রুদ্রনীল ধর
পাঁচ বছর পর, চিলেরবস্তি
টয় ট্রেনটা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছেড়ে দিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। জানালার ধারে বসে ঈশান পাহাড়ের কুয়াশার ভেতর তাকিয়ে ছিল। পাইনগাছগুলো যেন কুয়াশার শরীরে শীতের চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেমন তার স্মৃতিতে তীর্থার চোখে ছিল এক ধরনের মেঘলা অভিমান।
পাঁচ বছর। সময়টা কম নয়।
তবু তার মনে হয় এইতো সেদিন, সে এই চিলেরবস্তির গলিগুলো ধরে হাঁটছিল তীর্থার সঙ্গে। পাথরের সিঁড়ি, পাহাড়ি চা, সন্ধ্যার আগেই ঘনিয়ে আসা অন্ধকার। সেই সব কিছু এখন কেমন একটা আবছা গল্পের মতো লাগে।
তীর্থার সঙ্গে দেখা হয়েছিল একেবারে হঠাৎ করে। ঈশান তখন তার মাস্টার্সের রিসার্চ প্রজেক্ট নিয়ে পাহাড়ি পরিবেশ আর বনের প্রভাব নিয়ে কাজ করতে এসেছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে জঙ্গলে, বাকি সময়টা নোট আর ক্যামেরার মধ্যে।
একদিন বিকেলে, ঝরনার ধারে বসে যখন সে তার স্কেচ খাতায় কিছু আঁকছিল, তখনই প্রথম দেখা—তীর্থা হেঁটে আসছিল একদম চুপচাপ, পেছনের পাইনগাছের ছায়া পেরিয়ে। হাতে ছিল একটা বই—রবীন্দ্রনাথের ‘শেশে আসি’।
তীর্থা বলেছিল, “এখানে বসলে পাখিদের ডাকটা একটু বেশি পরিষ্কার শোনা যায়। আপনি কী আঁকছেন?”
ঈশান বলেছিল, “এই পাহাড়গুলোকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি।”
তীর্থা মুচকি হেসেছিল, “পাহাড় আঁকা যায় না। ওরা শুধু অনুভব করা যায়।”
সেই কথাগুলোর পরই শুরু হয়েছিল তাদের গল্প। রোজ সন্ধের পরে দেখা, বই আদানপ্রদান, চা-এর কাপ আর শীতের আগমনী হাওয়ায় একরকম চুপচাপ ভালোবাসা। এমনকিছু যা হয়তো ভাষায় বলা যায় না, তবুও গভীরভাবে টের পাওয়া যায়।
তবে সেই সম্পর্ক টেকেনি।
ঈশান তখন সদ্য সুযোগ পেয়েছিল এক নামকরা পরিবেশ সংস্থায়। তীর্থা বলেছিল, “তুমি যাও, তুমিই পারবে ওদের মতো বড় কিছু করতে। আমি তো এখানেই থাকব। আমি আর পাহাড়—আমাদের কেউ ডাকেও না।”
তাদের বিদায়ের দিনটায় কুয়াশা নেমেছিল আগেভাগেই। তীর্থার চোখে ছিল চাপা জল আর ঠোঁটে একটা হালকা হাসি। ঈশান কিছু বলেনি, শুধু পিঠে ব্যাগটা তুলে নিয়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়িয়েছিল।
তারপর পাঁচ বছর কেটে গেছে। ঈশান মুম্বইতে। বড় বড় কনফারেন্স, গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে গবেষণা, প্রেজেন্টেশন, মিডিয়া—সবই ছিল, শুধু ছিল না সেই চুপচাপ বিকেলগুলো।
আর হঠাৎই একদিন ডাকবাক্সে এসে পড়েছিল একটা হলুদ খামে লেখা চিঠি।
“পাহাড়ে এখনও তোমার জন্য এক কাপ চা রেখে দিই, রোজ বিকেলে। যদি একদিন ফিরতে চাও, আমি জানালার ধারে বসে থাকব।
– তীর্থা”
চিঠিটা পড়ে ঈশানের বুকের ভেতর একটা টান লেগেছিল। সে জানত না কেন, কিন্তু মনে হচ্ছিল, এবার ফিরতেই হবে।
গাড়ি থামল চিলেরবস্তির ঢোকার মুখে। একটা ছোট বাচ্চা চিলেকোঠার মতো দাঁত বের করে হাসল—“দাদা, পাহাড় দেখে এলেন নাকি?”
ঈশান মুচকি হেসে বলল, “এখনও দেখা শুরু করিনি। পুরনো কিছু দেখতে এসেছি।”
হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছল তিন নম্বর বাঁকে। এখান থেকেই তীর্থার কাঠের বাড়িটা দেখা যায়। একটা ছোট বারান্দা, দুটো গাছের ছায়া আর কাঠের দরজার পাশে একজোড়া সাদা চটি।
দরজা খোলা। ভেতর থেকে ভেসে আসছে পাতিল চায়ের গন্ধ।
ঈশান থমকে গেল।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতর পা রাখল।
সেই জানালার ধারে
দরজার চৌকাঠে পা রাখতেই ঈশানের মনে হল, এই ঘরের প্রতিটি দেয়াল যেন তাকে চিনে রেখেছে। যেন তার উপস্থিতির জন্যই তারা এতদিন অপেক্ষা করছিল। ঘরের ভেতরটা একেবারে বদলায়নি—দু’পাশে কাঠের তাক, পুরোনো ফটোফ্রেম, টেবিলের ওপর তীর্থার হাতে বানানো একগুচ্ছ শুকনো ফুলের তোড়া।
তীর্থা জানালার ধারে বসে আছে, যেন গত পাঁচ বছর সে এক মুহূর্তের জন্যও নড়েনি। চুপচাপ। মাথার চুলগুলো কাঁধ ছুঁয়ে পড়েছে, ধবধবে সাদা একটি শালে নিজেকে মুড়ে রেখেছে সে। চোখ দুটো আগের মতোই শান্ত, কিন্তু গভীরে একরকম নিঃশব্দ অস্থিরতা।
তাঁর চোখ ঈশানের চোখে পড়তেই তীর্থা বলল,
“তুমি এসেছো। আমি জানতাম, তুমি একদিন ঠিক আসবে।”
ঈশান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
তার কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে। হাজারটা কথা মাথায় ঘুরছিল, অথচ মুখে এল না কিছুই।
তীর্থা উঠে এল, চা-এর কাপটা এগিয়ে দিল,
“আজকের কাপটা গরম আছে। বাকিগুলো ঠান্ডা হয়ে যেত। কখনও কখনও গন্ধটুকু রেখে যেতাম—তুমি যদি হঠাৎ এসে পড়ো।”
চা-এর ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে দু’জনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। সময় যেন আটকে গেছে।
“তোমার শহর কেমন?”
তীর্থার প্রশ্ন।
“বড্ড ব্যস্ত। প্রতিদিন কিছু না কিছু ধরতে হয়। একটা ট্রেন, একটা ডেডলাইন, একটা ভার্চুয়াল মিটিং।”
ঈশান হেসে বলল।
“আর ধরতে ধরতে তুমি কি কিছু ফেলে এসেছো?”
তীর্থার কণ্ঠে যেন ব্যথার সুর।
ঈশান জানত, কী বলতে হবে। কিন্তু সত্যি বলার সাহস হয় না সহজে। পাঁচ বছর ধরে তীর্থার কোনো খোঁজ নেয়নি। কোনো চিঠি, ফোন, কিছুই না। তবুও আজ এই পাহাড়ে ফিরে এসে, তার মনে হল সেই শীতের বিকেলগুলো আরেকবার ফিরে পাওয়া যায় যদি।
“তুমি কি কাউকে ভালোবেসেছিলে, তীর্থা?”
প্রশ্নটা হঠাৎ বেরিয়ে এল ঈশানের মুখ থেকে।
তীর্থা একটু চমকে তাকাল, তারপর মৃদু হেসে বলল,
“ভেবেছিলাম তোমাকে ভুলে যাব। একদিন এক পলক চেনা মুখ দেখে বুঝলাম, ভুলিনি। তখন বুঝলাম, পাহাড় যেমন শীত আসে, বসন্ত আসে—তেমন ভালোবাসাও রয়ে যায়। থেকে যায় চুপচাপ।”
ঘরের ভেতর একটা পাইন কাঠের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, হয়তো বাতাসে। কিংবা পুরোনো স্মৃতিরা আবার ধুলো ঝেড়ে জেগে উঠল।
“তুমি কি চিরকাল এখানে থাকবে?”
ঈশানের কণ্ঠে এবার অনুরোধের সুর।
“এই বাড়ি, এই জানালা, এই ঝরনার শব্দ—এগুলোই তো আমার পৃথিবী। আমি তো শহরের আলোতে চোখ হারাই। তুমি পারবে আমার এই পাহাড়ে হাঁটতে?”
তীর্থার চোখে তখন ঈশান নিজেকে খুঁজে পেল।
সে কোনো উত্তর দিল না। শুধু জানালার পাশে বসে থাকা তীর্থার পাশে এসে বসল।
বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। পাহাড়ের গায়ে স্নিগ্ধ কুয়াশা। জানালার কাচে ধোঁয়া জমেছে। তীর্থার হাত ঈশানের হাতের পাশে।
কোনো শব্দ নেই।
শুধু ভিতর ভিতর কিছু গলে যাচ্ছে।
হয়তো বরফ নয়, জমে থাকা অপরাধবোধ।
হয়তো ভালোবাসা, যার কোনো নাম নেই, কিন্তু ঠোঁটের কোণে জমে থাকে।
পাইনবনের শব্দে
পরদিন সকালটা ছিল অসাধারণ। জানালার ওপাশে জেগে উঠেছিল সূর্যের কোমল আলো আর দূরের পাহাড়গুলোতে ছায়া-আলো লুকোচুরি খেলছিল। পাখিদের ডাক, ঝরনার শব্দ আর তীর্থার রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা আদা-চায়ের গন্ধ—সব মিলিয়ে ঈশানের মনে হচ্ছিল যেন এক অন্য পৃথিবীতে উঠে এসেছে সে।
তীর্থা টেবিলে দুটো কাপ রাখল।
“সকালবেলা এখানকার চা-টা একদম অন্যরকম,” সে বলল।
“তোমার শহরের মতো নয়—যেখানে চা মানেই হ্যান্ডলিং চার্জ, ডিসপোজেবল কাপ আর তাড়াহুড়ো।”
ঈশান চা-এর কাপটা হাতে নিয়ে জানালার দিকে তাকাল। নিচে দেখা যাচ্ছে ধাপে ধাপে বসানো বাড়িগুলো, গরুর ঘণ্টার আওয়াজ ভেসে আসছে দূরের কোনও খামার থেকে।
“তোমার স্কুল কেমন চলছে?” ঈশান জিজ্ঞেস করল।
“ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। ওদের চোখে এখনও স্বপ্ন থাকে। একটা কবিতা পড়লে তারা খুশি হয়, একটা গল্প শুনলে চুপ করে থাকে। ওদের দেখলে আমার মনে হয়, আমি ঠিক জায়গায় আছি,” তীর্থা শান্ত গলায় বলল।
“তুমি খুব পাল্টাওনি, জানো?” ঈশান বলল, একটু ইতস্তত করে।
“তুমিও না,” তীর্থা হেসে বলল, “তবে তুমি একটু বেশি ক্লান্ত লাগছো।”
ঈশান নিচু স্বরে বলল, “হয়তো শহরের ভিড়ে নিজের হারিয়ে যাওয়া অংশগুলো খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তোমার সঙ্গে সময় কাটানোর পরে মনে হয়, আমি আবার কিছু খুঁজে পেতে পারি।”
তীর্থা কিছু বলল না। চুপচাপ জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলো, আজ তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই। যেখানে আমরা একবার গিয়েছিলাম, তুমি ছবি এঁকেছিলে একটা বড় পাইনগাছের নিচে।”
ঈশান এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর মাথা নাড়ল।
দুজন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ল—পাহাড়ি রাস্তায়, ঝিরঝিরে হাওয়া, মাঝে মাঝে ঘাসফুল, আর মাথার ওপর বিশাল আকাশ।
হাঁটতে হাঁটতে ঈশান দেখল, তীর্থার হাঁটার ভঙ্গি এখনও আগের মতোই। পাহাড়ে হাঁটার সেই ছন্দটা আজও থেকে গেছে। আর তার মনে পড়ল সেই বিকেলের কথা, যখন তীর্থার চোখে সে একধরনের অভিমান দেখেছিল।
পাইনগাছের নিচে পৌঁছে তীর্থা বসে পড়ল ঘাসে।
“এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়,” সে বলল।
“তুমি যখন চলে গেলে, মাঝে মাঝে এখানে এসে বসতাম। কিছু কিছু কথা বাতাসে বলতাম। জানতাম, হয়তো পৌঁছবে না, তবুও মনটা হালকা হতো।”
ঈশান পাশে বসে পড়ল।
“আমিও ভুলে যাইনি। বরং মনে হতো, ভুলে যাব বলে যত চেষ্টা করেছি, ততই তুমি ফিরে এসেছো—আমার ঘুমের মধ্যে, আমার একাকীত্বে।”
তীর্থা ধীরে ধীরে বলল, “তোমার সঙ্গে যখন হাঁটতাম, তখন বুঝতাম, আমি শুধু পাহাড়ের নয়, তোমার দিকেও টান অনুভব করি।”
তাদের মাঝে বাতাসে গন্ধ ছিল পুরোনো দিনের, আবার নতুন আশার। পাইনবনের মধ্যে দিয়ে ছায়া খেলছিল। ঈশানের মনে হচ্ছিল, সময় একটুও এগোয়নি।
তীর্থা বলল, “তুমি তো আবার ফিরে যাবে, তাই না?”
ঈশান বলল, “আমি জানি না। তবে আমি চাই, এবার যেতে না হয়।”
তীর্থা চুপ করে থাকল। তার চোখে তখন শুধুই আকাশ। আর হয়তো কিছু কথা, যা আজও বলা হয়নি।
চুপকথার সন্ধ্যে
সন্ধে নামছিল ধীরে ধীরে। পাহাড়ের গায়ে আলোর শেষ আঁচড়টুকু পড়ে গেলে নীচে নেমে আসে এক নিঃশব্দ অন্ধকার, যেন প্রকৃতি নিজেই একটা মোহ তৈরি করে। তীর্থার কাঠের বাড়ির বারান্দায় দু’জনে বসে, সামনে রাখা একটা লণ্ঠন। তার আলোয় ঈশানের চোখে তীর্থাকে লাগছিল ঠিক সেই পুরনো দিনের মতো—চুপচাপ অথচ স্পষ্ট, স্পর্শ না করেও ছুঁয়ে যাওয়া যায়।
“তুমি এই বাড়িতে একা একা থাকো?”
ঈশান প্রশ্ন করল।
“না রে, একা থাকা হয় না কখনও। পাখিরা আসে, বৃষ্টির শব্দ থাকে, হাওয়ার মৃদু হাঁসফাঁস। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি এই বাড়ির বাসিন্দা নই—আমি এই বাড়িরই অংশ। একখণ্ড কাঠ, একটুকরো ছায়া,” তীর্থা হাসল।
ঈশান একবার তাকাল তার চোখের দিকে। এতদিন পরে কাছে এসে যেন বুঝতে পারছে, তীর্থার ভেতরটা অনেক গভীর, অনেক বেশি অনুভবের।
“তুই কি এখনও গান গাস?” ঈশান হঠাৎ বলল।
তীর্থা একটু অবাক হয়ে তাকাল, তারপর নিচু গলায় বলল, “হ্যাঁ, মাঝে মাঝে। তুই যে চলে গেছিস, গানগুলোই তখন সঙ্গী ছিল। কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও অতুলপ্রসাদ। জানিস, পাহাড়ে বসে গান গাইলে পাহাড়টা প্রতিধ্বনি দেয় না—ওটা চুপ করে শুনে যায়।”
তীর্থা একবার তাকাল বারান্দার রেলিংয়ের ওপাশে—দূরের অন্ধকারে আলো জ্বলেছে দু-একটা জানালায়। ঈশান বুঝতে পারল, কিছু কিছু রাত শুধু আলো দিয়ে নয়, স্মৃতি দিয়েও আলোকিত থাকে।
তীর্থা গুনগুন করে গাইতে লাগল—
“জীবন যদি ছিলে তবে এই জীবন খানি
তোমার পায়ে রাখি—”
কণ্ঠটা ছিল স্তব্ধ, স্থির, আর কোথাও একটা কাঁপা কাঁপা।
ঈশানের চোখ ঝাপসা হয়ে এল। এতোদিন ধরে সে ভুলে ছিল এই কণ্ঠ, এই অনুভব, অথচ আজ মনে হচ্ছিল, তার শহরের সাফল্য, সম্মান—সবই বৃথা। এই মুহূর্তটা যেন সবচেয়ে সত্য।
“তুই কি আর কোনওদিনও কাউকে ভালোবেসেছিলি না?”
এই প্রশ্নে তীর্থা হাসল। একটু দুঃখের, একটু তৃপ্তির।
“ভালোবাসা একবারই হয়, ঈশান। বাকি সব অভ্যাস।”
ঈশান চুপ করে গেল। কিছুই বলল না।
শুধু কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখল নিজের ক্যামেরাটা।
একটা ছবি তুলল—লণ্ঠনের আলোয় তীর্থার মুখ, কুয়াশার ফাঁকে পাহাড়ের চুপচাপ আকাশ।
“এই ছবিটা আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট হবে,” সে বলল।
তীর্থা মৃদু হেসে বলল, “আমি তোকে কিছু বলিনি ফিরে আসতে। তবুও তুই এলি। কেন?”
“চিঠিটা পেয়ে মনে হল, আমি এখনও কোনো দরজার ওপাশে অপেক্ষা করছি। ফিরে এলাম দেখতে, সেটা এখনও খোলা আছে কিনা।”
তীর্থার চোখ তখন চায়ের কাপের ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে।
“তুই জানিস, আমি প্রতিদিন বিকেলে এক কাপ চা করি। জানালার ধারে বসি। তারপর চুপ করে থাকি। কেউ আসে না। আজ তুই এসেছিস। জানি না এটা একদিনের জন্য, না চিরকালের জন্য। কিন্তু আজকের এই সন্ধ্যেটা শুধু আমাদের।”
ঈশান বলল, “আমরা যদি শুধু এই এক সন্ধ্যায় থাকি, তাও সেটা বহু বছরের চেয়েও বড় হতে পারে।”
সন্ধের নিঃশব্দ পাহাড় সেই কথাগুলো শুনল, আর মেনে নিল।
ফিরে দেখা, ফিরে চাওয়া
পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙল পাখির কিচিরমিচিরে। ঈশান জানালার পর্দা সরিয়ে তাকিয়ে দেখল—দূরের আকাশ এখনও হালকা রঙের, সূর্য কুয়াশার পর্দা ভেদ করে উঠছে ধীরে ধীরে। পাহাড়ের ঢালে ঘাসভেজা শিশির। গাছে গাছে রোদ এসে পড়েছে নিঃশব্দে।
তীর্থা ঘরেই ছিল। চুপচাপ রান্নাঘরে হাঁড়ি বসাচ্ছিল। ঈশান বলল, “তোর জন্য কিছু করতে চাই আজ। বল, কী করব?”
তীর্থা ঘুরে তাকিয়ে বলল, “চল, আজ তোকে আমার শৈশব দেখাই।”
দু’জনে বেরিয়ে পড়ল। পায়ে পায়ে পেরোল পাহাড়ি স্কুল, পাথর বসানো পথ, গাছগাছালি, ছোট ছোট পুকুর। ঈশান অবাক হয়ে দেখছিল—তীর্থা যেন এই জায়গাগুলোর সঙ্গে মিশে গেছে। তার স্মৃতির ভিতরেই যেন গড়ে উঠেছে এই গ্রাম।
তীর্থা বলল, “ওই পুকুরটার পাশে আমি প্রথমবার পড়েছিলাম। বাবার সঙ্গে এসেছিলাম, আমি পড়ে গিয়েছিলাম কাদা জলে। মা এসে তুলেছিল। তখন থেকেই বুঝেছিলাম—মাটি মানে শুধু ধুলো নয়, এটা আশ্রয়ও।”
ঈশান শুনছিল এক নিঃশব্দ আগ্রহে।
একটা মেয়ে, যে শহর ছেড়ে পেছনে রয়ে গেছে—সে কখনও অতীতকে আঁকড়ে ধরেনি, বরং তাকে বুনে নিয়েছে নিজের জীবনে।
“তুই কি কখনও আমার খোঁজ নিতে চাসনি?”
তীর্থা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
ঈশান একটু থমকে গেল।
“চেয়েছিলাম। কিন্তু ভয় পেতাম। ভেবেছিলাম, হয়তো তুই কাউকে পেয়েছিস, হয়তো ভুলে গেছিস।”
তীর্থা একটু হেসে বলল, “ভুলিনি। কিন্তু কাউকে খুঁজিওনি। আমার দরজাটা খোলা ছিল, কিন্তু জানালাটা বন্ধ করে রেখেছিলাম। ভয় পেতাম যদি তুই একদিন এসে দাঁড়াস আর আমি ভুল চাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি।”
ঈশান হাঁটতে হাঁটতে একটা পাইনগাছের তলায় দাঁড়াল।
“তুই জানিস, শহরে আমার খুব নাম হয়েছে। অনেকেই চেনে আমাকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই চেনাগুলো যেন মুখোশ—আমি আসলে কেউ নই। শুধু সেই পাহাড়ের সন্ধ্যেগুলোই আসল।”
তীর্থা বলল, “আসলে আমরা দু’জনেই সেই সন্ধ্যার লোক। আলো আর ছায়ার মাঝখানে থাকা, না আসা, না যাওয়া। শুধু থেকে যাওয়া।”
তারা দুপুর পর্যন্ত পাহাড়ে হাঁটল। পুরনো জলাশয়, পাথরের ভাঙা মন্দির, এক গাছের ছায়ায় বসে থাকা বাচ্চারা—সব যেন তাদের স্মৃতির অংশ হয়ে উঠল।
দুপুরে বাড়ি ফিরে এসে তীর্থা রান্না করল। মুড়ি, আলুভাজা, পেঁয়াজ কুচি, একটা মাটির বাটিতে দই। ঈশান বলল, “এই রকম দুপুর তো বহুদিন খাইনি। এমন একটা দুপুর খেতে হলে তোর মতো কাউকে পাশে থাকা লাগে।”
তীর্থা চুপ করে থাকল।
তারপর ধীরে বলল,
“তুই কি আবার চলে যাবি?”
ঈশান মাথা নিচু করল।
“যেতে হবে। কাজ আছে, দায়িত্ব আছে। কিন্তু এবার আর চুপ করে যাব না। যাব বলেই যাব। আর ফিরে আসব বলেই যাব। তোর কাছে আমি এবার সত্যি করে ফিরে আসব, তীর্থা।”
তীর্থা কিছু বলল না। কেবল জানালার ধারে তাকিয়ে রইল, যেন তার চোখের ভেতর আকাশ লুকিয়ে আছে।
বিদায়ের ভেতর প্রতীক্ষা
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। পাহাড়ে সূর্য নামা মানেই যেন সময়টা আচমকাই থেমে যায়। তীর্থার বাড়ির বারান্দায় বসে ঈশান তাকিয়ে ছিল দূরের আকাশে—যেখানে কুয়াশা ধীরে ধীরে নেমে আসছে, ঝরনার শব্দ একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে তীর্থা বলল,
“কাল ফিরছিস?”
ঈশান মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ। গাড়ির টিকিট কাটা আছে। কিন্তু মনটা যেন কোথাও আটকেছে।”
তীর্থা ম্লান হেসে বলল,
“এই পাহাড়ে একবার মন আটকে গেলে, তা আর সহজে ছাড়ে না।”
ঈশান তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
“তুই বল, তোর জন্য আমি থেকে যেতে পারি কি?”
তীর্থা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল,
“না, বলব না। থাকলে তুই নিজে থেকে থাক। আমি তো চাই না, তুই আমাকে জন্য তোর নিজের স্বপ্ন ফেলে দিস। আমি চাই, তুই ফিরে গিয়ে আমার কথাই ভাবিস—নিয়ম করে, স্পষ্ট করে।”
ঈশান চুপ। এই মেয়েটার নিঃশব্দ ভালোবাসা যেন পাহাড়েরই মতো—মজবুত, ধীর, অথচ গভীরে টান।
“তুই আমার জন্য একটা চিঠি রাখবি?”
ঈশান বলল।
“প্রতিদিন লিখি,” তীর্থা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“যা তোকে বলি না, তাই লিখি। যদি একদিন তুই ফিরে এসে পড়িস—তাই রেখে যাই।”
সন্ধের আলো নেমে এলো ঘরে। ঈশান তাকিয়ে দেখল, লণ্ঠনের আলোয় তীর্থার মুখ যেন একটুকরো শালপাতা—নরম, কোমল, এবং ধরা যায় না।
“তুই কি একদিন কলকাতায় আসবি?”
ঈশান জিজ্ঞেস করল।
“তুই যেখানে থাকিস, সেখানেই তো আমার সব অপেক্ষা। আমি পাহাড়ে থেকেই অপেক্ষা করতে পারি,” তীর্থা হেসে বলল।
ঈশান উঠে দাঁড়াল।
ব্যাগটা গুছিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই।
কিন্তু হৃদয়ের ভিতরটা খালি।
তীর্থার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“তুই জানিস না, এই কয়েকটা দিনে আমি কী ফিরে পেয়েছি।”
তীর্থা চুপ করে রইল।
“ভালোবাসা?”
তীর্থা ধীরে বলল।
“না, তার থেকেও বেশি। ফিরে পেয়েছি একটা সময়, একটা মানুষ, আর নিজেকে।”
তীর্থা তখন বলল,
“তুই যা, কিন্তু ফিরিস। আমি জানালার পাশে চা রেখে দেব—যদি কোনোদিন আবার তোকে আসতে হয়।”
ঈশান চলে যাওয়ার সময় পেছনে তাকাল। তীর্থা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, চুপচাপ, শান্ত। তার শাড়ি উড়ছে হাওয়ায়। আর পাহাড়ের বুক জুড়ে সেই অনন্ত প্রতীক্ষা, যেটা কখনও শেষ হয় না।
শহরের আলো, পাহাড়ের ছায়া
ফিরে এসেছিল ঈশান।
কলকাতার কংক্রিট, অফিস, ঘড়ির কাঁটার দৌড়—সবকিছু যেন এক ঝাঁক অদৃশ্য শিকলে তাকে আবার বেঁধে ফেলেছিল। কিন্তু এবারের ঈশান আগের মতো ছিল না। তার ভেতরটা বদলে গিয়েছিল।
প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে সে পাহাড়ের ছবি আঁকত। কাঠের বাড়ি, জানালার পাশের চেয়ার, লণ্ঠনের আলোয় এক মুখ—এইসব রঙে রঙে সে তীর্থাকে কাগজে ধরে রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু যতোই সে আঁকত, বুঝত—কিছু জিনিস আঁকা যায় না। যেমন ভালোবাসা। যেমন অপেক্ষা।
প্রেজেন্টেশন মিটিংয়ের মাঝেও ঈশানের চোখ চলে যেত জানালার বাইরে। তার মনে পড়ত তীর্থার গলা, সেই লাইনটা—
“ভালোবাসা একবারই হয়, বাকি সব অভ্যাস…”
তার সহকর্মী অনন্যা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল,
“তুমি আজকাল খুব চুপচাপ, ঈশান। সব ঠিক তো?”
ঈশান শুধু বলেছিল,
“সব কিছু ঠিক, শুধু কিছু কিছু জায়গা ভেতরে এখনও পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
বাড়ি ফিরে প্রতিদিন সে চিঠির খামে করে তীর্থার জন্য কিছু না কিছু লিখত। কখনও একটা ছোট কবিতা, কখনও পুরোনো দিনের একটা ছবি, কখনও শুধুই “আজ তোমাকে খুব মনে পড়ছে”। তারপর একটা কাঠের বক্সে রেখে দিত।
তীর্থার ঠিকানা জানত, কিন্তু চিঠিগুলো কখনও পোস্ট করত না। যেন ভয় পেত—কাছে গেলে আবার হারিয়ে যাবে সব।
এক সন্ধ্যায়, আচমকা সে জানলার পাশে বসে থাকতে থাকতে একটা সিদ্ধান্ত নিল।
নিজেকে প্রশ্ন করল—
“আমি কি প্রতীক্ষার মধ্যে বাঁচছি? নাকি নিজেই অপেক্ষা করাতে দিচ্ছি নিজেকে?”
পাহাড়ে যে সন্ধ্যাটা তাকে বদলে দিয়েছিল, তাকে নতুন করে গড়ে তুলেছিল—সেই সন্ধ্যার কাছে সে কি সত্যিই ফিরবে না?
সেই রাতেই সে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। এবার কোনও টিকিট কাটা নেই, কোনও আনুষ্ঠানিকতা নয়—শুধু একটা তাড়না।
পরদিন সকালে সে গাড়ি ধরল। মন বলছিল, কিছু একটা বদলে যাবে এবার। হয়তো তীর্থা থাকবে না, হয়তো সে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়েছে। কিন্তু তবুও, ঈশানের মনে হচ্ছিল—প্রতিটি প্রেম একবার হলেও তার পূর্ণতা চায়।
চিলেরবস্তির ঢোকার মুখে পৌঁছতেই তার বুকের ভেতর কাঁপতে লাগল। রাস্তা, গাছ, সেই বাঁক—সবকিছু যেন আরও বেশি চেনা, আরও বেশি অন্তরঙ্গ লাগছিল এবার।
তীর্থার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সে।
দরজা খোলা। বারান্দায় রাখা চা-এর কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে।
আর জানালার পাশে—তীর্থা। সেই একইভাবে বসে, চোখে সেই চুপচাপ আলোটা।
তারা কেউ কিছু বলল না।
শুধু তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে।
তীর্থা বলল,
“তুই এলি। আমি জানতাম।”
ঈশান মৃদু হাসল,
“এবার আমি ফিরলাম। আর চলে যাব না।”
তীর্থা চা এগিয়ে দিল।
সেই এক কাপ চা, যেটা প্রতিদিন রাখা হতো শুধুমাত্র তার জন্য। আজ অবশেষে সত্যিই কেউ এসে সেই চা খেল।
যা থাকে চুপ করে
পাহাড়ের সকালটা আজ যেন আরও একটু শান্ত, আরও একটু গাঢ়। জানালার ধারে ঈশান দাঁড়িয়ে আছে, এক হাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে একটা পুরনো স্কেচ খাতা। পেছনে তীর্থা রান্নাঘরে ব্যস্ত, কিন্তু প্রতিটি শব্দেই যেন একরকম নির্ভরতা মিশে আছে।
এই বাড়ির প্রতিটা কোণে এখন ঈশানের অস্তিত্ব ছড়িয়ে পড়েছে। পুরোনো কাঠের টেবিলে তার ক্যামেরা, দেয়ালে বাঁধানো নতুন কিছু ছবি, আর চৌকাঠে রাখা জুতোজোড়া। সব মিলিয়ে এ যেন আর কোনও অতিথির আসা নয়—এ এবার থেকে তার থাকার গল্প।
তীর্থা এসে দাঁড়াল পাশে।
“এই জায়গাটায় আমরা দু’জন দুই রকম। তুই শহর থেকে পালিয়ে এসেছিস, আমি পাহাড়ে পালিয়ে থেকেছি। এবার আমরা কি একসঙ্গে থাকতে পারি?”
ঈশান চুপ করে তার দিকে তাকাল।
“আমরা যদি ভিন্নও হই, ভালোবাসা তো একটাই—যেখানে থাকা মানে একে অপরের পাশে থাকা, রোজকার ছোট ছোট জিনিসে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া।”
তীর্থা হেসে বলল,
“তুই এবার কোথাও যাবি না তো, ঈশান?”
“না,” ঈশান ধীরে বলল।
“শহরের আলোয় চোখের দৃষ্টি কেবল বাইরের জিনিস দেখে। পাহাড়ের ছায়ায় চোখ ভিতরের দিকে যায়। আমি এবার নিজের চোখ ফেরাতে এসেছি।”
তীর্থা বলল,
“তাহলে তোকে একটা কাজ করতে হবে। স্কুলে আমার সঙ্গে যেতে হবে। ছোট ছোট বাচ্চাদের ছবি আঁকতে শেখাবি। আর তাদের বলবি, পাহাড়ে শুধু প্রকৃতি না, গল্পও থাকে।”
ঈশান মাথা নাড়ল, “আমি গল্প বলতে পারব না, কিন্তু একটা ছবি আঁকতে পারব, যেখানে তুই থাকবি, পাহাড় থাকবে, আর থাকবে একটা জানালার পাশে রাখা এক কাপ চা।”
সন্ধ্যায় তীর্থা একটা নতুন শাড়ি পরল। ঈশান তাকে বলল,
“এই পাহাড়ে আলোর চেয়ে তুই বেশি জ্বলে উঠিস।”
তীর্থা হেসে বলল,
“আমি না, তুই ফিরেছিস বলেই আলোটা যেন আলাদা লাগছে আজ।”
তারা একসঙ্গে বারান্দায় বসে।
ঝরনার শব্দ আসছে, দূরে কাঠের ঘরে আলো জ্বলছে, হাওয়ার মাঝে পাইনগন্ধ।
তীর্থা ধীরে বলল,
“আমরা তো আর কিছু চাইনি—না বড় শহর, না বড় স্বপ্ন। শুধু চেয়েছিলাম একটা জানালার পাশে একসঙ্গে বসে থাকতে, কিছু চুপ করে বলা কথা নিয়ে। সেটাই তো সবচেয়ে বড় কথা—যা থাকে চুপ করে, অথচ থেকে যায় সারাজীবন।”
ঈশান বলল,
“তাহলে লিখে রাখি—এই গল্পটা শেষ নয়, এটা শুরু।”
পাহাড় মাথা নাড়ল, হাওয়া থেমে গেল এক পলকে।
আর এক কাপ চায়ের ধোঁয়া জানালার কাচে উঠে গিয়ে লিখে দিল—
“তারা একসঙ্গে ছিল, কোনো শর্ত ছাড়াই।”
শেষ




