Bangla - তন্ত্র

পদ্মপীঠের অভিশাপ

Spread the love

স্নেহা মুখার্জী


অধ্যায় ১: আগমন

পৃথিবীতে কিছু আগমন নিতান্তই ঘটনাক্রম নয়, বরং পূর্বনির্ধারিত ছক, যা কারও অজান্তে বুনে চলে ভাগ্যের জাল।
অরিন্দম মুখার্জির শান্তিনিকেতনে আগমন তেমনই এক আগমন। আপাতদৃষ্টিতে গবেষণার জন্য শান্ত, নির্জন পরিবেশে এসে লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে এসেছেন তিনি, কিন্তু বাস্তবে—এই যাত্রা ছিল অতীতের একটি অসমাপ্ত অধ্যায়ের টান।

এক মেঘলা শরতের দুপুর। খোলা রিকশায় বসে অরিন্দম শান্তিনিকেতনের দিকে এগোচ্ছে।
রাস্তার ধারে লালমাটির পথ, পাশে শাল-পলাশের অরণ্য, মাঝে মাঝে কাঁঠালের গন্ধ ভেসে আসে বাতাসে। আকাশে রোদ-আলোর সঙ্গে মিশে আছে হালকা কুয়াশা, যেন প্রকৃতিই কিছু লুকিয়ে রেখেছে।

রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল,
— “আপনার বাড়ি কোথায়, বাবু?”
— “কলকাতা। তবে এখন থেকে কিছুদিন শান্তিনিকেতনে থাকব—গবেষণার কাজে।”

রিকশাওয়ালা একটু চুপ করে থেকে বলল,
— “এখানে কিসের গবেষণা করবেন, বাবু?”
— “লোকসাহিত্য। পুরনো পাঁচালী, পালাগান, ব্রতকথা এসব নিয়ে।”
— “ওহ্… পাঁচালী! সাবধানে থাকবেন বাবু। সব পাঁচালী পাঠ করবার না।”

অরিন্দম একটু হেসে বলল,
— “পাঠ না করবার পাঁচালী আবার কী রে ভাই?”
রিকশাওয়ালা চোখ ছোট করে বলল,
— “সব শুনবেন না। একটা পাঁচালী ছিল… পদ্মপীঠের পাঁচালী… যেটা কেউ পুরোটা পড়তে পারে না। কেউ পড়লেও বাঁচে না।”

অরিন্দম চমকে উঠলেও হেসে উড়িয়ে দিল। এ তো নিছক গ্রাম্য ভয় দেখানো কুসংস্কার।

 

সে উঠল শান্তিনিকেতনের এক পুরনো গেস্টহাউসে—উত্তরায়ণ নিকেতন
ঘরটি কাঠের জানালা আর লাল ইটের গাঁথুনি দেওয়া, তার ওপর সবুজ লতানো পাতার ছায়া। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের একটি অদ্ভুত চোখের স্কেচ।
ঘরে ঢুকেই সে খোলা জানালার পাশে বসে নিজের ডায়েরিতে লিখে ফেলল:

“শান্তিনিকেতনে প্রথম দিন। প্রকৃতি অতিমাত্রায় নিবিড়। বাতাস ভারী, যেন কিছুর প্রতীক্ষা করছে।
আমি কি নিছকই গবেষক, না কি আমি নিজেই গবেষণার বিষয়বস্তু?”

সন্ধ্যায় সে গেল বিশ্বভারতীর পাঠাগারে।
সহকারী লাইব্রেরিয়ান, সব্যসাচী দা, বেশ প্রাণখোলা মানুষ।
তিনি বললেন,
— “তুমি তো লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করছো, তাহলে তোমায় একটা বিশেষ শেলফ দেখাই। ওখানে খুব পুরনো পাঁচালী আর পুঁথি আছে।”

অরিন্দম কিছু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের তালিকা করে সেদিকে এগোল।
মাটির গন্ধমাখা কাঠের তাক, পাতাগুলো ধুলো জমে হলুদ হয়ে গেছে।
হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল এক অদ্ভুত বইয়ে। পাতলা খামে মোড়া, উপরে হাতের লেখা:

পদ্মপীঠের পাঁচালী”

লেখক: অজ্ঞাত
প্রকাশকাল: অনির্ধারিত
মন্তব্য: এই পাঁচালী পাঠ করলে দয়া করে শেষ পর্যন্ত পড়বেন না।”

সে অবাক হয়ে সব্যসাচী দাকে ডাকল।
— “দাদা, এই বইটা সম্পর্কে কিছু জানেন?”
সব্যসাচী দা তাকিয়ে বললেন,
— “ওটা? ওই বইটা কেউ পড়ে না। মানে… পড়ে না বলেই রয়ে গেছে। একবার এক লোক—গবেষক, তোমার মতোই—নিয়েছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সে বই কেউ হাতে নেয়নি। কেউ চায়ও না।”

অরিন্দম উৎসুক হয়ে বইটি হাতে নিল। পাতাগুলো খসখসে, কালি প্রায় মুছে গেছে।
তবু প্রথম পঙ্‌ক্তিগুলো পরিষ্কার:

“শোনো মাগো, পদ্মা নদীর তীরে
যেথা রাত নামে নিশীথ পাখির ডাকে,
সেখানে এক পীঠ—লুকানো, মৃত্তিকার তলে—
যেথা হাড়ে গাঁথা অভিশাপের রেখা।”

তার রোম কাঁটা দিয়ে উঠল। এই ভাষা, এই ছন্দ… যেন কোনো জ্যান্ত অস্তিত্ব কথা বলছে।

 

রাতে গেস্টহাউসে ফিরে, সে বইটি খোলে।
চারপাশে নিঃশব্দ।
একটি টেবিল ল্যাম্পের আলোয় সে প্রথম অংশ পড়তে শুরু করল।

“দেখো গো, রক্ত দিয়ে আঁকা পদ্মের দল।
সাধিকারা পায়ে হাঁটে, ঘর ছেড়ে চুপিচুপি।
তারা খোঁজে এক ত্রিকোণ বেদী—
যেখানে তিন কূল এক হয়,
মরণ সেখানে জন্মের দোর।”

পড়তে পড়তে সে যেন শব্দের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল।
হঠাৎ বাতাসে একটা ঠাণ্ডা দমকা হাওয়া।
জানালার কাঁচ টক্‌ করে শব্দ করে উঠল।

এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে ভেসে উঠল—
একজন সাদা শাড়ি পরা মহিলা, মাথায় খোঁপা, পায়ের আঙুলে লাল আলতা।
সে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভাঙা মন্দিরের সামনে, পেছনে পদ্মার স্রোত। তার ঠোঁটে শুধু একটি শব্দ:

শেষ করো…”

অরিন্দম হঠাৎ চমকে উঠে চোখ মেলে দেখে—তার ঘরে সে একাই।

 

পরদিন সকালে সে আবার পাঠাগারে যায়।
সব্যসাচী দা তাকিয়ে বলে,
— “বইটা নিয়ে গেলে কাল রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়েছে?”

অরিন্দম মুচকি হেসে বলে,
— “স্বপ্ন হয়েছিল… তবে খুব স্পষ্ট। এক মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল পদ্মার পাড়ে। মাথায় খোঁপা, শাড়ি পরা। মুখে বলছিল ‘শেষ করো’।”

সব্যসাচী দা থমকে গেল।
— “এমনই স্বপ্ন সেই আগের লোকটারও হয়েছিল।”
— “কে ছিল সে?”
— “নামটা ছিল অভীক। ১৯৮৭ সালে এসেছিল গবেষণার কাজে। হঠাৎ এক রাতে নিখোঁজ হয়ে যায়। বইটা তখন তার ঘরেই ছিল। খুঁজেও তার আর হদিস মেলেনি।”

অরিন্দম আর কিছু না বলে ফিরে এলো, কিন্তু তার মনে হল—এই পাঁচালী তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

 

রাতে আবার সে বইটি খুলল।

শেষ পৃষ্ঠাগুলো যেন তাকে ডাকছে।
এবার তার হাতে পৃষ্ঠা এমনভাবে খুলে গেল, যেন বই নিজেই নিজেকে পড়িয়ে নিতে চায়।

চোখে জল এসে গেল এক জায়গা পড়ে:

“যে পাঠ করে, সে দায় নেয়।
অভিশাপ যদি মুক্তি চায়, পাঠকই হয় পীঠের পুরোহিত।
পদ্মপীঠের গল্প যার কণ্ঠে শেষ হয়,
তারই হাত ধরে শেষ হয় অভিশাপ।”

সে ধীরে ধীরে অনুভব করে—সে শুধু পাঠক নয়, সে-ই যেন গল্পের অংশ।

বাতি নিভে গেল হঠাৎ।
জানালার বাইরে ঝড় উঠেছে। বৃষ্টি নামেনি, কিন্তু শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বাতাসে।

একটি কণ্ঠস্বর—বুকের মধ্যে নয়, মাথার ভিতরে বলে উঠল:

তুই ফিরে এসেছিস… এবার শেষ কর।”

অরিন্দম প্রথমবার ভয় পায় না।
সে শুধু চুপ করে বলে ওঠে—
আমি ফিরিনি। আমি আসিনি—আমি ছিলামই।”

 

অধ্যায় ২: পাঁচালীর পাঠ

 

সন্ধ্যার পর অরিন্দম উত্তরায়ণ নিকেতনের তার ঘরে ফিরে আসার পর কিছুটা থেমে পড়েছিল সব। চারপাশে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা। যেন বাতাসও নিঃশব্দে চলাচল করছে।
এক কাপ কড়া লিকার চা বানিয়ে জানালার পাশে বসল সে। বাইরে কুয়াশার মত হালকা ধোঁয়া জমেছে, যদিও তখনও সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টাও বাজেনি।

ডায়েরিতে সে লিখল:

“আজ দ্বিতীয় দিন। গতরাতের স্বপ্ন কি নিছকই কল্পনা?
নাকি আমি এমন কিছু পড়ছি যা আসলে পাঠযোগ্য নয়?”

বইটি আজ সে পড়বে ভেতরে, ল্যাম্পের নিচে, আয়নার সামনে না বসে।
সে যেন বুঝতে পারছিল—আজকের পাঠ তাকে শুধু পাঠকের জায়গায় রাখবে না।

 

দ্বিতীয় পাঠ:
পদ্মপীঠের পাঁচালী
(পাতা ৭-১২)

“তিন পথে তিন জনা
তারা হেঁটে আসে এক কেন্দ্রে
যেথা পীঠের বেদী পাতা,
রক্তের নকশায় আঁকা রক্তচন্দনের পদ্ম।

চতুর্থজন—সে দেখছে।
দেখেই মনে পড়ে যায়
সে এখানেই ছিল এক জন্মে—
তার হাতেই ছিল দীপ, মুখে মন্ত্র।”

শব্দগুলো অরিন্দমের মনে কেঁপে কেঁপে প্রতিধ্বনি তুলল।
তার কপালের কাছে হঠাৎ শীতল স্পর্শ! সে চমকে উঠে দেখে, বাতাস নেই, কিন্তু তার মুখের সামনে একটা পর্দা দুলছে।
একটা কালো কাপড়—হয়তো পর্দা, অথবা…

সে উঠে দাঁড়াতেই পায়ের নিচে কিছু একটা টোকা দেয়—
ছোঁ মেরে সে ল্যাম্প জ্বালায়—ঘরে কিছু নেই।

কিন্তু দেয়ালের ঘড়ির কাঁটা দাঁড়িয়ে গেছে: ২:০৭

 

সে জানে না, কেন এই সময়টা তার মনে গেঁথে গেল।
হয়তো কিছু একটা এই সময়েই ঘটে।
সে জানে না, তবে পাঁচালীর পরবর্তী পঙক্তিগুলো এবার যেন তাকে গল্পের মধ্যেই নিয়ে গেল—

 

দৃশ্যান্তর: গল্পের ভিতরে

সে হঠাৎ নিজেকে দেখে—সে আর অরিন্দম নেই।
সে পরনে ধুতি ও খদ্দরের জামা, গলায় একটি রুদ্রাক্ষ মালা।
তার সামনে একটি ভাঙা মন্দিরের চূড়া, পদ্মার পাড়ে। বাতাসে মাটি ও ধূপের গন্ধ।

চারপাশে তিনজন মানুষ হাঁটছে—একজন বৃদ্ধ, একজন যুবতী, একজন মাথা ঢাকা কিশোর।

বৃদ্ধর হাতে ছিল একটি রক্তমাখা কলস, যুবতীর মুখে মন্ত্র, আর কিশোরটি নিঃশব্দে নদীর দিকে তাকিয়ে।

এক কণ্ঠস্বর বলে উঠল তার পাশে:
— “তুই ফিরেছিস পুরোহিত! আজ শেষ হবে কি?”

অরিন্দম—নাকি পুরোহিত—চমকে তাকায়।

তার সামনে দাঁড়িয়ে সেই সাদা শাড়ি পরা মহিলা। চোখে লাল কাজল, কপালে রক্ততিলক।

— “তুই শেষবার অসম্পূর্ণ রেখে পালিয়েছিলি। এইবার ছিন্ন হবে বন্ধন, না হলে তুই চিরস্থায়ী!”

তার ঠোঁট নড়ে না, শুধু কণ্ঠস্বর ভেসে আসে বাতাসে।

আকাশে কালো মেঘ জমছে, পদ্মা নদীর স্রোত ঘূর্ণায়মান।
অরিন্দম বুঝে যায়, সে শুধু স্মৃতি দেখছে না—সে সেই স্মৃতিরই পুনর্জাগরণ।

সে যেন বলে উঠতে চায়,
— “আমি কী করব? আমি তো জানিও না মন্ত্র!”

তখন মহিলা এগিয়ে আসে, চোখে গভীর দৃষ্টি রেখে ফিসফিস করে বলে—
পড়… শেষ করে ফেল পাঁচালী। তখনই মনে পড়বে সব।”

 

ফিরে আসা

হঠাৎ কড়া শব্দে বইয়ের একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে যায়।
অরিন্দম ঘুম ভেঙে উঠে দেখে, বইয়ের পাতা ১৩-১৪ ছিঁড়ে মেঝেতে ছড়িয়ে আছে।

সে কুড়িয়ে নেয়, দেখে এক জায়গায় লেখা—

“অরিন্দম মুখার্জি”

নিচে অদ্ভুত লিপিতে কিছু লেখা—

সে বুঝতে পারে না কী লেখা, কিন্তু মনে পড়ে যায়—এই অক্ষরগুলো সে কোথায় যেন দেখেছে।

সে চোখ বন্ধ করে ভাবে—
এই নাম এই বইয়ের মধ্যে কী করে এলো?
কে লিখেছে?

সে বইয়ের প্রথম পাতায় তাকায়। আগের দিন দেখেনি—
এক কোণে লেখা:
পাঠকই লেখক, যদি সে পাঠের অন্ত ছোঁয়।”

 

পরদিন সকালে সে যায় স্থানীয় ইতিহাসের অধ্যাপক ড. অদিতি সেন–এর কাছে।
অদিতি সেন স্থানীয় পুরাণ, লোকগাঁথা এবং ব্রতকথার উপর গবেষণা করেন।

অরিন্দম তার দেখা, স্বপ্ন এবং বইয়ের কথা খুলে বলে।

ড. সেন কিছুক্ষন চুপ থেকে বলেন,
— “তুমি সম্ভবত এক ‘আখ্যান-চক্রে’ প্রবেশ করেছো। এই ধরণের পাঁচালী বা গাঁথা অনেক সময় ‘কথার জাদু’ নিয়ে চলে—যেখানে পাঠক আর গল্প আলাদা থাকে না।”

— “মানে?”
— “মানে, তুমি শুধুই পাঠ করছো না। তুমি সেই গল্পে পূর্বজন্মে ছিলে, বা হয়তো আগের কোনো পাঠক—যার জীবন এই পাঁচালীর সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।”

অরিন্দম প্রশ্ন করে,
— “তাহলে আমি কী করব?”
— “তুমি হয়তো এক ‘জ্যান্ত পাঁচালী’র অংশ। এটি সেই ধরনের আখ্যান যা লেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে রচে।”

তিনি বলেন,
— “পদ্মপীঠ ছিল এক বিশেষ তান্ত্রিক শক্তিপীঠ, যা হারিয়ে গেছে। তবে বিশ্বাস করা হয়, কেউ কেউ সেই পীঠ ‘স্মৃতির মধ্যে দিয়ে’ খুঁজে পায়। তুমি হয়তো সেই পথেই যাচ্ছো।”

অরিন্দম বেরিয়ে আসার সময় ড. সেন শুধু বলেন—
— “পরবর্তী পাঠে সাবধানে যেও। যে কিছু শুরু করে, তার শেষ করবার দায় তাকে নিতেই হয়।”

 

রাত নামতেই অরিন্দম আবার বসে পাঁচালী নিয়ে।

এবার সে ভয় পায় না, শুধু একধরনের দায়িত্ব অনুভব করে।

সে পড়ে:

“শেষ মন্ত্র না হলে, কাহিনি চলে
আবার পিশাচ জন্মায় বেদীতে।
পাঠক যদি মুখ না করে বন্ধ,
তার রক্তে হয় মন্ত্রের শেষ শ্লোক।”

তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
সে বুঝে যায়—সে নিজেকে থামাতে পারবে না।

সে শেষের পাতার দিকে তাকায়—
কিন্তু পাতাগুলো ফাঁকা।
তাতে লেখা:
তুমি যা দেখেছো, তাই লিখো। তাহলেই কাহিনি চলবে।”

অরিন্দম কলম তোলে।

 

অধ্যায় ৩: গ্রামের পেছনের গল্প

 

ভোরের আলো নামছে লাল মাটির পথ ঘেঁষে।
অরিন্দম চা হাতে বারান্দায় বসে। চোখে ক্লান্তি, মনে অস্থিরতা।

গত রাতের পাঠ… বইয়ের ফাঁকা পাতা…
তার লেখা যেন বইয়ের নতুন অংশ হয়ে উঠছিল।

সে কি নিজেই পাঁচালীর গল্প লিখে চলেছে?
না কি পাঁচালী তার ভেতর দিয়ে নিজেকে বলিয়ে নিচ্ছে?

সে স্থির করে, এবার তাকে সত্যি খোঁজ নিতে হবে—শুধু বই নয়, লোককথা, লোকস্মৃতি-তেও।

 

১. গ্রন্থাগার থেকে গাঁয়ের মাঠ

সব্যসাচী দা তাকে পরামর্শ দিলেন—
— “তুমি একবার কল্যাণপুর গ্রামের দিকে যাও। ওখানে কিছু প্রবীণ মানুষ আছেন, যাঁরা পুরনো গাঁথা, পাঁচালী মুখে মুখে বলেন। ওখানে গিয়ে হয়তো কিছু পাবে।”

অরিন্দম বাইসাইকেল ভাড়া করে রওনা দিল।
লালমাটির পথ, পাশের শাল-পলাশে ঢেকে থাকা ছায়া, মাঝে মাঝে দূর থেকে বাউল গানের টুকরো ভেসে আসে।

কল্যাণপুর গ্রামের প্রান্তে এক বৃদ্ধকে দেখল সে—দাঁতহীন মুখে চুপ করে বসে সূর্যস্নান করছেন।
নাম রতন পাল

— “কাকা, একটা পাঁচালী নিয়ে জানতে এসেছি। পদ্মপীঠের পাঁচালী… আপনি শুনেছেন?”

বৃদ্ধ চুপ করে তাকিয়ে থাকেন। তারপর ধীরে ধীরে বলেন—
— “এই নাম তো বহু বছর পরে শুনছি। তুমি কোথায় পেয়েছিস এই নাম?”

— “একটা বইয়ে… পুরনো পাঁচালী… খুব অদ্ভুত।”

বৃদ্ধ হেসে ওঠেন, চোখে পানি জমে যায়।
— “আমার মা বলত এই গল্প। যখন আমি ছোট। কিন্তু বলে দিতেন—শেষ পর্যন্ত শুনতে নেই। কাহিনির শেষে থাকত অশান্ত আত্মাদের ডাক। যে শুনত, তার ঘুমে আগুন লাগত।”

অরিন্দম কৌতূহলী হয়ে পড়ে।
— “এই পদ্মপীঠ বলতে কী বোঝায়?”
— “একটা গোপন তান্ত্রিক স্থল। বলা হত, তিন নদীর সঙ্গমে যেথা ভূমি ফেটে বেরিয়েছিল এক অগ্নিপদ্ম। সেইখানে এক সাধিকা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই সে স্থান অভিশপ্ত। কেউ যেতে পারত না। কেউ চাইলে স্বপ্নে গিয়ে ফিরত না।”

অরিন্দম জিজ্ঞেস করে,
— “আপনি জানেন এই পদ্মপীঠ কোথায় ছিল?”
— “লোককথা বলে, শান্তিনিকেতনের দক্ষিণে, যেখানে গগনপুর বিল আছে, ওখানেই পদ্মপীঠের চিহ্ন ছিল এককালে। এখন সেখানে কেবল জঙ্গল।”

— “আপনি বলেছিলেন, আপনার মা এই পাঁচালী বলতেন?”
— “হ্যাঁ। কিন্তু শেষটা কখনো বলেননি। বলতেন, শেষ অধ্যায় মুখে বললে যাঁর কানে পড়ে, সে ‘পাঠক’ হয়ে যায়। আর পাঠক মানেই উৎসর্গ…”

অরিন্দম ভয় পায়।
সে কি ইতিমধ্যে সেই ‘পাঠক’ হয়ে গেছে?

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান।
— “তুমি যা পেছনে ফেলতে চাও, সে যদি তোমার রক্তের সঙ্গে বাঁধা হয়, তবে ফেরত আসবে… ছায়া হয়ে, স্মৃতি হয়ে, অভিশাপ হয়ে।”

 

২. গগনপুর বিলের ধারে

সন্ধ্যার দিকে অরিন্দম একাই বেরোল গগনপুর বিলের দিকে।
দেখল—একসময় পুকুর ছিল এমন এক বিস্তীর্ণ জায়গা, যা এখন প্রায় শুকিয়ে কাদায় ঢেকে গেছে।

চারদিকে গা-ছমছমে নীরবতা। কেউ নেই।

সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
হঠাৎ তার মনে হয়—বাতাস কানে কিছু একটা ফিসফিস করে।

“পীঠে যার পা পড়ে, সে রক্ত ছাড়ে।
পাঠক যদি ফিরে আসে, সে পথ বুজে যায়।”

সে চমকে পেছনে তাকায়—কেউ নেই।

কিন্তু তার সামনে কাদা মাটির মধ্যে অদ্ভুত ছাপ—পদ্মফুলের মতো খোঁচাখোঁচা একটি চিহ্ন!

সে হাত দিয়ে ছুঁতে যায়, হঠাৎ কাদামাটি গরম হয়ে ওঠে।
সে হাত সরিয়ে নেয়, কিন্তু তার আঙুলে কাঁটা দিয়ে রক্ত পড়ে।

তার মনে পড়ে—
যে পাঠ করে, তার রক্তেই হয় মন্ত্রের শেষ শ্লোক।”

 

৩. অধ্যাপক অদিতির কাছে ফেরত

পরদিন সকালে সে আবার যায় ড. অদিতি সেন–এর কাছে।
সে গগনপুর বিল, পদ্মচিহ্ন, আর নিজের রক্ত পড়ার ঘটনা খুলে বলে।

ড. সেন এবার একধরনের আতঙ্কে বলে ওঠেন—
— “তুমি পদ্মপীঠের সঙ্গে বাঁধা পড়ে গেছো। তুমি শুধু গবেষক নও, তুমি সেই চক্রের ‘নির্বাচিত পাঠক’ হয়ে গেছো। একবার এই চিহ্ন যার রক্তে আসে, তার পিছু হটে না আর কিছু।”

— “তাহলে আমার করণীয় কী?”

— “তোমাকে শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। যে পাঁচালী তুমি পড়ছো, সেটাই তোমার মুক্তির পথ। কিন্তু ভুলে যেও না—শেষ অধ্যায় কখনো মুখে বলা যায় না। কেবল আত্মার ভেতরে পাঠ করতে হয়।”

তিনি তাকে একটা কাঁচের লকেট দিলেন—ভেতরে শুকনো পদ্মপাতা।

— “এটা রাখো। কোনো প্রাচীন পীঠের চিহ্ন পেলে—এটা কাঁপবে। তখন জানবে, তুমি কাছে এসেছো।”

 

৪. রাত একটি নতুন লেখনী

রাতে অরিন্দম আবার বইয়ের পাতা খুলে দেখে—
আজকের পাতাগুলো খালি।
কিন্তু পৃষ্ঠার নিচে ছোট করে লেখা:

“পাঠকের কলমেই লেখা হয় অতীত।
বলো—তোমার নাম কী ছিল আগের জন্মে?”

সে অবচেতনে লিখে ফেলে—অভীক।”

তার চোখ কেঁপে ওঠে। এই নাম সে শুনেছে—সব্যসাচী দা বলেছিলেন, ১৯৮৭ সালে এক গবেষক এই বই পড়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল—নাম ছিল অভীক।

সে চুপ করে, কলম ফেলে দেয়।
তাহলে সে কি…

না, সে তখনও জন্মায়নি। তবে…

তাহলে সে কি সেই অভীকের পুনর্জন্ম?
সে কি ফিরে এসেছে শেষ পাঠের জন্য?

 

৫. একটি পুরোনো চিঠি

ডায়েরির পাতার মধ্যে সে হঠাৎ একটি ভাঁজ করা কাগজ পায়।
তার হাতের লেখা নয়, কিন্তু অদ্ভুতভাবে পরিচিত।

চিঠির মধ্যে লেখা:

“যদি তুমি ফিরে এসো—
তবে জেনো, শেষটা অসম্পূর্ণ রেখেছিলাম আমি।
পদ্মপীঠ এখন নিঃস্ব, তবে শেষ পাঠে জাগবে।
তুমি যদি আমারই আরেক রূপ হও, তবে শেষ করো সেই, যা আমি পারিনি।
— অভীক”

অরিন্দমের ঠোঁট শুকিয়ে আসে।

সে জানে, এবার সে আর পেছনে ফিরতে পারবে না।

 

অধ্যায় ৪: দ্বিতীয় পাঠ পেছনের সময়

 

ঘড়ির কাঁটা আবার দাঁড়িয়ে যায় ঠিক সেই সময়: ২:০৭ AM
ঘুম ভেঙে যায় অরিন্দমের। ঘর নিস্তব্ধ, বাইরের কুকুরের হালকা ডাক, আর কোথা থেকে যেন শোনা যায় ঢাকের খুব ক্ষীণ শব্দ।

সে জানে, সে ডাকছেই। পাঁচালী।

বইটা বিছানার পাশে খুলে রাখা। লালচে কালিতে হাতে লেখা দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে আজ আর কোনও ভূমিকা নেই।
শুধু একটা বাক্য লিখে রেখেছে কেউ, যেন বিশেষভাবে তার উদ্দেশ্যেই—

“যে ফিরে আসে, সে ভুলে যায় সে চলে গিয়েছিল।”

অরিন্দমের গা কাঁটা দেয়।
সে হাত তুলে আলো জ্বালাতে যায়, কিন্তু বাতি জ্বলে না।
এবার সে চুপ করে বসে পড়ে মেঝেতে—পাশে রাখা সেই কাঁচের লকেটটা, যার ভিতরে শুকনো পদ্মপাতা।

লকেটটা ধীরে ধীরে কাঁপতে শুরু করে।

 

১. প্রবেশ: গল্পের গভীরে

সে পাতা উল্টায়।
নতুন অধ্যায়ের প্রথম পংক্তিগুলো তার মনোজগতকে ভেদ করে এক অন্য পৃথিবীতে নিয়ে যায়।

“চাঁদের ছায়া পড়েছে কাঁদা বেদীতে,
রক্ত দিয়ে আঁকা পদ্মের খাঁজে
দাঁড়িয়ে সেই পাণ্ডিত্যবর্জিত পুরোহিত—
যার স্মৃতি নেই, মুখে নেই মন্ত্র,
কিন্তু যার রক্তে লিখিত কাহিনির অন্ত।”

চোখের সামনে কালো হয়ে আসে সব।

কিছুক্ষণ পর সে নিজেকে দেখতে পায়—
সে হাঁটু গেড়ে বসে আছে এক জ্যান্ত পদ্মপীঠে।

চারদিকে জ্বলছে ধূপবাতি, গাছ নেই, পাখির আওয়াজ নেই।
নির্বাক প্রকৃতির মধ্যে সে বুঝতে পারে—এখানে সময় চলে না, কেবল পুনরাবৃত্তি ঘটে।

সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন—বৃদ্ধ তান্ত্রিক, এক কিশোর, ও সেই সাদা শাড়ি পরা মহিলাটি।

তাদের চোখে নেই বিস্ময়। তারা যেন অরিন্দমকে অনেক আগে থেকেই চিনে রেখেছে।

তান্ত্রিক বলে উঠল—
— “অবশেষে তুই ফিরলি, অভীক।”

অরিন্দম বলল না কিছু।
তার ঠোঁট থেকে নিজে থেকেই বেরিয়ে এল এক মন্ত্র:

“ত্রিকোণে পীঠ, চতুর্থে পাঠ
চরণে চিহ্ন, রক্তে রাত
মোরে কর ত্যাগ, অথবা কর স্মরণ—
জাগুক পদ্ম, শ্বাসে বরণ।”

 

২. পেছনের সময়

সে এখন জানে—সে কেবল স্মৃতি দেখছে না, সে সেই স্মৃতির পুনর্জন্ম
সে ছিল সেই পুরোহিত—অভীক, যে ত্রিশ বছর আগে পাঁচালী পাঠের মাঝপথে থেমে গিয়েছিল।
তার ভুল ছিল শেষ অধ্যায় না পড়া, আর সেই অর্ধেক কাহিনিই জন্ম দিয়েছে অভিশাপ।

তার সামনে পীঠে বসা সেই সাধিকা—শ্বেতা
তার চোখে লাল রেখা, কপালে অশ্রুবিন্দুর মতো তিলক।
সে মুখে বলল—
— “আমি তখন মুক্তির অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি চলে গেলে। আজ আবার এসেছো—শেষবারের জন্য।”

অরিন্দম শ্বাস আটকে রাখে।
সে জানে না কোনটা বাস্তব, কোনটা মায়া। কিন্তু যেটাই হোক, সে পিছিয়ে যেতে পারে না।

শ্বেতা বলে—
— “তুই যদি আজ পাঁচালীর শেষ পাঠ করিস, তবে আমি এই পীঠ থেকে মুক্তি পাব। তুইও তোর চক্র থেকে।”

— “আর যদি না করি?”

— “তাহলে আবার আরম্ভ হবে। তুই আবার জন্ম নিবি, আবার ফিরবি, আবার থামবি। চক্র চলতেই থাকবে।”

অরিন্দমের গলা শুকিয়ে আসে। সে বুঝে যায়—তার জন্ম কেবলই পূর্ণ করার দায়ে।

 

৩. আধুনিক সময়ের ছায়া

এক মুহূর্তে সে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। ঘামছে।

ঘর অন্ধকার, কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল—দূরে কোনও বালক সাদা ধুতি পরে মাঠে দাঁড়িয়ে আছে।
তার চোখে সরাসরি তাকিয়ে—অরিন্দমকেই।

সে চমকে উঠে দরজা খোলে। বাইরের মাঠ ফাঁকা।

সে জানে, এই চক্র ভেঙে দিতে হবে।

সে ফিরে গিয়ে পাঁচালীর পাতা উল্টায়।
দেখে, নতুন অধ্যায়ের প্রথম ছত্র তার নিজের হাতের লেখা!

“আমি অভীক, অথবা অরিন্দম।
পীঠের মাঝখানে আমি—
আমি পাঠক, আমি চরিত্র, আমি পুরোহিত।
আর এই গল্প আমারই শ্বাসে বেঁচে আছে।”

 

৪. লাল রঙের পাতাগুলো

ঘরের বাতি হঠাৎ জ্বলে ওঠে।
তার পাশে রাখা লকেটটা আবার কাঁপতে শুরু করে। এবার তার ভিতরের পদ্মপাতাটি আগুনের মত লালচে রঙে জ্বলছে।

পাঁচালীর শেষের দিকে লাল কালি দিয়ে লেখা এক ছত্র সে পড়ে:

“যার রক্তে পীঠ জাগে,
তার মুখে বন্ধ হয় পাঁচালীর শ্লোক।”

সে কলম তুলে নেয়। ডায়েরির পেছনের পাতায় লিখে ফেলে এক অজানা শ্লোক—

“ওম শ্রদ্ধা শ্রুতি রক্তে বর্ণ
পদ্মে উঠুক কাহিনির অর্নব
পাঠক না থাক, পাঠ রয়ে যাক—
শঙ্খ বাজুক, জপে থাকুক শব্দ।”

লেখা শেষ হতেই ঘরে হাওয়ার ঝড় ওঠে।

জানালায় ছিটকে পড়ে পাতা, বাতি নিভে যায়। দেয়ালের ছবিগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে পড়ে যায়।

কিন্তু তার চোখের সামনে এক মুহূর্তের জন্য আবার দেখা যায়—শ্বেতা দাঁড়িয়ে আছে পদ্মপুকুরের মাঝখানে। এবার তার চোখে জল, ঠোঁটে হাসি।

সে মুখে বলে—
— “শেষবারের মতো পাঠ হল সম্পূর্ণ। অভিশাপ শেষ। এখন তুমি পেছন থেকে সামনে হাঁটতে পারো।”

 

৫. অতীত থেকে ভবিষ্যৎ

পরদিন সকালে অরিন্দম ঘুম থেকে উঠে দেখল—পাঁচালীর বইটা খোলা, কিন্তু সব পাতা সাদা।

ডায়েরিতে গত রাতে লেখা ছত্রগুলোও অদৃশ্য।

সে উঠে গেস্টহাউসের বারান্দায় এলো।

পাশের খালি মাঠে দেখা গেল—এক ছোট ছেলেকে, সে ধুতি পরে গরুর পেছনে ছুটছে, মুখে হাসি।
তার মুখটা যেন কিছুটা…
…অরিন্দমেরই ছোটবেলার মতো?

সে চুপ করে হাসল।
চক্রটা হয়তো এবার থেমেছে। না হলে আবার শুরু।

 

অধ্যায় ৫: পূর্ণিমার পূর্বরাত্রি

 

রাতের আকাশ আজ অস্বাভাবিক পরিষ্কার।
চাঁদ প্রায় পূর্ণ, ঠিক যেন তার চুলে জড়ানো অদৃশ্য আলো ছড়িয়ে পড়েছে ধানের মাঠে, পুকুরপাড়ে, আর সেই পুরনো বেদীমূলে।

অরিন্দম জানে—এটাই সেই রাত্রি, যার কথা পাঁচালীর প্রথম পাঠেই ইঙ্গিত ছিল।

আজ রাত ২:০৭-এ তাকে ফিরতে হবে পদ্মপীঠে, শেষ শ্লোক পাঠ করতে।

 

১. প্রস্তুতি

গেস্ট হাউসের ঘরটা আজ যেন অন্যরকম ঠান্ডা।

অরিন্দম আয়নায় তাকিয়ে দেখে, নিজের চোখে আর আগের মতো কুয়াশা নেই।
তা সোজাসাপটা নয়—চোখের কোণে লাল রেখা, যেন অনেক রাত না ঘুমিয়ে থাকা কোনও তান্ত্রিকের চোখ।

সে খুলে নেয় কাঠের আলমারিতে রাখা পুরনো চাদর। তার ভেতর থেকে বের হয় কাঁচের লকেট।
আজ সেই লকেটে পদ্মপাতা নেই—তার বদলে শুধু একফোঁটা শুকনো রক্ত লেগে আছে ভেতরে।

সে জানে, সেটা তার নয়।
শ্বেতার।

সে পায়ের নিচে মাটির স্পর্শ নেয়, মৃদুস্বরে বলে—
— “পদ্মপীঠ, আমি আসছি। শেষবারের মতো।”

 

২. ফের সেই পীঠে

পদ্মপীঠ গ্রামের উত্তর প্রান্তে এক জঙ্গলের মধ্যে।
বহু বছর আগেই সেই জায়গা ‘অশুভ’ বলে চিহ্নিত হয়ে পড়েছে। কেউ যায় না সেখানে।

অরিন্দম, হাতে টর্চ, পায়ে মাটি চষে পৌঁছায় সেই বেদীর কাছে।
সেই শ্বেতপাথরের বেদি, যার গায়ে খোদাই করা পদ্মচিহ্ন লাল হয়ে আছে।

আজ বেদীর উপর বসে আছে কোনও পুরোহিত নয়—একজন ছোট ছেলেকে দেখা যায়।

ছেলেটি তাকে দেখে বলে—
— “তুমি আসবে, জানতাম। শেষ পাঠ তোমাকেই করতে হবে।”

— “তুই কে?” অরিন্দম প্রশ্ন করে।

— “আমি তুই-ই। তোর শৈশব, তোর ভুলে যাওয়া জন্ম। তুই যা ত্যাগ করেছিস, আমি তাই।”

বেশি কিছু না বলে সে উঠে দাঁড়ায়। বেদীতে এবার অরিন্দম বসে।

 

৩. পাঠের শুরু

সে বই খোলে না। কারণ পাঁচালীর শেষ অংশ আজ কাগজে নেই—তা রয়ে গেছে মনে।

সে উচ্চারণ শুরু করে—

“পূর্ণ পদ্মে পূর্ণ ছায়া,
পূর্ণিমাতে বন্ধ প্রলয়।
শব্দে গাঁথা শরীর খোলে,
যজ্ঞে ফিরে যে ছিল লয়।

আগুনে কাহিনি নিঃশেষ হলে,
রক্তে বাঁচে তারই পরোয়ান।
পাঠ শেষের শেষে লেখা,
পাঠকই তো সেই বিধান।”

শব্দ শেষ হতেই বেদীর চারদিকে আগুন ধরে ওঠে।
কিন্তু তা পোড়ায় না—বরং জ্যোতির্ময় আলোয় সব আলোকিত হয়।

 

৪. শ্বেতার মুক্তি

হঠাৎ, আগুনের ভেতর থেকে উদ্ভাসিত হয় এক নারী-মূর্তি—শ্বেতা।

সে আর অভিশপ্ত নয়। তার পরণে এখন নীল আর সাদা রেশমের শাড়ি, গলায় কাঁসার মালা।

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। বলে—
— “শেষে তুই করলি। আর কাউকে পাঠ করতে হয়নি। আমি এবার মুক্ত।”

তার চোখ থেকে পড়ে দুই ফোঁটা জল।
এক ফোঁটা মাটিতে, আর এক ফোঁটা অরিন্দমের হাতে।

সে বলে—
— “তুই অভীক ছিলি, অরিন্দম হয়েছিস। এবার ‘তুই তুই’ থাকিস। কোনও জন্মের দায় আর নেই।”

তারপর সে এক আলোর রেখায় মিলিয়ে যায়।

 

৫. সত্য বা মায়া?

সকাল।

অরিন্দম জেগে ওঠে। গেস্ট হাউসে।
সব কিছু যেন স্বাভাবিক।

তবে বিছানার পাশে রাখা বইটা আজ পুরো খালি
সব পাতা সাদা। এমনকি তার নিজের লেখাও নেই।

সে আয়নায় নিজের মুখ দেখে।
চোখে কোনও লাল রেখা নেই।
পাশে রাখা লকেট খুলে দেখে—পদ্মপাতা ফিরে এসেছে।
কিন্তু এবার পাতাটা সবুজ

একটা কাগজ পড়ে থাকতে দেখে জানালার নিচে।
খুব সাদামাটা কাগজ। তাতে একটাই লাইন:

“যে পাঠ করে, সে লেখকও বটে।”

অরিন্দম হাসে।

 

৬. চক্রের বাইরে

সে এবার গ্রামের মন্দিরে যায়।
পদ্মপীঠ সম্পর্কে জানতে চায়—কিন্তু কেউ কোনও কথা জানে না।
এমনকি কোনও জঙ্গল বা বেদির কথা কেউ কখনও শোনেনি।

কেউ বলে—
— “এখানে তো শুধু ধানখেত আর নদী। অমন কিছু ছিল না।”

তবে… এক বৃদ্ধ বলে—
— “তোর মুখ চেনা লাগছে। তুই আগে এখানে এসেছিলি বুঝি?”

অরিন্দম জবাব দেয় না।

সে শুধু ভাবে—
হয়তো সে এবার সত্যিই ফিরে এসেছে

 

অধ্যায় ৬: অভিশাপের পরে

 

১. শান্তি?

অরিন্দম ফিরেছে কলকাতায়।
সব কিছু যেন স্বাভাবিক। ক্লাস চলছে, গবেষণা আবার শুরু করেছে।
মনে হয় যেন শান্তিনিকেতন ছিল এক অদ্ভুত স্বপ্ন।

কিন্তু স্বপ্ন যদি হয়, তাহলে লকেটটা এখনো আছে কেন?
তার ভিতরে এখনো সেই সবুজ পদ্মপাতা, চকচকে ও জীবন্ত।

কেউ বিশ্বাস করে না তার অভিজ্ঞতার কথা।
বন্ধুরা ভাবে—সে “এক্সট্রা স্ট্রেস” এ ছিল।
কেউ একজন বলে, “তুই তো পাঁচালী নিয়ে পাগল ছিলি, তাই এমন হ্যালুসিনেশন।”

অরিন্দম চুপ করে থাকে।

 

২. পুরনো লাইব্রেরিতে

একদিন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো লাইব্রেরির কোণায় খুঁজে পায় একটা ধূসর মলাটের বই—
পদ্মতান্ত্রিক লোকগাঁথা: পূর্বভারতের অপ্রকাশিত পাঁচালী”
লেখক: অভীক রায়চৌধুরী।

তাঁর লেখা? কবে? কোথায়?

বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা:
এই গাঁথা রচনা হয়েছে পীঠে বসে, যার পদ্মপত্রে লেখা আত্মার ঋণ।”

অরিন্দম বইটা নিয়ে ছুটে যায় রেকর্ড সেকশনে।
তাঁরা বলে, “এই লেখকের নাম আমাদের তালিকায় নেই। কোনও আইএসবিএনও নেই। হয়তো কোনও ব্যক্তিগত সংগ্রহ।”

বইয়ের পিছনে পেন্সিলে লেখা এক তারিখ—
১৩৯৭ বৈশাখ”
সে তো ১৯৯০ সাল!
অথচ বইটা প্রায় নতুন।

 

৩. ফের দেখা

সন্ধ্যায় বৃষ্টির মধ্যে সে বসে কলেজের চত্বরের এক পুরনো বটগাছের নিচে।
হঠাৎ ছায়া নেমে আসে।

একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে।
তার মুখে শ্বেতার ছায়া নেই। চোখে অচেনা পরিচয়।

সে বলে,
— “এই লেখাটা তো তুমি লিখোনি, অরিন্দম। তুমি শুধু পাঠ করেছো। লেখক অন্য কেউ।”

— “তুমি কে?”

— “আমি মীরা। আমি শেষ পাঠকের বংশধর। আমাদের পরিবারই সংরক্ষণ করেছে এই পাঁচালী, যাতে শেষ পাঠ ঠিকমতো হয়।”

— “তাহলে সব শেষ হয়নি?”

— “না। শেষ পাঠ ছিল স্রেফ এক স্তর।
এখন সময় এসেছে লেখার নতুন চক্র শুরু করার।
নতুন অভিশাপ নয়—নতুন রূপান্তর।”

অরিন্দম হঠাৎ বুঝতে পারে—পাঠ যখন শেষ হয়, তখন লেখা শুরু হয়।

 

৪. সাদা পাতার শুরু

সে ঘরে ফিরে আসে।
ল্যাপটপ খুলে। একটা নতুন ফাইল খুলে লেখে:

পদ্মপীঠের উত্তরকথা”

প্রথম বাক্য লিখে:

“একটা সময় ছিল, যখন পাঁচালী শুধু শোনা হতো। এখন সময় এসেছে লেখার। অভিশাপের নয়, স্মৃতির। গল্পের নয়, জাগরণের।

লকেটের ভেতরের পদ্মপাতা তখন ধীরে ধীরে সাদা হয়ে যায়।
সবুজ মুছে গিয়ে এখন এক টুকরো কাগজের মতো সাদা।

অরিন্দম জানে—এটাই তার নিজের পাঁচালী।

 

৫. পাঠক লেখকের চক্র

কয়েক মাস পর, “পদ্মপীঠের অভিশাপ” নামে এক ছোট উপন্যাস প্রকাশ পায়।
লেখক: অ. রায়।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কেউ জানে না কে সে।

পাঠকরা বলে—
“এই বইটার মধ্যে এমন কিছু আছে, যেন নিজের আত্মার কথা বলা…”

কেউ কেউ বলে, “বইটা পড়তে পড়তে যেন স্বপ্নের মধ্যে গিয়েছিলাম।”

বইয়ের শেষে কোনও ‘শেষ’ নেই।
শেষ লাইন হলো:

“যদি তুমি এই গাঁথা পড়ো, তবে তুমি-ই লেখক। আর সেই পাঠই তোমার মুক্তি।”

 

৬. পাঠক তুমি, লেখকও তুমি

একদিন কলেজের এক ছাত্রী আসে অরিন্দমের কাছে।
হাতে সেই বই। চোখে একরাশ বিস্ময়।

সে বলে, “স্যার, এই বইটা আমি পড়ে শেষ করতে পারিনি।
শেষ অধ্যায় পড়তে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল—এটা তো আমি লিখেছি!”

অরিন্দম হেসে বলে—
— “হয়তো সেটাই সত্যি। হয়তো তুমি-ই পরবর্তী লেখক।
তোমার কণ্ঠে একটা নতুন পাঁচালী জন্ম নিচ্ছে।”

সে উঠে দাঁড়ায়।
লকেট খুলে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলে—
— “এটা এখন তোমার। পদ্মপাতা যখন ফের রং বদলাবে, তখন জানবে—সময় এসেছে।”

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-07-29-at-4.38.47-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *