ঋতুপর্ণা চৌধুরী
শান্তিনিকেতনের পথচলা
রুদ্রর হাত থেকে নোটবুকটা প্রায় খসে যাচ্ছিল, বাইক থেকে নামার সময়। শান্তিনিকেতনের হেমন্তের রোদ যেন কাগজের পাতার উপর কবিতার মতো পড়ছিল। কলকাতা থেকে পালিয়ে আসার পর প্রথমবার মনে হচ্ছিল, বেঁচে আছে। রাস্তার ধারে তাল গাছের সারি, লাল মাটি, আর ভোরের মিষ্টি শীত—সব মিলিয়ে একটা পুরনো কবিতা মনে হচ্ছিল চারপাশটা। “তুই আবার কবিতা লিখতে এলি, না পালাতে?”—প্রশ্নটা বাবার কণ্ঠে এখনো মাথার মধ্যে বাজছে। রুদ্র কিছু বলেনি, শুধু বলেছিল, “একটু সময় দে, নিজেকে খুঁজে নিচ্ছি।” কলকাতার ঘিঞ্জি ফ্ল্যাট, মা’র গুমরে রাখা কান্না, বাবার ভ্রুকুটি—এসব থেকে পালিয়ে এখানে এসেই যেন আবার শ্বাস নিতে পারছে সে।
রুদ্র থাকছে শান্তিনিকেতনের একটা হোমস্টেতে, নাম ‘আকাশতারা’। একতলা কাঠের বাড়ি, পেছনে ফুলের বাগান, আর সামনের বারান্দায় দুলুনির চেয়ার। বাড়ির মালিক বিমলা মাসি, যিনি দুধের চা বানাতে জানেন, অথচ কোনো দিন দুধ কমান না। “এইখানে সবাই শিল্পী হয়ে ওঠে”—তিনি এমন ভঙ্গিতে বললেন, যেন এটা কোনো নিয়ম। রুদ্র হেসে বলল, “তাহলে আমিও হয়তো একটা ভালো কবিতা লিখতে পারি।”
দু’দিন কেটে গেল। সকালবেলা রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে হাঁটা, দুপুরে গাছতলায় বসে লেখা, আর বিকেলে প্রকৃতির নিস্তব্ধতায় ডুবে যাওয়া। কবিতাগুলো যেন রুদ্রকে ফিরিয়ে নিচ্ছিল নিজের মধ্যে, কিন্তু কোথাও যেন একটা শূন্যতা থেকে যাচ্ছিল—অদৃশ্য কিছু, যেটা অনুভব করা যায়, ছোঁয়া যায় না।
চতুর্থ দিন সকালে সে গেল কাওস্টভ পাড়ার দিকে—সেখানে লোকশিল্পীদের এক গলি রয়েছে, যারা হাতে বানানো জিনিস বিক্রি করে। গলি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই তার চোখ আটকে গেল একটি মৃৎশিল্পের দোকানে। টেরাকোটার মূর্তি, রঙিন জলপাত্র, আর মাঝখানে এক মেয়ে মাটির ঘোরে বসে মূর্তি গড়ছে। তার কপালে একটু মাটি লেগে আছে, চুল বেঁধে রাখা কিন্তু কপালের ধার দিয়ে একটা চুল খুলে এসে পড়েছে। মেয়েটি একদৃষ্টে দেখছে মাটিকে, যেন একটা প্রাণ সে নিজের হাতে বানাচ্ছে।
রুদ্র দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েটি কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে বলল, “দেখতে ভালো লাগছে নাকি কিনবে কিছু?”
রুদ্র হকচকিয়ে বলল, “দু’টোই হতে পারে। আপনি নিজে বানাচ্ছেন?”
মেয়েটি হেসে বলল, “আপনি নিজে কবিতা লেখেন? কে না জানে এখানে আসা মানেই কেউ না কেউ শিল্পী। তবে, হ্যাঁ, বানাই আমি। মেঘলা নামে চেনেন সবাই।”
রুদ্র একটু কৌতুহলীভাবে বলল, “মেঘলা? মানে রোদ-মেঘের মিশ্রণ?”
মেঘলা মৃদু হেসে বলল, “তা তো সবাই-ই। আপনি কি শুধু কবিতা লেখেন না মানুষকে বিশ্লেষণও করেন?”
রুদ্র মাথা চুলকে বলল, “ভুল বললাম মনে হচ্ছে।”
মেঘলা কিছু না বলে মাটি গড়তে থাকে।
তারপরের কয়েকটা দিন, রুদ্র প্রায় প্রতিদিনই ঘুরে যেত সেই দোকানে। কখনো কিছু কিনত, কখনো না, কিন্তু মেঘলার সঙ্গে একটু কথোপকথন হতো। ধীরে ধীরে জানা গেল, মেঘলা এখানে বড় হয়েছে। বাউলদের গান শুনে ঘুমিয়ে পড়ত ছোটবেলায়, এখনো বিকেল হলেই সুরের টানে টান পড়ে মাঠের দিকে। সে একসময় বিয়ে করেছিল, কিন্তু এক বছরেই ভেঙে যায়—তবে এ নিয়ে সে খুব একটা কিছু বলে না। শুধু একদিন রুদ্রকে বলেছিল, “ভাঙা কিছু জিনিসও শিল্প হতে পারে। তুমি দেখো না, কাচ ফেটে গেলে রোদ কেমন খেলে যায় তার ওপর?”
একদিন রুদ্র বলল, “একটা কবিতা পড়াব তোমায়।”
মেঘলা বলল, “পড়ো, তবে যদি সেটা আমার জন্য লেখা হয়, তা আগে বলবে।”
রুদ্র থমকে গেল। কবিতাটা সত্যিই মেঘলাকে ভেবে লেখা ছিল। সেখানে লেখা ছিল—
“মাটি আর কবিতার মাঝে
তুমি এক বাঁকা বিকেল,
যার রোদে নেমে আসে
একটা নীল প্রতিশ্রুতি।”
মেঘলা কিছু বলল না। কিন্তু তার চোখে কিছু ক্ষণ থেমে থাকা আলো দেখে রুদ্র বুঝল, সে কবিতা ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে।
রাত্রে হোমস্টের বারান্দায় বসে রুদ্র লিখে ফেলল আরেকটি কবিতা। কিন্তু এবার শুধু কবিতা নয়, যেন নিজের মনের গোপন চিঠি সে লিখে চলেছে। সেই রাতে তার ঘুম এল না। একবার ভাবল, ফিরে যাবে কলকাতায়। এইসব না বলা কথাগুলো নিয়ে থাকাটা অনেক কঠিন। কিন্তু আবার মনে হল, এই মেয়েটির চোখে যে আলো, তার মানে সে-ও কিছু অনুভব করে।
পরদিন বিকেলে সে গেল মেঘলার কাছে। মেয়েটি তখন কাঁদছিল। তার বাবার শরীর খারাপ, চিকিৎসার খরচ চলছে না। রুদ্র প্রথমবার সেই দৃশ্য দেখল—এক শক্ত, স্বাধীন, শিল্পী মেয়ের ভাঙা মুহূর্ত। কিছু না ভেবে সে বলল, “আমি আছি তোমার পাশে।”
মেঘলা কিছু বলল না, শুধু বলল, “কেউ কোনোদিন ছিল না পাশে। এতদিনে অভ্যেস হয়ে গেছে একা থাকার।”
রুদ্র বলল, “অভ্যেস ভাঙতে সময় লাগে, কিন্তু একদিন হয়।”
সেই বিকেলে রুদ্র প্রথম তার হাত ধরেছিল। আর মেঘলা—প্রথমবার ভরসা করেছিল কাউকে।
মাটির ভিতর সূর্য
শান্তিনিকেতনের দুপুরটা যেন সেদিন একটু বেশিই নীরব হয়ে ছিল। পাখিরাও গাছের ছায়ায় বসে ছিল চুপচাপ, বাতাসও চলছিল নিঃশব্দে, যেন তারাও মেঘলার চোখের জল দেখেছে। রুদ্র তখনো তার হাত ধরে রেখেছিল, আলতো করে। মেঘলা চমকে উঠে হাতটা সরিয়ে নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এক মুহূর্তের সেই স্পর্শে এত দিনের একাকিত্বটা যেন খানিকটা কেঁপে উঠেছিল। রুদ্র কিছু বলল না, শুধু চোখ রাখল মাটিতে পড়ে থাকা একটা ফাটা জলপাত্রের দিকে, যেটা ঠিক তখনই মেঘলার হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে।
“ভাঙলে ভালো হয় না?” রুদ্র হেসে বলল। “তবে তো তুমি আবার গড়তে পারো।”
মেঘলা নিঃশব্দে তাকাল তার দিকে, সেই চোখে যেন প্রশ্ন ছিল, হয়তো অভিযোগও—“সব ভাঙা কি নতুন করে গড়া যায়?”
কিন্তু মুখে বলল, “সবই মাটির খেলা, জানো তো? কেউ কেউ রোদকে পোড়ায়, কেউ কেউ ছায়া দিয়ে ঠান্ডা রাখে। আমিও শিখে গেছি কাকে কতটুকু মাপতে হয়।”
রুদ্র হালকা গলায় বলল, “আমাকে কি তুমি এখনো মাপছ?”
মেঘলা একটু হাসল, সেই রকম একধরনের হাসি যা দু’ভাগ সন্দেহ আর একভাগ কৌতুহল দিয়ে গড়া। “তুমি কবি, তোমাকে তো মাপার আগে শব্দে ফেলতে হয়।”
দুপুরের পর রুদ্র আর হোমস্টে ফিরে গেল না। সে মেঘলার সঙ্গে থেকেই সাহায্য করল কিছু কাঁচা মাটি বাছতে, শুকনো পাতাগুলো সরিয়ে দিল, আর মাঝে মাঝে জল এনে দিল ছোট প্লাস্টিকের পাত্রে। তারা গল্প করল ছোট ছোট বিষয়ের—পিঠে বানানো শিখেছিল মেঘলা তার ঠাকুমার কাছ থেকে, রুদ্রর ছোটবেলায় হাওড়ার গলিতে রাবার বল খেলে জানালা ভেঙে ফেলা, মেঘলার দাদু নাকি একসময় শান্তিনিকেতনে ছায়া আঁকতেন—যেখানে মানুষ নয়, শুধু ছায়ার ভঙ্গিমা থাকত। “ছায়ার ভাষা জানলে, মানুষের অন্তর বোঝা যায়”—এ কথা বলে মেঘলা চুপ করে গিয়েছিল।
বিকেল নাগাদ একটা বাউল গান ভেসে এল মাঠের দিক থেকে। গলার সুরে ছিল একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো মধুরতা—
“মন রে, কোথায় পাবি তারে
সে তো বসে আছেরে রে তোর ভিতর ঘরে…”
রুদ্র থেমে গেল, কানে হাত দিয়ে কিছু সময় গানটা শুনল। তারপর তাকিয়ে বলল, “তুমি কীভাবে এভাবে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারো এতটা সৌন্দর্যের মধ্যে থেকেও?”
মেঘলা তখন মাটির উপর একটা সূর্য আঁকছিল, রোদ পোহানো মুখে বলল, “নিজেকে গুটিয়ে রাখিনি। বরং এই রোদ, এই মাটি, এরা তো আমার শরীরের একেকটা অংশ হয়ে গেছে। তুমি শুধু বাইরে থেকে দেখো—আমি তো ভিতর থেকে জানি।”
রুদ্রের গলা একটু গম্ভীর হয়ে উঠল, “আমি যদি ভেতরে আসতে চাই?”
মেঘলা চমকে তাকাল, তারপর বলল, “ভেতরে আসা মানে দায় নিতে হবে, কবি। শুধু কবিতা পড়িয়ে ভালো লাগা দিয়ে গেলে আমার দরকার নেই। আমি ভাঙা, আমার জীবনে রং কম, আর ছায়া অনেক বেশি। তুমি কি প্রস্তুত?”
রুদ্র একটুও না কাঁপিয়ে বলল, “আমি জানি মাটি দিয়ে শুধু মূর্তি নয়, ভবিষ্যতও গড়া যায়। আমি প্রস্তুত, যদি তুমি একটা সুযোগ দাও।”
সেদিন তারা প্রথমবার একসঙ্গে হাঁটল রবিশঙ্কর ভবনের দিকে, বিকেলটা নীল হতে হতে গাঢ় হল। পাখিরা ফিরছিল ডানায় ডানায়, আর রুদ্রর মনে হচ্ছিল যেন সে হঠাৎ একটা মায়ার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজেকে। তার লেখার খাতায় তখন শুধু একটা লাইন লেখা—
“তোমার ভাঙা মাটির ভিতর আমি একটুখানি সূর্য হয়ে থাকতে চাই…”
রাত্রে ফিরেও কিছু একটা টানছিল রুদ্রকে। বিমলা মাসি খেয়াল করলেন ওর চোখে আলো। বললেন, “বুঝতে পারছি, এখানে কেউ একজন রয়েছে, যার জন্য এই জায়গাটা এখন তোমার নিজের মতো হয়ে উঠছে।”
রুদ্র হেসে বলল, “আপনি তো দেখি সব বুঝে ফেলেন!”
মাসি বললেন, “শিল্পীর মন তো খুলে পড়ে থাকে, রে। আমি শুধু পড়ে নিই।”
পরদিন সকালে মেঘলা এসে দাঁড়াল ‘আকাশতারা’র সামনে। রুদ্র তখনো চা খাচ্ছিল বারান্দায়। মেঘলার হাতে একটা ছোট কাগজ মোড়া প্যাকেট। “এটা তোমার জন্য”—বলল সে।
রুদ্র খুলে দেখল—একটা মাটির তৈরি সূর্য। খুব সূক্ষ্ম কাজ করা, মাঝখানে ছোট্ট একটা গর্ত, যেন ভিতরটা ফাঁকা।
রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “এই ফাঁকাটা কেন?”
মেঘলা চোখ নামিয়ে বলল, “কারণ সত্যিকারের সূর্যও ফাঁপা মনে হয়, যদি কেউ নিজের আলো হারিয়ে ফেলে। আমি জানি না তুমি আমার আলো হয়ে উঠবে কি না, কিন্তু তোমার কবিতায় একটা প্রতিশ্রুতি ছিল। তাই…”
রুদ্র কিছু বলল না। শুধু সূর্যটাকে হাতে নিয়ে মনে মনে বলল, “এই মাটির ভিতর যদি আমি সত্যি কিছু হয়ে উঠতে পারি, তবে তা হবে তোমার জন্যই।”
ছায়ার ঘ্রাণ
মেঘলা চলে যাওয়ার পরও রুদ্র বেশ কিছুক্ষণ সেই মাটির সূর্যটা হাতে ধরে বসে রইল বারান্দায়। সূর্যের মাঝের ফাঁকা অংশে সে আঙুল ছুঁইয়ে দেখল, যেন সত্যিই বুঝে নিতে চাইছে ভেতরের শূন্যতা কতখানি গভীর। তার মনে হচ্ছিল, মেঘলা কোনো মূর্তি দেয়নি—সে নিজের ভেতরের এক টুকরো আগুন তুলে দিয়েছে ওর হাতে। একটানা তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুদ্র বুঝে গেল—এই মেয়েটিকে নিয়ে সে শুধু কবিতা লিখতে চায় না, বরং তার জীবনের প্রতিটি ছায়া ছুঁয়ে ফেলতে চায়, যতটাই গাঢ় হোক না কেন সেই ছায়ার রং।
সন্ধ্যেবেলা আবার দেখা হলো তাঁদের। শান্তিনিকেতনের মাঠে তখন বাউলদের রেওয়াজ চলছিল। রুদ্র চুপচাপ গিয়ে বসল একটা শিমুল গাছের নিচে। কিছুক্ষণ পর মেঘলা এসে তার পাশে বসে পড়ল। কিছু না বলে। রুদ্র বলল, “আজ তোমার চোখে একটা আলাদা গন্ধ আছে।”
মেঘলা তাকিয়ে বলল, “চোখের আবার গন্ধ হয় নাকি?”
রুদ্র বলল, “যতটা হয় কল্পনার মধ্যে, ঠিক ততটাই। আজ তোমার চোখ ছায়ার মতো গাঢ়, কিন্তু তার মধ্যে একটা সুগন্ধি মেঘ লুকিয়ে আছে।”
মেঘলা একটু হাসল, গলার স্বর ফিসফিসে, “তুমি কবি, আর আমি মানুষ। তুমি ছায়ায় গন্ধ খোঁজো, আমি শুধু খুঁজে ফিরি একটু রোদ।”
হঠাৎ মাঠের এক কোণায় বাচ্চারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। একটার সুতো ছিঁড়ে গেল, আর ঘুড়িটা ঢুকে পড়ল মাঠের পাশের এক গাছের ডালে। রুদ্র উঠে গিয়ে সেটি এনে দিল। মেঘলা অবাক হয়ে বলল, “তুমি তো নরম প্রকৃতির, হঠাৎ এত দৌড় কোথা থেকে এলো?”
রুদ্র মুচকি হেসে বলল, “ভালো লাগা থাকলে শরীরও হালকা হয়ে যায়, মেঘলা। আজকাল মনটাই হাওয়ার মতো উড়ছে।”
মেঘলা কিছু না বলে চুপ করে থাকল। তার বুকের ভিতর যেন কিছু কাঁপছিল। একটা ভয়, একটা অজানা শঙ্কা। সে জানে, এই মানুষটা তার জীবনে এসে আশ্রয়ের মতো হয়ে উঠছে, কিন্তু সেই আশ্রয়েও কি চিরকাল থাকা যায়? তার অতীতের দাগগুলো কি সত্যিই মুছে যাবে? নাকি এই সম্পর্কও একসময় ছায়া হয়ে মিলিয়ে যাবে দুপুরের রোদের মতো?
সন্ধ্যার আলো আস্তে আস্তে মিশে যেতে লাগল আকাশের গায়ে। মেঘলা বলল, “চলো, আজ তোমায় একটা জায়গায় নিয়ে যাই।”
রুদ্র হাঁটা দিল তার পাশে। তারা গিয়ে পৌঁছল শান্তিনিকেতনের বাইরের দিকে, একটা পুরনো পুকুরের ধারে। চারপাশে শালগাছ আর বুনো গাছপালা। পুকুরে চাঁদের আলো পড়ে এক ধরণের কাঁচের মতো চমক তৈরি করছিল। মেঘলা বলল, “এই জায়গাটা আমি ছোটবেলায় আবিষ্কার করেছিলাম। যখন মন খারাপ হতো, এইখানে এসে বসতাম। এই জল আমাকে কখনো প্রশ্ন করেনি, শুধু পাশে ছিল।”
রুদ্র ধীরে ধীরে বলল, “তুমি চাইলে, আমি এই জলের মতোই পাশে থাকতে পারি। কিছু না বলে। শুধু পাশে।”
মেঘলার গলা একটু থমকে গেল। “কিন্তু তোমার ভবিষ্যৎ আছে, রুদ্র। কবিতা, নাম, শহর, স্বপ্ন। আমার মতো কেউ একজন যদি সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে, কী হবে?”
রুদ্র বলল, “ভবিষ্যৎ আমি লিখে ফেলেছি কবিতায়। বাকিটা তোমার ইচ্ছে, আমার কবিতায় থাকতে চাও কি না।”
চুপচাপ পুকুরপাড়ে বসে তারা দু’জন অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল জলে পড়া নীল আকাশের প্রতিচ্ছবির দিকে। হঠাৎ হাওয়া উঠল, আর মেঘলার ওড়না সরে গিয়ে তার চুলের কিছু অংশ সামনে এসে পড়ল। রুদ্র সেই চুল সরিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু হাত বাড়াল না। শুধু চোখ রাখল চোখে। সেখানে একধরনের নীরব স্বীকৃতি ছিল।
রাতের দিকে ফিরে যাওয়ার সময় মেঘলা বলল, “আগামীকাল আমার স্টুডিও বন্ধ থাকবে। একটু বিশ্রাম দরকার। তবু তুমি চাইলে, এসো। কিন্তু কবিতা সঙ্গে আনো।”
রুদ্র মাথা নোয়াল, “কবিতা তো এখন তুমিই।”
রাতটা কাটল রুদ্রের কবিতার খাতায়। সে লিখল—
“ছায়ারও গন্ধ থাকে, যদি মেঘলা নামে কেউ
রোদ পোহায় কষ্টে, আর আমি পাশে শুয়ে থাকি—
একটা শব্দের মতো, যা বলা হয়নি কোনোদিন।”
রোদে ভেজা অনুপস্থিতি
রুদ্র সকালে উঠে দেখল, আজকের রোদ যেন অন্যদিনের তুলনায় বেশি গাঢ়। ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতেই মনে হল, এই আলোতে মেঘলার চেহারা আঁকা যেতে পারে—তার চোখের কোণায় যে ছায়া, তার গালজোড়া মাটির ছোপ, আর ঠোঁটের ফাঁকে যে হাসি অর্ধেক ঝিমোয়, অর্ধেক জেগে থাকে। সে একমুহূর্তও দেরি করল না, খাতার প্রথম পাতায় আজকের কবিতার নাম লিখল—”রোদে ভেজা অনুপস্থিতি”।
স্টুডিও বন্ধ থাকবে জেনেও রুদ্র ঠিক ১০টার মধ্যে পৌঁছে গেল মেঘলার গলির মাথায়। কিন্তু আজ গলিটাও যেন নিস্তব্ধ। কাওকে দেখা গেল না, দোকানগুলো অর্ধেক খোলা, আর মেঘলার ছোট্ট কাজের জায়গাটার ঝাঁপ পুরো নামানো। সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার ভিতরটা যেন ভারী হয়ে উঠছিল। সব কিছু ঠিক আছে তো? মেঘলা তো কখনো এমন করে না। সে ফোন করল না, এসএমএসও পাঠাল না। মেঘলার মতো মেয়েকে বিরক্ত করা মানে, তার ছায়ার মধ্যে হঠাৎ আলো ঢুকিয়ে দেওয়া। তাই সে অপেক্ষা করল।
বিকেল গড়াতে শুরু করল। রুদ্র হাঁটতে হাঁটতে চলে এল শান্তিনিকেতনের মাঠে। আজ সে একা বসে রইল সেই শিমুল গাছটার নিচে, যেখানে তারা একসঙ্গে বসে ছিল কয়েক দিন আগে। হাওয়ার টানে পাতাগুলো উড়ছিল, আর রুদ্র ভাবছিল—কেউ কি সত্যিই কারো হয়ে ওঠে? নাকি শুধু উপস্থিতির অভ্যেসটাই ভালো লাগে?
একটা বাচ্চা এসে জিজ্ঞেস করল, “দাদা, একা বসে আছেন কেন?”
রুদ্র হেসে বলল, “যার জন্য বসে আছি, সে আজ আসেনি।”
ছেলেটা চুপ করে রইল। তারপর একটা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে বলল, “এইটা রাখুন, আমি গেলে কেউ থাকবে না আপনার পাশে।”
রুদ্র পাতাটা হাতে নিয়ে বুঝল—ভালোবাসা শুধু বয়স বোঝে না, উপস্থিতিও বোঝে না। তার একটা ভেতরের গলিঘুঁজির মতো রাস্তা আছে, যেখানে শব্দের দরকার পড়ে না।
সন্ধে নামার ঠিক আগে সে ফিরে এল হোমস্টেতে। বিমলা মাসি তাকিয়েই বুঝলেন কিছু একটা ঘটেছে। বললেন, “আজ ও আসেনি, তাই তো?”
রুদ্র জবাব দিল না, শুধু বলল, “তার না থাকাটা যেন আজ চারপাশে ভাসছে।”
মাসি মাথা নাড়লেন, “ভালোবাসা বলেই তো ওর অনুপস্থিতিও এত গাঢ় লাগে। নয়তো কেউ না থাকলে তো কেবল শুন্যতা থাকে, ব্যথা না।”
রাত্রে খাওয়ার পর রুদ্র চুপচাপ বসে ছিল তার খাতার সামনে। আজ সে কোনো কবিতা লিখল না। লিখল শুধু মেঘলার নাম। বারবার। যতবার লেখে, ততবার অনুভব করে, যেন সে কোথাও একবার তাকিয়ে হাসছে। ঘুমের আগে সে একবার এসএমএস লিখল—
“আজ তোমার না থাকাটাও একটা কবিতা হয়ে গেল। কাল দেখা হবে?”
এসএমএস পাঠিয়ে ফেলে সে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। রাতে হালকা শীত পড়েছে। আকাশে জ্যোৎস্না। হঠাৎ মনে হল, পিছনে একটা শব্দ। সে ঘুরে তাকিয়ে দেখল, দরজার নিচ দিয়ে একটা খাম গড়িয়ে পড়েছে। কেউ এসে গিয়েছে।
রুদ্র তাড়াতাড়ি খামটা তুলে দেখল—হাতের লেখাটা চেনা। খুলে পড়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল।
“রুদ্র,
আজ সারাদিন আমি ইচ্ছে করেই আসিনি। কারণ বুঝতে চেয়েছি—তোমার উপস্থিতির ছায়ায় আমি কতখানি স্বস্তি পাই। আর বুঝেছি, তোমার না থাকায় কতখানি ভয় পাই। তাই এই অনুপস্থিতির মধ্যেই আমি নিজের অনুভব গুছিয়েছি।
কাল সকাল ৯টায় আমি তোমায় নিয়ে যাব, যেখানে সূর্য আর মাটি একসাথে গান গায়।
তুমি আসবে তো?
—মেঘলা”
রুদ্র চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরল। এই অনুভূতি কোনো শব্দে লেখা যায় না। অনুপস্থিতিও তখন হয়ে ওঠে সবচেয়ে ঘন ভালোবাসার স্বর।
সূর্য ও মাটির গান
পরদিন সকাল ৮টা ৪৫। রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিচিত গলির মুখে, একহাতে কবিতার খাতা, অন্য হাতে মাটির তৈরি সূর্যটা। হালকা শীতের মধ্যে একটা টানটান উত্তেজনা, যেন শব্দের আগে কণ্ঠস্বর কাঁপে। মেঘলা ঠিক সময়েই এল। আজ সে একটা হালকা হলুদ-মেঠো রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছে, মাথার চুল খোলা, চোখে এক ধরনের মাটির গন্ধমাখা তৃপ্তি। রুদ্র তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কিছু না বলেই সে মেঘলার পাশে হাঁটতে শুরু করল।
“আজ কোথায় নিয়ে চলেছ?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
মেঘলা হাসল, “এমন এক জায়গায় যেখানে মাটি গান গায়, আর সূর্য শোনে। আমার সবচেয়ে গোপন আশ্রয়।”
তারা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল শান্তিনিকেতনের একটু বাইরের দিকে, যেখানে শহরের গণ্ডি ফুরিয়ে যায় আর শুরু হয় খেতের বুক। সরু কাঁচা রাস্তা, দুপাশে সর্ষে গাছের মাঝে হলুদ ফুল ফোটে, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পুরনো ভাঙা কুটির।
“এই বাড়িটা আমার ঠাকুর্দার ছিল,” মেঘলা বলল। “এখন আর কেউ থাকে না। তবে আমি মাঝে মাঝে এখানে এসে বসি। কবিতা পড়ি না, শুধু মাটির ঘ্রাণ নিই।”
ভেতরে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচা মাটির মেঝে, জানালার পাশে টানা একটা লম্বা বেঞ্চ, আর দেয়ালে একপাশে একটা পুরনো আয়না—যেখানে এখন আর চেহারা দেখা যায় না, শুধু ছায়া ভেসে ওঠে।
“তোমার প্রিয় জায়গা বুঝি?”
মেঘলা মাথা নাড়ল, “প্রিয় আর নিরাপদ—দুই। এখানে কেউ নেই, অথচ এখানে আমি থাকি। নিজের সমস্ত মাটির মতো অনুভব নিয়ে।”
রুদ্র ধীরে ধীরে বলে উঠল, “আজ কি আমি থাকতে পারি তোমার এই মাটির মধ্যে?”
মেঘলা চোখ তুলল। আজ তার চোখে ভয় নেই, ছিল শুধু একরকম প্রশ্রয়। সে বলল, “হ্যাঁ, যদি তুমি প্রতিশ্রুতি দাও যে ছায়া এলেও তুমি পালাবে না।”
রুদ্র তার কবিতার খাতা খুলে পড়তে শুরু করল।
“তুমি যদি হও মাটি,
আমি হবো রোদ।
তোমার উপর পড়ে
নিজেকে প্রতিফলিত করব প্রতিদিন।”
মেঘলার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। “তুমি জানো, আমি আগে কাউকে এসব বলতে পারিনি। ভয় পেতাম—ভেঙে ফেলবে, ফেলে দেবে, চলে যাবে। তুমি পারবে?”
রুদ্র বলল, “আমি পারবো না হয়তো সবদিন। কিন্তু প্রতিদিন চেষ্টা করব তোমায় ঠিকভাবে পড়তে, অনুভব করতে, পাশে থাকতে। ভালোবাসার মতো প্রতিদিন নতুন করে শেখার মতো করে।”
সেই নির্জন কুটিরে, খোলা জানালায় বসে, তারা দু’জন অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল। তারপর হঠাৎ মেঘলা একটা ছোট্ট কাপড় মোড়ানো কিছু দিল রুদ্রকে।
“খুলে দেখো।”
রুদ্র দেখল, সেটি একটি মাটির তৈরি বাঁশি। খুব ছোট, কিন্তু নিখুঁত কাজ।
“এটা আমার বানানো প্রথম জিনিস,” মেঘলা বলল। “যখন আমি বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি গেছিলাম, তখন একা লাগত। সেখানকার আঙিনায় মাটি পেয়ে আমি এটা বানিয়ে ফেলেছিলাম। কেউ জানত না। এবার আমি এটা তোমায় দিলাম।”
রুদ্র কেঁপে উঠল, “তুমি কি তাহলে নিজের অতীতের ছায়াটাও আমার হাতে তুলে দিলে?”
মেঘলা বলল, “না, ছায়া না, বিশ্বাস। এই বাঁশির মতোই—যার শব্দ ছোট কিন্তু গভীর।”
রুদ্র বাঁশিটা হাতে নিয়ে বলল, “আমি জানি না এটা বাজাতে পারব কিনা। কিন্তু যদি কোনোদিন পারি, তাহলে বুঝে নিও, আমি তোমায় নিঃশব্দ ভালোবাসায় ডেকেছি।”
তারা চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। শুধু গাছের পাতায় পাতায় বাতাসের শব্দ। হঠাৎ দূরে কোথাও বাউলের কণ্ঠ ভেসে এল—
“মাটির ভিতর গান বাজে, প্রেম যদি শিখে শুনতে…”
তারা জানত না আগামী দিন কী আনবে। কিন্তু সেই দুপুরে মাটি, সূর্য আর ছায়া একসঙ্গে বসেছিল, আর তাদের ভালোবাসার প্রথম সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি লেখা হয়েছিল নিঃশব্দে, রোদের গায়ে।
একটা চুম্বনের ছায়া
সন্ধে নামার আগে তারা ফিরছিল সেই সরু কাঁচা রাস্তা ধরে, যার দু’পাশে সর্ষে ফুলের সোনালি ঢেউ। রুদ্রর মনে হচ্ছিল, আজ যেন সময় থেমে আছে। মেঘলা মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে রুদ্রর দিকে, আবার হঠাৎ চোখ সরিয়ে নিচ্ছে, যেন কোনো দ্বিধা কাজ করছে তার ভিতরে। হাওয়ায় আজ একটা অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, ঠিক যেমন হয় কোনো গান শোনার আগে, যেখানে প্রথম শব্দটা ঠিক কেমন হবে জানা থাকে না।
মাঠের ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে তারা এসে দাঁড়াল সেই পুকুরের ধারে, যেখানে আগে একবার এসেছিল। এবার পুকুরটা আরও নিস্তব্ধ, আকাশের চাঁদ যেন জলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে।
রুদ্র বলল, “আজ তুমি এত চুপ কেন?”
মেঘলা চোখ নামিয়ে বলল, “কারণ আমি ভাবছি—কোনো সম্পর্কের শুরুটা কখন হয়? প্রথম আলাপ? প্রথম স্পর্শ? না কি…”
রুদ্র থেমে বলল, “…প্রথম চুম্বন?”
মেঘলা তাকাল না, শুধু হেসে বলল, “তুমিই বলো।”
তাদের মাঝখানে একটা পাতার খসখস শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ ছিল না। পুকুরপাড়ে বাঁধা নৌকাটা জলের হালকা ঢেউয়ে দুলছিল। রুদ্র আস্তে আস্তে এগিয়ে এল, মেঘলার সামনে দাঁড়াল, খুব কাছাকাছি। সে বলল, “আমি চাই না, এই মুহূর্তটা নিছক শরীর ছোঁয়ার হয়ে উঠুক। আমি চাই, আমাদের মধ্যে যা আছে, সেটা একটা চুম্বনে জমা থাকুক—নিঃশব্দ, গভীর, প্রতিজ্ঞার মতো।”
মেঘলা তার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে ছিল একসঙ্গে ভয় আর মুগ্ধতা, অতীত আর সম্ভাবনার টানাপোড়েন।
“তুমি নিশ্চিত?”
রুদ্র বলল, “তোমার ছায়ার পাশেই আমি দাঁড়িয়ে আছি, মেঘলা। আলো নয়, ছায়াকে চুম্বন করতেই এসেছি।”
তারা একসঙ্গে এগিয়ে এল। আর ঠিক তখন, পুকুরের ওপার থেকে এক জোড়া শালিক উড়ে গেল। মেঘলার কাঁধে হাত রাখল রুদ্র, আলতো করে, যেন প্রথমবার কোনো ফুল ছোঁয়ার ভয়। তারপর তার ঠোঁট স্পর্শ করল মেঘলার কপাল।
না, ঠোঁটে নয়।
চুম্বনটা ছিল কপালে।
একটা বিশ্বাসের জায়গায়।
মেঘলা চোখ বন্ধ করে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর বলল, “তুমি আমার ভয়টাকে চুমু দিয়েছো রুদ্র, প্রেম নয়। আমি ভুল ভাবছিলাম—প্রথম চুম্বন হয়তো শরীরের কোথাও পড়ে, কিন্তু সবচেয়ে গভীর চুমু পড়ে আত্মায়।”
রুদ্র একটু হাসল, “তাহলে আমি সঠিক জায়গাতেই এসেছি।”
তারা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল মাঠের ধারে। চাঁদের আলোয় মেঘলার চুল উড়ছিল, আর রুদ্রর মনে হচ্ছিল সে যেন একটা জীবন্ত কবিতার মধ্যে হাঁটছে।
তাদের মাঝখানে আর কোনো কথা নেই। শুধু একটা অনুভূতির ছায়া লেগে আছে দু’জনের গায়ে—একটা চুম্বনের ছায়া, যা কোনওদিন স্পষ্ট হয়ে উঠবে না, কিন্তু থাকবে… চিরকাল।
রাত্রে হোমস্টেতে ফিরে রুদ্র আবার খাতা খুলল। আজ সে শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু খালি পাতায় সে একটিই লাইন লিখল—
“তোমার কপালে একটা চুমু রেখে এলাম, ছায়ার মতো। কেউ দেখবে না, শুধু তুমি অনুভব করবে।”
ছায়ার মধ্যে শরীর
রাতের পরদিন সকালে রুদ্র খুব ভোরেই উঠে পড়েছিল। এমনটা সাধারণত হয় না। কিন্তু আজ তার বুকের ভেতরে একটা ধুকধুক শব্দ সকালকেও ছাড়িয়ে গেছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে—দূরের মাঠে হালকা কুয়াশা, আর সেই কুয়াশার ভিতর দিয়ে যেন কেউ হেঁটে আসছে। মেঘলা নয়, সেই অনুভূতিটা। আগের রাতের সেই কপালের চুমু যেন ঘুমের মধ্যে গেঁথে ছিল, আর জেগে উঠে তার শরীর এখন সেই ছায়াকে ছুঁতে চাইছে—না, লালসায় নয়, কিন্তু এক রকম আকুতি নিয়ে।
সে কাপড় পরল দ্রুত, আর কবিতার খাতা না নিয়েই বেরিয়ে পড়ল। আজ কোথাও লেখার নেই, আজ তাকে ছুঁয়ে দেখতে হবে যাকে এতদিন শব্দে আঁকছিল। সে সোজা চলে গেল মেঘলার গলির দিকে। দোকানটা অর্ধেক খোলা। ভিতরে মেঘলা বসে নেই, কিন্তু তার কাজের টেবিলে রাখা আছে আধা-গড়া এক নারীমূর্তি, যার চোখের দিকটা এখনও তৈরি হয়নি।
রুদ্র টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতেই মেঘলা ভিতর থেকে বেরোল। আজ তার গায়ে সাদা রঙের একটা সুতির শাড়ি, চুল খোলা, মুখে কোনো সাজ নেই, কিন্তু চোখে গভীর ঘুম আর কোনো এক অদ্ভুত আলোর প্রতিচ্ছবি।
রুদ্র কিছু বলার আগেই মেঘলা জিজ্ঞেস করল, “আজ তুমি খাতা আনোনি?”
রুদ্র বলল, “আজ লিখতে আসিনি। দেখতে এসেছি, যে ছায়ার মধ্যে আমি এতদিন বেঁচে আছি, সেই ছায়ার শরীরটা ঠিক কতখানি স্পর্শযোগ্য।”
মেঘলা চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তুমি কি চাও আমি তোমায় স্পর্শ করতে দিই?”
রুদ্র এগিয়ে এল, খুব আস্তে, “না। আমি চাই তুমি নিজেই এগিয়ে এসো, যখন মনে হবে আমার শরীর তোমার ছায়াকে ভয় দেখাবে না।”
সেই মুহূর্তে মেঘলার চোখে জল চিকচিক করে উঠল। সে আস্তে এসে রুদ্রর কাঁধে হাত রাখল, তারপর তার বুকের কাছে মুখ গুঁজে দিল। সেই প্রথমবার, তারা একে অপরকে আলিঙ্গন করল—না, কোনো উত্তাপে নয়, বরং এক চূড়ান্ত ক্লান্তির শান্তিতে।
“তুমি জানো,” মেঘলা বলল, “আমি ভেবেছিলাম শরীর মানেই ভাঙন, শরীর মানেই ব্যবহার। আজ তোমার কাছে এসে বুঝলাম, শরীরও ছায়ার মতো কোমল হতে পারে, যদি ভালোবাসা দিয়ে ছোঁয়া যায়।”
তারা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।
তারপর মেঘলা বলল, “চলো, আজ একটা খালি ঘরে বসি, যেখানে শুধু আমি আর তুমি। কোনো শব্দ নেই, কোনো প্রতিশ্রুতিও না। শুধু নিঃশ্বাসের মধ্যে একে অপরকে বুঝে নিই।”
তারা গেল পুরনো কুটিরটার দিকে, যেখানে একসময় তারা মাটি ছুঁয়ে একে অপরকে চিনেছিল। আজ ঘরটা আরও নির্জন, বাতাসও থেমে গেছে। রুদ্র জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ মেঘলা তার পেছনে এসে দাঁড়াল, তার কাঁধে হাত রাখল। রুদ্র ঘুরে তাকাল না। শুধু বলল, “আমি জানি, তুমি এসেছো।”
মেঘলা আস্তে বলল, “তুমি এখনো ভয় পাচ্ছ?”
রুদ্র বলল, “ভয় নয়, শ্রদ্ধা। আমি জানি এই মুহূর্তটা শুধু শরীরের নয়, ইতিহাসেরও। তুমি যেটুকু আমাকে দেবে, সেটুকু আমি আমার সমস্ত কবিতার থেকেও বড় করে রাখব।”
মেঘলা সামনে এসে দাঁড়াল। তারা একে অপরকে দেখল, বহুক্ষণ। তারপর কোনো শব্দ ছাড়াই তাদের ঠোঁট ছুঁয়ে গেল। না, আজ কপাল নয়। আজ প্রেম তাদের ঠোঁটে বসেছিল, ঠোঁট ছুঁয়ে বলেছিল—”তোমরা তৈরি আছো এখন, একে অপরের ছায়া নয়, শরীর হয়ে ওঠার জন্য।”
রুদ্র জানত, এই চুম্বনের মানে শুধু আকর্ষণ নয়। এই চুম্বন হল ভাঙা অতীতের সম্মতির সিলমোহর, একটা নতুন জীবনের মাটি ছোঁয়া সূচনা।
সে রাতে রুদ্র লিখল—
“তোমার শরীরের ভিতর একটুকরো ছায়া আছে,
আর আমার ছায়ার মধ্যে তোমার শরীর।
এই জটিল জ্যামিতি ভাঙে না, কারণ ভালোবাসা রেখা টানে না—জমে থাকে।”
ভোরের আগে ভুল
শান্তিনিকেতনের আকাশে তখনো অন্ধকার, কিন্তু ঘুম ভেঙে গিয়েছে রুদ্রর। রাতটা যেন কেমন ঘুমহীন হয়ে গেছে, অথচ শরীরটা ক্লান্ত নয়। মাথার মধ্যে বারবার ঘুরছে মেঘলার চোখের সেই দৃষ্টিটা—যেটা তারা শেষবার পরস্পরের ঠোঁট ছুঁয়ে দেওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্য ছিল। যেন এক ধরণের বিস্ময় আর তীব্র বিশ্বাস একসঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছিল চোখে। কিন্তু বিশ্বাসের ঠিক উল্টোপিঠেই থেকে যায় ভয়।
রুদ্র জানে, আজ নতুন কিছু শুরু হয়েছে। কিন্তু শুরু মানেই কি শুধু রোমাঞ্চ? না কি শুরু মানেই পুরনো সবকিছুর অস্বস্তিকর স্মৃতি হঠাৎই উঠে আসে?
সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই তার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে মেসেজ—“আজ একটু সময় লাগবে, আমার কাজ আছে। দেখা হবে না। দয়া করে খোঁজ কোরো না।”
মেঘলা।
রুদ্রর বুকটা যেন হঠাৎ একটু চেপে ধরল। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! একদিন আগে তারা ছিল শরীরের সবচেয়ে গভীর জায়গায়, আজ হঠাৎ এমন দূরত্ব?
সে কিছু না বলেই বাইরে বেরিয়ে পড়ল। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল সেই পুরনো পুকুরটার পাশে, যেখানে তারা প্রথম একে অপরের পাশে চুপ করে বসেছিল। কিন্তু আজ সেই পুকুরটাও যেন চুপচাপ নয়, তার নির্জনতা আজ একটু বেশি কর্কশ, একটা শূন্যতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
রুদ্র নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল—সে কি ভুল করেছে? মেঘলা কি সেই চুম্বন, সেই শরীরী স্বীকৃতির জন্য তৈরি ছিল না? তার শরীরের ছায়া কি শুধু দেখা পর্যন্তই ছিল, ছোঁয়ার জন্য নয়? সে কি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে অনুভবের গতিপথে?
এইসব ভাবতে ভাবতেই একটা বাচ্চা এসে দাঁড়াল পাশে। সে আগেও এসেছিল, শিমুল গাছের তলায়। বলল, “আজ আপনি কাঁদছেন কেন?”
রুদ্র কিছু বলল না, কেবল মাথা নাড়ল।
ছেলেটা একটা সর্ষে ফুল এগিয়ে দিল। “যদি কেউ ভুল করে থাকে, ক্ষমা করে দিতে হয়, না হলে তারা আর ফিরে আসে না।”
রুদ্র বুঝল, ছেলেটি কিছু জানে না, কিন্তু তার কথা যেন একটা প্রাচীন সত্যের মতো ধাক্কা দিল। সে উঠে দাঁড়াল। আজ সে খোঁজ করবে না, প্রশ্নও করবে না। আজ সে শুধু অপেক্ষা করবে—যেমন একটা কবিতা অপেক্ষা করে পাঠকের বোঝার জন্য, কোনো জোর ছাড়াই।
সন্ধ্যার একটু পর হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। রুদ্র খোলার আগেই জানত—মেঘলা।
মেয়েটির মুখে ক্লান্তি, চোখে জলের দাগ।
সে আস্তে এসে বলল, “আমার ভয় করছিল, রুদ্র। শরীরের পর, সম্পর্কটা যদি বদলে যায়?”
রুদ্র বলল, “তুমি পালিয়ে গেলে।”
মেঘলা কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ। ভোর হওয়ার আগেই ভুল করে ফেলেছিলাম—ভাবছিলাম, তুমি বুঝবে না। কিন্তু আজ জানলাম, ভোরের আগে যা ঘটে, সেটাও প্রেমের মধ্যেই পড়ে। শুধু আলো আসার আগে তাকে বোঝা যায় না।”
রুদ্র তাকে বুকের দিকে টেনে নিল। তারা কিছুক্ষণ কিছু বলল না। শুধু নিঃশ্বাসের মধ্যে ভুলগুলো মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
রুদ্র বলল, “ভুল করো, কিন্তু পালিও না। কারণ আমি তো আর পালানোর মতো ভালোবাসিনি তোমায়।”
মেঘলা হাসল, “তোমার ভালোবাসায় ছায়াও রয়েছে, আর ছায়ায় সব ভুল ঢেকে যায়।”
সেই রাতে, তারা পাশাপাশি বসে লিখল—
“ভোরের আগে যদি ভুল হয়,
তবুও ভালোবাসা জেগে থাকে,
কারণ সত্যিকারের প্রেম—
ভুলকেও কাঁথা বানিয়ে ঢেকে রাখে,
ভোরের আলো আসার আগ পর্যন্ত…”
দূরত্বের ছায়াবৃত্ত
একটা সম্পর্ক যখন গাঢ় হয়, তখন সেখানে কেবল প্রেম থাকে না—থাকে ভয়, ভুল, ক্ষত আর সবচেয়ে বেশি থাকে—দূরত্বের আশঙ্কা। মেঘলা আর রুদ্র জানে, তারা একে অপরকে ভালোবাসে। জানে, শরীরের ঊর্ধ্বে, ছায়ার গভীরে তারা বাঁধা পড়েছে। তবু, সেই বন্ধনের মধ্যেও হঠাৎ করেই ঢুকে পড়ে একটা অদৃশ্য দূরত্ব, যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু হৃদয়ের মধ্যিখানে ধাক্কা মারে।
রুদ্রর ফিরে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছিল। কলকাতা থেকে মেসেজ আসছিল একের পর এক—মা জিজ্ঞেস করছে ফিরবে কবে, বাবা বলেছে, আর কত দিন এই ‘ছুটির কবিতা’? কিন্তু রুদ্র ফিরতে চায় না। সে বুঝতে পারছিল, শান্তিনিকেতন এখন তার ঠিকানা নয় শুধু—এটা একটা অনুভূতির শহর, যেখানে সে মেঘলার ছায়ায় নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে।
কিন্তু মেঘলা? সে যেন দিনে দিনে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। না, সে কথা কম বলছে না, হাসছে আগের মতোই, চা খাওয়ার কথা বলছে ঠিকঠাক, কিন্তু রুদ্র অনুভব করছে, কোনো এক ভিতরের কক্ষে সে আর নেই।
তারা যখন একসঙ্গে বসে, তখনও মাঝে মাঝে মেঘলা দূরে তাকিয়ে থাকে। রুদ্র প্রশ্ন করলে সে বলে, “কিছু না।” কিন্তু ‘কিছু না’ শব্দটাই এখন সবচেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠেছে।
একদিন রুদ্র বলল, “তুমি পালিয়ে যাচ্ছ আবার?”
মেঘলা একটু থেমে বলল, “না, পালিয়ে যাচ্ছি না। শুধু নিজেকে প্রশ্ন করছি—তোমার চলে যাওয়ার পর আমি কি আবার সেই মাটির ঘরে ফিরে যেতে পারব? এই রোদ, এই ছায়া, এই কপালে চুমু—সবকিছু কি আমার জীবন থেকে আবার মুছে যাবে?”
রুদ্র বলল, “তুমি চাইলে আমি ফিরবো না।”
মেঘলা মাথা নাড়িয়ে বলল, “না রুদ্র, কেউ ভালোবাসার জন্য নিজের ভবিষ্যৎ ছুঁড়ে ফেলে না। তুমি যদি থেকেও যাও, সেটা প্রেম হবে না—হবে পালিয়ে থাকা।”
রুদ্র বুঝল, ভালোবাসার মধ্যেই কখনো কখনো এক ধরণের বলিদান থাকে, যেটা দেখে মনে হয় দূরত্ব, কিন্তু আসলে সেটা এক ধরণের সুরক্ষা—যেন প্রেমটা নিজে থেকেই বাতাসে মিলিয়ে না যায়।
সন্ধ্যেবেলা তারা আবার এল সেই কুটিরে। পুকুরটা নীরব, মাঠে শালপাতা উড়ছে।
মেঘলা বলল, “এই জায়গাটা একটা ছায়াবৃত্ত। তুমি একদিন এসেছিলে, আমার শরীর আর অনুভূতির মাঝখানে বসেছিলে। আজ আমরা আবার এখানে—কিন্তু তুমি চলে যাবে, আর আমি থেকে যাব। দূরত্ব তৈরি হবে না?”
রুদ্র বলল, “তবে আমরা যদি এই ছায়ার মাঝেই ভালোবাসি?”
মেঘলা তাকিয়ে বলল, “ছায়া তো চলে যায়, সূর্য ঘোরে, আলো বদলায়।”
রুদ্র মৃদু হেসে বলল, “কিন্তু প্রতিশ্রুতি যদি ছায়া হয়, সেটা আর চলে না। যেমন আমি প্রতিদিন ভোরে লিখব তোমার কথা, আর তুমি প্রতিদিন সূর্যের নিচে মাটি ছোঁবে—সেখানে আমাদের দূরত্ব একটা ছায়াবৃত্তের মতো হয়ে থাকবে, পুরো নয়, অসম্পূর্ণ নয়—কিন্তু চিরস্থায়ী।”
মেঘলা চুপ করে রইল। তারপর তার মাটির আঙুলগুলো রুদ্রর আঙুল ছুঁয়ে দিল।
“আমরা যদি সত্যি থাকি, তাহলে দূরত্ব আমাদের আলাদা করতে পারবে না। আমি জানি, তুমি আসবে আবার একদিন। আর আমি অপেক্ষা করব সেই দিনটার জন্য।”
রুদ্র বলল, “এই অপেক্ষাটুকু হবে আমাদের ভালোবাসার সবচেয়ে সুন্দর কবিতা।”
তারা দুইজন আবার বসে রইল, ছায়ার মধ্যিখানে। দূরত্ব তখন আর যন্ত্রণা ছিল না—সে ছিল ভালোবাসার এক অপরিহার্য অংশ, যাকে মেনে নিয়েই জন্ম হয় প্রতিশ্রুতির।
নীল বিকেলের প্রতিশ্রুতি
স্টেশন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রুদ্রর হাতে ছিল দুটি জিনিস—একটা ছোট ব্যাগ, আর মেঘলার বানিয়ে দেওয়া মাটির সূর্য। হোমস্টে থেকে বেরোনোর সময় বিমলা মাসি বলেছিলেন, “তোমরা একে-অপরের ছায়ায় থেকো রে, ছায়া যেহেতু সঙ্গে থাকে।”
কিন্তু এই ছায়াও যে এখন একটু লম্বা, একটু ছেঁড়া হয়ে গেছে, সেটা রুদ্র জানে। ট্রেন আসতে এখনও দশ মিনিট। কিন্তু সময় যেন থেমে আছে আজ, শুধু দূরে শালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পরিচিত মূর্তি ছাড়া।
মেঘলা।
সে ধীরে ধীরে হাঁটছিল রুদ্রর দিকে, চোখে ছিল না জল, ছিল না হাসিও—কিন্তু ছিল এক ধরণের নিশ্চিন্ত শূন্যতা, যা তৈরি হয় প্রতিটি নিশ্চিত বিদায়ের ঠিক আগে।
“এসেছো?” রুদ্র বলল, গলা শুকনো।
মেঘলা মাথা নাড়ল, “শেষবার ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম সেই চোখ দুটোকে, যেগুলো আমার ছায়াকে আলো বলে চিনেছিল।”
রুদ্র আস্তে বলল, “তুমি জানো তো, আমি ফিরব?”
মেঘলা বলল, “আমি বিশ্বাস করি না এখন আর ফিরে আসার গল্পে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি প্রতিশ্রুতিতে। আর তুমি আমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে—যে এই ছায়াবৃত্তের মধ্যে থেকেও আমরা একে-অপরকে খুঁজে পাব। সেটাই তো ভালোবাসা নয়?”
পাশে রাখা ব্যাগ থেকে রুদ্র একটা খাম বের করল।
“তোমার জন্য কিছু রেখেছি,” সে বলল।
মেঘলা খাম খুলে দেখল, ভেতরে একটা কবিতার পাতা।
তাতে লেখা—
“তুমি যখন থাকো না, আমি তখন ছায়া ধরে হাটি
পেছনে পড়ে থাকা বিকেলের আলো খুঁজি
প্রতিটি দাগে, প্রতিটি শব্দে।
তোমাকে বলা শেষ হয়নি আমার,
এই রোদে—আমি প্রতিদিন
একটা নতুন কবিতা লিখব—
তোমার অপেক্ষায়।”
মেঘলা চুপ করে কাগজটা বুকের কাছে ধরে রাখল।
“তুমি যদি কোনোদিন ফিরে না আসো?”
রুদ্র বলল, “তাহলে এই কবিতা থাকবে, এই সূর্য থাকবে, আর এই নীল বিকেলটা—যেটা শুধুই আমাদের।”
তারা দুজন জানে, আজকের এই বিদায় চিরতরের নয়, তবুও এমনভাবে বলা হল যেন কোনো চিরদিনের মতোই বলা হচ্ছে।
ট্রেন চলে এলো। হুইসেল বাজল। রুদ্র উঠে দাঁড়াল, মেঘলার চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার যাবতীয় প্রেম রেখে যাচ্ছি তোমার এই চোখের ভিতর। তুমি চাইলেই কোনোদিন কাঁদো না, শুধু বুঝে নিও—তুমি ভালোবাসা পেয়েছিলে, ঠিক যেমনটা কবিতায় লেখা থাকে।”
মেঘলা বলল, “আর আমি রেখে দিলাম তোমার হাতে আমার সমস্ত ভাঙা মাটি, তুমি যদি কখনো ফিরো, তাহলে নতুন করে গড়ো আমাদের, ঠিক আগের মতো নয়, একটু অন্যরকম।”
রুদ্র ট্রেনে উঠে গেল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখল, মেঘলা দাঁড়িয়ে আছে, হাত তুলছে না, চোখ সরাচ্ছে না। তার গায়ের সাদা শাড়ি হাওয়ায় উড়ছে, পেছনে সর্ষে গাছের মাথায় রোদ পড়ছে।
এটাই নীল বিকেল।
এটাই সেই প্রতিশ্রুতি।
যেটা কোনোদিন লেখা হয়নি চিঠিতে, কিন্তু লেখা হয়েছিল চুম্বনে, চোখে, ছায়ার ভিতর।
এটাই ছিল—নীল বিকেলের প্রতিশ্রুতি।
শেষ