Bangla - প্রেমের গল্প

নীল সালোয়ার

Spread the love

ঋতব্রত মুখার্জি


পর্ব : প্রথম দেখা

সেদিন আকাশটা অদ্ভুত রঙে ভরে উঠেছিল। সারাদিনের গুমোটের পরে বিকেলের শেষে নামল হঠাৎ বৃষ্টি। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সবাই দৌড়চ্ছে—কেউ অটো ধরছে, কেউ বাসের জন্য ছুটছে, কেউ ছাতা ভিজিয়ে হাঁটছে। আমি তখন কলেজ থেকে ফিরছিলাম, হাতে কয়েকটা ফাইল আর এক কাপ কাগজের কফি। মনে হচ্ছিল—এই ভিজে ভিজে শহরে কেবল একটাই শব্দ চলছে, বৃষ্টির টুপটাপ।

বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো তাকে। নীল সালোয়ার পরে, কাঁধে ভেজা চুল ঝুলছে, একহাতে কালো ছাতা, তবু বৃষ্টির ফোঁটা তাকে যেন রেহাই দিচ্ছিল না। যেন ছাতার আড়াল থেকেও বৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে ফেলছিল বারবার। তার চোখদুটো ছিল একেবারে সামনে, কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন খুব দূরে তাকিয়ে আছে—হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কারও দিকে।

আমি একদম অচেনা, তবু হঠাৎ মনে হলো, তাকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। সেইরকম অদ্ভুত এক টান। চারপাশের লোকজন ঠেলাঠেলি করছে, ভিজে পিচ্ছিল রাস্তায় বাস থেমে যাচ্ছে, লাফিয়ে উঠছে মানুষ। কিন্তু আমার চোখ যেন আটকে গেল কেবল ওই মেয়েটির ওপরেই।

আমি কিছু বলতে পারিনি। কেবল দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর ও দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সামনের লাইটপোস্টের নিচে। ভিজে আলোয় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল চারদিক।

হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য সে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। আমি চমকে উঠলাম। সেই চোখে ছিল এক অদ্ভুত ক্লান্তি, তবু অদ্ভুত দীপ্তিও। আমার মনে হলো, সেই চোখেই লেখা আছে শত গল্প।

বাস এসে থামল। ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হলো। মেয়েটি ভেতরে উঠে গেল। জানালার কাঁচে বৃষ্টির জল বেয়ে নামছিল। তার মুখ কাঁচের ওপারে ঝাপসা, তবু স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, এক টুকরো রহস্য।

বাস ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। আমি ছাতার ভেতর দাঁড়িয়ে রইলাম। বুকের ভেতর হঠাৎ শূন্যতা। মনে হচ্ছিল, কিছু হারিয়ে ফেললাম, অথচ সেই কিছুটা আদৌ কখনও আমার ছিল না।

সেই রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। মনের ভেতর বারবার ভেসে উঠছিল সেই নীল সালোয়ার, ভিজে চুল, আর কাঁচের ওপারে ঝাপসা মুখ। আমি জানতাম না সে কে, নাম কী, কোথায় থাকে। তবু মনে হচ্ছিল—আগামীকাল আবার ওই একই সময়, ওই একই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

 

পর্ব : অপেক্ষার দিনগুলো

পরদিন বিকেল থেকেই আমার ভেতরে অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল। ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই ঘড়ির দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম। বন্ধুরা চায়ের আড্ডায় ডাকছিল, কিন্তু আমি অজুহাত দিলাম—বাড়ি যেতে হবে। আসলে বাড়ি নয়, আমার গন্তব্য সেই বাসস্ট্যান্ড।

আকাশে সেদিন মেঘ ছিল না, বৃষ্টি নেই, কেবল শুকনো হাওয়া বইছিল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ঠিক সেই জায়গাতেই, যেখানে গতকাল মেয়েটিকে দেখেছিলাম। চারপাশে লোকজন ভিড় করছে, ছেলেমেয়েরা কলেজ শেষে ঝাঁক বেঁধে যাচ্ছে, অফিসফেরত ক্লান্ত মানুষ সিগারেট ধরাচ্ছে। আমি কেবল অপেক্ষা করছি, যদি হঠাৎ দেখা মেলে।

কিন্তু সে এলো না। একটার পর একটা বাস থামছে, মানুষ ভরে যাচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অচেনা লোকজন বারবার ধাক্কা দিচ্ছে, “দাঁড়িয়ে আছো কেন? উঠছো না?”—আমি কেবল মাথা নেড়ে এড়িয়ে যাচ্ছি।

সেদিন ফিরলাম একেবারে শেষ বাসে। মনে হচ্ছিল, কিছু যেন মিস হয়ে গেল। তবু ভেতরে এক জেদ কাজ করছিল—সে আবার আসবে।

এরপর একে একে কেটে গেল তিন দিন। প্রতিদিন আমি ঠিক সেই সময়ে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। প্রথমদিনের বৃষ্টির স্মৃতি যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল আমার মনে। নীল সালোয়ার, ভিজে চুল, কাঁচের ওপারে চোখ—সবকিছু বারবার ফিরে আসছিল।

চতুর্থ দিনে ঠিক বিকেল পাঁচটার পর, যখন প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়লো তাকে। একই নীল সালোয়ার নয়, আজ তার গায়ে হালকা সাদা কুর্তি, হাতে একটা বই। আমার বুক ধক করে উঠলো।

সে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো, ঠিক লাইটপোস্টের নিচে। আমার মনে হলো, হয়তো এইবার কিছু বলা উচিত। পা দুটো এগোলোও, কিন্তু গলা শুকিয়ে এল। কেবল তাকিয়ে রইলাম।

বাস এলো। লোকজনের ঠেলায় সে উঠলো ভেতরে। আমি সাহস পেলাম না। আবার দূর থেকে তাকিয়েই রইলাম।

বাস চলে যাওয়ার পরে মনে হচ্ছিল, এভাবে আর চলবে না। প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকে কেবল চেয়ে থাকাটা তো কোনো গল্প নয়। আমার ভিতরে তখন একটাই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হচ্ছিল—পরেরবার সুযোগ এলে কিছু একটা বলতেই হবে। নাম জিজ্ঞেস করতে হবে, কিংবা অন্তত একটা হাসি দিয়ে শুরু করতে হবে।

কিন্তু সেই “পরেরবার” কি সত্যিই আসবে?

 

পর্ব : প্রথম কথোপকথন

পরের দিন থেকেই আমার বুকের ভেতর কেমন এক অদ্ভুত কাঁপুনি শুরু হয়েছিল। ক্লাসে বসে প্রফেসরের কণ্ঠস্বরও শুনতে পাচ্ছিলাম না, মনে হচ্ছিল, আজ হয়তো সেই সুযোগ আসবে—আজ কথা বলব। কিন্তু ঠিক কী বলব, সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। “তুমি প্রতিদিন এখানে দাঁড়াও?” না কি “আমি তোমাকে গত বৃষ্টির দিনে দেখেছিলাম”?—শোনালেই তো অদ্ভুত মনে হবে।

সেই বিকেলে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালাম স্বাভাবিকের চেয়ে একটু আগে। চারপাশে মানুষ জড়ো হচ্ছে, দোকানিরা পকোড়া ভাজছে, ধোঁয়ার গন্ধ মিশে যাচ্ছে বাতাসে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, বুকের ভেতর যেন ঢাক বাজছে।

হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ল তাকে। আজ আবার নীল সালোয়ার—সেই প্রথম দিনের মতো। বুকে যেন ঢেউ খেলল। সে এল আর আমার থেকে সামান্য দূরে দাঁড়াল। চোখে পড়লো, হাতে একটা ভিজে কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছে, হয়তো ক্লাস থেকে ফিরেছে।

আমি দ্বিধা ভাঙতে পারছিলাম না। কিন্তু হঠাৎই দেখা গেল, তার হাতে থাকা একটা কাগজ হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়লো আমার পায়ের কাছে। আমি ঝুঁকে তুলে নিলাম। কাগজটা এগিয়ে দিতে গিয়েই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল—

“এটা আপনার…”

সে তাকালো। সেই চোখ—ঝড়ের আগে নদীর মতো গভীর। এক মুহূর্ত যেন শব্দহীন হয়ে গেল চারপাশ। তারপর সে হালকা হেসে বলল,
“ধন্যবাদ।”

গলার স্বরটা যেন অচেনা অথচ বহু পুরোনো পরিচিত। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি প্রতিদিন এই বাসটা ধরেন?”

সে একটু বিস্মিত চোখে তাকাল, তারপর মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, বেশিরভাগ সময়।”

আমার বুকের ভেতর যেন হালকা আলো জ্বলে উঠলো। অবশেষে কথোপকথনের শুরু হলো।

বাস এসে থামল। ভিড় ঠেলে সে ভেতরে উঠলো। হঠাৎ না ভেবে আমিও উঠে পড়লাম তার পেছনে। জীবনে প্রথমবার মনে হচ্ছিল, কোনও অচেনা রাস্তায় হাঁটতে যাচ্ছি—কিন্তু সেই রাস্তার দিকটাই আমার প্রিয়।

বাসের ভিড়ে দাঁড়িয়ে সে জানলার পাশে জায়গা পেল। আমি দাঁড়ালাম কাছাকাছি। দুজনের মাঝে কেবল কয়েকটা অপরিচিত মানুষ, তবু মনে হচ্ছিল দূরত্বটা অনেক কমে এসেছে।

তার নাম জিজ্ঞেস করতে পারিনি সেদিনও। শুধু জানলাম, তার বাস আমার থেকে আলাদা রুটে যায়। নেমে যাবার আগে সে একবার তাকিয়ে হেসে বলল,
“আবার দেখা হবে।”

আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই তিনটে শব্দেই যেন এক নতুন গল্পের দরজা খুলে গেল।

 

পর্ব : নতুন অভ্যাস

সেদিনের পরে সবকিছু যেন বদলে গেল। আগে বাসস্ট্যান্ডটা আমার কাছে ছিল কেবল বাড়ি ফেরার জায়গা, এখন সেটা হয়ে উঠল এক অদ্ভুত প্রতীক্ষার ঠিকানা। প্রতিদিন বিকেলে ক্লাস শেষ হতেই আমি যেন অদৃশ্য দড়ির টানে ছুটে যেতাম সেখানে।

সে এলো কি না, সেটা বোঝার আগেই বুক ধড়ফড় করতে শুরু করত। প্রতিদিনের কোলাহল, ধোঁয়া, চিৎকার—সব কিছুর ভিড়ের মধ্যে তার এক ঝলক চোখে পড়া মানেই দিনের শেষ আলো জ্বলে ওঠা।

ধীরে ধীরে আমাদের কথোপকথনও একটু একটু করে বাড়তে লাগল। শুরুতে শুধু “হ্যালো” বা “কেমন আছেন” এর মতো ছোট বাক্য, পরে ধীরে ধীরে কলেজের ক্লাস, বই, কিংবা সেদিনের আবহাওয়া নিয়ে কথা। অদ্ভুতভাবে বুঝতে পারলাম, কথাগুলো ছোট হলেও তার ভেতরে জমছে এক গভীরতার বীজ।

একদিন সে জানাল, তার নাম মায়া। আমি মনে মনে বারবার নামটা উচ্চারণ করতে লাগলাম—মায়া। যেন নামটা বললেই ভেতরে এক মিষ্টি ঝংকার ওঠে।

আমারও নাম জানল সে। মায়া একটু হেসে বলল,
“তুমি কি প্রতিদিন এই একই সময়েই বাস ধরো?”
আমি দ্বিধা না করে উত্তর দিলাম,
“হ্যাঁ… এখন থেকে।”

সে হেসে ফেলল। সেই হাসি যেন বৃষ্টিভেজা বিকেলের মতো—শহরের ধূসরতার মধ্যে হঠাৎ ঝলমলে রোদ।

দিনগুলো এক অদ্ভুত নিয়মে বাঁধা পড়তে লাগল। সন্ধ্যার ভিড়ে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে থাকতাম পাশাপাশি। কখনও বাসের ভিড়ে ঠেসে দাঁড়াতাম, কখনও জানলার বাইরে তাকিয়ে গল্প করতাম। মাঝে মাঝে সে কলেজের প্রোজেক্টের খুঁটিনাটি বলত, আমি আমার ক্লাসের ক্লান্তির কথা শোনাতাম।

তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো—এইসব ছোটখাটো আলাপে থেকেও আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম, এর ভেতরে আরও গভীর কিছু জমছে।

একদিন বাসস্ট্যান্ডে না এসে সে হঠাৎ দেরি করল। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেল, মানুষজন একে একে চলে গেল। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক তখনই দূরে ছুটে আসতে দেখলাম তাকে। ভিজে চুলে দম ফেলার সময় নেই। এসে হেসে বলল,
“ক্ষমা করো, আজ কলেজে একটা মিটিং লম্বা হয়ে গেল। ভাবছিলাম তুমি হয়তো চলে গেছো।”

আমি শুধু মাথা নেড়ে হাসলাম। অথচ ভেতরে মনে হচ্ছিল, এটাই তো প্রমাণ—সে-ও আমাকে খুঁজছিল।

এভাবেই আমাদের প্রতিদিনের দেখা হয়ে উঠলো এক নতুন অভ্যাস। হয়তো আমরা কাউকেই বলিনি, তবু দুজনেই জানতাম, এই অভ্যাসটুকুই এখন দিনের সবচেয়ে জরুরি অংশ।

 

পর্ব : ভেতরে ভেতরে বদল

দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একই ছন্দে। ক্লাস শেষ, তারপর বাসস্ট্যান্ড, আর সেই পরিচিত মুখ। আমাদের কথোপকথন যত দীর্ঘ হচ্ছিল, ততই আমি বুঝতে পারছিলাম—এই মেয়েটি আমার ভেতরে এক অচেনা আলো জ্বেলে দিচ্ছে।

আগে যেখানে দিন মানেই ছিল একঘেয়ে পড়াশোনা, নোটস, ক্লাস আর পরীক্ষা—এখন সবকিছুর মাঝে লুকিয়ে থাকত একটাই প্রতীক্ষা। বিকেল নামার আগেই বুক ধড়ফড় করতে শুরু করত, কখন সেই দেখা হবে।

মায়া যেন বুঝতও সেটা। মাঝেমধ্যেই সে হেসে বলত,
“তুমি কি প্রতিদিন এতটাই সময় মেনে আসো? মনে হয় ঘড়ির কাঁটা তুমি চালাও।”
আমি জবাব দিতাম,
“না, ঘড়ি নয়… তুমি।”

এইসব ছোট ছোট বাক্যের ভেতরেই যেন এক অদ্ভুত গভীরতা জন্ম নিচ্ছিল।

কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, আমি আর আগের মতো নেই। বন্ধুরা সিনেমার পরিকল্পনা করলে আমি কেটে দিই, কোথাও আড্ডা ডাকলে অজুহাত বানাই। আমার দিন এখন কেবল ওই এক ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকেছে।

একদিন আমরা বাসে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভিড়ের মধ্যে ঠেসে থাকার অস্বস্তি হঠাৎ যেন এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতায় বদলে গেল। হাতের আঙুল ছুঁয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। কিছু না বলেও বুকের ভেতর আলোড়ন জাগলো।

মায়ার চোখে তখন হালকা ক্লান্তি, কিন্তু সেই চোখের ভেতরে আমি স্পষ্ট দেখলাম অন্যরকম কোমলতা। যেন বলতে চাইছে—তুমিই তো আছো।

আমারও বলতে ইচ্ছে করছিল, “তুমি ছাড়া আর কিছুর দরকার নেই।” কিন্তু ঠোঁট শক্ত হয়ে গিয়েছিল। শব্দের বদলে শুধু এক নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি জমে রইল ভেতরে।

এরপরের দিনগুলোতে আমরা আরও সহজ হয়ে উঠলাম একে অপরের কাছে। মাঝে মাঝে সে তার ক্লাসের নোটস আমার হাতে ধরিয়ে দিত, আমি তাকে গল্প শোনাতাম আমার প্রিয় লেখকের। আমরা একসাথে হেসে ফেলতাম অদ্ভুত কোনো বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে, কিংবা মজা করতাম বাসের কন্ডাক্টরের চিৎকারে।

তবে এসবের ভেতরেও আমি টের পাচ্ছিলাম—ভেতরে ভেতরে সবকিছু বদলাচ্ছে। এটা আর শুধু দেখা বা কথা নয়। এটা এমন এক টান, যা বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে অন্য কোনো নাম খুঁজছে।

কিন্তু সেই নামটা কি আমরা দিতে পারব? নাকি ভয়ে, দ্বিধায়, সমাজের চাপে আমরা কেবল এই নিঃশব্দ সম্পর্ককেই আঁকড়ে থাকব?

আমার ভেতরে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—আমি কি তাকে বলব?

 

পর্ব : অঘোষিত স্বীকারোক্তি

দিন যত এগোতে লাগল, আমাদের নীরবতা যেন কথার থেকেও বেশি কিছু বলছিল। চোখে চোখ পড়লেই এক অদ্ভুত স্রোত বয়ে যেত ভেতরে। দুজনেই কিছু বলতাম না, কিন্তু দুজনেই বুঝে যেতাম—এখানে লুকিয়ে আছে অনেক অপ্রকাশিত স্বীকারোক্তি।

একদিন বিকেলে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল হঠাৎ। বাসস্ট্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে। আমি আর মায়া দাঁড়িয়ে আছি পাশাপাশি, কিন্তু জায়গার অভাবে প্রায় ছুঁয়ে যাচ্ছি একে অপরকে। বাইরে ঝাপসা জলের পর্দা, বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ।

মায়ার চুল ভিজে কপালে লেগে আছে। হঠাৎ সে আমার দিকে তাকাল। সেই চোখে ছিল এক অদ্ভুত স্থিরতা, যেন বৃষ্টির ভেতর দিয়ে সে আমাকে পড়ছে। আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল।

আমি ধীরে ধীরে ছাতাটা মায়ার মাথার ওপরে ধরলাম। সে হেসে বলল,
“তুমি ভিজছো, কেবল আমাকে শুকনো রাখছো।”
আমি ফিসফিস করে উত্তর দিলাম,
“তুমি ভিজলে আমারও ভিজে যাওয়া হবে।”

শব্দগুলো আমার অজান্তেই বেরিয়ে গিয়েছিল। বলেই বুঝলাম, এ তো এক অঘোষিত স্বীকারোক্তি। মায়া চমকে তাকাল, তারপর হালকা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। গালে যেন এক চিলতে লাল আভা ফুটে উঠল।

সেই মুহূর্তে চারপাশের সব শব্দ মিলিয়ে গেল। বাসের চিৎকার, মানুষের ভিড়, বৃষ্টির ঝাপটা—সব যেন দূরে সরে গেল। কেবল রইল দুজনের নিঃশ্বাস আর চোখের ভেতরে জমে থাকা অদ্ভুত আলো।

বাস এসে থামল। ভিড় ঠেলে আমরা ভেতরে উঠলাম। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে কাঁচে হাত রাখল। বাইরে ঝাপসা শহর, ভেতরে আমরা। আমি চুপ করে তার দিকে তাকালাম।

মায়া ধীরে ধীরে বলল,
“কখনও ভেবেছো, কিছু কিছু মানুষকে আমরা হঠাৎ খুঁজে পাই… অথচ মনে হয় বহুদিনের চেনা?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
“প্রতিদিন ভাবি।”

আমাদের দুজনের চোখে চোখে তখনই লিখে গেল সবকিছু। কোনো আনুষ্ঠানিক বাক্যের দরকার হলো না। নিঃশব্দে আমরা দুজনেই জেনে গেলাম—এটাই সেই মুহূর্ত, যেখান থেকে সম্পর্কের আসল পথ শুরু হয়।

 

পর্ব : দূরত্ব আর কাছে টানা

সেদিনের বৃষ্টিভেজা বিকেলের পর সবকিছু বদলে গিয়েছিল। আমি জানতাম, মায়াও আমার ভেতরের সেই অঘোষিত স্বীকারোক্তি বুঝেছে। আর মায়ার চোখে যে নীরব সম্মতি দেখেছিলাম, তা আমাকে প্রতি মুহূর্তে নতুন সাহস দিচ্ছিল।

কিন্তু জীবনের নিয়ম সবসময় সরল পথে চলে না।

এক বিকেলে আমরা বাসে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। ভিড় কিছুটা কম, বাতাসে হালকা শীতের আভাস। আমি বলতে চেয়েছিলাম অনেক কিছু—কীভাবে প্রতিদিন তাকে দেখা আমার কাছে অভ্যাস নয়, বরং প্রার্থনা হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঠিক তখনই মায়া ফোন ধরল। তার কণ্ঠস্বর নরম হয়ে গেল, তবু চোখে একটা অদ্ভুত চাপা অস্থিরতা ফুটে উঠল।

ফোন রেখে সে নিঃশব্দে জানলার বাইরে তাকাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“সব ঠিক তো?”

সে একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল,
“হ্যাঁ… তবে হয়তো শিগগিরই কলেজ বদলাতে হতে পারে।”

আমার বুকের ভেতর যেন ভারী পাথর চেপে বসল। “কেন?”—এই প্রশ্নটা গলায় আটকে গেল। মায়া তখনো জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,
“বাবার ট্রান্সফার হয়েছে। হয়তো কয়েক মাস পরেই আমাদের পরিবারকেও সরে যেতে হবে।”

সেই মুহূর্তে আমার চারপাশ ঝাপসা হয়ে গেল। মায়ার কণ্ঠস্বর দূরের সমুদ্রের গর্জনের মতো শোনাচ্ছিল।

বাস থেকে নেমে যখন আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম, আমি বললাম,
“তাহলে… আমাদের এই প্রতিদিনের দেখা?”

মায়া হালকা হাসল। তার হাসি ছিল বেদনার, কিন্তু দৃঢ়ও।
“প্রতিদিনের দেখা হয়তো থাকবে না… কিন্তু যাদের চোখে ভরসা থাকে, তাদের জন্য দূরত্ব কোনো বাধা নয়।”

আমি চুপ করে গেলাম। অথচ ভেতরে ভেতরে অনুভব করলাম—সে-ও আমাকে কাছে টানছে, ঠিক যেমন আমি চাইছি।

সেই রাতে ঘুম এল না। আমি ভাবছিলাম, সময় যদি আমাদের আলাদা করে দেয়, তবে কি এই সম্পর্কটা কেবল এক অসমাপ্ত গল্প হয়ে থাকবে? নাকি এই গল্পেরও কোনো উপসংহার আছে, যেখানে দূরত্বকে জয় করে প্রেম আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে?

আমার মনে হচ্ছিল, এবার আর দেরি করা যাবে না। যা কিছু আছে, স্পষ্ট করে বলতেই হবে।

 

পর্ব : অপূর্ব স্বীকারোক্তি

কয়েকদিন ধরে আমার ভেতরে একটাই কথা ঘুরছিল—যদি মায়াকে না বলি, তবে হয়তো এই গল্পটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। সময় আমাদের হাতে নেই, কয়েক মাস পরই হয়তো সে অন্য শহরে চলে যাবে। আর আমি কেবল দাঁড়িয়ে থাকব সেই বাসস্ট্যান্ডে, যেখানে আর কেউ থাকবে না।

সেদিন বিকেলে আকাশ ছিল গোধূলির মতো ম্লান। আমি আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাতে একটা পুরোনো বই—যেটা আমি ঠিক করেছিলাম তাকে দেব। বুকের ভেতর লেখা একটিমাত্র চিঠি, কেবল দুটো লাইন— তুমি এলে জীবন ভরে ওঠে। তুমি না এলে শূন্যতা।

মায়া এলো একটু দেরিতে। গায়ে ছিল সাদা কুর্তি, চুল খোলা। ক্লান্ত লাগছিল, তবু চোখে সেই চেনা দীপ্তি।

আমি সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম। বললাম,
“মায়া, আজ তোমার জন্য কিছু এনেছি।”

সে অবাক হয়ে তাকাল। আমি বইটা তার হাতে দিলাম। বইয়ের ভেতর চিঠি লুকোনো। মায়া পাতা উল্টাতে গিয়ে সেটি খুঁজে পেল। পড়তে পড়তে তার মুখের রং বদলে গেল। চোখে এক অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল।

সে ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকাল। ঠোঁটে একটুখানি কাঁপা হাসি। তারপর খুব আস্তে বলল,
“তুমি জানো তো, আমিও প্রতিদিন অপেক্ষা করি… শুধু তোমার জন্য।”

আমার বুক থেকে যেন হাজারো বাঁধন একসাথে খুলে গেল। আমি কিছু বলতে পারলাম না। কেবল তাকিয়ে রইলাম তার চোখে, যেখানে আজ আর কোনো দ্বিধা নেই, কেবল এক নিখাদ সত্যি।

বাস এসে থামল। আমরা দুজন পাশাপাশি ভিড়ে উঠলাম। চারপাশে হইচই, কিন্তু ভেতরে মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা থেমে গেছে।

হঠাৎ হাতের আঙুলে তার আঙুল ছুঁয়ে গেল। সে হাত সরাল না। আমিও না। সেই এক স্পর্শেই যেন সব স্বীকারোক্তি, সব প্রতিশ্রুতি, সব ভবিষ্যৎ লুকিয়ে রইল।

সেদিন শহরের ভিড়ের ভেতর আমরা দুজন প্রথমবারের মতো বুঝে গেলাম—এই সম্পর্ক আর শুধু দেখা করার অভ্যাস নয়, এটা আমাদের দুজনের জীবনকে নতুন নাম দিচ্ছে।

 

পর্ব : ছায়া আলো

আমাদের সম্পর্ক তখন যেন নিজেরাই নিজেদের ছন্দ খুঁজে নিয়েছিল। প্রতিদিনের দেখা আর কথার মধ্যে নতুন এক আলোকিত পথ তৈরি হচ্ছিল। আমরা জানতাম, সময় সীমিত, তবু সেই সীমার ভেতরে যতটুকু পারা যায়, আলো জ্বালিয়ে নিতে হবে।

মায়া এখন অনেক সহজ হয়ে উঠেছিল। সে নিজের গল্প শোনাত—শৈশবের দুষ্টুমি, স্কুলের নাটকে প্রথম অভিনয়, কিংবা প্রথম যে বই তাকে কাঁদিয়েছে। আমি শুনতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। মনে হতো, প্রতিটি শব্দের ভেতরে তার হৃদয়ের নরম অংশগুলো আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

কিন্তু আলোর মতোই ছায়াও ধীরে ধীরে উপস্থিত হতে লাগল।

একদিন বিকেলে আমরা বাস থেকে নেমে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ রাস্তায় মায়ার বাবাকে দেখলাম। তিনি কঠিন মুখে তাকালেন, চোখে বিস্ময়ের সঙ্গে অস্বস্তি মেশানো। মায়া এক মুহূর্তে চুপ হয়ে গেল। আমি কেবল নমস্কার করলাম।

বাড়ি ফেরার পথে মায়া খুব নীরব ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“সব ঠিক তো?”

সে ধীরে ধীরে বলল,
“বাবা খুব রক্ষণশীল মানুষ। আমাদের পরিবারের মেয়েদের বাইরে কারও সঙ্গে বেশি মেলামেশা তিনি পছন্দ করেন না। আজ যদি কিছু প্রশ্ন করেন…”

তার চোখে তখন ভয়ের ছায়া। আমি প্রথমবার উপলব্ধি করলাম, এই সম্পর্কটা শুধু আমাদের দুজনের নয়—এখানে জড়িয়ে আছে সমাজ, পরিবার, নিয়মের অদৃশ্য বেড়া।

সেই রাতে আমি দীর্ঘক্ষণ ঘুমোতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, মায়াকে হারানোর ভয় আমার বুক চেপে বসেছে।

পরদিন সে আমাকে দেখে হালকা হেসে বলল,
“ভয় পেয়ো না। আমি জানি, এটা কেবল অভ্যাস নয়। এটা তার চেয়েও বেশি।”

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“যদি বাধা আসে, আমি তোমার হাত ছাড়ব না।”

মায়ার চোখ ভিজে উঠেছিল।
“তাহলে আলো ঠিকই ছায়াকে হারিয়ে দেবে।”

 

পর্ব ১০ : শেষ প্রতিশ্রুতি

শীতের হাওয়া তখন শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় আলোর নিচে ধোঁয়া উড়ছে, দোকানপাটে ভিড় জমছে। কিন্তু আমার চোখ কেবল মায়াকে খুঁজছিল। কয়েকদিন ধরে তার চোখের ক্লান্তি যেন আরও বেড়ে গেছে। আমি জানতাম, বাবার চাপ, পরিবারের অস্বস্তি—সব মিলিয়ে তার ভেতরে ঝড় চলছে।

সেদিন বিকেলে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই পরিচিত লাইটপোস্টের নিচে। মায়া চুপচাপ আমার দিকে তাকাচ্ছিল, যেন বলার মতো অনেক কথা জমে আছে। আমি নীরবতা ভাঙলাম।
“মায়া, তুমি যদি সত্যিই চলে যাও, আমি কীভাবে এই শহরটাকে দেখব?”

সে হালকা হাসল, কিন্তু চোখে জল চিকচিক করছিল।
“তুমি শহরটাকে দেখবে আমার চোখে। দূরে থেকেও আমি আছি।”

আমি তার হাত ধরলাম। প্রথমবার, খোলাখুলি, প্রকাশ্যে। চারপাশে মানুষ ছিল, কিন্তু আমি আর কিচ্ছু ভাবিনি। মায়ার চোখে চোখ রাখতেই বুঝলাম, আজ আমাদের আর কোনো দ্বিধা রাখা চলবে না।

“মায়া,” আমি ধীরে ধীরে বললাম, “আমার কাছে তুমি কেবল প্রতিদিনের দেখা নও। তুমি আমার প্রতিটি দিন। তুমি যদি দূরে চলে যাও, আমি তবু অপেক্ষা করব। যতদিন লাগে।”

মায়ার চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু সে মাথা নেড়ে বলল,
“আমিও। আমি জানি না সময় আমাদের কী উপহার দেবে, কিন্তু একটা কথা আমি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলতে পারি—আমি তোমাকে ভুলব না। দূরত্ব যদি আসে, তবুও এই সম্পর্ককে থামাতে পারবে না।”

আমরা দুজনেই জানতাম, ভবিষ্যতের পথ অনিশ্চিত। হয়তো মায়া সত্যিই অন্য শহরে চলে যাবে। হয়তো প্রতিদিনের এই বাসস্ট্যান্ডে দেখা হবে না। তবুও সেই মুহূর্তে আমরা দুজনেই ঠিক করে নিলাম—আমাদের গল্পটা অসমাপ্ত থাকবে না।

সেদিন বিদায়ের আগে মায়া ধীরে ধীরে বলল,
“যদি কোনোদিন তুমি আমাকে আবার সেই নীল সালোয়ারে দেখতে পাও, জানবে আমি তোমার জন্যই ফিরেছি।”

আমি তার হাত শক্ত করে ধরলাম।
“আমি অপেক্ষা করব।”

বাস এসে থামল। মায়া উঠে গেল। জানলার কাঁচে তার মুখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক প্রথম দিনের মতো। কিন্তু এবার ঝাপসার ভেতরও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম—একটি প্রতিশ্রুতির আলো।

আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ভিজে রাস্তায়, বুকের ভেতর এক আশ্চর্য শান্তি। কারণ আমি জানতাম, যেখানেই যাক, মায়া আর আমি এখন একে অপরের গল্পে বেঁচে থাকব।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-09-17-at-9.34.37-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *