Bangla - প্রেমের গল্প

নীল পাহাড়ের ধারে

Spread the love

মেঘলা সেনগুপ্ত


পর্ব ১: কুয়াশার ভেতর প্রথম দেখা

দার্জিলিংয়ের সকালটা যে রকম হতে পারে—একটু কড়া চা, টিনের ছাদের উপর টুপটাপ জল, আর দূরে টাটকা ধোঁয়ার মতো ভেসে থাকা মেঘ—তৃষা ঠিক ওই রকম এক সকালে পাহাড়ে পৌঁছোল। রাতের ট্রেনের ক্লান্তি চোখে গড়িয়ে থাকলেও তার ভেতরে ছিল সেই পুরনো অস্থিরতা—নতুন জায়গা, নতুন আলো, নতুন মুখ। ব্যাকপ্যাকে দুটো লেন্স, একখানা নীল নোটবুক, আর একটা পুরনো স্কার্ফ—ওর মা দিয়েছিল কলকাতা থেকে বেরোনোর আগে—“পাহাড়ে হাওয়া লাগে, গলা ঢেকে রাখবি।” তৃষা মুখে হালকা হাসি টেনে স্টেশনের ভিড় পার হল, বাইরে বেরিয়ে এল কুয়াশার ধোঁয়াটে পর্দা ভেদ করে।

তার বুক-পকেটে লিখে রাখা ছিল একটি নাম—“অভয় শেরপা”—স্থানীয় গাইড। হোয়াটসঅ্যাপে তিনবার কথা হয়েছে, লোকটা বেশি কথা বলে না। শুধু লিখেছিল—“আপনি আসার দিন সকাল নয়টায় ঘড়ি টাওয়ারের কাছে থাকব। সব ঠিক করে রেখেছি।” পাহাড়ের লোকের কথায় এক ধরনের সংযম থাকে, তৃষা ভেবেছিল, হয়তো ভালোই, বেশি কথা বলা মানুষকে সে তেমন বিশ্বাস করে না।

ঘড়ি টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে তৃষা দেখল কুয়াশা সিঁড়ির মতো নেমে এসেছে পাহাড়ের গায়ে। হঠাৎই কেউ খুব শান্ত গলায় বলল, “তৃষা?” সে ঘুরে তাকাল—মাঝারি উচ্চতা, তামাটে রং, বয়স তিরিশের কাছাকাছি, চিবুকে হালকা দাড়ি, চোখ দুটো আশ্চর্য শান্ত। কাঁধে পুরনো খাকি ব্যাগ, গলায় রঙচটা উলের মাফলার। অভয় হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি অভয়। চলুন, কুয়াশা ঘন হলে সকালটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

তৃষা হাসল—“সকাল কি নষ্ট হয়? আলো তো তখনই থাকে, শুধু আমরা দেখি কি দেখি না।” অভয় মাথা নাড়ল—“ঠিকই বলেছেন। তবে প্রথমে চায়ের দোকান—আপনার ট্রেনের ধকল গেছে কি?” ওরা দুজন চলে গেল রাস্তার মোড়ের ছোট চায়ের দোকানে। কাঁচের ভেতরে বিস্কুট, দেওয়ালে শ্যামাপ্রসাদের ক্যালেন্ডার, আর দরজার কাছে গরম রুটি সেঁকে দেওয়ার গন্ধ। দোকানদার মৃদু নেপালি উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল—“ম্যাডাম, মিল্ক টি না লেমন?” তৃষা বলল—“মিল্ক।” অভয় যোগ করল—“স্ট্রং, কম চিনি।” তৃষা তাকিয়ে বলল—“আপনি কী করে জানলেন?” অভয়ের হালকা হাসি—“স্টেশনে নেমে যেভাবে হাঁটছিলেন, বুঝলাম ক্লান্তি আছে কিন্তু তাড়াও আছে। স্ট্রং চাই।” তৃষা মাথা নাড়ল—লোকটা পর্যবেক্ষণ করতে জানে।

চা এল। প্রথম চুমুকেই তৃষা বুঝল পাহাড়ি দুধচা শহরের চা থেকে আলাদা—গায়ে একটা নরম উষ্ণতা থাকে। অভয় বলল, “আজ আমরা লেপচা জওয়ারের পুরোনো ট্রেইলটা নেব, ভিড় কম, কুয়াশা নামলে ছবিতে সুন্দর টেক্সচার আসে।” তৃষা কৌতূহলী—“আপনি কি ফটোগ্রাফি জানেন?” অভয় চুপ করে থাকল একটু, তারপর বলল—“জানি না, তবে আলো কখন বদলায়, বুঝি। আমার বাবা পাহাড়ে কাঠ কাটত, তিনি বলতেন—আলো বদলালে পাখিরা পথ চিনে ফেলে।”

দোকানের বাইরে তখন কুয়াশা ধীরে ধীরে ঘন হচ্ছে। গলির ভিতর থেকে কয়েকটা বাচ্চা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল—কারও হাতে ঘুড়ি, কারও হাতে বাঁশির মতো খেলনা। তৃষা ক্যামেরা তুলল, ফোকাসের ভিতর এক বাচ্চার চোখ পড়তেই ও চাপ দিল শাটার। কুয়াশার ভিতর চোখ দুটো ঝিলিক দিল। “সুন্দরের প্রতি মানুষের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল নীরবতা,” ওর নীল নোটবুকে এমনই একটা বাক্য লিখে রেখেছিল সে। আজ মনে পড়ল, আর মনে হল—এই নীরবতার সাথেই তো পাহাড়ের পরিচয়।

পথঘাট ধরে যখন ওরা উঠতে শুরু করল, মেঘ যেন সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে নেমে আসছিল। পাইনগাছের পাতা ভিজে, পায়ের নীচে ঠাণ্ডা মাটি। অভয় সামনে, তৃষা একটু পিছনে, মাঝে মাঝে দুজনের ছায়া কুয়াশায় লম্বা হয়ে যাচ্ছে। তৃষা জিজ্ঞেস করল—“তুমি কতদিন ধরে গাইড?” অভয় বলল—“সাত বছর। তার আগে কাঠের কাজে ছিলাম। শহরে গিয়েছিলাম একবার, কিন্তু পাহাড় ফিরিয়ে আনল।” “শহর কেন ছেড়েছিলে?”—তৃষা জানতে চাইল। অভয়ের কণ্ঠ নিস্তব্ধ—“শহরের ভিড়ে মানুষ একা হয়ে যায়।”

তৃষা কোনো কথা বলল না। কখনও কখনও নীরবতা প্রশ্নের থেকেও দূর যায়। পাহাড়ের মোড়ে এসে অভয় থামল—“এখানে দাঁড়ান, কুয়াশা একটু খুললেই নীচের ভ্যালির ছাদ দেখা যাবে। বামদিকে একটা পুরোনো কাঠের সেতু—ওখানে গেলে ফ্রেমটা ভালো পড়ে।” তৃষা যেন মন্ত্রবলে ক্যামেরা তুলল। কুয়াশা আচমকা সরল, নীচে ছাদগুলোর টিনের রেখা, দূরে গিরিখাতের একটা ঝাপসা রেখা, আর মাঝখানে সেতু—যেন ভূতের মতো দাঁড়িয়ে। শাটার—টিক, টিক, টিক—ধ্বনি যেন পাহাড়ের নীরবতায় হারিয়ে গেল।

“আপনি ফ্রেমে মানুষ রাখেন না?”—অভয় জিজ্ঞেস করল। তৃষা বলল—“মানুষ থাকলে মানুষকেই দেখি। মানুষ না থাকলে জায়গাটার মেজাজ ধরা পড়ে।” অভয় মাথা নাড়ল, কিন্তু তার চোখ যেন অন্য কিছু খুঁজছে। সে বলল—“তবু কখনও কখনও জায়গার মেজাজ ধরতে মানুষই দরকার। আপনি চাইলে… আমি সেতুতে দাঁড়াতে পারি?” তৃষা একটু হাসল—“তুমি মডেল?” অভয় গম্ভীর—“না, আমি পথ। আপনি যে জায়গায় পৌঁছতে চান, তার একটা খসড়া।” তৃষার বুকের ভিতর তখন হালকা ঝিরঝিরে বাতাস। সে বলল—“যাও, দাঁড়াও।”

অভয় সেতুর মাঝ বরাবর দাঁড়াল। এক পা একটু সামনে, কাঁধে ব্যাগ, মুখটা বামদিকে, যেন দূরের শব্দ শুনছে। কুয়াশা প্রায় সাদা পর্দা টেনে দিল, আর তৃষা শটে ধরে ফেলল—“মানুষের নীরবতা”। ছবিটা তোলার পর ওর মনে হল—এই মুহূর্তটা যেন কোথায় আগে দেখা। ডেজা ভু? নাকি পাহাড়ের অভ্যাস—লোককে মনে করিয়ে দেওয়া, তুমি আগে এসেছিলে?

দুপুরের দিকে একটু রোদ দেখা গেল। তারা একটা খোলা জায়গায় বসল, অভয় ব্যাগ থেকে লুচি-আলুরদম বের করল। “মা বানিয়ে দিয়েছেন,” সে বলল, “আপনি না খেলে আমার মার খেতে হবে।” তৃষা হাসল, গরম আলুরদমের গন্ধে তার পেট কেমন যেন নরম হয়ে গেল। খেতে খেতে অভয় জিজ্ঞেস করল—“আপনি কেন ফটোগ্রাফার?” তৃষা একবুক নিঃশ্বাস নিয়ে বলল—“কোনো কিছু থামাতে পারি না বলে। ছবি এক সেকেন্ডের ভিতর একটা সেকেন্ডকে আটকে দেয়। আমার জীবনে কয়েকটা মুহূর্ত আছে—আমি সেগুলো থামাতে চেয়েছিলাম, পারিনি। তাই এখন আলো থামাই।” অভয় চুপ করে শুনল। তারপর বলল—“কিছু থামানো যায় না, কিন্তু মনে রাখা যায়। পাহাড় তাই তো করে—বহুদিনের তুষার ধরে রাখে।”

পথ নেমে আসছিল আর হালকা রোদ ঝরছিল গাছের ডাল বেয়ে। হঠাৎ দূর থেকে বাঁশির মতো এক শব্দ এল—কোথাও একটা লোক পাহাড়ি সুর বাজাচ্ছে। তৃষার মনে হল, এই সুরটা যেন কোন পুরোনো গল্পের দরজা খুলে দিচ্ছে। “ওই সুরটা?”—সে জিজ্ঞেস করল। অভয় বলল—“বড়দের গান। শীত পড়লে গ্রামে বাজে। আজকে একটু আগে এসেছে।” “তুমি কি গান জানো?”—তৃষা জানতে চাইল। অভয় হেসে বলল—“গানকে চিনি, গাই না।”

বিকেলে ওরা চৌরাস্তায় ফিরল। কুয়াশা প্রায় সরে গেছে, দোকানগুলো খোলা, পর্যটকদের ভিড়। তৃষা একটা ছোট দোকান থেকে পাহাড়ি নেকলেস কিনল—নীল পাথরের, খুব সাধারণ। অভয় বলল—“সেটা আপনার গলায় মানাবে।” তৃষা বলল—“দেখছ তো, গলায় এখনও মায়ের স্কার্ফ।” অভয়ের চোখে এক মুহূর্তের জন্য খুব কোমল আলো পড়ে গেল—যেন পাহাড়ের সূর্য ডুবে যাবার আগে একটু থামে। “মায়েরা পাহাড়ের মতো,” সে বলল, “দূরে থেকেও পথ দেখায়।”

সন্ধ্যা নামল। তৃষা লজে ফিরল, কাঠের ঘরে চুপচাপ শীত ঢুকছে। সে ব্যাগ থেকে নীল নোটবুক বার করে আজকের দিনটা লিখতে শুরু করল—“পাহাড়ের প্রথম সকাল। একজন লোকের সাথে দেখা—নাম অভয়। চোখ শান্ত, কথায় কম। সেতুতে দাঁড়ানো তার ছবিটা আজকের সেরা। মনে হল, এই লোকটা পথ চেনে, আর আমি পথ খুঁজি।” লিখতে লিখতে তার মনে পড়ল, শহরে কেউ অপেক্ষা করছে না, ফোন তেমন বাজে না, তবু আজ কেমন যেন পূর্ণতা। জানলার বাইরে পাহাড়ি রাত নামছে, দূরে কুকুর ডেকে উঠল, কেউ কোথাও বাঁশি বাজাচ্ছে।

দরজায় ধাক্কা। তৃষা চমকে উঠে উঠে দরজা খুলতেই দেখল—অভয় দাঁড়িয়ে। হাতে একটা ছোট কাগজের ব্যাগ। “আপনার স্কার্ফটা দুপুরে পড়ে গিয়েছিল, দোকানের বেঞ্চে। আমি নিয়ে এলাম।” তৃষা অবাক—“তুমি কেমন করে বুঝলে আমার?” অভয় মৃদু হেসে বলল—“নীল রং আর পাতলা উলের গন্ধ। আপনাকে ছাড়া মানাচ্ছিল না।” তৃষা স্কার্ফটা হাতে নিয়ে বলল—“ধন্যবাদ।” অভয় মাথা নাড়ল—“কাল সূর্য ওঠার আগে রওনা দেব। টাইগার হিলের পথে একটা জায়গা আছে—সেখানে আলো প্রথমে গাছের কাঁধে নামে। আপনি চাইলে… আরো ভালো ছবি হবে।”

তৃষা তাকিয়ে রইল, দরজার ফাঁকে কুয়াশা এসে থামল। “কাল,” সে শুধু এইটুকু বলল। অভয় সিঁড়ি নেমে গেল। তৃষা দরজা বন্ধ করে স্কার্ফটা গলায় জড়াল। আয়নায় নিজের মুখে কেমন যেন অপরিচিত শান্তি দেখল—হয়তো পাহাড়ের, হয়তো কারও চোখের। জানলার বাইরে নরম রাত, আর মনে হল—পাহাড়ে কোনো কোনো দিন প্রথম দেখাই হয়তো দ্বিতীয় জন্ম।

কাগজের ব্যাগটা খুলে দেখল—ভেতরে একটা ছোট নীল পাথর। সঙ্গে একটা কাগজে খসখসে হস্তাক্ষর—“পাহাড়ে পথ হারালে, নীল পাথরটা হাতে রাখবেন। আলো নেমে আসবে।” তৃষা হাসল—এতটুকু উপহারই বেশ। সে নোটবুকে লিখল—“কুয়াশার ভেতর এক লোকের সাথে দেখা। নাম অভয়। পথ দেখাতে জানে। আজ আমি তাকে ফ্রেমে রেখেছি, কাল সে আমাকে আলোয় রাখবে।”

রাত গভীর হলে কুয়াশা জানলার কাচে একটু ভিজে সুর তুলল। তৃষা চোখ বন্ধ করল, আর ভাবল—কালকের আলো ঠিক কোথায় নামবে?

পর্ব ২: সূর্য ওঠার আগে যে আলো নামে

আলোর আগেই পাহাড়ে আলো নামে—এই কথাটা তৃষা আগে কখনও বোঝেনি। সকাল চারটের একটু পরে, যখন লজের বাইরের হিমেল বাতাস জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকছিল, তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে সবটাই অন্ধকার, তবুও দূর পাহাড়ের কাঁধে কেমন একটা ছায়া নড়ছে। সে বোঝে, অভয় আসবে, ঠিক করে বলেছিল—“সূর্য ওঠার আগে রওনা দিতে হবে।”

তৃষা গরম জামা, স্কার্ফ, আর ক্যামেরা গুছিয়ে নিচে নেমে এলো। বাইরের গেটের সামনে অভয় দাঁড়িয়ে, হাতে একটা থার্মোস আর চোখে চিরচেনা সেই শান্তি। “চা এনেছি, পথ লম্বা,” সে বলল। তৃষা একটা হালকা হাসি দিল—এই লোকটা যেন বুঝে ফেলে, কখন কী লাগে।

তারা দুজনে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। প্রথমে কুয়াশা ছিল ঘুমন্ত, একটু পর ঘন হতে শুরু করল—যেন কারও নিঃশ্বাসে বৃষ্টি জমেছে। অভয় চুপ করে হাঁটছিল, মাঝে মাঝে পেছনে ফিরে তৃষার দিকে তাকাচ্ছিল, সে পড়ে আসছে কিনা। তৃষা একবার জিজ্ঞেস করল—“তুমি কি সব ট্রেকারের সঙ্গে এতটা সাবধানে চল?” অভয় থেমে বলল—“না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যাই, কিন্তু সবাইকে ফিরিয়ে আনার ইচ্ছে জাগে না।”

তৃষার গলায় গরম চা গিয়ে নরম একটা অনুভূতি ছড়িয়ে দিল। সে কিছু না বলে হাঁটতে লাগল, অভয়ের কথাটার ওজন তার ভেতরে গিয়ে বসে রইল।

টাইগার হিলের রাস্তায় তখনও আলো নামেনি, কিন্তু আকাশের পূর্ব দিগন্তে ধীরে ধীরে একটা গাঢ় নীল রেখা গজিয়ে উঠছিল। অভয় বলল—“আর দশ মিনিট, তারপর জায়গাটা আসবে।” তারা এবার একটু দ্রুত হাঁটল, পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে আলোটা যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

একটা ঢালু ঘাসভরা জায়গায় অভয় থামল। সামনের পাহাড়ের গা ঘেঁষে মেঘ আর অন্ধকারের মাঝে একটা ছোট সমতল এলাকা—সেখানেই তারা দাঁড়াল। “এখান থেকেই আলো নেমে আসে,” সে বলল, “তবে ক্যামেরা তৈরি রাখবেন, মুহূর্তটা চট করে কেটে যায়।”

তৃষা ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করল। তার নিঃশ্বাস ভেতরে জমে আছে—আলো আসার অপেক্ষায়। হঠাৎ অভয় বলল—“আপনি কি একা ঘোরেন সবসময়?”
তৃষা বলল—“হ্যাঁ, একাই। সঙ্গ নেওয়া বা রাখা—এটা শহরে জটিল। কখনও কখনও মানুষ চাই না, শুধু কিছু আলো, কিছু শব্দ, আর আমার ক্যামেরা।”
অভয় তাকাল তার দিকে, বলল—“কিছু সম্পর্ক হয়তো শব্দ ছাড়াই তৈরি হয়। যেমন এই আলোটা, রোজ আসে, কাউকে কিছু না বলে।”

আলোর প্রথম রেখা তখন পাহাড় ছুঁয়ে নামছে। ধীরে ধীরে রোদটা গাছের পাতায় খেলা শুরু করল, আর তারপর নেমে এল ঢালে—যেখানে তৃষা আর অভয় দাঁড়িয়ে। ক্যামেরার লেন্সে ভেসে উঠল সেই মুহূর্ত, যেন পৃথিবী ঘুরে এসে আবার ঠিক এই জায়গাটাতে থেমে গেছে।

তৃষা একটার পর একটা শট নিচ্ছিল, অভয় কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখে হালকা আলো পড়েছিল, আর তৃষার মনে হল—এই আলো শুধু সূর্যের নয়, এই আলো যেন কারও ভেতরেরও।

“তোমার চোখে অদ্ভুত শান্তি,” হঠাৎ তৃষা বলল, ক্যামেরা নামিয়ে।
“তুমি সেটা খুঁজতে এসেছ?” অভয় জিজ্ঞেস করল।
“হয়তো,” তৃষা উত্তর দিল। “অথবা শান্তির একটা ছবি তুলতে।”

অভয় হেসে বলল—“যে শান্তি ক্যামেরায় ধরা পড়ে, সেটা অনেক সময় চোখের ভিতরের নয়।”
“তোমার ভেতরের?”
“সে কথা বলব না। হয়তো তুমি নিজেই একদিন বুঝে যাবে।”

পাহাড়ের নিচে তখন ঘুম ভাঙছে। পাখির ডাক, গরুর ঘণ্টার শব্দ, আর দোকানের শাটার খুলছে—এক এক করে। তারা নিচে নামতে শুরু করল। অভয় বলল—“কাল আমরা কালিম্পং যাব যদি তুমি চাও। এক জায়গা আছে, যেখানে মেঘ ধরা যায় হাতে।”
“তুমি কিভাবে মেঘ ধরা শেখালে?”
“শেখানো যায় না, শুধু সঙ্গে যেতে হয়। বাকিটা মেঘ ঠিক করে নেয়।”

তৃষা এবার একটু অবাক—এই লোকটা কখনও গাইডের মতো কথা বলে না, যেন নিজের ছায়াকে নিয়ে হাঁটে, আর আমন্ত্রণ জানায় তার ছায়ায় হাঁটতে।

লজে ফিরে এসে তৃষা নিজের নোটবুক খুলে লিখল—
“আজ একটা আলো দেখলাম, যা সূর্য ওঠার আগে নামে। একটা মানুষ দেখলাম, যার কথা কম, কিন্তু যার চোখে পাহাড়ের মতো গাম্ভীর্য আছে। মনে হয়, ছবির ভেতরে ধরা পড়েছে না পড়েনি, তার চেয়ে বড় কথা, আজ আমি নিজে একটু ধরা পড়ে গেছি কারও চোখে।”

চালিয়ে যাব? পর্ব ৩-তে যাব আমরা কালিম্পংয়ের পথে—যেখানে পাহাড়ের নীরবতা একটু বেশি স্পষ্ট হয়, আর তৃষা ও অভয়ের মাঝে জন্ম নেয় কিছু অজানা অনুভূতি।

পর্ব ৩: কালিম্পংয়ের পথে, যেখান থেকে মেঘ নামে

তৃষা ঠিক আগের রাতেই বুঝেছিল, অভয়ের কথায় একটা তল আছে—যা একবার বোঝা গেলে ফিরতে কষ্ট হয়। সেই কারণে সকালবেলা যখন সে কালিম্পংয়ের পথে রওনা দিল, তার মনে একটা মৃদু ধকধক করছিল—যেন সে নিজেই জানে না, সে কোথায় যাচ্ছে, কেবল কার সঙ্গে যাচ্ছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

রাস্তা ছিল ধীরে উঠে যাওয়া, পাহাড়ের কোল বেয়ে। অভয় জানত কোন বাঁক পেরিয়ে কোথায় ঠাণ্ডা বেশি পড়ে, কোথায় চা পাওয়া যাবে, কোন গাছটা শীতের ভেতরেও ফুল দেয়। তৃষা অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিল—লোকটা যেন শুধু পাহাড়ের গাইড নয়, গাছের গন্ধ, বাতাসের শব্দ, আর আলোর মেজাজও তার সঙ্গী।

“এই পথটা তোমার খুব পরিচিত মনে হয়,” তৃষা বলল, পাথরের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে।
“এই পথে একবার খুব আপন কাউকে হারিয়েছিলাম,” অভয় বলল, একটুও গলার সুর না বদলে।
তৃষা থেমে গেল। “হারিয়েছিলে?”
অভয় হেসে বলল—“তুমি ঠিক বুঝছ না। হারানো বলতে মৃত্যু নয়, বরং এমন হারানো, যেখানে মানুষটা রোজ সূর্যের মতো ফিরে আসে, কিন্তু ছোঁয়া যায় না।”

তৃষার মুখে আর কোনও প্রশ্ন এলো না। সেই মুহূর্তে পাহাড়ের নিস্তব্ধতাটা তাদের দুজনের মাঝখানে এক অলিখিত ব্যথা হয়ে দাঁড়াল।

দুপুর নাগাদ তারা পৌঁছল এক ছোট গ্রামের ধারে, যেখানে পাহাড়ের ধাপগুলোর মধ্যে গুটিকয়েক কাঠের ঘর ছড়িয়ে ছিল। দূরে একটা টিলা, যার গায়ে সাদা পতাকা নড়ছে—তৃষা জানত, ওগুলো প্রার্থনার চিহ্ন।

অভয় বলল—“এখানে একটা স্পট আছে, মেঘ মাঝে মাঝে এখানে থেমে দাঁড়ায়।”
তারা উঠতে শুরু করল টিলার দিকে। গাছপালা কমে আসছিল, বাতাস ছিল কাঁচের মতো ঠাণ্ডা, আর প্রতিটা নিঃশ্বাসে ছিল ইউক্যালিপটাসের ঘ্রাণ। হঠাৎ করেই একজায়গায় দাঁড়িয়ে অভয় বলল—“এখানেই।”

তৃষা তাকিয়ে দেখল—একটা খোলা টিলার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে তারা, আর সামনেই নেমে যাচ্ছে বিশাল এক খাঁদ। নিচে যেন মেঘ জমে আছে, সাদা তুলোর মতো। তৃষা ক্যামেরা তুলল, কিন্তু লেন্স থেকে চোখ না সরিয়ে বলল—“এটা কেমন জায়গা? এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আমি যেন ঠিকঠাক মানুষ না, বরং কোনও সুর হয়ে গেছি।”
অভয় বলল—“এই জায়গাটা আসলে শূন্যতা। যার পাশে দাঁড়ালে কেউ নিজেকে খুঁজে পায়, বা হারিয়ে ফেলে।”

তৃষা ছবি তুলছিল, অভয় তখন তাকে দেখছিল—এই মেয়েটা, যার চোখে এত আলো, অথচ নিজের ভেতরকার আঁধারকে ঢাকতে গিয়ে যেন কিছু জিনিস ছুঁয়ে ফেলতে চায়, কিন্তু সাহস পায় না।

“তুমি সবসময় আলো ধরতে চাও,” অভয় হঠাৎ বলল।
“হ্যাঁ,” তৃষা বলল। “আলো ছাড়া আর কিইবা থাকে?”
“ছায়া,” অভয় বলল। “যেটা সবসময় সঙ্গে থাকে, কিন্তু কেউ দেখে না।”

একটা দীর্ঘ নীরবতা। তারপর অভয় ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করল। “তোমার জন্য কিছু এনেছিলাম।”
তৃষা কৌতূহলী চোখে তাকাল। কাগজটা ছিল ভাঁজ করা। খোলার পর তাতে আঁকা ছিল মেঘের গায়ে এক তৃষ্ণারত মুখ—ছায়া আর আলোতে গড়া।
“এটা কে এঁকেছে?”
“আমি,” অভয় বলল। “একবার এক মেয়ে বলেছিল—সে মেঘ ছুঁতে চায়, কিন্তু জানে না কোথা থেকে শুরু করবে। আমি ভাবলাম, যদি মেঘ তার দিক থেকে এগিয়ে আসে?”

তৃষা চুপ করে গেল। তার গলার কাছে কিছু আটকে ছিল—যে অনুভূতির নাম হয়তো এখনও সে জানে না।

নীচে মেঘ তখন ধীরে ধীরে সরছে। সে তাকিয়ে দেখল—আলো পড়ছে পাহাড়ের গায়ে, আর ঠিক সেই আলোয় অভয়ের মুখটা যেন কোথাও থেকে আলাদা হয়ে পড়ছে, বাস্তবের চেয়েও বেশি স্পষ্ট।

তৃষা বলল—“তুমি কি কখনও কাউকে ভালোবেসেছিলে?”
অভয়ের উত্তর এলো ধীরে—“হ্যাঁ। কিন্তু ভালবাসা সবসময় উত্তর চায় না। কখনও কখনও সে শুধু চায় কেউ তাকে চোখে চোখ রেখে চুপ করে দেখুক।”
তৃষার ঠোঁটে একটুকরো কাঁপা হাসি।
“তাহলে আমি এখন চুপ করেই থাকি?”

অভয় কোনও কথা বলল না। ওরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল, বাতাসে উড়তে থাকা প্রার্থনার পতাকার নীচে, মেঘের সামনে।

ফিরতি পথে তৃষা কোনও ছবি তুলল না। সে বলল—“আজকের ছবিগুলো আমার চোখেই থাক। ক্যামেরা না থাকলেও কিছু জিনিস মুছে যায় না।”
অভয় হালকা মাথা নাড়ল—“হয়তো এই ছবিগুলোরই কোনও ক্যাপশন নেই, শুধুই অনুভূতি।”

লজে ফিরে এসে তৃষা তার নীল নোটবুকে লিখল—
“আজ মেঘ ছুঁতে গিয়েছিলাম, কিন্তু মেঘের থেকেও বেশি ছুঁয়ে গেল এক চুপচাপ মানুষ। তার আঁকা একটা মুখ, তার বলা একটা বাক্য, আর তার চোখের ছায়া—যা কিছু বলা হয়নি, সেগুলোই আজ বেশি মনে পড়ছে। আলো তোলা সহজ, কিন্তু ছায়া… ছায়া তোলা কঠিন।”

পর্ব ৪: সেইসব শব্দ, যেগুলো বলা হয় না

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করল। পাহাড়ি আলোয় রঙ বদলে গেল দিগন্তের রেখা, জানলার ধারে বসে তৃষা অনুভব করছিল যেন কোনও কিছু ধীরে ধীরে ভিতরে জমে উঠছে—একটা অদৃশ্য অনুভূতি, যার কোনও নাম নেই, সংজ্ঞা নেই, শুধু একটা স্পষ্ট অস্তিত্ব আছে।

অভয়ের সঙ্গে আজকের ট্রেক—ছায়া, মেঘ, আর সেই ছবিটা—সব মিলে যেন একটা দূরের গল্পের মতো মনে হচ্ছিল, অথচ বাস্তব। তৃষা লজের কাঠের বারান্দায় বসে ক্যামেরা তুলল না, ফোনে স্ক্রল করল না, শুধু বাতাসে কান দিল। বাতাসেই মাঝে মাঝে কেউ ফিসফিস করে—তেমনই মনে হয়।

“আনুমানিক আটটায় ডিনার হবে, ম্যাম,” লজের ছেলেটা এসে জানাল।
তৃষা মাথা নাড়ল—“ধন্যবাদ। আমাকে আপনি না বললেই চলবে। নাম তৃষা।”
ছেলেটি চলে গেলে সে ভাবল, অভয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় এমন কোনও সম্মানসূচক দূরত্ব কখনও তৈরি হয়নি। দুজনেই যেন কোনও অদৃশ্য ঘর ভাগ করে নিচ্ছে—যার জানালা খোলা, কিন্তু দরজা এখনও অর্ধেক বন্ধ।

হঠাৎ করেই দরজায় টোকা।
তৃষা উঠে দরজা খুলল—অভয়। একহাতে ফ্লাস্ক, অন্য হাতে একটা ছোট হরমোনিয়ামের ব্যাগ।
“গান জানো না তো?”—তৃষা মৃদু মজা করল।
অভয় বলল—“জানি না। বাজাই। মাঝে মাঝে। আজ তোমার কথা মনে পড়ছিল, তাই ভাবলাম একটা সুর বাজাই, যদি তুমি শোনো।”
তৃষা একটু থেমে বলল—“ভেতরে আসো।”

কাঠের ঘরের কোনে একটা ছোট কার্পেটের ওপর বসে পড়ল অভয়। হরমোনিয়ামটা খুলল, ধীরে হাত ছোঁয়াল রিডে। এক ধরনের নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা যেন সেই মুহূর্তে গড়ে উঠল—এই রাতে, এই আলোয়, এই দুটি মানুষের ভেতরে।

সুরটা নরম ছিল, পাহাড়ি লোকগানের মতো, কিন্তু ভেতরে যেন রাগদারীতার ছায়া। তৃষা জানল না, গানটার নাম কী, কোথা থেকে এসেছে, তবে সে বুঝতে পারল—এ গান কারও জন্য বাজানো, সে কেউ আজ নেই, কিন্তু কেউ আজও আছে।

অভয় চোখ বন্ধ করে সুরে ডুবে ছিল। তৃষা তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করে তার মনে হল, এই মানুষটা একেকটা শব্দের মধ্যে যেসব না বলা কথা লুকিয়ে রাখে, সেগুলো বুঝতে হলে কেবল কান নয়, হৃদয়কেও প্রস্তুত করতে হয়।

গান শেষ হল। ঘরে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর অভয় বলল—“তুমি জানো, কিছু গান আসলে শ্রোতার জন্য নয়, গায়কের নিজের মন ঠান্ডা করার জন্য।”
তৃষা মাথা নাড়ল—“তুমি কি আজ মন ঠান্ডা করছিলে?”
“হয়তো,” অভয় মৃদু হাসল। “হয়তো আমি চাইছিলাম, কেউ আমার না বলা কথাগুলো শুনে ফেলুক, গান হয়ে।”

তৃষার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল—“আমি শুনেছি।”

এই এক মুহূর্তে সবকিছু বদলে গেল। বাইরের বাতাস থেমে গেল, কাঠের ঘরের ছাঁদ যেন একটু নিচে নেমে এল, আর তাদের মাঝখানে ছিল না আর কোনও নীরবতা—ছিল শব্দ ছাড়া একটা স্বীকৃতি।

“তোমার ভিতরে এমন কী আছে, যা কেউ জানে না?”—তৃষা ধীরে জিজ্ঞেস করল।
অভয়ের চোখ কাচের জানালার বাইরের মেঘে। “একটা ভাঙা প্রতিশ্রুতি,” সে বলল, “যা আমি কাউকে দিইনি, কিন্তু আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”
“তোমার গল্প আছে?”
“সবাইর গল্প থাকে, কেউ বলে, কেউ বাজায়, কেউ ছবি তোলে।”
তৃষা সোজা হয়ে বসল। “তোমার গল্প যদি শোনার জন্য কেউ না থাকে?”
“তবে পাহাড়ে বলি। বাতাসে। মেঘে। তারা শুনে ফেলে।”

সেই মুহূর্তে যেন তৃষার গলা শুকিয়ে এল। কিছু একটা বলতে চাইল, পারল না। সে শুধুই তাকিয়ে রইল অভয়ের চোখে—যেখানে একটা পাহাড়ের মতো স্থিরতা, আর একটা নদীর মতো প্রবাহ ছিল।

হঠাৎ অভয় উঠে দাঁড়াল—“আমি যাই। কাল সকালে একটা জায়গায় নিয়ে যাব—তুমি যে আলো খুঁজো, সেটা এখান থেকে দেখা যায় না। কিন্তু এক পাহাড় পেরিয়ে গেলে একটা সরু ভ্যালি আছে, সেখানে আলো মাটিতে পড়ে না, সোজা চোখে নামে।”
তৃষা বলল—“আমি যাব। তুমি বললে আমি যাব।”

অভয় চলে গেল। তৃষা জানলা বন্ধ করল না। বাতাস ঢুকছিল, সেই সুরে ভেজা। সে নোটবুক খুলে লিখল—

“আজ এমন কিছু শুনলাম, যা কোনও শব্দে লেখা যায় না। কোনও ছবি নেই তার, কোনও ক্যাপশন নেই। কিন্তু সেই সুরের মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম। হয়তো ভালোবাসা শব্দের সঙ্গে আসে না। হয়তো সে সুর হয়ে ঘরে ঢোকে, তারপর হঠাৎ এক মুহূর্তে থেমে যায়, আর একটা মানুষ চোখে চোখ রেখে বলে—‘তুমি শুনে ফেলেছ, তাই আজ আমার ভেতরটা একটু হালকা।’”

পর্ব ৫: সেই আলো, যা সরাসরি চোখে নামে

ভোর চারটে।
তৃষা একবারও অ্যালার্ম ছাড়াই জেগে উঠেছিল। ঘরের ভিতর ছিল ঠাণ্ডা, জানলার বাইরে মেঘ থমকে। ঘুমের আড়াল থেকে শরীর উঠতে চাইছিল না, কিন্তু মন আগেই জেগে বসেছিল। অভয় বলেছিল—আজ একটা জায়গায় যাবে, যেখানে আলো নেমে আসে চোখে, মাটিতে নয়। তৃষা ভেবেছিল, ওটা হয়তো একটা রূপক—কিন্তু আজ তার মনে হচ্ছিল, সেটাও কোনও সত্যের ইঙ্গিত হতে পারে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দেখল—অভয় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক গ্লাস গরম দুধ, আজ আর থার্মোস নেই। চোখে সেই শান্ত আলো।
“আজ কোনও চা না?” তৃষা জিজ্ঞেস করল।
“চা পরে। আগে চোখে আলো পড়ুক,” অভয় হেসে বলল।

পাহাড়ি রাস্তাগুলো নিঃশব্দ। পাইন গাছের ছায়া, ভেজা মাটি, আর তাদের পায়ের শব্দ—সব মিলে যেন পৃথিবী একটু ধীরে ঘুরছে। অভয় আগে, তৃষা পেছনে। মাঝে মাঝে সে থেমে দাঁড়ায়, পেছনে তাকায়—না বলে জিজ্ঞেস করে, ঠিক আছ তো?

একটা পুরোনো রাস্তায় তারা উঠল—পাথরের গাঁথুনি, দুপাশে ঘন বন, মাঝখানে একটানা কুয়াশা। অভয় বলল—“এই পথে কেউ আসে না। এইখানে আলো পড়ে না ছায়া ফেলে—আলো চোখে নামে, সোজা। তাই এটাকে আমি ডাকি—‘নীরব আলো’র পথ।”

তৃষা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল—“তুমি তো আমার মতো শহরের মেয়ে নও, তাও কীভাবে এমন করে বোঝো আলো কেমনভাবে আসে?”
অভয় একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল—“আমি শব্দ শোনার চেয়ে আলো বুঝি বেশি। যেমন তুমি হয়তো কারও মুখ দেখে ভাবো সে কী বলতে চায়, আর আমি তার চোখে আলো পড়ে আছে কিনা সেটা দেখি।”
তৃষা থেমে গেল। “আজ আমার চোখে আলো আছে?”
অভয় ধীরে তাকাল, খুব ধীরে। “আজ… আলো তোমার ভিতরে।”

তারা পৌঁছাল এক খোলা জায়গায়। সামনে বিশাল ঢালু, নিচে সবুজ উপত্যকা। ওপরে মেঘের চাদর কিছুটা সরেছে। অভয় বলল—“এখানে দাঁড়াও। চোখ বন্ধ করো। আর ঠিক এক মিনিট অপেক্ষা করো।”

তৃষা দাঁড়াল। চোখ বন্ধ করল। বাতাসে ভিজে গন্ধ। পায়ের নিচে ঠাণ্ডা জমা মাটি। তার ভেতর অদ্ভুত এক শান্তি। তখন হঠাৎই, কোনও শব্দ ছাড়াই, একটি গরম, কোমল আলো পড়ল তার চোখে। সে চমকে উঠল না, চোখ খোলারও দরকার পড়ল না। যেন এক আশীর্বাদ নেমে এলো চোখের পাতার ওপর।

আলোটা খুব হালকা, খুব ব্যক্তিগত, যেন পাহাড় তাকে চিনে ফেলেছে।

তৃষা ধীরে চোখ খুলল। সামনের পাহাড়ের গায়ে রোদ পড়েছে, কিন্তু তার চোখে পড়ছে এক সরাসরি সূর্যের রেখা—সোজা মেঘ ফুঁড়ে। অভয় তার পাশে দাঁড়িয়ে। তাকিয়ে আছে সামনে, কিছু বলছে না।

তৃষা বলল—“এটা আমি কোনও দিন ক্যামেরায় তুলতে পারব না।”
অভয় বলল—“এই আলো ক্যামেরার জন্য নয়। এটা শুধু তাদের জন্য, যারা নিজের চোখে একবার হলেও ভেতর থেকে জেগে ওঠে।”

তৃষা অভয়ের দিকে তাকাল। বলল—“তোমার চোখে ওই আলো আমি আগেই দেখেছি।”
“সেটা তোমারই ছিল,” অভয় বলল। “তুমি শুধু নিজের ভেতরে খুঁজতে দেরি করেছিলে।”

সেই সকালে তারা কিছুই আর বলল না। একসাথে বসে রইল পাহাড়ের গায়ে, সূর্য উঠছে, রোদের টুকরো গাছের ফাঁকে ঢুকছে, আর বাতাসের ভিতর বাজছিল নিঃশব্দের সুর।

ফিরে আসার পথে তৃষা প্রথমবার অভয়ের হাত ধরল। কোনও আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই, কোনও ঘোষণা ছাড়াই—ঠিক যেন সেই আলোর মতো, যা মাটিতে নামে না, সোজা মানুষের চোখে।

লজে ফিরে এসে, তৃষা তার নীল নোটবুকে লিখল—

“আজ প্রথমবার মনে হল আমি প্রেমে পড়েছি। সে প্রেম কোনও চিঠি চায় না, ফোনকল নয়, প্রতিশ্রুতি নয়। সে শুধু চায় পাশে হাঁটা, কিছু না বলে তাকিয়ে থাকা, আর এমন একটা আলো—যা সরাসরি চোখে নামে।”

 

পর্ব ৬: ফিরে যাওয়ার আগে…

ঘড়িতে সকাল দশটা।
তৃষা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল—চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, ক্যামেরা চার্জে বসানো, ব্যাগ গুছোনো। বাইরে দার্জিলিং শহরের ভিড় বাড়ছে, নিচের রাস্তায় গাড়ির হর্ন, দোকানের ঝাঁপ খুলছে। কিন্তু ঘরের ভিতর, ওর মনে হচ্ছিল সময় কেমন থমকে গেছে।

অভয় আজ সকালবেলা আসেনি। গতকাল রাতে, নীরব আলোর পথে ফিরবার সময় তারা দুজনেই চুপ ছিল। কিন্তু সেই চুপটা কোনও দূরত্ব তৈরি করেনি, বরং এমন এক আত্মিক চুক্তি ছিল, যেখানে শব্দ বাড়তি হয়ে যায়।

তৃষা জানে, কাল তার ট্রেন। শহরে ফিরতে হবে। সেখানে তার কাজ আছে, ক্লায়েন্ট আছে, একক প্রদর্শনীর পরিকল্পনা আছে। এবং, কিছু না থাকা সত্ত্বেও থাকার ভান করতে হয়—সেই শহরেই।

হঠাৎ করেই দরজায় টোকা পড়ল।
তৃষা দরজা খুলতেই অভয়। আজ একটু আলাদা লাগছে—চোখে অস্বস্তি, মুখে চাপা হাসি। হাতে একটা ছোট কাঠের বাক্স।
“ভেতরে আসো,” তৃষা বলল।
অভয় ঢুকল, ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল।

“কাল ট্রেন,” তৃষা বলল নিজেই।
“জানি,” অভয় উত্তর দিল। “তোমাকে কিছু দিতে এসেছি।”

কাঠের বাক্সটা এগিয়ে দিল সে। তৃষা খুলে দেখল—ভেতরে তিনটি জিনিস:
১. পাহাড়ের শুকনো পাইনপাতা
২. তার নিজের তোলা সেই ‘সেতুর উপর অভয়’-এর প্রিন্ট করা ছোট ছবি
৩. আর একখানা চিঠি—হাতে লেখা, অদ্ভুত অক্ষরে।

তৃষা পড়তে শুরু করল—

“তৃষা,
যেদিন প্রথম তোমার চোখে কুয়াশা দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম, তোমার ভেতর আলো খুঁজছে কেউ। আমি শুধু পথ দেখিয়েছি—তুমি নিজেই খুঁজে নিয়েছো।

আমি পাহাড়। আমি অপেক্ষা করতে জানি। শহর কেমন, জানি না। তোমার ফোনে খুব কম শব্দ হয়, সেটা বুঝেছি। হয়তো ব্যস্ততা, হয়তো ক্লান্তি।

আমি কিছু চাই না। শুধু যদি কোনও দিন মনে হয়, আলো কম পড়ছে, এই পাইনপাতার গন্ধে নিজেকে মেলে নিও।

আর যদি কোনও দিন কেউ তোমার তোলা ছবির ক্যাপশন জানতে চায়—তুমি বলো, ‘এই ছবির পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল, যাকে দেখা যায় না। কিন্তু সে জানত, আলো কোথা দিয়ে নামে।’

অভয়।”

তৃষা চিঠিটা বন্ধ করল। তার চোখে জল নেই, কিন্তু হৃদয়টা ভারী।
“তুমি কি বলছ না, আমরা আবার দেখা করব?” সে প্রশ্ন করল।
অভয় বলল—“পাহাড় তো কোথাও যায় না। কিন্তু মানুষ যায়, কাজ যায়, ব্যস্ততা যায়। আমি কেবল এটুকু বলতে পারি—যদি কোনও দিন আবার আলোর অভাব হয়, ফিরে এসো। আমি ঠিক ওই সেতুর উপর থাকব। তোমার ফ্রেমের মতো দাঁড়িয়ে। তফাৎ শুধু, এবার তুমি যদি ছবি না তোলো, তাও আমি থাকব।”

তৃষা ধীরে অভয়ের দিকে এগিয়ে গেল। দুজনের চোখে চোখ।
তারপর সে বলল—“আমি ছবি তুলব না। এবার আমি থাকব।”

অভয় একটু থমকে গেল। তারপর প্রশ্ন করল—“তুমি কি পাহাড়ে থেকে যেতে চাও?”
“না,” তৃষা বলল। “আমি শহরে ফিরব। কিন্তু এবার আমার ভেতর পাহাড় থাকবে। আমি আলোর পথ জানি এখন। আর সেই আলো আমাকেও ফিরিয়ে আনবে, জানি।”

অভয় এক পা এগিয়ে এল। কোনও নাটকীয়তা ছাড়াই সে তৃষার হাত ধরল। এবার আর সেই হাত ধরার মধ্যে শুধু বন্ধুত্ব ছিল না। ছিল এক ধরনের নীরব প্রতিশ্রুতি।

তৃষা বলল—“শহরের আলো অন্যরকম। কিন্তু জানি, আমার চোখে পাহাড়ের আলো জ্বলবে এখন থেকে। আর সেই চোখেই কেউ একদিন পড়ে যাবে।”
অভয় হাসল—“তোমার চোখে পড়ে গেলে কেউ আর উঠতে পারবে না।”

বিকেলে তারা একসাথে আবার সেই সেতুতে গেল।
তৃষা ক্যামেরা সঙ্গে নেয়নি। শুধু দাঁড়িয়ে রইল অভয়ের পাশে। আর একবার সেই জায়গা, যেখান থেকে তারা শুরু করেছিল।

তৃষা নোটবুকে শেষবারের মতো লিখল—

“এই পাহাড় শুধু ছবি নয়। এই পাহাড় একজন মানুষ, যার চোখে আলো নামে, আর যার ভিতর আমি নিজেকে চিনে নিয়েছি। ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু আমার ভিতর এখন একটা সেতু তৈরি হয়েছে—যেখানে আলো থামে, আর আমি দাঁড়িয়ে থাকি অভয়ের পাশে। নীরবে। আলোর পাশে।”

শেষ।

WhatsApp-Image-2025-08-08-at-2.59.57-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *