Bangla - প্রেমের গল্প

নীল পাড়ের শাড়ি

Spread the love

দীপাঞ্জন দে


অয়ন ট্রেন থেকে নেমেই অনুভব করল, সে যেন অন্য এক জগতে এসে পৌঁছেছে। শহরের কোলাহল, ধোঁয়া আর যান্ত্রিক ছন্দ পেছনে ফেলে এই ছোট্ট গ্রাম তাকে এক অচেনা শান্তির স্পর্শ দিল। মামার বাড়ির দাওয়ায় বসে দূরে তাকালে দেখা যায় বিশাল মাঠ, পাকা আমগাছ, সরু মেঠোপথ আর সেই পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কূপ। অয়ন এতদিন বইয়ে পড়েছে, সিনেমায় দেখেছে, কিন্তু এভাবে সরাসরি গ্রামীণ জীবন তার চোখের সামনে কখনো ভেসে ওঠেনি। সে শহুরে ছেলে, যেখানে সবকিছুই গতি আর হিসেবের মধ্যে বাঁধা, সেখানে এই নিরিবিলি পরিবেশ তাকে প্রথমেই অদ্ভুত মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিল। মাটির ঘ্রাণ, বাতাসে ভেসে আসা ধূপকাঠির গন্ধ, আর পাখির ডাক তাকে যেন নতুন কোনো জগতে টেনে নিল। মামা অনেক যত্ন করে তাকে ঘর দেখালেন, আপ্যায়ন করলেন, কিন্তু অয়নের দৃষ্টি বারবার চলে যাচ্ছিল সেই কূপের দিকে, যেখানে মাঝে মাঝে গ্রামের মেয়েরা কলসী নিয়ে আসে। সে যেন কোনো অচেনা প্রতীক্ষায় ছিল, কোনো এক বিশেষ মুহূর্তের অপেক্ষায়।

সেই মুহূর্ত এল একেবারে হঠাৎ করেই। দুপুরের রোদে আলো-ছায়ার খেলা চলছিল চারপাশে। অয়ন দাওয়ায় বসে কাগজে কিছু লিখছিল, হঠাৎ চোখ গেল কূপের দিকে। সে দেখল—একজন মেয়ে আসছে, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। গায়ে সাদা শাড়ি, তাতে নীল পাড়, আর তার সঙ্গেই এক অদ্ভুত সরলতা। কুসুম। মাটির পথে হাঁটতে হাঁটতে কূপের পাশে দাঁড়াল, তারপর ঝুঁকে কলসীতে জল তুলতে শুরু করল। তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি যেন সুরের মতো মসৃণ, অনভ্যস্ত চোখে অয়নের কাছে তা ছিল একেবারে বিস্ময়কর। শহরের ব্যস্ততা আর সাজসজ্জার জগতে সে এমন সহজ সৌন্দর্য কোনোদিন দেখেনি। কুসুমের কালো চোখে একধরনের নীরব শক্তি, ঠোঁটে একটুখানি ক্লান্তির ছায়া, আর তবুও তার উপস্থিতি চারপাশকে আলোয় ভরিয়ে দিল। অয়ন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন তার কলম থেমে গেল, দম বন্ধ হয়ে এল।

একসময় কুসুম মাথা তুলে তাকাল। সেই মুহূর্তেই দু’জনের চোখাচোখি হল। অয়ন অনুভব করল যেন হৃদপিণ্ড একবার থমকে গেছে, তারপর হঠাৎ জোরে ধুকপুক করতে শুরু করল। কুসুমের চোখে বিস্ময়, আবার সঙ্গে লাজুক পর্দা। সে যেন এক মুহূর্তের জন্য অচেনা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কিন্তু সেই এক ঝলকেই অয়নের মনে অদ্ভুত আলোড়ন জাগল। সে যেন মনে মনে বলল—এতদিন যা খুঁজছিলাম, হয়তো এটাই। অথচ কোনো কথা হয়নি, কোনো পরিচয় হয়নি, তবুও চোখের ভাষা যেন হাজার অজানা কথা বলে দিল। কুসুম জল ভরা কলসী মাথায় তুলে ধীরে ধীরে চলে গেল, আর অয়ন দাওয়ায় বসেই অবাক হয়ে দেখল—কীভাবে তার ভেতরে নতুন একটা অনুভূতি জন্ম নিল। শহুরে কোলাহল, উচ্চাভিলাষ, ক্যারিয়ারের পরিকল্পনা—সব যেন মুহূর্তেই তুচ্ছ হয়ে গেল সেই নীল পাড়ের শাড়ি পরা মেয়েটির এক ঝলক হাসিমুখের সামনে।

দিনটা তারপর ধীরে ধীরে কেটে গেল। মামার বাড়িতে অতিথি-অভ্যর্থনা, গ্রামের মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি, চারপাশে অচেনা পরিবেশ—সবই ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু অয়ন জানত, তার মন আর কোথাও নেই, বারবার ফিরে যাচ্ছে সেই মুহূর্তে, যখন কুসুমের সঙ্গে চোখ মিলেছিল। সে নিজেই অবাক হচ্ছিল—কীভাবে সম্ভব, একবার দেখা হওয়া একজন মেয়ে তার হৃদয়ে এতটা আলোড়ন তুলতে পারে? সে মনের মধ্যে আবারও ছবিটা এঁকে নিল—সাদা শাড়ি, নীল পাড়, কলসীতে ভরা জল, কপালের ঘামে ভিজে যাওয়া সরল মুখ, আর সেই চোখ, যে চোখের দিকে তাকালে নিজের ভেতরের অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শহরে থাকলে হয়তো এই অনুভূতিকে সে হেসে উড়িয়ে দিত, কিন্তু এখানে, এই নিস্তব্ধ গ্রামে, সে জানল—এই প্রথমবার সে সত্যিই কারও দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাল, সত্যিই হৃদয়ের গোপন কোণে এক অচেনা সুর বেজে উঠল। অয়ন বুঝতে পারল, এ কেবল একটি দেখা নয়, বরং তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

অয়ন সেই দিন থেকে যেন অস্থির হয়ে পড়েছিল। প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকে বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই মেয়েটির রূপ—নীল পাড়ের শাড়ি, কূপের ধারে ঝুঁকে থাকা, আর এক ঝলক চোখে চোখ রাখা। সে নিজেই অবাক হচ্ছিল, কীভাবে এক অচেনা মুহূর্ত তার মনে এত গভীর ছাপ ফেলতে পারে। শহরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না, বরং গ্রামের সরল জীবন তার কাছে ক্রমে এক অদ্ভুত আকর্ষণ হয়ে উঠছিল। দুপুরবেলা মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে মাটির পথ ধরে হেঁটে গেল মাঠের দিকে। চারদিকে সোনালি ধানের ঢেউ, বাতাসে দুলছে শিস্‌ দিচ্ছে যেন। সেই মাঠের ধারে গিয়ে হঠাৎ অয়ন থমকে দাঁড়াল—একটা ছায়াঘেরা জায়গায় কুসুম বসে আছে, হাতে একটা পুরনো বই। তার চারপাশে প্রকৃতির শান্ত নিস্তব্ধতা, আর কুসুম যেন তার মধ্যেই ডুবে আছে। মেয়েটিকে দেখে অয়ন প্রথমে দ্বিধায় পড়ল—যাবে কি যাবে না, কথা বলবে কি না। কিন্তু মনে হল এ সুযোগ যদি হারায়, তবে হয়তো আর কখনো আলাপের সুযোগ আসবে না।

অয়ন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, কুসুম প্রথমে টেরই পেল না। তারপর হঠাৎ তাকাতেই চমকে উঠল। কপালে হালকা ঘাম, মুখে লজ্জার ছায়া। সে বইটা গুটিয়ে রাখতে যাচ্ছিল, কিন্তু অয়ন হেসে বলল, “না, লুকিও না। বই পড়ছো, তাই তো? কোন বইটা?” কুসুম দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিল, “এ তো বাংলা গল্পের বই… শরৎচন্দ্রের। আমি মাঝে মাঝে পড়ি।” অয়ন মুগ্ধ হয়ে তাকাল—একটি গ্রামের মেয়ে, এত সরলতার মধ্যে থেকেও বইয়ের প্রতি ভালোবাসা রাখে। শহরে মেয়েদের হাতে অনেক ফ্যাশনের বই বা মোবাইল দেখা যায়, কিন্তু কুসুমের হাতে ছিল পুরনো কাগজের গন্ধ মাখা একটি উপন্যাস। অয়ন মৃদু হেসে বলল, “শরৎচন্দ্র আমারও প্রিয়। শহরে আমরা অনেক বই পড়ি, কিন্তু এখানে তোমাকে এভাবে পড়তে দেখে আমার অদ্ভুত ভালো লাগছে।” কুসুম প্রথমে বেশি কথা বলল না, কিন্তু অয়নের আন্তরিকতায় ধীরে ধীরে মুখ খুলল। জানাল, পড়াশোনা তার ভীষণ ভালো লাগে, কিন্তু অভাব আর সমাজের বাধার কারণে বেশি দূর পড়তে পারছে না। স্কুল শেষ করেছে কষ্ট করে, এখন আর সুযোগ নেই। তবুও স্বপ্ন আছে—কোনোভাবে যদি কলেজে ভর্তি হতে পারত!

অয়ন মন দিয়ে শুনছিল। তার নিজের জীবনটাও কিন্তু এত সহজ নয়। শহরে জন্ম, ভালো স্কুল, নামী কলেজ—সবই আছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অয়ন খুঁজে ফিরছে অন্য কিছু। তার মনে হয় শহরের কোলাহলে মানুষ কেবল দৌড়াচ্ছে, কিন্তু কেউ সত্যিই নিজের হৃদয়কে বোঝে না। সে কুসুমকে বলল, “জানো, আমি শহরে থেকে থেকেও অনেক সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলি। মনে হয়, আমি কে, কী চাই, কিছুই বুঝি না। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে—তুমি যদিও ছোট্ট এক গ্রামে আছো, তবুও তুমি জানো তোমার স্বপ্ন কী।” কুসুম মৃদু হেসে বলল, “স্বপ্ন থাকলেই তো সব পাওয়া যায় না। আমাদের মতো মেয়েদের অনেক বাধা।” তার কণ্ঠে তীব্র হতাশা শোনা গেল, কিন্তু সেই সুরের মধ্যেও ছিল এক অদম্য জেদ। অয়ন অনুভব করল, এই সরল মেয়েটির ভেতরে এক অচেনা শক্তি আছে, যা শহরের অভিজাত মেয়েদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। দু’জনের কথোপকথনে সময় কখন কেটে গেল, তারা টেরও পেল না। বাতাসে ধানের গন্ধ, আকাশে উড়ন্ত সাদা মেঘ, আর মাঠের মধ্যে তাদের আলাপ যেন কোনো অজানা সেতুবন্ধন তৈরি করছিল।

সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। কুসুম উঠে দাঁড়াল, বলল তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। অয়ন তার মুখের দিকে চেয়ে রইল, যেন চোখ সরাতে পারছিল না। বিদায় নেওয়ার আগে কুসুম একবার তাকাল, চোখে একধরনের দ্বিধা আর গোপন আকর্ষণ একসঙ্গে। অয়ন শুধু বলল, “তুমি বই পড়া চালিয়ে যেও, আমি যদি কোনোদিন সুযোগ পাই তোমাকে বই এনে দেব।” কুসুম কিছু না বলে শুধু মৃদু হেসে চলে গেল। অয়ন মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থেকে গেল অনেকক্ষণ। তার মনে হচ্ছিল, জীবনের প্রথমবার যেন সত্যিকারের এক আলাপ হয়েছে—যেখানে সাজসজ্জা, ভান বা বাহ্যিকতা নেই, আছে শুধু স্বপ্ন আর মনের টান। সেই দিনের পর থেকে অয়ন জানল, এই মেয়েটির সঙ্গে তার দেখা কেবল কাকতালীয় নয়, বরং নিয়তির অদ্ভুত আয়োজন। কুসুমের সরলতা আর স্বপ্ন তাকে এমনভাবে টানতে শুরু করল, যেভাবে মাঠের বাতাস ধানের শীষ দোলায়।

পরের দিনগুলোতে অয়ন আর কুসুমের দেখা হওয়া যেন এক নীরব অভ্যাস হয়ে দাঁড়াল। কখনো মাঠের ধারে, কখনো কূপের পাশে, কখনোবা গাছতলায় হঠাৎ তাদের চোখাচোখি হয়ে যেত। প্রথমে দু’জনেই কিছুটা লজ্জায় নীরব থাকত, কিন্তু ধীরে ধীরে আলাপ জমতে লাগল। অয়ন শহরের গল্প বলত—আলো ঝলমলে রাস্তা, সিনেমাহল, কলেজের আড্ডা, কফি শপের গন্ধ। কুসুম বিস্মিত চোখে শুনত, কখনো বিশ্বাস করতে পারত না যে পৃথিবী এত রঙিন হতে পারে। আর কুসুম বলত গ্রামের কথা—ধান কাটার গান, পূজোর সময় মেলা, শীতের সকালের কুয়াশা। অয়ন শুনে মুগ্ধ হত, যেন এতদিন তার শহুরে জীবনে যে শূন্যতা ছিল, কুসুমের কথায় তা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তবুও কুসুম মাঝে মাঝে হঠাৎ চুপ করে যেত। তার চোখে একধরনের ভয় আর দোটানা ফুটে উঠত, যা অয়ন বোঝার চেষ্টা করলেও পুরোটা ধরতে পারত না।

কুসুমের মনে ছিল ভীষণ দ্বিধা। তার হৃদয় টানছিল অয়নের দিকে, কিন্তু সমাজের চোখরাঙানি তাকে পিছু টানত। গ্রামের মেয়েদের জীবন সহজ নয়—তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে নজর রাখে লোকজন। কোথায় গেল, কার সঙ্গে কথা বলল, কেন হাসল—সবকিছুর বিচার চলে। কুসুম জানত, যদি গ্রাম দেখে ফেলে সে শহরের ছেলের সঙ্গে কথা বলছে, তাহলে কুৎসা ছড়াতে সময় লাগবে না। তার বাবা গম্ভীর মানুষ, সমাজের ভয়ে কখনোই এমন সম্পর্ক মেনে নেবেন না। তবুও কুসুম যখন অয়নের চোখের দিকে তাকায়, সেখানে সে খুঁজে পায় এক অদ্ভুত আন্তরিকতা, যা তাকে ভেতরে ভেতরে টানে। এই টান থেকে পালাতে চাইলেও বারবার সে ফিরে আসে। একদিন কুসুম অয়নকে বলল, “তুমি শহরের ছেলে, তোমার অনেক কিছু করার আছে। আমি তো স্রেফ গ্রামের মেয়ে। আমাদের মধ্যে কোনো মিল নেই।” অয়ন হেসে বলল, “মিল নেই বলছো কেন? আমাদের স্বপ্ন আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমি তোমার চোখে দেখেছি সাহস। সেই সাহসই তো আমার কাছে সবচেয়ে বড় মিল।” কুসুম চুপ করে রইল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার বুক কেঁপে উঠল।

অয়নও সহজে হার মানার ছেলে নয়। তার আত্মবিশ্বাস কুসুমকে ধীরে ধীরে ভরসা জোগাতে লাগল। শহরে অনেক ছেলেই মেয়েদের পেছনে ঘোরে, কিন্তু অয়নের মধ্যে আলাদা কিছু আছে—সে শুধু কুসুমকে পেতে চায় না, বরং কুসুমের স্বপ্নকে বুঝতে চায়, তাকে এগোতে সাহায্য করতে চায়। কুসুম যখন বলত, “আমার তো পড়াশোনাই শেষ হয়ে যাবে,” অয়ন সঙ্গে সঙ্গে বলত, “তাহলে আমি তোমাকে বই এনে দেব।” কুসুম যখন দুঃখ করত, “আমাদের সমাজ মেয়েদের কিছু করতে দেয় না,” অয়ন বলত, “তাহলে আমরা সমাজকে বদলাব।” এই কথাগুলো কুসুমের মনে আলো জ্বালাত, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও জাগাত—এত সাহসী ভাবনা কি সত্যিই বাস্তবে সম্ভব? তবুও অয়নের দৃঢ় কণ্ঠ আর স্নিগ্ধ চোখ তার মনে জায়গা করে নিল।

তবে দ্বিধা থেকে গেল। প্রতিবার দেখা হওয়ার সময় কুসুমের ভেতরে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন চলত। একদিকে অয়নের সঙ্গে কথা বললে তার মন ভরে যেত, যেন জীবনের নতুন স্বপ্ন জেগে উঠছে। অন্যদিকে মনে হত, যদি কেউ দেখে ফেলে? যদি বাবার কানে যায়? যদি সমাজ তাকে কলঙ্কিত করে? অয়নের আন্তরিকতা তাকে সাহস দিত, কিন্তু সেই সাহসের সঙ্গে ভয় মিশে থাকত সবসময়। তবুও, যতই কুসুম নিজেকে দূরে সরাতে চাইত, ততই অয়ন তার ভেতরে জায়গা করে নিত। এই টান আর দ্বিধার মাঝেই তাদের সম্পর্কের শেকড় গজাতে শুরু করল—যেন নিষিদ্ধ মাটিতে এক গোপন চারা গজাচ্ছে, আলো পাওয়ার তৃষ্ণায় আকাশের দিকে মাথা তুলছে।

গ্রামের পুকুরপাড়ে সন্ধের আলো ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসছিল। কাঁঠালের গাছের তলায় বসে কুসুম কচি কচি ঘাস ছিঁড়ছিল আর অয়ন তার পাশে বসে শহরের গল্প শোনাচ্ছিল। অয়ন বলছিল—কীভাবে কলকাতার উঁচু দালান, আলো ঝলমলে রাস্তা, ক্যাফে আর সিনেমাহল মানুষকে প্রতিদিন নতুনভাবে বাঁচতে শেখায়। সে বলছিল, কীভাবে শহরে সবকিছু হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়—লাইব্রেরি থেকে শপিং মল, আধুনিক শিক্ষা থেকে নানা রকম সুযোগ। কুসুম মন দিয়ে শুনছিল, কিন্তু শুনতে শুনতে তার চোখ ভিজে উঠছিল। কারণ সে জানত, তার নিজের পৃথিবী এত আলাদা যে, অয়নের বলা জগতটা তার কাছে স্বপ্নের থেকেও বেশি দূরের। সে বলল, “আমাদের গ্রামে তো ভালো ডাক্তারও নেই, স্কুলে মেয়েদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে যায়। বিদ্যুৎ মাঝে মাঝেই থাকে না, কিন্তু মাঠে খাটতে হয় প্রতিদিন। তবু এই মাটির গন্ধেই বাঁচি আমরা।” কণ্ঠে ছিল গর্বও, আবার চাপা বেদনা-ও। অয়ন অবাক হয়ে তাকাল—সে জানত, শহরের জৌলুস যেমন চমকে দেয়, তেমনি গ্রামীণ জীবনের মাটির টানও অন্যরকম শক্তি রাখে।

আলাপ চলতে চলতে দু’জনেই বুঝতে পারছিল, তাদের দুই পৃথিবী যতই ভিন্ন হোক, মনের টানটাই তাদের আসল। অয়ন যখন কুসুমকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি শহরে গেলে কি মানিয়ে নিতে পারবে?”, কুসুম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “মানিয়ে নেওয়া তো শিখে নিতে হয়, কিন্তু আমি কি আমার গ্রামকে ভুলতে পারব? এই নদী, মাঠ, এই কূপ, এই মানুষগুলো—এরা তো আমার অস্তিত্বের অংশ।” কথাগুলো শুনে অয়ন গভীরভাবে চিন্তা করল। শহরে জন্মে বড় হলেও তারও একটা চাপা আকাঙ্ক্ষা ছিল—নিজেকে শুধু কংক্রিটের ভিড়ে সীমাবদ্ধ না রেখে কিছু আলাদা ভাবে বাঁচার। কুসুমের সরলতা, তার মাটির গন্ধে ভরা জীবনচিত্র যেন সেই অপ্রকাশিত আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলছিল। তবু দু’জনেই বুঝতে পারছিল, তাদের মিলনের পথটা এত সহজ নয়। শহরের ছেলে-মানুষ গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে কি? অথবা এক গ্রামের মেয়ে শহরের বহমান জীবনে টিকে থাকতে পারবে কি? এই প্রশ্নগুলো তাদের ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল।

সন্ধ্যা নামার পরও তারা দু’জনে পাশাপাশি বসে থাকল। দূরে ভেসে আসছিল ঢাক-ঢোলের শব্দ, গ্রামে কোনো পূজা বা বিয়ের আয়োজন হচ্ছিল। সেই সুরে মিশে যাচ্ছিল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হঠাৎ অয়ন বলল, “তুমি জানো কুসুম, শহরে মানুষ সবকিছু পায়, কিন্তু এখানে যে শান্তি, যে নির্ভেজাল হাসি—সেটা নেই। সবাই শুধু দৌড়োয়। সম্পর্কগুলো কেমন যেন যান্ত্রিক।” কুসুম মুচকি হেসে বলল, “তাহলে কি তুমি শহরকে ছেড়ে এখানে থাকতে চাও?” প্রশ্নটা শুনে অয়ন থমকে গেল। সে জানত, তার পরিবার কোনোদিনও চাইবে না যে সে গ্রামে গিয়ে সংসার পাকাক। আবার কুসুমও জানত, তার নিজের পরিবার অয়নকে সহজে মেনে নেবে না। দু’জনের চোখে এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধার ছায়া ফুটে উঠল। কিন্তু সেই দ্বিধার মাঝেও তাদের দৃষ্টি এক অদ্ভুত মায়ায় বাঁধা রইল, যেন তারা একে অপরকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছিল না।

রাত গভীর হয়ে এলে অয়ন কুসুমকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য উঠল। পথে হাঁটতে হাঁটতে তারা আর তেমন কিছু বলল না, শুধু মাঝে মাঝে চোখাচোখি হচ্ছিল। নীরবতার মাঝেই লুকিয়ে ছিল অনেক কথা—শহর বনাম গ্রামের ফারাক, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, আর তবুও অদম্য টান যা তাদের বারবার কাছাকাছি টেনে আনছিল। বাড়ির দরজায় পৌঁছে কুসুম শুধু বলল, “শুভরাত্রি।” অয়ন মাথা নাড়ল, কিন্তু চলে আসতে আসতে তার বুকের ভেতর ঢেউ খেলে গেল—এই গ্রাম, এই মেয়ে, এই নীল পাড়ের শাড়ির সরল রূপ তার শহুরে জীবনের প্রতিটি উজ্জ্বল মুহূর্তকেও হার মানাচ্ছে। অন্যদিকে, কুসুম শুতে গেল বটে, কিন্তু জানল—আজ থেকে তার স্বপ্নগুলো আর আগের মতো সাদাসিধে নেই, তাতে শহরের আলো আর অয়নের চোখের ঝলক মিশে গেছে। দু’জনেই অনুভব করল—ভবিষ্যতের পথ সহজ নয়, তবু এই অসম মিলনই যেন তাদের সত্যিকার জীবনকে গড়ে তুলতে চলেছে।

কলকাতায় ফিরে আসার পর অয়ন যেন ভেতর থেকে অস্থির হয়ে উঠল। গ্রামে কয়েকটা দিন কাটানো তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কুসুমের সরলতা, তার চোখের গভীরতায় লুকোনো স্বপ্ন আর সেই নীল পাড়ের শাড়ি—সব কিছু যেন তার মনে দাগ কেটে বসেছিল। কলেজে পড়ার ফাঁকেই সে বাবাকে নিজের অনুভূতির কথা জানাতে চাইল। এক সন্ধ্যায় ড্রয়িংরুমে বসে অয়ন কথাটা তুলল। রমেশ বাবু, যিনি শহরের নামকরা ব্যবসায়ী, চোখ সরু করে তাকালেন ছেলের দিকে। অয়ন একটু ইতস্তত করেও স্পষ্ট করে বলল—সে গ্রামে থাকা এক মেয়েকে পছন্দ করে, নাম কুসুম। কথাটা শেষ হতেই রমেশ বাবুর গলা ভারী হয়ে উঠল। তিনি টেবিলে রাখা চশমা নামিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “তুমি কি ভেবেছ আমাদের সমাজে মান-সম্মান বলে কিছু নেই? শহরের শিক্ষিত ছেলের জন্য গ্রামের মেয়ে মানে লোকে কী বলবে জানো?” ঘরের পরিবেশ মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেল। অয়ন বাবার চোখে ভেসে ওঠা রাগ আর তাচ্ছিল্য টের পেল, কিন্তু তবুও নিজের ভেতরের আবেগকে চেপে রাখতে পারল না।

সুজাতা দেবী, অয়নের মা, পাশেই বসে ছিলেন। তিনি পুরো কথোপকথন চুপচাপ শুনছিলেন। মায়ের মুখে ছিল চাপা অশান্তি, কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। অয়ন আশা করছিল অন্তত মা হয়তো তাকে সমর্থন করবেন, কিন্তু মায়ের নীরবতা তাকে আরও ভারাক্রান্ত করে তুলল। রমেশ বাবু আবার গর্জে উঠলেন, “তুমি জানো আমরা কোন পরিবেশে থাকি? আমাদের আত্মীয়স্বজন, ব্যবসায়িক পরিচয়, সমাজে আমাদের অবস্থান—এসব কিছু তুমি এক মুহূর্তে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাও?” অয়ন শান্ত গলায় বলল, “বাবা, আমি শুধু কুসুমকে ভালোবাসি। সে সরল, সৎ আর স্বপ্নবাজ। মান-সম্মান শুধু ধন-দৌলত দিয়ে হয় না। মানুষের হৃদয় আর মনের মানই আসল।” কথাগুলো শুনে রমেশ বাবুর রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। তিনি টেবিলে হাত মেরে উঠলেন, “তুমি বোঝ না অয়ন, এই সমাজ তোমার ভাবনায় চলে না। গ্রামের মেয়ে মানে পিছিয়ে পড়া, মানে হাজার ঝামেলা। আমার ছেলে কোনোদিন ওখানে গিয়ে মানাবে না।”

অয়ন সেদিন রাতে নিজের ঘরে এসে জানালার ধারে বসে রইল। বাইরের শহুরে আলো ঝলমল তার চোখে পড়ছিল, কিন্তু তার মনে পড়ছিল গ্রামের পুকুরপাড়, কুসুমের হাসি আর তার বলা স্বপ্নের কথা। সে ভেবেছিল বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারবে, কিন্তু এখন বুঝল সামনে পথ আরও কঠিন। তবু সে জানত, তার অনুভূতি সে মুছে ফেলতে পারবে না। ভালোবাসা তার কাছে মানে ছিল না শুধু আবেগ, বরং প্রতিশ্রুতি। সে চুপচাপ মুঠোফোনে কুসুমের ছবি দেখতে লাগল—গ্রামের উঠোনে দাঁড়িয়ে বই হাতে থাকা মেয়েটি যেন তাকে নতুন করে সাহস দিচ্ছিল। মা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক তাকিয়ে থেমে গেলেন। কিছু না বললেও তার চোখে একটা মমতার ছায়া ছিল। অয়ন বুঝল, মা হয়তো কিছুটা হলেও তার কষ্টটা অনুভব করছেন, শুধু বাবার সামনে সাহস করে কিছু বলতে পারছেন না।

কয়েকদিন এভাবেই কাটল। রমেশ বাবু ইচ্ছে করে ছেলের সঙ্গে তেমন কথা বললেন না। তিনি চেয়েছিলেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অয়ন নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। কিন্তু অয়ন আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। বন্ধুদের সঙ্গেও সে এই ব্যাপারে আলোচনা করল, কেউ কেউ তাকে বোঝালো—গ্রাম-শহরের ব্যবধান এত সহজে মিটবে না, সমাজে হাজার প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু অয়ন জানত, প্রশ্নের ভয় করে সত্যিকারের ভালোবাসা ছেড়ে দেওয়া যায় না। তার কাছে কুসুম শুধু গ্রামীণ মেয়ে নয়, বরং তার নিজের খুঁজে পাওয়া জীবনের মানে। রমেশ বাবু একদিন স্পষ্ট বলে দিলেন, “অয়ন, তুমি যদি এই জেদ ছাড়তে না পারো, তবে আমাদের সম্পর্কও ভেবে দেখব।” কথাটা শুনে অয়নের বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে প্রতিজ্ঞা করল—যত আপত্তিই আসুক, সে নিজের ভালোবাসাকে ছাড়বে না। শহরের উঁচু দালানের ভেতর থেকে তার কানে যেন আবার ভেসে এলো কুসুমের কণ্ঠ—“মানিয়ে নিতে শিখে নিতে হয়।” সেই কথাটাই তাকে মনে করিয়ে দিল, পথ যত কঠিন হোক, তাদের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তার আসল দায়িত্ব।

গ্রামের হাওয়ায় যেন হঠাৎ একটা অস্বস্তির ভারী গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। কুসুম আর অয়নকে কেউ মাঠে একসঙ্গে বসে থাকতে দেখেছিল, কেউ আবার কূপপাড়ে কথা বলতে। এইটুকুই যথেষ্ট ছিল গুজব ছড়ানোর জন্য। গ্রামের চায়ের দোকান থেকে হাটের মোড়, সবখানেই কানাঘুষো শুরু হলো—“ওই মেয়েটা শহুরে ছেলেকে ফাঁসিয়েছে।” কিছু মানুষ হেসে হেসে কটু কথা বলল, কেউ আবার নাক সিটকাল। কুসুমের কানে যখন এইসব কথা পৌঁছোল, তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। এতদিন যেটা ছিল একেবারে ব্যক্তিগত—তার মনের ভেতরের টান আর গোপন আলাপচারিতা—হঠাৎ করে যেন পুরো গ্রামের বিচারসভায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। সন্ধ্যায় যখন সে বাড়ি ফিরল, তখন দেখল বাবা হরিদাস চাষার চোখ লাল হয়ে আছে। ঘরে ঢুকতেই বাবা গর্জে উঠলেন, “এ কি শুনছি আমি? গ্রামের মান-সম্মান ডুবিয়ে দিচ্ছিস? শহরের ছেলের সঙ্গে আলাপ জমানোর সাহস হলো তোর?” কুসুম ভয়ে থমকে গেল। সে চেয়েছিল বাবাকে সত্যিটা জানাতে, কিন্তু বাবার রাগান্বিত মুখ দেখে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।

হরিদাস চাষা ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। সারা জীবন মাটির সঙ্গে লড়াই করে সংসার টেনেছেন, লোকসমাজের মান-সম্মান তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। তিনি কুসুমকে ধমক দিয়ে বললেন, “আমাদের মেয়ে হয়ে গ্রামের নিয়ম ভাঙতে পারিস না। মেয়েদের জন্য সমাজে অনেক বাঁধা, আর তুই সেটা জানিস না? শহরের ছেলেদের ভরসা করে জীবন চলে না।” কুসুমের চোখে জল এসে গেল। সে বলতে চাইল, অয়ন অন্যরকম, তার চোখে স্বপ্ন আছে, তার কথায় সত্যি আছে—কিন্তু বাবার সামনে দাঁড়িয়ে এই সাহস তার হলো না। মা সরলা পাশে এসে মৃদু গলায় বললেন, “এমন করলে তোর জীবনই শেষ হয়ে যাবে, কুসুম। লোকজন তোর নামে কী না বলে! মেয়ে মানুষের জন্য সমাজের জিহ্বা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।” সরলা যদিও জানতেন, মেয়ের মন অন্য জায়গায় বাঁধা পড়েছে, তবু তিনি ভয় দেখিয়েই তাকে সামলাতে চাইলেন। কুসুম নীরবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু তার ভেতরের টানটাও অটুট রইল।

এরপরের দিনগুলো আরও কঠিন হয়ে উঠল। গ্রামজুড়ে নানা কথা ঘুরতে লাগল। কেউ বলল, “শহরের ছেলে তো খেলে বেড়াবে, শেষে মেয়েটার জীবন শেষ করবে।” কেউ বলল, “ওরা যদি পালিয়ে যায়?” এমনকি পুকুরঘাটে জল তুলতে যাওয়া কুসুমকে অন্য মেয়েরা ফিসফিস করে এড়িয়ে চলতে লাগল। একসময়ে যাদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় কাটত তার দিন, তারা পর্যন্ত আজ দূরে সরে গেল। কুসুম বুঝল, সমাজের চাপ শুধু পরিবারের ভেতরেই নয়, বাইরেও এক ভয়ঙ্কর শক্তি হয়ে উঠছে। রাতে সে বিছানায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবত—তার কি সত্যিই ভুল হচ্ছে? তার ভালোবাসা কি সত্যিই গ্রামের মানহানির কারণ? অথচ অয়নের চোখের দৃঢ়তা মনে পড়তেই তার বুকের ভেতর আবার নতুন আলো জ্বলে উঠত। সে জানত, এই টান মিথ্যে নয়, এটা কোনো হঠকারিতা নয়, বরং সত্যিকারের আবেগ।

হরিদাস চাষা মেয়েকে নিয়ে আরও কড়া হয়ে উঠলেন। তিনি ঠিক করলেন, কুসুমকে এখন থেকে বাড়ির বাইরে কম বেরোতে দেবেন। সরলা মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “মা, সব স্বপ্ন সবার পক্ষে পূরণ হয় না। তোকে বাস্তব মানতে হবে।” কিন্তু কুসুমের মনে তখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—একদিকে বাবার রাগ, মায়ের ভয়, গ্রামবাসীর চাপ; অন্যদিকে অয়নের প্রতি অটল ভালোবাসা। সে জানত, এই সমাজ সহজে বদলাবে না। হয়তো তার জন্য সামনে লড়াই আরও কঠিন হবে। কিন্তু তার মন তখনও বলছিল—ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে কোনো বাঁধাই তাকে আটকে রাখতে পারবে না। সেই বিশ্বাসই তাকে অন্ধকারের মধ্যেও আলো দেখাচ্ছিল।

অয়ন শহরে বাবার আপত্তি, আত্মীয়স্বজনের ব্যঙ্গ আর সমাজের চাপ সয়ে অবশেষে আবার গ্রামে ফিরে এল। তার মন যেন দিন রাত কুসুমের চিন্তাতেই ভরে থাকত। ট্রেন থেকে নামতেই গ্রামের খোলা হাওয়া বুক ভরে নিল, যেন তাকে সাহস দিল। সোজা মামার বাড়ি গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করল, কিন্তু মন টানছিল নদীর ধারে। সন্ধ্যার দিকে সে কুসুমকে খবর পাঠাল—নদীর ঘাটে দেখা করতে। কুসুম প্রথমে দ্বিধায় পড়ল, এত কিছুর পর আবার দেখা করা কি ঠিক হবে? বাবার কড়া চোখ, মায়ের সতর্ক বাণী, গ্রামের লোকের তির্যক মন্তব্য সব মনে পড়ছিল। তবু মনে হলো—অয়ন যদি এত বাধা সত্ত্বেও এখানে আসে, তবে তাকেও পিছিয়ে যাওয়া মানায় না। মাটির পথ ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে কুসুম নদীর ঘাটে পৌঁছোল। দূরে অয়ন দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে এক অদম্য দৃঢ়তা। তাকে দেখেই কুসুমের বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত শান্তিও নেমে এলো।

নদীর জলে তখন গোধূলির আলো ঝিকমিক করছিল। দু’জনের দেখা হতেই প্রথমে নীরবতা নেমে এল। অয়ন এগিয়ে এসে বলল, “কুসুম, আমি অনেক ভেবেছি। বাবা রেগে আছেন, সমাজ আমাদের বিরুদ্ধে, তবুও আমি তোমাকে ছাড়ব না। যা-ই হোক, আমি লড়ব।” তার গলার স্বর দৃঢ়, চোখে কোনো দ্বিধা নেই। কুসুম নিচু চোখে নদীর দিকে তাকাল। তার ভেতরে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে জানে, এই পথ সহজ নয়। কিন্তু একইসঙ্গে জানে, অয়নের কথায় যে সত্যি আর যে সাহস আছে, তা উপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। একটু থেমে কুসুম বলল, “তুমি জানো না, এখানে কত চাপ। লোকজন প্রতিদিন আমার নামে কথা বলছে, বাবা রাগে ফুঁসছে। আমি ভয় পাই, আমাদের জন্য তোমার জীবনে ঝামেলা বাড়বে।” অয়ন তার হাত ধরে বলল, “ভয় পেও না, কুসুম। ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে লড়াই আমাদের দায়িত্ব। আমি তোমাকে ছাড়ব না।” কথাগুলো যেন কুসুমের হৃদয়ে নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল।

সেই মুহূর্তে কুসুম বুঝল, ভালোবাসা শুধু আবেগ নয়, বরং এক শক্তি—যা মানুষকে লড়াই করতে শেখায়। তার চোখে জল ভরে উঠল, কিন্তু সেই জলের ভেতর ছিল দৃঢ়তার ঝিলিক। সে আস্তে বলল, “আমিও ছাড়ব না, অয়ন। যত বাধাই আসুক, আমি লড়ব তোমার সঙ্গে।” এই প্রতিজ্ঞার মধ্যে দিয়ে দু’জনের সম্পর্ক যেন এক নতুন রূপ নিল। এতদিন শুধু চুরি চুরি দেখা, কথা আর টানাটানির মধ্যে আবদ্ধ ছিল তাদের সম্পর্ক। আজ সেই টান রূপ নিল সাহসী সিদ্ধান্তে। নদীর হাওয়া দু’জনের চুলে খেলা করছিল, আর ঢেউয়ের শব্দ যেন তাদের প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হয়ে রইল। দূরে কোথাও শঙ্খচিল উড়ে যাচ্ছিল, যেন তাদের নতুন আশার বার্তা দিচ্ছে।

রাত ঘনিয়ে এলো, কিন্তু দু’জনেই আর তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফেরার কথা ভাবল না। তারা জানল, আগামী দিনগুলো সহজ হবে না। বাবার রাগ, মায়ের ভয়, সমাজের বাঁধাধরা নিয়ম—সবকিছুই তাদের পথে কাঁটা ছড়াবে। তবু তারা আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, একে অপরকে ছাড়া যাবে না। অয়ন বলল, “কুসুম, হয়তো আমাদের লড়াই দীর্ঘ হবে, হয়তো আমরা হেরে যাব, তবুও আমি চাই আমরা চেষ্টা করি।” কুসুম মৃদু হাসল, সেই হাসিতে ভেসে উঠল অবিচল ভালোবাসা। সে বলল, “হার বা জেতা নয়, তোমার সঙ্গে পথ চলাটাই আমার স্বপ্ন।” এই কথাগুলো শুনে অয়ন যেন এক নতুন শক্তি পেল। দু’জনের হাত তখন শক্ত করে বাঁধা, যেন এই পৃথিবীর কোনো ঝড়ই আর তাদের আলাদা করতে পারবে না। নদীর তীরে সেই রাতের প্রতিজ্ঞা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল—ভালোবাসা আর সাহস এখন থেকে তাদের অস্ত্র হয়ে উঠল।

অয়নের প্রতিজ্ঞার পর কুসুমের মনে যে সাহস জন্মেছিল, তা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারল না। অয়ন যখন শহরে ফিরে গেল, তার বাবা রমেশ বাবু তাকে একেবারে কঠোরভাবে আটকে রাখলেন। কলেজে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে মেলা-মেশা—সব কিছুতেই নজরদারি বাড়ানো হলো। যেন তিনি বুঝে গেছেন, সুযোগ পেলে ছেলে আবার গ্রামে যাবে। অয়ন প্রথম দিকে মায়ের সাহায্যে কুসুমের সঙ্গে চিঠিপত্র চালাচালি করার চেষ্টা করল, কিন্তু সেসবও একসময় অসম্ভব হয়ে পড়ল। ফোন করা বা বার্তা পাঠানো—কোনো পথই খোলা থাকল না। শহরের বন্দিত্বে অয়ন ভেতর থেকে ভেঙে যাচ্ছিল, কিন্তু কুসুমের কথা মনে পড়লেই সে বুক শক্ত করত। এইদিকে গ্রামে কুসুম প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিল। তার বাবা হরিদাস চাষা রেগে গিয়ে একেবারে সিদ্ধান্ত নিলেন—মেয়েকে আর হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। পরিবার মিলে ঠিক হলো, কুসুমের বিয়ে দ্রুত অন্যত্র দিয়ে দেওয়া হবে। কুসুম মায়ের কাছে কান্নাকাটি করলেও মা সরলা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “মা, সমাজের সঙ্গে লড়াই করা সহজ নয়।”

গ্রামে কানাঘুষো তখন তুঙ্গে। কেউ সরাসরি কুসুমকে মুখের ওপর বলছিল, “তুই লজ্জা দে গ্রামটার।” কেউ আবার আড়ালে মন্তব্য করছিল, “শহরের ছেলেকে আঁকড়ে ধরে কিছু হবে না, শেষে মেয়েটা কলঙ্ক হয়ে বাঁচবে।” এমনকি পাড়ার মেয়েরা যাদের সঙ্গে কুসুম একসময় খেলত, তারাও এখন তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। চুলোর ধোঁয়া উঠতে থাকা উঠোনে কুসুম যখন বসে থাকত, পাশের বাড়ি থেকে কারও ফিসফিসানি কানে আসত—“ওকে সমাজচ্যুত করলেই ভালো হয়।” এ কথাগুলো তার কানে বাজত বিষের মতো, বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে যেত। তবুও কুসুম মনে মনে আঁকড়ে থাকত সেই নদীর ধারে অয়নের বলা প্রতিজ্ঞার কথা—“যা-ই হোক, আমি তোমাকে ছাড়ব না।” কুসুম জানত না অয়ন আসতে পারবে কি না, যোগাযোগ করবে কি না, কিন্তু তার কথাগুলোই তাকে টিকিয়ে রাখছিল।

বিয়ের প্রসঙ্গ শুরু হতেই কুসুমের ভয় যেন আরও বেড়ে গেল। পাড়ার লোকেরা সম্ভাব্য পাত্রের কথা বলতে লাগল। কেউ বলল, “ওই গ্রামের জমির মালিকের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দাও।” আবার কেউ বলল, “ওপারের গাঁয়ের ব্যবসায়ীর ছেলেকে দিলে মন্দ হবে না।” হরিদাস চাষা সব শুনে চুপ থাকতেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একরকম চাপা রাগে ফুঁসছিলেন। তিনি কুসুমকে খোলা গলায় বললেন, “তোর সব জেদ মিটে যাবে বিয়ের পর।” কুসুম চোখে জল নিয়ে বলল, “বাবা, আমি চাই না। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি।” কিন্তু বাবার কানে সে কথা গেল না। সরলা শুধু মেয়ে আর স্বামীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার নিজের ভেতরেও ভয় ছিল—গ্রামের মানুষদের বিরুদ্ধাচরণে দাঁড়ানো মানে বিপদ ডেকে আনা। এভাবে প্রতিটি দিন কুসুমের জীবনে একেকটা ঝড় হয়ে আসতে লাগল।

রাতে ঘরের অন্ধকারে কুসুম অনেক ভেবেছে। একদিকে বাবার কঠোর সিদ্ধান্ত, অন্যদিকে সমাজের ভয়াল হুমকি, আর তার মাঝখানে অয়নকে না পাওয়ার যন্ত্রণা। কখনও মনে হয়েছে ভেঙে পড়ুক সব, যাকগে জীবন; কিন্তু আবার মনে পড়েছে অয়নের চোখে দেখা সেই দৃঢ়তা, তার বলা কথা—“আমরা চেষ্টা করব, হার বা জেতা নয়।” সেই স্মৃতিই তাকে প্রতিবার নতুন করে দাঁড় করিয়েছে। বাইরের ঝড় যতই তীব্র হোক, কুসুমের বুকের ভেতর অয়নের প্রতিশ্রুতিই ছিল আশ্রয়। সে জানত, সামনে আরও বড় পরীক্ষা আসছে, কিন্তু সেই পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে ভালোবাসার জোরেই। গ্রাম তাকে সমাজচ্যুত করতে চাইছে, পরিবার তাকে জোর করছে, কিন্তু কুসুম নিজেকে বলছিল—“আমি লড়ব। আমি ভাঙব না।” এইভাবে ঝড়ের দিনের ভেতরেও সে প্রতিদিন নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলছিল, শুধু একটাই ভরসা নিয়ে—অয়ন একদিন আবার ফিরবে।

অয়ন যখন শহর থেকে ছুটে গ্রামে পৌঁছাল, তখন পুরো গ্রামটায় যেন অদ্ভুত একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে ছিল। কুসুমের বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে, গ্রামের মাতব্বররা হরিদাস চাষাকে প্রায় জোর করে রাজি করিয়েছে। অয়ন খবর পেয়েই আর দেরি না করে ট্রেনে চেপে বসেছিল, আর তার চোখে-মুখে তখন শুধু একটাই সংকল্প—যে কোনো মূল্যে কুসুমকে বাঁচাতে হবে। গ্রামের মাঠে যখন সে পৌঁছাল, তখন লোকজন জড়ো হয়েছে, আর চারদিকে গুঞ্জন, “শহুরে ছেলেটা ফিরে এসেছে।” চোখেমুখে কৌতূহল, কোথাও বিদ্বেষ, কোথাও আবার চাপা ঈর্ষা। অয়ন দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে বলে উঠল, “আমি এসেছি কথা বলতে, পালাতে নয়।” মুহূর্তেই একটা চাপা নীরবতা নেমে এলো। হরিদাস চাষা ভাঙা গলায় বললেন, “তুই জানিস সমাজের নিয়ম কী? আমরা ভয়ে ভয়ে বেঁচে আছি, এই সমাজ আমাদের ভাত খাওয়ায়, আমাদের সম্মান দেয়। সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি মেয়েকে কিভাবে তোর হাতে তুলে দিই?” তাঁর চোখে ভয়, লজ্জা আর অসহায়তা একসঙ্গে মিশে ছিল।

অয়ন বাবার কথা মনে করে আরও দৃঢ় হল। রমেশ বাবুও বলেছিলেন, “গ্রামের মেয়ে মানেই মান-সম্মান হারানো।” কিন্তু অয়ন জানত, আসল মান-সম্মান হলো নিজের সত্যিকারের অনুভূতিকে অস্বীকার না করা। সে সরাসরি গ্রামের মাতব্বরদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা যে সমাজের কথা বলছেন, সেই সমাজ কি আমাদের ভালোবাসাকে স্বীকার করতে এতটা অক্ষম? সমাজ যদি মানুষের সুখ কেড়ে নেয়, তবে তার মূল্য কোথায়?” মাতব্বররা চুপ করে গেল, তবে কেউ কেউ তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। এদিকে হরিদাস চাষা কাঁপা গলায় আবার বললেন, “আমি মেয়েকে ভিখিরি করব নাকি? লোকজন বলছে, মেয়েটা শহুরে ছেলেকে ফাঁসিয়েছে।” হঠাৎ কুসুম আর ধরে রাখতে পারল না। সে এগিয়ে এসে কেঁদে উঠল, “আমি কি মানুষ নই? আমারও কি ভালোবাসার অধিকার নেই? আমি কি শুধু বিয়ের বাজারে তোলা কোনো পণ্য?” তার কণ্ঠস্বর যেন বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সবাই এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।

মেয়েটির চোখের জলে সমাজের শত বছরের বাঁধাধরা প্রথা যেন এক নিমিষে কেঁপে উঠল। অয়ন কুসুমের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে বলল, “আজ যদি আমরা ভয় পাই, তবে কালও ভয় পেতে হবে। কিন্তু যদি এখন দাঁড়াই, তবে আমাদের পরের প্রজন্ম সাহস পাবে।” তার চোখে আগুন, কণ্ঠে দৃঢ়তা। গ্রামের লোকেরা নিজেদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু করল। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলল, “ছেলেটার কথা মিথ্যে নয়।” আবার কেউ বলল, “এমন কথা বলা সহজ, কিন্তু সমাজ ভাঙা কি এত সোজা?” হরিদাস চাষার চোখে জল এসে গেল। তিনি হয়তো বুঝতে পারছিলেন, মেয়ে ঠিকই বলছে। সরলা, কুসুমের মা, এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এবার তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “একজন মা হিসেবে আমি জানি, মেয়ের হাসি-খুশিই আসল, সমাজের ভয়ে তাকে কষ্ট দেওয়া নয়।” এই কথাগুলো যেন আরেকবার সবার মনে ঢেউ তুলল।

শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছল, যেখানে নীরবতাই হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় উত্তর। কেউ সরাসরি সমর্থন করল না, কিন্তু কেউ প্রতিবাদও করল না। অয়ন, কুসুম, আর তাদের পরিবার যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধ জিতে গেল। কুসুম চোখ মুছে অয়নের দিকে তাকাল—চোখে এখনও ভয়ের ছাপ থাকলেও সেখানে ভরসার আলোও জ্বলছিল। অয়ন তার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “আমরা একসঙ্গে লড়ব। তুমি একা নও।” গ্রামের বাতাসে তখনও ফিসফিসানি ভাসছিল, কিন্তু সেই ফিসফিসানির ভেতরেই নতুন এক যুগের আভাস মিলল—যেখানে ভালোবাসা সমাজের শিকল ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগাবে।

১০

গ্রামের ভেতরে উত্তেজনা থামলেও অশান্তি পুরোপুরি মুছে যায়নি। অয়ন শহর থেকে আবার গ্রামে আসার পর, দিন কয়েক যেন বাতাসও ভারী হয়ে উঠেছিল। সবাই ফিসফিস করে কথা বলছিল—“মেয়েটা কি সত্যিই ওই শহুরে ছেলেকে বিয়ে করবে?”—কেউ কেউ মুচকি হাসছিল, কেউ বা সন্দেহ করছিল। কিন্তু একদিন বিকেলে হঠাৎ করে গ্রামের মন্দির চত্বরে যখন দু’পরিবার মুখোমুখি হল, তখন দেখা গেল পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। অয়নের মা সুজাতা দেবী আর কুসুমের মা সরলা দুজনেই পাশে দাঁড়িয়ে রমেশ বাবু ও হরিদাস চাষাকে বোঝাতে শুরু করলেন। সুজাতা বললেন, “আমরা তো মেয়ে মানুষ, সমাজের নিয়ম-কানুন আমাদেরই বেশি বেঁধেছে। কিন্তু আমি জানি, সন্তানের মুখের হাসির চেয়ে বড় কিছু নেই।” সরলা কাঁপা গলায় যোগ করলেন, “আমার কুসুম অনেক কষ্ট করেছে, এখন যদি তার স্বপ্ন ভেঙে দিই, তবে মায়ের দোষ ক্ষমা হবে না।” এই কথাগুলো যেন দুই কঠোর পুরুষ হৃদয়ে ধাক্কা দিল। একসময় রমেশ বাবু মাথা নিচু করে রইলেন, আর হরিদাসের চোখে জল ভরে উঠল। ধীরে ধীরে চারপাশের চাপা বিরোধিতার বদলে এক ধরনের নীরব মেনে নেওয়া ছড়িয়ে পড়ল।

বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হতে দেরি হলো না, যদিও গ্রামে কেউ প্রকাশ্যে উৎসব করল না। সমাজের ভয় এখনো রয়ে গেছে, তবু ভেতরে ভেতরে অনেকে মেনে নিয়েছিল। কুসুমের মা যত্ন করে মেয়ে’র জন্য শাড়ি গুছিয়ে রাখলেন—সেই নীল পাড়ের শাড়ি, যা কুসুম বহুবার পড়েছে, কিন্তু আজকের দিনে তা অন্য রকম অর্থ বহন করছে। অয়ন যখন কুসুমকে দেখে বলল, “এই শাড়িতেই তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম, মনে আছে?”, কুসুম হাসল, তবে চোখ ভিজে উঠল। সে জানত, এই শাড়ি আর শুধু তার সরলতার চিহ্ন নয়, এটা এক লড়াইয়ের প্রতীক, যেখানে ভালোবাসা সমাজের বাঁধা ভেঙে সামনে এসেছে। এদিকে গ্রামের মেয়ে-বউরা আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কারও চোখে ঈর্ষা, কারও চোখে আবার সাহসের ঝিলিক। কুসুম বুঝল, হয়তো আজকের এই সাহস ভবিষ্যতে অন্য মেয়েদেরও পথ দেখাবে।

বিয়ের দিন সকালে গ্রামের মাঠে ছোট করে মণ্ডপ সাজানো হলো। কেউ ধুমধাম করে বাজনা বাজাল না, তবু বাতাসে এক অদ্ভুত শান্তি ভেসে বেড়াল। অয়ন মণ্ডপে দাঁড়িয়ে ছিল, সাদা পোশাকে তাকে যেন অন্যরকম লাগছিল—আত্মবিশ্বাসী, তবু বিনয়ী। হঠাৎ যখন কুসুম নীল পাড়ের শাড়ি পরে মণ্ডপে এল, তখন চারদিক যেন এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গ্রামের লোকেরা তাকিয়ে রইল—মেয়েটি সত্যিই যেন অন্য আলোয় ঝলমল করছে। তার মুখে লাজুক হাসি, চোখে সাহস আর গর্ব। সুজাতা দেবী আর সরলা মৃদু হেসে একে অপরের হাত চেপে ধরলেন। মনে হলো, দুই মা-ই আজ নিজেদের জীবনের লড়াইয়ের জয় দেখছেন। কুসুম যখন অয়নের পাশে দাঁড়াল, তখন তাদের দুজনকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, এ সম্পর্ক আর ভাঙার নয়।

মন্ত্রোচ্চারণের শব্দে, ধূপের গন্ধে, আর চারপাশের সেই চাপা প্রত্যক্ষদর্শী সমাজের সামনে কুসুম ও অয়ন সাত পাকে বাঁধা পড়ল। মুহূর্তটা সাধারণ ছিল না—এ যেন এক প্রতীকী জয়, যেখানে ভালোবাসা সব বাঁধা ভেঙে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। কুসুমের নীল পাড়ের শাড়ি বাতাসে উড়ছিল, যেন গ্রামকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—ভালোবাসা শুধু দু’জনের বিষয় নয়, এটা এক সাহসী সিদ্ধান্ত, যা ভবিষ্যতের পথ খুলে দেয়। বিয়ের শেষে যখন কুসুম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল, তখনও তার চোখে ভেসে উঠছিল গোপন এক দৃঢ়তা—সে জানত, সামনে আরও পরীক্ষা আসবে, কিন্তু আজকের দিনটা প্রমাণ করল, ভয়কে জিতিয়ে দিয়ে জয়ী হয় প্রেমই। গ্রামের আকাশের নিচে, সমাজের ভেতরে আর দুই পরিবারের মধ্যবর্তী বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে নতুন গল্প শুরু হলো, আর সেই গল্পের প্রতীক হয়ে থাকল কুসুমের নীল পাড়ের শাড়ি।

****

1000062864.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *