Bangla - ভ্রমণ

পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ: ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব ঘেরা ভ্রমণ–ডায়েরি

Spread the love

অরুণোদয় দত্ত


ঢাকার ব্যস্ত রেলস্টেশনে তখন সকাল গড়িয়ে আসছে। কোলাহলের ভেতরেও চারজন মানুষ যেন নিজেদের ছোট্ট এক পৃথিবীতে ডুবে আছে। অরিন্দম—ইতিহাসের অধ্যাপক—চোখে চশমা, হাতে একটি পুরনো নোটবুক, যেখানে সে বছরের পর বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর সম্পর্কে নোট লিখে রেখেছে। তার মধ্যে এক ধরনের দৃঢ়তা, যা ছাত্রদের সামনে লেকচার দেওয়ার সময়ের মতোই নির্ভীক। পাশে বসে আছে অনন্যা, পিঠে ঝোলানো কালো ব্যাগে রাখা ক্যামেরার লেন্স উঁকি দিচ্ছে। সে বারবার আশেপাশের দৃশ্যগুলো দেখছে, যেন প্রতিটি মুহূর্তকে ফ্রেমে ধরে রাখতে চায়। সায়ন একটু গম্ভীর চেহারায় টিকিট পরীক্ষা করে, আরেকবার ব্যাগের ভেতরের গবেষণার নথি গুছিয়ে রাখে। তার কাছে এই ভ্রমণ নিছক আনন্দ নয়, বরং ইতিহাসের এক বাস্তব ক্লাস। রিমা অন্যদিকে জানালার পাশে বসে, হাতে কলম আর ডায়েরি। সে লিখছে, “আজ আমাদের যাত্রা শুরু হলো। হয়তো এই ভ্রমণ শুধু ইট-পাথরের ধ্বংসাবশেষ দেখার নয়, বরং নিজেকে জানার এক অভিযানও।” বাইরে প্ল্যাটফর্মে বিক্রেতাদের ডাক, যাত্রীদের ব্যস্ততা, ট্রেনের সিটি বাজা—সব মিলিয়ে যেন এক বিশেষ পরিবেশ তৈরি হয়, যেখানে প্রত্যেকেই অনুভব করছে যে আজকের দিনটা সাধারণ কোনো দিন নয়।

ট্রেন যখন ধীরে ধীরে গতি নেয়, শহরের কোলাহল পেছনে পড়ে যায়। জানালা দিয়ে ঢুকে আসা বাতাসে ধুলো আর ঘাসের মিশ্র গন্ধ, দূরের গ্রাম, পুকুর, সরু মাটির রাস্তা যেন চোখের সামনে এক নতুন পৃথিবী উন্মোচন করে। অরিন্দম নীরবে বলতে থাকে, “পাহাড়পুর শুধু ইটের গাঁথুনি নয়, ওটা একসময় ছিল জ্ঞানের সমুদ্র। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসত পড়াশোনা করতে।” অনন্যা ততক্ষণে ক্যামেরা বের করে খোলা মাঠ, কুয়াশায় ঢাকা নদীর ছবি তুলতে ব্যস্ত। সে বলে ওঠে, “এই আলোটা দেখো, যেন প্রতিটি দৃশ্য অতীতের কোনো স্মৃতি হয়ে উঠছে।” সায়ন তখন অরিন্দমের কথার সঙ্গেই যুক্ত হয়—“ঠিক বলছেন, স্যার। পাহাড়পুরের মহাবিহার ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর একটি। এই ভ্রমণটা আমার থিসিসের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হবে।” রিমা তাদের কথোপকথন শুনে ডায়েরিতে লিখে রাখে—‘ইতিহাস শুধু পাঠ্যপুস্তকে আটকে থাকে না, কখনো কখনো ট্রেনের জানালার কাচে ভেসে ওঠা দৃশ্যেও ইতিহাসের ছায়া পাওয়া যায়।’ ট্রেনের ভেতরে এভাবেই তাদের যাত্রার প্রথম সকাল কেটে যায়, আর প্রত্যেকেই অনুভব করে যে সামনে অপেক্ষা করছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

বিকেলের দিকে ট্রেন যখন উত্তরবঙ্গের পথে পৌঁছায়, আকাশের রঙ বদলে যেতে শুরু করে। জানালার বাইরে ধানক্ষেত সোনালি হয়ে উঠছে, কোথাও দেখা যায় বক উড়ছে, কোথাও বা নদীর ঘাটে জেলেদের ব্যস্ততা। চারজনের ভেতর এক ধরনের নীরবতা নেমে আসে—যেন প্রত্যেকেই আপন মনে ভবিষ্যতের সেই ধ্বংসাবশেষের ছবি কল্পনায় আঁকছে। অরিন্দম তার নোটবুকের পুরনো পাতায় চোখ বুলিয়ে নেয়, মনে হয় যেন সে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করছে বর্তমান থেকে অতীতে। অনন্যা নিজের লেন্স পাল্টে সূর্যাস্তের আলো ধরে রাখে, তার চোখে এক ধরনের উচ্ছ্বাস যা শুধু একজন শিল্পীর চোখেই ধরা পড়ে। সায়ন হিসেব কষে দেখে, কত সময় লাগবে ভ্রমণ শেষ করতে, কতখানি জায়গা কাভার করতে হবে, তার মনে শুধু তথ্য আর প্রমাণ। রিমা এদিকে ভাবছে, এই যাত্রা হয়তো শুধু একাডেমিক ভ্রমণ নয়, বরং জীবনের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া কল্পনা, স্বপ্ন আর স্মৃতির সাথে পুনরায় দেখা হওয়ার পথ। ট্রেনের শব্দ ধীরে ধীরে যেন এক সুরে পরিণত হয়, যা প্রতিটি যাত্রীর হৃদয়ের ভেতর বাজতে থাকে। আর সেই সুরের ভেতর দিয়ে পাহাড়পুরের দিকে এগিয়ে চলা চার বন্ধু অনুভব করে—যাত্রার সূচনা মানে শুধু গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, বরং প্রতিটি মুহূর্তে ইতিহাস, শিল্প আর জীবনের নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া।

ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি, আকাশে হালকা নীল আর ফ্যাকাশে গোলাপি রঙের মিশ্র আভা। ট্রেন থেকে নেমে তারা গাড়িতে চেপে পাহাড়পুরের দিকে এগোতে থাকে। রাস্তার দু’পাশে কুয়াশায় ঢাকা ক্ষেত, কোথাও কোথাও খড়ের গাদা, গাছের ডালে ঝুলে থাকা শিশিরবিন্দু যেন ভোরের আলোয় ক্ষুদ্র মুক্তার মতো ঝলমল করছে। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে অনন্যা অনুভব করে, সময় যেন ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই দূরে কুয়াশার ভেতর থেকে এক বিশালাকার ইটের কাঠামো ভেসে ওঠে—পাহাড়পুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ। প্রথম দেখা মাত্রই বুকের ভেতর হাহাকার জাগে, যেন সে কোনো হারানো সভ্যতার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যা হাতের ক্যামেরাটা তাড়াতাড়ি তোলে, মুহূর্তের আলো, কুয়াশার স্তর আর বিশাল কাঠামোর রহস্যময় ছায়া বন্দী করে রাখে। ছবিগুলো তোলার সময় তার মনে হয়, ক্যামেরা শুধু ছবি ধরে রাখছে না, বরং হাজার বছর আগের প্রার্থনার শব্দ, পাঠশালার আওয়াজ আর ভিক্ষুদের পদচারণার ছায়াও ধরে রাখছে। অন্যদিকে রিমা গাড়ি থেকে নামার পর মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন সময়ের পর্দা হঠাৎ সরে গিয়ে প্রাচীন যুগের দ্বার তার সামনে খুলে গেছে। সে কেবল শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ধ্বংসাবশেষের দিকে, আর তার চোখে জল টলমল করতে থাকে—এটা নিছক একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস।

চারজন যখন প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে, তখন সূর্যের প্রথম রশ্মি কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে আসে। বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে ইটের ধ্বংসস্তূপ, ভগ্ন প্রাচীর আর টেরাকোটা ফলকের খণ্ডচিত্র যেন নিস্তব্ধতার ভেতরও প্রাণের সঞ্চার করছে। অরিন্দম ধীরে ধীরে চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে ওঠে, “ভাবো তো, আজ থেকে এক হাজার বছর আগে এখানে কী প্রাণবন্ত দৃশ্য ছিল! শিক্ষকরা ছাত্রদের পড়াচ্ছে, চারপাশে পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টানো শব্দ, ধূপের গন্ধ আর প্রার্থনার ধ্বনি ভেসে আসছে।” তার কণ্ঠে এক ধরনের আবেগ মিশ্রিত উত্তেজনা, যেন সে নিজেই অতীতের সেই সময়টিতে ফিরে গেছে। সায়ন এদিকে খুব মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি গঠন লক্ষ্য করছে—ইটের আকার, দেয়ালের গাঁথুনি, প্রাচীন স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য। সে নোটবুকে খুঁটিনাটি লিখে রাখছে, মাপজোখ করছে, মনে মনে মিলিয়ে নিচ্ছে গবেষণার তথ্যের সাথে। কিন্তু তার মনেও একটা অদ্ভুত আবেশ কাজ করছে—এই ভগ্নাবশেষ কেবল গবেষণার বিষয় নয়, বরং এক বিশাল সভ্যতার প্রতিচ্ছবি। অনন্যা তখনও ক্যামেরা হাতে নানা দিক থেকে ছবি তুলছে, সূর্যের আলো কিভাবে ইটের ওপর পড়ে ছায়ার নকশা তৈরি করছে, তা সে বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে। রিমা মৃদু কণ্ঠে বলে ওঠে, “এ যেন সময়ের থেমে যাওয়া মুহূর্ত। ইটগুলো শুধু দেয়াল নয়, যেন মানুষের স্বপ্ন, সাধনা আর প্রার্থনার জমাট রূপ।” বাকিরা থেমে যায়, একবার তাকিয়ে দেখে তাকে—রিমার চোখে যে মুগ্ধতা, তা কোনো গবেষণার ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।

ধীরে ধীরে তারা প্রাঙ্গণের ভেতরে হাঁটতে থাকে। চারদিকে ভগ্নস্তূপের ফাঁক দিয়ে লতাগুল্ম জন্মেছে, কোথাও কোথাও পাখির ডাক শোনা যায়। এই নিস্তব্ধতা যেন কোনো ভৌতিক শূন্যতা নয়, বরং শান্তির গভীর আহ্বান। হঠাৎই আব্দুল কাদির, স্থানীয় গাইড, তাদের দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখে অভ্যস্ত দৃষ্টি, মুখে উষ্ণ হাসি। সে বলে, “স্বাগতম পাহাড়পুরে। এখানে প্রতিটি ইটের গায়ে লুকিয়ে আছে অগণিত গল্প।” তার কণ্ঠে এমন ভরসা যে মনে হয় সত্যিই দেয়ালগুলো ফিসফিস করে কথা বলছে। চারজন একে অপরের দিকে তাকায়, যেন তারা বুঝতে পারছে—আজকের দিনটা শুধু একটি ধ্বংসাবশেষ দেখা নয়, বরং এক নতুন অভিজ্ঞতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো। সূর্যের আলো ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে পুরো প্রাঙ্গণে, আর ধ্বংসাবশেষ যেন ধীরে ধীরে জেগে ওঠে—ইটের ভেতর থেকে ভেসে আসে প্রার্থনার প্রতিধ্বনি, বিদ্যার সুর আর অতীতের হাজারো অমলিন স্মৃতি। প্রথম দেখাতেই পাহাড়পুর তাদের হৃদয়ে যে আলো জ্বেলে দেয়, তা চিরকাল বেঁচে থাকবে, ঠিক যেমন বেঁচে আছে ভগ্নাবশেষের প্রতিটি ইটে লুকানো ইতিহাস।

সকালের আলো যখন ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই ধ্বংসাবশেষের প্রাঙ্গণে এগিয়ে এলেন স্থানীয় গাইড আব্দুল কাদির। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি, গায়ের রঙ রোদেপোড়া, মুখে একধরনের আন্তরিক হাসি। মাথায় সাদা টুপি, পরনে সাদামাটা পাঞ্জাবি-পায়জামা, হাতে একটি বাঁশের লাঠি। তার হাঁটাচলায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট, যেন এই ভগ্নাবশেষই তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয়। অরিন্দম, অনন্যা, সায়ন ও রিমাকে দেখে তিনি হাত জোড় করে অভিবাদন জানালেন—“স্বাগতম আপনাদের পাহাড়পুরে। এই জায়গাটা শুধু মাটির ইট নয়, বরং একসময়ের স্বপ্ন আর সাধনার প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি ইট ইতিহাসের সাক্ষী।” তার কণ্ঠে ছিল মায়া আর গর্বের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। চারজন ভ্রমণকারীর চোখে তখনও প্রথম দেখার বিস্ময় লেগে আছে, আর আব্দুল কাদির যেন সেই বিস্ময়কে আরও গভীর করে তুললেন। রিমা নীরবে ভাবতে থাকে—এ মানুষটা যেন শুধু গাইড নন, বরং এই ধ্বংসাবশেষের জীবন্ত রক্ষক, যে তার বংশের গল্পের সাথে এই প্রাচীন মহাবিহারের কাহিনি মিশিয়ে বেঁচে আছেন।

আব্দুল কাদির তাদের নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি দেখালেন ভগ্ন প্রাচীর, উঁচু টিলা আর টেরাকোটা ফলকের চিহ্নিত অংশ। প্রতিটি স্থানের সঙ্গে যুক্ত করলেন একেকটি লোককথা। “আমার দাদাজান বলতেন,” তিনি শুরু করলেন, “পূর্ণিমার রাতে এখানে কখনো কখনো ভিক্ষুদের ছায়া দেখা যায়। তারা নাকি এখনো প্রার্থনা করে বেড়ায়। অনেক রাতের পাহারাদারও বলে, অদ্ভুত ঘণ্টাধ্বনি কানে আসে।” সায়ন হেসে ফেলে, যুক্তিবাদী কণ্ঠে বলে—“এগুলো তো লোককথা, কোনো প্রমাণ নেই।” আব্দুল কাদির শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, “লোককথায় সবসময় প্রমাণ মেলে না, কিন্তু এই মাটির সঙ্গে যাদের জীবন কেটে যায়, তাদের কণ্ঠে যে বিশ্বাস জন্মায়, সেটাও ইতিহাসের অংশ।” অরিন্দম তার কথায় গভীরভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তিনি বুঝতে পারলেন, লোককথা আসলে ইতিহাসের অন্তর্গত আবেগ, যা লিখিত নথির বাইরে থেকেও একটি সময়কে জীবন্ত করে রাখে। অনন্যা এদিকে ক্যামেরায় বন্দী করছিলেন কাদিরের মুখভঙ্গি, তার কণ্ঠের উচ্ছ্বাস, আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল ভগ্নাবশেষ। প্রতিটি ক্লিকেই যেন ধরা পড়ছিল মানুষের সাথে ইতিহাসের সম্পর্কের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন।

আব্দুল কাদির হেঁটে নিয়ে গেলেন একটি বিশেষ কোণের দিকে, যেখানে ভগ্নাবশেষের নিচে খুঁজে পাওয়া গেছে কিছু প্রত্নবস্তু। তিনি বললেন, “এই জায়গায় আগে নাকি এক বিশাল পাঠশালা ছিল। আমার পূর্বপুরুষরা মাঠে কাজ করতে গিয়ে অনেকবার ভগ্ন পাণ্ডুলিপির টুকরো খুঁজে পেয়েছে। তখন তারা বুঝতে পারেনি এগুলোর গুরুত্ব কী। কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকেই শুনেছি, এই মাটি শুধু ফসল দেয় না, ইতিহাসও জন্ম দেয়।” তার চোখ চকচক করে ওঠে, যেন নিজের বংশগৌরবের গল্প শোনাচ্ছেন। রিমা ডায়েরিতে লিখে রাখে—‘লোককথা আর ইতিহাস যখন মিশে যায়, তখন ধ্বংসাবশেষ কেবল নিস্তব্ধ থাকে না, বরং জীবন্ত হয়ে ওঠে।’ সায়ন আবারও দেয়ালের গাঁথুনি মাপজোখ করছে, তবু কাদিরের প্রতিটি কথায় কানও দিচ্ছে, যেন গবেষণা আর লোককথা একসাথে খুঁজে পেতে চায়। অরিন্দম বললেন, “আপনি জানেন, ইতিহাসের বই অনেক কিছু শেখায়, কিন্তু ইতিহাসের আসল সুর বেঁচে থাকে মানুষের মুখের গল্পে।” আব্দুল কাদির মৃদু হেসে জবাব দিলেন, “তাহলে তো আপনারা সঠিক জায়গায় এসেছেন। এখানে প্রতিটি ইট শুধু নিদর্শন নয়, বরং মানুষের বেঁচে থাকার কাহিনি।” সেই মুহূর্তে চার ভ্রমণকারী অনুভব করলেন—তাদের যাত্রার মূল সঙ্গী হয়ে উঠেছে এই গাইড, যার কণ্ঠে বেঁচে আছে অতীতের প্রতিধ্বনি। পাহাড়পুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ তাদের চোখে যতটা বাস্তব, আব্দুল কাদিরের গল্পে তা আরও রহস্যময় ও হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠল।

মহাবিহারের বিশাল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার মুহূর্তে চারজন ভ্রমণকারীর মনে হল, তারা যেন এক অদৃশ্য দরজা পেরিয়ে অন্য জগতে এসে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে ভগ্নপ্রাচীর, ভাঙা ইটের স্তূপ, আর খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাস—সবকিছু মিলিয়ে নেমে এসেছে এক গভীর নীরবতা। এ নীরবতা কোনো শূন্যতার নয়, বরং এমন এক নীরবতা, যেখানে প্রতিটি ইটের ভেতর লুকিয়ে আছে হাজার বছরের প্রতিধ্বনি। সায়ন সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যাগ থেকে মাপজোখের সরঞ্জাম বের করে দেয়ালের গাঁথুনি, ইটের দৈর্ঘ্য, প্রাচীরের পুরুত্ব সবকিছু নোট করতে শুরু করল। তার চোখে তখন গবেষকের দৃঢ় মনোযোগ, সে মুগ্ধ হয়ে বলল, “দেখুন, এই ইটগুলোর গাঁথুনি সাধারণ নয়, এগুলো নির্দিষ্ট অনুপাতে তৈরি। হয়তো এই অনুপাতে ছিল স্থাপত্যের নিখুঁত ভারসাম্য, যা শত শত বছর ধরে এই কাঠামোকে টিকিয়ে রেখেছিল।” অরিন্দম পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলেন, তার মনে ভেসে উঠল কল্পনা—হাজার বছর আগে এই বিশাল প্রাঙ্গণে শত শত ছাত্রছাত্রী বসে আছে, হাতে পাণ্ডুলিপি, সামনে শিক্ষক, বাতাসে ধূপের গন্ধ, আর মৃদু পাঠের ধ্বনি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। তার মনে হল, এই নিস্তব্ধতা আসলে এক অদৃশ্য পাঠশালা, যা এখনো শিক্ষা দিচ্ছে—কেবল পাঠ্য নয়, সময়কে উপলব্ধি করার শিক্ষা।

অনন্যা এদিকে ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তার চোখে ধরা পড়ছে শুধু দৃশ্য নয়, সেই দৃশ্যের ভেতর লুকানো আবেগও। সে লক্ষ্য করছে, কিভাবে ভগ্ন প্রাচীরের ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকে ইটের গায়ে একেকটা নকশা তৈরি করছে। প্রতিটি ফ্রেমে যেন এক অদৃশ্য গল্প ভেসে উঠছে—কোথাও হয়তো শিক্ষক ছাত্রকে নির্দেশ দিচ্ছে, কোথাও ভিক্ষুরা ধ্যান করছে, কোথাও বা ছাত্ররা একে অপরের সাথে আলোচনা করছে। অনন্যা ফিসফিস করে বলে উঠল, “এই নীরবতাকে ছবিতে বন্দী করা যায় না, কারণ এর শব্দ শোনা যায় শুধু হৃদয়ের ভেতর।” রিমা তখন সেই নীরবতায় ডুবে গিয়ে নিজের ডায়েরিতে লিখছে—‘ইটগুলো নিস্তব্ধ, অথচ মনে হচ্ছে তারা চিৎকার করে বলছে: আমরা ইতিহাসের সাক্ষী, আমরা সময়ের ভেতরে অমর হয়ে আছি।’ সে আরও লিখল, ‘এই নীরবতা ভয়ংকর নয়, বরং শান্তির, এমন এক শান্তি যা মানুষকে নিজের ভেতরে ডুবিয়ে দেয়।’ অরিন্দম তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিকই বলেছো, রিমা। এখানে যে নীরবতা, সেটা আসলে জ্ঞানের নীরবতা, প্রার্থনার নীরবতা।” সায়ন তখনও দেয়ালের গঠন পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত, কিন্তু তার চোখেও একরকম আবেগ ফুটে উঠছে, যা সে প্রকাশ করতে চায় না। গবেষণার তথ্যের পেছনেও সে বুঝতে পারছে, এখানে দাঁড়িয়ে মানুষ কেবল বিজ্ঞানী হয় না, হয়ে ওঠে সময়ের এক অনুচ্চারিত অংশ।

তারা ধীরে ধীরে প্রাঙ্গণের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। চারপাশের বাতাসে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য মিশে আছে, যা তাদের নিঃশ্বাসে প্রবেশ করে যেন মনকে ভারী করে তোলে। অরিন্দম দাঁড়িয়ে এক জায়গায় বললেন, “ভাবো তো, এখানেই হয়তো একসময় হাজার হাজার ছাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্য এসে বসত। তাদের হাসি, প্রশ্ন, কণ্ঠস্বর এখনো দেয়ালের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।” তার চোখে ভাসছে অতীতের সেই উজ্জ্বল দৃশ্য। সায়ন এবার থেমে বলল, “শুধু ইতিহাস নয়, এ জায়গাটা আসলে স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। এ ধরনের গঠন সেই সময়ে কতটা দক্ষ পরিকল্পনা আর জ্ঞানের প্রতিফলন ছিল, তা ভাবতেই অবাক লাগে।” অনন্যা তাদের দু’জনের কথোপকথন শুনতে শুনতে পেছনের আকাশে উড়ে যাওয়া কয়েকটি পাখির ছবি তোলে। তার কাছে মনে হয়, এই পাখিগুলো যেন অতীত আর বর্তমানের সেতুবন্ধন। রিমা মৃদু স্বরে বলে উঠল, “এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আমি এখনো সেই যুগের এক ছাত্রী, হাতে তালপাতার পাতা, মন ভরে যাচ্ছে জ্ঞানের আলোয়।” চারজনই তখন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। চারদিকে কেবল বাতাসের শব্দ আর পাখির ডাক। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতর তারা সবাই যেন শুনতে পেল হাজার বছরের আগের পাঠশালার আওয়াজ—যেন মহাবিহারের নীরবতা কেবল নীরব নয়, বরং ইতিহাসের এক গভীর, চিরন্তন গান।

প্রাঙ্গণের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছাল সেই স্থানে, যেখানে দেয়ালের গায়ে এখনো দৃশ্যমান টেরাকোটা ফলকের খণ্ডচিত্র। ইটের ওপর খোদাই করা সেই শিল্পকর্মগুলি সময়ের আঘাতে অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে, কোথাও ভাঙা, কোথাও ঝাপসা, তবুও তাদের ভেতরে লুকানো শিল্পীসত্তার জৌলুস অটুট। অনন্যা ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে প্রতিটি ফলককে একে একে ফ্রেমে বন্দী করতে শুরু করল। তার চোখে বিস্ময়ের ছাপ, যেন প্রতিটি ছবির ভেতরে সে শুধু নিদর্শন নয়, জীবন্ত মানুষের গল্প খুঁজে পাচ্ছে। সূর্যের আলো একেকটি ফলকের ওপর পড়ে এক অদ্ভুত ছায়া তৈরি করছিল, আর সেই ছায়া ছবিতে ধরা দিচ্ছিল নতুন এক মাত্রা হিসেবে। অনন্যা ফিসফিস করে বলল, “এগুলো শুধু অলংকরণ নয়, এ যেন সেই সময়ের জীবনের প্রতিচ্ছবি। দেখো, কৃষকের মুখে ঘামের রেখা, শিকারির হাতে ধনুক, সঙ্গীতশিল্পীর হাতে বীণা, সবকিছু এতটাই জীবন্ত যে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তারা আমাদের সামনে হেঁটে আসবে।” অরিন্দম তার কণ্ঠে উত্তেজনা টের পেলেন, তিনি বললেন, “ঠিকই বলেছো। শিল্প কখনো নিছক সৌন্দর্য নয়, এটি সময়ের দলিল। এই টেরাকোটা ফলকগুলো প্রমাণ করছে, সেই যুগের মানুষ শুধু জ্ঞানচর্চাতেই নিমগ্ন ছিল না, বরং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনও কত সমৃদ্ধ ছিল।” সায়ন পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে নোট করছে, কোন ফলকে কোন দৃশ্য ফুটে উঠেছে, তার তারিখ অনুমান করছে, আর মাঝে মাঝে মাথা তুলে তাকাচ্ছে শিল্পের গভীরতর অর্থ বোঝার জন্য।

রিমা এদিকে ডায়েরি হাতে দাঁড়িয়ে, কিন্তু তার চোখ টেরাকোটা ফলকের ভেতর লুকানো গল্পের ভুবনে। সে কল্পনায় ডুবে দেখে—সেই সময়ের এক কৃষক মাঠে নেমে ধান কাটছে, সূর্যের আলোয় ঘামে ভিজে যাচ্ছে তার শরীর, পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্ত্রী ও সন্তান। আবার অন্য এক ফলকে সে দেখে শিকারি জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে বসে আছে, ধনুক টেনে ধরেছে, আর চারপাশের গাছপালায় যেন প্রাণের স্পন্দন লুকিয়ে আছে। সঙ্গীতশিল্পীর খোদাই তাকে যেন নিয়ে যায় কোনো এক প্রাচীন আসরে, যেখানে গম্ভীর সুরে বীণা বাজছে, পাশে বসে ভিক্ষুরা ধ্যান করছে। রিমা ডায়েরিতে লিখে যায়, ‘এই ফলকগুলো আমার চোখের সামনে শুধু ছবি নয়, বরং জীবন্ত দৃশ্য হয়ে উঠছে। সময়ের দেয়াল ভেদ করে আমি যেন দেখতে পাচ্ছি সেই প্রাচীন জীবনযাত্রা—কত সহজ, কত স্বাভাবিক, অথচ কত শিল্পসুলভ।’ অনন্যা তখন আরেকটি ছবি তুলতে গিয়ে বলে উঠল, “দেখো, শিল্পী কী নিখুঁতভাবে মানুষের আবেগ ফুটিয়ে তুলেছে! এমনকি একটি পশুর চোখেও যেন অনুভূতির ছাপ আছে।” সায়ন একটু হেসে উত্তর দিল, “এই কারণেই তো ইতিহাস শুধু রাজাদের গল্প নয়, সাধারণ মানুষের জীবনকেও ধরে রাখে। আর এই ফলকগুলোই আমাদের সেই জীবন দেখাচ্ছে।” আব্দুল কাদিরও যোগ করলেন, “আমার পূর্বপুরুষরা বলত, এখানে প্রতিটি ইটের গায়ে মানুষের নিশ্বাস লেগে আছে। এই শিল্পগুলো তার প্রমাণ।”

তারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিটি ফলকের সামনে নিজেদের মতো করে ভেসে গেল অতীতে। একসময় অরিন্দম বললেন, “ভাবো তো, এই শিল্পকর্মগুলো তৈরির জন্য কতজন শিল্পী, কতজন কারিগর কত বছর শ্রম দিয়েছে। হয়তো তারা ভাবত না যে একদিন হাজার বছর পরে আমরা এসে এগুলো দেখব। তবুও তারা তাদের সময়, তাদের জীবনকে এই ইটের গায়ে খোদাই করে রেখে গেছে।” রিমা উত্তর দিল, “শিল্পের আসল শক্তি এখানেই—এটা সময়কে অতিক্রম করে জীবনের গল্প বলে।” অনন্যা তখন ক্যামেরা নামিয়ে চোখে হাত দিয়ে একবার দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল। তার মনে হল, যেন সেই কৃষক, শিকারি, সঙ্গীতশিল্পী আর ভিক্ষুরা সত্যিই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে—শুধু ইটের ভেতরে নয়, বরং বাতাসে, আলোয়, চারপাশের নিস্তব্ধতায়। সায়ন এই আবেগঘন মুহূর্তেও গবেষণার ভাষায় বলল, “এগুলো আমাদের সামাজিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ধর্ম, শিক্ষা আর সংস্কৃতির পাশাপাশি এগুলো প্রমাণ করছে অর্থনীতি, কৃষি, বিনোদন—সবকিছু মিলিয়েই গড়ে উঠেছিল সেই সভ্যতা।” আব্দুল কাদির চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিলেন, তারপর হেসে বললেন, “দেখলেন তো? এই ভগ্নাবশেষ আসলে মৃত নয়। শিল্পের ছাপ আজও মানুষকে কথা বলতে বাধ্য করে।” চারজনই তার কথায় মুগ্ধ হল। তারা বুঝতে পারল, পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ কেবল প্রাচীন ইট-পাথরের স্তূপ নয়, বরং শিল্পের ভেতর দিয়ে সময়ের এক অমর সেতু, যা অতীত ও বর্তমানকে যুক্ত করে রেখেছে।

পাহাড়পুর মহাবিহারের গভীর নীরবতায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আব্দুল কাদির হঠাৎ কণ্ঠ নিচু করে বলল, “আপনারা জানেন, এখানে নাকি পূর্ণিমার রাতে ভিক্ষুর ছায়া দেখা যায়।” বাক্যটি উচ্চারণের সাথে সাথেই অনন্যার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তার ক্যামেরা হাতে থাকা সত্ত্বেও মনে হলো যেন এক মুহূর্তের জন্য আঙুল শক্ত হয়ে গেছে, ছবির চেয়ে সেই গল্পের ভেতরে প্রবেশ করাই জরুরি। রিমার মনে হলো বাতাস যেন আচমকা ভারী হয়ে উঠেছে, চারপাশের প্রাচীন ইটের দেয়ালগুলোতে সেই গল্পের প্রতিধ্বনি বাজছে। অরিন্দম গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন, কারণ তিনি জানেন লোককথার ভেতরেই অনেক সময় লুকিয়ে থাকে অজানা ইতিহাসের ইঙ্গিত। সায়ন অবশ্য মৃদু হেসে বলল, “ভিক্ষুর ছায়া মানে আসলে মানুষের কল্পনা। পূর্ণিমার আলোয় ধ্বংসাবশেষের দেয়ালে যে ছায়া তৈরি হয়, সেটাই হয়তো মানুষ অতিরিক্ত কল্পনায় ভিক্ষুর আকারে দেখে।” কিন্তু তার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা আব্দুল কাদিরকে দমাতে পারল না। তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, “আমি নিজে দেখিনি, কিন্তু আমার বাবা শপথ করে বলতেন, তিনি এক পূর্ণিমার রাতে এখানে দাঁড়িয়ে দেখেছেন—সাদা বস্ত্র পরা এক ভিক্ষুর অবয়ব ধীরে ধীরে প্রাচীর বরাবর অদৃশ্য হয়ে গেল।” কথাটি বলার সাথে সাথে রিমা নিজের চোখে সেই দৃশ্য কল্পনা করল—চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা নিস্তব্ধ প্রাঙ্গণে এক ভিক্ষুর ছায়া হেঁটে যাচ্ছে, বাতাসে বেজে উঠছে অজানা মন্ত্রের সুর।

লোককথার এই বর্ণনায় পুরো দলটি মুগ্ধ হলেও সায়নের কণ্ঠে রয়ে গেল যুক্তির দৃঢ়তা। সে বলল, “লোককথা ইতিহাসের অংশ নয়, বরং মানুষের মানসিক প্রতিফলন। দীর্ঘদিন ধরে এই জায়গা নিয়ে মানুষের ভক্তি, ভয় আর কল্পনা মিশে গিয়ে এই ধরনের গল্প তৈরি করেছে।” অরিন্দম মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “তুমি ভুল বলছ না। তবে মনে রেখো, ইতিহাস শুধু ইট-পাথর বা দলিল দিয়ে গঠিত হয় না। মানুষের স্মৃতি, তাদের কাহিনি, বিশ্বাস—সব মিলিয়েই ইতিহাস পূর্ণতা পায়। এই লোককথাগুলো হয়তো সঠিক নয়, কিন্তু এগুলোই বোঝায় এই জায়গার প্রতি মানুষের আবেগ কেমন।” অনন্যা তখন ক্যামেরা দিয়ে প্রাচীরের উপর দিয়ে ধরা আলো-ছায়ার খেলা বন্দী করছিল। সে ফিসফিস করে বলল, “ক্যামেরায় শুধু ইটের ছায়া ধরা পড়ছে, কিন্তু আমার চোখে মনে হচ্ছে সত্যিই কারো উপস্থিতি আছে। হয়তো সেটাই শিল্প আর বাস্তবতার পার্থক্য।” রিমা তখন তার ডায়েরিতে লিখল—‘লোককথা আমাদের চোখের সামনে এক অদৃশ্য পর্দা ফেলে দেয়, আর সেই পর্দার ওপারে দাঁড়িয়ে যায় অতীত। পূর্ণিমার রাতে ভিক্ষুর ছায়া হোক সত্য বা কল্পনা, তাতে কী আসে যায়? মূল কথা, সেই গল্পের ভেতর দিয়ে আমরা অতীতকে অনুভব করতে পারি।’ আব্দুল কাদিরও যোগ করল, “আমাদের গ্রামে আজও অনেকে বিশ্বাস করে, পূর্ণিমার রাতে এখানে গেলে অদ্ভুত এক প্রশান্তি পাওয়া যায়, যেন ভিক্ষুরা এখনো ধ্যান করছে।” তার গলায় এমন এক আস্থার সুর ছিল, যা শুনে মুহূর্তের জন্য সবার মনে সন্দেহও যেন দূরে সরে গেল।

গল্প আর বাস্তবের এই মিশ্রণেই তারা উপলব্ধি করল, পাহাড়পুর শুধু ইটের স্তূপ নয়, বরং স্মৃতি, আবেগ আর কল্পনার এক বিস্ময়কর জগৎ। আব্দুল কাদিরের কিংবদন্তি শোনার পর প্রাঙ্গণের নীরবতাও যেন ভিন্ন এক অর্থ পেল। চাঁদের আলো তখনো ওঠেনি, কিন্তু বিকেলের শেষ আলোয় ভগ্নাবশেষের দেয়ালে যে ছায়া পড়ছিল, সেটাই মনে হচ্ছিল ভিক্ষুর চলার প্রতিচ্ছবি। সায়ন মনের ভেতরে যুক্তির বাঁধন টানতে চাইছিল, কিন্তু তার নিজেরও অদ্ভুত এক শিহরণ হচ্ছিল, যা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারল না। অরিন্দম শান্ত কণ্ঠে বললেন, “লোককথা ইতিহাস নয়, কিন্তু ইতিহাসকে রঙিন করে তোলে। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, এই ধরনের গল্প ততদিন চলতে থাকবে।” অনন্যা তার ক্যামেরার স্ক্রিনে ছবি দেখে মৃদু হেসে বলল, “ছবিতে হয়তো ছায়া ভিক্ষুর মতো ধরা পড়েনি, কিন্তু আমার মনে হয় এই জায়গা নিজেই এক জীবন্ত চরিত্র।” রিমা তার ডায়েরি বন্ধ করে চোখ তুলে ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকাল। তার মনে হচ্ছিল, সত্যিই হয়তো কোথাও এক অদৃশ্য ছায়া ভেসে যাচ্ছে, হয়তো সেই ভিক্ষুর আত্মা এখনো প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেনি। কিংবদন্তি আর লোককথা তাদের সবার ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি জাগাল, আর এই অভিজ্ঞতা যেন পাহাড়পুরের ইতিহাসকে আরও গভীর করে তুলল—একদিকে নিখাদ যুক্তি, অন্যদিকে অনন্ত কল্পনার ডানা। ইতিহাস আর লোককথা এখানে এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা হয়ে গেল, যা কেবল ভ্রমণ নয়, বরং আবিষ্কারের এক নতুন পথের সূচনা করল।

মহাবিহারের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে অরিন্দম ধীরে ধীরে কথার সুর বদলালেন। তার কণ্ঠে যেন এক অদ্ভুত গভীরতা ভেসে উঠল, যা শুধু তথ্য নয়, আবেগেও ভরা। তিনি বললেন, “ভাবুন তো, এই প্রাঙ্গণ একসময় ছিল এশিয়ার অন্যতম বড়ো শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে শুধু স্থানীয় নয়, দূরদূরান্ত থেকে—চীন, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি নেপাল থেকেও ভিক্ষু ও ছাত্ররা এসে জড়ো হতো। এখানে ছিল কেবল পাঠশালা নয়, ছিল জ্ঞানের এক অবিরাম সাধনা। কেউ দর্শন শিখছে, কেউ ধর্মতত্ত্ব, কেউ আবার জ্যোতির্বিদ্যা বা চিকিৎসা শাস্ত্র।” দলটি নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিল, যেন সময় থেমে গিয়ে অরিন্দমের কণ্ঠে অতীতের সেই প্রতিধ্বনি জীবন্ত হয়ে উঠছে। অনন্যা ক্যামেরা হাতে থাকলেও ছবি তুলছিল না; তার চোখ যেন গল্পের ভেতরে ঢুকে গেছে। সায়ন স্থির দৃষ্টিতে চারপাশের দেয়ালগুলো দেখছিল, যেন ইটের ফাঁকে ফাঁকে এখনও লুকিয়ে আছে সেই শিক্ষার আসর। রিমা কল্পনায় দেখতে পেল—লম্বা করিডরে সাদা পোশাক পরিহিত ভিক্ষুরা হাঁটছে, তাদের হাতে তালপাতার পুঁথি, আর আকাশভরা আলোয় ধ্বনিত হচ্ছে মন্ত্রোচ্চারণ। অরিন্দম আবার বললেন, “কল্পনা করুন, ঠিক এই জায়গাতেই প্রতিদিন ভোরে ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে শুরু হতো পাঠ। ধ্যান, বিতর্ক, পাঠদান—সব মিলিয়ে এটি ছিল জ্ঞানের সমুদ্র। আজ আমরা শুধু ইট-পাথরের ভগ্নাবশেষ দেখি, কিন্তু আসলে এগুলোই সাক্ষী, কীভাবে এক সভ্যতা তার জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল গোটা মহাদেশে।”

অরিন্দমের কথার ছন্দে যেন চারপাশের পরিবেশও সাড়া দিতে লাগল। ভগ্নাবশেষের দেয়ালে পড়া হালকা বাতাসের শব্দ, দূরের পাখির ডাক—সব মিলে মনে হচ্ছিল অতীত যেন ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছে। রিমা চোখ বন্ধ করে সেই শব্দগুলো শুনতে চেষ্টা করল, আর মনে হলো যেন সত্যিই দেয়ালের ভেতর থেকে মৃদু কণ্ঠ ভেসে আসছে—ভিক্ষুরা পাঠ করছে, শিক্ষকরা জ্ঞান বিতরণ করছেন। অনন্যা ডায়েরির পাতায় তাড়াহুড়ো করে কিছু লাইন লিখে রাখল—‘প্রতিটি ইট শুধু ইট নয়, এটি একেকটা কণ্ঠস্বর, যা যুগ যুগ ধরে বাজছে।’ সায়ন মৃদুস্বরে বলল, “অবিশ্বাস্য, এত বিশাল শিক্ষা ব্যবস্থা একসময় এখানে গড়ে উঠেছিল, অথচ এখন আমরা কেবল ভগ্নাংশই দেখতে পাই।” তার কণ্ঠে বিস্ময়ের সাথে একধরনের বেদনা মিশে ছিল, যেন হারানো এক জগতের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আব্দুল কাদিরও যোগ করল, “আমাদের দাদারা বলতেন, এ জায়গায় হাজার হাজার ভিক্ষু বাস করতেন। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রার্থনা আর পাঠের ধ্বনি ভেসে আসত। অনেক দূর থেকেও শোনা যেত সেই প্রতিধ্বনি।” কথাগুলো শুনে অরিন্দম মাথা নেড়ে বললেন, “এটা শুধু শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না, এটা ছিল সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। আজকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অনেকাংশে এই মহাবিহারের ধারণা থেকে শিক্ষা নিয়েছে।” তার কথায় অনন্যার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মনে হলো, ক্যামেরায় যত ছবি বন্দী করা যায় না, তারচেয়ে বেশি ছবি ফুটে উঠছে তাদের মনে।

ধীরে ধীরে সূর্যের আলো হেলে পড়তে লাগল, আর তার সোনালি আভা ভগ্নাবশেষের গায়ে এক অনন্য দৃশ্য আঁকল। সেই আলোয় যেন দেয়ালগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর অরিন্দমের বলা গল্প আরও জীবন্ত হয়ে বাজল। রিমা হঠাৎ বলে উঠল, “আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? মনে হচ্ছে যেন সত্যিই কেউ কোথাও মন্ত্র পড়ছে।” বাকিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। চারপাশে আসলেই নিস্তব্ধতা ছিল, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতর থেকে যেন অতীতের প্রতিধ্বনি ভেসে আসছিল। অনন্যা বলল, “হয়তো এটাই এই জায়গার জাদু—যেখানে দাঁড়ালে ইতিহাস কেবল পড়া বা দেখা নয়, শোনা যায়।” সায়ন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার বৈজ্ঞানিক মন ব্যাখ্যা খুঁজতে চাইলেও হৃদয়ের গভীরে এক অদ্ভুত আলোড়ন অনুভব করল। অরিন্দমের কণ্ঠ ধীর হয়ে এলো, তিনি বললেন, “আমরা শুধু দর্শক নই, আমরা সাক্ষী। এই প্রাঙ্গণের প্রতিটি নিস্তব্ধতা আমাদের কাছে এক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে—জ্ঞান ও সাধনার শক্তি কখনো নষ্ট হয় না, শুধু রূপ পাল্টায়।” দলটি আর কিছু বলল না। তারা শুধু নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, ভগ্নাবশেষের মাঝে প্রতিধ্বনিত অতীতের কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে। সময়ের স্রোত এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, আর তারা যেন হয়ে উঠল ইতিহাসেরই অংশ—অতীতের প্রতিধ্বনির সঙ্গে মিশে থাকা কিছু ক্ষণস্থায়ী মানুষ।

পাহাড়পুর মহাবিহারের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সবাই যখন অতীতের জ্ঞানের আলো কল্পনা করছিল, তখন সায়ন ধীরে ধীরে তার ব্যাগ থেকে কিছু দলিল বের করল। পুরনো গবেষণাপত্র, ইতিহাসবিদদের নোট আর প্রিন্ট করা পাণ্ডুলিপি তার সঙ্গে সবসময় থাকে। সে গম্ভীর মুখে বলতে শুরু করল, “এই মহাবিহার শুধু শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না, এটি ছিল রাজনৈতিক দিক থেকেও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। কিন্তু ইতিহাসে বারবার দেখা যায়, যখনই কোনো সভ্যতা বা প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়, তখনই তা অন্য শক্তির চোখে হুমকি হয়ে ওঠে। পাল যুগে এই মহাবিহার সমৃদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, উত্তরাধিকার নিয়ে যুদ্ধ এবং সীমান্তে অশান্তি ধীরে ধীরে এর পতনের পথ তৈরি করে।” দলটি চুপ করে শুনছিল। রিমা আকাশের দিকে তাকাল, মনে হচ্ছিল সেই আকাশ একসময় হয়তো দেখেছিল মহাবিহারের উজ্জ্বল দিন, আবার সেই আকাশই দেখেছিল এর পতনের মুহূর্ত। সায়ন আবার বলল, “ইতিহাসবিদদের মতে, সেন রাজাদের পতনের পর উত্তর ভারতের আক্রমণকারী সেনারা এ অঞ্চলে প্রবেশ করে। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সময়ে বহু জায়গায় আক্রমণ হয়, আর তখনই এই মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কেউ বলে আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল এর অনেক অংশ, কেউ বলে তলোয়ারের আঘাতে ধ্বংস হয়েছিল এর ভাস্কর্য।” তার কথায় একধরনের ভারী নিস্তব্ধতা নেমে এল। অনন্যা ক্যামেরা হাতে নিয়েও কিছুক্ষণ ছবি তুলল না, তার চোখ শুধু সেই ধ্বংসস্তূপের দিকে আটকে রইল।

অরিন্দম গভীরভাবে বললেন, “প্রতিটি সভ্যতার পতনের পেছনে রাজনীতি ও ক্ষমতার লড়াই বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাহাড়পুরও তার ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল বলে হয়তো আরও বেশি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। কারণ জ্ঞানের শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি।” রিমা ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু এত ধ্বংসের পরও দেখুন, সৌন্দর্য মরে যায়নি।” সত্যিই, দেয়ালে খোদাই করা টেরাকোটা ফলক, ভগ্ন স্তম্ভের ছায়া আর খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ইটের স্তূপ—সবই যেন প্রমাণ করছিল, ধ্বংস কোনো কিছুর শেষ নয়। বরং অবক্ষয়ের ভেতর দিয়েও থেকে যায় শিল্প, থেকে যায় সৌন্দর্য, থেকে যায় ইতিহাসের ছাপ। অনন্যা ক্যামেরায় ধরা সেই টেরাকোটার ভগ্নচিত্রের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, হয়তো আক্রমণের সময় অগ্নিশিখায় পুড়ে গিয়েছিল অনেক শিল্পকর্ম, হয়তো অনেক ফলক মাটির নিচে চাপা পড়েছিল, কিন্তু যেগুলো রয়ে গেছে, সেগুলো এখনো জীবন্ত সাক্ষী। সায়ন আবার দলিল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল, “আরও একটি বিষয় আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, প্রকৃতির প্রভাবও ধ্বংসের একটি বড় কারণ ছিল। ভূমিকম্প, বন্যা, মাটির ক্ষয়—এসব মিলিয়েও ভগ্নাবশেষ তৈরি হয়েছে। আমরা যেটা দেখি, সেটা শুধু যুদ্ধের ফল নয়, বরং সময়ের অবিরাম আঘাতের ফলও।” তার কথায় সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছিল, আর সেই ম্লান আলোয় ধ্বংসাবশেষ যেন আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল। তবে সেই বিষণ্ণতার ভেতরেও এক ধরনের মর্যাদা লুকিয়ে ছিল। অরিন্দম বললেন, “ভাবুন তো, হাজার বছর আগে যারা এই মহাবিহার তৈরি করেছিলেন, তারা নিশ্চয়ই কল্পনাও করেননি, একদিন এর ভগ্নাবশেষও হবে ইতিহাসের সম্পদ।” রিমা মৃদু হেসে বলল, “তাহলে কি ধ্বংসও একধরনের সৃষ্টি?” অরিন্দম উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, ধ্বংসও সৃষ্টি করে—নতুন ইতিহাস, নতুন কাহিনি। যা আমরা আজ পড়ছি, দেখছি, তা আসলে সেই ধ্বংসেরই উত্তরাধিকার।” অনন্যা চারপাশে ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিল, প্রতিটি কোণায় আলো-ছায়ার খেলা ধরে রাখার চেষ্টা করল। তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি ভগ্নস্তম্ভ, প্রতিটি দেয়াল যেন চিৎকার করে বলছে—“আমরা ধ্বংস হয়েছি, তবু বেঁচে আছি।” সায়ন আবার গম্ভীর হয়ে বলল, “আমরা যদি এসব ভগ্নাবশেষকে কেবল ধ্বংস বলে ভাবি, তাহলে ভুল করব। এগুলোই আমাদের পরিচয়, এগুলোই আমাদের শেকড়।” চারজনই তখন কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, বাতাসে শুধু দূরের কাকের ডাক শোনা যাচ্ছিল। সূর্যাস্তের রক্তিম আভা যখন ভগ্নাবশেষের উপর পড়ল, তখন মনে হলো যেন ধ্বংস আর সৌন্দর্য মিলে এক অদ্ভুত সিম্ফনি রচনা করছে। তারা বুঝল, এই জায়গা শুধু ইতিহাসের পাঠ নয়, বরং ধ্বংসের ভেতরেও কীভাবে জীবন টিকে থাকে তার এক অনন্ত উদাহরণ।

সূর্যের শেষ আলো যখন ধীরে ধীরে পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তখন পাহাড়পুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ এক অদ্ভুত লাল আভায় স্নান করতে শুরু করল। দিনের উত্তাপ কমে গিয়ে চারপাশে এক ধরনের শীতলতা নেমে এলো। অরিন্দম, অনন্যা, সায়ন আর রিমা তখনও বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু সন্ধ্যার আলোয় দৃশ্যপট এতটাই পরিবর্তিত হয়েছিল যে মনে হচ্ছিল তারা একেবারে অন্য এক জগতে এসে পড়েছে। লাল আকাশের নিচে ভগ্নপ্রাচীর, ভাঙা স্তম্ভ আর মাটির সঙ্গে মিশে থাকা প্রাচীন ইটগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। রিমা হঠাৎ থেমে গিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মনে হচ্ছিল, এই নিস্তব্ধতার ভেতরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য কণ্ঠস্বর, অসংখ্য প্রার্থনার ধ্বনি। হয়তো সেই ছাত্ররা, ভিক্ষুরা, শিক্ষকরা—যারা হাজার বছর আগে এখানে শিক্ষালাভ আর ধর্মচর্চা করত—তাদের নিঃশ্বাস এখনো ইটের ফাঁকে ফাঁকে রয়ে গেছে। সে মৃদু কণ্ঠে বলল, “তোমরা কি শোনো না? এই নীরবতার ভেতরে যেন প্রার্থনার শব্দ জেগে আছে।” অনন্যা ক্যামেরা তুলতে গিয়েও হাত নামিয়ে ফেলল। সত্যিই, এই মুহূর্তটা লেন্সে বন্দী করা সম্ভব নয়, কারণ এ এক অনুভূতি—যা শুধু হৃদয়ে ধরা পড়ে।

সায়ন, যে এতক্ষণ যুক্তি আর তথ্য দিয়ে সব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিল, সেও থেমে গেল। তার চোখে ঝলমল করছিল অচেনা এক আবেগ। সে মনে মনে ভাবছিল, ইতিহাসের শুষ্ক দলিলপত্রে হয়তো লেখা নেই, কিন্তু এই ভগ্নাবশেষের ওপর দাঁড়ালেই বোঝা যায় কীভাবে সময়ের স্তর পেরিয়ে এক যুগ আরেক যুগের সঙ্গে কথা বলে। সে বলল, “আমরা বইয়ে পড়ি, গবেষণায় খুঁজি, কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি মনে করছি, অতীত আমাদের সঙ্গে কথা বলছে।” অরিন্দম তার কাঁধে হাত রেখে মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক তাই। ইতিহাসের প্রকৃত পাঠ কেবল বই থেকে পাওয়া যায় না। এই নীরবতার ভেতরে যে সঙ্গীত বাজছে, সেটাই প্রকৃত শিক্ষা।” চারজন তখন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল, কারও মুখে আর কোনও শব্দ নেই। বাতাসে হালকা শীতলতা, কোথাও কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে শুরু করেছে। মাটির গন্ধে, শীতল হাওয়ায় আর ভগ্নাবশেষের ছায়ায় যেন এক রহস্যময় আবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। রিমা চুপচাপ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল, তার কানে ভেসে আসছিল এক অদ্ভুত সুর—যেন ধ্যানরত ভিক্ষুদের প্রার্থনার সুর, যা আজও বাতাসে মিশে আছে।

সন্ধ্যার লাল আলো ধীরে ধীরে গাঢ় হতে হতে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আকাশে তখন প্রথম তারাগুলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। অনন্যা ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে তাকাল, কিন্তু আলো এতটাই স্বর্গীয় মনে হচ্ছিল যে সে শাটার টিপল না। তার মনে হলো, কিছু মুহূর্ত কেবল হৃদয়ে জমা রাখার জন্যই তৈরি হয়, ছবিতে ধরে রাখার জন্য নয়। অরিন্দম ধীর কণ্ঠে বললেন, “এই নীরবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা ক্ষণস্থায়ী হলেও ইতিহাস চিরস্থায়ী।” সায়ন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, সে যেন নিজের ভেতরকার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না, আবার খুঁজতেও চাইছে না। রিমা তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, এত ধ্বংস, এত পতন, এত আক্রমণের পরও এই মহাবিহার আজও দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো সেটাই আসল শক্তি—যেখানে প্রার্থনা মরে না, ইতিহাস হারিয়ে যায় না। তারা চারজনই দীর্ঘ সময় নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যখন অবশেষে পাখিদের ডাক আর বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না, তখন তারা বুঝল, পাহাড়পুর কেবল একটি প্রত্নস্থল নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস, যার হৃদস্পন্দন সন্ধ্যার আলোয় এখনো শোনা যায়। সেই মুহূর্তে তাদের সবার মনে একই অনুভূতি জন্ম নিল—এই ভ্রমণ আর গবেষণা হয়তো শেষ হবে, কিন্তু পাহাড়পুরের এই সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা আজীবন বেঁচে থাকবে তাদের অন্তরে।

১০

শেষ দিনের সকালটা পাহাড়পুরে ছিল অন্যরকম। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নিস্তব্ধতা যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছিল, কারণ তাদের মনে ভর করেছিল এক অদ্ভুত বেদনা—বিদায়ের বেদনা। অরিন্দম, অনন্যা, সায়ন আর রিমা, চারজনেই জানত আজকের পর তারা এই মহাবিহারের ভগ্নপ্রাচীর ছেড়ে চলে যাবে, আবারও ব্যস্ত শহরের কোলাহলে ফিরতে হবে। অথচ এই কয়েক দিনে তারা যেন এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছিল—যেখানে ইতিহাস কেবল শুষ্ক দলিল নয়, বরং বেঁচে থাকা, নিঃশ্বাস ফেলা, কথা বলা এক প্রাণ। সকালের নরম আলোয় ধ্বংসাবশেষের প্রতিটি ইটকে তারা নতুন চোখে দেখছিল। মনে হচ্ছিল, এই ইটগুলো তাদের স্মৃতির ভেতরে চিরদিন বেঁচে থাকবে। চারজনের ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে, কিন্তু প্রত্যেকের মন গুছিয়ে উঠতে পারছিল না। অরিন্দম গভীর দৃষ্টিতে মহাবিহারের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মনে মনে বললেন, “কত শত শতাব্দী পার হয়ে গেছে, অথচ এই ভগ্নপ্রাচীর আজও আমাদের শিক্ষা দেয়।”

যাত্রার আগে তারা চারজনই নিজেদের ডায়েরি বের করল। প্রত্যেকের ডায়েরি হয়ে উঠল ভিন্ন ভিন্ন রঙের প্রতিচ্ছবি। অরিন্দম তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন ইতিহাসের আলোচনায় ভরা কিছু দীর্ঘ নোট—মহাবিহারের স্থাপত্য, তার প্রতিষ্ঠা, তার ধ্বংস আর তার টিকে থাকার কাহিনি। অনন্যা নিজের লেখা সাজাল ছবির পাশে অনুভূতির বর্ণনা দিয়ে—একটি টেরাকোটা ফলকের পাশে লিখল, “এখানে এক কৃষকের হাসি বন্দী হয়ে আছে,” আবার অন্য ছবির পাশে লিখল, “হাজার বছর আগে এই সিঁড়ি দিয়ে হয়তো একজন তরুণ ভিক্ষু ধ্যানকক্ষে যাচ্ছিল।” সায়ন নিখুঁত মনোযোগ দিয়ে নোট করছিল গবেষণার তথ্য—কোন কোন স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য নালন্দার সঙ্গে মেলে, কোন প্রমাণ প্রাচীন রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বলে, কোন মুদ্রা বা শিলালিপি কী প্রমাণ দেয়। কিন্তু রিমার ডায়েরি একেবারেই আলাদা হয়ে উঠল—সে লিখল কবিতা। প্রতিটি কবিতার লাইন যেন ধ্বংসাবশেষের নীরবতাকে ভাষা দিল। সে লিখল, “ইটের ভেতরে প্রার্থনা বেঁচে থাকে, সময়ের ভেতরে আলো লুকায় না। তুমি ধ্বংস হওনি, তুমি কেবল অন্য আকারে টিকে আছো।” রিমার ডায়েরি পড়ে অনন্যা চুপচাপ তার কাঁধে হাত রাখল, দুজনের চোখে তখন একই আবেগ জমে উঠেছে। তাদের চারজনের লেখা মিলে তৈরি হচ্ছিল পাহাড়পুরের এক বহুরূপী প্রতিচ্ছবি—যেখানে ইতিহাস, গবেষণা, শিল্প আর কবিতা একাকার হয়ে গেছে।

বিদায়ের মুহূর্তে আব্দুল কাদির এগিয়ে এলেন। তার চোখেমুখে অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন এই বিদায়ের মধ্যেও তিনি জানেন, পাহাড়পুর কাউকে কখনও পুরোপুরি ছাড়তে দেয় না। তিনি হাসিমুখে বললেন, “যখন আবার আসবেন, অতীত আপনাদের আরও কিছু শোনাবে।” এই এক বাক্যে যেন অমর হয়ে উঠল তাদের যাত্রার সমাপ্তি। ট্রেনে ফেরার আগে চারজন একবার শেষবারের মতো ভগ্নাবশেষের দিকে তাকাল। সূর্যের আলো ততক্ষণে তীব্র হয়ে উঠেছে, ইটের গায়ে ঝিলিক খেলছে। তাদের মনে হচ্ছিল, পাহাড়পুরের এই আকাশ, এই বাতাস, এই নীরবতা চিরদিন তাদের ডায়েরির পাতায় আর হৃদয়ের ভেতরে জীবন্ত থাকবে। ট্রেনের হুইসেল বাজল, আর ধীরে ধীরে তারা ফিরে গেল শহরের পথে। কিন্তু প্রত্যেকের চোখেমুখে স্পষ্ট ছিল এক প্রতিজ্ঞা—এ শুধু বিদায় নয়, আবার ফেরা। কারণ পাহাড়পুর ডাকে, পাহাড়পুর টানে, আর একবার যারা তার নীরবতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে, তারা আর কখনও তাকে ভোলার নয়।

****

1000054228.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *