অনিরুদ্ধ গোস্বামী
পর্ব ১: ছাই ও প্রত্যাবর্তন
তালপুকুরে ফিরে আসার দিনটা কুয়াশায় ডুবে ছিল। সকালের আলোও যেন পায়ের নিচে পচে যাওয়া পাতা। বাস থেকে নামতেই একরাশ গন্ধ এসে নাকে লাগে—পুরনো ঘামের, সোঁদা মাটির, আর মৃত কিছু একটা। দেবদান মুখার্জি, একসময় নামকরা ডকুমেন্টারি নির্মাতা, এখন এক মানসিক ভাঙনের পর নিজেকে গুটিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তালপুকুরে তার ঠাকুরদার বাড়ি—এমন একটা জায়গা যেখানে কেউ আর থাকেনা, শুধু দেয়ালের ফাটলে সময় জমে আছে। সে একটা সাদা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রিকশা ধরে, রিকশাওয়ালা কিছু না বলে মাথা নিচু করে চালায়। যেন সে দেবদানকে দেখেই চিনে ফেলেছে, কিন্তু মুখে কিছু বলবে না। শহরটা কেমন যেন কুঁকড়ে আছে, বাতাসে কেমন একটা নিঃশব্দ সতর্কতা।
বাড়িতে পৌঁছে চাবি ঘোরানোর শব্দে যেন একটা ঘুমন্ত প্রাচীন পোকা জেগে উঠল। দরজাটা খুলতেই একঝাঁক ধুলো, বাতাসে অদ্ভুত এক শব্দ—জানালার খচখচ, মেঝেতে কারও হেঁটে যাওয়ার কল্পনা। দেওয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে কমলিনী দেবীর ছবি। ঠাকুরদার মা। যে একদিন নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। লোককথায় বলে—সেই সময়ই বাহুদি নদী শুকিয়ে যায়। কেউ বলে, সে নাকি নিঃস্বাশ মঠে শেষ পঞ্চমুখ সাধনায় অংশ নিয়েছিল। আর তারপরই তার অস্তিত্ব মুছে যায়।
দেবদান ঠিক বিশ্রামের জন্যই এসেছে। শহরের কোলাহল, মানুষের মুখ, সমস্ত কিছু থেকে দূরে। মানসিক হাসপাতালে কাটানো তিন মাস এখনও দগদগে। সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছিলেন—‘দেব, তোমাকে থামতে হবে। তোমার ক্যামেরা, তোমার কাহিনি—সব থামাও কিছুদিনের জন্য।’ দেবদান থামেনি। শুধু নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে এসেছে। তালপুকুর ছিল সেই সুযোগ।
বাড়ির পিছনের ঘরটা খোলার সময় সে আবিষ্কার করে একটা পুরনো ট্রাঙ্ক। খুলতেই কেমন একটা গন্ধ—মিশ্রিত ধূপ, শুকনো লং ও পুরনো কাগজের। একটা লাল সুতো দিয়ে বাঁধা ডায়েরি, চামড়ার মলাটে লেখা—‘মুখ যে দেখে, সে আর মুখ থাকে না।’ ভেতরে কমলিনী দেবীর হাতের লেখা, কালীঘাটি হস্তাক্ষর। পাতাগুলোয় আঁকা আছে বিভিন্ন মুদ্রা, পঞ্চমুখ শিবের পঞ্চ রূপ—সত্যজাতা, বামদেব, অঘোর, তৎপুরুষ, এবং পঞ্চম—ঈশান। কিন্তু ঈশানের মুখটা খালি, শূন্য। পাতায় লেখা, ‘ঈশান দেখা যায় না। ঈশান দেখে।’
রাত বাড়তেই শহরের অন্যরকম রূপ নেয়। নিঃস্বাশ মঠের দিকে তাকালেই দেখা যায়, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তি—নাকি কল্পনা। নদীর দিক থেকে ভেসে আসে শব্দ—জলের না, যেন কেউ হেঁটে যাচ্ছে শূন্য নদীর বুক দিয়ে। দেবদান জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ক্যামেরা চালু হয়ে যায় নিজে থেকে। স্ক্রিনে ফুটে ওঠে পাঁচটা আলো, একফ্রেমে। তার পরেই ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যায়। সে বাইরে যায়। কিছুই নেই। শুধু বাতাস আর গন্ধ—আগুনের, পোড়া মাটির।
পরদিন সকালে বাজারে গেলে সবাই তাকে চেনার ভান করে না চেনার। একজন বলল, “আপনি মুখার্জিবাড়ির? এখানে এতদিন পর কে ফেরে?” আরেকজন বলল, “আপনার প্রপিতামহীর ছায়া এখনো মঠের কাছে ঘোরে, শুনেছেন?” দেবদান হাসে। সে যুক্তিবাদী, এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু ডায়েরির পাতাগুলো যেন টানছে। সেই রাতে ঘুম আসে না। মেঝেতে বসে সে ডায়েরি পড়ে, একটার পর একটা চিত্র আঁকা চোখে ভেসে ওঠে।
তারপর সে দেখতে পায় নিজের হাতে একটা দাগ—চক্রের মতো, ঠিক সেইরকম যেটা কমলিনীর ডায়েরির এক পাতায় আঁকা আছে। প্রথমে ভাবে হয়তো কোনো ব্যাগের চাপ লেগেছে। কিন্তু পরদিন সেটা গাঢ় হয়ে ওঠে, আরেকটা দাগ দেখা যায় কাঁধে। সেই রাতেই, ঠিক তিনটে তেইশ মিনিটে, সে শুনতে পায় পাঁচটা ঘণ্টার শব্দ। একটার পর একটা—স্পষ্ট, ধাতব, যেন বাতাস কাঁপিয়ে দেয়। অথচ তালপুকুরের কোনো মন্দিরে ঘণ্টা নেই। নিঃস্বাশ মঠ, বহু বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ সেখানে যায় না। অথচ দেবদান জানে—সে ভুল শোনেনি।
কিন্তু ঘড়ি দেখে, ক্যামেরা চালায়—কিছুই রেকর্ড হয়নি। নিঃস্বাশ শব্দ ছাড়া। তখনি সে ডায়েরির একদম পেছনের পাতায় খুঁজে পায় একটা বাক্য—“ঘণ্টা বাজলে, মুখ ডাকে।”
তারপরের দিন এক মেয়ে এসে হাজির হয় বাড়ির সামনে। নাম ভৃষ্টি সেন। কলকাতা থেকে এসেছে, নারী তান্ত্রিক ইতিহাস নিয়ে রিসার্চ করছে। শুনে এসেছে কমলিনী দেবী ছিলেন ভারতের শেষ পঞ্চমুখ সাধিকা। তার কথায় ধরা পড়ে সে জানে অনেক কিছু—কমলিনীর শেষ রাত্রি, নিখোঁজ হওয়া, নদীর নিঃস্বতা, নিঃস্বাশ মঠের চুপচাপ নিঃশ্বাস।
ভৃষ্টি ধীরে ধীরে বলে, “আপনি জানেন না, আপনি নিজের অজান্তেই একটা চক্রে ঢুকে গেছেন। আপনার শরীরেই সেই চিহ্ন ফুটে উঠছে। এই সাধনা কোনও পুরুষের জন্য নয়। কিন্তু কারা যেন আপনাকে সেই পথেই টেনে নিচ্ছে। মনে রাখবেন—পঞ্চম মুখ দেখা যায় না, সে নিজেই দেখে।”
দেবদান ডায়েরি বন্ধ করে। বাইরে হঠাৎ করেই বাতাস থেমে যায়। যেন শহর এক মুহূর্তে নিঃশ্বাস ছাড়ে না।
দূরে কোথাও, তালপুকুরের ঘুমন্ত আকাশে, আবার বেজে ওঠে পাঁচটি নিঃশব্দ ঘণ্টা।
পর্ব ২: যে নদী তার নাম ভুলে গেছে
তালপুকুর শহরটার আসল চেহারা সন্ধ্যার পর বোঝা যায়। দিনের আলোয় সবকিছু যতটা মৃত মনে হয়, রাতে তা যেন ছায়ার আড়ালে জীবন্ত হয়ে ওঠে। দেবদান দ্বিতীয় রাতে ডায়েরির পাশে শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু ঘুম আসে না। ঘণ্টা বাজে না, তবু ঘরের ছাদে কোথা থেকে যেন টুপটাপ শব্দ আসে, যেন জল পড়ছে অথচ কোথাও ফোঁটা নেই। এমন সময় কেউ দরজায় কড়া নাড়ে।
ভৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে—হাতের মুঠোয় একটা পুরনো কাগজের রোল। চোখদুটি রোদে পোড়া, কণ্ঠস্বর নিচু, কিন্তু কথা বলার মধ্যে যেন এক আশ্চর্য জোর আছে। “আপনি দেবদান মুখার্জি? কমলিনী দেবীর বংশধর?” প্রশ্নটা শুনেই দেবদান হাসে, “তুমি কে? মিডিয়া থেকে কেউ না তো?” ভৃষ্টি মাথা নাড়ে, “আমি ইতিহাস নিয়ে কাজ করি। বিশেষ করে নারী তান্ত্রিকদের ওপর। আপনার প্রপিতামহী ছিলেন এক রহস্য—সেই রহস্য নিয়েই এসেছি।”
দেবদান দ্বিধায় পড়ে যায়, তবু ভৃষ্টিকে ড্রয়িংরুমে বসায়। ভৃষ্টি কাগজের রোলটা খুলে দেখায় একটা পুরনো ম্যাপ—তালপুকুরের। আঁকা হয়েছে ১৯৩৭ সালে। সেখানে পরিষ্কার লেখা—“বাহুদি নদী: প্রবাহমান।” অথচ এখন নদীটা নেই। শুকিয়ে গেছে বলেও না—নেই, যেন কোনোদিন ছিলই না। কেউ কেউ বলে ভূমিকম্প, কেউ বলে ব্রিটিশ ড্যাম প্রোজেক্ট, কিন্তু কোনোকিছুই খাটে না। দেবদান বলে, “তোমার গবেষণার সঙ্গে আমার বাড়ির সম্পর্ক কী?” ভৃষ্টি একটু চুপ করে বলে, “কমলিনী দেবী শেষ যে সাধনায় বসেন, সেটি ছিল ‘পঞ্চমুখী’ সাধনা। সেই সময়েই নদী মিলিয়ে যায়। শহরের ইতিহাস থেকে বাহুদি নদী মুছে যায়, ঠিক যেমন কমলিনী দেবী।”
দেবদান ডায়েরি বের করে দেয়। ভৃষ্টির চোখে অদ্ভুত উন্মাদনা—সে একটা একটা করে পাতা উল্টায়, যেন বহু বছর ধরে এই বইটার খোঁজেই ছিল। তারপর সে থেমে যায় এক পাতায়, যেখানে আঁকা আছে পাঁচটি প্রদীপ—চক্রাকারে বসানো। নিচে লেখা, “প্রথম রাত, ভূমিকা। পাঁচটি আলো জ্বালিয়ে মুখ আহ্বান।”
“আপনি এই প্রদীপগুলো দেখেছেন?” ভৃষ্টি জিজ্ঞাসা করে।
দেবদান একটু থেমে বলে, “হ্যাঁ… ক্যামেরায় ফুটে উঠেছিল। কিন্তু আমি তো সেটা রেকর্ড করিনি। নিজে থেকেই ক্যামেরা চালু হয়ে গিয়েছিল।” কথা বলতে বলতে তার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। ভৃষ্টি তার হাতে তাকায়—চিহ্নটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এবার সেটা শুধু রেখা নয়, চক্রাকারে ঘুরছে, যেন মুদ্রা।
ভৃষ্টি বলে, “আপনার শরীর প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। এই চিহ্ন প্রাচীন তান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী কেবলমাত্র তখনই দেখা দেয় যখন সাধকের শরীর ‘পথ’ হয়ে ওঠে—একটি বাহন, একটি পাত্র। আপনাকে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই সাধনায়। আপনি শুধু উত্তরসূরি নন, আপনি সম্ভবত সেই অসম্পূর্ণ চক্রের উপকরণ।”
দেবদান অস্বস্তিতে উঠে পড়ে। “তুমি অনেক বেশি জানো। এটা কি তোমার গবেষণা না অন্য কিছু?”
ভৃষ্টি মাথা নিচু করে বলে, “আমার ঠাকুরমা ছিলেন কমলিনীর শিষ্যা। আমি জানি সেই মঠে কী হয়েছিল। আমি জানি কেন পাঁচটি ঘণ্টা বাজে প্রতি রাত তিনটা তেইশে। আমি জানি পঞ্চম মুখ কখন জাগে। আর সবচেয়ে বেশি জানি… যে এই সাধনা কোনো পুরুষের জন্য নয়।”
দেবদান কিছু বলার আগেই তার পেছনের দেয়ালটা কাঁপে—এক মুহূর্তের জন্য যেন সেই পুরনো ঘড়ির কাচটা কেঁপে ওঠে। তিনি ঘুরে দেখেন, কিছু নেই। তবে ঘরের বাতাস বদলে গেছে। ঘাম জমে তার কপালে। ঠিক তখনই ভৃষ্টি মৃদু কণ্ঠে বলে, “আজ রাত থেকে পঞ্চ রাত শুরু হচ্ছে। কালরাত্রির প্রথম পর্ব। আপনি যদি এই প্রক্রিয়া থামাতে চান, এখনই সময়। নইলে… পঞ্চম মুখ জেগে উঠবে। আর তখন মুখ থাকবে না—থাকবে শুধু মুখে গিলে ফেলার ক্ষমতা।”
বাইরে হঠাৎ শোঁ শোঁ বাতাস বইতে শুরু করে। জানালার ফাঁক দিয়ে কিছু একটার গন্ধ ভেসে আসে—পোড়া ধূপ, শুকনো রক্ত, আর ভেজা মাটি। দেবদান হঠাৎ কেঁপে ওঠে। কারণ সে ঠিক শুনতে পায়—দূরে কোথাও বাজছে প্রথম ঘণ্টা।
পর্ব ৩: ডায়েরি ও ছুরির গন্ধ
দেবদান ঘুম থেকে জাগে এক অদ্ভুত ঘামের ভেতর। ঘরের বাতাস ভারী, যেন কোনও ধোঁয়ার মধ্যে সে শুয়ে ছিল। বিছানার পাশে পড়ে আছে কমলিনীর ডায়েরি—খোলা পাতায় লেখা, “আগুনের মুখে জল ঢেলো না। সে তখন ধোঁয়া হয়ে গিলে খাবে।” ঘুম ভেঙেই সে বুঝতে পারে—কিছু একটা বদলে গেছে। একটা শব্দ কানে বাজে, একঘেয়ে ফিসফাস, যেন কেউ ধ্যান করছে, আবার যেন একসাথে অনেক কণ্ঠস্বরে মন্ত্র পড়া হচ্ছে।
সে উঠে পড়ে, দেখে নিজের হাতে আরও একটি চিহ্ন—এইবার ত্রিকোণ আকারে। চামড়া জ্বলছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু আঁকা হচ্ছে হাড়ের ভিতর দিয়ে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে চেহারাটা কেমন যেন বিকৃত মনে হয়—চোখের তলায় কালি, ঠোঁট শুকিয়ে আসা, আর চোখে একধরনের জ্যোতি, যেটা তার নিজের নয়।
নিচতলার স্টোররুমটা বহুদিন খোলা হয়নি। আজ হঠাৎ করে যেন কিছু একটা টানতে থাকে দেবদানকে সেই দরজার দিকে। দরজাটা খুলতেই এক ঝাঁক ঠান্ডা বাতাস, পচা কাঠ আর পুরনো ধূপের গন্ধ। ঘরের এক কোণে একটা কাঠের বাক্স। ওপরে লাল কাপড়ের টুকরো। সে কাপড়টা সরাতেই একটা পুরনো তান্ত্রিক ছুরি, কালো হাতলে রক্তমাখা সাদা তুলোর গোঁজা। ছুরির নিচে আরেকটা পাতলা খাতা—ডায়েরিরই অন্য খণ্ড।
খাতার প্রথম পাতায় লেখা—“চতুর্থ রাত আমি পার করেছিলাম। পঞ্চমের মুখে পৌঁছানোর আগেই আমি ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু রক্ত আমার কথা মনে রেখেছে।”
দেবদান খাতার পাতাগুলো উল্টায়। প্রতিটি পৃষ্ঠায় একেকটা চক্র, মুদ্রা, ত্রিকোণ, তন্ত্রলিপি। কোনও কোনওটায় জলরঙে আঁকা মুখ—কিন্তু সবগুলো মুখ অসম্পূর্ণ। কোনো মুখে চোখ নেই, কোনো মুখ শুধু কান, আবার কোনও মুখে চোয়াল নেই কিন্তু দাঁত আছে।
ভৃষ্টি এসে পড়ে ঠিক তখনই। দরজা খোলা রেখেই সে ভিতরে ঢোকে, ছুরিটা দেখে তার মুখ শুকিয়ে যায়। “এটা এখানেই ছিল?” সে প্রশ্ন করে। দেবদান জবাব দেয় না। শুধু মাথা হেলে দেখায় খাতাটা। ভৃষ্টি বলেও না, চুপ করে পড়ে পড়ে দেখে। তারপর বলল, “এই ছুরিটা ব্যবহার হয়েছিল শেষ চক্রে। রক্ত দিয়ে ‘মুখ’ আহ্বান করা হয়। শুধু নিজের নয়—পুরনো রক্ত, বংশের রক্ত, স্মৃতির রক্ত।”
তারপর সে আচমকাই একটা কথা বলে—“আপনি জানেন, কমলিনী দেবী গর্ভবতী ছিলেন তখন?”
দেবদান যেন শ্বাস নিতে ভুলে যায়। “তুমি কী বলছো?”
ভৃষ্টি ধীরে বলে, “এই ডায়েরিতে একটা পাতায় লেখা আছে—পঞ্চম মুখ কাউকে গিলে না খেয়ে যদি পছন্দ করে, তাকে নিজের বাহক বানিয়ে নেয়। সেই বাহক তার মধ্য দিয়ে নতুন চক্র তৈরি করে। আপনি সেই চক্রেরই এক চিহ্ন। আপনার জন্ম কেবল শারীরিক নয়—আপনার আত্মা তৈরি হয়েছে মুখের স্পর্শে।”
তখনি ঘরের বাইরে কিছু একটা শব্দ হয়। যেন ধাতব কিছু পড়ে গেল। দুজনেই দৌড়ে ছুটে আসে বারান্দায়। কিন্তু বাইরে কেউ নেই। শুধু বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে পানের পাতা, পুরনো বৈদ্যুতিক খুঁটি আর শহরের নিঃসাড় নিরবতা।
ভৃষ্টি পেছনে ফিরে বলে, “আজ রাতটা প্রথম চক্র। আপনি যদি শুরু করেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। মাঝপথে থামলে যা হয়, তা কল্পনাও করতে পারবেন না। কারণ মুখ অর্ধেক চেয়ে থাকা সহ্য করতে পারে না। সেটা বা তো গিলে খাবে, নয় তো নিজের রূপ আপনাকে দিয়ে সম্পূর্ণ করাবে।”
দেবদান বলে, “তুমি বোঝো তো, এটা পাগলামি মনে হয়। কিন্তু তারপরেও, আমার শরীর… আমার স্বপ্ন… সব কিছু একসাথে বলছে—আমি এই পথ থেকে আর ফিরতে পারব না।”
ভৃষ্টি চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “তাহলে আজ রাতেই শুরু করো। পাঁচটি প্রদীপ, পূর্ব মুখে বসে, নির্জনে। মনে রেখো—প্রথম মুখ শুধু দেখে, বলে না কিছু। তার চোখে ধরা পড়লে, সে তোমাকে ছাড়বে না।”
সন্ধে নামে তালপুকুরে। মঠের দিক থেকে হাওয়ার গায়ে গন্ধ আসে—মাদারের, ঘৃতকুমারীর, আর পোড়া তেলের। দেবদান বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে দূরে নিঃস্বাশ মঠ। অন্ধকারের মধ্যে যেন কারও ছায়া বসে আছে মন্দিরের ছায়ায়। বা হয়তো সে নিজের ভবিষ্যৎ দেখছে। অথবা, নিজের অতীত?
দূরে কোথাও আবার সেই ঘণ্টা বাজে। এইবার একবার, শুধু একবার।
প্রথম মুখ জেগে উঠেছে।
পর্ব ৪: প্রথম রাত্রি — সময়ের দৃষ্টি
তালপুকুরে রাত নামলে বাতাস ঘনিয়ে আসে, ঠিক যেন চামড়ার উপর জলের স্তর পড়ে। দেবদান বারান্দায় বসে, সামনে রাখা পাঁচটি প্রদীপ—পুরোনো পিতলের, ভৃষ্টির আনা। মাটিতে আঁকা হয়েছে একটি চক্র, ডায়েরি অনুযায়ী। চক্রের মধ্যমণিতে বসে সে, পূর্বদিকে মুখ করে। হাতে মেঘরঙা কাপড় দিয়ে বাঁধা রক্তজবা ফুল, যা কমলিনী দেবী ব্যবহার করতেন। ঘরের মধ্যে আলো শুধু প্রদীপের। বাইরে কুকুরের ডাক কানে বাজে, তবে কোথাও যেন অদৃশ্য এক ছন্দে সাড়া দিচ্ছে তালপুকুর।
ঘণ্টা বাজে—রাত তিনটে তেইশ। প্রথম মুখের সময়। দেবদান চোখ বন্ধ করে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করে—যেমনটা ডায়েরিতে লেখা ছিল, “তৎপুরুষায় বিদমহে, মহাদেবায় ধীমহি…”। মন্ত্র তার মুখে কাঁপে, নিজের কণ্ঠস্বর তার নিজের মনে হয় না। যেন অন্য কেউ তার শরীর ব্যবহার করছে।
হঠাৎই বাতাসের শব্দ থেমে যায়। চারপাশটা নিঃস্তব্ধ। তার শরীর কেঁপে ওঠে। মাটির নিচ থেকে যেন কিছুর নড়াচড়া। প্রদীপের আলো ধীর ধীরে লম্বা হয়ে গিয়ে ছায়ার মতো নড়তে শুরু করে। এক মুহূর্তে সব আলো নিবে যায়, শুধু মাঝখানে থাকা পঞ্চম প্রদীপ জ্বলতে থাকে। তার আলোয় দেখা যায় চারদিকে ফিকে সাদা ধোঁয়া। ধোঁয়ার ভিতর কেউ যেন দাঁড়িয়ে, পাঁচটা ভিন্ন কায়া, কিন্তু সবগুলো মুখহীন।
দেবদান চোখ খুলতেই দেখে সে আর চক্রে নেই—তার চারপাশে সেই পাঁচটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে, আর মাঝখানে একটি পুরোনো দেওয়াল ঘড়ি, যার কাঁটা ঘুরছে না। সে কিছু বলতে যায়, গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। কিন্তু মনের ভেতর একটা কণ্ঠ—না পুরুষ, না নারী, না জ্যান্ত, না মৃত—বলে, “তুই সময়কে ডেকেছিস। সময় তোকে এখন দেখছে।”
তার চোখে ভেসে ওঠে একের পর এক দৃশ্য—সে শিশু, সে বৃদ্ধ, সে মৃত, আবার সে জন্ম নিচ্ছে। সব একসাথে, এক মুহূর্তে। তার নিজের মুখ টুকরো টুকরো হয়ে আয়নায় ভেঙে যাচ্ছে, আবার জোড়া লাগছে অন্য চেহারায়। ভৃষ্টি বলেছিল, “প্রথম মুখ শুধু দেখে।” এখন সে বুঝতে পারছে—এই মুখ সময়ের। এই মুখে মুখ নেই, আছে শুধু দৃষ্টি। আর সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়ালেই কেউ নিজের সময় হারিয়ে ফেলে।
প্রদীপের আলো হঠাৎই দপ করে নিভে যায়। চারপাশ অন্ধকার। তারপর এক বিকট শ্বাস নেওয়ার শব্দ। যেন কেউ তার খুব কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলছে। গলায় শীতলতা, পিঠে ভারী একটা চাপ। সে বুঝতে পারে, কেউ তার কানে ফিসফিস করছে—কিন্তু শব্দ নয়, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। যেন এক অদৃশ্য রূপ তার নাম নিচ্ছে, দেবদান… দেবদান… আবার… আরেক নামে—যা সে কোনোদিন শোনেনি।
সে চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়, পেছনে ঘুরে দেখে কিছু নেই। চারপাশে নিঝুম, ঘর আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। চক্রটা মুছে গেছে। কিন্তু মাটিতে কিছু লেখা—খুব সূক্ষ্ম অক্ষরে: “সময়ের মুখ তোকে দেখে ফেলেছে। এখন তুই আর সময়ের বাইরে নেই।”
সকাল হতে না হতেই দেবদান ভৃষ্টিকে ডাকে। ভৃষ্টি এসে দেখে তার চোখ রক্তবর্ণ। পেছনে ঘাড়ে লম্বা একটা দাগ—ডায়েরিতে থাকা ‘প্রথম দৃষ্টির চিহ্ন’-এর হুবহু। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “তুমি ফিরে এসেছ, এটা ভালো। কারণ কেউ কেউ ফেরে না। কেউ কেউ শুধু সময়ের কল্পনায় আটকে যায়, আর তারা শ্বাস নেয় ভবিষ্যতের ভিতর, হাঁটে অতীতের ছায়ায়।”
দেবদান জিজ্ঞাসা করে, “এইটা কি স্বপ্ন ছিল? না বাস্তব?” ভৃষ্টি মাথা নাড়ে। “এটা দুইয়ের মাঝামাঝি। এটা সাধনার প্রথম স্তর—যেখানে মুখ তোর পরিচিতি সরিয়ে দিয়ে তোকে সময়ের রঙে রাঙায়। এখন থেকে তুমি আর তুমি নও। তুমি সেই দরজার ছায়া, যেটা খুলেছে কিন্তু বন্ধ হয়নি।”
দেবদান বলে, “আমি… আমি দেখতে পাচ্ছি আগামি দৃশ্য। আমি জানি, তুমি এক্ষুণি কী বলবে। আমি জানি, পাঁচ মিনিট পরে মেঘ উঠবে। আমি জানি আজকের দিনটা কীভাবে শেষ হবে।” ভৃষ্টি শিউরে ওঠে। বলে, “তুমি ভবিষ্যতের মুদ্রা গিলে ফেলেছ। এখন তুমি শুধু পথিক নও, তুমি পথ।”
তালপুকুরের আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করে। দুপুরবেলা হঠাৎ রাতের মতো অন্ধকার। ভৃষ্টি জানায়, দ্বিতীয় রাত্রি শুরু হবে সেই রাতেই—“শ্বাসের আয়নায়”। দেবদান জানে, এখন সে থামতে পারবে না।
তার ভিতরে কিছু জেগে উঠেছে।
পাঁচটি ঘণ্টা বাজবে। কিন্তু শোনা যাবে না কান দিয়ে—শোনা যাবে রক্ত দিয়ে।
পর্ব ৫: দ্বিতীয় রাত্রি — শ্বাসের আয়না
রাতের তালপুকুর যেন এক শ্বাসে জমে থাকা নদী। বাতাস চলাচল করে না, পাতা নড়ে না, এমনকি কুকুরের ডাকও আসে না। সমস্ত কিছু স্তব্ধ, শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস যেন শহরের শরীর ঘিরে রয়েছে। দেবদান মেঝেতে বসে, তার সামনে একটি কাঁচের পাত্রে রাখা কালো ছাই। ডায়েরির নির্দেশ অনুসারে, এটি মঠের ধ্বংসাবশেষ থেকে আনা ছাই—পুরোনো শিবলিঙ্গ পুড়িয়ে বানানো, তন্ত্রজাগরণে ব্যবহৃত। ভৃষ্টি নিজে গিয়ে এনেছে, যদিও তার চোখে ছিল তীব্র অনিচ্ছা।
“এই রাত্রির নাম শ্বাসের আয়না,” ভৃষ্টি বলেছিল সন্ধ্যেবেলা, যখন তারা পুরোনো বাড়ির আলো নিভিয়ে নিচতলার ঘরটা তৈরি করছিল। “এই রাতে মুখ শ্বাস নেয় সাধকের ভিতর দিয়ে। যদি তুমি ভিতরটা খালি রাখতে না পারো, তাহলে মুখ শ্বাস নিয়েই থেমে যাবে না। সে ভিতরে ঢুকে যাবে, এবং তুমি নিজেই হয়ে উঠবে আয়না।”
দেবদান প্রস্তুত। না হওয়ার কোনো উপায় নেই। প্রথম রাত্রির অভিজ্ঞতা এখনও তার চোখের পেছনে জ্বলছে। সে এখন জানে—যা সে দেখছে, তা সময় নয়, বরং সময়ের বাইরে থাকা কিছু।
ঘর অন্ধকার। পাঁচটি প্রদীপ আবার প্রজ্বলিত। বাতাসের মাঝে মৃদু ধূপের গন্ধ—ভৃষ্টির আনা। এই ধূপ ব্যবহার করা হত শুধুমাত্র “জীর্ণ-তন্ত্র” উদ্দীপক হিসাবে, যেটা অজানা অস্তিত্বকে মৃদু জাগরণে এনে ঠেলে দিত মানুষের চেতনার গায়ে। দেবদান চোখ বন্ধ করে, ডায়েরির দ্বিতীয় চক্র অনুসারে ধ্যান শুরু করে। কপালে ছাই মেখে, হাতের তালুতে প্রতিফলন-মুদ্রা আঁকা—একটি গোল ঘূর্ণির মাঝে পাঁচটি রেখা, যেন পাঁকচক্র।
মন্ত্র শুরু হয় ধীরে ধীরে, তার কণ্ঠে শব্দ কমে আসে, নিঃশ্বাস বেড়ে যায়। “অঘোরে চ ভূতঘনপতি মহাদেবায় ধীমহি… ঈশানায় বিদ্মহে তৎপুরুষায়…” সে বারবার ঘুরিয়ে ফিরে এই মন্ত্র পড়তে থাকে। শব্দ মিশে যায় নিঃশ্বাসে। সে অনুভব করে—তার শ্বাস আর তার নয়।
শরীরে কাঁপুনি আসে না, বরং একধরনের শান্তি। তার সামনে রাখা আয়না—এক পুরনো ব্রোঞ্জ মিরর, ডায়েরির নির্দেশ মতো—তাকে প্রতিফলিত করে না। প্রথমে সে ভাবে এটা কেবল আলো কম থাকার কারণে, কিন্তু তারপরে সে বুঝতে পারে আয়নায় শুধু ছায়া আছে, মুখ নেই।
তার নিঃশ্বাস জমে ওঠে আয়নার কাচে। প্রথমে স্বাভাবিক। তারপর ছায়ায় আঁকা হতে থাকে কিছু চিহ্ন—একটা সর্পিল রেখা, তার পাশে একটা বৃত্ত, আর সেই বৃত্তের মাঝে চোখ। দেবদান চিৎকার করতে চায়, কিন্তু মুখ খোলে না। তার গলার ভেতর যেন জমে গেছে শ্বাস। সে আর নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না—শুধু নিতে পারছে।
চারদিক অন্ধকার। শুধু তার নিঃশ্বাস জমছে আয়নায়—আর প্রতিটি স্তরে ফুটে উঠছে একেকটি মুখ। পেছনে কেউ যেন ধীরে ধীরে হাঁটছে। কিন্তু কানে কোনো শব্দ নেই। শুধু অনুভব—ঘাড়ের কাছে কারও গাঢ় দৃষ্টি। আয়নার কাচ এবার কাঁপে, আর তার ভিতরে সে দেখে এক মুখ—না, পাঁচটি মুখ—একসাথে! যেন একটার পর একটা গলে যাচ্ছে অন্যটার মধ্যে। সে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু তার গলা দিয়ে শুধু বেরোয় একটা দীর্ঘ ফুঁ, যেমন কেউ মরার আগে ছাড়ে।
তখনি হঠাৎ করে বাতাস ছিঁড়ে এক বিকট শব্দ—আয়নাটা ফেটে পড়ে। কাচ ছিটকে যায় চারপাশে। ঘরের ভেতর একঝাঁক ধোঁয়া—ধূপ নয়, পুড়ে যাওয়া কিছুর গন্ধ। দেবদান পড়ে যায় মেঝেতে, আর দেখতে পায়—তার হাত, পিঠ, বুক—সবখানে সেই প্রতিফলন-মুদ্রা ফুটে উঠেছে, এবার রক্তে।
ভৃষ্টি দৌড়ে আসে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই থমকে যায়। ঘরে কুয়াশার মতো ধোঁয়া, কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দেবদান কাঁপছে, কিন্তু চোখদুটো স্থির। সে বলে, “আমি… আমার শ্বাস… আমার ভিতরে কেউ ছিল। আমি তাকিয়েছিলাম… আমি নিজেকে দেখিনি। আমি অন্য কাউকে দেখেছিলাম, যে আমি হয়ে উঠছিল।”
ভৃষ্টি তার মুখ স্পর্শ করে। ঠান্ডা, কিন্তু দৃষ্টি তীব্র। “তুমি ভিতরটা খালি রেখেছো। কিন্তু তার ফলে সেই ‘সে’ তোমার ভিতরে ঢুকেছে। এখন থেকে তুমি শুধু দেখবে না, তুমি প্রতিফলিত করবে। যারা তোমার চোখে তাকাবে, তারা নিজেদের ভয় পাবে। তুমি মুখ হয়ে উঠছো।”
“আমি নিজেকে আর চিনতে পারছি না,” দেবদান ফিসফিস করে। “ঘরের ভেতরে আয়না ছিল না, আমি জানি। কিন্তু তখন আমি… নিজের চেহারা দেখে কাঁদছিলাম—অথচ সেটা আমার চেহারা ছিল না।”
ভৃষ্টি তাকে চুপ করে জড়িয়ে ধরে। “এখনও সময় আছে, দেবদান। এখনই ছেড়ে দিলে… হয়তো তোমার মধ্যে থাকা ‘সে’ নিঃশ্বাস ফেলে অন্য দিকে চলে যাবে।”
দেবদান হাসে। ঠোঁটের কোণায় রক্ত জমে গেছে। “সে চলে যেতে চায় না। সে বলে, আমি তার আয়না, আর সে আমার মুখ।”
ঘরের বাইরে রাত গভীর হয়। তালপুকুর নিশ্চুপ। কোথাও আবার সেই ঘণ্টা বাজে—এইবার দু’বার।
পঞ্চমুখ সাধনার দ্বিতীয় স্তর সম্পন্ন।
আর দেবদান আর কেবল মানুষ নয়—সে এখন সময় ও প্রতিফলনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক শ্বাসহীন আয়না।
পর্ব ৬: তৃতীয় রাত্রি — আগুনের জিহ্বা
তালপুকুরে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। গাছের পাতাগুলো মরা পাখির মতো থেমে থাকে, আর দূরে কোথাও একটা মেঘ কাঁপে, কিন্তু বাজ পড়ে না। দেবদান জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দেখে—রাতের শহরটা যেন দমবন্ধ অবস্থায় আছে। বাতাস নেই, আলো নেই, শব্দ নেই। শুধু নিঃস্বাশ মঠের দিক থেকে ধীরে ধীরে উঠছে ধোঁয়া, যেন কেউ পুড়িয়ে চলেছে রাতের শরীর।
ভৃষ্টি এক কোণে বসে, ডায়েরির তৃতীয় পাতাটি হাতে ধরে। সেখানে আঁকা রয়েছে আগুনের ত্রিভুজ, তার মাঝখানে জিহ্বা, আর পাঁচটি ক্ষুদ্র বৃত্ত ঘিরে রেখেছে তাকে। পাতার নিচে লেখা—“তৃতীয় রাত্রিতে জিভ আগুন হয়ে ওঠে। কথা আর কথা থাকে না, জ্বলন্ত প্রতিশ্রুতি হয়ে শরীরে ছাপ ফেলে।”
“তুমি কথা বললে,” ভৃষ্টি বলে ধীরে, “আগুন শোনে। কিন্তু সেই আগুন জ্বালিয়ে দেয় মুখ। তোমার শব্দই তোমার শত্রু হবে আজ রাতে।”
দেবদান হাসে। “আজ যদি আমি নীরব থাকি, তাহলে কি আমি বাঁচবো?”
ভৃষ্টি জবাব দেয় না। শুধু চোখ তুলে বলে, “তুমি আগুনকে নীরবতায় ভুল বোঝাতে পারবে না। সে চায় স্বর, চায় ফিসফাস, চায় হাহাকার। নীরবতা সে নিজেই তৈরি করে—তোমার নয়।”
রাত এগোলে দেবদান নিজেকে প্রস্তুত করে। ডায়েরির নির্দেশ অনুযায়ী, সে একটি পুরনো ধূপকাঠি থেকে তোলা ছাই আর মঠের দক্ষিণ কোণের চূড়া থেকে ভেঙে আনা ইঁট গুঁড়ো করে মিশিয়ে মাটি বানায়। সেই মাটি দিয়ে আঁকে ত্রিভুজ—যার তিন প্রান্তে তিনটি তামার পাত্র, তাতে পুরানো চামেলির পাতা, পোড়া তুলসী, আর তিসি বীজ। তার মাঝখানে এক কাপ পাত্রে কেরোসিন ও লাল রংয়ের একটি লেপা মোমবাতি।
“তোমার মুখ থেকে প্রথম যে শব্দ tonight বেরোবে, সেটাই আগুনের আহ্বান,” ভৃষ্টি বলে। “সেই শব্দ যদি শুদ্ধ না হয়, আগুন তোমাকে ভস্ম করবে। যদি শব্দ হয় মিথ্যা, আগুন তোমার জিহ্বা ছিঁড়ে নেবে। আর যদি সে শব্দ হয়—যে শব্দ মুখ চায়—তবে তুমি আগুন হয়ে উঠবে।”
দেবদান নিঃশ্বাস নেয়। তার মনে পড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় রাতের সেই মুখ, সেই শ্বাস, সেই আয়নার ভেতরের ছায়া। সে জানে, আর পেছনে ফেরা নেই।
রাত তিনটা তেইশ। এবার আর ঘণ্টা বাজে না। বদলে কোথা থেকে যেন ভেসে আসে সিঁদুর-জলের গন্ধ। দেবদান আগুন জ্বালায়। কেরোসিনে ভেজা সলতে এক মুহূর্তে জ্বলে ওঠে, ছায়া ফেলে চারপাশে, সেই ছায়া যেন দেয়ালে চড়ে হাঁটছে।
সে বসে পড়ে, চোখ বন্ধ করে মন্ত্র জপ করতে শুরু করে। কিন্তু আজ মন্ত্র আটকে যায়। জিভ শুকিয়ে যায়। মুখ কাঁপে। শব্দ বেরোতে চায়, কিন্তু শব্দ নয়, কণ্ঠের ভেতর আগুন যেন পাক খেতে শুরু করে।
তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক শিশু, তার মুখে আগুন। সেই শিশু চিৎকার করছে, কিন্তু সে চিৎকার শব্দ নয়—আগুন। পেছনে দাঁড়িয়ে এক নারী—অর্ধেক মুখ, অর্ধেক ছায়া, চোখ নেই, কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আছে।
তখন দেবদান বলে ফেলে, “আমি চেয়েছিলাম না—তবু আমি এসেছি। যদি আমি মুখ না হই, তবে কে হবে মুখ?”
এই বাক্য উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আগুন লাফিয়ে উঠে দেয়ালে লাগে। বাতাসে ঝাঁকুনি লাগে। ভৃষ্টির চিৎকার, “না! তুমি বললে!”
কিন্তু ততক্ষণে কিছু বদলে গেছে।
আগুন ছুটে আসে দেবদানের দিকে। তার মুখ জ্বলছে না, অথচ চোখে আগুনের প্রতিচ্ছবি। সেই আগুনে দেখা যায় এক মুখ—চেনা মুখ, আবার অচেনা। তার নিজের মুখ, কিন্তু চোখ কালো, দাঁত ছুঁইয়ে হাসছে, আর সেই মুখের জিহ্বা পুড়ে গিয়ে আগুনে গলে পড়ছে।
হঠাৎ ঘরের ভিতর বিকট শব্দ—ছাদের ফাটল ধরে ধুলোর ঢল। খাটের পাশে থাকা আয়নাটি ছিটকে পড়ে যায়, ভেঙে গিয়ে তার প্রতিফলনে দেখা যায় পাঁচটি মুখ—দেবদানের একটাই শরীর, কিন্তু পাঁচ রকম মুখ: শিশুর, বৃদ্ধের, নারীর, মুখহীন আর—একটা যার কেবল চোখ, আর চোখে আগুন।
তার শরীর এবার কাঁপে না, বরং হালকা হয়ে আসে। সে উঠে দাঁড়ায়, মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়। জিহ্বা রক্তাক্ত। তার মুখ যেন আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই।
ভৃষ্টি এগিয়ে আসে, কাঁপা গলায় বলে, “তুমি আজ আগুনকে খুশি করেছ। এখন তুমি মুখের মধ্যে প্রবেশ করেছ। এখন আর তুমি নিজের কথায় বলবে না—তুমি বলবে সেই শব্দ, যা বলা হয়েছিল বহু পূর্বে, প্রথম মুখ জেগে ওঠার সময়।”
দেবদান তাকিয়ে থাকে, তার চোখে প্রতিফলন নেই। সে বলে, “আমি জানি, চতুর্থ রাতে আমি আর থাকবো না। আমি থাকবো তার জন্য, যে ফিরে আসতে পারেনি।”
ভৃষ্টি পেছনে সরে যায়, ধীরে বলে, “কমলিনী?”
দেবদান মাথা নাড়ায়। “তাকে আমি দেখেছি আগুনের ভিতর। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছে—তুই যদি শেষ করিস, আমি মুক্তি পাবো। আমি না ফিরলে সে মুখ খুলবে না।”
ঘরের কোণে রাখা কুপিটা এবার নিজে থেকেই নিভে যায়। ছায়া আবার মেঝেতে লেপ্টে পড়ে। দূরে কোথাও পেঁচার ডাক শোনা যায়। তালপুকুরে শীত নেমে আসে—গ্রীষ্মের মধ্যরাতেও।
ভৃষ্টি জানে—তৃতীয় রাত্রির কাজ শেষ। কিন্তু দেবদান এখন আর দেবদান নেই। সে এক হাঁটতে থাকা মুখ, এক চলমান জিহ্বা, যার শব্দ আগুন হয়ে রয়ে গেছে সময়ের বাইরে।
পর্ব ৭: চতুর্থ রাত্রি — শূন্যের প্রতিধ্বনি
তালপুকুরের বাতাস আজ যেন আর নড়ে না, যেন দম বন্ধ হয়ে আছে শহরের। পেঁচার ডাকও থেমে গেছে, গাছের পাতাগুলো নিশ্চল, মেঘ নেমে এসেছে মাথার উপর—তবু বৃষ্টি নয়, যেন কুয়াশা নয়, একধরনের গা ঘিনঘিনে ভার। মঠের দিক থেকে ভেসে আসে একদম অস্পষ্ট একটা শব্দ—শাঁখের মতো, কিন্তু ফাঁপা, যেন কেউ চেষ্টা করছে আওয়াজ তুলতে, কিন্তু শব্দ জন্ম নিচ্ছে না।
ভৃষ্টি দরজার ধারে দাঁড়িয়ে, একহাতে ধরা কমলিনীর ডায়েরি, চোখে উদ্বেগ। দেবদান তাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যায় নীচের দিকে। তার পায়ের ছায়া এবার আর স্বাভাবিক নয়। সে জানে, ভৃষ্টি দেখছে সেটা—দুটি ছায়া পড়ে তার শরীর থেকে, একটি সামনে, আরেকটি পিছনে। আর পেছনের ছায়া যেন আর তার নয়। সে জানে, এটা ‘চতুর্থ মুখ’-এর লক্ষণ।
ঘরের ভিতরে আজ কিছু নেই। না প্রদীপ, না ধূপ, না রঙ। শুধু একখণ্ড সাদা কাপড়, যার মাঝে রাখা একটি শঙ্খ—দুধে ভিজিয়ে ধোয়া, কচি তুলসীপাতায় মোড়া। ডায়েরিতে লেখা, “চতুর্থ রাত্রি, প্রতিধ্বনিহীন আহ্বান। মুখ তখন নীরবতাকে চেনে। যে সাধক প্রতিধ্বনি পায় না, সে মুখের কাছে গৃহীত।”
ভৃষ্টি এগিয়ে এসে বলল, “তুমি আজ যে শব্দ উচ্চারণ করবে, তার কোনো প্রতিধ্বনি যদি না ফেরে—তা মানেই, তুমি গ্রহণযোগ্য। মুখ তখন তোমার ভেতরে কথা বলবে, তুমি বোঝার আগেই।”
দেবদান বলে না কিছু। সে বসে, শঙ্খ হাতে তুলে নেয়। কাঁপে না। তার চোখে যেন এক নিরপেক্ষ অন্ধকারের বাস। সে জানে, আজ এই রাত্রি শেষ হলে, সে আর হবে না সেই মানুষ, যে ফিরে আসতে পারে।
মন্ত্রপাঠ নয় আজ, আজ শুধু শঙ্খধ্বনি। ডায়েরি নির্দেশ দেয়—তিনবার শঙ্খে ফুঁ দাও, এবং প্রত্যেকবার কান পেতে প্রতিধ্বনি শোনো। যদি ফিরে না আসে, তবে চতুর্থ মুখ তোমার ভেতর প্রবেশ করেছে। প্রথমবার দেবদান ফুঁ দেয়—শঙ্খের শব্দ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে, কিন্তু ভেতরটা কেমন ফাঁপা হয়ে থাকে। যেন শব্দ হচ্ছে, অথচ কোথাও আটকে যাচ্ছে।
ভৃষ্টি দরজায় দাঁড়িয়ে শোনে—তাকে কানে কিছুই লাগে না। যেন বাতাস শুষে নিচ্ছে শব্দকে। দ্বিতীয়বার ফুঁ দিলে, শঙ্খ নিজেই কাঁপে। ঘরের মেঝেতে তাপ জমে ওঠে, অথচ শীতকাল।
তৃতীয়বার দেবদান যখন শঙ্খে ফুঁ দেয়, তখন হঠাৎই বাতাস থেমে যায়। শব্দ হয়, কিন্তু কোনো প্রতিধ্বনি নেই। না ঘরে, না বাইরে। এমনকি পাখিদের ডাকা, কুকুরের কান্না, রাতের গা-ছমছমে শব্দ—সব কিছু যেন কোথাও আটকে গেছে।
তখনই এক মুহূর্তে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সে দেখে—তার ছায়া আর প্রতিফলন নেই। আয়না নিঃস্ব, জল থেমে গেছে, এমনকি তার নিঃশ্বাসটাও কেমন যেন শব্দহীন হয়ে গেছে। সে জিভ সরিয়ে বলে, “আমি এখানে আছি।” কিন্তু সে নিজেই শব্দটা শুনতে পায় না।
ভৃষ্টি দৌড়ে আসে ভিতরে। তার হাতে রাখা ধুপটি হঠাৎ জ্বলে ওঠে, যদিও আগুন ধরানো হয়নি। সে দেবদানের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রাখে—তবু দেবদান চমকে ওঠে না, নড়ে না। তার চোখে এবার অতল এক শূন্যতা—যেন হাজারো মেঘ, তবু একটাও বৃষ্টি দেয় না।
ভৃষ্টি নিচু গলায় বলে, “তুমি আজ শূন্য হয়েছো। এখন থেকে শব্দ তোমার ভিতর দিয়ে যাবে, কিন্তু সেটা তোমার শব্দ হবে না। মুখ এখন তোমার দেহ ব্যবহার করবে, তার নিজের কথা বলার জন্য। তুমি যদি কিছু বলো, সেই শব্দে তোমার ইচ্ছা থাকবে না। থাকবে শুধু তার আদেশ।”
তখন হঠাৎ করে দেয়ালের একটি কোণ থেকে ছায়া সরে গিয়ে বের হয়ে আসে একটি আকৃতি। সে নারীর দেহ, কিন্তু মুখ অদৃশ্য। শুধু কপালে পাঁচটি বিন্দু—পঞ্চতত্ত্বের চিহ্ন। দেবদান তাকিয়ে বলে, “সে… সে আমার ঠাকুরমা নয়। সে আমি। বা, আমি তার। আমি জানি না। আমি এখন জানি, আমি কে না।”
ছায়ামূর্তিটি দেয়ালের ভেতর দিয়ে হাঁটে, আর তার প্রতিটি পায়ের ছাপ পড়ে না—শুধু চারপাশের আলো ফিকে হয়ে যায়।
ভৃষ্টি চোখ বন্ধ করে বলে, “চতুর্থ মুখ মুখ নয়—এটা প্রতিধ্বনি। যখন কেউ নিজেকেই শুনতে পারে না, তখন সে চতুর্থ স্তরে পৌঁছায়। তখন মুখ আর ভাষায় নেই, থাকে শূন্যে। তুমি এখন নিজেকে হারিয়েছো, দেবদান।”
সে উত্তর দেয় না। সে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে দেয়ালের কাছে গিয়ে, আঙুল চালিয়ে দেয়ালের উপরে লেখে কিছু—একটি পুরোনো বর্ণমালা, যা সংস্কৃত নয়, বাংলা নয়, কিন্তু গভীরভাবে চেনা। ভৃষ্টি কাছে গিয়ে দেখে, লেখা আছে:
“মুখ এখন চোখ দিয়ে দেখে না। সে শূন্যতা দিয়ে শোনে।”
তার পরদিন সকালে দেবদান কিছু বলে না। সে শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাহুদি নদীর জায়গায় এক সময়কার শুকনো চৌচির জমি দেখা যায় না। বরং সেখানে আজ কুয়াশা জমে আছে, যেন কোনো নদী আবার শ্বাস নিচ্ছে।
ভৃষ্টি তাকে দেখে, ফিসফিস করে বলে, “তুমি চারটি মুখ পার করেছো। এবার পঞ্চম মুখ আসবে—যা মুখ নয়, চোখ নয়, শব্দ নয়। সেটা তো শুধুই—নেই।”
দেবদান ধীরে বলে, “আমি অনুভব করছি তাকে। সে আমার ভিতরে নেই—সে আমি হয়ে উঠছে। আমি এখন সবকিছু দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু নিজের চোখ দিয়ে নয়। আমি এখন বুঝি, আমি শুধু এক বংশধর নই, আমি সেই ভুল যা একবার হয়েছিল, এবং আবার ঘটতে চলেছে।”
বাতাসে ঝিরঝিরে শব্দ হয়। একটা পুরনো জানালার কাচ নিজে থেকেই ভেঙে পড়ে। পেছনে একটা গানের সুর বাজে, যেন বহু পুরনো লোরি—এক মা গাইছে তার মৃত সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য। ভৃষ্টি জানে, আজ দেবদান আর মানুষ নয়। সে হয়ে উঠেছে পঞ্চম মুখের পূর্বসূরী।
পর্ব ৮: পঞ্চম রাত্রি — যে মুখ, মুখ নয়
তালপুকুরে আজ এমন এক রাত, যেন কোনো দিন নয়, কোনো বছর নয়—যেন সময় নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে। আকাশে চাঁদ নেই, তারা নেই, কুয়াশা নয়, বরং যেন কেউ সাদা কাপড়ে ঢেকে রেখেছে পৃথিবীটাকে। নিঃস্বাশ মঠের দিকে তাকালে মনে হয়, বাতাসও আজ সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছে।
ভৃষ্টি জানে, আজই সেই রাত—যে রাতের কথা কমলিনী দেবী ডায়েরির শেষ পাতায় লিখেছিলেন—“পঞ্চম মুখ দেখা যায় না। যে দেখে, সে আর মুখ থাকে না। সে হয়ে ওঠে শূন্য, যার ভিতর দিয়ে মুখ নিজেই নিজেকে দেখে।”
দেবদান সারা দিন কথা বলেনি। সে বসেছিল বারান্দায়, পেছনে তার সেই অতিপরিচিত ছায়া আর একটা নতুন ছায়া। চোখে ঘুম নেই, মুখে রক্ত জমে থাকা হাসি। সে যেন জানে, আজ শেষ রাত্রি। কিংবা, শুরু।
রাত ঠিক তিনটে তেইশে, তালপুকুরের বাতাসে শোনা যায় এক গভীর দীর্ঘশ্বাস। ঘণ্টা বাজে না, পেঁচার ডাক নেই, কুকুরের হাঁক নেই—কিন্তু সেই নিঃশ্বাস যেন গোটা শহরের ভিতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যেন কেউ জেগে উঠছে। না—কে যেন জেগে ছিলই, শুধু আজ চোখ খুলছে।
ঘরের মধ্যে রাখা হয়েছে একমাত্র জিনিস—একটা কালো পাথরের পাত্র, যার ভিতরে দেবদান নিজের হাতে এনেছে নদীর জলের মতো কিছু। বাহুদি তো বহু বছর আগেই শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গতকাল রাতেই ভৃষ্টি দেখেছে—দেবদান সেই শূন্য চরের এক কোণে বসে, মাটির ভিতর থেকে তুলে এনেছে কিছু তরল, যা পানি নয়, রক্ত নয়, তবু বেঁচে আছে।
“এই পাত্রে তাকাতে হয়,” সে বলেছিল ভৃষ্টিকে। “তবে নিজেকে দেখা যাবে না। শুধু সে, যে মুখ নয়, কিন্তু দেখায়।”
ভৃষ্টি এক কোণে দাঁড়িয়ে। তার শরীর শীতল, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। সে আজ জানে, আজ সে শুধু দর্শক নয়—আজ সে নিজেই সেই প্রতিধ্বনি, যার ভিতর দিয়ে এই সাধনা শেষ হবে। আজ সে আর গবেষক নয়, উত্তরসূরী নয়—সে হতে যাচ্ছে মুখ।
দেবদান কাপড় খুলে বসে, কপালে পাঁচটি চিহ্ন—আগুন, জল, বায়ু, ভূমি, শূন্য। প্রতিটি তৈরি হয়েছে আগের রাতের প্রতিক্রিয়া থেকে। সে চক্রের মাঝখানে বসে পড়ে, চোখ খুলে রাখে। তার সামনে রাখা পাত্রে সে ধীরে ধীরে মুখ ঝুঁকিয়ে দেখে—কোনো প্রতিচ্ছবি নেই। না মুখ, না চোখ, না ছায়া।
কিন্তু তার মাথার ভেতরে কিছু একটা কাঁপতে থাকে। শব্দ নয়, আলো নয়—এক ধরণের চিন্তা, যা নিজের থেকে আলাদা। যেন কারও মুখ খুলে তার মাথার ভিতর কথা বলছে।
“তুই আমার বাহক। আমি তোকে দেখছি। তুই তো নিজেই মুখ হতে চাসনি। তুই তো শুধু বুঝতে চেয়েছিলি সত্য কোথায়। আমি তো তোকে তা-ই দেখাব। তবে সত্য দেখা মানে, তোকে সত্য হওয়া। তোকে গিলে আমি মুখ হব, আর তুই থাকবি শুধু সেই মুহূর্ত—যখন কেউ বুঝেছিল, সে নিজের ভিতরেই কিছু নয়।”
তখন পাত্রের জল নড়ে ওঠে। কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ে ঘরের ভিতর। চারদিকে ছায়া চলে আসে—ছোট ছোট মুখ, চোখহীন, গলিত, রক্তাক্ত, কিংবা মুখহীন কঙ্কাল। ভৃষ্টি চিৎকার করে ওঠে—“তুমি থেমে যাও, দেবদান! তুমি শেষ মুখকে ডাকছ, যাকে ডাকা মানেই হারিয়ে যাওয়া!”
কিন্তু দেবদান তাকিয়ে থাকে পাত্রে। তার চোখে জল, বা না হয় রক্ত। তার গলার ভিতর থেকে বেরোয় এক শব্দ—না ভাষা, না মন্ত্র, না প্রলাপ। যেন কোনো লুপ্ত ভাষার আত্মা ফিরে এসেছে।
“আমি তোকে দেখছি,” সে ফিসফিস করে। “আমি জানি, তুই মুখ নোস। তুই সেই দৃষ্টি, যা নিজেরই অস্তিত্ব ভুলে গেছে। আমি তোকে মেনে নিচ্ছি। আমি মুখ হতে চাই না। আমি শুধু তোকে আয়না দিতে চাই।”
তখনই ঘরের দেয়াল ফেটে যায়। না, শব্দ হয় না, ধুলোর ঝড় ওঠে না—শুধু একধরনের আলো বেরিয়ে আসে, নীলাভ, কুয়াশার মতো, এবং সেই আলোয় দেখা যায় একটি রূপ—মানব নয়, নারী নয়, তান্ত্রিক নয়—একটি দৃষ্টি, যার কোনো মুখ নেই। মাথা আছে, শরীর আছে, কিন্তু মুখ ফাঁকা—যেখানে মুখ হওয়ার কথা, সেখানে শুধু কালো শূন্যতা।
দেবদান তাকিয়ে থাকে সেই শূন্য মুখের দিকে। আর সে ধীরে ধীরে সামনে হেঁটে যায়, পাত্রের জলের দিকে ঝুঁকে পড়ে, এবং হঠাৎ করেই তার মুখ মিলিয়ে যেতে থাকে। ভৃষ্টি দৌড়ে আসে, চিৎকার করে—“না! ফিরে এসো! তুমি তার বাহক ছিলে, তুমি সে নও!”
কিন্তু তখন কিছু ঘটছে—পাত্রের জল নিঃশব্দে উথলে ওঠে, আর দেবদানের মুখ আর প্রতিফলিত হয় না। তার কণ্ঠ বন্ধ হয়ে আসে, শরীর শূন্যের মতো হালকা হয়ে পড়ে, এবং একটা সময়—সে আর নেই।
ঘরের ভিতরে নিঃস্তব্ধতা।
শুধু ভৃষ্টি দাঁড়িয়ে, তার হাতে পাত্র। আর সেখানে, জলের গভীরে, ভেসে থাকে তার নিজের মুখ।
ভৃষ্টি ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে। ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা—
“যদি কেউ পঞ্চম মুখকে গ্রহণ করে, তবে সে মুখ হয় না। সে হয় দরজা। এবং একবার দরজা খুলে গেলে, মুখ আর থেমে থাকে না।”
তালপুকুরের আকাশে একটা অদৃশ্য আলো ভেসে ওঠে।
দেবদান নেই।
তবু রাত জেগে আছে।
পঞ্চম মুখ এখন দৃষ্টি নয়, শব্দ নয়, শরীর নয়—
সে এখন সময়ের এক ফাঁক।
আর সেই ফাঁকেই, ভৃষ্টি নিজের ছায়া হারাতে শুরু করে।
পর্ব ৯: ছায়াহীন শহর
তালপুকুর বদলে গেছে।সকালের আলো সেইরকমই নেমেছে, নদীর দিক থেকে কুয়াশার স্রোত বইছে, পাখিরা ডাকছে দূরে, অথচ কিছু একটা অদ্ভুত। যেন বাতাসে এক অচেনা স্তব্ধতা জমে আছে। তালপুকুরের মানুষেরা কথা বলছে, হাঁটছে, বাজারে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ ছায়া ফেলছে না। দেয়ালের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি, বাসার ছাদে কাপড় মেলতে থাকা মহিলা, বা চায়ের দোকানের মালিক—সবার শরীর থেকে আলো পিছলে পড়ছে, কিন্তু ছায়া গঠিত হচ্ছে না।
একদিনে শহরের সমস্ত ছায়া যেন ভরে গিয়েছে কোথাও, যেখানে আলো ঢুকে থেমে যায়।
ভৃষ্টি এখনও জীবিত। সে তালপুকুরে, দেবদানের পুরনো বাড়িতে, পেছনের ঘরটায় বসে আছে। তার সামনে খোলা কমলিনীর ডায়েরি, পাশে কালো পাথরের সেই পাত্র। কিন্তু এখন সেই পাত্র শূন্য। যেন তার ভিতরে থাকা জল নিজে থেকেই উবে গেছে।
দেবদান নেই।
না নিখোঁজ, না মৃত, না বেঁচে—সে এখন নেই। আর সেই অনুপস্থিতি তালপুকুরের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রতিটি জানলার কাচ, প্রতিটি অন্ধকার কোণ এখন যেন কিছু না থাকার চিহ্ন বহন করছে।
ভৃষ্টি নিজেকে আয়নায় দেখে। কিন্তু সেখানে শুধু তার শরীর, মুখ আছে, কিন্তু চোখের ভিতর ফাঁকা। ছায়ার মতো।
সে জানে, দেবদান পঞ্চম মুখ হয়ে গেছে না। বরং, সে হয়ে গেছে সেই দরজা—যা দিয়ে মুখ প্রবেশ করে। এখন থেকে মুখকে কেউ ডাকে না—মুখ নিজেই আসে, যাকে দরকার মনে করে, তাকে দিয়ে কথা বলে।
তালপুকুরের কিছু লোক ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। রিকশাওয়ালা গুনগুন করে এমন এক সুর যা কেউ চিনতে পারে না, এক মহিলা প্রতিদিন দুপুর তিনটে তেইশে একটা কাঁচের পাত্রে জল ঢালেন, আর বলে ওঠেন, “আমি মুখ নই, আমি প্রতিচ্ছবি।” একটা স্কুলের বাচ্চা হঠাৎই গায়, “তুমি যদি শূন্য হও, আমি তোমার ভিতরে শব্দ রাখবো।”
ভৃষ্টি জানে, এগুলো কাকতাল নয়। শহরের মাটি এখন সেই সাধনার ফল গ্রহণ করছে, যেটা অসম্পূর্ণ ছিল।
কিন্তু সে জানে না—এবার কে মুখ হবে?
এক রাতে, সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় নিঃস্বাশ মঠের সামনে। সেই মঠ যা এতকাল মৃত ছিল, এখন যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ভগ্নপ্রায় দেওয়ালে লতা চেপে বসেছে, কিন্তু দেওয়ালের ভেতর থেকে একটা হালকা কম্পন অনুভব করা যায়।
ভৃষ্টির চোখ পড়ে মঠের চূড়ায়—সেখানে আগুন জ্বলছে, অথচ কেউ নেই।
সে ভিতরে ঢোকে।
মঠের মেঝেতে রাখা পাঁচটি প্রদীপ। তার পাশে রাখা একটা ছায়া—না, কোনো পদার্থ নয়, একটা ছায়ার আকার, যেন মোমবাতির আলোতেই গড়া, কিন্তু শরীর ছাড়া। সেই ছায়া ধীরে ধীরে মাথা ঘোরায়, তাকায় তার দিকে।
ভৃষ্টি কিছু বলে না। কেবল দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ সে জানে—এটা দেবদান নয়, এটা সেই অনুপস্থিতি, যার ভেতর দেবদান নিজেকে সমর্পণ করেছিল।
ছায়াটা ফিসফিস করে—
“তুই তো মেয়ে। তুই তো জন্ম থেকেই জানিস, মুখ কেমন হয়। তোর ঠাকুরমা জানত। তোর রক্ত জানে। তুই আয়না হ। না হলে মুখ খুঁজবে নতুন চক্র। আবার কাউকে দরজা বানাবে।”
ভৃষ্টি শীতল হয়ে যায়। তার মুখ শুকিয়ে আসে। সে বলে, “আমি গবেষক ছিলাম। আমি শুধু জানার চেষ্টা করেছিলাম।”
ছায়া বলে, “জানা মানে ছোঁয়া। আর ছোঁয়া মানেই দাগ। একবার পঞ্চম মুখের গন্ধ নিলে কেউ স্বাভাবিক থাকে না। তুই জানিস—কমলিনী কেন অন্তর্ধান করেছিল? কারণ সে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু তুই পারিস। তুই মুখ হ। তুই না হলে, মুখ বেরোবে অন্য কোনো দরজা দিয়ে।”
ভৃষ্টি বুঝতে পারে, তালপুকুর কেবল দেবদানের শূন্যতায় বসে নেই, বরং সে নিজেই এখন জেগে থাকা মুখ।
সে ধীরে ধীরে চক্রের মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। তার হাত নিজে থেকেই তুলে নেয় পাথরের পাত্র। পাত্র এখন ফাঁকা, কিন্তু তার ভেতর থেকে একটা নীলাভ আলো ফোটে।
সে বুঝতে পারে, এখন পঞ্চম মুখকে ঠেকানো যাবে না। কিন্তু তাকে দৃষ্টি দেওয়া যায়। তাকে পথ দেখানো যায়।
সে চোখ বন্ধ করে বলে—
“আমি মুখ নই। আমি আয়না। আমি প্রতিচ্ছবি। আমি শূন্য। আমি সেই নদী যা ছিল না, তবু তৃষ্ণা মেটায়। মুখ যদি আসতে চায়, আসুক। তবে আমার ভিতর দিয়ে নয়। আমি মুখকে দেখাবো তারই মুখ।”
তখন চারদিকে আবার ছায়া জমতে শুরু করে। পাথরের পাত্রের ভিতর আলো কমে আসে। নিঃস্বাশ মঠের ভিতর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বয়ে যায়।
তালপুকুরে পরদিন সকাল হয়।
মানুষজন আবার কথা বলে, হাসে, হাঁটে। ছায়া ফেরে না। কিন্তু তারা জানে না, কিছু বদলে গেছে। তারা জানে না, কোনো এক নারী মঠের ভিতর দাঁড়িয়ে ছিল রাতভর, আর তার মুখে তখন চুপচাপ নেমে এসেছিল সেই অদৃশ্য মুখ, যা এখন আর কাউকে খুঁজছে না।
কারণ মুখ এখন নিজের প্রতিচ্ছবি পেয়েছে।
ভৃষ্টি আর দেখা যায় না তালপুকুরে। কেউ কেউ বলে, সে শহর ছেড়ে গেছে। কেউ বলে, সে পাগল হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু নিঃস্বাশ মঠের দেওয়ালে, কচি পাতায়, বাতাসে, এবং নির্জন দুপুরবেলায় কারও অদৃশ্য কণ্ঠে আজও শোনা যায়—
“আমি মুখ নই। আমি সেই আয়না, যেটায় মুখ নিজেকে দেখে ভয় পায়।”
পর্ব ১০: মুখহীন দৃষ্টি
তালপুকুরে গ্রীষ্ম পড়েছে, কিন্তু বাতাসে শরৎকালীন শীত। রাতের আকাশ কুয়াশা নয়, কেবল সাদা—যেন কেউ নক্ষত্রগুলো মুছে দিয়েছে। নিঃস্বাশ মঠের চারপাশে নিস্তব্ধতা, এমনকি পাখির ডাক নেই। বাতাস থেমে থাকলে বোঝা যায়, শহরের হৃদপিণ্ড আর স্বাভাবিকভাবে ধকধক করছে না।
তালপুকুর এখন আর আগের মতো শহর নয়, সেটি হয়ে উঠেছে এক চেতনার ধারক—যার ভিতর পঞ্চম মুখ জেগে আছে। কারও ভাষায় নয়, কারও চোখে নয়, কারও শরীরে নয়—একটি অদৃশ্য ‘আমি’র মতো, যা নিজেকে দেখায় না, শুধু দেখে।
কমলিনী দেবীর ডায়েরির শেষ পাতাটিও এখন আর লেখা নেই। সেই অক্ষরগুলি অদৃশ্য হয়ে গেছে—কিন্তু যারা জানে, তারা বুঝতে পারে, এখন আর কিছু লেখার দরকার নেই। এখন যা ঘটছে, তা ভাষার অতীত।
এমন এক সকালে, তালপুকুরের একজন বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক তার ক্লাসে ঢুকে বোর্ডে লেখেন—“আমি মুখ দেখিনি, তবে সে আমাকে দেখে ফেলেছে।“ শিশুরা চুপ করে থাকে, কারও মুখে শব্দ নেই। কেউ কেউ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু দেখছে, কিন্তু জানে না কী।
একটি মেয়ে, হয়তো আট বছরের, বাড়ি ফিরে এসে তার মাকে বলে—
“মা, আজ আমি আয়নায় নিজেকে দেখতে পারিনি। আমি যে মুখটা দেখেছি, সেটা আমি না।”
এদিকে, দেবদান নেই। ভৃষ্টি নেই। কিন্তু তাদের ছায়া ছড়িয়ে আছে শহরের প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি বন্ধ জানালায়, প্রতিটি চুপ করে থাকা আয়নায়।
হঠাৎ এক দিন দুপুরবেলা, তালপুকুরে এক অজানা যুবক আসে। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে গাঢ় চশমা। সে কারও সঙ্গে কথা বলে না, শুধু ঘুরে বেড়ায়, দেখে। সে মঠের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে এখনও আগুন জ্বলে না, ধূপ পোড়ে না। তবু একটা গন্ধ—ভিজে তুলসীপাতা আর পোড়া চন্দনের—ভেসে আসে।
তাকে দেখে এক বৃদ্ধা বলে ওঠেন—“ওখানে যাবেন না বাবু, ওখানে এখন সময় চলে না। ওখানে চোখ খোলে না, ওখানে শুধু মুখ ফোটে।”
তবু যুবক এগোয়। সে ভিতরে ঢোকে নিঃস্বাশ মঠে। ভেতরটা আজ অনেক শান্ত, অনেক স্বচ্ছ। আর সেখানেই সে দাঁড়িয়ে দেখতে পায়—একটি আয়না।
না, এটা কোনো কাঁচের আয়না নয়। এটা এক চকচকে কালো পাথর, ঘিরে পঞ্চমুখ প্রতীক আঁকা, মাঝখানে একটি ফাঁকা স্থান। আয়নায় সে তাকিয়ে দেখে—কিছুই না। না নিজের চেহারা, না ছায়া। শুধু এক চুম্বকীয় শূন্যতা।
হঠাৎ সেই শূন্যতা নড়ে ওঠে। তার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হয় এক অবয়ব—নারী, পঞ্চমুখ, অথবা তারা কেউই নয়। এক মুখহীন রূপ, যার শরীর আড়াল করা, যার চোখ নেই, কিন্তু সে দেখছে।
যুবক পেছনে সরে যেতে চায়, কিন্তু তার পা নড়ে না। কণ্ঠ থেকে শব্দ বেরোয় না। ঠিক তখনই, সেই রূপ ফিসফিস করে বলে—
“তুই নতুন আয়না হতে চাস? নাকি শুধু পুরনো মুখের প্রতিচ্ছবি?”
তখন তার মনে পড়ে যায় কিছু দৃশ্য—দেবদান বসে আছে পাথরের পাত্রের সামনে, ভৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে মঠের চক্রে, ডায়েরির পাতায় লেখা অক্ষর গলে যাচ্ছে, আর তালপুকুর নিঃশব্দে বিলীন হচ্ছে।
সে ফিসফিস করে উত্তর দেয়—
“আমি দেখতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই—শেষে কী থাকে?”
রূপ হেসে ওঠে। অথবা, হাসি নয়—এক ধরনের অদৃশ্য কম্পন হয় আশেপাশে। তারপর বলে—
“শেষে থাকে চোখ, যার দৃষ্টিতে মুখ নেই। আর সেই চোখ দিয়েই মুখ নিজেকে খুঁজে ফেরে বারবার।”
ঘরটা কেঁপে ওঠে। সেই আয়না আর থাকে না। সেখানে পড়ে থাকে শুধু এক লাল সুতো, যেটা দিয়ে কমলিনীর ডায়েরি বাঁধা ছিল।
যুবক ফিরে যায় শহরের দিকে। তার মুখে কথা নেই, চোখে কেবল বিস্ময়ের শীতল রেখা। কেউ তাকে আর কখনো দেখে না।
তালপুকুরে আরও বছর পেরোয়। শহর রাস্তাঘাট পায়, ফোন টাওয়ার ওঠে, এক আধুনিক দোকান খুলে যায়। মঠে কেউ আর যায় না। তার সামনে লাগানো হয় সাইনবোর্ড: “ঐতিহাসিক নিঃস্বাশ মঠ—স্থানীয় ইতিহাসের নিদর্শন”।
কিন্তু যারা রাতজেগে থাকে, যারা আয়নায় নিজের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকায়, তারা এখনও অনুভব করে—কখনো কখনো, কিছু ছায়া পড়ে না। কখনো কখনো, কেউ কিছু বলে না, তবু কানে বাজে পাঁচটি ঘণ্টা।
আর যে আয়নাটায় একদিন ভৃষ্টি নিজের মুখ খুঁজে পেয়েছিল, সেটি এখন একটি পরিত্যক্ত ঘরের এক কোণে ধুলোর নিচে পড়ে রয়েছে।
তবু মাঝে মাঝে, বিশেষত কালরাত্রির সময়, কেউ কেউ বলে—
“সেই আয়না এখনও দেখে। শুধু তার মুখ নেই।”
তালপুকুর আর কখনও স্বাভাবিক হয়নি।
কারণ পঞ্চম মুখ আর দেখা দেয় না।
সে এখন সব কিছু দেখে।
শেষ