Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

নীল পাথরের কঙ্কাল

Spread the love

এক

রাজস্থানের জয়সলমের থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, বিস্তীর্ণ মরুভূমির বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক পরিত্যক্ত দুর্গ—সোনাভর কোট। কেবল উড়ে বেড়ানো ধুলো, জ্বলে ওঠা মরীচিকা আর কয়েকটা গাছের কঙ্কালই সাক্ষী ছিল যে একদা এখানে সভ্যতা ছিল। সেই দুর্গের কাছাকাছি স্থানে খনন কাজ শুরু হয়েছিল Archaeological Survey of India-এর তত্ত্বাবধানে, যার নেতৃত্বে ছিলেন দিল্লির প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ বিপ্লব রায়চৌধুরী। ইতিহাসের গায়ে জমে থাকা ধুলো সরাতে তাঁর হাতের জুরি ছিল না। তাঁর দলে ছিলেন গবেষক তানিয়া শেখাওয়াত, স্থানীয় শ্রমিক গণেশরাম, আর কিছু ছাত্রছাত্রী। খননের প্রথম তিন দিন কেটেছে কেবল পোড়ামাটির পাত্র, ধ্বংসপ্রাপ্ত ইটের খণ্ড এবং কিছু অনির্বচনীয় নিদর্শন খুঁজে পাওয়ায়। কিন্তু চতুর্থ দিনে সকালবেলা, সূর্য যখন পুরো মরুভূমিতে আগুনের আঁচড় ফেলছে, তখন হঠাৎ একটি শ্রমিকের কোদাল গিয়ে লাগে কোনো ধাতব কিছুর গায়ে। সকলেই ভেবেছিল কোনো পুরোনো অস্ত্র হবে, কিন্তু ধুলো সরাতেই দেখা গেল—একটি অস্থির কাঠামো, মানুষের মতো, তবে অদ্ভুতভাবে কপালের মাঝখানে গাঁথা রয়েছে একটি চকচকে নীল পাথর।

ডঃ বিপ্লব সেই কঙ্কালের উপর ঝুঁকে পড়ে বিস্ময় মিশ্রিত উৎসাহে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তাঁর হাতে থাকা ছোট টর্চটি দিয়ে তিনি পাথরের উপর আলো ফেলতেই যেন কিছু এক মুহূর্তের জন্য কাঁপলো। সেই কাঁপুনিটা এতটাই সূক্ষ্ম, কেউ হয়তো লক্ষই করত না, কিন্তু বিপ্লব লক্ষ করলেন। পাথরের গায়ে ক্ষীণ নীল আভা খেলে গেল। তিনি সেটা খেয়াল করে নোটবুকে লিখে রাখলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। তখনই গণেশরাম পিছন থেকে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “সাবধান হুজুর, এই জায়গা ভালো না… আমার ঠাকুরদা বলতেন, এই দুর্গে একটা ছায়া ঘুমোয়। এই পাথর… ওর চিহ্ন।” তানিয়া হাসতে হাসতে বলল, “গণেশরাম, তুমি না এত কুসংস্কার বিশ্বাস করো! এটা নিছকই কোনো রাজকীয় পাথর, হয়তো মৃতের গহনার অংশ।” কিন্তু ডঃ বিপ্লব তখন কেমন যেন চুপচাপ। তিনি পাথরটিকে ছুঁয়ে দেখলেন, ঠাণ্ডা… বরফের মতো ঠাণ্ডা। সেই রাতে ক্যাম্পে ফিরে এসে তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখলেন: “এই পাথর যেন চোখ রেখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সে শুধু মরা নয়, সে হয়তো কিছু বলছে… হয়তো আমাদের আহ্বান করছে।”

রাত বাড়ার সাথে সাথে মরুভূমির শূন্যতা আরও গা ছমছমে হয়ে উঠল। ক্যাম্পে থাকা সব যন্ত্রপাতি—জিপিএস, ডেটা ট্রান্সফার, এমনকি ইন্টারনেট সংযোগ একে একে বিকল হয়ে যেতে লাগল। অদূরেই একটি ক্যাম্প লাইট হঠাৎ নিভে গেল, এবং কর্মীদের তাঁবুতে হালকা দুলুনি শুরু হয়, যেন কোনো অদৃশ্য কিছুর হাওয়া সরে যাচ্ছে তার পাশ দিয়ে। তানিয়া বাইরে এসে দাঁড়াতেই তার কানে আসে এক অদ্ভুত ধ্বনি—এক লম্বা টান দেওয়া শ্বাস, যেন কেউ অনেক দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে। সে ভেবেছিল বাতাসের খেলা, কিন্তু ক্যাম্পের ঘড়িতে তখন ঠিক তিনটা বাজে—আর গণেশরাম বারবার বলছিল, “তিনটে বাজলেই ওর ছায়া নড়ে।” ঠিক সেই মুহূর্তে দূরের খননস্থল থেকে এক ঝলক নীল আলো দেখা গেল, যেন কেউ মাটির নিচ থেকে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। পরদিন সকালবেলা, ক্যাম্পের কেউ একজন জানালেন, কঙ্কালের আশেপাশে রাখা সমস্ত খনন যন্ত্রপাতি কেউ যেন রাতেই নড়িয়ে দিয়েছে—একটি কোদাল পাওয়া গেছে মাটিতে গাঁথা অবস্থায়, যেটা আগের দিন দূরে রাখা ছিল। ডঃ বিপ্লবের মুখ কেমন যেন থমথমে, তিনি কিছু না বলেই শুধু বললেন, “আজ আরও গভীরে খনন করতে হবে।” আর ঠিক তখনই, মরুভূমির মধ্যে ভেসে এলো এক অদ্ভুত গন্ধ—চুন, ধাতু আর জ্বলন্ত তামার। ইতিহাস, যা এতদিন নিঃশব্দ ছিল, এবার যেন নিজের মুখ খুলে কিছু বলতে চাইছে।

দুই

রাতটা ছিল অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। মরুভূমির নীরবতা যেন এক অতল শূন্যতায় রূপ নিয়েছে, যেখানে বাতাস পর্যন্ত নিঃশব্দ হয়ে অপেক্ষা করে কোনো অনাহূত আগমনের। খননের পরদিন ক্যাম্পে অদ্ভুত ভার অনুভব করছিল সবাই, বিশেষ করে তানিয়া শেখাওয়াত। সে রাতে ডঃ বিপ্লব নিজের তাঁবুতে দ্রুত ফিরে গেলেও, তানিয়া বাইরে বসে খননের ছবি ও তথ্য整理 করছিল। চারপাশে ছড়িয়ে ছিল নিঃস্তব্ধতা, কেবল দূর থেকে মাঝেমধ্যে উটের ঘণ্টার আওয়াজ আর শুকনো পাতা ঘষার শব্দ। রাত তখন সবে আড়াইটে পেরিয়েছে। হঠাৎই তার মনে হলো, কাঁধের ওপর দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা নিশ্বাস বয়ে গেল। সে চমকে পিছনে তাকাল—কেউ নেই। বাতাসও নেই। কিন্তু ক্যাম্পের পেছনের দিকে, অন্ধকারে চোখ গেলে, তার হঠাৎ মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো সেই স্থানে আটকে থাকলেও সে আর কিছু দেখতে পেল না, কেবল হালকা এক ধূসরতা যেন জমে আছে অন্ধকারের গায়ে। সে ধীরে ধীরে টর্চটা হাতে তুলে নিল, কাঁপতে থাকা আঙুলে সুইচ চাপল—আলো জ্বলে উঠতেই কিছুই দেখা গেল না। সব যেন আগের মতোই। তবু বুকের ভেতর কেমন একটা চাপা ভয় গেঁথে গেল।

অজানা কৌতূহল এবং একরকম অদৃশ্য টান তাকে নিয়ে গেল খননস্থলের দিকে। অন্ধকারের বুক চিরে সে এগিয়ে যেতে থাকল, টর্চের আলো পড়ে বালির ওপর। দূরে সেই কঙ্কাল যেখানে রাখা ছিল, তার চারপাশে ঢেকে দেওয়া টারপলিনটি যেন কেউ সযত্নে একপাশে সরিয়ে রেখেছে। কেউ তো যায়নি ওদিকে—এই তো কিছুক্ষণ আগেই ডিউটি শেষ করে সবাই ঘুমিয়েছে। তানিয়া কাছে গিয়ে দেখতে পেল, কঙ্কালের গা থেকে ধুলোর স্তর সরানো হয়েছে, যেন কেউ সেটা পরিষ্কার করে রেখেছে নতুন করে। সে আরও অবাক হলো যখন কঙ্কালের কপালের সেই নীল পাথরটা নিজের মতো করে হালকা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। নিঃসন্দেহে, সেটা তার চোখের ভুল নয়। পাথরটা দপদপ করছিল—আলো নিভে আসা প্রদীপের মতো নয়, বরং যেন ভিতর থেকে বেঁচে থাকা কোনো জীবন্ত শক্তির মতো। ঠিক তখনই সে বুঝতে পারল—কঙ্কালের পাশে বালির গায়ে একটি ছায়া পড়েছে। মানুষের মতো, লম্বাটে আকৃতি। কিন্তু আশেপাশে তানিয়া ছাড়া কেউ নেই! তার নিজের শরীরের ছায়া পড়েছে উল্টো দিকে, অন্যদিকে আলো থাকায়। এই ছায়া এসেছে এমন কোনো দিক থেকে, যেখানে আলো নেই—অথচ ছায়া আছে। ঠান্ডা ঘাম বইতে লাগল তার কপাল দিয়ে। ছায়াটা নড়ল না, কিন্তু তার উপস্থিতি যেন শ্বাস বন্ধ করে দেয়ার মতো ভারী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তানিয়ার মনে হলো ছায়াটা তাকে দেখছে, অনুভব করছে, এবং—ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার হাতের টর্চ হঠাৎ নিভে গেল। আর সেই অন্ধকারে, কঙ্কালের দিকে তাকিয়ে সে কেমন যেন এক ফিসফিসানি শুনতে পেল, যা বাতাসের শব্দের মতো নয়—ছিল অনেক বেশি মানুষের নিঃশ্বাসের কাছাকাছি।

সে পিছু হটতে শুরু করল, পা পিছলাতে যাচ্ছিল বালির ওপর, কিন্তু ঠিক সেই সময় কঙ্কালের কপালের পাথরটা জ্বলজ্বল করে উঠল। পুরো এলাকা এক ঝলক নীল আলোর মধ্যে ভরে উঠল, আর সেই আলোর মধ্যে সে স্পষ্ট দেখতে পেল—একটা অর্ধ-স্বচ্ছ, ধুলোয় ঢাকা মুখ। চোখ নেই, মুখ নেই, কেবল মুখোশহীন এক ছায়া যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক মুহূর্ত স্থির থেকেও সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল, আর তখনই হঠাৎ করেই বাতাসের দমকা এসে সব আলো নিভিয়ে দিল। যখন ক্যাম্পের অন্য সদস্যরা ছুটে এসে তাকে খননের পাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল, তখন সে কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিল না। শুধু তার ঠোঁটে কাঁপতে থাকা একটি বাক্য শোনা গেল—“ছায়া… ও হাঁটে… ও জেগে আছে…”

তিন

তানিয়া ধীরে ধীরে চোখ মেলল, মাথার ভেতরে যেন কেউ মাটির নিচ থেকে ধুকধুক আওয়াজ তুলছিল। বাইরে সকাল হয়ে এসেছে, সূর্য তার আলো ছড়াচ্ছে মরুভূমির বুকে, কিন্তু ভিতরে তার বুকের গভীরে ছিল ঘন অন্ধকার। ক্যাম্পের সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল, আর পাশে বসেছিলেন ডঃ বিপ্লব রায়চৌধুরী, মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। “তুমি খননে গিয়েছিলে?”—প্রশ্নটা সোজা ছিল, কিন্তু তানিয়া উত্তর দিতে পারছিল না। তার মনে ছিল ছায়ার অবয়ব, নিঃশব্দে দাপিয়ে বেড়ানো এক অস্তিত্ব। সে শুধু বলল, “আমি… কঙ্কালের পাশে একটা ছায়া দেখেছিলাম। কারো ছিল না, কিন্তু ছিল…” ডঃ বিপ্লব কিছু বললেন না, কেবল জানালেন—গত রাতে কঙ্কালের অবস্থানে কেউ যায়নি, আর সব যন্ত্রপাতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে। ক্যাম্পে যেন নেমে এসেছিল এক গভীর নিঃশব্দ স্তব্ধতা। দুপুর নাগাদ তানিয়া কিছুটা সুস্থ বোধ করলে, সে জেদ করে গেল স্থানীয় জয়সলমের সংগ্রহশালায়। তার মনে হচ্ছিল—এই কঙ্কাল, এই পাথর, এই ছায়া—সব কিছুর পেছনে আছে এমন কিছু, যা ইতিহাসের পাতায় হয়তো নেই, কিন্তু লোককথার স্তরে রয়ে গেছে।

সেই পুরোনো সংগ্রহশালায়, ধুলো জমা তাকের ভেতর, এক ধ্বস্ত রাজপুতনামার পাণ্ডুলিপির ভেতর তানিয়া খুঁজে পেল সেই নাম—”নীল রক্ষক”। পাণ্ডুলিপিটি রাজা উদয়সিংহের শাসনকালের, খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের শেষভাগের। লেখা ছিল, “রাজ্যরক্ষার শপথ যারা ভাঙে, তাদের স্থান রাজসিংহাসনের ছায়ার নিচে নয়, মৃতের ভেতরে।” সে এক ভয়ঙ্কর কাহিনি—এক যোদ্ধা, রাজা উদয়সিংহের প্রিয় সেনানায়ক, যিনি জানতে পেরেছিলেন রাজা ব্রাহ্মণ হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছেন, এবং কপটভাবে ‘রাজ্যরক্ষার’ এক নীল পাথর ধারণ করেন যেটি আসলে ছিল প্রাচীন অলৌকিক প্রতীক। যোদ্ধা এই গোপন সত্য প্রকাশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু রাজা তাকে জীবন্ত পুঁতে দেয় প্রাসাদের গোপন সুড়ঙ্গের নিচে, তার কপালে স্থাপন করে সেই নীল পাথর—যা ছিল রাজশক্তির ‘অভিশপ্ত তৃতীয় চক্ষু’। পরবর্তীতে সেই দুর্গ ধ্বংস হয় এক অজানা আগুনে। বহু বছর পরে সেই জায়গাতেই তৈরি হয় সোনাভর কোট, যেখানে আজ সেই কঙ্কাল পাওয়া গেছে।

তানিয়া পাণ্ডুলিপির পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে অনুভব করল—এই কাহিনি সত্য হোক বা না হোক, তার অভিজ্ঞতা এই কাহিনির প্রতিধ্বনি বয়ে এনেছে। রাতে সে ডঃ বিপ্লবকে সবটা জানাল, কিন্তু তিনি পাণ্ডুলিপির নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। “লোককথা অনেক সময় বাস্তব নয়,” তিনি বললেন, “কিন্তু যেহেতু এটি ইতিহাসের চূড়ান্ত প্রান্তরেখায় দাঁড়িয়ে আছে, আমায় এটাকে গুরুত্ব দিতেই হবে।” তানিয়া শুধু বলল, “আমরা হয়তো একটা ভুল জায়গায় হাত দিয়েছি।” ডঃ বিপ্লব কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিলেন, “ইতিহাসের ভুল জায়গা বলে কিছু নেই, তানিয়া… শুধু ভুল সময়ে জেগে ওঠা সত্য থাকে।” ক্যাম্পে ফেরার পথে দুজনে দেখল, খননের ঠিক পেছনের একটি পাথরের দেয়ালে হঠাৎ করেই ভেসে উঠেছে চুলচেরা ফাটল, যেন ভিতর থেকে কেউ চাপ দিচ্ছে। আকাশে তখন ধুলো উড়ছিল, আর দূরে মরুভূমির গায়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এক দীর্ঘ ছায়া—যেটা ছিল না ঠিক আগের দিন।

চার

রাতের অন্ধকার যেন সেদিন একটু বেশিই ঘন হয়ে নেমেছিল। চারদিকে নিঃসাড় নীরবতা, এমনকি মরুভূমির পরিচিত বাতাসের আওয়াজ পর্যন্ত কেমন থেমে গিয়েছিল। ডঃ বিপ্লব রায়চৌধুরী সন্ধ্যা থেকে নিজের তাঁবুতে একা বসে ছিলেন। তানিয়া তাঁকে দুপুরের পাণ্ডুলিপি ও ছায়ার বিষয়ে বিস্তারিত বললেও, তিনি সে বিষয়ে মুখ খুলেননি। কেবল মৃদু গলায় বলেছিলেন, “তুমি বিশ্বাস করছো… আমি পরীক্ষা করতে চাই।” তিনি একটি স্কেচবুক ও ছোট লণ্ঠন নিয়ে বের হন রাত প্রায় দুটো নাগাদ, কোনোকে কিছু না জানিয়ে। ক্যাম্পে থাকা পাহারাদার পরে বলেছিল—তিনি কঙ্কালের দিকে যাচ্ছিলেন, আর তাঁর পায়ে পরা লালচে রঙের হাওয়াই চটি মরুভূমির বালিতে একটা দীর্ঘ চিহ্ন ফেলে যাচ্ছিল। সকাল হতেই ক্যাম্পে হুলুস্থুল পড়ে যায়—ডঃ বিপ্লব তাঁবুতে নেই, ফোন নিঃসাড়, যন্ত্রপাতি বন্ধ। খননের পাশে তাঁর খোলা স্কেচবুক পাওয়া গেল, যেখানে আঁকা ছিল একটা গোল সুড়ঙ্গ, যার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে এক ছায়াচ্ছন্ন হাত।

তানিয়া ভীত, কিন্তু স্থির। সে জানত, কিছু একটা হয়েছে—এটা নিছক নিখোঁজ হওয়া নয়। গণেশরাম জানায়, খননের জায়গায় একটা পুরনো, আংশিক ধসে যাওয়া মেঝে রয়েছে, যা সম্ভবত কোনো প্রাচীন চেম্বারের ছাদ। এতদিন সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি হয়নি। তানিয়া, গণেশরাম ও দুই ক্যাম্প কর্মী সাহস করে সেই জায়গাটা খুঁড়ে দেখতে শুরু করে। একটু পরেই এক ধাতব শব্দ পাওয়া গেল, যেন নিচে কোনো ফাঁপা কুঠুরি রয়েছে। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল—এক প্রাচীন সুড়ঙ্গ, তার মুখ ধুলোয় ঢেকে থাকা, আর পাশের পাথরের গায়ে লালচে দাগ—যেটা হতে পারে পুরোনো রক্ত। সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকতেই ভেতরে জমে থাকা ঠান্ডা বাতাস কানের ভেতরে কেঁপে উঠল। সেই গুহার দেয়ালে ঝুলছিল বাদুড়, আর ঘন অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল অদ্ভুত কিছু চিত্র—মানুষের মুখ, পাথরের চোখ, এবং একটি ছায়া, যার মাথায় বসানো রয়েছে উজ্জ্বল পাথর। দেয়ালের গায়ে হাত বোলাতে গিয়ে তানিয়া টের পেল—চুনাপাথরের নিচে কিছু যেন নড়ে উঠল। এক পলকের জন্য মনে হলো, কারো নিঃশ্বাস ঠিক তার গাল ছুঁয়ে গেল।

সেই সুড়ঙ্গের শেষে, ছোট এক প্রকোষ্ঠে, তাঁরা খুঁজে পেলেন একটি চামড়ার ব্যাগ, যার ভিতরে ডঃ বিপ্লবের লেখা গবেষণা-নোটবই, একটি পুরনো রাজমুদ্রা, এবং এক ভাঙা আয়না। আয়নাটি ছিল অদ্ভুত—তাতে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু টর্চের আলো ফেলতেই তারা দেখতে পেল—এক ছায়ামূর্তি আয়নার ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, স্থির। ব্যাগে রাখা নোটবুকে শেষ লেখা ছিল: “আমি ওর ভিতরে ঢুকে গেছি। ওর ছায়া আমার চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছে এখন।” চারদিকে হিমশীতল নিস্তব্ধতা। দূর থেকে যেন একটা কর্কশ ফিসফিসানি ভেসে এলো, এবং সুড়ঙ্গের দেয়াল একটু একটু করে কাঁপতে লাগল। সেই মুহূর্তে, গণেশরাম বলে উঠল, “এই জায়গা আর নয়… এটা ওর ঘুমের ঘর।” আলো নিভে যেতে শুরু করল, এক এক করে। তানিয়ার কণ্ঠ শুকিয়ে এলো, তার মনে হচ্ছিল ডঃ বিপ্লব এখনও এখানে আছেন… কিন্তু মানুষের মতো নয়। তিনি হয়তো এখন শুধু ছায়া, হয়তো প্রতিশোধপিপাসু অতীতের শরিক হয়ে গেছেন।

পাঁচ

সুড়ঙ্গ থেকে ফিরে এসে তানিয়া নিজের তাঁবুতে বসে ডঃ বিপ্লবের নোটবুকের পাতা উল্টাতে লাগল। পাতাগুলোর অনেকটাই জলে ভেজা, কালি ছড়িয়ে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু লাইন স্পষ্ট—”ওর নাম লেখা নেই ইতিহাসে… কিন্তু ওর ছায়া থেকে যায় প্রতিটি দেয়ালে”, অথবা “পাথরের ভিতর যে আলো আছে, সে আলো চোখে নয়, আত্মায় দাগ কাটে।” প্রতিটি বাক্যে যেন একটা ভয়াল পূর্বাভাস মিশে আছে। ক্যাম্পের চারপাশে এখন অতল নীরবতা, আর কর্মীদের মুখে অদৃশ্য আতঙ্ক। পরদিন সকালে তানিয়া স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় পৌঁছায় জয়সলমেরের পুরনো জেলা লাইব্রেরিতে, যেখানে সংরক্ষিত আছে ব্রিটিশ আমলের কিছু সরকারি রেকর্ড। সেখানে বহু খোঁজাখুঁজির পরে, সে হাতে পায় একটি পাতলা, কাঠের খাপে রাখা নথি—১৮৫৭ সালের, লিখিত “ব্রিগেডিয়ার রবার্ট ক্লিভল্যান্ড”-এর নামে। নথিতে লেখা, “সোনাভর দুর্গে এক ব্রাহ্মণ যোদ্ধার গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মাথায় রহস্যময় রত্ন। সেই রত্ন রাতের বেলায় আলো দেয়, আর সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।” এবং পরের লাইনটা পড়ে তানিয়ার গা শিউরে ওঠে—“দুর্গের নীচে আমি একটি আয়না খুঁজে পেয়েছি, যেখানে কেবল আমার ছায়া প্রতিফলিত হয়, মুখ নয়।” রিপোর্টের শেষ অংশে লেখা: “আমি এখন তীব্র টান অনুভব করছি। মনে হচ্ছে কিছু একটা আমায় ডাকে… হয়তো আমি ফিরে যেতে পারব না।” নথির তারিখ অনুযায়ী, সেই ব্রিগেডিয়ার আর কখনও ফিরে আসেননি।

লাইব্রেরির বৃদ্ধ রক্ষণাবেক্ষণকারী বলল, “ব্রিগেডিয়ার ক্লিভল্যান্ডের খোঁজে পরে অনেক অনুসন্ধান হয়েছিল, কিন্তু কেউ তাঁর দেহ বা অস্ত্র খুঁজে পায়নি। স্থানীয়রা বলে, তিনি ‘নীল ছায়ার সৈনিক’ হয়ে গিয়েছিলেন।” তানিয়া ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল, ডঃ বিপ্লবের হারিয়ে যাওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়—এই দুর্গ, এই পাথর, এই ছায়া—সবকিছুই যেন একটা অভিশপ্ত আবর্তনের অংশ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একই ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, একই ছায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। দুপুর নাগাদ ক্যাম্পে ফিরে এসে সে খেয়াল করল, ডঃ বিপ্লবের তাঁবুর দরজায় কে যেন নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছে—চারটি আঁকাবাঁকা দাগ, যেগুলো ঠিক মানুষের নয়, আবার পশুরও নয়। রাতে ক্যাম্পে আলো নিভে গেলে সে ডায়েরির শেষ পাতাটি খুলে দেখতে পেল, পাতায় লেখা হয়েছে নতুন একটি লাইন—“সে এখন ঘুমোচ্ছে না। ওর চোখ খোলা। আমি দেখতে পাচ্ছি।” প্রশ্ন হলো, কে লিখেছে সেটা? ডঃ বিপ্লব তো নেই, আর কেউ তো ওই তাঁবুতে প্রবেশ করেনি।

সেই রাতে, ক্যাম্পে আর কেউ সাহস করে ঘুমাতে পারল না। একজন কর্মী তানিয়াকে ডেকে জানায়—সে নিজে কঙ্কালের পাশে একটা নীলাভ ছায়া দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, যার মুখ না থাকলেও একটা আবেগ ছড়াচ্ছিল—ক্রোধ, যন্ত্রণার মতো কিছু। ছায়াটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা যেন পাথরের ওপর চেপে বসে থাকে। ক্যাম্পে থাকা টেম্পোরারি মন্দিরের প্রদীপ নিভে যায় হঠাৎ, বাতাস না থেকেও আগুন নিভে যাওয়ার মতো। তানিয়া বুঝতে পারল, নীল পাথর শুধু কোনো অলঙ্কার বা প্রতীক নয়—এ এক সজীব, লুকিয়ে থাকা শক্তি, যা সময়ের সীমা ভেঙে এখনকার জগতে ঢুকে পড়েছে। সে সিদ্ধান্ত নিল—পুরো দুর্গ এলাকা আরও একবার পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ, যদি অতীতের দরজা একবার খুলে গিয়ে থাকে, তবে ভবিষ্যতের পথ হয়তো অন্ধকার ছায়ায় হারিয়ে যেতে বাধ্য।

ছয়

সকালবেলা ক্যাম্পের ভেতর এক অস্বস্তিকর ভারি পরিবেশ। রাত্রির আতঙ্ক যেন বাতাসের ভেতর জমে আছে। কেউ কারও চোখের দিকে ঠিক করে তাকাচ্ছে না। সেই রাতে তিনজন কর্মী আলাদাভাবে দাবি করেছে—তারা প্রত্যেকে কঙ্কালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ‘মানুষের মতো অবয়ব’ দেখেছে, যার শরীর ছায়ার মতো ঝাপসা, কিন্তু চোখ দুটো একদম জেগে থাকা নীল পাথরের মতো দীপ্তিমান। গণেশরাম বলল, তার তাঁবুর বাইরে কেউ হাঁটার শব্দ করেছে বারবার, কিন্তু বাইরে কেউ ছিল না। তার বালির ওপর রাখা পানির ঘটি নিজের থেকেই উল্টে যায়। তানিয়া টের পাচ্ছিল—কিছু একটা তাদের ঘিরে আসছে। কিন্তু সত্যিটা সেই রাতে প্রকাশ পেল, যখন ক্যাম্পের বৈদ্যুতিক আলো হঠাৎ নিভে যায়, আর সমস্ত জায়গা ঢেকে যায় অন্ধকারে। সবাই মিলে যখন আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছিল, তখন কঙ্কালের দিক থেকে আসে একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো গর্জন—যেটা মানুষ দেয় না, প্রাণীও নয়।

তানিয়া টর্চ নিয়ে দৌড়ে গেল কঙ্কালের দিকে। সেই মৃতদেহ আর আগের মতো স্থির ছিল না—তার পাশের বালিতে দেখা যাচ্ছিল ঘষাটে চিহ্ন, যেন কেউ কাঁধ ঘেঁষে বসে আছে। তার আশপাশে বালির গায়ে ছড়িয়ে ছিল হাতের ছাপ—ছোট নয়, লম্বা এবং হাড়ের গঠন স্পষ্ট, কিন্তু কোথাও কেউ নেই। টর্চের আলো ঘুরতে ঘুরতে আচমকা এক মুহূর্তের জন্য তানিয়া দেখতে পেল—একটি ছায়া কঙ্কালের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, বুক পর্যন্ত মানুষ, নিচ থেকে ধোঁয়ার মতো গঠিত, মাথা নিচু করে তাকিয়ে, যেন কিছু ফিসফিস করছে মৃতদেহের কানে। সে মুহূর্তেই একটি বিকট শব্দে ক্যাম্পের সবচেয়ে পুরনো তাঁবুটি ছিঁড়ে যায়, এবং ভেতরের আলো নিভে গিয়ে একটা ধাক্কা লাগে মাটির নিচে—একটি চোরা ভূমিকম্পের মতো অনুভূতি, কিন্তু কেবল সেই নির্দিষ্ট জায়গাতেই। সবাই ছুটে এসে দেখল, কঙ্কালের কপালের নীল পাথর নিজে থেকেই জ্বলছে, আর তার গায়ে কেউ যেন অদৃশ্য হাত বুলিয়ে দিয়েছে—কারণ ধুলো উঠে গেছে, হাড় চকচক করছে অদ্ভুতভাবে।

পরদিন সকালে তানিয়া আর গণেশরাম সেই পুরোনো গুহার ভিতরে আরও গভীরে ঢুকে পড়ল। এবার তারা একটা খোলা কুঠুরি দেখতে পেল, যেখানে পাথরের মেঝের গায়ে উৎকীর্ণ রয়েছে এক অলৌকিক বৃত্ত—ছয়টি চোখ, একটি কঙ্কালমূর্তি, আর তার মাঝখানে বসানো পাথরের প্রতীক। সেই প্রতীক হুবহু মিলছে সেই নীল পাথরের সঙ্গে। তানিয়া বুঝল, এই পাথর শুধু কোনো এক রাজা বা যোদ্ধার প্রতীক ছিল না—এটা ছিল এক প্রাচীন আত্মাবন্ধের মাধ্যম, যেটি সময়কে আটকে রাখে এবং চেতনার এক সীমারেখার মাঝে পুরে দেয় দেহহীন উপস্থিতিকে। ডঃ বিপ্লব হয়তো সেই সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছেন। তখনই তারা শুনল এক ভাঙা কণ্ঠ—দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ফিসফিস শব্দ, “আমার চোখ দিয়ে এখন সে দেখে… আমাকে মুক্ত করো…”

তানিয়া আতঙ্কে পিছু হটতে গিয়ে দেয়ালের পাশে রাখা একটি আয়নায় চোখ রাখে—আর সেখানেই প্রথমবারের মতো সে দেখে এক মুখ, অর্ধেক তার নিজের, অর্ধেক ডঃ বিপ্লবের! ছায়া আর বাস্তব একে অপরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। দ্বিতীয় আত্মপ্রকাশ শুরু হয়ে গেছে—এবার আর কেবল কঙ্কাল নয়, পাথর নয়—নিজেই এক জীবন্ত আত্মা হয়ে উঠেছে পুরোনো অভিশাপ। ইতিহাসের লেখা নয়, এই গল্প নিজেই ইতিহাস হয়ে উঠতে চলেছে।

সাত

তানিয়া রাতে ঘুমোতে পারল না—সে জানত, আর সময় নেই। সেই আয়নায় ডঃ বিপ্লবের মুখ দেখা মানে একটিই ব্যাখ্যা—তাঁর শরীর আর এখানে নেই, কিন্তু তাঁর চেতনা আটকে আছে সেই নীল পাথরের গভীরে। পাথরটি একটি গুহার বুকে বসানো অভিশপ্ত চক্রের কেন্দ্র, আর এই চক্র তৈরি হয়েছে শতাব্দীজুড়ে জমে থাকা ছায়া ও প্রতিশোধের শক্তি দিয়ে। ক্যাম্পের অনেকেই জায়গা ছেড়ে চলে গেছে, বাকিরা চুপচাপ। গণেশরাম রাতের খাওয়া শেষ করে জানায়, সে আর থাকতে পারবে না—তার ঠাকুরদার মুখে শোনা যে ‘নীল অগ্নির চোখ’ জেগে উঠলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। কিন্তু তানিয়া সিদ্ধান্ত নেয়—সে শেষ পর্যন্ত থাকবে। কারণ, ডঃ বিপ্লব তাকে একবার বলেছিলেন, “একজন গবেষকের কাজ শুধুই দেখা নয়—মুক্ত করা।”

পরদিন ভোরবেলা, সে সেই প্রাচীন সুড়ঙ্গে আবার নামে—এবার একা। হাতে টর্চ, কোমরে দড়ি, আর ব্যাগে রাখা এক লালচে পাথর, যা সে স্থানীয় এক তান্ত্রিক পাণ্ডুলিপি থেকে সংগ্রহ করেছে—প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে। সুড়ঙ্গের ভিতর ঢুকতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। এবার শব্দ নেই, ফিসফাস নেই, শুধু নিঃসাড় এক ঘন নিস্তব্ধতা, যেটা শব্দের থেকেও বেশি তীব্র। সে পাথরের সেই চক্রটির কাছে পৌঁছায়, এবং দেখে—পাথরের কেন্দ্রে পড়ে আছে কঙ্কালহীন এক শূন্য দাগ, যেন কারও অস্তিত্ব মুছে গেছে চিরতরে। ঠিক তখনই চারদিকে হালকা ধোঁয়া জমে ওঠে, আর ধোঁয়ার মধ্যে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে এক মুখ—আধা-মানব, আধা-ছায়া, চোখদুটি নীল পাথরের মতো উজ্জ্বল। সেই মুখটি বলে—“তুমি এসেছো, মুক্ত করতে… না নিজেকে উৎসর্গ করতে?”

তানিয়া ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠলেও মুখে দৃঢ়তা ধরে রাখে। সে জানত, এই আত্মাকে মুক্ত করতে হলে পাথরের সঙ্গে যুক্ত চক্রটি ভাঙতে হবে—কিন্তু সেটা করা মানে নিজের চেতনাকে উৎসর্গ করা সেই শক্তির কাছে। সে পাথরের উপর লাল পাথরটি স্থাপন করে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল, যা সে আয়নার লেখার পেছনের লেখাগুলো উল্টে পড়ে আবিষ্কার করেছিল। হঠাৎ করে চক্রের ভিতর থেকে শুরু হয় প্রবল কম্পন, পাথর কাঁপতে থাকে, দেয়ালের প্রতিটি মুখ আর মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসে একত্র শ্বাস—যেন শতশত মানুষ একসাথে তাদের শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে। পাথরের ঠিক নিচে তৈরি হয় এক অন্ধকার গহ্বর, যেখান থেকে হাত বাড়িয়ে আসে ছায়ামূর্তি। তানিয়া চোখ বন্ধ করে পাথর ভাঙে—চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে সেই নীল আলো, আর এক ধাক্কায় সব আলো নিভে যায়।

এক মুহূর্ত পরে, চারপাশে নেমে আসে নিঃস্তব্ধতা। সূর্য উঠেছে। ক্যাম্পের লোকজন শুনতে পায় পাথরের খোলস ভেঙে পড়ার শব্দ। তারা দৌড়ে এসে দেখে—তানিয়া অজ্ঞান, হাতের মুঠোয় ধরা সেই লাল পাথরের গুঁড়ো। আর কঙ্কালটি? উধাও। শুধু সেখানে পড়ে আছে একটি ভাঙা আয়নার টুকরো, যার ওপর কুয়াশায় লেখা—“সে মুক্ত”।

আট

তানিয়া যখন চোখ মেলে, তখন সূর্য সবে মরুভূমির বুকে পা রেখেছে। সোনালি আলো তার মুখ ছুঁয়ে বলছিল—তুমি বেঁচে আছো। পাশে বসে ছিল গণেশরাম, চোখে বিস্ময় আর শ্রদ্ধা। সে জানাল—তানিয়া যখন অজ্ঞান ছিল, তখন পুরো খননস্থলে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। হঠাৎই ঝড় শুরু হয়, কিন্তু সেটি ছিল শব্দহীন। বাতাস ঘুরে ঘুরে সব তাঁবু থেকে ধুলোর স্তর সরিয়ে দেয়। আর ঠিক সেই সময় কঙ্কালের জায়গায় পড়েছিল এক টুকরো আয়না, আর একটি লিপি খোদাই করা মুদ্রা, যার ভাষা কেউ পড়তে পারছিল না। ক্যাম্পে থাকা এক স্থানীয় ইতিহাসবিদ সেই প্রতীক পড়ে জানাল—এটা ‘মুক্তির অভিশাপ’। যারা অভিশপ্ত আত্মাকে পরিত্রাণ দেয়, তারা নিজের কিছুটা অংশ সেই ইতিহাসে রেখে যায়। আর তানিয়া? সে বুঝে গিয়েছিল, তার চোখের ভিতর এখন কিছু বদলে গেছে।

তানিয়া ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার ঠিক আগের দিন, সে একা গিয়েছিল সেই সুড়ঙ্গের মুখে। এবার সেখানে কোনো ছায়া নেই, কোনো কঙ্কাল নেই, কেবল দেয়ালে একটি নতুন দাগ—একটি নারীর মুখাবয়ব, চোখদুটি বন্ধ। সে জানত, এটা তার প্রতিচ্ছবি, হয়তো এক আত্মিক চিহ্ন, হয়তো ছায়ার পক্ষ থেকে একটি চিরন্তন কৃতজ্ঞতা। ডঃ বিপ্লব আর কখনও পাওয়া গেল না, কিন্তু তানিয়া বিশ্বাস করে, তিনিও মুক্ত হয়েছেন। হয়তো সেই আত্মা তাঁর চেতনাকে গ্রহণ করে ছায়ার রাজত্ব থেকে আলাদা করেছে, কিংবা এক নতুন আলোয় সমর্পিত করেছে। ক্যাম্পের মানুষজন আর সেই এলাকায় খনন চালাতে চায়নি। সরকার জায়গাটিকে সংরক্ষিত ‘ঐতিহাসিক অভিশপ্ত এলাকা’ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয়। মানুষ ভুলে যেতে শুরু করে। কিন্তু মরুভূমির বুকে, সেই জায়গাটায় প্রতি বছর একই দিনে—রাত দুটো বেজে তেত্রিশ মিনিটে—হালকা একটা নীল আভা দেখা যায়, যেটা কেউ টর্চ বা আলো দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

তানিয়া এখন কলকাতায় থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ায়। ছাত্রদের শেখায়, ইতিহাস শুধু দলিলের মধ্যে বন্দি থাকে না, কিছু ইতিহাস চলে আসে মানুষের ভিতর, রক্তে, ঘুমে, ছায়ায়। তার ডেস্কের ডানদিকে আজও রাখা সেই লাল পাথরের ধুলো—একটি কাচের শিশিতে, ছোট্ট কাগজের ট্যাগে লেখা: “Where the past breathes.” সে জানে, কঙ্কালের সেই নীল পাথর আজ আর নেই, কিন্তু তার গল্প আছে। কারণ সব সত্য মুছে যায় না, কিছু সত্য ছায়ার মতো থেকে যায়—নীরবে, অপেক্ষায়।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *