অর্কদীপ চক্রবর্তী
পর্ব ১ — প্রদর্শনীর রাত
বালিগঞ্জের ‘মিত্র ভিলা’ যেন আজ আলোর এক জটিল গোলকধাঁধা। প্রাচীন করিন্থীয় স্তম্ভগুলোতে সাদা কাপড়ের পর্দা নেমে এসেছে, বাতাসে শীতাতপের সঙ্গে ফুলের গন্ধ—চামেলি, টিউব রোজ, আর একটু যেন আপাত অচেনা ধূপের ধোঁয়া। চৌহদ্দিতে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের দিকে থেকে মৃদু ট্রামের ঘণ্টা ভেসে আসে, কিন্তু বাড়ির ভিতর তা পৌঁছয় না; ভিতরের উল্লাস আর ফিসফাস শব্দ সবকিছুকে আড়াল করে দেয়। আজ প্রদর্শনীর রাত—শুভ্রাংশু মিত্র তাঁর নতুন অধিগ্রহণ, সেই বিরল নীল হীরের ‘প্রাইভেট ভিউয়িং’-এর আয়োজন করেছেন।
‘নীল শাপলা’—এই নামটায় স্থির হয়েছে বাড়ির শিল্পপরামর্শদাতা মৃণালিনী বসু। কাঁচের বক্সের মধ্যে হীরেটা রাখা—জার্মানির বুলেটপ্রুফ গ্লাস, চারদিক জুড়ে ক্ষীণ লাল লেজার-গ্রিড, নিচে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, চারটি মাইক্রো-ক্যামেরা নিরবচ্ছিন্নভাবে নজর রাখছে। বক্সের পাশের প্ল্যাকার্ডে লেখা: ‘উৎস—গোলকোন্ডা অঞ্চলের পুরোনো খনি। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে কলকাতায় আনা হয়; ইতিহাসে একাধিক মালিক-বদল। বিরল ফ্যান্সি ডীপ ব্লু ডায়মন্ড।’ ‘অভিশপ্ত’ শব্দটা সেখানে নেই, কিন্তু অতিথিদের মধ্যে কানে কানে সেটাই ছড়িয়ে পড়ছে, যেন সাদা পর্দার ভাঁজে ভাঁজে গোপন এক শিরশিরানি।
শুভ্রাংশু মঞ্চে উঠে সুললিত কণ্ঠে বললেন, “বন্ধুরা, এটা কেবল একটি রত্ন নয়; একটা ইতিহাস। ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের আঁধার, রাজপ্রাসাদের উচ্ছ্বাস, নিলামঘরের অতীত—সবকিছু মিশে আছে এর নীলের মধ্যে।” মঞ্চের নীচে বসা অতিথিরা করতালি দিলেন। প্রথম সারিতে তাঁর স্ত্রী ইশিতা, শান্ত মুখে; পাশে কলেজপড়ুয়া মেয়ে তিতলি, চোখে অনাবিল কৌতূহল। দ্বিতীয় সারিতে বসে আছে প্রেস—‘স্টেটসক্রিপ্ট’-এর তরুণ সাংবাদিক আদিত্য দে, কলমের ডগায় নোট নিচ্ছে; আর একটু দূরে এক প্রবীণ জুয়েলার প্রসেনজিৎ রায়, ঠোঁটের কোণে অসন্তুষ্টির রেখা, যেন এই নীলের উজ্জ্বলতা তাঁর চোখে কাঁটা।
বক্সের সামনে প্রথম ভিড়টা কমতেই কার্তিক মুণ্ডা এগিয়ে এল—শুভ্রাংশুর নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান। গায়ের রঙে জঙ্গলমহলের মাটি লেগে আছে, কাঁধ চওড়া, চোখে নীরব সতর্কতা। “দয়া করে হাতে কিছু লাগাবেন না,” সে এক বয়স্ক অতিথিকে সাবধান করল, যিনি কাঁচে মৃদু ঠোকাঠুকি করে নীল আলোটা আরও কাছ থেকে দেখতে চাইছিলেন। কাঁচে হাত পড়তেই একফালি ঠান্ডা কুয়াশা জমে উঠে মিলিয়ে গেল—এয়ারকন্ডিশনিংয়ের ফিসফাসে কেউ কেউ একটুও খেয়াল করল না, কিন্তু মৃণালিনী দেখলেন। তাঁর মুখে থেমে থাকা হাসিটা এক মুহূর্ত কেঁপে উঠল।
মধ্যাহ্নের পর থেকে বৃষ্টি থেমে ছিল; সাড়ে আটটার দিকে আকাশটা আবার টানটান। ছাদের স্কাইলাইটে বৃষ্টির প্রথম দানা পড়তে না পড়তেই ইলেকট্রিশিয়ান বিদ্যুৎব্যবস্থা পরীক্ষা করে নিল। “ব্যাকআপ জেনারেটর অটো-মোডে,” সে কার্তিককে বলল। “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।” কার্তিক মাথা নেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে পথবাতির আলোয় জবজবে ভেজা রাস্তা, দূরে এক কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠল—খামোখা, অথবা কোনো অদৃশ্য সঙ্কেতে। অদৃশ্য সঙ্কেতের কথা কার্তিক বিশ্বাস করে না, কিন্তু আজ যে রাতটা স্বাভাবিক নয়, তার একটা আভাস সে বারবার পাচ্ছে।
লোকজন হীরেকে ঘিরে গল্প করছে, যেন প্রত্যেকে তার নীলের ভেতরে নিজেদের গল্প দেখতে পায়। কেউ বলছে, “প্যারিসের এক শিল্পপতির বিধবা নাকি এই হীরেটা গলায় দিয়ে সাঁঝবেলা বাগানে হাঁটতেন; একদিন বেঞ্চে বসে হঠাৎ নিঃশ্বাস থেমে যায়।” কেউ বলছে, “বোম্বাইয়ের এক নায়ক—বছর দশেক আগে—লোকে বলত, ওই হীরের চোখ আছে; যে তাকায়, তাকে বেছে নেয়।” আদিত্য হাসল—পৌরাণিক কল্পনা সাংবাদিকতার নোটবুকে কিনারা পায় না। তবু এমন রাতেই হয়তো গল্প জন্ম নেয়; সে মনে মনে একটা শিরোনাম ভেবে রাখল—‘নীলের ভেতর কালো ছায়া’।
তিতলি কাঁচের খুব কাছে গিয়ে নিঃশব্দে বলল, “মা, দেখেছ? ভেতরে যেন জল বয়ে যাচ্ছে।” ইশিতা মৃদু হেসে বলল, “হীরের কাটাই—আলো ভাঙে বলে তোমার তাই লাগছে।” মেয়ে মাথা নেড়ে আরেকটু নেমে তাকাল। সে দেখল, যেন বড় যে ফেসেটটা মাঝখানে, তার প্রান্তে খুবই ক্ষীণ একটা রেখা—বলতে গেলে না-দেখারই মতো—চোখে বেঁধে যাচ্ছে। সে বলতে যাবে, ঠিক তখনই গ্লাস-চেম্বারের ওপরের দিকে বসানো এক ক্যামেরার নীল এলিইডি একবার টিমটিম করে নিভে আবার জ্বলে উঠল। সেকেন্ডখানেক। তারপর সব স্বাভাবিক।
ভেতরের দেওয়ালে পুরোনো কলকাতার নকশা ঝুলছে—ডালহৌসি স্কোয়ার, বোটানিক্যাল গার্ডেন, জোড়াসাঁকো। মৃণালিনী এক বৃদ্ধাকে ধরেছেন যিনি দাবি করলেন, হীরেটা এককালে শোভাবাজারের এক রাজবাড়ির গহনার আলমারিতে ছিল। “মহারানি শেষ দিকে খুব অসুস্থ ছিলেন,” বৃদ্ধা বললেন। “একদিন পুজোর সিঁদুর রাখার কৌটোতে মিশে গেছিল হীরের এক কণা—তিনি শাঁখা-পলা পরতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছিলেন… রক্ত থামছিল না।” মৃণালিনী সাবধানে হাসলেন—প্রদর্শনীতে কৌতূহল সুস্থ রেখে ভয় কমিয়ে রাখা তাঁর কাজ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ভাবছেন—এ সব গল্প কি কেবলই গুজব? নাকি কোথাও কোনো নথি আছে যা তিনি পড়েননি?
শুভ্রাংশুর আত্মগর্বী হাসি কক্ষটায় গা ভাসাচ্ছে। এই হীরা তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের ট্রফি—থার্ড-জেনারেশন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের মধ্যে তাঁর জায়গাটা পাকাপাকি করার এক চিহ্ন। তিনি ইশিতার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। ইশিতা অপ্রকাশিত এক দুশ্চিন্তা চেপে ধরে হাসলেন। এমন রাতগুলোতে তিনি স্বামীর খুশি দেখতে ভালোবাসেন; তবু জানালার ওপারের কালো আকাশ, বৃষ্টির ধূসর ধারা, আর ভেতরে হীরের নীল—সব মিলিয়ে ভেতরে ভেতরে যেন কোনো পাতলা সুতোর টান। তিনি লক্ষ্য করেন, হীরের চারপাশে অন্য সব কিছুর রং একটু ফিকে হয়ে যাচ্ছে—এই অনুভূতিটা সত্যি, না কি কেবল আলো-ছায়ার খেলা—বুঝতে পারেন না।
ন’টার কিছু পরেই আলো একবার খুব হালকা টলমল করল। তৎক্ষণাৎ জেনারেটর ধরল। কেউ খুব একটা লক্ষ্য করল না; কার্তিক লেজার-গ্রিডের মনিটরের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। সবুজ সংকেতগুলোর মাঝে একবার ক্ষণিকের জন্য ‘সিগন্যাল-লস’—দুই সেকেন্ড। সে নোট করে রাখল। ঠিক তখনই পাশের টেবিল থেকে হালকা ক্যাম্ফরের গন্ধ এল—কে যেন পকেট থেকে ছোট্ট ডিবে খুলেছিল, আবার ভাঁজ করে নিল। কার্তিক খুঁজে পেল না কে। ভিড়ের ভেতর প্রায় একইরকম কালো স্যুট, রেশমি শাড়ি, সূক্ষ্ম পারফিউমের গন্ধ—মুখগুলো যেন একে অন্যের প্রতিচ্ছবি।
“মি. মিত্র, আমরা কি একটু ক্লোজ-আপ পাব?” প্রসেনজিৎ রায়ের কণ্ঠে দাবি, যেন তাঁর জুয়েলারির পুরোনো কর্তৃত্ব আজকের উত্সবে নিজের জায়গা চাইছে। শুভ্রাংশু ভেবে বললেন, “একটু পরে। এখন দূরত্ব বজায় রাখাই নিয়ম।” প্রসেনজিতের ঠোঁটের কোণে হাসি নেই। “নিয়ম মানলে হীরের সৌন্দর্য বুঝতে সময় লাগে,” তিনি বললেন, “আর নিয়ম ভাঙলে—সৌন্দর্যই সময় ভাঙে।” কথাটা যে কাকে লক্ষ্য করে বলা, বোঝা গেল না। আদিত্য কলম থামিয়ে তাকাল—শব্দেরা মাঝে মাঝে নিজেদের ওজন বাড়িয়ে নেয়।
দশটার সময় প্রথম ব্যাচের অতিথিরা বিদায় নিল। দ্বিতীয় ব্যাচে এল কিছু তরুণ বিনিয়োগকারী, দু-একজন অভিনেতা, আর এক আধ্যাত্মিক গুরু—কমলা জোব্বা, গলায় রুদ্রাক্ষমালা। তিনি কাঁচের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “চোখে নীল দেখলেই মনে করো ঠাণ্ডা জল—কিন্তু গভীর নীল মানে অভুক্ত সমুদ্র। যে সমুদ্র গিলতে জানে।” কেউ হেসে উড়িয়ে দিল, কেউ যেন অস্বস্তিতে গলা খাঁকারি দিল। মৃণালিনী ভদ্রতা বজায় রেখে গুরুকে অন্য দিকে নিয়ে গেলেন; প্রদর্শনীর ভাষ্য নিরপেক্ষ না থাকলে হুজুকের বাজার গরম হয়ে যায়।
রাত এগারোটার গা ঘেঁষে অতিথিদের ভিড় পাতলা হল। ফটোগ্র্যাফাররা শেষ কয়েকটা শট নিয়ে নিল, ‘শেষ বেলায় নীল একটু গাঢ় দেখাচ্ছে’—এই মন্তব্য কানে এলো। ইশিতা ক্যাটারিংয়ে বলে দিলেন, রাতে কারি-রোল আর চায়ের থার্মোস গেটের কাছে দিয়ে দিতে—গার্ডদের জন্য। তিতলি বারান্দার লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ভেজা অন্ধকারে তাকাল; সকালের পরীক্ষার কথা মনে পড়ল। সে ভেতরে ঢোকার আগে আবার একবার হীরের দিকে তাকাল—তখনই তার মনে হল, বক্সের ভেতরে নীলের কোনো এক কোণায় আলোটা যেন শ্বাস নিচ্ছে। খুবই ধীর, খুবই অল্প—কিন্তু আছে। সে চোখ মুছে আবার তাকাল—কিছুই না, কাচের উপর নিজের মুখ ছাড়া।
কার্তিক আর একজন গার্ড ঠান্ডা মাথায় ক্লোজিং প্রটোকল পড়ছিল—রাত বারোটার আগে বক্সের চারদিকের লেজার মডিউল একবার রিবুট, তারপর বাড়ির বেসমেন্টের ভল্টে নামিয়ে দেওয়া। “সার, অ্যালার্ম কোড?” গার্ড জিজ্ঞেস করল। “ওয়ান-ফোর-টু-নাইন,” কার্তিক বলল, তারপর সঙ্গে সঙ্গে বদলে দিল, “না, থ্রি-সিক্স-ওয়ান-ফাইভ।” এমন খুঁটিনাটি বদল তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। তবু আজকের ছোট ছোট ভ্রম—‘সিগন্যাল-লস’, ক্যাম্ফরের গন্ধ, ক্যামেরার এলিইডি টিমটিম—সবকিছু তার মস্তিষ্কে ছোট ছোট মাকড়সার মতো জাল বুনছে।
শুভ্রাংশু শেষ অতিথিকে বিদায় দিয়ে গেট বন্ধ হওয়ার শব্দটাকে যেন সইতে পারলেন না। তিনি ফিরে এসে কাঁচের বক্সের দিকে তাকালেন। ঘড়িতে ১১:৪৮। “মৃণাল, ভল্টে নামিয়ে দিন,” তিনি বললেন। মৃণালিনী মাথা নেড়ে কার্তিককে ইশারা করলেন। কার্তিক কন্ট্রোল প্যানেলে হাত বাড়াতেই হঠাৎ একটা শব্দ—খুব ক্ষীণ, যেন দূরের ঘরের কোনো কাঠের আলমারির মধ্যে কে আঙুল বোলাল—টিক্। সঙ্গে সঙ্গে আলো আরেকবার খুব হালকা টলে গেল। জেনারেটর ধরল। লেজার-গ্রিডের এক দন্ড আলো এদিক-ওদিক হয়ে আবার সোজা, অ্যালার্ম বাজল না। কার্তিক স্ক্রিনে চোখ গেঁথে রাখল। ঠিক ওই সময়, বৃষ্টির এক ধার হঠাৎ স্কাইলাইটে পাতার মতো ছুড়ে এল—টুপটাপ শব্দে ঘরটা মুহূর্তের জন্য এক ধরনের ঠান্ডা গুমোটে ঢেকে গেল।
ইশিতা খেয়াল করলেন—কাঁচের উপর কার যেন নখ দিয়ে হালকা আঁচড়। তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, আঁচড় নয়—একটা রেখা, প্রায় অদৃশ্য, বক্সের ভিতরের দিকের কাচে। “কার্তিক?” তাঁর গলার সুর বদলে গেল। কার্তিক এগিয়ে এসে টর্চ জ্বেলে কাচের পৃষ্ঠ পরীক্ষা করল। বাইরের কাচ নির্দোষ, ভিতরের কাচে আঁচড়ের মতো লম্বা দাগ—কিন্তু সেটা কি সত্যি আঁচড়, না কি কেবল আলো-ছায়ার অপটিক্যাল ইলিউশন—তার সিদ্ধান্তে আসার আগেই ঘরের প্রাচীন পেন্ডুলাম ক্লক বারোটার প্রথম ঘন্টা বাজিয়ে উঠল—ডং।
সেই ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যর ফোনে একটা নোটিফিকেশন আসল—‘নেটওয়ার্ক রিস্টোরড’। রয়েছে মানে কিছুক্ষণ নেটওয়ার্ক ছিল না—সে খেয়ালই করেনি। বাইরে হঠাৎ বজ্রপাত, জানালার কাঁচে সাদা রেখা। ঘরের মধ্যে সবাই এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল নীলের দিকে। হীরেটা নিশ্চুপ, নির্মম, উত্তরের বরফের এক টুকরোর মতো; কিন্তু ইশিতার মনে হচ্ছিল, বরফও তো কখনও কখনও ভিতর থেকে শব্দ করে—চাপের নিচে।
ডং… ডং… পেন্ডুলাম ঘড়ি বারোটার শেষ ধ্বনি শেষ করল। কার্তিক ধীরে ধীরে কন্ট্রোল প্যানেলের কভার বন্ধ করল। “ভল্টে নামাচ্ছি,” সে বলল, নিজের গলায় শব্দ শুনে মনে হল সেটা তাঁর না। কাচের ওপর যে দাগটা ছিল, ততক্ষণে আলো বদলেছে; দাগ দেখা যাচ্ছে না। ইশিতা নির্বাক। তিতলি দূরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে; তার মনে হল, বৃষ্টি আজ যেন একটু নীল। মৃণালিনী নথিপত্র গুছিয়ে টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে দিলেন। ঘরে কেবল বক্সের নিচের সরু নীল-সাদা আলো জ্বলছে।
ভেতরের কোথাও যেন খুব আস্তে একটা টিক্—আরেকবার। তারপর সব নিস্তব্ধ। বাইরে ক্যানোপির ওপর বৃষ্টির ছন্দ, ভেতরে লেজার-গ্রিডের সোজা লাল রেখা, কাচের ভিতরে পাহারায় বসে থাকা নীল। আর উপরে স্কাইলাইটে জমে থাকা জল বেয়ে নামছে রেখার মতো—যেন কাঁচে কেউ নখ বুলিয়ে লিখতে চেয়েছিল একটি শব্দ, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেছে।
রাতটা প্রদর্শনীর জন্য ছিল। তবু, বারোটার পরে যে রাত শুরু হল, সেটা অন্য কোনো কিছুর। এবং সেটার নাম কেউ মুখে উচ্চারণ করেনি—এখনও।
পর্ব ২ — হীরের অন্তর্ধান
সকালটা যেন অদ্ভুত অস্থিরতায় ভরা। বালিগঞ্জের ‘মিত্র ভিলা’র লোহার গেটে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন প্রতিবেশী, কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে ভিতরের দিকে। গত রাতের প্রদর্শনীতে কারও আমন্ত্রণ ছিল না, অথচ আজ সকালবেলা ভিলার চারপাশে খবর ছড়িয়ে পড়েছে—“হীরেটা নেই!”
ভেতরে ঘরে ঘরে টানটান উত্তেজনা। বারান্দার কার্পেটে রাতের বৃষ্টির আর্দ্রতা এখনও ভিজে আছে। হীরের জন্য বানানো বিশেষ কাচের বাক্সটা খালি—কোনো চিহ্ন নেই, কেবল ভেতরে হালকা আঁচড়ের মতো দাগ, যা রাতেই দেখা গিয়েছিল। চারপাশের লেজার গ্রিড অক্ষত, অ্যালার্ম সিস্টেমের রেকর্ড অনুযায়ী কোনো সিগন্যাল লস হয়নি। অথচ, নীল শাপলা উধাও।
শুভ্রাংশু মিত্র চিৎকার করে উঠলেন, “এটা অসম্ভব! পুরো সিকিউরিটি সিস্টেম চালু ছিল, কী করে হীরেটা উধাও হবে?” তাঁর কণ্ঠে রাগের চেয়ে ভয়ের সুরই বেশি। ইশিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে, চোখে অসহায় আতঙ্ক। তিতলি বারান্দায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যা ঘটছে।
কার্তিক, নিরাপত্তা প্রধান, মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে। “স্যার, রাত বারোটার পর ভল্টে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সব সিস্টেম ঠিকঠাকই কাজ করছিল। কিন্তু…” বাক্যটা শেষ করতে পারল না।
ঠিক তখনই ভিলার ফটকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন বাজল। দু’জন অফিসার ভেতরে ঢুকলেন। সামনে সুব্রত মুখার্জি—লালচে চোখ, কড়া গলায় নির্দেশ দিতে অভ্যস্ত, কলকাতা পুলিশের অভিজ্ঞ অফিসার। তিনি এক ঝলক কাচের খালি বাক্সটা দেখে ঠোঁটে অর্ধেক হাসি টানলেন।
“সবাই একই গল্প বলে, কিন্তু হীরা থাকে না,” তিনি ফিসফিস করে বললেন, তারপর উচ্চকণ্ঠে, “মিস্টার মিত্র, দয়া করে সবাইকে ড্রয়িংরুমে ডাকুন। এখন থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবেন না।”
এক এক করে সবাই জড়ো হল—শুভ্রাংশু, ইশিতা, তিতলি, মৃণালিনী বসু, প্রসেনজিৎ রায়, সাংবাদিক আদিত্য দে, আর কয়েকজন অতিথি যারা রাত অবধি থেকে গিয়েছিলেন। সুব্রত প্রথমেই ঘোষণা করলেন, “প্রত্যেকের বয়ান রেকর্ড করা হবে। এবং মনে রাখবেন, মিথ্যা বললে আপনাদেরই ক্ষতি।”
প্রথম বয়ান—শুভ্রাংশু মিত্র।
তিনি বললেন, “রাত বারোটার দিকে আমি নিজে হীরেটা ভল্টে নামানোর ব্যবস্থা করছিলাম। তখনও সেটা বক্সে ছিল। এরপর আর কিছু মনে নেই।”
সুব্রত ভ্রূকুটি করে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে? আপনি কি সেখান থেকে সরে গিয়েছিলেন?”
শুভ্রাংশু অস্বস্তিতে গলা খাঁকারি দিলেন। “হ্যাঁ, হঠাৎ ফোনে একটা কল এল ব্যবসার কাজে। কয়েক মিনিট বাইরে ছিলাম। ফেরার পর দেখি, সব কিছু ঠিকঠাক।”
দ্বিতীয় বয়ান—ইশিতা।
তিনি শান্ত গলায় বললেন, “আমি শুধু জানি, বারোটার সময় বক্সে একটা দাগ দেখেছিলাম। সেটা হীরের ভেতরের আলোর প্রতিফলন নাকি আসল আঁচড়, বোঝা যায়নি। এরপর… আমি আর কিছু খেয়াল করিনি।”
তৃতীয় বয়ান—তিতলি।
কিশোরী মেয়ে দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, “আমি জানি না… কিন্তু মনে হয়েছিল, হীরেটা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আলোটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল।” তার কথা শুনে অনেকেই হেসে উঠল, কিন্তু সুব্রত একেবারেই হাসলেন না। শুধু নোটবুকে লিখে নিলেন।
চতুর্থ বয়ান—মৃণালিনী বসু।
তিনি বললেন, “আমি অনেক গল্প শুনেছি এ হীরেকে নিয়ে। কিন্তু গত রাতের ভিড়ে, বিশেষ কিছু খেয়াল করিনি। শুধু এটুকু বলতে পারি, অতিথিদের মধ্যে কেউ অস্বাভাবিক আচরণ করছিল। বিশেষ করে সেই কমলা জোব্বা পরা আধ্যাত্মিক গুরুর কথা বলছি।”
পঞ্চম বয়ান—প্রসেনজিৎ রায়।
বয়স্ক জুয়েলার ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ। “আমি বারবার বলেছিলাম, হীরের গায়ে ঘেঁষে না দেখলে তার প্রকৃত সৌন্দর্য বোঝা যায় না। কিন্তু কেউ কথা শুনল না। এখন হীরাই যদি না থাকে, তো কে দোষী? নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ব্যর্থ।” তার চোখে বিদ্বেষ, যেন কারও ওপর দায় চাপাতে চাইছে।
ষষ্ঠ বয়ান—আদিত্য দে।
তরুণ সাংবাদিক বলল, “আমি পুরো রাত নোট নিচ্ছিলাম। শেষবার যখন হীরেকে দেখেছি, সেটা ঠিক বারোটার আগে। তারপর লাইট টলমল করেছিল, নেটওয়ার্ক কেটে গিয়েছিল। আমার মনে হয়, সেই সময়ই কিছু ঘটেছে।”
সবাই নিজের মতো করে কথা বলল, কিন্তু প্রত্যেক বয়ানের মধ্যে অসঙ্গতি রয়ে গেল। কেউ বলল বারোটার পরও হীরেটা ছিল, কেউ বলল তখনই নেই। কারও মতে দাগ কেবল আলো-ছায়ার খেলা, কারও মতে আসল আঁচড়।
সুব্রত টেবিলে হাত চাপড়ে বললেন, “তাহলে ব্যাপারটা পরিষ্কার—এখানে উপস্থিত প্রত্যেকেই সন্দেহভাজন।”
তারপর গম্ভীর গলায় যোগ করলেন, “কিন্তু মনে রাখবেন—এটা শুধু চুরির মামলা নয়। আমি আশঙ্কা করছি, এর সঙ্গে অস্বাভাবিক কিছু জড়িত আছে।”
কার্তিক এতক্ষণে গম্ভীর মুখে রিপোর্ট দিল, “স্যার, সিসিটিভির ফিডে কিছু নেই। রেকর্ডিং ঠিক বারোটার সময় আটকে গিয়েছিল, তিন মিনিটের জন্য।”
“তিন মিনিট?” সুব্রত কপাল কুঁচকে তাকালেন।
কার্তিক মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার। তিন মিনিট, যার মধ্যে হীরেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।”
ড্রয়িংরুমে যেন হিমেল বাতাস বয়ে গেল। সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল। তিন মিনিট। সেই তিন মিনিটে ঠিক কী ঘটেছিল?
শুভ্রাংশু ঠোঁট কামড়ে বললেন, “আমি সব দিক থেকে সিকিউরিটি এনেছিলাম। এটা মানুষিকভাবে সম্ভব নয়।”
সুব্রত ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, “মানুষিকভাবে না হলে—অভিশাপে?”
কথাটা শুনে চারপাশের নিস্তব্ধতা আরও ভারী হয়ে গেল। যেন কেউ শ্বাস নিচ্ছে না। হীরার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া কেবল চুরি নয়—এ যেন অভিশাপের অশুভ ছায়া, যা সবার চারপাশে নেমে এসেছে।
পর্ব ৩ — গোয়েন্দার প্রবেশ
কলকাতা পুলিশের লালবাজার সদর দফতরে খবর পৌঁছতে সময় লাগেনি। সংবাদমাধ্যমে প্রথম পাতায় বেরোনোর আগেই, শহরের অলিগলি ধরে ছড়িয়ে পড়ল গুজব—“মিত্র ভিলা থেকে হীরা উধাও!” কেউ বলছে, ‘নীল শাপলা অভিশপ্ত’, কেউ বলছে, ‘এটা ইনসাইড জব’। কিন্তু পুলিশের অভ্যন্তরে সবাই জানত, এমন জটিল মামলায় এক বিশেষ মানুষকেই ডাকা ছাড়া উপায় নেই—অর্ণব রায়।
অর্ণব রায়—পেশায় স্বাধীনচেতা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। বয়স চল্লিশের কোঠায়, লম্বা-চওড়া নয়, বরং ক্ষীণকায়, তবে চোখে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা। একসময় ফরেনসিক সায়েন্সে পড়াশোনা করেছিলেন, পরে সরকারি চাকরি ছাড়েন নিজের নিয়মে কাজ করার জন্য। তিনি শহরের অপরাধ জগতের কাছে সমান ভয়ের ও শ্রদ্ধার নাম।
সকালের দিকে যখন পুলিশি জেরা শেষ হয়েছে, তখনই সুব্রত মুখার্জি ফিসফিস করে বললেন, “আমাদের বাইরে থেকেও কারও দরকার। এই কেস সাধারণ নয়।” তার কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল ভিলার ফটকে। নামলেন অর্ণব—সাদা শার্ট, কালি লেগে থাকা নীল ব্লেজার, হাতে পুরোনো লেদারের ফাইল। কোনো অভিবাদন নয়, সোজা ভিতরে চলে এলেন।
“অর্ণবদা, এত দ্রুত এলেন?” সুব্রত অভ্যর্থনা করলেন।
“হীরের ডাক এলে কে দেরি করে?” অর্ণব মৃদু হেসে বললেন। তারপর চোখ বোলালেন খালি বাক্সটার ওপর। তিন মিনিট—এই তিন মিনিটের ফাঁকটাতেই সব রহস্য লুকোনো।
অর্ণব প্রথমেই চারপাশের দেয়াল, ক্যামেরার পজিশন আর লেজার গ্রিড খুঁটিয়ে দেখলেন। হঠাৎ মেঝের এক কোণে ঝুঁকে পড়লেন। সেখানকার গালিচার ওপর ছোট্ট একটা ভিজে দাগ—খুব সূক্ষ্ম, চোখ এড়িয়ে যেত। তিনি আঙুল ছুঁয়ে নাকের কাছে নিলেন—“বৃষ্টির জল। কিন্তু বাইরে থেকে এভাবে ভেতরে আসার কথা নয়।”
শুভ্রাংশু চটপট বললেন, “সম্ভব নয়! পুরো বাড়ি সিল করা ছিল।”
অর্ণব চুপ করে তাঁকে একবার তাকালেন। “অসম্ভব কথাটা তদন্তে বলবেন না, মিস্টার মিত্র। হীরের ইতিহাসই বলে—যা অসম্ভব, তাই ঘটে।”
এরপর তিনি আলাদা করে সবাইকে একপাশে ডাকলেন। প্রথমে ইশিতা। অর্ণব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি বলেছিলেন দাগ দেখেছিলেন কাচের ভেতরে। সেটা কেমন?”
ইশিতা দ্বিধা করে বললেন, “আঁচড়ের মতো ছিল। কিন্তু আলো পাল্টালে মিলিয়ে যাচ্ছিল।”
অর্ণব মাথা নেড়ে বললেন, “আলো পাল্টালে মিলিয়ে যাওয়া জিনিস সত্যি থেকেও মিথ্যা হতে পারে। আবার মিথ্যা থেকেও সত্যি।”
তিতলিকে ডাকলেন পরেরবার। কিশোরীর চোখে এখনও ভয়। অর্ণব জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি বলেছিলে হীরা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। সেটা কেমন লাগছিল?”
তিতলি ফিসফিস করে বলল, “একটা আলো ফুসফুসের মতো ফুলে-সঙ্কুচিত হচ্ছিল। হয়তো আমার চোখের ভুল।”
অর্ণব চোখ সরু করলেন। “কখনও কখনও শিশুর চোখেই সত্যি প্রথম ধরা পড়ে। চোখের ভুল বলে উড়িয়ে দিও না।”
প্রসেনজিৎ রায়কে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার আপত্তি কেন এত?”
প্রসেনজিৎ গম্ভীর সুরে বললেন, “আমি পেশাদার জুয়েলার। আমি জানি, হীরের গায়ে এমন দাগ যদি থাকে তবে সেটা আসল নয়। হয়তো ভুয়ো। কিংবা বদলানো হয়েছে।”
অর্ণব ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি টানলেন। “বদলানো—এই শব্দটাই তো আসল সূত্র হতে পারে।”
আদিত্য দে-র দিকে ঘুরলেন। “তুমি বলছ নেটওয়ার্ক কেটে গিয়েছিল। ঠিক কত মিনিট?”
আদিত্য বলল, “প্রায় তিন মিনিট। ফোনে আবার সিগন্যাল আসার নোটিফিকেশন পেয়েছিলাম।”
অর্ণব মাথা নেড়ে লিখে রাখলেন, “চুরি যদি হয়েও থাকে, সেটা ওই তিন মিনিটেই।”
তারপর হঠাৎ করেই ঘরের মধ্যে এক শীতল নীরবতা নেমে এলো। আধ্যাত্মিক গুরু যিনি আগের রাতে অতিথি ছিলেন, তিনি সকালে উপস্থিত নেই। তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
অর্ণব তাকিয়ে বললেন, “যে প্রথমে অভিশাপের কথা বলেছিল, তার হদিশ নেই। কাকতালীয় ভাববেন না। কাকতালীয় শব্দটা খুব অলসদের জন্য।”
ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সবাই কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে গেল। অর্ণব একবার খালি বাক্সটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নীল আলো নেই, কিন্তু তিনি চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করলেন—
“যার মালিকানা নেই, সে-ই হীরেকে ধরে রাখতে চেয়েছিল। আর হীরা কাউকেই রাখে না।”
সুব্রত এগিয়ে এসে বললেন, “তাহলে আপনার মতে… এটা সাধারণ চুরি নয়?”
অর্ণব ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, “না, সুব্রতবাবু। এটা অভিশাপ আর মানুষের লোভের মিশ্র খেলা। আর আমি বিশ্বাস করি, এর মধ্যে একজন এখানেই বসে আছে—যে জানে সত্যিটা।”
সবাই স্তব্ধ হয়ে রইল। বাইরে আকাশে মেঘ জমছে, আবার বৃষ্টি নামার আগে ঠিক যেমন চাপা অন্ধকার নামে, তেমন এক অদ্ভুত ভার ভিলার মধ্যে নেমে এল।
পর্ব ৪ — প্রথম ছায়া
অর্ণব রায় মিত্র ভিলার বিশাল লাইব্রেরির এক কোণে বসে আছেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর, তবু বাড়ির বাতাসে যেন অস্বস্তির ধোঁয়া ভাসছে। বাইরে বৃষ্টির দমক থেমে আবার শুরু হয়, জানালার কাচে টুপটাপ শব্দ। তাঁর সামনে ছড়ানো পুরোনো নথি, পুরু বই, কিছু কেটে রাখা পত্রিকা। মৃণালিনী বসু সব ডকুমেন্টস এনে দিয়েছেন—নীল হীরের অতীতের খোঁজে।
অর্ণব চোখ সরু করে পড়তে শুরু করলেন। প্রথমেই চোখে পড়ল একখানা সংবাদপত্র, তারিখ ১৯০৭। শিরোনাম: “গোলকোন্ডার নীল হীরায় মৃত্যু রহস্য”। তৎকালীন এক ইংরেজ ব্যবসায়ী, এডওয়ার্ড স্যাভিল, কলকাতায় এই হীরেটি এনেছিলেন। তিনিই প্রথম এটাকে লন্ডনের নিলামে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিলামের আগের দিন হঠাৎ নিজের বাড়িতে আগুন ধরে গিয়ে তিনি মারা যান। পরে তদন্তে আগুনের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু তাঁর গলায় হীরের নীল প্রতিফলনের মতো এক অদ্ভুত পোড়া দাগ পাওয়া গিয়েছিল।
এরপর অর্ণব আরেকটি নথি উল্টোলেন। ১৯৩৪ সালের ঘটনা—ফরাসি এক শিল্পপতির বিধবা, মাদাম লুসিল দ্যুভাল। তিনি নাকি গলায় হীরেটি পরে প্রায় প্রতিদিন বাগানে হাঁটতেন। এক বিকেলে হঠাৎ তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, মুখে আতঙ্কের ছাপ, অথচ শরীরে কোনো আঘাত নেই। মেডিক্যাল রিপোর্টে লেখা—“হার্ট ফেইলিউর।” কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিল, তাঁর কানে শোনা গিয়েছিল এক অদ্ভুত গুঞ্জন, যেন কারও ফিসফিসানি।
১৯৭২ সালে হীরেটি বোম্বাইয়ের এক চলচ্চিত্র নায়কের হাতে আসে—অরুণ কুমার। নামজাদা অভিনেতা, যিনি আভিজাত্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি এক গালা নাইটে হীরেটি গলায় পরে উপস্থিত হয়েছিলেন। ঠিক দু’দিন পর নিজের অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু। পুলিশের রিপোর্টে লেখা—“অ্যাকসিডেন্ট।” কিন্তু সাংবাদিকদের মধ্যে গুঞ্জন—তিনি আত্মহত্যা করেননি, বরং যেন অদৃশ্য কারও ধাক্কা।
অর্ণব ফাইল বন্ধ করলেন। ঘর অন্ধকার হয়ে এসেছে, জানালার কাচে ধূসর ছায়া। মৃণালিনী ফিসফিস করে বললেন, “আপনি নিজেই দেখছেন, অর্ণববাবু। এই হীরার ইতিহাস কেবল মৃত্যুই বলে।”
অর্ণব শান্ত স্বরে জবাব দিলেন, “ইতিহাসে অভিশাপের গল্প বেশি লেখা থাকে, কারণ মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। কিন্তু প্রতিটি মৃত্যুর পিছনে মানবিক কারণ থাকে। আগুন, হার্ট অ্যাটাক, পড়ে যাওয়া—সবকিছুরই ব্যাখ্যা আছে। তবে…” তিনি থামলেন। “এই তিনটি ঘটনায় একটা মিল আছে—প্রত্যেকেই মৃত্যুর আগে কারও কাছে বলেছিলেন, তাঁরা অদ্ভুত শব্দ শুনছেন।”
ঠিক তখনই কার্তিক ঘরে ঢুকল। মুখে ঘাম আর অস্বস্তি। “স্যার,” সে বলল, “আমাদের এক গার্ডকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাত বারোটার পরে যে ডিউটিতে ছিল, সে ভোরে গেট খোলার পর আর দেখা যায়নি।”
অর্ণব ভুরু কুঁচকে তাকালেন। “গার্ড নেই? তার নাম কী?”
“সঞ্জয়। নতুন এসেছে, মাসখানেক হলো।”
অর্ণব চুপ করে গেলেন। হারানো গার্ড, অদৃশ্য হওয়া হীরা, আর ইতিহাসের অস্বাভাবিক মৃত্যু—সব এক অদ্ভুত সুতোর মতো জোড়া লাগছে।
তখনই সাংবাদিক আদিত্য ড্রয়িংরুম থেকে চেঁচিয়ে ডাক দিল, “মিস্টার রায়! তাড়াতাড়ি আসুন!”
অর্ণব উঠে দৌড়ে গেলেন। গেটের কাছে ভিড় জমেছে। মেঝেতে পড়ে আছে একটা রুদ্রাক্ষমালা—সেই গুরুর, যিনি আগের রাতে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, মালার ভেতরে আটকে আছে একটুখানি কাচের টুকরো—যেন সেই বক্স থেকে খসে পড়েছে। কাচটাতে হালকা নীল প্রতিফলন ছড়িয়ে আছে।
অর্ণব সেটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, “প্রথম ছায়াটা দেখা দিল।”
সবার শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
পর্ব ৫ — অদ্ভুত মৃত্যু
বৃষ্টি থেমে গেছে, আকাশে কেবল মেঘের স্তূপ। মিত্র ভিলার বাইরের বাতাসে কেমন অস্বস্তি, যেন অজানা কিছু ঘটতে চলেছে। ভিতরে টানটান উত্তেজনা। অর্ণব কাচের টুকরোটা টেবিলে রেখে বললেন, “যতই প্রযুক্তি থাক, এ কেসে মানবিক দুর্বলতা আর অস্বাভাবিক ছায়া—দুটোই কাজ করছে।”
হঠাৎ করেই ভেতরের ঘর থেকে চিৎকার ভেসে এল। সবাই ছুটে গেল অতিথিকক্ষে। মেঝেতে পড়ে আছেন প্রসেনজিৎ রায়—সেই বয়স্ক জুয়েলার। চোখ খোলা, মুখ বিকৃত, ঠোঁট ফ্যাকাশে। তাঁর হাত শক্ত করে চেপে ধরা, আঙুলের ফাঁক দিয়ে লালচে রক্ত গড়িয়ে আসছে।
ইশিতা কেঁপে উঠলেন, “ওঁর কী হলো?”
অর্ণব মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে দ্রুত পরীক্ষা করলেন। প্রসেনজিতের চোখ স্থির হয়ে গেছে, শরীর ঠান্ডা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কোথাও বড় কোনো আঘাত নেই। শুধু ডান হাতের তালুর মাঝখানে সূক্ষ্ম এক কাটা দাগ—যেন কাচ বা হীরের ধারালো প্রান্ত ছুঁয়ে গেছে।
কার্তিক গম্ভীর গলায় বলল, “স্যার, এটা তো সেফ রুম। এখানে বাইরের কেউ ঢুকতেই পারে না।”
অর্ণব ধীরে ধীরে জবাব দিলেন, “প্রসেনজিৎবাবু নিজেই যেটা হাতে নিয়েছিলেন, সেটা হয়তো তাঁর মৃত্যুর কারণ।”
ড্রয়ার খুঁজে দেখা গেল, তাঁর পকেটে একটা ছোট লুপ—জুয়েলারদের কাঁচ। তার ভেতরে আটকে আছে ক্ষুদ্র নীলচে গুঁড়ো, যেন কোনো রত্ন থেকে খসে এসেছে। অর্ণব সেটাকে সাবধানে টিস্যুতে জড়িয়ে রাখলেন।
“হীরেটা অভিশপ্ত,” মৃণালিনী ফিসফিস করে বললেন।
অর্ণব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন। “না, এটা অভিশাপ নয়। এটা একটা প্যাটার্ন। কেউ জানে, কীভাবে হীরেকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করা যায়।”
সুব্রত পুলিশ অফিসার ফোনে এম্বুলেন্স ডাকলেন, কিন্তু তাঁর মুখেও আতঙ্ক। “এক রাতেই দুটো ঘটনা—চুরি আর মৃত্যু। প্রেসে গেলে আমরা রক্ষা পাব না।”
অর্ণব শান্তভাবে বললেন, “প্রেসে যাবেই। আর সেটাই দরকার। খুনি চাইবে না খবর বাইরে যাক। ও যদি ভাবে আমরা চাপা দেব, তবে ও নিরাপদ মনে করবে। কিন্তু প্রকাশ্যে এলে, ওর পদক্ষেপে তাড়াহুড়ো আসবে।”
তিতলি কাঁপা গলায় বলল, “কিন্তু প্রসেনজিৎ কাকু তো শুধু সন্দেহ করেছিলেন হীরেটা আসল কি না… তার মানে, যিনি সত্যিটা লুকোতে চাইছেন, তিনি-ই খুনি?”
অর্ণব মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা নেড়ে বললেন, “কখনও কখনও শিশুর যুক্তিই সবচেয়ে সহজ আর সঠিক।”
হঠাৎ বাইরে বজ্রপাত হল। জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল। সেই আলোয় অর্ণব দেখলেন—ড্রয়িংরুমের কোণে রাখা বড় আকারের আয়নায় হালকা কুয়াশা জমেছে, অথচ ঘরে কেউ শ্বাস ফেলছিল না। তিনি এগিয়ে গিয়ে হাত বোলালেন। আয়নাটা ঠান্ডা, একেবারে বরফের মতো। যেন অদৃশ্য কেউ ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে।
তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “প্রথম মৃত্যু ঘটল। এটা শেষ নয়। হীরেটা যাঁর কাছে আছে, সে জানে, এই মৃত্যু কেবল শুরু।”
পর্ব ৬ — সাক্ষীদের দ্বন্দ্ব
মিত্র ভিলার ড্রয়িংরুমে সবাই একত্রিত হয়েছে। প্রসেনজিৎ রায়ের মৃতদেহ এম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার ছায়া এখনও যেন ঘরটায় ভাসছে। প্রত্যেকের মুখে ভয়ের ছাপ, কিন্তু তার সঙ্গে মিশেছে অস্বস্তি আর গোপন আতঙ্ক—কেউ যেন কিছু লুকোচ্ছে।
অর্ণব চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। চোখের দৃষ্টিটা ধারাল। “এখন থেকে প্রত্যেকেই আবার নিজের বয়ান দেবেন। রাত বারোটার পরে কে কোথায় ছিলেন, ঠিক কী দেখেছেন—সব। মনে রাখবেন, যে মিথ্যে বলবেন, তাঁর মুখেই ফাঁস বেরোবে।”
প্রথমে এলেন মৃণালিনী বসু।
তিনি শান্ত গলায় বললেন, “আমি তো লাইব্রেরিতে ছিলাম নথিপত্র গুছোতে। আমার কোনো কারণ নেই এই ঘটনায় জড়ানোর।”
অর্ণব হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে আপনি কীভাবে জানলেন, হীরেটার ইতিহাসে মৃত্যুর ঘটনা আছে? আপনার কাছে যে রেকর্ডগুলো এসেছে, সেগুলো সব নকল।”
মৃণালিনী কেঁপে উঠলেন। “মানে?”
“মানে, কেউ ইচ্ছে করে আপনার হাতে ভুয়ো ইতিহাস তুলে দিয়েছে। যাতে আপনি সবাইকে অভিশাপের ভয় দেখাতে পারেন।”
এরপর এলেন ইশিতা মিত্র।
তিনি বললেন, “আমি শুধু দাগ দেখেছিলাম কাচে। এর বেশি কিছু জানি না।”
অর্ণব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু সেই দাগটা অন্য কেউ দেখেননি কেন? আপনি কি তখন একা ছিলেন?”
ইশিতা গলা নামিয়ে বললেন, “হ্যাঁ… একা ছিলাম।” তাঁর চোখে এক মুহূর্তের জন্য আতঙ্ক ঝলক দিল।
তিতলি এবার সামনে এল। সে দৃঢ়ভাবে বলল, “আমি মিথ্যে বলিনি। আমি সত্যিই দেখেছিলাম হীরেটা আলো টানছিল।”
অর্ণব তার দিকে তাকালেন। “তুমি একমাত্র, যে ভয়ের বদলে খোলাখুলি সত্যি বলছো। কিন্তু এই সত্যিটা প্রমাণ করা কঠিন।”
এরপর এল আদিত্য দে।
সে বলল, “আমি তো সাংবাদিক। আমি যা দেখেছি, তাই লিখেছি। নেটওয়ার্ক তিন মিনিট বন্ধ ছিল।”
অর্ণব তার চোখে চোখ রেখে বললেন, “তুমি কি নিশ্চিত এটা কেবল নেটওয়ার্ক লস? নাকি কেউ ইচ্ছে করে জ্যামার ব্যবহার করেছিল?”
আদিত্য চমকে গেল। “জ্যামার? আমি তো সে বিষয়ে কিছু জানি না।”
সবশেষে ডাক পড়ল কার্তিকের।
গম্ভীর, শক্ত গলায় সে বলল, “আমি তো দায়িত্বে ছিলাম। আমি কিছুতেই হীরেকে হাত দিইনি।”
অর্ণব ধীরে ধীরে বললেন, “তোমার রিপোর্টে লেখা, সিসিটিভি তিন মিনিট বন্ধ ছিল। অথচ সিস্টেমে কোনো টেম্পারিংয়ের চিহ্ন নেই। তাহলে কীভাবে রেকর্ডিং বন্ধ হলো?”
কার্তিক ঘামতে শুরু করল। “হয়তো… কোনো ত্রুটি।”
অর্ণব তার চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করলেন, “ত্রুটি হয় না। করানো হয়।”
ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। প্রতিটি মুখে দ্বন্দ্ব আর অস্বস্তি। কে মিথ্যে বলছে, কে সত্যি বলছে—তা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার—এখানে উপস্থিত প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে গোপন কিছু জানে।
ঠিক তখনই বাইরে থেকে এক সশব্দ চিৎকার ভেসে এল—গেটের পাহারাদার দৌড়ে এসে জানাল, “স্যার, বাইরে বাগানের কুয়োর পাশে অদ্ভুত কিছু পাওয়া গেছে!”
অর্ণব উঠে দাঁড়ালেন। “চলুন সবাই।”
বাগানের কুয়োর কাছে ভেজা মাটিতে পড়ে আছে এক জোড়া জুতো—সঞ্জয়, সেই নিখোঁজ গার্ডের। আর কুয়োর ভিতর থেকে আসছে এক অদ্ভুত গন্ধ—লোহা আর শ্যাওলার মিশ্রণ, কিন্তু তার সঙ্গে যেন মেশানো রক্তের ধাতব আভাস।
অর্ণব কুয়োর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “যতই দ্বন্দ্ব লুকোন, সত্যিটা বেরিয়েই আসবে। হীরের ছায়া একে একে সবার ওপর পড়ছে।”
পর্ব ৭ — গোপন দলিল
কুয়োর ধারে ভিড় জমেছে। সঞ্জয়ের জুতো দুটো ভিজে কাদায় ডুবে আছে। কার্তিক ভ্রূকুটি করে বলল, “ও পালিয়ে গেছে, স্যার। পালানোর সময়েই জুতো খুলে ফেলেছে।”
অর্ণব নীরবে মাটির দাগ পরীক্ষা করছিলেন। তিনি আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন—জুতোগুলো হঠাৎ খুলে রাখা হয়নি, টেনে নামানো হয়েছে। যেন কাউকে টেনে কুয়োর ধার ঘেঁষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
“পালানো নয়,” তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, “ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
সবার শরীর কেঁপে উঠল।
এরপর অর্ণব আবার লাইব্রেরিতে ফিরে এলেন। ভিলার পুরোনো নথিপত্রের বাক্স এক এক করে খুলে দেখছিলেন। ধুলো জমা নীল ফাইলের ভেতরে হঠাৎ তিনি খুঁজে পেলেন একটি চিঠি—হলদে কাগজ, কালি ফিকে হয়ে এসেছে। খামের ওপর লেখা, “গোলকোন্ডা আর্কাইভস, ১৮৯৯”।
চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন—
“এই হীরা কেবল রত্ন নয়, এটি এক অসমাপ্ত যজ্ঞের অঙ্গ। দক্ষিণ ভারতের এক তান্ত্রিক তার জীবনের বিনিময়ে এক প্রাচীন যজ্ঞের মধ্যে হীরেটিকে বেঁধে রেখেছিলেন। যজ্ঞ অসমাপ্ত রয়ে যায়। ফলে হীরেটি যার হাতেই যায়, তার প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে শুষে নেয়। মুক্তি একটাই—যজ্ঞের সমাপ্তি।”
অর্ণব চোখ সরু করলেন। “অসমাপ্ত যজ্ঞ… মানে এ কেবল অভিশাপের গল্প নয়। এর পেছনে প্রাচীন এক আচার লুকিয়ে আছে।”
ঠিক তখনই মৃণালিনী ঘরে ঢুকলেন। তাঁর চোখে আতঙ্ক। “অর্ণববাবু, আমি এই নথি কখনও দেখিনি। কে জানে, এতদিন কোথায় ছিল।”
অর্ণব চিঠিটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “যে এটাকে লুকিয়ে রেখেছিল, সে জানত হীরেটার রহস্য ফাঁস হলে তার লাভ শেষ হয়ে যাবে।”
বাইরে হঠাৎ বজ্রপাত হলো। জানালার কাচ আলোতে ঝলসে উঠল। ইশিতা ছুটে এসে বললেন, “অর্ণববাবু! ড্রয়িংরুমের আয়নায় আবার কুয়াশা জমেছে… আর এবার তার ভেতরে স্পষ্ট একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে।”
সবাই ছুটে গেল। আয়নার ভিতরটা ঝাপসা কুয়াশায় ভরে গেছে। আর কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অস্পষ্ট এক অবয়ব—লম্বা, গা ঢাকা পোশাক, হাতে যেন উজ্জ্বল কিছু। কারও মুখ বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছে প্রবলভাবে।
তিতলি ভয়ে মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরল।
অর্ণব ধীরে ধীরে বললেন, “ছায়া নয়… এটা এক ইঙ্গিত। হীরেটা যার কাছে আছে, সে এই আয়নার আড়ালে থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।”
সুব্রত কড়া গলায় বললেন, “তাহলে বুঝুন, খুনি এখনও এখানেই আছে।”
অর্ণব চিঠিটা মুঠোয় ধরে গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ। আর যতক্ষণ না আমরা সেই যজ্ঞের রহস্য ভাঙছি, ততক্ষণ আরও মৃত্যু ঘটবে।”
পর্ব ৮ — অভিশাপের কাহিনি
মিত্র ভিলার ভেতরে টানটান অন্ধকার। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু আকাশে এখনো ধূসর ভার। সবাই ড্রয়িংরুমে জড়ো হয়েছে। অর্ণব টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রেখেছেন সেই পুরোনো চিঠি, গোলকোন্ডা আর্কাইভস-এর দলিল। নীরবতা এত ঘন যে দূরের ঘড়ির টিকটিক শব্দও ভেতরে শোনা যাচ্ছে।
অর্ণব গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন—
“এই হীরেটার ইতিহাস কেবল ব্যবসা বা সৌন্দর্যের নয়। এর জন্ম রক্তের ভিতরে। উনিশ শতকের শেষভাগে, গোলকোন্ডার এক পরিত্যক্ত মন্দিরে এক তান্ত্রিক যজ্ঞ হয়েছিল। নাম—‘অগ্নিসূত্র যজ্ঞ’। এই যজ্ঞের লক্ষ্য ছিল মৃত্যুকে জয় করা। কিন্তু মাঝপথে তান্ত্রিক খুন হন। তাঁর শেষ নিঃশ্বাস মিশে যায় হীরের ভেতরে। যজ্ঞ অসমাপ্ত রয়ে যায়। আর তখন থেকেই হীরেটা হয়ে ওঠে অদ্ভুত—যার হাতেই যায়, তার প্রাণশক্তি টেনে নেয়।”
মৃণালিনী কেঁপে উঠলেন। “তাহলে এ-ই সেই অভিশাপ?”
অর্ণব মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, তবে অভিশাপ মানেই কেবল অলৌকিক নয়। এটা মানুষের ভেতরের ভয়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যে হীরেটা পায়, সে ভয়েই ধ্বংস হয়ে যায়।”
ইশিতা মৃদু গলায় বললেন, “আর সেই যজ্ঞ যদি শেষ না হয়?”
অর্ণব গম্ভীর দৃষ্টিতে উত্তর দিলেন, “তাহলে মৃত্যু চলতে থাকবে।”
ঠিক তখনই আদিত্য সামনে এগিয়ে এল। তার চোখে আতঙ্ক। “আমি একটা কথা বলতে চাই। গতকাল রাতে যখন নেটওয়ার্ক কেটে গিয়েছিল, আমি খেয়াল করেছিলাম, আধ্যাত্মিক সেই গুরু হীরের দিকে তাকিয়ে কিছু মন্ত্রোচ্চারণ করছিলেন। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো নাটক। তাই কিছু বলিনি।”
সবার মুখে ধাক্কার ছাপ।
কার্তিক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “মানে ও লোকটা এই যজ্ঞের উত্তরাধিকারী?”
অর্ণব শান্তভাবে বললেন, “সম্ভব। ও হয়তো জানত, যজ্ঞ অসমাপ্ত। আর হীরেটাকে ব্যবহার করে সে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে চাইছে।”
হঠাৎ আয়নায় আবার কুয়াশা জমল। এবার কুয়াশার ভেতর স্পষ্ট এক শব্দ ভেসে এলো—মন্ত্রোচ্চারণের মতো।
“অগ্নিসূত্র… সমাপ্ত করো… সমাপ্ত করো…”
তিতলি আঁচল আঁকড়ে ধরল। ইশিতা চোখ বুজে প্রার্থনার মতো ফিসফিস করলেন। সুব্রত বন্দুক বের করে দাঁড়ালেন।
অর্ণব একেবারে স্থির দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা প্রমাণ করছে, হীরেটা এখন সেই গুরুর কাছেই। কিন্তু সে কোথায় লুকিয়েছে, সেটাই জানতে হবে।”
মৃণালিনী সাহস সঞ্চয় করে বললেন, “চিঠিতে কি কিছু সূত্র আছে? কোথায় যজ্ঞ অসমাপ্ত হয়েছিল?”
অর্ণব কাগজের শেষ লাইনটা পড়লেন—
“যজ্ঞস্থল ছিল মেদিনীপুরের গহীন বনে, কালীমুখী মন্দিরে।”
সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
অর্ণব দাঁড়িয়ে পড়লেন। “এই রহস্য কলকাতার দেয়ালের ভেতর সমাধান হবে না। আমাদের যেতে হবে মেদিনীপুরের সেই মন্দিরে। সেখানে হয়তো যজ্ঞের শেষ সূত্র আছে।”
বাইরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে, জানালার কাচে আবার হালকা বৃষ্টির ফোঁটা। মনে হলো, যেন শহর নিজেই নিশ্বাস ফেলে উঠছে—অপরিচিত এক যাত্রার আগে।
পর্ব ৯ — অন্তর্ঘাত
মেদিনীপুরের পথে রওনা হল দল। ভোরের প্রথম ট্রেন, বাইরে কুয়াশা ঢাকা মাঠ, ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য কাকের ডাক ভেসে আসছে। কামরায় বসে আছে শুভ্রাংশু, ইশিতা, তিতলি, মৃণালিনী, আদিত্য, আর অর্ণব। কার্তিক দায়িত্ব নিয়ে পাশের সিটে বসেছে। সুব্রত পুলিশ অফিসারও সঙ্গে। প্রত্যেকের মুখে উত্তেজনা, কিন্তু তার নিচে চাপা ভয়—মেদিনীপুরের কালীমুখী মন্দিরে কী অপেক্ষা করছে কে জানে।
অর্ণব জানালার পাশে বসে খাতায় নোট নিচ্ছিলেন। তিনি একবার সবার দিকে তাকালেন—প্রত্যেকের চোখেই ক্লান্তি ও অস্বস্তি। হীরার ছায়া যেন সবাইকে গ্রাস করেছে।
ঠিক তখনই কামরার আলো নিভে আবার জ্বলে উঠল। কারও কাঁধে ঠোকাঠুকি লাগল, কেউ চমকে উঠল। আলো ফিরে আসার পর দেখা গেল, আদিত্যর ব্যাগ ছিঁড়ে মেঝেতে কাগজ ছড়িয়ে পড়েছে। অর্ণব ঝুঁকে পড়ে একটা কাগজ হাতে তুলে নিলেন।
কাগজটা পুরোনো নীল কালি দিয়ে লেখা, আর সেটা চিঠির টুকরো—
“যজ্ঞ সম্পূর্ণ হলে, হীরের মালিকানা চিরতরে স্থায়ী হবে…”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বললেন, “আদিত্য, এটা তোমার ব্যাগে কী করছে?”
আদিত্য কেঁপে উঠল। “আমি… আমি জানি না! হয়তো ভুল করে চলে এসেছে।”
অর্ণব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। “মিথ্যে বলছো। তুমি সাংবাদিক, কিন্তু তোমার আগ্রহ খবরের চেয়ে বেশি—তুমি আসলেই খুঁজছিলে কিভাবে হীরেটা নিজের করে নেওয়া যায়।”
ঘরে শ্বাসরুদ্ধ নীরবতা। ইশিতা চমকে বললেন, “মানে! আমাদের মধ্যে কেউ—”
অর্ণব ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। অন্তর্ঘাত এখানেই।”
কার্তিক হঠাৎ দাঁড়িয়ে বন্দুক বের করল। “আমি অনেকক্ষণ চুপ ছিলাম। স্যার, আমার সন্দেহ ছিল আদিত্যর ওপর।”
অর্ণব শান্তভাবে হাত তুললেন। “কার্তিক, বন্দুক নামাও। খুনি বা বিশ্বাসঘাতক এত সহজে ধরা পড়ে না। তুমি যদি সত্যিই দোষী না হও, তবে ধৈর্য ধরো। আর যদি দোষী হও—তাহলে তুমি নিজেই প্রকাশ পাবে।”
আলো আবার একবার নিভে গেল। কামরার ভেতরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। অন্ধকারে স্পষ্ট শোনা গেল কারও ফিসফিসানি—
“হীর আমার… যজ্ঞ শেষ হলে আমার হবে…”
আলো জ্বলে উঠতেই দেখা গেল, ব্যাগের ভেতর থেকে উজ্জ্বল নীল আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সেটা হীরা নয়—বরং হীরের সঙ্গে থাকা এক ছোট্ট খণ্ডিত টুকরো, যা হয়তো বক্স থেকে খসে পড়েছিল। সেটাই আদিত্য লুকিয়ে রেখেছিল।
অর্ণব সেটি হাতে তুলে নিয়ে ধীরে বললেন, “তাহলে সত্যি, অন্তর্ঘাতের ছায়া আমাদের ভেতরেই ছিল। কিন্তু আদিত্য একা নয়। কেউ ওকে সাহায্য করছে।”
সবাই একে অপরের দিকে তাকাল। কে সেই গোপন সহায়ক? দলের ভেতরেই কি আরেকজন বিশ্বাসঘাতক আছে?
অর্ণব জানালার দিকে তাকালেন। কুয়াশায় ঢাকা গ্রামগুলো পেছনে ছুটে যাচ্ছে। সামনে মেদিনীপুর, আর সেখানে অপেক্ষা করছে কালীমুখী মন্দির—যেখানে অভিশাপের শেষ রহস্য উন্মোচিত হবে।
পর্ব ১০ — শেষ অঙ্গীকার
ট্রেন থেমে গেল মেদিনীপুর স্টেশনে। সকাল তখনও কুয়াশার চাদরে ঢাকা। ভোরের হাওয়া ঠান্ডা, তবু যেন অদৃশ্য উত্তাপ ভাসছে বাতাসে। দল নেমে গাড়ি করে রওনা দিল কালীমুখী মন্দিরের দিকে। পথ ফাঁকা মাঠ, জঙ্গল, কাদামাখা কাঁচা রাস্তা। মন্দিরের কাছে আসতেই চারপাশে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল, যেন পাখিরাও ডাক বন্ধ করেছে।
মন্দির প্রাচীন, ভাঙাচোরা পাথর, অর্ধেক ভেঙে পড়া গম্বুজ। শ্যাওলা ঢাকা দেয়ালে কালো ফাটল। ভেতরে অন্ধকার, বাতাসে ধূপ-ছাইয়ের গন্ধ। সবাই ভয়ে কেঁপে উঠলেও অর্ণব এগিয়ে গেলেন মশাল হাতে। তাঁর চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকতেই দেখা গেল—সেই আধ্যাত্মিক গুরু, কমলা জোব্বা পরা, কপালে ত্রিপুণ্ড্র আঁকা। তাঁর হাতে নীল হীরা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। চারপাশে আঁকা প্রাচীন যজ্ঞমণ্ডল। গুরুর কণ্ঠে গর্জন, “অগ্নিসূত্র যজ্ঞ আজ সমাপ্ত হবে। হীর এখন আমার।”
শুভ্রাংশু চিৎকার করে উঠলেন, “আমাদের হীরা ফেরত দিন!”
গুরু হেসে বললেন, “হীরা কারও নয়, হীরার মালিক কেবল মৃত্যু। আমি সেই মৃত্যুকে জয় করব।”
ঠিক তখনই অর্ণব এগিয়ে এলেন। “তুমি ভুল করছো। যজ্ঞ অসমাপ্ত ছিল কারণ তান্ত্রিক তার জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। তাকে অতিক্রম করে কেউ অমর হতে পারে না। হীরার শক্তি কাউকে দেয় না, কেবল নিয়ে নেয়।”
গুরু মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। হীরার নীল আলো মন্দির ভরে তুলল। মৃণালিনী, ইশিতা, তিতলি সবাই চিৎকার করে উঠল। কার্তিক বন্দুক তুলল, কিন্তু অর্ণব হাত বাড়িয়ে থামালেন। “গুলি নয়। এ লড়াই অন্যরকম।”
অর্ণব হঠাৎ পকেট থেকে বের করলেন সেই খণ্ডিত নীল টুকরো, যা আদিত্যর ব্যাগ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। সেটাকে মাটির যজ্ঞমণ্ডলে ছুঁড়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরো মণ্ডল ফেটে গেল, আগুনের মতো লাল আলো বেরোল। গুরু হীরেটা আঁকড়ে ধরলেন, কিন্তু তাঁর হাত কাঁপতে শুরু করল। নীল আলো যেন তাঁকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
গুরুর মুখ থেকে শেষ চিৎকার বেরোল—“অগ্নিসূত্র… সমাপ্ত…”
পরক্ষণেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, নিথর। হীরেটা গড়িয়ে এসে থেমে গেল অর্ণবের পায়ের কাছে। আলো নিভে গেল, কেবল একটি নিস্তব্ধ পাথর পড়ে রইল।
অর্ণব ধীরে ধীরে হীরেটা তুলে নিলেন। এবার সেটা আর ঝলমল করছে না, যেন ভিতরের আগুন নিভে গেছে। তিনি মাটিতে বসে মশালের আলোয় শান্ত কণ্ঠে বললেন, “শেষ অঙ্গীকার পূর্ণ হলো। অভিশাপ ভাঙল।”
মৃণালিনী কেঁদে ফেললেন। ইশিতা তিতলিকে আঁকড়ে ধরলেন। সুব্রত মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেললেন, যেন এক পাহাড় সরল কাঁধ থেকে।
শুভ্রাংশু অবিশ্বাসের চোখে অর্ণবের দিকে তাকালেন। “তাহলে… হীরেটা এখন?”
অর্ণব হীরেটা মুঠোয় চেপে ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, “হীরার জায়গা মানুষের হাতে নয়। এ রত্ন মাটিরই অংশ। এটাকে ফের মাটির কোলে সমাধিস্থ করা হবে। নইলে আবার লোভ, আবার মৃত্যু।”
সেদিন সন্ধ্যায়, সূর্য ডোবার সময়, মেদিনীপুরের জঙ্গলের গভীরে এক অচেনা শ্মশানবনে হীরেটাকে মাটির নিচে পুঁতে দেওয়া হলো। কোনো ধ্বনি, কোনো প্রার্থনা নয়—শুধু অর্ণবের কণ্ঠে এক লাইন,
“মানুষের লোভ শেষ হোক, মাটির কাছে যা, তা মাটির কাছেই ফিরুক।”
মিত্র ভিলা ফিরল আলো-আঁধারের জীবনে। কিন্তু যারা একবার নীল হীরের ছায়া দেখেছে, তারা জানে—কোনো কোনো আলো সৌন্দর্য নয়, মৃত্যুর আভাস।
আর অর্ণব রায়? তিনি আবার নিঃশব্দে শহরে ফিরে গেলেন, পরের রহস্যের অপেক্ষায়।