অতীন্দ্র সোম
অধ্যায় ১: নতুন আলো
নতুন জায়গায় সকালটা সবসময় অচেনা গন্ধে ভরা থাকে। রিয়া সেন যখন উত্তরবঙ্গের পাহাড়ঘেরা ওই নিঃসঙ্গ গ্রামে পৌঁছালেন, তখন আকাশটা ছিল ঘোলাটে, যেন পুরোনো কাপড়ের মতো রঙচটা। রিয়া একটা পুরনো জিপ থেকে নামলেন—হাতে একটা কাঁধব্যাগ, চোখে চশমা, পরনে হালকা সাদা কুর্তা আর ধুলোমাখা স্যান্ডেল। চারপাশটা যেন নিঃশব্দে তাঁকে পরখ করছিল। দূরে চা-বাগানের গাছেরা হাওয়ায় মাথা নেড়ে চলেছে, আর মাঝেমাঝে কিছু পাখির ডাক ভেসে আসছে—অপরিচিত, গভীর, নিঃশব্দকে কেটে দেওয়া একরকম সুর। রিয়া এই গ্রামে এসেছে একটা স্কুল খোলার উদ্দেশ্যে—সরকারি অনুদানে নয়, কোনো এনজিও-র প্রজেক্টেও নয়, নিজের স্বপ্নে। শহরের স্কুলের চাকরি ছেড়ে এসে সে ভেবেছিল, এই নির্জন গ্রামের এক কোণায় একটা ছোট্ট স্কুল গড়ে তুলবে, বাচ্চাদের অক্ষরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাবে, যেখানে টিফিনে গাছের ছায়ায় বসে অ আ ক খ শেখা যাবে। কিন্তু গ্রামে পা রাখতেই সে টের পেল, এখানে কেবল পাঠ্য বইয়ের পৃষ্ঠা নয়, কিছু অদেখা পাতা ওল্টে আছে, যেগুলোর শব্দ গায়ে কাঁটা দেয়।
গ্রামের নাম ‘ডুয়ারিপাড়া’। নামটা যেমন, জায়গাটাও তেমনই—দুয়ারের মতো খোলা, কিন্তু পাহাড়ের বুকে চাপা। গ্রামটায় পৌঁছেই রিয়া প্রথম যাদের দেখা পেলেন, তারা ছিল পাঁচ-ছ’জন শিশু—মুখে ধুলো, চোখে কৌতূহল, আর পায়ে পায়ে থমকে যাওয়া হাসি। তারা চুপচাপ তাকিয়ে থাকল, কেউ এগিয়ে এসে কিছু বলল না, কেবল একজন, একটু বড় ছেলেটা, তার নাম নয়ন, জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি মাস্টারমশাই?” রিয়া হেসে বলল, “না রে, আমি মাস্টারমেম।” ওরা তখন একটু হাসল। গ্রামের প্রধান মানস দা পরে এলেন, মৃদুভাষী, বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, মুখে ঘন দাড়ি আর চোখে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ক্লান্তি। তিনিই দেখালেন একটা পুরনো কাঠের দোচালা ঘর, যা রিয়া স্কুল ঘর হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। ঘরটার এক পাশে বাঁশঝাড়, অন্য পাশে বিশাল একটা পুরনো আমবাগান। বাগানটার দিকেই তাকিয়ে রিয়ার কেমন যেন গা ছমছম করল। গাছগুলো যেন অনেকটা বেশি চুপচাপ। মানস দা হঠাৎ বললেন, “এই বাগানটা আগে ছেলেমেয়েরা খেলত, নাম ছিল পুতুলতলা। এখন কেউ আর যায় না। আপনি বাচ্চাদের নিয়ে ওদিকটা এড়িয়ে চলবেন।” রিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ‘পুতুলতলা’—নামটার মধ্যেই একটা অদ্ভুত গাঢ়তা, যেন খেলনার নয়, কেমন যেন অতীতের জমাট রক্ত।
রিয়া কিন্তু ভয় পান না। অন্তত, শহরে তিনি নিজের ভাড়া বাড়িতে যখন একা থাকতেন, রাতে জানালায় ছায়া দেখলেও বুক ঠুকে বারান্দায় বেরিয়ে দেখে আসতেন, কেউ সত্যিই আছে কিনা। কিন্তু এই গ্রামে প্রথম রাতেই, যখন সে ঘর গোছাতে ব্যস্ত, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছায়া তার চোখে পড়ে। না, মানুষ নয়, বা সে রকম স্পষ্ট কিছু নয়—কেবল হঠাৎ নড়েচড়ে ওঠা একটা ধূসর দেহাবয়ব, যেন বাতাসে ভাসছে। পাশের আমগাছের নিচে সেটা যেন হাঁটছিল ধীর পায়ে, ঠিক পুতুলের মতো। চোখে ঘন অন্ধকার, আর পেছনে ছোট ছোট কিছুর হাসির শব্দ। রিয়া জানালা বন্ধ করে দিলেন। নিজেকে বোঝালেন, এটা তার কল্পনা—নতুন জায়গায় শরীর-মনের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু রাতের ঘুমটা এল না। তার খেয়াল ছিল, ঘরের এক কোণায়, যে বাক্সে সে খাতা-পেন্সিল রেখেছে, তার ঢাকনাটা নিজের থেকেই হঠাৎ খুলে গিয়েছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, যেন কোনো বাচ্চার হাত ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
পরদিন সকালেই রিয়া স্কুলঘরের পাশে কয়েকটা টেবিল-চেয়ার গুছিয়ে ফেলেন, আর দেয়ালে আঁকেন রঙিন বর্ণমালা। বাচ্চারা খুশি হয়, নয়ন এবং আরও কয়েকজন ভয়ে ভয়ে আসে। কিন্তু কেউই বাগানের দিকে যেতে চায় না। নয়ন কানে কানে বলে, “ওদিকটা রাতে বাজে বাজে আওয়াজ করে, মেম। আর ওই পাথরের পুতুলটা, যেটা বাগানের মধ্যে পড়ে আছে, সেটা চোখ গুলো খোলে মাঝেমাঝে।” রিয়া হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু সেই বিকেলে সে নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, এক টুকরো পাথরের মাটির পুতুল—হয়তো কোনোদিন কারো খেলনা ছিল—তার চোখে যেন কষ্ট লেগে আছে। যেন অভিমান। যেন কেউ চায়, তাকে কেউ নিয়ে যাক, তার কথা কেউ শুনুক। রিয়ার বুক কেমন যেন ভারী হয়ে আসে। ‘নতুন আলো’-র স্বপ্ন নিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানে হয়তো আলো আছে, কিন্তু তার নিচে ছায়ার গাঢ় কুয়াশাও রয়ে গেছে।
অধ্যায় ২: পুতুলতলার ছায়া
যতদিন যাচ্ছিল, রিয়ার মধ্যে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছিল। সকালে যখন সে বাচ্চাদের সঙ্গে ক্লাস করত, তাদের চোখে মুখে সেই নিষ্পাপ আনন্দ দেখত—সে মনে করত, সে ঠিক পথেই আছে। কিন্তু সন্ধ্যে নামলেই চারপাশটা যেন বদলে যেত। ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকত, কিন্তু সেই হাওয়ায় শুধু ঠান্ডা নয়, যেন কারও কান্নার আবছা গন্ধ মিশে থাকত। সে চেষ্টা করেছিল নিজেকে বাস্তবতায় আটকে রাখতে, প্রতিদিনের পাঠ, খেলার সময়, হাতের আঁকায় আনন্দ খুঁজে নিতে। কিন্তু গ্রামের অদ্ভুত নিরবতা তাকে ঘিরে ধরছিল ধীরে ধীরে, যেন এই নির্জন জায়গার মাটির নীচে কোনো অজানা কিছু তাকে ডাকছিল। নয়ন, সেই বাচ্চা ছেলেটা, এখন স্কুলে রিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সে প্রায়ই বলে, “মেম, ওরা খুশি হয় যখন আমি খেলা করি ওদের সঙ্গে।” রিয়া জিজ্ঞেস করে, “কারা রে, ‘ওরা’ বলতে?” নয়ন কেবল হেসে ফেলে, আর গলা নামিয়ে বলে, “ওরা… যারা পুতুলতলায় থাকে।”
এক সন্ধ্যায়, পড়ার পর যখন রিয়া টেবিল গুছিয়ে চায়ের কাপ হাতে বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন চোখে পড়ে এক ছায়া—ধীর পায়ে গাছের তলায় হাঁটছে। সে চিন্তায় ছিল হয়তো কেউ চুরি করতে এসেছে। কিন্তু ছায়াটা এত ছোট, যেন কোনো শিশুর, এবং তার চলনটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। রিয়া চোখ কুঁচকে তাকায়—সেই ছায়াটা একবার থামে, তারপর গাছের গোড়ার দিকে নুয়ে পড়ে, আর ধীরে ধীরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে যায়। রিয়ার গলা শুকিয়ে যায়, কাপটা টেবিলে রেখে দৌড়ে বাইরে যেতে যাবে, ঠিক তখনই একটা ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া ঘরটা কাঁপিয়ে দেয়। সে থেমে যায়, আর ফিরে আসে জানালায়। এবার ছায়া নেই। কিন্তু তার চোখ পড়ে, সেই পাথরের পুতুলটা, যেটা আগেও সে দেখেছিল, এবার একটুও নড়েনি। কিন্তু তার চারপাশে মাটির ওপর পাতা ছেঁড়াছেঁড়ি, যেন কেউ সেখানে বসেছিল। রিয়ার শরীরে হিম স্রোত বয়ে যায়। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না—কিন্তু একটা বিষয় সে বুঝতে পারল, এই বাগানে কিছু এমন আছে, যা কেবল চোখে দেখা যায় না, অনুভবে এসে চিৎকার করে।
পরদিন ক্লাস চলাকালীন রিয়া নয়নকে জিজ্ঞেস করল, “তুই সত্যি কি কারো সঙ্গে খেলিস রে?” নয়ন একটু চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “তারা সবাই পুতুল নয়, কেউ কেউ মানুষও ছিল। আগে। কিন্তু এখন তারা খেলনা হয়ে গেছে।” রিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “মানে?” নয়ন নিচু গলায় বলল, “তোমাকে কেউ কিছু বলেনি বুঝি? এই পুতুলতলায় একসময় একখানা খেলার জায়গা ছিল। অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্য। কিন্তু এক রাতে আগুন লেগে সব পুড়ে যায়। সবাই মরে যায়, শুধু কিছু খেলনা বেঁচে ছিল। ওদেরই ওরা পছন্দ করে। যারা হারায়, তারা হয়ে যায় পুতুল।” রিয়া আঁতকে ওঠে, “এই কথাগুলো তুই কোথায় শুনলি?” নয়ন আঙুল তুলে দেখায় বাগানের এক কোণে একটা খেজুরগাছের পাশ, “ওখান থেকে কেউ রাতে এসে আমাকে বলে। ওরা জানে আমি কথা শুনি।” রিয়া থেমে যায়। শহরে থাকাকালে সে এমন অনেক শিশুর সঙ্গে কাজ করেছে যারা কাল্পনিক বন্ধু বানাত, কল্পনার দুনিয়ায় বাস করত। কিন্তু নয়নের চোখে আজ যেন ভয়ের চেয়ে বেশি কিছু—অদ্ভুত এক চেনা ভাব, যেন সে সত্যিই জানে কিছু এমন, যেটা বললে বাস্তব বদলে যাবে।
রিয়া সিদ্ধান্ত নেয়, এবার তাকে গ্রামটার পুরনো ইতিহাস জানতে হবে। সে সন্ধ্যাবেলা গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক রামধনু মাস্টারের কাছে যায়, যিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত। তাঁর বাড়ি গ্রামের এক কোণায়, দাওয়ার সামনে বড় বটগাছ, আর উঠোনে পেতলের ঘটি। মাস্টারমশাই চুপচাপ চা খাচ্ছিলেন। রিয়া সব খুলে বলেন, নয়নের কথা, পুতুলতলার ছায়া, পাথরের পুতুল—সব। রামধনু মাস্টার গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “তুমি জানো, আমি সেই আশ্রমটার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। পঁচিশ বছর আগে এই বাগানের ঠিক পেছনেই একটা ছোট অনাথ আশ্রম ছিল, যেখানে দশ বারোটা বাচ্চা থাকত। ওদের খেলানোর জন্য স্থানীয় লোকজন কিছু পুতুল, গাড়ি, কাঠের খেলনা দিয়েছিল। একদিন রাতে ভয়ংকর আগুন লাগে, কোনো এক পুতুলের ভেতর দিয়েই নাকি আগুন শুরু হয়। কেউ বেরোতে পারেনি—সব বাচ্চা, সব খেলনা পুড়ে যায়। পরদিন শুধু কয়েকটা পুতুল পাওয়া গিয়েছিল যেগুলো অক্ষত ছিল, আর ওদের চোখগুলো… জানো, যেন তারা পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছে। তার পর থেকে কেউ ওদিকে যায় না। ‘পুতুলতলা’ নামটাও পরে লোকেরা দিয়েছে।” রিয়া চুপ করে শোনে। তার চোখের সামনে যেন ছবির মতো ফুটে ওঠে সেই পুড়ে যাওয়া ঘর, ছেঁড়া পুতুল, আর বাচ্চাদের আর্তনাদ। সে তখনই বুঝে নেয়—এই স্কুল গড়ে তোলা আর পাঁচটা কাজের মতো নয়। এ জায়গায় শুধু বই বা খাতা নয়, কিছু অতীতের ছায়াকেও সে নাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেই ছায়ারা কি ঘুম ভেঙে উঠেছে?
অধ্যায় ৩: গল্পিরাণী ও তার ছড়া
বৃষ্টির দিন ছিল সেটা—আকাশ ছিল ছাই রঙা, যেন দীর্ঘশ্বাসে ঢেকে রাখা একটা পুরনো আয়না। সকাল থেকেই ক্লাস চলছিল না; বাচ্চারা কেউই আসেনি, নয়নও নয়। রিয়া স্কুলঘরের এক কোণে বসে জানালার পাশে চা খাচ্ছিল, বাইরে শুধু বৃষ্টি আর অদূরে পাতা ঝরার শব্দ। সেই সময়েই হঠাৎ জানালার বাইরে দেখা যায় এক বৃদ্ধাকে—ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন পুতুলতলার ধার ঘেঁষে। তাঁর পরনে ময়লা শাড়ি, মাথায় সাদা চুল, আর হাতে কাঠের লাঠি। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল তাঁর গলার আওয়াজ—তিনি একটা ছড়া বলতে বলতে যাচ্ছিলেন। শব্দগুলো ছিল অস্পষ্ট, তবে এতটাই ছন্দে বাঁধা যে তা কানে লেগে গিয়েই থাকল।
“পুতুল পুতুল, চোখের তারা / কে খুলেছে তোমার দ্বার রে সারা?
রাতের শেষে বাজে বাঁশি / কারা আসে পায়ের হাসি?”
রিয়া থমকে যায়। ছড়ার ভেতরে এমন এক টান ছিল, যেন কোনো ঘুম পাড়ানি নয়, বরং ঘুম ভাঙানোর মন্ত্র। তিনি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু ততক্ষণে বৃদ্ধাটি গাছের আড়ালে মিলিয়ে গেছেন। রিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে, কিন্তু চোখ তুলে আবার পুতুলতলার দিকে তাকিয়ে কিছু অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পান না। কেবল মন বলল, তিনি এবার কেবল কিছু শুনেননি—তা তাঁর ভেতরে ঢুকে গেছে।
পরদিন সকালবেলা নয়ন স্কুলে এল। কিন্তু সে আজ অন্যরকম। মুখ গম্ভীর, চোখে যেন ঘুমহীন রাতের ছায়া। রিয়া তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কই ছিলি রে কাল?” নয়ন একটু ভেবে বলল, “ওরা ডেকেছিল ম্যাডাম। ছড়াটা শুনে আমি গেলাম পুতুলতলায়।” রিয়া ভুরু কুঁচকে বলল, “ছড়াটা তুই আগে শুনেছিলি?” নয়ন মাথা নাড়ল, “না, প্রথমবার। ওটা ওঁর, গল্পিরাণীর ছড়া।” রিয়া প্রথমবার এই নাম শোনে। নয়ন ব্যাখ্যা করল, “ও বুড়ি ওখানেই থাকে। কেউ তার ঘরে যায় না। সে নাকি পুতুল বানাতে জানত, আর তার বানানো পুতুলগুলোই নাকি ওখানে পড়ে আছে। কেউ বলে, আগুনের আগে ওখানেই ওর দোকান ছিল।” রিয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। একজন পুতুল-কারিগর, যিনি আজও বেঁচে আছেন, আর তার মুখে সেই ছড়া? এটা কাকতালীয় হতে পারে না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন—এই মহিলা, ‘গল্পিরাণী’, তাঁর সঙ্গে একবার কথা বলতেই হবে।
দুপুরের দিকে রিয়া ছাতা নিয়ে বেরোলেন। গ্রামের উত্তরপূর্ব কোণে খেজুরগাছের নিচে একটি ভাঙাচোরা কুঁড়ে ঘর, যার সামনে কাঁটা বেড়া আর শুকনো ফুলের মালা। সে ঘরটিই গল্পিরাণীর। রিয়া যখন সেই ঘরের সামনে পৌঁছালেন, তখন ভেতর থেকে একটা ছড়ার সুর ভেসে এল—তিনটি চরণের পর চতুর্থটি আর আসছিল না, যেন কেউ ইচ্ছে করে থেমে আছে। দরজায় নক করার সঙ্গে সঙ্গে সে আওয়াজ থেমে গেল। কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধতা, তারপর দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। একজোড়া ম্লান চোখ, যেন শতাব্দী পেরিয়ে আসা ক্লান্ত চাহনি। রিয়া নিজেকে পরিচয় দিলেন, “আমি রিয়া সেন। এখানে স্কুল খুলেছি। আপনার নাম শুনেছি—আপনি কি গল্পিরাণী?” বৃদ্ধা একটু হাসলেন—হাসিটা ছিল আধা-শুন্য, আধা-মায়াবী। তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে একটিই প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি সেই মেয়েটা… যে একদা এক পুতুল ফেলে চলে গিয়েছিল?” রিয়া চমকে ওঠে, “কি বলছেন আপনি?” বৃদ্ধা বললেন, “তোমার নাম রিয়া? আগে কি রূপা ছিল?”
রিয়ার বুকটা কেমন যেন টনটন করতে লাগল। এই নামটা… ছোটবেলায় তার দত্তক নেওয়ার আগের নাম। এই গল্পিরাণী তা জানেন কী করে?
সন্ধ্যে নেমে আসে ঘন অন্ধকারে, কিন্তু রিয়া সরে আসতে পারেন না। গল্পিরাণী তাকে নিজের ঘরের ভেতরে ডেকে নেন—ঘরটা ভাঙা হলেও আশ্চর্যভাবে ভেতরটা সাজানো পুতুলে পুতুলে ভরা। কিছু আধভাঙা, কিছু চোখমারা, কিছু কাঁটা পাতা দিয়ে মোড়া। যেন এই ঘরটা একটা বৃত্ত, আর তার কেন্দ্রে বসে আছে ইতিহাস। গল্পিরাণী ধীরে ধীরে বলতে থাকেন—“অনেক বছর আগে, আমি পুতুল বানাতাম। এই বাগানের পিছনে একটা শিশু আশ্রম ছিল, আমি সেই বাচ্চাদের জন্য পুতুল বানাতাম। কিন্তু একটা পুতুল… খুব জেদি ছিল। ও চাইত রোজ খেলা, আদর। একদিন একটা মেয়ে তাকে ভুল করে ফেলে রেখে চলে যায়। সেই পুতুল… সেদিন থেকে চুপচাপ নেই, ও অপেক্ষা করে। চোখ খুলে খোঁজে তাকে।” রিয়া কথা বলতে পারেন না। গল্পিরাণী এক পলক রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুমি তো ফিরেছ, এখন ওরা সবাই জেগে উঠবে।”
রিয়া স্তব্ধ হয়ে জানে, তার অতীত, এই গ্রামের ছায়া, আর পুতুলতলার কাহিনী—সব এক সূত্রে বাঁধা। আর সেই সূত্রের ছড়া এখন তার কানে বাজছে—
“পুতুল পুতুল, ফিরে চাও / কে এসেছে ফিরে? খুঁজে পাও?
হারানো নাম, হারানো হাত / পুতুলের আছে কি মনেবাত?”
এই গল্পটা আর কল্পনার নয়, এটা তার নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া কুয়াশা।
অধ্যায় ৪: নয়নের খেলা
নয়নের মধ্যে হঠাৎ এমন কিছু পরিবর্তন এল, যা রিয়ার চোখ এড়াল না। সেই কৌতূহলী, প্রাণবন্ত বাচ্চাটা যেন একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। ক্লাসে সে ঠিকমতো উত্তর দিচ্ছে না, বন্ধুদের সঙ্গে খেলছে না, এমনকি মাঝে মাঝে ক্লাসের মধ্যে পাথরের মতো তাকিয়ে থাকে—ঠিক যেন কেউ কিছু বলছে তার কানে, আর সে শুনছে। রিয়া প্রথমে ভেবেছিল হয়তো অসুস্থ, কিন্তু নয়নের মা—এক নিরীহ বিধবা—বললেন, “বিকেলবেলা ঘর থেকে পালিয়ে যায়। রাত করে ফেরে। বলে, ওরা ওকে ডাকে।” রিয়া চমকে ওঠে। সে জানে, “ওরা” মানে নয়নের কাছে কারা। পুতুলতলার সেই পুতুলেরা—যারা মৃত নয়, হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং অপেক্ষায় থাকা আত্মা, যারা বেঁচে থাকার জন্য খোঁজে নতুন শরীর, নতুন খেলা। এক বিকেলে রিয়া ক্লাস শেষে নয়নকে বলল, “চল, আজ একটু হাঁটা যাই।” নয়ন নিঃশব্দে রাজি হয়। তারা একসাথে হাঁটতে থাকে, স্কুলঘর পেরিয়ে, বাঁশঝাড় পেরিয়ে, সেই পুরনো আমবাগানের দিকে। গাছগুলো যেন স্থির, বাতাস নেই, কিন্তু পাতাগুলো অদ্ভুতভাবে একে অন্যকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেন ইশারায় কথা বলছে। হঠাৎ নয়ন থেমে যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, “তারা জানে তুমি এসেছ।” রিয়া অবাক হয়, “কে রে তারা?” নয়নের চোখে তখন এক অচেনা আলো—যেটা কোনো শিশুর নয়। সে ফিসফিস করে বলে, “যারা ফিরে আসতে চায়। যাদের খেলা এখনো শেষ হয়নি।”
বাগানের ভেতরে ঢুকে রিয়া বুঝতে পারে, এটা আর নিছক গাছপালা নয়। প্রতিটি গাছ, প্রতিটি শিকড়, যেন সময়ের মধ্যে আটকে আছে। হঠাৎ নয়ন দৌড়ে যায় একটা জায়গায়—একটা খালি জায়গা, যেটা একটু গর্তের মতো, ঘাস নেই, শুধু মাটি কেটে বেরিয়ে এসেছে। “এইখানে ছিল রুমকি। আমার বন্ধু,” বলে নয়ন, মাটিতে বসে পড়ে। “ও রাতে আসে। বলে, আমি যেন খেলা চালিয়ে যাই। না হলে ওরা রাগ করে।” রিয়া ঠোঁট শুকিয়ে আসে, “কে রে রুমকি?” নয়ন চুপ করে, তারপর পকেট থেকে একটা মাটির পুতুল বের করে দেয়। পুতুলটা ভাঙা, তার একটা চোখ নেই, গায়ে পুড়ে যাওয়া দাগ, কিন্তু তার মুখের রেখায় যেন জীবন্ত কারও অভিমান জমে আছে। রিয়া সেই পুতুলটা হাতে নিতেই শরীর কেঁপে ওঠে—তাপ, নরম একটা স্পন্দন, যেন দুধে ভিজে থাকা হাড়! সে বুঝতে পারে, এ খেলনা নয়। এ শরীরের ছায়া। হঠাৎ নয়ন ছড়াটা বলতে শুরু করে—ঠিক সেই সুরে, সেই ভঙ্গিতে, যা গল্পিরাণীর মুখে সে শুনেছিল। “পুতুল পুতুল, কারা তুমি? / খেলার মাঝে থেমে যুমি…” শব্দগুলো তার ঠোঁট থেকে বেরোচ্ছে, কিন্তু চোখটা যেন কাচের মতো—চোখে মানুষ নেই, কেবল প্রতিধ্বনি। রিয়া এগিয়ে আসে, নয়নের কাঁধে হাত রাখে, “তুই তো নয়ন, তাই না? এই রুমকি কে রে?” নয়ন ফিসফিস করে বলে, “আমরা সবাই ছিলাম। তুইও ছিলি। রূপা… রূপা।”
সেই রাতে রিয়া ঘুমাতে পারলেন না। ঘরের বাতাস যেন ভারী, খোলা জানালার বাইরে পাতা নেই, কিন্তু শব্দ আছে—চলার, ফিসফিসের, কারও দীর্ঘশ্বাসের। তার বিছানার পাশে রাখা ডায়েরি হঠাৎ খুলে যায়, আর একটি পাতা উড়ে এসে মেঝেতে পড়ে। সেই পাতায় কেউ লিখে রেখেছে সেই ছড়াটা—যেটা সে লেখেনি, এবং যার অক্ষর কালি দিয়ে লেখা নয়, যেন ছাই মেখে আঁকা। ভয়ে নয়, অবিশ্বাসে রিয়া উঠে জানালায় যান, বাইরে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। কিছু নেই, কিন্তু কিছু যেন রয়েছে। সেই পাথরের পুতুলটা—যেটা স্কুলঘরের পেছনে পড়েছিল—এখন তার ঘরের দরজার সামনে পড়ে আছে, ঠিক পায়ের কাছে। কিন্তু তার চোখে এবার ঘুম নেই, কাঁপন নেই, বরং যেন একরাশ জিজ্ঞাসা। রিয়া পুতুলটা তুলে ঘরে আনেন না, কেবল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ একটা মৃদু শব্দ—“রূপা…”—কানে আসে। রিয়া কাঁপে না, চমকায় না। শুধু তার বুকের ভিতর থেকে এক পুরনো চেনা নাম ছুটে আসে—“রূপা, আমি ফিরে এসেছি।”
পরদিন নয়ন স্কুলে আসেনি। রিয়া তার খোঁজে যায় নয়নের বাড়ি। দরজায় নয়নের মা চোখ লাল করে বসে আছেন। “সকাল থেকে ঘরেই নেই। কোথাও চলে গেছে।” রিয়া তখন জানে, সে কোথায় গেছে। সে একাই বেরিয়ে পড়ে পুতুলতলার দিকে। এবার কোনো ভয় নেই। কেবল প্রয়োজন সত্যকে ছুঁয়ে ফেলার। বাগানের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবে—সে কি সত্যিই ছিল সেই অনাথ আশ্রমে? তাহলে গল্পিরাণীর কথাগুলো কাকতালীয় নয়। তার ছোটবেলার পুতুল, তার নাম, তার অতীত—সবই কীভাবে জড়িয়ে আছে এই স্থানে! বাগানের ঠিক মাঝখানে গিয়ে সে দাঁড়ায়—যেখানে আগুন লেগেছিল, যেখানে মাটির নিচে কেউ নেই, কিন্তু ছায়াগুলো থেকে যায়। হঠাৎ সে অনুভব করে কারও নিঃশ্বাস, কারও কণ্ঠ, তার কানে শুধু এই শব্দ বাজে—
“তুই ফিরেছিস। এবার আমরা সবাই খেলতে পারব, আবার…”
পেছনে তাকাতেই সে দেখে, নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু নয়নের পাশে আরেকটা ছায়া—একটা মেয়ের, তার বয়স নয়নের সমান, চোখে পুতুলের মত শূন্যতা, আর ঠোঁটে ছড়ার শেষ চরণ। বাগান নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে। পুতুলতলা, আবার খেলা শুরু করতে চায়।
অধ্যায় ৫: রক্তে ভেজা পুতুল
সকালের আকাশ ছিল নীল নয়, অদ্ভুতভাবে ধূসর আর ভারী। স্কুলের আঙিনায় রিয়া দাঁড়িয়ে ছিলেন যখন ছোট্ট শর্মিলা ছুটে এসে বলল, “ম্যাডাম, মাটিতে রক্ত আছে।” রিয়া সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে দেখে, স্কুলঘরের ঠিক সামনের খোলা জমিতে একটি ছোট্ট মাটির পুতুল পড়ে আছে। তার গায়ে লালচে রঙের দাগ—ঠিক যেন রক্তের ছিটে। কিন্তু পুতুলের গড়ন ছিল এমন, যা আধুনিক নয়—বেশ পুরোনো, হাতে গড়া, গায়ে পোড়া দাগ, চোখে ভাঙা কাঁচ বসানো। আশ্চর্যজনকভাবে দাগগুলো এখনো টাটকা, যেন কিছুক্ষণ আগেই কেউ কিছু দিয়ে রাঙিয়েছে। পাশে একটুকরো কাপড়ও পড়ে ছিল, যেন কোনো শিশুর জামার অংশ। রিয়া পুতুলটা হাতে তুলে নেয়—তাতে ছিল একরাশ শীতলতা, এমন শীত যা কেবল মৃতের শরীর থেকে আসে। হঠাৎই রিয়ার মনে হয়, কেউ তার পেছন থেকে তাকিয়ে আছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে—নয়ন, একপায়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। চোখে এক অজানা ভয়। সে ফিসফিসিয়ে বলল, “ওদের একজন রাগ করেছে ম্যাডাম। আপনি ওর খেলনা নিয়ে এসেছেন, ও এখন আসবে… রক্তের গন্ধে।”
রিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তখনই হঠাৎ স্কুলঘরের জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল নিজে থেকেই। ঘরে কেউ ছিল না, কিন্তু জানালার কাঁচে ধুলোর ওপর আঁকা হয়ে গেল তিনটে আঙুলের দাগ—ছোটো, যেন শিশুর, কিন্তু সেগুলোর বৃত্ত ছিল অসমান, ভেতরে যেন ক্ষতচিহ্ন। পুতুলটাকে কোণে রেখে রিয়া ক্লাস চালাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু প্রতিটি বাচ্চা একসময় চুপ হয়ে গেল। কেউ কেউ আঁচলে মুখ ঢাকল, কেউ ঘাড় নিচু করে বসে থাকল। রিয়া টের পেল, ঘরে কিছু এমন ঢুকেছে যাকে চোখে দেখা যায় না, কেবল অনুভবে ধরা পড়ে। পুতুলটার পাশের বেঞ্চে বসা ছোট্ট রাহুল আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল—“ও আমার গা ছুঁয়েছে, ঠান্ডা, ঠান্ডা!” এরপরেই সে মূর্ছা যায়। রিয়া তাকে কোলে নিয়ে বাইরে আনেন, কিন্তু পেছন থেকে সেই ছড়াটা আবার ভেসে আসে—
“পুতুল পুতুল, রক্তের রেখা / কারা এল আজকে দেখা?
খেলতে চায়, বাঁচতে চায় / কারা আবার ফিরে চায়?”
এই ছড়ার প্রতিটি শব্দ যেন রক্ত জমিয়ে দেয়। বাচ্চারা একে একে স্কুল ছেড়ে চলে যায়। রিয়া একা দাঁড়িয়ে থাকেন, কোণে পড়ে থাকা সেই রক্তাক্ত পুতুলের দিকে তাকিয়ে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে রিয়া সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সেই পুতুলটাকে ঘর থেকে সরাবেন না—তিনি ওটা দেখবেন, ওটার মুখোমুখি হবেন। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আসতেই তার চারপাশে অদ্ভুত কিছুর শুরু হয়। ঘরের দরজা নিজে থেকেই খোলে, বাতি বারবার নিভে যায়, দেওয়ালের আয়নায় ছায়া পড়ে যেটা তার নিজের নয়। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে হাসির শব্দ, যা এক শিশুর, কিন্তু বিষাক্তভাবে খুশি। রাত তখন দুটো, হঠাৎ দরজার বাইরে ঠকঠক শব্দ হয়। রিয়া লাইট জ্বালিয়ে বাইরে তাকান—কেউ নেই। কিন্তু দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে আসে একটি কাগজ—ছেঁড়া পুরোনো কাগজ, তাতে লেখা এক শিশুর হাতের লেখা ছড়া:
“ম্যাডাম, আমিও পড়তে চাই
আমার বইটাও তুমি দিও ভাই
কিন্তু আমার পুতুল ফেরাও আগে
না হলে তোমার ছায়া যাবে কাঁদে।”
রিয়ার হাত কাঁপে, কাগজটা বুকের কাছে চেপে ধরে সে আবার ঘরে ঢোকে। জানে—এবার এই খেলা আর কেবল নয়নের কল্পনা নয়, পুতুলতলার অতীত এবার তার সঙ্গে কথা বলছে, দাবি করছে হারানো ইতিহাসের স্নেহ আর স্বীকৃতি।
পরদিন সকালে রিয়া আবার পুতুলটাকে নিয়ে স্কুলঘরে গেলেন, একপ্রকার ইচ্ছা করে—যদি সত্যিই কিছু হয়, সেটা তিনি নিজে দেখবেন। কিন্তু স্কুলঘরে ঢুকে দেখেন, পুতুলটা নেই। বেঞ্চের ওপর কেবল এক ফোঁটা টাটকা রক্ত, আর নয়নের খাতা খোলা—শেষ পৃষ্ঠায় আঁকা এক পুতুলের ছবি, যার চোখের জায়গায় কালো শূন্যতা। ছবির নিচে লেখা—
“আমার নাম রুমকি। আমি রাগ করেছি।”
সেই মুহূর্তে রিয়ার মনে পড়ে যায় গল্পিরাণীর কথা—একটি পুতুল, যে হারানো আদরে বেঁচে আছে, আর তার অপেক্ষা আজও শেষ হয়নি। রিয়া জানে, আজ নয়ন বা স্কুল নয়, তাকে সেই ‘রুমকি’র মুখোমুখি হতে হবে, তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে যেটা সে একদিন ভুলে চলে গিয়েছিল—স্নেহ, স্বীকৃতি, ভালোবাসা। পুতুল যে কেবল মাটির নয়, ওটাও এক সময়ের প্রতিচ্ছবি—এক শিশু আত্মার শেষ আশ্রয়।
অধ্যায় ৬: রামধনু মাস্টারের কাহিনী
গ্রামটায় ভোর নামে যেন নিঃশব্দে, পায়ে পায়ে। পাখির ডাক নেই, শুধু কুয়াশায় ঢেকে থাকা গাছের ফাঁকে ফাঁকে হাওয়া চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রিয়া আর দাঁড়াতে পারছিলেন না—নয়নের চোখের অদ্ভুত ছবি, রক্তাক্ত পুতুল, অচেনা ছায়া, আর রুমকির মুখ—সব যেন তাকে এক যন্ত্রণায় জর্জরিত করছে, যে যন্ত্রণা শুধু চোখে নয়, হাড়ে কাঁপন ধরায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—সব কিছু ছাপিয়ে, তাকে রামধনু মাস্টারের কাছে আবার যেতে হবে। সেই মানুষটিই একমাত্র জীবিত, যিনি সেই ভয়াবহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। সকাল সকাল তিনি পৌঁছে গেলেন মাস্টারমশায়ের বাড়ি। উঠোনে বসে মাস্টারমশাই তামাক শুকোচ্ছিলেন। রিয়া কিছু না বলে চুপ করে তাঁর সামনে বসে পড়লেন। তাঁর চোখে ছিল ঘুমহীন ক্লান্তি, আর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা—“তুমি তাকে দেখেছ, না?”
রিয়া জবাব দেন না, শুধু বলেন, “সবটা শুনতে চাই, আপনি যা জানেন। কে ছিল রুমকি, আর কেন পুতুলতলা এমন অভিশপ্ত হয়ে উঠল?”
রামধনু মাস্টার যেন দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর ধীরে ধীরে অতীতের পাতা ওল্টাতে শুরু করলেন। “অনেক বছর আগে, আমি এই গ্রামের পাঠশালায় পড়াতাম। ছোট্ট ঘর, মাটির ফ্লোর, বাঁশের বেড়া। আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছিল এক মেয়ে—রুমকি। সাত বছরের। অনাথ। চোখে গভীরতা ছিল, যেটা দেখলে মনে হতো যেন সে চুপ করে থেকেও অনেক কথা জানে। তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল একটা পুতুল—নাম দিয়েছিল ‘মিঠু’। খেলত, কথা বলত, আর প্রতিদিন স্কুল শেষে পুতুলটা নিয়ে খেজুরগাছের ছায়ায় বসত। আমি অনেকবার ভেবেছি, ও যেন নিজের ছায়াকে সেই পুতুলে ঢেলে দিয়েছিল।” মাস্টারমশায়ের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। “এক রাতে আগুন লেগে যায়—যেভাবে, সেটা আজও কেউ জানে না। বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট ছিল না, চুলা কেউ জ্বালায়নি। আমি দৌড়ে গিয়েছিলাম। পুরো পেছনের দিকটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। বাচ্চারা ভেতরে আটকা। আমি নিজে তিনজনকে টেনে বের করেছি, কিন্তু রুমকি আর বাকি ছ’জন বাচ্চাকে বাঁচানো যায়নি। পরদিন পুড়ে যাওয়া ভস্মের মধ্যে মাটির তিনটে পুতুল পাওয়া গিয়েছিল—একটাও ভাঙেনি। ওদের মধ্যে একটাই ছিল চোখমারা, আর গায়ে রুমকির জামার একফালি কাপড়।” তিনি থেমে গেলেন।
রিয়া শুনছিল স্তব্ধ হয়ে। মাথার মধ্যে যেন শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে, কেবল সেই জ্বলন্ত ভস্মের গন্ধ যেন কুয়াশা ভেদ করে তার গায়ে লেপ্টে আছে। “তারপর?” জিজ্ঞেস করলেন রিয়া। মাস্টারমশাই বললেন, “তারপর পুতুলতলা হয়ে গেল মৃতদের খেলার মাঠ। কারও চোখে দেখা যেত না, কিন্তু মাঝেমাঝে রাতবেলা ছড়ার আওয়াজ ভেসে আসত। কেউ কেউ দেখেছে গাছের ফাঁকে শিশুর ছায়া, কেউ শুনেছে পুতুলের হাওয়ায় চলার শব্দ। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি জায়গাটা সংস্কার করতে, কিন্তু বাঁশের বেড়া গড়িয়ে পড়ে, পাথর চিহ্ন রেখে যায়।” রিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, “আপনি গল্পিরাণীকে চিনতেন?” মাস্টারমশায়ের চোখ কুঁচকে গেল, “তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?” রিয়া মাথা নাড়ে। “ও ছিল সেই অনাথ আশ্রমের পুতুল কারিগর। পুতুলগুলো তিনিই বানাতেন। কিন্তু আশ্রম পুড়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি আর মানুষের সঙ্গে মেশেননি। বলেন, তার পুতুলের ভেতরে কিছু ঢুকে গেছে—যাদের মুখ, চোখ আর চাহনি মানুষদের মতো নয়, বরং মৃত্যুর মতো স্থির।”
রিয়া এবার জানেন, সব কিছু কাকতালীয় নয়। রুমকি, নয়ন, ছড়া, সেই পুরনো আগুন—সবই পরস্পর জড়ানো। কিন্তু একটাই প্রশ্ন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে—সে কি সত্যিই রূপা? গল্পিরাণী যেভাবে তাকে চিনেছে, পুতুল যেভাবে তাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে—সেই সব কি তার হারানো অতীতের সন্ধান? মাস্টারমশায়ের কণ্ঠে যেন অন্ধকার ভেঙে আসে, “তুমি বলেছ তোমার নাম রিয়া, কিন্তু ছোটবেলায় যদি কেউ তোমায় দত্তক নিয়েই থাকে, আর সে ইতিহাস কেউ গোপন রাখে, তবে তুমি কি জানো, তুমি কে ছিলে আগে? তোমারও তো সেই সময়কার একটা নাম ছিল, একটা পুতুল ছিল, একটা শৈশব ছিল এই পুতুলতলায়।” রিয়ার বুক কেঁপে ওঠে। “তাহলে… আমি…?” মাস্টারমশাই বলেন, “আমার মনে আছে, একটা মেয়ে বেঁচে গিয়েছিল সেই আগুন থেকে। তাকে একজন আশ্রমকর্মী শহরে নিয়ে গিয়েছিল—তোমার চোখ অনেকটা তার মতো।” রিয়া বুঝতে পারে, তার ফিরে আসা শুধু ইচ্ছা ছিল না—এটা ছিল ডাক, অতীতের টান, যা রক্তের ভেতর গেঁথে থাকে। পুতুলতলা তার কাছে কেবল ভয় নয়—এটা তার শৈশব, তার হারানো নিজস্বতা, তার রূপা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।
অধ্যায় ৭: ছায়াদের স্কুল
সেই রাতে রিয়া ঘুমাতে পারেননি। মনের ভিতরে বারবার ঘুরে ফিরেছে রামধনু মাস্টারের কথাগুলো—একটা পুড়ে যাওয়া মেয়ে, যে হারিয়ে গিয়েছিল শহরের কোলাহলে, আর ফিরে এসেছে রিয়া নামে। কিন্তু সে যদি-ই বা সেই রূপা হয়, তাহলে কেন এত বছর পর পুতুলতলা তাকে ডাকছে? সে জানে, উত্তর আছে, কিন্তু উত্তর পাওয়ার জন্য তাকে আরও গভীরে যেতে হবে—সেই জায়গায়, যেখান থেকে ডাক এসেছে বারবার, যেখানে নয়ন হারিয়ে যায়, যেখানে ছড়ার প্রতিধ্বনি সময়ের দেয়াল কাঁপিয়ে তোলে। পরদিন ভোরেই রিয়া হাঁটলেন পুতুলতলার দিকে, একা। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু আকাশে এখনো আলো নেই, কুয়াশা এতটাই ঘন যে পা দু’টোও দেখা যায় না। গাছেরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, পাতা নেই, ফুল নেই—কেবল অপেক্ষা। সেই আমবাগানের ভেতর ঢুকে রিয়া এক নতুন পথ খুঁজে পান—যেটা আগে ছিল না, কিন্তু আজ যেন মাটি নিজেই খুলে দিয়েছে। সেই পথ ধরে এগোতে এগোতে হঠাৎ সামনে পড়ে একটি স্কুলঘর—ছোট্ট, মাটির তৈরি, বাঁশের বেড়া, কাঠের বেঞ্চ। এবং সেখানে বসে আছে বাচ্চারা—কিন্তু তারা নিঃশব্দ, স্থির। তাদের মুখ দেখা যায় না, কেবল অবয়ব, ছায়ার মতো গড়ন, চোখহীন মুখ, আর পুতুল হাতে।
রিয়ার শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। এই স্কুলটা বাস্তবে নেই—এটা সেই স্কুল, যা পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, সেটা দাঁড়িয়ে আছে, আর তার ছাত্রছাত্রীরা… তারা কী? মৃত আত্মা? সময়ের ছায়া? রিয়া ধীরে ধীরে ঘরে ঢোকে। কেউ তাকায় না, কেউ ডাকে না, কিন্তু সব তাকানো যেন তার দিকেই। হঠাৎ একটি শিশু উঠে দাঁড়ায়—ছোট, মেয়ে, হাতে একটি ছেঁড়া পুতুল, চোখে কিছু নেই, শুধু পোড়ার দাগ। সে বলে, “তুমি ফিরেছ, রূপা। আমরা তো অপেক্ষা করছিলাম।” রিয়া থমকে দাঁড়ায়, বুকের ভিতর ঢেউ তোলে কিছু একটার। “তুমি রুমকি?” মেয়েটি মাথা নাড়ায়, “আমি ছিলাম। এখন আমি ছায়া। আমাদের খেলার জায়গা পুড়ে গেছে। আমাদের কথা কেউ রাখেনি। কেবল এক পুতুল রেখেছিলে, ভুলে গিয়েছিলে। সেই ভুল আজ ঘুম ভাঙিয়েছে আমাদের। আমরা আবার খেলতে চাই।” রিয়া হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। “তোমরা কি রাগ করেছ রুমকি?” মেয়েটির ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি, “আমরা শুধু চেয়েছিলাম আবার পুতুল নিয়ে খেলতে। কেউ যাতে ভুলে না যায়, আমরা ছিলাম। তুমি যদি ফিরে না আসতে, আমরা নিঃশব্দে থেকে যেতাম। কিন্তু এখন তো তুমি এসেছ, রূপা।”
তখনই একটি বেঞ্চ থেকে নয়নের ছায়া উঠে আসে। সে ছায়ার নয়ন, কিন্তু চোখে নয়নের সেই অভিব্যক্তি নেই—বরং এক অদ্ভুত স্থিরতা, যেন কেউ তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সে এগিয়ে এসে বলে, “তুমি যদি থাকো, তাহলে খেলাটা শেষ করা যাবে।” রিয়া তাকে ডাকতে চেষ্টা করে, “নয়ন, নয়ন…” কিন্তু ছায়া শুধু হাসে। ঘরভর্তি ছেলেমেয়েরা একে একে উঠে দাঁড়ায়। তারা ছড়ার মতো বলছে—
“রূপা ফিরেছে, খেলা হবে
পুতুল কাঁদে, ছায়া জাগে
যে পুড়ে মরে, সে শুধু নয়
যে ভুলে যায়, সে-ও তো ক্ষয়।”
রিয়ার চারপাশে গা ছমছমে ছায়া ছায়া গড়নগুলো ঘিরে ধরে। তারা ভয়ানক নয়, বরং বেদনাবিধুর। রিয়া জানে, এই স্কুল, এই ছেলেমেয়েরা সবই হারানো অস্তিত্ব—যাদের কথা কেউ মনে রাখেনি, যাদের গল্প কেউ লেখেনি। কিন্তু তারা আজও বেঁচে আছে—ভিন্নভাবে। সে এগিয়ে গিয়ে রুমকির হাতে নিজের ডায়েরি দেয়—যেখানে সে তার অনুভব, স্মৃতি আর পুতুলতলার কথা লিখেছে। “তোমরা এখন কেবল ছায়া নও। আমি তোমাদের কথা লিখব। আমি তোমাদের গল্প ফেরাব।” পেছনে ঘূর্ণি ওঠে হাওয়ার, আর একে একে ছায়ারা মিলিয়ে যেতে থাকে।
শেষে কেবল নয়ন পড়ে থাকে—নির্জন, নিস্তব্ধ। রিয়ার ডাক শুনে সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে। এবার তার চোখে আবার সেই চেনা আলো, “ম্যাডাম?” রিয়া হেসে ওঠেন, “তুই ঠিক আছিস, নয়ন?” সে মাথা নাড়ায়। “তারা চলে গেছে?” রিয়া বলল, “তারা কেবল শান্তি চেয়েছিল, ভুলে যাওয়া থেকে ফিরে আসতে। এখন ওরা জানে, কেউ একজন মনে রাখবে।” নয়ন কিছু বলে না, কেবল উঠে এসে রিয়ার হাত ধরে। পেছনে সেই স্কুলঘর আর নেই—যেন কখনো ছিলই না। পুতুলতলার ভিতর থেকে শুধু একটা পুতুল পড়ে থাকে, নিঃশব্দ, নিস্তরঙ্গ। কিন্তু এবার সেটা ঠান্ডা নয়, রক্তে ভেজা নয়—বরং তপ্ত, যেন জীবনের ছোঁয়া পেয়েছে।
অধ্যায় ৮: গল্পিরাণীর শেষ পুতুল
যেদিন নয়ন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল, সেদিন রিয়া ঠিক করলেন—সব শেষে একবার গল্পিরাণীর কাছে আবার যেতে হবে। কারণ পুতুলতলা তাকে যা দেখিয়েছে, তা একের পর এক ছায়া আর ভয়ের আবরণ সরিয়ে আজ এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে ভয় আর বিস্ময় আলাদা হয়ে যায় না। কিন্তু একটা প্রশ্ন এখনও জ্বলছে—গল্পিরাণী তাকে রূপা বলেছিলেন, পুতুলগুলো তাকে ডাকছিল, কিন্তু এই ডাকের কেন্দ্রবিন্দু কী? কে ছিল সেই যিনি সব জানতেন, সব দেখেছিলেন, আর সব বানিয়েছিলেন? উত্তর লুকিয়ে আছে সেই বৃদ্ধার কাছে—যিনি আগুনের পরেও থেকে গিয়েছিলেন, না-জানিয়ে, না-বলা অবস্থায়।
রিয়া দুপুরে গিয়ে দাঁড়ালেন সেই ভাঙা কুঁড়েঘরের সামনে, যেখানে আগে থেকে শুকনো ফুল আর লাঠির ছায়া পড়ে থাকত। আজকে ঘরের সামনে পাতা নেই, দরজা খোলা, আর ভেতর থেকে কোনো ছড়ার শব্দও আসছে না। ধীরে পা বাড়িয়ে রিয়া ভেতরে ঢুকলেন—অবাক হয়ে দেখেন, ঘরের মধ্যিখানে বসে আছেন গল্পিরাণী। তার সামনে ছোট্ট কাঠের বাক্স, তার হাতে ছেঁড়া সুতো, আর পাশে রাখা একটি অপূর্ব পুতুল—যেটা রিয়া কখনো দেখেননি। পুতুলটা নিখুঁত। গায়ে বোনা নকশা, চোখে যেন জলরঙের গভীরতা, আর ঠোঁটে একটা হালকা হাসি—ভয় নয়, বরং আশ্বাস। গল্পিরাণী বললেন, “এই ছিল আমার শেষ পুতুল। কখনো কাউকে দেখাইনি। কারণ এটা বানানো হয়েছিল একটির জন্যই—তোমার জন্য।”
রিয়ার হৃদয় থেমে যায় এক মুহূর্তে। “আমার জন্য?” বৃদ্ধা মাথা নাড়ান, “যখন আগুন লাগল, আমি ছুটে গিয়ে দেখি, রূপা নেই। কিন্তু এক জোড়া জুতো পড়ে আছে, আর একটা পুতুল—মাটির ভিতরে অর্ধেক পোঁতা। আমি জানতাম, রূপা বেঁচে গেছে। কিন্তু কোথায়, তা জানতাম না। তখনই আমি এই পুতুলটা তৈরি করি—মনে মনে ওকে বলি, তুই একদিন ফিরবি। তোকে মনে করানোর জন্য তোকে বানালাম। যদি কখনো দেখিস, চিনতে পারিস।”
পুতুলটা তখন গল্পিরাণীর হাতে। কিন্তু এটা যেন আর কেবল মাটির নয়—এই পুতুলটায় যেন মানুষের অভিমান, চাওয়া, আর ভাঙা সময়ের সেলাই। রিয়া ধীরে পুতুলটা হাতে নেন। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে সব খুলে যেতে থাকে—সে দেখে ছোট্ট এক মেয়ে, চোখে ধুলো, গলায় ছেঁড়া জামা, হাতে পুতুল ধরে হেঁটে যাচ্ছে একটি আগুন থেকে পালিয়ে। সে দেখে পেছনে পড়ে থাকা ছায়ারা ডাকছে—“রূপা! ফিরিস না?” সে জানে, মেয়েটি তাকেই দেখে যাচ্ছে। সেই পুতুল, সেই শৈশব—এটাই তার নিজের, এটাই তার পরিচয়। সে চিৎকার করে ওঠে, “আমি রূপা! আমি ফিরেছি!”
গল্পিরাণীর চোখে জল, কিন্তু মুখে প্রশান্তি। “তুই ফিরেছিস, রূপা। আর এখন ওদের শান্তি হবে।”
হঠাৎ ঘরের চারপাশে হাওয়া ভারী হয়ে ওঠে, মাটির নিচ থেকে যেন ছায়া ওঠে আসতে থাকে, বাতাসে ছড়ার ছায়া ভাসে—
“শেষ পুতুল, শেষ ছায়া / রূপা ফিরেছে, নিঃশ্বাস ছায়া
খেলা থেমে, পুতুল হাসে / আগুন থেমেছে পাথর পাশে।”
ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে রিয়া একা, কিন্তু একা নন—তার সঙ্গে সেইসব ছায়া, যাদের ভুলে গিয়েছিল এই পৃথিবী, আর যাদের আজ সে মনে রাখছে। গল্পিরাণী ধীরে ধীরে উঠে বলেন, “এটাই ছিল আমার কাজ। এখন আমি যেতে পারি।” তিনি দরজা পেরিয়ে হেঁটে যান, পেছন না ফিরে, আর সেই পেছনে পড়ে থাকে কেবল একটা ঘর, কিছু পুতুল, আর একজন মেয়ে—যে এখন আর হারিয়ে যাওয়া কেউ নয়। সে রূপা। সে রিয়া। সে সেই যিনি একদিন ফিরে এসে অন্ধকার ঘরে আলো জ্বেলেছেন।
অধ্যায় ৯: পুতুলতলার শুদ্ধি
সকালের আলো ঠিক আগের মতো নয়। এ যেন অন্যরকম একটি সকাল—যেখানে কুয়াশার ভিতরে ভেসে আসে না আর দীর্ঘশ্বাস, বরং অনুপম এক নিরবতা। রিয়া হাঁটছেন পুতুলতলার দিকে—হাতে সেই শেষ পুতুল, মনে একটা সিদ্ধান্ত। আজ আর তিনি ভয় পান না। তিনি জানেন, আজ তাকে দিতে হবে মুক্তি—তাদের জন্য, যারা আগুনে পুড়ে হারিয়ে গিয়েছিল, এবং তাদের জন্যও, যারা আজও নিঃশব্দে সেই আগুনের গন্ধ বয়ে বেড়ায়। পেছনে নেই কেউ—না গল্পিরাণী, না নয়ন, না মাস্টারমশাই। কিন্তু এই চলার পথে তার সঙ্গে আছেন ছায়ারা, স্মৃতি আর সেই একরত্তি শিশুকণ্ঠের প্রতিধ্বনি—যারা তাকে শিখিয়েছে, কীভাবে ভুলে যাওয়ার মাঝে সবচেয়ে গভীর হাহাকার লুকিয়ে থাকে।
আমবাগানে পৌঁছে রিয়া দেখলেন, গাছেরা যেন পথ খুলে দিয়েছে, মাঝখানের সেই পোড়া মাটি যেন আবার মৃদু আলোয় স্নাত। তিনি সেই মাঝখানে এসে দাঁড়ান—যেখানে আগুন সব কেড়ে নিয়েছিল। হাতে থাকা শেষ পুতুলটা তিনি মাটির ভিতর পুঁতে দেন। তারপর কাঁপা গলায় বলেন, “এই পুতুল কেবল খেলনা নয়। এটা তোমাদের জন্য। যাতে তোমাদের গল্প কেউ ভুলে না যায়। তোমাদের পায়ের শব্দ, ছড়ার ছায়া, পাথরে আঁকা ছুটন্ত কণ্ঠ—সব মনে রাখা হবে। আমি ছিলাম একসময় তোমাদের একজন। আজ আমি এসেছি, সব ফিরিয়ে দিতে।”
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলেন রিয়া। হঠাৎ গাছের পাতাগুলো একসাথে কেঁপে উঠল—না হাওয়ার ছোঁয়ায়, বরং যেন কৃতজ্ঞতায়। সেই পাতাগুলোর মধ্যে আলো পড়ল, আর চারপাশ থেকে ভেসে এল একটি সুর—যেটা ছড়া নয়, ভয়ও নয়, বরং শান্তির। পুতুলতলার মাঝে চারদিকে দাঁড়িয়ে পড়েছে ছায়ারা—রুমকি, ছোট্ট রাজু, পল্টু, রাহুল—যাদের মুখ কখনো দেখা যায়নি, আজ যেন তাদের অবয়ব একটুখানি পরিষ্কার। তারা হাসছে, হাত নাড়ছে, কেউ কেউ আবার বেঞ্চে বসে খেলছে, পুতুলের চোখে চোখ রেখে। এই স্কুল, এই বাগান, এই মৃত আত্মারা আজ যেন মুক্ত। কারণ আজ তাদের কণ্ঠ কারও কানে পৌঁছেছে, আজ কেউ বলেছে—“তোমরা ছিলে।”
রিয়া তখন একে একে সেই ছায়াগুলোর দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে কাঁপা গলায় বলে ওঠেন, “আমি ক্ষমা চাই। তোমাদের ছাড়া চলে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম। আজ মনে পড়েছে, আর তোমাদের গল্প আমি শেষ করব না—চালিয়ে নিয়ে যাব। তোমরা এখন ঘুমাও, শান্তিতে।” চারদিক থেকে এক নিঃশব্দ হাততালি ভেসে আসে—না শব্দে, না আঘাতে, বরং বাতাসের চলনে। এটা যেন স্বীকৃতি, সম্মতি।
ঠিক তখনই মাটির মধ্যে থেকে আলো উঠতে শুরু করে—ধীরে ধীরে, উষ্ণ হলুদ এক রেখা, যেটা ঘিরে নেয় সেই পুঁতে রাখা পুতুলটাকে। পুতুলটা কাঁপে না, নড়ে না, কেবল তার গায়ে যেন ফুটে ওঠে একধরনের নকশা—যেটা রিয়ার ছোটবেলার জামার মতো। চারপাশের ছায়ারা একে একে মিলিয়ে যেতে থাকে, মুখে তৃপ্তির ছায়া। পেছনে রিয়া হঠাৎ ঘাড় ফেরালে দেখেন, নয়ন দাঁড়িয়ে, সঙ্গে তার মা। তারা এগিয়ে এসে বলে, “ম্যাডাম, এই জায়গাটা এখন আলাদা লাগে। আর ভয় করে না।” রিয়া হাঁসেন, “এখন এটা পুতুলতলা নয়, এটা স্মৃতিতলা—যারা ছিল, তাদের ভালোবাসার জায়গা।” নয়ন কাছে এসে বলে, “ওরা কি গেছে?” রিয়া মাথা নাড়ে, “না, ওরা থাকবে। শুধু এবার আর রাগ করে নয়। বরং খেলার মাঝখানে না থেমে, শান্তির পুতুল হয়ে।”
শেষবারের মতো রিয়া পেছনে তাকান। আগের পোড়া গন্ধ নেই, ছড়ার শীতল প্রতিধ্বনি নেই। কেবল এক ঝাঁক পাখি গাছ থেকে উড়ে যায়। সূর্য উঁকি দেয় পাতার ফাঁক দিয়ে। রিয়া জানেন, তিনি এবার এখান থেকে দূরে যাবেন, কিন্তু তার ভিতর একটা নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে। তিনি পুতুলতলার কাহিনী নিয়ে ফিরে যাবেন শহরে, লিখবেন সেই হারিয়ে যাওয়া ছায়াদের কথা, যারা পুড়ে গিয়েও ভুলে যেতে দেয়নি। আর সেই লেখার শেষে থাকবে একটা পংক্তি—
“যাদের ছায়া ছিল, তাদের নামও থাকুক—পাথরের ওপরে, পুতুলের বুকে।”
অধ্যায় ১০– ছড়ার শেষ চরণ
দু’বছর কেটে গেছে পুতুলতলা থেকে ফিরে আসার পর। শহরের জীবন আবার রিয়ার চারপাশে গড়ে উঠেছে—শিশুদের ক্লাস, মাতাল ট্র্যাফিক, অগোছালো টেবিলভর্তি বই আর কাগজের মাঝে। কিন্তু যেটা পাল্টায়নি, সেটা তার লেখার টেবিল। সেখানে একটা কোণায় বসে আছে সেই শেষ পুতুল—গল্পিরাণীর বানানো, রূপার স্মৃতির বাহক, আর ছায়াদের সাক্ষ্যপ্রমাণ। রিয়া এখন শিশুদের লেখিকা—তার প্রথম বই “ছায়াদের স্কুল” এখন পাঠ্যসূচির অংশ নয়, কিন্তু লাইব্রেরির সবচেয়ে বেশি ধার নেওয়া বই। বইটা শুরু হয়েছে ছড়ার একটি লাইন দিয়ে—“পুতুল পুতুল, কাহিনী লুকাও না”—আর শেষ হয়েছে একটি চিঠির মতো—রিয়ার লেখা, ছোট্ট রুমকির উদ্দেশে। সেই চিঠিতে সে লিখেছে, “তোমরা হয়তো ছায়া, কিন্তু তোমাদের ছায়াতেই আমি নিজের মুখ চিনেছি। তোমরা গেছ, কিন্তু তোমাদের গল্প থাকবে।”
অনেক রাতে যখন শহর নিঃশব্দ হয়ে যায়, তখন রিয়া মাঝে মাঝে টের পান, সেই পুতুলটা নড়ে না, কিন্তু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে যেন কেউ চুপচাপ তাকিয়ে আছে—নয়নের চোখের মতো, রুমকির কণ্ঠের মতো, গল্পিরাণীর নিঃশ্বাসের মতো।
একদিন হঠাৎ রিয়ার হাতে ডাক আসে—একটি সরকারি আমন্ত্রণ। স্থানীয় প্রশাসন ঠিক করেছে, সেই পুরনো আমবাগানের পাশে নতুন করে একটি শিশুকেন্দ্রিক পাঠাগার তৈরি হবে, নাম রাখা হবে “পুতুলতলার পাঠশালা”, আর তার উদ্বোধনে রিয়াকে ডাকা হয়েছে। সঙ্গে থাকবে একটি প্রতীক—একটি হাতে বানানো পুতুল, যেটা সে নিজে নিয়ে যাবে, গল্পিরাণীর শেষ উপহার। সে ফিরে যায়। অনেকদিন পর আবার সেই পথ ধরে হাঁটে—যেখানে প্রতিটি গাছের ফাঁকে লুকিয়ে ছিল এক সময়কার দীর্ঘশ্বাস, এখন সেখানে বাতাসে ভেসে বেড়ায় নতুন ফুলের গন্ধ। আমবাগানের ভিতর যে জায়গায় আগুন জ্বলেছিল, সেখানে আজ দাঁড়িয়ে আছে একখানা গোল দোচালা ঘর—রঙিন, শিশুর আঁকায় মোড়া। রিয়া পা রাখেন মাটিতে, সেই জায়গায় যেখানে একদিন ছায়ারা খেলতে চাইত, আর আজ সেখানে ছোট্ট শিশুরা হেসে ওঠে বইয়ের পাতায় ছড়ার খেলা করে। রিয়া পুতুলটা তুলে রাখেন একটি কাঠের তাকের ওপর, পেছনে ছোট্ট ফলকে লেখা—“রুমকির স্মরণে: যে পুড়েও আলোয় ফিরে এসেছিল।”
কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই, কোনো বড়ো বক্তৃতা নেই। শুধু কয়েকজন বাচ্চা, কয়েকজন গ্রামবাসী, আর রিয়া। নয়ন বড় হয়েছে, এখন সে স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করে—তিনিই শিশুকেন্দ্রের দায়িত্বে। সে এসে বলে, “ম্যাডাম, আজ এই স্কুলটা পুতুলের নয়, ছায়ারও নয়—এটা এখন আলোয় ভরা। আপনি ফিরে না এলে এটা হতো না।” রিয়া হেসে বলেন, “ওরা আমাকে ফিরিয়েছে নয়ন, আমি শুধু লিখেছি।” শিশুরা একে একে সামনে এসে দাঁড়ায়, তাদের চোখে উচ্ছ্বাস, তারা পড়ে শোনায় সেই ছড়া—
“পুতুল দেখে, গল্প বলে
ছায়ার ভাষা কাঁদে চলে
যারা গেছে, তারা জানে
তাদের নাম আজ আলোয় মানে।”
রিয়ার চোখে জল আসে না, আসে শান্তি। এই ছড়ার প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ের মতো।
সন্ধ্যা নামার আগে রিয়া আবার হাঁটেন সেই আমগাছের নিচে—যেখানে একসময় তিনটি পোড়া পুতুল পাওয়া গিয়েছিল। এখন সেই জায়গায় বসানো হয়েছে একটি ছোট্ট পাথরের ফলক। তাতে খোদাই করে লেখা—
“এইখানে পুড়েছিল আগুন
এইখানে গেঁথে ছিল ছায়ার দাগ
আজ এইখানে বই পড়ে, পুতুল হাসে
কারণ একদিন কেউ ভুলে যায়নি।
—পুতুলতলার রূপা”
রিয়া মাথা নিচু করেন। বাতাসে তার চুল উড়ে আসে, কিন্তু কানে ভেসে আসে না আর ছড়ার ঠাণ্ডা শব্দ—এবার আসে পাখির ডানা ঝাপটার মতো এক শব্দ। সে জানে, সব ছায়া যায় না, কিছু ছায়া থাকে। কিন্তু ভয় হয়ে নয়, তারা থাকে মনে রাখার জন্য। গল্পিরাণী হয়তো আজ নেই, কিন্তু তাঁর পুতুলগুলো এখন শিশুর হাতে, খেলনার বাক্সে, আর গল্পের বইয়ে। আর রিয়া? সে এখন কেবল একজন শিক্ষিকা বা লেখিকা নয়—সে সেই মানুষ, যিনি একবার হারিয়ে গিয়েও ফিরে এসেছিলেন, ছড়ার শেষ চরণ হয়ে।
শেষ




