Bangla - প্রেমের গল্প

পলাশ ফুলের দিন

Spread the love

সৌম্যজিৎ দাশ


অধ্যায় ১: লাল মাটির পথ

ট্রেনটা যখন বোলপুর স্টেশনে থামল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অনিন্দ্য ব্যাগ কাঁধে তুলে নামল। মাথার ওপর নীল আকাশ, কিন্তু তার নিচে ছড়িয়ে রয়েছে ধুলো মাখা লাল মাটি। হাওয়ার ঝাপটায় পাতার খসখসানি আর স্টেশনের বাইরে হাঁকডাক—কেমন যেন অন্য এক পৃথিবীতে এসে পড়েছে সে।

কিন্তু ও এখানে এসেছে একটা নির্দিষ্ট কারণে—রবীন্দ্রসংগীত ও গ্রামীণ জীবনের প্রভাব নিয়ে রিসার্চ করতে। শহরের কংক্রিট আর কর্পোরেটের ক্লান্তি থেকে একটু মুক্তির জন্যও বটে। এই জায়গাটায় কিছু একটা আছে, যা টানছে তাকে। হয়তো লাল মাটি, কিংবা পলাশের আগুনে রঙ।

হাটু পর্যন্ত ধুলো মাখিয়ে আশ্রমপথে ঢোকার সময় চোখে পড়ল চিত্রভবনের সামনের একটা গাছের তলায় বসে থাকা মেয়েটিকে। ক্যানভাসে রং তুলছে, চুল খোলা, মাথায় হালকা হলুদ ওড়না। খুব সাধারণ দেখতে, কিন্তু তেমনই অসাধারণ।

সে দেখল না, অনিন্দ্য তাকিয়ে আছে। কিন্তু অনিন্দ্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
— “তুমি কি এখানে পড়?”
মেয়েটা মুখ তুলে চমকে উঠল, কিন্তু ভয় পেল না। হাসল হালকা করে।
— “হ্যাঁ। চিত্রভবনে। তুমি?”
— “আমি অনিন্দ্য। কলকাতা থেকে এসেছি। রিসার্চ স্কলার। বিশ্বভারতীতেই কাজ করতে এসেছি কিছুদিন।”
— “ভাল্লাগছে। আমি রূপসা।”

এইভাবে আলাপ শুরু।

রূপসা অদ্ভুত রকমের মিশ্রণ—গম্ভীর নয়, উচ্ছ্বল নয়। মাঝে মাঝে হাসে, মাঝে মাঝে একেবারে চুপ। অনিন্দ্য কিছুতেই বুঝতে পারে না, ঠিক কী ভাবছে সে। তবে ওর আঁকার মধ্যে একটা কষ্ট আছে। হয়তো অভ্যন্তরীণ কোনও কথা, যেটা রং দিয়ে বলে দেয়।

দুদিন পরেই বসন্ত উৎসব। শান্তিনিকেতনের এক বড়ো দিন। আশ্রমপথে সাজ সাজ রব, ছাত্রছাত্রীদের গলায় রঙিন গামছা, হাতে আবির। আর পলাশ ফুল—সবচেয়ে বেশি কথা বলে যেন।

সেদিন বিকেলে অনিন্দ্য আবার গেল চিত্রভবনের দিকে। রূপসা তখনও ছবি আঁকছে, এবারে তার ছবিতে এক মহিলা, সাদা শাড়িতে, মাঠের ধারে বসে আছেন। পেছনে পলাশ ফুলের গাছ।

— “তোমার আঁকা খুব শক্তিশালী,” বলল অনিন্দ্য।
রূপসা বলল,
— “এই ছবিটা আমার ঠাকুমার স্মৃতিতে। উনি শান্তিনিকেতনে পড়াতেন। জীবনটা পলাশ ফুলের মতোই ছিল—উজ্জ্বল, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী।”

অনিন্দ্য চুপ করে গেল। এই মেয়েটা সবকিছু এত গভীরভাবে দেখে! শহরের মেট্রো আর ডেডলাইনসের ভিড়ে এমন অনুভবের মানুষ দেখা যায় না।

সন্ধ্যাবেলা দুজনে হাঁটতে বেরোল। শালবনের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পথে আলো-ছায়ার খেলা।
— “তুমি গান গাও?”
রূপসা জিজ্ঞেস করল।
— “গাই, মানে চেষ্টা করি। রবীন্দ্রসংগীত খুব পছন্দ।”
— “তবে গেয়ে শোনাও।”

অনিন্দ্য গাইল, “আকাশ ভরা সূর্য তারা…”। গলার স্বর নিখুঁত নয়, কিন্তু গলায় ছিল মন থেকে বেরনো আবেগ। রূপসা তাকিয়ে ছিল, চোখে কোনও মন্তব্য ছিল না, ছিল শুধু গভীর মনোযোগ।

শেষে বলল,
— “ভালো লাগল। কারণ তুমি ঠিকঠাক গাও না, কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে গাও।”

এভাবে প্রতিদিন দেখা হতে লাগল। প্রজেক্টের ফাঁকে ফাঁকে অনিন্দ্য রূপসার কাছে শিখে নিত আশ্রমপথের গাছগুলোর নাম, গানের রাগ, মাটির গন্ধ। একদিন রূপসা বলল—
— “তুমি কি জানো, পলাশ গাছ কখন ফুল ফোটায়?”
— “বসন্তে, জানি।”
— “না, ওরা ফোটায় তখন, যখন মাটি আগুনের মতো গরম হয়ে ওঠে। মানে ফুল ফোটানোর জন্য একটু কষ্ট লাগে।”

এই কথাটা অনিন্দ্যর মনে গেঁথে গেল।

একদিন হঠাৎ রূপসা বলল,
— “চলো, তোমাকে একটা জায়গা দেখাই।”

রাত তখন। পূর্ণিমার আলোয় ছেলেটা আর মেয়েটা হাঁটছে মাঠ পেরিয়ে। পেছনে কুকুরের ডাক, দূরে বাউলের গান ভেসে আসছে। তারা পৌঁছল একটা ছোটো পুকুরের ধারে। চারপাশে পলাশ গাছ। রূপসা বলল—
— “এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। যখন মন খারাপ হয়, এখানেই আসি।”

অনিন্দ্য বলল—
— “তাহলে আজ থেকে আমিও আসব।”

রূপসা তার দিকে তাকিয়ে বলল—
— “তুমি কি থাকবে? না প্রজেক্ট শেষ হলেই চলে যাবে?”

অনিন্দ্য উত্তর দিল না। কারণ সে নিজেও জানে না, এই প্রেমটা রয়ে যাবে কি না। কিন্তু ওই মুহূর্তে, তারা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল, শান্তিনিকেতনের লাল মাটি ছুঁয়ে, বসন্তের বাতাসে, পলাশ ফুলের ঘ্রাণে।

কিছু ভালোবাসা প্রশ্ন ছাড়াই আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে, ঠিক যেমন পলাশ ফোটে আগুনের ভিতর দিয়েও।

 

বসন্তের রঙে

রবির প্রথম আলোয় শান্তিনিকেতন যেন অন্যরকম জেগে উঠল। আকাশে রঙিন আবিরের কুয়াশা, চারদিকে আলাপ আর হাসির ধ্বনি। আজ বসন্ত উৎসব—শান্তিনিকেতনের প্রাণের দিন।

অনিন্দ্য সাদা পাঞ্জাবি পরে আশ্রমপথে দাঁড়িয়ে। তার গলায় হলুদ গামছা, চোখে স্নিগ্ধ একটা উত্তেজনা। সে অপেক্ষা করছে রূপসার জন্য।

রূপসা এল একটু দেরিতে। পরনে গেরুয়া রঙের শাড়ি, মাথায় খোলা চুল, পায়ে আলতা। কোনো গয়না নেই, কিন্তু চোখে এমন একটা দীপ্তি যেন সে-ই এই উৎসবের দেবী।

অনিন্দ্য তাকিয়ে রইল। মুখে কিছু বলল না, শুধু চোখে একটা কথা—“তুমি কীভাবে এমন হলে?”

রূপসা হাসল।
— “চলো, ফুল ছড়াতে হবে তো!”

তারা আশ্রমের মাঠে গেল। ছেলেমেয়েরা গানের সুরে নেচে উঠেছে, “ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল…”। চারদিকে হলুদ, সবুজ, লাল আবিরের ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে রূপসা অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল—
— “তোমার চোখে একটু রঙ লাগিয়ে দিই?”

অনিন্দ্য মাথা নাড়ল।
— “তুমি লাগালে, সেই রঙ আমি কোনোদিন ধুতে পারব না।”

রূপসা তার গাল ছুঁয়ে হালকা হলুদ আবির মাখিয়ে দিল। এক মুহূর্তের জন্য ওরা কেউ কথা বলল না। এই নিরবতাই তাদের সবচেয়ে গভীর আলাপ হয়ে উঠল।

তাদের চারপাশে উৎসব চলতেই থাকল। গান, কবিতা পাঠ, শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের দল বেঁধে গান—সবকিছুর মাঝেও অনিন্দ্য আর রূপসা এক ফাঁকা জায়গায় বসে রইল। একটা বড় শালগাছের নিচে।

— “তোমার ছবি আঁকা আমি বুঝতে পারি না ঠিকঠাক,” অনিন্দ্য বলল।
রূপসা হেসে বলল,
— “সবাই বুঝতে হবে না। অনুভব করলেই হয়।”

— “তবে তুমি যে আমায় এঁকে রাখবে বলেছিলে, সেটা কি সত্যি?”
রূপসা একটু চুপ থেকে বলল,
— “আমি আঁকি শুধু যাদের হারাতে চাই না। কিন্তু আঁকা মানেই চিরস্থায়ী নয়, অনিন্দ্য।”

অনিন্দ্য তার দিকে তাকিয়ে বলল—
— “তুমি কি ভয় পাও ভালোবাসায়?”
— “ভালোবাসা নয়, বরং তার ক্ষণস্থায়ীত্বে।”

সন্ধ্যায় তারা আবার সেই পুকুরপাড়ে গেল। সেই চেনা নির্জনতা, পলাশ গাছগুলো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। পুকুরে জ্যোৎস্নার প্রতিবিম্ব।

রূপসা বলল—
— “তুমি জানো, বসন্ত ফুরিয়ে গেলে এই গাছগুলো কেমন যেন নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে।”
অনিন্দ্য বলল—
— “তুমি চাইলে, আমি থেকে যেতে পারি। এই গাছের মতই, তোমার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।”

রূপসা তাকিয়ে রইল। বলল না কিছুই। শুধু তার চোখ ভরে উঠল আবিরে, ভালোবাসায়, অনিশ্চয়তায়।

সে রাতটা শেষ হল না। পলাশ ফুলের গন্ধে ভেসে যাওয়া সেই দীর্ঘ রাত, যেখানে কথা ছিল অল্প, অনুভব ছিল অনেক।

পালকের মতো নিঃশব্দ

বসন্ত উৎসব পেরিয়ে গেছে। আশ্রমপথে এখন সুনসান, পলাশের গায়ে লেগেছে ধুলো, রঙের উচ্ছ্বাসে ভিজে গিয়েছিল যে শান্তিনিকেতন, তা আজ অনেক শান্ত।

রূপসার সঙ্গে সেই রাতের পর অনিন্দ্যর আর দেখা হয়নি। ফোন করলেও রিসিভ করে না, বার্তা পাঠালেও উত্তর আসে না।

অনিন্দ্য বুঝতে পারে না, কী ভুল করেছে সে। বসন্তের রাতে তো ওরা পাশাপাশি বসে স্বপ্ন দেখেছিল। সেই স্বপ্ন কি কেবলমাত্র উৎসবের দিনেই মানায়?

অনিন্দ্যর ঘুম উড়ে যায়। কাঁথা মুড়িয়ে সে জানালার পাশে বসে থাকে। শালগাছের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো পড়ে। দূরে কোথাও বাউল গান ভেসে আসে—

“তোমার নামটি রবে আমার গানে গানে
কথা না থাকুক মুখে, সুরে সুরে বলে যাবে মনে…”

সকালে চিত্রভবনের দিকে গেল সে। জানে না রূপসা আসবে কি না, তবুও যাওয়া দরকার বলে মনে হয়। ওখানে গিয়েই সে দেখতে পেল তাকে—রূপসা একটা নতুন ক্যানভাসে তুলির ছোঁয়া দিচ্ছে, মুখে অদ্ভুত রকম একটা নিস্তব্ধতা।

অনিন্দ্য এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।
— “তুমি পালিয়ে যাচ্ছ কেন?”

রূপসা একটুও চমকাল না। শুধু বলল,
— “পালাচ্ছি না। শুধু একটু দূরে সরে দাঁড়িয়েছি।”

— “কেন?”
— “ভালোবাসা হল একটা টান—যেটা টানতে টানতে একসময় ছিঁড়ে যায়। আমি ছেঁড়ার আগেই সরে যেতে চাই।”

অনিন্দ্য হতবাক।
— “তুমি কি ভয় পাচ্ছো আমাকে?”
— “তোমাকে না। নিজেকে। আমি জানি না, আমি কতটা গভীরে যেতে পারি। আর তোমার তো আবার ফিরতে হবে। প্রজেক্ট তো আর চিরকাল নয়।”

অনিন্দ্য মাথা নিচু করে বলল,
— “প্রজেক্ট শেষ হবে, কিন্তু আমার ভিতরটা তো আর শেষ হবে না। তুমি সেটা বুঝতে পারো না?”

রূপসা বলল না কিছু। কেবল ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে রইল। সেখানে আঁকা ছিল—একটা একলা পলাশ গাছ, যার নিচে কেউ নেই।

সেদিন সন্ধ্যায় অনিন্দ্য একাই হাঁটছিল। পুকুরপাড়ে গিয়েছিল, যেখানে ওরা একসঙ্গে বসেছিল সেই রাতে। এবার রূপসা নেই, শুধু জ্যোৎস্না আছে, বাতাস আছে, আর পলাশগাছগুলো—যা যেন তাকিয়ে আছে, নীরবে।

পানিতে একটা পালক ভেসে এল কোথা থেকে। সাদা, হালকা, কিছু না বলেই যেন কিছু বলে গেল।

অনিন্দ্য জানে না শেষ পর্যন্ত কী হবে। কিন্তু এই নিঃশব্দ পালকটাই হয়তো তার ভালোবাসার প্রতীক—হালকা, উড়ে যেতে পারে, তবুও একবার ছুঁয়ে দিয়ে যায় হৃদয়ের জলে।

মাটির মুগ্ধতা

রূপসা যখন অনিন্দ্যকে প্রথম দেখেছিল, তখনই বুঝেছিল—এই ছেলেটা শহর থেকে এসেছে, কিন্তু তার চোখে একটা গ্রামোচিত ব্যাকুলতা আছে। যেন সে খুঁজছে কিছু, কিন্তু জানে না কী।

প্রথমে ভাবত, হয়তো আর পাঁচটা গবেষকের মতো ওর আগ্রহ শুধু তথ্য সংগ্রহে। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই বুঝে গিয়েছিল—অনিন্দ্যর গবেষণা যতটা নয়, ভালোবাসা ততটাই বেশি। এই মাটি, এই ফুল, এই গান—সবকিছুর মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে পেতে চাইছে।

আর সেই খোঁজের মাঝখানে এসে গিয়েছিল রূপসা।

সে জানে, ভালোবাসা একধরনের কোমল দুর্বলতা। যাকে জায়গা দিলে সে ভেতরটা ছুঁয়ে যায়। আবার সেই স্পর্শেই নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

রূপসা হারাতে চায় না নিজেকে। বহুদিন ধরে নিজের ভিতরটা গড়ে তুলেছে এই শান্তিনিকেতনের বাতাসে, এই মাটির গন্ধে। তার আঁকায়, তার নির্জনে, তার নীরবতায় সে নিজেকে পেয়েছে। এখন যদি হঠাৎ করে সেই নির্জনতা নষ্ট হয়ে যায়?

সে বুঝে গিয়েছিল অনিন্দ্য তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। বসন্ত উৎসবের দিন, সে যখন গালে আবির মেখে দিল, তখন ওর চোখে যে অবাক হয়ে থাকা গভীর তাকানো—সেটা কোনও ভুল ছিল না।

কিন্তু তারপরেই ভয়টা ফিরে আসে।
এই ছেলেটা ফিরবে শহরে। আবার অফিস, মেট্রো, ক্লাস, প্রেসেন্টেশন—আর রূপসা থেকে যাবে এই পলাশ গাছের নিচে, তার ক্যানভাসে, একলা।

ভালোবাসার চেয়ে বেশি নিঃসঙ্গতা কিছু নেই।

তাই সে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিল। ফোন ধরেনি, মেসেজের উত্তর দেয়নি। নিজেকে মনে করিয়ে দিয়েছে—এই ছেলেটা অতিথি, বসন্তের মতই। যেমন আসছে, তেমনই চলে যাবে।

কিন্তু যেদিন অনিন্দ্য সরাসরি এসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি পালাচ্ছো?”—সেদিন রূপসা বুঝল, এই ছেলেটার ভিতরেও তার মতোই ভয় আছে।

ভালোবাসা শুধু আকর্ষণ নয়, তা একধরনের প্রার্থনা। একটা শিকড়ের মতো, যা একবার গেঁথে গেলে উপড়ে ফেলা যায় না সহজে।

সেদিন রাতে রূপসা নিজের খাতার পাতা খুলে একটা ছবি আঁকল—দুজন হাঁটছে শালবনের মধ্য দিয়ে। পেছনে জ্যোৎস্না, সামনে কোনো গন্তব্য নেই। তারা জানে না কোথায় যাবে, তবুও হাঁটছে পাশাপাশি।

চোখ বন্ধ করে রূপসা ভাবল—
“হয়তো এই ভালোবাসাই চাই আমার। কথা না, নিশ্চয়তা না—শুধু একসঙ্গে হাঁটা।”

তবে কি এবার সে নিজের ভয় পেরোবে?

ক্যানভাসের আড়ালে

বিকেলটা অদ্ভুত রকম শান্ত। শালগাছের পাতাগুলো নড়ে না, বাতাস থেমে গেছে যেন। অনিন্দ্য বই হাতে খোলা চাতালে বসে, কিন্তু চোখ তার পাতার উপর নয়। মনটা কেমন যেন উসখুস করছে।

হঠাৎ পেছন থেকে রূপসার গলা—
— “চলো, একটা জায়গায় নিয়ে যাই তোমায়।”

চমকে উঠে দাঁড়াল অনিন্দ্য।
— “তুমি নিজে এসেছো?”
রূপসা হেসে বলল,
— “সবসময় পালিয়ে গেলে তো হবে না। কিছু সময় মুখোমুখি হতে হয়।”

ওরা হাঁটতে লাগল। চিত্রভবনের পিছন দিক দিয়ে একটা সরু পথ বেয়ে গেল। ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর—আধা স্টুডিও, আধা নিজের গড়া দুনিয়া। দরজার মাথায় ঝোলানো কাঠের বোর্ডে লেখা: “রঙের ভিতর জীবন”।

রূপসা ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করল। তারপর একটা কাপড় ঢাকা ক্যানভাসের দিকে ইঙ্গিত করল—
— “এটা আমি বহুদিন আগে আঁকেছিলাম। কাউকে দেখাইনি। আজ তোমায় দেখাতে চাই।”

অনিন্দ্য নিঃশব্দে মাথা নেড়ে কাপড়টা সরাল।

আর তারপর যে চিত্রটা চোখে পড়ল, তা দেখে তার বুকটা ধ্বক করে উঠল।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে—একটা লাল মাটির রাস্তা। রাস্তার একপাশে পলাশ গাছের সারি। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে এক ছেলেটি, সাদা পাঞ্জাবি পরা, গলায় গামছা, চোখে তাকিয়ে আছে দূরে। ছেলেটার মুখ আঁকা হয়নি স্পষ্ট করে, কিন্তু তবু যেন বুঝতে অসুবিধা হয় না—সে নিজেই।

— “আমি?”
রূপসা বলল,
— “হ্যাঁ। আমি তোকে বহুদিন আগে এঁকেছি। না, তোকে দেখার আগে নয়। কিন্তু তোর মধ্যে যা দেখেছি, তার ছায়া অনেকদিন আগেই অনুভব করেছিলাম।”

— “তাহলে তো তুমি আগেই ভালোবেসে ফেলেছিলে,” অনিন্দ্য হেসে বলল, চোখে জল জমে উঠেছে।
রূপসা উত্তর দিল না। শুধু বলল,
— “ভালোবাসা আগে-পরে হয় না। সে নিজের মতো সময় খুঁজে নেয়।”

অনিন্দ্য সামনে এগিয়ে এসে তার হাত ধরল।
— “তুমি কি এবার আমার সঙ্গে হাঁটবে? ঠিক যেমন ওই ছবির পথটা এগিয়ে গেছে, জানা নেই কোথায়, কিন্তু একসঙ্গে?”

রূপসা বলল—
— “হ্যাঁ, হাঁটব। তবে আমার মতো করে, আস্তে, থেমে থেমে, গন্ধ শুঁকে, আলো দেখে। পারবে তো?”

অনিন্দ্য জবাব দিল,
— “তুমিই আমার গন্তব্য, রূপসা। পথ নয়, সঙ্গীটাই তো সব।”

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় তারা পুকুরপাড়ে গিয়ে বসেছিল—আবার সেই পুরনো জায়গায়। তবে এবার তাদের মাঝখানে নীরবতা ছিল না। ছিল হাতের উপর হাত, আর একটা নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি।

পলাশ গাছগুলো জানে, এ ভালোবাসা বসন্তে শুরু হলেও, এর রং কোনও ঋতুর মধ্যে আটকে থাকবে না।

একদিন ফেরার আগে

ঘড়ির কাঁটা চলতে থাকে আপন গতিতে, কারো অপেক্ষা করে না। অনিন্দ্যর শান্তিনিকেতন থাকার সময় শেষের পথে। হাতে আর কেবল কয়েকটা দিন।

এই কয়েক মাসে যেন একটা আলাদা জীবন বুনে ফেলেছিল সে—পলাশ গাছ, শালবন, রূপসার ক্যানভাস, কাঁধে ঝোলা আর প্রতিদিনের হাঁটা।

আর রূপসা—সে যেন হয়ে উঠেছে এক নির্জন সুর, যা সারাদিন বাজে অনিন্দ্যর ভিতরে।

তবু ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। রিপোর্ট জমা দিতে হবে, সেমিনারে অংশ নিতে হবে। সেই পুরনো ছন্দে ফেরা—যেটা এখন কেমন যেন বেমানান মনে হয়।

রূপসা জানতে পেরেছিল ঠিকই। কিন্তু সে কিছু বলছিল না। ওদের দেখা হচ্ছিল প্রতিদিন, তবে যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠেছে—ভালোবাসা থেকেও কিছুটা দূরত্ব রেখে চলা।

এক বিকেলে, চিত্রভবনের পেছনের বাঁধানো ঘাটে বসেছিল দুজনে। পাখিরা ফিরছে, রোদ নেমে এসেছে চোখের পাতা ছুঁয়ে।

অনিন্দ্য বলল,
— “রূপসা, আমি জানি, ফিরে যেতে হবে। জানি, এখান থেকে কিছুই সঙ্গে করে নেওয়া যায় না। কিন্তু…”
— “তুমি কি কিছু রেখে যেতে চাও?” রূপসা থামিয়ে দিল।

অনিন্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “তুমি যদি চাও, আমি থেকে যেতে পারি।”

রূপসা তাকাল না। পেছনের দিকে শুয়ে থাকা গাছের পাতার দিকে চেয়ে রইল।
— “থেকে গেলে সেটা ভালোবাসা হবে না, হবে দায়। আমি চাই না, আমার জন্য তুমি নিজের স্বপ্ন ছেড়ে দাও।”

অনিন্দ্য বলল—
— “তাহলে তুমি কী চাও?”
রূপসা হেসে বলল—
— “আমি চাই, তুমি ফিরে যাও, এবং এমনভাবে ফিরে আসো—যেন আমি রয়ে গেছি তোমার ভিতর। যেন আমাদের এই বসন্ত কোনো দিন শেষ না হয়, শুধু রঙ বদলায়।”

সেদিন রাতে রূপসা একটা খামে ভরে অনিন্দ্যর হাতে একটা কাগজ দিল।
— “এখন খুলো না। ট্রেনে বসে খুলবে। যখন তুমি একা থাকবে, কিন্তু একদম একা না থাকতে চাও।”

পরদিন সকাল। স্টেশন। লালমাটি আবার উঠছে অনিন্দ্যর জুতায়। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, হুইসেল বেজেছে একবার।

রূপসা বলল না কিছু। শুধু এক মুহূর্তের জন্য ওর গালে হাত রেখে বলল—
— “এই মাটি কিন্তু তোমার পায়ের ছাপ মনে রাখবে।”

ট্রেন ছাড়ল।

অনিন্দ্য জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল যতক্ষণ পারা যায়। রূপসা আর দেখা যাচ্ছিল না, শুধু গাছের সারি আর রঙিন কিছু ঝলক।

খামের ভিতরের কাগজটা খুলল সে ধীরে।

একটা ছোট্ট স্কেচ—ওদের দুজন, পলাশ গাছের নিচে, হাতে হাত। নিচে লেখা:
“ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না। শুধু তার দৃশ্যপট বদলায়।”

পলাশ ফোটে ফিরে ফিরে

এক বছর কেটে গেছে।

কলকাতার জীবন আবার অনিন্দ্যকে গিলে ফেলেছে—মেট্রো রেলের গতি, অফিসের তাড়া, মেইল আর মিটিংয়ের ভিড়। কিন্তু এই গোটা বছরে শান্তিনিকেতন কখনোই তার ভেতর থেকে মুছে যায়নি।

প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যেয়, যখন জানলার পাশে বসে থাকে, তখন মনে পড়ে সেই পুকুরপাড়, সেই ক্যানভাসের ঘ্রাণ, আর সবচেয়ে বেশি—রূপসার চোখের সেই নির্ভার, কিন্তু গভীর দৃষ্টি।

এবছর বসন্ত উৎসবের আগে, হঠাৎ সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কারও কিছু না বলে ব্যাগ গোছায়, পুরোনো ঝোলা, রঙচটা খাতা, আর একজোড়া আবিরের প্যাকেট—হলুদ আর কমলা।

বোলপুর স্টেশন সেই একই আছে, তবে এবার নিজের মতো পরিচিত। রাস্তাগুলো চেনে, কিন্তু মানুষের মুখগুলো নতুন।

চিত্রভবনের দিকেই আগে হাঁটে। সেই গাছ, সেই পলাশ এখন আরও জ্বলজ্বল করছে। ঠিক একবছর আগে এই গাছের নিচেই সে প্রথম রূপসাকে দেখেছিল।

কেউ আঁকছে। কিন্তু রূপসা নেই।

হতাশ হয়ে পুকুরপাড়ে গেল সে। সেখানে বসে রইল একা, দীর্ঘ সময় ধরে।

তখনই শুনল—
— “তুমি এবার দেরি করে এলেও, পলাশ কিন্তু সময়মতোই ফোটে।”

চমকে পেছনে তাকাল। রূপসা।

ঠিক আগের মতোই, মাথায় হলুদ ওড়না, চোখে মৃদু হাসি।

অনিন্দ্য কিছু বলল না। শুধু উঠে এসে পাশে দাঁড়াল।
— “তুমি জানো, আমি প্রতিদিন ভেবেছি তোমার কথা। কিন্তু জানতাম না, আবার দেখা হবে কি না।”

রূপসা বলল—
— “তোমার দেওয়া গানের সিডিটা আমি রোজ শুনি। ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ এখন আমার ভিতরে বাজে, এমনকি চুপ করে থেকেও।”

তারা পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। পেছনে পলাশ গাছগুলো একে একে মাথা নাড়ছে বাতাসে।

অনিন্দ্য হঠাৎ থেমে বলল—
— “এইবার আর আসা-যাওয়ার খেলা খেলতে চাই না, রূপসা। আমি থেকে যেতে চাই, যদি তুমি চাও।”

রূপসা চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওর চোখে। তারপর মাথা নেড়ে বলল—
— “তবে থাকো, তবে হাঁটো আমার পাশে। কিন্তু মনে রেখো, ভালোবাসা কখনো গন্তব্য নয়, এ শুধু পথ। আর এই পথ—লাল মাটির, পলাশের, আর নিঃশব্দ অনুভবের।”

পেছনে সূর্য ডুবছে। তাদের ছায়া লম্বা হয়ে যাচ্ছে।

রূপসা হাত বাড়াল, অনিন্দ্য তাতে হাত রাখল।

আকাশ জুড়ে ভেসে উঠল বসন্তের রঙ, আর তাদের চারপাশে শুধু পলাশ—ফুটছে আবার, ফিরে ফিরে, ঠিক তাদের মতো।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-06-19-at-5.18.37-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *