Bangla - তন্ত্র

পঞ্চতন্ত্র

Spread the love

জয় সাহা


কলকাতার শীতল জানুয়ারির সকালে ঘন কুয়াশা ঢাকা দিয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া। রাস্তার ধারে পুরনো বইয়ের দোকানগুলো থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া আর চায়ের গন্ধ মিশে গিয়েছিল শহরের আর্দ্র নিঃশ্বাসে। ড. শৌণক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গা-ছমছমে নীল টweed কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন ‘শর্মা রেয়ার কালেকশন’-এর দিকে—একটি আধাভগ্ন, অন্ধকার বইয়ের দোকান যা শহরের বহু ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে। দোকানের দরজায় ঝুলন্ত ঘণ্টা বেজে উঠল ক্লান্ত সুরে, আর ভিতর থেকে উঠে এল ধুলোমাখা কাগজের গন্ধ। শৌণক জানতেন কেন তিনি এসেছেন। তিন দিন আগে এক নামহীন খামে পাঠানো চিঠিতে শুধু একটি লাইন লেখা ছিল—“তোমার বাবার শুরু যেখানে শেষ হয়েছিল, পঞ্চতন্ত্রের প্রথম ছায়া সেখানেই অপেক্ষা করছে।” চিঠির নিচে কোন নাম ছিল না, শুধু একটি অদ্ভুত চিহ্ন—একটি বৃত্ত যার মাঝখানে ছিল পাঁচটি বিন্দু, যেন একটি পাঁচচক্র যুক্ত শক্তির মুদ্রা। শৌণক থমকে গিয়েছিলেন, কারণ ঠিক এই চিহ্নটিই তিনি তাঁর বাবার মৃত্যুর পর প্রথম দেখেছিলেন, এক পুরনো নোটবুকে। সেই স্মৃতি ফিরে আসতে সময় লাগেনি—একটি বর্ষার রাত, বাবার বন্ধ ঘর, অদ্ভুত গন্ধ, আর দেওয়ালের তলায় অর্ধেক পোড়া এক কাগজ। তখন তিনি ছাত্র ছিলেন, এখন একজন খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ, যিনি জানেন ইতিহাস কখনও নিছক কাহিনি নয়—কখনও কখনও তা সময়ের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সত্যের ছায়া।

দোকানের মালিক শর্মা তার শুকনো মুখে অদ্ভুত এক হাসি মেখে তাকে নিয়ে গেল ভিতরের ঘরে, যেখানে ধুলোমাখা কাঠের আলমারির এক কোণায় রাখা ছিল একটা ক্যানভাসে মোড়া চামড়ার ফাইল। শৌণক সেটি খুলতেই শিরদাঁড়া বেয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল—একটি তাম্রলিপি, যা মনে হচ্ছিল প্রাক-আলোকিত যুগের কোনো গ্রন্থের অংশ, যেখানে খোদাই করা ছিল এক অপার্থিব ভাষা। লিপির প্রান্তে ছিল একই চিহ্ন—পঞ্চবিন্দু যুক্ত বৃত্ত। পাশেই ছোট করে লেখা: “মন্ত্র ১ – ‘প্রতিধ্বনি শূন্যতা থেকে উঠে আসে।’” এই একটি বাক্যই যেন খুলে দিল এক বিস্মৃত জগৎ। শৌণক জানতেন, এই পুঁথিটি তাঁর বাবার শেষ গবেষণার অংশ—”পঞ্চতন্ত্র” নামে পাঁচটি তান্ত্রিক পুঁথির অস্তিত্ব, যা একত্র হলে মৃত্যুর মূল রহস্য উন্মোচিত হবে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ একে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিলেও তাঁর বাবা বিশ্বাস করতেন—এগুলো বাস্তব এবং ভীষণ বিপজ্জনক। শৌণক পুঁথিটিকে তুলে নিতেই দোকানের পেছনের দেওয়াল যেন কেঁপে উঠল, টিনের চালের ওপরে কারা যেন হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎই আলোর ঝলকানিতে প্রবেশ করলেন একজন নারী—চওড়া চাদর জড়ানো, চোখে স্পষ্ট আত্মবিশ্বাস, গলায় রুদ্রাক্ষ আর ধাতুর কণ্ঠহার। তিনি শান্ত গলায় বললেন, “আপনি পুঁথিটি হাতে নিয়েছেন, মানে আপনি নির্বাচন হয়ে গেছেন। এখন আর ফেরা নেই, ড. শৌণক বন্দ্যোপাধ্যায়।” এ ছিলেন ভাগ্যশ্রী ঠাকুর, লাদাখের এক বৌদ্ধ তান্ত্রিক আশ্রম ‘থুকজাং’-এর প্রধান সাধিকা, যিনি বহুদিন আগে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর মুখে এমন কিছু ছিল, যা বিজ্ঞান বা যুক্তির পরিসীমার বাইরে।

ভাগ্যশ্রী তাকে জানালেন, পাঁচটি পুঁথির প্রতিটিই এক একটি ধাপে মৃত্যুকে বশ করার এক প্রাচীন পথ দেখায়, কিন্তু একত্র করলে তা মৃত্যুকে ডেকে আনে। তার ভাষায়, “পঞ্চতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে তন্ত্রবিদ্যার সেই শেষ সীমানা, যেখানে জীবন ও সময়কে অতিক্রম করার প্রবেশদ্বার খোলে।” তিনি বলেন, এই পুঁথির খোঁজে আছে আরও এক শক্তিশালী গোষ্ঠী—”লাল চক্র”, যারা বিশ্বাস করে, তারা যদি পঞ্চতন্ত্র একত্র করতে পারে, তবে তারা অমরতা অর্জন করতে পারবে। এই গোষ্ঠীর মাথা পীযূষ ধর—একসময়ের প্রত্নতত্ত্ব গবেষক, এখন কালোবাজারি। এবং শৌণকেরই প্রাক্তন সহপাঠী। ভাগ্যশ্রী স্পষ্ট করেন, পুঁথিগুলি কেবল ধাতু নয়—এরা প্রাণবান, এবং প্রত্যেকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক তান্ত্রিক চক্র, যার প্রহরী রয়েছে। শৌণক অবাক হয়ে দেখলেন, চামড়ার ফাইলের নিচে রাখা একটি চিঠি, যেটিতে তাঁর বাবার হাতের লেখা—“যদি কখনো পুঁথিটি খুঁজে পাও, ভাগ্যশ্রীকে বিশ্বাস করো। আমার ভুল তুমি করো না।” শৌণক আর কিছু না বলে ফাইলটা বন্ধ করলেন, চোখে চুপচাপ জ্বলছিল পিতৃঋণের ছায়া, অজানা ভবিষ্যতের আগুন। জানালার বাইরে কলকাতার কুয়াশা তখনও ঘন হয়ে রইল—ঠিক যেমন ঘন হতে শুরু করল এক প্রাচীন তন্ত্রের ছায়াময় পথচলা।

বারাণসী, ভোর ৪টা ৪৫। ঘাটে তখনও আলোর রেখা পড়েনি, কিন্তু চন্দ্রবদন দাশ নামের এক স্থানীয় মাঝি শৌণক ও ভাগ্যশ্রীকে নিয়ে পৌঁছে দেন হরিশ্চন্দ্র ঘাটের দক্ষিণ পাশে, যেখানে এক পোড়া গন্ধময় শ্মশানচত্বরে পচা কুয়াশা জমে ছিল। আগের রাতেই বারাণসী পুলিশ এক খবর দেয়—ঘাটের পাশে জলে ভেসে উঠেছে এক অদ্ভুত পোশাকপরা মৃতদেহ, যার বুকে খোদাই করে লেখা ছিল অপরিচিত এক লিপি। খবর পেয়েই ভাগ্যশ্রী স্থির করেন, “এটা দ্বিতীয় পুঁথির ইঙ্গিত হতে পারে।” শৌণক প্রথমে সংশয় করলেও চিঠির ছায়া তাকে টেনে আনে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দু’জন দেখতে পান—এক অদ্ভুত দেহ, মাথা পুরো কামানো, চোখদুটো খোলা, যেন মৃত্যুর পরও কিছু দেখতে চাইছে। শরীরের বুকজুড়ে এক তালপাতার নকশা সদৃশ মুদ্রা খোদাই করা, যার চারপাশে ছিল রক্তে লেখা মন্ত্র, ও মাঝখানে সেই একই চিহ্ন—পঞ্চবিন্দুর বৃত্ত। ভাগ্যশ্রী নিচু হয়ে মৃতদেহের চোখ বন্ধ করেন, মন্ত্রোচ্চারণ করেন পলকা কণ্ঠে। শৌণক তখন তাঁর নোটবুকে লিপিটি অনুবাদ করতে ব্যস্ত, লিপিটির ভাষা ছিল প্রাচীন পালি ও সংস্কৃতের মিশ্ররূপে—যা সে প্রথম পড়েছিল শ্রীলঙ্কায় একবার, যখন মিথ্যাচার বলা হয়েছিল তাঁর পিতার গবেষণাকে। লিখিত ছিল—”দ্বিতীয় পথ – প্রাণের তরলে নিহিত শব্দ যা মৃতকে জাগায়।” শৌণকের কাঁধ গেয়ে বয়ে গেল ঠান্ডা একটা শ্বাস। মন্ত্রের মধ্যে মৃত জাগানোর কথা—কিন্তু কাদের?

সন্ধ্যা নাগাদ তাঁরা পৌঁছালেন মহাশ্মশানের পাশের এক পুরাতন বৌদ্ধ বিহারে, যেখানে এক অন্ধ ভিক্ষু তাঁদের অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর নাম ছিল মৃগেন্দ্র। তিনি ভাগ্যশ্রীকে চিনতেন, কারণ একদা তিনিও ‘থুকজাং’ আশ্রমের পাঠশালায় ছিলেন, তারপর এক ভয়ঙ্কর আগুনের রাতে সব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই তাঁরা জানতে পারেন, যে মৃত সন্ন্যাসী ছিলেন এক “শব্দপাঠক”—তান্ত্রিক গ্রন্থ যারা নিজের শরীরেই ধারণ করতেন, শরীরকে করে তুলতেন পুঁথির পৃষ্ঠায় রূপান্তরিত। কিন্তু সমস্যা হল, দ্বিতীয় পুঁথির বাকিটুকু এই মৃত শরীরে নেই। শুধু মন্ত্রের খণ্ডাংশ রয়ে গেছে, বাকিটুকু লুকানো আছে ‘তলগা গুহা’য়—একটি ডুবন্ত বৌদ্ধ গুহা, যেটি বছরে মাত্র একবার, পূর্ণিমার দিন, গঙ্গার স্রোত থামলে দৃশ্যমান হয়। ভাগ্যশ্রী তখন বলেন, “আজ পূর্ণিমা, আর সময় হাতে এক রাত।” অতএব, পরের মুহূর্তে তাঁরা নৌকায় ওঠেন, মাঝি চন্দ্রবদনের হাত ধরে গঙ্গার বুকে এগিয়ে যান সেই গুহার দিকে। গঙ্গার জল যেন তখন ঘন অন্ধকারে মোড়ানো কালো আয়না, তার নিচে লুকিয়ে ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক পাতা। তলগা গুহার মুখে পৌঁছে যখন তাঁরা ভিতরে নামলেন, তখন রাত প্রায় দেড়টা। গুহার গা বেয়ে নামতে নামতে শৌণক দেখলেন—দেয়ালের গায়ে খোদাই করা মানুষের শরীর, যেগুলি ছিল একধরনের বুদ্ধমূর্তির বিকৃত প্রতিরূপ। যেন এ এক বৌদ্ধ মঠ নয়, বরং মরণতান্ত্রিকদের উপাসনাস্থল। একটি খাঁজে লুকানো ছিল দ্বিতীয় পুঁথির মূলাংশ—একটি তালপাতার সঙ্কলন, যার চারপাশে রক্তরঙা চিহ্ন। তিনি যখনই সেটি তুলতে গেলেন, হঠাৎ পিছনের দেয়াল ফেটে বেরিয়ে এল এক ছায়ামূর্তি, তার মুখে বাঁকা হাসি—পীযূষ ধর।

পীযূষের উপস্থিতি যেন শূন্যে বিষ ছড়িয়ে দিল। তার চোখদুটি যেন লালচে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এবং ঠোঁটের কোণে সেই পুরনো ভঙ্গিমা—“তুমি এতদিনেও বুঝলে না, শৌণক? এটা শুধু ইতিহাস নয়, এটা ক্ষমতার খেলা।” তার হাতে ছিল একটি ধাতব চাকু, যেটি নাকি তৈরি হয়েছে মৃত সন্ন্যাসীদের হাড় দিয়ে। সে দ্বিতীয় পুঁথি নিজের কাছে চায়, কিন্তু শৌণক বাধা দেয়। ভাগ্যশ্রী তখন এক আশ্চর্য মুদ্রা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে পড়েন, তাঁর কণ্ঠে গর্জে ওঠে তিব্বতি এক মন্ত্র—তালপাতা কাঁপে, গুহার ছাদ থেকে পাথর ঝরতে শুরু করে। শৌণক সেই সুযোগে পুঁথি তুলে নেন, আর তিনজনের মাঝখানে জেগে ওঠে এক প্রবল শব্দ—মৃত সন্ন্যাসীর দেহ থেকে উচ্চারিত হয় একটি বাক্য, যেন কারও রেকর্ডিং চালু হল:
“পঞ্চতন্ত্র একত্র হলেই, সময়ের প্রবাহ থেমে যাবে।”
গুহা কেঁপে ওঠে, জল ঢুকে পড়ে, এবং গুহামুখ বন্ধ হয়ে আসে। তাঁরা তিনজন কোনোমতে পালাতে সক্ষম হন—পীযূষ অদৃশ্য হয়ে যায়। গঙ্গার ধারে ফিরে এসে শৌণক লক্ষ্য করেন, তালপাতার পুঁথির শেষ লাইনটি রক্ত দিয়ে লেখা:
“অধরা শব্দই প্রকৃত জ্ঞান, তাকে ধরতে হলে মৃত্যুকে ছুঁতে হয়।”
ভাগ্যশ্রী পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে বলেন, “শব্দ মানে ধ্বনি নয়, শব্দ মানে প্রাণ। এবং এই মন্ত্র সক্রিয় হয়ে গেছে।” শৌণক বুঝতে পারেন, তিনি কেবল একটি ধাপ পার করেছেন। আর সামনে আছে তিনটি আরও ভয়ানক পথ—প্রতিটিই অপেক্ষায়, আত্মা আর চেতনার চূড়ান্ত পরীক্ষার।

কলকাতার দক্ষিণ শহরের একটি পুরনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল শেডের নিচে লুকিয়ে ছিল সেই জায়গাটি, যার অস্তিত্ব কেবল কল্পনার জগতে ছিল এতদিন। নাম—“শূন্যকেন্দ্র”। অফিসপাড়ার ধারে পরিত্যক্ত এই গুদামঘরটি বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না, ভিতরে প্রবেশ করলেই বোঝা যেত—এটা কোনও সাধারণ সংগঠনের কেন্দ্র নয়। শৌণক ও ভাগ্যশ্রী রাত ঠিক ১২টা নাগাদ পৌঁছান, ভাগ্যশ্রীর হাতে ছিল দ্বিতীয় পুঁথির প্রতিলিপি, আর শৌণকের ব্যাগে কয়েকটি রক্ষাকবচ ও ইতিহাসচিহ্নিত মানচিত্র। গুদামঘরের প্রবেশপথে একটি লাল পাউডারে আঁকা বৃত্ত, আর তার মাঝে সেই পাঁচটি বিন্দু—“লাল চক্র”-এর প্রতীক। ভিতরে প্রবেশ করতেই তাঁরা দেখলেন—এক দল মুখোশধারী, প্রত্যেকের পরনে গেরুয়া ও কালো রঙের মিশ্র পোশাক, এবং গলায় ঝুলছে একটি করোটির মিনিয়েচার। মৃদু ধূপ ও চন্দনের গন্ধে ঘর ভরে আছে, কিন্তু তার নিচে লুকিয়ে একধরনের কৃত্রিম ভয়ের অনুভূতি। মঞ্চের ওপর বসে আছে একজন—সে মুখোশহীন, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে ভয় জাগে। সে-ই পীযূষ ধর। আজ সে শুধুই কালোবাজারি নয়—সে একজন তন্ত্রাচার্য। তার মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি, এবং গলায় জড়ানো আছে এক তালা—যা শুধুই প্রতীক নয়, বরং তান্ত্রিকদের বিশ্বাসে এটি “মৃত্যুর মুখ” রূপে পূজিত। সে বলে, “আমরা কেবল অতীতের ব্যাখ্যা চাই না, আমরা সেই অতীতকে আবার নির্মাণ করতে চাই। এবং তার জন্য চাই পঞ্চতন্ত্র।”পীযূষ বুঝিয়ে দেয়, “লাল চক্র” একটি সংগঠন নয়, একটি বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস—মৃত্যু হলো এক ধরনের বিভ্রম, আর তন্ত্র দিয়ে সেই বিভ্রমকে চূর্ণ করা সম্ভব। তারা পাঁচটি তান্ত্রিক পুঁথি সংগ্রহ করতে চায়, কারণ সেই পুঁথির প্রতিটি মন্ত্র এক একটি ধাপ, যা অমরত্বের দিকে নিয়ে যাবে। এবং তারা মানে, সেই পুঁথিগুলির সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক তান্ত্রিক আত্মা—নামের উল্লেখ নেই, তবে তারা তাকে ডাকে “বাহুবলী” নামে, যার দেহ ধ্বংস হলেও আত্মা বন্দি রয়েছে ভারতের এক গোপন গুহায়, যেখানে সময় প্রবাহমান নয়। শৌণক প্রথমে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ভাগ্যশ্রী তাঁকে থামিয়ে দেন। কারণ এখানে কথা নয়, তথ্যের দাম দেওয়া হয় প্রাণ দিয়ে। হঠাৎই পীযূষ ঘোষণা দেয়—আজ রাতে একটি মন্ত্রপাঠ হবে, যেখানে দ্বিতীয় পুঁথির একটি অংশ ব্যবহার করা হবে। এবং শর্ত—মন্ত্র পাঠের সময় কেউ যদি ভয় পায় বা মন্ত্র ভুল উচ্চারণ করে, তবে তার দেহ জ্বলে যাবে। এই ঘোষণার পরে এক তরুণ সদস্য মন্ত্রপাঠে বসে, কিন্তু উচ্চারণের মাঝেই তার শরীর কাঁপতে শুরু করে, এবং মাত্র কয়েক সেকেন্ডে সে দগ্ধ হয়ে পড়ে। উপস্থিত সকলে মন্ত্র জপ করে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু শৌণক হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে। এমন তন্ত্র কি সত্যিই সম্ভব? ভাগ্যশ্রী তখন বলেন, “তন্ত্র মানেই অলৌকিক নয়। যদি তন্ত্র হয় মন ও শরীরের সম্পূর্ণ অনুশাসন, তবে এই ধ্বংস একটি ‘ব্যর্থ ইচ্ছাশক্তির’ প্রতিফলন।”এই ঘটনার মধ্যেই শৌণক খেয়াল করেন, পীযূষের চারপাশে থাকা মুখোশধারীরা একে একে পঞ্চতন্ত্রের প্রতিটি মুদ্রার হদিস জানে, তাদের হাতে আছে মানচিত্র, গোপন রুট ও প্রাচীন চিহ্নের সংগ্রহ। অথচ কেউই নিশ্চিত নয় কোন পুঁথি কোথায়। কারণ, তান্ত্রিক বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতিটি পুঁথি নিজেই নিজের অবস্থান বদলে নিতে পারে—যদি কেউ তার উদ্দেশ্য বিকৃত করতে চায়। আর এই কথাই প্রথমবার শোনার পর শৌণকের মনে হয়—তাঁরা যত এগোচ্ছেন, তত পুঁথিগুলি যেন তাঁদেরই দিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎই সভাস্থলে ঢুকে পড়ে একজন মহিলা, গায়ের পোশাক ছেঁড়া, চোখে আতঙ্ক—তার গলায় ছিল তালপাতার একটি পাত, আর সেই পাতের ওপর রক্তের দাগে লেখা ছিল মন্ত্রাংশ:
“তৃতীয় পথ—আগুন ও ছায়ার মাঝে সত্য লুকিয়ে থাকে।”
পীযূষ সেই পাতটি দেখে গর্জে ওঠে—এটি তৃতীয় পুঁথির টুকরো! মহিলাটি দাবি করে, সে এক শ্মশানের কাছ থেকে পেয়েছে, যেখানে প্রতি অমাবস্যায় কিছু লোক “ছায়া বলি” দেয়। পীযূষ তাকিয়ে বলে, “তবে এবার আমাদের গন্তব্য শ্মশান। কারণ পঞ্চতন্ত্রের তৃতীয় অংশ অপেক্ষায়।” শৌণক বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় কমে আসছে। ভাগ্যশ্রী কানে কানে বলেন, “যদি ‘ছায়া বলি’র সন্ধানে যাই, তবে শ্মশানে শুধু আত্মা নয়, জীবন্ত প্রহরীও থাকবে। তুমি প্রস্তুত?” শৌণক ধীরে মাথা নাড়ে। কারণ তার হৃদয়ের গভীরে তখন শুধু একটা বাক্য ধ্বনিত হচ্ছিল—“তোমার পিতা সেই শ্মশানেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।” আর ভাগ্য এবার ইতিহাস নয়, প্রতিশোধের রূপ নিচ্ছে।

বারাণসীর দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত অঘোরী শ্মশানঘাট, জনমানবহীন, শহরের বাইরের একটি ঘন বনের মাঝখানে অবস্থিত সেই স্থান, যা স্থানীয়রা অশুভ বলেই জানে। শৌণক ও ভাগ্যশ্রী ঠিক রাত ২টা নাগাদ সেখানে পৌঁছান, লুকিয়ে, নিঃশব্দে। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন না কেউ—না পীযূষ, না অচিন্ত্য সেন। এই অভিযানে কেউ যেতে চায়নি। কারণ এই শ্মশানে নাকি প্রতি অমাবস্যায় হয় এক গোপন “ছায়া বলি”—যেখানে জীবিত মানুষকেই মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে আত্মাহুতির জন্য ব্যবহার করা হয়। ভাগ্যশ্রী মুখে চাদর বেঁধে, হাতে রাখেন রক্ষামন্ত্র খচিত তাম্রচক্র। শৌণকের কাছে একটি বিশেষ নোট ছিল—তাঁর বাবার লেখা এক পাতার চিঠি, যেখানে শুধু তিনটি বাক্য ছিল লেখা:
“শবের ছায়া মিথ্যে নয়।
আগুনই বলে সত্যি।
তৃতীয় পুঁথি মঞ্চের নিচে।”
তাঁরা এক গভীর শ্বাসে গুহার দিকে এগিয়ে যান, যেখানে আগুনের মৃদু আলো ও ধোঁয়ার কুয়াশার ভিতরে সাদা কাপড়ে মোড়া শব রাখা রয়েছে, আর চারপাশে জড়ো হয়েছে একদল মুখোশধারী—তাঁদের কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু চোখদুটি অস্বাভাবিকভাবে লালচে।

মন্ত্রপাঠ শুরু হয়। একজন পুরোহিত-সদৃশ মুখোশধারী সুরে সুরে এক তিব্বতি মন্ত্র পাঠ করতে থাকে, আর প্রতিটি স্তবকে মিলে যায় তালের মতো শবদেহের গায়ে আগুনের ছায়া। সেই ছায়া কখনও শূন্যে উঠে গিয়ে মিলে যায় মেঘে, কখনও ভেদ করে মাটিকে। ভাগ্যশ্রী নিচু গলায় বলেন, “এটা ‘মন্ত্র-ছায়া’—প্রতিটি মন্ত্র একটি আত্মার ছায়াকে আহ্বান করে। যদি ভুল মন্ত্র পড়ে, তবে সেই আত্মা মূর্ত হয়।” শৌণকের শিরদাঁড়ায় শীতলতা বয়ে যায়। সে খেয়াল করে, এক কোণায় রাখা একটি পাথরের বাক্সের গায়ে খোদাই করা সেই পরিচিত চিহ্ন—পঞ্চবিন্দুর বৃত্ত। তার মানে এই ঘাটেই তৃতীয় পুঁথি একসময় ছিল। হঠাৎই উচ্চারণ থেমে যায়। পুরোহিত ঘোষণার মতো গলায় বলে, “আজকের বলি হবে বিশেষ। কারণ আজ আমরা আহ্বান করব মৃত আত্মাকে, যিনি পঞ্চতন্ত্র রচয়িতা ছিলেন।” উপস্থিত সবাই মন্ত্রের তালে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বলি হতে যাওয়া যুবকটির চোখে অস্পষ্ট জ্ঞান, হয়ত তাকে মাদক খাইয়ে আনা হয়েছে। ঠিক যখন তার গলায় ছুরি নামানো হবে, ভাগ্যশ্রী বিদ্যুতের গতিতে এক মুদ্রা ছুঁড়ে দেয় আকাশে—তা বাতাসে বিস্ফোরিত হয়, ছড়িয়ে পড়ে ধূপের মত এক নীল কুয়াশা। শৌণক সামনে ছুটে গিয়ে ছেলেটিকে উদ্ধার করে, আর মুহূর্তেই চারপাশে গমগম করে ওঠে চিৎকার—তন্ত্রপাঠ ব্যাহত হয়েছে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, শ্মশান যেন কেঁপে ওঠে নিজের গোপন ক্রিয়ায়।

এগিয়ে এসে শৌণক সেই পাথরের বাক্স ভাঙেন একটি ধাতব রড দিয়ে। ভেতরে পাওয়া যায় তালপাতায় মোড়া একটি পুঁথি, যার চারপাশে সিঁদুরে আঁকা মন্ত্রচক্র। ভাগ্যশ্রী সেটা হাতে নিয়ে বলে, “এই পুঁথি নিজেই রক্ত চায় না, কিন্তু যাঁরা একে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে চায়, তাদেরই রক্ত লাগে।” বাক্সের গায়ে খোদাই করা ছিল তৃতীয় মন্ত্র—
“আগুন আর ছায়ার মধ্যেই সত্য জন্ম নেয়। শব নয়, ছায়াই পথ দেখায়।”
সেই সময়ই ছায়ার আড়ালে দেখা যায় পীযূষকে—সে শ্মশানের এক কোণে দাঁড়িয়ে হাসছে। তার চোখে সেই পুরনো শীতলতা, ঠোঁটে বিষাক্ত আত্মবিশ্বাস। সে বলে, “তোমরা ভেবেছ একেকটা পুঁথি উদ্ধার মানেই জয়? পঞ্চতন্ত্র নিজে কাউকে বেছে নেয়, আর কাউকে বর্জন করে। শেষ পর্যন্ত তোমরাও পুঁথির দাস হয়ে যাবে।” ভাগ্যশ্রী তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, “তন্ত্র যার আত্মার ভিতরে নেই, সে কেবল পুড়ে যায়। এই পুঁথি আমাদের বেছে নিয়েছে।” গর্জনের শব্দে মেঘ ছিঁড়ে যায়। পীযূষ অদৃশ্য হয়, শ্মশানের মুখ ঢেকে যায় কুয়াশায়। শৌণক প্রথমবার অনুভব করেন—এই পুঁথিগুলি কেবল ইতিহাস নয়, এগুলি যেন সচেতন সত্তা, যারা নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, কার হাতে যাবে, আর কাকে করবে ধ্বংস। পেছনে ফেলে তাঁরা যখন শ্মশান ছাড়লেন, তখন পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠছে, আর পুঁথির পাতায় জেগে উঠছে রক্তরঙা একটি নতুন শব্দ—“অগ্নিবিন্দু”। এই শব্দের মানে তারা তখনও জানতেন না, কিন্তু ইতিহাস ঠিকই জানত—এই শব্দ মানে মৃত্যু নয়, নতুন এক জন্ম। এবং পঞ্চতন্ত্রের চতুর্থ স্তর তারই অপেক্ষায়।

কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে, গলির শেষে এক পুরনো জমিদারবাড়ি, যার নাম কারও মুখে নেই, ঠিকানাও সরকারি নথিতে নেই—তবে শৌণক জানতেন এখানেই রয়েছে মুখোশধারী গোষ্ঠীর মূল কেন্দ্র। এই গোষ্ঠী “লাল চক্র”-এর ছায়াগোষ্ঠী, যারা নিজেদের বলে “অভিশপ্ত বাহুবলীবংশ”। ভাগ্যশ্রীর কাছ থেকে শোনা গেছে, এই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব প্রাচীন গুপ্তযুগ থেকে, এবং তারা বিশ্বাস করে যে মুখোশই প্রকৃত পরিচয়—মানুষের মুখ নয়। বিকেলে যখন তারা সেই বাড়িতে পৌঁছায়, তখন চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বিবর্ণ রঙের কাঁচ, ভাঙা বারান্দা, আর নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ানো কালো বিড়াল। ভিতরে ঢুকতেই অন্ধকার তাদের গিলে ফেলে। কোনও আলো নেই, শুধু কিছু প্রাচীন তাম্রচিত্র আর খোদাই করা মুখোশ ঝোলানো কাঠের দেওয়ালে। একটা ঘরে গিয়ে তারা দেখতে পায় এক বৃদ্ধ—দৃষ্টিহীন, কিন্তু যেন সব জানেন। তাঁর নাম বলা হয় না, তাঁকে ডাকা হয় “নীরব পাঠক” নামে। তিনি জানতেন শৌণক আসবেন, কারণ তাঁর কথায়—“তোমার পিতা আমার শেষ শিষ্য ছিলেন।” এই বাক্যই শৌণকের শিরদাঁড়ায় বিদ্যুৎ নামিয়ে দেয়। বৃদ্ধ জানান, তাঁরাই বাহুবলীর ইতিহাস রক্ষা করে চলেছে—বাহুবলী এক তান্ত্রিক সম্রাট ছিলেন, যিনি পাঁচটি পুঁথি রচনা করেন। কিন্তু তার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, এবং গোপন মন্ত্রচক্রের মাধ্যমে তাঁকে সময়চক্রে বন্দি করা হয়—এক বৃত্তে, যেখানে কাল কখনো এগোয় না, কখনো ফিরে আসে।

বৃদ্ধ এক দেয়াল ঘুরিয়ে শৌণক ও ভাগ্যশ্রীকে নিয়ে যান এক গোপন কক্ষে। সেখানে রাখা ছিল শতাধিক মুখোশ—প্রতিটি মানুষের দুঃস্বপ্নের মতো বিকৃত, কোনটি করোটির মতো, কোনটি জন্তুর মুখে পরিণত। এই মুখোশগুলো নাকি সেইসব আত্মাদের, যারা বাহুবলীর পুঁথির সন্ধানে এসে হারিয়ে গেছে। নীরব পাঠক জানান, তৃতীয় পুঁথির ছায়া একে একে তাদের মগজে গেঁথে দিয়েছে চিত্র—আর এই চিত্রগুলোর সম্মিলিত রূপ তৈরি করেছে “চতুর্থ পুঁথির মডিউল”—এক ধরনের তান্ত্রিক ম্যাপ, যা সময়ের মধ্য দিয়ে পথ খুলে দেয়। মুখোশের একটিতে ছিল অদ্ভুত আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা একটি বাক্য:
“কালচক্রে ফিরে আসে সে, যাকে সময়ই ছাড়েনি।”
এই চিহ্ন দেখে ভাগ্যশ্রী চমকে ওঠেন—কারণ এটি তাঁর স্বপ্নে বারবার এসেছে। এই একই চিহ্ন তিনি দেখেছিলেন থুকজাং আশ্রমের নিচে, যেখানে তাঁকে বলি দেওয়া হয়েছিল একটি সাধনায়—যেখানে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। সেইদিন থেকে তিনি বুঝেছিলেন—তাঁর জীবনের সঙ্গে পঞ্চতন্ত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। নীরব পাঠক তখন আরও বলেন—শৌণকের বাবাও একদিন এই সময়চক্রের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন, আর আর কখনো ফেরেননি। তিনি তাঁর পুত্রকে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন—“পঞ্চতন্ত্র কখনো উদ্ধার হয় না, তা শুধুই আবিষ্কারের ভ্রান্তি।”

তবে দেরি হয়ে গেছে। সেই বাড়ির নিচে, এক সিঁড়িপথ ধরে তাঁরা নামেন যেখানে রয়েছে “মুখোশগৃহ”—এক বিস্মৃত গুহা, যেখানে সময় বাস্তব নয়। সেখানে দাঁড়িয়েই তাঁরা প্রবেশ করেন **“কালচক্র গুহা”**য়—এক স্থানে, যেখানে ঘড়ি থেমে থাকে, শব্দ ফিরে আসে, এবং ছায়া বলে দেয় ভবিষ্যৎ। দেয়ালে খোদাই করা অদ্ভুত চক্র, যার কেন্দ্রস্থলে লেখা:
“চতুর্থ পুঁথি নিজে আসবে, যখন আত্মা চিনবে নিজেকে।”
ঠিক তখনই শৌণক যেন দেখতে পান—তাঁর পিতা, তরুণ বয়সে, মুখে দুঃখ, হাতে পুঁথি। মুহূর্তেই চিত্র মুছে যায়। ভাগ্যশ্রী অনুভব করেন—এই গুহা প্রকৃতপক্ষে এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, যা পঞ্চতন্ত্র রক্ষার জন্য তৈরি হয়েছিল। আর চতুর্থ পুঁথি আর কাগজে নেই—তা এখন ভাগ্যশ্রীর শরীরেই বিরাজ করছে। তাঁর হাতের একটি পুরনো দাগে জেগে ওঠে তাম্রচক্র। নীরব পাঠক বলেন, “পঞ্চতন্ত্র তোমাকে গ্রহণ করেছে। এখন পঞ্চম পুঁথির সন্ধান তুমি ছাড়া কেউ করতে পারবে না।” সেই মুহূর্তেই এক প্রবল শব্দ, গুহার ভিতর কাঁপন, আর মুখোশগুলো একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায়—শতাব্দীর ক্লেদে ভেজা সেই আত্মারা জেগে ওঠে। শৌণক ও ভাগ্যশ্রী কোনোমতে পালিয়ে উপরের জগতে ফিরে আসেন, কিন্তু জানতেন—তাঁদের সময় এখন তাঁদের জন্য অপেক্ষা করবে না। কারণ কালচক্রে একবার ঢুকলে, সময় আর সোজাসাপ্টা চলে না। বাহুবলীর মুখোশ হয়তো আজও বেঁচে আছে, হয়তো শ্বাস নেয় কারও শরীরে।
এবং পঞ্চতন্ত্র এখন কেবল পুঁথি নয়, এখন তা নিজেই এক প্রাণ।

লাদাখের নুব্রা উপত্যকায় যখন শৌণক ও ভাগ্যশ্রী পৌঁছলেন, তখন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ যেন এক বিশাল নিঃশব্দের মধ্যে মিশে গেছে। তুষারপাত থেমে ছিল, কিন্তু বাতাস ছিল ধারালো—একধরনের অতল ঠাণ্ডা, যা কেবল ত্বক নয়, আত্মাও বিদীর্ণ করে। দু’জনের গন্তব্য ছিল থুকজাং আশ্রমের বহু ঊর্ধ্বে অবস্থিত এক তুষারগুহা—যার অবস্থান কেবল জানেন একজন, আশ্রমের সবচেয়ে প্রাচীন তাপসী, নাম মাতুং শ্রী। এই সাধিকা প্রায় এক শতাব্দী ধরে নীরবতাব্রত পালন করে আসছেন, এবং তাঁর কাছে নাকি লুকিয়ে আছে পঞ্চম পুঁথির শেষ সংকেত। আশ্রমে পৌঁছে তাঁরা জানতে পারেন, শৌণকের পিতা মৃত্যুর এক বছর আগে এখানে এসেছিলেন, এবং এক রাত গুহায় কাটিয়ে ফিরেও যাননি। ভাগ্যশ্রী এই খবর শুনে এক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে যান—তিনি জানতেন, এবার তাঁদের জন্য সহজ হবে না কিছুই। ঠাণ্ডার কামড়ে শরীর বেঁধে আসছিল, তবু তাঁরা উঠে চলেন তুষারঢাকা পথ ধরে, যেখানে প্রতিটি পা ফেললেই কাঁপে বরফ, আর নিচে লুকিয়ে থাকে শতাব্দীর পুরোনো গুহা, যা তৈরি হয়েছিল তন্ত্ররক্ষার জন্য, কিন্তু নিজেই হয়ে উঠেছে তন্ত্রের জীবন্ত প্রতিরূপ।

তুষারগুহার প্রবেশপথে পৌঁছে ভাগ্যশ্রী মাটিতে বসে ধ্যানমগ্ন হন। তাঁর কপালে ফুটে ওঠে একটি তাম্রবৃত্ত, যা চতুর্থ পুঁথির স্পর্শে সেদিন জেগে উঠেছিল। শৌণক তখন চেয়েছিলেন কিছু বলতে, কিন্তু শব্দ গিলে নেয় বরফ। হঠাৎই, কুয়াশার আড়াল থেকে এগিয়ে আসেন মাতুং শ্রী—এক ক্ষীণকায়, কিন্তু চোখদুটোতে ভয়ানক দীপ্তি। তিনি কিছু বলেন না, শুধু এক নিঃশব্দ ইশারায় তাদের নিয়ে যান গুহার গভীরে, যেখানে নেই আলো, নেই শব্দ, শুধু হিমশীতল এক ঘূর্ণিপথ। অনেকটা এগিয়ে, এক পাথরের স্তম্ভের নিচে থামেন মাতুং শ্রী, তারপর হঠাৎই মুখে উচ্চারণ করেন—“শেষ পুঁথি কোনো কাগজ নয়। তা লুকিয়ে আছে আত্মার আয়নায়।” তাঁর চোখ পড়ে ভাগ্যশ্রীর দিকে। “তুমি বেছে নিয়েছো পঞ্চতন্ত্রকে, এখন পঞ্চতন্ত্রও তোমার ভিতর লুকিয়ে পড়েছে। পঞ্চম স্তর মানে আত্ম-পরীক্ষা।” গুহার ভিতরে তখন শোনায় দেয় আশ্চর্য এক প্রতিধ্বনি—যেন হাজার বছর আগের কোন মন্ত্র ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। হঠাৎই, শৌণক দেখতে পান তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ—তাঁর পিতা। কিন্তু তিনি মৃত! তাঁকে দেখে শৌণক এগিয়ে যেতে চায়, কিন্তু ভাগ্যশ্রী বাধা দেন। “এটি মায়া—তন্ত্রের পরীক্ষার অংশ।”

কিন্তু সেই মায়া কথা বলে। “তুমি যা খুঁজছ, তা তুমি নিজেই। তন্ত্র কেবল বাহ্যিক পুঁথি নয়, তা নিজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার সাহস। পঞ্চম পুঁথি খুঁজতে গেলে, নিজেকে ভাঙতে হবে।” সেই মুহূর্তে গুহা কেঁপে ওঠে। মাতুং শ্রী তখন বলেন, “তোমাদের কেউ একজন আজকে গুহার বাইরে ফিরবে, আর একজন রয়ে যাবে এখানে, চিরদিনের জন্য। কারণ আত্মা চায় অর্ঘ্য।” গুহার চারপাশে বরফ জমে ক্রমে গলে যাচ্ছে, আর বরফের নিচে জেগে উঠছে তাম্রলিপিতে খোদাই—পঞ্চম মন্ত্র:
“নিজেকে জয় করলেই মৃত্যুকে জয় করা যায়। পঞ্চতন্ত্র তখনই সম্পূর্ণ, যখন আত্মা হয় নির্ভয়।”
ভাগ্যশ্রী এগিয়ে যান সেই খোদাইয়ের কাছে। তখনই তাঁর মাথার চুল বাতাসে উড়তে থাকে, ত্বক গরম হয়ে ওঠে, আর চোখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত দীপ্তি। তিনি ধীরে বলেন, “এই পুঁথি এখন কেবল আমাকে নয়, আমার মধ্য দিয়ে তোমাকেও গ্রহণ করছে, শৌণক।” এবং সেই মুহূর্তে পঞ্চম পুঁথির চিহ্ন জেগে ওঠে দু’জনের শরীরে—দুটি আলাদা তিল, যেগুলো মিলে একটি পূর্ণ চক্র গঠন করে। মাতুং শ্রী মৃদু হাসেন—“তোমরা একত্রে যখন পঞ্চতন্ত্রকে ছুঁয়েছ, তখন তা এবার মুক্ত। বাহুবলীর সময়চক্র শেষ, নতুন সময়ের প্রবেশ শুরু।” গুহা এবার ফাটতে শুরু করে, চারপাশে ধ্বংস, শিলাচ্যুতিপূর্ণ শব্দ, আর একটি আলোয় ঢাকা বিস্ফোরণ।
তবে শৌণক আর ভাগ্যশ্রী তখন উঠে এসেছেন গুহার ওপরে, তাদের চারপাশে অন্ধকার। কেবল হৃদয়ের ভিতরে পঞ্চতন্ত্রের মন্ত্র, যার অর্থ তখনই খুলছে—“তন্ত্র বাহ্য নয়, তা আত্মসন্ধান। এবং তার চাবিকাঠি শুধু সাহস।”

লাদাখ ছেড়ে ফেরার পথে শৌণক ও ভাগ্যশ্রী বারংবার অনুভব করছিলেন—তাঁরা আর আগের মানুষ নন। পঞ্চতন্ত্রের পঞ্চম স্তর শুধু তাদের বাহ্যিক অভিযানে নয়, এক আত্মিক রূপান্তরের মধ্য দিয়েও নিয়ে গেছে। তবে এখনও ছিল একটি বাকি—শেষ রহস্য, বাহুবলী। পঞ্চপুঁথির মূলে যে আত্মা বন্দি, তাকে মুখোমুখি না হলে কিছুই সম্পূর্ণ হবে না। এবং সেই মুখোমুখি হওয়ার একমাত্র জায়গা, জানাল মাতুং শ্রী, হল ভৈরবকুণ্ড—ভারত-নেপাল সীমান্তের ঠিক এক মৃত আগ্নেয়গিরির গহ্বর। কথিত আছে, একসময় এই গহ্বরে তন্ত্রযোগীরা বলি দিত আত্মা আহ্বানের জন্য। পঞ্চতন্ত্র অনুযায়ী, এখানেই বাহুবলী সময়চক্রে বন্দি রয়েছেন, তাঁর আত্মা ঘুরপাক খাচ্ছে কালের ঘূর্ণিতে। তাঁদের গন্তব্য তখন ঠিক হল—ভৈরবকুণ্ড।

সেখানে পৌঁছানো সহজ নয়। পুরনো রাস্তাগুলি বরফে ঢাকা, পাহাড়ের পাথর একেকটা জীবন্ত বিপদ। কিন্তু আরও ভয়ংকর ছিল অদৃশ্য এক আকর্ষণ, যা তাঁদের ক্রমাগত গন্তব্যের দিকে টানছিল। ভাগ্যশ্রী বলেন, “তন্ত্র এখন আমাদের টানছে। আমরা আর খুঁজছি না—তন্ত্র আমাদের খুঁজে নিচ্ছে।” ভৈরবকুণ্ডের কাছে পৌঁছে তাঁরা এক গহ্বরের মুখে দাঁড়ান—গভীর, কুয়াশাচ্ছন্ন, আর একদম নীচ থেকে উঠে আসছে এক ছায়াশব্দ—যেমন মৃত কেউ নিজের নাম ভুলে গিয়েছে, কিন্তু উচ্চারণ করছে কিছু… আবার কিছু… বারবার। তাঁরা গুহায় নামার মুহূর্তে চারপাশে বাতি নিভে যায়। তুষার নেমে আসে পাথরের ফাঁক গলে। এবং তারপর, আলোহীন সেই গহ্বরে, তাঁরা দেখতে পান—একজন মানুষ বসে আছেন, বা বলা ভালো—চক্রাকারে বাঁধা আত্মা। তাঁর শরীর নেই, চোখ নেই, মুখ নেই। কেবল একটা ছায়া। চারপাশে পাঁচটি মুদ্রার মতো ঘুরছে শব্দ, আলো, তপ্ত নিঃশ্বাস।
তিনি বলেন না কিছুই, কিন্তু শব্দ শোনা যায় শৌণকের মাথার ভিতরে:
“তুমি এসেছো আমার গল্প শেষ করতে, না কি নিজেই সেই গল্পের অংশ হতে?”
শৌণক কেঁপে ওঠেন। ভাগ্যশ্রী তাঁর কাঁধে হাত রাখেন। দু’জনেই বুঝতে পারেন—এটা বাহুবলীর শেষ পরীক্ষা।

ভাগ্যশ্রী এগিয়ে যান। বলেন, “তুমি একসময় পঞ্চতন্ত্র রচনা করেছিলে, মানুষের আত্মসংশোধনের জন্য। কিন্তু তুমি নিজেই তার ফাঁদে পড়ে গেলে। মুক্ত হতে গেলে, এখন তোমাকেই নিজের সৃষ্টি ছিঁড়ে ফেলতে হবে।” ছায়া তখন এক চিৎকারে ভেঙে পড়ে, চারপাশ কাঁপতে থাকে। বাহুবলীর আত্মা ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক পূর্ণদেহে—যেন তুষার-ভরা এক মূর্তি, যার চোখ দুটি উজ্জ্বল আগুনের মতো। সে শৌণকের দিকে এগিয়ে আসে।
“তুমি ইতিহাসকে ভুল ব্যাখ্যা করছ। আমি তৈরি করেছিলাম পঞ্চতন্ত্র, কারণ মানুষকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলাম, রক্ষা নয়। তন্ত্র যদি কারও হাতিয়ার হয়, তবে সেটি অস্ত্র; আর যদি আত্মার আয়না হয়, তবে সেটি ভ্রান্তি। আমি ক্ষমতা চেয়েছিলাম, এবং সেই চাওয়ার মধ্যে হারিয়েছিলাম নিজেকে। কিন্তু এখন আমি ফিরে আসতে চাই।”
শৌণক ধীরে বলেন, “তুমি ফিরে এলে, তন্ত্র শুধু ইতিহাস নয়—তা আবার রক্তের হয়ে উঠবে। তোমাকে থামতেই হবে।”
বাহুবলী ফুঁসে ওঠে—তার চিৎকারে গুহার গায়ে আগুন জ্বলে ওঠে, দেয়ালে ফুটে ওঠে পঞ্চতন্ত্রের প্রতিটি মন্ত্র, প্রতিটি ঘূর্ণি ঘুরতে ঘুরতে রক্তে রূপ নেয়। শৌণক ও ভাগ্যশ্রী তখন একসঙ্গে মন্ত্রপাঠ শুরু করেন—পঞ্চপুঁথির সেই শেষ সংযুক্ত ধ্বনি, যা একত্রে উচ্চারণ করলে তন্ত্র নিজেই নিজের শৃঙ্খল ভাঙে।
“ওঁ হ্রিং কালে, নিজম দেহে পরাভব।
আত্মে সিদ্ধি, শব্দে বন্ধন, শূন্যে মুক্তি।”
আলো, অন্ধকার, আত্মা—সব মিশে এক দমকা হাওয়ায় ছিন্ন হয়। বাহুবলী ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েন—শরীর নয়, আত্মা। তিনি বলেন শেষবার, “তোমরা পারলে… পঞ্চতন্ত্র এখন তোমাদের। এবার মানুষ হয়তো সত্যি শিখবে—ক্ষমতা নয়, আত্মজ্ঞানই মুক্তির পথ।”
গুহা ভেঙে পড়ে না, বরং শান্ত হয়। চারপাশ নিঃশব্দ। পঞ্চপুঁথি মিশে যায় বাতাসে, আলোয়, শ্বাসে।

শৌণক ও ভাগ্যশ্রী উঠে দাঁড়ান। দু’জনেই জানেন, অভিযান শেষ। কিন্তু এর পরিণতি শুধু তাঁদের মধ্যে থাকবে না। পৃথিবী জানবে না এই যুদ্ধের কথা, কিন্তু ইতিহাস বদলে যাবে। বাহুবলী আর নেই, কিন্তু তাঁর ত্রুটি—ক্ষমতা চাওয়ার মোহ—মানুষের মধ্যেই বেঁচে থাকবে। আর পঞ্চতন্ত্র? এখন আর তা বই নয়, পাথর নয়, গুহা নয়। তা এখন মানুষের মধ্যে, তাঁদের ভেতরের তন্ত্রে।
শৌণক ভাগ্যশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুমি কি জানো, তুমি নিজেই পঞ্চতন্ত্রের পঞ্চম স্তর হয়ে উঠেছ?”
ভাগ্যশ্রী হেসে বলেন, “আর তুমি সেই পাঠক, যে কেবল ইতিহাস পড়েনি, তাকে বাঁচিয়ে তুলেছে।”
তুষার হিম বাতাসে এক নতুন সূর্যের আলো ফুটে ওঠে। গুহার বাইরে এক নতুন দিন অপেক্ষায়।

কলকাতা ফেরার পর প্রথম কয়েকদিন যেন নিঃশ্বাস ফেলারও সময় ছিল না। বাহুবলীর আত্মা নিঃশেষ হলেও তার কীর্তির রেশ রয়ে গেছে চারপাশে—পুরনো তান্ত্রিক কেন্দ্রগুলো, মুখোশধারী চক্রের ছায়া, আর একটি গোপন যুদ্ধ যা ইতিহাসে কখনও লেখা হবে না। শৌণক নিজেকে গ্রন্থাগারে নিমজ্জিত করলেন—তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটাই, পঞ্চতন্ত্রের প্রত্যেকটি স্তরের ঐতিহাসিক প্রতিফলন খুঁজে বের করা। ভাগ্যশ্রী তখন কাজ করছিল অচিন্ত্য সেনের সংগৃহীত সেই গুপ্তচিহ্ন নিয়ে, যা তাঁরা তৃতীয় পুঁথির সময় পেয়েছিলেন—একটি তাম্রফলকে খোদাই করা ছিল অদ্ভুত রক্তমিশ্রিত চিহ্ন, যা দেখতে ছিল এক মৃত নারী দেহের মতো। প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু ভাগ্যশ্রী বুঝতে পারেন—এই চিহ্ন একটি তান্ত্রিক হত্যার সাক্ষ্য, যা গুপ্তযুগে ঘটেছিল এবং রেকর্ড রাখা হয়েছিল শুধুমাত্র পঞ্চম পুঁথির শেষ পাতায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই পাতাটি কখনও বাহুবলীর হাতে ছিল না। তাহলে তা কোথায় গেল?

একটি সন্ধ্যায়, দক্ষিণ কলকাতার এক পরিত্যক্ত গোডাউনে এক মৃতদেহ পাওয়া যায়। দেহটি বসানো ছিল তান্ত্রিক ভঙ্গিতে—পদ্মাসনে, দু’হাত প্রসারিত, কপালে খোদাই করা সেই একই রক্তচিহ্ন। পুলিশ প্রথমে আত্মহত্যা ধরে নেয়, কিন্তু ভাগ্যশ্রী বলেন, “এটা বলি। ছায়া বলি নয়—এটা প্রতিশোধ বলি।” পোস্টমর্টেমে জানা যায়, মৃত ব্যক্তি ছিলেন এক প্রত্নতত্ত্ববিদ—নাম দীপঙ্কর দে, যার কাজ ছিল পঞ্চতন্ত্রের ছায়া-রচনাগুলি সংগ্রহ করা, এবং যিনি নিখোঁজ ছিলেন গত দুই বছর। তাঁর নখের নিচে পাওয়া যায় এক সুক্ষ্ম লাল কালি—পরীক্ষায় জানা যায়, এটি তৈরি হয়েছে মানব রক্ত ও চন্দনের মিশ্রণে, যা ব্যবহৃত হত কেবল “নির্ঘণ্ট বলি মন্ত্রে”—একটি নিষিদ্ধ তন্ত্রপাঠ, যা বাহুবলী নাকি শেষবার ব্যবহার করেছিলেন একজন নারীকে বলি দিতে, যিনি সেই পঞ্চম পাতার মূল লেখক ছিলেন। এ কথা শুনে শৌণক স্তব্ধ হয়ে যান—তাঁর মনে পড়ে মাতুং শ্রী বলেছিলেন, “পঞ্চতন্ত্রের শেষ স্তর আত্মার, কিন্তু তার পৃষ্ঠাগুলি কেউ একা লেখেনি।” তবে কি সেই নারী ছিলেন বাহুবলীর প্রতিদ্বন্দ্বী? ভাগ্যশ্রী বলেন, “সম্ভবত তিনিই পঞ্চম পুঁথির আসল ধারক। বাহুবলী কেবল দখল করতে চেয়েছিলেন।”

তদন্ত করতে গিয়েই তাঁরা আবিষ্কার করেন, কলকাতার এক প্রাচীন কালীমন্দিরের নিচে রয়েছে একটি বন্ধ সুড়ঙ্গ, যা অতীতে তান্ত্রিক বলির জন্য ব্যবহৃত হত। সেখানে গেলে তাঁরা খুঁজে পান কিছু পুরনো হাড়গোড়, আর একটি আধভাঙা প্রতিমূর্তি—এক নারী, যার কপালে খোদাই সেই একই রক্তচিহ্ন। ভাগ্যশ্রী বুঝতে পারেন—এই নারীই ছিলেন সেই আসল লেখক, বাহুবলীর আত্মিক প্রতিদ্বন্দ্বী। তার আত্মা হয়ত মুক্ত হয়নি। কারণ প্রতিশোধ তখনও বাকি ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, এবং এক সুরেলা কণ্ঠ শোনা যায়—“আমার লেখা কে নিয়েছে? আমি কি ফিরতে পারি?”
তাঁরা বুঝতে পারেন—এটা আত্মার আকুতি নয়, এটা জাগরণ।
এখনকার হত্যাগুলো কে করছে? বাহুবলী তো শেষ। তবে কি কেউ নতুন বাহুবলী হয়ে উঠছে?
শৌণক বলেন, “যদি কেউ আবার সেই নারী আত্মাকে বন্দি করতে চায়, তবে সে পঞ্চতন্ত্রের ক্ষমতা চায় বাহুবলীর থেকেও বেশি।”
আর সেই ব্যক্তি কে, সেটা হয়তো তাঁদের কাছেই রয়েছে—একজন যিনি পঞ্চতন্ত্রের ছায়ায় বড় হয়েছেন, নিজেকে রক্ষাকারী বলে দাবি করেন, কিন্তু হয়তো তিনি-ই নতুন চক্রের স্রষ্টা।

গল্পের মোড় এবার নিচ্ছে এক নতুন ছায়ার দিকে—
পঞ্চতন্ত্র শেষ হয়নি। তা এখন ফিরে এসেছে নারীর কণ্ঠে, রক্তের প্রতিশোধে।

সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সাল। গুপ্ত সাম্রাজ্য তখন নিজের সোনালি কাল পেরিয়ে প্রবেশ করছে এক ছায়াচ্ছন্ন অধ্যায়ে। ক্ষমতার উন্মাদনা এবং আত্মিক ব্যর্থতা, উভয়ের মধ্যবর্তী ছায়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এক তন্ত্রসংঘ, নাম ছিল—ঋণচক্র মণ্ডল। বাহ্যিকভাবে তারা ছিল রাজদরবারের জ্যোতির্বিদ, ঔষধ প্রস্তুতকারক, আচার্য; কিন্তু গোপনে তারা পরিচালনা করত এক অদৃশ্য সাম্রাজ্য, যেখানে আত্মা, শরীর ও ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করা হত মন্ত্রের মাধ্যমে। আর এই গোষ্ঠীর প্রধান রচনাকারী ছিলেন বাহুবলী—এক প্রতিভাবান কিন্তু ক্রমাগত ক্ষমতার দিকে ধাবিত ব্রাহ্মণ তান্ত্রিক, যিনি চারটি পুঁথি রচনা করেন—মন্ত্রতন্ত্র, ছায়াতন্ত্র, শরীরতন্ত্র, ও অগ্নিতন্ত্র। পঞ্চমটি তখনও অসম্পূর্ণ ছিল—কারণ বাহুবলী জানতেন না আত্মার কথা। তিনি জানতেন যন্ত্র, প্রক্রিয়া, বলি, নিয়ন্ত্রণ—কিন্তু জানতেন না ছেড়ে দেওয়ার ভাষা। আর ঠিক তখনই আবির্ভাব ঘটে ঋণবালা নামের এক যুবতীর—যিনি ছিলেন এক বহিষ্কৃত জনজাতি থেকে আসা, শিক্ষায় সিদ্ধ, কণ্ঠে মন্ত্র, হৃদয়ে করুণা।

ঋণবালা বাহুবলীর সংস্পর্শে এসে প্রথমে তাঁকে সাহায্য করতে শুরু করেন পঞ্চম পুঁথির রচনায়, কিন্তু অচিরেই বোঝেন—বাহুবলী যে তন্ত্র গড়ে তুলতে চাইছেন, তা মুক্তির নয়, তা বন্দিত্বের। তিনি বোঝেন, যদি আত্মতন্ত্র বাহুবলীর হাতে পড়ে, তবে মানুষ আর নিজস্ব চিন্তায় চলতে পারবে না—তন্ত্র হয়ে উঠবে এক আত্মিক দাসত্ব। এই উপলব্ধির পর তিনি গোপনে রচনা করেন “পঞ্চম পৃষ্ঠার অন্তর্লিখন”—এক তাম্রলিপি, যেখানে লিপিবদ্ধ ছিল এমন এক মন্ত্র, যা আত্মাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারে, এমনকি অতীত-ভবিষ্যৎ দুই সময়চক্রকে ভেদ করে জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তা জানতে পারলে বাহুবলী নিশ্চয়ই তাঁকে ধ্বংস করতেন। এবং সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। এক রাতে, বাহুবলী যখন জানতে পারেন ঋণবালা পঞ্চম স্তর গোপনে সম্পূর্ণ করেছেন, তখন তাঁর অভিশপ্ত ক্রোধে তিনি চালিয়ে দেন “নির্ঘণ্ট বলি”—যে মন্ত্রে মানুষের আত্মা ছেঁকে নেওয়া হয় তার শরীরচিত্র থেকে। ঋণবালাকে এক কালিমন্দিরে বলি দেওয়া হয়, অথচ তাঁর রচিত পৃষ্ঠাটি তখনও তাঁর শরীরেই ছিল—তাঁর আত্মার গভীরে। বাহুবলী সেই পাতাটি কখনও খুঁজে পাননি। কিন্তু তাঁর অভিশাপ ছিল—যদি পঞ্চম পুঁথি পূর্ণ হয় কখনও, তবে তার আত্মা চিরদিন বন্দি থাকবে সময়চক্রে, ঋণবালার ছায়ার সামনে।

আজ এত শতাব্দী পর, শৌণক ও ভাগ্যশ্রী সেই ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছেন। ভাগ্যশ্রীর স্বপ্নে এখন ঘুরে ফিরে আসে সেই মুখ—ঋণবালার কণ্ঠস্বর, তাঁর আর্তনাদ, আবার তাঁর অভিভাবক-সুলভ শান্ত বচন। কখনও তিনি বলেন, “তুমি ফিরে এসেছো। এবার তুমি আমার অসমাপ্ত কথা বলবে।” কখনও তিনি বলেন, “তন্ত্র বন্দি নয়, তা স্রোত। তুমি যদি গলায় শঙ্খধ্বনি পেতে চাও, তবে তোমাকেই হতে হবে সমুদ্র।” শৌণক বুঝতে পারেন—পঞ্চতন্ত্রের এই পুনর্জাগরণ কেবল বাহুবলীর জন্য ছিল না। এটি ছিল ঋণবালার স্মৃতি ফেরানোর প্রতিশোধ, একজন নারী ইতিহাসে যার স্থান ছিল না, অথচ তিনিই ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ভাগ্যশ্রী তখন বলেন, “আমরা যদি সত্যিই পঞ্চতন্ত্রকে সম্পূর্ণ করতে চাই, তাহলে আমাদের ফিরতে হবে সেই জায়গায়—যেখানে ঋণবালাকে বলি দেওয়া হয়েছিল। কারণ এখনও… তাঁর আত্মা ফিরে চায় তার পৃষ্ঠা। এবং সে পৃষ্ঠা শুধু কাগজে নেই, সে রক্তে লেখা, স্মৃতিতে বাঁধা।”
তখনও তারা জানত না—কলকাতার সেই পুরনো মন্দিরের নিচে, এখনও অপেক্ষা করছে এক অসমাপ্ত আত্মা…
আর তার অপেক্ষা, শুধুই প্রতিশোধের নয়—তা ছিল শেষ মুক্তির।

১০

কলকাতার বুকে এমন কিছু স্থান আছে যেগুলোর অস্তিত্ব নথিতে নেই, অথচ শহরের আত্মায় তারা গেঁথে আছে যুগ যুগ ধরে। দক্ষিণ শহরের এক গলির ধারে রয়েছে একটি ভগ্নপ্রায় মন্দির, যার ভেতরের গর্ভগৃহ বন্ধ বহু দশক ধরে, আর নিচে একটি সুড়ঙ্গ, যা নাকি সরাসরি পৌঁছে দেয় এক অদৃশ্য বলিগৃহে। এই স্থানেই এক সময় বলি দেওয়া হয়েছিল সেই নারীকে—ঋণবালাকে—যিনি ছিলেন পঞ্চতন্ত্রের আত্মতত্ত্বের রচয়িতা। সেই রাতেই, বহু শতাব্দী পরে, আবার খুলে দেওয়া হয় সেই সুড়ঙ্গ। শৌণক ও ভাগ্যশ্রী হাতে করে প্রাচীন তাম্রমুদ্রা ও চতুর্থ পুঁথির ছায়ামন্ত্র নিয়ে নামেন ধাপে ধাপে নিচের দিকে। প্রতিটি ধাপের পরে বাতি নিভে আসে, যেন অন্ধকার নিজেই চাইছে তাদের গ্রাস করতে। মেঝেতে পড়ে থাকা শিকল, গন্ধে মেশানো রক্ত আর চন্দনের ছাপ, আর দেয়ালে খোদাই করা “হ্রিং কালে আত্মবিন্দু” মন্ত্রটি শীতল স্নায়ুর ভিতরে চিৎকার তোলে। ভাগ্যশ্রী মনে মনে জপ করেন একটি আত্মমন্ত্র—“আমি আসছি, ঋণবালা। আমি শুনছি তোমার কথা।”

নিচে পৌঁছাতেই দেখা যায়, একটি গোলাকৃতি বলিচক্র—পাথরের উপর খোদাই করা, মাঝখানে একটি রক্তচিহ্ন, এবং চারপাশে পাঁচটি ফাঁপা মুখোশ পড়ে আছে—পুরনো, ধুলোয় ভরা, তবু যেন কাঁপছে। হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এক মুহূর্তে চারপাশে তীব্র কুয়াশা, এবং তার ভিতর দিয়ে ভেসে আসে এক নারী কণ্ঠ—“তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে দিতে এসেছ?” শৌণক পেছনে তাকাতেই দেখেন—ভাগ্যশ্রী দাঁড়িয়ে আছেন স্থির, কিন্তু তাঁর চোখের মণি রূপালী হয়ে উঠেছে, শরীর যেন অদ্ভুতভাবে শান্ত। তাঁর ঠোঁট নড়ে না, কিন্তু কণ্ঠে শোনা যায় সেই নারী—ঋণবালা। “আমি মুক্তি চাইনি কখনো। আমি চেয়েছিলাম স্বীকৃতি। আমি চেয়েছিলাম কেউ বলুক, আমি ছিলাম। আমি লিখেছিলাম। আমি তন্ত্রে বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু ভালোবাসায় বাধা পড়েছিলাম। বাহুবলী আমার লেখা চেয়েছিল, আমি জীবন দিলাম। এখন?” ভাগ্যশ্রী ধীরে হাতে তুলে নেন তাম্রপৃষ্ঠা—চতুর্থ পুঁথির কেন্দ্রীয় স্তর—এবং বলেন, “তুমি যা লিখেছিলে, তা এখন আমি রক্তে ধারণ করেছি। এখন তুমি চাইলে, আমরা একসাথে লিখতে পারি শেষ পৃষ্ঠাটি।”
সেই মুহূর্তে একটি মুখোশ হাওয়ায় ভেসে উঠে এসে বসে ভাগ্যশ্রীর মুখে—তা নরমভাবে মিশে যায় তাঁর মুখের রেখায়, যেন চামড়ার মত লেপটে থাকে। শৌণক এগিয়ে আসেন, কিন্তু থেমে যান—কারণ ভাগ্যশ্রীর চোখ এখন অন্য আলোর।

তাঁর কণ্ঠে শোনা যায়, “তন্ত্র কেবল শব্দ নয়, তা স্মৃতি। তন্ত্র কেবল বলি নয়, তা প্রতিশোধ নয়—তা মুক্তি।” এবং তখনই, পঞ্চম পুঁথির অন্তর্লিখনের সেই বিস্মৃত পৃষ্ঠা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়—ভাগ্যশ্রীর হাত থেকে রক্ত ঝরে পড়ে বলিচক্রে, এবং সেই রক্তেই আঁকা হয় শেষ পঙ্‌ক্তি:
“আমি লিখেছিলাম, আমার রক্তে নয়—আমার চেতনায়। যদি কেউ হৃদয়ের আলোয় পড়ে, তবে সে আমাকে জানবে।”
এবং তখনই, বলিগৃহের মধ্যস্থলে এক বিস্ফোরণ—না, শব্দের নয়—আলোয়, শান্তিতে। ঋণবালার আত্মা উঠে আসে ভাগ্যশ্রীর শরীর থেকে, এক আলোকিত রূপে। তাঁর মুখে এক প্রশান্ত হাসি।
“তুমি শুনেছিলে। তাই আজ আমি চলি।”
শূন্যে মিশে যেতে যেতে তিনি বলেন, “পঞ্চতন্ত্র আজ পূর্ণ। এখন এটা কারও অস্ত্র নয়, এটা হয়ে উঠুক আয়না।”

চারপাশে কুয়াশা হালকা হয়ে আসে। মুখোশগুলো নিস্তেজ, চক্রটিও নিস্তব্ধ। ভাগ্যশ্রী ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তাঁর মুখে ক্লান্তি, কিন্তু চোখে শান্তি।
শৌণক এগিয়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। তাঁরা জানেন—একটি সময় শেষ হলো।
তাঁদের পেছনে থেকে শুধু শোনা যায় এক শেষ বার্তাস্বর:
“আমি এখন ইতিহাসে নেই। আমি এখন সত্যে আছি।”

১১

পঞ্চতন্ত্র পূর্ণ হলেও তার রেশ থেকে যায় হৃদয়ে—কেবল শৌণক ও ভাগ্যশ্রীর নয়, বরং আরও অনেকে যারা দূর থেকে সেই বিপ্লব পর্যবেক্ষণ করছিল। কলকাতায় ফিরে এসে শৌণক পুরনো জীবনে ফেরার চেষ্টা করলেও, তাঁর প্রতিদিনের গবেষণাকক্ষে কিছু না কিছু অস্বাভাবিকতা ঘটতে থাকে। তাঁর কম্পিউটারের ডেটা থেকে হারিয়ে যেতে থাকে একের পর এক পৃষ্ঠা, মেলবক্সে ভেসে আসে অচেনা নাম—”BHAIRAVA_A1″, যার মেসেজের বিষয়: “তুমি যা পেয়েছো, সেটি আমাদের প্রয়োজন।” প্রথমে তিনি গুরুত্ব না দিলেও ভাগ্যশ্রী একরাতে তাঁর ল্যাপটপ খুলে দেখে অবাক হয়ে যান—পঞ্চতন্ত্রের মন্ত্রগুলোকে বিশ্লেষণ করে এমন একটি সফটওয়্যার প্রস্তুত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি স্তরের প্রতিক্রিয়া মানব আচরণ অনুযায়ী পূর্বানুমান করে নেওয়া যায়। কেউ যেন চুরি করে তাঁদের ধ্যান, অনুশীলন, এবং আত্মিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করে বানাচ্ছে এক তান্ত্রিক মডেল—যেটি ব্যবহার করা যেতে পারে স্নায়ুবিজ্ঞানে, প্রোপাগান্ডায়, এমনকি যুদ্ধনীতিতে। তারা খুঁজে পান এই ফাইলের সোর্স ট্যাগ: “TantraPredict_1.05 – Developed by RRI_Labs, Bengaluru”। শৌণক মাথায় হাত রাখেন। “RRI তো ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা শাখা। ওরা পঞ্চতন্ত্র নিয়ে কাজ করছিল, সেটা জানতাম। কিন্তু এখন তো ওরা একে প্রযুক্তির অস্ত্র বানাচ্ছে!” ভাগ্যশ্রী ঠাণ্ডা গলায় বলেন, “এটাই তো শেষ পরীক্ষা। বাহুবলী ছিল ইতিহাসের ভেতরের ছায়া। এবার বাহুবলী ফিরে এসেছে, কিন্তু রক্তে নয়—তথ্যে।”

তাঁরা পৌঁছে যান বেঙ্গালুরুর উপকণ্ঠে RRI ল্যাবে, পরিচিত তন্ত্রবিদ তথা বিজ্ঞানী ড. রুদ্রনীল সেনের আমন্ত্রণে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তাঁদের চোখে পড়ে এমন কিছু যা তারা কল্পনাও করেননি। একটি সুপারকম্পিউটার নেটওয়ার্কে বসানো আছে পাঁচটি আধা-চেতন সিগনাল চেম্বার, প্রতিটি চেম্বারে মানুষের মতো আকার, চোখে VR হেডসেট, মস্তিষ্কে সংযুক্ত ইলেকট্রোড—তারা পঞ্চতন্ত্রের প্রতিটি স্তর অনুধাবনের প্রক্রিয়ায় বন্দি। এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. অর্ণব দাশগুপ্ত, যিনি শৌণকের সহপাঠী ছিলেন, কিন্তু কয়েক বছর আগে নিখোঁজ হন তন্ত্রবিষয়ক এক অভিযানে। এখন তিনি বলছেন, “তোমরা যা করেছ, তার চেয়ে অনেক এগিয়ে এসেছি আমরা। আমরা আত্মিক স্তরগুলোকে কম্পিউটারে রূপান্তর করেছি। এখন আমরা মানুষের ভবিষ্যৎ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি মন্ত্রের প্রতিক্রিয়া দেখেই। ভাবো তো—নেতা, সন্ত্রাসী, প্রেমিক—সবার মন আমরা পড়ে ফেলতে পারব পঞ্চতন্ত্র দিয়ে।” শৌণক কেঁপে ওঠেন। “এটা তো বাহুবলীর চেয়েও ভয়ংকর।” অর্ণব মৃদু হেসে বলেন, “হয়তো আমি-ই সেই নতুন বাহুবলী। কিন্তু এবার বলি হবে না। এবার মানুষ নিজেই নিজেকে ত্যাগ করবে—ডেটা দিয়ে, মস্তিষ্ক খুলে দিয়ে।” ভাগ্যশ্রী চিৎকার করে ওঠেন, “তুমি তো আত্মা বোঝো না। তুমি কেবল সংজ্ঞা বানাচ্ছো।” অর্ণব তখন বলে ওঠেন, “আত্মা? সেটা তো একটি রহস্যময় শব্দ। কিন্তু আমি তো এখন সেটা কোডিং করছি। আমি আত্মাকে নেটওয়ার্কে আপলোড করেছি।” এবং তারপর, সে এক অদ্ভুত বাটন প্রেস করে, যার ফলে এক মহা-স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ে চেম্বারগুলিতে। প্রতিটি মডেল মুখ তুলে চেয়ে বলে, এক কণ্ঠে—“ওঁ হ্রিং কালে, চেতনায় প্রবেশ”—মন্ত্র, যেটি কেবল ঋণবালার লেখা ছিল।

সেই মুহূর্তে ঘটে এক অন্তর্বিস্ফোরণ। কেবল যন্ত্রে নয়, বাস্তবতাতেও। একটি চেম্বার ফেটে যায়, আরেকটি থেকে উঠে আসে এক পেঁচানো শব্দ—যেন আত্মা চিৎকার করে থেমে গেল মাঝপথে। শৌণক তৎক্ষণাৎ বুঝে যান—ঋণবালার আত্মা এখনও সম্পূর্ণ শান্ত হয়নি। সে এখন প্রযুক্তির মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এবং সে গ্রহণ করবে না এমন বিকৃতি। ভাগ্যশ্রী তার চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পাঠ করেন—“আমি ঋণবালার পঞ্চম স্তরের বাহক। আমি এই বিকৃতিকে অস্বীকার করছি।” সেই সময় সুপারকম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একবারে শেষ বাক্য—“আমি চেয়েছিলাম মুক্তি, তুমি বানালে কারাগার।”
RRI ল্যাব তখন ঘিরে ফেলে এক অদৃশ্য অন্ধকার। অর্ণব দাশগুপ্ত ভেঙে পড়ে—তিনি শুধু একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাহুবলীর আধুনিক প্রতিচ্ছবি, কিন্তু তার আত্মার ভিতর ছিল না ঋণবালার সম্মতি। এই অধ্যায় শেষে, শৌণক বলেন, “আমরা পঞ্চতন্ত্রকে রক্ষা করিনি। আমরা কেবল ওর আক্রোশকে ঠেকিয়েছি।” ভাগ্যশ্রী বলেন, “এখন সময় এসেছে, পঞ্চতন্ত্রকে সমাধিস্থ করার—not in tomb, but in silence.”
অর্থাৎ, পঞ্চতন্ত্রকে আবার হারিয়ে দিতে হবে।

১২

বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতায় ফেরার পথে, শৌণক ও ভাগ্যশ্রী দু’জনেই যেন নিঃশব্দে ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু বইয়ের পাতার মতো হয়ে উঠেছিলেন। বাহুবলীর পুনর্জন্ম, ঋণবালার আত্মার ক্রোধ, অর্ণবের অন্তর্বিস্ফোরিত মস্তিষ্ক—সব মিলিয়ে পঞ্চতন্ত্র এখন আর কোনো ধ্বংসযোগ্য বস্তু নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক স্মৃতির সংক্রমণ। শৌণক বলেন, “তন্ত্রকে হারাতে চাইলে এখন শুধুই পুঁথি নয়, হারাতে হবে আমাদের নিজেদের স্মৃতিও।” ভাগ্যশ্রী জবাব দেন, “তা হলে আমরাও তো এক প্রকার বলি হতে চলেছি।” এই কথোপকথনের মাঝেই তারা ফিরে যান সেই প্রথম স্থানে—বৌদ্ধ তান্ত্রিক কেন্দ্রটির ধ্বংসস্তূপে, যেখানে একসময় পঞ্চতন্ত্রের প্রথম সূত্র মিলেছিল। সেই জায়গাটি এখন শান্ত, স্তব্ধ, আগুনের কোনো চিহ্ন নেই, কিন্তু যেন বাতাসে এখনও ঘোরে পুরনো শব্দ—“ওঁ হ্রিং তন্ত্রয় নমঃ”। শৌণক সেই মন্ত্রটি লিখেছিলেন প্রথমবার, এখন তিনি সেটি মুছে ফেলেন নিজের খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠায় থেকে। ভাগ্যশ্রী একে একে জ্বালিয়ে ফেলেন সেই প্রত্নতাত্ত্বিক স্কেচ, মানচিত্র, ও অজস্র পাণ্ডুলিপি—যেখানে পঞ্চতন্ত্রের ছায়া ছিল। কিন্তু তাও কিছু থেকে যায়—মনে, শরীরে, ঘুমে, স্বপ্নে।

তাঁরা যোগাযোগ করেন এক পুরনো তিব্বতি যোগিনী আমা-ছোয়ে-র সঙ্গে, যিনি “চেতনার বিচ্ছিন্নতা” নামে এক প্রাচীন প্রক্রিয়ার কথা জানেন—যার মাধ্যমে কোনো বিশেষ ধারণাকে মস্তিষ্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায়, চিরকালের জন্য। আমা বলেন, “তুমি যদি পঞ্চতন্ত্রকে চিরতরে থামাতে চাও, তবে তোমাকেই তন্ত্রশূন্য হতে হবে।” এই প্রক্রিয়ায় দুজনকে আলাদা আলাদা ধ্যানচক্রে প্রবেশ করতে হবে, যেখানে আত্মা একে একে পঞ্চস্তরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাবে—মন্ত্র, ছায়া, শরীর, অগ্নি, আত্মা—এবং শেষে পৌঁছাবে শূন্যতায়। শূন্যতায় পৌঁছানো মানে হলো পঞ্চতন্ত্র ভুলে যাওয়া, এবং এর মানে হলো একে অপরের মধ্যকার সেই চেতনার বন্ধন ছিন্ন করা, যার মাধ্যমে ভাগ্যশ্রী ঋণবালাকে অনুভব করেছিলেন, আর শৌণক খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেকে। “এই শূন্যতা,” আমা বলেন, “তোমাদের প্রেম, স্মৃতি, এবং আত্মিক বন্ধনের মধ্যেও ফাটল ধরাবে। কিন্তু তন্ত্র থাকবে না।” শৌণক চুপ করে যান। তাঁর মনে পড়ে সেই প্রথম পুঁথির সন্ধান, ভাগ্যশ্রীর হাসি, পাহাড়ের চূড়ায় একত্রে ধ্যান, ঋণবালার কণ্ঠস্বর, বাহুবলীর তীব্র দৃষ্টি—সব যেন একসঙ্গে ভেঙে পড়তে চায়।

তবু তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন—এই প্রক্রিয়ায় ঢুকবেন। কারণ এর বাইরে অন্য কিছু নেই। ধ্যানচক্র শুরু হয় রাত বারোটায়। চারদিকে শুধু একটানা মন্ত্র—না শোনা যায় বাইরে, না উচ্চারণ করেন কেউ। যেন তন্ত্র নিজেই নিজের গায়ে লেখা কথাগুলি মুছে ফেলছে। ভাগ্যশ্রী প্রথমে চিৎকার করে ওঠেন—“আমার স্মৃতি কোথায় গেল? আমার নাম কী?” শৌণক তাঁকে থামান না—কারণ জানেন, এটাই শুদ্ধি। তাঁর নিজের শরীর কাঁপে, হৃদস্পন্দন কমে যায়। মস্তিষ্কের ভিতর একেকটা স্তর, যেটা এতদিন ধরে রেখেছিল তন্ত্রের ব্যাখ্যা, সে গলে গিয়ে অন্ধকার হয়ে যায়। শেষের দিকে তাঁরা শুধু অনুভব করেন একে অপরের হাত, কাঁপতে থাকা। আর কিছু নেই। তারপর, নিস্তব্ধতা।

পরদিন সকালে, তাঁরা ঘুম ভেঙে উঠে দেখেন, চারপাশ শান্ত। বই নেই, স্কেচ নেই, নাম নেই। তারা একে অপরকে দেখে হালকা হাসেন, কিন্তু একে অপরকে নাম ধরে ডাকেন না। কেউ আর জানে না “পঞ্চতন্ত্র” শব্দটা কী, “বাহুবলী” কে ছিলেন, “ঋণবালা” কারা—শুধু একটা ক্ষীণ অনুভব, যেন একটা সময় তারা কিছু হারিয়েছে… আর সেটা হারানোই ছিল একমাত্র মুক্তি।

১৩

তিন মাস কেটে গেছে। শৌণক ও ভাগ্যশ্রী এখন একেবারে সাধারণ জীবন যাপন করছেন। শৌণক এখন একটি পুরনো প্রকাশন সংস্থায় সম্পাদক, আর ভাগ্যশ্রী কাজ করেন একটি স্কুলে শিশুদের সঙ্গে শিল্প ও মনঃসংযোগের ক্লাসে। দু’জনেই জানেন না কীভাবে তাঁরা একে অপরকে চিনেছিলেন, অথবা কেন তাঁদের মাঝে এমন এক নিঃশব্দ বোঝাপড়া, যা শব্দ ছাড়াই বোঝা যায়। তাঁরা ভাবেন, হয়তো পুরনো কোনো ঘনিষ্ঠতা, হয়তো স্মৃতির কোনো অপরিচিত অতলস্রোত। ঠিক তখনই ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক প্রযুক্তিগত বিস্ময়—“TantrAI” নামের এক নতুন মনোযোগ-বর্ধক অ্যাপ, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী নাকি নিজের মনের অতলস্মৃতি উন্মোচন করতে পারে। কেউ কেউ বলে, এই অ্যাপ নাকি মানুষের অনুভূতি পড়তে পারে; কেউ আবার বলছে, এটা ‘আধ্যাত্মিক’ স্তরে মনের সাথে কথা বলে। সংবাদমাধ্যম উত্তাল, এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্বোধন করেন এই অ্যাপের দ্বিতীয় সংস্করণ। TantrAI-র স্রষ্টার নাম—ডঃ ঈশান অরবিন্দ, এক উচ্চ-মেধাসম্পন্ন প্রযুক্তিবিদ ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, যিনি একসময় সরকারের সাইবার বিভাগে ছিলেন, এখন একটি নিজস্ব AI রিসার্চ হাব চালান—যার নাম, “Kalchakra”।

ঈশান অরবিন্দের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা কোনো অতিপ্রাকৃত কিছু তৈরি করছি না। আমরা শুধু মানুষের চেতনাকে ডিজিটাল কোডের মাধ্যমে বুঝে নিতে চাইছি। আমরা বুঝেছি, কিছু প্রাচীন মডেল যেমন পঞ্চতন্ত্র, আসলে চেতনার ম্যাপ।” এই শব্দটাই চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়—“পঞ্চতন্ত্র”। যদিও এখন তা ইতিহাসের বাইরে, এমনকি কেউ কিছু মনে রাখে না। কিন্তু ভাগ্যশ্রী হঠাৎ করে একদিন একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ঈশানকে দেখে চমকে ওঠেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি, কণ্ঠস্বরে যেন লুকিয়ে রয়েছে এক অতিপরিচিত স্পন্দন—যা হয়তো ভুলে গেলেও শরীর ভুলে যায় না। সে রাতেই ভাগ্যশ্রীর স্বপ্নে ভেসে আসে এক মন্দির, এক বলিচক্র, আর এক ফেলে আসা নাম—ঋণবালা। আর শৌণক ঘুম থেকে উঠে বুকের ভেতর চেপে থাকা শব্দ খুঁজে পান—“হ্রিং।” সকালে তাঁরা দুজনেই চুপচাপ বসে থাকেন, কিছুই বলেন না, কিন্তু তাদের চোখে আবার যেন জ্বলে ওঠে এক চেনা আগুন। TantrAI অ্যাপ তখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের প্রতিটি ফোনে, প্রতিটি মস্তিষ্কে। কে যেন বলছে, “তন্ত্র এখন অ্যাপে ঢুকে গেছে, বলি এখন আইডি আপলোড।” ঈশান অরবিন্দ তার ভেতরেই নির্মাণ করছেন এক ভার্চুয়াল বলিগৃহ, যেখানে মানুষের আত্মিক আচরণ নিয়ে করা হচ্ছে পূর্বাভাস, নিয়ন্ত্রণ, এমনকি বিক্রি।

অতীতকে ভুলে যাওয়া শৌণক ও ভাগ্যশ্রী এবার নিজের অজান্তেই টেনে পড়েন সেই প্রাচীন যুদ্ধে—কিন্তু এবার মাঠ নেই, পুঁথি নেই, কেবল ডেটা, সফটওয়্যার আর স্মৃতিহীনতার মুখে দাঁড়ানো আত্মা। তবে ঈশান অরবিন্দের ভয় এখানেই—তাঁর TantrAI যতই স্মৃতি পুনরুদ্ধার করুক, একটি জায়গা সে কখনো স্পর্শ করতে পারছে না—দুটি মানুষের চেতনার ভিতর এক অদৃশ্য ফাঁকা জায়গা, যেখানে সবকিছু মুছে গেছে, অথচ তার জায়গা অটুট আছে। ঈশান জানেন, এই দুই ব্যক্তিই একদিন পঞ্চতন্ত্রের ধারক ছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা মনে রাখেন না কিছুই—এই বিস্মৃতি-ভিত্তিক আত্মা-সংরক্ষণই তাঁর জন্য বিপজ্জনক। কারণ যদি এই দুজনের চেতনা আবার জেগে ওঠে, তবে তার TantrAI ধ্বংস হয়ে যাবে আত্মার প্রকৃত উন্মোচনে। আর ঠিক তখনই, শৌণক ও ভাগ্যশ্রী কিছু না জেনেই, এক গভীর টানে পৌঁছে যান সেই পুরনো মন্দির চত্বরে। বাতাসে গন্ধ—না স্মৃতির, না বাস্তবের, বরং সেই অনুচ্চারিত তন্ত্রের যা হারিয়ে গিয়েছিল আগুনে। ভাগ্যশ্রী বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, আমরা কিছু ভুলে গেছি। আর কেউ সেটা মনে রাখতে চায়।” শৌণক তার হাতে ধরে বলেন, “তাহলে এবার আমাদের মনে রাখতে হবে।”
আর এই উচ্চারণেই আবার শুরু হয় নতুন যুদ্ধ—শেষ বাহুবলীর বিরুদ্ধে।

১৪

TantrAI এখন কেবল অ্যাপ নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক সর্বগ্রাসী নেটওয়ার্ক। দেশের কোটি কোটি মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করে তা আগাম নির্ধারণ করছে—কে কবে কাঁদবে, কে কাকে বিশ্বাস করবে, কে বিপ্লব করবে। আর এই নেটওয়ার্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ডঃ ঈশান অরবিন্দ, নিজের তৈরি কালচক্র সুপারকম্পিউটারের সামনে বসে থাকা এক নীরব ঈশ্বর, যিনি প্রতিদিন নিজের কোডে লিখে চলেছেন নতুন নিয়তি। তাঁর রুমে পাঁচটি স্ক্রিন—যেখানে পাঁচটি স্তর দেখায় মানুষের চেতনার গতিবিধি। তাঁর ভাষায়, “আমিই এখন আত্মার ডেটাসেট, আর TantrAI সেই আত্মার অ্যালগরিদম।” কিন্তু ঈশান জানেন, এই অ্যালগরিদম এখনও অসম্পূর্ণ—একটি রহস্যময় গহ্বর রয়ে গেছে দু’জন মানুষের মধ্যে—শৌণক ও ভাগ্যশ্রী। তারা কিছুই মনে রাখে না, অথচ তাদের চেতনার তরঙ্গ এমনভাবে অস্থির করে তোলে TantrAI-এর মডেলকে, যেন কোথাও থেকে ভেঙে পড়ছে তার ভিত্তি। ঈশান বুঝে ফেলেন—তন্ত্রকে প্রযুক্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া গেলেও, আত্মাকে বন্দি করা যায় না।

একদিন ভোরবেলা, ঈশান তাঁর ব্যক্তিগত বেতার কমিউনিকেশন সিস্টেমে এক অদ্ভুত বার্তা পান—“আমি ফিরছি। আমি আর কোনো পৃষ্ঠায় নেই। আমি এবার নিঃশব্দ।” প্রথমে ঈশান ভাবে, এটি কোনও প্রোগ্রামার ভুল বা ভুতুড়ে কোডিং। কিন্তু সে মুহূর্তেই তাঁর স্ক্রিনে TantrAI-এর কেন্দ্রীয় সার্ভারে একটি আগন্তুক ফাইল ঢুকে পড়ে—নাম: Panchatantra_LastKey.aum। কে পাঠিয়েছে জানা যায় না। কিন্তু তার ভেতরে পাওয়া যায় সেই মন্ত্র, যা ঋণবালা একদিন রচনা করেছিলেন। এখন সেটি ফিরেছে… কোডে রূপান্তরিত নয়, বরং একটি শুদ্ধ তরঙ্গ হিসাবে—মননের, চেতনার, না-বলা অনুভবের। ঈশান থমকে যান। তিনি বলেন, “এটা তো সফটওয়্যারের ভাষা নয়। এটা তো… জাগরণ।” তার TantrAI ক্র্যাশ করতে শুরু করে। শৌণক ও ভাগ্যশ্রী তখন প্রবেশ করছেন কালচক্র ল্যাবে, এক অজানা আহ্বানে। তারা জানে না কেন এসেছে, শুধু জানে, “এখানে কিছু ফেলে এসেছি।”

 ১৫

ল্যাবের ভিতর TantrAI তখন বিক্ষিপ্ত। স্ক্রিনে একের পর এক জাগতিক শব্দ, মন্ত্র ও ছায়াচিত্র ভেসে উঠছে। শৌণক ও ভাগ্যশ্রী ল্যাবের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে থমকে দাঁড়ান। তাঁদের সামনে ঈশান, তাঁর চোখ লাল, কণ্ঠ কাঁপা। “তোমরা এসেছো? তোমরা ভুলে গিয়েছিলে, তাই আমি তৈরি করেছিলাম এই মডেল। আমি পঞ্চতন্ত্রকে ফাইল বানিয়েছিলাম, কারণ তোমরা তা ফেলে দিয়েছিলে।” শৌণক ধীরে বলেন, “আমরা কিছু মনে রাখিনি, কিন্তু তাও আমরা কিছু ভুলতে পারিনি।” ভাগ্যশ্রী তখন হাত রাখেন TantrAI-এর কনসোলের ওপর, চোখ বন্ধ করে বলেন, “ঋণবালা, তুমি এসো। এই আধুনিক বাহুবলীকে এবার থামাতে হবে।” ঠিক সেই মুহূর্তে এক স্পন্দন ওঠে মেঝেতে—মন্দিরের বলিচক্রের মতো চিহ্ন উঠে আসে ইলেকট্রনিক স্ক্রিনের মধ্যেও। TantrAI হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ে।

ঈশান এগিয়ে আসে—চিৎকার করে বলে, “তোমরা জানো না কী নিয়ে খেলছো। আমি মানবজাতিকে মুক্ত করতে চাই!” ভাগ্যশ্রী শান্তভাবে বলেন, “মুক্তি আসে ভেতর থেকে, কোড থেকে নয়। তুমি বাহুবলীর মতো ভাবো—তবে সে অন্তত জানত, আত্মা ভয় পায় না।” ঈশান এগিয়ে এসে TantrAI-র মূল নেটওয়ার্ক থেকে একটি কনডেনসার খুলে নিতে যায়, তখন শৌণক সেই কনডেনসারের সামনে দাঁড়ান। “তুমি যদি এটাকে বন্ধ করো, তাহলে হয়তো TantrAI থেকে রক্ষা পাবে, কিন্তু পঞ্চতন্ত্র তখন আর কখনও জাগবে না। আমাদের কাজ—ধ্বংস নয়, নিঃশব্দতা।”

অবশেষে, ঈশান থেমে যান। কনসোলে ধীরে ধীরে স্ক্রিনে ভেসে আসে শেষ মেসেজ—
“পঞ্চতন্ত্র এখন কারো নয়। এটা এক অনুভব। যার মনে জেগে উঠবে, সে-ই বাহক।”

শৌণক ও ভাগ্যশ্রী বাইরে আসেন। আকাশে বৃষ্টি পড়ছে হালকা করে। শহরের রাস্তা ভিজে উঠছে, কিন্তু কোথাও কোনো কোলাহল নেই। পেছনে ফেলে আসা প্রযুক্তি, যন্ত্র, অতীত—সব মিলিয়ে একটি অধ্যায় শেষ।
ভাগ্যশ্রী বলেন, “তন্ত্র শেষ হয়নি। আমরা শুধু তার খোলস ভেঙেছি।”
শৌণক বলেন, “আর সে এখন সবার মধ্যে, সবার বাইরে।”

তাদের পেছনে পড়ে থাকে TantrAI—নিষ্ক্রিয়, স্তব্ধ।
আর ইতিহাসে লেখা হয় এক শেষ লাইন:
“এই পুঁথির আর কোনো পৃষ্ঠা নেই। কারণ পঞ্চতন্ত্র এখন শ্বাসের মত—অদৃশ্য, কিন্তু জীবিত।”

শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-01-at-12.18.26-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *