প্রমিতা বাগচী
পাহাড়ি সকালের চায়ে
কালিম্পঙে পৌঁছোনোর পর প্রথম রাতটা কাটলো খানিকটা জড়তা আর খানিকটা অভ্যাস ত্যাগের প্রস্তুতিতে। শহরের গাড়ির শব্দ ছেড়ে হঠাৎ করে যখন শুধু পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে, তখন প্রথমে বোঝা যায় না, কোথায় এসে পড়েছি।
হোমস্টে—মিসেস ছেত্রীর পুরনো কাঠের বাড়ি। চারপাশে গাছ, বারান্দায় টবে বেগুনী ফুল, আর কাঠের দেওয়ালে ঘুমিয়ে থাকা পাথরের ঘড়ি। মনে হয়, সময় এখানে একটু ধীর গতি পেয়েছে।
সকালবেলায় ঘুম ভাঙতেই জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি—এক পাহাড়ি দৃশ্য! দূরে দূরে গিয়ে মিলিয়ে গেছে সবুজ, তার ওপরে কুয়াশার আলতো ঘোমটা। ঘরের কোণে টেবিলের ওপর রাখা গরম চায়ের কাপ, যেন আমায় ডাকছে।
আমি নিচে নেমে এলাম। মিসেস ছেত্রী তখন ছাতা হাতে রোদে দাঁড়িয়ে টবে জল দিচ্ছেন।
“চা হয়ে গেছে, ম্যাডাম,” বললেন তিনি হাসিমুখে।
তাঁর সেই হাসিতে যেন পাহাড়ি ঝর্নার শব্দ, শান্ত অথচ ছন্দময়।
তিনি আমায় একটি মাটির কাপ ধরিয়ে দিলেন। লাল চা, সঙ্গে আদার হালকা গন্ধ।
প্রথম চুমুকেই যেন শরীর জেগে উঠল, অথচ মনটা আরও গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ল এই শহরের কোলে।
আমি বারান্দায় বসলাম। সামনের পাইন গাছের মাথায় রোদ পড়েছে। দূরে একটি ছোট মেয়ে স্কুল ড্রেসে নিচে নামছে, তার পিঠে স্কুলব্যাগের পাশে একগাছা চুল দুলছে বাতাসে।
এই শহরে সময় যেন অন্যরকম। এখানে সকাল মানেই দৌড় নয়, একটা আলতো প্রসারিত হাই, একটা ধীরে চলা সূর্য।
মিসেস ছেত্রী এসে পাশে বসলেন।
“আপনি লেখেন বুঝি?”
“একটু লিখি,” বললাম আমি, “কিন্তু লিখতে বেশি ইচ্ছে করে যখন পাহাড় দেখি।”
তিনি হেসে বললেন, “এই তো ঠিক জায়গায় এসেছেন।”
তারপর তিনি একটা গল্প শুরু করলেন—একজন হোমস্টে অতিথির, যিনি তিন দিনের জন্য এসেছিলেন, থেকে গিয়েছিলেন তিন মাস।
“তিনি বলতেন, পাহাড়ের হাওয়ায় যা আছে, শহরের কথায় তা নেই।”
চা শেষ করে আমি হাঁটতে বেরোলাম। রাস্তা সরু, কিন্তু পায়ে হেঁটে চলার জন্য যেন আদর্শ। বাঁক পেরোলেই নতুন দৃশ্য। একদিকে নামছে সিঁড়ির মতো পথ, অন্যদিকে উঠে গেছে বনের দিকে।
এক বৃদ্ধ বসে ছিলেন রাস্তার ধারে, তাঁর পাশে বাঁশের ঝুড়িতে কিছু ফুল আর মৌরি। তিনি বললেন, “তোমরা শহরের মানুষ, তাড়াহুড়ো করো, কিন্তু পাহাড় চায় ধৈর্য।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এখানেই থাকেন?”
তিনি মাথা নাড়লেন, “পাহাড়ে কেউ থাকে না, সবাই কেবল আসা-যাওয়ার মাঝখানে থাকে।”
সেই কথাটা আমার মনে গেঁথে গেল।
বিকেলে আমি আবার বারান্দায় বসে ছিলাম। একটা বই খুলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু পড়া হচ্ছিল না। দূরের কুয়াশা, গাছের ডালে বসে থাকা পাখি, আর ঘাসে হেলে পড়া আলো—সবকিছু যেন একটা অদৃশ্য কবিতা লিখছিল।
তখন মনে হল, লিখি। খাতায় কলম তুলে লিখলাম—
“তুমি যদি পাহাড় হও,
আমি হতে চাই সেই সকাল
যে ভোরবেলায় নিঃশব্দে তোমার গায়ে রোদ বুলিয়ে যায়।”
এই শহরটা আমাকে কবিতা লেখাতে বাধ্য করছে। অথচ এখানে কেউ কবি নয়, শুধু মনটা একটু খোলা, সময়টা একটু ধীর।
রাত নামল আস্তে আস্তে। চারপাশে শুধু পাখির ডাক আর দূরের কারও রান্নার গন্ধ।
মিসেস ছেত্রী এসে বললেন, “ভাত হবে গরম, আপনি একবার এসে খেয়ে যান।”
আমি জানি, ওনার খাবারে যতটা স্বাদ, তার চেয়েও বেশি আছে আন্তরিকতা।
চলার শুরুতেই বুঝে ফেললাম—এই পাহাড়ি সকাল আমার ভেতরের একটা দরজা খুলে দিয়েছে। শহরের যান্ত্রিকতায় যে আমি ধরা পড়ে গিয়েছিলাম, সেই আমিকে পাহাড় ছেড়ে দিল একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার ছুটি।
ভুল পথে পাওয়া ঠিক ঠিক ঠিকানা
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ মনে হল, আজ কোনও পরিকল্পনা থাকুক না। আজ কোনও দিশা না মেনে হেঁটে যাই—যেদিকে পাহাড় টানে, সেদিকে।
মিসেস ছেত্রীকে বললাম, “আজ একটু হাঁটতে যাব ভাবছি, কোথাও ঠিক ঠিক যাব না।”
তিনি চা এগিয়ে দিলেন, বললেন, “ভুল পথে গেলে তবে ঠিক ঠিক পাহাড় ধরা পড়ে।”
আমিও ভাবলাম, ঠিকই তো। শহরে তো ঠিক ঠিকটাই খুঁজি—ঠিক বাস, ঠিক অফিস, ঠিক লিফট, ঠিক মোবাইল চার্জার। অথচ এখানে এসে যদি সেই “ভুল” জিনিসটাই একটু চেখে দেখা যায়?
রওনা হলাম। পিঠে একটা হালকা ব্যাগ, পায়ে স্নিকার্স, আর কাঁধে একটা ওড়না যা শুধু ছবি তোলার সময় কাজে লাগে।
রাস্তা একটা ছিল পাহাড়ের বুক চিরে উঠে গেছে, বাঁ পাশে নামছে এক অজানা ধারের দিকে।
আমি নামার দিকটাই বেছে নিলাম।
মনে হচ্ছিল, যেন কেউ পেছন থেকে কানে কানে বলছে, “এই দিকেই যা, তোর জন্য কিছু আছে ওখানে।”
একটু নেমেই বুঝলাম, এই পথটা খুব একটা পাকা না—গাছের শিকড় বেরিয়ে এসেছে, মাটি আলগা, আর মাঝে মাঝে কুয়াশা চোখ ঢেকে দেয়।
তবু পা থামাতে ইচ্ছে করছিল না।
শুধু মনে হচ্ছিল, এই জায়গায় আমি আগে এসেছি… বা কোনও গল্পে পড়েছি… বা কোনও স্বপ্নে!
নেমে এলাম একটা ছোট্ট মাঠে। পাশে একটা কাঠের বেঞ্চি, যা অনেকদিন কেউ ব্যবহার করেনি। সেখানে বসে পড়লাম।
ঠিক তখনই চোখে পড়ল—এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন দূরে। পেছনে একটা চা বাগান। হাতে লাঠি, আর মুখে একরাশ কৌতূহল।
তিনি কাছে এসে বললেন,
— “আপনি শহর থেকে এসেছেন?”
— “হ্যাঁ, ভুল করে এই দিকে চলে এসেছি।”
তিনি হেসে বললেন,
— “পাহাড়ে ভুল বলে কিছু নেই। আপনি যেখানে পৌঁছেছেন, সেখানেই আসা আপনার প্রাপ্য ছিল।”
এই কথাটা শুনেই যেন একটা রোমাঞ্চ হল।
এত সহজ একটা সত্যি কথা, অথচ কত দিন ধরে মাথা নিচু করে ঠিক পথ খুঁজেই জীবন পার করছি!
তিনি বললেন, “এই দিকে অনেকেই আসে না, অথচ এখানেই সকালের আলো সবচেয়ে সুন্দর পড়ে। আপনি থাকলে কাল সকাল দেখে যাবেন।”
আমি হেসে বললাম, “আপনি কি এখানে থাকেন?”
তিনি মাথা নাড়লেন, “না, আমি পাহাড়ে থাকি না। আমি পাহাড়ের গল্প শুনি।”
কথাটা শুনে একটু থেমে গেলাম।
এর মানে?
তিনি বললেন, “পাহাড় কথা বলে না, কিন্তু যাদের মন খোলা থাকে, তাদের সঙ্গে গল্প করে। আপনিও শুনবেন।”
তারপর আমাকে একরকম হাত ধরে নিয়ে গেলেন একটু ওপরে, চা বাগানের মধ্যে দিয়ে। সেখানে একটা কাঠের ঘর—ছোট, কিন্তু সাজানো।
তিনি বললেন, “এটা আমার দাদুর পুরনো বাড়ি। আমি মাঝে মাঝে এসে থাকি, আর যাঁরা হারিয়ে যান, তাদের নিয়ে একটু গল্প করি।”
আমি বসে পড়লাম চৌকিতে। ঘরের ভেতর পুরনো বই, কপার বাটি, আর দেওয়ালে একটা পুরনো ফোটোফ্রেমে তিনজন মানুষের ছবি—হাসিমুখে।
তিনি বললেন, “এই পাহাড় আমাদের পরিবারের কাছে এক প্রকার শিক্ষক। এখানে ভুল করলে রাগ করে না, বরং শেখায়।”
চোখ ভরে দেখছিলাম চারপাশটা। মনে হচ্ছিল, সত্যিই তো, কিছু ভুল পথ আমাদের জীবনে ঠিক ঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেয়।
না হলে আমি কি কখনও এই বাড়ি দেখতে পেতাম? এই গল্পটা শুনতে?
বিকেলে যখন ফেরার জন্য উঠলাম, তিনি একটা চিঠির খাম হাতে দিলেন।
বললেন, “কাল সকালে বাড়ি ফেরার সময় যদি এই পথে আবার আসেন, খামটা এই বেঞ্চের তলায় রেখে যাবেন। কেউ এসে নিয়ে যাবে।”
আমি বললাম, “কী আছে এতে?”
তিনি বললেন, “একটা গল্প, যা পাহাড়কে জানানো দরকার।”
আমি হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম হোমস্টেতে।
মিসেস ছেত্রী বললেন, “আপনি তো অন্যদিকে চলে গিয়েছিলেন!”
আমি মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ, ভুল করে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে ঠিক দিনটা ছিল আজ।”
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে খাতা খুলে লিখলাম:
“ভুল পথে হেঁটে যাওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়।
পাহাড় জানে, ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায়, ঠিক মানুষের সঙ্গে ঠিক কথাটি ঠিক ঠিকই হয়ে যায়।”
মানুষগুলো যাদের গল্প পাহাড় জানে
শহরে আমরা প্রতিদিন অসংখ্য মুখ দেখি, কিন্তু মনে থাকে ক’টা?
কিন্তু পাহাড়ে এসে প্রথম যেটা টের পাই, তা হলো—মানুষের মুখগুলো এখানে আর পাঁচটা পাতার মতো নয়। তারা যেন পাথরের গায়ে খোদাই করা একেকটা গোপন ইতিহাস।
সেদিন সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখি, হোমস্টের গেটের সামনে বসে আছে একটা ছোট ছেলে। পিঠে ব্যাগ, হাতে একটা গামছায় মোড়ানো কিছু।
আমায় দেখে সে উঠে দাঁড়াল।
বলল, “দিদি, তেনজিং।”
আমি বললাম, “আমি প্রমিতা। কোথায় যাচ্ছ?”
সে বলল, “স্কুলে, কিন্তু আগে কাকা’কে বাঁচি দিয়ে যাব।”
আমি একটু কৌতূহলী হয়ে বললাম, “তোর কাকা?”
সে বলল, “চা বাগানে কাজ করে, সকালে জলপাইপাতার বাঁচি খেতে ভালোবাসে।”
একটা শিশুর মুখে ‘জলপাইপাতার বাঁচি’ শুনে আমি চমকে গেলাম। এই শহরে এমন ছোট ছোট রীতির মধ্যে যে কেমন আশ্চর্য আন্তরিকতা, তা শহরের মোবাইল স্ক্রিনে ধরা পড়ে না।
আমি হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম একটা বাঁক বরাবর। এক বৃদ্ধা বসে কাঁথা সেলাই করছেন। তাঁকে দেখে মনে হলো—উনি পাহাড়েরই এক টুকরো, কেবল সময় তাঁর মুখে একটু বেশি রেখা কেটেছে।
তিনি আমায় দেখে ডেকে বললেন, “নতুন এসেছেন বুঝি?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, তিন দিন হলো।”
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কথা শোনেন?”
প্রশ্নটা অদ্ভুত ছিল। আমি একটু থেমে বললাম, “শোনার চেষ্টা করি।”
তখন তিনি বললেন, “পাহাড়কে শুনতে হয়। না হলে ওর কথা হারিয়ে যায়।”
তিনি সেলাই করতে করতেই বলতে লাগলেন—
“আমি আগে সিকিমে থাকতাম। স্বামী মারা যাওয়ার পর এখানে ভাইয়ের সঙ্গে চলে আসি। তখন থেকেই পাহাড়ই আমার সব কথা শোনে।”
এই কথা শুনে মনে হলো—এই মানুষগুলোর মধ্যে পাহাড় কেমন করে রক্তের মতো বয়ে যায়।
আরও কিছুটা এগিয়ে এক চা দোকানে ঢুকলাম। দোকানের নাম—“দিদি’স টি কর্নার।”
চমকে গেলাম।
এক মহিলা বললেন, “দিদি আমি দিদি না, নাম ছিল দেবী। কিন্তু এখানে সবাই আমায় দিদি বলে।”
আমি হেসে বললাম, “তাহলে নামেই দোকানের আত্মা।”
তিনি চা এগিয়ে দিলেন।
তারপর বললেন, “আমি একা থাকি। ছেলেমেয়েরা সব দিল্লিতে।
এখানে আমি কথা বলার জন্য এই দোকান চালাই। চা তো বাহানা।”
সত্যিই তো! শহরে আমরা কত মানুষকে দেখি, যাঁরা আমাদের টুকরো করে কথা বলে। এখানে একজন মানুষ একটা দোকান খুলেছেন শুধু গল্প শোনার আশায়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সবচেয়ে সুন্দর অতিথি কে এসেছিলেন আপনার এখানে?”
তিনি একটু ভাবলেন।
তারপর বললেন, “একবার এক লেখক এসেছিলেন। সকালবেলা এসে বলেছিলেন, ‘আমি লিখতে পারছি না।’
আমি তাঁকে এক কাপ চা দিয়ে বসতে বলি। তিনি সেদিন তিন ঘণ্টা এই দোকানে বসে শুধুই লিখেছেন।”
এমন অনেক অজানা মানুষের গল্প এখানে বাতাসে ভাসে।
তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি ছিলেন ছেত্রীর স্বামী—বুড়ো লোপসাং।
তিনি খুব বেশি কথা বলেন না। কিন্তু সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে পাইন গাছের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কী দেখেন?”
তিনি বললেন, “তোমার মতোই কিছুই না। শুধু সময়টাকে একটু মন দিয়ে দেখি।”
তারপর তিনি একটা জিনিস বললেন যা আমি কোনও দিন ভুলব না—
“মানুষ পাহাড়ে আসে ছবি তুলতে, প্রকৃতি দেখতে। কিন্তু যদি মানুষের চোখের দিকে তাকাও, তবে পাহাড় আরও বেশি স্পষ্ট হয়।”
সেই মুহূর্তে মনে হলো, সত্যিই তো! পাহাড় শুধু দৃশ্য নয়, সে অভিজ্ঞতা।
এবং সেই অভিজ্ঞতা তৈরি হয় মানুষে মানুষে, চা কাপের ধোঁয়ায়, কথার ছায়ায়।
সেদিন রাতে আমি একটা বাক্য লিখেছিলাম খাতার কোণে—
“এই পাহাড় যতটা সবুজ, তার চেয়েও বেশি মানুষের গল্পে রঙিন।”
মেঘেরা যা বলে না
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই জানালার বাইরে দেখি, পাহাড় যেন আজ কিছু লুকোতে চাইছে।
গত ক’দিনের পরিচিত রোদ্দুর-ছায়া আজ নেই।
আজ আকাশ ভারি।
আর সেই ভার থেকেই ঝুলে আছে মেঘ, যেন একসঙ্গে অনেক না-বলা কথা নিয়ে।
পাহাড়ে মেঘ কেবল একখণ্ড জলীয় বাষ্প নয়, একেকটা মেঘ যেন একেকটা অনুভূতি।
কারও মনে জমে থাকা অভিমান, কারও হঠাৎ কান্না, কারও একটা অসমাপ্ত কবিতা।
আমি বারান্দায় বসে চা নিয়ে সেই মেঘগুলোকে দেখতে লাগলাম।
তারা ভেসে যাচ্ছে, থেমে থাকছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে যেন কিছু বলার আগে থেমে যাওয়া কারও মতো।
তখনই মনে পড়ল কাল বিকেলের কথা।
আমি পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গিয়েছিলাম থারপ নামের একটা চূড়োয়।
বলা হয়, সেখানে বসে কেউ যদি চুপ করে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে, তবে একসময় নিজের ভেতরের গলা শুনতে পায়।
আমি একটা পাথরের উপর বসেছিলাম। পাশে কিছু লাল রঙের ছোটো ফুল, আর দূরে গাছেদের মাথায় বৃষ্টির আলতো ছোঁয়া।
হঠাৎ যেন মনে হল, কেউ আমার পাশে এসে বসেছে।
পিছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই।
তবু একটা উপস্থিতি ছিল—অদৃশ্য, কিন্তু অনুভবযোগ্য।
মনে হচ্ছিল, এই মেঘেরা কেবল ভেসে আসে না—তারা শুনতেও জানে।
আমি খুব নিচু গলায় বললাম,
“তোমরা যদি আমার কথা শুনতে পাও, তবে আজ একটু আমার দুঃখটা নিয়ে যাও।”
কী এক মায়াবী মুহূর্ত ছিল সেটা!
মনে হচ্ছিল, সেই মেঘটা একটু থেমে গেল। যেন শুনল।
তারপর আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেল, হারিয়ে গেল দিগন্তে।
ফিরে আসার সময় দেখা হল এক ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে। তার নাম ডলি। মাথায় দুটো বেণী, চোখে কৌতূহল।
বলল, “দিদি, তুমি মেঘকে কী বলছিলে?”
আমি চমকে গেলাম।
সে বলল, “আমি দূর থেকে দেখছিলাম, তুমি ওর সঙ্গে কথা বলছিলে।”
আমি কিছু বলার আগেই সে বলল,
“আমিও বলি। যখন মন খারাপ হয়, আমি মেঘের সঙ্গে গল্প করি।”
আমি বললাম, “মেঘ কি উত্তর দেয়?”
সে বলল, “না। কিন্তু মেঘ চুপ করে শোনে। সেটাই তো সবচেয়ে বড়ো কথা, তাই না?”
এই ছোট্ট কথায় যেন সার্বিক সত্যি ধরা ছিল।
শহরে কত মানুষ আমাদের শোনে?
আমরা চারপাশে কথা বলি, status দিই, নোট লিখি।
কিন্তু কজন আছেন, যাঁরা নিঃশব্দে আমাদের শুনতে পারেন?
পাহাড়ের মেঘেরা যেন সেই নিঃশব্দ শ্রোতা। তারা কথা বলে না, তারা বিচার করে না—শুধু শোনে।
রাত বাড়তে বাড়তে আকাশ আরও ঘন হয়। দূরের গাছে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পাতা নড়ছে টুপটাপ শব্দে।
হোমস্টের বারান্দায় মোমবাতি জ্বলছে। বিদ্যুৎ নেই।
এই অন্ধকারের মধ্যে আমি একটা কবিতা লিখলাম—
“তুমি যদি কুয়াশা হও,
আমি হতে চাই সেই গাছ,
যে তোমাকে নিজের ভিতর টেনে নিয়ে
নিঃশব্দে বৃষ্টি হয়ে পড়ে।”
মিসেস ছেত্রী এসে বললেন,
“আজ খুব ভাবনার মধ্যে আছেন দেখছি?”
আমি বললাম, “মেঘ শোনে, জানেন তো?”
তিনি হেসে বললেন, “পাহাড়ের মেঘ শুধু শোনে না, কিছু কিছু নিজের করে রাখেও।”
এই কথাটা শুনে কেমন যেন ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল।
হয়তো আমিও আজ আমার কিছু অংশ সেই মেঘের কাছে রেখে এলাম।
ভবিষ্যতে যদি কখনও নিজেকে ভুলে যাই, তবে এই পাহাড়ের আকাশে তাকিয়ে মনে পড়ে যাবে—একদিন আমি এখানে বসে ছিলাম, এক কাপ চা হাতে, আর আমার মনের কথাগুলো মেঘে গিয়ে মিশে গিয়েছিল।
ফিরে দেখা মানে রেখে যাওয়া
ফিরে যাওয়া সবসময়ই একটু কষ্টের।
তবু, পাহাড়ে কয়েকদিন কাটানোর পর যখন শহরের ট্রেনের সময়টা গায়ে গায়ে এসে পড়ে, তখন মেনে নিতে হয়—ফেরা ছাড়া উপায় নেই।
চোখ খুলেই জানালার বাইরে তাকালাম।
আজ আকাশ ঝকঝকে। কুয়াশার চাদরটা যেন কারও আদুরে হাতে সরিয়ে রাখা হয়েছে, আর পাহাড় যেন নির্লজ্জ রোদে স্নান করছে।
মনটা এমন দোটানায় পড়ে যায়—একদিকে ব্যাগ গোছানোর তাড়া, আরেকদিকে সেই বারান্দায় বসে শেষবারের মতো চা খাওয়ার আবদার।
মিসেস ছেত্রী আজ একটু গম্ভীর।
চা দিয়ে বললেন, “আপনারা শহরের মানুষ, এলে ভালো লাগে, গেলে মন খারাপ হয়।”
আমি হেসে বললাম, “আপনার হোমস্টে শুধু থাকার জায়গা নয়, মনে রাখার মতো একটা অভিজ্ঞতা।”
তিনি কিছু বললেন না, শুধু হাতের গরম কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। সেই চায়ের কাপে যেন কোনও বিদায় ছিল না—ছিল শুধু আত্মীয়তার আরাম।
প্যাকিং করতে করতে জানালার দিকে চোখ গেল। সেই চেনা পাইনগাছ, সেই পাখিদের দল, আর দূরের স্কুলের বাচ্চারা।
একটা মেয়ে আজ হাত নাড়ল আমায় দেখে। কে জানে, কালকেও এমন সকাল হবে কিনা, কিংবা এমন করে কেউ হাত নাড়বে কিনা।
তবু চলে যেতে হয়।
চলার মধ্যে থেকেই তো আসা-যাওয়ার মানে তৈরি হয়।
তখনই তেনজিং এসে দাঁড়াল দরজায়।
হাতে একটা ছোটো ছবি—একটা পাহাড়, তার গায়ে এক মেয়ের মুখ আঁকা, আর উপরে বড় অক্ষরে লেখা—“দিদি, তুমি পাহাড়কে শুনতে পেরেছো।”
চোখটা একটু ভিজে উঠল।
বললাম, “এই তোদের কাছেই রেখে যাচ্ছি আমার গল্প। যতবার কেউ পড়বে, ততবার আমি আবার এখানে ফিরে আসব।”
সে বলল, “তুমি আবার আসবে তো?”
আমি বললাম, “হয়তো ঠিক এই তারিখে নয়, কিন্তু মন তো থেকে যাচ্ছে।”
গাড়ি যখন নিচে নামছিল, তখন শেষবারের মতো মাথা ঘুরিয়ে পাহাড়টার দিকে তাকালাম।
সেই চোখে একরাশ না বলা কথা।
পাহাড় তো কিছু বলে না, তবু এত কিছু যেন বলা হয়ে যায়।
রাস্তায় নামতেই ফের দেখা সেই চা দোকান—“দিদি’স টি কর্নার।”
আমি নামলাম। দিদিকে বললাম, “আপনার চা না খেয়ে গেলে মন ভালো থাকে না।”
তিনি হাসলেন, বললেন, “এক কাপ চায়ে সব গল্প ঢুকে যায়।”
চা খেতে খেতেই আমি একটা ছোট্ট নোট লিখে রেখে দিলাম তাঁর টিনের বাক্সে—
“আমি আবার আসব। যদি না আসি, তবে জানবেন, এই চা আর কথাগুলোর মধ্যে আমি আছি।”
চুপিচুপি চোখ ভিজে উঠছিল, কিন্তু মনটা হালকা।
কারণ এই ফেরা কোনও পরাজয় নয়, বরং রেখে যাওয়ার এক আশ্চর্য অনুভূতি।
চোখের সামনে দিয়ে পাহাড়ের দৃশ্যটা ছোট হতে থাকে, কিন্তু মন জানে, আমি একে ছোট করিনি। বরং এই পাহাড় আমার ভিতরে আরও বড়ো হয়ে উঠেছে।
বাড়ি ফিরে, স্যুটকেস খুলতেই প্রথমে হাতে এল সেই তেনজিং-এর আঁকা ছবি।
তার পাশে পড়ে ছিল এক টুকরো মেঘের রঙে ভেজা পাতা।
আমি জানি, এই সফর শেষ হল না। শুধু পাতার মতো ভাঁজ হয়ে খাতার মধ্যে থেকে গেল।
শেষ পৃষ্ঠায় আমি লিখলাম:
“ফিরে এলাম বটে,
কিন্তু আমায় যারা ভালোবেসেছিল—
তাদের চোখে আজও পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি আছি,
সেই হাওয়ায়, সেই বারান্দায়,
সেই চায়ের কাপে…
ফিরে দেখা মানেই
পুরোটা ফেলে আসা নয়।”




