিগদর্শন। এটা কেবল একটা জামার গল্প নয়, এটা সেই সমাজের গল্প যেখানে শ্রেণির দেয়াল অদৃশ্য থাকে, কিন্তু শক্তিশালী হয়—তবে সেটা ভাঙতেও লাগে না খুব বেশি—শুধু একটুখানি মন খুলে ভালোবাসা, একটু শ্রদ্ধা, আর একটা নির্ভেজাল বন্ধুত্ব। সাহেব এখন আর নিজেকে ‘গৃহকর্মীর ছেলে’ ভাবে না, সে ভাবে সে একজন যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নিজের পায়ে, যে কাউকে সাহায্য করতে পারে, যেমন সে করেছিল ঝড়ের রাতে। আর্যও আর ‘অভিজাত স্কুলের ছেলে’ নয়, সে এক এমন ছেলে যে শিখেছে—বন্ধু হওয়া মানে সমান হয়ে পাশে থাকা, কখনো ওপর থেকে নয়। আর সেই বন্ধুত্বের ভাষা কোনো দামি শব্দে লেখা হয় না—তা লেখা হয় স্মৃতির অদৃশ্য কাগজে, সেই পুরনো সোয়েটারের মতো, যেটা যত পুরনো হয়, ততই দামি হয়ে ওঠে।
___