Bangla - ভূতের গল্প

পানবিবির আসর

Spread the love

প্রতীক দত্ত


এক

গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন মন্দির, যার বয়স যেন সময়ের গণ্ডি ছুঁয়ে গেছে। চারপাশে বিশালাকার বটগাছ, শেকড় ঝুলে পড়েছে দেয়ালের উপর, যেন প্রকৃতি নিজেই মন্দিরটিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। পাথরের দেওয়ালে শেওলার আস্তরণ, ফাটল থেকে জন্ম নিয়েছে ছোট ছোট গাছ, আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধে মন্দিরের ভেতর সবসময়ই মনে হয় কারও উপস্থিতি রয়েছে। শীতের সকালের কুয়াশা কিংবা গ্রীষ্মের দুপুরের রোদ—মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করলে বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশ চোখে পড়ে। এখানে সময় থেমে আছে, আর সেই থেমে যাওয়া সময়ের ভেতর লুকিয়ে আছে অজস্র লোককথা, বিশ্বাস আর আতঙ্ক। গ্রামের প্রতিটি মানুষ এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে, কারণ এখানেই পূজিত হন পানবিবি—দেবী, যিনি মাতৃরূপে করুণাময়ী আবার অভিশাপের মুহূর্তে রুদ্ররূপে ভয়ঙ্কর। শিশুরা বড় হতে হতে শোনে, পানবিবির নিয়ম ভাঙলে শুধু মৃত্যু নয়, গোটা গ্রামে নেমে আসতে পারে অমোঘ দুর্যোগ। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই গ্রাম যেন বেঁচে আছে, আবার এই মন্দিরই গ্রামের হৃদয়ে এক অনির্বচনীয় ভীতি ছড়িয়ে রেখেছে।

কথিত আছে, শত শত বছর আগে নদীর তীরে ঘটে যাওয়া এক মহাদুর্ভিক্ষ থেকে গ্রামকে রক্ষা করেছিলেন এই দেবী। সেই সময় গ্রামের এক তরুণী পুকুরঘাটে গলাফাটা কণ্ঠে গান গাইতে গাইতে মূর্ছা যায়। লোকেরা তাকে মন্দিরে নিয়ে এলে সে যেন এক অদৃশ্য শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছিল—চোখ লাল, কণ্ঠে বজ্রের মতো শব্দ, আর শরীর থেকে নির্গত হচ্ছিল তীব্র আলো। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বিশ্বাস করলেন, সে আর কেউ নয়, দেবী পানবিবির আবির্ভাব। তখন থেকেই মন্দিরে পূজা শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই তরুণীর শরীর ভস্ম হয়ে যায়, কিন্তু তার আত্মা থেকে যায় মন্দিরে বন্দী হয়ে। তারপর থেকেই গ্রামের মানুষ তাঁকে পূজা করে আসছে, তাঁকে ঘিরেই রচিত হয়েছে অসংখ্য নিষেধ আর আচার। দেবীর নিয়ম ভাঙলে তাঁর রুদ্ররূপ প্রকাশ পায়, এমন গল্প বহুবার শোনা গেছে। কেউ রাতে মন্দিরের প্রদীপ নিভিয়েছিল, সকালে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় গ্রামের পুকুরে। কেউ নিষিদ্ধ দিনে মন্দিরে ঢুকেছিল, সে উন্মাদ হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিল দিনরাত। তাই ভক্তি আর ভয়ের সীমারেখা মিলেমিশে গেছে পানবিবির পূজায়।

পুরোহিত রাধাকান্ত পণ্ডিত এই মন্দিরের প্রাণ। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হলেও তাঁর চোখে যেন ক্লান্তির ছাপ নেই। গায়ের রঙ শ্যামলা, কপালে চন্দনের লম্বা দাগ, আর ঠোঁটে সবসময়ই একরকম সতর্কতার রেখা। ছোটবেলা থেকেই মন্দিরেই মানুষ তিনি, তাঁর বাবা ছিলেন আগের পুরোহিত। গ্রামবাসীরা তাঁকে শুধু পুরোহিত হিসেবেই নয়, দেবীর বাণীর বাহক হিসেবেও মানে। তাঁর কথার মানেই নিয়ম, তাঁর সতর্কবাণী মানেই দেবীর আদেশ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি পূজা সেরে গ্রামের মানুষকে বসিয়ে দেবীর কাহিনী শোনান। কণ্ঠে তাঁর এক আশ্চর্য দৃঢ়তা, যা শুনে গ্রামবাসীর গা শিউরে ওঠে। তিনি বলেন, “যে দেবী আমাদের বাঁচান, সেই দেবীই আমাদের ধ্বংস করতে পারেন। নিয়ম মানলে মা আশীর্বাদ দেবেন, আর অমান্য করলে মা কারও রেহাই দেবেন না।” তাঁর এই কথার পর গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মধ্যে এক অদ্ভুত শীতল ভয় কাজ করে। গ্রামের কারও সাহস হয় না নিয়ম ভাঙার, কারণ তারা বিশ্বাস করে দেবীর চোখ সবসময় মন্দিরের অন্ধকার থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তবু মন্দিরের ভেতর এক রহস্যময় আকর্ষণ কাজ করে। সন্ধ্যার পর শঙ্খ বাজলে মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, আর সকালের প্রথম আলোয় দরজা খোলা হয়। রাতের বেলা কেউই সেখানে যায় না। অথচ গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলে—অমাবস্যার রাতে মন্দিরের ভেতর থেকে শোনা যায় কান্নার শব্দ, কখনও আবার শোনা যায় শাঁখ বাজানোর আওয়াজ। কেউ কেউ দাবি করে, তারা দেখেছে লাল আগুনের মতো আলো ভেসে বেড়াতে। কিন্তু এসব কথা শুধু ফিসফিস করে উচ্চারিত হয়, প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করে না। রাধাকান্ত পণ্ডিত এসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান, তবে তিনি একথা বারবার বলেন—“মায়ের আসর ডাকলে কেউ আটকাতে পারে না।” গ্রামের মানুষ জানে না এই ‘আসর’ কী, কেমন করে হয়, কিংবা কখন হয়। শুধু এটুকুই বোঝে, আসর মানেই মৃত্যু আর ধ্বংসের সন্নিকট। আর এই ভয়ের ছায়াতেই গ্রাম বাঁচে, প্রাচীন মন্দির দাঁড়িয়ে থাকে, আর পানবিবি নামের দেবী হয়ে ওঠেন ভক্তি ও আতঙ্কের মিলিত প্রতীক।

দুই

শহর থেকে আসা তরুণ গবেষক জয়ন্তর বয়স মাত্র আটাশ, কিন্তু চোখেমুখে কৌতূহলের তীব্র ঝিলিক। কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকসংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করছে সে, আর তার গবেষণার মূল বিষয় লোককথা ও অলৌকিক বিশ্বাস। বহুদিন ধরেই সে শুনেছিল জঙ্গলঘেরা এক প্রত্যন্ত গ্রামের নাম—যেখানে ‘পানবিবির আসর’ নামে পরিচিত এক ভয়ংকর লোকবিশ্বাস বেঁচে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এই গল্প প্রথমে তার কাছে নিছক গ্রামীণ কুসংস্কারের মতোই মনে হয়েছিল, কিন্তু যত পড়াশোনা করেছে, ততই বুঝেছে, এ এক অমূল্য উপাদান তার গবেষণার জন্য। তাই শীতের ভোরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে, নোটবুক আর ক্যামেরা সঙ্গে করে, সে এসে পৌঁছল সেই গ্রামে। ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি, গ্রামের চারপাশে কুয়াশা ঝুলে আছে, আর দূরে কাক ডাকছে। জয়ন্তর প্রথম দর্শনেই গ্রামটি যেন এক রহস্যময় পর্দায় ঢাকা মনে হলো—আধুনিকতার ছোঁয়া নেই, মাটির বাড়ি, বাঁশের বেড়া, আর দূরে গাছেদের মাথার ফাঁক দিয়ে প্রাচীন মন্দিরের টপ দেখা যায়। সে মনে মনে হাসল—“এই গ্রামই হবে আমার গবেষণার সেরা উপাদান।”

গ্রামে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় কিছু গ্রামবাসীর। প্রথমে তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে—শহরের ছেলেমেয়েরা খুব একটা আসে না এখানে, আর এ যে একেবারে অপরিচিত মুখ। জয়ন্ত নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেয়, জানায় সে লোককথা নিয়ে পড়াশোনা করছে এবং গ্রামে কয়েকদিন থাকতে চায়। গ্রামবাসীরা তার কথায় খানিকটা অবিশ্বাসের ছায়া পেলেও অতিথিকে অবহেলা করে না। তারা জানায়, গ্রামের এক প্রান্তে সুবল দাস নামের এক প্রবীণ লোক আছেন, যিনি লোককাহিনী আর পানবিবি সম্পর্কিত গল্পে ভরপুর। জয়ন্ত ঠিক করে সেখান থেকেই শুরু করবে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন তাকে সাবধান করে দেয়—“বাবু, পানবিবির নিয়ম নিয়ে বেশি প্রশ্ন করবেন না। এখানে সবকিছুর সীমানা আছে। মায়ের নিয়ম ভাঙলে কেউ রেহাই পায়নি।” এই সতর্কবাণীতে জয়ন্ত হেসে ওঠে, সে ভাবে—এগুলো নিছক ভয় দেখানো, গ্রামের সরল মানুষদের মানসিক নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়। তার চোখে সবকিছুই যুক্তির আলোয় দেখা যায়। তাই সে বলে—“আচ্ছা, দেবী যদি সত্যিই থাকেন, তবে আমাকে সামনাসামনি দেখা দিক। আমি এসব ভূতপ্রেত মানি না।” এই উক্তি শোনার পর গ্রামবাসীর মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে ওঠে, কেউ মুখ ঢেকে নেয়, কেউবা ধীরে ধীরে সরে যায়, যেন এই কথার জন্যই ভয়ংকর কিছু নেমে আসবে।

সন্ধ্যার সময় জয়ন্তকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরের সামনে। মন্দির ঘিরে বিশাল বটগাছ, চারপাশে শেওলা জমা দেওয়াল, আর ভেতর থেকে আসা ধূপ আর প্রদীপের গন্ধ। পুরোহিত রাধাকান্ত পণ্ডিত তখন সন্ধ্যারতি শেষ করেছেন। জয়ন্ত নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিলে পণ্ডিত প্রথমে শান্তভাবে শোনেন, তারপর গভীর গলায় বলেন—“গবেষণা করুন, তবে সাবধান হোন। মায়ের আসর নিয়ে খেলা নয়। নিয়ম মানতে হবে, নইলে সর্বনাশ হবে।” জয়ন্ত মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেও মনে মনে হাসল—“আধুনিক যুগে এসব কথা এখনও মানুষ বিশ্বাস করে, অবিশ্বাস্য!” সে চারপাশটা মন দিয়ে দেখতে থাকে। মন্দিরের ভিতরের মূর্তি আসলে কোনো খোদাই করা মূর্তি নয়, একখণ্ড কালো পাথরে খোদাই করা লালচে দাগ, যা দেখতে মানুষের মুখাবয়বের মতো। পাথরের চারপাশে লাল সিঁদুর, তেলের প্রদীপ, আর শাঁখ রাখা। জয়ন্ত খেয়াল করে, গ্রামবাসীরা সেখানে পা রাখতেই মাথা নিচু করে, ঠোঁটে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে। তার কাছে এগুলো একরকম নাটকীয় আচার ছাড়া কিছুই মনে হয় না।

রাতে গ্রামের একটি মাটির ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয় তার। খাওয়া শেষে খোলা উঠোনে বসে সে নোটবুক বের করে দিনের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করে। কিন্তু তখনই সুবল দাস এসে বসেন তার পাশে। সাদা ধুতি, কুঁচকানো মুখ, চোখেমুখে গ্রাম্য জীবনের অগণিত অভিজ্ঞতা। তিনি এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলতে শুরু করেন—“বাবু, আপনি শহরের মানুষ, বই পড়েন, যুক্তি মানেন, কিন্তু এই গ্রামে মা পানবিবি আছেন, এটা মানতে হবে। কত মানুষকে তাঁর ক্রোধ ভোগ করতে হয়েছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। একবার এক তরুণী নিয়ম ভেঙেছিল, রাতে প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল—পরের দিন সকালেই তাকে পুকুরে মৃত পাওয়া যায়। আবার এক ব্যক্তি অমাবস্যার রাতে মন্দিরে ঢুকেছিল—তারপর থেকে সে উন্মাদ হয়ে শুধু হাহাকার করত। আপনি যদি মায়ের নিয়ম ভাঙতে চান, আগে মনে রাখবেন—এই গ্রামে মৃত্যুর জন্য কেউ দায় নেবে না।” সুবল দাসের গলায় এমন এক দৃঢ়তা, এমন এক ভীতি মিশে ছিল, যা জয়ন্তর বুকেও খানিকটা শীতল স্রোত বইয়ে দিল। তবু যুক্তিবাদী জয়ন্ত নিজের মনে স্থির করল—সে ভয়ে পিছিয়ে আসবে না। মানুষের ভক্তি ও আতঙ্কের আড়ালে কী লুকিয়ে আছে, সেটাই সে খুঁজে বের করবে।

তিন

রাত নেমেছে গ্রামে। অমাবস্যা না হলেও আকাশে চাঁদহীনতার মতো এক ভারী অন্ধকার নেমে এসেছে। হাওয়া নেই, তবু বটগাছের পাতাগুলো অকারণেই সাঁই সাঁই করে নড়ে উঠছে। গ্রামের মাঝখানে খোলা উঠোনে কাঠ জ্বালানো হয়েছে, চারপাশে গ্রামবাসীরা গোল হয়ে বসেছে। কেউ চুপচাপ, কেউবা ভয়ে আঁকড়ে ধরেছে পাশের মানুষকে। মাঝখানে বসে আছেন সুবল দাস—সাদা ধুতি, গায়ে পুরোনো চাদর, চোখে ধূসর স্মৃতির ছাপ। আগুনের আলোয় তাঁর মুখখানি যেন আরও ভৌতিক হয়ে উঠেছে। তিনি ধীরে ধীরে শুরু করলেন, কণ্ঠে ভারী গাম্ভীর্য—“শুনুন সবাই, আবার শুনুন। মায়ের নিয়ম মানা না মানার ফল আমি নিজের চোখে দেখেছি। এটা কোনো কুসংস্কার নয়, এটা সত্যি।” আগুনের আলোতে জয়ন্ত তার প্রতিটি শব্দ মন দিয়ে শুনছে, অন্যরা আতঙ্কে গা শিউরে উঠছে।

“বছর পঁচিশ আগের কথা,” সুবল দাস বলতে থাকেন, “গ্রামে ছিল এক যুবক—গোপাল। শহরে পড়াশোনা করে ফিরে এসেছিল, আর আমাদের মতো সাদাসিধে মানুষদের নিয়ে মশকরা করত। বলত, মা পানবিবি নেই, এসব শুধু গড়াপেটা কাহিনী। সে একদিন ঠিক করল, অমাবস্যার রাতে মন্দিরে যাবে, আর প্রমাণ করবে কিছুই ঘটবে না। গ্রামের সবাই তাকে অনেক বোঝালো, কিন্তু সে হাসল, বলল—‘তোমরা অন্ধবিশ্বাসে ডুবে আছো, আমি গিয়ে তোমাদের ভুল ভাঙাব।’ সেই রাতেই আমরা শুনলাম ভেতর থেকে ভেসে আসছে শঙ্খধ্বনি, অথচ পণ্ডিতমশাই তো মন্দির বন্ধ করে চলে গেছেন! কেউ সাহস করে কাছে যায়নি। পরদিন সকালে গোপালকে পাওয়া গেল মন্দিরের সিঁড়িতে—চোখ দুটো রক্তলাল, মুখ ফাঁকা, শরীরের হাড়গোড় অদ্ভুতভাবে মুচড়ে গেছে। গ্রামের ডাক্তার দেখল, কিন্তু বলল এমন মৃত্যু কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়।” সুবলের কণ্ঠ গম্ভীর হয়ে ওঠে, যেন সেই রাতের শিহরণ আবার তার ভেতরে জেগে উঠেছে।

গ্রামবাসীরা আগুনের চারপাশে বসে শুনতে শুনতে গা শিউরে ওঠে। মহিলারা আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকে, শিশুরা মায়ের কোলের ভেতরে মুখ গুঁজে রাখে। কারও কারও ঠোঁট কাঁপছে, আর কেউ কেউ বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছে—“মা, আমাদের রক্ষা করো।” বাতাসে হঠাৎ যেন হিমেল শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে। আগুন জ্বলছে, তবু ঠাণ্ডা আঁকড়ে ধরছে শরীরকে। জয়ন্ত চারপাশের এই ভয়ের পরিবেশ লক্ষ করে, কিন্তু তার মনে ভয় নয়, বরং কৌতূহলের ঝড় ওঠে। সে মনে মনে ভাবে—এই কাহিনী নিশ্চয়ই গোপালের আকস্মিক রোগ বা বিষক্রিয়ার ফলাফল, আর গ্রামবাসীরা তাকে দেবীর অভিশাপ বলেই ধরে নিয়েছে। তবু সে বুঝতে পারছে, এই লোককাহিনী মানুষের মনে কতটা গভীরভাবে প্রোথিত। প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করছে, নিয়ম ভাঙলে ভয়ংকর কিছু ঘটবেই। জয়ন্ত নিজের খাতায় নোট করতে থাকে—“লোকবিশ্বাসের প্রভাব এত প্রবল যে, মৃত্যুর স্বাভাবিক ব্যাখ্যাও গ্রামবাসী মেনে নিতে অস্বীকার করে।” তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, যেন সে এক বিরল সত্য উদ্ঘাটনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু সুবল দাস তখনও থামেননি। তিনি আগুনের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন—“গোপালের মৃত্যুর পর থেকেই মা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন। রাতের অন্ধকারে মন্দির থেকে ভেসে আসে মায়ের আসরের ডাক—শাঁখ, ঢোল আর কান্নার শব্দ। আমরা কেউ সাহস করি না কাছে যেতে। গ্রামের প্রতিটি মানুষ জানে, নিয়ম ভাঙা মানেই সর্বনাশ। মা পানবিবি দয়া করেন, কিন্তু রাগলে রক্ষা নেই।” তাঁর এই কথার পর নীরবতা নেমে আসে গোটা আসরে। শুধু আগুনের কটকট শব্দ আর দূরের পেঁচার ডাক শোনা যায়। জয়ন্ত সেই নীরবতায় যেন আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হয়ে ওঠে। সে নিজের মনে ভাবে—“এই ভয়, এই ভক্তি—এসবকে ভাঙতে হবে। আমি খুঁজে বের করব সত্যিটা। মায়ের আসর যদি থেকে থাকে, তবে আমি তা নিজ চোখে দেখব।” তার এই সিদ্ধান্ত হয়তো গ্রামবাসীরা জানে না, কিন্তু সেই রাতের আগুনের পাশে বসে থাকা প্রতিটি মুখই যেন নিঃশব্দে বুঝে ফেলছে—এই শহরের গবেষক ছেলেটি একদিন এমন কিছু করবে, যা গ্রামে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে।

চার

পরদিন দুপুরে জয়ন্ত বসেছিল গ্রামের প্রাচীন পাঠাগারের মতো এক ঘরে—আসলে এটি এক পুরোনো জমিদারবাড়ির ধ্বংসপ্রায় ভাঁজ, যেখানে কিছু দলিল-দস্তাবেজ আর পুঁথি এখনও যত্নে রাখা আছে। সূর্যের আলো ধুলো জমা জানালা ভেদ করে ঘরে প্রবেশ করছিল, আর কাঠের তাকগুলোতে রাখা ছিল হাতে লেখা কাগজ, পুরোনো রেজিস্টার, আর হলদে হয়ে যাওয়া পাতার স্তুপ। জয়ন্ত গভীর মনোযোগে এগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল, কিন্তু এত পুরোনো লেখাগুলো পড়া তার পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই দরজার পাশে নরম কণ্ঠ শোনা গেল—“আপনি বুঝতে পারছেন না, তাই না?” জয়ন্ত তাকিয়ে দেখে, প্রায় ষোলো-সতেরো বছরের এক কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে, পরনে সাদা-নীল সালোয়ার, চুল খোলা, চোখে এক ধরনের সরলতা আর দৃঢ়তা একসঙ্গে। মেয়েটির নাম কোমলিকা। সে গ্রামের স্কুলে পড়ে, শহরের কলেজে ভর্তি হবার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু একইসঙ্গে দেবীর ভক্তিও তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত। কোমলিকা এগিয়ে এসে জয়ন্তর হাতে থাকা এক পুরোনো খাতা টেনে নিল, সাবলীল ভঙ্গিতে পড়তে শুরু করল। জয়ন্ত বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল—এ মেয়ে শুধু পড়াশোনায় পটু নয়, গ্রামীণ ইতিহাস আর লোকগাথার সঙ্গেও তার গভীর পরিচয়।

জয়ন্ত প্রথমেই বুঝল, এই কোমলিকা তার গবেষণার জন্য অপরিহার্য সহযোগী হতে পারে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তারা দলিলপত্র থেকে বের করে আনল নানা তথ্য—কবে থেকে পানবিবির আসরের প্রথা চালু, কোন সময়ে নিয়মগুলো কঠোর করা হয়, আর কোন কোন ঘটনায় গ্রামবাসীরা দেবীর অলৌকিক উপস্থিতি টের পেয়েছে বলে বিশ্বাস করে। কোমলিকা পড়তে পড়তে একসময় থেমে গেল। তার চোখে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব ফুটে উঠল। সে ধীরে বলল, “জানেন, বাবু, আমি মা পানবিবিকে ভক্তি করি। ছোটবেলা থেকে আমার মা শিখিয়েছেন, নিয়ম মানতে হয়। কিন্তু পড়াশোনা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়—এগুলো কি সত্যিই দেবীর নিয়ম, নাকি মানুষই বানিয়েছে ভয় দেখানোর জন্য?” তার কণ্ঠে দ্বিধা, ভক্তি আর প্রশ্ন মিশে গেল একসাথে। জয়ন্ত মৃদু হাসল, বলল—“তুমি ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছো। তুমি যেমন বিশ্বাস করো, তেমনই প্রশ্ন করছো। এটাই সত্যের পথে হাঁটার প্রথম ধাপ।” কোমলিকা চুপচাপ তাকিয়ে রইল, তার চোখে জল চিকচিক করছে, হয়তো ভয়, হয়তো আকুলতা।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তারা দুজনে বাইরে বের হল। গ্রামের আকাশ তখন রঙিন হয়ে উঠেছে, লাল সূর্যের শেষ আলো মাঠে পড়ছে। কোমলিকা ধীরে হাঁটতে হাঁটতে জয়ন্তকে বলল, “তুমি শহর থেকে এসেছো, তোমার কাছে সবকিছুই যুক্তি দিয়ে বোঝা যায়। কিন্তু আমি তো এই গ্রামে বড় হয়েছি। মা পানবিবির মন্দির আমার শৈশবের অংশ। প্রতি পূর্ণিমায় আমি সেখানে প্রদীপ জ্বালাই। আমি যদি ভাবি সব মিথ্যে, তাহলে মনে হয় আমি অপরাধ করছি।” জয়ন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনল, তারপর শান্ত স্বরে বলল, “কোনো ভক্তিকে আমি তুচ্ছ করি না, কোমলিকা। ভক্তি মানুষের আত্মার শক্তি দেয়। কিন্তু ভয়ের নামে যদি মানুষকে বেঁধে রাখা হয়, তবে তা জানার চেষ্টা করা উচিত। তোমার দ্বিধাই প্রমাণ করে, তুমি ভয়ের কাছে হার মানতে চাও না।” কোমলিকা নিচু গলায় বলল, “কিন্তু যদি সত্যিই মা রাগ করেন? যদি আমাদের সর্বনাশ হয়?” তার কণ্ঠে কাঁপন, তবু চোখে জেদও আছে। জয়ন্ত এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকিয়ে চুপ রইল—এই মেয়েটি তার নিজের ভেতরের সংগ্রামের প্রতিফলন যেন।

রাত নামার সময় কোমলিকা বাড়ি ফিরছিল, হাতে ছিল কয়েকটি পুরোনো দলিল যা জয়ন্তকে সাহায্য করার জন্য নিয়ে এসেছে। হাঁটার সময় সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল—“মা, আমাকে রক্ষা করো। আমি তোমাকে অবমাননা করছি না, আমি শুধু জানতে চাই।” সেই প্রার্থনার ভেতরে ছিল দ্বিধার তীব্রতা, একদিকে দেবীর প্রতি অপরিসীম ভক্তি, অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষার আলোর প্রতি টান। জয়ন্ত নিজের ঘরে বসে সেই রাতে খাতায় লিখল—“কোমলিকা হলো গ্রামের বিশ্বাসের প্রতীক, যেখানে পুরোনো লোককাহিনী আর নতুন যুগের প্রশ্ন একসঙ্গে লড়াই করছে। এই লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই হয়তো সত্য প্রকাশ পাবে।” জয়ন্তর চোখে কোমলিকা হয়ে উঠল সেতু—একদিকে ভক্তি, অন্যদিকে যুক্তি। গ্রামের ভয়ের দেয়াল ভাঙার জন্য জয়ন্ত জানল, তার সবচেয়ে বড় সহযোগী এই কিশোরী, যে নিজেই দ্বন্দ্বে জর্জরিত। কিন্তু সে বুঝতে পারল না, এই দ্বন্দ্বই হয়তো একদিন ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দেবে তাদের দুজনকেই।

পাঁচ

দিন কয়েক ধরে জয়ন্ত মনের ভেতরে এক অদম্য আগুন অনুভব করছিল। প্রতিটি সন্ধ্যায় সে মন্দিরের চারপাশে ঘুরে বেড়াত, দূরে দাঁড়িয়ে দেখত কেমন করে মানুষজন প্রদীপ জ্বালায়, আর ভক্তির স্রোতে মিশে যায়। গ্রামের লোকেরা একবারও সাহস করে মন্দিরের নিয়ম অমান্য করে না। জয়ন্তর চোখে এসব ভক্তি যেন এক অচল কুসংস্কার। সে যতই দলিল-দস্তাবেজ খুঁজে পড়ছে, ততই তার মনে হচ্ছে—এই ভয়ের বাঁধ ভাঙা দরকার। গ্রামবাসীর চোখে দেবীর উপস্থিতি ভয়ঙ্কর এক অলৌকিক শক্তি, কিন্তু জয়ন্তর চোখে এটি কেবল অন্ধকার অজ্ঞানের প্রতিফলন। সে নিজের খাতায় লিখল—“সত্য উদ্ঘাটনের একমাত্র পথ হলো পরীক্ষা। আমি নিজেই যাব, আমি নিজেই নিয়ম ভাঙব।” এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এলো, যেন সে বড় কোনো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। কিন্তু বাইরে গাছপালার ফাঁকে বাতাসে যে শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ছিল, তাতে তার বুকের ভেতরেও মাঝে মাঝে অজানা কাঁপুনি জাগত।

জয়ন্তর এই পরিকল্পনার কথা কেমন করে যেন ছড়িয়ে পড়ল। এক সন্ধ্যায় রাধাকান্ত পণ্ডিত তাকে ডেকে পাঠালেন। মন্দিরের প্রাচীন উঠোনে বসে পণ্ডিত মশাইয়ের চোখ যেন আগুনের মতো জ্বলছিল। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন—“বাবা, যা করতে চাইছো, তা কোরো না। নিয়ম ভাঙা মানেই সর্বনাশ। মা শুধু ভক্তি চান, অবমাননা সহ্য করেন না।” জয়ন্ত শান্ত গলায় বলল, “পণ্ডিতমশাই, যদি মা সত্যিই থাকেন, তবে তিনি কি অল্প কিছু নিয়ম ভাঙায় রাগ করবেন? আর যদি না থাকেন, তবে আমরা অকারণেই ভয় পাচ্ছি।” পণ্ডিতমশাই কপালে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার চোখে ছিল শোক মেশানো অসহায়তা। এরপর সুবল দাসও জয়ন্তকে জোর দিয়ে সতর্ক করলেন। আগুনের পাশে বসে তিনি কাঁপা কণ্ঠে বললেন—“আমি গোপালের মৃত্যু দেখেছি। চোখের সামনে ওর শরীর ভেঙে গেল। ওর আত্মার আর্তচিৎকার আমি এখনও শুনতে পাই। তুমি ওভাবে যেও না, বাবা। তোমার সর্বনাশ হবে।” কিন্তু জয়ন্তর চোখে ছিল দৃঢ়তা। সে শুধু মাথা নেড়ে বলল, “আমি যাবই।”

কোমলিকার মনে দ্বন্দ্ব তখন ভয়ংকর রূপ নিল। একদিকে জয়ন্তর প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করছে সে। শহরের এই গবেষক ছেলেটির চোখে আছে দৃঢ়তা, আর মনে আছে যুক্তি। কোমলিকা বুঝতে পারছে, জয়ন্তর মতো মানুষই পারে অন্ধকার ভেদ করে সত্যের আলো দেখাতে। কিন্তু আবার তার বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে ভয়—যদি মা সত্যিই রাগ করেন? যদি এই নিয়ম ভাঙার খেসারত গোটা গ্রামকে দিতে হয়? এক রাতে কোমলিকা জয়ন্তকে থামাতে এল। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া পথ ধরে সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি এটা কোরো না। যদি সত্যিই কিছু ঘটে?” জয়ন্ত তার চোখের দিকে তাকাল, দৃঢ় স্বরে বলল, “কোমলিকা, যদি ভয় আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে, তবে আমরা কোনোদিন জানতেই পারব না কী সত্য আর কী মিথ্যে। আমি শুধু জানতে চাই।” কোমলিকার চোখে জল ভেসে উঠল। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, নিজের হৃদয়ের টানাপোড়েন কারও কাছে প্রকাশ করতে পারল না। সে বুঝতে পারল, জয়ন্তকে থামানো অসম্ভব।

অমাবস্যার রাত আসতে বেশি দেরি নেই। গ্রাম জুড়ে অদ্ভুত এক অশুভ আবহ ছড়িয়ে পড়েছে। কাক ডাকছে অকারণেই, কুকুর রাতভর চেঁচাচ্ছে। মানুষজন আতঙ্কে গুটিয়ে গেছে, যেন আসন্ন কোনো ঝড়ের আভাস তারা পাচ্ছে। জয়ন্ত নিজের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার খাতায় শেষবারের মতো লিখছে—“অমাবস্যার রাতে দেবীর আসরে গিয়ে নিষিদ্ধ কাজ করব। যদি কিছু না ঘটে, তবে প্রমাণ হবে সব কুসংস্কার।” অন্যদিকে কোমলিকা নিঃশব্দে কাঁদছে নিজের ঘরে। সে জানে, জয়ন্তকে সাহায্য না করলে হয়তো সে ব্যর্থ হবে, কিন্তু সাহায্য করলে তার নিজের বিশ্বাসের মূলে আঘাত আসবে। সে শেষমেশ নিজের অন্তরে এক প্রার্থনা করে—“মা, আমাকে ক্ষমা কোরো। আমি জানি না আমি কী করব।” অন্ধকারে মন্দিরের ওপর জমাট বেঁধে ওঠা অমাবস্যার ছায়া যেন তাদের সবাইকে ঘিরে ফেলল, আর সেই ছায়ার ভেতরে শোনা গেল এক অদৃশ্য আহ্বান—যেন মা নিজেই অপেক্ষা করছেন নিয়ম ভাঙার মুহূর্তটির জন্য।

ছয়

অমাবস্যার রাতের ঘন কালো অন্ধকারে গোটা গ্রাম যেন ভয়ে শ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা, শুধু মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে সেই নীরবতা ভেঙে যাচ্ছে। দূরে কোথাও হঠাৎ কুকুরের কান্নাজড়ানো ডাক শোনা গেল, আর সেই শব্দ যেন বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। গ্রামের মানুষজন ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, জানালা কপাট আটকে দিয়েছে, যেন বাইরের ভয়ঙ্কর রাতের সাথে কোনো যোগাযোগ না রাখাই শ্রেয়। এই রাতটা অন্য রাতের মতো নয়—এটা অমাবস্যার রাত, আর এই রাতেই জয়ন্ত তার ঘোষণা অনুযায়ী মন্দিরে যাবে। পুরোনো দলিলপত্র, লোককথা, আর গ্রামবাসীর সতর্কবাণী সবকিছুই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তবু যুক্তির জয় ঘটানোর তৃষ্ণা তাকে থামাতে পারল না। কোমলিকা জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ছিল, কাঁপা কণ্ঠে প্রার্থনা করছিল—“মা, ওকে রক্ষা করো।” জয়ন্ত একা, হাতে শুধু একটি লণ্ঠন, পায়ে পাথরের পথে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন অচেনা অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে পড়া।

মন্দিরে পৌঁছে জয়ন্ত থমকে দাঁড়াল। চারপাশে ঘন বটগাছ, তাদের পাকানো শেকড় যেন অদৃশ্য সাপের মতো কিলবিল করছে। মন্দিরের পাথরের দেওয়ালে শেওলা আর কালের দাগ জমে আছে, আর গম্বুজে বাদুড় উড়ছে। মন্দিরের দরজার সামনে রাখা প্রদীপগুলোর আলো একে একে নিভে যাচ্ছে বাতাসে। জয়ন্তর বুক ধুকপুক করছিল, কিন্তু সে মনে মনে নিজেকে দৃঢ় করল—“ভয়কে জয় করতেই তো এসেছি।” সে মন্দিরের ভেতরে ঢুকল। ভেতরে অদ্ভুত এক গন্ধ, পুরোনো ধূপ আর শেওলার মিশ্রিত গন্ধে ভরে আছে চারদিক। মাঝখানে দেবীর আসন, তার সামনে জ্বলছে এক নিষিদ্ধ প্রদীপ—যা কোনোদিনও কেউ নিভানোর সাহস করেনি। জয়ন্ত ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু চোখে জেদ। এক মুহূর্তের জন্য সে থেমে গেল, তারপর হঠাৎ হাত বাড়িয়ে প্রদীপটা নিভিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে পুরো মন্দির অন্ধকারে ডুবে গেল, আর বাতাস যেন হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল।

নিঃশ্বাস নেওয়াই যেন কঠিন হয়ে গেল জয়ন্তর। চারদিকে শীতল হাওয়া বইতে লাগল, অথচ বাইরে ছিল গরমের রাত। অন্ধকার ভেদ করে দূরে কোথাও কারও মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এলো। সেই হাসি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকল, যেন কোনো নারী গভীর তৃপ্তি নিয়ে অশুভ আনন্দ করছে। জয়ন্তর বুকের ভেতর প্রথমবার কাঁপুনি ধরল। “কে?” সে গলা শুকিয়ে যাওয়া স্বরে ডাকল। কোনো উত্তর এলো না, শুধু হাসিটা আরও গাঢ় হলো, আরও কাছে এল। হঠাৎ মন্দিরের ভেতরে শঙ্খনাদ বেজে উঠল—ভয়ঙ্কর, তীব্র, কর্ণবিদারক। কোনো মানব কণ্ঠে এই শঙ্খ বাজতে পারে না। শঙ্খনাদের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের দেওয়াল যেন কেঁপে উঠল, পাথর থেকে ধুলো ঝরতে লাগল। জয়ন্তর হাত থেকে লণ্ঠন পড়ে ভেঙে গেল। চারদিক নিস্তব্ধ অন্ধকারে ডুবে গিয়ে শুধু সেই শঙ্খের গর্জন আর হাসির প্রতিধ্বনি ভেসে বেড়াতে লাগল। জয়ন্ত হঠাৎ অনুভব করল তার পায়ের নিচে মাটি যেন সরে যাচ্ছে, চারপাশের বাতাস জমাট বাঁধছে।

জয়ন্ত যিনি এতদিন যুক্তির যুক্তি খুঁজে বের করতে মরিয়া ছিলেন, তার শরীরে প্রথমবার ভয় প্রবলভাবে প্রবেশ করল। গলা শুকিয়ে গেছে, কপালে ঘাম জমেছে, শরীর জমে আসছে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে পেছনে ফিরল, কিন্তু মন্দিরের দরজাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, যেন সে আর বেরোতে পারবে না। তার কানে ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই নারীকণ্ঠের হাসি, শঙ্খনাদ, আর শূন্যতার গম্ভীর গুঞ্জন। জয়ন্তর মনে হলো—কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, কারও জ্বলন্ত চোখ অন্ধকার ভেদ করে তাকে বিদ্ধ করছে। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা সেই ভয় আর অস্বীকার করার মতো রইল না। সে বুঝতে পারল, অন্ধকারকে মিথ্যে ভেবে যাত্রা শুরু করলেও এখন সে এমন এক শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে গেছে, যা কেবল কুসংস্কার নয়, যা কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। জয়ন্ত কাঁপা হাতে দেওয়ালের ভর ধরে দাঁড়াল, কিন্তু তার ভিতরে প্রথমবার আতঙ্কের বাস্তব ছাপ গেঁথে গেল। অমাবস্যার রাত এখন আর কেবল রাত নয়—এটা হয়ে উঠল দেবীর উপস্থিতির এক ভৌতিক আহ্বান।

সাত

মন্দিরের ভেতর শঙ্খনাদের গর্জন ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে না হতেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এক অদ্ভুত লালচে আলো। প্রথমে মনে হচ্ছিল অন্ধকারের ভেতর থেকে কেউ আগুন জ্বালিয়েছে, কিন্তু পরক্ষণেই বোঝা গেল—ওটা আগুন নয়, বরং ধোঁয়ার আস্ত এক সাগর, যেটা মাটির ফাঁক, দেওয়ালের ফাটল, এমনকি দেবীর আসন থেকেও বেরিয়ে আসছে। সেই ধোঁয়া ধীরে ধীরে রক্তাভ আভা নিতে শুরু করল। জয়ন্ত প্রথমে ভেবেছিল এটা তার কল্পনা, হয়তো প্রদীপ নেভানোর পর ভয়ের কারণে মনের ভেতর দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে। কিন্তু ধোঁয়ার ভেতর থেকে ভেসে আসা তীব্র গন্ধ, পোড়া ধূপ আর অচেনা অশুভ ঘ্রাণ তাকে কাঁপিয়ে দিল। সে দেখল ধোঁয়ার মধ্যে একটা অবয়ব গড়ে উঠছে। প্রতিটি মুহূর্তে সেই অবয়ব আরও স্পষ্ট হচ্ছে—চোখ দুটো যেন রক্তে রাঙানো, চুলগুলো উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আকাশ পর্যন্ত, হাতে ধরা আছে এক ভয়ঙ্কর বেত্র, আর চারদিকে ঘূর্ণায়মান অগ্নিশিখার মতো জ্বলজ্বলে রেখা। জয়ন্তর বুকের ভেতর তীব্র শীতলতার ঢেউ আছড়ে পড়ল। এ দৃশ্য যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, এ যেন সময়ের গর্ভ থেকে উঠে আসা এক অলৌকিক শক্তি।

পানবিবির আবির্ভাব সেই মুহূর্তে যেন মন্দিরের প্রতিটি কোণে বজ্রপাত ঘটাল। চারদিক কেঁপে উঠল, ভাঙাচোরা দেওয়াল থেকে ধুলো ঝরে পড়তে লাগল, শেওলা ছিঁড়ে মাটিতে পড়ল, বাদুড়েরা উন্মত্ত হয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল। দেবীর চোখের দৃষ্টি এতটাই ভয়ঙ্কর যে জয়ন্ত সেদিকে তাকাতে গিয়েও চোখ নামিয়ে নিল। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, হাত-পা কাঁপছিল অদম্য আতঙ্কে। পানবিবির রক্তাভ চোখ যেন সোজা তার আত্মার ভেতরে প্রবেশ করছে। সেই চোখে ছিল ক্রোধ, ছিল অপমানের প্রতিশোধ, ছিল যুগ যুগ ধরে জমে থাকা অশুভ শক্তির বিস্ফোরণ। দেবীর উন্মুক্ত কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো বজ্রনাদের মতো গর্জন—কোনো ভাষায় নয়, তবু প্রতিটি শব্দ যেন বিদ্যুতের শক দিয়ে জয়ন্তর শরীরকে ছিন্নভিন্ন করছে। তার হাতে ধরা বেত্র আকাশে ঘূর্ণি তুলে নামল, আর সেই আঘাতে মন্দিরের মেঝে ফেটে গিয়ে ভেতর থেকে অগ্নি ঝরতে লাগল। জয়ন্ত শিউরে উঠল, তার চোখে ভয়ের জল জমে গেল, ঠোঁট শুকিয়ে এল, আর বুকের ভেতর থেকে শুধু একটাই কথা ভেসে উঠল—“এটা সত্যি!”

এবার জয়ন্তর সমস্ত যুক্তি, সমস্ত আধুনিক চিন্তা-ভাবনা মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সে এতদিন ধরে গ্রামবাসীকে বোঝাতে চেয়েছিল—ভয় কেবল কুসংস্কার, দেবী নিতান্তই লোককথার অংশ। কিন্তু সেই দেবী এখন তার সামনে অগ্নিমূর্তিতে দাঁড়িয়ে। জয়ন্ত কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ল। তার মনের ভেতর ভেসে উঠল সুবল দাসের গল্প, রাধাকান্ত পণ্ডিতের সতর্কবাণী, আর কোমলিকার সেই অনুনয়ভরা চোখ—সবকিছুই যেন এখন তীক্ষ্ণ সত্য হয়ে উঠল। দেবীর আগুনে রাঙা দৃষ্টি যেন তার সমস্ত অহংকার, সমস্ত জেদ গলিয়ে দিল। জয়ন্ত বুঝতে পারল, তার একটুখানি কৌতূহল, তার একটুখানি প্রমাণ খোঁজার আকাঙ্ক্ষা গ্রামের শতাব্দীর বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সে এক নিমেষে উপলব্ধি করল—বিশ্বাস ভাঙা মানে শুধু ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা নয়, বরং এমন এক শক্তির সামনে দাঁড়ানো, যা মানব যুক্তির বাইরে। জয়ন্তর ঠোঁট কাঁপছিল, সে অস্ফুটে বলতে লাগল, “আমি ভুল করেছি… আমি জানতাম না…”

পানবিবির অগ্নিমূর্তি তখনও ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। তার চুল উন্মুক্ত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মতো আকাশে উঠছে, চোখ থেকে রক্তের ঝলক বেরিয়ে আসছে, আর প্রতিটি পদক্ষেপে মন্দিরের মাটি কেঁপে উঠছে। জয়ন্ত হাঁটু গেড়ে পড়ে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে আর গবেষক নয়, আর যুক্তির সৈনিক নয়, বরং ভয়ে জমে যাওয়া এক অসহায় মানুষ। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। দেবীর হাতের বেত্র ধীরে ধীরে তার দিকে নামতে শুরু করল, আর সেই মুহূর্তে জয়ন্ত বুঝল—তার সমস্ত কৌতূহল, সমস্ত তর্ক, সমস্ত অহংকার এখন আর কোনো কাজে আসবে না। এই মুহূর্তে সে শুধু প্রার্থনা করতে পারল—“মা, আমাকে ক্ষমা করো।” কিন্তু দেবীর চোখে দয়া ছিল না, সেখানে ছিল শুধু রক্তের মতো জ্বলন্ত প্রতিশোধ। মন্দিরের চারদিকে বজ্রপাতের মতো শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আর সেই শব্দের ভেতর জয়ন্তর আত্মা বুঝতে পারছিল—সে এখন আর কেবল নিজের জন্য নয়, পুরো গ্রামের জন্যই ভয়ঙ্কর এক বিপদের দরজা খুলে দিয়েছে।

আট

অমাবস্যার রাতের সেই ঘটনার পর গ্রাম যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দুনিয়ায় প্রবেশ করল। ভোর হতেই দেখা গেল, গ্রামের আকাশে কাক ডাকছে না, গরু-বাছুর চারণে বের হচ্ছে না, এমনকি শিশুরা কান্নাকাটিও করছে না—সবকিছু যেন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে। অথচ সেই নিস্তব্ধতার ভেতরে ছিল ভয়ঙ্কর চাপা আতঙ্ক, যা প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কেউ কেউ ঘুম ভেঙে শরীরে অজানা জ্বর নিয়ে কাঁপতে শুরু করল, কারও চোখ রক্তাভ হয়ে গেল, আবার কেউ মাঝরাতে হঠাৎ হাহাকার করে উঠল। গ্রামের মহিলারা দেবীর নাম জপ করতে করতে শিউরে উঠছিলেন, পুরুষরা ঘরের আঙিনায় আগুন জ্বালিয়ে রক্ষাকবচ তৈরি করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তবু সেই ভয়ের ছায়া কাটছিল না। মানুষের চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—দেবী সত্যিই ক্রুদ্ধ হয়েছেন। গ্রামের বয়স্ক লোকেরা বলছিলেন, “এমন ভয় আমরা কোনোদিন দেখি নাই।” আতঙ্ক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে গ্রামের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। সবাই একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল—কার জন্য দেবী রুষ্ট, কার কারণে এত বিপদ? আর সেই প্রশ্নের উত্তর সবাই জানত—জয়ন্ত।

রাধাকান্ত পণ্ডিত এই অবস্থায় গ্রামবাসীকে একত্রিত করলেন। তার কণ্ঠে ছিল কঠোর দৃঢ়তা, তবু ভয়ও লুকোনো ছিল না। তিনি বললেন, “এখন আর দেরি করলে চলবে না। মা-কে শান্ত করতে হবে, নয়তো এই গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে।” সুবল দাস তখন পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, “আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, মায়ের ক্রোধ নিবারণের একমাত্র উপায় বিসর্জনের আচার। শাস্ত্র মেনে, নিষ্ঠা নিয়ে সেই আচার না করলে গ্রাম রক্ষা পাবে না।” মানুষজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাথা নুইয়ে ফেলল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ঢাক-ঢোলের প্রস্তুতির শব্দ, মাটির প্রদীপ জ্বালানোর আয়োজন। মহিলারা কলসি ভর্তি গঙ্গাজল আনতে শুরু করলেন, পুরুষরা মন্দির ঘিরে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করতে লাগল। যেন সমগ্র গ্রাম আতঙ্কে কেঁপে উঠেও সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছে—মায়ের ক্রোধ প্রশমিত করার। জয়ন্ত তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছিল সবকিছু। তার চোখ ফাঁকা হয়ে গেছে, মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সে জানত, গ্রামের এই ভয়, এই আতঙ্কের জন্য দায়ী সে নিজেই। কিন্তু পালানোর কথা ভাবেনি। তার ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি কাজ করছিল—সে সবকিছু নিজের চোখে দেখতে চায়, শেষ পর্যন্ত বুঝতে চায় দেবীর শক্তির সত্য।

যখন আচার শুরু হলো, মন্দির প্রাঙ্গণ ভরে গেল ধূপধুনোর ধোঁয়ায়। ঢাকের শব্দে বাতাস কেঁপে উঠছিল, শঙ্খনাদের প্রতিধ্বনি দূর থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। রাধাকান্ত পণ্ডিত মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে দেবীর সামনে গঙ্গাজল ঢালছিলেন, সুবল দাস আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছিলেন। গ্রামের মানুষ প্রার্থনায় ডুবে যাচ্ছিল, কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। এই সময়েই আবার শুরু হলো ভয়ঙ্কর কিছু লক্ষণ। হঠাৎ মাটিতে কাঁপন শুরু হলো, যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। কয়েকজন মানুষ হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠল—তাদের চোখ লাল হয়ে গেল, মুখ থেকে অদ্ভুত ভাষায় কথা বের হতে লাগল, যেন তারা নিজেরা নেই, অন্য কেউ তাদের দেহ দখল করে নিয়েছে। মহিলারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মূর্ছা গেলেন, শিশুরা হাহাকার করে উঠল। কিন্তু রাধাকান্ত পণ্ডিত থামলেন না। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে মন্ত্র জপ করতে থাকলেন, আর সুবল দাস বললেন, “ভয় পাবেন না, এ-ই হল মায়ের ক্রোধের চিহ্ন। যতক্ষণ না বিসর্জন সম্পূর্ণ হয়, এভাবে চলতেই থাকবে।” জয়ন্ত দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে শরীর কাঁপতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি মন্ত্র, প্রতিটি আচার তার বুকের ভেতর আঘাত করছে। সে বুঝতে পারছিল—এখন আর কোনো যুক্তি বা বিজ্ঞান এখানে কার্যকর নয়, এটা অন্য এক জগতের লড়াই।

ধীরে ধীরে আচার এগোতে থাকল। রক্তাভ চাঁদের আলো তখন মন্দিরকে ভৌতিক করে তুলেছিল। গঙ্গাজল দেবীর মূর্তির সামনে ঢালা হলো, আগুনে ছিটানো হলো অঞ্জলি, আর পুরোহিত দেবীর উদ্দেশে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। গ্রামের মানুষ সম্মিলিতভাবে একসাথে মাথা নত করে প্রার্থনা করল—“মা, আমাদের রক্ষা করো।” বাতাসে সেই প্রার্থনার কাঁপন ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন মানুষের আত্মাই দেবীর পায়ে বিসর্জন দিচ্ছে। জয়ন্ত তখন মাটিতে বসে পড়েছিল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল, শরীর কাঁপছিল, তবু সে চোখ ফিরিয়ে নিল না। সে দেখতে চাইল শেষ পর্যন্ত কী হয়। তার ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব কাজ করছিল—একদিকে গভীর অনুশোচনা, অন্যদিকে সত্য জানার অদম্য ইচ্ছা। গ্রামের সবাই দেবীর শান্তি কামনায় প্রাণপাত করছে, আর জয়ন্ত সেই ভয়ের ভেতর দিয়েই খুঁজছিল উত্তর। আচার চলতেই থাকল, আতঙ্ক আরও বাড়ল, কিন্তু এর ভেতরেই জয়ন্ত বুঝতে পারল—এখন তার জীবন আর তার নিজের হাতে নেই। দেবীর করুণায় কিংবা ক্রোধেই নির্ধারিত হবে তার ভবিষ্যৎ, আর হয়তো সমগ্র গ্রামেরও।

নয়

মন্দির প্রাঙ্গণে আতঙ্ক তখনও ঘনীভূত হয়ে আছে। ঢাকের শব্দ ক্রমশ বেসুরো হয়ে উঠছে, শঙ্খের ধ্বনি কাঁপতে কাঁপতে স্তব্ধ হয়ে আসছে, গ্রামের মানুষ একে একে ভয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। দেবীর ক্রোধ যেন আর কোনো আচার-অনুষ্ঠানে দমছে না। রাধাকান্ত পণ্ডিত ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, সুবল দাস কণ্ঠ ভাঙা মন্ত্রে একটানা প্রার্থনা করে যাচ্ছেন, অথচ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এই সময় কোমলিকা দাঁড়িয়ে উঠল। তার চোখে ভয়ের চিহ্ন নেই, বরং গভীর দৃঢ়তা। এতদিন ধরে তার ভেতরে যে দ্বন্দ্ব চলছিল—একদিকে দেবীর প্রতি ভক্তি, অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষায় বেড়ে ওঠা যুক্তিবাদী মন—সেই দ্বন্দ্ব হঠাৎ যেন মুছে গেল। সে বুঝতে পারল, বিশ্বাস আর যুক্তি এখানে প্রতিযোগিতায় নেই; এখানে দরকার আত্মসমর্পণ। সে অনুভব করল, দেবীর ক্রোধ নিবারণ করার জন্য শুধু আচার নয়, কারও ব্যক্তিগত ত্যাগ প্রয়োজন। আর সেই দায়িত্ব যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার নিজের কাঁধে এসে পড়েছে। কোমলিকা চারপাশে তাকাল, আতঙ্কিত গ্রামবাসীর চোখে শুধু ভয়ের ছাপ, কিন্তু কারও মধ্যে নেই সেই সাহস যা প্রয়োজন। তখনই সে চুপচাপ সামনে এগিয়ে গেল, মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে দেবীর সামনে দাঁড়াল।

চারদিকের আলো তখন অদ্ভুত রক্তাভ হয়ে উঠেছে। দেবীর অগ্নিমূর্তি যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। উন্মুক্ত চুলের ঘূর্ণি আকাশে ছুটছিল, চোখ থেকে রক্তের মতো ঝলক ছড়িয়ে পড়ছিল। বেত্র হাতে দেবী গর্জন করছিলেন, যেন আরেকবার আঘাত নামালেই সবকিছু ভস্ম হয়ে যাবে। সেই মুহূর্তেই কোমলিকা মূর্তির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সে নিজের কাপড়ের আঁচল ছিঁড়ে হাতের কব্জি মেলে ধরল, আর একটি ধারালো কাঁচের টুকরো দিয়ে নিজের হাতে ক্ষত করল। সাথে সাথে রক্ত ঝরতে শুরু করল। গ্রামের মানুষ চিৎকার করে উঠল—“না! থামাও তাকে!”—কিন্তু কেউ এগিয়ে আসতে পারল না। জয়ন্ত আতঙ্কে স্থির হয়ে গেল, তার শরীর শিউরে উঠল, কিন্তু কোমলিকার চোখে তখন ছিল এক অদ্ভুত জ্যোতি। সে রক্তমাখা হাত তুলে দেবীর দিকে প্রার্থনায় যোগ করল—“মা, আমি তোমার কাছে নিজের রক্ত দিলাম। আমার প্রাণ যদি লাগে, তবে তুমি নিয়ে নাও। কিন্তু গ্রামকে রক্ষা করো, এই মানুষদের রক্ষা করো।” তার কণ্ঠে ছিল না কোনো ভয়ের ছাপ, ছিল না কোনো দ্বিধা—ছিল কেবল এক অনন্ত আস্থার শক্তি।

দেবীর রক্তাভ চোখ তখন কোমলিকার দিকে স্থির হয়ে রইল। মুহূর্তের জন্য যেন বজ্রপাত থেমে গেল, মন্দিরের কাঁপনও থমকে দাঁড়াল। সেই অগ্নিমূর্তির গর্জন একটুখানি থেমে গিয়ে নিস্তব্ধতার গভীরতা ছড়িয়ে দিল। কোমলিকার হাত থেকে রক্ত ফোঁটা ফোঁটা করে মাটিতে পড়ছিল, আর প্রতিটি ফোঁটার সাথে যেন বাতাসে এক নতুন সুর ভেসে উঠছিল—ভক্তির সুর। দেবী ধীরে ধীরে তার বেত্র নামিয়ে আনলেন, কিন্তু এ আঘাতের জন্য নয়, বরং যেন পরীক্ষা করার জন্য। গ্রামের সবাই শ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল। জয়ন্ত অনুভব করল, এই মুহূর্তে মানবতার সবচেয়ে বড় শক্তি—ত্যাগ—দেবীর সামনে নিজের আসন খুঁজে নিয়েছে। দেবীর চোখের রক্তাভ ঝলক কিছুটা ম্লান হয়ে এল, তার চুলের ঘূর্ণি ধীরে ধীরে থেমে গেল। দেবীর অগ্নিমূর্তি আগের মতো ভয়ঙ্কর আর নয়, বরং এক অদ্ভুত শান্তির আভায় আবৃত হতে শুরু করল। যেন কোমলিকার ভক্তি আর সাহস দেবীর ক্রোধকে ধীরে ধীরে প্রশমিত করছে। মন্দিরের ভেতরে ভেসে এলো শঙ্খের মধুর ধ্বনি, যা আগে ছিল ভয়ঙ্কর, এখন যেন শান্তির প্রতীক।

রাধাকান্ত পণ্ডিত তখন হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে ফেললেন। সুবল দাস চোখ ভিজে প্রার্থনা করতে লাগলেন। গ্রামের মানুষ বিস্ময়ে ভরে গেল, কেউ কাঁদতে লাগল, কেউ আবার হাততালি দিয়ে দেবীর জয়ধ্বনি করতে শুরু করল। কিন্তু কোমলিকা তখনও রক্তাক্ত হাত তুলে বসে আছে, তার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু সে প্রার্থনা থামাচ্ছে না। “মা, আমি তোর মেয়ে… আমি কিছু চাই না, শুধু তুই রুষ্ট হোস না।” ধীরে ধীরে দেবীর অগ্নিমূর্তি আভায় রূপান্তরিত হয়ে আকাশের দিকে মিলিয়ে গেল। শেওলায় ঢাকা মন্দিরের দেওয়াল আর কাঁপছিল না, বাতাসও শান্ত হয়ে এলো। মানুষের চোখে এক নতুন আলো জ্বলে উঠল—দেবী ক্রোধ ত্যাগ করেছেন। জয়ন্ত হাঁটু গেড়ে বসে কোমলিকার দিকে তাকাল, তার বুক ভরে উঠল গভীর শ্রদ্ধা আর অনুতাপের অশ্রুতে। সে উপলব্ধি করল, যেটা সে সারা জীবন যুক্তি দিয়ে খুঁজতে চেয়েছিল, সেই সত্যকে প্রমাণ করল কোমলিকা নিজের ত্যাগ দিয়ে। মানুষের বিশ্বাস, ভক্তি, আর আত্মসমর্পণের শক্তি কোনো গবেষণার বিষয় নয়—ওটা অনুভবের, ওটা জীবনের গভীরতম শক্তি। কোমলিকার রক্ত ঝরল, কিন্তু তার ভক্তি গ্রামকে বাঁচাল। সেই রাতে গ্রামের মানুষ শুধু দেবীকে নয়, কোমলিকাকেও মা জ্ঞান করে মাথা নত করল।

দশ

মন্দিরে রাতের ভৌতিক ঘূর্ণি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছিল। আকাশে তখনো অমাবস্যার অন্ধকার, তবুও দূরে পূর্ব দিগন্তে ভোরের আগমনী আভাস মৃদু সোনালি রেখা হয়ে ফুটতে শুরু করেছিল। দেবীর অগ্নিমূর্তি আর নেই, রক্তাভ ধোঁয়া মিলিয়ে গিয়ে চারপাশে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে। মন্দিরের ভেতর, যেখানে কিছুক্ষণ আগেও বজ্রগর্জন আর শঙ্খনাদের প্রতিধ্বনি ভর করে ছিল, এখন সেখানে শুধুই নিস্তব্ধতা। শেওলায় ঢাকা দেওয়াল যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, বটগাছের পাতায় শিশির জমে ঝরতে শুরু করল। কোমলিকা অচেতন হয়ে মন্দিরের সিঁড়িতে পড়ে আছে, তার হাতের ক্ষত থেকে রক্ত জমে গেছে, তবুও ঠোঁটে এখনো যেন প্রার্থনার ছাপ লেগে আছে। গ্রামের মানুষ ভয়ে-ভক্তিতে কাঁপতে কাঁপতে একে একে এগিয়ে এলো, কেউ তার মাথায় জল ছিটিয়ে দিল, কেউ কপালে হাত রাখল। তারা সবাই বুঝতে পারল—দেবী এবার শান্ত হয়েছেন, আর সেই শান্তির মূল উৎস এই মেয়ের ত্যাগ। ভোর হওয়ার আগে দেবীর রূপ সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে গেল, শুধু বাতাসে রয়ে গেল এক গভীর আভা, যা প্রত্যেককে মনে করিয়ে দিল—“পানবিবির আসর” কেবল সাময়িকভাবে থেমেছে, চিরতরে নয়।

গ্রামবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে ছিল জয়ন্তর দিকে। সেই শহুরে গবেষক, যিনি এতদিন এই লোকবিশ্বাসকে নিছক কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, এখন তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। জয়ন্তের বুকের ভেতর থেকে যেন এক ভারি বোঝা সরে গেল। সে কোমলিকার পাশে বসে তার ক্ষত বাঁধতে লাগল, তারপর মাথা নিচু করে বলল—“আমি ভুল ছিলাম। আমি বুঝতে পারিনি এই বিশ্বাসের গভীরতা, এই ভক্তির শক্তি।” তার কণ্ঠে ছিল আন্তরিক অনুতাপ আর এক নতুন উপলব্ধি। রাধাকান্ত পণ্ডিত ধীরে ধীরে তার কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন—“বাবা, দেবী অলৌকিক হতে পারেন, আবার মানুষের ভেতরের শক্তিও হতে পারেন। বিশ্বাস মানে শুধু অন্ধতা নয়, সেটা আমাদের ভয়ের সীমা অতিক্রম করার সাহস।” সুবল দাস কাঁপা গলায় যোগ করলেন—“আজ তুমি চোখে দেখলে, যে শক্তি আমরা শতাব্দী ধরে মানি, তা কেবল কাহিনী নয়, তা জীবন্ত।” জয়ন্ত মাথা নত করে সেই কথার সত্যতা স্বীকার করল। তার ভেতরের যুক্তিবাদী মনোভাব নিভে যায়নি, কিন্তু তা নতুন আলোয় বদলে গেছে—এখন সে জানে, যুক্তি আর ভক্তি দুটোই মিলেই মানুষের জীবনের সম্পূর্ণতা তৈরি করে।

সকাল গড়াতেই গ্রাম ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরল। আতঙ্কিত মুখগুলোতে আবার আলো ফিরল, মন্দিরের দরজা আবার খোলা হলো। মানুষ মিলে পরিষ্কার করতে শুরু করল মন্দিরের চত্বর—পড়েছিল ভাঙা প্রদীপ, ভস্ম হয়ে যাওয়া ধূপ, আর শুকনো রক্তের দাগ। কিন্তু সেই দাগ তারা মুছে ফেলল না, বরং ফুল দিয়ে সাজাল, কারণ সেটাই ছিল দেবীর ক্ষমার প্রতীক এবং কোমলিকার ত্যাগের চিহ্ন। নারীরা শঙ্খ বাজাতে লাগল, পুরুষেরা জয়ধ্বনি তুলল—“পানবিবি মা কি জয়!” গ্রামের প্রতিটি মানুষ বুঝতে পারল, এই রাতের অভিজ্ঞতা কেবল ভয় নয়, বরং ভক্তির শক্তির সাক্ষ্য। কোমলিকা ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেল, তার চোখে দুর্বলতা থাকলেও ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। সে শান্ত কণ্ঠে বলল—“মা রুষ্ট ছিলেন, এখন তিনি ক্ষমা করেছেন।” গ্রামের মানুষ তাকে ঘিরে ধরল, কেউ তার পায়ে হাত রাখল, কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ নিল। কোমলিকা যেন নিজের অজান্তেই দেবীর আশীর্বাদের প্রতিনিধি হয়ে উঠল।

জয়ন্ত গ্রাম ছাড়ল না। সে জানল, তার গবেষণা এখন আর কেবল কাহিনী সংগ্রহ নয়, বরং মানুষের বিশ্বাসের শক্তি বোঝার এক আজীবন যাত্রা। তার চোখে কোমলিকা আর গ্রামবাসীরা হয়ে উঠল জীবন্ত দলিল, আর মন্দির হয়ে উঠল তার কাছে প্রমাণ যে যুক্তির বাইরে এমন এক জগৎ আছে, যা কেবল অনুভব করা যায়। মন্দির আবার নিয়মিত পূজার জন্য খুলে দেওয়া হলো, কিন্তু সবাই জানে—“পানবিবির আসর” নিছক কোনো পূজা নয়, এটি দেবীর শক্তির এক চিরন্তন উপস্থিতি, যা আবার জেগে উঠতে পারে যদি কেউ নিয়ম ভাঙে বা ভক্তিকে অস্বীকার করে। গ্রামের প্রাচীন কিংবদন্তি এখন নতুন করে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাবে—কোমলিকার ত্যাগের গল্প, জয়ন্তর পরিবর্তনের কাহিনী, আর দেবীর ভীতিকর কিন্তু ন্যায়পরায়ণ রূপের শিক্ষা। সূর্যের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, মন্দির স্নান করল সেই আলোয়, আর মানুষ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—তারা বিশ্বাস রাখবে, তারা নিয়ম মানবে, কারণ তারা জানে, আসর থেমেছে বটে, কিন্তু তার ডাক এখনো লুকিয়ে আছে রাতের অন্ধকারে, আবার জেগে ওঠার অপেক্ষায়।

শেষ

1000059723.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *