পুরোনো বনেদি বাড়ি শহরের একটি পুরোনি অঞ্চলেই অবস্থিত, যেখানে সময় যেন থেমে গেছে। বাড়ির প্রবেশদ্বারে পৌঁছালেই চোখে পড়ে সেই বিশাল, ত্রিমাত্রিক কাঠের দরজা, যা কালের সঙ্গে বিবর্ণ হয়ে ধূসর হয়ে উঠেছে। দরজার নক বেজে উঠলেই মনে হয় যেন অতীতের কোনো আভাস শোনাচ্ছে। বাইরে থেকে বাড়ি যতটা বড় মনে হয়, ভেতরে প্রবেশ করলে তার বিশালতা আরও প্রমাণিত হয়—দীর্ঘ, অন্ধকার করিডর, যার একপাশে ধুলো জমে থাকা অগণিত প্রতিমা স্থাপন করা। প্রতিমাগুলোর চোখ যেন জীবন্ত, মনে হচ্ছে কেউ নীরবে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভেতরের অব্যক্ত রহস্যগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। করিডরের মাঝখানে একটি পুরোনো ঝুলন্ত বাতি, যার কাঁচে ধুলো জমে রয়েছে, আর কখনো কখনো বাতির দুলে সূক্ষ্ম আলো ভেসে আসে, যা অন্ধকারের মাঝে একটি অদ্ভুত ছায়া তৈরি করে। করিডরের প্রতিটি কোণে যেন গল্পের কিছু অংশ লুকিয়ে আছে—কেউ কি কখনো চিন্তা করেছে যে প্রতিমাগুলোও ইতিহাসের সাক্ষী?
এক কোণে লোহার তালাবন্ধ একটি পুতুলবাড়ি অবস্থান করছে, যা নাতনি অনন্যার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুতুলবাড়িটি ছোট হলেও তার নকশা অত্যন্ত জটিল, জানালা ও দরজাগুলো এত নিখুঁতভাবে তৈরি যে মনে হয়, এটি শুধু খেলনা নয়, বরং একটি জীবনন্ত নগরের প্রতীক। তালা বন্ধ থাকলেও অনন্যা বারবার চেষ্টা করে, যেন জানতে চায় ভিতরের জগৎটি কি রহস্য বয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ির ধুলোয় মিশে থাকা পুরোনো ফার্নিচার, টেবিলের পাশে রাখা কুঁচকানো চিঠি, আর একপাশে ধোঁয়া নেশা মাটির প্রদীপ—সবকিছু যেন সময়ের সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত স্থিরতা সৃষ্টি করেছে। অনন্যার মনে হলো, এই বাড়ি শুধু আরেকটি স্থাপনা নয়; এটি যেন অতীতের গল্প, দাদীর কথার ছায়া আর তার নিজের কল্পনার মিলনস্থল।
প্রথমবার দাদীর কণ্ঠে বাড়িটির ইতিহাস শুনতে শুরু করল অনন্যা। দাদী বললেন, “এই বাড়ি আমাদের পরিবারের গৌরব, কিন্তু একসঙ্গে আছে অনেক গোপন রহস্যও। প্রতি পূর্ণিমায় কিছু বিশেষ ঘটে—যা কেউ চোখে দেখে না, শুধু অনুভব করে।” অনন্যা আগ্রহে চোখ বড় করে শুনছে, আর মনে মনে ভাবছে, এমন রহস্য কি সত্যিই হতে পারে? দাদী কথায় আরও বললেন, “পুতুলবাড়িটি শুধু খেলার জন্য নয়। এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি, এবং কখনো কখনো তারা আমাদের গল্প বলতে চায়।” অনন্যা বুঝতে পারল, এই বাড়ি, প্রতিমা, পুতুলবাড়ি—সবকিছু যেন জীবন্ত, যেন অতীতের ছায়া এখানে এখনো বেঁচে আছে। সেই মুহূর্তে, অনন্যার মনে হলো, সে শুধু একটি পুরোনো বাড়িতে প্রবেশ করেনি, বরং এক অদ্ভুত, রহস্যময় জগতে পা দিয়েছে, যেখানে অতীত ও বর্তমান এক হয়ে এক অদ্ভুত নীরব কথোপকথন করছে।
–
সুবর্ণলতা দেবী, যিনি পরিবারের প্রবীণ এবং ইতিহাসের জীবন্ত জ্ঞানভাণ্ডার, বসে নাতনি অনন্যার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে এমন এক অভিজ্ঞতার দীপ্তি, যা শুধুমাত্র সময় এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে আসে। বাড়ির ধুলো জমা চেয়ারটিতে বসে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “অনন্যা, এই বাড়ির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি কোণার ছায়া কেবল ইতিহাস নয়, কিছু অদ্ভুত রহস্যও ধারণ করে। বিশেষ করে, পুতুলবাড়িটি—সেখানে কখনো যেও না। ওখানে অন্য খেলা চলে, যা আমাদের চোখে দেখা যায় না।” অনন্যা প্রথমে দাদীর কথাগুলো শুধুই গল্পের মতো মনে করল। কিন্তু দাদীর কণ্ঠের গভীরতা, চোখের ধ্রুবক সতর্কতা তাকে বুঝিয়ে দিল যে, এই সতর্কবার্তা কোনো সাধারণ অযৌক্তিক ভয়ের সৃষ্টি নয়। অনন্যার কৌতূহল তখনো সীমাহীন—যতই দাদী বারণ করুক, মনে হচ্ছে সে আরও বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে পুতুলবাড়ির দিকে, যেন কোনো অদ্ভুত শক্তি তাকে টানে।
দিনের আলো বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময়, অনন্যা পুতুলবাড়ির দিকে বারবার চোখ বুলাতে থাকে। ধুলোয় মোড়ানো জানালা, কুঁচকানো চিঠি এবং কোণে রাখা অদ্ভুত পুতুলগুলো যেন তার দিকে নিঃশব্দে হেঁটে আসে। দাদী যতই বলুন, “পুতুলবাড়িতে প্রবেশ মানে নিজের জন্য ঝুঁকি নেয়া,” ততই অনন্যা ভাবতে থাকে, সেখানে কী ধরনের ‘অন্য খেলা’ চলে, যা শুধুমাত্র দাদী জানেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগমনে, বাড়ির করিডরের অন্ধকার কোলাহল এবং বাতির নরম আলো যেন পুতুলবাড়ির প্রতি আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়। অনন্যা অনুভব করে, যেন পুতুলবাড়ি কেবল একটি খেলার জায়গা নয়, বরং এক জগৎ যেখানে অতীতের প্রতিমা, দাদীর স্মৃতি, এবং অদৃশ্য শক্তিগুলো একত্র হয়ে কোনো নীরব খেলায় লিপ্ত। তার কল্পনার ভেতর সেই খেলার চিত্র ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে—পুতুলগুলো যেন শুধু বসে নেই, তারা চোখে দেখা যায় না এমন কোনো গতিশীল জীবনের ছায়া বহন করছে।
দাদীর সতর্কবার্তার মধ্যেই অনন্যার মনে হয়, পুতুলবাড়িটি হয়তো কোনো ভয়ঙ্কর নয়, বরং এক অদ্ভুত রহস্যের কেন্দ্র। তিনি ভাবেন, প্রতিদিনই যে গল্পগুলো দাদী বলতেন—যেখানে প্রতিমাগুলো আচমকাই কিছু নীরব নড়াচড়া করত, কোণার বাতি অদ্ভুতভাবে ঝলমল করত—তাতে কি সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি লুকিয়ে আছে? দাদী সতর্কবার্তা দিলেও, অনন্যার মনে তারেক্তার কৌতূহল চুপ করতে পারছে না। বরং সে প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অদ্ভুত আলোকে নিজের চোখে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। মনে মনে সে ঠিক করে, একদিন সঠিক মুহূর্তে সে জানবে, পুতুলবাড়িতে কি সত্যিই সেই ‘অন্য খেলা’ চলে, এবং সেই রহস্য কি শুধু অতীতের স্মৃতি, নাকি এটি সত্যিই জীবন্ত কোনো অদ্ভুত শক্তির খেলা। এই চিন্তা অনন্যাকে রাতের অন্ধকারেও স্বপ্নে টানে, যেখানে পুতুলবাড়ির ছোট জানালার আলো যেন তাকে নিঃশব্দে আহ্বান করছে, আর কৌতূহল ক্রমশ ভয়কে অতিক্রম করছে।
–
পূর্ণিমার রাত ছিল শান্ত, কিন্তু বনেদি বাড়ির ভেতরের করিডরগুলো যেন অন্য কোনো জীবনের উপস্থিতিতে কম্পমান। অনন্যা তার রুমের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো পড়তে দেখছিল, যখন হঠাৎ করিডরের একপাশ থেকে হালকা হাসির শব্দ ভেসে এলো। শব্দটি ছিল মৃদু, সরল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্বাভাবিক—যেন কোনো শিশু বা পুতুল নিজেই কণ্ঠ ছাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে অনন্যা পায়ের শব্দও শুনতে পেল, ছোট ছোট, মৃদু পদক্ষেপ যা যেন কারো নরম পা ধীরে ধীরে করিডরের ধূলোর ওপর চলছিল। প্রথমে সে ভেবে নিল যে, হয়তো তার কল্পনা বা বাতির দোলনের ছায়াই এমন কিছু ইলিউশন তৈরি করছে। কিন্তু শব্দগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল, করিডরের প্রতিটি কোণ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, আর হাসির ধ্বনিতে এক অদ্ভুত আনন্দের ছায়া ঘরের মধ্যে ভেসে উঠল। অনন্যা অনুভব করল, এই হাসি কেবল শব্দ নয়, বরং একটি অনুভূতি—যা তাকে ঘিরে ধরে, হৃদয়ের সঙ্গে খেলছে, এবং এক অদ্ভুত আতঙ্কের মতোই এক অব্যক্ত উত্তেজনা জাগাচ্ছে।
পরিবারের অন্য সদস্যরা এই অদ্ভুত ঘটনার প্রতি অমনোযোগী বা অবিশ্বাসী। সকলে হাসি শুনলেও তুচ্ছ মনে করে। কিন্তু মায়ের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন—মা মৌসুমী, যিনি সাধারণত খুবই ধৈর্যশীল ও বাস্তবমুখী, হঠাৎ ভীত হয়ে ওঠেন। তার চোখে এক অদ্ভুত দুশ্চিন্তার ছায়া, শরীর খানিকটা কাঁপতে শুরু করে। তিনি অনন্যাকে ধীরে ধীরে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, “অনন্যা, হয়তো কিছু নেই, তবে ভালো হয় তুমি আজ রাতে একা বের হইও না।” মায়ের ভীত প্রতিক্রিয়া অনন্যার মনকে আরও দ্বিধাগ্রস্ত করে—একদিকে তার কৌতূহল, অন্যদিকে ভয়ের অনুভূতি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অনন্যা বুঝতে পারে, হাসির শব্দ এবং পায়ের নীরব পদক্ষেপগুলো সম্ভবত কোনো সাধারণ কারণ নয়; এতে কিছু অদৃশ্য শক্তি বা অতীতের ছায়া লুকিয়ে থাকতে পারে।
রাতের অন্ধকার বাড়ির ভেতরে ক্রমশ ঘন হতে থাকে। হাসির শব্দ মাঝে মাঝে হঠাৎ থেমে যায়, আবার কখনো দূরের করিডরের বাঁক থেকে নতুন করে ভেসে আসে। অনন্যা নিজেকে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও প্রতিটি শব্দ তার কল্পনাকে জাগ্রত করছে—প্রতিমা যেন চোখ খুলে তাকাচ্ছে, পুতুলবাড়ির তালাবদ্ধ জানালা যেন এক নীরব দিক নির্দেশ করছে। সে ধীরে ধীরে অনুভব করল, এই হাসি শুধুই কোনো অবাস্তব কল্পনা নয়; বরং এটি এক জীবন্ত গল্পের অংশ, যা ঘরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছায়া, এবং প্রতিটি অতীতের স্মৃতি বহন করছে। অনন্যা জানল, এই পূর্ণিমার রাত তাকে শুধু ভয় দেখাতে নয়, বরং এক নতুন রহস্যের দরজা খুলে দিয়েছে, যা তাকে পুতুলবাড়ি ও তার অদ্ভুত খেলাগুলোর দিকে আরও আকৃষ্ট করছে, এবং সে জানে, একদিন তাকে এই রহস্যের মুখোমুখি হতে হবে, সেই হাসির শব্দের উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
–
অরিন্দম, অনন্যার বাবা, ছিলেন সেই ধরনের মানুষ যিনি জীবনের সবকিছুকে যুক্তি এবং বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন। বনেদি বাড়ির রহস্যময় ঘটনার কথা অনন্যা তার কাছে বললেই তিনি হেসে উড়িয়ে দিতেন, বলতেন, “অনন্যা, এসব কল্পনা এবং অদ্ভুত শব্দ শুধু তোমার কল্পনার খেলা। পূর্ণিমার আলো, ধূলোমাখা করিডর, এবং রাতে হাওয়া—সবই মনে হয় অদ্ভুত, কিন্তু বাস্তবে কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে না।” তিনি বারবার অনন্যাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই, শুধু ঘরের পরিবেশ এবং রাতের ধোঁয়া-আলোই তার মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করছে। অনন্যা প্রথমে বাবা যখনই হাসির শব্দ, পুতুলবাড়ি বা ধুলোমাখা প্রতিমাগুলো নিয়ে কিছু বলতেন, তাতে তার নিজের কল্পনার প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেছিল। তবে প্রতিবারই যে অনুভূতি ঘুম ভাঙার মতো প্রকৃত—তাতে সে বুঝতে পারল, এখানে কিছু অদ্ভুত এবং অমীমাংসিত রহস্য আছে, যা যুক্তি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
অরিন্দমের অবিশ্বাস অনন্যার মনকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। প্রথমে সে কেবল মৃদু কৌতূহল বোধ করলেও, বাবা যে প্রতিটি ঘটনার উপর ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তা তাকে ক্রমশ রাগান্বিত করল। মনে হলো, বাবা তার অনুভূতি ও আতঙ্ককে ছোট করে দেখছেন, অথচ সে স্বীকার করতে চায়, প্রতিটি হাসির শব্দ, পায়ের নীরব পদক্ষেপ, পুতুলবাড়ির তালাবদ্ধ জানালার অদ্ভুত আলো—সবই এক ধরনের সত্যিই ঘটে যাওয়া ঘটনা। রাগ এবং উত্তেজনার মধ্য দিয়ে অনন্যা সিদ্ধান্ত নিল, আর কেউ তাকে বাধা দিক না কেন, সে নিজের চোখে ঘটনার রহস্য উন্মোচন করবে। রাতের অন্ধকার এবং ঘরের প্রতিটি কোণ যেন তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল, আর সে বুঝল, এই অদ্ভুত পরিস্থিতি তার কৌতূহলকে আরও উস্কে দিচ্ছে।
একটি নির্দিষ্ট রাত, অনন্যা চুপচাপ ঘরে বসে পরিকল্পনা করল। সে ভাবল, পুতুলবাড়ি, ধুলোয় মোড়ানো প্রতিমা এবং করিডরের অদ্ভুত হাসি ও পদক্ষেপগুলো নিজেই পর্যবেক্ষণ করবে। বাবার অবিশ্বাস এবং মায়ের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে সে ভাবল, বাস্তবিক ঘটনা খুঁজে বের করা তার নিজের দায়িত্ব। সে টর্চ লাইট নিয়ে করিডরের দিকে এগোল, চোখ কপাল ঘেঁষে প্রতিটি কোণ লক্ষ্য করল, ধূলোমাখা প্রতিমাগুলোকে সরিয়ে, পুতুলবাড়ির তালা স্পর্শ করল, যেন জানতে চায় সেখানে কি আছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি অদ্ভুত আলোর দোলন তাকে আরও গভীরে টেনে নিল। অনন্যা বুঝতে পারল, শুধু তার কৌতূহল নয়, বরং সাহসই তাকে এই রহস্যের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। রাতের নিঃশব্দতা, করিডরের দীর্ঘ সুরক্ষিত প্রান্ত, এবং পুতুলবাড়ির অদ্ভুত উপস্থিতি—সবকিছু মিলিয়ে অনন্যার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং এক অদম্য প্রত্যয় জন্মাল, যা তাকে নিজেই অনুসন্ধান চালাতে প্ররোচিত করল, যেন সে জানতে চায়, সত্যিই কি এই বাড়ি এবং তার রহস্যময় বস্তুগুলো জীবন্ত।
–
রাতের অন্ধকার ঘন, চাঁদের আলো বাড়ির করিডরের ধুলোমাখা প্রাচীরে হালকা ছায়া ফেলছে। অনন্যা, যাকে কৌতূহল এবং রাগ একসাথে টানে, চুপচাপ পুতুলবাড়ির দিকে এগোতে থাকে। হাতের ছোট্ট টর্চ লাইট তার পথ আলোকিত করছে, আর প্রতিটি পদক্ষেপে ধূলোর গন্ধ এবং পুরোনো কাঠের ঘ্রাণ তাকে অতীতের এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। তালা, যা বহু বছর ধরে অচল এবং অদৃশ্য রহস্যের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, অনন্যা নিজের ছোট হাত দিয়ে ধীরে ধীরে ভাঙে। তালা ভেঙে গেলে পুতুলবাড়ির দরজা চুপচাপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা নীরব শক্তি যেন তাকে স্বাগত জানায়। ভিতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য তার চোখের সামনে প্রকাশ পায়—শত শত পুতুল, প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন পোশাক, ভিন্ন ভিন্ন মুখাবয়ব, যেন তারা জীবন্ত হয়ে শ্বাস নিচ্ছে। অনন্যার মনে হলো, এই পুতুলগুলো শুধু কাঠ বা কাপড়ের তৈরি নয়; বরং এরা যেন এখানে বসবাসকারী জীবনের নিদর্শন, যাদের চোখে নীরবতার সঙ্গে কোনো গল্পের ছায়া ভাসছে।
অনন্যা ধীরে ধীরে পুতুলবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, প্রতিটি পুতুলের দিকে তাকিয়ে সে নিজের কল্পনাকে বাধা দিতে পারছে না। হঠাৎ, এক লাল জামার পুতুল তার দিকে তাকালো। পুতুলটির মাথা ধীরে ধীরে ঘুরে অনন্যার দিকে চোখ রাখল—এক অদ্ভুত জীবনানুভূতি, যা শুধু কাঠের পুতুল থেকে আসতে পারে না। অনন্যা কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেল, মনে হলো হৃদয় ধীর গতিতে কম্পিত হচ্ছে। পুতুলটির চোখে এক অদ্ভুত বুদ্ধিমত্তা এবং এক ধরনের চাওয়া-অনুরোধের ছায়া, যা অনন্যাকে এক রকম মুগ্ধ এবং ভীত zugleich অনুভূতি দেয়। সে বুঝতে পারে, এই পুতুল কেবল একটা খেলনা নয়; বরং এটি এক অদ্ভুত রহস্যের প্রথম জীবন্ত সাক্ষী। চারপাশে থাকা অন্যান্য পুতুলও যেন চুপচাপ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে, তাদের নীরব উপস্থিতি অনন্যাকে আরও সতর্ক এবং আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য করছে।
অনন্যা লক্ষ্য করল, পুতুলবাড়ির ভেতরের বাতাসেও এক অদ্ভুত গতিশীলতা আছে—ছোট ছোট পদক্ষেপের শব্দ, হালকা হাওয়ার দোলা, এবং অদ্ভুত হাসির নীরব ধ্বনি মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করছে। লাল জামার পুতুলটি অনন্যার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য স্থির থাকে, যেন সে অনন্যাকে কোনো বার্তা দিতে চাইছে। অনন্যার হৃদয়ে অদ্ভুত এক উত্তেজনা, ভয়, এবং কৌতূহলের মিশ্রণ তৈরি হয়। সে বুঝতে পারে, এই রাত এবং এই প্রথম সাক্ষাৎ তাকে এক নতুন জগতে প্রবেশ করিয়েছে, যেখানে প্রতিটি পুতুল, প্রতিটি শব্দ, এবং প্রতিটি ছায়া কোনো না কোনো রহস্যকে ধারণ করছে। রাতের নীরবতা, পুতুলবাড়ির অদ্ভুত উপস্থিতি, এবং লাল জামার পুতুলের জীবনানুভূতিময় চোখ—সবকিছু মিলিয়ে অনন্যাকে বার্তা দিচ্ছে যে, সে শুধুমাত্র দর্শক নয়; তার এই প্রথম পদক্ষেপ এক অদ্ভুত, রহস্যময় খেলায় তাকে অংশগ্রহণকারী হিসেবে পরিচিত করছে।
–
অনন্যা পুতুলবাড়ির ভিতরে আরও গভীরে প্রবেশ করতেই আশেপাশের পরিবেশ ক্রমশ বদলাতে থাকে। প্রথমে সে বুঝতে পারে না, তবে হঠাৎ পুতুলগুলো নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে শুরু করে। ছোট ছোট কাঠের হাত এবং পা অদ্ভুতভাবে নড়তে লাগল, আর প্রতিটি মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। বাতির নরম আলোয় প্রতিটি পুতুল যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অনন্যা সঙ্কোচভরে পিছলে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার কৌতূহল অদ্ভুতভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে। হঠাৎ করিডরের ধূসর কোণ থেকে নীরব নাচের সুর শোনা যেতে লাগল—পুতুলগুলো একসাথে ধীরে ধীরে নাচ শুরু করল। তাদের ছোট ছোট পা তালের সঙ্গে মিলিয়ে ঘুরছে, ঘুরপাক খাচ্ছে, আর অদ্ভুতভাবে হালকা হাওয়ার দোলনে তাদের রং পরিবর্তন হচ্ছে। অনন্যার হৃদয় দ্রুত ধুকছে, কেবল ভয় নয়, বরং এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং কৌতূহলও তার মনে প্রবাহিত হচ্ছে। পুতুলগুলোর হাওয়ায় ভেসে আসা নরম গানের সুর যেন তার কানে আসছে, এক অদ্ভুত মোহময় এবং রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
তার চোখ তখনই এক বিশেষ পুতুলের দিকে যায়—রানী পুতুল, লাল ও সোনালী রঙের ঐশ্বর্যপূর্ণ পোশাক পরে, সোনালী মুকুট মাথায় মাথায় ঝলমল করছে। রানী পুতুল তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, যেন কোনো নিঃশব্দ আহ্বান পাঠাচ্ছে। অনন্যার মনে হলো, এটি শুধু একটি পুতুল নয়, বরং এক জীবন্ত সত্তা, যা খেলোয়াড়কে খেলার মধ্যে প্রবেশ করতে ডেকে নিচ্ছে। হঠাৎ রানী পুতুলের ছোট্ট মুখে অদ্ভুতভাবে কথা শোনা গেল, “অনন্যা, খেলায় যোগ দাও। তবে মনে রেখো, এই খেলার নিয়ম কঠোর—হারলে, তুমি আর পলকে ফিরে আসবে না। তুমি আমাদের মতো পুতুল হয়ে যাবে।” অনন্যার মনে এক অদ্ভুত শিহরণ ভেসে এল; সে বুঝল, এটি কোনো সাধারণ খেলা নয়। প্রতিটি পুতুল, প্রতিটি নাচের তাল, প্রতিটি সুর—সবই এক অভিশপ্ত খেলায় তাকে টানছে।
অনন্যা কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে ভাবল—কীভাবে সে এই খেলায় অংশ নেবে, আর কীভাবে ফিরে আসবে। পুতুলদের নাচ, গান এবং নীরব আহ্বান তাকে ক্রমশ প্রবলভাবে আকৃষ্ট করল। রানী পুতুল ধীরে ধীরে অনন্যার দিকে এগোচ্ছে, হাতে ছোট্ট সোনালী ব্যাজ, যেন খেলার সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছে। অনন্যা বুঝল, এই অভিশপ্ত খেলায় অংশ নেওয়া মানে শুধু খেলার আনন্দ নয়, বরং এক জীবন্ত এবং বিপজ্জনক রহস্যের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া। হাওয়ার দোলন, নরম আলো, নৃত্যরত পুতুল এবং গান—সবকিছু মিলিয়ে অনন্যার মনে এক অদ্ভুত আতঙ্ক এবং কৌতূহলের মিশ্রণ তৈরি করছে। সে জানে, এই রাতের খেলাই তার প্রথম পদক্ষেপ এক নতুন জগতে, যেখানে হার মানা মানে পুতুল হয়ে যাওয়া, আর জয় মানে অদ্ভুত রহস্যের জগতের একটি অংশ হয়ে ওঠা। অনন্যা ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে রানী পুতুলের কাছে এগোতে থাকে, তার চোখে আতঙ্ক আর আগ্রহের মিলিত জ্বলন, যেন সে প্রস্তুত—একটি অভিশপ্ত খেলায় প্রবেশ করতে, যা তাকে চিরকাল বদলে দিতে পারে।
–
সুবর্ণলতা দেবী এক সন্ধ্যায় অনন্যাকে ডেকে বসালেন, এবং গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে অতীতের গল্প শোনাতে শুরু করলেন। অনন্যার চোখে আগ্রহ আর ভয়ের মিশ্রণ, আর তার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত নীরব প্রত্যাশা—সে জানতে চাইছে, কেন পুতুলবাড়ি এত রহস্যময়। দাদী বললেন, “অনন্যা, আমি যখন তোমার বয়সের ছিলাম, তখনও এই বাড়ির প্রতিটি কোণ ছিলো এক অদ্ভুত জগত। রাতের অন্ধকার, ধুলো জমা প্রতিমা, আর পুতুলবাড়ি—সবই যেন প্রাণবন্ত। আমার বড় বোন, যাকে আমরা দাদা-মামারা খুব ভালোবাসতাম, এক রাতে খেলার সময় সেখানে হারিয়ে গিয়েছিল।” অনন্যার চোখ বড় হয়ে গেল; সে কেবল গল্পের মধ্যে ভেসে থাকেনি, বরং বুঝতে পারল যে, এই রহস্য শুধু অতীতের নয়, বরং এখনো জীবন্ত। দাদীর চোখে এক অদ্ভুত দুঃখের ছায়া, আর কণ্ঠে এক মৃদু কম্পন—যা প্রমাণ করে, এই ঘটনা তার জীবনের সবচেয়ে গভীর ও অমীমাংসিত স্মৃতি।
দাদী অব্যক্তভাবে বললেন, “আমরা অনেক খুঁজেছি, ডাক দিয়েছি, কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। মনে হয়েছে, সে শুধু অদৃশ্য হয়ে গেছে। পরে বুঝেছি, পুতুলবাড়ি তার আবাস। সে হারিয়েছে নিজের মানুষ হওয়ার পরিচয়, আর সেই রাত থেকেই সে এই অভিশপ্ত খেলার অংশ হয়ে গেছে। আমাদের জন্য এটি এক ভয়ঙ্কর সত্য, কিন্তু তোমার জন্য এটি শিক্ষণীয়—পুতুলবাড়ির রহস্য সত্যিই জীবন্ত, এবং সেখানে প্রবেশ মানে শুধু কৌতূহল নয়, বরং বিপদও।” অনন্যার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বুঝল, এই রহস্যের মূলে শুধু পুতুল নয়, বরং একটি হারানো আত্মার গল্প লুকিয়ে আছে। দাদীর কথা অনন্যার মনের গভীরে অদ্ভুতভাবে বাজছে—একদিকে ভয়, অন্যদিকে সেই হারানো বোনের জন্য সহমর্মিতা এবং উৎসাহ। সে অনুভব করে, পুতুলবাড়ি শুধু একটি খেলনার জায়গা নয়; এটি এক অতীতের বন্দী আত্মার আবাসস্থল, যা এখনও নিঃশব্দে জীবন ধারণ করছে।
রাতের নিস্তব্ধতায় অনন্যা বসে থাকে, আর দাদীর স্মৃতিচারণের প্রতিটি শব্দ তার মনে গভীর ছাপ ফেলে। সে ভাবতে থাকে, কিভাবে তার দাদী ছোটবেলায় সেই অভিশপ্ত খেলার সাক্ষী হয়েছিল। সে কল্পনা করে যে, তার দাদীর বড় বোন কেমনভাবে পুতুলবাড়ির ভেতরে হারিয়ে গিয়েছিল, পুতুলদের নাচ-গান, এবং রানী পুতুলের আহ্বান—সবই তাকে নিজস্ব খেলার মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। অনন্যা উপলব্ধি করে, এই রহস্যের সামনে তার পদক্ষেপ শুধু কৌতূহল নয়, বরং সাহসের পরীক্ষা। দাদী তার অতীতের স্মৃতির আলোকে ভাগ করে নিলেন, যেন অনন্যা বুঝতে পারে—প্রতিটি পুতুল, প্রতিটি খেলার নিয়ম, এবং প্রতিটি হাসির শব্দ শুধু খেলনা নয়; এতে লুকানো আছে হারানো আত্মার গল্প, এবং অনন্যা সেই গল্পের সাক্ষী হয়ে যাওয়া তার পরবর্তী দায়িত্ব। এই রাতের আলোয়, অনন্যার মনে এক অদ্ভুত প্রতিশ্রুতি জন্মায়—সে সত্যটি জানতে চায়, এই অভিশপ্ত খেলা থেকে হারানো আত্মাকে উদ্ধার করতে চায়, আর পুতুলবাড়ির অদ্ভুত রহস্যের গভীরে নিজেকে সমর্পণ করতে প্রস্তুত হয়।
–
এক সকালে বনেদি বাড়ির ভেতর অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছিল, ঠিক তখনই অর্ণব নামের এক তরুণ গবেষক বাড়িতে প্রবেশ করল। সে নিজেকে পরিচয় করাল, বলল যে সে পুরোনো অতিপ্রাকৃত ঐতিহ্য এবং অতীতের অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে গবেষণা করে। অনন্যা প্রথমে কিছুটা আশ্চর্য হলেও তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। অর্ণবের চোখে কৌতূহল এবং জ্ঞানের দীপ্তি ছিল, যা দেখে অনন্যা বুঝতে পারল, এই মানুষটি শুধু ইতিহাসের গল্প বলে না, বরং সে সত্যের খোঁজে এসেছে। অর্ণব ধীরে ধীরে বাড়ির প্রতিটি কোণ, করিডর, ধুলো জমা প্রতিমা এবং পুতুলবাড়ির দিকে নজর দিতে থাকে। সে পুরোনো পুঁথি, খতিয়ান এবং পরিবারের সংরক্ষিত নথিপত্র ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে। অনন্যা নিজের চোখে দেখল যে, অর্ণব শুধু রূপকথার ভ্রান্তি উড়িয়ে দিচ্ছে না; বরং সে বাস্তব তথ্যের আলোকে পুতুলবাড়ির রহস্য উন্মোচন করতে চাচ্ছে।
অর্ণবের গবেষণার মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটি চমকপ্রদ সত্য প্রকাশ পেতে থাকে। সে বলল, “এই পুতুলগুলো কেবল খেলনা নয়। শতবর্ষ আগে এখানে কিছু শিশু বাস করত, যারা হঠাৎ মৃত্যু বরণ করেছিল, কিন্তু তাদের খেলা কখনও শেষ হয়নি। এই অপূর্ণ খেলার কারণেই তাদের আত্মা এই পুতুলগুলোর মধ্যে আবদ্ধ হয়েছে। তাই প্রতি পূর্ণিমার রাতে, এই পুতুলগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, নাচ-গান করে, আর অনুরোধ জানায়—যাদের খেলা অসম্পূর্ণ তারা ফিরে আসার চেষ্টা করছে।” অনন্যা হতবাক হয়ে শুনল। সে আগে কখনো ভাবেনি যে, পুতুলবাড়ি এবং তার অভিশপ্ত খেলা কেবল অতিপ্রাকৃত রহস্য নয়; বরং এখানে এক শতবর্ষ পুরোনো মানবিক কাহিনী লুকিয়ে আছে—শিশুদের অপূর্ণ খেলনা এবং তাদের আত্মার অস্থিরতা। অর্ণবের কথায় অনন্যার মনে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি জাগল—ভয়, কৌতূহল, এবং সহানুভূতির এক অদ্ভুত মিলন।
রাতের নিস্তব্ধতায় অর্ণব এবং অনন্যা একসাথে পুতুলবাড়ির প্রতি নজর দিল। অর্ণব দেখাল পুরোনো নথি, যেগুলোতে লেখা আছে প্রতিটি পুতুলের নাম, তার ছোট মালিকের নাম, এবং কীভাবে তারা হঠাৎ এই জীবন্ত অবস্থায় আবদ্ধ হল। অনন্যা বুঝল, প্রতিটি পুতুল কেবল কাঠের তৈরি নয়; এতে রয়েছে এক শিশু আত্মার প্রতিফলন, যাদের খেলা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। অর্ণব বলল, “যদি আমরা তাদের খেলার চূড়ান্ত সমাধান করতে পারি, তাদের অপূর্ণতা পূর্ণ করতে পারি, তাহলে এই অভিশপ্ত খেলা শেষ হবে, আর পুতুলবাড়ি শান্তি ফিরে পাবে।” অনন্যা সিদ্ধান্ত নিল, সে এই রহস্যের সঙ্গে যুক্ত হবে, শিশুদের আত্মাকে মুক্ত করতে চেষ্টা করবে, আর পুতুলবাড়ির অতিপ্রাকৃত অভিশপ্ত খেলাকে সমাধান করবে। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে অনন্যা বুঝল, কৌতূহল এবং সাহস শুধু তার নিজের জন্য নয়; বরং এটি শতবর্ষের অতৃপ্ত আত্মার মুক্তির চাবিকাঠি, যা তাকে এক নতুন অভিযান এবং দায়িত্বের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।
–
বনেদি বাড়ির ভেতরে রাতের অন্ধকার আরও ঘন এবং ভীতিকর হয়ে উঠেছে। চূড়ান্ত পূর্ণিমার রাত এসে গেছে, আর পুতুলবাড়ির ভিতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছে। অনন্যা নিজের কণ্ঠে নীরবতা বজায় রেখে, টর্চের আলো নিয়ে করিডরে এগোচ্ছে। হঠাৎ, পুতুলগুলো একত্রে নড়তে শুরু করে। ছোট ছোট কাঠের হাত, মুখ, এবং পা ধীরে ধীরে সারা ঘর জুড়ে প্রাণ পায়। শুধু নাচ নয়, পুতুলগুলোর সঙ্গে হঠাৎ এক অদ্ভুত হাসি এবং কান্নার মিশ্রণ শোনা যেতে শুরু করে—যেন আনন্দ আর দুঃখ একইসঙ্গে ঘরের মধ্যে ভেসে আসছে। অনন্যার হৃদয় দ্রুত কম্পিত হচ্ছে, ভয় এবং কৌতূহল একসঙ্গে তার মনে ভাসছে। সে বুঝতে পারল, এই রাতের শক্তি আগের রাতের সঙ্গে তুলনাহীন—এখানে পুতুলের নাচ, হাসি এবং কান্না মিলিত হয়ে এক অভিশপ্ত শক্তি তৈরি করেছে, যা তাকে আটকে রাখছে।
অনন্যা নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে চাইলেও, পুতুলগুলো যেন তার চারপাশে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাধা দিচ্ছে। তার চোখের সামনে লাল জামার রানী পুতুল ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, চোখে অদ্ভুত জীবনানুভূতি। অর্ণব দ্রুত ধাওয়া করে তার কাছে আসে, আর দাদী, সুবর্ণলতা দেবী, সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের জন্য এগোয়। তারা একসঙ্গে অনন্যার দিকে এগিয়ে আসে, প্রতিটি ধাপ যতটা সম্ভব সাবধানে, যেন পুতুলগুলোর ক্রোধকে বাড়াতে না পারে। অনন্যা দাদী ও অর্ণবকে দেখে কিছুটা সাহস পায়, কিন্তু পুতুলগুলোর শক্তি এতটাই প্রবল যে, তা সহজে নিয়ন্ত্রণে আসে না। হাসি আর কান্নার ধ্বনি, নৃত্যরত পুতুল এবং বাতির নরম দোলন—সব মিলিয়ে অনন্যাকে এমন এক জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সময় এবং বাস্তবতার সীমা যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।
দাদী এবং অর্ণব সব শক্তি দিয়ে অনন্যাকে পুতুলগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করে। অর্ণব পুরোনো পুঁথির নির্দেশ অনুযায়ী পুতুলগুলোর খেলার সমাধান খুঁজে বের করতে লাগল, আর দাদী তার অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যবহার করে অনন্যাকে নিরাপদ স্থানে রাখল। পুতুলগুলো ক্রমশ তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে থাকে, আর হাসি ও কান্নার মিশ্রণ আস্তে আস্তে শান্ত হতে শুরু করে। অনন্যা বুঝতে পারল, এই চূড়ান্ত পূর্ণিমার রাত শুধু ভয় দেখাতে নয়, বরং সেই হারানো শিশু আত্মাদের খেলার পূর্ণতা দেওয়ার এক শেষ সুযোগ। দাদী ও অর্ণবের সাহায্যে, পুতুলবাড়ি ক্রমশ শান্তি ফিরে পেল, আর অনন্যা শিখল, সাহস, কৌতূহল এবং জ্ঞানের সংমিশ্রণই এই অভিশপ্ত খেলা থেকে নিরাপদে মুক্ত হওয়ার চাবিকাঠি। সেই রাতে, বনেদি বাড়ি এবং তার রহস্যময় পুতুলবাড়ি—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্তি এবং শূন্যতার মধ্যে স্থির হয়ে গেল, যেন অতীতের ছায়া আবার নতুনভাবে নিঃশব্দে বিশ্রাম নিচ্ছে।
–
চূড়ান্ত সংঘর্ষের মুহূর্তে বনেদি বাড়ির ভেতরে অবিশ্বাস্য উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পুতুলগুলো আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, তাদের চোখে আগুন, মুখে অদ্ভুত হাসি এবং কান্নার মিশ্রণ—যা অনন্যার হৃদয়কে অবিরাম কম্পিত করছে। সে ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেও পুতুলগুলোর শক্তি তার প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা তৈরি করছে। তখনই দাদী, সুবর্ণলতা দেবী, সাহসীভাবে অনন্যার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখে দৃঢ়তা, এবং কণ্ঠে এক অদ্ভুত স্থিরতা—যে কোনো ভয়কে নীরব করে দিতে পারে। দাদী জানতেন, একমাত্র তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে অনন্যা বাঁচানো সম্ভব। সে ধীরে ধীরে পুতুলগুলোর মাঝে প্রবেশ করলেন, রানী পুতুলের চোখের আগুনের দিকে তাকিয়ে। তার শরীর ধীরে ধীরে আলোয় ঝলমল করল, আর একটি গভীর, নিঃশব্দ প্রার্থনা মনে মনে উচ্চারিত হল। পুতুলগুলোর নাচ এবং হাসি এক মুহূর্তে থমকে গেল, যেন তাদের শক্তি এবং অভিশাপ চূড়ান্তভাবে ধীরে ধীরে নীরব হতে শুরু করল।
অনন্যা অবাক হয়ে দেখল, দাদীর আত্মত্যাগের ফলে রানী পুতুলের চোখের আগুন নিভে গেছে। পুতুলগুলো স্থির হয়ে গেছে, নাচ এবং গান থেমে গেছে। অর্ণব দ্রুত অনন্যার কাছে ছুটে আসে এবং তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়। অনন্যা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই রাতের ঘটনা কেবল তার কৌতূহল এবং সাহসের পরীক্ষা নয়; বরং এটি একটি বৃহত্তর মানবিক ত্যাগের প্রমাণ—যেখানে দাদী তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, প্রেম, সাহস এবং আত্মত্যাগ কখনোও বৃথা যায় না। পুতুলবাড়ির অদ্ভুত নীরবতা এবং স্থিরতা অনন্যাকে অদ্ভুত শান্তি দিচ্ছে। সব কিছুর শেষে, বনেদি বাড়ি যেন এক নতুন জীবন পেয়েছে—পুরোনো ভয়, রহস্য এবং অতিপ্রাকৃত খেলা ক্রমশ নিঃশব্দ হয়ে গেছে।
তবে ঠিক সেই সময়, পুতুলবাড়ির এক কোণার জানালা হালকা ঝলমল করে, আর সেখান থেকে ক্ষীণ একটি হাসি ভেসে আসে। অনন্যার হৃদয় আবারও কেঁপে ওঠে; মনে হয়, রহস্য সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়নি। সে বুঝতে পারে, পুতুলবাড়ি ও তার অভিশপ্ত খেলাগুলো নিঃশেষ হয়নি—বরং এখনো এক অদৃশ্য শক্তি, নীরব এবং ক্ষীণ, অপেক্ষা করছে। বনেদি বাড়ি, দাদীর ত্যাগ এবং অনন্যার সাহস—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মিলনস্থল তৈরি করেছে, যেখানে অতীত, বর্তমান এবং রহস্য একসাথে বেঁচে আছে। অনন্যা জানে, এই অভিশপ্ত খেলায় মুক্তি এসেছে, তবে অভিশাপও কখনো সম্পূর্ণভাবে নিঃশব্দ হয়নি। শেষ হাসি তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে—রহস্য এখনো জীবন্ত, এবং পুতুলবাড়ি তার নতুন অধ্যায়ের জন্য অপেক্ষা করছে, যেন আবারও একটি নতুন কাহিনীর সূচনা হবে।
***



