Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

নোলক

Spread the love

অনামিকা পোদ্দার


এক

বাড়ির উঠোনটা এখন আর আগের মতো নেই। আগের সেই লালমাটির ছোঁয়া, গোলপাতার ছায়ায় মেখে থাকা দুপুরগুলো যেন বহু আগেই হারিয়ে গেছে, আর আজকের এই কংক্রিট বাঁধানো বারান্দার ঠাণ্ডা ছায়ায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীমণি দেবী যেন সেই সব দিনের অলিখিত স্মৃতিগুলো স্পর্শ করতে চায়। তাঁর হাতে ধরা একটা ছোট কাঁচের বাক্স, যার ভিতরে মোটা তুলোয় মোড়া সেই পুরনো সোনার নোলক। ছেলেবেলার দিনগুলোয় লক্ষ্মীমণি যেদিন প্রথম শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছিলেন, সেদিন শাশুড়িমা এই নোলকটি তাঁর নাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন বলেছিলেন, “এইটা শুধুই অলংকার নয়, এইটা হইলো আমাদের ঘরের গৌরব, নারীর কৌলীন্য, সম্মান আর আত্মপরিচয়ের ছাপ।” আর সেই দিন থেকে শুরু করে অজস্র রাত্রি কেটে গেছে, উনুনে চড়েছে খুন্তি, সন্তানদের অসুখে ভিজেছে শাড়ির আঁচল, আর এই নোলক—এটি যেন নিজেই লক্ষ্মীমণির আত্মজীবনের এক অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু আজ, এত বছর পরে দাঁড়িয়ে, এই নোলক কার হাতে যাবে—এই প্রশ্নটাই তাঁকে বিব্রত করে। রত্না, তাঁর বড় পুত্রবধূ, যে এত বছর ধরে সংসার টেনেছে, সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে—সে নোলকের দাবি রাখে নিশ্চয়। কিন্তু কুহু? রত্নার মেয়ে, তার রক্ত, তারই গর্ভজাত—যার মধ্যে আধুনিকতার স্পষ্ট ছাপ, কিন্তু বংশীয় ঐতিহ্যের প্রতি স্পষ্ট অনাগ্রহও।

রত্না রান্নাঘরের পাশে রাখা বেতের মোড়ায় বসে কলা পাতা পরিষ্কার করছিল। ত্রিপল টাঙানো ছাদের তলায় বসে থাকতে থাকতে সে অনুভব করছিল ভেতরে কেমন একটা কুয়াশা জমেছে—মনের, না কি স্মৃতির, বোঝা কঠিন। লক্ষ্মীমণির হাতে সেই নোলক দেখে হঠাৎ তার বুকের মধ্যে কেমন একটা ধুকপুকুনি শুরু হয়েছিল। তার মনে পড়ল, কুহুর বিয়ের সময় মা বলেছিলেন, “এখন নয়, সময় হলে দিমু।” সেই সময়টা আজ কি এসে গেছে? রত্না নিজেও জানে না। কুহুর সঙ্গে তার বহু বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য থাকলেও, সে মেয়েকে ছোট করে ভাবতে শেখেনি কখনও। কুহু সবসময় তার নিজের মতো করে ভাবতে শিখেছে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছে, কিন্তু সে-ও কি জানে, তার দিদিমার এই নোলকের পেছনে কত ইতিহাস, কত রক্ত-মাংসের গল্প জড়ানো? এই অলংকার কোনো দামী গয়না নয়—এটা একটা প্রজন্মের দায়বদ্ধতা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কুহু এই ধরনের দায় মানে না। কুহুর স্বামী রুদ্র তো স্পষ্টই বলেছে, “তোমার মা যেন বুঝতে শেখে, মেয়েকে শেকলে বেঁধে রাখা যায় না।” সেই কথা শুনে রত্নার ভিতরে যেমন রাগ হয়েছিল, তেমনই একটু ভয়ও। আজ যদি নোলক কুহুকে দিয়ে দেওয়া হয়, সে কি তার আদরের সুরক্ষায় রাখবে, নাকি এই পুরো ব্যাপারটাকেই অবজ্ঞা করে, ‘পুরনো যুগের কুসংস্কার’ বলে উড়িয়ে দেবে?

কলকাতার ছোট্ট ফ্ল্যাটের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কুহু নিজের ল্যাপটপে শেষ লাইনটা টাইপ করে চোখ বন্ধ করল। বহুদিন ধরেই একটা স্টোরি লেখার কথা ভাবছিল—”ঐতিহ্য বনাম নারীর নিজস্বতা”। আর অবচেতনভাবে তার ভিতরটা বারবার নোলকের ছবিতে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। ছোটবেলায় দাদুর মৃত্যুর পর ছাদে উঠে চুপচাপ বসে থাকা লক্ষ্মীমণিকে দেখেছিল সে, কপালে সিঁদুর নেই, গলায় গয়না নেই, শুধু নাকে সেই ছোট্ট নোলক। কুহুর মনে হতো, সেই নোলকটাই বুঝি একমাত্র প্রমাণ যে তিনি কারও স্ত্রী ছিলেন, কারও ঘরের বউ ছিলেন। এখন কুহু নিজের জীবনে দাঁড়িয়ে সেই সব প্রশ্ন তোলে—নারী কি শুধুই পরিচয়ের ছাপে বাঁচবে? একটি অলংকার কীভাবে তার আত্মপরিচয়ের সীমারেখা হয়ে ওঠে? সে চায়, এই নোলকের উত্তরাধিকার যেন একজন নারীর স্বাধীন ভাবনার সঙ্গে খাপ খায়। কুহুর নিজের মেয়ে মীনা আজ আট বছর বয়সী—সে নোলকের গল্প শুনে বলে, “ওটা কি রূপকথার কিছু?”—এ কথা শুনে কুহু হেসে ফেলে। হয়তো এটাই ভবিষ্যতের পথ, যেখানে নোলক আর কোনো বন্ধন নয়, বরং একটি কাহিনির রূপ, একটি অতীতকে বোঝার খোলা জানালা। তবে কুহু জানে, এই ভাবনার বিপরীতে রয়েছে তার মা আর দিদিমার জীবনভর তৈরি করা মিথ, আবেগ, ও এক ধরনের বিশ্বাস যা ভাঙা যায় না স্রেফ যুক্তি দিয়ে।

দুই

বিকেলটা যেন একটু বেশি নীরব আজ। দোতলার পুরনো ঘরটার জানালা দিয়ে আসা আলোতে ধুলোর কণা ভাসছে, আর ঘরের মধ্যে বসে থাকা লক্ষ্মীমণি দেবী সেই ভেসে থাকা আলোয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজের যৌবনের ছায়া। সামনে রাখা ছোট্ট পেতলের থালায় নোলকটা রাখা, একটানা তাকিয়ে আছেন তাতে—যেন চোখে চোখ পড়ছে অতীতের। এমন সময়ে রত্না এসে দাঁড়াল দরজায়। তার মুখে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা, যা সে চাপতে চাইছে শালীনতার আড়ালে। “মা,” সে বলল ধীরে, “তুমি কি ঠিক করেছ কার হাতে যাবে নোলকটা?” প্রশ্নটা খুব সাধারণ হলেও, তাতে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। লক্ষ্মীমণি চোখ না সরিয়েই বললেন, “আমার ঠিক করা কিছু না, সময়ই ঠিক করে দেয় কে কাকে বহন করবে।” রত্নার গলায় একটু কাঁপুনি, “আমি তো সবসময় ভেবেছি, এটা কুহুর জন্য থাকবে। কিন্তু কুহুর চিন্তা ভাবনা তোমার তো ভালোই জানা আছে। সে এইসব ঐতিহ্য মানে না, মা। সে নিজে বলেছে আমাকে—এই নোলক হল তার কাছে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতীক, আর কিছু না।” লক্ষ্মীমণি শান্ত গলায় বললেন, “তাই যদি হয়, তাহলে তো আরও প্রয়োজন, যে বুঝে এইটাকে মান্য করবে, সেই পায়। ঐতিহ্য ফেলে দেওয়ার জিনিস না, ওটা বোঝা আর বয়ে নেওয়ার শক্তি থাকতে হয়।”

রাত্রে খেতে বসে কুহু চোখ নামিয়ে চুপচাপ খাচ্ছিল। রুদ্র তখনো ফোনে অফিসের মেইল চেক করছে। মেয়ে মীনা পাশে বসে পেঁয়াজ ছাড়া ডাল খেতে খেতে মাকে বলল, “মা, দিদিমা কি সত্যিই তোমাকে সেই সোনার নোলক দেবেন?” কুহু একটু থমকে গিয়ে বলল, “তুমি এটা কোথা থেকে শুনলে?” মীনা হেসে বলল, “খালামণি বলেছিল। বলেছে, পুরনো গল্পের রাণীর মতো তুমি যদি ওই নোলক পরো, তাহলে তুমি ‘বংশের গর্ব’ হবে।” রুদ্র এবার মুখ তুলে তাকাল, ঠোঁটের কোণে হালকা বিদ্রুপ, “তাহলে তো ভালোই, কুহু রাণীমা হতে চলেছে।” কথাটা এমনভাবে বলা যেন একটা ব্যঙ্গও আছে তাতে। কুহু মৃদু গলায় বলল, “আমি কোনো বংশের গর্ব হতে চাই না রুদ্র। আমি কেবল চাই, আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমার নিজের হোক।” এই কথা শুনে রুদ্র একটু কঠিন হয়ে বলল, “আর তোমার মা চায়, তুমি তোমার দিদিমার মতো হও। রোজ নোলক পরে রান্নাঘরে বসে থাকো, আর অতীতের গর্বে চোখ ভরে রাখো। তুমি কি সেটা চাও?” প্রশ্নটা এমন এক ধাঁধার দরজা খুলে দিল যেখানে কুহু নিজেও কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল। সত্যিই তো—সে কি চায় এই অলংকার তার চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করুক? না কি সেই স্মৃতি বহন করুক যেটা তার দিদিমার আত্মত্যাগের সাক্ষ্য?

পরদিন সকালে কুহু নিজের পুরনো বাড়িতে এসে পৌঁছায়, যেখানে লক্ষ্মীমণি দেবী তাকে ডেকেছিলেন। বাড়িটার চারদিকে তাল গাছের সারি, উঠোনে বাগানের ফুল ফুটে আছে, কিন্তু কুহুর চোখ স্থির নোলকের বাক্সের দিকে। লক্ষ্মীমণি ধীরে বললেন, “তুই তো বলিস, এই নোলক বন্দিশ। তাই ভাবলাম, তোর হাতে দিলে, তুই চাইলে খুলে ফেলতে পারবি—মুক্তি দিতে পারবি এই বন্দি আত্মাকে।” কুহু একটু চমকে তাকায়, “তুমি আমাকে দিচ্ছো, জেনেও আমি ওটাকে মূল্য দিই না?” লক্ষ্মীমণি হেসে বলেন, “তুই আমার রক্ত, কিন্তু তোর ভাবনা আলাদা—এই পার্থক্যটাই তো প্রমাণ করে নোলক কেবল পরার জন্য না, বয়ে নেওয়ার জন্য। তুই বুঝতে শিখলে, তুই ঠিক পথেই নিয়ে যাবি একে। হয় পুঁতে রাখবি, নয়তো পুনর্জন্ম দিবি।” কুহু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি জানি না আমি কী করব এখনই, কিন্তু আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি—এটাকে আর কেবল নারীত্বের শৃঙ্খল বলে অবহেলা করব না। এটাকে বোঝার চেষ্টা করব।” লক্ষ্মীমণি চোখ বুজলেন শান্তি নিয়ে, যেন সময় তার উত্তর পেয়ে গেছে।

তিন

গভীর দুপুরে বাতাস যেন জমে আছে। দোতলার ঘরটায় বসে কুহু একের পর এক পুরনো ট্রাঙ্ক খুলে দেখছিল—তার দিদিমার চিঠি, কিছু বিবর্ণ ছবি, আর একটি খামের ভেতর রাখা ছোট্ট চিরকুট, যার কালি অনেকটা মুছে গেছে। কাগজটার কোণায় জ্বলনের দাগ, মনে হয় কোনো একসময় পোড়াতে গিয়েও শেষ অবধি রাখা হয়েছিল। কুহুর হাত থেমে গেল। সে হঠাৎ বুঝতে পারল—এই কাগজটা তো তার মায়ের হাতের লেখা! কাগজে লেখা, “মা, আমি জানি আপনি কখনো জানতে চাইবেন না আমার নিজের ইচ্ছের কথা। আপনি হয়তো ভাববেন, আমি এই সংসারে নিজে থেকে এলাম। কিন্তু না, আমি ভালোবেসেছিলাম অন্য কাউকে। এই বিয়ে, এই সংসার—সব কিছু ছিল মান্যতার নাম করে একটা বিসর্জন।” কুহুর মাথা ঘুরে গেল। সে কল্পনাও করেনি, তার মা রত্না—যিনি একাধারে নম্র, ত্যাগী এবং রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত—তারও ছিল এক গোপন অতীত? কুহু নোলকের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এ তো কেবল বংশের ভার নয়, এক জীবনের স্তব্ধতা, না বলা গল্পের নীরব সাক্ষীও। সেই মুহূর্তে কুহু স্থির সিদ্ধান্ত নেয়—মাকে সামনে বসিয়ে, সত্যটা শুনতেই হবে। শুধু নোলক নয়, যে সম্পর্কগুলো এই অলংকারের চারপাশে গড়ে উঠেছে—তাও তো জানতে হবে, বুঝতে হবে, না হলে সে কীভাবে এর উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাবে?

বিকেলের সময় রত্না বারান্দায় তুলসী গাছে জল দিতে দিতে কুহুর পায়ের শব্দে থেমে গেলেন। “মা, একটু কথা বলবো?” কুহুর গলায় এক ধরনের দৃঢ়তা ছিল, যাতে রত্না বুঝে ফেললেন—আজ কিছু গোপন পর্দা সরে যাবে। চুপচাপ বসে পড়লেন তাঁরা, বেলগাছের ছায়ায় ছায়ামাখা মুখ দুটো মুখোমুখি। কুহু ধীরে কাগজটা মায়ের সামনে রাখল। “তুমি কখনো বলোনি, কিন্তু তুমি তো চেয়েছিলে অন্য জীবন। ভালোবেসেছিলে অন্য কাউকে। তাহলে কেন নিজেকে এই বন্ধনে আটকে রাখলে মা?” রত্না অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “কারণ তোমার দিদিমা। আমি এই বাড়িতে এসে প্রথম যেদিন সেই নোলকটা পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল আমি এই পরিবারের মেয়েই ছিলাম আগেও, কোনো জন্মে। আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম, সে হয়তো আমাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু এই বাড়ির উঠোনে, এই কাঁসার থালায়, এই মেয়েদের চোখে আমি দেখেছিলাম একটা শান্তি—যেটা ভালোবাসা দিয়েও মেলে না সবসময়।” কুহু আবেগে কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে তুমি আজীবন ভালোবাসাহীন থেকে গেলে?” রত্না মৃদু হেসে বললেন, “ভালোবাসা তো অনেক রকম হয় মা। তুই তো একজন সাংবাদিক—তুই জানিস সত্য মানেই একরৈখিক নয়। আমি এই সংসারকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সেই ভালোবাসা ছিল নাড়ির মতো, না কেটে পারা যায় না।” কুহু স্তব্ধ হয়ে গেল। নোলকের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হলো, এই অলংকারটা সত্যিই যেন জীবনের এমন সব স্তব্ধ অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে যা মুখে বলা যায় না, শুধু বোঝা যায়।

রাত্রে কুহু দিদিমার ঘরে এসে আবার সেই বাক্সটা খুলল। নোলকটা হাতে নিয়ে সে অনুভব করল, এটা কেবল রূপার বা সোনার জিনিস নয়—এটা তার দিদিমার নীরবতা, মায়ের বিসর্জন, আর নিজের ভিতরের সংঘাতের একমাত্র শারীরিক চিহ্ন। জানালার বাইরে ঝিঁঝিঁ ডাকছিল, আর ঘরের বাতাসে ভেসে আসছিল তুলসীর গন্ধ। কুহু এবার প্রথমবারের মতো নিজেকে প্রশ্ন করল—সে কী চায়? ঐতিহ্যের ভার নাকি তার নিজস্ব সত্তার মুক্তি? সেই রাতে অনেকক্ষণ পর ঘুম এল তার। স্বপ্নে সে দেখল, নোলকটা সে কানের কাছে ধরে কিছু শুনছে—কিন্তু কণ্ঠটা তার নিজের, তার মায়ের, না দিদিমার—তা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু একটা কথা স্পষ্ট, “তুই শুনছিস তো? এবার তুই বল।”

চার

বাড়ির উঠোনে লাল রঙের রঙোলি আঁকা হয়েছে, দু’পাশে কলাপাতা দিয়ে সাজানো। লক্ষ্মীমণি দেবীর জন্মদিন উপলক্ষে পরিবারের সবাই একত্র হয়েছে, এমন দৃশ্য বহু বছর পর ঘটছে। দোতলার ছাদ থেকে দেখতে দেখতে কুহুর চোখে যেন একটা সিনেমার মতো ভেসে উঠছিল সব কিছু—তার ছোটবেলার সেই মেজকাকা, বৌদি, কাজিনদের হাসি, একপাশে আলু পোস্তর গন্ধে ভরপুর রান্নাঘর, আর সেই অভ্যস্ত চেনা গলাগুলো, যাদের অনেককেই সে অনেক বছর দেখেনি। কিন্তু এমন একটা পরিবেশের মধ্যেও তার ভেতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা—আজ সে সেই নোলকটা সকলের সামনে তুলে ধরবে। নয় কোন দম্ভে, নয় কোন দৃষ্টান্তে—বরং এক আত্মজিজ্ঞাসার দৃষ্টিকোণ থেকে। লক্ষ্মীমণি দেবী ছোট খাটে বসে আছেন, মাথায় সাদা চাদর, চোখে শান্তির রেখা। মাইকে সবাই বক্তব্য রাখছে, কেউ কবিতা পড়ছে, কেউ পুরনো গল্প বলছে। আর সেই সময়েই বাড়ির মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেন এক পুরনো মুখ—সুধাংশু কাকা, যাকে কুহু শোনামাত্র চিনতে পারল না। কিন্তু রত্নার মুখ দেখে সে আঁচ করল, এখানে কিছু আছে—ভেতরে চাপা এক ঢেউ, যা এতদিন ধরে স্তব্ধ ছিল, আজ যেন নিজেই দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

সুধাংশু ছিলেন লক্ষ্মীমণির ছোট ভাইপো—ছোটবেলায় খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন রত্নার সঙ্গে। বিয়ের কিছুদিন আগে হঠাৎ করে কলকাতায় চাকরির সুবাদে চলে যান, আর কখনও ফেরেননি। আজ বহু বছর পর, একটি রোদ্দুরে ভরা দুপুরে, তিনি ফিরে এসেছেন। সকলের মধ্য থেকে ধীরে এগিয়ে এসে লক্ষ্মীমণির পা ছুঁয়ে বললেন, “মা, আজ ফিরলাম… একটু দেরিতে হলেও।” লক্ষ্মীমণি মাথায় হাত রাখলেন, কাঁপা গলায় বললেন, “ফিরেছিস, এতেই শান্তি।” কিন্তু রত্নার মুখে কোনো ভাষা নেই—তার চোখ শুধু আটকে আছে সেই এক পুরনো স্মৃতিতে, যেখানে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে কেউ বলেছিল, “চল, পালিয়ে যাই।” কুহু এবার অনুভব করল, তার মায়ের মুখে সেই অস্বীকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের মুখোশের আড়ালে কী ভীষণ এক স্তব্ধতা কাজ করছিল। অনুষ্ঠানের মাঝে নোলকের বাক্স নিয়ে কুহু যখন সামনে আসে, তখন রত্না হঠাৎ উঠে দাঁড়ান। তিনি বলেন, “এই নোলক আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বোঝা আর আশ্রয়—একসাথে। আমি এর উত্তরাধিকার দিতে পারতাম, কিন্তু আজ বুঝলাম—আমার অধিকার ছিল না। কুহু, আজ তুই যা করার কর।” সকলের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কেউ বুঝতে পারে না কী বলবে। কিন্তু কুহু খুব শান্তভাবে নোলকটি তুলে নিয়ে বলে, “এই অলংকার শুধু একটি পরিবারের ঐতিহ্য নয়, এটি একটি নারীর আত্মত্যাগ, সাহস ও মৌনতার প্রতীক। আমি এটাকে রাখবো, কিন্তু নতুন করে, নতুনভাবে। এটি আর শুধু রক্তরেখা নয়—এখন থেকে এটি বেছে নেওয়া এক পথের চিহ্ন।”

অনুষ্ঠান শেষে ছাদে উঠে আসে মা-মেয়ে। দুজনেই চুপচাপ। হঠাৎ রত্না বলল, “তুই যদি পালিয়ে যেতে বলিস, আমি কি যাব?” কুহু হেসে বলল, “আজ আর পালানো নয় মা, শুধু মুখোমুখি দাঁড়ানো।” দূর থেকে বাজি ফুটছে, আলোয় ঝলমল করছে গাঁয়ের আকাশ। কুহুর মনে হল, নোলকটা যেন হালকা লাগছে আজ—শুধু ধাতব এক জিনিস নয়, আত্মসম্মতির এক প্রতীক।

পাঁচ

কলকাতার শহরতলির সেই শান্ত ফ্ল্যাটে বসে কুহু অনেকদিন পর নিজের ডেস্কে ফিরে এসেছিল। বাইরে বৃষ্টির ধারা জানালার কাচে টোকা দিচ্ছিল, আর কুহুর সামনে রাখা ছিল দিদিমার দেওয়া সেই ছোট কাঁচের বাক্স—যার মধ্যে রাখা নোলক এখন যেন শুধু একটি অলংকার নয়, একটি আন্দোলনের বীজ। কুহু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে এই নোলককে শুধু উত্তরাধিকার হিসেবে রাখবে না—এর মধ্য দিয়ে সে দেখাবে নারীর নিঃশব্দ সংগ্রাম, অতীতের ত্যাগ আর বর্তমানের প্রশ্ন। তার নতুন প্রজেক্টের নাম সে রেখেছে—”The Women Behind the Ornament”—একটি লেখচিত্র ও প্রদর্শনী সিরিজ, যেখানে বিভিন্ন সময়ের নারীরা বলবেন, কীভাবে এক একটি অলংকার তাদের জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে—কখনও শক্তি, কখনও শৃঙ্খল, আবার কখনও নিঃশব্দ আত্মত্যাগের চিহ্ন। কুহু জানে, এই প্রকল্প শুধু তার পরিবারের গল্প নয়—এই বাংলার, এই দেশের, এই সমাজের হাজারো রত্নাদের কণ্ঠস্বর। সেই ভাবনা থেকেই সে আজ কলম ধরেছে, প্রথম অধ্যায়ের নাম রেখেছে—”নোলক: শব্দহীনতার স্বরলিপি”।

প্রথম সাক্ষাৎকারের জন্য সে গিয়েছিল শ্যামবাজারের এক শতায়ু বৃদ্ধার কাছে—শোভা দেবী, যিনি একসময় বিপ্লবী পরিবারের সদস্য ছিলেন। তাঁর চোখে স্পষ্ট ছাপ বর্তমান আর অতীতের মেলবন্ধনের। শোভা দেবী বলেছিলেন, “আমার শ্বশুরমশাই বলতেন, মেয়ের নাকের নোলকে পরিবারের মান থাকে। আমি সেই নোলক খুলে ফেলে বলেছিলাম, আমার মান আমার কণ্ঠে, আমার কলমে।” কুহু সেই কথাগুলো লিখে রেখেছিল যেন আগুন দিয়ে গড়া এক পঙ্‌ক্তি। আরেক সাক্ষাৎকারে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক গ্রামের গৃহবধূ জানায়, তার মা মারা যাওয়ার আগে তাকে একটি নোলক দিয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, “যদি কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলিস, এইটা ছুঁয়ে মনে করিস—তুই কত পথ হেঁটেছিস।” কুহু দেখল, প্রতিটি নারী, প্রতিটি অলংকারের মধ্যে যেন জমা হয়ে আছে এক একটি মহাকাব্য—যা কেউ কখনও লেখেনি, কেউ শোনেনি। এই গল্পগুলো সংগ্রহ করতে করতে কুহুর নিজের ভিতরেও চলছিল এক রূপান্তর, এক পরিপক্বতা, যা তাকে তার দিদিমা আর মায়ের কাছে আরও গভীরভাবে টেনে নিচ্ছিল।

রাতে মীনা পাশে বসে চুপ করে সেই নোলকটা দেখছিল। শিশুর চোখে সেটি যেন রূপকথার কোনো যন্ত্র—যা দিয়ে সময় পেরিয়ে অতীতে যাওয়া যায়। “মা,” মীনা বলল, “এইটা কি আমি কখনও পরতে পারব?” কুহু মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি কখনও মনে হয়, এটা শুধু গয়না নয়, একটা গল্প বহন করে—তাহলে অবশ্যই। কিন্তু যদি মনে হয়, এটা তোমাকে কোনো পথে বাধ্য করে, তখন নিজের পথ নিজেই বেছে নিও।” মীনা মাথা নাড়ল। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছিল। কুহু জানে, এই প্রজেক্টটা শুধু লেখালেখি নয়, এ তার নিজের অস্তিত্বের খোঁজ। আর নোলক—সেই খোঁজের মানচিত্র হয়ে রইল।

ছয়

কলকাতার এক শিল্প প্রদর্শনীর গ্যালারিতে, একচিলতে জায়গায় সাজানো হয়েছে কুহুর স্বপ্নের প্রথম প্রকাশ—The Women Behind the Ornament প্রদর্শনী। নরম আলোয় সাজানো প্রতিটি দেয়ালে টাঙানো আছে বিভিন্ন নারীর অলংকার ও তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া তাদের জীবনগল্পের নির্যাস। সেখানে কুহুর দিদিমা লক্ষ্মীমণি দেবীর সেই ঐতিহাসিক নোলকটি রাখা আছে একটি স্বচ্ছ কাচের বাক্সে, ঠিক নিচে ছোট করে লেখা—“ঐতিহ্য নয়, আত্মত্যাগের প্রতীক।” গ্যালারির প্রতিটি কোণে ঘুরছে সাংবাদিক, শিল্পপ্রেমী, গবেষক, কৌতূহলী দর্শক। কুহু দাঁড়িয়ে আছে সামনের ডেস্কে, মাথার ভেতর তখন চলছে নানা প্রশ্নের তোড়জোড়—সবাই কি বুঝবে এই অলংকারগুলোর গভীরতা? এই সোনার টুকরোগুলো যে আসলে কতটা রক্ত, ঘাম, অশ্রু জমিয়ে তৈরি? তার চোখে জল আসার আগে মাইক্রোফোনে ডাক আসে, “সাংবাদিক কুহু রায়কে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে—তাঁর এই ব্যতিক্রমী প্রোজেক্ট নিয়ে কিছু বলার জন্য।” কুহু উঠে দাঁড়ায়, ধীরে এগিয়ে যায়, কিন্তু তার মুখ খুলতে না খুলতেই পিছনের সারি থেকে ভেসে আসে এক কণ্ঠ, “আপনার দিদিমা কি চাইতেন, তাঁর সেই নোলকটা এভাবে জনসমক্ষে আসুক?”

প্রশ্নটা যেন চাবুকের মতো এসে পড়ে কুহুর মুখে। সবাই নীরব হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। প্রশ্নকর্তা একজন প্রবীণ ইতিহাসবিদ, শম্ভু মুখার্জি, যিনি নারী-ঐতিহ্য নিয়ে বহু বছর কাজ করেছেন। তার কণ্ঠে তেমন কোনো রুক্ষতা নেই, কিন্তু প্রশ্নে এক দ্বিধার ঝলক আছে—“আপনি বলছেন, এই নোলক আত্মত্যাগের প্রতীক, কিন্তু আত্মত্যাগ তো ব্যক্তিগত অনুভব। দিদিমা কি চাইতেন এই অনুভব এতগুলো অচেনা চোখের সামনে নগ্ন হোক?” কুহুর গলায় মুহূর্তের জন্য স্বর হারিয়ে যায়। ভেতর থেকে বহুদিনের একটি প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়—সে কি নিজের মত প্রকাশ করতে গিয়ে দিদিমার মৌনতা ভেঙে দিয়েছে? সে কি নোলককে ‘প্রতীক’ করে তার ব্যক্তিগত ব্যথাকে জনসমক্ষে টেনে এনে অন্যায় করেছে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলে, “আমার দিদিমা আমাকে কখনও বলেননি এই নোলক নিয়ে কিছু করতে বা না করতে। কিন্তু তিনি এটাকে শুধু অলংকার হিসেবে দেখতেন না, জানি। তিনি এটিকে ভালোবাসতেন, আবার একইসঙ্গে এর ভারে কিছুটা নিচু হয়েও থাকতেন। আমি চেষ্টা করেছি সেই ভারের শব্দ শুনিয়ে দিতে। হয়তো তিনি মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু তাঁর নীরবতা, তাঁর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, তাঁর চোখের ভেতরে লুকোনো কষ্ট—সবটাই আমার কাছে ভাষা হয়ে উঠেছে। আমি বিশ্বাস করি, যদি তিনি আজ থাকতেন, হয়তো কিছু বলতেন না—কিন্তু তিনি আমার চোখের ভেতরটা দেখতেন। আর সেটা দেখলেই বুঝতেন—আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করছি, উন্মোচন নয়, শ্রদ্ধার প্রতিচ্ছবি দিচ্ছি এই প্রদর্শনীতে।” গ্যালারির মধ্যে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছিল বৃষ্টির ধারা, আর সেই নীরবতাকেই যেন সাক্ষী রেখে উঠে আসছিল এক নতুন ব্যাখ্যা—মৌনতা মানেই গোপনতা নয়, তা কখনো কখনো সাহসের চূড়ান্ত রূপ।

প্রদর্শনীর শেষে সুধাংশু কাকা চুপচাপ এগিয়ে এসে কুহুর পাশে দাঁড়ান। বলেন, “তোর দিদিমা তো মুখে কিছু বলতেন না। কিন্তু চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন—তুই চোখে চোখ রেখেছিস, এটাই তো যথেষ্ট।” কুহু জানে, তার পথ সহজ নয়। প্রত্যেকটি প্রশ্ন, প্রতিটি চোখের জিজ্ঞাসা তাকে প্রতিদিন নতুন করে ভাবাবে, কিন্তু সে সেই ভার নিতে প্রস্তুত। কারণ নোলক এখন শুধু তার নয়—এটা হয়ে উঠেছে প্রতিটি শোভা, প্রতিটি রত্না, প্রতিটি কুহুর নিঃশব্দ উত্তরাধিকার।

সাত

গ্রীষ্মের শেষভাগ, কুহু এবার তাঁর প্রদর্শনী থেকে এক ধাপ এগিয়ে গ্রামের দিকে পা বাড়ায়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক প্রত্যন্ত গ্রামে সে আয়োজন করেছে একটি খোলা সভার—যেখানে গ্রামের নারীরা তাদের পুরনো অলংকারের গল্প শেয়ার করবেন, যেন প্রত্যেকটি অলংকার হয়ে ওঠে একেকটা জীবনরেখার প্রতিচ্ছবি। একচিলতে শালকাঠাল গাছ ঘেরা মাঠে, মাটির ঘরের পাশে ছায়ার নিচে পাতা হয়েছে চটের পাটাতন, আর সেখানে একে একে বসেছেন গ্রামের বিভিন্ন বয়সের নারীরা—হাতের চুড়ি, কানের দুল, নাকফুল কিংবা নোলক নিয়ে। কেউ বলছেন বিয়ের গল্প, কেউ বলছেন একাকীত্বে পাওয়া উত্তরাধিকার, আবার কেউ ব্যাখ্যা করছেন, কীভাবে এই ছোট ছোট ধাতব বস্তুগুলো তাঁদের সাহস কিংবা সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে কোনও এক জীবনের বাঁকে। কুহু সবার কথা মন দিয়ে শুনছেন, মাঝে মাঝে টুকে নিচ্ছেন। এমন সময় ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে এলেন একজন বৃদ্ধা—সাদা থান পরে, চোখে ঝাপসা চশমা, হাতে একটি ছোট কাপড়ের পুটলি। তিনি কিছু না বলে পুটলিটা কুহুর হাতে দিলেন। কুহু খুলে দেখে, সেখানে রাখা একটি অদ্ভুত গঠনের নোলক—অর্ধচন্দ্রাকার, কিন্তু মাঝখানে একটি গহ্বর। এমন নোলক সে আগে কখনও দেখেনি। বৃদ্ধা বললেন, “এইটা আমার নয় মা, আমার মায়ের। সে এটা গলায় ঝুলিয়ে রাখত—নাকে পরত না। জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘যেদিন নিজের ইচ্ছায় এই নোলক পরতে পারব, সেদিন পরব।’” কুহু চমকে যায়। “তাঁর নাম কী ছিল?” বৃদ্ধা বলেন, “তাঁর নাম ছিল রেখা।”

সেই নামটাই যেন বজ্রের মতো কুহুর মনে আঘাত হানে—রেখা, যে নাম সে বহুবার শুনেছে, কিন্তু সুধাংশু কাকার সঙ্গে কখনও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। রত্নার জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া ছায়া—যার কারণে দিদিমার মুখ একসময় কঠোর হয়ে গিয়েছিল। “রেখা কি এই গ্রামেরই কেউ ছিলেন?” কুহু জিজ্ঞেস করতেই বৃদ্ধা বলেন, “না মা, সে এসেছিল পলাশপুর থেকে—কেউ বলত শহর থেকে পালিয়ে এসেছে। কেউ বলত বিপ্লবী দল ছেড়ে একা ঘুরছে। কিন্তু সে এখানে এসে দুঃস্থ মেয়েদের পড়াতে শুরু করে। কেউ তার পরিণতি জানে না। একদিন হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে যায়, তার ঘরে শুধু এই নোলকটাই পড়ে ছিল।” কুহু যেন আর শ্বাস নিতে পারছিল না। তার মনে হল, সে যেন লক্ষ্মীমণি দেবীর চোখের ভাষা বুঝতে পারছে এখন, রত্নার মুখের নীরবতা মিলিয়ে ফেলছে সেই হারিয়ে যাওয়া রেখার গল্পের সঙ্গে। হয়তো রেখা-ই ছিল সেই নারী, যাকে ভালোবেসেছিলেন সুধাংশু কাকা, যাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিলেন রত্না। অথচ তিনজনের কেউই নিজের পথ শেষমেশ বেছে নিতে পারেনি। কুহু এবার সেই নোলকটা হাতে তুলে স্পষ্ট করে বুঝতে পারে—নোলক মানেই কেবল উত্তরাধিকার নয়, কখনও তা হয় অসমাপ্ত জীবনের একমাত্র অবশিষ্ট রেখা।

রাত্রে কুহু বসে সেই পুরনো পুটলি আর রেখার নোলক সামনে রেখে লিখতে শুরু করে—“The Absent Curve” নামে একটি অধ্যায়, যেখানে সে রেখার কথা বলবে—এক হারিয়ে যাওয়া মেয়ের, যে হয়তো বাঁচতে চেয়েছিল নিজের মতো, কিন্তু সে সময়ের সমাজ তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। কুহুর মনে হয়, এ অধ্যায় সে কারো অনুমতির জন্য নয়, দায়বদ্ধতা থেকে লিখছে—তিন প্রজন্ম ধরে যাঁরা কেবল সহ্য করেছেন, মুখ খোলেননি, তাঁদের হয়ে।

আট

রাত্রির আকাশে চাঁদ ওঠেনি, কিন্তু জানালার ফাঁক গলে শহরের আলোর ঝাপসা ছায়া এসে পড়েছে মেঝের ওপর। কুহু বসে আছে তার মায়ের ঘরে, সামনে টেবিলে রাখা সেই অদ্ভুত নোলক—যার মাঝে এক ফাঁকা গহ্বর, যেন একটি অনুপস্থিত জীবনের প্রতীক। বহু বছর ধরে সে নিজের মাকে দেখেছে নীরব, আত্মসচেতন, এমনকি প্রশ্ন এড়িয়ে চলতেও। কিন্তু আজ সে আর কোনও উত্তর চেপে রাখতে চায় না। তার গলায় কাঁপা স্বর, “মা, রেখা কে ছিল?” প্রশ্নটা শুনেই রত্না যেন পাথর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন, তারপর জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “তুই এই প্রশ্ন করতে এতদিন সময় নিলি কুহু?” কুহু বলল, “আমাকে সময় লেগেছে বুঝতে—তুমি নোলকের ভার বয়ে নিয়ে শুধু আমার মা ছিলে না, তুমি নিজেও তো একজন অসমাপ্ত গল্পের নায়িকা।” রত্না চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর কণ্ঠে এখন গুঞ্জন, যেন নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “রেখা আমার বোনের মতো ছিল, কিন্তু আমার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে—সে যা চেয়েছিল, আমি সাহস পাইনি চাইতে।”

ঘরটা নীরব, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যেন অনেক কিছু চলছে। রত্না ধীরে বলতে শুরু করেন, “আমি যখন বিয়ে হয়, তখন কিছুই বুঝতাম না। শুধু জানতাম, দিদিমার চোখে যেন সব ঠিকঠাক থাকুক। কিন্তু আমি জানতাম, সুধাংশু আর রেখার মধ্যে কী ছিল। সেটা একটা নিষিদ্ধ কথা, যেটা আমাদের বাড়ির মেয়েরা কেবল চোখ নামিয়ে সহ্য করত। রেখা চলে যাওয়ার পর দিদিমা অনেকটা ভেঙে পড়েন, কিন্তু বাইরে কাউকে বুঝতে দেননি। শুধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই মুখ বুজে থাকবি, তাহলে সংসার টিকে থাকবে।’ আমি মুখ বুজেছিলাম কুহু, এতটাই শক্ত করে, যে নিজের ইচ্ছেগুলোকেও চেপে ফেলেছিলাম।” কুহুর চোখে জল। সে জানে, আজ তার মা কোনও নাটক করছে না—আজ সত্যি নিজেকে উন্মোচন করছে। “তুমি কি রেখার মতো পালাতে চাওনি মা?”—প্রশ্নটা ধীরে এসে পড়ে। রত্না জবাব দেন, “হ্যাঁ, চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি পালাতে পারিনি। আমি বেছে নিয়েছিলাম থাকাকে, পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে যাওয়াকে। আমার নোলক ছিল আমার স্তব্ধতার শপথ।”

কুহু এবার সেই গহ্বরওয়ালা নোলকটি রত্নার হাতে দেয়। “এইটা রেখার ছিল। আমি জানি না সে কোথায় হারিয়ে গেল, কিন্তু তার অস্তিত্ব হারায়নি মা। সে থেকেছে তোমার চোখে, দিদিমার মুখে, আমার রক্তে।” রত্না নোলকটি হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। তাঁর চোখে জল, কিন্তু সেটি কাঁপছে না—বরং স্থির, সমর্পণের মতো। “তুই আমাকে আজ প্রথমবার মনে করিয়ে দিলি, যে আমি শুধু কারও মা বা বউ না, আমি নিজেও একজন মানুষ ছিলাম। আমি চাই, তুই এই গল্পগুলো বলিস, কুহু। রেখে যা তোরা বলিনি।” কুহু মায়ের হাত ধরে বলে, “তোমরা যে নীরবতা বেছে নিয়েছিলে, আমি তার ভাষা তৈরি করতে চাই।”

সেই রাতে, প্রথমবার কুহু দেখে, তার মা ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজের কপালে স্নেহভরে রেখার নোলকটি ছুঁয়ে রাখলেন—নাকে নয়, গলায় নয়—ঠিক হৃদয়ের কাছে। যেন এক অদৃশ্য প্রতিজ্ঞা, এক নীরব আত্মপ্রকাশ।

নয়

প্যারিসের সেই মৃদু শীতল সন্ধ্যায়, কুহু দাঁড়িয়ে আছে Maison des Femmes গ্যালারির উজ্জ্বল আলোকিত হলে, হাতে তার সেই ছোট কাঁচের বাক্স—যার ভিতরে রাখা আছে লক্ষ্মীমণি দেবীর দেওয়া নোলক, রেখার অর্ধচন্দ্রাকার ফাঁকা নোলক, আর আরও কিছু নির্বাচিত অলংকার—যাদের প্রত্যেকটির পেছনে একটি করে উচ্চারণহীন কণ্ঠ রয়েছে। তার আজকের বক্তৃতার বিষয়: “Inherited Silence: Ornamentation and the Voice of South Asian Women”। হল ভর্তি শ্রোতা, তাদের অধিকাংশ বিদেশি সমাজতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, নারীবাদী লেখক—যাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারে আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরণ। কুহু জানে, সে আজ শুধু নিজের নয়, রত্না, রেখা, লক্ষ্মীমণিদের আত্মার প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছে। সে গভীর শ্বাস নেয়, শুরু করে—“In our part of the world, women wore their silence in gold…” হল নিস্তব্ধ। তার কণ্ঠে দুলছে ইতিহাসের ধুলো, গায়ের প্রতিটি সুর আঁকা যেন একটি স্তব্ধ বহমান নদী।

কিন্তু প্রশ্নোত্তর পর্বে ঝড় আসে। একটি তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দেন অধ্যাপক ম্যারিয়েন ক্লার্ক—যিনি বহু বছর ধরে আফ্রিকান এবং এশিয়ান নারীবাদ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন, “Ms. Roy, your presentation is visually moving. But I must ask—why must we still find identity through objects—through ‘things’ forged by patriarchal economies? Isn’t it problematic that your grandmother’s voice still lives inside an ornament she didn’t choose?” হল যেন মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে আসে। কুহু শোনে প্রশ্নটির প্রতিধ্বনি যেন তার হৃদয়ের মধ্যেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—সে নিজেও তো একসময় ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিল। সে চুপচাপ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর মাইক্রোফোনে একটু ঝুঁকে বলে, “Yes, she didn’t choose the ornament. But she lived through it. And sometimes, what we don’t choose—becomes the very stage where our resistance matures in silence.” সে থামে না—“You see this as a symbol of patriarchal design. I see it as evidence of endurance. While Western feminism often dismantles symbols, our struggle often repurposes them—we turn cages into carvings, chains into stories.” হল যেন হঠাৎ নড়ে ওঠে, কারও মুখে বিস্ময়, কারও চোখে মুগ্ধতা। কুহুর কণ্ঠে আর লজ্জা নেই—সে এখন শুধুই এক কথক, এক উত্তরসূরী, এক নির্মাতা।

সেই রাতে হোটেলরুমে ফিরে কুহু দীর্ঘ চিঠি লেখে মাকে। “আজ কেউ প্রশ্ন করেছিল, কেন আমাদের কণ্ঠ অলংকারে বন্দি? আমি বললাম, আমরা অলংকারে কণ্ঠ বসিয়েছি। তুমি যা বলনি মা, আমি তার ভাষা খুঁজে বের করেছি।” সে চিঠির সঙ্গে একটি ছোট স্কেচও পাঠায়—একটি নারী মুখ, যার নাকে কোনও নোলক নেই, কিন্তু তার কণ্ঠের ভেতর ফুটে উঠছে একটি অদৃশ্য রূপালী রেখা—রেখার মতো, পবিত্র, অসমাপ্ত, অথচ উচ্চারিত।

দশ

শীতের এক আলস্যমাখা সকালে কুহু ফিরে এসেছে দেশে। দক্ষিণ কলকাতার সেই পুরনো ফ্ল্যাটবাড়িটা যেন আরও নীরব, আরও ক্লান্ত লাগছে। তবে এবার তার চোখে বিষণ্ণতা নেই—বরং এক রকম শান্তি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কুহু সেই নোলক দুটো হাতে নেয়—দিদিমার পরিধেয় গাঢ় সোনার জ্যোৎস্না আর রেখার অর্ধচন্দ্রাকার শূন্যতার প্রতীক। অনেক দূর হেঁটে সে আজ এই সিদ্ধান্তে এসেছে—নোলক কেবল উত্তরাধিকার নয়, এটি উত্তর খোঁজার পথ। সে একে বংশরক্ষার ভার নয়, প্রশ্ন করার সাহস হিসেবে দেখতে চায়। কুহু আজ মীনার জন্য একটি বিশেষ উপহার রেখেছে—একটি নোলক, তবে সম্পূর্ণ নতুন নকশায়—এক আধুনিক শিল্পীর হাতে তৈরি, যাতে দিদিমা, মা, আর রেখার ছায়া মিশে আছে।

দুপুরবেলায় মীনা স্কুল থেকে ফিরে দেখে, তার বিছানায় রাখা একটি খাম, তাতে লেখা—“এই নোলক তোমার, যদি তুমি একদিন নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখো।” মীনা বিস্মিত চোখে মাকে দেখে। কুহু মৃদু হেসে বলে, “এই অলংকার তুমি পড়ো বা না পড়ো, আমি চাই তুমি বুঝো—এটা কেবল গহনা নয়। এটা জীবনের সেই অংশ, যেটা প্রশ্নকে ভয় পায় না।” মীনা জিজ্ঞেস করে, “এইটা কি দিদিমার?” কুহু মাথা নাড়ায়, “না, এটা তোমার। নতুন। কিন্তু তাতে রয়েছে তোমার দিদিমা, রেখা, আমার, আর তোমার গল্প—সবকিছু একসাথে।” মীনা কৌতূহলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে সেই অলংকার, যেন বুঝতে চায়, এর ভেতরে ঠিক কী লুকিয়ে আছে। হয়তো সে এখনো সম্পূর্ণ বোঝে না, কিন্তু বোঝার বীজ সে হৃদয়ে রাখে।

বিকেলে কুহু পুরনো বাড়িতে গিয়ে শেষবারের মতো দিদিমার ঘরে ঢোকে। লক্ষ্মীমণি দেবী আর নেই, কিন্তু তার ব্যবহৃত আয়না, কাশ্মীরি কাঠের চৌকি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের আলমারি—সব আছে। কুহু সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির পাশে কল্পনা করে তার দিদিমাকে, যিনি একদিন এই আয়নার সামনেই নোলক পরে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কুহু নিজের কান থেকে নোলক খুলে আলমারির ওপর রাখে—একটি ছায়ার পাশে আরেকটি ছায়া রেখে দেয়।

শেষবারের মতো সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে থেমে যায়। ধীরে বলে, “আজ আমি নোলক রেখে যাচ্ছি না, বরং নিয়ে যাচ্ছি—নতুন রূপে, নতুন প্রজন্মে। এবার আর কেউ এই অলংকারে বন্দি থাকবে না। এবার থেকে এ এক প্রতিজ্ঞা—চুপ না থাকার।” জানালার বাইরে শালিক ডাকছে, আর সূর্য তার সোনালি আলোয় আচ্ছাদিত করছে সেই ছোট কাঁচের বাক্সটাকে—যার ভেতর নোলক নেই, কেবল একটা অদৃশ্য উত্তর দীপ্ত হয়ে আছে।

___

1000032847.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *