অর্ক ভট্ট
১
পদ্মার কোলঘেঁষে ছায়াঘেরা এক গ্রাম, যেখানে সকাল শুরু হয় কাকডাকা ভোরে আর শেষ হয় নদীর ঢেউয়ের নিঃশব্দ হাহাকারে। ঠিক সেই জায়গাটায় পৌঁছাল মেঘা সেন, শহরের এক ডকুমেন্টারি নির্মাতা, যাকে নিয়ে এসেছে তার নিজস্ব কৌতূহল—নদী, তার মানুষ আর তাদের জীবনগাথা। লাল মাটি, ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা, কাদা-মাখা পায়ের ছাপ পেরিয়ে মেঘ দাঁড়ায় নদীর ঘাটে। কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা, পরনে হালকা তুলো কাপড়ের সালোয়ার, চোখে একরাশ আগ্রহ আর মুখে একরাশ ক্লান্তি। তার চোখ প্রথমেই আটকে যায় এক মাঝির ওপর, যার গায়ের রং ঠিক নদীর পলির মতো ধূসর, যার নৌকা যেন নদীর বুকে গড়িয়ে চলা এক অভ্যস্ত ছায়া। সে জলে দাঁড়িয়ে জাল গুছিয়ে নিচ্ছিল, চোখে গভীর মনোযোগ। মেঘা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনার নাম?” ছেলেটি একটু চমকে তাকায়, যেন মানুষের সঙ্গে কথা বলার অভ্যেস নেই, তারপর ধীরে বলে, “তনু মাঝি।” সেই প্রথম পরিচয়। শহরের মেয়ে আর নদীর ছেলে—দুই ভিন্ন দিক থেকে আসা, তবু পদ্মার সামনে দাঁড়িয়ে যেন সমান্তরালে মিলেছে তাদের চোখ।
পরদিন থেকেই মেঘ শুরু করে তার কাজ। সকালে ঘাটে এসে বসে, ক্যামেরা সেট করে। নৌকো ওঠা-নামা, গ্রামের মানুষের মুখ, চুলে খই ফোটানো ছোট মেয়েগুলোর কৌতূহলী দৃষ্টি—সবই তার লেন্সে ধরে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে তনুর ছবি। সে কথা কম বলে, প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ে বা ছোট্ট করে বলে ‘হুঁ’। কিন্তু তার চালানো নৌকোর ধরণ, জল ছেঁচে তোলার ভঙ্গি, গলায় হালকা গান—সব মিলিয়ে সে যেন নদীর একটি ভাষ্য হয়ে ওঠে। মেঘ বুঝতে পারে, তনুর মধ্যেই রয়েছে সেই নদীর কথোপকথন যা সে খুঁজছে। একদিন সে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এই নদীর মধ্যে কী খুঁজে পাও?” তনু জবাব দেয় না, শুধু বলে, “এই নদী আমায় চেনে। যতবার ভেঙে পড়েছি, নদী আমায় বাঁচিয়েছে। শহরের মতো না, বেইমান না।” মেঘ চুপ করে যায়। তনুর কথাগুলো ক্যামেরা নয়, তার ভেতরে রেকর্ড হয়ে যায়। সেইদিন রাতে ঘরের ভিতর বসে মেঘ খেয়াল করে, তনুর মুখ বারবার ফিরে আসছে স্ক্রিনে, প্রতিটি দৃশ্য যেন তার মন ছুঁয়ে যাচ্ছে অজান্তেই।
এক সপ্তাহ কেটে যায়। মেঘ এখন গ্রামের লোকের চেনা মুখ। তনুর মা মাধবী একদিন তাকে হাঁড়ির ভাত খেতে দেয়, রবি—তনুর ছোট ভাই—তাকে পুকুরে নিয়ে যায় ছবি তুলতে। কিন্তু তনুর সঙ্গে সে যতই সময় কাটায়, ততই বুঝতে পারে, সে শুধু নদীর মাঝি নয়—সে একটা বিরাট শূন্যতার পাহারা দেয়। তার মধ্যে একধরনের নিঃশব্দ দুঃখ আছে, যা সে কাউকে বলতে চায় না, কিন্তু লুকিয়েও রাখতে পারে না। একদিন বিকেলে, তারা একসঙ্গে নদীর পাড়ে বসে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, জলে লাল আভা। মেঘ হঠাৎ বলে বসে, “তনু, তুমি জানো? শহরে নদীর মতো কিছু নেই। যতসব প্লাস্টিকের দড়ি আর ইট-কাঠের দেয়াল। এখানে এসে তোমার নদীকে দেখে মনে হয়, সে জীবন্ত।” তনু তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে, তারপর বলে, “তুমি নদী ভালোবাসো?” মেঘ উত্তর দেয়, “ভালোবাসি বোধহয়। তবে তুমিই প্রথম নদীর মতো কেউকে দেখলাম।” মুহূর্তটা কেমন অদ্ভুত নীরবতায় ভরে ওঠে। কেউ কিছু বলে না, কিন্তু যেন শব্দের বদলে স্রোতের ভিতর দিয়ে একটা টান বইতে থাকে—মেঘ আর তনুর মাঝে।
২
সকালটা ছিল শান্ত, বাতাসে কাশফুলের নরম গন্ধ। মেঘ আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘাটে এসে দাঁড়ায়। তনু তখনও আসেনি, শুধু নদীটা আপন মনে বয়ে চলেছে। মেঘ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল পানির টলমল চলন, হঠাৎ যেন মনে হল, নদীটা তাকে কিছু বলছে। হয়তো এটাই তনুর বলা ‘নদীর ভাষা’। সে নিজের ক্যামেরা বের করে পদ্মার ঢেউগুলোকে ধরা শুরু করে, তবে আজকের ফ্রেমে তনু নেই বলে দৃশ্যটা অসম্পূর্ণ লাগে তার কাছে। মিনিট কুড়ি পর তনুর নৌকা দূর থেকে ভেসে আসে। সে আজ একটু ক্লান্ত, কপালে ঘাম জমেছে। “তুমি দেরি করেছো,” মেঘ বলে। তনু জবাব দেয় না, শুধু মাথা নিচু করে রশি টেনে নৌকোটা ঘাটে বাঁধে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “ঘরের গরুটা আজ সকালে মরল… মা খুব কাঁদছিল।” মেঘ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “তুমি চাইলে আমি আসতাম তোমাদের বাড়ি, সাহায্য করতাম।” তনু তাকায় তার দিকে, প্রথমবার যেন চোখে একটা নরম ভরসা দেখা যায়। “তুমি শহরের মেয়ে, তোমাদের কান্না–সান্ত্বনা এত সহজ হয় না। তবে বললে খারাপ লাগছে না,” বলে তনু।
মেঘ আজ তনুর সঙ্গে নৌকোয় ওঠে, তার অনুমতিতে। এই প্রথম সে নদীর বুকে বসে, চারপাশে শুধু জল আর ঢেউয়ের নাচন। ক্যামেরা পাশে পড়ে থাকে, কারণ আজ সে শুধু দেখতে চায়—তনুর চোখ দিয়ে পদ্মাকে। তনু হালকা করে চেপে হাল ঘোরায়, আর বলে, “এই নদীকে বুঝতে হলে শুধু দেখলেই চলবে না, শুনতে হবে। তার রাগ আছে, দুঃখ আছে, আবার একলা ঘোরার অভ্যাসও।” মেঘ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে তার দিকে। এতটা গভীরতা সে কোনো মাঝির মধ্যে কখনো দেখেনি। শহরে এমন ভাবনা থাকে কবিদের, লেখকদের। তনু যেন তার সমস্ত ধারণা পাল্টে দিচ্ছে। সে জানতে চায়, “তুমি পড়াশোনা করোনি তো?” তনু হেসে বলে, “ক্লাস ফোর অবধি, তারপর নৌকা। কিন্তু নদী অনেক কিছু শেখায়। শিখিয়েছে দাঁতে দাঁতে লড়তে, আর না-বলা কথা বুঝতে।” মেঘ কিছু বলে না। আজকের দিনটা তার ক্যামেরায় থাকল না ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ে গেঁথে গেল তনুর বলা প্রতিটি কথা।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। নৌকা ঘাটে ফিরে আসে, তনু তাকে নামিয়ে দেয় নিজের হাতে। হঠাৎ করে বলে, “তোমার ক্যামেরা চালু ছিল না আজ?” মেঘ বলে, “ছিল না। আজ আমি শুধু নদী শুনেছি।” তনু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুমি শহরের হয়েও অনেক কিছু শোনো, দেখে অবাক লাগছে।” তারপর সোজা চলে যায়। মেঘ দাঁড়িয়ে থাকে নদীর দিকে চেয়ে। তার চোখে আজ জল নেই, কিন্তু মনের ভেতর জলের মতোই বয়ে যাচ্ছে একটা অদ্ভুত অনুভব—একটা ভাষা, যেটা সে ক্যামেরায় ধরতে পারবে না। নদী আজ যেন তার একটা অংশ ছুঁয়ে দিয়ে গেল।
৩
রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছে, নদীর জলে তার ছায়া। ঘরের খাটে শুয়ে মেঘ পেছনের সব ক্লিপ ঘাঁটছিল—তনুর হাঁটার ভঙ্গি, নৌকা চালানোর দৃশ্য, নদীর হাহাকার। প্রতিটা দৃশ্য যেন একেকটা গল্প বলছে। কিন্তু তার মন বসে না। মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে একটাই নাম—তনু। শুধু মাঝি নয়, সে যেন নদীর আত্মা। অথচ কতটা একা মানুষটা। বাবার মৃত্যুর পর সংসার সে-ই টানছে, মাকে দেখে, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা দেখে, নৌকা চালিয়ে পেট চালায়। কিন্তু সেই মানুষটাও হাসে না খুব একটা, চোখে কেমন যেন স্থিরতা। মেঘ ভাবে—এই একলা মাঝি কি জানে, তার জীবনও ঠিক তনুর মতো? শহরে গাদাগাদি করা জনস্রোতের মাঝে থেকেও সে আসলে একা। এক ভাঙা সম্পর্কের স্মৃতি, ক্যারিয়ারের দোদুল্যমানতা, মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা—সবই তার সঙ্গী। এখন এই নদীপাড়ে এসে, সেই নিঃসঙ্গতা যেন আরেকটা প্রতিচ্ছবিতে ধরা দিচ্ছে—তনু নামে।
পরদিন সকালে মেঘ চুপচাপ তনুর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাটির ঘর, টালির ছাদে বৃষ্টি পড়ে জল জমে আছে। দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল রবি, তনুর ছোট ভাই। সে চমকে ওঠে মেঘকে দেখে, তারপর বলে, “দাদা তো নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে, নদীর ওপারে গেছে আজ সকালে।” মেঘ ধন্যবাদ জানিয়ে ঘাটের দিকে হাঁটতে থাকে। তার মনটা ভারী, কেন এমন অস্থির লাগছে বুঝতে পারে না। সে চায়, তনুর সঙ্গে কথা বলতে, জানতে চায়, মাঝির গল্পটা ঠিক কোথায় থেমে আছে। কিন্তু নদীর ওপারে মানুষ পার করতে গিয়েই যেন তনু দূরে চলে যাচ্ছে, আর মেঘ বুঝতে পারছে—এই দূরত্বটা শুধু নদীর নয়, জীবনের। সে ঘাটে বসে থাকে চুপ করে, পায়ের আঙুলে জল ছুঁয়ে যায় ঢেউ, কিন্তু আজ নদীও কথা বলে না।
তনু ফিরে আসে বিকেলে। মুখে ধুলো, শরীরে ক্লান্তি। কিন্তু মেঘকে ঘাটে বসে থাকতে দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। “তুমি এখানে?” মেঘ শুধু মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর মেঘ বলে, “তুমি একা থাকো কেন?” তনু কিছু না বলে নৌকোর রশিটা খোলার ভান করে। “আমি জানি না, কীভাবে বোঝাতে পারি, কিন্তু তোর মতো কেউ আমি কখনও দেখিনি,” বলে মেঘ হঠাৎ করেই। তনু তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আমি যা, তাই থাকি। আমি নদীর মতো—যার পাশে মানুষ আসে, আবার চলে যায়। কেউ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে না।” মেঘের চোখ ভিজে যায়। তনু হেঁটে চলে যায় নিজের ঘরের দিকে, আর মেঘ বুঝে যায়—দুই একাকিত্বের মাঝে গড়ে ওঠা সম্পর্কটা এখনো অদৃশ্য, তবু গভীর, ভেসে চলেছে পদ্মার স্রোতের মতো।
৪
সকালে নদীটা অদ্ভুত রকম নিরব। না বাতাস আছে, না ঢেউয়ের ছন্দ, শুধু জলের গায়ে নেমে এসেছে এক ধরনের নিস্তব্ধতা। মেঘ ঘাটে এসে দাঁড়াতেই তনুর চোখে পড়ে তার ছায়া। সে আজ নৌকার উপর বসে জাল গুছাচ্ছিল, কাঁধে লাল গামছা, গলায় অল্প ভেজা কাদা। মেঘ ধীরে ধীরে নৌকার কাছে আসে। কিছু বলে না। তনুও না। কিন্তু সেই চুপচাপ থাকার মধ্যে আজ প্রথমবার অস্বস্তি নেই, বরং আছে এক ধরনের স্বস্তিকর নীরবতা। হঠাৎ মেঘ বলে ওঠে, “তুমি জানো, আজ আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। ওঁর মৃত্যুর পর আমার জীবনটা থমকে গেছিল। তখন থেকেই আমি খুঁজছি কোথাও এমন কিছু—যা ঠিক মানুষ না, কিন্তু বেঁচে আছে। আমি ভেবেছিলাম নদী সে রকম কিছু হতে পারে। আর এখন দেখি—তুমি নিজেই হয়তো নদীর মতো।” তনু চমকে তাকায় তার দিকে। তারপর এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, “তাহলে তুইও একা?”
মেঘ কিছু না বলে হেসে ওঠে। সেই হাসির মধ্যে ছিল দুঃখ, ছিল টান। “হ্যাঁ, আমি একা,” সে বলে। “তুমি তো দেখেছো না, শহরের একাকিত্ব কেমন। এখানে অন্তত নদী আছে কথা বলার মতো, কিন্তু ওখানে শব্দ আছে, কেউ শোনে না।” তনু তার দিকে চেয়ে বলে, “তুমি চাইলে আজ নদীতে আমার সাথে চলো। ওপারের গাছগুলো এখন সাদা সাদা ফুলে ভরা—তুই পছন্দ করবি।” মেঘ চমকে ওঠে—তনুর মুখে ‘তুই’! শহরের ভাষা থেকে বেরিয়ে সে এক পা ফেলেছে তনুর জগতে। নৌকা ছুটে চলে জলরেখার উপরে, চারপাশে ছায়ার মতোন পাখি উড়ে যায়, আর মাঝখানে বসে থাকে মেঘ—তনুর পাশে, নদীর বুকে।
তারা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। হঠাৎ করে তনু বলে, “তুই কি জানিস, এই নৌকোর নাম কিছু নেই?” মেঘ হেসে বলে, “তাহলে তোকে একটা নাম দিতে হবে। প্রত্যেক নৌকার একটা আত্মা থাকে। তুই বলেছিস না, নদী জীবন্ত? তাহলে তোর নৌকোটাও তো জীবন্ত।” তনু মাথা চুলকে বলে, “আমি নাম রাখতে পারিনি কখনও… কেমন যেন ভয় হতো।” মেঘ বলে, “ভয় কীসের?” তনু চুপ করে যায়। চোখে জল ভরা নদী আর তার বুক চিরে চলা নৌকা, সেই দৃশ্যের মধ্যে বসে আজ তারা কেউ শহর-গ্রাম নয়, কেউ শহরের মেয়ে আর মাঝিপাড়ার ছেলে নয়। তারা শুধু দুই মানুষ, যাদের মাঝখানে নদীর মতো এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়েছে, আর সে সেতুর ছায়ায় ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে এক অচেনা, কিন্তু অতি চেনা ভালোবাসা।
৫
বিকেলবেলা রোদ একটু একটু করে ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। ঘরের উঠোনে বসে তনুর মা, মাধবী, ধান বাছছিলেন। সেই সময় মেঘ ধীরে ধীরে বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। তার পরনে হালকা হলুদ কুর্তা, হাতে ক্যামেরার ব্যাগ। রবি খুশি হয়ে দৌড়ে আসে, “দিদি, এসো! মা ভাত রেঁধেছে।” মাধবী একবার চোখ তুলে দেখে, তারপর চোখ নামিয়ে আবার কাজে মন দেয়। মেঘ অস্বস্তি অনুভব করে, কিন্তু কিছু না বলে বারান্দার কোণে বসে পড়ে। রবি তার পাশে বসে গল্প শুরু করে—স্কুলে কী হয়েছে, নদীর ওপারে কে সাপ ধরেছে, সব। মেঘ হেসে হেসে শুনে যায়। কিন্তু মাধবীর মুখে কোনো কথা নেই। একটু পরে তিনি ধীরে বলে ওঠেন, “আপনাদের শহরে কি কেউ নদীতে নামে? নৌকা চালায়?” মেঘ একটু থেমে বলে, “আমাদের ওখানে নদীই নেই ঠিক মতো।” মাধবী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, আর মাঝিও নেই। তাই বুঝি মাঝির জীবনটা আপনাদের খুব রঙিন লাগে।”
মেঘ মৃদুস্বরে বলে, “আমি আপনাদের জীবনকে রঙিন বলিনি কাকিমা। আমি তো শুধু জানার চেষ্টা করছি… বোঝার চেষ্টা করছি।” মাধবী এবার তার দিকে তাকিয়ে বলেন, “বোঝা কি এত সহজ? এই ঘরের চাল ভাঙে, নৌকা উল্টায়, নদী ধুয়ে নিয়ে যায় জমি—এইসব কি ক্যামেরায় বোঝা যায়?” মেঘ স্তব্ধ হয়ে যায়। সে কিছু বলার চেষ্টা করলেও মাধবী থামিয়ে দেন, “আমার ছেলে তনু ভালো ছেলে, দায়িত্ব নেয়, কাঁধে সংসার। আমি চাই না সে আবার কোথাও মন বাঁধে। শহরের মেয়ে এসে তার মন নিয়ে যাবে, আর ফিরবে না। নদী যেমন ফাঁকি দেয়, তেমন শহরের মানুষ।” মেঘের চোখে পানি চলে আসে, কিন্তু সে কথা বাড়ায় না। চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়, বিদায় নিয়ে চলে যায়। রবি তার পেছন পেছন আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মাধবী চোখের ইশারায় বাধা দেয়।
তনু সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মায়ের মুখ দেখে বুঝে যায়, কিছু হয়েছে। “কেউ এসেছিল?” সে জিজ্ঞেস করে। মাধবী সংক্ষেপে বলে, “হ্যাঁ, শহরের মেয়ে এসেছিল। তোমার সাথে ঘুরে ঘুরে কত কথা শিখে গেছে মনে হয়।” তনু কিছু বলে না, মাথা নিচু করে বসে পড়ে। তার ভেতরে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন শুরু হয়। সে জানে, মেঘ আলাদা, সে শহরের হলেও অন্ধকার দেখে—জীবনের মতো করে। কিন্তু মা ঠিকই তো বলেছে, শহরের মানুষ থেকে যাবে তো? নদী যেমন নিজের পথেই চলে, শহরের মানুষও কি ভালোবাসা বুঝতে পারে? নাকি শুধু গল্পের মতো শোনে, ক্যামেরায় তোলে, তারপর ফিরে যায় নিজের কাচের ঘরে? রাতের ঘুম আসে না তনুর। বারবার চোখে ভেসে ওঠে মেঘের মুখ—ভিজে গলায় বলা সেই কথা: “তুই নিজেই নদীর মতো।” তার বুকের ভেতরটা নদীর ঢেউয়ের মতো কাঁপতে থাকে, আর মনে হয়—এই ভালোবাসা যদি ডুবেই যায়, তবে সে কি নৌকার মতো ভেসে থাকতে পারবে?
৬
রাতটা ঘুমহীন কাটে মেঘেরও। পেটিকোট বাক্সে চিঠি, লেন্স, মেমোরি কার্ডের পাশে এখন জমে উঠেছে অস্পষ্ট কিছু অনুভূতি—যেটা প্রেম কিনা, সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না, কিন্তু তনুর গলা, তার চাহনি, তার নৌকার ছায়া কিছুতেই মন থেকে সরছে না। সকালে বেরিয়ে পড়ে সে, আবার ঘাটে যায়। আজ তার মধ্যে একরকম তাড়া—জীবনের, সম্পর্কের, উত্তর খোঁজার। ঘাটে গিয়ে দেখে তনু একা বসে আছে, নৌকার মধ্যে। দূর থেকে মেঘ হাঁটতে হাঁটতে যায়, আর মনে মনে ভাবে—আজ না বললে, এই সম্পর্ক হয়তো ভেসে যাবে সেই নদীর স্রোতের মতোই। সে নৌকায় উঠে পড়ে। তনু তাকায় না, চুপচাপ বসে থাকে। কিছুটা সময় পেরিয়ে মেঘ বলে, “তুমি এমন করছো কেন? আমি কী ভুল করলাম?” তনু চোখ সরিয়ে ধীরে বলে, “তুই কিছু ভুল করোনি। আমি ভুল করছি, ভাবছি আমি তোকে বোঝাতে পারব।” মেঘ জিজ্ঞেস করে, “কি বোঝাতে?” তনু থেমে যায়, তারপর ফেটে পড়ে, “তুই শহরের মেয়ে, তোকে দেখে মনে হয় সব বুঝিস, কিন্তু শহরটা তো আমায় বোঝে না! তুই একদিন চলে যাবি, আর আমার জীবনটা আবার ওই ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকবে—শূন্য হয়ে।”
মেঘ থমকে যায়। তনুর চোখে জমে থাকা যন্ত্রণাটা যেন তাকে বিদ্ধ করে। সে মৃদু গলায় বলে, “তুই আমায় জানিস না ঠিক মতো, তুই জানিস না আমি কতটা ভেঙে পড়েছি এর আগে। আমি শহরের হলেও, আমারও ঠাঁই ছিল না কোথাও। আমি এসেছি শুধু নদী দেখতে নয়, নিজেকে খুঁজতে। আর সেই খোঁজে আমি তোকে পেয়েছি।” তনু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “আমায় না পেলেই ভালো হতো। তোর কাঁধে শহর আছে, আমার কাঁধে সংসার। আমি একটা নৌকা চালাই, ভরসা রাখি জলের ওপরে—যে জল এক ঝটকায় সব নিয়ে যায়।” মেঘের চোখ জলে ভরে ওঠে, কিন্তু সে নিজেকে সামলে বলে, “তুই যদি ভাসতেই থাকিস, তবে বুঝবি না কখন তোর কূলে এসে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল।”
তনু কিছু বলে না। নদী হঠাৎ উত্তাল হয়ে ওঠে, ঢেউ এসে নৌকার পাটাতনে ধাক্কা খায়। দুজনে চুপচাপ বসে থাকে—নৌকা দুলে ওঠে, কিন্তু তারা নড়ে না। এই মুহূর্তে যেন নদী তাদের আবেগের প্রতিচ্ছবি—কখনও শান্ত, কখনও রেগে ওঠা, কখনও নিরব, আবার কখনও সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাদের ভিতরে থাকা অনিশ্চয়তা, ভয়, ভালোবাসা—সবই একে অপরের দিকে ধেয়ে যায়, আবার সরে যায়। সেই বিকেলে, মেঘ একা ফিরে যায় ঘরে, আর তনু বসে থাকে নৌকায়, চোখে ফেলে নদীর স্রোতের দিকে। আর দূরে… সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে, ঠিক যেমন ডুবে যায় দুই হৃদয়ের জলের মতো কিছু না বলা কথা।
৭
পদ্মার পাড়ে যে সম্পর্কের জল একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছিল, তার ঢেউকে এলোমেলো করে দিতে শহর থেকে নেমে এল এক অপরিচিত পদধ্বনি। ঘাটে লোকের কৌতূহলী চোখ, দোকানদারের ফিসফাস, আর সেইসবের কেন্দ্রবিন্দুতে—এক ঝকঝকে ক্যামেরা হাতে, আধুনিক পোশাকে একজন ছেলেমানুষ দাঁড়িয়ে, তার মুখে শহুরে আত্মবিশ্বাসের পরত। সে নাম অর্ণব, মেঘের প্রাক্তন প্রেমিক। ক্যামেরা হাতে নেমেছে সে পদ্মার মানুষ ও প্রকৃতি নিয়ে একটা আলাদা ফিচার বানাতে, এবং ‘আকস্মিকভাবে’ জেনে গেছে মেঘ এখানেই আছে। সে সরাসরি চলে আসে ঘাটে, যেখানে মেঘ সাধারণত সকালবেলায় কাজ করত। এবং ঠিক সেদিন, যখন মেঘ তনুর সঙ্গে আগের ঝড়ো কথোপকথনের ভারে গুমরে ছিল, সে দেখে, ঘাটের ওপারে দাঁড়িয়ে অর্ণব হেসে ডাকছে—“মেঘ!”
মেঘ থমকে যায়। অর্ণবের উপস্থিতি তার মনের ভিতরের সেই পুরনো দরজা খোলার চেষ্টা করে, যেটা সে বহু কষ্টে বন্ধ করেছিল। “তুমি এখানে?” তার মুখে বিস্ময়, কিন্তু চোখে ছিল একটা অনিশ্চয়তা। অর্ণব সহজ ভাবে বলে, “তুই বলেছিলি না, নদীটা দেখতে চাই? তোর কথা শুনেই মনে হলো, একবার পদ্মা না দেখলে চলবে না। আমি জানতাম, তুই এখানে থাকবি।” তনু দূর থেকে পুরোটা দেখছিল—কিন্তু কিছু বলছিল না। তার গলায় সেই গভীর নীরবতা জমতে শুরু করল, যা তার বহুদিনের অভ্যাস। অর্ণব আর মেঘ কিছুক্ষণ হাঁটল নদীর ধার ধরে, শহুরে সুরে গল্প, পুরনো স্মৃতি, ছবির আলোচনা—যা তনুর পক্ষে অস্পৃশ্য, অচেনা। সে নিজের নৌকোটা সারাতে ব্যস্ত থাকার ভান করল, কিন্তু চোখ চলে যাচ্ছিল সেই দুটি মানুষে—যাদের গতিবিধি নদীর মতো তরল, অথচ কোথায় গড়াবে তা অনিশ্চিত।
সন্ধ্যা নামল। মেঘ একা ফিরে এল, মুখে গুমোট ভাব। তনু চুপ করে বসে ছিল। মেঘ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুই কিছু জিজ্ঞেস করবি না?” তনু মাথা নাড়ল না, বলল না কিছুই। তখন মেঘ বলল, “তুই তো চুপ করে গেলি, অর্ণব এল বলেই?” তনু আস্তে বলে, “তোমাদের জগৎ আলাদা। আমি জানি, শহরের মানুষ শহরেই ফিরে যায়। মেঘ যদি ধরে রাখা যেত, তবে আকাশে থাকত না।” মেঘ ফেটে পড়ে, “তুই জানিস না, আমি কেন এসেছিলাম, কী খুঁজছিলাম। অর্ণব এসেছে, তাই কি আমি পালিয়ে যাব? আমি এসেছি কারণ তুই আমায় কিছু শিখিয়েছিস, যা শহরের লোক দেখাতে পারেনি। আমি সেই সত্যকে ভালোবেসেছি—তোর মধ্যে যে সত্য আছে।”
তনু কিছু না বলে চলে যায় ঘরের ভিতর। কিন্তু সেই রাতে, তার চোখে ঘুম আসে না। বারবার মনে পড়ে, সেই ক্যামেরা হাতে ছেলেটির কথা, তার ঝকঝকে কথাবার্তা, আর মেঘের চোখে সেই পুরনো ভাসা আবেগ। একসময় যে নদী ছিল তনুর একান্ত, সেখানে এখন ঢুকে পড়েছে এক শহুরে রূপকথা। আর সে—তনু—ভেবেও কূল পায় না, কোনটা বেশি বিপজ্জনক—নদীর ঢেউ, না মেঘের চোখে গোপন জল?
৮
ভোরের আলো নদীর কোল ছুঁয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল, কিন্তু তনুর চোখে ছিল এক গভীর অন্ধকার। অর্ণব চলে গেছে আগের রাতেই, শহরের ফিরতি ট্রেনে, কিন্তু রেখে গেছে একরাশ প্রশ্ন, কিছু অজানা ভয় আর এক দগদগে নিঃশব্দ যুদ্ধ—তনুর ভেতরে। সে চুপচাপ ঘাটে গিয়ে বসেছিল অনেক আগে, যখন সাধারণত কেউ আসে না। তার সামনে পড়ে ছিল সেই পুরনো নৌকো—যার নাম সে কোনোদিন রাখেনি। শুধু ভাসিয়েছে, চালিয়েছে, বাঁচিয়ে রেখেছে নিজের মতো করে। আজ হঠাৎ করে মনে হচ্ছে, এই নৌকা কি শুধুই একটা যান? নাকি তার মতোই এক নির্জন সঙ্গী? ঠিক তখনই মেঘ আসে, ধীরে ধীরে পেছন থেকে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে এক টুকরো সাদা চুন, মুখে লাজ লুকোনো সিদ্ধান্তের রেখা।
তনু তাকায় মেঘের দিকে, কিছু বলার আগেই মেঘ নৌকার সামনে ঝুঁকে পড়ে। ধীরে ধীরে চুনে লিখে ফেলে একটি শব্দ—‘তুমি’। সেই শব্দটা নদীর জলের প্রতিফলনে নড়ে ওঠে, দুলে ওঠে, তারপর থেমে থাকে। তনু বিস্ময়ে বলে, “এই কী করলি?” মেঘের চোখে জল, সে বলে, “তুই তো কোনদিন নাম রাখিসনি। আমি দিলাম। এই নৌকো শুধু তোর নয়, আমারও একটা ভরসা। তাই নাম দিলাম—‘তুমি’। কারণ তুইও তো আমার ‘তুমি’, এই নদীর, এই জীবনের।” তনু চুপ করে যায়, চোখের গভীরে ঝাপসা হয়ে ওঠে কিছু দৃশ্য—তার বাবা জাল ছুঁড়ছে, মা ভাত বাঁচিয়ে রাখছে, রবি দৌড়ে আসছে স্কুল থেকে, আর মেঘ… তার চোখে সেই নদীর ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে বলছে—“তুই আমার তুমি।”
মেঘ নিচু গলায় বলে, “আমি চলে যাচ্ছি কাল। কাজ শেষ। ফিরে যাবো শহরে, ক্যামেরা, এসাইনমেন্ট, সভ্য অচেনা মুখগুলোয়। কিন্তু যাবার আগে তোকে কিছু বলতেই হতো। তুই আমার সেই নদী, যেখানে আমি ভেসেছি, বাঁচতে শিখেছি। কিন্তু আমি জানি, তোর নদী আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না, কারণ আমি ওই কূলে জন্মাইনি। তুই থাকবি নিজের জলে, নিজের ঘাটে, আর আমি থাকব শহরের গলিতে, ট্র্যাফিক সিগনালে, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার ভেতরের সবচেয়ে নরম জায়গাটায় তুই রয়ে যাবি—এই ‘তুমি’ হয়ে।” তনু কথা বলতে পারে না। শুধু নৌকার গায়ে হাত বোলায়, সেই নামটাকে ছুঁয়ে দেখে, যেন প্রথমবার নিজের ভালোবাসার ঠাঁই পেয়েছে কোনো শব্দে।
তাদের মাঝে নদী বইছিল আগের মতোই, কিন্তু আজ জলের সুরে কেমন যেন একটা সমাপ্তির ধ্বনি। মেঘ ফিরে যায় নিরব পায়ে, আর তনু দাঁড়িয়ে থাকে, তার সেই ‘তুমি’ নৌকার পাশে। নদী হয়তো সেই শব্দটা বয়ে নিয়ে যাবে কতদূর, কে জানে—তবে সেই দিন, সেই মুহূর্তে, মেঘ তার সবটুকু দিয়ে রেখে যায় একটি নাম… আর সেই নামেই বেঁচে থাকবে তনুর নৌকা, তার অপেক্ষা, আর তার এক অমোচনীয় ভালোবাসা।
৯
বছর কেটে গেছে এক নিঃশব্দ স্বরের মতো, ঠিক যেমন নদীর জলে চলে যায় স্রোত, কিন্তু ফেলে যায় কিছু ঘূর্ণি। সেই ঘূর্ণির মতোই মেঘ রয়ে গেছে তনুর জীবনে—নেই সে দৃষ্টিতে, কিন্তু আছে প্রতিদিনের বাতাসে, বিকেলের আলোয়, আর সবচেয়ে বেশি—তনুর নিজের নৌকার গায়ে লেখা সেই নামটায়: ‘তুমি’। মেঘ চলে যাওয়ার পর তনু আর কারো সঙ্গে খুব একটা মিশে না। মাঝেমাঝে শহর থেকে কেউ আসে, ছবি তোলে, ড্রোন ওড়ায়, গল্প খোঁজে, কিন্তু তনু যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, সেই এক শব্দের গভীরে। নদী এখন তার কাছে শুধু কর্ম নয়, ভালোবাসার স্মৃতি। নৌকা চালানোর সময় সে কখনও পেছনে তাকায়, কখনও আকাশ দেখে—যেন অপেক্ষা করে মেঘ আবার কোনো এক ভোরে এসে পড়বে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে।
একদিন সন্ধ্যায়, যখন রোদ আর নদীর জল মিশে গিয়ে লালচে হয়ে উঠছিল, ঠিক তখনি রবি শহর থেকে ফিরে আসে। হাতে এক খাম—পাতলা, আধা-কুঁচকে যাওয়া, তবু সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ‘তনু’। সে বলল, “দাদা, স্টেশন থেকে ফিরছিলাম, এক ভদ্রলোক দিলেন। বললেন, এটা তোর কাছে পৌঁছে দিতে।” তনু ধীরে ধীরে খামটা নেয়, বসে পড়ে ঘাটের এক কোণে। খামের ভিতরে শুধু একপাতা চিঠি—কোনো সাল তারিখ নেই, নেই কোনো অতিরিক্ত শব্দ। শুধু কয়েকটি পঙক্তি, যেগুলোর গন্ধ মেঘের মতোই ধরা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়:
“তুই নদী। আমি কূল হতে পারিনি, স্রোত হতে চেয়েছিলাম। তোর নৌকা হয়তো এখনো ভেসে চলে, আর আমি ফিরি ডুবে যাওয়ার শহরে।
তুই আমায় মনে রাখিস না, আমি জানি।
কিন্তু তোর সেই ‘তুমি’—আমার জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নাম।
ভালো থাকিস, নদীর মতো।
—মেঘ।”
তনু চিঠিটা বুকের উপর রাখে। চোখে জল নেই, শুধু ঠোঁটে একটা অদ্ভুত চাপা হাসি। যেন কারো কাছ থেকে ফিরে এসেছে এক নদীভরা উত্তর। সে চিঠিটা আবার ভাঁজ করে রাখে, খুব যত্নে। তারপর উঠে দাঁড়ায়, নৌকার গায়ে হাত রাখে। সেই ‘তুমি’ লেখা জায়গায় একবার হাত বুলিয়ে সে বলে ওঠে, “তুই ফিরলি, মেঘ। চিঠির মতো, নদীর মতো, আমি তোকে ছাড়িনি।” চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আসে, নদীর বুক জুড়ে হঠাৎ হালকা হাওয়া, যেন কারো নিঃশ্বাসের মতোই নরম।
সেই রাতে, তনু তার নৌকা জলেতে নামায়। কোনো গন্তব্য নেই, শুধু ভেসে চলা—চিঠির শব্দের মতোই, নিরুদ্দেশে। আর ‘তুমি’ নামের সে নৌকো বয়ে নিয়ে চলে তনুর ভালোবাসা, যা হয়তো ফিরে আসবে আবার… হয়তো একদিন।
১০
আষাঢ়ের মাঝামাঝি, পদ্মার জল ফুলে উঠেছে। চারদিক ভেজা, কাদা, জলের শব্দে মেশা বাতাসে কেমন এক চুপচাপ ধ্বনি—যেন কেউ কিছু বলছে না, তবু শুনিয়ে যাচ্ছে এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার গল্প। সেই জলেই, সেই নীরবতার মধ্যেই তনু আজও তার ‘তুমি’ নামের নৌকো নিয়ে বেরিয়েছে। নৌকার মাথায় বাঁধা আছে একটি লাল গামছা, আর তার বুকপাশে ভাঁজ করা সেই চিঠি—যেটা মেঘ লিখেছিল। সময় কেটে গেছে, কিন্তু তনুর মনে মেঘ এখনো নদীর ঢেউয়ের মতো গাঁথা—নিয়মিত, নরম, আর হঠাৎ হঠাৎ হাহাকার জাগানো।
সে জানে না, কবে শেষবারের মতো তাকিয়ে ছিল মেঘের দিকে। জানে না, সে ফিরবে কিনা। শুধু জানে, নদী ফিরিয়ে দেয় সবকিছু, হয়তো সময় নিয়েই। আর সেই বিশ্বাসেই সে রোজ জল ছুঁয়ে বলে, “তুমি ফিরে আসবে তো?” সে দিন, এমনই এক আষাঢ়ের দুপুরে, ঠিক যখন ঘাটে কেউ ছিল না, তখন দূর থেকে একটা গাড়ি এসে থামে। বের হয় একজন নারী, ছাতা হাতে, কাদা এড়িয়ে হাঁটে সে—কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ, চোখে সেই পুরনো দৃঢ়তা। কিন্তু আজ তার চোখের নিচে ক্লান্তির রেখা, অভিজ্ঞতার ছায়া, আর ঠোঁটে এক চেনা গন্ধ—যেটা তনু অনেক আগে নদীর বুকে শুঁকেছিল।
তনু কিছুক্ষণ দেখেই বুঝে নেয়, সে—মেঘ। কোনো সন্দেহ নেই। সে ছুটে যায় না, চিৎকারও করে না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। মেঘ এগিয়ে এসে বলে, “তুই জানিস, আমি অনেক জায়গায় গিয়েছি, অনেক নদী দেখেছি, কিন্তু কোনোটা তোর মতো হয়নি। পদ্মা যেমন আমার প্রথম ভালোবাসা, তুইও তেমন… ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।” তনু চোখ সরায় না, শুধু জিজ্ঞেস করে, “এইবার তুই থেকে যাবি?” মেঘ উত্তর দেয় না, শুধু তার হাতটা এগিয়ে দেয়—যেভাবে নদী ডাকে, শব্দহীন অথচ অস্বীকার করা যায় না।
সেই সন্ধ্যায়, প্রথমবার তনু আর মেঘ একসাথে চালায় ‘তুমি’ নামের নৌকো। দুজনের হাত ছুঁয়ে থাকে হালের উপর, আর তাদের মাঝখানে না বলা কোনো কথা নেই আর। কেবল নদী, নৌকা আর নিঃশব্দ ভালোবাসা। ঘাটে লোকেরা ফিসফিস করে বলে, “মাঝির নৌকোর নাম ছিল ‘তুমি’, এখন নাকি তার পাশে সত্যিকারের ‘তুমি’ এসে বসেছে।” মাধবী একপাশে বসে থাকেন, মুখে যেন এক মৃদু শান্তি। রবি হাঁসিমুখে দেখে দাদার চোখে সেই উজ্জ্বলতা, যা বহুদিন পরে ফিরেছে।
পদ্মা নদীর বুকে আজ আর কোনো দোলাচল নেই। যেন সে জানে, তার বুকের উপর যে প্রেম গেঁথে গেছে, তা আর ভাসবে না, ডুববে না—থাকবে… ঠিক সেই নৌকার মতো, যার নাম ‘তুমি’, আর যে ভালোবাসা আজ শহর আর গ্রাম পেরিয়ে, জল আর কূল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে, স্থির হয়ে, মেঘ আর তনুর মধ্যে।
—
শেষ