Bangla - ছোটগল্প

পাহাড় ডাকে

Spread the love

শ্রীজিত বন্দ্যোপাধ্যায়


ট্রেন ছাড়ার হুইসেল যখন শিয়ালদহ স্টেশনের কোলাহল কেটে রাতের নিস্তব্ধতাকে চিরে দিল, তখন আমি জানলার পাশে বসে সামনের সাত দিনের চিন্তায় ডুবে ছিলাম। ব্যাগে জুতসই জামাকাপড়, হাতে একটা নোটবুক, মাথায় শুধু একটাই ইচ্ছা—নিজেকে একটু খুঁজে পাওয়া।
নামটা আগেই ঠিক ছিল—কালিম্পং। দার্জিলিং, কার্শিয়াং, মিরিক ঘুরে ফেলেছি অনেকবার, কিন্তু এই পাহাড়ি শহরটা আমার কাছে ছিল এক রহস্য।
ট্রেন ছুটছে—কাঁচের বাইরে শহরের আলো এক এক করে ফিকে হয়ে আসছে। পাশে বসা সত্তরোর্ধ্ব ভদ্রলোক হঠাৎ কথা বলে উঠলেন,
“উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন?”
আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ, কালিম্পং।”
তিনি চোখ মুছলেন, “কালিম্পং মানে আমার শৈশব। আপনার ভালো লাগবে, খুব ভালো।”
রাত বাড়ছে, ট্রেন এগোচ্ছে শিলিগুড়ির দিকে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অন্ধকারের ভিতর এক অদৃশ্য হাত যেন টেনে নিচ্ছে আমাকে কোনো অজানার দিকে।
সকালে ঘুম ভাঙল এক কাপ চায়ের গন্ধে। হকার ছেলেটা কেশে উঠে বলল, “বাবু, মালবাজার। আর একটু পরেই নিউ মাল জংশন।”
শিলিগুড়ি নামতেই টের পেলাম ঠান্ডা হাওয়ার এক অদ্ভুত শীতলতা, যেটা কোলকাতার কনকনে ঠান্ডা নয়—এটা পাহাড়ের স্পর্শ।
একটা ছোট মারুতি গাড়ি বুক করেছিলাম আগেই। ড্রাইভারের নাম বিনয়। হাঁটু অবধি চাঁড়ি জ্যাকেট, চিবিয়ে চলেছেন পান। বললেন,
“কালিম্পং যেতে তিন ঘণ্টা লাগবে, কিন্তু রাস্তা সুন্দর।”
গাড়ি চলল টিজি রোড ধরে—এক দিকে খাড়া পাহাড়, অন্য দিকে গভীর খাদ। চা বাগানের মাঝে মাঝে ছোট দোকান, স্কুলের ছেলেমেয়েরা হেসে হেসে রাস্তা পার হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, আমি যেন একটা চলন্ত সিনেমার ভিতর ঢুকে পড়েছি।
দুই ঘণ্টা পেরিয়ে যেতেই দূরে দেখা দিল পাহাড়ি শহর—ছোট ছোট কাঠের বাড়ি, ছাউনির ওপরে ধোঁয়া উঠছে, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা ফিকে ছায়া।
বিনয় বলল, “এই তো কালিম্পং। এখানেই স্বপ্নরা ঘুমোয়, বাবু।”
হোটেলটা শহরের একটু উপরে। কাঠের বারান্দা, জানলা দিয়ে মেঘ ঢোকে মাঝে মাঝে। রিসেপশনের দিদি বললেন,
“চা দেব? এখানকার লেমন গ্রাস চা কিন্তু বিখ্যাত।”
আমি জানলার ধারে বসে চায়ের কাপ হাতে ভাবতে থাকি—এই শহরের কোথাও আমার হারানো কিছু লুকিয়ে আছে কি?
***
ঘুম ভাঙল এক অচেনা শব্দে—নয়, এটা অ্যলার্ম নয়, বা শহরের হর্ন নয়। এটা যেন এক পাখির ডানার শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা ঘণ্টার রিনরিন। আমি জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি—কালিম্পংয়ের ভোর উঠে এসেছে ঘুমচোখে, মেঘের চাদর গায়ে মুড়ি দিয়ে।
হোটেলের কাঠের ঘর ঠান্ডায় জমাট। বাইরে নেমে আসতেই চায়ের ভাঁড় হাতে ধরিয়ে দিলো রিসেপশনের ছেলেটি—
“ভোরের লেমন গ্রাস চা, স্যার।”
চুমুক দিয়েই টের পেলাম—এই চায়ে আছে গন্ধ, কিন্তু শব্দ নেই; আছে স্মৃতি, কিন্তু শব্দ নেই।
সকালে বেরিয়ে পড়লাম শহরের দিকে। কালিম্পংয়ের রাস্তাগুলো যেন আঁকাবাঁকা কবিতা। বাঁ দিকে গোমফা, ডান দিকে ফুলের নার্সারি। বাজারের মোড়ে দাঁড়ানো এক বুড়ো মানুষ বাঁশি বাজাচ্ছেন।
এক অদ্ভুত সুর—মেঘ, চা, আর ছেলেবেলার গল্পে গাঁথা।
এগিয়ে গেলাম হান্সা হিল ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ে চড়তে চড়তে হাফ ধরে এল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তেই পেছন থেকে একটা মিষ্টি গলা—
“এগোবেন না, ওইদিকে স্লিপারি।”
আমি ঘুরে দেখি—সাদা সোয়েটারে এক মেয়ের মুখ, চোখে লাল টিপ, হাতে একটা নোটবুক। সে বলল,
“আমার নাম কুহেলি। আমি এখানে গাইড করি। চলুন, আমি ঠিক জায়গাটায় নিয়ে চলি।”
আমরা একসঙ্গে হাঁটতে থাকি। তার হাঁটার ছন্দে যেন পাহাড়ের তাল মেলে।
সে বলল, “আপনি কী করেন?”
আমি বলি, “কলকাতায় থাকি। গল্প লিখি। মাঝে মাঝে পালিয়ে আসি।”
সে হাসে। “পাহাড়ে পালিয়ে এলে কি পালানো যায়?”
আমি বলি, “না। বরং নিজের দিকে ফেরা যায়।”
আমরা পৌঁছাই ভিউ পয়েন্টে। সামনে মেঘে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা। কুহেলি বলল,
“এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। এখানে দাঁড়ালে সময় থেমে যায়।”
আমি দাঁড়িয়ে আছি, পকেট থেকে খাতা বের করি। লিখে ফেলি—
“আজকের সকাল শুধু পাহাড়ের নয়, এক গাইডের চোখেও আমি নিজেকে নতুন করে দেখলাম।”
***
“আপনি যদি একটু অন্যরকম কিছু দেখতে চান, তাহলে ধামসা মনস্ত যাবেন। শহর থেকে অনেক দূরে, ট্যুরিস্টরা যায় না ওখানে,” কুহেলি বলেছিল আগের দিন বিদায়ের সময়।
আমি বলেছিলাম, “চলো না, আমিও তো পালিয়ে এসেছি, এবার একদম পালিয়ে যাই।”
পরদিন সকাল আটটা। আমি আর কুহেলি একটা ছোট গাড়িতে উঠলাম। কালিম্পং ছাড়িয়ে গাড়ি চলতে লাগল মাটির রাস্তা ধরে। রাস্তার পাশে চা বাগান, অর্কিডের ঝোপ, গাঁয়ের ছেলেরা খালি পায়ে হেঁটে চলেছে। একটা সময় পরে গাড়ি আর এগোতে পারল না—সামনের রাস্তা কাদায় ভরা, ঢালু আর পাথুরে।
বিনয় বলল, “এরপর হাঁটতে হবে বাবু। ধামসা মনস্ত এখান থেকে আর ঘণ্টাখানেক।”
হাঁটা শুরু হল। পথের পাশে ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে লামা বাঁশের ঝাড়। হঠাৎ করেই এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়ালেন, হাতে বাঁশের ঝুড়ি, চোখে চওড়া চশমা।
“নতুন মানুষ বুঝি এল গ্রামে?”
কুহেলি হেসে বলল, “দিদিমা, কলকাতা থেকে এসেছে। লেখে, দেখতে এসেছে আমাদের ধামসা মনস্ত।”
দিদিমা বললেন, “তাহলে আসুন, আগে এক কাপ রক্তচন্দন চা খেয়ে তারপর দেখবেন পাহাড়ের গান।”
গ্রামের ঘরগুলো কাঠ আর মাটির। বাড়ির ছাদে শুকোচ্ছে রিংখি মরিচ, উঠোনে ছাগল রোদ পোহাচ্ছে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক চলে গেছে সেই কবে, কিন্তু এখানে কান্না নেই—শুধু হাঁসির আওয়াজ।
দিদিমার ঘরে ঢুকে দেখি পুরোনো হ্যান্ডক্রাফটস, পাথরের তৈরি পুতুল, আর এক কোণে বাঁশি রাখা। চা এসে গেল—লালচে রঙের, গন্ধে যেন মাটি মিশে আছে।
আমি বললাম, “এই গ্রামে কেউ আসে না?”
কুহেলি বলল, “শুধু যারা খুব ক্লান্ত, তারাই আসে।”
সন্ধ্যায় পাহাড়ের কোল ধরে হাঁটছিলাম আমরা তিনজন—আমি, কুহেলি আর ছোট্ট সোনাই, দিদিমার নাতনি। সোনাই বলল,
“আপনি কী লেখেন?”
আমি বলি, “তোমাদের মতো পাহাড়ের গল্প।”
সে হেসে বলল, “তাহলে আমাদের নামও থাকবে?”
আমি মাথা নেড়ে বলি, “হ্যাঁ, গল্পে থাকবে ধামসা মনস্ত, থাকবে তোমার লাল জামা, দিদিমার চা, আর এই পাহাড়।”
রাত গভীর হলে কুহেলি বলল, “আপনি এখানেই থাকুন আজ। এখানে থেকে গেলে কাল ভোরে সূর্যোদয়টা দেখতে পাবেন, মেঘের বিছানার উপর থেকে।”
আমি বলি, “আজ থাকি, কারণ মনে হচ্ছে—এই গ্রামের চুপ করে থাকা, আমার চুপ থাকা ভাষা পেয়েছে।”
***
ভোররাতে ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়। ঘরের জানলা খুলতেই চোখের সামনে ছড়িয়ে পড়ল যেন কোনো স্বপ্নের খোলা পাতা—সমস্ত গ্রাম ঘিরে সাদা মেঘের চাদর, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা রুপোলি আলো।
কুহেলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কাঁধে শাল জড়ানো। আমি চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ালাম তার পাশে।
সে বলল, “দেখেছেন কখনও মেঘের উপর দিয়ে সূর্য ওঠে?”
আমি মাথা নাড়লাম, “আজ প্রথম।”
নিঃশব্দে দুজন দাঁড়িয়ে রইলাম। মেঘের স্তর কেটে রোদের ফালি ছুঁয়ে দিল কাঠের রেলিং। সেই আলোয় কুহেলির মুখ দেখলাম স্পষ্ট—একটা নির্ভার তৃষ্ণা, যেন অনেক কিছুর পরে একটুখানি শান্তি খুঁজে পেয়েছে।
“তুমি আগে এখানে থাক?”
সে বলল, “না। আমার দাদু থাকতেন এই গ্রামে। ছোটবেলায় গ্রীষ্মের ছুটিতে আসতাম। এখনকার মতো শান্ত তখনও ছিল, কিন্তু তখন বুঝিনি শান্তি কাকে বলে।”
আমি বলি, “তুমি তাহলে ফিরে এসেছ নিজের ফেলে যাওয়া গ্রামে?”
সে চোখ নামিয়ে বলল, “ফিরে আসা ঠিক নয়, বরং পালিয়ে আসা। শহর আমাকে কাঁদতে দেয় না, এখানে অন্তত চোখের জল লুকোতে হয় না।”
আমি তাকিয়ে থাকি তার চোখে।
“তুমি লিখো তো?”
আমি মাথা নাড়ি।
সে বলল, “তাহলে আমার একটা গল্প লেখো।”
“কী গল্প?”
“একটা মেয়ে—যে পাহাড়ে গিয়ে নিজের ছায়াটাকে খুঁজে পায়। ছায়া তো হারিয়ে যায় না, ঠিক?”
আমি কিছু বলি না। খাতাটা বার করে লিখতে থাকি—”মেঘে লেখা চিঠি।”
বিকেলের দিকে দিদিমা একটা পুরনো ট্রাঙ্ক খুলে কুহেলিকে ডেকে বললেন, “তোমার মায়ের পুরোনো জিনিসগুলো রইল। রেখে দাও।”
কুহেলি চুপচাপ ট্রাঙ্কের একটা কাগজ তুলে নিল—হাতে লেখা চিঠি, এক অজানা ঠিকানায় পাঠানো হয়নি কোনোদিন।
সে ফিসফিস করে বলল, “আমার মা এখানে ফিরতে চেয়েছিল, পারেনি। আমি ফিরেছি। সেই চিঠির জবাব হয়তো আমার গল্পেই থাকবে।”
রাতের খাওয়া শেষে আমি বারান্দায় বসে লিখে চলি।
“এই গ্রামে শব্দ নেই, অথচ কত গল্প! একটানা পাহাড়, মেঘ, হারানো মা, এক মেয়ের ফিরে আসা। এটাই কি বাড়ি?”
***
ধামসা মনস্তের শেষ সকালটা অন্য রকম ছিল। পাখির ডাক যেন একটু বেশিই নরম, মেঘটা যেন একটু বেশিই ধরা যায়—আর কুহেলির চোখে তখন এক অদ্ভুত স্থিরতা।
আমার ব্যাগ গুছোনো, খাতাটা তবু খোলা—শেষ পাতায় কিছুই লেখা হয়নি।
কুহেলি বলল, “ফিরে যাচ্ছ?”
আমি বললাম, “ফিরছি না। ফিরে দেখছি। আমার ভিতরেই একটা জায়গা থেকে যাচ্ছ।”
সোনাই এসে বলল, “গল্পটা লিখবেন তো?”
আমি বললাম, “তুমি পড়বে তো?”
সে হাসল, “তবে লিখুন।”
বিদায়ের সময় দিদিমা এক মুঠো শুকনো লবঙ্গ আর চা পাতি দিলেন। বললেন, “কলকাতার গন্ধে মিশিয়ে দিয়ো পাহাড়ের কথাগুলো।”
পাহাড়ি রাস্তায় নামার আগে শেষবারের মতো পেছন ফিরে দেখি—কুহেলি দাঁড়িয়ে, কাঁধে হালকা শাল, চোখে কোনো অভিমান নেই, শুধু এক টুকরো চুপ থাকা।
গাড়িতে বসে আমার খাতা খুলে পড়ি আগের লাইনগুলো—
“এই গ্রাম ছিল না কোনও মানচিত্রে, কিন্তু আমার ভিতরের মানচিত্রে ধামসা মনস্ত চিরকাল থাকবে।”
শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন ছাড়তেই শহরের আলো ফিরতে লাগল। জানলার বাইরে পরিচিত গাছপালা, দোকান, স্টেশন। কিন্তু ভিতরে কোথাও একটা বদল হয়েছে। আর আমি জানি, সেই বদল—ধামসা মনস্তই এনেছে।
কলকাতায় ফিরে প্রথম রাতেই লিখলাম সেই শেষ লাইনটা—
“যেখানে শব্দ থেমে যায়, সেখানেই শুরু হয় পাহাড়ের ভাষা। ধামসা মনস্ত ছিল আমার শব্দহীন চিঠি, কুহেলি ছিল পাঠক। আর আমি? আমি ছিলাম সেই পাহাড়, যে ডাকে না—শুধু অপেক্ষা করে।”

শেষ

Lipighor_1749874934559.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *