Bangla - ভূতের গল্প

পদচিহ্ন

Spread the love

নিবেদিতা চক্রবর্তী


অধ্যায় ১: কুমিরডাঙার বাংলো

অরিত্র বসুর মনটা বেশ কয়েক মাস ধরেই ভারী হয়ে আছে। ছবি আঁকার চেষ্টা করলেই মনে হয়, ব্রাশটা যেন বাতাসে দোলা খায়, কিন্তু রঙে ডুবে না। ক্যানভাসে রঙ মিশে যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে জীবন থাকে না। তার ভেতরের কিছু যেন চুপ করে বসে আছে, আর তা না জাগলে কিছুই উঠে আসে না ক্যানভাসে।

কলকাতার কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে, এক বন্ধুর পরামর্শে সে চলে এল পুরুলিয়ার এক প্রাচীন, নির্জন গ্রামে—কুমিরডাঙা। পাহাড়, জঙ্গল আর অদ্ভুত নীরবতায় ঘেরা এই গ্রাম এখনো যেন কালের গায়ে আঁচড় পড়তে দেয়নি। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক চলে না, ইলেকট্রিকের তার আসে আবার যায়—আর মানুষজন? নিরীহ, কিন্তু চোখে একটা চাপা ভয়।

গ্রামের প্রান্তে এক কাঠের পুরনো বাংলো ভাড়া নিয়েছে অরিত্র। কাঠের পাটাতনে পা ফেললেই হালকা কড়মড় শব্দ হয়, যেন বাংলো নিজেই ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে চায়।

“এখানে কেউ থাকে না বোলছি দাদাবাবু,” আগেই বলেছিল মাধব মণ্ডল—বয়স পঁচিশ-ত্রিশ, বাংলোর কেয়ারটেকার,
“পূজোর আগের বছর একটা ট্যুরিস্ট ছিল কিছুদিন, কিন্তু হঠাৎ একদিন চলে গেল। আর কেউ আসে না। আপনিও সাবধানে থাকবেন।”

অরিত্র হেসেছিল, “ভূতটুত বিশ্বাস করি না মাধব। শুধু একটু শান্তি চাই, আর ছবি আঁকার সময়।”

মাধব মাথা নেড়ে বলেছিল, “শান্তি পাবেন দাদা। কিন্তু রাতের দিকে… বাইরে বেরোবেন না। শুধু এটুকু বলি।”

প্রথম রাতটা কেটেছিল ঠিকঠাক। জানালার বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দূরের বন থেকে আসা শেয়ালের হালকা হাঁক আর কুয়াশার চাদরে ঢাকা চাঁদের আলো—অরিত্রর মনে এক ধরণের নিঃসঙ্গ প্রশান্তি ছড়ায়। সে একটা স্কেচ প্যাড নিয়ে বসে পড়ে, কিছু টান টানতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ যেন তার হাতে কাঁপুনি লাগে।
প্যাডে সে যা এঁকেছে, সেটা স্পষ্ট নয়—কিন্তু দেখতে যেন একটা ছোটো পায়ের ছাপ… একটার পর একটা… যেন কাদার মধ্যে থেকে কেউ পা তুলে তুলে হেঁটে এসেছে… ঠিক তার বিছানার দিকে।

সে আঁচড় কাটে সেটা, ভাবে মস্তিষ্কের খেলা। বাইরে গিয়ে দেখে—বর্ষা হয়নি, বরফ পড়েনি, এমনকি কাদাও নেই।

পরের দিন সকালে গ্রামের এক বয়স্ক মানুষ, গজানন দা, দোকানে বসে চা দিতে দিতে বলল,
“ও বাংলোটা আগে এক পাহাড়ি মেয়ের ছিল। লোকজন বলত, বাচ্চাটা মরে যাওয়ার পর সে নিজেরে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়। তারপর থেকে কেউ কেউ বলে, কাদামাখা পায়ের ছাপ তারা দেখে। কিন্তু… বিশ্বাস না করলেও, জায়গাটা অভিশপ্ত বলেই ধরে নেয় সবাই।”

অরিত্র হেসে বলে, “গল্প ভালো বললেন, কিন্তু আমি এসেছি ছবি আঁকতে, গল্প শুনতে না।”

কিন্তু সেই রাতে আবার ফিরে আসে সেই কাদামাখা পায়ের ছাপ—এইবার সে নিজেই দেখে, কেমন ছোট ছোট পদচিহ্ন বারান্দা থেকে দরজা পেরিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেছে। সে দৌড়ে দরজা খুলে দেখে—বাইরে কেউ নেই। দূরে ঝোপে একটা সাদা ছায়া যেন কেঁপে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়।

তৃতীয় দিন তার অজান্তেই একটি ছবি আঁকা হয়ে যায়—সে আঁকে একটিই গাছের নিচে দাঁড়ানো একটি শিশু। তার মুখ অস্পষ্ট, চোখ দুটি যেন ফাঁকা গহ্বর।
অরিত্র মনে করে, “এটা আমি কেন আঁকলাম?”
সে জানে, সে এমন কিছু আঁকতে চায়নি।

চতুর্থ রাতে সে ঘুমের মধ্যে শোনে, দরজা ঠুকঠুক শব্দ হচ্ছে। ঘুম ভেঙে দেখে—কেউ নেই।
কিন্তু দরজার নিচে আবার সেই ছোট পায়ের ছাপ—এবার যেন ভেজা কাদার গন্ধও এসে পৌঁছেছে ঘরের ভেতর।

ঘরের কোণে রাখা আয়নার সামনে সে দাঁড়াতেই দেখতে পায়—পিছনে একটা সাদা জামা পরা শিশু দাঁড়িয়ে আছে। সে ফিরে তাকায়—কেউ নেই। আয়নায় আর কেউ নেই।

পঞ্চম দিনে তার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। ক্যানভাসে সে বারবার সেই শিশুটির মুখ আঁকছে। প্রতিবারই মুখটা অর্ধেক আঁকা—আর প্রতিবারই যেন সে দেখতে পাচ্ছে, মুখটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে।

চতুর্থ ছবির পর তার মনে হয়, শিশুটির ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে। যেন সে কিছু বলছে…
সে কানে কাছে ছবি এনে শুনে—এক চাপা ফিসফাস…

মা কই?”

সে আঁতকে ওঠে। ঘামছে, নিঃশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটছে।

সেই রাতেই সে ঠিক করে—পরদিন গ্রাম ছাড়বে। কিন্তু রাত তিনটেয় সে ঘুম ভাঙে এক ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায়। চোখ মেলেই সে দেখে—তার বিছানার পাশে সেই ছোট পায়ের ছাপ, এবার কাদার সঙ্গে লালচে দাগও দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেন রক্তমাখা কাদা।

সে বিছানার নিচে তাকায়… সেখান থেকে দুটি ক্ষীণ, জর্জরিত, কঙ্কালসদৃশ হাত বেরিয়ে আছে।

সে চিৎকার করে ওঠে—কিন্তু বাংলোর কাঁপন ছাড়া আর কোনো আওয়াজ কেউ শুনতে পায় না।

 

আয়নার ওপারে

 

ঘেমে ভিজে উঠেছিল অরিত্রর সারাটা শরীর। বিছানার পাশটা যেন জমাট ঠান্ডায় জমে গিয়েছে। বুকের মধ্যে ধকধক করছে, মাথার মধ্যে বারবার ঘুরছে একটাই শব্দ—
মা কই?”

সে আলো জ্বালিয়ে ঘর খুঁটে দেখল। বিছানার নিচে কিছু নেই, দরজা বন্ধ, জানালা লক করা। অথচ কাদার গন্ধ এখনও ভাসছে ঘরের বাতাসে, আর সেই লালচে রং… কী ছিল সেটা? কাদা? না রক্ত?

সকালে মাধব এসে দেখে তাকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় বারান্দায় বসে থাকতে।
“আপনি ঠিক আছেন, দাদাবাবু?”
অরিত্র বলল, “মাধব… তুই আমাকে কিছু লুকাচ্ছিস না তো?”

মাধব একটু থেমে বলল, “আপনি জিজ্ঞেস করলে বলব… কিন্তু শুনে যদি আপনি ভয় পান, আমি দায়ী থাকব না।”

অরিত্র চোখ বন্ধ করে বলল, “শুনব।”

মাধব ধীরে বলল, “এই বাংলোটা আগে এক পাহাড়ি মেয়ের ছিল। নাম ছিল দয়াময়ী। শ্বেত কুষ্ঠে আক্রান্ত হয়েছিল। স্বামী ফেলে চলে যায়। গ্রামে কেউ তাঁকে গ্রহণ করত না। কিন্তু তার ছিল এক শিশু—মেয়ের নাম ছিল মাধুরী। তার চোখ দুটো নাকি ঠিক আপনার আঁকা ছবির মতো ফাঁকা দেখাত—সাদা, নির্জীব। মেয়েটা কথা বলত না, কেবল মায়ের হাত ধরে বসে থাকত সারাদিন।”

“তারপর?”

“মাঝে মাঝে জঙ্গলের ভেতর চলে যেত… মা খুঁজত। একদিন শোনা যায়, শিশুটি পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছে। কেউ জানে না সেটা দুর্ঘটনা ছিল, না কিছু আর… তারপর থেকেই জোছনার রাতে কেউ কেউ শিশুর ছায়া দেখে, আর শুনতে পায় সেই ডাক—‘মা কই?’… দয়াময়ীও পরদিন আত্মহত্যা করেন।”

অরিত্র চুপ। তার পেটের ভেতরটা মোচড় দিতে থাকে। “তুই এসব আগেই বলিসনি কেন?”

মাধব শুধু বলে, “অনেকেই এসব গল্প বলে মানসিক ভারসাম্য হারায়। আপনি বুঝি এখন নিজের আঁকা ছবিগুলোতে ওকে দেখতে পাচ্ছেন?”

অরিত্র কিছু বলে না।
সে শুধু তার স্টুডিওর দিকে হাঁটে—ঘরের দেওয়ালে টাঙানো সেই ছবিগুলোর দিকে তাকায়।
প্রথম ছবিতে ছায়া ছিল, দ্বিতীয় ছবিতে একটি মুখের রেখা, তৃতীয় ছবিতে দুটি চোখ… আর চতুর্থ ছবিতে শিশুটির ঠোঁট স্পষ্ট—সেই ফাঁকা মুখে যেন শব্দ আটকে আছে।

সে পঞ্চম ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দিতে শুরু করে।
বিনা চিন্তায় হাত চলে—জানা অজানার এক অদ্ভুত গতিতে।
সে নিজের অজান্তেই আঁকে—এক নারী চরিত্র। ক্লান্ত, কপালে ফাটা দাগ, চোখে জল, কোলে এক ফাঁকা শিশু।

ঠিক তখন, দরজার পাশে রাখা আয়না খানিকটা কেঁপে ওঠে।

অরিত্র তাকিয়ে দেখে—সে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে না। বরং সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছোট্ট শিশুটি।
সে ধীরে ধীরে বলল—
তুই কেন এলি, মা? আমি তো তোকে খুঁজছিলাম না… তুই তো অন্য কেউ।”

অরিত্র পেছনে ঘুরে দেখে—কেউ নেই। কিন্তু আয়নায় শিশুটা রয়ে গেছে।

হঠাৎ ঘরে থাকা ছবিগুলোর ক্যানভাস যেন হাওয়ার ঝাপটায় নড়ে ওঠে। প্রতিটি ক্যানভাসের শিশুটি মুখ খুলে দিয়েছে।
আর তারা যেন একসঙ্গে ফিসফিস করে বলছে—
আমাদের কথা কেউ শোনেনি… আমাদের মা কই?”

সে কাঁপতে কাঁপতে ক্যানভাসের দিকে পা বাড়ায়। ঘরের আলো নিভে যায় হঠাৎ। আর তারপর…

ঠক ঠক ঠক — দরজায় চাপা কড়া নাড়ার শব্দ।

অরিত্র চিৎকার করে বলে ওঠে, “কে?”

বাইরে থেকে কোনো শব্দ নেই। শুধু হালকা বৃষ্টির ছিটে। সে দরজা খুলে দেখে—দরজার সামনে রাখা একটা ছোট্ট কাঠের পুতুল। রঙ উঠে যাওয়া মুখ, চোখে গর্ত—তবে গায়ের পেছনে আঁকা আছে তার নিজের স্বাক্ষর!

এটা আমি আঁকি কবে?”
সে ভাবতে ভাবতেই দেখে পুতুলটা হঠাৎ হেলে পড়ে… আর তার পিছনে জমে আছে সেই পদচিহ্ন—ছোট ছোট পায়ের ছাপ, এবার আরো গভীর, যেন মাটির তলায় গেঁথে যেতে চাইছে।

সে এবার স্থির করে—এই রহস্যের জট খুলতেই হবে।

 

ঠাকুরদালানের ছায়া

 

গ্রামের বৃদ্ধ লোকজন যেদিকে তাকাতে ভয় পায়, সেই রাস্তায় হাঁটছে আজ অরিত্র। মাধব বারবার অনুরোধ করেছিল—“ওদিকে যাবেন না দাদাবাবু, ওখানে একটা ছায়া আছে যেটা ফিরে আসে। ওই ঠাকুরদালানে কারও পা পড়লে সে বুঝতে পারে।”

কিন্তু অরিত্রর মাথায় এখন একটাই চিন্তা—যদি সত্যিই এই ভূতের ছায়া থাকে, তাহলে তার অস্তিত্ব কোথাও ইতিহাসে গাঁথা আছে। যদি এই শিশু তাকে ডাকে, তবে সে কিছু চাইছে—বিচার, মুক্তি, অথবা পরিচয়।
আর সে যদি অরিত্রর ক্যানভাসে নিজের মুখ ফুটিয়ে তোলে, তবে তার দায় শুধু ভয় পাওয়ার নয়—বোঝারও।

ঠাকুরদালান—গ্রামের প্রাচীনতম ভগ্নপ্রায় দালান, যার একপাশ ভেঙে পড়েছে, আর অন্য পাশে এখনও শ্বেতপাথরের কিছু স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে বিশাল উঠোন, যেখানে শোনা যায় এক কালে দুর্গাপুজো হত জমিদার বাড়ির।

কিন্তু এখন—চুপচাপ, জমে থাকা পাতার গন্ধে ভরা এক শ্মশানের মতো নিস্তব্ধতা।

অরিত্র থেমে দাঁড়ায়। পায়ের নিচে খসখসে পাতা চিড়িক করে শব্দ করে ওঠে।

দালানের ভেতরে পা রাখতেই হঠাৎ যেন বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। তার মনে হলো—কেউ যেন তাকিয়ে আছে। কিন্তু এ তো বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত জায়গা।

ঠিক তখনই চোখে পড়ল—একটি ভাঙা দরজার পাশের দেওয়ালে আঁকা রয়েছে এক নারী-মূর্তি। দেওয়ালের রং উঠে গেছে, কিন্তু সেই চিত্রে স্পষ্ট—একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ক্লান্ত নারী। মুখে জ্যামিতিক ছায়া, চোখ দুটি বড়—কিন্তু হাহাকারপূর্ণ।

দেখে অরিত্রর গায়ে কাঁটা দেয়। কারণ ওই চোখের রেখা, ওই মুখের আকার… ঠিক তার আঁকা সেই শেষ ছবির মতো!

সে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে। দেয়ালের নিচে মাটির কাছ ঘেঁষে এক পাথরের ফলক বসানো—অস্পষ্ট হরফে লেখা:

মাধুরী – এখানে ঘুমিয়ে আছে”

তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।

এখানেই শিশুটিকে কবর দেওয়া হয়েছিল?

অরিত্র হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মাটিতে হাত রাখে—ঠান্ডা, কিন্তু কেমন যেন জীবন্ত স্পন্দন… তার কান ঘেঁষে আবার ফিসফিস—
তুই তো বলেছিলি ফিরে আসবি মা…”

সে ঘুরে দেখে—কেউ নেই।

কিন্তু পেছনে—যে পথ দিয়ে সে এসেছে, সেখানে এখন ছোট ছোট পায়ের ছাপ। ধাপে ধাপে এগিয়ে আসছে তার দিকে।

সে পেছন হটতে থাকে… কিন্তু পায়ের ছাপ থামে না। বরং এগিয়ে আসে, একেবারে তার সামনে, তারপর থেমে দাঁড়ায়।

কেউ যেন দালানের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে।

তার শরীর জমে যায়। কাঁধের ওপর হালকা স্পর্শ… আর তারপর—

একটা ছোট্ট গলা, একদম ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে:
আমার ছবি শেষ করো…”

অরিত্র চমকে উঠে পড়ে পেছন দিকে। পড়ে যায় মাটিতে।

কিন্তু এবার কোনো ছায়া নেই। কেবল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাদামাটি আর সেই পদচিহ্নগুলো… তার শরীর কাঁপতে থাকে, কিন্তু মন বলে—শেষ করতেই হবে…”

পরদিন সকালে সে ফিরে আসে বাংলোয়। নিজের স্টুডিওতে ঢুকে, পঞ্চম ক্যানভাসটা টেনে বের করে আনে।

এইবার সে বুঝে গেছে—শুধু ছবির মধ্যে নয়, তার হৃদয়ের মধ্যে এই শিশুটির আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে তুলে নেয় তুলি, রঙ, ক্যানভাস।

শুরু করে শিশুটির মুখ আঁকা—চোখের ফাঁকা গহ্বর পূর্ণ করে চোখের জল, ঠোঁটে এক ক্ষীণ হাসি, হাতে একটা পুতুল… আর পেছনে এক নারী চরিত্র—দয়াময়ী।

ছবিটা সম্পূর্ণ হতেই, ঘরের মধ্যে যেন বাতাস জমাট বাঁধে। এক মুহূর্তে সব শান্ত… আর তারপর—

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।

পেছনে তাকিয়ে অরিত্র দেখে—আয়নার মধ্যে শিশুটি দাঁড়িয়ে নেই।

শুধু সে নিজে, একা।

আর ছবি?

ছবিটা শুকিয়ে গেছে। মুখে যেন প্রশান্তি।

বহুদিন পর অরিত্র প্রথমবার শান্তিতে ঘুমোয়।

 

কাদামাটির নিচে

 

ঘুমটা যেন কয়েক দিনের ছিল। গভীর, ঘন আর একরকম শান্ত।
অরিত্র যখন ঘুম থেকে উঠল, তখন দুপুর প্রায় গড়িয়ে বিকেলের দিকে। বাংলোর জানালায় কুয়াশার মতো এক নরম আলো পড়ছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো—সব স্বপ্ন ছিল।

তবে ঘরের দেয়ালে যখন সে তার আঁকা ছবিটার দিকে তাকাল, তখন বুঝল—না, সবটা স্বপ্ন ছিল না।

ছবিটা এখন সম্পূর্ণ।
শিশুটির চোখে আতঙ্ক নেই। ঠোঁটে হাসি। কোলে একটা লাল পুতুল।
আর তার পেছনে—দয়াময়ী দাঁড়িয়ে আছেন। মাথা নত, মুখে শান্তি।

অরিত্র হঠাৎ অনুভব করল—ঘরটা আজ হালকা। যেন একটা ভার কমে গেছে। যেন অনেকদিন পর প্রথমবার বাতাসও নিঃশব্দ নয়—সে স্বস্তির শব্দে ভরা।

তবু, একটা অদ্ভুত কৌতূহল তাকে ছাড়ছিল না—সবটা কি সত্যিই শেষ?

সে বারান্দায় এসে বসে। কিছুক্ষণ পর মাধব আসে। দেখে আজ মাধবের মুখেও চাপা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার ছাপ।

“আজ আপনার চেহারা অন্যরকম লাগছে দাদা,” মাধব বলল, “ভয় কমেছে বুঝি?”

অরিত্র হেসে বলল, “ভয় তো ছিল না। ছিল বোঝার চেষ্টা। শেষমেশ মনে হল, মেয়েটা শুধু একটা অসমাপ্ত গল্প বলছিল। আমি শুধু ক্যানভাস দিয়েছি।”

মাধব থেমে থাকে। তারপর আস্তে বলে, “জানেন দাদা, মাধুরীর মৃত্যুর পরে দয়াময়ীর আত্মহত্যা নিয়েও অনেক কাহিনি শোনা যায়। কেউ বলে সে আসলে বেঁচে ছিল আরও কিছুদিন। কেউ আবার বলে—দয়াময়ী আত্মহত্যা করেনি, তাকে…”

“তাকে?” অরিত্র প্রশ্ন করে।

মাধব চোখ নামায়। “মানুষের মন বড় অন্ধ দাদা। এই গ্রাম অনেক কিছু চেপে রেখেছে… আপনি যদি চান, আমি আপনাকে এক জায়গা দেখাতে পারি।”

দুপুরের শেষে তারা পৌঁছল গ্রামের এক প্রাচীন পোড়োবাড়ির ধ্বংসাবশেষে। স্থানীয় লোকেরা বলে—এটা ছিল সেই জমিদারের পুরোনো কুঠি, যিনি দয়াময়ীর আত্মীয় ছিলেন।

ছাদভাঙা সেই বাড়ির নিচতলায় একটি বদ্ধ ঘর, যেখানে মাধব একসময় খুঁজে পেয়েছিল পুরনো কিছু কাঠের বাক্স।
অরিত্র কৌতূহল নিয়ে এগোয়।

ঘরের কোণে পড়ে থাকা বাক্সটা খুলতেই ধুলো উড়ে ওঠে। তার মধ্যে কয়েকটি পুরনো কাগজ, ছেঁড়া কাপড় আর একটি ছোট্ট ডায়েরি।

অরিত্র ডায়েরিটা খুলে পড়ে:

 

আজ আমি মাধুরীকে শেষবার কোলে নিয়েছি। ওর দৃষ্টি আজ আমার দিকে ছিল না। সবাই বলেছে আমি অপবিত্র, পাগল। ওর মৃত্যুর জন্য আমাকেই দোষারোপ করেছে। কিন্তু জানে, ওর মা কে। ওর মা কখনো ফেলে যায় না। আমি ওকে নিজের কাছে রাখব—জীবনেও, মৃত্যুতেও।”
দয়াময়ী

 

অরিত্রর গলা শুকিয়ে আসে। সে ডায়েরি বন্ধ করে বাক্সে ফেরত রাখতে গিয়ে দেখে—একটা পাতলা সোনালি চেইন পড়ে আছে। একটা ছোট্ট লকেট লাগানো, যার গায়ে খোদাই—“M”

“মাধুরী,” অরিত্র ফিসফিস করে।

মাধব বলে, “আপনি চাইলে এটা দাফন করে দিতে পারেন কবরটার পাশে। ও হয়তো শান্তি পাবে চিরকালের জন্য।”

সন্ধ্যে নামে কুমিরডাঙার উপর। অরিত্র কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আবার সেই ঠাকুরদালানে পৌঁছায়।
ফুল, ধূপ, সেই লকেট আর ডায়েরির পাতাগুলো নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে ছোট্ট সমাধির পাশে।

মাটি একটু খুঁড়ে সে জিনিসগুলো রাখে। তারপর চোখ বন্ধ করে শুধু একটুকু বলে:

তোমার কথা কেউ শোনেনি, আমি শুনেছি। এবার ঘুমাও মাধুরী।”

হালকা বাতাস বয়ে যায়। গন্ধ আসে—নতুন পাতার, দূরের ফুলের, আর কাদামাটির…
তবে এবার সেই কাদা থেকে আর কোনো পদচিহ্ন উঠে আসে না।

 

শেষ চিঠি

 

সেই রাতে অরিত্র বাংলোয় ফিরে ঘুমোতে পারল না। বাইরে হালকা ঝরো হাওয়া বইছিল, ছাতিম ফুলের গন্ধে ভরে উঠছিল চারপাশ। মাধুরীর লকেট আর ডায়েরির পাতা সমাধির পাশে রেখে আসার পর তার মনে হচ্ছিল—সব শেষ, এবার শান্তি।

কিন্তু গভীর রাতে, দরজার নিচ দিয়ে কিছুর আসা যাওয়ার শব্দে তার ঘুম ভাঙে।

সে উঠে দরজার নিচে ঝুঁকে দেখে—একটা ছোট্ট খামে ভরা কিছু রাখা। কুড়িয়ে নিয়ে দেখে, হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ। খামের ওপরে স্পষ্ট হাতে লেখা…

অরিত্র বসু—যিনি শুনতে পান”

তার বুকটা ধক করে ওঠে। এতদিনের এই অদৃশ্য যোগাযোগ কি এবার সত্যিই রূপ নিল? সে ধীরে ধীরে খামটা খোলে।

ভেতরে একটি চিঠি, কালি অনেকটা মুছে গেছে, কিন্তু কিছু লাইন পরিষ্কার:

 

যদি কেউ কখনও শুনতে চায়, আমি জানাতে চাই—আমি দোষী ছিলাম না। আমার মেয়েটা আমার কাছে নিরাপদ ছিল। ওর মৃত্যু দুর্ঘটনা ছিল না। যে কুকুরগুলোর মতো আমার মেয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারাই আমাকে পাগল প্রমাণ করেছিল। আমি কিছু বলতে পারিনি। আমার কণ্ঠ রুদ্ধ ছিল সমাজের শিকলে।”

যদি কেউ এই চিঠি পড়ে, তবে জেনে রেখো, সত্য কবর চাপা পড়ে না। ওর আত্মা তোমাকে বেছে নিয়েছে কারণ তুমি শোনো—আর তুমি আঁকো। ওর কথা তুমি জানাবে। আমি… মুক্তি চাই না। শুধু চাই, কেউ জানুক—আমি একজন মা ছিলাম। শুধু তাই।”

দয়াময়ী
(তারিখ: ১২ নভেম্বর, ১৯৪৮)

 

চিঠিটা পড়তে পড়তে অরিত্রর মনে হল, কাঁধের ওপরে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে—না ভয় নয়, এক গভীর ক্লান্তি থেকে আসা স্বস্তির নিঃশ্বাস। সে জানে, এই শব্দ কেবল তার কানে আসে—যেহেতু সে শোনে।

সকালে, সে একেবারে অন্য মুডে স্টুডিওতে বসে পড়ে। সে এবার নতুন একটি ক্যানভাসে তুলির প্রথম আঁচড় দেয়—একজন নারী, কুয়াশায় মোড়া, চোখে অদ্ভুত জ্যোতি, হাতে একটি খোলা চিঠি।

এই ছবির নাম সে দেয়—“The Voice That Spoke”

সেই সপ্তাহেই সে কলকাতায় ফিরে যায়, আর তার এই ছবিগুলোর একটি প্রদর্শনী হয়। নাম—“Whispers from Kumedanga”

লোকজন মুগ্ধ। কেউ বলে শিল্পের গভীরতা অসাধারণ, কেউ বলে ছবি যেন কথা বলে। কিন্তু কেউ জানে না, এই কথাগুলো আসলে কার কণ্ঠে ছিল।

প্রদর্শনীর শেষ দিন এক বয়স্কা মহিলা এগিয়ে এসে ছবির পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,
“এই চোখদুটো কোথাও যেন দেখেছি। এরা কি কাউকে খুঁজছিল?”

অরিত্র হেসে বলে, “হ্যাঁ। এক মা খুঁজছিল তার কন্যাকে। এখন তারা একসাথে।”

বৃদ্ধা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর বলেন,
“তুমি শোনো। তুমি আঁকো। তুমি তাই… নির্বাচিত। এবার তুমি যাকে খুঁজবে, সেও হয়তো তোমাকেই খুঁজছে।”

অরিত্র চমকে তাকায়। মহিলা তখন আর নেই।

 

আবার সেই ছায়া

 

কলকাতায় ফিরে এসে অরিত্র যতই নিজের জীবনে স্বাভাবিক ছন্দ ফেরাতে চাইছিল, ততই সে অনুভব করছিল—কিছু একটা পাল্টে গেছে। শুধু কুমেদাঙ্গা নয়, তার ভেতরটাও বদলে গিয়েছে।

সে তার স্টুডিওর জানালায় বসে নতুন একটা ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, ছাদের ওপর ছাতিম ফুল পড়ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ সে খেয়াল করল—ক্যানভাসে সে এখনও তুলির ছোঁয়াও দেয়নি, অথচ তাতে হালকা ধূসর ছায়ায় একটি পায়ের ছাপ।

সে উঠে এসে ক্যানভাস ছুঁয়ে দেখে—কিছু নেই। কিন্তু আলো নেভালেই ছাপটা আবার দৃশ্যমান। অরিত্রর মনের ভিতর থেকে গা ছমছমে একটা প্রশ্ন উঠে আসে—এ কি আরেক কাহিনির শুরু?

সেই রাতে ঘুমের ভেতর অরিত্র যেন একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটছিল—একটা পুরনো, কাঠের মেঝে, লম্বা করিডোর, আর দেওয়ালে ঝোলানো ছবি। একটার সামনে এসে সে থেমে যায়। ছবিতে একটি ছোট মেয়ে—চুলে ফিতে, চোখে যেন অপার প্রশ্ন—আর তার মুখ অদ্ভুতভাবে কুয়াশায় ঢাকা। ছবির নিচে লেখা—

প্রতীক্ষা – ১৯৩৭”

ঘুম ভাঙতেই সে টের পায়, তার হাত দিয়ে স্কেচ প্যাডে কিছু একটা আঁকা হয়ে গেছে। সেই ছবির ঠিক সেইরকম ছায়াচিত্র। অরিত্র কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা উলটে দেখে—পিছনে লেখা একটা লাইন,

আমি ফিরে আসিনি। আমি তো ছিলামই না—আমাকে শুধু সৃষ্টি করা হয়েছিল।”

পরের দিন থেকে অরিত্র খুঁজতে শুরু করে, ‘প্রতীক্ষা’ নামটা নিয়ে পুরনো আর্কাইভ, খবরের কাগজ, সাহিত্য ম্যাগাজিন। একদিন সে ‘প্রবাহ’ পত্রিকার ১৯৪০ সালের একটি সংখ্যা পায়, যেখানে একটি রহস্যগল্প ছাপা হয়েছিল—রক্তফুলের মুখোশ”

লেখক—নামহীন
গল্পে বলা হয়েছে, এক ধনী জমিদারের আদুরে মেয়ে ছিল, যার মুখ কেউ কখনও দেখেনি। কারণ সে ছিল তার বাবার ‘সৃষ্টি’—এক কাঠের পুতুল, যাতে আত্মা প্রবেশ করেছিল।

গল্পটা যত পড়ে, ততই অরিত্রর গায়ে কাঁটা দেয়।

শেষ লাইনটা ছিল:
যদি তুমি শুনতে পাও, আমি আর একবার আসব। এবার আমি গল্প হব না—আমি বাস্তব হব।”

স্টুডিওতে ফিরে অরিত্র আবার তার ক্যানভাসের দিকে তাকায়। সেই পায়ের ছাপ এবার দুটো হয়েছে।

সে বোঝে—দয়াময়ীর কাহিনি ছিল শুরু। এবার প্রতীক্ষার পালা।

বাতাসে আবার সেই গন্ধ—ছাতিম ফুল, ভেজা কাঠ, আর একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ। অরিত্র ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকে।

এই গল্প এখন আর তার একার নয়।

 

মুখোশের ওপারে

 

ভোরের দিকে অরিত্রর ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায়। বাতাসে একটা গন্ধ—পুরনো কাঠ, ধুলো, আর যেন শরতের কাশফুলের মতো একটা ম্লান স্মৃতি। সে উঠে বসে, চারপাশ দেখে—স্টুডিও নিঃশব্দ, জানালার পাশে ঝুলছে কালি-কালো মেঘ।

টেবিলের ওপর খোলা স্কেচপ্যাডে সেই ছবিটা আবার বদলে গেছে। মেয়েটার মুখটা আগের দিনের চেয়ে একটু স্পষ্ট—দুটি চোখ যেন ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ছবি আঁকেনি সে নিজে। রং, রেখা, ছায়া—সব যেন আপনমনে গড়ে উঠেছে।

অরিত্র সিদ্ধান্ত নেয়, আর চুপ করে বসে থাকবে না। সে ফোন করে তার পরিচিত পুরাতত্ত্ববিদ বন্ধুকে—ঈশিতা রায়। সমস্ত কাহিনি না বললেও, সে শুধু বলে—“প্রতীক্ষা নামটা কি তুমি শুনেছ কখনও? ১৯৩৭ সাল, ছবি বা পুতুল সংক্রান্ত কিছু?”

ঈশিতা প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও পরে বলে, “অদ্ভুত ব্যাপার! দু-তিন মাস আগেই ‘গভর্নমেন্ট আর্টিফ্যাক্ট রেকর্ডস’-এ এমন একটা নাম এসেছিল—এক কাঠের মুখোশ, যার নাম দেওয়া ছিল ‘প্রতীক্ষা’। ওটা কুমেদাঙ্গা অঞ্চলের এক জমিদারবাড়ি থেকে কলকাতায় আনা হয়েছিল বহু বছর আগে। তবে…” সে থামে।

“তবে কী?” অরিত্র উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করে।

“ওটা নাকি হঠাৎই উধাও হয়ে যায় সংগ্রহশালা থেকে। যে কর্মী তখন দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর দাবি—মুখোশ নাকি নিজের ইচ্ছায় কাচ ভেঙে বাইরে বেরিয়ে গেছে।”

অরিত্রর বুক ধকধক করে ওঠে।
সে ভাবে—যদি ওই মুখোশটাই এখন কোনোভাবে আমার কাছে ফিরে এসে থাকে? ছবির মধ্যে এসে গেছে?

সে সেই রাতে কিছুটা সাহস করে ঘরে রাখা নিজের পুরনো ক্যামেরা সেট করে। টাইমল্যাপ্স মোডে, সে ক্যানভাসটার দিকে ফোকাস করে রেখে দেয়। এরপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।

ঘুম আসে না।

ভোরের দিকে হঠাৎ একটা ঠান্ডা ছোঁয়া তার গালে লাগে। সে চোখ মেলে দেখে—তার ঠিক পাশ দিয়ে ধোঁয়ার মতো কিছু একটা হেঁটে যাচ্ছে। ঘরের বাতাস জমাট। সাদা ধোঁয়ার ভেতরে এক জোড়া চুলের ফিতে ভেসে ওঠে, তারপর মিলিয়ে যায়।

সে দৌড়ে গিয়ে আলো জ্বালায়, ক্যামেরা স্টপ করে।

ভিডিও চালিয়ে দেখে—ক্যানভাসের সামনে একটানা ৪৭ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ছিল একটা ধোঁয়াটে অবয়ব। প্রথমে অস্পষ্ট, পরে ক্রমে স্পষ্ট হয়—মেয়েটা—প্রতীক্ষা।

ভিডিওর শেষ মুহূর্তে মেয়েটার মুখ হঠাৎ এক ঝলকে দৃষ্টিগোচর হয়—চোখ নেই, শুধু ফাঁপা গহ্বর, আর ঠোঁটে হালকা হাসি।

ক্যামেরার ফুটেজ দেখে অরিত্রর মনে হয়,
এটি কেবল মুখোশ নয়—এটি একটি অনন্ত অপেক্ষার আত্মা। যাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ হতে দেওয়া হয়নি। এখন সে খুঁজে বেড়াচ্ছে… সেই শিল্পীকে… যে তাকে শেষ করে দেবে।

অরিত্র বুঝতে পারে,
তার ক্যানভাস এখন আর কেবল ছবি আঁকার জায়গা নয়। এটা একটা দরজা।

 

 

মুখোশের আর্তনাদ

 

অরিত্রর মন আজ ভীষণ অস্থির। প্রতীক্ষার সেই ধোঁয়াটে ছায়াটি যেন তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে, বারবার নিজেকে প্রকাশ করার জন্য।

সে বুঝতে পারে—এখন শুধু আঁকাই যথেষ্ট নয়। তাকে জানতে হবে, কেন প্রতীক্ষা সম্পূর্ণ হতে পারেনি, কেন তার আত্মা এই দশকের পর দশক ধরে বেঁচে আছে নিঃস্বাসহীন মুখোশের আড়ালে।

অরিত্র সন্ধ্যায় কলকাতার পুরানো গ্রন্থাগারে বসে পুরাতন পত্রিকা আর নথিপত্র খুঁটিয়ে খুঁজতে থাকে। একসময় সে এমন একটি প্রতিবেদন পায়, যেখানে লেখা ছিল—

১৯৩৭ সালের গ্রীষ্মে, কুমেদাঙ্গার জমিদারের মেয়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর রহস্যজনক ঘটনা ঘটে। মেয়েটির বাবার অনুরোধে একটি মুখোশ তৈরি করা হয়, যাকে ‘প্রতীক্ষা’ বলা হয়, যেন মেয়েটির আত্মা এই মুখোশে বাস করুক। কিন্তু এর পরই জমিদারবাড়িতে অদ্ভুত ঘটনার আরম্ভ হয়। মুখোশ কখনো নিজে থেকেই ভেসে ওঠে, কখনো রাতে অদ্ভুত শব্দ করে।”

প্রতিবেদনে আরও লেখা ছিল,
যে শিল্পী মুখোশটি তৈরি করেছিলেন, তিনি অদৃশ্য আঘাতের শিকার হয়েছিলেন এবং কাজ শেষ না করে পালিয়ে গিয়েছিলেন।”

অরিত্রের রক্ত হিম হয়ে যায়। এ যেন তার নিজের গল্প।

পরের দিন সে সেই জমিদারবাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় যায়। চারপাশে ভাঙাচোরা দেয়াল, তিল তিল করে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের ছাপ।
সে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বলে,
“প্রতীক্ষা, তুমি কি সত্যিই আমাকে বেছে নিয়েছো? তুমি কি শেষ হতে চাও?”

হঠাৎ বাতাসে একটা হিমশীতল সান্নিধ্য। সে ঘুরে দেখল—কেউ নেই।
কিন্তু পাশে থাকা একটি ধোঁয়াটে আলো হালকা নড়ে ওঠে, মৃদু ফিসফিস শব্দ শোনা যায়—
শেষ করো…”

অরিত্র অনুভব করল, এবার সময় এসেছে।

স্টুডিও ফিরে সে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে সেই মুখোশের আর্তনাদের আঁকতে লাগল। আঁকতে আঁকতে যেন সে প্রতীক্ষার এক এক করে সব আবেগ, আশা, ভয় বুঝতে পারছে।
দূর থেকে হঠাৎ বাতাসের কানে কানে শব্দ আসে—
আমি অপেক্ষা করেছি শত বছর… আমাকে শেষ করো।”

কিন্তু শেষ করার মানে কি মুক্তি? নাকি চিরকালীন বন্দিত্ব?

অরিত্র বুঝতে পারল, প্রতীক্ষার আত্মা মুক্তি পেতে চাইছে, কিন্তু জানে না মুক্তির পরে কি আসবে।

সে নিজেকে বলল, “আমার হাতে আজ তোমার মুক্তি। তবে তোমাকে ভাল করে চেনা দরকার।”

শেষ পর্যন্ত সে আঁকতে শুরু করল এক চিত্র—মুখোশের আড়ালে এক এক করে সব আবেগের অভিব্যক্তি। ভয়, একাকিত্ব, কান্না, আশা—সব একসাথে।

অন্ধকার ও আলোয় ভরা সেই ছবি শেষ হতেই, স্টুডিও জুড়ে একটা শান্তি নেমে এলো।

অরিত্র চোখ বন্ধ করে ভাবল—
এইবার তুমি মুক্তি পাবে, প্রতীক্ষা।”

বাইরে হঠাৎ সূর্যের প্রথম রশ্মি পড়ে স্টুডিওর জানালায়।

শুধু একটি শব্দ শোনা যায়, দূর থেকে, মৃদু—
ধন্যবাদ…”

শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-29-at-6.38.47-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *