Bangla - সামাজিক গল্প

পড়শির কাহিনি

Spread the love

অনির্বাণ সেন


পর্ব

কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে এক বিশাল আবাসন—গ্লাসের বারান্দা, রঙিন আলো, লিফটে ওঠানামার শব্দে ভরা। সেখানকার অষ্টম তলার ফ্ল্যাটে থাকে দত্ত পরিবার। সুদীপ্ত দত্ত একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ অফিসার, মাসের শেষে তার অ্যাকাউন্টে যে বেতন জমে, তাতে অনায়াসেই চলে যায় তাদের তিন সদস্যের সংসার। তার স্ত্রী মৌসুমি, একসময় কলেজে ইংরেজি পড়াতেন, কিন্তু এখন ঘরের দেখাশোনাই তার প্রধান কাজ। মেয়ে ঐশী—নবম শ্রেণির ছাত্রী, পড়াশোনায় মেধাবী, আঁকতে ভালোবাসে, আর মাঝে মাঝে পিয়ানো বাজাতে শিখছে।

ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে তাকালে দূরে দেখা যায় আকাশচুম্বী সব টাওয়ার, আর একটু নিচে তাকালেই উল্টো দৃশ্য। ঝুপড়ি ঘরগুলোর ছাউনিতে টিন, কোথাও পলিথিন, কোথাও বা ভাঙা বাঁশ দিয়ে খাড়া করা দেওয়াল। সেখানেই রয়েছে এক গুচ্ছ পরিবার, তাদের দিন কাটে দিনমজুরি, ঝি-ঝামেলার কাজ, রিকশা টানা বা ছোটখাটো দোকান চালিয়ে। সেই বস্তির এক কোণে থাকে রফিকের পরিবার। রফিক দিনমজুর, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্মাণকাজে শ্রম দেয়। তার স্ত্রী হাসিনা বিভিন্ন ফ্ল্যাটে গিয়ে বাসন মাজার কাজ করে। ছেলে সাহিলের বয়স এগারো, পড়াশোনা করে কাছের সরকারি স্কুলে, কিন্তু তার চোখে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। ছেঁড়া বলটাকে নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে মাঠে নেমে যায়, আর সেখানে তার প্রাণ খুলে যায়।

দত্ত পরিবার আর রফিকের পরিবার—দুই জগতের মধ্যে যেন অস্পষ্ট একটা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। একজনের কাছে বিলাসিতা নিত্যদিনের অভ্যাস, আরেকজনের কাছে দুবেলা ভাত জোটানোই যুদ্ধ। অথচ একটাই রাস্তা দিয়ে দু’পাশের মানুষ যাতায়াত করে, একই আকাশের নিচে বাস করে।

মৌসুমি জানালা দিয়ে প্রায়ই ওদিকটা দেখত। ঝাঁপসা আলোয় বাচ্চারা কাদায় খেলছে, মহিলারা টিউবওয়েলের লাইনে দাঁড়িয়ে জল তুলছে, আর রফিকের মতো পুরুষেরা সন্ধ্যায় কাজ ফেলে বাড়ি ফিরছে। কখনো কখনো তার মনে হতো—আমাদের সঙ্গে এদের আসলে পার্থক্যটা কোথায়? শুধু টাকার অঙ্ক? তবু ফ্ল্যাটের সভ্য সমাজে এ নিয়ে কেউই তেমন কথা বলতে চাইত না। বরং পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস ঘোষ প্রায়ই বলতেন,
“এই বস্তিটাই আমাদের সর্বনাশ। চুরি-চোট্টাই এদের রক্তে। সুযোগ পেলেই গেট ভেঙে ঢুকে পড়বে।”
সেই কথাগুলো শুনে মৌসুমির ভেতরে একটা অস্বস্তি হতো, কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস হয়নি কখনো।

ঐশীর স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই সাহিলের সঙ্গে দেখা হতো। সে ভাঙাচোরা বল হাতে নিয়ে দৌড়োচ্ছিল। ঐশী মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে একঝলক দেখত। সাহিলের খেলার ভঙ্গিতে একরকম উচ্ছ্বাস থাকত—যেন জীবনযুদ্ধের সব ক্লান্তি মুছে দিয়ে কেবল মাঠে গোল দেওয়াই তার সত্য। কিন্তু দুজনের মধ্যে কখনো কথা হয়নি। একদিকে অভিজাত স্কুলড্রেস, অন্যদিকে পুরনো ছেঁড়া শার্ট। অদৃশ্য একটা প্রাচীর যেন দাঁড়িয়ে থাকত।

কিন্তু একদিন হঠাৎ পরিস্থিতি বদলে গেল।

সেই দিনটা ছিল শনিবার। সুদীপ্ত অফিসে গেল না, ঘরে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছিল। মৌসুমি বাজার করতে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ ঐশী বুক চেপে ধরল। শ্বাসকষ্ট, গা ঘামা—সব মিলিয়ে মুহূর্তে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মৌসুমি চিৎকার করে ডাকল সুদীপ্তকে। দ্রুত গাড়ি ডেকে ঐশীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার জানালেন, বুকে সংক্রমণ ও শ্বাসনালীতে জটিলতা হয়েছে, এখনই ভর্তি করতে হবে।

সবকিছু এত তাড়াহুড়োর মধ্যে ঘটছিল যে, মৌসুমি ঘাবড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের কাগজপত্র, ওষুধের প্রেসক্রিপশন, টাকার ব্যবস্থা—সব একসঙ্গে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই সময় হাসিনা হাজির হলো। সে কাজ থেকে ফেরার পথে মৌসুমির চিৎকার শুনে ছুটে আসে।
“আপনি চিন্তা কইরেন না দিদি, আমি আছি। এই হাসপাতালে আমার আত্মীয় কাজ করে। আমি ফোন করি।”
কথা না বাড়িয়ে হাসিনা ফোন করে পরিচিত ওয়ার্ডবয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করল। দ্রুত বেডের ব্যবস্থা হলো। মৌসুমি এক মুহূর্তে অবাক হয়ে গেল—যে মানুষকে সে এতদিন কেবল দূর থেকে দেখেছে, আজ সেই-ই তার সবচেয়ে বড় ভরসা।

ঐশীকে যখন অক্সিজেন দিয়ে শুইয়ে রাখা হলো, মৌসুমির চোখে জল চলে এল। সে হাসিনার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল,
“তোকে আমি কখনো চিনতাম না হাসিনা। আজ তুই না থাকলে আমি জানি না কী করতাম।”
হাসিনা শুধু হেসে বলল, “আমরাও মানুষ দিদি। বিপদে মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়।”

সেই রাতে মৌসুমি এক নতুন উপলব্ধি নিয়ে বাড়ি ফিরল। কিন্তু সে জানত না—এটাই কেবল শুরু। ভাগ্য দুই পরিবারকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে যাচ্ছে, যেখানে ভুল বোঝাবুঝি, শ্রেণিবিভেদ আর মানবিকতার লড়াই মিলেমিশে যাবে।

পর্ব

ঐশী হাসপাতালের সাদা চাদরে ঢাকা বেডে শুয়ে আছে। গায়ে স্যালাইন, নাকে অক্সিজেনের নল। মাঝেমাঝেই কাশি চেপে আসে। মৌসুমি আর সুদীপ্ত দু’জনেই নার্সের আসা-যাওয়ার দিকে চোখ রাখছে, যেন ছোট্ট একটু ভুলও না ঘটে। একসময় ডাক্তার এসে বললেন—
“চিন্তার কিছু নেই। সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তবে ক’দিন হাসপাতালেই থাকতে হবে।”

ডাক্তারের আশ্বাসে খানিকটা স্বস্তি পেল মৌসুমি, কিন্তু ওষুধ, টেস্ট, আর হাসপাতালে থাকার খরচের হিসাব দেখে সুদীপ্তর কপালে ভাঁজ পড়ল। তার বেতন যথেষ্ট, কিন্তু হঠাৎ এতখানি খরচ বের করা সহজ নয়। মৌসুমি বুঝতে পারছিল, স্বামী চেপে যাচ্ছে কথা, তবু চোখে সেই দুশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট।

ঠিক তখনই হাসিনা এসে হাজির হলো। হাতে প্লাস্টিক ব্যাগ ভর্তি ফল আর কয়েক বোতল জল।
“দিদি, আমি একটু বাজার থেকে এনেছি। ঐশির কাজে লাগবে।”
মৌসুমি অবাক হয়ে তাকাল। “তুই আবার এত ঝামেলা করছিস কেন? তোর নিজের সংসার—”
“ওসব ভাববেন না। আপনারা তো আমায় অনেক বছর ধরে চেনেন। আপনার মেয়ে মানে আমারও মেয়ে।”

হাসিনার চোখের সরলতা মৌসুমিকে নীরব করে দিল। অভিজাত আবাসনের সভ্য সমাজে এই খোলামেলা মন পাওয়া যায় কোথায়? সেখানে সবাই একে অপরকে দূরত্বে রাখে। আর এখানে, এক বস্তির গৃহকর্মী নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসছে।

পরদিন বিকেলে সাহিলও এলো মাকে নিয়ে। ছোট্ট হাতে ঐশীর জন্য একটা চকোলেট। সে কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলল—
“দিদি, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। খেলায় আসবেন।”
ঐশীর ফ্যাকাশে মুখে এক ঝলক হাসি ফুটে উঠল। প্রথমবার তাদের মধ্যে সরাসরি কথা হলো। মৌসুমির বুকটা ভরে গেল, অথচ তার চারপাশে শোনা সেই চিরচেনা কণ্ঠস্বর বাজল—
“বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে দিলে কিন্তু খারাপ প্রভাব পড়ে।”
এ ছিল পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস ঘোষের কথা, যিনি হাসপাতালেও এসেছিলেন খোঁজ নিতে। মৌসুমি চুপ করে গেল। প্রতিবাদ করার মতো সাহস হয়নি, তবে ভেতরে কোথাও একটা তীব্র অসন্তোষ জমে রইল।

দিন কেটে যেতে লাগল। ঐশীর শারীরিক অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হলো। হাসিনা প্রায় প্রতিদিনই এসে কিছু না কিছু সাহায্য করত—ওষুধ আনা, ফার্মাসির লাইনে দাঁড়ানো, নার্সদের সঙ্গে কথা বলা। সুদীপ্ত প্রথমে দ্বিধায় ভুগছিল, পরে তিনিও মেনে নিলেন।
একদিন তিনি হাসিনাকে আলাদা ডেকে বললেন—
“তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাব কীভাবে ভেবে পাচ্ছি না। হয়তো অনেকেই ভুল বোঝে তোমাদের মতো মানুষকে।”
হাসিনা শান্ত গলায় উত্তর দিল, “আমাদের কপালটাই দোষ, বাবু। গরিব বলেই মানুষ ছোট করে দেখে। কিন্তু আমরা তো মানুষই।”

অন্যদিকে বস্তির জীবনও থেমে নেই। রফিক প্রতিদিন ভোরে বেরোয়, রাতে হাড়ভাঙা খাটুনির পর ফেরে। সাহিল স্কুলে যায়, কিন্তু তার চোখে মাঠের নেশা। খেলার সঙ্গীদের নিয়ে সে প্রায়ই ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে, কারণ সবারই স্বপ্ন বড়, অথচ সামর্থ্য ছোট।
এক সন্ধ্যায় সাহিল মাকে বলল,
“আম্মি, আমার নতুন বুট জুতো দরকার। এই ছেঁড়া জুতোতে খেলতে লজ্জা লাগে।”
হাসিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “বাবা, এখন তো টাকাপয়সা হাতে নাই। তোর আব্বু যা কামাই করে, তাতে সংসারই চলতে কষ্ট।”
সাহিল মুখ ভার করে চুপ করে গেল।

পরিস্থিতি খারাপ হলো যখন রফিক হঠাৎ একদিন কাজে চোট পেল। নির্মাণসাইটে ইট পড়েছিল তার কাঁধে। ব্যথায় কাবু হয়ে সে শুয়ে পড়ল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না, কারণ ওদের হাতে টাকা নেই।
এ খবর শুনে মৌসুমি একদিন সন্ধ্যায় বস্তিতে গিয়ে হাজির হলো।
“হাসিনা, তুমি তো ঐশীর জন্য এত করেছো। এখন আমার পালা। রফিককে হাসপাতালে নিয়ে চলো।”
হাসিনা অবাক হয়ে তাকাল। এতদিন যাদের ফ্ল্যাটে সে বাসন মেজেছে, আজ তারাই তাদের বিপদে হাত বাড়াচ্ছে।

মৌসুমি নিজে গাড়ি এনে রফিককে হাসপাতালে ভর্তি করাল। চিকিৎসকের কাছে টাকা জমা দিল। সেই মুহূর্তে দুই পরিবারের মধ্যে অদ্ভুত এক সেতুবন্ধন তৈরি হলো।

কিন্তু সমাজ কি সহজে মেনে নেয়?
আবাসনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে খবর ছড়িয়ে পড়ল—
“দত্তবাবুরা নাকি বস্তির লোকদের গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। ওদের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা ভালো নয়।”
কমেন্টের ঝড় উঠল। সুদীপ্ত কড়া গলায় লিখলেন—
“মানুষ বিপদে আছে, সাহায্য করাই কি অপরাধ?”
কেউ উত্তর দিল না, তবে চাপা গুঞ্জন থামল না।

এদিকে ঐশী হাসপাতাল থেকে ফেরার পর জানল, সাহিলের বাবা আহত হয়ে শুয়ে আছে। সে মাকে বলল,
“আমি কি সাহিলের সঙ্গে দেখা করতে পারি? ও তো আমার জন্য এত চিন্তা করেছে।”
মৌসুমি প্রথমে দোটানায় পড়ল, তারপর বলল,
“যাবে। তবে কাউকে জানানো চলবে না। আমাদের চারপাশের মানুষরা এসব বোঝে না।”

এভাবেই এক নতুন গল্পের শুরু। দুই পরিবারের জীবন জড়িয়ে গেল এক অদৃশ্য সূতোয়। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি আর সমাজের দৃষ্টির কারণে এই সূতো কি টিকে থাকবে, নাকি ছিঁড়ে যাবে—তা সময়ই বলে দেবে।

পর্ব

ঐশী হাসপাতাল থেকে ফিরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিল। স্কুলে যাওয়া কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, বারান্দায় বসে আঁকতে ভালোবাসত সে। রঙিন পেন্সিলে ফুল, পাখি, কখনো বা সূর্যাস্তের ছবি আঁকত। কিন্তু একদিন হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেল ফ্ল্যাটের সামনের মাঠের দিকে। সেখানেই দেখল সাহিল ছেঁড়া বলটাকে নিয়ে খেলছে। মাটি ধুলোয় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে শরীর, তবু তার চোখে অদম্য এক দীপ্তি।

ঐশীর মনে হলো—কী আশ্চর্য! ওর জীবন কত কঠিন, তবু খেলার মাঠে দাঁড়ালেই হাসিখুশি হয়ে ওঠে। হয়তো এটাই সত্যিকারের আনন্দ। সে হঠাৎ ইচ্ছে করল সাহিলের ছবি আঁকবে। কাগজে আঁকতে গিয়ে বুঝল, ওর চোখের ভেতরে একটা স্বপ্ন আছে—যেন বড় হয়ে সত্যিই কিছু করতে পারবে।

কয়েকদিন পরে মৌসুমি সাহস করে ঐশীকে নিয়ে বস্তিতে গেল। হাসিনার ঘরে গিয়ে বসতেই হাসিনা চমকে উঠল—
“আরে দিদি! আপনি নিজে এসেছেন?”
ঐশী লাজুক গলায় বলল, “আমি সাহিলকে দেখতে এসেছি।”

সেই দিন প্রথমবার ঐশী ও সাহিল খোলাখুলি কথা বলল। সাহিল দেখাল তার পুরনো ট্রফি—স্কুলের আন্তঃশ্রেণি ফুটবল ম্যাচে সে গোল দিয়ে জয় এনেছিল। ঐশী অবাক হয়ে তাকাল।
“তুই তো দারুণ খেলিস! তোর কোচ আছে?”
“না দিদি। মাঠে যারা বড় ভাই খেলে, ওদের দেখে শিখি।”
ঐশী চুপ করে গেল। মনে মনে ঠিক করল—যেভাবেই হোক সাহিলকে সাহায্য করবে।

কিন্তু এ সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। আবাসনের কয়েকজন মহিলা দেখে ফেলল ঐশীকে বস্তিতে ঢুকতে। সেদিনই লিফটে ওঠার সময় মিসেস ঘোষ কটাক্ষ করে বললেন—
“এই বয়সেই ওখানে ঘোরাঘুরি করছে! কালকে আবার ওরা এসে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়বে।”
মৌসুমির মুখ শক্ত হয়ে গেল। তিনি আর কিছু বললেন না, কিন্তু রাতে সুদীপ্তর কাছে সব খুলে বললেন।
সুদীপ্ত গভীরভাবে শুনে বলল,
“শোনো, আমরা কারও কথায় কান দেব না। ওরা যা করছে, তাতে কোনো অপরাধ নেই। আমি বরং ভাবছি সাহিলকে একটা ফুটবল কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিই।”
মৌসুমি অবাক হয়ে গেল। স্বামীকে এতটা উদার ভঙ্গিতে আগে দেখেনি।

পরের সপ্তাহেই সুদীপ্ত অফিস থেকে ফেরার পথে এক কোচিং সেন্টারের সঙ্গে কথা বলে এল। কিন্তু ফি-এর পরিমাণ শুনে চমকে উঠল। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা প্রায় অসম্ভব। তবু সে ঠিক করল—অন্তত কয়েক মাসের জন্য সাহিলকে ভর্তি করাবে।

এক সন্ধ্যায় সে রফিক ও হাসিনাকে ফ্ল্যাটে ডেকে বলল,
“আপনাদের ছেলেটা সত্যিই প্রতিভাবান। আমি চাই ওর খেলা যেন থেমে না যায়। আমি কোচিংয়ের ব্যবস্থা করতে চাই।”
রফিক প্রথমে কিছুতেই রাজি হলো না।
“না বাবু, এটা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমরা গরিব বটে, কিন্তু দান চাই না।”
মৌসুমি শান্তভাবে বললেন,
“এটা দান নয়, রফিক। এটা শুধু একটা সুযোগ। যেটা হয়তো তোমরা দিতে পারছ না, আমরা দেব। কাল যদি সাহিল ভালো জায়গায় পৌঁছায়, সেটা তোমাদের গর্বও হবে।”

হাসিনার চোখে জল এসে গেল। সে স্বামীর দিকে তাকাল, তারপর মাথা নত করে সম্মতি দিল।

এই খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। আবাসনের গ্রুপে আবার সমালোচনার ঝড় উঠল। কেউ লিখল—
“আমাদের সমাজের মানহানি করছে দত্ত পরিবার। বস্তির ছেলেকে কোচিংয়ে পাঠানো মানে তো মাথায় তুলে নেওয়া।”
কেউবা আবার কটাক্ষ করল—
“এইসব গরিবদের ভরসা করলে একদিন না একদিন বিপদ হবেই।”

সুদীপ্ত দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলেন না। শুধু মুঠো শক্ত করে বললেন,
“সময়ই উত্তর দেবে।”

এদিকে সাহিল কোচিং শুরু করল। প্রথম দিনেই কোচ তাকে দেখে বললেন,
“তুই তো প্রাকৃতিক খেলোয়াড়! যদি মনোযোগ দিয়ে খেলিস, অনেক দূর যাবি।”
সাহিলের বুকটা আনন্দে ভরে গেল। ঐশী দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। সে ভাবল, হয়তো জীবন এভাবেই বদলায়—একটা ছোট্ট সুযোগ হাজার দরজা খুলে দিতে পারে।

কিন্তু সমাজের চোখে এসব এত সহজ নয়। আবাসনের কয়েকজন বাবা-মা অভিযোগ করল—
“আমাদের সন্তানদের সঙ্গে ওই ছেলেটা খেলবে না। ওর ব্যাকগ্রাউন্ড খারাপ।”
কোচ দ্বিধায় পড়লেন। তিনি জানতেন সাহিল প্রতিভাবান, কিন্তু অভিভাবকদের চাপও এড়ানো মুশকিল।

এই টানাপোড়েনের মাঝেই একদিন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আবাসনের কার-পার্কিং থেকে হঠাৎ কয়েকটা জিনিস হারাল। সঙ্গে সঙ্গে আঙুল উঠল বস্তির দিকে।
“চুরিটা ওরাই করেছে।”
“ওই ছেলেটা তো প্রায়ই এখানে আসে।”

অভিযোগ সরাসরি গিয়ে পড়ল সাহিলের ওপর।

পর্ব

চুরির অভিযোগে আবাসনের পরিবেশ একেবারে উত্তাল হয়ে উঠল। একসঙ্গে এত গাড়ির যন্ত্রাংশ, কয়েকটা দামি সাইকেল, আর কিছু ছোটখাটো ইলেকট্রনিক্স হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। সবার চোখ ঘুরে গেল বস্তির দিকে। যেন ওরা জন্মগত অপরাধী, শুধু সুযোগ পেলেই হাত বাড়ায়।

সেই রাতেই আবাসনের কমিটির জরুরি মিটিং ডাকা হলো। গেটের নিরাপত্তারক্ষীকে ডেকে প্রশ্ন করা হলো—কাউকে সন্দেহজনকভাবে ঢুকতে দেখেছ কি না। গার্ড কাঁপা গলায় বলল—
“আমি তো কিছু দেখিনি। তবে ওই ছোট ছেলেটা, সাহিল, ওকে প্রায়ই এখানে খেলতে দেখি।”

একটিই বাক্য যথেষ্ট ছিল। উপস্থিতরা গর্জে উঠল—
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ও ছাড়া আর কে করবে!”
“ওকে এতদিন মাথায় তুলে রাখছিল দত্তবাবুরা, এখন ফল বেরোচ্ছে।”
“এমনিতে গরিবি, হঠাৎ চকচক করবে না?”

মৌসুমি ও সুদীপ্ত সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মৌসুমি রাগে ফেটে পড়লেন—
“আপনারা প্রমাণ ছাড়াই একজন বাচ্চাকে অপরাধী বানাচ্ছেন? এটা অন্যায়।”
কেউ শুনল না। বরং মিসেস ঘোষ কটাক্ষ করলেন—
“আপনি তো ওদের পক্ষে বলবেই। যতই হোক, আপনার মেয়ে তো ওর সঙ্গে মিশছে।”

মৌসুমির মুখ লাল হয়ে উঠল। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সুদীপ্ত হাত চেপে ধরল। সে শান্ত গলায় বলল—
“আমি নিশ্চিত, সাহিল এর সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু প্রমাণের জন্য আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নেব।”

এমন সময়ে ফুটেজ বের করা হলো। ক্যামেরায় ঝাপসা আলোয় দেখা গেল তিনজন যুবক রাতের অন্ধকারে ঢুকছে, তাদের মুখ ঢেকে রাখা। সাহিলের কোনো ছায়াও নেই সেখানে। কিন্তু তবুও অনেকে যুক্তি দিল—
“ওরা নিশ্চয়ই বস্তিরই লোক। সাহিল পথ দেখিয়েছে।”

এই অন্যায়ের বোঝা যেন পুরো বস্তির ওপর চাপানো হলো। পরদিন সকালেই রফিককে ডেকে পাঠানো হলো। গেটে দাঁড়িয়ে কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরে গলা তুলল—
“তোমার ছেলের ওপর নজর রাখো। না হলে পুলিশের হাতে তুলে দেব।”
রফিক অপমান সহ্য করতে না পেরে গলা উঁচু করল—
“আমার ছেলে চোর নয়! আমরা গরিব ঠিকই, কিন্তু চুরি করি না।”

ভিড় আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল। মৌসুমি দ্রুত নেমে এসে রফিককে রক্ষা করলেন। তিনি সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—
“একটু লজ্জা করেন! মানুষকে গরিব বলে অপমান করছেন? ফুটেজে তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সাহিল নেই।”
কিছুক্ষণ গুঞ্জন চলল, তারপর লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। কিন্তু দৃষ্টির তিরস্কার রয়ে গেল—যেন সমাজ তাকে আর তার পরিবারকেই আলাদা চোখে দেখছে।

ঐশী সেদিন ভীষণ কাঁদল। সে সাহিলকে ফোন করল (মৌসুমি গোপনে একটা পুরোনো ফোন দিয়েছিল হাসিনাকে)।
“আমি জানি তুই কিছু করিসনি। আমি তোর পাশে আছি।”
সাহিলের গলা কেঁপে উঠল, “সবাই আমায় চোর ভাবে দিদি। আমি মাঠে খেলতে গেলেও হাসাহাসি করে। আমার মনে হয় পড়াশোনা-খেলাধুলা সব ছেড়ে দিই।”
ঐশী দৃঢ় গলায় বলল, “না। তুই কিছু ছাড়বি না। আমি দেখব।”

পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ঐশী ব্যাগ থেকে একটা নতুন ফুটবল বের করে সাহিলকে দিল।
“এটা তোর জন্য। খেলবি, জিতবি।”
সাহিল চোখ বড় বড় করে তাকাল। “এটা তুই দিলি?”
“হ্যাঁ। এটা আমার বার্থডে গিফট ছিল। কিন্তু আমি চাই, এটা তুই ব্যবহার কর।”
সাহিল কিছু বলতে পারল না। তার চোখে জল ভরে উঠল।

এদিকে আবাসনের পরিবেশ আরও খারাপ হতে লাগল। দত্ত পরিবারকে আঙুল তুলে বলা হলো—
“ওরা গরিবদের মাথায় তুলছে, তার ফল আমাদের সবাইকে ভুগতে হচ্ছে।”
সুদীপ্ত একদিন রাতে মৌসুমিকে বলল,
“আমি ভয় পাচ্ছি। আমাদের চারপাশের মানুষগুলো হয়তো একদিন আমাদেরকেই সমাজচ্যুত করে দেবে।”
মৌসুমি শান্ত স্বরে বলল,
“যদি মানবিকতার জন্য সমাজচ্যুত হতে হয়, তবে সেটা মেনে নেব।”

কিন্তু ঘটনাটা এখানেই থামল না। এক সপ্তাহ পরে হঠাৎই খবর এলো—বস্তির ভেতরে আগুন লেগেছে। টিনের ছাউনি, বাঁশের দেওয়াল মুহূর্তে ছাই হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে হাহাকার, দমকলের গাড়ি পৌঁছানোর আগেই অর্ধেক ঘর ভস্মীভূত হয়ে গেছে।

ঐশী বারান্দা থেকে সব দেখছিল। তার বুক কেঁপে উঠল—
“মা! সাহিলের ঘরটা তো ওদিকেই!”
মৌসুমি ছুটে এল, সুদীপ্তও দৌড়ে নামল। শ্বাসরুদ্ধকর ধোঁয়ার মধ্যে তারা খুঁজতে লাগল হাসিনাকে। অবশেষে দেখা গেল, হাসিনা ভিজে কাপড়ে ছেলেকে বাঁচিয়ে বাইরে এনেছে। কিন্তু রফিক ভেতরে আটকা পড়েছে।

মুহূর্তে এক সিদ্ধান্ত নিতে হলো। ভিড়ের কেউ এগোতে চাইছিল না। ঠিক তখনই সুদীপ্ত নিজের কোট খুলে মাথায় চাপিয়ে দৌড়ে ঢুকে গেল আগুনের ভেতর।

পর্ব

আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁয়ে উঠছিল। ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার, শ্বাস নেওয়াই দায়। লোকজন চিৎকার করছে—“পানি আনো! দমকল ডাকো!”—কিন্তু কেউ ভেতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছিল না।

সেই সময় সুদীপ্ত দৌড়ে ঢুকে গেল অগ্নিগর্ভ ঘরের ভেতর। মৌসুমি চিৎকার করে উঠল, “সুদীপ্ত! ফিরে এসো!”—কিন্তু ততক্ষণে সে ধোঁয়ার আস্তরণে মিলিয়ে গেছে।

ভেতরে প্রবল উত্তাপে চোখ জ্বলছিল। দেয়াল ভেঙে পড়ার শব্দে আতঙ্ক বেড়ে যাচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। তবু সুদীপ্ত খুঁজে বের করল রফিককে—সে অচেতন হয়ে পড়ে আছে এক কোণে, মাথায় আঘাত। গলা জড়িয়ে ধরে সুদীপ্ত হাঁক দিল, “হাল ছেড়ো না! আমি নিয়ে যাচ্ছি তোকে।”

পুড়ে যাওয়া বাঁশ ভেঙে গায়ের ওপর পড়ছিল, কিন্তু সুদীপ্ত ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে গেল। অবশেষে যখন বাইরে এল, তখন উপস্থিত ভিড় হুহু করে চিৎকার করে উঠল—“বাঁচিয়েছে! বাঁচিয়েছে!”

রফিককে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার জানালেন, প্রাণে বেঁচে গেছে, তবে কয়েকদিন নজরে রাখতে হবে। সুদীপ্তর হাতে ও কপালে দগদগে দাগ পড়ে গেল। মৌসুমি চোখের জল মুছে তার মাথায় হাত রাখল—
“তুমি জানো না, আজ তুমি শুধু একজন মানুষকে নয়, আমাদের সমাজকেও বাঁচালে।”

এই ঘটনার পরেই আবাসনের অনেকের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। যারা এতদিন বস্তির লোকজনকে অপমান করত, তারাও থমকে গেল। কিন্তু অন্তরে অন্তরে একটা গুঞ্জন রয়ে গেল—“ওদের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা ভালো ফল দেবে তো?”

এদিকে ঐশী হাসপাতালে গিয়ে সাহিলকে জড়িয়ে ধরল।
“তোর আব্বুকে আমার বাবাই বাঁচিয়েছে। এবার তুই প্রমাণ করে দে, তুইও কিছু করতে পারিস।”
সাহিল মৃদু হাসল। তার চোখে একরাশ দৃঢ়তা—“হ্যাঁ দিদি, আমি খেলব। যেভাবেই হোক।”

দিন গড়াতে লাগল। রফিক সুস্থ হয়ে উঠল, কিন্তু কাজের সামর্থ্য আগের মতো রইল না। ভারী বোঝা তোলার শক্তি তার আর নেই। সংসারের ভার প্রায় পুরোপুরি চলে গেল হাসিনার কাঁধে। সেইসময় মৌসুমি এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি চাইলে আমি তোমাকে কিছু বাড়তি কাজ জোগাড় করে দিতে পারি।”
হাসিনা অবাক হয়ে তাকাল। “আপনারা তো অনেক করেছেন দিদি। আর কেমন সাহায্য নেব?”
মৌসুমি মৃদু হেসে উত্তর দিল, “এটা সাহায্য নয়, ভাগ করে নেওয়া।”

ঐশী ও সাহিলের বন্ধুত্বও দিনকে দিন গভীর হতে লাগল। ঐশী সাহিলকে পড়াশোনায় সাহায্য করত—ইংরেজির ব্যাকরণ শেখাত, গণিতের অঙ্ক কষতে বসত। সাহিল তার খেলার গল্প শোনাত, মাঠে নতুন নতুন ট্রিকস দেখাত। তাদের মধ্যে সম্পর্কটা এমন জায়গায় পৌঁছল, যেখানে কোনো শ্রেণিবিভেদ ছিল না—শুধু ছিল সমানভাবে স্বপ্ন ভাগাভাগি করা।

কিন্তু বাইরের সমাজ কি এত সহজে বদলায়? আবাসনের কয়েকজন আবার কানাঘুষো শুরু করল। একদিন মৌসুমিকে সরাসরি বলে দিল মিসেস ঘোষ—
“আপনার মেয়ে যদি ওই ছেলেটার সঙ্গে এভাবে মিশতে থাকে, ভবিষ্যতে বড় বিপদ হবে। পড়াশোনা সব নষ্ট হয়ে যাবে।”
মৌসুমি এবার চুপ করে থাকলেন না। তিনি সোজাসুজি জবাব দিলেন—
“আমার মেয়ে কাকে বন্ধু করবে, সেটা আমার পরিবারের ব্যাপার। সমাজ যদি বন্ধুত্বকে অপরাধ ভাবে, তবে সেই সমাজকেই পাল্টাতে হবে।”

এই উত্তরে অনেকেই স্তম্ভিত হলো। তবে প্রতিরোধের সুর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

অন্যদিকে, সাহিলের ফুটবল কোচিংয়ে প্রতিভার ছাপ স্পষ্ট হতে শুরু করল। স্থানীয় এক টুর্নামেন্টে সে দারুণ খেলল, টানা তিনটি গোল দিয়ে দলকে জেতাল। খেলার মাঠে তাকে ঘিরে হাততালি উঠল। ঐশী মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসে চিৎকার করছিল—
“সাহিল! তুই পারবি!”

কোচ ম্যাচ শেষে এসে বললেন,
“এই ছেলেটা যদি নিয়মিত খেলার সুযোগ পায়, একদিন বড় দলের হয়ে খেলবেই।”
কথাটা শুনে রফিক ও হাসিনার চোখে জল এলো। তারা জানত, এই স্বপ্ন পূরণ একার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু দত্ত পরিবারের হাত বাড়ানোয় তা সম্ভব হচ্ছে।

তবু গল্পের ভেতর যেন অদৃশ্য একটা ঝড় জমতে থাকল। কারণ সমাজ এখনও পুরোপুরি বদলায়নি। আবাসনের কমিটির কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিল—
“দত্ত পরিবার যদি এভাবে বস্তির লোকজনকে আশ্রয় দেয়, তবে তাদের ওপর কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”

এক অদৃশ্য লড়াই শুরু হলো। মানবিকতা বনাম সমাজের বাঁধাধরা নিয়ম। আর এই লড়াইয়ের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে গেল ঐশী ও সাহিলের বন্ধুত্ব।

পর্ব

আবাসনের নোটিশ বোর্ডে এক সকালেই নতুন কাগজ সাঁটা হলো—গাঢ় অক্ষরে লেখা: “নিরাপত্তাজনিত কারণে বহিরাগতদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। আবাসনের বাসিন্দারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বস্তি এলাকার ব্যক্তিদের আনাগোনা বন্ধ রাখবেন। কেউ নির্দেশ অমান্য করলে জরিমানা ধার্য হবে—₹১০,০০০।” নীচে সেক্রেটারি অরুণ বসুর সই, পাশে কোষাধ্যক্ষ বিজন দে’র মোটা মোটা অক্ষর। কাগজটার উপরেই লাল কালিতে কেউ লিখে দিয়েছে—“মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখুন”—কিছুক্ষণের মধ্যে সেটাকে ঝাপটা মেরে তুলে ফেলল এক সিকিউরিটি গার্ড।

এই নোটিশ দেখেই মৌসুমির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। যেন হঠাৎ করে ফ্ল্যাটটার ভেতর বাতাস ঘন হয়ে গেল। সুদীপ্ত ঠান্ডা গলায় পড়ল, মুখ শক্ত, “এটা সরাসরি আমাদের উদ্দেশ্যে।” একটু থেমে বলল, “জরিমানা দিলে দিলাম, কিন্তু আমি কার সাহায্য করব, সেটা কমিটি ঠিক করবে কেন?” মৌসুমি জানত—এই মুহূর্তে আবেগের বদলে বুদ্ধি দরকার। সে কাগজটা ফোনে তুলে রেখে বলল, “ঠিক আছে, আজ সন্ধ্যার জেনারেল মিটিং-এ গিয়ে কথা বলো। প্রকাশ্যে কথা বললেই সবাই শুনবে।”

সন্ধেয় কমিউনিটি হলে চেয়ার সাজানো, সামনে মাইক্রোফোন। চারপাশে ফিসফাস—“দত্তদের জন্যই এসব হল”, “বস্তির লোকজন মাথায় উঠছে”, “চুরি-ডাকাতি বাড়বে।” মিসেস ঘোষ সামনের সারিতে, ঠোঁটের কোণে অবজ্ঞা। অরুণ বসু গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন—“বন্ধুগণ, আমাদের আবাসনের সুনাম রক্ষার্থে কিছু নিয়ম কড়াকড়ি করতে হচ্ছে। সম্প্রতি বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা…”

সুদীপ্ত হাত তুলল, মাইক্রোফোন নিল। “অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মানে চুরি? সেই চুরির সিসিটিভি ফুটেজে তো স্পষ্ট তিনজন মুখোশধারী। একজনও বস্তির শিশু নয়, সাহিল তো নয়ই। তারপরও আপনি বহিরাগত বলতে কেবল বস্তির মানুষের কথাই বোঝাচ্ছেন কেন?” হলঘরটা একটু দবদব করে উঠল। কেউ বলল—“কথা কাঁটাকাটি নয়, নিরাপত্তা আগে।” আরেকজন, “মানবিকতা দেখাতে চাইলে নিজের ফ্ল্যাটের ভেতরে দেখান, কমপাউন্ডে নয়।”

মিটিং শেষে দরজার কাছে দাঁড়ানো গার্ড রাজেশ ফিসফিস করে বলল, “দাদা, আমি তো দেখেছি সেদিন যে লোকগুলো ঢুকেছিল, তাদের একজন বাইরের নয়, ‘নিজেদেরই’ কেউ। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে চুপ থাকতে। চাকরি আছে না…” তার গলা কেঁপে গেল। সুদীপ্ত থমকে দাঁড়াল। চোখাচোখি হতেই রাজেশ মুখ ঘুরিয়ে নিল—ভয় আর অসহায়তা দুটোই তার কণ্ঠে।

পরদিনই কমিটির হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নতুন “নির্দেশ”—বস্তির কারও জন্য কমপাউন্ডে খেলাধুলার অনুমতি নেই, শিশুদের ক্ষেত্রেও নয়। কে যেন স্ক্রিনশটে তুলে দিল ঐশীর হাতে ফুটবল ধরা—ক্যাপশন, “এভাবে শুরু হয় ‘ঘনিষ্ঠতা’।” ছবিটা দেখে মৌসুমির হাতে ফোন কেঁপে উঠল। ঐশী নিজের ঘরে চুপচাপ আঁকছিল, কাগজে সাহিলের খেলার একটা স্কেচ—হালকা গ্রাফাইটের টানে ছুটন্ত পায়ের রেখা। মা দরজায় দাঁড়াতেই সে মুখ তুলে বলল, “মা, আমি কি ভুল করছি?” মৌসুমি এসে তার কাঁধে হাত রাখল, “না। ভুল করছে যারা মানুষের মুখে তালা পরাতে চায়।”

কোচিং সেন্টার থেকেও চাপ এল। কোচ সন্ধেয় ফোন করে বললেন, “সাহিলের খেলা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু আবাসনের কয়েকজন অভিভাবক বলেছেন, ‘ও’ নাকি কমপাউন্ডে বিশৃঙ্খলা করে। আমি আপনারা যা করছেন, তার পাশে আছি, কিন্তু সেন্টারের ‘ইমেজ’…” শব্দগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেল। সুদীপ্ত ভদ্র গলায় উত্তর দিল, “কোচ, আমরা ফি সময়মতো দিচ্ছি। আপনি খেলাটা দেখুন, ইমেজ আমরা সামলাব।” ফোনটা কেটে গিয়ে ঘরে একটানা নীরবতা রইল—যেন দূরে কোনো খেলামাঠে বাঁশি বেজে উঠেও পৌঁছতে পারছে না।

সেই রাতেই আরেক গোলমাল। আবাসনের জিম থেকে এক সদস্যের ফোন হারাল। পুরোনো গল্পের নতুন পৃষ্ঠায় একই কালি—“বস্তির ছেলে আজ বিকেলে দেখা গেছে!” অরুণ বসু ভোরে ভোরে দুই গার্ড নিয়ে বস্তির দিকে গেলেন, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার, “দেখুন, যদি ফেরত দেন, পুলিশ কেস উঠবে না।” ভিড় জমে গেল। বাচ্চারা কৌতূহলী, মায়েরা আঁচল টেনে ধরে আছে। হাসিনা এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বলল, “সাহেব, আপনারা চাইলে আমাদের ঘর তল্লাশি করুন, কিন্তু আগে অপবাদ দেওয়ার আগে একবার ভাববেন। আমরা আগুনে ছাই হলাম, তারপরও কি আপনারা আমাদের অপরাধীই রাখবেন?” অরুণ বসুর চোখে এক ঝলক বিচলন এল, কিন্তু তিনি মুখ শক্ত রেখে ফিরে গেলেন।

ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই ফোনটা জিমের পিছনের স্টোররুমে পাওয়া গেল—এক সদস্য ভুলে রেখেছিলেন। গ্রুপে কেউ দুঃখ প্রকাশ করল না; শুধু এক লাইন—“মিলেছে।” অপবাদটার রঙ মুছল না। ঐশী খবরটা শুনে মুচকি হেসে বলল, “সত্যি ধরা পড়ল।” মৌসুমি বলল, “সত্যি নিজে নিজে ধরা পড়ে না, তাকে টেনে আনতে হয়।”

ঐশী ঠিক করল—আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটা রিলিফ ড্রাইভ করবে। পুরোনো জামা, বই, স্কুলব্যাগ, ওষুধ—কমিউনিটি হলে একটা টেবিলে সাজিয়ে রাখবে। পোস্টার বানাল: “পড়শি মানে পাশে থাকা।” নীচে ছোট অক্ষরে লিখল—“দান নয়, ভাগ করে নেওয়া।” স্কুলের বন্ধুদের ডাকল, পরিচিত টিউটরদের, এমনকি কয়েকজন অভিভাবকও সায় দিলেন। কিন্তু হল বুক করার আবেদন যেই গেল, ফিরতি ই-মেলে উত্তর এল—“হল শুধুমাত্র ‘ইন্টারনাল’ ইভেন্টের জন্য। বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ।” মৌসুমি প্রশাসনিক ভাষার মধ্যেকার অহংকার চিনে ফেললেন। তিনি ফোন করলেন সেক্রেটারিকে, “কমিউনিটি শব্দটার মানে কমিটি নয়, মানুষ। এটা মনে আছে?” ওপাশে কেবল দীর্ঘশ্বাস, “ম্যাডাম, নিয়ম আছে।”

তবু থেমে থাকা যায় না। সুদীপ্ত ফ্ল্যাটের বারান্দা আর ড্রয়িং রুম মিলিয়ে ছোট্ট একটা কর্নার বানিয়ে ফেলল—“রিলিফ কর্নার”—কার্ডবোর্ডে হাতে লেখা সাইন, বাচ্চারা এসে বই রেখে যাচ্ছে, কেউ পুরোনো কম্বল, কেউ ফুটবলজুতো। সাহিল লাজুক গলায় এসে বলল, “দিদি, আমি আমার ট্রফিটা আনবো? যারা রাস্তায় থাকে, তারা দেখলে খুশি হবে।” ঐশী থমকে গেল, “ট্রফি তো তোর স্বপ্নের চিহ্ন।” সাহিল মাথা নেড়ে বলল, “স্বপ্ন ভাগ করলে ছোট হয় না, বড় হয়।” তার সরল বাক্যটা ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে অদৃশ্য এক পোস্টার হয়ে টাঙিয়ে রইল।

এমন সময় স্কুল থেকে ফোন—ঐশীর ক্লাস টিচার জানতে চাইলেন, “তুমি কি বস্তিতে নিয়মিত যাও?” ঐশী বলল, “হ্যাঁ ম্যাম।” ওপাশে নিঃশ্বাস, “স্কুলের কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করেছেন। বলছেন, ‘বেঠিক প্রভাব’…” ঐশী অবাক হয়ে হাসল, “মানুষকে সাহায্য করা কবে থেকে বেঠিক হলো?” টিচার ধরা গলায় বললেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমার পাশে। কিন্তু নোট করে রাখলাম—তুমিই কখনো ভয় পেয়ো না।” ফোন কেটে গেলে ঐশীর চোখের কোণে একরাশ দৃঢ়তা জমে উঠল—ছোট্ট, কিন্তু কড়া।

রাতে সুদীপ্ত কম্পিউটারে আগুন লাগার রাতের ফুটেজ খুঁজছিল। রাজেশ যেটুকু পারল পেনড্রাইভে কপি করে দিয়েছে—অল্প, তবু ইঙ্গিত আছে। ধোঁয়ার মধ্যে ক্ষীণভাবে দেখা যায়—একজন গার্ড কারও সঙ্গে ফিসফিস করে মেইন গেট খুলে দিচ্ছে; টাইমস্ট্যাম্প মিলে যায় চুরির রাতের সঙ্গে। মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু ইউনিফর্মের হাতায় যে সেলাই, সেটা রাজেশের নয়। সুদীপ্ত মাথা তুলে বলল, “চুরি একটা ‘ভিতরের’ খেলা। বাইরে যারা দাঁড়িয়ে, তারা দোষী দেখায় বলে সুবিধে।”

পরদিন সকালে কমিটির অ্যাডভাইজরি—দত্ত পরিবারকে “শো-কজ”। কারণ: “কমিউনিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ”—রিলিফ কর্নার নাকি ‘অননুমোদিত’; বস্তির লোকজন ‘প্রবেশের চেষ্টা করেছে’। জরিমানা ২৫ হাজার। চিঠিটা হাতে নিয়েই মৌসুমি হেসে ফেলল—যে হাসি রাগেরও, তাচ্ছিল্যেরও, আবার দৃঢ়তারও। “পে করি,” বলল সুদীপ্ত, “কিন্তু তার আগে ওপেন-হিয়ারিং চাই। সবাই সামনে থাকবে, আমরা প্রমাণ দেখাব।”

হিয়ারিংয়ের দিন ঠিক হলো। হলঘরে আলো ঝলমলে, চেয়ার টানাটানি, সামনে প্রোজেক্টরের সাদা পর্দা। রাজেশ ভীত চোখে এসে দাঁড়াল দরজার পাশে—“দাদা, আমি যা দেখেছি, বললে চাকরি যাবে। কিন্তু না বললে শরীরটা কেমন করে।” সুদীপ্ত তার কাঁধে হাত রাখল, “সত্য বলার জন্য চাকরি গেলে আমরা আছি। মানুষ যদি মানুষকে না ধরে, নিয়মের কাগজ কাকে ধরে?”

হিয়ারিং শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে হঠাৎ লিফটের সামনে ভিড়। মিসেস ঘোষ হাঁফ ছেড়ে বলছেন, “এ কী! বস্তির লোক ঢুকে পড়েছে!” সবাই দরজার দিকে চেয়ে দেখল—হাসিনা নয়, রফিক নয়—ছোট্ট সাহিল দাঁড়িয়ে আছে, হাতে সেই নতুন ফুটবল, চোখে অনর্গল সাহস। সে চুপচাপ এসে প্রথম সারির ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ল। কেউ উঠিয়ে দিতে গেল—ঐশী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ও এখানে ‘বহিরাগত’ নয়। আমরা সবাই যার পড়শি, সে-ই ‘নিজের’।” আর ঠিক তখনই প্রোজেক্টরে প্রথম ফ্রেমটি জ্বলে উঠল—ধোঁয়ামাখা ফুটেজে একটি হাত গার্ডরুমের লগবুকের উপর নাম লিখছে। নামটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকল… হলঘরে যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।

পর্ব

প্রোজেক্টরের সাদা পর্দায় কালো অক্ষর ভেসে উঠতেই হলঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ফ্রেমের নিচে ঝাপসা করে ধরা পড়ল লগবুকের নাম—বিজন দে”। আবাসনের কোষাধ্যক্ষ, যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিটি আলোচনায় বস্তির লোকেদের দিকে আঙুল তুলছিল, সেদিন রাতে গার্ডরুমে নিজের হাতে নাম লিখে গিয়েছিল। টাইমস্ট্যাম্প মিলে যাচ্ছে চুরির ঘটনার সঙ্গে।

ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ চেয়ারে সরে বসল, কেউবা চুপচাপ বিজনের দিকে তাকাল। বিজনের মুখের রঙ মুহূর্তেই পাল্টে গেল। সে হকচকিয়ে উঠল, গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,
“এটা ফাঁদ। ফুটেজ এডিট করা। আমাকে অপমান করার জন্য সাজানো হয়েছে।”

সুদীপ্ত মাইক্রোফোন হাতে নিলেন, গলা শান্ত কিন্তু দৃঢ়—
“এটা এডিট নয়। এই ফুটেজ রাজেশ দিয়েছে, আর সিসিটিভির সার্ভার থেকে সরাসরি তোলা। প্রমাণ নকল করলে সহজেই ধরা পড়ত। প্রশ্ন হলো—আপনারা এতদিন প্রমাণ ছাড়াই সাহিলকে দোষী বানিয়েছিলেন কেন?”

রাজেশ কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এসে বলল,
“সেদিন আমি দেখেছিলাম, বিজনবাবু গার্ডকে বলছিলেন গেট খুলতে। আমাকে চুপ থাকতে বলা হয়েছিল।”
তার কণ্ঠ কেঁপে উঠলেও সত্যের ওজন হলঘরটাকে যেন কাঁপিয়ে দিল।

হঠাৎ মিসেস ঘোষ চেঁচিয়ে উঠলেন,
“এভাবে কি কাউকে দোষী করা যায়? আমাদের কমিউনিটির সম্মান আছে।”
মৌসুমি এবার উঠে দাঁড়ালেন। চোখে বিরক্তির আগুন, কণ্ঠে ধার—
“সম্মান কীসে? গরিবকে অপমান করে? শিশুদের অপরাধী বানিয়ে? নাকি নিজের দোষ চাপা দিতে?”

ভিড়ের ভেতরে কেউ মাথা নুইয়ে ফেলল, কেউবা চুপচাপ তাকিয়ে রইল। ঐশী হঠাৎ সাহিলের হাত চেপে ধরল। তার ছোট্ট বুক দুরু দুরু করছে, তবু সে বসে আছে একেবারে সামনের সারিতে।

অবশেষে অরুণ বসু, সেক্রেটারি, গলা নিচু করে বললেন,
“দেখুন, বিষয়টা সিরিয়াস। আমাদের ভেতরেই কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকলে সেটা প্রশাসনকে জানাতে হবে।”
তিনি বিজনের দিকে তাকালেন। বিজন হঠাৎ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল। ভিড় থেকে দু-একজন তাকে ধরে ফেলল। হলঘরে মুহূর্তেই হইচই বেধে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ডাকা হলো। প্রোজেক্টরের ফুটেজ ও রাজেশের বয়ান তাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। বিজনকে নিয়ে যাওয়া হলো থানায়। আবাসনের ভেতর বাতাস যেন বদলে গেল—সেই শত্রুভাবাপন্ন চাউনি গলে গিয়ে এবার ভিড়ের চোখে এল লজ্জা।

সুদীপ্ত মাইক্রোফোনে শেষবার বললেন,
“আজ প্রমাণ হয়েছে, অপরাধ গরিব-ধনী দেখে আসে না। আমরা সবাই মানুষ, আর মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে।”

হলঘর থেকে বেরোবার সময় হাসিনা এগিয়ে এসে মৌসুমির হাত ধরে বলল,
“আপনারা না থাকলে আমরা আজও অপবাদ মাথায় নিয়ে বাঁচতাম। আপনারা আমাদের মান দিলেন।”
মৌসুমি মৃদু হেসে জবাব দিলেন,
“আমরা একে অপরের পড়শি। এটাই যথেষ্ট।”

ঐশী সাহিলকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“দেখলি তো, সত্যি শেষমেশ জেতে।”
সাহিলের চোখ জ্বলে উঠল। সে বলল,
“হ্যাঁ দিদি, এবার আমি শুধু মাঠেই না, জীবনের সব খেলায় জিততে চাই।”

কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। কারণ সমাজের পুরনো দেয়াল এত সহজে ভাঙে না।
যদিও অপবাদ মুছে গেছে, তবু ফিসফাস এখনো বেঁচে আছে—
“বিজন ধরা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু বস্তির লোকেরা একেবারেই নির্দোষ বলা যাবে?”
মানুষের মনের অন্ধকার এত তাড়াতাড়ি মুছে যায় না।

তবু ঐশী, সাহিল, মৌসুমি আর সুদীপ্ত জানত—এটা একটা শুরু। সত্যের আলো একবার জ্বলে উঠলে তা কখনো পুরোপুরি নিভে যায় না।

পর্ব

বিজন দে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আবাসনের ভেতরে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হলো। যারা এতদিন সাহিলকে আঙুল তুলেছিল, তারাই এখন মুখ নিচু করে চলে যায়। কিন্তু মুখে দুঃখ প্রকাশ নয়, শুধু চুপচাপ এড়িয়ে যাওয়া। সমাজ নিজের ভুল কখনো সহজে স্বীকার করে না।

তবু বাতাসে একটা বদলের আভাস টের পাওয়া যাচ্ছিল। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বস্তির মানুষরা হেসে ফিসফিস করছিল—
“দেখলি? গরিব বলে সবাই চোর হয় না।”
“ও দত্তবাবু না থাকলে আমাদের নাম চিরকাল কালো থাকত।”

এই সময়েই এল নতুন খবর। সাহিলের কোচ একদিন সন্ধ্যায় দত্তদের ফ্ল্যাটে এসে হাজির। হাতে একটা চিঠি।
“সাহিলকে জেলা পর্যায়ের জুনিয়র টুর্নামেন্টের জন্য বাছাই করা হয়েছে। আগামী মাসে ম্যাচ। এখানে অনুমতির কাগজে সই দরকার।”

হাসিনা আবেগে ভেসে গেল। চোখে জল নিয়ে বলল,
“আল্লাহর রহমত! কিন্তু খরচাপাতি?”
কোচ বললেন, “যাতায়াত, কিট, জার্সি—সব মিলিয়ে কিছু খরচ আছে। তবে যদি ও ভালো খেলে, সামনে বড় দলের নজরে আসতে পারে।”

মৌসুমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না। “খরচ আমরা দেব। সাহিল খেলবে।”
রফিক কাঁপা গলায় বলল, “কিন্তু এত টাকা…”
সুদীপ্ত হেসে উত্তর দিলেন, “টাকা আসে যায়, কিন্তু সুযোগ বারবার আসে না।”

ঐশী যেন নিজের স্বপ্নও সাহিলের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল। সে বইপত্র গুছিয়ে সাহিলের হাতে দিল—
“খেলাটাই তোর জীবন, কিন্তু পড়াশোনা ছাড়বি না। আমি তোর সঙ্গে আছি।”
সাহিল মাথা নেড়ে বলল, “আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, দিদি।”

এদিকে আবাসনের কমিটিতে অস্থিরতা বেড়েছে। বিজন ধরা পড়ায় নেতৃত্বে শূন্যতা। অরুণ বসু এখন শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়েছেন। মিসেস ঘোষও কিছুদিন চুপ করে আছেন, তবে আড়ালে এখনও ফিসফাস চালাচ্ছেন—
“ফ্ল্যাটের নাম নষ্ট হয়ে গেল। দত্তরা না থাকলে এসব হতো না।”

কিন্তু দত্ত পরিবার আর এসব কানে তুলল না। তারা নিজেদের লড়াইয়ে জিতেছে।

টুর্নামেন্টের দিন এসে গেল। ছোট্ট মাঠে রঙিন পতাকা, দর্শকদের ভিড়। সাহিল নতুন জার্সি পরে মাঠে নামল। চোখে ভয় নেই, আছে শুধু দৃঢ়তা। ঐশী গ্যালারিতে বসে, হাততালি দিচ্ছে প্রতিটি ছোঁয়ায়। হাসিনা প্রার্থনা করছে, রফিক চোখে গর্বের আভা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

খেলা শুরু হলো। প্রথমার্ধে দু’পক্ষ সমানে সমান। দ্বিতীয়ার্ধে হঠাৎ সাহিল বল পেয়ে দৌড় দিল। তার গতি দেখে দর্শক চমকে উঠল। গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে নিখুঁত শটে বল জালে জড়াল। মাঠ কেঁপে উঠল করতালিতে।

“সাহিল! সাহিল!”—নাম ধ্বনিত হলো চারপাশে।

ম্যাচ শেষে কোচ দৌড়ে এসে সাহিলকে জড়িয়ে ধরলেন।
“তুই ভবিষ্যতে বড় খেলোয়াড় হবি। শুধু মনোবল ধরে রাখ।”

ঐশী গর্বে ভেসে উঠল। তার মনে হলো—এই একটা গোল যেন শুধু ম্যাচ নয়, বরং অপমানের দেয়াল ভেঙে দেওয়া এক আঘাত।

কিন্তু এই সাফল্যই আবার নতুন ঝড় ডেকে আনতে চলেছে। আবাসনের কিছু মানুষ হঠাৎ বলতে শুরু করল—
“এই ছেলেটা এখন ফ্ল্যাটের নাম ব্যবহার করছে। আমাদের অনুমতি ছাড়া বাইরে গিয়ে নাম রোজগার করছে।”
কেউ কেউ বলল, “আজ খেলোয়াড়, কাল নেতা হয়ে যাবে না তো?”

মৌসুমি শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “মানুষ যখন বদলায়, সমাজ তখন নতুন অজুহাত খোঁজে।”

তবু ঐশী জানত—এবার তাদের থামানো যাবে না। সাহিলের জীবনে নতুন দরজা খুলে গেছে। আর তারা, পড়শি হয়েও, একে অপরের হাত ধরে এই পথেই এগোবে।

পর্ব

সাহিলের টুর্নামেন্টের গোল যেন শুধু মাঠেই নয়, আবাসনের গণ্ডির বাইরেও আলোড়ন তুলল। স্থানীয় সংবাদপত্রে ছোট্ট এক খবরে বেরোল—
বস্তির ছেলে জেলার টুর্নামেন্টে জয়ী—অভিজাত আবাসনের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোয় সম্ভব হলো স্বপ্ন।”
খবরটা পড়েই মৌসুমির বুক ভরে উঠল, কিন্তু আবাসনের লিফটে ঢুকতেই শোনা গেল চাপা গুঞ্জন—
“কাগজে নাম ছাপানো শুরু হয়েছে, কালকে টিভিতেও দেখাবে।”
“এখনই যদি এত নামডাক পায়, পরে আমাদের ফ্ল্যাটের মাথায় না ওঠে?”

সুদীপ্ত এগিয়ে এসে স্পষ্ট করে বললেন, “একটা বাচ্চার সাফল্যে যদি আপনাদের ভয় লাগে, তবে সেটাই দুঃখের।”

কিন্তু ভয় থামল না। মিসেস ঘোষ কয়েকজনকে নিয়ে নতুন প্রস্তাব আনলেন—
“আবাসনের নিয়মে লিখে দিতে হবে—বাহিরের কেউ এখানে নিয়মিত আসতে পারবে না। বিশেষ করে বস্তির লোকজন।”
কিছু লোক মাথা নাড়ল, কেউ বলল, “ঠিকই তো, আজ খেলোয়াড়, কাল নেতা হলে আমাদের বিপদ।”

এদিকে ঐশী এসব শুনে ভিতরে ভিতরে দমে গেলেও সাহিলকে কিছু জানাল না। সে প্রতিদিন পড়াতে আসত, একসঙ্গে বসে খাতা খুলত। এক সন্ধ্যায় সাহিল জিজ্ঞেস করল,
“দিদি, তুই এত কষ্ট করে আমাকে শেখাচ্ছিস কেন?”
ঐশী মুচকি হেসে উত্তর দিল,
“কারণ তুই একদিন আমাদের সবার স্বপ্ন হয়ে উঠবি। আর স্বপ্ন একা দেখা যায় না, ভাগ করেই বড় হয়।”

রফিক সুস্থ হলেও কাজে আগের মতো ফিরতে পারল না। তখন হাসিনা আরও বেশি ঘরের কাজে যেতে শুরু করল। কিন্তু প্রতিটি ঘরেই সে এখন অন্যভাবে দেখা হচ্ছিল—
“ওরা তো নাম করেছে, এখন আবার বড়লোকের মতো হবে না তো?”
মাঝে মাঝে হাসিনা অপমান বয়ে নিয়ে ফিরত, তবু সাহিলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যেত।

একদিন রাতে আবাসনের গেটে ঝামেলা হলো। কয়েকজন বাইরের যুবক এসে ভাঙচুর করতে লাগল। তারা নাকি বিজন দে’র চেনাজানা লোক। গার্ডরা সামলাতে পারছিল না। সেই সময় রফিক নিজের শরীর নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আহত কাঁধ নিয়েও চেঁচিয়ে উঠল—
“এটা আমাদের বাড়ি। যেভাবেই হোক আমরা রক্ষা করব।”
তার সঙ্গে দাঁড়াল সুদীপ্তও। শেষমেশ পুলিশ এসে সবাইকে সরাল।

ঘটনার পর অরুণ বসু চুপ করে মৌসুমির কাছে এসে বললেন,
“আমরা ভুল করেছিলাম। আজ বুঝলাম, সমাজ টাকার প্রাচীর দিয়ে চলে না। পাশে দাঁড়ানোর সাহস দিয়েই চলে।”

কিন্তু মিসেস ঘোষ মানলেন না। তিনি সোজা বললেন,
“এইসব নাটক করে ফ্ল্যাটের মানহানি হয়েছে। দত্তরা যদি বস্তির লোকেদের সঙ্গে মিশতেই থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।”

ঐশী আর সহ্য করতে পারল না। সবার সামনে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করল—
“আমার নাম ঐশী দত্ত। আমি বন্ধুত্ব করি সাহিলের সঙ্গে। সে বস্তির ছেলে, কিন্তু আমার কাছে সে সত্যিকারের মানুষ। আপনারা চাইলে আমাকে শাস্তি দিন, কিন্তু আমি আমার বন্ধুর পাশে থাকব।”

এক মুহূর্তের জন্য হলঘর স্তব্ধ হয়ে গেল। এত ছোট্ট একটা মেয়ের কণ্ঠে এমন দৃঢ়তা কেউ কল্পনাও করেনি। সাহিল দূরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিল—অপমান, স্বপ্ন, সাহস সব মিলে তার বুক ভরে উঠছিল।

তবে এই প্রতিবাদ আরও বড় দ্বন্দ্ব ডেকে আনল। আবাসনের কমিটির কয়েকজন সরাসরি ঘোষণা করল—
“দত্ত পরিবার যদি নিজেদের অবস্থান না বদলায়, তবে তাদের ফ্ল্যাটের সদস্যপদ খারিজের দাবি জানাব আমরা।”

পর্ব ১০

আবাসনের বাতাস যেন বিদ্বেষে ভারী হয়ে উঠেছিল। কমিটির বৈঠকে সরাসরি প্রস্তাব উঠল—দত্ত পরিবারকে শো-কজ করে তাদের সদস্যপদ খারিজের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ—“আবাসনের ভাবমূর্তি নষ্ট করা”।

সেই রাতে মৌসুমি চুপচাপ বারান্দায় বসেছিলেন। আলো-অন্ধকারের ফাঁক দিয়ে তিনি দেখছিলেন, বস্তির ভেতর হাসিনা রান্নার আগুন জ্বালাচ্ছে, রফিক সাহিলকে পাশে বসিয়ে চুপচাপ কথা বলছে। মানুষের দৈনন্দিন লড়াই—যা কোনও নিয়মের কাগজে ধরা পড়ে না। সুদীপ্ত এসে বললেন,
“আমাদের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে, সেটা রুখতে হলে শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রমাণও দেখাতে হবে।”
ঐশী গম্ভীর গলায় বলল,
“প্রমাণ আমরা আগেই দেখিয়েছি। এখন সাহস দেখানোর পালা।”

পরের সপ্তাহে আবাসনের বড় সভা ডাকল কমিটি। চারপাশে ভিড়, কেউ উত্তেজিত, কেউ কৌতূহলী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অরুণ বসু গলা ঝাড়লেন—
“আজকের আলোচ্য বিষয়—দত্ত পরিবারের কার্যকলাপ। আপনাদের মতামত নথিভুক্ত হবে।”

হঠাৎ দরজার বাইরে হইচই শোনা গেল। কয়েকজন সংবাদকর্মী ক্যামেরা হাতে ঢুকলেন। স্থানীয় এক পত্রিকার রিপোর্টার গলা উঁচু করে বললেন,
“আমরা খবর পেয়েছি, এই আবাসন থেকে একজন গরিব পরিবারের ছেলেকে ফুটবল খেলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আজ সে জেলা পর্যায়ে খেলছে। এটিই তো সমাজের গর্ব। তাহলে এমন পরিবারকে বহিষ্কার করার কারণ কী?”

সবাই থম মেরে গেল। কেউ কল্পনাও করেনি, বাইরের দুনিয়া এই খবর তুলে ধরবে।

ঠিক তখনই সাহিল এগিয়ে এল। পরনে স্কুলড্রেস, হাতে তার জেতা ট্রফি। সে স্পষ্ট গলায় বলল,
“আমার নাম সাহিল। আমি এই আবাসনের ঠিক পাশের বস্তিতে থাকি। আমি চোর নই, আমি খেলোয়াড়। আমার স্বপ্ন আছে। আর সেই স্বপ্ন পূরণে দত্ত দাদু-দিদি আর ঐশী দিদি আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। যদি ওদের শাস্তি দেন, তবে আমাকেও শাস্তি দিন।”

তার কণ্ঠের সরল সাহস সারা হলঘরকে কাঁপিয়ে দিল। ভিড়ের মধ্যে হাততালি উঠল—প্রথমে অল্প, তারপর আরও জোরে। অনেকেই উঠে দাঁড়ালেন। মিসেস ঘোষ চেঁচিয়ে উঠলেন—
“এটা আবেগের নাটক!”
কিন্তু তার কণ্ঠ করতালির আওয়াজে ডুবে গেল।

অরুণ বসু মাইক্রোফোন হাতে নিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“সমাজ কাকে বহিষ্কার করবে, তা সমাজকেই ঠিক করতে হয়। আজকের সভায় আমি দেখছি, দত্ত পরিবারকে নয়, আমাদের মানসিকতাকেই পাল্টানো দরকার। প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হলো।”

শব্দগুলো যেন শিকল ভাঙার মতো বাজল। মৌসুমি চোখ বন্ধ করে গভীর স্বস্তি নিলেন। সুদীপ্ত তাঁর হাত চেপে ধরলেন। ঐশী দৌড়ে গিয়ে সাহিলকে জড়িয়ে ধরল।

সেই রাতটা অন্যরকম ছিল। ফ্ল্যাটের আলো, বস্তির টিমটিমে প্রদীপ—সব মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেল। মানুষের ভেতরকার দেয়াল ভাঙতে শুরু করল ধীরে ধীরে।

কয়েক মাস পর সাহিল আবার মাঠে নামল—এবার রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতা। সংবাদপত্রে ছবিসহ খবর বেরোল—“বস্তির সাহিল আজ স্বপ্নের দোরগোড়ায়।” ঐশী সেই খবর কেটে ডায়েরিতে লাগাল। নিচে লিখল—
বন্ধুত্ব মানে শুধু খেলা নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও।”

দত্ত পরিবার ও রফিকদের পরিবার—দু’জনার সংসার আলাদা জগতে থেকেও এখন একে অপরের আশ্রয় হয়ে উঠেছে। সমাজের শ্রেণি-বিভেদের প্রাচীর পুরোপুরি ভাঙেনি, কিন্তু একটা ফাঁটল পড়েছে। আর সেই ফাঁটল দিয়েই আলো ঢুকতে শুরু করেছে।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-08-25-at-5.33.35-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *