অর্পিতা সেনগুপ্ত
১
২০২৫ সালের বসন্তকাল। শান্তিনিকেতনের কাঁচা রাস্তার ধুলো তখনো শীতের শেষ হাওয়ায় হালকা হয়ে উড়ছে, আর কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোতে ফুটতে শুরু করেছে লালচে ফুল। ভোরবেলা গ্রামের পূর্বদিকে হঠাৎ যেন এক অচেনা কোলাহল নেমে আসে। কাঁচা রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ঢুকে পড়ে কয়েকটি বড় ট্রাক—কেউ বহন করছে বিশাল আলো ঝোলানোর স্ট্যান্ড, কেউ বা কাঠের বাক্সে ভরা অদ্ভুত যন্ত্রপাতি। সঙ্গে রঙিন কভার দিয়ে ঢাকা পোশাকের গাড়ি, আরেকটিতে খাবারের সরঞ্জাম। কয়েকজন লম্বা বিদেশি, গলায় ক্যামেরা ঝুলানো, আর চওড়া টুপিওলা কর্মীরা নামতেই গ্রামের শিশুরা কৌতূহলী চোখে ভিড় জমায়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা খেজুর গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে, “ওরা নাকি সিনেমা তুলবে।” শ্যামলী দত্তের হোমস্টের উঠোন তখন হইচইয়ে ভরা—সেখানেই ইউনিটের কয়েকজন আগেই এসে চা খাচ্ছে। এই হোমস্টেরেই থাকবেন কয়েকজন ক্রু, আর স্থানীয় গাইড হিসেবে আগেই খবর পেয়েছে মধু মণ্ডল—তাকে সকালেই হাজির হতে হবে বিদেশিদের লোকেশন দেখানোর জন্য।
মধু যখন পৌঁছায়, তখন হোমস্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন লম্বা শ্যামলা মেয়ে নোটবুকে কিছু লিখছে। পরনে সুতির কুর্তা, পায়ে ক্যানভাস জুতো, আর চুলগুলো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে আছে। মধু প্রথমে তাকে চিনতে পারে না, পরে আন্দ্রেয়াস ডিরেক্টর তাকে ডেকে বলে, “This is Rima, our costume designer.” রিমা মাথা তুলে হালকা হাসি দেয়, কিন্তু সেই হাসিতে একটা শহুরে অভ্যস্ততা—যেটা মধুর কাছে অচেনা, যেন দূর থেকে শোনা কোনো সুর। কাজের সূত্রেই প্রথম কথা হয়। রিমা জানতে চায়, আশেপাশে কোথায় এমন লোকেশন আছে যেখানে পুকুরপাড়, খোলা মাঠ আর পুরনো বটগাছ একসঙ্গে ধরা যায় ক্যামেরায়। মধু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে তার চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আছে, তবে দুপুরের আলোয় গেলে ভালো লাগবে।” এই সংলাপের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য সুতো বুনতে শুরু করে—কিন্তু তখনো দু’জনের কেউ তা টের পায় না।
দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শুটিং প্রস্তুতি শুরু হয়। গ্রামের লোকেরা চারপাশে দাঁড়িয়ে দেখে, কেমন করে বিদেশিরা বড় বড় লাইটের কাঠামো বাঁধছে, কেমন করে মাটিতে চক দিয়ে চিহ্ন টেনে ক্যামেরার অবস্থান ঠিক করছে। মধু রিমাকে নিয়ে লোকেশন ঘুরে দেখাতে যায়—কাঁচা রাস্তার ধারে ধানগাছের সবুজ ঢেউ, মাঝখানে ভাঙা সেতু, আর দূরে তালগাছের সারি। রিমা হাঁটতে হাঁটতে সবকিছু খুব মন দিয়ে দেখে, মাঝে মাঝে থেমে নোটবুকে স্কেচ করে। তার হাঁটার ভঙ্গি তাড়াহুড়ো নয়, কিন্তু তবুও মধু বুঝতে পারে—এ মেয়ে অভ্যস্ত ব্যস্ততার মধ্যে চলতে। আর রিমা যখন খেয়াল করে, মধুর চোখে একধরনের প্রশান্তি লেগে আছে—যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গেই সময় একটু ধীরে বয়ে যায়—তখন অজান্তেই তার মনে হয়, এই মানুষটির ভেতরে এমন কিছু আছে যা শহুরে আড়ম্বর জানে না। এই প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তেই এক অদ্ভুত টানটান ভাব তৈরি হয়—না তাড়াহুড়ো, না নির্লিপ্ততা—বরং এমন এক অনুভূতি, যেন দুই ভিন্ন জগতের মানুষ একই আকাশের নিচে একে অপরকে চেনা শুরু করেছে।
২
দুপুরের আলো তখন নরম হয়ে এসেছে, আকাশে হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। লোকেশন স্কাউটিং-এর ফাঁকে মধু রিমাকে বলল, “আপনাকে একটা জায়গা দেখাই?” রিমা কৌতূহলী চোখে মাথা নাড়ল। তারা হেঁটে গেল সরু কাঁচা পথ ধরে, দু’পাশে শিমুল গাছের লাল ফুল ঝরে আছে মাটিতে। বাতাসে পাকা ধানের গন্ধ আর পুকুরপাড়ের কচি ঘাসের সোঁদা সুবাস। কিছুদূর গিয়ে রাস্তা হঠাৎ বাঁক নিয়ে থেমে গেল এক পুকুরের ধারে—যেন সবুজ জলে ভেসে আছে অসংখ্য গোলাপি পদ্মফুল। রিমা থমকে দাঁড়াল, বিস্ময়ের রঙ তার চোখে ছড়িয়ে পড়ল। সে ধীরে ধীরে বারান্দার ব্যাগ থেকে স্কেচবুক বের করল, হাঁটু গেড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে রঙ পেন্সিলে আঁকতে শুরু করল। মধু কিছু বলল না, শুধু তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। পুকুরের জল হালকা হাওয়ায় কেঁপে ওঠে, আর পদ্মফুলগুলো সেই দুলুনি খেলে পাপড়ি নাড়িয়ে যেন কারও সাথে গোপন কথা বলে।
রিমা আঁকতে আঁকতে মধুর দিকে একবার তাকাল, যেন কিছু বলবে, কিন্তু তারপর আবার চুপচাপ কাগজে মন দিল। মধুর চোখ তখন পুকুরের দিকে, কিন্তু তার মন চলে গেছে অন্য কোথাও—সে ভাবছে, এই দৃশ্যটা হয়তো সে শতবার দেখেছে, তবু আজ কেমন যেন নতুন লাগছে। রিমার আঙুলের চলনে এমন এক মৃদুতা আছে, যেন সে শুধু ফুল আঁকছে না, জলের ঢেউ, আকাশের প্রতিফলন, এমনকি বাতাসের ঘ্রাণও কাগজে বন্দি করছে। হঠাৎ মধুর মনে হল, যদি একটা ফুল তুলে রিমাকে দেয়, কেমন হবে? কিন্তু সাথে সাথেই ভাবনাটা থামিয়ে দিল। এই ফুল জলের মধ্যে যেমন আছে, তেমনই সুন্দর—তাকে ছিঁড়ে নিলে সৌন্দর্যের প্রাণটাই নষ্ট হয়ে যাবে। সে ধীরে ধীরে বলল, “ফুলটা এখানেই থাকুক, জল ছাড়া ওর বাঁচা মুশকিল।” রিমা একটু থেমে তার দিকে তাকাল, তারপর মুচকি হাসল—এমন এক হাসি, যাতে সম্মতি আছে, আর আছে এক অদৃশ্য সেতুর প্রথম পাথর বসানো।
পুকুরের ধারে সেই বিকেলটা আর তেমন কিছু ঘটেনি—না কোনো বড় আলাপ, না কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি। তারা কেবল নীরবে বসে ছিল, মাঝে মাঝে জলের শব্দ বা দূরে গরুর ঘণ্টির টুংটাং ভেসে আসছিল। কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যেই যেন এক কোমল সুর বেজে উঠেছিল, যা তারা দু’জনেই অনুভব করেছিল, যদিও কেউ মুখে আনেনি। সূর্য ঢলে এলে রিমা স্কেচবুক বন্ধ করে ব্যাগে রাখল, আর মধু বলল, “চলুন, আলো নষ্ট হয়ে যাবে।” তারা পাশাপাশি হাঁটতে লাগল, আর পেছনে রয়ে গেল পুকুর, পদ্মফুল আর সেই প্রথম নীরব মুহূর্ত—যেটা তাদের সম্পর্কের শুরুর গোপন দিনলিপির প্রথম লাইন হয়ে গেল।
৩
শুটিং শুরু হওয়ার পর গ্রামটা যেন অন্যরকম রূপ নিল। সকালবেলা থেকেই বড় বড় লাইট, ক্যামেরা, তারের জট, আর লোকজনের হাঁটাহাঁটিতে পুকুরপাড় থেকে কাঁচা রাস্তা পর্যন্ত ব্যস্ততা। রিমা কস্টিউমের কাপড়গুলো বড় বড় বাঁশের ওপর ঝুলিয়ে রোদে শুকোচ্ছে, কখনও অভিনেতার শরীরে মাপ নিচ্ছে, কখনও বা সেলাই মেশিনে তাড়াহুড়ো করে শেষ মুহূর্তের পরিবর্তন করছে। মধুর কাজ অন্য—বিদেশি ডিরেক্টর আন্দ্রেয়াস আর স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা। সে লোকাল ভাষা থেকে ইংরেজি, আবার ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করছে, লোকেশন বদলের নির্দেশ দিচ্ছে, আর ক্রুদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করছে। তবু এই কর্মব্যস্ততার মাঝেও দু’জনের চোখ প্রায়ই একে অপরের দিকে আটকে যায়—হয়তো রিমা দূর থেকে মধুকে চা দিচ্ছে, অথবা মধু কাপড়ের বোঝা নিয়ে রিমার দিকে এগিয়ে আসছে।
ফাঁকের সময়গুলোতে তাদের আলাপ জমতে থাকে। একদিন দুপুরে, সবাই লাঞ্চে ব্যস্ত, রিমা মধুকে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে সকালের নাশতায় কী খাও?” মধু হেসে বলল, “মুড়ি আর চা, কখনও লুচি, তবে সবসময় গ্রামের ঘরের রান্না।” রিমা হাসল, “আমাদের ওখানে তো সকাল মানেই কফি আর ব্রেড।” তারপর থেকে সুযোগ পেলেই তারা শহর-গ্রামের পার্থক্য নিয়ে কথা বলতে লাগল—শহরের ব্যস্ততা বনাম গ্রামের ধীর গতি, ফাস্টফুড বনাম খেজুর গুড়ের পাটিসাপটা, মেট্রোর ভিড় বনাম ক্ষেতের হাওয়া। মাঝে মাঝে মধু গ্রামের মানুষের গল্প শোনাত—কোন বৃদ্ধ কৃষক কেমন করে ধান কাটে, বা কোন ছেলেটা কীভাবে ফুটবল খেলায় নাম করেছে। রিমা শোনে আর চোখের সামনে সেই দৃশ্যগুলো কল্পনা করে।
আন্দ্রেয়াস ডিরেক্টর, যিনি খুব কম কথা বলেন, এইসব মুহূর্ত লুকিয়ে লুকিয়ে ক্যামেরায় ধরে রাখেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, মধু আর রিমার এই ক্ষুদ্র আলাপগুলো যেন তাদের কাজের বাইরেও এক অদৃশ্য কাহিনি তৈরি করছে—যা মূল সিনেমার ফ্রেমে ধরা পড়বে না, কিন্তু হয়তো কোনোদিন কেউ সেই ফুটেজ দেখলে বুঝবে, কীভাবে ক্যামেরার ফাঁকে এক সম্পর্কের প্রথম রঙ গোপনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। বিকেলের দিকে, সূর্যের আলো যখন গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পুকুরের জলে পড়ে, তখন প্রায়ই দেখা যেত মধু আর রিমা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কিছু একটা আলোচনা করছে—এমনকি তারা যদি নীরবও থাকে, তবুও তাদের মধ্যে সেই অনুচ্চারিত স্বস্তি যেন পুরো পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ত।
৪
সেই দিন বিকেল থেকে আকাশে কালো মেঘ জমেছিল, আর সন্ধ্যার মুখে হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামল। শুটিং বন্ধ হয়ে সবাই হোমস্টের বারান্দায় আশ্রয় নিল। বাইরে তালপাতার আওয়াজ, টিনের চালের টুপটাপ শব্দে চারপাশ ভরে গেছে। শ্যামলী দত্ত, হোমস্টের মালকিন, চুলায় কড়াই বসিয়ে মুড়ি ভেজে চিঁড়ে-গুড় দিয়ে কিছু একটা বানাচ্ছিলেন। এতদিন ধরে তিনি রিমাকে কেবল অতিথি হিসেবেই দেখেছেন—শহুরে মেয়ে, কাজ নিয়ে ব্যস্ত, যার সঙ্গে গ্রামীণ মেলবন্ধন হবে না বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু সেদিন রিমা চুপচাপ এসে তার পাশে বসে বলল, “আপনি কি আমাকে শেখাবেন, কীভাবে এই মুড়ি ভাজেন?” শ্যামলী প্রথমে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন, তারপর একটু হাসি ফুটল মুখে—যেন বরফের দেওয়াল ভেঙে গেল এক মুহূর্তে।
চুলার ধোঁয়া আর গরম তেলের গন্ধে রান্নাঘর ভরে গেছে। শ্যামলী হাতে মুড়ি নাড়তে নাড়তে নিজের শৈশবের কথা বলতে লাগলেন—কীভাবে বর্ষায় পুকুরে সাঁতার কাটতেন, কীভাবে মায়ের হাতের পাটিসাপটার জন্য সারা গ্রাম অপেক্ষা করত। রিমা মন দিয়ে শুনছিল, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছিল, “তখন কি বিদ্যুৎ ছিল না?” অথবা “আপনারা কি নিজেরা চাল ভাঁজতেন?” তাদের কথায় সময় গড়াতে লাগল, আর বাইরে বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমে এলো। রিমা রান্নার ফাঁকে শ্যামলীকে নিজের শহুরে শৈশবের গল্প বলল—মেট্রোর আওয়াজ, স্কুলের পর ফুচকা খাওয়া, আর পুজোর সময়ে রাস্তায় ঠেলাঠেলি করে প্যান্ডেল দেখা। দুই ভিন্ন জীবনের গল্প যেন এক সুতোর মালায় গাঁথা হতে লাগল।
মধু দূর থেকে বারান্দার এক কোণে বসে এই দৃশ্য দেখছিল। রিমার হাতে যখন চুড়ি নেই, কিন্তু তবুও সে কেমন যেন গ্রামের মেয়েদের মতোই দেখাচ্ছে—চুল খোঁপা করে বাঁধা, মুখে হালকা হাসি, চোখে মনোযোগ। তার মনে হল, রিমা যদি এই গ্রামেই জন্মাত, তাহলে হয়তো পুকুরঘাটের পথে তাকে প্রায়ই দেখা যেত—হয়তো মাথায় জলভরা কলস নিয়ে হাঁটছে, হয়তো শ্যামলীর রান্নাঘরে বসে শীতের পিঠে বানাচ্ছে। সেই কল্পনায় এক অদ্ভুত উষ্ণতা অনুভব করল মধু। বাইরে বৃষ্টির গন্ধে ভেজা মাটির সুবাস আর ভেতরে রান্নার সুগন্ধ মিলে হোমস্টের সেই সন্ধ্যা যেন এক অমলিন ছবির মতো হয়ে রইল তার মনে।
৫
সকালের আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছিল, কিন্তু কেউ ভাবেনি যে শুটিং পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাবে। বিদেশি ডিরেক্টর আন্দ্রেয়াস কিছুটা বিরক্তি নিয়ে জানালেন, “আজ লাইট ঠিক হবে না, রোদ চাই।” ক্রুদের বেশিরভাগই হোমস্টেতে ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিল। রিমা নিজের কস্টিউম ব্যাগ গুছিয়ে দরজার বাইরে বেরোতেই দেখল, মধু ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে চিরচেনা শান্ত হাসি। রিমা অবাক হয়ে বলল, “তুমি এখনো এখানে?” মধু মাথা নেড়ে বলল, “আজ তো ছুটি হয়ে গেল, ভাবলাম তোমাকে একটু অন্য জায়গা দেখাবো।” রিমা ভ্রু উঁচিয়ে কৌতূহলভরে তাকাল, আর কোনো প্রশ্ন না করেই ছাতার নিচে চলে এল। তারা মাটির পথ ধরে হেঁটে চলল, চারপাশে বৃষ্টির হালকা গন্ধ ভাসছে। পথে গ্রামের দু’একজন তাদের দেখে মুচকি হাসল—বিদেশি ফিল্মের কস্টিউম ডিজাইনার আর স্থানীয় গাইডের এই বন্ধুত্ব এখন আর সবার অজানা নয়।
পথ যতই এগোতে লাগল, ততই বৃষ্টির শব্দ ঘনিয়ে এল। মধু রিমাকে নিয়ে এল কপালকুণ্ডলা নদীর ধারে—একটা পুরনো কাঠের ঘাট, যেখানে সিঁড়ি নেমে গেছে জলের দিকে। নদীটা তখন ভরা বর্ষায় গাঢ় সবুজ রঙে শান্তভাবে বয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ঢেউ তুলছে। রিমা এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল। শহুরে জীবনে নদী মানে তার কাছে শুধু ব্রিজের নিচ দিয়ে দেখা জল আর দূরের নৌকা, কিন্তু এখানে নদী যেন চোখের সামনে এক জীবন্ত প্রাণ। মধু চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখানে দাঁড়ালে বোঝা যায়, আকাশ আর জল একে অপরকে ছুঁয়ে থাকে।” রিমা একদম নীরব হয়ে গেল। হঠাৎ একটা বালক নদীতে ঝাঁপ দিল, জলে গড়াগড়ি খেল, আর দূরে দাঁড়ানো তার বন্ধুরা হেসে চিৎকার করল। রিমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “শহরে আমরা কখনো এত খোলা আকাশের নিচে এতক্ষণ কাটাই না। সবসময় তাড়া, শব্দ, ভিড়।”
মধু হালকা হাসল, সেই হাসিতে যেন বৃষ্টির পরের শীতলতা মিশে আছে। সে বলল, “এখানে আকাশও কথা বলে।” রিমা তার দিকে তাকাল, মনে হল এই মানুষটার কথার ভেতরে কোনো অদৃশ্য সত্য লুকিয়ে আছে। তারা কিছুক্ষণ নদীর ধারে বসে রইল, বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে রিমার চুলের গোছা মুখে এসে লাগল, মধু চুপচাপ হাত বাড়িয়ে সেটা সরিয়ে দিল। কোনো কথা নয়, শুধু নদীর শব্দ, আকাশের নীরবতা আর অচেনা এক অনুভূতির ঢেউ যেন তাদের চারপাশে ঘিরে ধরল। দূরে কোথাও মেঘ গর্জে উঠল, আর নদীর ওপরে হালকা কুয়াশা জমতে শুরু করল। তখনই রিমা অনুভব করল, এই গ্রাম, এই নদী আর এই মানুষ—সব মিলিয়ে যেন তার ভেতরে একটা নতুন ছবি আঁকছে, যা কোনোদিনও সে ভুলতে পারবে না।
৬
হোমস্টের আকাশে সেই রাতে চাঁদের আলো মিশে গিয়েছিল হালকা শীতল বাতাসের সঙ্গে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর মাঝে মাঝে গাছের পাতার ফাঁকে হাওয়ার মৃদু শোঁ শোঁ শব্দ। মধু নিজের ঘরে ফেরার পথে হঠাৎ বারান্দার এক কোণে আলো দেখতে পেল। পায়ের শব্দ চুপিয়ে কাছে গিয়ে দেখে, রিমা একা বসে আছে ছোট্ট টেবিলের সামনে, পাশে তার স্কেচবুক আর কয়েকটি রঙিন কলম ছড়ানো। কিন্তু আজ স্কেচবুক নয়—সে সাদা কাপড়ের উপর রঙ দিয়ে নকশা আঁকছে। মধুর কৌতূহল জাগে, সে ধীরে ধীরে কাছে এসে দাঁড়ায়। রিমার আঙুলে রঙের দাগ, চোখে গভীর মনোযোগ, যেন বাইরের দুনিয়ার কোনো অস্তিত্ব নেই। মধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু রিমা হঠাৎ খেয়াল করে, মাথা তুলে হেসে বলে, “তুমি আবার চুপিসারে এসে দাঁড়ালে?”
মধু মৃদু হাসল, তারপর কাপড়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “এত সুন্দর নকশা! কিন্তু সবগুলোতেই পদ্মফুল কেন?” রিমা রঙের তুলি নামিয়ে রেখে ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “পদ্ম আমার কাছে কেবল একটা ফুল নয়। এটা আমার শান্তির প্রতীক… আমার নিজের ভেতরের একটা জায়গা, যেটা এতদিন শহরের ভিড়, কোলাহল, দৌড়ঝাঁপে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখানে এসে, এই গ্রাম, নদী, তোমাদের সরলতা—সব মিলে যেন সেই জায়গাটা আবার খুঁজে পেয়েছি।” তার কণ্ঠে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি, কিন্তু তাতে লুকোনো আছে বহুদিনের ক্লান্তি। মধু তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, এই পদ্মফুল শুধু একটি নকশা নয়—এ যেন রিমার নিজের জীবনের গল্প, যা সে কাউকে বলে না।
রাত গভীর হতে থাকে, বারান্দার বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। মধু কিছু না বলে চুপচাপ বসে পড়ে রিমার পাশে, যেন তার এই নীরব সৃজনের অংশ হয়ে থাকতে চায়। রিমা আবার তুলি হাতে নেয়, কিন্তু এবার মধুকে বলে, “তুমি চাইলে একদিন তোমাকেও শিখিয়ে দেব এই নকশা আঁকা।” মধু হেসে মাথা নাড়ে, তার মনে হয়, এই মুহূর্তটাই হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে শান্ত, সবচেয়ে সত্যি মুহূর্ত। আর আন্দাজও করতে পারে না যে, এই পদ্মফুল হয়তো একদিন তাদের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে—যা লিখে রাখা থাকবে না কোনো কাগজে, বরং থেকে যাবে গোপন ডায়েরির মতো তাদের দু’জনের হৃদয়ে।
৭
শুটিংয়ের দিনটা ছিল রোদঝলমলে, তবে আকাশে হালকা সাদা মেঘের ভেসে থাকা যেন একটা আলগা নির্লিপ্ততা তৈরি করেছিল। লোকেশন ছিল গ্রামের এক পুরনো মাটির রাস্তা, দু’পাশে ধানের ক্ষেত, আর দূরে দেখা যাচ্ছিল গাছের সারি। পুরো ইউনিট মজা করছিল, কারণ আজ ছিল তুলনামূলকভাবে হালকা শিডিউল। নীলাঞ্জন, যিনি ছবির এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করছেন এবং শহুরে রসবোধের জন্য পরিচিত, একদম হেসে হেসে শটের ফাঁকে রিমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। কথাবার্তা চলছিল হালকা-পাতলা, ঠিক তখনই তিনি অকারণে বলে ফেললেন, “মধু তো রিমার জন্য পাগল হয়ে আছে।” কথা শুনে আশপাশের কয়েকজন টেকনিশিয়ান খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। রিমা প্রথমে চমকে গেলেও মুহূর্তেই হাসি চাপার চেষ্টা করল, কিন্তু তার চোখের ভেতরে এক ধরণের অস্বস্তি ঝলকে উঠল, যা মধু দাঁড়িয়ে থাকা দূর থেকেও টের পেল না। তার কাছে সবকিছুই ছিল সাধারণ মজার আলাপের মতো, কিন্তু রিমার মনে তখনই যেন এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার বীজ বপন হলো।
বিকেলের শুটিং শেষ হওয়ার পর রিমা আর মধুর মধ্যে কথাবার্তা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। আগে যেমন শটের ফাঁকে দু’জনের চোখে-চোখে চুপিসারে ছোট ছোট হাসি বিনিময় হতো, আজ তেমন কিছুই ঘটল না। রিমা তার কাজ শেষ করে সোজা মেকআপ ভ্যানে চলে গেল, মধুর কোনো কথা শোনার সুযোগই দিল না। মধু প্রথমে ভেবেছিল হয়তো রিমা ক্লান্ত, কিন্তু রাতের খাবারের সময়ও যখন সে দূরত্ব বজায় রাখল, তখন মধুর মনে সন্দেহের কাঁটা খোঁচা দিতে শুরু করল। সে মনে মনে ভাবল, “আমি কি কিছু ভুল বলেছি? নাকি আচমকা কিছু করে ফেলেছি?” কিন্তু সে বুঝতেই পারছিল না, সমস্যাটা আসলে কোথায়। অন্যদিকে রিমা নিজের ভিতরে এক ধরণের লজ্জা আর বিরক্তির মিশ্রণ অনুভব করছিল—লজ্জা এই জন্য যে, এমন ইঙ্গিত সামনে সবাইকে শোনানো হয়েছে, আর বিরক্তি এই জন্য যে, মধু হয়তো সত্যিই তার জন্য কিছু অনুভব করে, অথচ সে তা বুঝতে পারছে না বা লুকোচ্ছে।
সন্ধ্যার পর গ্রামের আকাশে হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল, হোমস্টের বারান্দায় সবাই বসে চা খাচ্ছিল। মধু চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, আর রিমা হালকা আলোতে নিজের ফোন স্ক্রল করছিল, যেন চোখে না পড়ার চেষ্টা করছে। নীলাঞ্জন তখনো হাসি-ঠাট্টায় মেতে ছিল, কিন্তু তার আগের কথাটা যেন দু’জনের মাঝেই এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছিল। মধু চাইলেও এগিয়ে এসে কিছু বলতে পারছিল না—সে ভয় পাচ্ছিল, হয়তো কিছু ভুল বুঝে আরও পরিস্থিতি খারাপ করবে। আর রিমা, নিজের মনের ভেতরে ঢেউ খেলানো অস্থিরতার সঙ্গে লড়াই করছিল, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না মধুর সঙ্গে আগের মতো নির্ভারভাবে কথা বলা এখন ঠিক হবে কিনা। রাত গভীর হলে দু’জনেই আলাদা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল, কিন্তু তাদের মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—কে প্রথম সেই অদৃশ্য দূরত্ব ভাঙবে, আর আদৌ কি সেটা ভাঙা সম্ভব হবে?
৮
পৌষ মেলার রাত যেন গ্রামটিকে অন্য এক রূপে সাজিয়ে দিয়েছিল। চারপাশে মাটির প্রদীপের আলো, নারকেল পাতার বাঁধন, পাটের রঙিন পতাকা—সব মিলিয়ে যেন সময় কয়েক দশক পিছিয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর মাঠের একপাশে অস্থায়ী মঞ্চে লোকগানের দল সুর বাঁধতে শুরু করেছে, আর অপর প্রান্তে হাতপাখা, মাটির বাসন, কাঠের খেলনা, বোনা শাল—সব মিলিয়ে হাট বসেছে। এই ভিড়ের মধ্যেই রিমা হোমস্টে থেকে বেরিয়ে এল শাড়ি পরে, চুলে তাজা গাঁদা ফুল গুঁজে। মধু প্রথম তাকে দেখেই এক মুহূর্ত স্থির হয়ে গেল—রিমা যেন ঠিক সেই পদ্মফুলের প্রতিচ্ছবি, যেটা তারা প্রথম দিন পুকুরে দেখেছিল। আলো-আঁধারি মাঠের মধ্যে রিমার গায়ের রঙ, শাড়ির রং, আর তার মৃদু হাসি একসঙ্গে মিলেমিশে যেন কোনো পুরনো গ্রামীণ গল্পের ছবিকে জীবন্ত করে তুলছিল। মধুর চোখে পড়ল, আশেপাশের কয়েকজনও রিমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে হালকা কণ্ঠে বলল, “আজকে তুমি মেলার সেরা সাজ।” রিমা একটু লাজুক হেসে বলল, “তুমি কি সবসময়ই এমন করে কথা বলো?” মধুর উত্তর ছিল একটুকরো নীরবতা, যার ভেতরে যেন অনেক অপ্রকাশিত বাক্য লুকিয়ে ছিল।
তারা দু’জনে মেলার ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। মধু রিমাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের বিভিন্ন খাবারের স্বাদ নিতে বলল—পাটিসাপটা, খেজুরের গুড়ের রসগোল্লা, ঝাল মুড়ি আর কচুরি-আলুর দম। রিমা প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও পরে হাত দিয়ে মুড়ি মাখতে শুরু করল, আর হেসে বলল, “শহরে থাকলে আমি কখনো এভাবে হাত মেখে খেতাম না।” মধু তৃপ্তি নিয়ে তার এই রূপান্তর দেখছিল। এরপর তারা হাটের এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে গ্রামের বয়স্ক এক কারিগর কাঠের বাঁশি বাজাচ্ছিলেন—তার সুরে যেন নদীর জলের মৃদু ঢেউয়ের শব্দ মিশে আছে। হঠাৎ আন্দ্রেয়াস ক্যামেরা হাতে হাজির হয়ে তাদেরকে দেখে মৃদু হাসল, যেন নীরবে বুঝে ফেলেছে—এ রাতের সৌন্দর্য কেবল মঞ্চের লোকগানে নয়, এই দুই মানুষের নীরবতার মধ্যেও আছে। রিমা মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে মধুর দিকে তাকাচ্ছিল, কিন্তু চোখ মেলামেশা হলেই দ্রুত অন্য দিকে তাকিয়ে নিচ্ছিল, যেন নতুন করে হৃদয়ের এক অচেনা সুরে ধরা পড়ে গেছে।
মেলার শেষে মাঠের মাঝে বড় করে আগুন জ্বালানো হল, চারপাশে গ্রামের মানুষ হাতে হাত রেখে ঘুরে ঘুরে নাচছে। রিমা প্রথমে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কিন্তু মধু এগিয়ে এসে বলল, “এসো, ভয় পেয়ো না—এখানে সবাই গান গায়, সবাই নাচে।” রিমা হালকা দ্বিধা কাটিয়ে তার হাত ধরল, আর মধু তাকে নিয়ে আগুনের চারপাশে ঘুরতে শুরু করল। রাতের আকাশে তারার ভিড়, কানে ভেসে আসছে ঢোলের তালে ভরা গানের সুর, আর আগুনের আলোয় রিমার মুখ যেন এক নতুন উজ্জ্বলতা পেয়েছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য রিমা ভুলে গেলো শহর, শুটিং, কোলাহল—তার মনে হচ্ছিল, এই গ্রাম, এই মেলা, এই হাতের উষ্ণতা—সবই যেন তার নিজের। নীলাঞ্জনের বলা কথার ভুল বোঝাবুঝি যেন এই আগুনের তাপে গলে গেল। রাত যখন গাঢ় হল, মধু আর রিমা মেলা থেকে ফেরার পথে কিছু না বলেই পাশাপাশি হাঁটছিল। তাদের নীরবতা এবার আর দূরত্বের নয়—বরং এক অদৃশ্য সেতুর মতো, যা ধীরে ধীরে তাদের দু’জনকে আরও কাছে টেনে আনছিল।
৯
শেষ দিনের সকালটা যেন অন্য রকম নীরবতায় ভরা ছিল। গ্রামজুড়ে হালকা কুয়াশা, শীতের বাতাসে ধানের গন্ধ, আর হোমস্টের উঠোনে ঝরে থাকা গাছের পাতাগুলো যেন বিদায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। রিমা তখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল, কিন্তু চোখ বারবার জানালার বাইরে চলে যাচ্ছিল, যেখানে মধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে দূরের মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। শুটিংয়ের শেষ দিন হওয়া সত্ত্বেও কারও মুখে হাসি নেই, শুধু একধরনের অব্যক্ত চাপা কষ্ট। দুপুরের খাওয়া শেষে রিমা সবার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানায়, কিন্তু মধুর সঙ্গে আলাদা করে কোনও কথা হয় না—শুধু চোখাচোখি হলে এক মুহূর্তের নীরবতা, যা কথার থেকেও ভারী।
শেষ বিকেলে মধু নিজেই রিমার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলে, “চলো, কোথাও যাই।” রিমা অবাক হয়ে তার পিছু নেয়, আর তারা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় সেই পুকুরের ধারে, যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে, আকাশের রঙ মিশে যাচ্ছে কমলা, গোলাপি আর বেগুনিতে। জলের ওপর ভেসে আছে কিছু পদ্মফুল, আর হাওয়ায় হালকা শীতের শিরশিরে স্পর্শ। মধু ধীরে ধীরে পুকুরের ধারে নেমে যায়, জলে হাত ডুবিয়ে একটা সজীব পদ্মফুল তুলে আনে। রিমা কিছু বলার আগেই মধু সেই ফুল তার হাতে দিয়ে নরম স্বরে বলে, “এটা শুকিয়ে যাবে, কিন্তু গন্ধ থাকবে।” সেই কথার ভেতর যেন জমে থাকা সব অনুভূতি, সব অব্যক্ত কথা মিশে ছিল—যা রিমার চোখে হঠাৎ জল এনে দেয়।
দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু বাতাসের শব্দ আর দূরে কারও বাঁশির সুর শোনা যায়। রিমা ফুলটা বুকের কাছে চেপে ধরে, যেন সেটা শুধু একটা ফুল নয়, বরং এই গ্রামের স্মৃতি, মধুর হাসি, বৃষ্টিভেজা নদীর ধারে কাটানো বিকেল—সবকিছুর প্রতীক। মধু কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দগুলো তার ঠোঁটেই আটকে যায়। শেষ আলো ম্লান হতে হতে রিমা ধীরে পা বাড়ায়, পেছনে একবার ফিরে তাকায়—মধু তখনও দাঁড়িয়ে আছে পুকুরপাড়ে, হাতে পকেটে রাখা, মুখে হালকা হাসি, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা। সেই মুহূর্তে রিমা বুঝে যায়, এই গন্ধ—এই অনুভূতি—তার শহরের ব্যস্ত রাস্তায় গিয়েও কখনও মিলিয়ে যাবে না।
১০
শীতের এক রোদেলা বিকেল, কপালকুণ্ডলা নদীর পাড়ে শ্যামলীর হোমস্টের উঠোনে বসে আছে মধু। তার হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, কিন্তু চোখ যেন অন্যমনস্ক—দৃষ্টি চলে যাচ্ছে দূরের পুকুরের দিকে, যেখানে জলে ভেসে আছে কিছু শুকনো শাপলা আর কয়েকটি কচি পদ্মপাতা। শ্যামলী হঠাৎ এসে বলে, “মধু, তোমার নামে চিঠি এসেছে কলকাতা থেকে।” মধু অবাক হয়—তার নামে তো সচরাচর চিঠি আসে না। খামের উপর রিমার হাতের লেখা, যা সে প্রথম দেখেছিল শুটিংয়ের সময় রিমার স্ক্রিপ্ট নোটবুকে। বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়, হাত কাঁপতে কাঁপতে খাম খুলে ফেলে মধু।
ভেতরে কোনো চিঠি নয়, বরং একটি সাদা কাপড়ের টুকরো। কাপড়ের মাঝখানে সূক্ষ্ম সূচিকর্মে ফুটিয়ে তোলা একটি পদ্মফুল—নরম গোলাপি রঙ, চারপাশে সবুজ পাতার পরিমিত ছোঁয়া। সেই নকশার পাশে নীল কালি দিয়ে রিমা লিখেছে—“এই গ্রামের দিনগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে শান্ত দিন। আমি যখনই এই নকশা বানাবো, তোমাকে মনে করবো।” মধুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে নদীর ধারে সেই বিকেল, যখন রিমা বলেছিল পদ্মফুল তার কাছে মনের শান্তির প্রতীক। কত হাসি, কত গল্প, কত চুপচাপ মুহূর্ত যেন এই ছোট্ট কাপড়ের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে। মনে হয়, এ যেন কোনো সাধারণ নকশা নয়—এ যেন তার আর রিমার মধ্যেকার অদৃশ্য সেতু, যা দূরত্ব পেরিয়েও অটুট থাকবে।
মধু কাপড়ের টুকরোটা হাতের তালুতে রেখে পুকুরের ধারে গিয়ে বসে। চারপাশে নিস্তব্ধতা—শুধু মাঝে মাঝে বাতাসে পাতা নড়ার শব্দ আর পুকুরের জলে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের মৃদু আওয়াজ। তার মনে হয়, কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে পদ্মফুলের হালকা গন্ধ—ঠিক যেমনটা সে রিমাকে দিয়েছিল বিদায়ের আগে। চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নেয় সে, আর মনে মনে বলে, “শুকিয়ে গেলেও গন্ধ থেকে যায়।” আকাশে তখন ম্লান হয়ে আসছে সূর্য, লালচে আভায় জ্বলজ্বল করছে জল, আর সেই আলোয় মধুর চোখের কোণে একফোঁটা জল চিকচিক করে ওঠে—যেন পদ্মফুলের শিশিরবিন্দু, যা কখনও মুছে যায় না।
শেষ