অরিন্দম ভট্টাচার্য
পর্ব ১ : যাত্রার ডাক
হাওড়া স্টেশন সেই চিরচেনা ভিড়, অথচ প্রতিবারই যেন নতুন এক উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। বিশাল গম্বুজের নীচে হুড়োহুড়ি মানুষ, ঘোষণার ভাঙা ভাঙা শব্দ, স্টিম আর ধোঁয়ার গন্ধ, ভেজা রেলের চাকার ধাতব আওয়াজ—সব মিলিয়ে এক অস্থির, অথচ জীবন্ত ছন্দ। সেই ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে অনির্বাণ। হাতে মাঝারি মাপের ট্রলি ব্যাগ, কাঁধে বহুদিনের সঙ্গী কালচে ব্যাকপ্যাক, যার চেইন একপাশে খানিক ঢিলে হয়ে গেছে। অফিসের নিরন্তর ফাইলের বোঝা, ডেডলাইনের অবসাদ, যান্ত্রিক নিস্তব্ধতার পর এই মুহূর্তটা যেন তার কাছে মুক্তির প্রথম নিশ্বাস। বহুদিন ধরে ভেবে আসছিল, এক মাসের এক অনিশ্চিত ভ্রমণ—যেখানে থাকবে না কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য, থাকবে না ট্যুর গাইডের বাঁধা-বাঁধি পরিকল্পনা, শুধু থাকবে পথ, আর পথের ভেতর দিয়ে আলো খোঁজার অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা। সে মনে মনে বলেছিল, “আমি খুঁজতে যাচ্ছি আলো—শহরের বিজ্ঞাপনী আলো নয়, অফিসের সাদা টিউব লাইট নয়, বরং সেই আলো যেটা অচেনা মানুষ, অদেখা প্রান্তর, অপরূপ দৃশ্যের ভেতর থেকে উঁকি দেয়।”
প্ল্যাটফর্ম নম্বর ন’এ দাঁড়িয়ে ছিল শতাব্দী এক্সপ্রেস, গন্তব্য দিল্লি। টিকিট কাটা হয়েছে অনেক আগেই, অথচ বুকের ভেতর এখনো কেঁপে উঠছে অজানা উত্তেজনা। চারপাশে যাত্রীদের আনাগোনা, কেউ শেষ মুহূর্তে চা হাতে ছুটছে, কেউ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ব্যস্ত, কেউ বিদায় জানাচ্ছে চোখের জল মুছে। অনির্বাণ দাঁড়িয়ে বুঝছিল, এই প্ল্যাটফর্মেই তার ভ্রমণের সূচনা, আর সমাপ্তি—সেটা হবে কোথায়, জানে না সে নিজেও।
ট্রেন ছাড়তেই যেন কাঁধ থেকে অদৃশ্য বোঝা নেমে গেল। জানলার বাইরের দৃশ্য দ্রুত বদলাচ্ছে—শহরের উঁচু বাড়ি, ছায়া মাখা গলি, সিগন্যালের জটিল আলো সব মিলিয়ে ফেলে আসা জীবনের প্রতীক। ধীরে ধীরে সবকিছু পিছিয়ে গেল, মিলিয়ে গেল শহরের গুঞ্জন, ট্রাফিকের অস্থিরতা, মানুষের অনন্ত তাড়াহুড়ো। মনে হল, সে যেন অদৃশ্য সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে এক নতুন দিগন্তে।
বর্ধমান পার হতে হতে সন্ধ্যা নেমে এল। আকাশের বুকে ফ্যাকাসে লাল আলো, ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা ট্রেনের জানলায় ভেসে আসছিল শান্ত সবুজের নিস্তব্ধতা। কোথাও কোথাও ছোট মাটির ঘর, জানলার ফাঁক দিয়ে জ্বলছে কেরোসিন ল্যাম্প, যেন অচেনা গ্রামগুলো হাত নাড়ছে—“এসো, আমাদের গল্প শোনো।” অনির্বাণ তাকিয়ে থেকে অনুভব করছিল, ভ্রমণ মানেই শুধু দূরের দৃশ্য নয়, প্রতিটি অচেনা আলোয় লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবনের অগণিত অপ্রকাশিত কথা।
সহযাত্রীরাও যেন এই গল্পেরই চরিত্র। পাশের বার্থে বসা এক বৃদ্ধ দম্পতি উচ্ছ্বাসভরে শোনাচ্ছিলেন তাদের কেদারনাথ যাত্রার অভিজ্ঞতা। কাঁপা কাঁপা গলায় যখন তারা বলছিলেন কীভাবে তুষার ঢাকা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিলেন, অনির্বাণ অনুভব করছিলেন যে ভ্রমণের ভেতর ধর্ম-অধ্যাত্ম নয়, বরং মানুষের আত্মিক মুক্তির আনন্দই প্রবল। কুপে থাকা আরেক তরুণী জানাচ্ছিলেন রাজস্থানের মরুভূমি নিয়ে তার বিস্ময়। প্রতিটি গল্প যেন আলাদা আলো, প্রতিটি মুখ যেন আলাদা জানালা খুলে দিচ্ছিল তার ভেতরের দিকে।
রাত যত গভীর হচ্ছিল, জানলার বাইরে অন্ধকারে ছুটে চলা আলোর বিন্দুগুলো যেন আরো স্পষ্ট হচ্ছিল। কখনো দূরের গ্রাম থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে, কখনো বা রেলের গেটের ঝিলিক দিয়ে মুছে যাচ্ছে এক মুহূর্তের জীবনচিত্র। এই অদ্ভুত ছন্দের ভেতরেই অনির্বাণ ডায়েরি খুলে লিখতে লাগল—“আজ থেকে শুরু হলো আমার পথযাত্রা। আমি খুঁজছি আলো, খুঁজছি নিজেকে। জানি না কোথায় পৌঁছব, কিন্তু বিশ্বাস করি প্রতিটি পথই নতুন এক দরজা খুলে দেবে। ভ্রমণ মানে কেবল স্থান নয়, মানুষের চোখে ধরা আলো, তাদের কথায় মিশে থাকা ইতিহাস, আর আমার নিজের ভেতরের নিঃশব্দ স্রোত।”
হঠাৎ কুপে বাতি নিভে এল, মুহূর্তের জন্য অন্ধকার। আবার আলো ফিরে আসতেই দেখা গেল সহযাত্রীদের মুখ, কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ জানলার পাশে টেক দিয়ে চুপচাপ বাইরের অন্ধকার গুনছে। অনির্বাণ বুঝল, ভ্রমণের প্রথম দিনেই সে শিখে নিয়েছে এক গোপন সত্য—প্রতিটি যাত্রার ভেতরেই থাকে দ্বৈত সুর। বাইরে ট্রেনের গতি, ভেতরে এক অদৃশ্য নীরবতা। আর সেই নীরবতার ভেতর দিয়েই শুরু হয় আত্ম-আলো খোঁজা।
রাত বাড়তে লাগল, ট্রেন এগিয়ে চলল উত্তর ভারতের দিকে। অনির্বাণ জানত, এ তো কেবল শুরু। সামনের পথেই অপেক্ষা করছে অগণিত অচেনা শহর, পাহাড়, নদী, মরুভূমি, আর সেইসব মানুষের গল্প, যাদের সঙ্গে কখনো দেখা হতো না যদি না সে এ যাত্রায় বেরোত। আজকের দিনটা শুধু প্রথম সিঁড়ি, কিন্তু এই প্রথম সিঁড়ির পাদদেশেই যেন তার মনে হল—হ্যাঁ, আলো খোঁজার যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।
পর্ব ২ : দিল্লির গলিতে প্রথম ভোর
শতাব্দী এক্সপ্রেস ভোরের প্রথম আলোয় পৌঁছল দিল্লি স্টেশনে। জানলার বাইরে তখন কুয়াশা আর হালকা ধোঁয়া মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছে। প্ল্যাটফর্মে নেমেই অনির্বাণ বুঝল, কলকাতার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক ছন্দে সে এসে পৌঁছেছে। চারপাশে দৌড়ঝাঁপ, হকারদের চিৎকার, রিকশাওয়ালাদের ডাক, ভোরবেলার চায়ের গন্ধ—সবকিছু মিলিয়ে এক জমজমাট কোলাহল। কিন্তু এই কোলাহলের মধ্যেও কোথাও যেন একটা অনুচ্চারিত উত্তেজনা, একটা ডাক—“এসো, আমাদের শহরটাকে জানো।” অনির্বাণ ব্যাকপ্যাক টেনে কাঁধে চেপে নিল। কোথাও হোটেল বুক করা ছিল না, আর সেটাই ছিল তার পরিকল্পনা—অচেনা শহরে অচেনা পথের উপর নিজেকে সঁপে দেওয়া। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়েই টানা অটো ধরে পৌঁছে গেল চাঁদনী চক-এর দিকে।
চাঁদনী চক, নামটা বহুবার শুনেছে, কিন্তু সকালবেলায় সেই প্রাচীন বাজারের গলিপথে হাঁটার অভিজ্ঞতা যেন অন্যরকম। সরু অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল অগণিত দোকান, কোথাও রঙিন কাপড়ের স্তূপ, কোথাও মশলার দমকা গন্ধ, কোথাও আবার কড়াইতে সোনালি জিলিপি ভাজার ঝমঝম শব্দ। দোকানিদের চিৎকার, ক্রেতাদের দর কষাকষি, গলির ভেতর দিয়ে হর্ন বাজিয়ে চলে যাওয়া রিকশা—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, এ এক অন্তহীন মেলা। অনির্বাণের মনে হল, ভ্রমণ আসলে শুধু বাইরের দৃশ্য নয়, শহরের গায়ে গায়ে লেগে থাকা গন্ধ, শব্দ, স্বাদ—সবকিছু মিলেই এক জীবন্ত গল্প।
একটা চায়ের দোকানে বসে গরম মাটির কুলহড়ে চা খেল সে। দোকানদার বলল, “দিল্লি ঘুরতে এসেছেন? কোথাকার?” অনির্বাণ হেসে উত্তর দিল, “কলকাতা।” তখনই পাশের এক বৃদ্ধ, মাথায় পাগড়ি, দাড়ি ভরা মুখ, কথা জুড়ে দিলেন—“কলকাতা! আহা, একসময় অনেকবার গেছি ব্যবসার কাজে। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া, বউবাজারের গলি—সব এখনো মনে আছে। আপনার শহরের মিষ্টির স্বাদ অন্য কোথাও নেই।” বৃদ্ধের চোখে যেন অতীতের আলো, এক শহর থেকে আরেক শহরে জুড়ে থাকা সম্পর্কের সুতো। অনির্বাণ বুঝল, অচেনা জায়গায় সবচেয়ে বড় সেতু হলো মানুষ।
চাঁদনী চক ঘুরে ঘুরে সে পৌঁছে গেল লালকেল্লার সামনে। সুবিশাল লাল পাথরের দেয়াল, প্রাচীন ইতিহাসের এক গম্ভীর সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে সে অনুভব করল, ইতিহাস কোনো জাদুঘরের কাচের ভেতর বন্দি নয়, বরং দেয়ালের ইটগুলোর ভেতরেও একটা নিঃশব্দ স্পন্দন বেঁচে থাকে। একসময় সম্রাটদের পদচারণা, সভার গর্জন, যুদ্ধের দামামা—সব যেন আজও প্রতিধ্বনি হয়ে ভেসে আসছে। এই ভ্রমণের মুহূর্তগুলোতে অনির্বাণ বুঝল, সে কেবল পর্যটক নয়, বরং সময়ের সঙ্গেও কথা বলছে।
দুপুরে পৌঁছল জামা মসজিদে। সাদা-লাল পাথরের অপরূপ স্থাপত্য, বিশাল উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই মনে হলো মানব সভ্যতার এক অদম্য স্থাপত্যস্বরূপ। নামাজের সময় মসজিদের ভেতর যে সুরেলা ধ্বনি ভেসে এল, সেটি শুধু ধর্মীয় আহ্বান নয়, বরং মানুষকে মানুষের কাছাকাছি টেনে আনার এক অন্তরঙ্গ সুর। অনির্বাণের ভেতর যেন অন্যরকম এক শান্তি নেমে এলো।
বিকেলে ঘুরে গেল ইন্ডিয়া গেট। বিস্তৃত চত্বর, সবুজ লন, চারপাশে মানুষের ভিড়, বাচ্চারা বেলুন নিয়ে দৌড়চ্ছে, রাস্তার ধারে ফুচকার দোকান। অথচ স্মৃতিসৌধের নিচে যখন সে দাঁড়াল, শহীদের নাম খোদাই করা শিলালিপিগুলো দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন এক ভার জমল। ভ্রমণ কখনো কখনো শুধু আনন্দের নয়, বরং গভীর উপলব্ধিরও।
রাত নামতেই কনট প্লেসের দিকে গেল। সাদা রঙের গম্বুজ আকৃতির ভবন, চারপাশে ঝলমলে আলো, রেস্তরাঁ আর বইয়ের দোকান। এক দোকানে ঢুকে কিনল একটা নোটবুক। ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্ত লিখে রাখার জন্য সে প্রতিজ্ঞা করল। ক্যাফেতে বসে ডায়েরি খুলেই লিখল—“দিল্লি মানে বৈপরীত্যের শহর। এখানে ইতিহাসের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি আর আধুনিকতার ঝলকানি পাশাপাশি বাঁচে। ভ্রমণ মানে এই দ্বৈততা অনুভব করা। সকাল থেকে রাত, প্রতিটি মোড়ে আলো আর ছায়া মিলেমিশে গেছে।”
রাতের ট্রেনে পরের গন্তব্য ঠিক করল আগ্রা। বুক করা টিকিট নেই, কেবল প্ল্যাটফর্মে গিয়ে জেনারেল টিকিট কেটে উঠে পড়ল ট্রেনে। লোকাল কুপে ভিড়, গরমে হাঁসফাঁস, মানুষের ঠাসাঠাসি। তবুও সেই ভিড়ের মধ্যেই এক অদ্ভুত উষ্ণতা। পাশের আসনে বসা কলেজপড়ুয়া ছেলেটি নিজের টিফিনের পরোটা ভাগ করে দিল। কেউ কেউ গল্প শুরু করল নিজেদের শহর নিয়ে। এক মহিলা বললেন, তিনি মথুরা যাচ্ছেন মেয়ের বিয়ের কেনাকাটার জন্য। অনির্বাণ অনুভব করল, অচেনা মানুষের সঙ্গে অচেনা মুহূর্ত ভাগ করাই ভ্রমণের আসল সম্পদ।
রাত গভীর হলো, ট্রেন ছুটছে আগ্রার দিকে। জানলার বাইরে অন্ধকার, মাঝে মাঝে দূরের আলো জ্বলছে। অনির্বাণ নোটবুকে লিখল—“আজকের দিনটা আমার জীবনের এক বড় পাঠ। শহরের কোলাহল, ইতিহাসের দেয়াল, ধর্মীয় প্রার্থনার সুর, কিংবা সহযাত্রীদের অচেনা দানশীলতা—সব মিলিয়ে আমি শিখছি আলো আসলে কোথায় থাকে। আলো থাকে মানুষের চোখের ভেতর, তাদের স্মৃতিতে, তাদের উদারতায়। আর এই আলোই আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পরের যাত্রার দিকে।”
পর্ব ৩ : তাজমহলের আড়ালে এক শহর
ভোরের আগ্রা স্টেশনে নেমে প্রথম যে জিনিসটা অনির্বাণের মনে হল, সেটা হলো শহরের ভেতরে যেন একধরনের নিঃশব্দ প্রতীক্ষা লুকিয়ে আছে। স্টেশন চত্বরে নেমেই সে চারপাশের কোলাহল শুনল—রিকশাওয়ালাদের ডাক, ট্যাক্সি চালকদের টানাটানি, চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসা ধোঁয়া। হাতে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়েই সে ভাবল, এ শহরে আসার আসল উদ্দেশ্য তো সকলের মতোই এক—তাজমহল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, শুধু সেই সাদা মার্বেলের সৌন্দর্য দেখাই নয়, বরং এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা শহরের স্বরূপও অনুভব করতে হবে। রিকশা নিয়ে পৌঁছে গেল দক্ষিণ গেটের দিকে। ভোরবেলা, তখনো ভিড় জমেনি। প্রবেশপথ পেরোতেই চোখের সামনে ধরা দিল সেই বিখ্যাত দৃশ্য। দূরে দাঁড়িয়ে আছে সাদা মার্বেলের গম্বুজ, চারদিকে চারটি মিনার, যেন কুয়াশার পর্দার মধ্যে ভেসে ওঠা কোনো অলৌকিক স্বপ্ন। মুহূর্তের জন্য অনির্বাণের নিঃশ্বাস আটকে গেল। ছবিতে, বইয়ে, সিনেমায় হাজারবার দেখা সেই সৌন্দর্য সামনে দাঁড়িয়ে যেন অচেনা নতুন এক অর্থ পেল। সে টুকরো টুকরো আলোয় দেখল মার্বেলের গায়ে খোদাই, পাথরে পাথরে ঝরে পড়া ইতিহাসের অশ্রু। কিন্তু এই অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝেও তার মনে হলো—এ কেবল প্রেমের স্মৃতিসৌধ নয়, বরং অগণিত শ্রমিকের ঘাম, অজানা শিল্পীর হাতের ছাপ, আর সময়ের নির্মমতা। ভিতরে ঢুকে যখন সে মার্বেলের গায়ে হাত রাখল, ঠান্ডা পাথর যেন ফিসফিস করে বলল, “প্রেমের সঙ্গে যন্ত্রণা সবসময় জড়িয়ে থাকে।”
আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকদের ভিড় ধীরে ধীরে বাড়ছিল। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ গাইডের পিছু নিয়ে ইতিহাস শুনছে। অনির্বাণ দূরে বসে সবকিছু লক্ষ্য করছিল। ভ্রমণের এই মুহূর্তে সে বুঝল, প্রতিটি স্থাপত্যের ভেতর থাকে দুই স্তর—একটা দৃশ্যমান, আরেকটা অদৃশ্য। দৃশ্যমান হলো সৌন্দর্য, যা সবাই দেখে; অদৃশ্য হলো যন্ত্রণার ছাপ, যা কেবল উপলব্ধির চোখে ধরা দেয়।
তাজমহল থেকে বেরিয়ে সে রিকশা নিয়ে শহরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। সরু গলি, মাটির রঙের বাড়ি, রাস্তার পাশে বাচ্চারা খেলছে, কোথাও পকোড়া ভাজার গন্ধ, কোথাও মিষ্টির দোকানের ঝলমলে প্রদর্শনী। এই আগ্রা তার চোখে অন্যরকম। এখানে নেই সাদা মার্বেলের ঝলকানি, আছে মানুষের সহজ জীবন, মাটির গন্ধ, প্রতিদিনের ছন্দ। এক দোকানে থেমে গরম লস্যি খেল। দোকানদার জিজ্ঞেস করল, “তাজমহল ঘুরে এলেন?” অনির্বাণ মাথা নাড়ল। তখন দোকানদার হেসে বলল, “সাহেবরা আসে, ছবি তোলে, চলে যায়। কিন্তু আমাদের শহরটা আসলে ওই চার দেয়ালের বাইরেই বেঁচে আছে।” কথাটা শুনে অনির্বাণ অনুভব করল, ভ্রমণ কেবল সৌন্দর্য দেখা নয়, বরং সেই সৌন্দর্যের আশেপাশে যে অদৃশ্য জীবন জেগে থাকে, সেটাকেও চিনে নেওয়া।
দুপুরে সে পৌঁছল আগ্রা ফোর্টে। লাল বেলেপাথরের দেয়াল, ভেতরে অসংখ্য প্রাসাদ, মসজিদ, উঠোন। গাইড বলছিলেন কীভাবে সম্রাট শাহজাহানকে এখানেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল, যিনি শেষ জীবনে জানলার ফাঁক দিয়ে দূরে দাঁড়ানো তাজমহলের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছিলেন সময়। অনির্বাণ যখন সেই জানলার কাছে দাঁড়াল, তার বুকের ভেতর অদ্ভুত ভার জমল। ভাবল, মানুষ কখনো কখনো তার নিজেরই নির্মাণের ভেতর বন্দি হয়ে যায়। যেমন শাহজাহান বন্দি হয়েছিলেন নিজেরই স্বপ্নের স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে, তেমনই আমরাও হয়তো আজকের জীবনে নিজের তৈরি দেয়ালের মধ্যে বন্দি।
সন্ধ্যা নামতেই শহরের রাস্তায় বেরিয়ে সে দেখল আলো ঝলমলে বাজার। ছোট ছোট দোকানে পেতলের জিনিস, চামড়ার ব্যাগ, রঙিন পাথরের গয়না। ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল, এই শহরের প্রতিটি কোণ একেকটা গল্প বলে। রাস্তার ধারে একজন বেহালাবাদক বসে বাজাচ্ছিল ধীর সুর। মানুষ থেমে শুনছিল, কেউ কয়েন ছুঁড়ে দিচ্ছিল। অনির্বাণও দাঁড়িয়ে গেল। সুরটা তার মনে অদ্ভুত এক আলোড়ন তুলল—সৌন্দর্যের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে বিষাদ, আর বিষাদের মধ্যেও কখনো কখনো জন্ম নেয় আলোর ঝলক।
রাতে ফিরে এল স্টেশনের কাছাকাছি এক ছোট্ট লজে। ঘরটা অতি সাধারণ—একটা খাট, একটা টেবিল, ম্লান আলো। কিন্তু জানলার ফাঁক দিয়ে দূরে তাজমহলের ছায়া দেখা যাচ্ছিল, চাঁদের আলোয় যেন নিঃশব্দ ভেসে আসছে। টেবিলে বসে অনির্বাণ ডায়েরি খুলে লিখল—“আজ শিখলাম, ভ্রমণ মানে শুধু বিস্ময়ের দিকে তাকানো নয়, বরং বিস্ময়ের আড়ালে যে নিঃশব্দ যন্ত্রণা আর সাধারণ মানুষের জীবন লুকিয়ে থাকে, সেটাকেও দেখা। তাজমহল হয়তো প্রেমের চিহ্ন, কিন্তু আগ্রার গলিগুলোও একেকটা প্রেমের গল্প বয়ে নিয়ে চলে—মায়ের হাতে বানানো রুটি, দোকানদারের হাসি, রাস্তায় বাজতে থাকা বেহালার সুর। আলো সব জায়গায়, যদি চোখে তাকানোর ক্ষমতা থাকে।”
ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার মনে হলো, এ যাত্রার তৃতীয় দিনে সে বুঝতে পেরেছে ভ্রমণ আসলে তাকে ক্রমশ নিজের ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শহরের বাইরের দৃশ্যের ভেতর দিয়ে সে আসলে খুঁজছে নিজের ভেতরের প্রতিচ্ছবি। বাইরে যেমন সৌন্দর্য আর যন্ত্রণা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে, ভেতরেও তেমনি আছে আলো আর অন্ধকারের সহাবস্থান। ভ্রমণ মানে সেই ভারসাম্যকে চিনে নেওয়া।
পর্ব ৪ : মরুভূমির রোদে জয়পুর
আগ্রা থেকে রাতের ট্রেনে উঠে অনির্বাণ পৌঁছল জয়পুর। ভোরের আলোয় স্টেশন থেকে বেরিয়েই মনে হলো সে একেবারে অন্য জগতে এসে পড়েছে। বাতাসে ধুলো আর রোদের মিশ্র গন্ধ, চারদিকে গুলাবি রঙের প্রাসাদসদৃশ বাড়ি, রাস্তায় উট, ঘোড়ার গাড়ি, টুকটুক করে চলা অটো—সব মিলিয়ে যেন রঙের মেলা। জয়পুরকে পিঙ্ক সিটি বলা হয়, আর সেই পিঙ্ক রঙের ইট আর দেওয়াল আসলেই যেন শহরের শরীরে এক বিশেষ সুর বেঁধে দিয়েছে। অটোয় চেপে সে প্রথমে গেল হাওয়া মহলের দিকে। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিখ্যাত পাঁচতলা প্রাসাদ যেন বাতাসের সঙ্গে খেলা করছে। অসংখ্য ছোট ছোট জানলা দিয়ে আলো হাওয়া ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। অনির্বাণ যখন সেই জানলাগুলোয় দাঁড়াল, কল্পনা করল একসময় রাজবধূরা এখান থেকে রাস্তায় চলতে থাকা উৎসব দেখতেন। ইতিহাস আর বর্তমান যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।
হাওয়া মহল থেকে বেরিয়ে সে গেল আম্বের ফোর্টে। পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সুবিশাল দুর্গ যেন মরুভূমির বুকে এক স্বপ্নের মতো। উট আর হাতিতে চেপে পর্যটকরা উঠছে, কিন্তু অনির্বাণ হাঁটতে হাঁটতে উঠল। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সে অনুভব করছিল, প্রতিটি পাথরে সময়ের ছাপ, প্রতিটি খিলানে কালের রেখা। ভিতরে ঢুকে সুবিশাল উঠোন, আয়নার প্রাসাদ, রঙিন দেওয়াল, সব মিলিয়ে এক অপূর্ব রাজকীয় আবহ। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের আড়ালে তার মনে হচ্ছিল—এ রাজপ্রাসাদও একসময় ছিল ক্ষমতার প্রতীক, যেখানে ছিল যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র, আর অগণিত ত্যাগ। ভ্রমণ মানে সৌন্দর্যের পাশাপাশি সেই অদৃশ্য ইতিহাসকে উপলব্ধি করা।
দুপুরে সে শহরের বাজারে ঘুরতে গেল। জহরির বাজারে রঙিন গয়না, মির্জা ইসমাইল রোডে ব্লু পটারি, বাপু বাজারে উজ্জ্বল রাজস্থানি কাপড়—সব মিলিয়ে যেন রঙের উল্লাস। গরম রোদে হাঁটতে হাঁটতে এক দোকানে থেমে লস্যি খেল। দোকানদার বলল, “ভাইসাব, এখানে এলে পেঁয়াজ কচোরি না খেলে কিছুই খাওয়া হলো না।” সত্যিই, গরম কচোরির সঙ্গে ঝাল চাটনি মুখে দিতেই অনির্বাণের মনে হলো ভ্রমণের স্বাদ আসলে খাবারের মাধ্যমেও ধরা পড়ে। প্রতিটি শহর তার নিজের স্বাদে ভ্রমণকারীর মনে ছাপ ফেলে যায়।
বিকেলের দিকে সে গেল নাহারগড় ফোর্টে। পাহাড়ের উপর থেকে নিচে তাকাতেই দেখা গেল গোটা শহর লালচে আভায় ভেসে উঠছে। সূর্য ধীরে ধীরে নামছে পশ্চিমে, আকাশ রঙ বদলাচ্ছে সোনালি থেকে কমলা, তারপর লালচে বেগুনি। অনির্বাণ চুপচাপ বসে সেই দৃশ্য দেখছিল। তার মনে হলো, ভ্রমণ আসলে এই মুহূর্তগুলোই—যেখানে ভাষার প্রয়োজন নেই, শুধু চোখ আর মন খোলা রাখলেই আলো ভেসে আসে। পাশে বসা এক বিদেশি পর্যটক বলল, “This sunset makes you believe in silence.” অনির্বাণ মাথা নেড়ে হাসল। হ্যাঁ, আলো কখনো কখনো নীরবতার ভেতরেই জন্ম নেয়।
রাত নামতেই সে গেল চোকি ধানি নামের এক সাংস্কৃতিক গ্রামে। মাটির ঘর, প্রদীপের আলো, রাজস্থানি নাচ, পুতুল খেলা, ঢোলকের তালে তালে মানুষজন। একেবারে অন্য জগৎ। থালিভর্তি রাজস্থানি খাবার—ডাল বাটি চুরমা, গাট্টে কি সবজি, লাল মাংস—সব মিলে এক ভোজনের উৎসব। খেতে খেতেই মনে হচ্ছিল, এ কেবল পেট ভরানো নয়, বরং এ অঞ্চলের আত্মার সঙ্গে সংযোগ ঘটানো।
ডায়েরি খুলে লিখল অনির্বাণ—“জয়পুর মানে রঙের শহর, আলো-ছায়ার খেলা, ইতিহাস আর সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মিশ্রণ। এখানে দাঁড়িয়ে বোঝা যায় ভ্রমণ কেবল স্থাপত্য বা দৃশ্য নয়, বরং স্বাদ, গন্ধ, রঙ, আর মানুষের উচ্ছ্বাসে গড়ে ওঠে। আলো আসলে বহুরঙা, একেক শহরে একেক রূপে ধরা দেয়।”
রাতের আকাশে অগণিত তারা জ্বলছিল। লজের ছাদে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ তাকিয়ে রইল সেই আকাশের দিকে। তার মনে হলো, প্রতিটি শহর যেন তারার মতো—দূর থেকে আলাদা আলাদা দেখা যায়, কিন্তু আকাশের ভেতর সব একসঙ্গে জ্বলজ্বল করে। ভ্রমণ মানে হয়তো এই তারাদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া।
ঘুমোবার আগে তার মনে পড়ল, পরের গন্তব্য হবে জোধপুর, নীল শহর। নীল রঙের ভেতর দিয়ে নতুন আলো খুঁজে পাওয়ার আশায় সে প্রস্তুত হতে লাগল।
পর্ব ৫ : নীল শহরের নীল আলো
রাতের ট্রেনে করে অনির্বাণ পৌঁছল জোধপুরে। স্টেশন থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল ভোরের আলোয় স্নাত এক অদ্ভুত শহর। দূরে উঁচু পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে মেহরানগড় দুর্গ, যেন এক প্রাচীন রক্ষক, আর তার পায়ের নিচে ছড়িয়ে আছে নীলচে বাড়িগুলোর সমুদ্র। জোধপুরকে নীল শহর বলা হয়, আর সত্যিই, সূর্যের আলোয় যখন ঘরবাড়ির দেওয়ালগুলো ঝিকমিক করে উঠল, মনে হলো যেন শহরটা এক বিশাল চিত্রকলা। অটো নিয়ে সে ঢুকে পড়ল পুরনো শহরের সরু গলিতে। নীল রঙের দেওয়াল, রঙিন দরজা, জানলার কারুকাজ, ছাদের ওপর শুকোতে রাখা লঙ্কা আর কাপড়—সব মিলিয়ে যেন জীবন্ত রূপকথা। রাস্তায় ছুটে চলা গরু, মাথায় জলভরা কলসি নিয়ে হাঁটছে মহিলারা, দোকানের সামনে বসে আছে বয়স্ক পুরুষেরা চা খাচ্ছে—সব মিলিয়ে শহরের ছন্দে যেন সময় আলাদা রূপ পেয়েছে। অনির্বাণের মনে হলো, এ শহর কেবল নীল রঙে মোড়া নয়, বরং মানুষের জীবনযাত্রার স্নিগ্ধ সরলতায় মোড়া।
সকালবেলায় সে উঠল মেহরানগড় দুর্গে। উঁচু পাহাড়ের গায়ে দাঁড়ানো এই দুর্গের ভেতর ঢুকতেই ইতিহাসের নিঃশব্দ স্পন্দন টের পাওয়া যায়। বিশাল দরজা, কামানের গোলার দাগ, রাজকীয় অন্দরমহল, জটিল জানলা—সব যেন অতীতের রাজকীয়তার স্মৃতি বহন করছে। গাইড বলছিলেন, “এখান থেকে রাজারা পুরো শহর নিয়ন্ত্রণ করতেন।” অনির্বাণ যখন দুর্গের প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে নিচের শহরের দিকে তাকাল, তার চোখে পড়ল অগণিত নীলচে ছাদের সমুদ্র। মনে হলো, যেন নীল রঙের ঢেউ উঠছে আর নামছে। বাতাস এসে লাগছিল মুখে, আর তার ভেতর জেগে উঠছিল এক অদ্ভুত মুক্তির অনুভূতি। ভ্রমণ মানে হয়তো এই প্রাচীর থেকে শহর দেখা—একদিকে ইতিহাস, অন্যদিকে বর্তমান, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পথিক।
দুর্গ থেকে নামার পর সে গেল জসওয়ান্ত থাডা। সাদা মার্বেলের ছায়াময় সৌধ, শান্ত লেকের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা, চারদিকে গাছগাছালি। সেখানে বসে অনির্বাণ বুঝল, ভ্রমণের মধ্যে শুধু ভিড়ভাট্টা নয়, নির্জনতাও প্রয়োজন। নীরবতার ভেতর দিয়ে শহরের আসল আলো ধরা দেয়।
দুপুরে সে গেল ক্লক টাওয়ার বাজারে। চারপাশে ভিড়, গরম রোদ, অসংখ্য দোকান—মশলা, রঙিন কাপড়, হস্তশিল্প। এক দোকানে বসে খেল বিখ্যাত মাখনিয়া লস্যি। ঘন লস্যির ওপর ভাসছিল বাদাম আর জাফরান। প্রথম চুমুকেই মনে হলো, এ শুধু পানীয় নয়, বরং শহরের আত্মার স্বাদ। পাশে বসা দোকানদার বলল, “জোধপুরে আসলে মাখনিয়া লস্যি না খেলে যাত্রা অসম্পূর্ণ।” অনির্বাণ হেসে মাথা নাড়ল। সত্যিই, ভ্রমণ মানে খাবারের মধ্য দিয়েও শহরের গল্পকে চিনে নেওয়া।
বাজারের একপাশে বসেছিল এক বৃদ্ধ বাদ্যকর, হাতে সারেঙ্গি। তার সুর যেন বাজারের কোলাহল ছেদ করে আকাশে ভেসে যাচ্ছিল। মানুষ দাঁড়িয়ে শুনছিল, কেউ টাকা ছুঁড়ে দিচ্ছিল। অনির্বাণও থেমে গেল। সুরের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত বিষণ্নতা, আবার একই সঙ্গে অদম্য টান। তার মনে হলো, নীল শহরের আসল রঙ শুধু দেওয়ালে নয়, বরং সুরের ভেতরেও বেঁচে আছে।
বিকেলে সে গেল উমেদ ভবন প্যালেসের দিকে। আজও রাজপরিবারের বসতবাড়ি, অর্ধেকটা আবার হোটেল। বিশাল প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ বুঝল, স্থাপত্য মানে কেবল পাথরের গাঁথুনি নয়, বরং মানুষের স্বপ্নের প্রতিফলন। মরুভূমির শহরে এমন প্রাসাদ দাঁড়ানো আসলে অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রয়াস। ভ্রমণ মানে সেই স্বপ্নকেও অনুভব করা।
সন্ধ্যা নামতেই সে শহরের বাইরে গেল এক গ্রামে। মরুভূমির ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখল। আকাশ তখন রঙ বদলাচ্ছিল—কমলা, লাল, তারপর বেগুনি। বালিয়াড়িতে বসে মনে হলো পৃথিবী যেন নিঃশব্দ। কেবল বাতাস আর দূরে পাখির ডাক। এক স্থানীয় ছেলে এসে বলল, “সাহেব, উটের পিঠে করে মরুভূমি দেখবেন?” অনির্বাণ হাসল, আর উটের পিঠে চেপে ধীরে ধীরে মরুভূমির ভেতরে ঢুকে গেল। চারদিকে শুধু বালি আর আকাশ। সূর্য ডুবে গেল, আর আকাশে উঠল অগণিত তারা। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো, ভ্রমণ মানে কখনো কখনো নিজের ক্ষুদ্রতাকে বুঝে নেওয়া। মরুভূমির নিঃসঙ্গতা আর আকাশের অসীমতা মিলিয়ে তাকে যেন নতুন করে চিনতে শিখিয়ে দিল।
রাতে শহরে ফিরে এসে ছাদের ওপর বসে সে ডায়েরি খুলল। লিখল—“জোধপুর মানে নীল রঙের শহর, ইতিহাসের দুর্গ, বাজারের কোলাহল, বাদ্যযন্ত্রের সুর, আর মরুভূমির নিঃশব্দতা। আজ শিখলাম, আলো কেবল চোখে দেখা যায় না, কখনো কখনো সুরে, কখনোবা নীরবতায়ও জ্বলে ওঠে। নীল শহরের নীল আলো আমার ভেতরের গভীরে নেমে গিয়ে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিল।”
ঘুমোবার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বুঝল, প্রতিটি শহর আসলে একেকটা পাঠ শেখায়। আগ্রা শিখিয়েছিল সৌন্দর্যের আড়ালে যন্ত্রণা আছে, জয়পুর শিখিয়েছিল রঙের উল্লাসের ভেতরেও ইতিহাস লুকিয়ে থাকে, আর জোধপুর শিখাল নীরবতার মধ্যেও আলো জ্বলে। পরের গন্তব্য ঠিক করল যোধপুর থেকে জয়সালমের, মরুভূমির হৃদয়।
পর্ব ৬ : জয়সালমের মরুভূমির বুকে
জোধপুর থেকে ভোরের ট্রেনে উঠে অনির্বাণ পৌঁছল জয়সালমের। মরুভূমির শহর, থর-এর বুকের ধারে দাঁড়ানো এক সোনালি নগরী। স্টেশন থেকে বেরিয়েই সে দেখল চারদিকে বালুর ধুলো উড়ছে, আর সূর্যের আলোয় পুরো শহর যেন সোনার মতো ঝলমল করছে। দূরে চোখে পড়ল সুবিশাল জয়সালমের ফোর্ট, যেন বালির ওপর ভেসে ওঠা কোনো স্বপ্নের দুর্গ। শহরের লোকেরা একে বলে “সোনার কেল্লা”—সত্যিই, বেলেপাথরের সেই দুর্গের দেয়াল দুপুরের রোদের তাপে যেন অগ্নিশিখার মতো দীপ্ত হয়ে উঠছিল। অটোতে চেপে সে পৌঁছল ফোর্টের গেটে। গলিপথ বেয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছোট ছোট দোকান, হস্তশিল্পের সামগ্রী, চামড়ার জুতো, রঙিন কাপড়, পুতুল—সব মিলিয়ে এক জাগ্রত বাজার। অথচ চারদিকে ইতিহাসের নিঃশব্দ স্পন্দনও রয়েছে, যেন প্রাচীন সৈন্যদের পায়ের শব্দ এখনো পাথরে প্রতিধ্বনিত। অনির্বাণ অনুভব করল, এ শহর বেঁচে আছে অতীত আর বর্তমানের মেলবন্ধনে।
ফোর্টের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে সে গেল রাজপ্রাসাদের দিকে। সূক্ষ্ম কারুকাজ করা জানলা, আঙিনার ফোয়ারা, দেওয়ালে আঁকা রঙিন নকশা—সব মিলিয়ে এক অনুপম দৃশ্য। গাইড বলছিলেন, “এই প্রাসাদ থেকে রাজারা শুধু শহর নয়, মরুভূমির বাণিজ্যপথও নিয়ন্ত্রণ করতেন।” অনির্বাণ ভাবছিল, মরুভূমি শুধু শূন্যতা নয়, বরং আদানপ্রদানের সেতু, সভ্যতার পথ। ভ্রমণ তাকে বারবার শিখিয়ে দিচ্ছিল—যা শূন্য মনে হয়, তার ভেতরেও জীবন আছে।
দুপুরে সে নেমে গেল পাটওয়াঁ কি হাভেলিতে। উনিশ শতকের বণিকদের তৈরি সেই বাড়িগুলোর দেওয়ালে সূক্ষ্ম কারুকাজ, বারান্দার ফাঁক দিয়ে আলো-ছায়ার খেলা, ভেতরের আঙিনায় নিঃশব্দ ইতিহাস। অনির্বাণ যখন সেই দেওয়ালের গায়ে হাত রাখল, মনে হলো অতীতের কোনো বণিক হয়তো এখনো ফিসফিস করছে, “আমাদের স্বপ্ন, আমাদের গল্পগুলোকে ভুলে যেও না।”
বিকেলে সে উটের সাফারির জন্য বেরোল। শহরের বাইরে, ধীরে ধীরে বালিয়াড়ি ছড়িয়ে পড়ছিল দিগন্ত পর্যন্ত। উটের পিঠে চেপে যখন সে মরুভূমির ভেতর এগোতে লাগল, বাতাসে উড়ছিল বালি, আকাশ ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছিল। সূর্য যখন ডুবে যাচ্ছিল, বালুর ওপর পড়া তার আলো যেন সোনালি আগুনের মতো ঝলমল করছিল। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল উটের পায়ের শব্দ আর বাতাসের সুর। অনির্বাণের মনে হলো, এ এক অনন্ত শূন্যতা, যেখানে মানুষ নিজেকে সবচেয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়।
রাত নামল মরুভূমির আকাশে। অগণিত তারা ঝলমল করছে, আকাশ যেন বালির ওপর ঝুঁকে এসে তার কানে কিছু বলছে। ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে বসে রাজস্থানি লোকেরা গান গাইছিল, ঢোলক বাজছিল, নাচছিল মহিলারা রঙিন ঘাঘরা পরে। অনির্বাণও আগুনের ধারে বসে শুনছিল। সুরের ভেতর ছিল আনন্দ, আবার কোথাও লুকিয়ে ছিল বেদনা। তার মনে হলো, মরুভূমি যেমন দিনে তপ্ত, রাতে শীতল, তেমনই মানুষের জীবনের ভেতরও আনন্দ আর বেদনা পাশাপাশি জেগে থাকে। আলো মানে হয়তো এই দুইয়ের মেলবন্ধন।
খাওয়ার পর সে ক্যাম্পে বসে ডায়েরি লিখল—“আজ মরুভূমি আমাকে শিখাল, শূন্যতা আসলে শূন্য নয়। এখানে প্রতিটি বালুকণা সময়ের গল্প বহন করে, প্রতিটি তারা মানুষের স্বপ্নের সাক্ষী। আলো কেবল শহরের রঙিন বাজারে নয়, কখনো কখনো এ নীরব মরুভূমির বুকে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে।”
ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে উটের পাশে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। বাতাসে ছিল মরুর শুষ্ক গন্ধ, তবুও সেই গন্ধের ভেতর অদ্ভুত শান্তি। তার মনে হলো, ভ্রমণের এই পর্যায়ে এসে সে নিজের ভেতরকার অস্থিরতা ধীরে ধীরে ঝেড়ে ফেলছে। মরুভূমি তাকে শেখাচ্ছে ধৈর্য, নীরবতা আর অসীমতার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পাঠ।
পরদিন সকালে সূর্যের আলোয় আবার মরুভূমি রঙ বদলাল। সোনালি আলোয় বালিয়াড়ি যেন জেগে উঠল নতুন করে। উটের পিঠে ফিরে আসতে আসতে অনির্বাণ জানত, এবার তার পথ তাকে নিয়ে যাবে অন্য দিকে—উদয়পুর, হ্রদের শহর। মরুভূমির শূন্যতা থেকে জলরাশির কাছে, আলো এবার অন্য রূপে ধরা দেবে।
পর্ব ৭ : হ্রদের শহর উদয়পুর
জয়সালমের মরুভূমির নিঃশব্দ শূন্যতা পেরিয়ে অনির্বাণ পৌঁছল উদয়পুরে, হ্রদের শহর। ট্রেন থেকে নেমেই তার মনে হলো, এ শহরের রঙ আর আবহ একেবারেই আলাদা। মরুর শুষ্কতার পর এখানে বাতাসে জলরাশির স্নিগ্ধ গন্ধ, দূরে পাহাড়ের ঢালে সাদা প্রাসাদ, আর তার পাদদেশে জলে ভেসে থাকা প্রতিচ্ছবি। অটোতে চেপে প্রথমে গেল পিচোলা লেকের ধারে। সকালের সূর্যের আলোয় লেকের জল চিকচিক করছিল, দূরে ভাসমান সাদা প্রাসাদ যেন জলের ফুলের মতো ফুটে আছে। চারপাশে নৌকো চলছে ধীরে ধীরে, আর বাতাসে ভেসে আসছে মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ। অনির্বাণ মনে করল, ভ্রমণ মানে শুধু পথ নয়, পথের পাশে দাঁড়ানো জলও গল্প বলে।
লেকের ধারে বসে তার চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ মৎস্যজীবী জাল ফেলছেন। অনির্বাণ এগিয়ে গেল কথা বলতে। বৃদ্ধ বললেন, “এই লেক আমাদের জীবনের আশ্রয়। মাছ দেয়, জল দেয়, শান্তি দেয়।” কথার ভেতরেই ছিল জীবনের সহজ সত্যি—প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কই আসল আলো।
তারপর সে গেল সিটি প্যালেসে। বিশাল রাজপ্রাসাদ, ভেতরে সোনালি ঝাড়লণ্ঠন, রঙিন কাঁচের জানলা, কারুকাজ করা বারান্দা। বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে যখন সে লেকের দিকে তাকাল, মনে হলো, এ প্রাসাদ শুধু রাজশক্তির প্রতীক নয়, বরং সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা। গাইড বলছিলেন, “মেবার রাজারা এখানে থেকে শাসন করতেন, কিন্তু এ প্রাসাদ আসলে শিল্প আর স্থাপত্যের প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রমাণ।” অনির্বাণ ভাবছিল, ভ্রমণ মানে অতীতের স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখা।
দুপুরে সে গেল সাজ্জনগড় মনসুন প্যালেসে। পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রাসাদ থেকে পুরো শহর আর লেকের সমুদ্র দেখা যায়। আকাশে তখন মেঘ জমছিল, হালকা বৃষ্টি নেমে এল। লেকের জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ছোট ছোট ঢেউ তৈরি হচ্ছিল। অনির্বাণ মনে করল, জীবনও যেন লেকের মতো—শান্ত পৃষ্ঠে হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটা নেমে আসে, আর সেই ঢেউ-ই জীবনকে নতুন রূপ দেয়।
বিকেলে সে গেল ফতেহসাগর লেকের ধারে। এখানে শহরের মানুষ বেড়াতে আসে, নৌকো ভাড়া করে, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। রাস্তার ধারে ভুট্টা ভাজার দোকান, গরম ধোঁয়া উঠছে। এক থালা ভুট্টা হাতে নিয়ে অনির্বাণ লেকের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। সূর্য তখন ডুবছিল, আকাশ রঙ বদলাচ্ছিল সোনালি থেকে লাল, তারপর বেগুনি। জলের ওপর প্রতিফলিত সেই রঙের খেলা তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিল। ভ্রমণের আসল আলো হয়তো এই সন্ধ্যাতেই ধরা পড়ে।
রাত নামতেই সে গেল বাগোর কি হাভেলিতে। সেখানে লোকনৃত্য আর পুতুলনাচের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। মহিলাদের ঘুঙুরের ঝমঝম আওয়াজ, পুরুষদের ঢোলকের তালে তালে নাচ, পুতুলের প্রাণবন্ত অভিনয়—সব মিলিয়ে এক উৎসব। অনির্বাণ অনুভব করল, ভ্রমণ মানে শুধু নিস্তব্ধতা নয়, আনন্দের উল্লাসও। আলো কখনো নিঃশব্দ লেকের প্রতিফলনে জন্ম নেয়, আবার কখনো মানুষের গানের তালে জেগে ওঠে।
লজে ফিরে এসে ডায়েরি লিখল—“উদয়পুর আমাকে শিখিয়েছে, জীবন আসলে জল আর আলোর মতো। জল যেমন আকার বদলায়, আলোও তেমন রঙ বদলায়। ভ্রমণ মানে সেই বদলকে চোখে দেখা, মনে রাখা।”
রাত গভীর হলো, লেকের ধারে বাতাস বইছিল শীতল। অনির্বাণ জানল, পরের যাত্রা তাকে নিয়ে যাবে পাহাড়ি শহরে—মাউন্ট আবু। মরুভূমি আর লেকের পর এবার পাহাড়ের বুকের আলো খুঁজে পাওয়ার পালা।
পর্ব ৮ : মাউন্ট আবুর পাহাড়ি নিস্তব্ধতা
উদয়পুর থেকে বাসে চেপে অনির্বাণ রওনা দিল মাউন্ট আবুর পথে। মরুভূমির গরম, হ্রদের স্নিগ্ধতা পেরিয়ে এবার পাহাড় ডাক দিচ্ছিল তাকে। বাস ঘুরপথ বেয়ে যত ওপরে উঠছিল, বাতাস তত শীতল হয়ে আসছিল। রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গলের সবুজ, মাঝে মাঝে বানরের দল রাস্তার ধারে বসে আছে, আকাশে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। চার ঘণ্টার যাত্রার পর বাস যখন থামল, অনির্বাণ মনে করল সে যেন অন্য জগতে এসে পড়েছে। এখানে নেই মরুর ধুলো, নেই লেকের জল, আছে পাহাড়ি বাতাসে ভেসে থাকা নীরবতা।
ছোট্ট হোটেলে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে গেল সে প্রথমেই নকী লেকের ধারে। হ্রদের চারপাশে পাহাড়, জলরাশির ওপর ভেসে চলেছে নৌকা। পর্যটকদের ভিড় আছে, তবুও কোথাও একটা শান্তির ছায়া। হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে বাতাসে ভেসে আসছিল মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। নৌকোয় বসে যখন সে লেকের মাঝখানে গেল, মনে হলো আকাশ আর জল একে অপরকে ছুঁয়ে ফেলছে। আলো যেন চারদিক থেকে এসে মিলছে সেই জলের বুকে।
তারপর সে গেল দিলওয়ারা মন্দিরে। মার্বেল পাথরে খোদাই করা সেই সূক্ষ্ম শিল্পকলা তার চোখ ঝলসে দিল। প্রতিটি স্তম্ভে, প্রতিটি ছাদে এমন সূক্ষ্ম নকশা যে মনে হচ্ছিল পাথর নয়, যেন তুলো দিয়ে গড়া। ভেতরে নিস্তব্ধতা, কেবল ভক্তদের পায়ের শব্দ। অনির্বাণ যখন মন্দিরের মূর্তির সামনে দাঁড়াল, তার মনে হলো আলো মানে কেবল সূর্যের নয়, মানুষের ভক্তির ভেতর থেকেও আলো জন্ম নেয়। শিল্প, বিশ্বাস আর সময় মিলিয়ে এখানে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা তৈরি করেছে।
দুপুরে পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল হানিমুন পয়েন্টে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাতেই দেখা গেল বিস্তীর্ণ সমতলভূমি, দূরে ঝাপসা মরুভূমির রেখা। বাতাসে ঠান্ডা হিম, পাশে অচেনা পর্যটকরা নীরবে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের প্রতীক্ষা করছে। সূর্য ধীরে ধীরে নামতে নামতে আকাশে রঙের বিস্ফোরণ ঘটাল—সোনালি, কমলা, লাল, তারপর বেগুনি। পাহাড়ি বাতাসে সেই রঙ যেন গলে গিয়ে অনির্বাণের ভেতরে ঢুকে গেল। ভ্রমণের এই মুহূর্তে সে বুঝল, প্রকৃতির রঙই মানুষের ভেতরের আঁধার মুছে দেয়।
সন্ধ্যা নামতেই বাজারের দিকে গেল। ছোট ছোট দোকান, পাহাড়ি ফল, কাঠের খেলনা, উলের পোশাক, গরম ভুট্টার গন্ধ। রাস্তার ধারে এক দোকানে গিয়ে খেল গরম রাজমা-চাওল। দোকানদার বলল, “পাহাড়ের খাবার সোজা, কিন্তু পেট ভরে যায়।” সত্যিই, সরল খাবারের মধ্যেও এক অদ্ভুত তৃপ্তি ছিল। অনির্বাণ মনে করল, ভ্রমণ মানে শুধু বিলাস নয়, সরলতাকেও উপভোগ করতে শেখা।
রাতে হোটেলের ছাদে উঠে সে আকাশের দিকে তাকাল। পাহাড়ি আকাশে তারা যেন আরও কাছে মনে হচ্ছিল। বাতাসে শীতলতা, চারদিকে নিস্তব্ধতা। ডায়েরি খুলে সে লিখল—“আজ পাহাড় আমাকে শিখিয়েছে, আলো কখনো কখনো নীরবতার ভেতরেই জন্ম নেয়। লেকের প্রতিফলনে, মন্দিরের খোদাইয়ে, পাহাড়ের রঙে—সবখানেই একেক রকম আলো। ভ্রমণ মানে সেই আলোর পথ অনুসরণ করা।”
ঘুমোবার আগে তার মনে হলো, এবার সে আরেকটি যাত্রার পথে নামবে—উত্তর ভারতের পাহাড়ের ডাক আরও স্পষ্ট হয়ে আসছে। মরুভূমি, হ্রদ, পাহাড়—সব মিলিয়ে আলো তাকে ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য লক্ষ্যর দিকে টেনে নিয়ে চলেছে।
পর্ব ৯ : ঋষিকেশের গঙ্গার স্রোত
মাউন্ট আবুর শীতল পাহাড়ি বাতাস ছেড়ে এবার অনির্বাণ রওনা দিল উত্তর ভারতের দিকে। কয়েক দফা ট্রেন বদল আর বাসযাত্রার পর সে পৌঁছল ঋষিকেশে। স্টেশন থেকে বেরিয়েই মনে হলো, এখানে বাতাসেই যেন ভিন্ন এক ধ্বনি। পাহাড় ঘেরা শহরের বুক দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা, সবুজ আর নীলের মিশ্র ধ্বনি যেন বাতাসে গান গাইছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা মন্দির, সেতুর ওপরে দুলতে থাকা লোহার ঝুলন্ত কাঠামো, চারদিকে ভেসে আসা ঘণ্টাধ্বনি আর শঙ্খের আওয়াজ—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, ঋষিকেশ এক অদ্ভুত সাধনার স্থান।
প্রথমেই সে গেল লক্ষ্যণঝুলা সেতুর দিকে। ঝুলন্ত সেতুতে দাঁড়াতেই চারপাশে তীব্র বাতাস, নিচে গঙ্গার সবুজাভ জল গর্জন করে বয়ে চলেছে। সেতুতে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ চোখ বুজে রইল। মনে হলো নদী যেন বলছে—“আমি বহমান, আমায় থামানো যায় না, জীবনও তাই।” এই স্রোতের ভেতর দাঁড়িয়েই অনির্বাণ উপলব্ধি করল, ভ্রমণ আসলে গন্তব্য নয়, এক নিরন্তর প্রবাহ।
তারপর সে গেল আশ্রমে। ভেতরে সাদা পোশাক পরা সাধু, ধ্যানমগ্ন মানুষজন, নির্জন আঙিনা। এক গাছতলায় বসে থাকা এক সাধুর সঙ্গে কথা বলল সে। সাধু হেসে বললেন, “ভ্রমণ মানে বাইরে ঘোরা নয়, ভেতরের পথ খুঁজে পাওয়া।” অনির্বাণ শুনে চুপ করে গেল। ভ্রমণের প্রতিটি ধাপে সে এখন বুঝতে পারছে, আলো কেবল বাহিরে নয়, ভেতরেও জন্ম নেয়।
দুপুরে সে গঙ্গার ধারে বসল। ভেসে আসছিল ভজনের সুর, মানুষ নদীতে স্নান করছে, ফুল ভাসাচ্ছে। হঠাৎ এক বালক তার কাছে এসে বলল, “ভাইয়া, আরতি দেখবেন?” অনির্বাণ মাথা নাড়ল। সন্ধ্যার আগে সে পৌঁছল ত্রিবেণী ঘাটে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আকাশ লালচে। চারদিকে ভিড় জমেছে। মন্দির থেকে পুরোহিতেরা প্রদীপ নিয়ে এলেন, আর মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে আলো জ্বলে উঠল। ঢোলকের তালে তালে, ভজনের সুরে, মানুষের কণ্ঠে একসঙ্গে যখন আরতি শুরু হলো, তখন গঙ্গার জলে প্রতিফলিত আলো যেন আকাশ-পাতাল ভরে তুলল। অনির্বাণের চোখে জল এসে গেল। মনে হলো, আলো মানে কেবল সূর্যের দীপ্তি নয়, মানুষের মিলিত প্রার্থনার মধ্যেও আলো আছে।
আরতির শেষে গঙ্গায় ছোট্ট প্রদীপ ভাসিয়ে দিল সে। প্রদীপটা জলের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে অদৃশ্য হলো। অনির্বাণ ভাবল, মানুষও হয়তো ঠিক এমন—অল্প আলো নিয়ে জন্মায়, তারপর স্রোতে ভেসে যায়, কিন্তু সেই আলো কিছুক্ষণের জন্য চারপাশকে উজ্জ্বল করে তোলে।
রাতে সে আশ্রমের ছাদে বসে ডায়েরি লিখল—“ঋষিকেশ আমাকে শিখিয়েছে, জীবন মানে প্রবাহ। নদীর মতো চলতে হয়, আরতির মতো জ্বলে উঠতে হয়, সাধুর মতো ভেতরের আলো খুঁজতে হয়। এখানে দাঁড়িয়ে আমি বুঝলাম, ভ্রমণ মানে নিজের ভেতরের অন্ধকার ভাঙার পথ।”
আকাশে তারা ঝলমল করছিল, গঙ্গার স্রোত নিচে বয়ে চলছিল নিরন্তর। ঘুমোবার আগে অনির্বাণ জানল, তার পরের যাত্রা তাকে নিয়ে যাবে হিমালয়ের আরও গভীরে—হরিদ্বার পেরিয়ে ঋষিকেশের পর এবার গঙ্গার উৎসের দিকে তাকিয়ে ডাকছে গঙ্গোত্রী। আলো এবার বরফের বুক থেকে জন্ম নেবে।
পর্ব ১০ : গঙ্গোত্রীর বরফে শেষ আলো
ঋষিকেশের আরতির সুর এখনো কানে বাজছে, অথচ অনির্বাণ তখন যাত্রা করছে আরও উত্তরে, গঙ্গার উৎসের দিকে। হরিদ্বার পেরিয়ে বাস এগোতে লাগল পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে। একদিকে গভীর খাদ, অন্যদিকে উঁচু পাথুরে ঢাল। জানলার বাইরে নিস্তব্ধ গ্রাম, ধোঁয়া ওঠা কুঁড়েঘর, দূরে তুষারঢাকা শৃঙ্গ—সব মিলিয়ে যেন পৃথিবী নতুন রূপ নিয়েছে। কয়েক ঘণ্টা কষ্টকর যাত্রার পর সে পৌঁছল উত্তরকাশী, আর সেখান থেকে জিপে চেপে রওনা দিল গঙ্গোত্রীর দিকে। বাতাস পাতলা, ঠান্ডা ক্রমশ তীব্র, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু বুকের ভেতর এক অদ্ভুত টান তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সামনে।
গঙ্গোত্রীর কাছে পৌঁছে প্রথমেই চোখে পড়ল দেবদারু গাছের বন, আর তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা গঙ্গার স্রোত। এখানে গঙ্গা তরুণী, যেন পাহাড়ি কিশোরী, অসংযত, বেগবান, উচ্ছল। তার সাদা ফেনায়িত জল পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে, আর চারদিকে ধ্বনিত হচ্ছে এক অদ্ভুত গর্জন। মন্দিরের সামনে দাঁড়াতেই অনির্বাণ অনুভব করল, এ কেবল ভ্রমণের এক গন্তব্য নয়, বরং তার নিজের যাত্রারও চূড়ান্ত প্রকাশ।
সে গঙ্গোত্রী মন্দিরে ঢুকল। সাদা পাথরের ছোট্ট মন্দির, ভেতরে মূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বলছে, ঘন্টা বাজছে। ভক্তরা প্রণাম করছে, ফুল দিচ্ছে, আর অনির্বাণ দাঁড়িয়ে ভাবছিল—নদীকে দেবী বলা হয় কেন? উত্তর যেন নিজেই ধরা দিল। নদী জন্ম দেয়, লালন করে, ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আবার একসময় সমুদ্রে মিলিয়ে যায়। মানুষের জীবনও তো তাই। আলো এখানে দেবীর রূপে জ্বলছে, অদৃশ্য অথচ চিরন্তন।
পরদিন সকালে সে বেরোল গঙ্গার উৎসের পথে। গঙ্গোত্রী থেকে কয়েক কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছনো যায় গোমুখে। ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে সে ধীরে ধীরে উঠতে লাগল। পথে দেখা মিলল সন্ন্যাসী, তীর্থযাত্রী, আবার কিছু বিদেশি পর্যটকও। পাহাড়ি পথে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তবুও প্রতিটি পায়ে মনে হচ্ছিল যেন ভেতরের বোঝা হালকা হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে বরফে ঢাকা শৃঙ্গ, গ্লেসিয়ারের ভাঙা টুকরো, আর নীল আকাশ। পথের ধারে এক বৃদ্ধ সাধু বসেছিলেন, অনির্বাণকে দেখে বললেন, “উৎসের দিকে গেলে মানুষ নিজের উৎসকেও চিনে ফেলে।” কথাটা যেন তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলল।
ঘণ্টাখানেক কষ্টকর হাঁটার পর অবশেষে সে পৌঁছল গোমুখে। বিশাল গ্লেসিয়ারের মুখ থেকে গলে বেরোচ্ছে সাদা জল, সেটাই গঙ্গার জন্ম। অনির্বাণ পাথরের ওপর বসে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। মনে হলো পৃথিবীর বুক থেকে আলো ফেটে বেরোচ্ছে। তার চোখ ভিজে এল—এই তো সেই আলো, যার খোঁজে সে মাসখানেক ধরে পথে পথে ঘুরছে। শহরের কোলাহল, মরুভূমির নিঃশব্দতা, লেকের প্রতিফলন, পাহাড়ের সূর্যাস্ত—সব মিলিয়ে শেষমেশ আলো এসে ধরা দিল এই বরফের বুকে।
সে ব্যাকপ্যাক থেকে ডায়েরি বের করে শেষ পাতা খুলল। লিখল—“আমি খুঁজতে বেরিয়েছিলাম আলো। ভেবেছিলাম কোনো শহরে, কোনো স্থাপত্যে, কোনো মানুষের চোখে খুঁজে পাব। কিন্তু আজ বুঝলাম, আলো আসলে বহির্জগতের জিনিস নয়। আলো জন্ম নেয় ভেতরে, যখন মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়, যখন সে নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে। গোমুখে দাঁড়িয়ে আমি সেই আলোর স্বাদ পেলাম।”
কিছুক্ষণ সে চোখ বুজে রইল। বাতাসে বরফের গন্ধ, চারদিকে অশেষ নীরবতা, কেবল গঙ্গার জন্মের গর্জন। মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল এখানে এসে থেমে গেছে। আলো যেন তার ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ফিরতি পথে হাঁটতে হাঁটতে অনির্বাণ বুঝল, এ ভ্রমণ শেষ নয়। আলো খোঁজার যাত্রা তো আসলে অন্তহীন। শহর বদলাবে, দৃশ্য বদলাবে, কিন্তু আলো খোঁজা চলতেই থাকবে। সে নিজেকে প্রতিজ্ঞা করল, জীবন যতদিন আছে, ততদিন এই যাত্রাও চলবে।
রাতে গঙ্গোত্রীর আকাশে অগণিত তারা জ্বলছিল। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কম্বলের নিচে শুয়ে সে শেষবারের মতো ডায়েরি খুলল। শেষ লাইন লিখল—“আলো কোনো গন্তব্য নয়, আলো হলো পথের ভেতরকার উপলব্ধি। আমি পথিক, আর আলো আমার চিরসঙ্গী।”
তারপর নিস্তব্ধ পাহাড়ি রাতে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল অনির্বাণ। বাইরে গঙ্গা তার নিরন্তর স্রোত নিয়ে বয়ে চলল, আর আকাশে আলো ঝলমল করে উঠল—অমর, অচল, চিরন্তন।




