সৃজনী দেব
কলকাতার ভিড় আর শব্দের বেসরকারি চাপ থেকে মুক্তি খুঁজতে অনির্বাণ ভোরবেলায় দার্জিলিংয়ের পথে রওনা হয়। শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট, ক্লান্ত মানুষজন, হাহাকার আর যানজট সবই যেন তাকে এক অদৃশ্য জালে আটকে রাখছিল, যেখানে নীরবতার স্বাদ পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু পাহাড়ের দিকে যাওয়ার সাথে সাথে এই নৈরাশ্যটা ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছানোর পর, ছোট্ট টয় ট্রেনের ঢেউ খেলানো স্লোপে ওঠার সাথে সাথেই তার মন ভরে ওঠে অজানা আনন্দে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের কুয়াশা, দার্জিলিং শহরের ছোট্ট চা-বাগান আর দূরবর্তী আকাশের সঙ্গে মিশে থাকা সবুজের সমাহার তাকে এক অবর্ণনীয় শান্তি দেয়। ট্রেন যখন ধীরে ধীরে পাহাড়ের বাঁক কেটে এগোতে থাকে, প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাকে কেবল তার চারপাশের দৃশ্যের সৌন্দর্যকে দেখার জন্য নয়, বরং নিজের ভিতরের শব্দগুলোকে শোনার জন্যও ডাকছে।
পাহাড়ি হাওয়া তার চুলে খেলতে খেলতে মনে করায়, কলকাতার শহরের গরম ও ধোঁয়াশা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল। সবুজ পাহাড়, সরু পথ, আর কুয়াশার আড়ালে লুকানো ছোট্ট ঘরগুলো যেন তাকে গল্পের পাতায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি বাঁক তার মনকে নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করছে। অনির্বাণ লক্ষ্য করে যে, তার নিজের জীবনের ব্যস্ততা, ফোনের কল, মিটিংয়ের চাপ—সবই এই সফরে যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। চোখে পড়ছে চা-বাগানের শ্রমিকদের কাজ, যেখানে তারা শান্তভাবে পাতাগুলো তুলছে, কখনও হালকা গানের স্বরে কথা বলছে। সেই দৃশ্য তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, জীবনের সহজ মুহূর্তগুলোর সৌন্দর্যকে অনুধাবন করা কতটা জরুরি। তার মনে হয়, এই সফর শুধুমাত্র দার্জিলিং-এর দৃশ্য দেখতে আসা নয়, বরং নিজের আত্মার গভীরে প্রবেশ করার এক অনন্য সুযোগ।
ট্রেনের যাত্রা যত বাড়ে, কুয়াশা তত ঘন হয়ে আসে, এবং পাহাড়ের সঙ্গে মিশে থাকা ছোট শহরগুলো যেন ধীরে ধীরে তার মনকে আরো নরম করে দেয়। অনির্বাণ হঠাৎ অনুভব করে, এই ভ্রমণ কেবল তার নিজের জন্য নয়—কেউ বা কিছু, হয়তো অতীতের স্মৃতি বা এক অজানা গল্প, তার সাথে এই সফরে এসেছে। মাঝে মাঝে কুয়াশার আড়ালে, পাহাড়ের এক কোণে যেন একটি মৃদু হাসি বা ছায়া ভেসে ওঠে, যা তার কৌতূহলকে আরো উদ্দীপ্ত করে। শহর থেকে পাহাড়ের এই যাত্রা শুধু ভ্রমণ নয়, এটি এক ধরণের অন্তঃদর্শন, যেখানে প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি কুয়াশার পরতে পরতে অনির্বাণ নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি এবং আনন্দের অনুভূতি জাগিয়ে দেয়—এক ধরনের অনুভূতি যা শহরের ব্যস্ততায় সে কল্পনাও করতে পারত না। পাহাড়ি বাতাসের সাথে মিলিয়ে তার মনও যেন নতুন করে শ্বাস নেয়, জীবনের ছোট্ট আনন্দগুলোকে চেনে এবং স্বীকার করে। এই প্রথম অধ্যায়ের শেষ দিকে, অনির্বাণ বুঝতে পারে, এই সফর কেবল দার্জিলিং-এর সৌন্দর্য দেখার জন্য নয়, বরং নিজের ভিতরের অজানা অনুভূতিগুলোকে চেনার এক রহস্যময় যাত্রা।
_
মল রোডের ব্যস্ত ভিড়ের মধ্যে, যেখানে পর্যটক, স্থানীয় দোকানদার এবং পথচারীর পদচারণায় পথ যেন নাড়া খাচ্ছিল, অনির্বাণ হঠাৎ একটি ছোট্ট বইয়ের দোকানের সামনে থেমে যায়। দোকানের জানালা দিয়ে দেখা যায় পাহাড়ের সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন পর্যটন স্থান নিয়ে লেখা বইয়ের সজ্জা, আর তাতে চোখ আটকে যায় তার। যন্ত্রণা ও শহরের ব্যস্ততা থেকে মুক্তির খোঁজে সে এখানে এসেছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছিল কিছু অনির্বাণের জন্য অপেক্ষা করছিল। দোকানের ভেতরে ঢুকে, তার চোখ পড়ে এক তরুণীর দিকে—নরম কুয়াশার মতো শান্ত মুখ, চোখে কৌতূহল আর হালকা মৃদু হাসি। ঐশী নামের সে তরুণী তার হাতে ধরেছে এক বই, যার পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা ছিল পাহাড়, চা-বাগান, পাহাড়ি মানুষ এবং প্রকৃতির ছোট ছোট গল্প। অনির্বাণও সেই একই বইয়ের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন চোখ দুটো একই পথে মিলিত হয়েছে।
একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় তাদের প্রথম কথোপকথন। “আপনিও এই বই পড়ছেন?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে। ঐশী হালকা করে হাসে এবং মাথা নাড়ে। ভিড়ের মধ্যে যেন মুহূর্তটি থেমে যায়, শব্দগুলো—ট্রাফিক, মানুষজনের পদচারণা, দোকানের চমৎকার ঘ্রাণ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নীরবতার ছায়া তৈরি করে। তারা বইয়ের বিষয় নিয়ে আলাপ করতে শুরু করে—পাহাড়ের গল্প, প্রকৃতির সৌন্দর্য, মানুষ এবং তাদের সম্পর্ক। অনির্বাণ লক্ষ্য করে, ঐশীর কথায় এমন গভীরতা, যা শহরের জীবন এবং তার নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলছে। প্রতিটি প্রশ্নে, প্রতিটি হালকা হেসে উত্তর দেওয়ায় অনির্বাণের মনে একটি অদ্ভুত টান তৈরি হয়। মনে হয়, তারা দুজনেই এক অচেনা জগতের খোঁজ করছে, যেখানে পাহাড়, কুয়াশা, বই এবং কথোপকথন মিলিত হয়ে নতুন ধরনের বন্ধন তৈরি করছে।
সেখানে কয়েক মিনিটের আলাপ শুধু সময়ের হিসাব নয়, বরং এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করে। অনির্বাণ বুঝতে পারে, এই অচেনা দেখা কেবল সৌন্দর্য বা আকর্ষণ নয়; এটি এক অদৃশ্য সেতু, যা তার এবং ঐশীর মনে থাকা অসম্পূর্ণ অনুভূতিগুলোকে সংযুক্ত করছে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা দুজন একে অপরের দিকে তাকায়, এবং সেই চোখের বিনিময়ে বোঝা যায়, এখানে একটি অদ্ভুত টান তৈরি হয়েছে যা সহজে ভাঙবে না। দোকানের ছোট্ট কোণ, বইয়ের খোঁজ, পাহাড়ের গল্প—সবই মিলিয়ে অনির্বাণকে অনুভব করায় যে, এই সফর তার একাকিত্বকে নয়, বরং নতুন পরিচয় এবং সম্ভাবনার জন্য খুলে দিচ্ছে। মল রোডের হুলস্থূল, ভিড় আর শব্দের মধ্যে, এই ছোট্ট মুহূর্তটি যেন তার জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা—যেখানে অচেনা দেখা শুধুই দেখা নয়, বরং এক অদৃশ্য বন্ধনের প্রথম নিদর্শন।
_
পরদিন ভোরবেলায়, এখনও পাহাড়ি হাওয়ার মধ্যে শিশিরের গন্ধ ভেসে আসছিল, অনির্বাণ এবং ঐশী মিলে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখতে রওনা হয়। পথটি সরু এবং বাঁকা, দুইপাশে পাহাড়ি গাছ এবং ঝরা পাতা, যা তাদের পায়ের তলে ক্রিস্পি শব্দ তৈরি করে। হালকা কুয়াশা পথটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে, যেন প্রতিটি পায়ের ছাপ অস্থায়ী কোনো গল্পের অংশ। তাদের কথোপকথন শুরু হয় খুব স্বাভাবিকভাবে—পাহাড়ের সৌন্দর্য, চা-বাগানের শ্রমিকদের দিন শুরু করার দৃশ্য, এবং তাদের নিজস্ব শহুরে জীবন থেকে যে বিরতি নিয়েছে তা নিয়ে। কিন্তু যত বেশি তারা হাঁটে, কথাগুলো ক্রমে গভীর হয়ে আসে। অনির্বাণ লক্ষ্য করে, ঐশীর চোখে এমন এক উজ্জ্বলতা, যা শুধুমাত্র পাহাড়ের সৌন্দর্যকে নয়, বরং মানুষের অন্তরের অনুভূতিকে প্রতিফলিত করছে। হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নীরব মুহূর্তগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে; কুয়াশার আড়ালে শুধু তাদের শব্দ নয়, অনুভূতিও মিশে যাচ্ছে।
কুয়াশা তাদের চারপাশের দৃশ্যকে মৃদু এবং রহস্যময় করে তুলেছে। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি চূড়া যেন নতুন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। তাদের পায়ের তলে ঝরা পাতার গন্ধ আর হিমেল বাতাসের স্পর্শ এক ধরনের উষ্ণতা এবং সতেজতা দেয়, যা শহরের কোনো শব্দ বা আলোতে পাওয়া যায় না। অনির্বাণ অনুভব করে, প্রতিটি ধাপ তাকে তার নিজস্ব চিন্তা এবং অনুভূতির দিকে আরো কাছে নিয়ে আসছে। তারা হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়, কুয়াশা, সূর্যোদয় এবং একে অপরের কথা—সবকিছু একাকার হয়ে যায়। কান্চনজঙ্ঘার দূরবর্তী রঙিন ঝলক হঠাৎ চোখে পড়ে, এবং সেই দৃশ্য তাদের মনকে এমন এক অদ্ভুত কম্পনে ভরিয়ে দেয়, যা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, বরং নতুন আবিষ্কারের অনুভূতি। ঐশী তখন হেসে অনির্বাণের দিকে তাকায়, এবং তাদের দুজনের মধ্যে সেই অদৃশ্য টান আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে।
সূর্য ধীরে ধীরে পাহাড়ের গায়ে উঠে আসে, এবং হালকা সোনালী আলো কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আলো এবং কুয়াশার খেলা তাদের চারপাশের পরিবেশকে এক স্বপ্নময় আবহে পরিণত করে। হাঁটা থেমে তারা এক ছোট্ট চিলকানি পাথরের উপরে দাঁড়ায়, দূরের পাহাড়কে অবলোকন করে। সেই মুহূর্তে অনির্বাণ মনে মনে ভাবতে থাকে, এই সফর কেবল একটি ভ্রমণ নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ যাত্রা, যা তার জীবনের নতুন অধ্যায় খুলে দিচ্ছে। প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি কথোপকথন, প্রতিটি চমৎকার দৃশ্য তাদের মনকে এক অদ্ভুত সংযোগের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে। পাহাড়ের নীরবতা, কুয়াশার মৃদু আড়াল, এবং কান্চনজঙ্ঘার ঝলক—সবই মিলিয়ে তাদের অনুভূতিকে এমন এক দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, যা শহরের কোনো বিশৃঙ্খলা দিতে পারত না। তাদের হাঁটা শেষ হলেও মনে হয়, এই কুয়াশার পথে হাঁটা তাদের এক অদৃশ্য বন্ধনের সূচনা মাত্র, যা সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হতে থাকবে।
_
দিনগুলি কাটতে কাটতে অনির্বাণ এবং ঐশীর দেখা হওয়া যেন এক স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়। সকালবেলা টয় ট্রেনের কুয়াশা থেকে শুরু করে মল রোডের ব্যস্ততা, সব কিছুতে তাদের চোখ একে অপরের দিকে খোঁজে। চা-বাগানের সবুজে বসে তারা সময় কাটায়, পাতার রঙিন শোভা আর বাতাসের মৃদু সুরে মুখে হাসি ফোটে। কখনও তারা শুধু চুপচাপ বসে থাকে, শুধু পাহাড়ের দৃশ্য আর কুয়াশার নরম আবেশ উপভোগ করে; কখনও আবার তাদের কথোপকথন গভীর হয়ে যায়, অতীতের স্মৃতি, ভবিষ্যতের স্বপ্ন এবং জীবনের ছোট ছোট আনন্দ নিয়ে। অনির্বাণ লক্ষ্য করে, প্রতিটি ছোট মুহূর্তে, প্রতিটি হাসি এবং চুপচাপের মধ্যে, যেন তার মন এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। তার চোখে শহরের ব্যস্ততা, অফিসের চাপ—সবই দূরে চলে যায়, এবং কেবল ঐশীর উপস্থিতিই তার দৃষ্টিপাতের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
চা-বাগানের ছোট্ট বেঞ্চে বসে হালকা বাতাসে পাতাগুলো নড়ে গেলে তাদের কথোপকথনও একটি হালকা ছন্দে প্রবাহিত হয়। ঐশীর হাসি, চোখের উজ্জ্বলতা, এবং কথার মধ্যে থাকা মৃদু কৌতূহল অনির্বাণের হৃদয়ে এক অদ্ভুত কম্পন সৃষ্টি করে। কখনও তারা হেসে উঠে, কখনও শুধু চুপচাপ বসে থাকে; কিন্তু এই চুপচাপও যেন কথার সমান শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এরপর দুপুরবেলা কফি শপে গরম কাপের ভাপে ভেজা আঙুল স্পর্শ করলে, অনির্বাণ অনুভব করে—প্রতিটি মুহূর্ত শুধু সময় পার করার জন্য নয়, বরং এক নতুন অভিজ্ঞতা, এক অচেনা সান্নিধ্য তৈরি করার জন্য। শহরের ব্যস্ততা এবং দার্জিলিংয়ের স্বাভাবিক সৌন্দর্য—সব মিলিয়ে তার অনুভূতিকে এমন এক আবহে ভরে তোলে, যা আগে কখনও অনুভব হয়নি।
দিনশেষে, পাহাড়ের নরম আলো ধীরে ধীরে তারা দুজনকে মৃদু আবহে ঢেকে দেয়। অনির্বাণ বুঝতে পারে, এই সফর শুধু পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য নয়, বরং তার মনও ধীরে ধীরে এক অপরিচিত কণ্ঠস্বরের কাছে বাঁধা পড়ছে। ঐশীর উপস্থিতি, হাসি, কথার ছন্দ—সবই যেন তার জীবনের নতুন রঙ এবং গতি এনে দিয়েছে। প্রতিটি ছোট অভ্যাস, যেমন চা-বাগানের বেঞ্চে বসা, কফি শপের কাপ ছোঁয়া, কিংবা একসাথে হাঁটা—সবই তার মনকে ঐশীর সঙ্গে অদৃশ্যভাবে যুক্ত করে রেখেছে। অনির্বাণ অনুভব করে, এই অপ্রত্যাশিত সান্নিধ্য কেবল আনন্দ বা আনন্দদায়ক মুহূর্ত নয়; এটি একটি গভীর অভিজ্ঞতা, যা তার অনুভূতি, মন এবং হৃদয়কে এক নতুন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, যেখানে পাহাড়, কুয়াশা এবং এক অপরিচিত কণ্ঠস্বর মিলিয়ে এক নতুন জীবনের সূচনা ঘটাচ্ছে।
_
সন্ধ্যার নরম আলো পাহাড়ের কোলে ধীরে ধীরে ভেসে আসে, আর গুম্ফার ছোট্ট প্রাঙ্গণে মোমবাতির কম্পিত আলো তাদের চারপাশে এক অদ্ভুত উষ্ণতা তৈরি করে। বাতাসে আছে কুয়াশার নরম ছোঁয়া, যা প্রতিটি শব্দকে মৃদু এবং গভীর করে তোলে। অনির্বাণ এবং ঐশী এক নিরিবিলি কোণে বসে থাকে, দুই হাতের মাঝে চায়ের কাপের উষ্ণতা মিশে আছে। সেই নিরিবিলি মুহূর্তে, ঐশী হঠাৎ তার চোখে মৃদু জল ছড়িয়ে, তার জীবনের গল্প খুলতে শুরু করে। শহরের ব্যস্ততা, কাজের চাপ, দায়িত্বের বোঝা এবং একাকীত্ব—সবই তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। তার কণ্ঠে এক অজানা কোমলতা, যা অনির্বাণের হৃদয়ে গভীর ছোঁয়া ফেলে। তিনি লক্ষ্য করেন, এই স্বীকারোক্তি শুধু কথার বিনিময় নয়; এটি এক অনুভূতির সেতু, যা দুই নিঃসঙ্গ আত্মাকে একে অপরের দিকে টেনে নিয়ে আসে।
অনির্বাণও তার নিজের অনুভূতিগুলোতে গভীরভাবে প্রবেশ করে। শহরের চাপে এবং জীবনের দ্রুত গতিতে যে একাকীত্ব তিনি অনুভব করতেন, সেটি এই পাহাড়ি কুয়াশার আড়ালে হঠাৎ মিলিত হয় ঐশীর নিঃসঙ্গতার সঙ্গে। তাদের চোখের মিলন, কথার গভীরতা এবং নীরবতার মুহূর্তগুলো এক ধরনের অদ্ভুত সুর তৈরি করে। অনির্বাণ উপলব্ধি করেন, এই মুহূর্তে পাহাড়, কুয়াশা, মোমবাতির আলো—সবই যেন তাদের অন্তরের অনুভূতিকে স্পর্শ করছে। কথাগুলোতে আছে ভীতিভাব, আশা, এবং অজানা আকর্ষণ, যা তাদের দুজনকে এক অপরিচিত কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করছে। প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি চোখের দৃষ্টি তাদের কাছে বলে দিচ্ছে যে, একাকীত্ব কেবল শূন্যতা নয়, বরং অন্য কারও কাছে পৌঁছানোর একটি সেতু হতে পারে।
মোমবাতির নরম আলো এবং কুয়াশার আড়াল তাদের চারপাশকে এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যেখানে সময় এবং স্থান যেন থেমে গেছে। ঐশী তার গল্প শেষ করে, আর অনির্বাণ ধীরে ধীরে তার নিজের অনুভূতিগুলো স্বীকার করে—তার একাকীত্ব, তার খুঁজে পাওয়া অভাব, এবং অজানা আকর্ষণ যা ঐশীর প্রতি অনুভব হচ্ছে। প্রথমবার তারা স্বীকার করে নেয়, যে তাদের মধ্যে শুধু বন্ধুত্ব নয়, বরং একটি গভীর এবং নতুন অনুভূতির জন্ম হয়েছে। পাহাড়ি কুয়াশার মধ্যে, মোমবাতির নরম আলোতে, তাদের দুজনের হৃদয় যেন একসাথে নাড়া দেয়, এক অদ্ভুত কম্পনে, যা শহরের ব্যস্ততা, দায়িত্ব, এবং জীবনের চাপে কখনও পাওয়া যেত না। সেই সন্ধ্যা তাদের জন্য শুধু একটি সময় নয়, বরং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে কুয়াশা, আলো এবং স্বীকারোক্তি মিলিয়ে একটি স্থায়ী বন্ধনের ভিত্তি স্থাপন করে।
_
ভ্রমণের দিনগুলি ক্রমে শেষের দিকে এগোতে থাকে, আর অনির্বাণ মনে করতে থাকেন যে তার ফেরার দিন ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে। পাহাড়ি রাস্তায়, যেখানে কুয়াশা এখনও তাদের চারপাশকে ঢেকে রেখেছে, তারা দু’জনে হাঁটছে, কিন্তু কথার বিনিময় আজ আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত নয়। বাতাসে আছে সামান্য ঠান্ডা, যা তাদের শরীরে এক ধরনের নীরবতা এবং গভীর চিন্তাভাবনা ঢুকিয়ে দেয়। তারা একে অপরের দিকে তাকায়, কিন্তু চোখে চোখ রাখার সময়ও মাঝে মাঝে নীরবতা ঢুকে পড়ে। অনির্বাণ মনে করেন, এই নীরবতা শুধু পাহাড়ের শান্তির প্রতিফলন নয়, বরং এক অজানা ভয়—ভয় যে এই মুহূর্ত, এই সম্পর্ক, এই অপ্রত্যাশিত সান্নিধ্য, সবই শুধুই পাহাড়ি কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে। তাদের পায়ের ছাপ ঝরা পাতার ওপর পড়ে যায়, কিন্তু মনে হয়, এই ছাপগুলোও খুব শীঘ্রই মুছে যাবে, যেমন তাদের দেখা এবং হাসি মুছে যেতে পারে শহরের ব্যস্ততা এবং বাস্তবতার মাঝে।
হাওয়ার সঙ্গে কুয়াশার নরম আচ্ছাদন তাদের মনকে এক অদ্ভুত সংযমে রাখে। অনির্বাণ লক্ষ্য করে, ঐশীর চোখে আজ আগের মতো উজ্জ্বলতা আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে একটা দুর্বল আভাস দেখা যায়, যা বলে দিচ্ছে—সে জানে এই সুন্দর সময়ের সীমিততা। কথার মাঝখানে তাদের দুজনেই হঠাৎ থেমে যায়, শুধুই চারপাশের প্রকৃতি এবং নিজেদের অনুভূতির প্রতিফলনে ডুবে। শহরের ব্যস্ততা, কাজের চাপ, এবং ফিরতি যাত্রার চিন্তা—সবই এক অদৃশ্য ছায়ার মতো তাদের দুজনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অনির্বাণ অনুভব করেন, এই সম্পর্কের গভীরতা এবং ঐশীর প্রতি তার অনুভূতি এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যা কেবল এই পাহাড়ি কুয়াশার মধ্যে সংরক্ষিত। কিন্তু একই সঙ্গে তার মনে ভেসে ওঠে শঙ্কা—যদি তারা ফিরে যায়, শহরের জীবনে এই সম্পর্ক কি টিকবে, নাকি কেবল পাহাড়ের নিঃশব্দ মুহূর্তের একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে?
চূড়ান্ত সূর্যাস্তের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তাদের নীরবতা আরও ঘন হয়ে যায়। পাহাড়ি রাস্তায়, যেখানে কুয়াশা সবকিছুকে মৃদু করে ঢেকে রাখছে, অনির্বাণ এবং ঐশী একে অপরের হাতে হালকা স্পর্শ ছুঁয়ে সেই অজানা ভয় এবং আকাঙ্ক্ষার মিলন অনুভব করে। তারা জানে, এই মুহূর্তটি সীমিত, কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতা তাদের অনুভূতিকে আরও প্রগাঢ় করে। কুয়াশার আড়ালে, হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা পাতার শব্দ, দূরের পাহাড়ের রঙিন ছায়া, এবং মৃদু আলো—সবই যেন তাদের অনুভূতিকে এক অদৃশ্য সেতুর মাধ্যমে যুক্ত করছে। অনির্বাণ মনে করেন, হয়তো এই সম্পর্ক শুধুই পাহাড়ের কুয়াশায় মিলিয়ে যাবে, কিন্তু সেই মিলন তার মনে গভীর ছাপ রেখে যাবে, যা শহরের বাস্তবতায় ফিরে এসে তাকে চুপচাপ অনুসরণ করবে। দূরত্বের আভাস তাদের দুজনের হৃদয়কে একটি নরম কম্পনে ভরিয়ে দেয়, যা এই সফরের সৌন্দর্যকে আরও স্মরণীয় এবং অনির্বাণের মনে একটি অনন্ত টান তৈরি করে।
_
মল রোডের শেষ বিকেল যেন এক স্বপ্নময় ছবিতে পরিণত হয়েছে। আকাশে লালচে সূর্যাস্তের আলো ধীরে ধীরে শহরের ছাদ, দোকান, আর মানুষের মধ্যে মিশে যাচ্ছে, আর রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া সেই আলো যেন প্রতিটি পদক্ষেপকে মৃদু উষ্ণতা দিচ্ছে। অনির্বাণ এবং ঐশী হাঁটছে ধীরে ধীরে, চারপাশের ভিড়ের মধ্যে তাদের চোখ কেবল একে অপরের দিকে নিবদ্ধ। ঐশীর চোখে অজান্তেই জল জমে এসেছে, যা সূর্যাস্তের লাল আলোয় আরও উজ্জ্বল এবং নরম প্রতিফলন তৈরি করছে। অনির্বাণ অনুভব করেন, তার কণ্ঠে আজ দ্বিধা এবং আবেগের মিশ্রণ; সে জানে, কিছু কথার জন্য শব্দ যথেষ্ট নয়। রাস্তায় নেমে থাকা হালকা হাওয়া, আশেপাশের দোকানের হালকা আলো, এবং দূরে শোনা এক-দু’টি হাসি—সবই যেন তাদের এক নিরব, কিন্তু গভীর মুহূর্তে পরিবেষ্টিত করছে। এই বিকেল শুধু একটি বিদায় নয়, বরং এক অদৃশ্য সংযোগের সময়।
নীরবতার মাঝে, তারা একে অপরের দিকে তাকায়। অনির্বাণ দেখেন, ঐশীর চোখের জল শুধু আবেগ নয়, বরং একটি অদ্ভুত প্রত্যয়, যা বলছে—হ্যাঁ, সে এই সম্পর্ককে শূন্যে ফেলার জন্য নয়, বরং এটিকে ধরে রাখতে চাইছে। সে ধীরে ধীরে হাত বাড়ায়, অনির্বাণের হাত স্পর্শ করে, এবং সেই স্পর্শের মধ্যে তাদের সমস্ত অনুভূতি, আশঙ্কা, আনন্দ এবং গভীর টান প্রকাশ পায়। দু’জনেই জানে, ভ্রমণের শেষ হওয়া মানেই এই সম্পর্কের শেষ নয়; বরং শহরের ব্যস্ততা, দায়িত্ব এবং দূরত্ব তাদের বন্ধনকে নতুন রূপে পরীক্ষা করবে। এই প্রতিশ্রুতি শুধু কথার বিনিময় নয়, বরং হৃদয়ের গভীরতম স্তরে এক অদৃশ্য চুক্তি, যা পাহাড়ের কুয়াশার মধ্য দিয়ে তাদের একত্রিত করেছিল, তা শহরের আলো, শব্দ এবং বাস্তবতার মধ্যেও টিকে থাকবে।
সূর্যাস্তের লাল আলো ক্রমে ধূসর আকাশে মিশে যায়, আর মল রোডের ব্যস্ততা তাদের চারপাশে ফিরে আসে। কিন্তু অনির্বাণ এবং ঐশী একে অপরের দিকে তাকিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি মনে রাখে—যে দূরত্বই আসুক, যে সময়ই পেরিয়ে যাক, তাদের হৃদয়ের বন্ধন কখনও ম্লান হবে না। তারা ধীরে ধীরে হেঁটে শহরের হোড়ে-মোড়ে হারিয়ে যায়, কিন্তু মন থেকে তাদের সম্পর্কের ছাপ কখনও মুছে যাবে না। পাহাড়, কুয়াশা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত—সবই তাদের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকবে। অনির্বাণ অনুভব করেন, এই শেষ বিকেলের প্রতিশ্রুতি শুধু একটি মুহূর্ত নয়; এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে শহরের দূরত্বের মধ্যে থেকেও তারা একে অপরের অনুভূতি, ভালোবাসা এবং অদৃশ্য বন্ধনের সাথে সংযুক্ত থাকবে, এবং সেই সংযোগ তাদের জীবনকে আরও গভীর, আরও সুন্দর এবং আরও স্মরণীয় করে তুলবে।
_
সকালে, নরম কুয়াশার আড়ালে পাহাড়ি শহর ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। অনির্বাণ ট্রেনের সময়মতো স্টেশনে পৌঁছায়, আর প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে ভেসে ওঠে কুয়াশার মধ্যে ঐশীর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো—চা-বাগানের বেঞ্চে বসা, গুম্ফার মোমবাতির আলো, পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটার নীরব আনন্দ। তার হাতের আঙুলে সেই স্পর্শের স্মৃতি এখনও বেঁচে আছে, আর চোখের কোণে হালকা আর্দ্রতা ঝলমল করছে। ট্রেনের ভিড়ে ভেসে যাওয়া মানুষের মধ্যে তার মন যেন একাকীত্বের ছায়া পায়, কিন্তু সেই ছায়ার ভেতরও কুয়াশার কোমল স্মৃতি জ্বলছে। পাহাড়ের নরম বাতাস, ঝরা পাতা, পাহাড়ি রাস্তায় ধীরে ধীরে হাঁটা—সবই তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি এবং উচ্ছ্বাস জাগাচ্ছে, যা শহরের ব্যস্ততা এবং কোলাহলকে অদৃশ্য করে দিচ্ছে।
দূরত্বের অনুভূতি তাকে মৃদু বিষণ্ণ করে, কিন্তু একই সঙ্গে একটি শক্তি দেয়। সে বুঝতে পারে, এই সম্পর্ক শুধু পাহাড়ের কুয়াশায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং হৃদয়ের গভীরে স্থায়ী। ঐশীর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত—হাসি, কথোপকথন, নিঃশ্বাসের মিলন—সবই তার জীবনের এক অমর অংশ হয়ে গেছে। শহরের ট্রেনের হুইসেল, মানুষজনের পদচারণা, এবং ব্যস্ত রেলস্টেশন—সবকিছু যেন সে ভেসে যেতে দিচ্ছে না, কারণ তার মনে আছে ঐশীর চোখের উজ্জ্বলতা, কুয়াশার আড়ালে হাতের স্পর্শ এবং পাহাড়ি পথের নিঃশব্দ বন্ধন। অনির্বাণ উপলব্ধি করেন, যে দূরত্ব আসুক না কেন, তারা এখনও একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত, কেবল ভৌগোলিকভাবে নয়, মানসিক এবং হৃদয়গতভাবে।
কলকাতায় ফেরার পর শহরের ব্যস্ততা, অফিসের কাজ, এবং রুটিন জীবনের চাপ তাকে ঘিরে ধরে, কিন্তু তার মন ধীরে ধীরে সেই কুয়াশার স্মৃতি থেকে শক্তি পায়। ঐশী পাহাড়ে থাকলেও, তাদের হৃদয়ের বন্ধন প্রতিটি দিন আরও দৃঢ় হচ্ছে। অনির্বাণ ভাবতে থাকে, এই কুয়াশার মধ্যে শুরু হওয়া প্রেম এবার বাস্তব জীবনে এক নতুন রূপ নেবে—শহরের ব্যস্ততা, দূরত্ব, এবং প্রতিদিনের জীবনের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও তারা একে অপরের অনুভূতি, ভালোবাসা এবং স্মৃতিকে ধরে রাখবে। প্রতিটি ফোন কল, মেসেজ, এবং ছোট্ট মুহূর্তের বিনিময় তাদের বন্ধনকে শক্তিশালী করবে, যেন কুয়াশার আড়ালে হাঁটানো সেই পথ আবারও জীবনে ফিরে আসে। পাহাড়ি রাস্তায় হাত ধরার সেই অদ্ভুত স্পর্শ, মোমবাতির আলো, সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত—সবই তাদের মনকে একটি নতুন যাত্রার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রেম শুধু স্মৃতি নয়, বাস্তব এবং স্থায়ী হয়ে ওঠে।
*****