Bangla - ভ্রমণ

নেপালের নোটবুক

Spread the love

শ্ৰীরূপা দে


এক

হিমালয়ের গায়ে বসে থাকা শহর পোখরায় পৌঁছানোর সময় অরিত্রর চোখে ছিল নিঃসঙ্গতা, আর মীনাক্ষীর মুখে ছিল নিঃশব্দ ক্লান্তি—যেন তারা দু’জনই এই ভ্রমণটাকে জীবনের অপ্রকাশিত শূন্যতা থেকে সাময়িক মুক্তির পথ ভেবেছিল, কিন্তু কেউ কাউকে সেই সত্যি বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। বিমানবন্দরের থেকে হোটেল অবধি ট্যাক্সিতে বসে তারা খুব কম কথা বলেছিল, কিছু দায়সারা মতন মন্তব্য—“আবহাওয়াটা ভালোই তো” কিংবা “ওই বরফ দেখা যাচ্ছে”—এর বেশি কিছু নয়। মীনাক্ষী জানালার দিকে মুখ করে বসেছিল, আর অরিত্র ফোনে মেইল চেক করছিল। তারা যে এখন একে অপরের থেকে কয়েক মাইল দূরের মানুষ হয়ে উঠেছে, সেটা তারা দুজনেই টের পায়, কিন্তু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে বহু আগেই। হোটেলটি ছিল ছোট, কিন্তু সাজানো; কাঠ ও পাথরের মিশেলে তৈরি রিসর্টের ঘর, যেখানে বড় একটি জানালা খুললেই দেখা যায় ফেওয়া লেকের জলছবি আর দূরে মাউন্ট মচ্ছপুচ্ছরের তুষার-ঢাকা চূড়া। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মীনাক্ষী খেয়াল করে, এক কোনায় পড়ে আছে একটি পুরনো বাদামি রঙের নোটবুক, বাঁধাই করা মোটা কভারে, যেটি নিশ্চয়ই কোনও আগের অতিথি ফেলে রেখে গিয়েছে। “তুমি দেখেছো? এটা কার?” বলে সে নোটবুকটা তুলে নেয়। অরিত্র তখন স্যুটকেস আনপ্যাক করছিল, অবহেলাভরে বলল, “হোটেলের কাউন্টারকে বলে দিও, কেউ হয়তো রেখে গেছে ভুল করে।” কিন্তু মীনাক্ষী ততক্ষণে প্রথম পাতাটা খুলে ফেলেছে—লেখা আছে কাঁচা হস্তাক্ষরে: “এই ভ্রমণটা কেবল পাহাড় দেখতে নয়, নিজেকে খুঁজে বের করাই ছিল আসল উদ্দেশ্য।” তার গলার স্বর একটু বদলে গেল, যেন একটা অদ্ভুত কৌতূহল ধীরে ধীরে চুঁইয়ে পড়ছে মনের ভিতর।

রাতটা অনেকটাই ঠান্ডা ছিল, লবিতে আগুন জ্বালানো চিমনির পাশে বসে থাকাকালীন মীনাক্ষী আবার সেই নোটবুকটা নিয়ে বসে। “তুমি কি পড়ছো?” অরিত্র জিজ্ঞেস করে, যেন খুব একটা আগ্রহ নেই তার। মীনাক্ষী বলে, “একটা মেয়ের লেখা… নামটা রূপসা, কলকাতা থেকে এসেছে বছরখানেক আগে… দেখো তো কী সুন্দর লিখেছে, ‘পাহাড় আমাকে কখনো ডাকে না, আমি নিজেই পালিয়ে আসি, কারণ সমতলের মধ্যে শিকড় নেই আমার।’” অরিত্র হেসে ফেলে, “সবই কাব্যিক কথাবার্তা, বাস্তবে কাজ চলে না এগুলো দিয়ে।” মীনাক্ষী তাকিয়ে থাকে তার দিকে, কয়েক সেকেন্ড নীরবতা… তারপর মুখ ঘুরিয়ে আবার পড়ে। সে জানে, অরিত্র বদলে গেছে। আগে এমন কথা সে বলত না, আগে ওর চোখে ছিল গল্প শোনার আগ্রহ, এখন কেবল যুক্তি খোঁজে। কিন্তু এই ডায়েরির মধ্যে যেন এক আশ্চর্য টান আছে—রূপসা দে নামের অচেনা মেয়েটি এমনভাবে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছে যে, পড়তে পড়তে মনে হয় যেন কেউ তার নিজের গোপন প্রশ্নগুলো শব্দে ধরে রেখেছে। “এই মেয়েটা কেমন করে লিখেছে জানো অরিত্র, যেন পাহাড়ের পাথরের ফাঁক দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে—সোজা, ধীর, অথচ ছুঁয়ে যায় গভীরভাবে।” অরিত্র তখন ফোনে অফিসের মেসেজ লিখছে, উত্তরে শুধু বলল, “হুম। তুমি পড়ো।” সেই ছোট্ট হুম-এর মধ্যে ছিল একটা স্পষ্ট দূরত্ব—যা পোখরার হিমেল বাতাসে আরও ঠান্ডা হয়ে যায়।

পরদিন সকালে তারা বেড়িয়ে পড়ে শহর দেখতে, গন্তব্য পিস প্যাগোডা, তারপর দেবী ফলস। অরিত্র সব জায়গায় ছবি তোলে, ক্যামেরার লেন্সে ব্যস্ত থাকে, আর মীনাক্ষী মাঝে মাঝে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে কোনও পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন তার মনে চলছে অন্য কোনও যাত্রা। কিন্তু মীনাক্ষীর মাথায় তখনও গেঁথে আছে সেই ডায়েরির পাতা, গতরাতের পড়া লেখাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভিতর। গাড়িতে ফেরার পথে সে বলে, “জানো, আজকের দিনটা যেন একরকম ধোঁয়াটে। ঠিক যেন আমি জানি না কোথায় যাচ্ছি, কিন্তু বুঝতে পারছি, কোথাও কিছু বদলাচ্ছে।” অরিত্র উত্তর দেয় না। সে জানে মীনাক্ষী এসব বলে নিজের মনের কথা বোঝাতে চায়, কিন্তু এখন তাদের মধ্যে ভাষা নেই বলেই সব প্রশ্ন বাতাসে ভাসতে থাকে। হোটেলে ফিরে এসে মীনাক্ষী আবার সেই নোটবুক খুলে পড়ে—এবার রূপসা লিখেছে কাঠমান্ডু শহরের কথা, এক ছোট বইকাফে, আর এক রহস্যময় মানুষের কথা—চেয়ান নামের একজন, যে নাকি তার জীবনের একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছিল। মীনাক্ষীর চোখ জ্বলে ওঠে। সে পড়ে, “চেয়ানকে আমি চিনি না, তবুও তার চোখে দেখেছিলাম এমন এক প্রশান্তি, যা আমি নিজের মধ্যেও খুঁজছিলাম অনেকদিন ধরে।” মীনাক্ষীর বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে কিছু। সে চুপচাপ ডায়েরির শেষ পাতায় চোখ বুলিয়ে যায়, আর নিজের অজান্তেই সে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “এই মেয়েটার সঙ্গে আমার এত মিল কেন লাগছে?”

দুই

রাত্রি আরও নেমে আসে পোখরার গায়ে, হিমালয়ের সাদা মাথাগুলো অন্ধকারে মিশে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু মীনাক্ষীর চোখের সামনে যেন খুলে যেতে থাকে এক অন্য জগৎ—নোটবুকের পাতায় পাতায় ধরা এক তরুণীর আত্মস্বীকারোক্তির বিশাল ক্যানভাস। বসার ঘরে ল্যাম্প জ্বেলে মীনাক্ষী ডায়েরির দ্বিতীয় অধ্যায় পড়তে শুরু করে, আর পাঠের সঙ্গে সঙ্গে সে যেন এক অদ্ভুত তন্ময়তায় ডুবে যায়। রূপসা দে লিখেছে, “আমি যখন বিমানে উঠি, তখন আমার ভেতর একটাও স্বপ্ন ছিল না, ছিল কেবল ক্ষোভ, অভিমান আর ক্লান্তি। কারো উপর না, নিজের উপরই বেশি। কলকাতার ট্র্যাফিকের মতোই আটকে গিয়েছিলাম আমার জীবনে। হঠাৎ মনে হল, পালাতে হবে, গন্তব্য না থাকলেও। নেপাল তখন একটা মানচিত্রের বিন্দু, কিন্তু আমার কাছে মুক্তির নাম।” এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে মীনাক্ষীর বুক ধকধক করে ওঠে—কারণ ওর নিজের মধ্যেও যেন এমন কিছু জমে আছে, যা সে কোনওদিন কারও কাছে বলেনি। অরিত্র তখন পাশের সোফায় বসে নিউজ দেখছে, কিন্তু মীনাক্ষীর মন আর নোটবুকের ছেঁড়া পাতাগুলোর মাঝখানে একটাও ফাঁক নেই। রূপসা লিখেছে তার কলেজের প্রেমের কথা—যেখানে প্রথম ভালোবাসা ছিল উচ্ছ্বাসে ভরা, কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যেই তা হয়ে দাঁড়ায় নিয়ন্ত্রণ আর দমবন্ধ হয়ে থাকার চেন। “সে আমায় ভালোবাসত, তবু আমায় চায়নি এমনভাবে যেভাবে আমি নিজেকে চাইতাম। আমি তাকে ছেড়ে পালিয়ে এসেছি, না বলে, শুধু একটা চিঠি রেখে।” এই স্বীকারোক্তি যেন মীনাক্ষীর মনেও উস্কে দেয় একটা পুরনো কথা, একটা ইচ্ছা, যা সে কবর দিয়ে রেখেছিল বিবাহের ভিতর।

ডায়েরির পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে রূপসা তার পোখরার প্রথম কয়েক দিনের কথা লিখেছে—ফেওয়া লেকের ধারে একা বসে থাকা, হোটেলের ছাদে গরম চা হাতে নীল পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকা, আর সেই একাকীত্ব, যা মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে আবার গড়ে তোলে। “আমি কারও খোঁজে বেরোইনি, শুধু নিজের ভাঙাগুলোকে জোড়া লাগানোর জন্য জায়গা খুঁজছিলাম।” সে লিখেছে একটি সন্ধ্যার কথা, যখন এক বিদেশিনী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি এখানে কী খুঁজতে এসেছো?” উত্তরে সে হেসে বলেছিল, “ভুলে যাওয়ার অজুহাত।” এই সমস্ত শব্দের গহনে মীনাক্ষী ডুবে যায়। তার মনে হতে থাকে, রূপসা যেন কোনও অচেনা আত্মীয়—অথবা, তারই সেই ছায়া, যে কোনো এক অতীতে অন্য পথ নিলে আজ এই লেখা তারই হতে পারত। সে একবার অরিত্রর দিকে তাকায়—পুরোনো সেই অরিত্রর ছায়াও আজ আর ওর মধ্যে খুঁজে পায় না। কোথাও একটা ক্লিক করে না, কোথাও কিছু হারিয়ে গেছে—আর সে সবকিছু চুপচাপ সহ্য করে গেছে বছর বছর ধরে। অথচ এই ডায়েরির পাতাগুলো যেন সাহস জোগায়, “তুমি চাইলে নিজেকে ফিরে পেতে পারো।” হঠাৎ একটা গভীর আকর্ষণ অনুভব করে সে—রূপসার এই যাত্রা সে শেষ না করে ছাড়বে না।

পরদিন সকালে পোখরার পথে হাঁটার সময়, মীনাক্ষী হঠাৎ অরিত্রকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কখনো নিজের থেকে পালাতে চেয়েছো?” অরিত্র অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আমার তো পালানোর সময় নেই।” এই কথাটা শুনে মীনাক্ষী বুঝতে পারে—তারা দুজন দুই দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে গেছে। একে অপরের ভাষা বুঝলেও হৃদয়ের অন্তর্নিহিত সুর হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে এটাও জানে, কথা না বললে সম্পর্ক শুধু বাইরে থাকে, ভেতরে পৌঁছায় না। তাই সে ডায়েরির কথা শোনায় না আর, কেবল চুপচাপ ভাবে—সে পড়বে, সে জানবে রূপসার সবটা, কারণ এই মেয়েটি শুধু নিজের গল্প বলেনি, অরিত্র-মীনাক্ষীর মতন আরও অনেক দম্পতির মধ্যে চুপ করে থাকা প্রশ্নগুলোও রেখে গেছে প্রতিটি লাইনে। ডায়েরির পরবর্তী পাতায় মীনাক্ষী দেখতে পায়, রূপসা লিখেছে: “একদিন কাঠমান্ডু যাবো। শুনেছি সেখানে একটা বইকাফে আছে—যেখানে দেওয়ালে কিছু লেখা থাকে, আর চুপচাপ মানুষ বসে কফি খায় আর পড়ে—সেখানে কেউ যদি আমার মতন নিঃশব্দতা বোঝে, তবে হয়তো একটা কথা বলব। না হলে, চুপ করে তাকিয়ে থাকব।” এই লাইনগুলো পড়ে মীনাক্ষীর মনে হয়—সে যদি কখনো সেই কাফেতে পৌঁছায়, তবে রূপসার মতো তাকেও কেউ হয়তো পড়তে পারবে। সেই প্রথম সে ভাবে, কাঠমান্ডু যাওয়ার দিন যেন তাড়াতাড়ি আসে, কারণ নোটবুকের পরবর্তী পাতাগুলো যেন তাকে ডাকছে, আরও গভীরে, আরও নির্জনতায়।

তিন

পোখরার ভোরটা ছিল চুপচাপ, পাখির ডাক আর দূরের জল ছলছল শব্দে গাঁথা একরকম মন্থর সুরে গড়া। হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মীনাক্ষী ডায়েরির আরও পৃষ্ঠা উল্টে যায়, যেন সেই পাতাগুলোর মধ্যে লুকোনো আছে এমন কিছু যা সে নিজের জীবনে কখনো খুঁজে পায়নি—একটা মুক্তি, একটা না বলা অনুভব। আজ সে যেটা পড়ছে তা ছিল রূপসার সম্পর্কের খোলস উন্মোচনের অধ্যায়—”প্রেম মানে যদি একে অপরের জায়গা দখল করে নেওয়া হয়, তবে সেই ভালোবাসা জড়িয়ে ধরে না, গিলে খায়”—এই লাইনটা পড়েই মীনাক্ষীর বুকটা ভার হয়ে ওঠে। রূপসা বর্ণনা করছে কীভাবে তার প্রেমিক ধীরে ধীরে তাকে ভালোবাসার নামে দমন করতে শুরু করেছিল—প্রথমে পোশাক নিয়ে মন্তব্য, পরে বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে রাখা, তারপর ছোট ছোট কথায় অপমান, আর সেই সবের আড়ালে একেকটা আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়া আত্মা। মীনাক্ষী মনে মনে ভাবে, তার নিজের জীবনেও এমন কিছুর শুরু হয়েছিল, যদিও অরিত্র কখনো চিৎকার করেনি, গায়ে হাত তোলেনি, কিন্তু তার চোখের সেই ধাতব ঠাণ্ডা অভিব্যক্তি মাঝে মাঝে এমনভাবে তাকে অস্পষ্ট করে তুলত, যেন সে আর নিজেকে নিজেই চিনতে পারত না। এমনকি, কিছুদিন আগে কোনো এক রাতে যখন সে বলেছিল, “আমরা একে অপরকে সময় দিই না,” তখন অরিত্র চোখ না তুলে বলেছিল, “সময় চাইলেই পাওয়া যায় না।” সেই রাতের নিঃশব্দ কান্না সে কাউকে বলতে পারেনি, এমনকি নিজেকেও নয়।

সেদিন দুপুরে তারা বের হয় বেগনাস লেক ঘুরতে, কিন্তু সফরের মাঝেই হালকা বাদল নামে। গাড়ির ভিতর অরিত্র জানায়, সে একটা ভিডিও ক্লায়েন্টকে পাঠাতে হবে, তাই ফিরে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসবে। মীনাক্ষী মাথা নাড়লেও তার চোখ ছিল অন্যদিকে—যেখানে রূপসা লিখেছে, “একটা সম্পর্কের মৃত্যু চুপিচুপি ঘটে, ঠিক যেমন পাহাড়ের গায়ে ধসে পড়ে পাথর, কিন্তু কারও কানে তা পৌঁছায় না, কারণ শব্দ হয় না।” গাড়ির ভিতরে বসেই সে চুপচাপ পাতা উল্টায়, আর প্রতিটি লাইনের সঙ্গে মিলে যেতে থাকে তার নিজের অতীতের কিছু স্মৃতি—একটা সময় ছিল যখন অরিত্র তাকে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় ফোন করে বলত, “তুমি আজ কী খেয়েছো?”, আর এখন ও একসঙ্গে থেকেও জিজ্ঞেস করে না, “তুমি ঠিক আছো তো?” সে ভাবে, সেই সব খুঁটিনাটি ভালবাসার ইশারা হয়তো সময়ের সঙ্গেই মুছে যায়, নাকি মানুষ ইচ্ছা করেই হারিয়ে ফেলে? ডায়েরির একটা লাইন খুব মনে ধরে তার—“ভালোবাসার সবচেয়ে বিপজ্জনক রূপ হলো অভ্যাস, যেখানে আর কাঁটা বিধে না, কারণ চামড়া মোটা হয়ে যায়।” মীনাক্ষী জানে, তাদের বিবাহিত জীবনের চামড়াও এখন এমনই শক্ত হয়ে গেছে। সে কখনো কখনো ভাবতে শেখে, রূপসার মতন পালিয়ে গেলে কী হতো? যদি একদিন সত্যিই সব ছেড়ে এই নেপালের কোনও পাহাড়ি ঘরে একা থাকতে পারত, তবে কি সে নিজেকে ফিরে পেত? আর কীভাবে ফিরে পাওয়া যায় এমন এক মেয়েকে, যে বছর দশেক আগে শহরের ব্যস্ততা আর প্রেমের প্রতিশ্রুতি নিয়ে অরিত্রর পাশে হাঁটছিল?

রাতের খাওয়াদাওয়ার পর অরিত্র টিভিতে নিউজ দেখতে দেখতে বলে, “তুমি এই নোটবুকটা এত পড়ছো কেন? এটা কি গল্প না ডায়েরি?” মীনাক্ষী উত্তর দেয়, “ডায়েরি। একটা মেয়ের। তুমি একবার পড়ে দেখো, কেমন জানি… খুব সত্যি।” অরিত্র একটু বিরক্তি নিয়ে তাকায়, “সত্যি যদি হয়, তবে তো আরও খারাপ। কেউ একা এত ব্যথা নিয়ে চলে বেড়াচ্ছে—দেখতে তো খুব রোম্যান্টিক মনে হয়, কিন্তু আসলে সেটা মানসিক সমস্যা।” মীনাক্ষীর মনে হয়, এই কথাটা শুধু রূপসাকে নিয়ে বলা হয়নি, বলা হয়েছে তাকে নিয়েও—কারণ সেও তো এখন কিছুটা একা, কিছুটা অদ্ভুত, কিছুটা বাস্তববাদহীন। সে আর কথা না বাড়িয়ে উঠে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে যায়। বাইরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাত গাঢ় হয়ে আসছে, আর সে অনুভব করে, তার ভিতরের সেই চেনা পৃথিবীটা প্রতিদিন একটু একটু করে ধসে যাচ্ছে—নীরবে, শব্দহীন ভাঙনের মতন। কিন্তু এই ভাঙনের শব্দ একমাত্র সে-ই শুনতে পাচ্ছে, কারণ সে একা, ঠিক যেমন রূপসা। জানালা দিয়ে ঝিরঝিরে বাতাস ঢুকে আসে, আর সেই হাওয়ায় পাতার শব্দের মতো মীনাক্ষীর মনেও ভেসে ওঠে একটা প্রশ্ন—এই সম্পর্ক কি বাঁচানো যাবে, না কি এই ডায়েরির পরের পৃষ্ঠাগুলো তাকে সত্যিই কিছু শেখাবে?

চার

দুই দিনের নিঃশব্দ পোখরা ভ্রমণের শেষে আজ তারা রওনা দিল কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে। গাড়ির জানালায় পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ আর সবুজের ছায়া দ্রুত পিছিয়ে যেতে থাকল, আর ভিতরে মীনাক্ষী কিছুক্ষণ ডায়েরি পড়ল, তারপর একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল বাইরে। অরিত্র তার পাশে বসে এখনো ফোনে মেসেজ টাইপ করছে, ক্লায়েন্টের সঙ্গে আলোচনার রুটিন, সোশ্যাল মিডিয়া ক্যালেন্ডার, ব্র্যান্ড টোন—সবই যেন এখন তার বাস্তব। একসময় মীনাক্ষী বলে ওঠে, “তুমি জানো, রূপসা কাঠমান্ডু গিয়েছিল নিজের মতো করে হাঁটার জন্য, একটা ক্যাফে খুঁজে পেয়েছিল, যেটার দেওয়ালে লেখা ছিল—‘Words are where silence lives’।” অরিত্র তাকায় না, বলে, “ওরা এভাবেই লেখে—দার্শনিকতা আর কাব্যিকতা মিশিয়ে একটা ইমেজ তৈরি করে। বাস্তবে তো এসব খুঁজে পাওয়া যায় না।” মীনাক্ষী কিছু বলে না, কিন্তু মনে মনে ঠিক করে নেয়—সে খুঁজে দেখবে, যদি সত্যিই এমন কোনও ক্যাফে থাকে, তাহলে সে গিয়ে দেখবে, বসে থাকবে চুপচাপ, আর সেই রূপসার ছায়াকে অনুভব করার চেষ্টা করবে। গাড়ির হঠাৎ এক ধাক্কায় ডায়েরির ভেতরে রাখা একটি ছোট্ট পাতার খসখস শব্দ হয়—এটা ছিল রূপসার নিজের হাতে এঁকে রাখা একটা মানচিত্রের মতন কিছু, যেখানে লেখা ছিল: “Thamel Street থেকে ডান দিকে ঘুরলেই পাওয়া যাবে The Yellow Room Cafe”। পাতাটি যেন হাতছানির মতো ডাকে।

কাঠমান্ডু শহর ব্যস্ত, হাঁটতে হাঁটতে পা ক্লান্ত হয়ে যায়, কিন্তু চোখ ও মন অতৃপ্ত থেকে যায়। হোটেলটি তামেল এলাকার এক গলির ভিতরে, ব্যালকনি থেকে দূরের স্টূপা দেখা যায়, আর পাশেই লোকাল বাজারের গুঞ্জন, প্যাঁচানো রাস্তা, তিব্বতি মালার দোকান। দুপুরের বিশ্রামের পর মীনাক্ষী চুপচাপ একাই বেরিয়ে পড়ে, অরিত্র তখন স্নান করে বিছানায় শুয়ে ফোনে স্ক্রল করছে, আর মীনাক্ষী কেবল বলে, “আমি একটু হাঁটতে যাচ্ছি।” হাতে ডায়েরির সেই পাতাটি, সে ঘোরে শহরের মাঝের পথগুলো দিয়ে, মানুষের কোলাহলের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। অবশেষে একটা সরু গলির মাথায় সে দেখতে পায় ছোট্ট কাঠের সাইনবোর্ড, হলুদ রঙে লেখা “The Yellow Room Cafe”। বুকের ভিতর যেন হঠাৎ করে ধুকধুক শুরু হয়—এই তো সেই জায়গা, যেটা কেবল পাতায় পড়েছিল, আজ সামনে দেখা যাচ্ছে। ভিতরে ঢুকে সে দেখে, কাফেটি নিঃশব্দ, গুনগুন করছে হালকা জ্যাজ সংগীত, বইয়ের তাকের উপরে চা-চশমা পরা এক বৃদ্ধা বই পড়ছেন, আর কোন এক কোণে দুটি কিশোরী ফিসফিস করে কথা বলছে। দেয়ালে একটা লাইন সত্যিই লেখা—“Words are where silence lives”—আর তার নিচে, খোলা রাখা একটা নোটবুক, যেখানে কেউ একজন লিখে রেখেছে, “আমার দুঃখ গুলো এখানে শব্দ হয়ে বসে থাকে, কেউ পড়ে না, তবু আমি রেখে যাই।” মীনাক্ষী হালকা কাঁপা হাতে বসে পড়ে, এক কাপ ব্ল্যাক কফি অর্ডার করে আর ডায়েরিটা খুলে বসে।

সন্ধ্যা ধীরে নেমে আসে কাঠমান্ডুর উপর, লাল-কমলা আভায় গাছের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে জানালায়, আর সেই আলো-আঁধারিতে মীনাক্ষী রূপসার সেই অধ্যায় পড়তে থাকে, যেখানে সে এই কাফে নিয়ে লিখেছে—“এখানে এসে আমি প্রথম বুঝেছিলাম, নীরবতাও কথা বলে। কেউ প্রশ্ন করে না, কেউ উত্তর চায় না, কিন্তু একটা চোখ জানে কিভাবে কান্না চিনতে হয়।” সেই পাতাগুলোতে লেখা ছিল চেয়ান নামের এক রহস্যময় ব্যক্তির কথা—ক্যাফের মালিক, অল্প বয়স, নেপালি, শান্ত স্বভাবের, চোখে যেন দূর পাহাড়ের রঙ। “আমি তাকে চিনি না, তবু তার চুপ করে থাকা যেন আমার মনের সব শব্দ পড়ে ফেলেছিল”—এই লাইন পড়ে মীনাক্ষী শিউরে ওঠে। সে টেবিলের অপর প্রান্তে চোখ রাখে—সেখানে একজন লোক, মাথায় হালকা টুপি, বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হয়, এই তো হতে পারে সেই চেয়ান, অথবা কেবল কল্পনা। কিন্তু সে বুঝতে পারে, এই ক্যাফে কেবল একটি জায়গা নয়, এটি একটি অনুভূতির নাম, যা রূপসাকে বদলে দিয়েছিল, আর আজ মীনাক্ষীকেও ভিতর থেকে স্পর্শ করছে। সে বেরিয়ে আসে, বাইরে তখন নেপালি রাত জেগে উঠছে, বাতাসে তিব্বতি মশলার গন্ধ আর দূরে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। সে হেঁটে চলে হোটেলের দিকে, হাতে ডায়েরি আঁকড়ে ধরা, মনে মনে ঠিক করে নেয়—রূপসার পথ সে পুরোটা পেরোবে, কারণ এই যাত্রায় সে কেবল এক অচেনা মেয়েকে জানছে না, বরং ধীরে ধীরে নিজের হারিয়ে যাওয়া আত্মাকেও চিনতে শিখছে।

পাঁচ

পরদিন সকালটা শুরু হয়েছিল নীরবতার মোড়কে, কাঠমান্ডুর সেই শহুরে কোলাহলের মাঝেও মীনাক্ষীর মনে যেন এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে। রাত্রে দেরি করে হোটেলে ফিরলেও অরিত্র কিছু জিজ্ঞেস করেনি, বরং চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েছিল তার পাশের বিছানায়। মীনাক্ষী সারা রাত চোখে ঘুম আনতে পারেনি—রূপসার লেখা শেষ কয়েকটা পৃষ্ঠা বারবার মনে ঘুরেছে। সেই Yellow Room Cafe-র নিঃশব্দ দেওয়াল, সেই আশ্চর্য নাম—চেয়ান—আর তার সেই অসম্পূর্ণ উপস্থিতি যেন মীনাক্ষীর ভেতরের কোনও খালি জায়গাকে শব্দহীন ভাষায় ছুঁয়ে দিয়ে গেছে। সকালে সে ঠিক করে, আজ আবার সেই ক্যাফেতেই যাবে, কিন্তু এইবার একা নয়—অরিত্রকে নিয়েই যাবে। সে জানে, অরিত্র ক্যাফে কিংবা ডায়েরির প্রতি অতটা উৎসাহী নয়, তবু হয়তো এই যাত্রাটা তাদের একে অপরকে নতুন করে চেনার একটা সুযোগ হতে পারে। অরিত্র প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও, মীনাক্ষীর চোখে চাপা অনুরোধ দেখে শেষমেশ মাথা নাড়ল। “আচ্ছা, একটা কফি খাওয়া যাবে। কিন্তু গল্পের খোঁজে না, এইসব ডায়েরির রোম্যান্টিসিজমে আমার তেমন বিশ্বাস নেই,” বলে হালকা হেসে উঠে পড়ে সে। মীনাক্ষী জানে, আজকের অভিজ্ঞতা শুধু চোখ দিয়ে নয়, অনুভব দিয়ে বুঝতে হয়।

Yellow Room Cafe-র দরজায় পা রাখতেই অরিত্র একটু থেমে যায়—এই ছোট্ট কাঠের ঘরটায় ঢুকলেই যেন বাইরের শহরটা পেছনে পড়ে যায়। ভিতরে ঢুকে টেবিলে বসার সময় মীনাক্ষী চোখে চোখ রাখে এক তরুণের সঙ্গে—চেয়ান কি? তারই মতো দেখতে, মাথায় হালকা টুপি, গলায় কাঠের মালা, আর চোখে এক ধরনের শান্ত আবরণ। মীনাক্ষী কিছু বলার আগেই সে হেসে বলে, “আপনারা রূপসার খোঁজে এসেছেন?” এই প্রশ্নে অরিত্র চমকে তাকায় মীনাক্ষীর দিকে—তবু মীনাক্ষী ধীর গলায় বলে, “হ্যাঁ, আমরা তার লেখা পড়েছি… একটি নোটবুকে। আপনি কি চেনেন তাকে?” তরুণ চেয়ান একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, “সে এখানে এসেছিল গত বছর। চুপচাপ বসে থাকত। মাঝে মাঝে লিখত, মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকত বাইরের দিকে। খুব বেশি কথা হয়নি আমাদের মধ্যে, কিন্তু কখনো কখনো তো কথার থেকেও বেশি বোঝা যায় চুপ করে থেকে।” এই সংলাপের ভেতর দিয়ে যেন অরিত্র প্রথমবার অনুভব করে, রূপসা হয়তো একটা কল্পনা নয়, একটা বাস্তব স্পর্শযোগ্য যন্ত্রণার নাম, যা কাঠমান্ডুর এই অচেনা কোণকে তার নিজের করে রেখেছিল। চেয়ান মৃদু গলায় বলে, “সে বলেছিল, তার হৃদয়ের শব্দগুলো কেউ বুঝতে চায় না। আমি বলেছিলাম, কেউ না বুঝলেও তুমি লিখে যাও—কারণ শব্দ কখনো একা থাকে না।” এই ক্যাফের কোনে রাখা একটি পুরনো নোট খাতায় রূপসার হাতের লেখা এখনো রয়ে গেছে—মীনাক্ষী এক পৃষ্ঠা খুলে পড়ে, “যে মানুষ প্রশ্ন না করেও তোমার যন্ত্রণা বুঝে নিতে পারে, তার মুখ মনে রাখার দরকার হয় না—তার স্পর্শ থেকে যায়।”

চেয়ানের এই কথাগুলো শোনার পর অরিত্রের মনেও একটা অস্পষ্ট আলোড়ন তৈরি হয়, কিন্তু সে সেটা চুপ করে রাখে—হয়তো অনুভবটা তার ভেতরে পরিণত হতে সময় নেবে। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসার সময় মীনাক্ষী ধীরে ধীরে হেঁটে যায়, আর অরিত্র তার পাশে পাশাপাশি হাঁটে—কোনো কথাবার্তা নেই, কেবল একটানা হাঁটা। একসময় মীনাক্ষী বলে, “চেয়ান ঠিক বলেছে, কিছু কিছু বোঝার জন্য শব্দের দরকার পড়ে না।” অরিত্র একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি মনে করো, আমরা এখনও বোঝার চেষ্টা করছি?” এই প্রশ্নের মধ্যে অনুতাপ ছিল না, বরং ছিল এক ধরনের স্বীকারোক্তি। মীনাক্ষী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে, “আমি চেষ্টা করেছি অনেক, এখন চাই শুধু অনুভব করতে।” তারা দুজনেই বুঝতে পারে, রূপসার নোটবুক শুধু এক তরুণীর ভ্রমণকাহিনি নয়, বরং এক জীবন্ত আয়না, যেখানে তাদের নিজেদের চেহারাগুলো প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। সেই সন্ধ্যায় তারা হোটেলে ফিরে নীরবেই বসে থাকে ব্যালকনিতে, দূরের পাহাড়ে সূর্য ডুবে যায়, আর তার আলোর রেখা দুটো মানুষের মুখে পড়েও কিছু বলেনা—শুধু বলে, “ভেতরের ভাঙন বুঝতে পারলে সম্পর্ক আবার গড়া যায়।” আর চুপ করে বসে থাকা সেই সময়ের ভেতর দিয়েই অরিত্র প্রথম অনুভব করে—কোনো এক অবচেতন গভীরতায় সে রূপসার সেই নোটবুকের পাতার ভেতর ঢুকে পড়েছে।

ছয়

পরদিন সকালটা যেন এক নতুন ভাবনায় গাঁথা ছিল—বহুদিন পর অরিত্র নিজেই চা বানিয়ে মীনাক্ষীর হাতে এগিয়ে দেয়, হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তারা দুইজনেই নীরবে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তুষারসজ্জিত শৃঙ্গগুলো এতদিন শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনে হলেও আজ যেন তারাও কিছু বলতে চাইছে—কোনও অলক্ষ্য ভাষায়, যা স্পর্শ করে যায় চুপ থাকা সম্পর্ককে। মীনাক্ষী ডায়েরির নতুন অধ্যায় খুলে পড়ে, যেখানে রূপসা লিখেছে চেয়ানের সঙ্গে তার শেষ দিনের কথোপকথনের কথা—“সে বলেছিল, আমরা যা খুঁজি তা বাইরের নয়, সবকিছুই ভেতরের অপেক্ষা। তুমি যদি নিজের প্রশ্নের দিকে তাকাও, উত্তর তোমার মধ্যেই লেখা থাকে।” এই শব্দগুলো যেন মীনাক্ষীর নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে ছুঁয়ে যায়। সে ভাবে, এতদিন তার সমস্ত অসন্তোষ, অপূর্ণতা কেবল অরিত্রর উপর চাপিয়ে দিয়েছিল, অথচ হয়তো তার নিজের মনেও বহু অজানা গোলক ছিল, যেগুলো খুলতে সে নিজেই ভয় পেত। সে জানে, এখনও সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায়নি, কারণ অনুভবের কোনও বয়স হয় না—শুধু চেনার ইচ্ছা লাগে, জানার তৃষ্ণা লাগে। সেই অনুভব থেকেই মীনাক্ষী এবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলে, “চলো, আজ নেপাল ছাড়ার আগে রূপসার শেষ ছায়াটা খুঁজে ফিরি। ক্যাফের আশেপাশে এমন কোনও জায়গা থাকবে হয়তো, যেখানে সে কিছু রেখে গেছে। না হোক চিঠি, একটা নোট, অথবা নিঃশব্দেই ফেলে যাওয়া কিছু।” অরিত্র এবার আর বিরোধিতা করে না, সে মাথা নাড়ায়—এই নীরব সম্মতির মধ্যেই হয়তো কোনও সম্পর্ক আবার নতুন করে হাঁটা শুরু করে।

তারা ঘোরে কাঠমান্ডুর অলিগলি—তামেলের পিছনের দিক, সস্তা বইয়ের দোকান, ধূপের গন্ধে ভরা প্রার্থনার ঘর, আর ছোট এক গলির শেষে আবিষ্কার করে একটা পুরনো স্টেশনারি শপ, যেখানে রূপসা সম্ভবত নোটবুকটা কিনেছিল। দোকানি বৃদ্ধ মনে করতে পারে না নাম, কিন্তু একটি পুরোনো অর্ডার খাতায় ‘R. Dey’ নামের পাশে লেখা আছে—‘Hardbound Tibetan-paper Journal, mustard tone.’ এই ক্ষুদ্র সূত্র যেন তাদের ভেতরের কল্পনাকে বাস্তবের সঙ্গে বেঁধে দেয়। মীনাক্ষী সেই দোকানের এক কোণে বসে আবার ডায়েরি পড়ে—এইবার পৃষ্ঠা যেখানে রূপসা লিখেছে, “কখনও কখনও আমি ভাবি, আমার এই যাত্রা যদি কেউ পড়ে—তবে সে যেন জানে, আমি কেবল পালিয়ে আসিনি, আমি নিজেকে খুঁজতে চেয়েছিলাম। যদি কেউ এই লেখাগুলোতে নিজেকে খুঁজে পায়, তবে জানবে, আমরা একা নই।” এই লাইন পড়ে অরিত্র চুপ করে বসে থাকে। সেও নিজের ভিতরে অনেক প্রশ্ন চেপে রেখেছিল—প্রথমদিকে হয়তো কাজের চাপ, সময়ের অভাব, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই চাপা প্রশ্নগুলো অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। আজ এই যাত্রা তাকে বুঝিয়ে দেয়, যে অনুভব গুলো সে ভুলে গিয়েছিল—সেগুলোরই পুনরাবিষ্কার সম্ভব। সেও এই নোটবুকের পৃষ্ঠায় নিজের মুখ দেখতে পায়—একটা এমন অরিত্র, যে শুধু দায়িত্বশীল ছিল না, অনুভব করতে চেয়েছিল, কিন্তু কথা বলতে পারেনি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তারা আবার Yellow Room Cafe-তে ফিরে আসে, এইবার ভেতরে ঢুকে মীনাক্ষী ছোট্ট একটা চিরকুট রেখে আসে—ডায়েরির ফাঁকা পাতার শেষে লিখে দেয়: “আমরা তোমার লেখা পড়েছি, রূপসা। আর তা আমাদের নিজেদের সম্পর্ককেও নতুন করে পড়তে শিখিয়েছে।” চেয়ান তখনও সেখানে, দূরের জানালায় বসে, নীরব হাসি নিয়ে দেখে সেই লেখা, কিছু বলে না, কেবল মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানায়—যেন বুঝে গেছে এই দুই আগন্তুকের বদলের অভ্যন্তরীণ ভাষা। তারা যখন বেরিয়ে আসে, তখন নেপালের আকাশে লালচে সোনালি আলো, বাতাসে একটা নির্জন গান বাজছে, কোনও সঙ্গীত যন্ত্র ছাড়াই। অরিত্র হঠাৎ থেমে বলে, “আমরা ফিরে যাবো, কিন্তু তুমি কি চাও আমরা আবার নতুন করে চেষ্টা করি—না শুধুই পড়ে ফেলি এই গল্পটাকে?” মীনাক্ষী তাকিয়ে থাকে তার চোখে—সেই পুরনো চেনা চোখে এখন আর অবহেলা নেই, আছে একরাশ অনুতাপ, আর নতুন করে চেনার ইচ্ছা। মীনাক্ষী হালকা হাসে, “গল্পগুলো পড়ে শেষ করা যায়, সম্পর্কগুলো আবার লিখতে হয়।” তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে, আর রূপসার নোটবুক সেই হোটেলের টেবিলে খোলা পড়ে থাকে, যেন অপেক্ষা করছে পরবর্তী কাউকে, যে সেই শব্দের মধ্য দিয়ে আবার নিজের জীবনের কোনও হারিয়ে যাওয়া সুরকে চিনে নেবে।

সাত

নেপাল ভ্রমণের শেষ দিন, সকালবেলা এক অদ্ভুত শান্তির অনুভূতিতে জেগে ওঠে মীনাক্ষী। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে আছে কাঠমান্ডুর মৃদু আলো, জানালার ফাঁক গলে হালকা হাওয়া ঢুকে আসে—কেমন এক স্বচ্ছ ও নিঃশব্দ অনুভব যেন গোটা শরীর আর মনের উপর ছায়া ফেলেছে। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে সে ডায়েরিটা বার করে বিছানার উপর রাখে, আর অনুভব করে এটা কেবল কাগজে লেখা কিছু শব্দ নয়, এটা একটা যাত্রাপথ, যেটার গায়ে সে নিজের ছায়া রেখেছে। আজ সে ঠিক করেছে, ক্যাফেতে আরেকবার যাবে, চেয়ানকে একটা কথা বলবে—শুধু একটা ধন্যবাদ নয়, একটা স্বীকৃতি। অনেকদিন পর সে বুঝেছে, কেউ কিছু না বলেও কারও জীবনের বাঁকে আলো ফেলতে পারে, ঠিক যেমন চেয়ান করেছিল রূপসার সঙ্গে, আর অদৃশ্যভাবে তাদের সঙ্গেও। অরিত্র তখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলে, “আজ সকালে কিছু জায়গা দেখে নিতে পারি, বৌদ্ধনাথ, পাটান দরবার স্কয়ার?” মীনাক্ষী মাথা নাড়লেও বলে, “একবার Yellow Room এ যেতে চাই।” অরিত্র আর প্রতিবাদ করে না—তার চোখে এখন এক নরম জায়গা, যেখানে সে নিজের ত্রুটি আর শূন্যতাকে মেনে নিতে শিখছে। দুজন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে, হালকা রোদ, অল্প ঠান্ডা, আর গলির মধ্যে হঠাৎই যেন সব শব্দ মিইয়ে যায়, কেবল হৃদয়ের ধ্বনি শোনা যায় স্পষ্ট।

Yellow Room ক্যাফেতে পৌঁছে মীনাক্ষী একটু থেমে যায় দরজার সামনে। এই দরজার ওপারে তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি অপেক্ষা করেছিল মাত্র কয়েকদিন আগে, আর আজ সে ফিরছে তার প্রতিধ্বনি নিয়ে। ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পায় চেয়ান যথারীতি জানালার ধারে বসে আছে, হাতে একটা পুরনো বই, মুখে নিঃশব্দ প্রশান্তি। মীনাক্ষী ধীরে কাছে গিয়ে বলে, “আপনার কাছে একটা প্রশ্ন আছে—রূপসা কি সত্যিই একা চলে গিয়েছিল?” চেয়ান একটু তাকিয়ে বলে, “সে একা আসেনি, নিজের সমস্ত যন্ত্রণা নিয়ে এসেছিল, আর যখন গেল, তার ভিতরে ছিল এক ধরনের মুক্তি।” সে একটু থেমে আবার বলে, “রূপসা এখানে শেষদিন একটা খাম রেখে গিয়েছিল, বলেছিল যদি কেউ সত্যি মন থেকে তাকে খুঁজে পায়, তবে সেটা দিতে পারি।” চেয়ান ক্যাফের ডেস্ক থেকে একটা হলুদ খাম বের করে মীনাক্ষীর দিকে এগিয়ে দেয়। অরিত্র অবাক চোখে তাকায়, আর মীনাক্ষীর হাত কেঁপে ওঠে খামটা নিতে নিতে। ভিতরে একটি মাত্র চিঠি—রূপসার হাতের লেখা, “প্রিয় অচেনা পাঠক, আমি জানি, তুমি যদি এই চিঠি পড়ছো, তবে তুমি সেই একজন, যে আমার যন্ত্রণার শব্দকে বোঝার মতো অনুভব বুকে নিয়ে হাঁটে। আমি ঠিক জানি না, আমি কে—তবে তুমি যদি নিজের ভিতরে আমায় খুঁজে পাও, তবে আমি হারাইনি। মনে রেখো, আমরা যারা অনুভব করি, তারাই জীবনকে গভীর করে দেখি।” চোখের কোণে অশ্রু জমে ওঠে মীনাক্ষীর, কিন্তু সে কাঁদে না—কারণ সে জানে, এই চোখের জল কেবল বিষণ্ণতা নয়, এটা উপলব্ধির প্রশান্তি।

হোটেলে ফিরে তারা শেষবারের মতো ব্যাগ গোছায়, আর মীনাক্ষী ডায়েরিটা সযত্নে ব্যাগে রেখে দেয় না—ছাদে উঠে গিয়ে সেই ছোট্ট লাইব্রেরি কোণে রেখে আসে, ঠিক যেখানে অন্য ট্রাভেলারেরা বই রেখে যায়। অরিত্র অবাক হয়ে বলে, “তুমি রেখে দিচ্ছো?” মীনাক্ষী হেসে বলে, “এটা এখন আমার মধ্যে আছে, বইটা অন্য কারও হতে দাও—আর কারও দরকার হতে পারে।” তারা বিমানবন্দরের পথে হাঁটতে হাঁটতে আর কোনো পুরনো আলোচনা তুলে আনে না—কেবল চোখে চোখ রেখে নতুন এক যাত্রার পরিকল্পনা করে। মীনাক্ষী ভাবে, রূপসার ডায়েরি যদি তাদের মধ্যে একবার ভাঙন তৈরি করেও থাকে, সে ভাঙনই তো দরকার ছিল ভেতরের স্তরগুলো বুঝতে, ভালোবাসা আবার অনুভব করতে। সম্পর্ক কোনো সমাধান নয়—এটা একটা প্রশ্ন, যাকে প্রতিদিন নতুন করে জিজ্ঞেস করতে হয়। আর সেই প্রশ্নে যদি একে অপরের চোখে একটু চুপ থাকা, একটু হাত ধরা, একটু বোঝার ইচ্ছা থাকে, তবে তার উত্তর শব্দ দিয়ে নয়, অনুভবেই আসে। নেপাল পেছনে পড়ে যায়, তবু ডায়েরির পাতাগুলো আর রূপসার সেই অচেনা উপস্থিতি তাদের সঙ্গী হয়ে থাকে, ঠিক যেমন নীরবতা থেকেও কেউ রয়ে যায়—জীবনের সবচেয়ে উচ্চারণযোগ্য স্মৃতির মতো।

আট

কলকাতায় ফেরার পর প্রথম ক’দিন যেন সব কিছু ঘোলাটে মনে হয় মীনাক্ষীর কাছে—যেন সে এখনও কাঠমান্ডুর পাহাড়ঘেরা ক্যাফের এক কোণে বসে আছে, আর প্রতিটি কাগজের পাতায়, বাতাসের গন্ধে, কারও নিঃশব্দ উপস্থিতি লেগে আছে। শহরের চেনা কোলাহল, পরিচিত রুটিন আর পুরনো দেয়ালগুলো হঠাৎই কেমন অনাত্মীয় লাগে—ঘরের পর্দা, বিছানার চাদর, রান্নাঘরের শব্দ—সব কিছু যেন তাকে প্রতিধ্বনির মতো মনে করিয়ে দেয়, সে কোথাও একটু পালিয়ে গিয়েছিল নিজেকে খুঁজতে। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে সে যা পেয়েছে, তা ছিল তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি—ডায়েরির পাতায় লুকানো রূপসার আত্মকথায় সে যেটা খুঁজে পেয়েছে তা কেবল সহানুভূতি নয়, নিজের দুঃখের স্বীকৃতি। চেয়ানের দেয়া সেই চিঠিটা সে বারবার পড়ে, সেই শেষ লাইনটা—“তুমি যদি নিজের ভিতরে আমায় খুঁজে পাও, তবে আমি হারাইনি”—এই একটা বাক্যই যেন তার ভিতরের দীর্ঘদিনের জমে থাকা বিষাদটাকে এক গভীর মমতায় ছুঁয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে, রূপসা তার জীবনে কেবল একজন পথিকের মতো আসে না, বরং তার চুপ থাকা জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া সুরটাকে ফিরিয়ে আনে, যা এতদিন ধরে সে ভুলে গিয়েছিল কিভাবে গাইতে হয়।

অরিত্র প্রথম কয়েকদিন সোজাসুজি কিছু বলেনি, কিন্তু তার প্রতিটি কাজে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যায়—ভোরে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা, সন্ধ্যেবেলা মীনাক্ষীর সঙ্গে চা খাওয়ার অনুরোধ, আর মাঝেমধ্যে “তুমি ঠিক আছো তো?” বলা ছোট ছোট বাক্য—যা এতদিনে প্রায় মুছে গিয়েছিল। এক রাতে মীনাক্ষী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আর অরিত্র এসে বলেছিল, “তুমি কি এখনও সেই চিঠিটা সঙ্গে রেখেছো?” মীনাক্ষী একটু চমকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ, প্রতিদিন পড়ি না, কিন্তু জানি সেটা আছে। মনে হয়, সে আমাকে আমার দুঃখগুলোকে ভয় না পেতে শিখিয়েছে।” অরিত্র ধীরে ধীরে বলে, “আমিও যেন এই ক’দিনে একটু একটু করে নিজেকে বুঝেছি। হয়তো অনেকদিন তুমি পাশে থেকেও অচেনা হয়ে গিয়েছিলে, আর আমি সেটা দেখিনি।” এই স্বীকারোক্তি খুব বড় কিছু নয়, তবু মীনাক্ষীর চোখে জল আসে না, বরং তার ভেতরে এক ধরনের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। তারা দুজনই জানে, সম্পর্ক আবার নতুন করে সাজানো যায় না ঠিকই, কিন্তু সেই ভাঙা অংশগুলোর মধ্যে আলো ফেলা যায়—সেগুলো জোড়া না লাগলেও তাদের উপস্থিতি স্বীকার করলেই সম্পর্কের ভার হালকা হয়ে যায়। এক বিকেলে তারা বসে একসাথে পুরনো ছবি দেখতে থাকে, যেগুলো কখনোই গুরুত্ব পায়নি—সেখানে রূপসা নেই, নেপাল নেই, কিন্তু আছে তারা দুইজন, নতুন হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।

কয়েক সপ্তাহ পর মীনাক্ষী ঠিক করে, সেই চিঠিটা সে পাঠিয়ে দেবে চেয়ানকে, বা হয়তো শুধু একটি কপি রাখবে নিজের কাছে—অরিজিনাল চিঠি যাবে তাদের হিমালয় ঘেরা সেই ক্যাফেতে, যেখানে প্রতিটি পাঠক নিজের একটা কোণা খুঁজে পায়। সে চিঠির শেষে আরেকটি বাক্য যোগ করে—“তোমার শব্দে আমি নিজেকে ফিরে পেয়েছি, আমি চাই অন্য কেউও তা পাক।” চিঠি এক খামে ভরে, হলুদ টেপে মুড়ে মীনাক্ষী একটা ছোট্ট প্যাকেটে পাঠিয়ে দেয় নেপালের ঠিকানায়। কিছুদিন পরে ক্যাফের ইনস্টাগ্রাম পেজে একটি ছবি পোস্ট হয়—টেবিলের উপর রাখা সেই চিঠির খাম, তার পাশে চেয়ানের এক জোড়া চশমা, আর নিচে ক্যাপশন: “Some stories return home. Some voices never leave.” মীনাক্ষী ছবিটা দেখে হাসে, তার মুখে শান্তির ছায়া পড়ে। সে জানে, রূপসা সত্যিই হারিয়ে যায়নি, ঠিক যেমন ভালোবাসা, অনুভব, আর সম্পর্ক—হারিয়ে গেলেও ফিরে আসতে পারে, যদি কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে। সেই শেষ বাক্যটার মতই—“তুমি যদি নিজের ভিতরে আমায় খুঁজে পাও, তবে আমি হারাইনি”—এই লাইন আর মীনাক্ষীর জীবনের মাঝে কোনও পার্থক্য থাকে না। এখন সে জানে, প্রত্যেক হারিয়ে যাওয়া শব্দেরই একটা ঠিকানা থাকে—শুধু খুঁজে নিতে হয় নীরবতার ভিতরে।

নয়

নেপাল থেকে ফেরার পর কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে। শহরের ব্যস্ততা, ট্রাফিকের ক্লান্তি, আর দম বন্ধ করা রুটিনে মীনাক্ষী আর অরিত্র ফের ডুবে যায়, কিন্তু এবার সেই ডুবটা একেবারে নিঃসাড় নয়—বরং তারা যেন নিচে নেমেও একে অপরের হাতে ধরা থাকে। মীনাক্ষী অফিসের কাজ সামলানোর ফাঁকে মাঝেমধ্যে দুপুরে এক কাপ কফি বানিয়ে অরিত্রর ডেস্কে দিয়ে আসে, আর অরিত্র নিঃশব্দে চোখ তুলে দেখে, বলে না কিছু, শুধু মৃদু হাসে—সেই হাসি এখন কথা বলে, যা আগে চুপ করে থাকত। তারা আর ডায়েরি পড়ে না, রূপসার নামও উচ্চারণ করে না বেশি, কিন্তু জানে, সেই নোটবুকের প্রতিটি পৃষ্ঠা তাদের সম্পর্কের গায়ে আলো ফেলে গিয়েছে। সেই আলোয় পুরনো ফাটলগুলো দেখা যায় স্পষ্ট করে, আর সেগুলোকেই তারা ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দেখছে—মেরামত নয়, বরং স্বীকৃতির স্পর্শে। এক রাতে মীনাক্ষী বলেছিল, “জানো, আমি এখন চুপচাপ থেকেও অনেক কিছু বুঝি। আগে ভাবতাম, ভালোবাসা মানেই প্রচুর বলা, বোঝানো, প্রতিদিন কিছু না কিছু প্রকাশ করা। এখন বুঝি, ভালোবাসা অনেক সময় নিঃশব্দে পাশে দাঁড়ানোর মতো। রূপসা যেটা অনুভব করেছিল, আমরা সেটা চোখের সামনে দেখেছি।” অরিত্র উত্তর দেয়নি, কিন্তু সে মীনাক্ষীর হাত ধরে ছিল অনেকক্ষণ—ঠিক যেমন কাঠমান্ডুর ব্যালকনিতে বসে তারা চুপচাপ চা খেয়েছিল, কোনো কথা না বলেও সবকিছু বুঝে নিয়েছিল।

তাদের দিনগুলো এখন আগের মতো বাঁধা ছকে চলে, কিন্তু মাঝেমধ্যে সেই ছকের বাইরে একটু আলোর রেখা এসে পড়ে। কখনো সন্ধ্যেবেলা অরিত্র বলে, “চলো, আজ বাইরে খাই”, বা মীনাক্ষী বলে, “আজ তোমার কাজ শেষ হলে ছাদে বসি একটু।” এই ছোট ছোট অনুরোধগুলোর মধ্যেই তারা এখন সম্পর্ক গড়ে নিচ্ছে, নতুন করে। আর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন, তারা এখন আর আগের মতো অভিযোগ করে না—বরং চেষ্টা করে অনুভব করতে, একে অপরের অসহায়তাও বুঝতে। একদিন হঠাৎ অরিত্র বলল, “তুমি কি জানো, আমি একটা ছোট গল্প লিখতে শুরু করেছি?” মীনাক্ষী অবাক হয়ে তাকায়, “তুমি লিখছো?” অরিত্র একটু অপ্রস্তুতভাবে বলে, “হ্যাঁ, এই ক’মাসে মনে হচ্ছে, শব্দ না থাকলে অনেক কিছু বলা যায় না। রূপসার লেখা পড়েই সাহস পেয়েছি।” মীনাক্ষীর চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে—তারা জানে, সেই নেপালের নোটবুক তাদের সম্পর্কের শুরু নয়, কিন্তু একটা সেতু ছিল, যার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজনেই নিজের এবং একে অপরের অনুভবকে ছুঁতে শিখেছে। তাদের ভালোবাসা এখন আর শব্দ দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়, তা এখন একটা নিরব আলাপ—যেখানে একজন না বললেও আরেকজন বুঝে যায়, কখন পাশে দাঁড়াতে হয়।

এখন মীনাক্ষী নিজেও লিখে—নোটবুকে নয়, ফোনের খসড়ায়, মাঝেমাঝে ডায়েরিতে। তার লেখাগুলো ব্যক্তিগত নয়, কল্পনার নাম করে লেখা হলেও আসলে প্রতিটি লাইনে সে ছুঁয়ে যায় নিজের অনুভব। সেইসব শব্দ সে অরিত্রকে পড়ে শোনায় না, কিন্তু টেবিলে ফেলে রাখে ইচ্ছাকৃতভাবে—আর অরিত্র বুঝে যায়, কোন শব্দটা তাকে উদ্দেশ করে লেখা। একদিন তারা পুরনো ছবির অ্যালবাম খুলে বসে, আর হঠাৎ করেই মীনাক্ষী বলে, “এই ছবিটার পাশে কি একটা ক্যাপশন দেওয়া যায়?” অরিত্র ভাবে, তারপর বলে, “হয়তো—‘তুমি পাশে ছিলে, শুধু আমি চোখ মেলিনি।’” তারা দুজনে হেসে ওঠে, নিঃশব্দে, মৃদু—কিন্তু সেই হাসির মধ্যেই ভালোবাসার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তাদের কোনো বিশেষ দিন নেই, কোনো প্রমাণ নেই যে তারা একে অপরকে কতটা বদলে দিয়েছে, কিন্তু সেই নিঃশব্দ আলাপ, সেই অনুভবের মৃদু তরঙ্গ এখন প্রতিদিন সকালবেলা আলোর সঙ্গে জেগে ওঠে, রাতে ঘুমের পাশে এসে বসে। রূপসার নোটবুক এখন আর তাদের সঙ্গে নেই, তবু তার প্রতিটি শব্দ বেঁচে আছে তাদের অভ্যন্তরের শান্তি আর স্বীকৃতির ভিতর—যা কোনোদিনও মুছে যাবে না।

দশ

শীতের এক নিরালায় ছুটির দিনে মীনাক্ষী আলমারির পেছনের তাকে খুঁজে পায় সেই পুরোনো কাগজের খাম—চেয়ানের দেওয়া রূপসার চিঠি। কুয়াশাভেজা সকালে রোদ ঢুকছে জানালা দিয়ে, চায়ের কাপে ধোঁয়ার পাশে চিঠির কালি আজও গাঢ়। বহুদিন এই খামটা সে স্পর্শ করেনি, ভেবেছিল রেখে দেবে—অপরের স্মৃতি নিজস্ব হোক, কিন্তু আজ হঠাৎ যেন সেই শব্দগুলোর দরকার হয়ে পড়ে। সে চিঠিটা আবার পড়ে, এইবার শেষ বাক্যটা বেশি করে অনুভব করে—“তুমি যদি নিজের ভিতরে আমায় খুঁজে পাও, তবে আমি হারাইনি।” এতদিন ধরে এই বাক্য তার কাছে এক উপলব্ধি ছিল, আজ তা হয়ে ওঠে উত্তর—রূপসা সত্যিই হারাননি, কারণ মীনাক্ষীর ভেতরে তার সমস্ত বেদনার প্রতিচ্ছবি আজও জেগে আছে। মীনাক্ষী ভাবে, নোটবুকের শেষ পৃষ্ঠা আসলে কখনো শেষ হয় না, বরং তা নতুন কোনো পাঠকের যাত্রার শুরু। সে জানে, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু অপূর্ণতা থাকে, যা হয়তো বলে উঠতে পারে না—রূপসার মতোই। কিন্তু সেই অপূর্ণতার কথা যদি কেউ স্পর্শ করে যায় নিঃশব্দে, তাহলে একটা অনামা আশ্বাস জন্ম নেয়—যে কেউ তো বুঝতে পারে, এমনকি অচেনাও।

অরিত্র এসে দাঁড়ায় পেছনে, দেখে তার স্ত্রীর হাতে সেই চিঠি। জিজ্ঞেস করে না কিছু, শুধু পাশের চেয়ারে বসে বলে, “আজকাল এই শহরটাকেও বড় বেশি শান্ত লাগে, জানো?” মীনাক্ষী মুচকি হাসে, “তুমি কি সেটা ভালো নাকি খারাপ বলছো?” অরিত্র একটুখানি ভেবে বলে, “ভালোই, কারণ এই নিঃশব্দতার মধ্যে কথারা জেগে থাকে, আর শব্দহীনতার ভেতর ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়।” তারা দুজনে চুপ করে বসে থাকে, কেবল বাইরে কুয়াশা, ভিতরে আলো, আর তাদের মাঝখানে সেই নোটবুক, যা কোনো এক ভ্রমণের সময় অচেনা কারও ব্যথা দিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছিল চেনা জীবনের ভিতরকার শূন্যতাকে। মীনাক্ষী বলে, “এই চিঠিটা আমি আবার পাঠাবো, এবার অন্য কাউকে, যাকে দরকার।” অরিত্র মাথা নাড়ায়, “তুমি কি ভাবছো, আমরা আমাদের গল্পও লিখে পাঠাতে পারি?” মীনাক্ষীর চোখে জল আসে না, শুধু এক অদ্ভুত প্রশান্তি খেলে যায় মুখে, “হয়তো পারি, কারণ প্রত্যেকটা সম্পর্কই একটা ডায়েরি, কেউ পড়ে, কেউ রেখে দেয়, আর কেউ শুধু অনুভব করে।” সেই মুহূর্তে যেন তারা বুঝে যায়, রূপসার নোটবুক তাদের জীবন থেকে আলাদা কিছু নয়—এটা একটা প্রতিচ্ছবি, একটা পাথেয়, একটা সাক্ষ্য যে ভালোবাসা, যদি খাঁটি হয়, তার কোনও ভাষা লাগে না, কেবল একজনকে প্রয়োজন, যে পড়ে, আরেকজনকে, যে লেখে।

সন্ধ্যাবেলায় তারা সেই নোটবুকের অনুলিপি প্রিন্ট করে, নিজের অভিজ্ঞতার কিছু প্যারা যোগ করে আর শেষে লেখে—“এই লেখা তোমার জন্য, যদি তুমি একদিন নিজেকে প্রশ্ন করো, আর উত্তর না পাও। যদি কোনও সম্পর্ক হারিয়ে যেতে যেতে তোমার ভেতরের শান্তি নষ্ট করে দেয়—এই পৃষ্ঠাগুলো পড়ে নিও, হয়তো নিজের ভেতরে কিছু ফিরে পাবে।” তারা সেই খামটি আবার ভরে, এবার পাঠায় একটি ছোট পাবলিক লাইব্রেরিতে—যেখানে আগন্তুকেরা চুপচাপ এসে বই পড়তে বসে, হয়তো কেউ কেউ কাঁদেও, কেউ লিখে দেয় লাইব্রেরির দেওয়ালে ‘আমি বেঁচে আছি’। এবং সেই নোটবুক, যার শেষ পৃষ্ঠায় কোনও ইতি নেই, কেবল একটি লাইন থাকে—“যদি তুমি এই শব্দে নিজেকে খুঁজে পাও, তবে আমরা কেউই হারাইনি।” এইভাবেই নেপালের সেই নোটবুক হয়ে ওঠে সময়ের একটা নিঃশব্দ বর্ণনা—ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, উপলব্ধি, এবং ফিরে আসার এক সূক্ষ্ম, অথচ জীবন্ত গল্প, যা আরেকজন পাঠকের হৃদয়ে একদিন আবার শুরু হয়ে যাবে।

শেষ

1000032688.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *