Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

পটচিত্রের অভিশাপ

Spread the love

শ্রীজিত সাহা


অধ্যায় ১: হাটের হদিস

কলকাতার গাঢ় ধূসর সকালে শহরের বুক চিরে যখন শরদ রায় তাঁর পুরনো অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেন, আকাশে তখনও কুয়াশার বৃষ্টি লটকে ছিল। পেছনের সিটে রাখা ছিল একটি ধুলোমাখা ক্যামেরা, নোটবই, এবং বছর তিরিশেক পুরনো বাংলার লোকশিল্প বিষয়ক একটি জীর্ণ বই। শরদ একজন খ্যাতনামা শিল্প সংগ্রাহক হলেও তাঁর সংগ্রহ মানেই কেবল গ্যালারির ঝকঝকে ফ্রেম বা বিদেশ থেকে আনা মিনিয়েচার নয়—তিনি খোঁজেন মাটির গন্ধে মাখা হারিয়ে যাওয়া শিল্প, লোকজ ঐতিহ্য। আর তাই আজ তিনি চলেছেন নদিয়ার ধারের এক প্রাচীন গ্রামে, যেখানে প্রতি বছর বসে “মারগাঁ হাট”—এক আশ্চর্য হাট, যেখানে লোকশিল্পীরা নিজেদের সৃষ্ট পট, মুখোশ, মাটির মূর্তি কিংবা গীতিকার পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসেন। শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে দূরে, যেসব শিল্প চোখে পড়ে না কারও, সেগুলিই খোঁজেন শরদ। সেই খোঁজে তাঁর অনেকবার লাভ হয়েছে, আবার বহুবার… কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতাও হয়েছে, যার ব্যাখ্যা তিনি নিজেই আজও খুঁজে পাননি।

মারগাঁ হাটে পৌঁছে প্রথমেই শরদ বুঝলেন, এ জায়গার হাওয়াতেও যেন একরকম অনুনয় রয়েছে—যেন শত শত বছর ধরে থেমে থাকা শব্দেরা এখানে রং হয়ে কাগজে বসেছে। মাঠের এক প্রান্তে একটি বয়স্ক লোক মাদুরে বসে ছিল। তার সামনে রাখা কিছু ধুলোমাখা পটচিত্র—সবই পুরনো, মলিন, কিন্তু প্রত্যেকটায় ছিল এক নিজস্ব টান। শরদ সাবধানে এগিয়ে গিয়ে প্রতিটি চিত্র পর্যবেক্ষণ করছিলেন, যখন তাঁর চোখ আটকে গেল এক ছবিতে। ছবিটির পটভূমিতে আঁকা এক গাঢ় নীল সন্ধ্যা, মাঝখানে এক বাউল গায়ক বসে আছেন এক চৌকাঠে, হাতে একতারা, চোখ দুটো ঝুঁকে পড়েছে কোনও দূরের দিকে। ছবির রঙ ছিল ম্রিয়মাণ, কিন্তু বাউলের চোখের অভিব্যক্তি এমন জীবন্ত ছিল, যেন সে এখনও কাঁদছে। শরদ কাঁধে ব্যাগ নামিয়ে ছবি হাতে তুলে নিতেই পাশ থেকে বৃদ্ধ লোকটি গলায় একরকম কাঁপা গলায় বলে উঠল, “এইটা নিবেন না বাবু, অভিশপ্ত।” শরদ হেসে বললেন, “সব শিল্পেরই তো একটা ইতিহাস থাকে, না?” বৃদ্ধ চুপ করে থাকল, কিছু না বলেই। দাম শুনে শরদ বিস্মিত হলেন—এমন শিল্প, অথচ এমন কম দামে? শরদ এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেও শেষ পর্যন্ত পটচিত্রটি কিনে ফেললেন, ব্যাগে ভরে আবার গাড়ির পেছনের সিটে রেখে ফিরতি পথ ধরলেন। কিন্তু তাঁর চোখ বারবার যেন অনুভব করছিল, ব্যাগের ভেতরের ছবিটির চোখও তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে, খুব গভীরভাবে।

বাড়িতে ফিরে পটচিত্রটি তিনি ঝুলিয়ে দিলেন নিজের পড়ার ঘরের ঠিক সামনে। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা, কলকাতার গলির কুকুরগুলো তখনও ঘেউ ঘেউ করে চলেছে। শরদ কফির কাপ হাতে বসে ছিলেন নিজের ডেস্কে, হাতে একটি নতুন লোকশিল্প বিষয়ক পাণ্ডুলিপি—তবে পড়ায় মন বসছিল না। হঠাৎই যেন কানে এল এক অচেনা সুরের ধ্বনি—একতারা আর খঞ্জনির যুগল সুর। প্রথমে তিনি ভাবলেন বাইরের রাস্তায় কেউ গান গাইছে, কিন্তু জানালার বাইরেটা ছিল একেবারেই নিস্তব্ধ। তিনি আবার বসে পড়লেন, কিন্তু মিনিট দশেক পর আবার সেই সুর। এবার একটু স্পষ্ট, একটু বিষণ্ণ। শরদ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে পটচিত্রের দিকে গেলেন। ঘরের আলো নিভু নিভু, ছবির ওপর মৃদু ল্যাম্পশেডের আলো। তিনি লক্ষ করলেন—বাউলের চোখে এক অদ্ভুত আলো যেন ঝলক দিয়ে গেল, ঠিক যেন বাস্তব কারও চোখের মধ্যে আলো প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন, এক মুহূর্তের জন্য যেন মনে হল ছবির মধ্যের বাউলটি তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শরদের। তিনি তাড়াতাড়ি ঘরের আলো জ্বালালেন, জানলা বন্ধ করলেন, এবং ঘরের দরজা লক করে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুম তাঁর চোখে এলো না—কেবলই মনে হচ্ছিল ছবির ভিতরে কেউ নিঃশব্দে হাঁটছে, হয়তো গান গাইছে… অথবা তাকিয়ে আছে এক নিষ্পলক অভিশপ্ত দৃষ্টিতে। সেই রাতে অনেক দিন পর শরদ আবার সেই পুরনো দুঃস্বপ্নটা দেখলেন—কেউ যেন গভীর রাতে তাঁকে ডেকে বলছে, “আমার শেষ গান কেউ গায়নি বাবু, তোমার গলায় যদি শুনি… আমি মুক্তি পাব…”

অধ্যায় ২: অশরীরী গান

শরদ রায়ের ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত গানের সুরে। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত তিনটে ছুঁই ছুঁই। বাইরে নিস্তব্ধতা এতটাই গা-চাপা যে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার বুক চিরে ভেসে আসছিল এক পুরনো বাউলের কণ্ঠস্বর—জ্যোৎস্না-ভেজা কোনো মাঠের মাঝখান থেকে যেন কেউ গাইছে, “মনরে, আমার দেহের বাসা ঘর না রে…”। কাঁথার নিচ থেকে শরদ ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। পায়ের পাতায় ঠান্ডা ফ্লোর লাগতেই শরীর শিরশির করে উঠল। এই গান, এই সুর… আগে কোথাও শুনেছেন বলে মনে পড়ে না, অথচ মনে হচ্ছে অনেকদিনের চেনা। তিনি নিঃশব্দে দরজা খুলে পড়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন—যেখানে ঝুলছে সেই পটচিত্র। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল, পায়ের নিচে যেন কিছুটা ঠাণ্ডা ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক যেন ঘরের মেঝে নয়, বরং কোনো ভিজে মাঠ। দরজার পাশে পৌঁছেই থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের ভেতর আলো নিভানো, কিন্তু ভিতর থেকে আসছে সেই একই সুর, একতারা আর খঞ্জনির মায়াবী ছন্দ। তিনি ধীরে ধীরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন—আর মুহূর্তেই তাঁর চোখ আটকে গেল পটচিত্রে।

ছবিটির মধ্যে আলো পড়ে আছে অদ্ভুতভাবে। যেন কোথাও থেকে এক ধূসর চাঁদের আলো এসে পড়েছে বাউলের মুখে। বাউলের চোখ এখন আরও জীবন্ত, আরও গভীর, আর সবচেয়ে ভয়াবহ—সেই চোখের কোণে চিকচিক করছে জল! শরদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন, চোখ সরাতে পারছেন না। ছবির এক কোনা থেকে যেন ধোঁয়ার মতো এক কুয়াশা বেরিয়ে আসছে, ধীরে ধীরে তা ঘরের বাতাসে মিশে যাচ্ছে। হঠাৎ বাউলের ঠোঁটে দেখা যায় এক ম্লান হাসি—একটুও শান্তি নেই, কেবল তৃষ্ণা, অধরা আকুলতা। তখনই আবার সেই সুর—এইবার স্পষ্ট করে শুনতে পান কথাগুলো, যেন কেউ শরদের ঠিক কানের কাছে দাঁড়িয়ে গাইছে। তিনি পেছনে ঘুরে তাকান—কেউ নেই। জানলা বন্ধ, দরজা লক। তিনি এগিয়ে যান ছবির দিকে, হাত বাড়ান, ছবির ওপর আঙুল রাখেন। সঙ্গে সঙ্গেই একটা কাঁপুনি শরীর দিয়ে বয়ে যায়—এক মুহূর্তে যেন তিনি অনুভব করেন, ছবির ক্যানভাসটা কেবল কাপড় নয়, বরং একটা দেহ… একটা উষ্ণতা… একটা অস্তিত্ব। সেই রাতের বাকি সময়টা কাটে শরদের এক অসম্পূর্ণ ঘোরের মধ্যে। বিছানায় শুয়ে থেকেও মনে হয় কেউ তার কানের পাশে ফিসফিস করছে, কেউ যেন তার বুকের ভেতর ঢুকে বসে আছে—একটা গান নিয়ে, একটা অতৃপ্ত প্রার্থনা নিয়ে। পরদিন সকালে উঠে তিনি আয়নায় নিজেকে দেখেন—চোখে কালি, শরীর কাঁপছে, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মনে হচ্ছে, শরীরের কোথাও একটা নতুন কিছু জন্ম নিচ্ছে—একটা সুর, একটা গল্প, একটা অভিশাপ।

দিনের আলোয় সব কিছু যেন একটু স্বাভাবিক মনে হয়। সকালবেলা শরদ তাঁর সহকারী নন্দিনী ঘোষ-কে ডাকেন। নন্দিনী লোকসংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করে, পটচিত্র নিয়ে তার আগ্রহও প্রবল। শরদ তাকে ছবিটি দেখান এবং আগের রাতের অভিজ্ঞতার কথা বলেন—কিন্তু শব্দগুলো যেন গলায় আটকে যায়, কারণ কেউ যদি বলেন, “ছবির ভিতর থেকে কেউ গান গাইছে,” তা শুনে যুক্তিবাদী কারোরই বিশ্বাস হয় না। নন্দিনী চুপ করে ছবিটি দেখেন, তারপর বলেন, “এই ছবিটা… এমন একটা বাউলকে নিয়ে আঁকা হয়েছে, যিনি জীবিত অবস্থায় সম্পূর্ণ গান রেকর্ড করতে পারেননি। এমন লোকজ কাহিনি আমি পড়েছি একবার—এরা গান গেয়ে আত্মা রেখে যায় বাতাসে।” শরদ তখন প্রশ্ন করেন, “তাহলে কি এই ছবি… কোনো আত্মাকে ধারণ করছে?” নন্দিনী বলেন, “হতে পারে। তবে এর উৎস জানতে হলে আমাদের ছবি কোথা থেকে এসেছে, কে এঁকেছে, আর কাকে আঁকা হয়েছে—তা জানতে হবে।” শরদের ভিতরে তখন সুরের মতোই বাজছে একটা নামহীন আকুলতা, আর পটচিত্রের সেই চোখজোড়া যেন ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে। পটচিত্রটা হয়তো শুধু একটা শিল্প নয়—বরং একটি দরজা, যা খুলে যাচ্ছে এক অন্য জগতে, এক অভিশপ্ত বাউলের অসমাপ্ত যাত্রাপথে।

অধ্যায় ৩: পটের ইতিহাস

নন্দিনী ঘোষ দুপুরবেলা শহরের কলেজ স্ট্রিটের এক ছোট্ট লাইব্রেরির ধুলো জমা ঘরে বসে পটচিত্র সম্পর্কিত পুরাতন দলিল ঘাঁটছিলেন। শরদ রায়ের পড়ার ঘরে ঝোলানো সেই অদ্ভুত চিত্রটি তাকে ঘুমোতে দেয়নি। আগের রাতের শরদের বর্ণনা, তার চোখের নিচের কালশিটে দাগ, ছবির সেই গভীর চোখজোড়া—সব মিলিয়ে একটা কৌতূহল নয়, বরং এক ধরণের অস্থিরতা তৈরি করেছিল তার মধ্যে। নন্দিনী জানতেন, বাংলার লোকশিল্পে এমন পটচিত্র পাওয়া যায়, যেগুলি কেবল ধর্ম বা রূপকথা নয়, বরং মৃত আত্মার প্রতিচ্ছবি বহন করে। যেসব শিল্পী এমন ছবি আঁকতেন, তাঁরা বিশ্বাস করতেন, অসমাপ্ত ইচ্ছা বা অসমাপ্ত সুর ক্যানভাসে আটকে যায়। এক পুরনো বইয়ের পৃষ্ঠার ভাঁজে পাওয়া গেল একটি ছোট্ট উল্লেখ—”দেউলবাড়ি অঞ্চলের কিছু পুরনো পটচিত্রে এক মৃত বাউলের চিত্র আঁকা হতো। বিশ্বাস, তাঁর আত্মা গান দিয়ে মুক্তি পেতে চায়।” জায়গাটার নাম চোখে পড়তেই নন্দিনীর মন কেঁপে উঠল—দেউলবাড়ি! ছবির পেছনের কোণে তিনি আগেই দেখেছিলেন এক ম্লান হস্তাক্ষর—‘D-Bari’। তখন তিনি ভেবেছিলেন সেটি হয়তো শিল্পীর নাম, কিন্তু এখন বোঝা গেল সেটি ছিল জায়গার সংকেত। এক লাইন কালি-ঝাপসা তথ্যও কখনো কখনো এক অন্ধকার ইতিহাসের দরজা খুলে দেয়।

অন্ধকার দরজা খোলার সিদ্ধান্তটা নন্দিনী নিয়ে ফেললেন। পরদিনই তিনি রওনা দিলেন দেউলবাড়ির উদ্দেশ্যে, নদীয়ার এক অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম, যেখানে এখন লোকজনও খুব একটা যাতায়াত করে না। ভাঙা বাসস্ট্যান্ড, কাঁদামাটির পথ, সোঁদা গন্ধে মেশানো বাতাস, আর সেই চেনা বাংলার গ্রামীণ নিস্তব্ধতা—সব মিলে গ্রামটি যেন এক স্থির অতীতের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। কিছুটা খোঁজ নিয়ে তিনি পৌঁছলেন গ্রামের এক বৃদ্ধ শিল্পী দাদারাম মল্লিক-এর বাড়িতে। তিনি গ্রামের একজন প্রবীণ পটশিল্পী, যিনি অনেক বছর আগে লোকশিল্পে অবদান রাখলেও এখন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। প্রথমে খুব একটা কথা বলতে চাইলেন না, কিন্তু যখন নন্দিনী ছবিটির কথা বলেন এবং শরদের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলেন, তখন দাদারাম একটু চুপ করে থাকেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে বলেন, “আপনি যেটা বলছেন, সেটা কোনো গল্প নয়… ও ছবি আঁকা হয়েছিল সমর পালের নামে। উনি আমাদের গ্রামের বাউল ছিলেন। কিন্তু ওর মৃত্যু ছিল… স্বাভাবিক নয়।” নন্দিনী তখন চমকে ওঠেন। সমর পাল—এই নামটি আগে কখনও শোনেননি, কিন্তু তাতে কী! পটচিত্রের মধ্যে তারই তো প্রতিচ্ছবি! দাদারাম জানালেন, সমর পাল একসময় এই গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন, তাঁর গলায় ছিল একতারা আর চোখে ছিল অদ্ভুত দৃষ্টি। তাঁর গান ছিল এমন, শুনলে মানুষ কেঁদে ফেলত। কিন্তু গ্রামের এক জমিদারের মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা তখনকার সমাজ সহ্য করতে পারেনি। সমরকে এক রাতে পিটিয়ে মেরে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর আগেই তিনি একটি গান শুরু করেছিলেন—যা কেউ শেষ করতে শোনেনি। তাঁর আত্মা তখন থেকেই ভেসে আছে বাতাসে, আর বহু বছর পরে এক শিল্পী, দাদারামেরই গুরু, সেই স্মৃতিচিহ্ন ধরে সেই পটচিত্র আঁকেন। কেউ ছবিটি বাড়িতে রাখলে নাকি সমরের সুর আবার জেগে ওঠে।

নন্দিনী স্তব্ধ হয়ে শোনেন সবটা। সমস্ত যুক্তির বাইরে গিয়ে এই গল্প যেন এক অদৃশ্য বৃত্ত সম্পূর্ণ করে ফেলে। তিনি বুঝতে পারেন, শরদের জীবনে এখন যা ঘটছে, তা নিছক মানসিক বিভ্রম নয়—বরং এক দীর্ঘদিনের দমবন্ধ আত্মার আবেদন। সমর পালের অসমাপ্ত গান এখন খুঁজে ফিরছে একটি শরীর, একটি গলা, যেখান দিয়ে সে মুক্তির শেষ সুর গেয়ে যেতে পারে। নন্দিনী দাদারামের থেকে পায় সমর পালের জীবনের শেষ গানের কিছু পঙ্‌ক্তি, যা তাঁর গুরু শুনে লিখে রেখেছিলেন—তবে গানটি অসম্পূর্ণ ছিল। বাকি অংশ কেবল সমরের আত্মা জানত। পটচিত্রটি আরেকবার যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে নন্দিনীর—ছবির বাউল তার চোখে তাকিয়ে আছে, যেন বলছে, “আমার গানটা শেষ করে দাও… আমায় মুক্তি দাও…”।

অধ্যায় ৪: দেউলবাড়ি যাত্রা

নন্দিনী ঘোষের মনের ভিতরে তখন এক অদ্ভুত টানাপোড়েন—একদিকে যুক্তিবাদ, অন্যদিকে অনুভূতির নিঃশব্দ জোয়ার। কলেজের গবেষণাগারে বসে থেকে পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করা এক জিনিস, কিন্তু সত্যি সত্যিই অতৃপ্ত আত্মা, প্রেতসুর, অভিশপ্ত শিল্প—এসব কি বাস্তবে সম্ভব? তবু শরদ রায়ের পটচিত্র থেকে আসা সেই গানের ধ্বনি, তাঁর ভিতরে জন্ম নেওয়া অস্বাভাবিক আবেশ, আর দাদারাম মল্লিকের বলা সমর পালের মৃত্যু-কাহিনি—সব একে অন্যকে এমনভাবে জুড়ে বসেছে যেন এই কাহিনি কেবল গল্প নয়, বরং বাস্তবের কোনো একটি পরতে আটকে থাকা অসমাপ্ত ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার জন্যই নন্দিনী আবার যান দেউলবাড়ি—এইবার এক গবেষক নয়, বরং একজন সাক্ষী হয়ে, যিনি শুধু জানতেই চান না, সেই ইতিহাসের ভিতরে নিজেকেও ঢুকিয়ে দিতে চান।

গ্রাম তখন চৈত্রের শেষ দুপুরে ঝিমোচ্ছে। ধুলোমাখা সরু রাস্তা, পেছনে হাঁসের ডাক, আর কচি পাতার হাওয়ায় যেন বারবার ফিরে আসছে সেই সুর—যেটা শরদের বাড়ির ঘরে রাতভর বাজে। দাদারাম মল্লিক এবার একটু খোলামেলা কথা বলেন। তিনি বলেন, “আপনাদের শরদ বাবু যা দেখেছেন, যা শুনেছেন—তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমর পালের আত্মা ছবির মধ্যেই আছে, আমরা কেউই তা অস্বীকার করি না। অনেক বছর আগে একজন শিল্পী সেই ছবি আঁকেন। তবে যে রঙে আঁকা হয়েছিল, তা ছিল মরা মানুষের শরীর থেকে তৈরি করা আলকাতরা আর গানের থালায় জমে থাকা সুরের ছাপ—তাই ওটা শিল্প নয়, ওটা একধরনের বন্ধন। আত্মা আঁকা থাকলে, ছবি কাঁদে, গান গায়, ডাকেও।”

নন্দিনী বিস্মিত হয়ে শোনেন সবটা। তিনি জানতে চান, সমরের শেষ গানটা কী ছিল? দাদারাম বলেন, “গানটা সমর পাল শুরু করেছিলেন এক পূর্ণিমা রাতে। কিন্তু তার আগেই গ্রামের লোকেরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর মুখ থামিয়ে দেয় চিরতরে। কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে খুন—কিন্তু আমরা জানি, সে রাত থেকে সমর আর শান্তি পায়নি।” বৃদ্ধ উঠে গিয়ে ঘরের এক কোণা থেকে একটা পুরনো খাতা বের করেন—যার পৃষ্ঠায় লেখা সমরের অসমাপ্ত গানের কিছু লাইন:
“ঘর ছেড়েছি মন বাউল হইতে…
জন্মভূমির মাটি বলে—থামিস না রে পাগল…”

তবে এই লাইনগুলোর পরে আর কিছু নেই। কালি ফুরিয়ে গেছে, অথবা বাউলের কণ্ঠ বন্ধ হয়েছে। নন্দিনীর মনে তখন একটাই প্রশ্ন—এই অসমাপ্ত গান কি সম্পূর্ণ করা সম্ভব? আর যদি তা হয়, তবে সেটা কি সমরের আত্মাকে মুক্তি দিতে পারে?

দেউলবাড়ির পুকুরঘাটে বসে নন্দিনী নিজের ফোনে শরদের পাঠানো পটচিত্রের ছবি বারবার দেখেন। ছবির বাউলের চোখ যেন এখন আরও বেশি করে তাঁকে অনুরোধ করছে—“আমায় শেষবারের মতো গাইতে দাও…”। পুকুরঘাটের জলে প্রতিফলিত হয় এক অদ্ভুত আলো, আর তখনই গ্রামের এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়ান তাঁর পাশে। মুখে বলিরেখা, কিন্তু চোখে রহস্য। তিনি বলেন, “ও গান আবার গাওয়া হলে গ্রামের অভিশাপ ভাঙবে। আপনি পারবেন?”
নন্দিনী নিরুত্তরে তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। ভেতরে কোথাও যেন সমরের সেই অসমাপ্ত সুর ধীরে ধীরে জমে উঠছে—এক গানের টুকরো, যা শুধু গাওয়া নয়, বরং অনুভব করা দরকার। এই যাত্রা আর গবেষণা নয়—এ এক আত্মা আর আত্মার গল্পের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রজন্মের প্রতিনিধি, যে সত্যি চাইছে—গানের মধ্যে দিয়ে কেউ পাবে শান্তি, কেউ পাবে মুক্তি, আর কেউ একজন… পাবে পরিত্রাণ।

অধ্যায় ৫: আগুনের রাত

কলকাতার গ্রীষ্মের রাতগুলোর মধ্যে একটি অদ্ভুত ভার থাকে—নিরবতা যেন বোঝা হয়ে ঘরে নামে, বাতাসে জমে থাকে ঘামের গন্ধ, আর কোথাও যেন এক অনুচ্চারিত অস্থিরতা ধীরে ধীরে জমতে থাকে দেয়ালের ফাটলে, ঘড়ির কাঁটার নিচে। সেই রাতেও শরদ রায় নিজের পড়ার ঘরে বসে ছিল। ঘর অন্ধকার, শুধু পটচিত্রের উপর একটা নরম ল্যাম্পজ্বলা আলো। সে একটানা তাকিয়ে ছিল ছবিটির দিকে। ছবির বাউলের চোখে যেন দিনদিন পরিবর্তন আসছিল—আজ রাতেও সেই চোখে ছিল এক ধরনের জ্বলন্ত আকুতি, আর এক করুণ অভিমান। শরদ জানে, সে এখন আর সম্পূর্ণ নিজে নেই—তার ভেতরে কোথাও যেন বাসা বেঁধেছে অন্য কেউ, অন্য কোনো সময়ের গান, অন্য এক আত্মা।

হঠাৎ করেই যেন সে অনুভব করল—ঘরের তাপমাত্রা কিছুটা কমে গেছে, বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। পটচিত্রের সামনে সে বসে নিজের ডেস্ক থেকে একটা পুরনো একতারা তুলে নিল, যেটা সে কলেজ জীবনে শখ করে কিনেছিল, কিন্তু কোনোদিন বাজায়নি। তার আঙুল স্বতঃস্ফূর্তভাবে নড়ে উঠল—এক অজানা সুর বাজতে শুরু করল, যার উৎস শরদের জানা নেই। গলার ভেতর থেকে উঠে এলো এক সুর—নামহীন, ভাষাহীন, অথচ তীব্রভাবে জীবন্ত। শরদ যেন নিজেই বুঝে উঠতে পারল না, সে এখন গান গাইছে না—বরং কারো হয়ে গাইছে, যেন তার গলায় কথা বলছে এক মৃত আত্মা। ঘরের বাতাস হঠাৎ করে ভারী হয়ে এল, দেয়ালে ঝোলানো ছবির মধ্য থেকে বেরিয়ে এল এক ধোঁয়াচ্ছন্ন ছায়া, যেটা ধীরে ধীরে পুরো ঘরটাকে ঢেকে ফেলল। এক মুহূর্তে পটচিত্রের চোখ জ্বলে উঠল লালচে আলোয়—আর ঘরের জানালা, দরজা, সব যেন নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের বাইরে বৃষ্টি পড়ছে না, কিন্তু জানালার কাঁচের ওপারে টিপটিপ জলের ছাপ—যেন কেউ বা কিছু তাকিয়ে আছে বাইরে থেকে।

তখনই ঘটে গেল অদ্ভুত ঘটনা—শরদ এক মুহূর্তে দেখে, সে আর নিজের পড়ার ঘরে নেই। সে বসে আছে এক মাটির উঠোনে, তার সামনে কয়েকজন শ্রোতা, হাতে একতারা, তার গলায় সেই একই সুর। সামনে চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে বাউল সমর পাল—তার চোখে জল, ঠোঁটে হাসি, আর পিছনে পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে সেই জমিদারের মানুষরা, যারা তাকে মেরেছিল। মুহূর্তেই দৃশ্যটা পাল্টে গেল—সমর পড়ে যাচ্ছে, মাটির ওপর রক্ত, আর পেছন থেকে একটা স্বর বলছে, “আমার গান শেষ হয়নি… কেউ গাও… কেউ একবার গাও…”। শরদ চেঁচিয়ে ওঠে, ঘরের ভিতর থেকে সে যেন নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে চায়, কিন্তু পারছে না। চোখ খুলে দেখে, আবার সে নিজের ঘরে ফিরে এসেছে, ঘরের এক কোণায় আগুন লেগেছে—ছবির ফ্রেম থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, কিন্তু ছবি তবু ঝলসে যাচ্ছে না। তার হাতে তখনও একতারা, গলায় কাঁপতে থাকা আধা গাওয়া সেই সুর।

ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ে নন্দিনী। ঘর খুলে দেখে—শরদের মুখ ঘেমে ভিজে গেছে, ঠোঁট ফাঁকা গানে নড়ে চলেছে, আর চোখদুটি জ্বলছে অন্য এক আলোর ছটায়। নন্দিনী দ্রুত ছবি নামিয়ে ফেলে, ঠান্ডা জল ছিটিয়ে শরদের স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে শরদ জ্ঞান ফিরে পায়, এবং বলে—”আমি গানটা গাইছিলাম… কিন্তু শেষ করতে পারলাম না… কেউ কাঁদছিল… আমার গলার ভেতর…”। নন্দিনী তাকিয়ে দেখে, ছবির মধ্যে বাউলের চোখ এখন বন্ধ, মুখে মৃদু হাসি। যেন সে প্রশান্তির ঘুমে গেছে, কিন্তু ঘুমটা এখনও শেষ হয়নি—গানটা এখনও অসম্পূর্ণ।

সেই রাত ছিল শরদ রায়ের জীবনের প্রথম পূর্ণ অভিশপ্ত সংলাপ—যেখানে বাস্তব আর অলৌকিক একে অপরের সীমানা মুছে দিয়েছিল। সেই আগুনের রাতের শেষে শুধুই রয়ে গেল অসম্পূর্ণ একটি সুর, এক গভীর রাতের ভয়, আর একটি প্রশ্ন—কে গাইবে সেই অসমাপ্ত গান? কে দেবে সমর পালের আত্মাকে শেষবারের মতো মুক্তি?

অধ্যায় ৬: সমরের মৃত্যু

পরদিন সকালে নন্দিনী ঘোষ খুব ভোরেই উঠে পড়েন। ঘুম তাঁর ঠিকঠাক হয়নি—গতরাতের আগুন, শরদের অচেনা সুর, আর পটচিত্রের সেই চোখদুটি এখনও যেন দৃষ্টি রেখেছে তাঁর উপর। নন্দিনী জানতেন, এবার আর সময় নষ্ট করার উপায় নেই। সমর পালের মৃত্যুর সঠিক ইতিহাস না জানলে পটচিত্রের মধ্যে আটকে থাকা অভিশাপ থেকে কেউ মুক্তি পাবে না। শরদ রায়ের শরীরের উপরে এই আত্মিক প্রভাব দিনের পর দিন বাড়ছে, সে যেন ধীরে ধীরে সমর পালের অস্তিত্বে মিশে যাচ্ছে। সময় এসেছে, গভীরে ঢোকার।

তিনি ফের যান দেউলবাড়ি—এইবার এক দমে পৌঁছান সরাসরি দাদারাম মল্লিকের কাছে নয়, বরং গ্রামের সেই পুরোনো পাঠশালার দোতলার ঘরে, যেখানে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ভগীরথ ঘোষাল। ভগীরথ বাবু একসময় গ্রামের ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছিলেন, অনেক পুরনো দলিলও সংগ্রহ করে রেখেছেন। নন্দিনী তাঁর সামনে পটচিত্রের প্রিন্টআউট আর সমরের অসমাপ্ত গানের পঙ্‌ক্তিগুলো রাখেন। ভগীরথবাবু চুপ করে ছিলেন খানিকক্ষণ, তারপর যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “সমর পাল? ও নাম তো এখন আর কেউ নেয় না। ও ছিল এক বাউল, পাগল, প্রেমিক—আর শেষে… এক অভিশপ্ত আত্মা।”

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে এক কাঠের সিন্দুক থেকে বের করেন পুরনো কাগজ, ডায়েরি, এবং একটা বিবর্ণ সাদা-কালো ছবি—যেখানে দেখা যাচ্ছে এক দীর্ঘদেহী মানুষ, চোখে সোজাসুজি তাকানো দৃষ্টি, হাতে একতারা। “এইটা সমরের একমাত্র তোলা ছবি,” বলেন ভগীরথবাবু। “এই গ্রাম তাকে ভয় পেত। কারণ ওর গলায় ছিল এমন সুর, যা শুনলে মেয়েরা কাঁদত, পুরুষেরা অস্থির হয়ে উঠত। ওর গান ছিল সাধনার মতো, একেবারে তলদেশ থেকে উঠে আসা—কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল—ও ভালোবেসেছিল জমিদারের মেয়ে চারুলতা সেনকে।”

নন্দিনীর গলা শুকিয়ে এল। এই প্রথম চারুলতার কথা শুনছেন। ভগীরথবাবু বলেন, “সমর আর চারুলতার ভালোবাসা পুরো গ্রাম জানত। কিন্তু জমিদার করুণাসিংহ তা মেনে নেয়নি। এক রাতে, পূর্ণিমা, সমর যখন তাঁর নতুন গান শুরু করেছিল মাঠের মাঝে, তখনই কয়েকজন লাঠিয়াল এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। কেউ বলে পিটিয়ে মারে, কেউ বলে তাকে গাছে বেঁধে ফেলে। শেষমেশ তার দেহ ফেলে দেওয়া হয় জমিদার বাড়ির পুকুরে। পরদিন সকালে সেই পুকুরের জলে ছিল কেবল তার একতারা আর গানের চোঙা। চারুলতা তারপর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বছরখানেক পর তারও মৃত্যু হয়।”

ভগীরথবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, “কিন্তু, সমরের আত্মা শান্তি পায়নি। জমিদারবাড়িতে এরপর একের পর এক অশরীরী কান্ড ঘটতে থাকে। গানের আওয়াজ, রাতের বেলা পুকুরের ধারে ভেসে ওঠা ছায়া। তখন একজন পটচিত্র শিল্পী সেই ঘটনার ভিত্তিতে আঁকেন সমরের প্রতিচ্ছবি—যা আপনি আজ নিয়ে এসেছেন।”

নন্দিনী স্তব্ধ হয়ে থাকেন। তার মাথার ভেতরে তখন যেন একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে—সমরের একতারা, চারুলতার চোখের জল, পুকুরের জলের নীচে থেমে থাকা সুর, আর ছবির ভিতর আটকে পড়া আত্মা। সমস্ত গল্পটা যেন এক অনন্ত অভিশাপের মধ্যে আবদ্ধ, যেটার শেষ তখনই সম্ভব, যদি কেউ সমরের সেই অসমাপ্ত গান গেয়ে শেষ করতে পারে—ঠিক যেভাবে সে সেই রাতে গাইছিল।

ফিরে আসার সময় পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে নন্দিনী অনুভব করেন বাতাস ভারী হয়ে এসেছে। জলের উপর ছায়া ভেসে আছে, যেন কেউ স্নান সেরে উঠে আসছে। হঠাৎই তাঁর কানে আবার ভেসে আসে সেই গান—কিন্তু এবার স্পষ্ট, একটু দূর থেকে, যেন ঘাসে বসে কেউ গাইছে। নন্দিনী জানেন, আর সময় নেই। শরদ রায় এখন সেই পাত্র, যার মাধ্যমে সমরের আত্মা গান গেয়ে যেতে চায়। আর তাঁকে—নন্দিনীকে, সেই গানটি সম্পূর্ণ করতেই হবে, যতই অসম্ভব হোক না কেন।

অধ্যায় ৭: অধরা আত্মা

ঘরে ফিরে নন্দিনী শরদ রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তাঁর চোখে যেন ঠিকরে পড়ছিল গভীর শূন্যতা, একটা দীর্ঘ রাতের জেগে থাকা ক্লান্তি, আর এক নিঃশব্দ আকুতি। শরদের দৃষ্টিতে আজ আর আগের মতো জীবনের স্পষ্টতা নেই—যেন চোখ দুটো অন্য কারও, যেন ভিতর থেকে তাকিয়ে আছে এমন কেউ, যে এই সময়ের নয়। নন্দিনী বুঝলেন—সমর পালের আত্মা শরদের দেহে প্রবেশ করেছে, অথবা তাকে আশ্রয় করেছে একরকমের ‘মাধ্যম’ হিসেবে। শরদ বারবার বলতে থাকেন, “আমি গাইছিলাম… মনে হচ্ছিল, আমি জানি গানটা… শেষ লাইনটা আমার মুখেই ঘুরছিল, কিন্তু কেউ আমাকে থামিয়ে দিল…”

নন্দিনী তাঁর কাঁধে হাত রাখেন। “তুমি জানো না, শরদ, তুমি আসলে একজন আত্মার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছো। এই পটচিত্রের মধ্যে আটকে থাকা সমরের আত্মা তোমার ভেতর দিয়ে তার অসমাপ্ত গানটা গাইতে চায়।” শরদ চুপ করে শোনে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আমি কাউকে দেখেছি… একটা মেয়ে… সাদা শাড়ি পরে… খুব কাঁদছিল… সেই রাতে যখন আমি চোখ বন্ধ করে গান গাইছিলাম, সে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি গান থামাতেই সে মিলিয়ে গেল।” নন্দিনী আঁতকে ওঠে। এ কি তাহলে চারুলতা সেন? সমরের ভালোবাসা, যার মৃত্যুও ছিল বেদনাদায়ক? তাহলে এই আত্মিক যাত্রায় শুধু সমর নয়, চারুলতার আত্মাও কি আটকে আছে?

শরদের মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে পরদিন থেকেই। তাঁর ঘুমের মাঝে মুখে এক অচেনা ভাষা ভেসে ওঠে—যা বাংলা হলেও যেন পুরনো দিনের কোনো উচ্চারণ। চোখের পাতা পড়লে মুখে ফুটে ওঠে এক গভীর অনুরাগ, এক বিষণ্ণতা। দুপুরবেলা হঠাৎ করে ঘরের জানালার পাশে বসে একতারা হাতে গান গেয়ে ওঠেন তিনি, যা শুনে পাড়ার কুকুরেরা চুপ করে যায়। সেই সুর রেকর্ড করে নন্দিনী শুনে শিউরে ওঠেন—কারণ সেই সুরই তিনি শুনেছিলেন দেউলবাড়ির পুকুরঘাটে। শরদ এখন শুধু শরদ নন, তিনি হয়ে উঠেছেন এক জীবন্ত সেতু—যার ভেতর দিয়ে অতীত আর বর্তমান, মৃত্যু আর জীবনের সীমারেখা মুছে যাচ্ছে।

নন্দিনী একটি সিদ্ধান্ত নেন—এই অভিশাপ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে সমর পালের অসমাপ্ত গানটি সম্পূর্ণ করে গাওয়া। তাঁর ধারণা, এই গানটিকে পূর্ণরূপে গাওয়া হলে সমরের আত্মা শান্তি পাবে, এবং শরদের শরীরেও ফিরে আসবে স্বাভাবিকতা। তিনি দাদারাম মল্লিক, ভগীরথবাবু এবং কলকাতার এক লোকসঙ্গীত গবেষকের সহায়তায় গানের পঙ্‌ক্তিগুলোর পূর্ণতা খুঁজে বার করতে থাকেন। তাঁদের ধারণা অনুযায়ী সমরের গানে যেমন আত্মত্যাগ ছিল, তেমনই ছিল প্রেম, মুক্তি আর বিরহের রস। তাই গানটা যে কেবল সুরে গাওয়া যাবে তা নয়, তার অন্তরের অনুভব না এলে সে গান শুধু শব্দই থাকবে—সুর হবে না।

এই সময় শরদের শরীরে প্রতিদিন কিছু অদ্ভুত লক্ষণ দেখা যায়। কোনোদিন সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেঁদে ওঠে, আবার কোনোদিন নিজেকে আয়নায় দেখে প্রশ্ন করে, “আমি কে?” তাঁর হাতে একতারা জড়িয়ে থাকে ঘুমের মধ্যেও। খাবার খেতে ইচ্ছে করে না, চোখে আলো সহ্য হয় না। ছবির পটচিত্রটাও এখন যেন পাল্টে যাচ্ছে—আগে যেখানে চোখে ছিল অনুরোধ, এখন সেখানে ধীরে ধীরে আসছে হতাশা, যেন বারবার বলছে, “সময়ের ভিতর আমি আর আটকে থাকতে পারি না…”

নন্দিনী বুঝতে পারেন, সময় শেষের দিকে। পটচিত্রের অভিশাপ এখন শুধু শরদের শরীর নয়—তার আত্মাও গ্রাস করতে চলেছে। যদি গানটি সম্পূর্ণ না করা যায়, তাহলে শরদ চিরতরের জন্য হারিয়ে যাবে, আর সমরের আত্মাও আটকে থাকবে সেই অনন্ত বৃত্তে।

অধ্যায় ৮: শেষ সুরের সন্ধানে

কলকাতার মেঘলা সন্ধ্যা ধীরে ধীরে নেমে আসছিল শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোর উপর। নন্দিনী ঘোষ একটার পর একটা লোকসংগীত পাণ্ডুলিপি, গবেষণা প্রবন্ধ, আর বাউল-ফকির গানের রেকর্ড ঘেঁটে চলেছেন গলদঘর্ম হয়ে। তাঁর মাথার মধ্যে তখন কেবলই ঘুরছে একটি অসমাপ্ত গান—সমর পালের সেই আত্মিক আহ্বান, যা প্রতি রাতে শরদ রায়ের শরীরে প্রবেশ করে তাকে আরেক সত্তায় পরিণত করছে।

দাদারাম মল্লিকের পুরনো খাতার সূত্র ধরে নন্দিনী বুঝতে পারেন, সমর পালের গানটি ছিল আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার শেষ আহ্বান—এক এমন সময়ের চিহ্ন, যেখানে কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু সুর হারায়নি। পুরনো পঙ্‌ক্তিগুলো ছিল আধ্যাত্মিকতায় ভরা:
“ঘর ছাড়েছি মন বাউল হইতে
জন্মভূমির মাটি বলে—থামিস না রে পাগল
সুরের ভিতর শ্বাস পড়ে আজও
প্রেম ছিল বলেই আমি মরিনি আগল…”

কিন্তু এর পরে? শেষ পঙ্‌ক্তিগুলো? কেউ জানে না। তাই নন্দিনী ছুটে যান শান্তিনিকেতনের এক বয়স্ক বাউল-গায়ক সদানন্দ পাগলার কাছে, যিনি একমাত্র মানুষ হতে পারেন যিনি সময়ের স্মৃতি দিয়ে গানকে অনুভব করতে পারেন। সদানন্দ পাগলা প্রথমে কিছু বলতে চান না, কিন্তু পটচিত্রের ছবি দেখিয়ে যখন নন্দিনী তাঁকে শরদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন, তখন তিনি গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করেন, যেন সেই সুর আবার মনে করছেন।

তারপর এক মুহূর্তে তিনি গেয়ে ওঠেন:
“তুই যেদিন আসবি সুরের পাড়ে,
আমি ওই রক্তজল নদী হইয়ে থাকব
তুই গাইলে আমি জেগে উঠব,
আর না গাইলে… বাঁচব না রে বাউল।”

সেই পঙ্‌ক্তিগুলো শুনে নন্দিনীর সারা শরীর কাঁপতে থাকে। সে জানে—এটাই সেই গানটির শেষ সুর, শেষ প্রার্থনা। একটা আত্মা এই কথাগুলো বলেই চিরনিদ্রায় গিয়েছিল, কিন্তু তার কণ্ঠ ছিল স্তব্ধ। সেই কণ্ঠকেই এখন গলা দিতে হবে, গাইতে হবে, মুক্তি দিতে হবে।

নন্দিনী কলকাতায় ফিরে এসে শরদ রায়ের সঙ্গে বসে। শরদের শরীর তখন অদ্ভুত রকম শান্ত, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে—তবে সেই আগুনে আর আতঙ্ক নেই, আছে অপেক্ষা। নন্দিনী বলে, “তুমি পারবে?” শরদ শুধু মাথা নেড়ে বলে, “ও গানটা আমার ভেতরেই আছে… আমি শুধু শব্দ খুঁজছিলাম…”

পরদিন রাত ঠিক ১২টা। পুরো ঘর নিঃশব্দ, কেবল একতারা আর খঞ্জনির নরম শব্দ। শরদ ধীরে ধীরে গাইতে শুরু করেন—প্রথমে সেই পুরনো পঙ্‌ক্তিগুলো, যেগুলো তাঁর গলার মধ্য দিয়ে এমনভাবে বেরোয়, যেন বহুদিন পর ঘুম ভেঙেছে কোনো সুর। তারপর আসে সদানন্দ পাগলার শেখানো সেই শেষ পঙ্‌ক্তি—
“তুই গাইলে আমি জেগে উঠব,
আর না গাইলে… বাঁচব না রে বাউল।”

ঠিক তখনই, পটচিত্রের মধ্যে একটা আলো জ্বলে ওঠে—না, আগুনের নয়, বরং যেন সকালবেলার প্রথম আলো। ছবির বাউলের চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে যায়, যেন হাজার বছর পর সে শান্তিতে ঘুমোতে পারল। ঘরের বাতাস হঠাৎ হালকা হয়ে আসে, যেন এক ভার নেমে গেল দেওয়াল থেকে, জানালা থেকে, শরদের গলা থেকে।

শরদ ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে, চোখে জল। নন্দিনী চুপ করে তাঁর পাশে বসে। কোনো শব্দ নেই, কোনো ভয় নেই, শুধু আছে শান্তি। পটচিত্রের অভিশাপ ভেঙে গেছে। সমর পাল এখন আর ছবি নয়—সে পরিত্রাণ পেয়েছে, তার সুর সম্পূর্ণ হয়েছে।

অধ্যায় ৯: চারুলতার প্রতীক্ষা

সমর পালের আত্মা মুক্তি পেলেও, ঘরে তখনও একটা নিঃশব্দ অপেক্ষা রয়ে গিয়েছিল। শরদ রায় এখন আগের চেয়ে অনেক শান্ত, সুস্থ এবং স্থির, কিন্তু তাঁর চোখের ভেতর যেন কোথাও লুকিয়ে আছে এক অসমাপ্ত যাত্রার ছায়া। পটচিত্রটি এখন আর ভয়ঙ্কর নয়—দেয়ালের উপর ঝুলে আছে নিঃশ্বাসবিহীন এক শিল্প, যার চোখ বন্ধ, ঠোঁটে ক্লান্ত প্রশান্তি। কিন্তু এই শান্তির মধ্যেও নন্দিনী উপলব্ধি করেন—সবকিছু শেষ হয়নি। সমরের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে যেন কিছু একটার দরজা খুলে গেছে, আর সেই দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি আত্মা—নিঃসঙ্গ, অপেক্ষমাণ, এবং বেদনায় নিমগ্ন।

এক রাতে শরদ স্বপ্নে দেখতে পান—পুকুরের ধারে বসে আছে এক মেয়ে, সাদা শাড়ি, কপালে ছোট্ট টিপ, আর চোখে অদ্ভুত এক স্নিগ্ধ বিষণ্ণতা। সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, বলে, “সে গান গেয়েছে, তাই সে মুক্তি পেয়েছে… কিন্তু আমার কথা কেউ শোনেনি। আমার প্রতীক্ষা তো এখনও শেষ হয়নি।” শরদ উঠে বসেন ঘামেভেজা গায়ে। পটচিত্রের দিকে তাকাতেই যেন দেয়ালের ছায়ার মাঝে সেই মেয়েটির অবয়ব মিলে যায়—চারুলতা সেন!

নন্দিনী এইবার সিদ্ধান্ত নেন—সমরের গল্পের মধ্যে চারুলতাকে বাদ দেওয়া যায় না। প্রেম কেবল আত্মা ছুঁয়ে গেলেই সম্পূর্ণ হয় না, সেখানে অপেক্ষার গভীরতাও থাকে। তিনি আবার ফিরে যান দেউলবাড়ি, এবং খোঁজ করেন জমিদার বাড়ির পুরনো ইতিহাস, যেখানে পাওয়া যায় চারুলতার মৃত্যুর রেকর্ড—“শরীরিক অস্থিরতার কারণে আত্মহনন, মৃত্যুকাল: পূর্ণিমা রাত, সমরের মৃত্যুর একবছর পরে।”

দাদারাম মল্লিক জানান, “চারুলতা নিজের ঘরে বসে রোজ সমরের গান গাইতেন। কেউ কেউ বলে, তিনি পটচিত্র আঁকায় হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু তার আঁকা কোনো ছবি পাওয়া যায়নি।” ভগীরথবাবুও বলেন, “সমরের আত্মা হয়তো পটচিত্রে বন্দি ছিল, কিন্তু চারুলতার আত্মা কোথাও যায়নি… সে ছিল ‘প্রতীক্ষা’র আত্মা… যে এখনো চায় দেখা, সংলাপ, অথবা অন্তত বিদায়।”

নন্দিনী বুঝে ফেলেন—সমর তো নিজের গান শেষ করেছে, কিন্তু চারুলতা তো তার গান শুনতে পারেনি। সে এখনও অপেক্ষায়, পুকুরঘাটে বসে, কিংবা পটচিত্রের অন্ধকার কোণায়, কিংবা শরদের স্বপ্নের মধ্যে—যেখানে সে বারবার বলে, “আমি আসিনি বিদায় নিতে… আমি এসেছিলাম শেষ সুর শোনার জন্য…”

তখনই মাথায় আসে এক ভাবনা—পটচিত্রে যদি সমরের মুখ আঁকা থাকে, তাহলে আরেকটি পটচিত্রের প্রয়োজন—যেখানে থাকবে চারুলতার প্রতিচ্ছবি, যাতে সেই গান শুনতে পেয়ে তাঁর আত্মাও যেতে পারে মুক্তির পথে। দাদারাম মল্লিক রাজি হন একটি বিশেষ পটচিত্র আঁকার কাজে—এই প্রথম, যেখানে সমরের পাশাপাশি চারুলতাকে আঁকা হবে, কিন্তু চোখ থাকবে তার খোলা, যেন সে শুনছে।

তিনদিনের মধ্যে ছবিটি প্রস্তুত হয়—ছবিতে দেখা যায় সমর একতারা হাতে গান গাইছে, আর চারুলতা পাশে বসে শুনছে—চোখে জল, ঠোঁটে শান্তি। ছবিটি শরদের ঘরে টানানো হয়, এবং সেদিন রাতেই ঘরে আসে এক অদ্ভুত বাতাসের স্পর্শ। পটচিত্র থেকে যেন ভেসে আসে এক মৃদু সুর, আর তারপর এক নিঃশব্দ হাসি—যেন কারো দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষ হলো।

পটচিত্রের সেই রাতে কারো ঘুম ভাঙেনি, কারো চিৎকার শোনা যায়নি—শুধু সকালে উঠে দেখা গেল, ছবির দুই মুখই এখন শান্ত। শরদ বলেন, “আমি শুনেছিলাম ওর কণ্ঠ… শেষবার… সে বলেছিল—‘এবার ভালোবাসার ইতি হল, এবার আমি যেতে পারি…’”

অধ্যায় ১০: শেষ পটের রঙ

বৃষ্টি নামছে ধীরে ধীরে। শহরের ছাদগুলোর উপর ঝরে পড়ছে এক স্নিগ্ধ নৈঃশব্দ্য। সেই ঘর—যেখানে একসময় পটচিত্রের চোখ থেকে ঝরে পড়ত অভিশাপ, আজ সেখানে শান্তি। শরদ রায় জানালার পাশে বসে আছেন, একতারা তাঁর কোলে। তিনি এখন আর সমর পাল নন, তবে সমরের সুর তাঁর ভিতর ছায়া হয়ে থেকে গেছে। ঘরের দেয়ালে টাঙানো দুটি পটচিত্র—একটিতে সমর, অন্যটিতে চারুলতা—আজ যেন কথা বলছে না, গান গাইছে না, কেবল তাকিয়ে আছে নিঃশব্দ প্রশান্তির দিকে, এক শেষ গন্তব্যের পথে।

নন্দিনী ঘোষ তাঁর শেষ নোটবুকের পাতায় লিখে চলেছেন—”পটচিত্রের অভিশাপ: লোকশিল্পে আত্মার বন্দিত্ব ও মুক্তির কাহিনি”। এই গবেষণা শুরু হয়েছিল এক অলৌকিক ঘটনায়, যেখানে যুক্তি আর বাস্তবতা প্রতিদিন মুখ থুবড়ে পড়েছিল চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এক অসমাপ্ত প্রেমগাথার কাছে। তিনি লিখেছেন, “একটা পটচিত্র কেবল রঙ ও তুলির কাজ নয়, কখনও কখনও তা হয়ে ওঠে আত্মার আবাস, অসমাপ্ত ভালোবাসার দিনলিপি। সমর পাল এবং চারুলতা সেনের গল্প আমাদের শিখিয়ে দেয়—প্রেম কখনও মরে না, তা শুধু অপেক্ষা করে, সুর খুঁজে নেয়, মাধ্যম বেছে নেয়… আর শেষে মুক্তি পায়।”

এই অভিজ্ঞতা নন্দিনীকে একদম বদলে দিয়েছে। আগে যেখানে তিনি শুধুই নথি, দলিল আর পাণ্ডুলিপির মধ্যে ইতিহাস খুঁজতেন, এখন বুঝতে শিখেছেন—ইতিহাস কেবল লিখিত নয়, বরং অনুভবনীয়। গ্রামের প্রাচীন গানের ধারা, পটচিত্রে আঁকা চোখের ভাষা, আর প্রেতসুরের ভিতরেও লুকিয়ে থাকতে পারে সত্য।

একদিন সকালে শরদ রায় তাঁকে বলেন, “পটচিত্র দুটো এখন আমি রাখব না। এগুলো একদিনের না, এগুলো এখন ইতিহাস। এগুলো কোনো সংগ্রহশালায় থাকা উচিত, যেখানে ওদের চোখ কেউ ভয় নয়, অনুভব নিয়ে দেখবে।” সেই কথা মতো, দুই পটচিত্র স্থান পায় শান্তিনিকেতনের এক লোকশিল্প সংগ্রহশালায়, যেখানে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা দাঁড়িয়ে পড়ে ওদের সামনে। কেউ শুধুই রঙ দেখে, কেউ খোঁজে গান, আর কেউ বুঝে ফেলে—এই দুটো চোখ আর ঠোঁট আসলে হাজার বছর ধরে বলা না-হওয়া ভালোবাসার শেষ সুর।

নন্দিনী তাঁর গবেষণার জন্য পুরস্কার পান, দেশ-বিদেশে সেমিনারে যান, কিন্তু হৃদয়ের এক কোণে থেকে যায় সেই পুকুরঘাট, সেই পটচিত্র, সেই গানের অসমাপ্তি, আর শরদের গলায় ভেসে ওঠা সুর। পটচিত্রের অভিশাপ না হয় ভেঙেছে, কিন্তু সেই অভিশপ্ত শিল্প আমাদের শেখায়—প্রেম শুধু শরীরের নয়, আত্মারও হয়, আর শিল্প সেই প্রেমকে বন্দি করে রেখে দেয় যুগের পর যুগ, যতক্ষণ না কেউ এসে তার শেষ সুর গেয়ে দেয়।

শেষ দৃশ্যে, নন্দিনী এক পাণ্ডুলিপির শেষ পাতায় লিখে রাখেন—
“যে ভালোবাসা শেষ হতে পারে না, সে প্রেত হয়ে ফিরে আসে,
আর যে গান থেমে যায়, সে অন্য কারো কণ্ঠ খুঁজে নেয়।
পটচিত্রটা এখন নিঃশব্দ… কিন্তু আমি জানি, সে চিরকাল গাইবে।”

সমাপ্ত

1000039063.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *