Bangla - তন্ত্র

পাঁচ মুখো তান্ত্রিক

Spread the love

অরুণাভ ভট্টাচার্য


সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে, কিন্তু কালীঘাটের শ্মশানে সেই আলো-আঁধারির খেলা যেন কালেরও ঊর্ধ্বে। পুরনো বটগাছের গায়ে লেপ্টে থাকা শ্যাওলার মতো এক ধরণের অদৃশ্য আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল চারপাশে। অগস্ত্য ধীর পায়ে ঢুকল ভেতরে। মাথায় পুরনো ছাইরঙা চাদর, চোখে লালসালুকে ছেয়ে যাওয়া অভ্যস্ত দৃষ্টির অভিব্যক্তি — এক সমাজচ্যুত তান্ত্রিক, যার নাম এখন আর কেউ স্মরণ করে না। কেউ বলে সে পাগল, কেউ বলে অভিশপ্ত, কিন্তু সে জানে — সে ফিরে এসেছে শ্মশানে একটা মাত্র মুখ খুঁজতে, যেটা তার নিজের। এখানে, এই আগুন আর ছাইয়ের ভেতরে লুকিয়ে আছে সেই মুখ — পাঁচ মুখো তান্ত্রিকের একটি অংশ — যে নাকি শুধুমাত্র শ্মশানে দেখা দেয়, আর যার দেখা পাওয়া মানেই জীবন আর আগের মতো থাকে না। দূরে দূরে কিছু চিতার আগুন নিভে এসেছে, পোড়া গন্ধ বাতাসে ভাসছে। বাতাসে ঘন কুয়াশা, যেন মৃতদের আত্মা ঘোরাফেরা করছে। হঠাৎ করেই একটি ধ্বস্ত চিৎকার ভেসে এলো — একটা শিয়াল হয়তো নতুন কোনো মৃতদেহের হাড় নিয়ে টানাটানি করছে। অগস্ত্য থেমে দাঁড়াল, চোখ বন্ধ করল, আর হঠাৎই তার শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠল — ঠিক কানের পাশে একটা ফিসফিস আওয়াজ — “তুই এসে গেছিস আবার?”

ভেতরের গলি ধরে এগিয়ে গেল সে — যেখানে আগে তার গুরু থাকতেন। এখন সেখানে ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে থাকা কিছু পোড়া কাঠ আর চিহ্নহীন ছাই। সেই জায়গাটাতে বসে পড়ে সে, হাতে তুলে নেয় একটা তিন-শিখা ধূপদানি — যেটা সে একসময় গুরুপ্রণামে ব্যবহার করত। তার মনে পড়ে সেই দিন — যেদিন সে গোপনে নিজের গুরুর মন্ত্রচর্চা দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল, আর তার গুরু তাকে বলেছিলেন, “তুই এখনো প্রস্তুত নস। তোর মনের মধ্যে পাঁচটা দৃষ্টি জন্ম নেবে একদিন, পাঁচ মুখে দেখবি তুই নিজেকে। তার আগে তুই শুধু ছায়া।” সেই কথা আজও অগস্ত্যর রক্তে খোদাই হয়ে আছে। সে জানে, সেই পাঁচ মুখের একটি মুখ তার নিজের — কিন্তু কোনটা, কিভাবে, কেন? বৃন্দাবনী দাসী, সেই বৃদ্ধা কালীসাধিকা, হঠাৎই এসে হাজির হন। তাঁর গলার স্বর এখনো একইরকম — কর্কশ অথচ গভীর, যেন মাটির ভেতর থেকে উঠে আসছে। “তুই ফেরার কথা ছিল, আমি জানতাম,” বলে তিনি একটা লাল আলতা-দাগ লাগানো পাথরের দিকে ইঙ্গিত করেন — “ওখান থেকে শুরু কর।” অগস্ত্য চমকে উঠে বলে, “তুমি জানো আমি কাকে খুঁজছি?” বৃন্দাবনী হেসে বলেন, “যে নিজেকে খোঁজে, সে তো একে একে পাঁচ রূপে নিজেকেই খুঁজে পায়।”

রাত্রি গাঢ় হয়ে এসেছে। শ্মশানের মধ্যে বাতি জ্বলে না, জ্বলে শুধু চিতার আলো আর মানুষের ভেতরের ভয়। অগস্ত্য সেই পাথরের ওপর বসে ধ্যান শুরু করে — একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কালীমূর্তির ছায়ার দিকে, যেটা গঠিত হচ্ছে দূরের একটা চিতার কম্পমান আলোয়। কিছুক্ষণ পরেই তার চোখে ভেসে ওঠে একটা মুখ — অস্পষ্ট, অন্ধকারে ঢাকা, চোখদুটি জ্বলছে আগুনের মতো। মুখটি স্পষ্ট নয়, যেন একাধিক মুখ একসাথে গলে গেছে — বিভ্রান্তিকর এক চেহারা। তার মুখে শোনা যায় গুনগুন শব্দ, যা কোনো মন্ত্রের ছায়া — কিন্তু সুরটা যেন খুব চেনা। তার মাথার ভেতর অদ্ভুত চাপ তৈরি হয়, এবং হঠাৎ সে অনুভব করে যেন পেছন থেকে কেউ তার কাঁধে হাত রাখল। কিন্তু ফিরে তাকাতেই দেখা গেল কিছু নেই। এই মুহূর্তে সে বুঝে গেল — সে দেখা পেতে শুরু করেছে। সেই মুখ সত্যিই এখানে আছে। হয়তো শুধু ছায়ায়, হয়তো কেবল তার চেতনায়। কিন্তু সে জানে, এই মুখগুলো তারই জন্য অপেক্ষা করছিল এতদিন ধরে। অগস্ত্য ধীরে ধীরে নিজের চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, “আমি এসেছি, আমাকে চিনে নাও।” ছায়া যেন একটু নড়ে ওঠে, আর পেছনের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে যেতে বলে — “এটা তো কেবল শুরু। পাঁচ রূপে তুই নিজেকেই চিনবি। আর প্রতিটা রূপই তোকে পোড়াবে।”

শ্মশানের পেছনের দিকে, যেখানে এখন আর কেউ যায় না, সেই ভাঙা শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল অগস্ত্য। জায়গাটা বহু বছর আগে সন্ন্যাসীদের ধ্যানে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু এখন কেবল মৃত পাতা, ছিন্ন ছাদ, আর ভাঙা চূড়োর নিচে ঠাঁই নিয়েছে চামচিকেরা আর গন্ধহীন ফুল। বৃন্দাবনী দাসী তাকে জানিয়েছিলেন, সেই পুরনো চাতালের নিচে একটা চোরা গুহা আছে — যেখানে পাঁচ মুখের প্রথম প্রতীক খোদাই করা ছিল। অনেকেই বিশ্বাস করত, এই মুখগুলোর মূর্তি প্রাচীন তন্ত্রমতে খোদিত হয়েছিল এক উন্মাদ যোগীর হাতে, যার চোখ ছিল তিনটি এবং জিভ ছিল নীল। অগস্ত্য ধীরে ধীরে সেই জায়গায় পৌঁছে যখন জঙ্গলজমা ফাটল খুঁজে পায়, তখন সূর্য একেবারে অস্ত যাওয়ার মুখে। একটা পাথরের খাঁজে আঙুল চালাতেই মাটি কিছুটা নেমে যায় নিচে, এবং তার সামনে খুলে যায় এক সরু সিঁড়ির পথ — গন্ধময়, স্যাঁতস্যাঁতে, আর অন্ধকারে ভরা। মাটির নিচে নামতে নামতে সে দেখতে পেল দেওয়ালের গায়ে আঁকা অদ্ভুত কিছু প্রতিচ্ছবি — পাঁচটি মুখ, পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে বসে আছে — আগুন, জল, বায়ু, মৃত্তিকা আর মানুষের মনের প্রতীক হিসেবে। অগস্ত্য বুঝতে পারল, সে জায়গা কেবল প্রাচীন গুহা নয় — এটা যেন তার নিজের মনের অভ্যন্তরীণ পথ।

গুহার শেষ প্রান্তে একটা গোলাকার কক্ষ, যার মাঝে ছিল একটি প্রাচীন পঞ্চভুজ আকৃতির চক্র। তার প্রতিটি কোণ জুড়ে একটি মুখের রূপরেখা খোদাই — কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় ছিল, মাঝখানে বসে থাকা এক ভগ্ন মূর্তি, যার মুখ একেবারে মুছে গেছে। যেন কোনো চরম শক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সেটাকে অপসৃত করেছে। অগস্ত্য ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ল সেই চক্রের মাঝে। তার হাতে ছিল এক পুরনো রুদ্রাক্ষ মালা — গুরুর দেওয়া — যা আজ পর্যন্ত সে আগলে রেখেছে। সে ধ্যান শুরু করল, উচ্চারণ করল সেই মন্ত্র যা এককালে তার গুরু গোপনে বলতেন — কিন্তু আজ সে নিজের করেই উচ্চারণ করছে: “অগ্নি, আপঃ, বায়ু, ভূমি, মানস— এক হইয়া প্রকাশ হো।” প্রথমে কিছুই ঘটল না, তারপর হঠাৎই গুহার বাতাস যেন ভারী হয়ে এলো। এক অদৃশ্য কাঁপন অনুভব করল সে, এবং এক এক করে সেই পাঁচ মুখের খোদাই যেন প্রাণ পেয়ে উঠল — চোখ খুলে গেল, অশরীরি আলোয় জ্বলে উঠল গুহা। প্রতিটি মুখ যেন তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু কেবল গুঞ্জনের মতো আওয়াজ আসছে। তখনই মাঝখানে সেই ভগ্ন মুখহীন মূর্তিটা কেঁপে উঠল।

সেই মূর্তির বুক থেকে একটা হালকা ধোঁয়া বেরিয়ে এল, এবং অগস্ত্যর চারপাশে পাক খেতে শুরু করল। ধোঁয়ার মধ্যে সে দেখতে পেল নিজেরই ছায়াকে — কিন্তু সেই ছায়ার মুখ ধীরে ধীরে পাঁচটি মুখে ভেঙে যাচ্ছে। প্রথমে আগুন, তারপর জল, হাওয়া, মাটি, এবং শেষে এক অদ্ভুত ধূসর, স্মৃতিভরা মুখ — যার চোখের গভীরে ছিল অগস্ত্যরই চেনা একটি অভিমান। সেই মুখটি তাকে বলে উঠল, “তুই আমাকে খুঁজতে আসিস, অথচ আমি তো তোরই ভেতরে।” এরপর মুখগুলো মিলিয়ে গিয়ে মিশে গেল তার দেহের মধ্যেই। ধোঁয়া ধীরে ধীরে গায়েব হল, গুহা নিস্তব্ধ। অগস্ত্য শ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে, যেন তার ফুসফুসেও আজ প্রাচীন তন্ত্র ঢুকে পড়েছে। সে জানে, এই গুহা কেবল তার অনুসন্ধানের সূচনা নয়, বরং সে নিজেই এক সময় এই মুখগুলোর বাহক হয়ে উঠবে — কারণ পাঁচ মুখের এক মুখ তার নিজের। আর এই সত্য জানার পর তার ফেরার আর কোনো পথ নেই।

আগুনের গন্ধ তাকে সবসময় টানে। ছোটবেলায় কালীপুজোর রাতে যখন প্রথমবার চিতার ধারে বসেছিল, তখনই বুঝেছিল — আগুন কেবল আলো নয়, তা এক ভাষা, এক সত্তা। সেই আগুনই আজ তাকে ডেকেছে। অগস্ত্য আবার কালীঘাটের দক্ষিণ দিকে সেই পুরনো পোড়া চাতালে বসেছে, যেখানে একসময় তার গুরু চামুণ্ডা সাধন করতেন। সেই রাতটা বিশেষ — আজ অমাবস্যা, আর শ্মশান তার নিজস্ব জাগ্রত ভয়াবহতায় জ্বলছে। পেছনে এক পোড়া চিতা থেকে এখনো সোনালি ধোঁয়া উড়ছে। অগস্ত্যর চোখ স্থির, মনের মধ্যে সেই মন্ত্রঘোর— “অগ্নিমুখ প্রদীপ্তং, জ্বাল যন্ত্র সংহারঃ।” হঠাৎ, পোড়া কাঠের মধ্যে থেকে যেন গর্জনের মতো আওয়াজ উঠে এল, আর আগুন নিজে যেন ছায়া নিয়ে সোজা তার দিকে তাকাল। চিতার আগুন থেকে ধীরে ধীরে মাথা বের করল এক মুখ — আগুনরাঙা চোখ, তপ্ত কপাল, দহনধর্মী মুখাবয়ব। সেই মুখ কোন মানুষ নয় — তা যেন চলমান শিখার রূপ, মুখে গর্জনের মতো এক উচ্চারণ — “তুই আসবি জানতাম।”

অগস্ত্য শ্বাস আটকে রেখে বলল, “তুই কে? আমার অংশ?” আগুনের মুখ বলল, “আমি তোর রাগ, তোর অভিশাপ, তোর সেই মুহূর্ত — যখন তুই নিজের গুরুর উপর হাত তুলেছিলি।” এই কথা শুনে অগস্ত্যর গায়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে যায়। স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই রাত, যখন সে নিজের গুরুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল — কারণ সে বিশ্বাস করেছিল, গুরু তার শক্তি আটকে রাখছেন, তার প্রকৃত রূপে পৌঁছাতে দিচ্ছেন না। কিন্তু তাতে সে জানত না, প্রকৃত শক্তি লোভে নয় — ত্যাগে। সেই আগুন, যেটা গুরুর চক্রে তার হাত পুড়িয়ে দিয়েছিল, আজ আবার ফিরে এসেছে মুখ হয়ে। আগ্নিমুখ ধীরে ধীরে বলে, “তুই আগুনের সন্তান, কিন্তু আগুন তোর বন্ধুও নয়, শত্রুও নয়। আগুন বিচার করে না, পোড়ায় শুধু — যেমন তুই পোড়িয়েছিস সব।”
“তুই আমাকে কী করতে বলছিস?” — অগস্ত্য ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে। মুখ উত্তর দেয় — “তুই নিজেকে পোড়া, নিজের অহং পোড়া, তবেই আমি তোকে ছেড়ে যাবো।”

পোড়া কাঠের চুল্লির পাশে বসে অগস্ত্য নিজের কাঁধে গন্ধক মাখে — সে জানে, এই ধ্বংস থেকে তাকে নিজেকে বার করে আনতেই হবে। গায়ে গন্ধকের জ্বলন্ত গন্ধ, আগুনের ধোঁয়া চোখে জল আনছে, কিন্তু সে স্থির। তারপর সে এক পা এগিয়ে গিয়ে নিজের বাম হাত চিতার আগুনে ধরল — শুধু এক মুহূর্তের জন্য। তীব্র জ্বালায় সে কেঁপে ওঠে, চিৎকার না করেও চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। সেই মুহূর্তে আগ্নিমুখ হেসে উঠে বলে, “তুই পোড়াতে শিখলি, তুই সহ্য করতেও শিখলি। এবার তুই অগ্নিমুখ বয়ে চল। এক মুখ তোর হয়ে উঠল।” তারপর সেই মুখ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় আগুনের শিখায়। অগস্ত্য মাটিতে বসে পড়ে, তার কাঁধ কাঁপছে। সে জানে, পাঁচ মুখের প্রথমটি তার মধ্যে প্রবেশ করেছে — আগ্নিমন্ত্র তার রক্তে মিশে গেছে। কিন্তু এখনও চারটি মুখ বাকি — প্রতিটি নিজস্ব যন্ত্রণার বাহক, প্রতিটি নতুন এক উপলব্ধির দরজা। কিন্তু সে তৈরি, কারণ প্রথম সত্তা — ধ্বংসের সত্তা — তাকে গ্রহণ করেছে।

সেদিন রাতে অগস্ত্য গঙ্গার ধারে এল। আকাশ মেঘলা, ঘন অন্ধকার, বাতাসে জলজ গন্ধ। সে জানত আজ তাকে দ্বিতীয় মুখের সামনে দাঁড়াতে হবে — সেই মুখ, যা এক সময় ছিল কোমল, ভেজা, প্রেমময়। কিন্তু সেই মুখই তাকে কষ্ট দিয়ে গেছে, ছিনিয়ে নিয়ে গেছে তার হৃদয়ের এক টুকরো। রুক্মিণী — সেই মেয়েটির নাম, যে একদিন অগস্ত্যর জীবনের কেন্দ্র ছিল, আর এখন কেবল স্মৃতি। গঙ্গার পাড়ে এসে সে দেখে, বাতাস থমকে গেছে, আর মাঝ নদীতে একটা পুরনো শবদেহ বয়ে যাচ্ছে — অথচ আশ্চর্যভাবে কাক কিংবা কুকুরের কোনো শব্দ নেই। চারপাশ যেন নিঃশব্দ এক গহ্বরে পরিণত হয়েছে। অগস্ত্য হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, আর গঙ্গার জলে নিজের মুখ দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু বারবার সেই প্রতিচ্ছবির মধ্যে রুক্মিণীর মুখ ভেসে উঠছে — কখনো হাসিমুখ, কখনো হতাশ, কখনো চোখে জল। সে জানে, তার তান্ত্রিক জীবনের প্রথম বলি ছিল রুক্মিণী — না শরীরীভাবে, বরং মানসিকভাবে। তার প্রেমের উপর তন্ত্রকে বেছে নেওয়ার পেছনে ছিল গর্ব, অহংকার, ক্ষমতা-পিপাসা। আজ, এই গঙ্গাতীরে, সেই পাপই তাকে ডেকে এনেছে।

কয়েক মুহূর্ত পর, নদীর বুক থেকে উঠতে শুরু করল ধোঁয়ার মতো হালকা কুয়াশা। সেই কুয়াশার মাঝখানে ধীরে ধীরে গঠিত হতে লাগল এক মুখ — জলবর্ণ, নীলাভ, ঠোঁটের কোণে জলবিন্দুর মতো কাঁপুনি। এই মুখটি বলল না কিছু, বরং চোখের দিকে তাকিয়ে রইল — এক দীর্ঘ, অভিমানী দৃষ্টিতে। অগস্ত্য জানত, এ জলমুখ — দ্বিতীয় মুখ, যা স্মৃতি, সম্পর্ক আর বেদনার প্রতীক। সে হঠাৎ করে অনুভব করল, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে, গায়ের রক্ত যেন জমে যাচ্ছে। জলমুখ ধীরে ধীরে ফিসফিস করে উঠল — “তুই যা ত্যাগ করেছিলি, তাই আজ তোকে গ্রাস করবে।” এরপর সে জিজ্ঞেস করে, “রুক্মিণী কি ছিল কেবল এক বলির জন্য?” অগস্ত্যর চোখে জল আসে, কিন্তু সে উত্তর দিতে পারে না। সেই মুখ বলে, “যে প্রেমের ভিত নষ্ট করিস, তার উপর তন্ত্র দাঁড়ায় না। প্রেম না থাকলে তন্ত্র পঙ্গু।” হঠাৎ অগস্ত্যর মনে পড়ে যায় সেই দিন — যেদিন রুক্মিণী কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “তুই যদি একদিন নিজেকেই না চিনিস, তখন আমার কথা মনে করিস।” এখন সেই কথা যেন অলিন্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, আর সেই মুখে গলে গলে বেরোচ্ছে প্রতিটি স্মৃতি।

গঙ্গার জল অগস্ত্যর হাঁটু ছুঁয়ে যায়। ঠান্ডা, গভীর, কিন্তু পরিশুদ্ধ। সে জানে, ক্ষমা চাওয়ার ভাষা তার নেই। কিন্তু সে নিজের দুই হাত জলে ভিজিয়ে নিজের মাথায় ছিটিয়ে দেয় — যেন ভেতরের আগুন কিছুটা নেভাতে পারে। সে ধীরে ধীরে বলে, “আমি তোকে অপমান করেছি, ভালোবাসার অপমান করেছি। তুই যা বলিস, আমি স্বীকার করি।” মুখটি তখন ফিসফিস করে বলে, “তোর চোখে জল এসেছে, এবার তুই বুঝবি — আমি কে। আমি জল, আমি প্রবাহ, আমি ক্ষমা — কিন্তু আমি ভাসিয়ে নিতে জানি।” এরপর সেই মুখ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় নদীর বুকেই, আর তার সঙ্গে মিলিয়ে যায় রুক্মিণীর প্রতিচ্ছবিও। কিন্তু জলমন্ত্র তার কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে — “জল যেমন নম্র, তেমনি শক্তিশালী। যে সহ্য করে, সে গভীর হয়।” অগস্ত্য উঠে দাঁড়ায়। তার শরীর কাঁপছে, কিন্তু সে জানে, দ্বিতীয় মুখও তার মধ্যে প্রবেশ করেছে — সে এখন কেবল আগুন নয়, এখন সে জলও।

অগস্ত্যর শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। আগুনে দগ্ধ হাত, জলে ভেজা হৃদয় — শরীর এবং মন, দুটোই যেন ভেতরে ভেঙে পড়ছিল। ঠিক তখনই কলকাতার এক আধুনিক মনোরোগ কেন্দ্র থেকে ডাকা হল একজন বিশেষজ্ঞকে — ডঃ কৌশিক মিত্র। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, চকচকে ফ্রেমের চশমা, হাতে ট্যাব আর ঠোঁটে যুক্তিবাদী শুষ্ক হাসি। তিনি বহুদিন ধরে Dissociative Identity Disorder নিয়ে গবেষণা করছেন, এবং শোনার পর যে এক তান্ত্রিক নিজেকে “পাঁচ মুখো” বলছে, আর নিজেকে ভাগ করে পাঁচটি সত্তায় দেখতে পাচ্ছে — তাঁকে আর থামানো গেল না। বৃন্দাবনী দাসীই তাকে ডেকেছিলেন, যদিও তিনি নিজে জানতেন— এই খেলা শুধুই মনস্তত্ত্বের নয়। ডঃ মিত্র এসে যখন অগস্ত্যর পাশে বসলেন, তখন সে এক ঘোরের মধ্যে ছিল। মৃদু স্বরে ডাকলেন, “শুনছেন, অগস্ত্যবাবু?” সে চোখ খুলল — সেই চোখে যেন আগুন আর জলের ছায়া।

প্রথমে কৌশিক ধীরে ধীরে তাকে বোঝাতে শুরু করলেন, “আপনি মানসিকভাবে বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এই যে আপনি পাঁচটা মুখ দেখছেন, একে একে উপলব্ধি করছেন — এটা Multiple Personality অথবা Dissociative Hallucination-এর ফল। মানে, আপনি নিজের জীবনের পাঁচটা অধ্যায়কে পাঁচটা মুখে রূপ দিচ্ছেন।” অগস্ত্য চুপচাপ শুনল। তারপর হঠাৎ বলল, “আপনিও একটা মুখ দেখতে পান কি, ডক্টর?” কৌশিক একটু থমকে গেলেন। “মানে?”
“যখন আয়নায় নিজেকে দেখেন, তখন সবসময় নিজের মুখই দেখেন তো?” — কণ্ঠস্বরে তীব্রতা ছিল না, ছিল নিঃসঙ্গতা। কৌশিক হেসে বললেন, “আমি বিজ্ঞানী, আয়নায় আমি আমার নিউরনের প্রতিফলন দেখি।” অগস্ত্য এবার হঠাৎ আয়নার দিকে তাকাল, আর সেখানে এক মুহূর্তে দেখা গেল — ডঃ মিত্রর প্রতিচ্ছবি ধীরে ধীরে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, চোখে অন্ধকার, মুখে অতল নিঃশ্বাস। কৌশিক চমকে উঠে তাকালেন আয়নায়, কিন্তু কিছু দেখলেন না। তবু, তার গলার স্বর কাঁপছিল।
“আপনি হয়তো ঠিকই বলছেন,” অগস্ত্য শান্তভাবে বলল, “কিন্তু সেই আয়নাটাই তো আমার চতুর্থ মুখ — মানসমুখ। মানসের যা খেলা, বিজ্ঞান তা বোঝে, কিন্তু আয়নাটা… সেটা শুধু চোখে দেখা যায় না।” কৌশিকের মাথায় চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো। যেন কেউ তার নিজের ভিতরেই প্রশ্নের ঢেউ তুলছে — আর উত্তরটা নেই।

বৃন্দাবনী দাসী এসে ধীরে ধীরে বললেন, “আপনি যা দেখলেন, তা যদি বিভ্রম হয় — তবে তার মানে কী দাঁড়ায়? বিভ্রমও তো সত্য, যদি তাকে অনুভব করা যায়।” ডঃ মিত্র এবার আর কিছু বললেন না। বাইরে শ্মশানের বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আয়নার ধারে রাখা ধূপের ধোঁয়া ঘূর্ণি তুলে ঘরে ঢুকছে। অগস্ত্য আবার মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আপনি বিশ্বাস না করলেও, আমার চতুর্থ মুখ আজ জেগে উঠেছে — চেতনার মুখ, স্মৃতির মুখ, বিভ্রান্তিরও মুখ। আপনি হয়তো আমাকে পাগল বলবেন, কিন্তু সেই মুখ আমাকে যা দেখিয়েছে — তা আপনার যুক্তি দিয়ে ধরা যাবে না।” কৌশিক এবার চুপ। তিনি জানতেন, কিছু কিছু অনুভব বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি যখন বেরিয়ে গেলেন, আয়নার কোণায় আবার এক মুহূর্তের জন্য সেই মুখ দেখা গেল — চোখদুটি জ্বলজ্বল করছে, ঠোঁটে যেন এক দুর্বোধ্য মন্ত্র।
অগস্ত্য একা ঘরে বসে, ধীরে ধীরে নিজের হৃদয়ে গুনছে সেই মন্ত্র — “তৃতীয় মুখ আমার হয়েছে, চতুর্থও জেগেছে। এখন সময় পঞ্চমের — যেখানে মুখ আর মুখ থাকে না, শুধু আমি হয়ে ওঠে মুখ।”

রাতের বেলা কলকাতা শহরের চারপাশে যখন নিঃশব্দতা ভেসে বেড়ায়, তখন কিছু কিছু গলি যেন বাস্তব নয় — যেন সেগুলো স্বপ্নের মধ্যে লুকানো এক দরজা। অগস্ত্য হাঁটছিল সেইরকমই এক গলির মধ্যে, শোভাবাজারের এক পুরনো ঠাকুরদালান ঘেরা রাস্তা, যেখানে বাতাস কাঁপে না, অথচ কানে শোনা যায় ধুপের গন্ধমাখা আওয়াজ। সে জানত, আজ তাকে খুঁজে নিতে হবে তৃতীয় মুখ — বায়ুমুখ — যা দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়, যা বলেও না, কিন্তু কানপাতে ফিসফিস করে। গলির ভেতর হঠাৎ করেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, চারদিক নিস্তব্ধ, অথচ গাছের পাতা থরথর করে কাঁপছে। অগস্ত্য একটা অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে পড়ল। শ্বাস টানল ধীরে ধীরে। হঠাৎই তার চারপাশে বাতাস পাক খেতে শুরু করল — যেন অদৃশ্য কোন কিছুর অস্তিত্ব জেগে উঠছে। চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ে গেল তার ছেলেবেলার সেই দিন, যখন সে গৃহত্যাগ করেছিল — কোনো কথা না বলে, কাউকে না জানিয়ে, হাওয়ার মতো উধাও হয়ে গিয়েছিল। সেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার প্রবণতা, সেই পালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস — সেটাই কি ছিল বায়ুমুখের প্রথম ইঙ্গিত?

বাতাস গা ঘেঁষে ছুঁয়ে যায় তাকে, কানে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “তুই সবকিছু থেকে পালিয়ে গেছিস, এখন কি নিজেকে খুঁজবি?” অগস্ত্য চমকে ওঠে না, শুধু মাথা নাড়ে। বায়ুমুখ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে — হালকা ধোঁয়ার মতো, মুখের রেখাগুলি পাতা আর ধূপের গন্ধে গঠিত। মুখটির কোনো দিক নেই, কোনো ভাষা নেই, কিন্তু তার মধ্যে এক গভীর ঋদ্ধতা আছে। “তুই তো বায়ুর সন্তান,” সেই মুখ বলে, “তুই ভেসে চলিস, কখনও থাস না, কখনও দাঁড়াস না। ভেবেছিস এটা শক্তি?” অগস্ত্য চুপ। তার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য ছিল — সে কখনোই কিছুতে বাঁধা পড়ে থাকতে পারেনি। প্রেম, গুরু, মন্ত্র — সবই থেকে গেছে তার পেছনে। পালিয়েই সে নিজেকে খুঁজেছে, কিন্তু আজ সেই পালানোই প্রশ্ন হয়ে ফিরে এসেছে। বায়ুমুখ বলে, “যে দাঁড়ায় না, তার শিকড় হয় না। যে শিকড়হীন, সে তো উড়ে যায় শুধু — পড়ে না মাটিতে।” অগস্ত্যের মনে হয় যেন সে বাতাসের মধ্যেই কোথাও উড়ছে, বাস্তব আর সময়ের সীমা হারিয়ে গেছে। চোখ খুলে দেখে, সে কোনও চেনা গলিতে নেই — বরং তার চারপাশে যেন শূন্যতা। সময় স্থির।

এই শূন্যতার মধ্যে হঠাৎ করেই সে শুনতে পায় এক পুরনো শব্দ — গুরুর কণ্ঠস্বর, রুক্মিণীর কান্না, নিজের শিশুকালের হাঁটার আওয়াজ। সবকিছু ভেসে আসছে বাতাসে, যেন অতীতের সমস্ত স্মৃতি ফিরে আসছে তার দিকে। বায়ুমুখ আবার বলে, “তুই শুধু শোন, দেখিস না। আর আজ থেকে তুই যা শুনবি, তা শুধু বাতাসের মধ্যেই থাকবে। সব মুখ বলে, আমি শোনাই।” এরপর সেই মুখ অদৃশ্য হয়ে যায় হাওয়ার মধ্যে। অগস্ত্য আবার সেই গলিতে ফিরে আসে — যেন কিছুই হয়নি, অথচ সবকিছু পালটে গেছে। তার মনে হয়, শরীরটা যেন হালকা হয়ে গেছে, আর মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত দোলাচল — যা শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় না।
সে জানে, তৃতীয় মুখ এখন তার ভেতরে। এখন সে আগুন জানে, জল বোঝে, আর হাওয়ার মতো পালিয়ে যাওয়া নিজেকে চিনেছে। কিন্তু এখনও মাটি তাকে ডাকছে। মাটি — যা জন্ম দেয়, যা সব মুখকে ধারণ করে। সে প্রস্তুত চতুর্থের মুখোমুখি হতে — পার্থিভমুখ, মৃত্তিকার মুখ, যা তার জন্মের গভীর রহস্য বয়ে নিয়ে এসেছে।

সকালবেলার কুয়াশা মিলিয়ে গেছে, কিন্তু অগস্ত্যর চোখে তখনও কুয়াশা জমে আছে— স্মৃতির কুয়াশা। আজ সে ফিরছে তার জন্মস্থানে — নদিয়ার পাশের সেই ক্ষুদ্র গ্রাম, যেখানে প্রথম এক তান্ত্রিক উৎসবে সে দেখেছিল মৃত্তিকামূর্তির চোখে জীবনের ছায়া। বহু বছর পরে আবার সে হাঁটছে সেই পথ ধরে — যেখানে মাটির গন্ধে মিশে আছে গরুর গা থেকে গড়িয়ে পড়া জল, পুরনো ঘরের পচা চাল, আর একসময়ের বকাঝাঁকা মায়ের কণ্ঠস্বর। গ্রামের শেষ প্রান্তে সেই পোড়ো মন্দির — যার গায়ে এখনও লেখা “অগ্নিভৈরব আশ্রম” — তার গুরু যেখানে এককালে তাকে প্রথম বলেছিলেন, “তুই মাটি থেকে উঠে এসেছিস, কিন্তু তোর পা এখনও হাওয়ায় ঝুলে আছে।” আজ, এত বছর পর, অগস্ত্য ফিরে এসেছে তার চতুর্থ মুখের সামনে দাঁড়াতে — পার্থিভমুখ, মাটির মুখ — যা জন্ম দেয় এবং গ্রাস করে। মন্দিরের প্রাচীন দরজায় হাত রাখতেই এক ঝটকায় সে যেন ঢুকে পড়ল আরেক সময়ে। দেয়ালে গায়ে খোদাই করা এক মূর্তির ফাটলের মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে এক অর্ধভগ্ন মুখ — যা দেখতে অদ্ভুতভাবে তার মায়ের মুখের মতো।

সে ঘরের ভিতর ঢুকে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে — চারপাশে শুধু ধুলো, ধ্বংস, আর মৃত পাখির পালক। হঠাৎ যেন মাটির তলা থেকে আওয়াজ আসে — “তুই কতদূর উড়েছিস, কিন্তু ফিরে এসেছিস কোথায়?” কণ্ঠস্বর সেই মুখের, পার্থিভমুখের — গম্ভীর, ধীর, মাটির মতোই স্থিত। মুখটি ধীরে ধীরে গঠিত হয় মন্দিরের এক দেওয়ালে — চোখে নেই উগ্রতা, বরং এক অভিভাবকের মতো কোমলতা। “তুই নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে সবার কাছ থেকে নিজেকে কেটে ফেলেছিস, কিন্তু তোর শিকড় কোথায়?” — মুখটি প্রশ্ন করে। অগস্ত্য চুপ। তার মনে পড়ে যায় সেই দিন, যেদিন সে গ্রাম ছেড়ে শহরে পালিয়ে গিয়েছিল — কারণ সে নিজের মধ্যে অনুভব করেছিল এক অস্বাভাবিক আগুন, যা দমন করতে পারেনি কেউ। মা তাকে বলেছিলেন, “মাটি থেকে জন্মেছিস, মাটিতেই ফিরবি।” সেই কথা আজ যেন বাস্তব রূপে ফিরে এসেছে। পার্থিভমুখ আবার বলে, “তুই সমস্ত মুখে নিজের দেহ সাজাচ্ছিস, কিন্তু দেহটা যে মাটি দিয়ে গড়া — তা ভুলিস কেমন করে?”

অগস্ত্য এবার দুই হাতে মাটির ধুলো তুলে নিজের কপালে ছোঁয়ায়। তার চোখ বন্ধ, আর কান পাতলেই সে শুনতে পায় সেই পুরনো দিনের গুঞ্জন — পুকুর পাড়ে মায়ের গলা, সন্ধ্যার আরতির ঘন্টাধ্বনি, আর শিশুবেলার নিজের হাসি। তার চোখ বেয়ে নেমে এল ধুলো মেশানো জল — যেন মাটি আজ তার আত্মা ছুঁয়ে ছুটছে ফিরে। সে ধীরে ধীরে বলে, “তুই আমায় মাফ করিস মা। আমি মাটিকে অস্বীকার করেছিলাম, আমি আমার জন্মকে লুকিয়েছিলাম।” পার্থিভমুখ জবাব দেয় না, কেবল এক দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে, আর ধীরে ধীরে মিশে যায় মন্দিরের ফাটলে। মাটি আবার হয়ে ওঠে স্তব্ধ, নিঃশব্দ, অথচ মমতাময়। অগস্ত্য মাথা নিচু করে বসে থাকে। সে জানে — এখন তার পায়ে শিকড় গজাচ্ছে। সে কেবল আগুন, জল, বাতাস নয় — সে এখন মাটিও। চতুর্থ মুখ তার মধ্যে প্রবেশ করেছে। আর এখন — সামনে আসবে শেষ মুখ। সেই মুখ, যেটা মুখ নয়, বরং চেতনার আয়না — পঞ্চম মুখ — মানসমুখ।

রাত গভীর। অগস্ত্য এইবার আর কোনো শ্মশান, নদী বা মন্দিরে নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে এক নির্জন ঘরের মধ্যে — এক পুরনো পরিত্যক্ত হাভেলি, শহরের এক কোণে, যেখানে দেয়ালজোড়া আয়না ছাড়া আর কিছু নেই। ঘরটা যেমন ঠান্ডা, তেমনি নিঃস্তব্ধ। বাতাসও থেমে গেছে যেন। চারদিকে শুধু প্রতিচ্ছবি, একের পর এক অগস্ত্য, একেকটা একেক অভিব্যক্তির — কেউ রাগী, কেউ শান্ত, কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে। সে জানে আজ এখানে সে মুখোমুখি হবে নিজেরই সঙ্গে — সেই মুখ, যেটা অন্য কোনো উপাদানের নয়, বরং সম্পূর্ণভাবে চেতনাগত। মানসমুখ। সে ধীরে ধীরে আয়নার সামনে দাঁড়ায় — ঠিক সেই মধ্যের আয়নাটি যেখানে সে একাধিকবার নিজেকে ভেঙে যেতে দেখেছে। এবার সে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়, মনে মনে বলে ওঠে, “আমি তোর মুখ খুঁজে এসেছি, কিন্তু তুই কি আমার চেহারায় আছিস?”

হঠাৎ, আয়না কাঁপতে শুরু করে। অগস্ত্য চোখ মেলে দেখে, তার প্রতিচ্ছবি স্থির নেই — একটার পর একটা মুখ তার সামনে ভেসে উঠছে। প্রথমে ছোটবেলার অগস্ত্য — ভয়ভীতু, অসহায়; তারপর যৌবনের অহংকারী, রুক্মিণীকে ছেড়ে চলে যাওয়া; তারপর গুরুর সঙ্গে সংঘর্ষ করা বিক্ষুব্ধ যুবক; তারপর শ্মশানে ধ্যানরত তান্ত্রিক। প্রতিটি মুখ একেকটা রূপ — একেকটা বিভাজিত সত্তা। কিন্তু হঠাৎ একসময় প্রতিটি মুখ মিলিয়ে এক মুখ তৈরি হয় — একরঙা, নিরাবেগ, ঠান্ডা, অথচ গভীর চোখের অধিকারী। সেই মুখ বলে, “আমি তোর নিজের মুখ। আমি মুখ নই, আমি চিন্তা — আমি জ্ঞান। তুই এতদিন মুখ খুঁজেছিস বাইরে, অথচ আমি ছিলাম তোর ভেতরেই। আমি কোনও উপাদানে গঠিত নই — না আগুনে, না জলে, না হাওয়ায়, না মাটিতে। আমি শুদ্ধ মানস। যে সবকিছুকে দেখছে, কিন্তু অংশ হচ্ছে না।”

অগস্ত্যর গলা শুকিয়ে আসে। তার মনে হয় যেন চারপাশের সমস্ত আয়না গলে গিয়ে তার মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছে। তার চোখে ভেসে উঠছে — পাঁচটি মুখ, পাঁচটি পথ, এবং সব শেষে এক কেন্দ্রবিন্দু — যে মুখ আর মুখ নয়, বরং দৃষ্টি। মানসমুখ আবার বলে, “তুই এখন পরিপূর্ণ, কারণ তুই নিজেকে দেখেছিস। কিন্তু দেখাই তো শেষ নয় — এখন প্রশ্ন, তুই কী করবি এই মুখ নিয়ে? তুই এক তান্ত্রিক, যে পাঁচটি মুখ পেয়েছে। এখন তোর দায়িত্ব এই মুখগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা, তাদের দৃষ্টি দিয়ে সত্যিকে খুঁজে আনা।” অগস্ত্য হঠাৎ অনুভব করে, তার শরীর আর শরীর নেই — যেন সে এক প্রবাহ, এক আত্মা, এক দর্শন। চোখ বন্ধ করে সে শেষবারের মতো উচ্চারণ করে, “আমি মুখ নই, আমি দৃষ্টি।”
এরপর সেই মধ্যের আয়না হঠাৎ ভেঙে পড়ে — শব্দ হয় না, কাচ ছিটকে যায় না। শুধু একটা নিঃশব্দ আলো চারদিক ছেয়ে ফেলে। অগস্ত্য একা দাঁড়িয়ে থাকে — মুখহীন, অথচ সমস্ত মুখের অধিকারী।

অগস্ত্য আজ আর খুঁজছে না মুখ। সে জানে— যা খুঁজছিল, তা তো সেই নিজেই। আগুন, জল, হাওয়া, মাটি, চেতনা— সব মিলিয়ে গঠিত সে এখন, সে-ই তন্ত্রের আধার। কিন্তু ঠিক তখনই হঠাৎ শহরের কোণে শুরু হল এক অশুভ কাঁপুনি। পুরনো মৃত ঘরগুলো থেকে উঠতে লাগল কালো ধোঁয়া, বাতাস ভারী হয়ে উঠল অদ্ভুত শব্দে। বৃন্দাবনী দাসী ছুটে এসে জানালেন— “তুই যে পাঁচ মুখ নিজের মধ্যে গ্রহণ করেছিস, তার প্রতিটি শক্তি এখন তোকে চাইছে। কিন্তু তারা একসঙ্গে বাস করে না। যদি তুই নিজের ভেতরে ভারসাম্য না আনতে পারিস, তবে এই মুখগুলো তোকেই ধ্বংস করে দেবে।” অগস্ত্য বুঝতে পারল, একীভবনের মুহূর্ত এসেছে। এখন আর বাইরে মুখ খুঁজে বের করার নয়— এখন নিজের ভেতরে প্রবেশ করার সময়। সে চোখ বন্ধ করে, মাটিতে বসে পড়ল পদ্মাসনে। সমস্ত শরীর নিস্তব্ধ, কেবল মনে মনে উচ্চারণ— “অগ্নিমুখ, জলমুখ, বায়ুমুখ, পার্থিভমুখ, মানসমুখ— তোমরা এসো। কিন্তু যুদ্ধ নয়— মিলন হোক।”

হঠাৎ, চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। মনে হচ্ছিল, তার ভিতরের পাঁচ মুখ যেন একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে— আগ্নিমুখ চাইছে শুদ্ধ ধ্বংস, জলমুখ কাঁদছে সংবেদনের জন্য, বায়ুমুখ পালাতে চাইছে, পার্থিভমুখ টানছে নিচে, আর মানসমুখ নির্লিপ্ত হয়ে কেবল দেখছে। এই সংঘর্ষ শুরু হল তার আত্মার গভীরে। অগস্ত্য বুঝতে পারছিল— তার হৃদয় বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, সে যেন নিজের মধ্যেই ভেঙে পড়ছে। হঠাৎ তার মাথার ভিতর গর্জন করে উঠল সেই প্রাচীন মন্ত্র, যা কোনও গ্রন্থে লেখা নেই, কোনও তান্ত্রিক জানে না— কেবল সে শুনেছে শ্মশানে ধ্যানরত অবস্থায়— “পঞ্চতত্ত্ব মিলিলে প্রকৃতি হয় জাগ্রত। জাগ্রত হইলে তন্ত্র জন্মায়, তন্ত্র জন্মালে আত্মা জাগে।” তখনই অগস্ত্যর দেহ ঘিরে এক উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ল, ঠিক যেন পাঁচটি মুখ একে একে এসে বসছে তার শরীরের পাঁচটি কেন্দ্রে— মাথা, কণ্ঠ, হৃদয়, নাভি ও পদতলে। সেই পাঁচ কেন্দ্রে শক্তির উন্মোচন হল।

অগস্ত্য চোখ খুলল। সে আর আগের মতো নেই। তার চোখে আছে আগ্নিমুখের দীপ্তি, কণ্ঠে জলমুখের কোমলতা, শরীরে বায়ুমুখের ভাসমান গতি, পায়ে পার্থিভমুখের স্থিতি, আর মস্তিষ্কে মানসমুখের দৃষ্টি। সে জানে, এইরূপ তার আত্মশক্তির রূপ— এখন সে তান্ত্রিক নয়, সে নিজেই এক মুখ— “শক্তির মুখ”। বৃন্দাবনী সামনে দাঁড়িয়ে, প্রণাম করলেন— “আজ তুই পূর্ণ হলি। এখন তুই পারবি মুখ না থাকা সেই এক মুখকে খুঁজে পেতে— যার অস্তিত্বই তন্ত্রের শেষ কথা।” অগস্ত্য ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। চারপাশ স্তব্ধ, কিন্তু তার ভিতর নিঃশব্দে বাজছে চেতনার ঘন্টাধ্বনি।
তার পেছনে থাকা ছায়াগুলো এক এক করে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে জানে, পরবর্তী যাত্রা— এক মুখহীন মুখের দিকে। যেখানে মুখ নেই, কেবল উপস্থিতি। সত্যিকার ‘তন্ত্র’— সেখানেই লুকিয়ে।

১০

অন্ধকারে ডুবে থাকা এক গুহা, যা কোনও মানচিত্রে নেই। বৃন্দাবনী বলেছিলেন, “সেই মুখহীন মুখের দরজা সময়ের বাইরে, দৃষ্টির বাইরে, শরীরেরও বাইরে।” অগস্ত্য একা পা রাখে সেই গুহার দিকে, হাতে নেই মন্ত্র, ঠোঁটে নেই নাম। কেবল বুকে এক অতল শূন্যতা— যেন যে সত্য এতদিনে পেয়েছে, সেই সত্যকেও ছাড়তে হবে। গুহার ভিতর ঢুকে পড়তেই আলো অদৃশ্য হয়ে গেল। সে হাঁটছে, অথচ বুঝতে পারছে না সে পথ নিচে নামছে না উপরে উঠছে, ডান-বাম কোনো অনুভব নেই। গুহার দেওয়াল গায়ে লাগছে না, শব্দ নেই নিজের পায়ের, নিশ্বাসও যেন নিরব। এক সময় এসে সে থেমে যায়— সামনে কিছুই নেই, কেবল অন্ধকার, এমন অন্ধকার যা চোখের মধ্যে ঢুকে পড়ে আত্মা আঁধার করে। তখনই এক কণ্ঠ ভেসে আসে, কেবল কানে নয়, রক্তে, হাড়ে— “তুই এত মুখ পেয়েছিস, এখন নিজেকে ছেড়ে দে। কারণ মুখ থাকা মানেই বিভাজন। আমি সেই মুখ, যার কোনো চেহারা নেই, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই, আমি সেই ‘না’-এর ভিতর ‘হ্যাঁ’। আমি শূন্য।”

অগস্ত্যর বুক কেঁপে ওঠে। এত মুখ দেখে যে নিজেকে পূর্ণ মনে করেছিল, সে আজ বুঝছে, পূর্ণতা মানে সব মুখ ফেলে এক নিঃসঙ্গ শূন্যতায় দাঁড়ানো। অন্ধকারে হঠাৎ করে ফুটে ওঠে কিছু প্রতীক — নয়টি বৃত্ত, প্রতিটি একেকটা সত্তার প্রতীক — জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, লোভ, ক্ষমা, ধ্বংস, সৃজন, মৌনতা, আর শেষে — অস্তিত্বহীনতা। সেই শেষ বৃত্তের কেন্দ্রে এক বিন্দু আলো — যেখানে মুখ নেই, কিন্তু তা চেয়ে আছে তারই দিকে। মুখহীন মুখ বলে ওঠে, “তুই যদি সত্যি নিজেকে পেতে চাস, তবে মুখভাঙা হ, তোর মুখ ছুঁড়ে ফেল।”
অগস্ত্য ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে, নিজের ভিতরে ডুব দেয়। আগুন, জল, বায়ু, মাটি, চেতনা — সব এক এক করে গলে যাচ্ছে তার মধ্যে। সে শুনতে পায় নিজের নামটাও মিলিয়ে যাচ্ছে, শ্বাস, ভাষা, ভাব— সব। কিছুক্ষণ পরে কেবল থাকে এক বিন্দু— অগস্ত্য নয়, তান্ত্রিক নয়, মানুষ নয়— কেবল এক চেতন সত্তা।

তারপর আবার আলো ফিরে আসে। গুহার দেয়াল আছে, পথ আছে, শরীর আছে, কিন্তু কেউ নেই— কেবল অগস্ত্যর কণ্ঠে এক নিঃশব্দ হাসি। সে মুখে কিছু বলে না। এখন সে জানে, মুখ থাকলে মুখো দেখা যায়, কিন্তু মুখহীন হলে দেখা যায় নিজেকে। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। বাইরে সূর্য উঠেছে। সে গুহা থেকে বেরোলে পেছনে কিছুই থাকে না — কোনো দরজা, কোনো গুহা, কিছুই। বৃন্দাবনী তাকে দূর থেকে দেখে, কিন্তু এবার প্রণাম করে না— কারণ এখন সে কোনো তান্ত্রিক নয়, কোনো গুরুও নয়। সে এখন এক চলমান মুখহীনতা— সে নিজেই এখন “পাঁচ মুখো তান্ত্রিক” নয় — সে হল ‘এক মুখহীন আত্মা’, যার কোনো নাম নেই, কোনো চেহারা নেই। তন্ত্র, মন্ত্র, উপাসনা— সবই তার ভেতর, আর কিছুই নয়।

শহরের কোণে মাঝে মাঝে কেউ একজন দেখা যায়, সে খুব চুপচাপ হাঁটে— না পুরোহিত, না সন্ন্যাসী, না তান্ত্রিক। তার চোখ গভীর, ঠোঁটে নিঃশব্দতা, এবং মাটিতে পড়ে থাকা ধুলোও যেন তার পথ দেখে। কেউ বলে, সে পাগল; কেউ বলে, সে ‘মুখো-মানব’ — যার মুখ নেই, কিন্তু যার চোখে পাঁচটি মৌলিক শক্তির ছাপ।
আর বৃন্দাবনী দাসী? তিনি আবার লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে গিয়েছেন, ঠিক যেমন তাঁকে পাওয়া গিয়েছিল।
শুধু মাঝে মাঝে কোনও শ্মশানের ধারে বসা কেউ ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে—
“তন্ত্র জানে না, মুখ কাকে বলে। মুখের বাইরে যে সত্তা, সেটাই সত্য। সেই মুখহীন আত্মা এখন এই জগতে ঘুরে বেড়ায়, কারও গুরু হয়ে নয়— বরং একজন নিরব চেতনার বীজ হয়ে।”

তন্ত্রের শেষে মুখ থাকে না, থাকে শুধুই উপলব্ধি।

সমাপ্ত

1000036344.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *