Bangla - রহস্য গল্প

পাহাড়ের ডাক

Spread the love

তীর্থজিৎ পাল


অধ্যায় ১: ভেঙে পড়া স্বপ্ন

অয়ন মেট্রোর জানালায় চোখ রেখে বসে ছিল। কাচের ওপারে ছুটে চলা শহরের বিলবোর্ড, গাড়ির হেডলাইট, এবং রঙিন আলোগুলো তার চোখে ঝাপসা হয়ে আসছিল। ভিড়ে ঠাসা কোচের মাঝেও সে যেন একা। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু ক্লান্তি। একধরনের গভীর, নিঃসঙ্গ ক্লান্তি।

শেষ এক বছরে তার জীবন যেন ভেঙে গিয়েছে বারবার। সে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি—ডিগ্রি ভালো, অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট, কিন্তু প্রতিটি ইন্টারভিউ শেষে শুনেছে সেই একই কথা—“আমরা আপনার প্রোফাইল আপাতত বিবেচনা করছি না।” কর্পোরেট দুনিয়ার শীতল ভাষা একসময় তার হৃদয়কেও ঠান্ডা করে দিয়েছে।

চাকরির খোঁজে ছুটে চলা এই শহরটা তাকে যে পরিমাণ স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার চেয়ে দ্বিগুণ স্বপ্ন ছিঁড়ে নিয়েছে।

অয়ন কলকাতার উপকণ্ঠে ছোট এক শহরে বড় হয়। বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মা গৃহিণী। ছোটবেলায় সে পাহাড়, নদী আর আকাশের ছবি আঁকত। কিন্তু পরামর্শ এসেছিল—“সায়েন্স নাও, ভালো রেজাল্ট করো, চাকরি হবে।” অয়ন শুনেছিল, চুপ করে আঁকা রেখে দিয়েছিল।

স্নাতক পাশ করার পর সে শহরে চলে আসে, প্রথমে পড়াশোনা, তারপর চাকরির খোঁজে। কিন্তু এখানে এসে সে বুঝল—শহরের ইট-কাঠে শুধু ভবিষ্যৎ গড়ে না, মানুষ নিজেকেও হারিয়ে ফেলে।

রাতগুলো অয়ন কাটাত এক খালি ঘরে, বেসরকারি এক হোস্টেলের এক কোনায়। জানালার ওপারে শোনা যেত দূরের ট্রেনের হুইসেল, পাশের ঘর থেকে আসত কারও ভিডিও কলের হাসি—তাতে তার জন্য কোনো স্থান ছিল না।

সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সে এক ব্যর্থ প্রেমিক। শুভ্রা—বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচয়। মেয়েটি উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। তারা স্বপ্ন দেখেছিল একসাথে একটা জীবন গড়ার। কিন্তু শহরের বাস্তবতা আর টানাপড়েনের মাঝে সেই সম্পর্কও ফিকে হয়ে যায়।

“তুই সবসময় নিজের ভেতরেই বন্দি থাকিস, অয়ন। বাইরে বেরোতে শেখ। এইভাবে কেউ বাঁচে?”
সেদিন শুভ্রার সেই কথায় অয়ন কোনো উত্তর দিতে পারেনি। হয়তো সে নিজেকেও চিনতে পারছিল না।

একদিন শুভ্রা হঠাৎ ফোন করেই বলল, “আমি এবার সিংগাপুর চলে যাচ্ছি। স্কলারশিপ পেয়েছি। সময় পেলে চিঠি লিখিস।”
চিঠি? এই যুগে? কিন্তু তার ফোনে কোনো উত্তর না দিয়ে, শুধু স্ক্রিনটা বন্ধ করে দিয়েছিল অয়ন।

সন্ধ্যায় সে প্রায়শই দক্ষিণ কলকাতার এক পার্কে বসত। চুপচাপ, ফোনের স্ক্রিনে স্ক্রল করতে করতে, অথবা শুধু গাছের পাতার শব্দ শুনে। তার পাশে বসা মানুষগুলো প্রেম করত, হাসত, চিৎকার করত। সে বসে থাকত যেন এক প্রেতাত্মার মতো—থাকা আর না থাকার মাঝামাঝি।

একদিন এক বৃদ্ধ লোক পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলে, তুমি কি কিছু খুঁজছো?”
অয়ন একটু চমকে উঠেছিল। “না… মানে… না তো।”
বৃদ্ধ হেসেছিলেন, “তোমার চোখের মধ্যে দেখি একটা পাহাড় আছে। সেইখানেই হারিয়ে গেছো হয়তো।”
অয়ন থেমে গিয়েছিল। “পাহাড়?”

সে কোনো উত্তর দেয়নি, কিন্তু সেদিন থেকেই অদ্ভুতভাবে সেই শব্দটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে—”পাহাড়”।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙে একটা স্বপ্নে। সে দেখেছে—সে একটা বিশাল পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শীতল বাতাস, সাদা মেঘ, এবং পাহাড়ের একদম চূড়া থেকে যেন কেউ তাকে ডাকছে। স্বপ্নটা খুবই স্পষ্ট ছিল, যেন বাস্তব।

সেইদিন সে প্রথমবার নিজের কলেজের পুরোনো স্কেচবুক বের করে। ভিতরে একটা পাতায় আঁকা ছিল একটা উঁচু পাহাড়, তার পাদদেশে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট মানুষ—বোধহয় সে নিজেই।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই সে ইন্টারনেটে সার্চ দেয়: “অরণ্যপাহাড়”।
তেমন কিছু উঠে আসে না। শুধু কিছু ব্লগ, অল্প কিছু মানুষের লেখা—একজন ট্রেকার লিখেছে: “এই পাহাড়ে গিয়েছিলাম, ফিরে আসার পর আর আমি আগের মানুষ ছিলাম না।”

অয়ন চমকে যায়। কী আছে সেই পাহাড়ে?

এরপর থেকে, তার সকালগুলো শুরু হয় পাহাড়ের ছবি খুঁজে আর রাতে ঘুম আসে না—কেবল এক অদ্ভুত ডাকে মন ছুটে চলে যায় দূরের কোনা।

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। বাবা-মা এখনও অপেক্ষায়—”ছেলে একদিন চাকরি পাবে।”
কিন্তু অয়ন জানে, সে দিন বোধহয় আর আসবে না।
সে চায় পালাতে। সবকিছু থেকে—চাকরি, সম্পর্ক, দায়িত্ব, ব্যর্থতা—এই পুরো শহরটা যেন তার উপর চাপ সৃষ্টি করছে, শ্বাসরোধ করছে।

এক রাতে, জানালার ধারে বসে সে লিখে:
“আমি যাচ্ছি। কোথায় জানি না, শুধু জানি—আর এখানে থাকতে পারছি না। যদি ফিরে আসি, আমি হয়তো এক নতুন মানুষ হবো। না ফিরলে… অন্তত নিজের মতো করে বেঁচে থাকবো।”

একটা ব্যাগে গুছিয়ে নেয় কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস—দু-তিনটা জামা, একটা নোটবুক, ও পুরোনো সেই স্কেচবুকটা।

মেট্রো স্টেশনের গেট পার হয়ে যাওয়ার সময়, সে আর পেছনে তাকায় না। শহরটা এখন আর তার নয়। সে জানে না কতদূর যেতে হবে, জানে না কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু ভেতরে যেন একটা কণ্ঠ বলছে—“চল।”

ট্রেন ছাড়ে। জানালার ওপার দিয়ে শহরটা ছোট হতে থাকে। অয়ন দেখে একটা পাখি উড়ছে আকাশে—মুক্ত, নিশ্চিন্ত, নির্ভার।

সেই মুহূর্তে সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে,
“আমি শেষ কবে মুক্ত বোধ করেছিলাম?”

কোনো উত্তর মেলে না।কিন্তু তার বুকের ভিতর কোথাও এক ধ্বনি ধীরে ধীরে জেগে ওঠে— পাহাড়ের ডাক।

অধ্যায় ২: ডাকে সাড়া

আলো নিভে যাওয়ার অনেক পরে, যখন শহরের ট্রাফিক শব্দ স্তব্ধ হয়ে আসে, অয়ন তখনো জেগে বসে থাকে খোলা স্ক্রিনের সামনে। চোখ লাল, মুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে।

গত তিন রাত ধরে সে ঘুমায়নি প্রায়। ইন্টারনেটের অজস্র প্রান্ত ঘেঁটে, অয়ন খুঁজছে এক পাহাড়ের নাম—“অরণ্যপাহাড়”। নামটা অদ্ভুত, যেন কোনো সাহিত্যিক রূপকথার অংশ। গুগল ম্যাপসে পাওয়া যায় না, কোনো সরকারি মানচিত্রে চিহ্নিত নয়, কিন্তু ব্লগ ও ফোরামের গহীনে কিছু ছায়াময় মন্তব্য পাওয়া যায়।

একজন লিখেছে:
“এই পাহাড়ে গেলে মনে হবে, কেউ তোমাকে চুপিচুপি দেখছে। ওটা শুধু পাথর নয়। ওটা যেন এক সত্তা।”

অয়ন ঘামছিল। এক অজানা ভয় ও কৌতূহল তাকে আঁকড়ে ধরেছে।

হোস্টেলের পুরোনো কেবিনেট ঘাঁটতে গিয়ে একদিন সে পায় এক হলুদ হয়ে যাওয়া খাতা—তার কলেজের বন্ধু কৌশিকের পুরোনো দিনলিপি। কৌশিক একসময় পাহাড়ে ট্রেকিং করত, নানা জার্নাল লিখত। এরপর হঠাৎ সে চাকরির জন্য ব্যাঙ্গালোর চলে যায়, আর যোগাযোগ কমে যায়।

দিনলিপির মাঝামাঝি এক পাতায় অদ্ভুতভাবে বড় করে লেখা— “অরণ্যপাহাড় – যেখানে পথ ফুরায়, শুরু হয় আত্মা।”

তার নিচে আঁকা আছে এক অস্পষ্ট স্কেচ—উঁচু এক পাহাড়, যার চূড়ায় মেঘের ভিতর কিছু লুকিয়ে আছে, আর নিচে লেখা তারিখ—“৫ই এপ্রিল, ২০১৫”।

অয়ন থমকে যায়। সে জানত কৌশিক হিমাচল বা উত্তরাখণ্ডে অনেক ট্রেক করেছে, কিন্তু এমন কোনো পাহাড়ের নাম সে কখনও শুনেনি। কৌশিক এই দিনলিপি রেখে গেছে কেন? হঠাৎ মনে পড়ে, একবার ফোনে কৌশিক বলেছিল—“আমি এমন এক জায়গায় গিয়েছিলাম, যা কোথাও নেই, কিন্তু তবুও আছে। বুঝবি একদিন।”

অয়ন তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। আজ, হাসি নেই।

এরপরের ক’দিন সে দিনলিপির পাতাগুলো মন দিয়ে পড়ে। সেখানে লেখা আছে বিভিন্ন হিমালয় যাত্রার বিবরণ, কিন্তু “অরণ্যপাহাড়”-এর অংশটি ভিন্ন।

কৌশিক লিখেছে—
“পাহাড়টা সব ট্রেকারদের কাছে পরিচিত নয়। স্থানীয়রা একে ‘বনপাহাড়’ বলে। শোনা যায়, অনেক বছর আগে কিছু সন্ন্যাসী এখানে তপস্যা করত। তারপর হঠাৎ একদিন এক ভূমিকম্পে তারা হারিয়ে যায়। কেউ আর ফিরে আসেনি। মানুষ বলে, পাহাড়টা নিজের মতো করে বাঁচে—যাকে চায়, তাকেই ডাকে।”

অয়ন শিউরে ওঠে। এটা কি কেবল কল্পনা? নাকি সত্যিই কিছু আছে?

একটি লাইন তার চোখে বারবার ধাক্কা দেয়—
“পাহাড়ের ডাক আসে হৃদয়ের গভীর থেকে। শহর যাদের গ্রাস করতে পারেনি, তারা একদিন সেই ডাক শুনবেই।”

সে রাতেই অয়ন সিদ্ধান্ত নেয়—সে যাবে। যে শহরে সে দিনদিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আর কোনো আশা নেই। তার কিছু হারানোর নেই, কিন্তু অনেক কিছু খুঁজে পাওয়ার বাকি।

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে, সে প্রথমবার দীর্ঘদিন পর আয়নায় নিজেকে দেখে। চোখে লাল ভাব, মুখে দাড়ি, কিন্তু এক নতুন কিছু চমক দেখা যায়। একরকম আলো যেন। তার মনে হয়—“হ্যাঁ, এটা আমার পথ।”

প্রথম কাজ—স্থান নির্ধারণ। অয়ন দিনলিপির হিমালয় অংশ বিশ্লেষণ করে বোঝে যে কৌশিক “অরণ্যপাহাড়”-এর কথা বলেছিল উত্তরাখণ্ডের পিন-পার্বতী উপত্যকার কাছাকাছি কোনো জায়গায়। সেখানে রুগড ট্রেল, ন্যূনতম ট্রাফিক, এবং অনেক পুরোনো গ্রাম, যেখানে আজও মোবাইল সিগনাল যায় না।

তবে সে নিশ্চিত নয়। এই জায়গাটা ম্যাপে নেই।

তবুও, সে খোঁজ পায় একটা স্থানীয় ট্রেকিং ফোরামের পোস্টে, যেখানে কেউ বলেছিল—
“অরণ্যপাহাড় ট্রেইল কোনো অনুমোদিত পথ নয়, স্থানীয় গাইড ছাড়া যাওয়া নিষিদ্ধ। গাইডরাও যেতে চায় না।”

অয়ন লেখে, “আমি একা যাব।”

পরদিন সে নিউ মার্কেট থেকে একটা ব্যাকপ্যাক কিনে, জুতো, হেডল্যাম্প, শুকনো খাবার, স্লিপিং ব্যাগ, জলফিল্টার ইত্যাদি গুছিয়ে নেয়। সে পাহাড়ের জন্য শরীরকে প্রস্তুত করতে শুরু করে—প্রতিদিন ভোরে হাঁটতে বেরোয়, দৌড়ায়, হালকা ওজন বহন করে।

হোস্টেলের লোকজন প্রশ্ন করে—“কোথায় যাচ্ছ?”
সে বলে—“বাড়ি।”
কিন্তু তার চোখ জানে, সে যাচ্ছে এমন এক জায়গায়, যা কারও বাড়ি নয়, তবুও তার নিজের।

মাকে ফোন করে। অনেকদিন পর।
“মা, আমি কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি।”
মা ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করেন, “চাকরির কথা কী হলো?”
অয়ন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে—“চাকরি না হয় পরে দেখা যাবে। আগে নিজেকে একটু খুঁজে নিই।”
মা উত্তর দেয় না। শুধু বলে—“সাবধানে থাকিস। যে দিকেই যা, ঠিকঠাক খাস।”

ফোন রাখার পর অয়ন জানালার পাশে বসে। শহরের ওপারে দূরের একটা উঁচু ছাদে সে কল্পনায় দেখে পাহাড়—ধোঁয়ায় ঢাকা, কিন্তু সজীব।

যাত্রার দিন আসে। ভোর ৫টা। ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে সে বেরোয়। শহর তখনো ঘুমে। সে সিএসটি স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে দিল্লি হয়ে দেরাদুন। সেখান থেকে বাস, তারপর আবার জিপ। প্রতিটি বাঁকে বদলায় তার চারপাশ—খালি ফ্ল্যাট থেকে ভরা বন, ব্যস্ত ট্রাফিক থেকে নীরব পাহাড়ি রাস্তা।

ক’দিনের মধ্যেই সে পৌঁছে যায় একটি ছোট পাহাড়ি গ্রামে—দারগাঁও। এখানেই কৌশিকের দিনলিপিতে শেষবার নাম ছিল।

এখানকার মানুষজন চুপচাপ। তারা বাইরের লোককে সহজে বিশ্বাস করে না।

অয়ন এক বৃদ্ধ গাইডকে প্রশ্ন করে—“আপনি কি অরণ্যপাহাড়ের কথা শুনেছেন?”
বৃদ্ধ চোখ সরু করে তাকান, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন—“ও জাগা ভালো নয়। কেউ গেলে ফিরে আসে না। পুরোনো শাপ আছে।”
অয়ন বলে, “আমি যাব। আপনি শুধু পথটা দেখিয়ে দিন।”

বৃদ্ধ হেসে বলেন—“পথ দেখিয়ে দিলেই চলা যায় না। পাহাড় নিজে ডাকলে তবেই যাও।”

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙে অদ্ভুত এক স্বপ্নে। সে দেখছে, গাঢ় কুয়াশার মধ্যে একটা পাহাড়ের ছায়া—তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে, “এসো।”
তার শরীর ঘামে ভিজে যায়। কিন্তু সেই ভয় আর কাঁপুনির মাঝেও, তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি।

অয়ন জানে, সময় এসেছে। পাহাড় ডাক দিয়েছে।

দুপুরে সে বৃদ্ধ গাইডের কাছে গিয়ে বলে—“আপনি ঠিক বলেছিলেন। ও ডাক দিয়েছে।”
বৃদ্ধ চমকে তাকান। তারপর বলেন—“যাও, কিন্তু মনে রেখো—পাহাড় সব কিছু দেয় না। কিছু কেড়ে নিয়েও দেয়।”
অয়ন মাথা ঝাঁকায়। সে প্রস্তুত।

তার ব্যাগে একটি নোটবুক, কিছু শুকনো খাবার, প্রথম-সাহায্য বাক্স, ও দিনলিপির সেই পাতাগুলো।
সন্ধ্যায়, সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে, সে হাঁটা শুরু করে গ্রাম ছেড়ে—অজানা এক পাহাড়ের পথে।পেছনে আর তাকায় না।

অধ্যায় ৩: যাত্রার শুরু

পাহাড়ি সকালের একটা নিজস্ব ভাষা থাকে—যেখানে বাতাস কথা বলে, গাছেরা নড়ে আর পাখিরা অচেনা সুরে গান গায়। অয়ন সেই সকালেই দারগাঁও গ্রামের শেষ মাথায় এসে দাঁড়ায়। তার হাতে একটা লাঠি, কাঁধে ব্যাকপ্যাক, বুকভরা উত্তেজনা আর একটু ভয়।

পুরো গ্রামে এখনো কেউ জেগে ওঠেনি, কিন্তু অয়ন জেগে ছিল রাতভর। তার ভিতর একটা অনুভূতি যেন বলছে—“আজ, সব বদলে যাবে।”

পেছনে ছোট্ট পাহাড়ি হাট, সামনের দিকে সরু পাথুরে পথ—যার শেষে কোথায় নিয়ে যায়, কেউ জানে না।

গ্রামের প্রবীণ বৃদ্ধ গাইড হরিমন চাচা একবারও রাজি হননি ওকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য।
“আমি ওই পাহাড়ে গেছিলাম একবার, ছেলেবেলায়। ফিরে এলেও কিছু রেখে এসেছিলাম। এখন আর ও পাহাড় আমাকে চায় না,” বলেছিলেন তিনি।

অয়ন জিজ্ঞাসা করেছিল, “কী রেখেছিলেন সেখানে?”

হরিমন শুধু বলেছিলেন—“ভয়।”
তারপর আর কিছু বলেননি।

তবুও তিনি অয়নকে একটা পুরোনো কাপড়ের পুঁটলি দেন, যার ভিতর আছে কয়েকটা শুকনো ফল, লবণ মাখানো শুকনো মাংসের টুকরো আর কিছু আয়ুর্বেদিক গুল্ম।
“জঙ্গলে কাজে দেবে,” তিনি বলেন।
অয়ন চুপচাপ মাথা ঝাঁকায়। চোখে কৃতজ্ঞতা।

পাহাড়ের চূড়াটা দেখা যায় না এখানে দাঁড়িয়ে। কুয়াশা সব ঢেকে রেখেছে। তবে দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সে পাহাড়ের নিচু ঢালের পথটা খুঁজে পায়—একটা শুকিয়ে যাওয়া ঝর্নার ধারে, যেখানে পাথরের ওপর আঁকা অদ্ভুত সব দাগ।

কৌশিকের দিনলিপিতে লেখা ছিল, “প্রথম খোঁজ পাবে সেই ঝর্ণার ধারে, যেখানে পাথরের মুখে আঁকা আছে বনের দেবতা।”

অয়ন থেমে যায় সেখানে। সে দেখে, এক বিশাল পাথরের গায়ে কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে মুখের মতো এক ছায়া—চোখ দুটো বড়, টানা। ঠোঁট নেই। যেন একটা মুখ যা চুপ করে তাকিয়ে আছে।
কোমরের ব্যাগ থেকে সে দিনলিপির পাতা বের করে মিলিয়ে দেখে। হ্যাঁ, একদম একরকম।

তবে বাস্তবে দেখতে আরও ভয়ংকর।

পথ শুরু হয় সেই পাথর থেকে। অয়ন হাঁটতে থাকে। প্রথমে পাইন বন, তারপর সরু ঢাল বেয়ে পাথুরে পথ। প্রায় এক ঘন্টা চলার পর বনের গভীরে ঢুকে পড়ে।

এমন জঙ্গল সে আগে কখনও দেখেনি। গাছগুলোর গায়ে অদ্ভুত লতা, পাতাগুলো ঘন আর আঠালো। কোথাও কোথাও গাছের গায়ে আঁচড়ের দাগ, যেন কেউ তার নখ দিয়ে পাথর চিরে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর বাতাস থেমে যায়।

না, সেটা বাতাস থামেনি—ধরেই নিয়েছে, কেউ এসেছে।

অয়ন বারবার চারপাশ তাকায়। কেউ নেই। তবুও, মনে হয় কেউ তাকে দেখছে।

সে মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে।

দুপুর নাগাদ সে পৌঁছে যায় এক ছোট্ট খোলা জায়গায়—ঝর্না আর একটা বড়ো পাথরের মাঝে। এখানেই সে কিছু খায়—চিনি আর শুকনো রুটি, কিছুটা ফল।

পায়ের নিচে মাটি আলগা। হঠাৎ একটি পাথরের টুকরো গড়িয়ে পড়ে নিচে, আর নিচে কোথাও ধ্বনি ফিরে আসে—ধাঁ-ন-ন-ন!
অয়ন চমকে ওঠে। গুহা?

সে নিচে তাকায়। পাথরের আড়ালে যেন একটা ছায়া নড়ে উঠল। কিন্তু মুহূর্তেই আবার সব নিঃশব্দ।

সে ঠিক করে, এখনই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। তার কাছে এখনো বহু পথ বাকি। অয়ন আবার হাঁটতে শুরু করে।

বিকেলের দিকে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়।

হঠাৎ সে দেখে সামনে একটা কুঁড়েঘর—পুরোনো কাঠ আর পাথরের তৈরি, দরজা নেই, জানালায় ছেঁড়া কাপড়। চারপাশে কুয়াশা ঘুরছে।

এটা কি হরিমন চাচা বলেছিলেন সেই পুরোনো সাধুদের আশ্রম?
সে সাহস করে ঢুকে পড়ে।

ভিতরে একটা পাথরের উপর ধূলিধূসরিত বসার আসন, কোণায় পুরোনো শালপাতার থালা, আর দেয়ালে সাদা খড়ি দিয়ে লেখা—
“ভেতরে যাওয়া মানেই নিজের বাইরে ফেরা।”

তার নিচে অদ্ভুত চিহ্ন, যেন বৃত্তের মাঝে একটা চোখ।

অয়ন জানে না কেন, কিন্তু ভিতরটা ঠান্ডা, অথচ শরীর ঘেমে ওঠে। সে টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে চায়, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাতি নিভে যায়।

তারপর নিঃশব্দে যেন কেউ ফিসফিস করে—
“ফিরে যা…”
সে চমকে ওঠে, পিছিয়ে আসে, আর দৌড়ে বেরিয়ে আসে কুঁড়েঘর থেকে।

সন্ধ্যা নামছে। অয়ন বুঝতে পারে, আজকের মতো এখানেই থামতে হবে। সে একটি উঁচু শুকনো জায়গায় তাঁবু খাটায়—দিনলিপির পরামর্শ অনুযায়ী, পাহাড়ি বন্যপ্রাণীদের হাত থেকে বাঁচতে উঁচু জায়গায় রাত কাটানো ভালো।

আকাশে চাঁদ উঠেছে, কিন্তু চারপাশ কুয়াশায় ঘেরা। গাছগুলো যেন ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাহারা দিচ্ছে।

তাঁবুর ভিতর ঢুকে সে টর্চ জ্বালে, নোটবুকে লেখে—

“১ম দিন: পথ অজানা, কিন্তু কিছু একটা আমাকে টানছে। এটা শুধু ট্রেকিং নয়। এটা যেন… ডাক। আজ রাতে যদি ঘুমাতে পারি, তাহলে কাল পাহাড়ের চূড়ার দিকেই এগোব।”

তারপর সে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতে চায়, কিন্তু কান শুনে ফেলে একটা অদ্ভুত শব্দ—
“ঝরঝর…চপচপ…”

কেউ যেন জলে পা ফেলছে। কোথায়? আশেপাশে তো কোনো ঝর্না নেই।

সে টর্চ হাতে বেরিয়ে আসে তাঁবুর বাইরে, কিন্তু কেউ নেই।

শুধু অরণ্যপাহাড় দাঁড়িয়ে আছে আকাশে—ঘন অন্ধকারের গায়ে ঠেস দিয়ে।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙে পাখির চিৎকারে। অয়ন উঠে দাঁড়ায়, গা ঝাড়া দেয়। গত রাতের সেই শব্দ যেন এখন স্বপ্ন মনে হয়। কিন্তু তাঁবুর ঠিক পাশে কাদা-মাখা পায়ের ছাপ দেখে তার শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।

কোন প্রাণী?

ছাপটা মানুষের মতোই, কিন্তু একপায়ে খোড়া।

অয়ন আর কিছু ভাবে না। ব্যাগ গোছায়, পাহাড়ের ওপরে চড়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। এবার আর পথ নেই—একটা খাড়া পাথুরে ঢাল বেয়ে উঠতে হবে।

শরীর কাঁপছে, কিন্তু মন স্থির।

উঠতে উঠতে তার মনে পড়ে বাবার কথা। বাবা বলতেন—“মানুষ পাহাড়ে ওঠে অন্যকে হারিয়ে দিতে নয়, নিজেকে খুঁজে পেতে।”

আজ তার সেই কথা যেন বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুই ঘণ্টা টানা উঠার পর সে এক খোলা জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখান থেকে দূরে পুরো উপত্যকা দেখা যায়। সবুজ বন, নদী, আর দূরের গ্রাম—সব একাকার হয়ে আছে।

এটাই অরণ্যপাহাড়ের পাদদেশ। এর চূড়ায় কী আছে, সে জানে না। কৌশিকও বোধহয় পুরোটা লেখেনি।

সে জানে, সামনে যে রহস্য অপেক্ষা করছে, তা শুধু পাহাড়ের নয়—তার নিজেরও।

দিন শেষে, ক্লান্ত, রক্তাক্ত (পাথরে পড়ে গিয়ে কেটে গেছে হাঁটু), পিপাসার্ত, অয়ন একটা শুকনো গাছের গুঁড়ির পাশে বসে পড়ে।

সূর্য ঢলে পড়ছে। আলো মরে আসছে। তবে দূরে—চূড়ার দিকে—একটা আলো দেখা যাচ্ছে।

না, সূর্য নয়। আগুনের আলো? কেউ আছে ওখানে?

তার চোখ স্থির হয়ে যায়।

সে বুঝে ফেলে—একা নয় সে। কেউ ওর আগেই ওখানে পৌঁছেছে।

হয়তো, এখনো আছে।

অধ্যায় ৪: নিঃসঙ্গ পথ

ভোরের আলো যখন কুয়াশা ছেঁড়ে আসতে থাকে, অয়ন তখন চুপ করে বসে আছে এক পাহাড়ি ঢালে। রাতের ঠান্ডা এখনো গা জড়িয়ে আছে, কিন্তু সূর্যের প্রথম কিরণ যেন তাকে জড়িয়ে ধরে বলে—“তুমি ঠিক পথে আছো।”

সে উঠে দাঁড়ায়। শরীর ক্লান্ত, হাঁটুতে ব্যথা, কিন্তু মন এখন এক অন্য রকম চঞ্চলতায় ভরে আছে। যেন পাহাড় তাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে—একটি অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার দিকে।

আজ তার কোনো সঙ্গী নেই, শুধু পাখির ডাক, বাতাসের শব্দ আর মাথার উপর খোলা আকাশ।

পথ এখন সরু হয়ে এসেছে। দু’পাশে ঘন জঙ্গল আর মাঝে এক বাঁকা পাথরের গলি। মাঝে মাঝে নিচে খরস্রোতা নদীর শব্দ শোনা যাচ্ছে, যদিও দেখা যায় না।

অয়ন শ্বাস নিতে নিতে সামনে এগিয়ে যায়। মাঝে মাঝে সে থেমে পড়ে, শুধু দেখার জন্য।

একবার থেমে সে দেখে—দূরের একটা গাছে বসে আছে লালচে-নীল পালকের পাখি, যা সে আগে কখনো দেখেনি। সেই পাখি তাকিয়ে থাকে অয়নের দিকে। তারপর হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে যায়।

তারপর—একটি পাতার ওপর জমে থাকা শিশির বিন্দু টুপ করে পড়ে যায় নিচে, আর সেই ক্ষুদ্র শব্দ অয়ন শুনতে পায়।

সে নিজেই অবাক হয়ে যায়—এই যে এত ক্ষুদ্র শব্দ, এত রঙ, এত আলো, এত হাওয়া… আগে সে কখনও তো এসব শোনেনি, দেখেনি।

একটা উঁচু পাথরের পাশে দাঁড়িয়ে সে গভীর শ্বাস নেয়। এক ঢাল নেমে গেছে গভীর খাদে। নিচে দেখা যাচ্ছে বনভূমি, মেঘের সাদা সাদা স্তর যেন স্নেহে ঢেকে রেখেছে পৃথিবীটাকে।

অয়ন এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয়, সে যেন নিজেকে এই দৃশ্যের মধ্যে হারিয়ে ফেলতে পারত।

তখনই বাতাস বয়ে যায়। না, শুধু সাধারণ হাওয়া নয়—একটা সুরের মতো, অদ্ভুত কিছুর শব্দ ভেসে আসে তার কানে।

সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। কোথা থেকে এল সেই শব্দ? বাঁশির মতো? না, কারো কণ্ঠ?

হয়তো তার মনেরই কল্পনা। আবার হয়তো, পাহাড় কথা বলছে।

পথ যত এগোয়, তত বদলায় প্রকৃতি। আগে ছিল পাইন বন, এখন ঘন শাল আর ওক গাছ। রোদ আর ছায়ার খেলা। কোথাও কোথাও পাহাড়ের পাথর এত উঁচু, যেন সেই ছায়া আকাশে রেখা কেটে দেয়।

একটা জায়গায় এসে সে দেখে, এক ঝোপের মধ্যে গোলাকৃতি পাথর রাখা—ছোট, মাঝারি, বড়, তারপর আবার ছোট। এমন সাজানো, যেন কেউ অনেক আগেই ওখানে বসে, সময় নিয়ে রেখেছিল।

“কারা রাখল এগুলো?”—অয়ন ভাবে।

তার মন বলে—“এই পথ অনেক প্রাচীন। তুমি নতুন হলেও, তোমার মতো অনেকে আগে এসেছিল। পাহাড় তাদেরও ডেকেছিল।”

সে কিছুক্ষণের জন্য বসে পড়ে সেই পাথরের পাশে। বাতাসে শুকনো পাতার গন্ধ, মাটির কোমলতা, আর দূরের গরগর শব্দ—হয়তো পাহাড়ি নদী।

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। পথ ক্রমশ খাড়া হয়ে উঠছে। ক্লান্তি এসে পড়ছে শরীরে, কিন্তু মন তাতে সায় দিচ্ছে না। প্রতি কদমে সে যেন নতুন কিছু শিখছে।

এক সময় হঠাৎ হেঁটে হেঁটে সে একটা খোলা ঘাসভূমিতে পৌঁছে যায়। চারদিকে বিশাল গাছ, মাঝখানে নরম ঘাসে ঢাকা উপত্যকা।

হঠাৎ বাতাসে ভেসে আসে গানের মতো কিছু। এবার সে স্পষ্ট শুনতে পায়—একটা কোমল সুর, যেন মায়ের ঘুমপাড়ানি গান।

সে চারপাশে তাকায়। কেউ নেই। তবুও সুর থেমে যায় না। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে, কিন্তু ভয় নয়—মুগ্ধতা।

সে নিজেই বলে ওঠে—“তুমি… কে?”

সাড়া মেলে না। শুধু বাতাসে পাতারা মৃদু কেঁপে ওঠে। যেন ফিসফিস করে বলে—“তুমি তো জানো। তুমি তো চেনো আমাকে।”

অয়ন স্তব্ধ হয়ে থাকে।

পথে আরও কিছুটা এগিয়ে সে পায় পাহাড়ি ফুলে ভরা এক ঢাল। ছোট ছোট হলুদ ফুল, নীল রঙা বুনো লতাপাতা, কোথাও কোথাও গোলাপি রঙের অচেনা পাপড়ি।

সে মুগ্ধ হয়ে ছবি তোলে, কিন্তু পরে দেখে ক্যামেরায় ঠিকঠাক ধরা পড়ছে না সেই রঙ।

হয়তো এটা সেই রঙ, যা চোখ দেখে, কিন্তু যন্ত্র বুঝতে পারে না।

সেই ফুলের পাশে হঠাৎ দেখে একটা অদ্ভুত দাগ—পায়ের ছাপ। কিন্তু মানুষের নয়, আবার পশুরও নয়। অদ্ভুত তিনটে আঙুল, যেন অজানা কোনো প্রাণী হেঁটে গেছে এ পথ ধরে।

অয়ন কিছু বলে না। শুধু নোটবুকে আঁকিয়ে রাখে ছাপটা।

তার ভিতরের কৌতূহল বাড়তে থাকে।

বিকেলের দিকে পাহাড়ের রং পাল্টে যেতে থাকে। সূর্যের আলো পাথরে পড়ে লালচে-সোনালি আভা ছড়িয়ে দেয়। পাথরের ছায়াগুলো লম্বা হতে থাকে, যেন বড় হাত বাড়িয়ে কিছু ধরতে চাইছে।

এবার তার মনে হয়, সে বুঝতে পারছে পাহাড় কী বলতে চায়।

“তুমি মানুষ। তোমরা সব দখল করতে চাও। কিন্তু আমায় জয় করা যায় না। আমায় শুধু বোঝা যায়, যদি তুমি চুপ করে থাকো।”

এই বোধ আসতে আসতেই সে পাহাড়ের এক বাঁক ঘুরে এসে পড়ে একটা ফাঁকা চূড়ায়।

সেখানে দাঁড়িয়ে সে দেখে—নিচে মেঘের সাগর, পাশে রংবেরঙের পাখি উড়ে যাচ্ছে। একটুও ভয় নেই আর।

সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ।

পরে, সে গাছতলায় বসে পড়ে। কিছু ফল খায়। ব্যাগ খুলে বার করে পুস্তিকা—দিনলিপি।

এখানে একটা লাইন লেখা—
“যখন তুমি একা থাকো, তখনো তুমি একা নও। পাহাড়, বাতাস, আকাশ, সব শুনছে তোমার কথা।”

তখনই সে ভাবে—এতকাল সে একাকিত্ব মানে বুঝত নিঃসঙ্গতা। এখন বুঝছে, প্রকৃতির কাছে নিজেকে ছেড়ে দিলে, সে একা নয়।

হঠাৎ দূরে এক ছায়া দেখা যায়—গাছের ফাঁকে দাঁড়িয়ে কেউ যেন।

সে চমকে ওঠে। ছায়াটা স্থির। অয়ন ডাকে—”কে?”

কেউ উত্তর দেয় না। সে টর্চ ধরলে আর কিছু দেখা যায় না। ছায়া মিলিয়ে যায়।

এটা কি মানুষের ছায়া? নাকি পাহাড়ের? না কি, তার মনের?

রাত ঘনিয়ে এলে, সে আবার তাঁবু খাটায়। আজ একটু বেশি নির্জন জায়গা, কিন্তু সে আর ভয় পায় না। চারপাশে গাছেরা দুলছে, যেন গান গাইছে।

সে শুয়ে পড়ার আগে চাঁদের আলোয় চারদিকে তাকায়। তার মন বলে—
“এই পাহাড় শুধু একটি জায়গা নয়। এটি একটি চরিত্র, একটি সত্তা, যা জেগে আছে। তুমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারো, যদি মন দিয়ে শোনো।”

সে চোখ বন্ধ করে। আজ আর স্বপ্ন আসবে না। শুধু সেই অনুভব থাকবে—একাকিত্বের মাঝে অন্তরঙ্গতা।

এই অধ্যায়ের শেষ প্রান্তে অয়ন বুঝে যায়, তার যাত্রা শুধু শরীরের নয়, আত্মার। পাহাড় তাকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করছে। সে যেমন ছিল, সেই মানুষ আর নেই।

এখন তার ভিতর এক অজানা আলো জেগে উঠেছে—একজন সত্যিকারের শ্রোতা, যাকে ডাকলে পাহাড়ও জবাব দেয়।

অধ্যায় ৫: অদৃশ্য বন্ধু

রাত গভীর। চাঁদ ঢেকে গেছে কালো মেঘে। চারপাশের জঙ্গল অদ্ভুত নিস্তব্ধ। তাঁবুর মধ্যে শুয়ে আছে অয়ন। ক্লান্ত শরীর হলেও তার চোখে ঘুম নেই। কিন্তু হঠাৎই…

একটা কণ্ঠ তাকে ডাকতে থাকে।
নরম, করুণ, ধীরে ধীরে যেন তার নাম উচ্চারণ করে—

“অয়ন… অয়ন…”

সে চমকে উঠে বসে পড়ে। চারদিকে টর্চ মারে, কোনো শব্দ নেই।
বাতাস একটুও নড়ছে না, পাতারা থেমে আছে।

কিন্তু সেই কণ্ঠ… সে জানে সে জেগে ছিল না, আবার ঘুমিয়েও ছিল না।
এটা কোনো স্বপ্ন নয়—এ যেন একটা ডাক।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সে কেমন যেন ভারমুক্ত বোধ করে।
তার মাথায় এখনো বাজছে সেই স্বপ্নের শব্দ।

সে ভাবতে থাকে—এই পাহাড়ে কেউ আছে কি?
না, হয়তো কোনো আত্মা? না হয়… শুধু তার কল্পনা?

কিন্তু যতক্ষণ সে ভাবতে থাকে, ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার অনুভব—পাহাড় তাকে ডাকছে।

কিন্তু ডাকটা শুধু নামে নয়। যেন পাহাড় বলছে—
“আমি বুঝি তোমার কষ্ট। তুমি ভেবো না, তুমি একা।”

ট্রেক আবার শুরু করে সে। আজ রোদ কিছুটা উজ্জ্বল, বাতাসে আশ্চর্য প্রশান্তি।

চুপচাপ হেঁটে চলেছে অয়ন। আগের মতো আর ভয় করে না।
বরং মনে হচ্ছে, কেউ তার পাশে পাশে হাঁটছে—অদৃশ্য, অথচ নিবিড়ভাবে উপস্থিত।

একটা পাথরের পাশে থেমে সে জিরোতে বসে। সামনে ছোট ঝর্ণা, পাথরে জল পড়ছে শব্দ করে।

সে বলে ওঠে—
“তুমি আছো না কি? তুমি কি সত্যিই কথা বলো?”
চারদিক নীরব।

কিন্তু হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা আসে। পাতারা দুলে ওঠে, আর ঝর্ণার শব্দ একটু বেড়ে যায়।

সে অনুভব করে—এই জবাব।

পথে যেতে যেতে সে এখন পাহাড়ের সঙ্গে কথা বলে।

আগে সে আত্মকেন্দ্রিক ছিল—শহরের ব্যর্থতা, হারানো সম্পর্ক, মানসিক ভার।
এখন সে শুনছে, প্রকৃতি কী বলছে।

একটা শুকনো ডালে হাত বুলিয়ে সে বলে—
“তোমরা কি জানো, আমি কেন এসেছি এখানে?”
একটা পাখি তখন উড়ে যায় তার মাথার উপর দিয়ে।

একটা পাথরে হঠাৎ সে লেখাটা দেখতে পায়—
“তুমি একা নও।”
পুরনো খোদাই করা, প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু বোঝা যায়।

সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

সন্ধ্যার আগে সে পৌঁছে যায় এক চূড়ার ধারে। সেখানে বসে থাকে নিঃশব্দে।

তার চোখে আজ পানি আসে। কারণ পাহাড় তাকে কোনও প্রশ্ন করেনি, কোনও ব্যর্থতার হিসেব চায়নি।

শুধু তাকে জায়গা দিয়েছে—তার ক্লান্তি, তার নীরবতা, তার অশ্রু।

সে ধীরে ধীরে বলে ওঠে—
“তুমি আমার বন্ধু। একমাত্র যে সত্যিই বোঝে আমাকে।”

এই প্রথম, এতদিন পর, কারো উদ্দেশে সে বন্ধু শব্দটা বলে।

সে নাম দেয় পাহাড়কে—“অরণ্যপাহাড়, আমার বন্ধু।”

রাতে তাবুর ভিতর সে দিনলিপি খুলে লেখে—

“আজ আমি বুঝেছি, পাহাড়ও ভালোবাসে।
ওর ভালোবাসা নিরব, গভীর, নির্ভরযোগ্য।
ওর ডাক শুধু অ্যাডভেঞ্চারের জন্য নয়, বেঁচে থাকার অর্থ বোঝার জন্য।
আজ আমি ওকে বলেছি, ‘তুমি আমার বন্ধু।’
অদৃশ্য হলেও, ওর স্পর্শ আমি পেয়েছি।”

তারপর সে চুপ করে শুয়ে পড়ে। তার চারপাশে কোনো আলো নেই, কিন্তু তার ভিতরে আলোকিত কিছু জন্ম নিচ্ছে।

মাঝরাতে আবার সেই কণ্ঠ— “অয়ন… তুমি শুনছো তো?”

সে উঠে বসে। কিন্তু এবার আর ভয় পায় না। সে চুপ করে বলে— “হ্যাঁ, আমি শুনছি। তুমি কোথায়?”

হাওয়ার মাঝে পাতারা নড়ে ওঠে, যেন কেউ হেসে বলে—“আমি সবখানেই।”

সে উঠে গিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। আকাশে তারাভরা রাত।
তার মনে হয়, পুরো পাহাড়ের আকাশ তাকে জড়িয়ে ধরেছে।

তখন সে স্পষ্ট ভাবে শুনতে পায়—
“তুমি ঠিক জায়গায় এসেছো, অয়ন। এখনো অনেক কিছু জানা বাকি।”

পরদিন সকালে সে আর আগের মতো মানুষ নয়।

তার চোখে ক্লান্তি নেই, কাঁধে বোঝা নেই, শুধু একটা গভীর সংযোগ আছে—
এই অরণ্যের, এই বাতাসের, এই পাহাড়ের সঙ্গে। সে হাসে। হয়তো অনেক বছর পর।

তারপর, সামনে তাকিয়ে বলে—
“চলো বন্ধু, আজ আরেকটু এগোই।”

পাহাড় যেন উত্তর দেয় এক ঝাপটা বাতাসে, পাখির ডাক দিয়ে। তারা দুই বন্ধু রওনা হয় এক নতুন রহস্যের পথে।

অধ্যায় ৬: গুহার গোপন দরজা

সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। আলোর রঙে পাহাড় যেন সোনালি চাদরে ঢেকে গেছে। অয়ন দিনের ট্রেক শেষ করে পাহাড়ের এক নতুন পথে হাঁটছিল, যেটা আগে খেয়াল করেনি।

বাতাস ছিল ভারী, যেন কোনও কিছু বলার চেষ্টা করছে।
তার ভেতরে কেমন যেন একটা টান ছিল—এক অদৃশ্য টান, যা তাকে পথ দেখাচ্ছিল। হঠাৎ সে এক অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছায়—এক প্রাকৃতিক পাথরের দেওয়াল, যেটা পাহাড়ের অন্য অংশ থেকে একটু আলাদা।

দেওয়ালের এক পাশে গাছপালায় ঢাকা, যেন কেউ ইচ্ছা করেই আড়াল করেছে কিছু।

হাত দিয়ে ঝোপ সরাতেই দেখা গেল— এক গুহার মুখ।

অয়ন থমকে গেল। এই জায়গাটা পাহাড়ের নকশায় কোথাও ছিল না, আগের গাইডবইয়েও কিছু বলা ছিল না।
এটা যেন লুকানো, খুব সতর্কভাবে আড়াল করে রাখা।

সে সামনে গিয়ে দেয়ালে হাত রাখল—ঠান্ডা, কিন্তু কাঁপছে না।
এটা কোনও মিথ্যে নয়। এটা বাস্তব। সে টর্চ বের করল। আলো ফেলে দেখল গুহার মুখটা বেশ সরু, কিন্তু ঢুকবার মতো জায়গা আছে। এক মুহূর্ত দোটানায় থেকেও, অবশেষে ভিতরে ঢোকে।

গুহার ভেতরটা অদ্ভুত ঠান্ডা। দেয়ালে সাদা-ধূসর শিলাস্তর, যার মাঝে মাঝে খোদাই করা কিছু চিহ্ন—
বৃত্ত, ত্রিভুজ, আর একটা আকৃতি—যেটা যেন পাহাড়ের মতো দেখতে। টর্চের আলোয় গুহার ভেতরের দেয়ালগুলো যেন কাঁপছে, প্রাণ নিচ্ছে। ভিতরে কয়েক ধাপ হেঁটে সে এক খোলা জায়গায় আসে—
একটি গোলাকার প্রকোষ্ঠ, যার এক পাশে ছোট একটা পাথরের মঞ্চ।
মঞ্চের উপরে পাথরের কিছু বস্তু সাজানো, আর তার পাশে একটি পুরনো ডায়েরি।

অয়ন অবিশ্বাসে তাকিয়ে থাকে।

“এটা কীভাবে এখানে এল?”

সে ধীরে ধীরে ডায়েরিটা তুলে নেয়। পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, কিছু জায়গা ছেঁড়া, তবে অধিকাংশ লেখা এখনো পরিষ্কার। তবে সমস্যা হলো—এই লেখাগুলো কোনো পরিচিত ভাষায় নয়।

সেগুলো দেখতে লিপির মতো—একধরনের বক্ররেখা, কিছু প্রতীক, মাঝে মাঝে চিহ্ন যার অর্থ সে বুঝতে পারে না।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে—লেখাগুলো পরিচিত লাগে।
যেন আগে কোথাও দেখেছে, অথবা… স্বপ্নে পড়েছে।

প্রথম পাতার নিচে লেখা—

“অরণ্যপাহাড়, তুমিই সাক্ষী।”

এই লাইনটা বাংলায়। বাকি লেখাগুলো সেই অজানা ভাষায়।

অয়ন বসে পড়ে পাথরের মেঝেতে। বাতাস যেন থেমে গেছে।
সে পাতাগুলো উলটে দেখতে থাকে—প্রতিটি পৃষ্ঠায় কোনোকিছু লিখা, যেন এক দীর্ঘ কাহিনি।

হঠাৎ একটি পাতায় সে আঁকা দেখতে পায়—এক মানুষ পাহাড়ে উঠছে, আর পেছনে একটি ছায়ামূর্তি।

তার নিচে লেখা— “সে ফিরে আসবে।”

কিন্তু কে সে? আর কেন এই কথাগুলো এত পরিচিত মনে হচ্ছে?

অয়ন ডায়েরি পাশে রেখে দেয়ালের খোদাই লক্ষ্য করে। প্রতিটি চিহ্ন যেন এই ডায়েরির ভাষার অংশ।

সে ভাবে—
“এই পাহাড় শুধু প্রকৃতি নয়, ইতিহাসও বয়ে এনেছে। আর কেউ না কেউ আগে এসেছিল।”

গুহার এক কোণে আরেকটি ছোট ফাটল ছিল।
সেখানে আলো ফেলে অয়ন দেখে—ছোট ছোট পাথরের টুকরো, আর কয়েকটি পুরনো পুস্তক, ধুলোয় ঢাকা।

পুস্তকগুলোয় আবার সেই অজানা ভাষা। কিন্তু পাতাগুলোর মাঝে একটি ছেঁড়া মানচিত্র।

পাহাড়ের নকশা আঁকা, আর একটা জায়গা চিহ্নিত—এক গোল চিহ্ন, যেখানে “দরজা” শব্দটা বাংলায় লেখা।

“গোপন দরজা?”

অয়ন অনুভব করে—এই গুহা শুধু আশ্রয় নয়, এটা প্রবেশপথ—এক রহস্যের ভিতর ঢোকার দরজা।

হঠাৎ টর্চের আলো মরে যেতে থাকে। অয়ন ব্যাগ থেকে আরেকটা ছোট টর্চ বের করে। আলো ফেরত এলে, সে দেখে— গুহার দেয়ালে একটা অংশ আলগা, যেন ঠেলে দিলে নড়তে পারে।

সে ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দেয়ালটাকে ঠেলে…একটা শব্দ—“ধরররর”
আর সাথে সাথে একটা অংশ ঘুরে এক নতুন সরু পথ খুলে যায়।

সেখানে ঘন অন্ধকার। বাতাস ভিতর থেকে আসছে, ঠান্ডা, আরেকটু ভারী। সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ভাবে। এরপর বলে—
“তুমি যদি চাও আমি সত্যি জানি, তবে আমাকেই যেতে হবে।”

সে ভিতরে ঢোকে। এই অংশ গুহার থেকে ভিন্ন। এখানে পাথরের পরিবর্তে মাটির গন্ধ বেশি।
দেয়ালে আঁকা আরও চিহ্ন—একটি সূর্য, এক নদী, আর একজন মানুষকে জলে ডুবে যেতে দেখা যাচ্ছে।

অয়ন আঁকাগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে—এ যেন এক ইতিহাসের গল্প।

আর এই ইতিহাসের অংশে কোথাও যেন তার নাম লেখা আছে। অথচ সে এখানে এলো কেবল কিছু ভুলে থাকতে—কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কিছু পুনরাবিষ্কার করতে।

শেষে সে এসে পৌঁছায় এক জায়গায়, যেখানে দেয়ালে একটা ধাতব দরজা।
দরজার গায়ে সেই অজানা ভাষার লেখায় খোদাই করা কিছু বাক্য, যার একটাই অংশ সে বুঝতে পারে—

“স্মৃতির পাহাড়ে দাঁড়ালে, সময় থেমে যায়।”

অয়ন দরজার সামনে বসে পড়ে। ডায়েরির সেই পৃষ্ঠা তার মনে পড়ে যেখানে লেখা ছিল—

“সে ফিরে আসবে।”

তার মাথায় এখনো ঘুরছে সেই স্বপ্নের কণ্ঠ—
“তুমি ঠিক জায়গায় এসেছো।”

সে জানে, তার জীবন পাল্টে যাচ্ছে। এই পাহাড় তাকে শুধু আশ্রয় দেয়নি— তাকে ডেকেছে, তাকে তার প্রকৃত পরিচয়ের খোঁজে পাঠিয়েছে। সে জানে, এই দরজা খুললেই সব বদলে যাবে।

অধ্যায় ৭: হারানো অভিযাত্রী

সকালের আলো গুহার প্রাচীর ছুঁয়ে এক কোমল আলো ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। অয়ন ডায়েরিটি হাতে ধরে, যেন সেটাই এখন তার একমাত্র দিশারী।

ডায়েরির পাতাগুলোতে একটি নাম বারবার ফিরে আসে—
“অমর সেন”।

প্রথমে নামটা কেমন চেনা চেনা লাগলেও, অয়ন স্পষ্ট কিছু মনে করতে পারে না। তবে যত পড়তে থাকে, এক রহস্যময় জীবনচিত্র ধীরে ধীরে খুলে যায়।

ডায়েরির পাতায় লেখা: “আমি অমর সেন, এক অভিযাত্রী।
১৯৭২ সালের গ্রীষ্মে আমি এই ‘অরণ্যপাহাড়’-এ এসেছিলাম।
পাহাড়ের ডাক শুনেছিলাম আমি—এক অলৌকিক, গভীর আর করুণ ডাক।
কেউ বিশ্বাস করেনি, কিন্তু আমি জানতাম, এটা কেবল এক পাহাড় নয়। এটা এক আত্মা।”

অয়ন শিউরে ওঠে। কারণ এই অনুভূতি তারও হয়েছে—একমাত্র তার নয়?

ডায়েরির পাতাগুলো ক্রমে এক সঙ্গীতের মতো তার সামনে বয়ে চলে।

“প্রথম তিনদিন ছিল নিঃসঙ্গতা। আমি জঙ্গলে পথ হারিয়েছিলাম। কিন্তু ঠিক চতুর্থ দিন, গুহাটার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। ওখানে বসে আমি প্রথম অনুভব করি—পাহাড় আমাকে দেখছে। আমার ভয়, কষ্ট, অতীত সব যেন জানে।”

আরও নিচে লেখা:

“এক রাতে ঘুমের মাঝে এক নারী কণ্ঠ শুনি—
‘তুমি তো ভুলে এসেছ, কিন্তু আমি তো চিনি তোমাকে।’
আমি জেগে উঠি, ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে, আর দেখি গুহার এক দেয়ালে আলোর রেখা।”

অয়ন চোখ বড় করে পড়ে। তার নিজের অভিজ্ঞতা যেন ঠিক এইভাবেই ঘটেছিল। তবে অমরের লেখার একটা ধারা একসময় বদলে যায়।

“আমি জানি না আমি কতদিন এখানে আছি।
সময় আমার কণ্ঠ ভুলে গেছে। দিনরাত্রি সব এক হয়ে গেছে।
আমি ডায়েরি লিখি যেন নিজেকেই মনে করিয়ে দিই, আমি কে।”

“আমি কে।”
এই শব্দটা যেন অয়নকে কাঁপিয়ে দেয়।

অয়ন গুহার বাইরে এসে বসে পড়ে। পাহাড়ের ঢালে সূর্য ছুঁয়ে যাচ্ছে বরফের চূড়োকে।
সে ভাবে—কে ছিলেন এই অমর সেন?

একটা দুর্বল স্মৃতি মাথায় ভেসে আসে—
ছোটবেলায় একটা বই পড়েছিল সে—“হিমালয়ের অন্তরালে”, এক রহস্যময় অভিযাত্রীকে নিয়ে, যে নিখোঁজ হয়ে যায় অজানা পাহাড়ে।

সে দ্রুত নোট খাতায় খোঁজ করে, লিখে রাখে:
“১৯৭২—নিখোঁজ অভিযাত্রী—অমর সেন। খবর কাগজে দেখেছিলাম?”

সে বুঝতে পারে, এই পাহাড়ে একসময় এক মানুষ এসেছিলেন ঠিক তার মতো, হয়তো ভাঙা, ক্লান্ত, প্রশ্নভরা হৃদয় নিয়ে।
কিন্তু তিনি আর ফিরে যাননি।
তাঁর অস্তিত্ব একমাত্র গুহার গায়ে আঁকা প্রতীকে, আর এই ডায়েরির পাতায়।

অয়ন আবার ডায়েরির শেষাংশ পড়ে—

“এই পাহাড় শুধু মাটি আর পাথর নয়।
এটা এক জীবন্ত আত্মা, এক সত্তা, এক ইতিহাস।
যারা গভীর হৃদয়ে আসে, তাদের সে গ্রহণ করে।
কিন্তু ফিরতে হলে নিজের সত্যকে চিনতে হয়।”

এই লেখাটা অয়নকে থামিয়ে দেয়। সে ভাবে—তাহলে অমর কি নিজের ‘সত্য’ চিনতে পারেননি?
তাই কি তিনি ফিরে যাননি? নাকি তিনি ইচ্ছেই করেননি ফিরে যেতে?

অয়ন আবার গুহার দেওয়ালের প্রতীকগুলোর দিকে তাকায়।
একটা চক্র—যার মাঝখানে চোখ।
তার নিচে আঁকা এক পথ, যেটা উঠে গেছে চূড়ায়, কিন্তু পথের মাঝে ছায়া পড়ে আছে।

সে বুঝতে পারে—পাহাড়ে উঠার এই যাত্রা কেবল বাহ্যিক নয়, এটা অন্তরেরও পথ।
যেমন অমর একসময় নিজের যাত্রায় হারিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি আজ অয়নও দাঁড়িয়ে আছে সেই সন্ধিক্ষণে।

তার মনে পড়ে—
“আমি পালাতে চেয়েছিলাম, ভুলে যেতে।
কিন্তু পাহাড় তো শুধু ভুলে যেতে দেয় না—সে স্মরণ করায়।”

অয়ন ডায়েরির ভাঁজে আরেকটি পাতার টুকরো খুঁজে পায়—
ছেঁড়া কাগজে অমরের হাতে আঁকা একটি রূপরেখা—
পাহাড়ের চূড়ার দিকেই একটি স্থান চিহ্নিত—

“মনের দরজা” — পাশে লেখা
“যদি কেউ আসে আমার পরে, সে বুঝবে আমি কেন থেকে গেছি।”

এই লাইনটা পড়ে অয়ন থেমে যায়।

সে ভাবে, তবে কি অমর এই ডায়েরি ইচ্ছাকৃতই রেখে গিয়েছেন, যেন কেউ একদিন পড়ে? কেউ, যাকে পাহাড় ডাকবে আবার?

এই ডায়েরি তো শুধু তার ব্যক্তিগত আত্মকথা নয়—এটা এক টর্চলাইট, ভবিষ্যতের কারো জন্য।

অয়ন যেন অনুভব করে, অমর তাঁরই সঙ্গে হাঁটছে।
অদৃশ্য, কিন্তু প্রাজ্ঞ, গভীর, ধীর পায়ের ছাপ ফেলে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। গুহার বাইরে দাঁড়িয়ে অয়ন চূড়ার দিকে তাকায়।
সেখানে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে সেই চিহ্নিত “মনের দরজা”—যেটার কথা অমর বলেছেন।

অয়ন সিদ্ধান্ত নেয়, সে সেদিকেই যাবে।
এই মুহূর্তে তার যাত্রা আর কেবল পাহাড় জয়ের নয়—
এটা এক আত্মা-যাত্রা।

সে মনে মনে বলে—

“অমরদা, যদি আপনি এখনো এই পাহাড়ের কোথাও থাকেন, আমি আসছি।
আপনার পদচিহ্নে, আপনার পথ ধরে, আমি আমার সত্য খুঁজে বের করব।”

সেই রাত, অয়ন আবার স্বপ্ন দেখে।
একজন বৃদ্ধ তাকে বলছে—

“পাহাড় কখনো কাউকে একা ফেলে না।
কিন্তু তুমি একা এলেও, ফিরে যেতে হলে নিজের সত্যটা খুঁজে নিতে হবে।”

সে জেগে ওঠে। আকাশে তারাগুলো পরিষ্কার। বাতাসে ঠান্ডা আর রহস্যের গন্ধ।

অয়ন গুহার মুখে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি চলে যাব না—যতক্ষণ না বুঝি আপনি কে ছিলেন, আর আমি কে।”

ডায়েরি, মানচিত্র, নিজের যন্ত্রণাকে ব্যাগে ভরে সে পাহাড়ের চূড়ার দিকে রওনা হয়।
তার সামনে অমর সেনের ছায়া যেন এগিয়ে চলেছে।
নীরবে, নিঃশব্দে, কিন্তু সুস্পষ্ট।

অধ্যায় ৮: সচেতন পাহাড়

সকালের সূর্য প্রথম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল যখন অয়ন তার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গুহার মুখ থেকে বের হয়। তার হৃদয় অচেনা এক উত্তেজনায় ধুকধুক করছিল—একটু ভয়ের, একটু আশা নিয়ে। সে জানত, আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন হবে। পাহাড়ের “মনের দরজা” কাছে পৌঁছানো মানে তার ভেতরের ভয়, সন্দেহ আর অবিশ্বাসের মুখোমুখি হওয়া। পাহাড় তার মৃদু বাতাসে তাকে আবার ডাকছিল।
সেই ডাক একেবারে আলাদা। জোরালো, গভীর এবং কঠোর।

পথটা সহজ ছিল না। নিচের ঢালে সে বেশ কিছু ঝড়, ভূমিধসের চিহ্ন দেখল। গাছপালা চিরুনির মতো কুঁচকে পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে পাথরের টুকরো নিচে নামছে, মাটি যেন রক্তাক্ত কিছু কথা বলছে। অয়ন এগোতে এগোতে অনুভব করল, এই পাহাড় যেন সচেতন, নিজের শক্তি ও রাগ প্রকাশ করছে।

মধ্যাহ্নের পর হঠাৎ করে আকাশ কালো মেঘে ঢাকা গেল। ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল। গাছের পাতাগুলো ধীরে ধীরে কম্পমান হতে লাগল। বাতাস শক্তিশালী হল।

অয়ন ছাতা বের করল না, কারণ বুঝতে পারছিল—এই ঝড় কেবল প্রকৃতির নয়, এটা পাহাড়ের এক পরীক্ষা।

হঠাৎ বাতাসে এক ঝাঁক শীতল গুঞ্জন—এক অদ্ভুত শব্দ যা কেবল তার কানে বাজছিল। পাহাড় যেন তাকে বলতে চাইছিল,
“তুমি কি সত্যিই আমাকে বুঝতে পারবে? কি পারবে তুমি আমাকে ভরসা করবে?”

ঝড় শুরু হলো। বৃষ্টি পড়তে লাগল, গাছের ডালগুলো সওয়ারের মতো লাঠির মতো নেড়ে। অয়ন একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিল। সে ভাবল,
“ভয় আমার সঙ্গী, কিন্তু এই ভয়ই আমার পথের অংশ।”

বৃষ্টি থামার পর, অয়ন পথ চলতে শুরু করল। তার পায়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে আছে, কিন্তু সে লক্ষ্য করল তার মন আগের চেয়ে বেশি শান্ত। ঝড়ের শোরগোল যেন তার ভেতরকার চিন্তাগুলো পরিষ্কার করে দিয়েছে।

পাহাড় যেন বলছিল—
“আমি তোমাকে ছাড়ব না। তোমার ভয় আর বিশ্বাস দুটোই আমি গ্রহণ করব।”

সে বুঝল, পাহাড় শুধু এক কঠিন ঠাই নয়, এক জীবন্ত প্রাণী যার নিজের শক্তি, রাগ, প্রেম আছে। আর এই পাহাড়ে চূড়ান্ত সফল হতে হলে তাকে তার ভয়কে পাশ কাটিয়ে, বিশ্বাসের শক্তি নিতে হবে।

রাতের আগে অয়ন পৌঁছাল পাহাড়ের এক পর্বতে, যেখানে সাম্প্রতিক ভূমিধসের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আগের দিনের ঝড়ের প্রভাবে সেখানে মাটি নড়ে গেছে, পাথরের বড় টুকরো গড়িয়ে পড়েছে নিচে।

সে অনুভব করল এই ভূমিধস যেন তার জীবনের বিপর্যয়ের প্রতীক। যেমন তার জীবনের একসময় সব ধসে পড়েছিল, তেমনি এই পাহাড়ও ঝড়ে ক্ষত পেয়েছে।

কিন্তু পাহাড় তখনো দাঁড়িয়ে আছে, শক্তপোক্ত, আরো দৃঢ়। অয়নও তাই করতে চায়।

ভূমিধসের পর রাত নেমে আসে শান্তিপূর্ণ, যেন পাহাড় নিজেই শান্তি চাইছে। অয়ন গাছের নিচে বসে নিস্তব্ধতা শোনে। এই শান্তিতে সে আবিষ্কার করে একটা গভীর সত্য—ভয় ছাড়া সাহস নেই, কিন্তু সাহস মানে ভয়কে গৃহীত করে তার থেকে এগিয়ে যাওয়া।

সে ধীরে ধীরে গুহার ডায়েরির কথাগুলো স্মরণ করে—“পাহাড় এক জীবন্ত আত্মা।”

এখন সে বুঝতে পারল, সেই আত্মা তার ভেতরেও আছে। তার ভয়, তার আশা, তার আত্মার যন্ত্রণা, সবই একাকার।

তাদের একটা বিশেষ মুহূর্ত আসে যখন অয়ন হঠাৎ করেই অনুভব করে, যেন পাহাড় তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নয়, কোনো শব্দ নয়, শুধু এক ধরনের অনুভূতি—এক গভীর যোগাযোগ।

সে মনে করে, পাহাড় তার সমস্ত অভিজ্ঞতা, তার সংগ্রাম, তার আনন্দ, তার কান্না দেখে নিয়েছে। পাহাড় তাকে বিচ্ছিন্ন মনে করছে না, বরং তার অংশ মনে করছে।

এই উপলব্ধি অয়নের ভেতর নতুন আত্মবিশ্বাস জাগায়। সে অনুভব করে, ভাঙা জীবন আবার নতুন করে গড়া সম্ভব।

অয়ন রাত কাটায় এক পর্বতের কুঁড়েতে, যেখানে আকাশ পরিষ্কার, তারারা ঝলমল করছে। সে ভাবতে থাকে—পাহাড় তাকে কেবল শাস্তি দেয়নি, বরং শিখিয়েছে কিভাবে জীবনের দুঃখের মধ্যেও শক্ত থাকতে হয়।

সে জানে, পরের দিন তার যাত্রা আরও কঠিন হবে। কিন্তু তার ভেতরে ভয়ের চেয়ে বিশ্বাস শক্তিশালী।

পাহাড়ের সাথে তার বন্ধুত্ব এখন গভীর, অবিচ্ছেদ্য।

অধ্যায় ৯: আত্মদর্শন

পাহাড়ের ঢালে একটি ছোট সমতল জায়গা। চারপাশে ছায়া, হালকা কুয়াশা, মাথার ওপর খোলা আকাশ। অয়ন সেখানে বসে আছে, একেবারে নিঃশব্দে। সময়টা ঠিক জানা যায় না—দিন, সন্ধ্যা, না রাত। সবকিছু এক অদ্ভুত শান্তির মধ্যে হারিয়ে গেছে।

সে এখন আর কোনো দিকেই যাচ্ছে না। না উপরে, না নিচে—সে যেন স্থির।

প্রথমবার, পাহাড়ের সব শব্দ থেমে গেছে। পাখির ডাকা নেই, হাওয়ার সুর নেই, এমনকি নিজের নিঃশ্বাসও যেন থেমে আছে।

এই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে সে শুধু একটা শব্দ শুনতে পায়—
নিজের অন্তরের শব্দ।

অয়ন চোখ বন্ধ করে। শরীর শক্ত কিন্তু মন আলগা।
সে পাহাড়ের মাটি ছুঁয়ে বসে—মাথা সামান্য নিচু, দুই হাত হাঁটুর ওপর রাখা।

আস্তে আস্তে, সে শ্বাস নেয়। আর মনে মনে বলে,
“আমি কে?”
“আমার ব্যথা কোথা থেকে আসে?”

সে নিজের অতীতকে টানতে থাকে—ছোট ছোট স্মৃতি।
মায়ের হাসি, বাবার রাগ, প্রেমিকার অশ্রু, বন্ধুর ছলনা, অফিসের অপমান—সব এক এক করে এসে দাঁড়ায় তার সামনে।

প্রথমে এগুলো খুব কষ্ট দেয়, মনে হয় শ্বাস আটকে আসছে। কিন্তু ধীরে ধীরে, সে দেখে স্মৃতিগুলো কেবল রঙ আর ছায়া—যার ওপর তার আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

হঠাৎ সে দেখতে পায় এক ছোট অয়ন—স্কুলের মাঠে বসে একা কাঁদছে। বন্ধুদের সাথে খেলতে চেয়েছিল, কিন্তু কেউ তাকে নেয়নি। সেই অপমান, সেই একাকীত্ব তখন খুব গভীর হয়ে জমে গিয়েছিল।

এই একাকীত্বই বড় হয়ে গেছে। সেই ব্যথা তাকে আজও ঘিরে রেখেছে।

অয়ন বলে,
“তুই শুধু একটা বাচ্চা ছেলে, ভয় পেয়ে গেছিস। কিন্তু আমি তো বড় হয়েছি। এবার তোকে আমি মুক্তি দিই।”

ছোট অয়ন হেসে উঠে মিলিয়ে যায়।

এরপর সে দেখে রিনি’কে—তার প্রাক্তন প্রেমিকা। তারা হাত ধরে বসে আছে কোনো পার্কে। সেই সুন্দর দিন।
কিন্তু ঠিক পেছনে রয়েছে সেই ঝগড়া, সেই ভুল বোঝাবুঝি।

সে বলে,
“আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু নিজের ভয় থেকে তোকে দূরে ঠেলে দিয়েছি। তুই চলে গিয়েছিলি, আমি তোকে বোঝাতে পারিনি।”

রিনির মুখে কোনো দোষ নেই। সে কেবল একটা আয়না—যেখানে অয়ন নিজের অসহায়তা, নিজের অপরিণত ভালোবাসা দেখেছিল।

“আমি তোকে দোষ দিই না। এবার আমি নিজেকেই ক্ষমা করি।”

হঠাৎ এক মুহূর্তে অয়ন নিজেরই সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
একদম ঠিক তার মতো দেখতে, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে কঠোরতা।

অয়ন-দুই বলে,
“তুই পালিয়ে এসেছিস। শহর ছেড়ে, জীবন ছেড়ে। কী পেয়েছিস এখানে?”

অয়ন বলে,
“পেয়েছি নিজেকে। এই পাহাড় আমাকে কোনো গাইড দেয়নি, কোনো আশ্বাস দেয়নি। শুধু শিখিয়েছে—আমি আমার নিজের পথ চলার যোগ্য কিনা।”

অয়ন-দুই চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে হেসে উঠে বলে,
“তুই বদলাচ্ছিস। ঠিক পথে আছিস।”

তারপর মিলিয়ে যায় বাতাসে।

পাহাড় তখন এক নিঃশব্দ অথচ জীবন্ত জাগরণ।
গভীর রাতে হাওয়ার এক মৃদু শ্বাস যেন তাকে স্পর্শ করে।
সে মনে মনে ভাবে,
“এই পাহাড় তো কেবল পাথর নয়, এ এক দর্শন। এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি—আমার ভেতরের আমি।”

সে পাহাড়কে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি আমাকে বদলে দিলে?”

কোনো শব্দ হয় না, কিন্তু অয়ন তার ভিতর থেকে উত্তর পায়—
“না, তুই নিজেকেই বদলেছিস। আমি শুধু আয়না।”

এক গভীর ধ্যানের মুহূর্তে, হঠাৎ অয়নের চোখের সামনে দিয়ে আলো ভেসে ওঠে। যেন তার সমস্ত দুঃখ, অপমান, ভুল এক এক করে বেরিয়ে যাচ্ছে তার দেহ থেকে।

সে কাঁদে না, কিন্তু চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এই কান্না মুক্তির, এই কান্না চেতনার।

তার মনে হয়, এতদিন সে অন্যদের ক্ষমা করতে পারছিল না, কারণ নিজেকেই ক্ষমা করেনি। এখন সে পারছে।

রাত কেটে যায় ধ্যান আর আত্মদর্শনে।

সকালে সূর্য উঠলে অয়ন দাঁড়ায়। তার চোখে ক্লান্তি নেই, ভয় নেই।
সে কেবল মনে করে—
“এটাই তো ছিল আমার যাত্রার আসল গন্তব্য। গুহা নয়, চূড়া নয়—এই আমি, নিজেকে পাওয়া।”

তার হাঁটুর নিচে মাটি। সামনে পুরো পাহাড়।
সে পাহাড়ের দিকে চেয়ে বলে,
“তুমি আমার শিক্ষক। এখন আমি প্রস্তুত।”

অধ্যায় ১০: ফিরে আসা, কিন্তু নতুন রূপে

পাহাড়ের চূড়া তখন মেঘে ঢাকা। অয়ন দাঁড়িয়ে, মাথার ওপরে সূর্যের প্রথম আলো পড়ে তার কপালে। চারপাশের নৈঃশব্দ্য যেন তাকে বিদায়ের মন্ত্রপাঠে আশীর্বাদ জানায়।

গত কয়েকদিন তার জীবনের সবচেয়ে নির্জন অথচ গভীর সময়। অয়ন জানে, সে যা খুঁজতে এসেছিল তা পেয়ে গেছে—কোনো পদক নয়, চূড়ার ছবি নয়, বরং নিজের একটা পরিচয়।

সে পাহাড়ের দিকে মুখ করে মাথা নিচু করে।
চোখ বন্ধ করে বলে,
“ধন্যবাদ। তুমি আমাকে ফের গড়েছো।”

পাহাড় কিছু বলে না—তবু বাতাসের এক দোলা তার কাঁধ ছুঁয়ে যায়, যেন বিদায়ের হাতছানি।

অয়ন পাহাড় থেকে নামতে শুরু করে—ধীরে, সংযত পায়ে।
যে ট্রেল সে একা একদিন উঠেছিল, সেই পথ এখন একেবারে নতুন মনে হয়।

কিছুদিন আগেও এ পথ তাকে ভয় দিত, কষ্ট দিত। এখন এই পথ তার চেনা। সে জানে, কোন বাঁকে পা সাবধানে ফেলতে হয়, কোন খাদের ধারে থেমে চোখ রাখতে হয়।

পথে পড়ল সেই গাছটা—যার নীচে একদিন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এবার সে তার ডালে হাত রেখে বলে,
“তুমি আমার একমাত্র ছায়া ছিলে। তোমাকে মনে রাখব।”

গ্রামে নেমে আসতেই কয়েকজন লোক চমকে ওঠে।
—“আপনি একা গেছেন ‘অরণ্যপাহাড়ে’? বাঁচলেন কী করে?”
—“কেউ তো ফিরে আসে না… শুনেছিলাম একবার এক সাহসী লোক গিয়েছিলেন, অমর সেন… তিনিও আর ফেরেননি।”

অয়ন শুধু মৃদু হাসে।
সে বলে না, যে সে অমর সেনের রেখে যাওয়া ডায়েরি পড়েছে।
সে বলে না, পাহাড়ের গুহার রহস্য সে উন্মোচন করেছে।

সে শুধু বলে,
“পাহাড় যদি চায়, আপনাকে ফিরিয়ে দেবে।”

লোকেরা চুপ করে যায়। তাদের চোখে ভয় নয়, একরাশ শ্রদ্ধা।

ট্রেনে ফেরার সময় অয়ন জানালার পাশে বসে থাকে। মাঠ, নদী, গ্রাম পেরিয়ে শহর এগিয়ে আসে।

সে দেখে, শহর যেমন ছিল তেমনই আছে।
কিন্তু যিনি তাকাচ্ছেন, তিনি আর আগের মানুষটি নন।

সে কাগজে লিখতে শুরু করে—
“জীবনের কোনো পর্বই শেষ নয়, কেবল রূপান্তর হয়। পাহাড় আমাকে জীবন দেখিয়েছে, ভয়কে আলিঙ্গন করতে শিখিয়েছে।”

একটু দূরে এক ছোট্ট ছেলে খিচুড়ি খাচ্ছে, পাশের বয়স্ক মহিলা গল্প করছেন নিজের ছেলের চাকরির খবর নিয়ে—সবকিছু যেন আবার নতুন অর্থ পেতে শুরু করেছে।

বাড়িতে ফিরে প্রথমে মায়ের চোখে জল।
সে বলে,
—“তুই কোথায় ছিলি রে এতদিন?”

অয়ন মায়ের কাঁধে হাত রাখে।
—“নিজের মধ্যে ছিলাম মা। এখন ফিরে এলাম।”

বাবা কিছু না বলে সামনে বসে চা খাচ্ছিলেন। অয়ন গিয়ে বলল,
—“আপনার অনেক কথা শোনার বাকি আছে, বাবা। আজ থেকে আমি পালাব না।”

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের পর, বাবা বলে উঠলেন,
—“তুই বদলে গেছিস, ছেলেটা। চোখে একটা শান্তি দেখছি।”

অয়ন হাসে।
পাহাড় তার চোখে এসে বসেছে।

অয়ন ফোন করে অভিককে—যে একদিন তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল, পরে দুরত্ব তৈরি হয়েছিল কিছু টানাপোড়েনের কারণে।

—“দোস্ত, দেখা করবি?”
—“তুই তো হারিয়ে গেছিস রে!”
—“না, এবার আর হারাব না।”

ক্যাফেতে দেখা হয়। অভিক প্রথমে সন্দেহের চোখে দেখে, তারপর বলে,
—“তুই এত চুপচাপ কেন? বদলে গেছিস?”

অয়ন শুধু বলে,
—“শান্তি পেয়েছি রে। এই প্রথম।”

দুজন চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কোনো কথা না হলেও, যোগাযোগটা ফের জেগে ওঠে।

অয়ন পুরোনো অফিসে আর ফিরে যায় না।
সে ছোট একটা জায়গা ভাড়া নেয়, সেখানে এক নিজস্ব স্টুডিও বানায়—যেখানে সে লেখে, আঁকে, ছবি তোলে।

সে ভাবনার খাতায় লেখে,
“শহর আমার বন্দিশালা ছিল না—আমি নিজেই ছিলাম নিজের শিকল। এখন আমি মুক্ত। পাহাড় শিখিয়েছে—অস্থিরতা থেকে শান্তি আসে ধৈর্যের মধ্য দিয়ে।”

সপ্তাহে একদিন সে স্থানীয় বাচ্চাদের যোগ, ধ্যান আর গল্প বলা শেখায়।

সে বলে,
—“তোমরা যদি প্রকৃতিকে মন দিয়ে শোনো, সে তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবে।”

একদিন সে গুহা থেকে আনা অমর সেনের ডায়েরির শেষ পাতাটা আবার পড়ে।

সেখানে লেখা ছিল:
“যদি কেউ এই লেখাটা পড়ে, জানবে আমি মরিনি। আমি এই পাহাড়েই আছি—আলো হয়ে, বাতাস হয়ে। পাহাড় কাউকে মেরে ফেলে না, বদলে দেয়।”

অয়ন ডায়েরি বন্ধ করে বলে,
“অমর সেন, আপনি তো আমার পথপ্রদর্শক। আপনি ছিলেন প্রথম যাত্রী, আমি হয়ত দ্বিতীয়। আর আমাদের মতো আরও আসবে।”

সে পাহাড়কে আবার একদিন দেখবে—এ বিশ্বাস তার মধ্যে অটুট।

অয়ন রিনিকে একটি চিঠি লেখে—

“তুমি যেদিন বলেছিলে, ‘তুই নিজেকেই চেনিস না’, তখন খুব রাগ হয়েছিল আমার। এখন বুঝি, তুমি ঠিক ছিলে। পাহাড়ে গিয়েছিলাম নিজেকে খুঁজতে। পেয়েছি। তোমার জন্য নয়, নিজের জন্য। যদি কোনোদিন আবার দেখা হয়, হয়তো দুজনে আবার নতুন করে কথা বলব। ততদিন, ভালো থেকো।”

সে চিঠি পোস্টবক্সে ফেলে দেয়। কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই।

রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে চাঁদের আলোয় পাহাড়ের অবয়ব কল্পনা করে।
মনে হয়, পাহাড় যেন তার নাম ধরে ডাকে, খুব গভীর ভাবে—
“অয়ন… অয়ন…”

সে চোখ বন্ধ করে হাসে।
পাহাড় তার স্মৃতিতে নয়, তার অস্তিত্বেই রয়ে গেছে।

সে জানে, যেখানেই থাকুক, পাহাড় তার আশ্রয়। পাহাড়ের ডাক একবার এলে, আর কোনোদিন পুরোপুরি ফেরা যায় না।

 

-সমাপ্ত-

1000023471.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *