রূপসী সেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে গবেষণা করছে। তার প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু কাহিনি খুঁজে বের করা যা আধুনিক সমাজে হারিয়ে যেতে বসেছে। স্থানীয় গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় সে শুনেছে এক রহস্যময় মঠের কথা, যেখানে অতিপ্রাকৃত ঘটনা সংঘটিত হয় বলে মানুষের মধ্যে ভীতি ও কৌতূহল দুটোই বিরাজ করে। গ্রামের প্রবীণরা বারবার তাকে সতর্ক করেছে, “মঠে যেও না, রূপসী। সেখানে যে ঘটনা ঘটে, তা কল্পনার অতীতেও নেই।” রূপসী শুরুর দিকে ভয় পেয়েও গবেষণার প্রতি তার আকর্ষণ তাকে পিছনে সরাতে পারেনি। প্রতিটি লোককথা তাকে আরও গভীরে টানছে, যেন মঠের প্রতি একটি অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে গেছে। সে তার নোটবুক হাতে নিয়ে মঠের ইতিহাস, স্থানীয় কিংবদন্তি এবং অজানা কাহিনির সূত্রগুলো রেকর্ড করতে আগ্রহী, যাতে তার গবেষণায় নতুন মাত্রা যুক্ত হতে পারে। গ্রামের মানুষজন তাকে চেনে, তবে মঠের রহস্যকে নিয়ে তাদের ভীতি যেন তাকে আরও আগ্রহী করে তুলছে।
রূপসী মঠের প্রাচীর ও এর চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ শুরু করে। সে লক্ষ্য করে, মঠের বাইরে সমস্ত স্থান শুষ্ক ও পরিত্যক্ত, যেন সময় এখানে থেমে গেছে। চিরসবুজ গাছপালা ও তার ওপর জমে থাকা কুয়াশা মঠকে আরও রহস্যময় করেছে। কিছু অংশে প্রাচীরের ফোঁটা পড়ে গিয়েছে এবং পুরনো স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো ভাঙা অবস্থা দেখাচ্ছে। মঠের গেটের ধাতব তালা অনেকটা মরিচা খেয়ে গেছে, তবে তা এখনও দৃঢ় এবং অচল। মাটি ও প্রাচীরের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে—যা প্রবেশকারীদের সতর্ক করতে চায়। রূপসী নোটবুকে বিস্তারিতভাবে প্রতিটি অবস্থা লিখে রাখে। সে জানে, এই মঠের ইতিহাস ও এর চারপাশের পরিবেশ কেবল মাত্র প্রাচীন স্থাপত্য নয়, বরং এটি স্থানীয় বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাসের সংমিশ্রণ। সে মনে মনে ভাবছে, কিভাবে এই অজানা রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করলে তার গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। তবে প্রত্যেক ধাপের সঙ্গে একটি শিহরণও জড়িয়ে আছে—এখানকার নিঃশব্দতা ও পরিবেশ যেন বারবার তাকে সতর্ক করছে।
মঠের অভ্যন্তরে প্রবেশের আগে রূপসী নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে থাকে। সে জানে, গ্রামের লোকেরা যা বলছে, তার মধ্যে একাধিক সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে। সঠিক সময়ে এবং সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই সে পুরনো মঠের রহস্য উন্মোচন করতে পারবে। রূপসী নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যে তার গবেষণা শুধুই তথ্য সংগ্রহের জন্য, তবে কৌতূহল ও সাহস তার প্রাথমিক চালিকাশক্তি। রাতের নিরিবিলি পরিবেশ, কুয়াশা, এবং গাছের ছায়া যেন তার ধীরে ধীরে পায়ের নীচে প্রতিটি আওয়াজ শোনাচ্ছে। সে গভীর নিশ্বাস নেয়, তার হাতের নোটবুক ও টর্চের আলো নিয়ে ধাপে ধাপে মঠের ভিতরে প্রবেশ করে। প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে একটা অদৃশ্য শীতল বাতাস তাকে আঘাত করে। মঠের ভেতরের অন্ধকার, দীর্ঘ করিডর ও ভাঙা দেয়ালগুলো যেন এক অদৃশ্য গল্প বলছে—যা ইতিহাস, রহস্য, এবং অজ্ঞাত অতিপ্রাকৃত শক্তির মিশ্রণ। রূপসীর হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে—কৌতূহল, ভয়, এবং উত্তেজনা সব একসাথে। সে জানে, এই প্রথম ধাপ তাকে এক নতুন দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করাবে, যেখানে পুরনো কিংবদন্তি ও বাস্তবের সীমা মিশে যাবে।
***
রূপসী মঠের গভীরে প্রবেশ করলে তার চোখে পড়ে এক কুঁজো বৃদ্ধ—দয়াল। দয়াল নিজের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে রূপসীকে সতর্ক করে, “ওই দরজা খুলো না। কিছু কিছু জিনিস মানুষ বুঝতেই পারে না। এখানে প্রবেশ করলে শুধুই বিপদ।” দয়ালের কণ্ঠে এমন এক অদ্ভুত তীব্রতা আছে যা শুনে রূপসী কিছুটা স্থির হয়ে যায়। তবে কৌতূহল তার মনকে আরও জোরালো করে। বৃদ্ধের সতর্কতা যেন তার মধ্যে একটি অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি জাগিয়ে তোলে—ভয় ও উত্তেজনা একসাথে। রূপসী ধীরে ধীরে মঠের অন্ধকার কক্ষগুলোতে পায় চলাচল শুরু করে। দেয়ালগুলোতে সময়ের ছাপ স্পষ্ট, ছেঁড়া বাঁশি, পুরনো তেলবাতি, এবং ভাঙা পাথরের গঠন যেন অতীতের কাহিনী বলে যাচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে হালকা কুয়াশা ও বাতাসের শব্দ তাকে ঘিরে রাখে, যেন মঠ নিজেই তার আগমনের খবর জানিয়ে দিচ্ছে।
তার চোখ আচমকা এক লোহার দরজার দিকে যায়, যা আগের কোনো দরজার মতো নয়। দরজার উপরে অদ্ভুত চিহ্ন এবং রহস্যময় লিপি খোদাই করা আছে। রূপসী হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। দরজার লোহার পৃষ্ঠে সময়ের ছাপ স্পষ্ট, তবে সেই ছাপের মধ্যেও যেন এক অদ্ভুত শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। চিহ্নগুলো দেখে সে বুঝতে পারে, এগুলো শুধুই অলঙ্কার নয়, বরং এক প্রাচীন সংকেত যা সম্ভাব্য বিপদের কথা জানাচ্ছে। দরজার চারপাশে মাটির মধ্যে হালকা কম্পন অনুভব করা যায়, যেন ভিতরের কিছু জীবিত। রূপসীর হৃদয় তীব্রভাবে স্পন্দিত হয়, কৌতূহল এবং আশঙ্কা একত্রিত হয়ে তার মনকে উত্তেজিত করে। তার গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে, এই দরজার রহস্য উন্মোচন করা অপরিহার্য মনে হচ্ছে, কিন্তু মানসিকভাবে সে জানে, প্রবেশের সাথে বিপদের ঝুঁকি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
রূপসী কিছুক্ষণ স্থির থাকে, তবে কৌতূহল তাকে অগ্রসর হতে বাধ্য করে। সে দরজার পৃষ্ঠ স্পর্শ করে এবং অনুভব করে, ঠান্ডা ধাতু তার হাতে স্পর্শকাতর এক অনুভূতি ছড়াচ্ছে। দয়ালের সতর্ক বার্তাগুলো তার মনে বাজতে থাকে, তবে সে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে তার উদ্দেশ্য শুধুই তথ্য ও রহস্য সংগ্রহ করা। ধীরে ধীরে রূপসী দরজার চারপাশে নজর রাখে, আশেপাশের প্রতিটি কোণ বিশ্লেষণ করে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে, দরজার নীচের অংশে এক অদ্ভুত চিহ্ন, যা যেন প্রবেশকারীর পদক্ষেপের প্রতি সাড়া দেয়। বাতাসের শব্দ, দূরবর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠের কণার ধ্বনি, এবং অন্ধকারের চাপ— এগুলো এক ধরনের অবর্ণনীয় উত্তেজনা তৈরি করছে। রূপসী গভীর নিশ্বাস নেয়, তার হৃদয় তীব্রভাবে স্পন্দিত হচ্ছে, এবং অবশেষে সে নিজের কৌতূহল ও সাহসকে সঙ্গে নিয়ে সেই নিষিদ্ধ দরজার দিকে এগিয়ে যায়, বুঝতে পারছে যে এই প্রথম ধাপ তাকে এমন এক রহস্যের মুখোমুখি করবে যা শুধু ইতিহাস বা কল্পনা নয়, বরং অজানা অতিপ্রাকৃত শক্তির সংমিশ্রণ।
***
রূপসী মঠের নিষিদ্ধ কক্ষে প্রবেশের পর দরজার পেছনের অন্ধকারে এক রহস্যময় পরিবেশ তাকে ঘিরে রাখে। তার চোখে পড়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, যা ধুলো জমে থাকা বুকসেলফে রেখে দেওয়া হয়েছে। পাণ্ডুলিপির পাতায় অদ্ভুত মন্ত্রলিপি খোদাই করা আছে—এক ধরনের রহস্যময় চিহ্ন ও অজানা ভাষা, যা সে আগে কখনো দেখেনি। রূপসীর গবেষণার নেশা তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না; সে নিজেকে প্রস্তুত করে মন দিয়ে সেই মন্ত্রলিপি পড়তে। প্রাচীন ভাষার প্রতিটি শব্দ তার জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ, প্রতিটি উচ্চারণের মাঝে লুকিয়ে আছে শক্তির প্রতিফলন। সে পাতাগুলো নোটবুকে রেকর্ড করে এবং প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের চেষ্টা শুরু করে। অন্ধকার কক্ষের স্থিরতা, বাতাসের হালকা সুঁই ও ধুলো—সবই যেন তাকে মনোযোগী হতে বাধ্য করছে। রূপসী ধীরে ধীরে মনে মনে শব্দগুলোর সঠিক উচ্চারণ চেষ্টা করে, কিন্তু তার অজানা কৌতূহল ও উত্তেজনা এক ধরনের অমনোনীত উদ্দীপনা সৃষ্টি করে যা তার মনকে ঝুঁকিতে ফেলে।
অচিরেই, রূপসী অজানাতেই একটি শব্দ ভুল উচ্চারণ করে ফেলে। মন্ত্রের ক্ষুদ্রতম ভুলও মুহূর্তে তার শক্তিকে পরিবর্তন করে দেয়। অজান্তে সে ভাঙা মন্ত্রের প্রভাবের মধ্যে পড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে কক্ষের বাতাস পরিবর্তিত হয়, অন্ধকার গভীর হয়, এবং প্রাচীন ধূলিময় পাণ্ডুলিপি থেকে একটি অদ্ভুত শক্তির ঝলক ছড়িয়ে পড়ে। রূপসী বুঝতে পারে কিছু ভয়ংকর ঘটেছে, তবে সময়মতো পিছু হটতে পারে না। তার চোখের সামনে কল্পনার অতীত ও বাস্তব একত্রিত হয়, এবং অগ্নিমন্ত্র ও পিশাচিনীদের আত্মা মুক্তি পায়। তাদের চোখে এক অদ্ভুত জ্বলন্ত রাগ, মৃদু হাসি ও অতিপ্রাকৃত শক্তির ছোঁয়া প্রতিফলিত হয়। রূপসী স্তব্ধ হয়ে যায়, কারণ সে বুঝতে পারে যে তার এক ভুল উচ্চারণ মন্ত্রের বাধা ভেঙে দিয়েছে, যা অনেক শতাব্দী ধরে封印 করা ছিল। কক্ষের প্রতিটি কোণ থেকে অদ্ভুত শব্দ, হালকা আলো এবং অন্ধকারের ছায়া যেন তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে, একধরনের শীতল ভয় জাগিয়ে।
রূপসী নিজের ভুলের পরিণতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করে, কিন্তু মন্ত্র ভাঙার প্রভাব এতটাই প্রবল যে সে নিজেই সেই শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। অগ্নিমন্ত্র ও পিশাচিনীরা ঘরের মধ্য দিয়ে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়, প্রতিটি ধ্বনি, ছায়া ও জ্বলন্ত আলোতে তাদের উপস্থিতি স্পষ্ট হয়। রূপসী মনে মনে বুঝতে পারে, এই মুহূর্ত থেকে তার গবেষণা শুধু তথ্য সংগ্রহের কাজ নয়, বরং জীবন ও মৃত্যুর সীমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তার দিক থেকে সবকিছু এখন অজানা, প্রতিটি পদক্ষেপে বিপদ লুকিয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে নিজের কৌশল ও ধৈর্য ব্যবহার করতে শুরু করে, প্রাচীন মন্ত্র এবং পিশাচিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। তার হৃদয় তীব্রভাবে স্পন্দিত হচ্ছে, ভয়, উত্তেজনা ও কৌতূহল একত্রিত হয়ে তাকে মানসিকভাবে কঠোর পরীক্ষা দিচ্ছে। সেই প্রথম মুহূর্ত থেকে, রূপসী উপলব্ধি করে যে তার কৌতূহল তাকে এমন এক রহস্যের সঙ্গে যুক্ত করেছে, যা কেবল ইতিহাস বা গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অজানা অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি।
***
রূপসী মঠ থেকে বেরিয়ে গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে কিছু অদ্ভুত ঘটনা চোখে পড়তে শুরু করে। প্রথমে তা ছিল ছোট ছোট নিঃশব্দ চিহ্ন—কোনো বাড়ির দরজা হালকা খোলা, পাখার আওয়াজ ছাড়া কক্ষের মধ্যে শব্দ। এরপর গ্রামে শিশুদের দুঃস্বপ্নের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। শিশুরা রাত জেগে কেঁদে উঠছে, ভয়ানক চিৎকার করছে এবং ঘুম থেকে জেগে আতঙ্কিত দেহে কাঁপছে। স্থানীয় মানুষজন মনে করতে শুরু করে যে, মঠ থেকে ফিরে আসার পর রূপসীর সঙ্গে কিছু পরিবর্তন এসেছে। বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে, যা শুধু রূপসীর কাছেই স্পষ্ট নয়, গ্রামবাসীরাও তা অনুভব করছে। রাতের অন্ধকারে ছায়াগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে, কৌশল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি ছায়া নিজেকে মানুষের চোখে অদৃশ্য রাখার চেষ্টা করছে, তবে হঠাৎ কোনো কোণ থেকে মানুষের দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে। রূপসী প্রথমে বুঝতে পারছিল না, এগুলো কি বাস্তব নাকি কল্পনা, কিন্তু ধীরে ধীরে সে উপলব্ধি করে, এই অদ্ভুত ঘটনার পেছনে তারই অবজ্ঞাত কৃতকর্ম—ভাঙা মন্ত্রের প্রভাব কাজ করছে।
গ্রামের মানুষজন দিনে বাইরে কাজ করছে, কিন্তু রাতের ঘোর অদ্ভুতভাবে বাড়ছে। কেউ বাড়িতে একা থাকতে চাইছে না, কেউ নিঃশব্দে ভয়ে ঘরে আটকে যাচ্ছে। শিশুদের দুঃস্বপ্ন এতটাই তীব্র যে, তাদের চোখের সামনে অদ্ভুত ছায়া ও অচেনা মুখগুলো ভেসে উঠছে। রাতের নিরিবিলি সময়ে, রূপসী নিজেও তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করতে থাকে। সে দেখেছে, কোনো বাড়ির দেওয়াল থেকে হঠাৎ ছায়া নড়াচড়া করছে, দরজা নিজের ইচ্ছায় খোলা-বন্ধ হচ্ছে, এবং বাতাসে অদ্ভুত শব্দ প্রতিধ্বনি করছে। এই ঘটনাগুলো দেখে রূপসীর হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে—ভয়, দুঃখ, এবং অপরাধবোধের মিশ্রণ। সে বুঝতে পারে, সে ভাঙা মন্ত্রের কারণে গ্রামে অজান্তেই অতিপ্রাকৃত শক্তিকে মুক্ত করেছে। এই শক্তি শুধুমাত্র মন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং সে নিজেই এটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। রূপসী আরও গভীরে চিন্তা করতে শুরু করে, কিভাবে এই ছায়ার খেলা থামানো যায় এবং গ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়।
রূপসী জানে, তার সিদ্ধান্ত এখন শুধু নিজের জীবনই নয়, পুরো গ্রামের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। সে রাতে মঠের পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসে পড়ে এবং পুনরায় মন্ত্রলিপি বিশ্লেষণ করতে শুরু করে। তবে অগ্নিমন্ত্র এবং পিশাচিনীর ছায়া এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, তাদের কার্যকলাপ কোনো সাধারণ মানুষের চোখে অদৃশ্য নয়। ছায়াগুলো মানুষের চোখের সামনে ঘুরছে, তারা ঘর ঘর পরীক্ষা করছে, কখনো কোনো নিঃসঙ্গ প্রাণীকে ঘিরে ধরছে, কখনো দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। রূপসীর মাথায় একটাই চিন্তা—কিভাবে এই অদ্ভুত শক্তিকে আবারও স্থির করা যায়। সে জানে, তার কাছে কেবল জ্ঞান ও সাহসই অস্ত্র, তবে সময় খুবই সীমিত। রাতের প্রতিটি মুহূর্তে শক্তি আরও বাড়ছে, এবং রূপসী অনুভব করছে যে, ছায়ার খেলা এখন শুধু শুরু হয়েছে, এর কোনো অতি সহজ সমাপ্তি নেই। গ্রামে আতঙ্কের চিত্র দেখতে দেখতে, সে এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেয়—সরাসরি এই ছায়ার শক্তির উৎস খুঁজে বের করা এবং যেভাবে সম্ভব, মন্ত্রকে পুনরায় স্থাপন করার চেষ্টা করা। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে রূপসী উপলব্ধি করে যে, তার কৌতূহল তাকে এক অজানা যুদ্ধে নিয়ে এসেছে, যেখানে শুধুমাত্র সাহস, জ্ঞান এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাকে বাঁচাতে পারে।
***
রূপসী মঠের গহ্বরের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলে অদ্ভুত শক্তির স্পন্দন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সে দেখেছিল অগ্নিমন্ত্রের প্রভাব কতটা ব্যাপক, কিন্তু এখন যা চোখে পড়ল, তা কল্পনার চেয়েও ভয়ংকর। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এক এক করে পিশাচিনীরা আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। তাদের রূপ ভিন্ন ভিন্ন, কেউ লম্বা হাতের আকারে, কেউ উল্টো মুখের সঙ্গে, কেউ কেবল ধোঁয়ার মতো ঝাপসা, তবে প্রত্যেকের চোখে জ্বলন্ত রাগ ও শত্রুতা প্রতিফলিত হচ্ছে। রূপসী মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারে, এই শক্তি শুধু মন্ত্র ভাঙার ফল নয়, বরং শিকারের জন্যে শতাব্দীর বন্দিদশার প্রতিশোধকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়েছে। পিশাচিনীরা নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের কণ্ঠে এক অদ্ভুত অনিশ্চিত সুর—যা শুনলেই মনে হয় সময় ও স্থান ভেঙে গেছে। রূপসীর মন অস্থির হয়; একদিকে তার কৌতূহল তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, অন্যদিকে আতঙ্ক ও ভয় তাকে স্থির করতে চায়। তিনি লক্ষ্য করেন, এই অগ্নিমন্ত্রের দল তাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত এবং প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি ও চোখের ঝলক যেন প্রতিশোধের অঙ্গীকারের প্রমাণ।
পিশাচিনীর আসর ধীরে ধীরে কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকার কক্ষে বাতাস নীরব নয়, বরং অদ্ভুত শব্দের সঙ্গে পরিবেশ কম্পিত হচ্ছে। ধোঁয়া, আগুনের জ্বলন্ত লেপ্টা এবং ঝলকানো আলো—সবই এক ধরনের অতিপ্রাকৃত পরিবেশ তৈরি করছে। রূপসী অনুভব করে, এই শক্তি শুধু তার উপস্থিতি নয়, বরং প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃষ্টি, এবং প্রতিটি পদক্ষেপকে লক্ষ্য করছে। পিশাচিনীরা একত্রিত হয়ে এক অদ্ভুত বিন্যাসে দাঁড়ায়; লম্বা হাতের পিশাচিনী ধীরে ধীরে হেঁটে আসে, উল্টো মুখের পিশাচিনী তার ভয়ঙ্কর হাসি ছড়াচ্ছে, এবং ধোঁয়ায় ঢেকে থাকা পিশাচিনী যেন আকাশের মতো বিস্তৃত। তারা ঘোষণা করে যে, এই শতাব্দীর বন্দিদশার প্রতিশোধ সময় এসেছে এবং কোন কিছু তাদের থামাতে পারবে না। রূপসীর মন অস্থির, কিন্তু সে জানে যে এই বিপদকে সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিটি পিশাচিনীর শক্তি, উপস্থিতি এবং উদ্দেশ্য পর্যবেক্ষণ করে সে নিজের কৌশল তৈরি শুরু করে।
রূপসী বুঝতে পারে যে, শুধু সাহস নয়, তার জ্ঞান ও পূর্বের গবেষণার তথ্যই তাকে রক্ষা করতে পারে। পিশাচিনীর আসরের দৃশ্য এমন যে, এক মুহূর্তেই সে আবিষ্কার করে—এই শক্তি একাধিক মাত্রায় কাজ করছে। শত্রুর দৃষ্টি, অগ্নিমন্ত্রের আগুন, ছায়ার নড়াচড়া—সব মিলিয়ে এক জটিল জাল তৈরি করছে। রূপসী অনুভব করে, তার হাতে থাকা মন্ত্রপাণ্ডুলিপি এবং অতীতের গবেষণার নোটগুলোই একমাত্র সম্ভাব্য অস্ত্র। সে স্থির মন নিয়ে ভাবতে থাকে, কিভাবে পিশাচিনীর শক্তিকে পরাজিত করা যায়, কিভাবে অগ্নিমন্ত্রের শক্তি পুনরায় নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, এবং কিভাবে গ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। পিশাচিনীর উপস্থিতি যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনি তার প্রতিটি পদক্ষেপে ছায়া ও আলো মিলিয়ে এক রহস্যময় খেলা তৈরি হচ্ছে। রূপসী উপলব্ধি করে, এই যুদ্ধে শুধু বেঁচে থাকা নয়, বরং মন্ত্রের পুনরায় নিয়ন্ত্রণই তার প্রধান লক্ষ্য। ধীরে ধীরে, সে পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, জানে যে, পিশাচিনীর আসর শুধু প্রতিশোধের প্রমাণ নয়, বরং তার সাহস ও জ্ঞান পরীক্ষা করার এক চরম মুহূর্ত।
***
রূপসী মঠের পিশাচিনীর আসরের ভয়ঙ্কর প্রভাব থেকে কিছুটা সময় বের করে গ্রামের এক নিঃশব্দ রাতে শুয়ে থাকে, কিন্তু তার মন কখনো শান্ত হয় না। ঘুম আসে, তবে ঘুমের মধ্যে ভয় এবং আতঙ্কের ছায়া তাকে ধীরে ধীরে তার মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। হঠাৎ সে স্বপ্নে প্রবেশ করে—এক অদ্ভুত, শান্ত, কিন্তু শক্তিশালী পরিবেশে। স্বপ্নে দেখা দেয় দিদিমা, রূপসীর জীবনে একজন প্রিয় আত্মীয়, যার জীবনধারা ও জ্ঞান অতীতের রহস্যময় শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। দিদিমার চেহারা স্বপ্নে উজ্জ্বল, শান্ত, এবং একই সঙ্গে এক গভীর জ্ঞান প্রদর্শন করছে। রূপসী অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে, দিদিমা তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন জানে সে কোন পরিস্থিতিতে আটকে আছে। দিদিমা ধীরে ধীরে তার কাছে আসে এবং একটি প্রাচীন মন্ত্র শেখাতে শুরু করে। তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত মৃদু সুর, যা শুনলেই রূপসীর মন শান্ত হয়, ভয় কমে যায় এবং এক ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি জাগ্রত হয়।
মন্ত্র শেখানোর সময়, দিদিমা রূপসীকে বলে—“বৃত্ত যদি ভাঙো, ফেরত বৃত্তেই বেঁধো।” রূপসী প্রথমে ঠিক বুঝতে পারে না, তবে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে, এটি কোনো সাধারণ মন্ত্র নয়। এটি সেই প্রাচীন শক্তি নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায়, যা ভাঙা মন্ত্রের প্রভাবকে স্থির করতে পারে এবং পিশাচিনীর শক্তিকে পুনরায় বন্দি করতে পারে। স্বপ্নে দিদিমা প্রতিটি ধাপে ধীরে ধীরে নির্দেশ দেয়, কিভাবে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে হবে, হাতের অঙ্গভঙ্গি এবং মনোযোগের সমন্বয় করতে হবে। রূপসী মনোযোগ দিয়ে সব শিখছে, তবে তার মনে ভয়ও আছে—কারণ বাস্তব জগতে শক্তি এতটাই প্রবল যে, এক ভুল পদক্ষেপই সমস্ত প্রচেষ্টা ধ্বংস করতে পারে। স্বপ্নে দিদিমার উপস্থিতি তাকে শান্তি এবং সাহস দেয়, যা তার ভিতরের শক্তিকে জাগ্রত করছে। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে রূপসী মনে মনে বুঝতে পারছে, এটি শুধু মন্ত্রের পুনঃস্থাপন নয়, বরং তার আত্মবিশ্বাস ও জ্ঞানকে পরীক্ষার এক চরম মুহূর্ত।
রূপসী স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে, তবে দিদিমার শিক্ষা তার মনে অম্লান। সে জানে, যে মন্ত্র শিখেছে তা তার একমাত্র অস্ত্র, এবং এটি প্রয়োগ না করলে গ্রামে ছায়ার খেলা এবং পিশাচিনীর প্রতিশোধ অব্যাহত থাকবে। সে নোটবুকে মন্ত্রের শব্দগুলো লিখে রাখে, প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি উচ্চারণ নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে। তার মনে একটি স্থির সংকল্প জন্মায়—বৃত্তকে পুনরায় বন্ধ করতে হবে, ভাঙা মন্ত্রের ক্ষতকে শুদ্ধ করতে হবে এবং পিশাচিনীর শক্তিকে পুনরায় বন্দি করতে হবে। রাতের নিরবতা, বাতাসের হালকা শব্দ, এবং ঘরের ছায়া—সবই যেন তাকে পরীক্ষা করছে। রূপসী বুঝতে পারে যে, সাহস, মনোযোগ এবং প্রাচীন শিক্ষার সমন্বয় ছাড়া সে সফল হতে পারবে না। স্বপ্নের শিক্ষা তাকে শুধু তথ্য নয়, বরং আত্মবিশ্বাস এবং প্রয়োজনীয় কৌশলও প্রদান করেছে। রূপসী প্রস্তুতি নেয়, ধীরে ধীরে মন্ত্র উচ্চারণের জন্য স্থির হয়ে যায়, জানে যে এটি হতে পারে তার, গ্রামবাসীর, এবং ভাঙা মন্ত্রের ভয়ঙ্কর শক্তির পুনঃস্থাপনের শেষ রক্ষাকবচ।
***
রূপসী মন্ত্রের প্রভাব পুনঃস্থাপনের প্রস্তুতি নিয়ে অধ্যাপক সহ মঠের গভীরে প্রবেশ করে। তারা দুজনেই জানে যে, এখন কোনো সাধারণ পরীক্ষা নয়—এটি এক জীবন ও মৃত্যুপরীক্ষা, যেখানে ভুল পদক্ষেপের ফল ভয়ঙ্কর। অধ্যাপক ধীরে ধীরে রূপসীর কাছে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, পূর্বের গবেষণায় যা শিখেছে তা ভিত্তি করে কৌশল সাজায়। রূপসীর মন স্থির হলেও, ভয় এবং দুশ্চিন্তার ছায়া তার মনে প্রবেশ করে। তারা ধীরে ধীরে মন্ত্র পুনরাবৃত্তি শুরু করে, উচ্চারণের প্রতিটি শব্দ সঠিকভাবে মিলিয়ে ধরা হচ্ছে। তবে, অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যায় যে, পিশাচিনীরা তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে। ঘরের বাতাস ঘন হয়ে যায়, অদ্ভুত ছায়া নড়াচড়া শুরু করে এবং পিশাচিনীর আগুনি চোখ প্রতিটি কোণে ঘুরছে। প্রতিটি উচ্চারণে তারা বাধা দেয়—দরজা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, আলো নিভে যায়, ধোঁয়া কক্ষের মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রূপসী এবং অধ্যাপক উপলব্ধি করে যে, শুধু জ্ঞান ও সাহস যথেষ্ট নয়, বরং মন্ত্রকে পুনরায় স্থাপন করার জন্য আরও বড় আত্মত্যাগ প্রয়োজন।
দয়াল, যে সমস্ত সময়ে তাদের সতর্ক করছিল, হঠাৎ প্রकट হয় এবং সত্য প্রকাশ করে। তিনি বলে, “এই মন্ত্রের শক্তি এতই প্রবল যে, এটিকে স্থির করতে একজনকে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। কোনো বিকল্প নেই। শুধু সাহস, জ্ঞান, বা কৌশল দিয়ে এটি সম্ভব নয়। কেউকে নিজের সর্বশেষ শক্তি দিয়ে মন্ত্রকে পুনরায় বন্ধ করতে হবে।” রূপসী স্থবির হয়ে যায়। তার সামনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়—কীভাবে সে তার নিজের জীবন এবং গ্রামের নিরাপত্তার মধ্যে সমন্বয় করবে। অধ্যাপকও এই কঠিন সত্যকে মেনে নেয়, এবং দুজনের মধ্যে নীরব এক বোঝাপড়া তৈরি হয়। ছায়া ঘন হয়ে যায়, পিশাচিনীর শক্তি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বাতাসে আগুনের গন্ধ, অদ্ভুত শব্দ, এবং ঘরের প্রতিটি কোণ যেন তাদের প্রতি হুমকি জানাচ্ছে। এই মুহূর্তে বিশ্বাস এবং ভয় একসাথে কাজ করছে, যা রূপসীকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। তার মনে আসে দিদিমার শিখানো প্রাচীন মন্ত্র—বৃত্ত যদি ভাঙো, ফেরত বৃত্তেই বেঁধো। কিন্তু এবার তাকে উপলব্ধি করতে হবে, এই “ফেরত বৃত্ত” মানে একান্তই আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত।
রূপসী ও অধ্যাপক শেষবার চেষ্টা শুরু করে। উচ্চারণ, অঙ্গভঙ্গি, এবং মনোযোগের মিলিত প্রতিটি পদক্ষেপ এখন এককভাবে জীবন-মৃত্যুর পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। পিশাচিনীর আক্রমণ আগের চেয়ে আরও তীব্র। ধোঁয়া ঘন, বাতাস কঠিন, এবং অদ্ভুত আলো কক্ষের মধ্য দিয়ে ঝাপসা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা রূপসীর মনকে আরও স্থির করে, তবে ভয়ও বাড়ায়। সে জানে, একমাত্র আত্মত্যাগের মাধ্যমে মন্ত্র স্থির হবে। রূপসী নিজের অন্তরের সাহসকে আহ্বান করে, এবং সে প্রস্তুত হয় জীবনের সর্বশেষ শক্তি উৎসর্গ করার জন্য। অধ্যাপক তার পাশে দাঁড়ায়, নীরব সমর্থন প্রদর্শন করে। শেষ মুহূর্তে, রূপসী নিজের প্রাণের শক্তি মন্ত্রে উৎসর্গ করে, এবং সেই শক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে ভাঙা মন্ত্র পুনরায় বৃত্তে বাঁধা হয়। ঘরের অন্ধকার ও ছায়া এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়, আগুন নিভে যায়, এবং পিশাচিনীর শক্তি স্থির হয়। রূপসী জানে, বিশ্বাস, সাহস, এবং প্রয়োজনীয় আত্মত্যাগ ছাড়া এই বিভীষিকা কখনো সমাধান হতো না।
***
রূপসী মঠের গভীর অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করলে সে অনুভব করে, প্রতিটি কোণেই অগ্নিমন্ত্রের শক্তি ঘন হয়ে আছে। বাতাস ভারী, স্থির নয়—প্রতিটি শ্বাসে কক্ষ যেন কম্পিত হচ্ছে। ছায়া এবং আলো এক ধরনের অদ্ভুত খেলা করছে, যা অচেনা ভয় এবং উত্তেজনার সংমিশ্রণ তৈরি করছে। রূপসী ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়, হাতে নোটবুক এবং প্রাচীন মন্ত্রপাণ্ডুলিপি ধরে। হঠাৎই, অগ্নিমন্ত্র নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে—এক জ্বলন্ত, আগুনের মতো শক্তিশালী সত্তা, যা নিজের উপস্থিতি দিয়ে কক্ষকে আলোড়িত করছে। তার চোখে এক অদ্ভুত প্রলুব্ধি, যা রূপসীর মনকে টানার চেষ্টা করছে। অগ্নিমন্ত্র ধীরে ধীরে বললো, “আমার সাথে এলে তুমিও অমর হবে। শক্তি, যন্ত্রণাহীনতা, এবং সময়ের বাঁধা ছাড়াই তুমি আমার সঙ্গে মিলিত হতে পারো।” রূপসী স্থবির, মনে ভয় জাগে, কিন্তু দিদিমার শেখানো প্রাচীন মন্ত্র এবং তার নিজের অভ্যন্তরীণ সাহস তাকে স্থির রাখে। তার মনে একটাই লক্ষ্য—মন্ত্রকে পুনঃস্থাপন করে অগ্নিমন্ত্রকে আবারও বন্দি করা।
সংঘর্ষ শুরু হয়। অগ্নিমন্ত্র রূপসীকে প্রলুব্ধ করার জন্য সব ধরণের শক্তি ব্যবহার করছে। আগুন, ছায়া, এবং অদ্ভুত শব্দের সমন্বয়ে কক্ষ যেন এক বাস্তব-অস্তিত্বহীন জায়গায় পরিণত হয়। রূপসী ধীরে ধীরে তার মনকে একত্রিত করে, দিদিমার শেখানো মন্ত্রের প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ শুরু করে। শব্দগুলো প্রথমে কণ্ঠে কম্পিত হয়, তবে প্রতিটি উচ্চারণে একটি দৃঢ় শক্তি তৈরি হচ্ছে। অগ্নিমন্ত্র ক্রমশ উত্তেজিত হয়, তার আগুনের লেপ্টা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ছায়া আরও তীব্র এবং অদ্ভুত। সে চেষ্টা করছে রূপসীর মনকে ভেঙে দিতে, প্রলুব্ধি এবং ভয় দেখানোর মাধ্যমে। কিন্তু রূপসী স্থির থাকে। প্রতিটি উচ্চারণে তার আত্মবিশ্বাস, সাহস, এবং দিদিমার শেখানো জ্ঞান মিলিত হয়ে অগ্নিমন্ত্রের আগুনের দিকে শক্তি ছুড়ে দিচ্ছে। কক্ষের বাতাস কম্পিত, আলো এবং ছায়ার খেলা আরও জটিল, তবে রূপসী জানে, এখন শুধু সাহস নয়, মনোযোগ এবং সঠিক উচ্চারণই তাকে বাঁচাতে পারে।
শেষ মুহূর্ত আসে। রূপসী মন্ত্রের শেষ শব্দ উচ্চারণ করলে, কক্ষের সব শক্তি যেন একত্রিত হয়ে স্থির হয়ে যায়। অগ্নিমন্ত্র চিৎকার করে, আগুন হালকা হয়ে যায়, এবং তার ছায়া ও শক্তি ক্রমশ ধীরে ধীরে বিলীন হতে শুরু করে। রূপসী শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, তার মন স্থির, মনে ভয় অদৃশ্য, কারণ সে জানে, দিদিমার মন্ত্র এবং নিজের সাহসই তাকে এই চূড়ান্ত সংঘর্ষে রক্ষা করেছে। অন্ধকারের ঘনতা হ্রাস পায়, বাতাস আবার শান্ত হয়, এবং কক্ষের সমস্ত আগুন নিভে যায়। অগ্নিমন্ত্র অবশেষে বন্দি হয়ে যায়, তার প্রতিশোধী শক্তি স্থির হয়। রূপসী বুঝতে পারে, তার সাহস, দিদিমার প্রাচীন শিক্ষা, এবং মনোযোগ মিলিয়ে সে অগ্নিমন্ত্রকে পুনরায় মন্ত্রের মধ্যে বন্দি করতে সক্ষম হয়েছে। সংঘর্ষ শেষ হলেও, রূপসী জানে, এই বিজয় কেবল তার কৌতূহল, বিশ্বাস এবং আত্মত্যাগের ফলে সম্ভব হয়েছে, এবং মন্ত্র পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে গ্রামের শান্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
***
ভোরের অন্ধকার ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে, মঠের ভেতরের বাতাসে হালকা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু রূপসীর মন এখনও অস্থির। তার চোখে দেখা যায়, পিশাচিনীর অদ্ভুত ছায়া এবং অগ্নিমন্ত্রের শক্তি ক্রমশ স্থির হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে, সেই শক্তি একটি বন্ধ বৃত্তে আবদ্ধ হয়, যা দিদিমার শেখানো প্রাচীন মন্ত্র এবং তার নিজস্ব সাহসের ফল। রূপসী লক্ষ্য করে, বৃত্তটি কেবল একটি অদৃশ্য সীমারেখা নয়; এটি এক ধরনের শক্তির সমন্বয়, যা পিশাচিনী এবং অগ্নিমন্ত্রকে স্থির করে রেখেছে। তবে, এই স্থিরতা একটি নীরব, শীতল পরিবেশের মধ্যে আসে। বাতাসে আগুনের গন্ধ নেই, ছায়া আর নড়াচড়া করছে না, এবং কক্ষের প্রতিটি কোণ নিঃশব্দ হয়ে গেছে। রূপসী ধীরে ধীরে নিজের নিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, যদিও তার মনে একটি অদ্ভুত প্রশ্ন জাগে—বৃত্ত কি সত্যিই সম্পূর্ণ, নাকি কোথাও কোনো অদৃশ্য ছায়া এখনও মুক্ত আছে।
দয়াল, যে সমস্ত সময়ে রূপসীকে সতর্ক ও সহায়তা করেছে, নিজেকে উৎসর্গ করে মন্ত্রের পূর্ণতা নিশ্চিত করে। তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে বৃত্তে অন্তর্ভুক্ত সমস্ত পিশাচিনী ও অগ্নিমন্ত্রের শক্তি স্থির হয়ে যায়। রূপসী চোখের সামনে দেখছে, কেমন করে তার প্রিয় কুযো বৃদ্ধ নিজেকে উৎসর্গ করে, সমস্ত শক্তি স্থির করার মাধ্যমে বৃত্তকে সম্পূর্ণ করছে। দয়ালের এই আত্মত্যাগ শুধু শক্তিকে বন্ধ করেছে না, বরং রূপসীর মধ্যে এক গভীর শিক্ষাও প্রতিফলিত করেছে—সাহস, বিশ্বাস, এবং আত্মত্যাগ মিলিয়ে যে কোনো ভয়ঙ্কর শক্তিকে সামলানো যায়। রূপসী ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, প্রতিটি মন্ত্র, প্রতিটি উচ্চারণ, প্রতিটি পদক্ষেপ একত্রিত হয়ে এই চূড়ান্ত শান্তি এনেছে। দয়ালের আত্মত্যাগ ছাড়া সম্ভব হত না, এবং তার শিক্ষা রূপসীর মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে।
সকালের আলো মঠের কক্ষে ঢুকে পড়ে, নরম রোদ মাটির ফোঁটা এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্যের ওপর পড়ে। সমস্ত ভয়, শক্তি এবং অন্ধকার যেন স্থির হয়ে গেছে। রূপসী বাইরে দাঁড়িয়ে মঠের দিকে তাকায়, গভীর প্রশান্তি অনুভব করে, তবে মনে প্রশ্ন থেকে যায়—এই বৃত্ত কি সত্যিই সম্পূর্ণ, নাকি কোনো অদৃশ্য ছায়া এখনো মুক্ত আছে। মাটির ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ, বাতাসের হালকা সুঁই এবং গাছের নড়াচড়ায় সে মনে করতে থাকে, এই শান্তি কি চিরস্থায়ী, নাকি কোনো সময় আবার ছায়া ফিরে আসবে। তার মনে আসে দিদিমার শেখানো মন্ত্র, দয়ালের আত্মত্যাগ এবং তার নিজের সাহস—এই তিনটির সমন্বয়ই বৃত্তকে সম্পূর্ণ করেছে। তবে, রূপসী জানে, অতিপ্রাকৃত শক্তি কখনো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না; শুধু এটিকে স্থির ও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সে ধীরে ধীরে মঠ থেকে বেরিয়ে আসে, বুকে অদ্ভুত প্রশান্তি, এবং মনে একটি অম্লান প্রশ্ন—বৃত্ত কি সত্যিই সম্পূর্ণ, নাকি কোনো অদৃশ্য ছায়া এখনও মুক্ত আছে—যা তার ভবিষ্যতের জন্য এক অদৃশ্য সতর্কতা হিসেবে থেকে যায়।
____



