অন্বেষা সেন
নীল করচা, নীল চোখ
বৃষ্টি থেমেছে। ঝাঁঝালো এক নীরবতা জমে আছে নদিয়ার ঠাকুরবাড়ির চারদেয়ালে। বাড়ির ভাঙা ভাঙা বারান্দায় দাঁড়িয়ে শ্রেয়া মনে মনে ভাবল, “সব রহস্যের শব্দ হয় না—কিছু শুধু নীরবতা দিয়ে ডাকে।”
তিন দিন ধরে সে এই পুরনো জমিদারবাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গবেষণার বিষয়: “উনবিংশ শতাব্দীর নারীলোকের গোপন আখ্যান ও অলিখিত তান্ত্রিক প্রথা।” ইতিহাস বিভাগ এহেন ‘পপুলার’ বিষয়ে নাক সিঁটকোলেও শ্রেয়ার গবেষণা গতি থামেনি। বরং গতকাল রাতে পুরনো আলমারির পেছনে এক নীল কাপড়ে মোড়া ডায়েরি পেয়ে তার গবেষণা হঠাৎই ধাঁধা হয়ে উঠেছে।
আজ সকালে সে ধুলো ঝেড়ে সেই নীল করচা খুলে পড়তে শুরু করে।
“শ্রীশ্রী বগলা মহাবিদ্যায় নমঃ।
এ ডায়েরি কেউ পড়লে জানুক—আমি বিষ্ণুপ্রিয়া, মৃত নয়। শুধু নীরব।”
শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে শ্রেয়ার। গা ছমছম করে, অথচ চোখ ছাড়ে না পাতাগুলোকে। লেখাগুলি হস্তাক্ষরে, তামার কালি দিয়ে লেখা। যেন কোনো নিষিদ্ধ শিল্পকর্ম।
প্রথম পাতায় ছিল কিছু অদ্ভুত মুদ্রা ও আঁকা এক মুখ—নারী না দানব ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, শ্রেয়া ডায়েরিটি ছুঁতেই হঠাৎ যেন পেছন থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল—”তুইও তোর গলা খুলবি, শ্রেয়া।”
সে চমকে ফিরে তাকাল। কেউ নেই। শুধুই সেই পরিত্যক্ত কক্ষের আধভাঙা আয়নাটা, যার গায়ে জল পড়ে একটা দাগ তৈরি হয়েছে—ঠিক যেন একটা চোখ।
দুপুরে দীপাঞ্জন ঘোষাল এলো। ইতিহাসের অধ্যাপক, শ্রেয়ার থিসিস সুপারভাইজার। রাশভারী, মৃদু কণ্ঠ, কিন্তু তীব্র চোখ।
“তুমি ডায়েরির কথা বলেছিলে ফোনে,” সে বলল, পুরনো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে, “কোথায় সেটা?”
শ্রেয়া ডায়েরিটা তুলে দিল। দীপাঞ্জন কিছুক্ষণ পড়ে একবার মুখ তুলে তাকাল। “তুমি জানো তো, এটি যদি সত্যি হয়, তবে এটি শুধু ইতিহাস নয়, এক নারীর আত্মঘোষণা। নারী তন্ত্রের নিঃশব্দ উচ্চারণ। কিন্তু একে ছাপানো যাবে না। এটা শুধু পড়ার জন্য, বুঝে ওঠার জন্য। রক্তে মেশানোর জন্য।”
শ্রেয়া প্রশ্ন করল, “আপনি বিশ্বাস করেন এগুলো?”
দীপাঞ্জন একটু থেমে বলল, “আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাসে শুধু যা লেখা থাকে তাই সত্যি নয়। কিছু সত্যি লেখা হয় শরীরে, স্পর্শে, অথবা দগদগে নির্জনতায়।”
সন্ধ্যায় শ্রেয়া একা থাকল। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, কেমন যেন ধূপের মতো গন্ধ। ডায়েরি হাতে নিয়ে সে আবার পড়া শুরু করল—
“বিধবা হয়েছি পনেরোতে। বলেছে—এখন থেকে সাদা পড়বি, নিঃশব্দ চলবি। কিন্তু আমার শরীর জানে, দেবী কী চায়। আমি গোপনে গেছি পুরোহিত নন্দকেশ্বরের কাছে। তিনিই আমার দীক্ষা দেন। প্রথমে স্বপ্নে দেখতাম বগলা দেবী—জিভ বার করে হাসছেন। পরে, আমি নিজেই তার রূপ পেলাম—হাসি দিয়ে খুন করতে পারি। ভয় দিয়ে ছাড়াতে পারি।”
পাতা থেকে যেন ধোঁয়া উঠছে। শ্রেয়া চোখ বন্ধ করল। আরেকটা ফিসফিসানি:
“ডাকছে তোর ভিতর থেকেও। নীল করচাটা কি পড়ছিস, না নিজেকেই খুলছিস?”
সেই রাতে, শ্রেয়া ঘুমাতে গিয়ে দেখল—সে দাঁড়িয়ে আছে এক শ্মশানে। চারপাশে লাল শাড়ির বিধবারা, চোখ ছলছল করছে, ঠোঁটে কালো মন্ত্র। মাঝখানে বসে আছে এক মহিলা—কালো মুখে সিঁদুরের আঁচড়, জিভটা লম্বা, হাতে রক্তমাখা পদ্মফুল।
“তুই প্রস্তুত তো?” সেই নারী বলল।
শ্রেয়া চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। ডায়েরির পাতার মতো জিভ আটকে আছে।
এক বিধবার উচ্চারণ
ঘুম ভাঙতেই শ্রেয়া নিজেকে চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় পেল। ডায়েরি খোলা, লাস্ট পৃষ্ঠায় আঙুল রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝি। কপালটা ঘামে ভিজে গেছে। বাইরে সকাল হলেও ঘরের বাতাস ভারী—আধেক ধূপ, আধেক বাসি জল। কিন্তু যা সবচেয়ে অদ্ভুত, তা হলো—ডায়েরির পাতায় নতুন কিছু লেখা দেখা যাচ্ছে, যা গতরাতে ছিল না।
“যখন আমি প্রথম ও-ঘরে ঢুকি, তখন শরীর কাঁপছিল। কেউ দেখে ফেললে কী হবে? কিন্তু তারও বড় ভয় ছিল—আমি নিজেকে দেখে ফেলব। নিজের কামনা, নিজের ভয়। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছিলেন। বললেন, ‘তুমি নিজের নাম ভুলে যাবে। এখন থেকে তুই বগলার কন্যা। তোর দেহ হবে দেবীর বাসস্থান।’”
শ্রেয়া হাত ছুঁয়ে দেখল পাতাটা। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর বুকের নিচে এক অদ্ভুত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল, যেন ভেতর থেকে কেউ নখর আঁচড় কেটে বলছে—“শুধু পড়লেই হবে না, তোরও তো বলার আছে, শ্রেয়া।”
সে উঠে দাঁড়াল। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখ পড়ল ভাঙা কুয়োর দিকে। কালরাতে সে শ্মশান দেখেছিল, আজ সকালে দেখে সেই কুয়োর পাশে কেউ যেন বসে—সাদা শাড়ি পরা, লাল আঁচলে ঢাকা মুখ। এক মুহূর্তে দেখল, আর এক মুহূর্তে কেউ নেই।
কলেজে ফিরে শ্রেয়া তার ল্যাপটপ খুলে ‘বগলা’ শব্দটার অর্থ অনুসন্ধান করল। দেবী বগলা মূলত দশ মহাবিদ্যার অন্যতম, যিনি নিষিদ্ধ আকর্ষণ, জিভ-বার-করা ব্যঙ্গ, কণ্ঠরোধ, স্তব্ধতা ও বুদ্ধিহীনতার দেবী। তাঁর সাধকরা কথা নয়, নীরবতার মাধ্যমে সিদ্ধি পেত।
একটা পঙ্ক্তি বারবার চোখে পড়ল:
“যার জিভ শক্তি হয়ে ওঠে, সে নিজেই বগলা। যার কণ্ঠ স্তব্ধ, সে তার সন্তান।”
ঠিক তখনই দীপাঞ্জনের ফোন এল।
—”তোমার কাছে কি ডায়েরিতে লেখা বিষ্ণুপ্রিয়ার নাম পুরো পাওয়া গেছে?”
—”হ্যাঁ, কেন?”
—”কারণ আমি কেবলমাত্র একটা জায়গায় তার নাম পেয়েছি—এক পুরনো অগ্নি-স্মারক পুরোহিতনামায়। তাতে লেখা আছে, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া সেন, যিনি ‘মন্ত্রভ্রষ্টা’, যিনি বগলার গৃহে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।’ কিন্তু ওই তথ্য পরে মুছে ফেলা হয়েছিল। আমার ধারণা, ডায়েরিটা শুধু তার নয়—তার কাম, লজ্জা, বিদ্রোহ, সব কিছুর কাহিনি।”
—”তাহলে এটা কি তার শেষ ইচ্ছা ছিল?”
—”না, শ্রেয়া। এটা ছিল তার উচ্চারণ। যা কখনো কেউ শুনতে চায়নি। এখন তুমি শুনছো। সাবধানে শোনো। কারণ ও উচ্চারণও একধরনের ডাক।”
রাতে শ্রেয়া ডায়েরির পরবর্তী অংশ খুলল।
“তৃতীয় রাত্রে আমি নগ্ন অবস্থায় বসলাম চতুষ্পদ আসনে। চোখে কাপড় বাঁধা, বুকের উপর একটা শালিক পাখি বসে রইল। পুরোহিত বললেন—‘ভয় পাস না। দেবী তোকে জানবে তোদের মত করে, যারা ভয় পায়, তারা বোঝে না কিরূপে মুক্তি আসে।’ আমি তখন দেখলাম, আমার দেহ আর দেহ নয়—একটা তামার পাত্র, যার ভেতরে অগ্নি লুকিয়ে আছে।”
সেই মুহূর্তে শ্রেয়া শুনতে পেল কারা যেন তার জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ছে। খুব নিম্নস্বরে, দ্রুত। সে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। কেবল ছায়া। তারপর—ঘরের দরজাটা নিজের থেকে বন্ধ হয়ে গেল।
পরদিন সকালে বাড়ির কাজের লোক চায়ের কাপ দিতে এসে জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম, আপনি রাত তিনটেয় বারান্দায় হাঁটছিলেন?”
শ্রেয়া অবাক। “না তো।”
লোকটা বলল, “আমি জেগে ছিলাম। দেখলাম সাদা শাড়ি পরা একজন মহিলা বারান্দা ধরে ঘুরছিলেন আর কি যেন নিচু গলায় বলছিলেন। আপনি না হলে তাহলে কে ছিল?”
শ্রেয়া কিছু না বলে ডায়েরির পাতায় চোখ রাখল। নতুন একটি বাক্য ঝিলমিল করছে, যেন কালি এইমাত্র শুকোল:
“তুইও উচ্চারণ করেছিস, শ্রেয়া। এখন থেকে তুইও কেবল পাঠিকা নোস, তুই বগলার কন্যা।”
কামনা ও করুণা
ডায়েরির পাতাগুলো যেন এখন আর কেবল ইতিহাস নয়—একটা জীবন্ত অভিজ্ঞতা। প্রতিটি বাক্য পড়তে পড়তে শ্রেয়ার কাঁধ ভারী হয়ে আসে, হৃদস্পন্দন বদলে যায়। এ যেন বিষ্ণুপ্রিয়ার আত্মার রক্তলিপি, যার প্রতিটি অক্ষর একেকটি স্পর্শ, একেকটি নিঃশ্বাস।
“সেই রাতে, আমি বুঝলাম কামনা আর করুণা একে অপরের শত্রু নয়। সমাজ বলে বিধবা নারীর কামনা পাপ, কিন্তু দেবী বলেন—কামনাই করুণা। নিজের দেহকে ভালোবাসাই তার পূজা।”
শ্রেয়া পড়ে যেতে থাকে। বিষ্ণুপ্রিয়া বলছেন তার প্রথম স্পর্শের কথা, সেই পুরোহিত নন্দকেশ্বরের সাথে এক ঘরে বসে যখন তার বুক কাঁপছিল, আর বাইরে চলছিল সন্ধ্যা আরতির ঘণ্টা।
“তিনি আমার কপালে এক ফোঁটা চন্দন দিলেন। বললেন—‘দেবী তোর ভেতরেই আছে। তুই নিজেকে নিষিদ্ধ ভাবিস না। তোর হাত, তোর স্তন, তোর জরায়ু—সবই তার মন্দির। তোর শরীর তোর মন্ত্র।’”
শ্রেয়া গলা শুকিয়ে যায়। গলা পর্যন্ত জল উঠে আসে, যেন সে নিজে দাঁড়িয়ে সেই ঘরের মাঝখানে, নগ্ন, প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের আলোয় লাল হয়ে উঠছে তার শরীর, আর সে শুনতে পাচ্ছে—“ওঁ হ্রীং বগলায়ৈ নমঃ”।
সন্ধ্যায় শ্রেয়া সিদ্ধান্ত নেয় যে এই ডায়েরি শুধু পড়ে রাখার জন্য নয়। এটিকে নিয়ে একটি নন-ফিকশন বই লেখা দরকার। নাম দিতে চায়—“নারীত্বের গোপন ঘর”। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে যায় দীপাঞ্জনের সতর্কতা: “সব উচ্চারণ প্রকাশযোগ্য নয়। কিছু কিছু শব্দ রক্তে মিশে থাকাই ভালো।”
তারপরই ফোন আসে দীপাঞ্জনের।
—”আজ আমার একটা কথা বলার আছে, শ্রেয়া। কাল রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। জানো, আমি স্বপ্নে দেখেছি বিষ্ণুপ্রিয়া আমাকে ডেকেছেন। বললেন—‘তুমি তো শুধু পড়ছো। কখন লেখবে নিজের কথা?’ এটা কি শুধু আমার এক্সপেরিয়েন্স, না কি ডায়েরি আমাদের দুজনকেই টানছে?”
—”আমিও…” শ্রেয়া থেমে যায়। কি বলবে? যে রাতে সে চুমু খেয়েছে এক অচেনা নারীর মুখে, নিজেরই শরীরের ভিতরে? যে সে নিজের কণ্ঠে শোনে অন্য এক গলার আওয়াজ?
রাতে সে আবার ডায়েরির কাছে ফিরে যায়। এবার একটু কাঁপা কাঁপা হাতে। পাতায় লেখা—
“যখন আমি প্রথম উরুর ফাঁকে হাত রাখি, আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। কিন্তু সেখানেই তো আমার করুণা বাসা বেঁধে আছে। কামনাই তো আমাকে জীবিত রাখে।”
হঠাৎ করে জানালার বাইরে থেকে একটা পাখির কণ্ঠস্বর—“টিঁ-টিঁ-টিঁ”—অদ্ভুত কর্কশ। শ্রেয়া জানে না কেন, শব্দটা শুনে তার মনে হলো কেউ যেন তাকে আহ্বান করছে… নিজের গভীর শরীরের দিকে, নিজের ভিতরের দেবীমূর্তির দিকে।
সেই রাতে ঘুম আসে না। দরজা খুলে সে দাঁড়ায় বারান্দায়। হঠাৎ পা পড়ে যায় এক ভেজা জায়গায়। দেখতে পায় একটা নীল রঙা কাপড় পড়ে আছে—একটু রক্ত লেগে। সে জানে না কার, কেন, কীভাবে।
ডায়েরির শেষ পাতায় হঠাৎ জ্বলে ওঠে একটা নতুন লাইন—
“তুইও কামনায় দগ্ধ, করুণায় ডুবে আছিস, শ্রেয়া। তোর দেহও এখন করচা।”
শরীর গরম হয়ে উঠছে, ঠোঁট জ্বলছে, বুক দুলছে। আর তখনই, হঠাৎ করেই ডায়েরির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক আঁকা হাত, যা শুধু কালি নয়—আলতা লেগে আছে যেন। সেটা ছুঁয়ে যায় শ্রেয়ার গলা, আর বলেই ওঠে—“উচ্চারণ কর। এবার তুই।”
তালপাতার নিঃশব্দ গর্জন
তালপাতার পাতা সাধারণত খসখসে, হালকা হলুদ। কিন্তু এই পাতাটা ছিল অদ্ভুত—ছাইয়ের মতো ধূসর, আর তার গায়ে অদ্ভুত এক লালচে রঙের হস্তাক্ষর। তামার মতো, অথচ রক্তের মতো ঘন।
ডায়েরির মাঝের দিকে গোঁজা ছিল পাতাটা—যেন কেউ পরে এঁটে রেখেছে, আদতে যা ছিল ডায়েরির অন্তর্গত নয়, বরং অতিরিক্ত, নিষিদ্ধ। পাতাটা খুলতেই এক ধাক্কায় বাতি নিভে যায়।
শ্রেয়া দম আটকে পড়ে থাকে, তারপর হাত গিয়ে ফোনের টর্চ জ্বালে। পাতার ওপর লেখাঃ
“আমি তালপাতা থেকে লিখেছি আমার আত্মঘাত। লিখেছি মন্ত্র, লিখেছি আহ্বান।
যদি এই পাতা খোলো, তবে তুই আর একা থাকবি না।
তোর মুখ দিয়ে আমার গর্জন শোনা যাবে।”
— বিষ্ণুপ্রিয়া
শ্রেয়া শব্দ করে পড়ে ফেলল ওই তিনটি লাইন। আর তখনই হঠাৎ কাঁধে এক ঠান্ডা স্পর্শ।
সে ঘুরে দেখে—ঘরে কেউ নেই। কিন্তু জানালার গ্লাসে ধোঁয়ার মতো ভেসে আছে একটি মুখ—অস্পষ্ট, কিন্তু নারীর, চোখ দুটি ফাঁকা, কিন্তু যেন কিছু বলছে।
সকালবেলায় শ্রেয়া সেই পাতাটার ছবি তুলে পাঠাল দীপাঞ্জনকে।
এক ঘণ্টা পর তার উত্তর আসে—
“এটা তালপাতায় লেখা দক্ষিণাচার ও বামাচার একত্রে মিশ্র তন্ত্রমন্ত্র। এগুলো খুব বিরল। এভাবে শরীর ও কামনার কথাকে মন্ত্রে বেঁধে রাখার ঐতিহ্য শুধু কিছু নারী সাধিকার মধ্যেই ছিল। তুমি জানো কি, এই ধরনের গোপন পুঁথি ‘নির্ঘণ্ট কায়া’ নামে পরিচিত ছিল?”
—“মানে?”
—“যে লেখাগুলি শরীরে লেখা হয়েছিল, মাটিতে ছোঁয়া যায় না, চোখে দেখা গেলেও ঠোঁটে বলা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। এই পাতা তেমন কিছু।”
শ্রেয়া সেদিন সারাদিন কথা বলে না কারো সাথে। তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘোরে: “আমি কি কেবল ডায়েরির পাঠক, না কি ধীরে ধীরে বিষ্ণুপ্রিয়ার ‘পাঠ্য’ হয়ে যাচ্ছি?”
রাতে সে আবার বসে ডায়েরি নিয়ে। বাতির নিচে বসে পড়ে এক পৃষ্ঠা—
“পঞ্চম রাতে পুরোহিত বললেন—আজ থেকে আমি নিজেই দেবী হব। আমায় বললেন, নগ্ন হয়ে একটি আয়নার সামনে দাঁড়াতে। আমি দাঁড়ালাম। প্রথমে লজ্জা, তারপর কৌতূহল, তারপর শুধুই দৃষ্টির আনন্দ। আমারই চোখ আমার শরীর দেখে বলে—‘তুই নিষিদ্ধ নোস, তুই অসীম।’”
শ্রেয়া জানে না কখন তার হাত চুঁইয়ে নামছে ঘাম, কপাল ঠাণ্ডা। তখন হঠাৎ দরজার নিচে দিয়ে সোঁ সোঁ করে কিছু সাদা কাগজ ঢুকে পড়ে।
সে দৌড়ে দরজা খুলে দেখে—কেউ নেই। শুধু সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে—পিছন ফিরে, মাথায় চুলের ঝাঁপটা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “ডাকলি কেন?”
শ্রেয়া কিছু বলতে পারে না। মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
সেই রাতেই ঘুমের মধ্যে শ্রেয়া দেখে সে একটা বড় উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে মাটির প্রদীপ। মাঝখানে একটি শবদেহ। সবাই সাদা শাড়ি পরে, কেউ মুখে কাপড় বেঁধেছে, কেউ নগ্ন বুক ঢেকেছে কেবল করচা দিয়ে।
তারা একসাথে বলতে থাকে,
“তালপাতার মন্ত্র শোন। আজ তুইও সঙ্গিনী। আজ থেকে তোর গলা, তোর জিভ, তোর স্তন—সবই শব্দ।”
তখন হঠাৎই মাঝখান থেকে উঠে আসে বিষ্ণুপ্রিয়ার কণ্ঠ—
“তুই এখন মেয়ে নোস। তুই এখন ভাষা।”
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই শ্রেয়া দেখে, বিছানার পাশে পড়ে আছে সেই তালপাতার পাতা। অথচ সে তো ডায়েরির ভেতর রেখেছিল। পাতার নিচে এক নতুন লাইন লেখা—
“এই পাতাই তোর কণ্ঠ হবে, শ্রেয়া। মুখ বন্ধ করলেই শব্দ শুনবি।”
বগলার দৃষ্টিপথ
ঘুম থেকে উঠে আয়নার দিকে তাকাতেই শ্রেয়ার শরীর কেঁপে উঠল।
সে দেখল তার মুখ নয়—আয়নায় দেখা যাচ্ছে এক অন্য মুখ। যেন তারই শরীর, কিন্তু চোখ দুটো লালচে, কপালে চন্দনের বদলে তামার ছোপ, ঠোঁটের কোণায় একধরনের বিদ্রুপী হাসি। এক মুহূর্তের মধ্যেই মুখটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু তার ভেতর একটা আওয়াজ রয়ে গেল, ভেসে আসা এক মন্ত্র—
“হ্রীং বগলায়ৈ নমঃ।
যে নিজেকে দেখে, সে নিজেকে ভুলে।
যে ভুলে যায়, সে জানে।
যে জানে, সে বলে না।
যে বলে না, সে পূর্ণ।”
শ্রেয়া পেছন ঘুরে দাঁড়াল। পুরো ঘর নিঃসাড়, কিন্তু বাতাস ঘন। ঘরের কাঁচের জানালায় কুয়াশার মতো ভেসে উঠছে এক চোখ—কখনো সাদা, কখনো নীল, কখনো রক্তিম।
সে ডায়েরি খুলল। আজ কোনো পৃষ্ঠা পড়ার দরকার পড়ল না। নিজের থেকেই পাতাগুলো উল্টে যেতে লাগল। বাতাস ছিল না। কিন্তু পাতাগুলো চলল।
অবশেষে থামল এক পাতায়, যেখানে লেখা ছিল:
“বগলার চোখে নিজেকে দেখা মানে
পিছনে ফিরে দেখাও নয়, সামনে গিয়ে হারিয়েও নয়।
মানে দাঁড়ানো, দেখে ফেলা।
যা অন্যরা দেখে না, তা নিজেকে দেখানো।”
তাকে দেখতে এল দীপাঞ্জন।
শ্রেয়া চুপচাপ বসে ছিল, জানালার পাশে। চুল এলোমেলো, চোখে জ্বালা। হাতে সেই তালপাতার পাতা।
দীপাঞ্জন বলল, “তুমি ঠিক আছ?”
সে কিছু বলল না। দীপাঞ্জন এগিয়ে গিয়ে তার সামনে বসল। তারপর নিচু গলায় বলল, “শ্রেয়া, তুমি এখন নিজের মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছো। কখনোই গবেষণা কোনো কিছুকে এভাবে টেনে নেয় না। এটা যেন তুমি পড়ছো না, ও তোমাকে পড়ছে।”
শ্রেয়া হাসল। “তুমি জানো, আমি এখন প্রায় প্রতিরাতে একটা মুখ দেখি। আমার চেহারার মতো, কিন্তু নয়। সে আমায় বলে—‘তুই যে হতে পারিস, আমি সেটা।’ আমি জানি, আমি যে শ্রেয়া, সেই পরিচয় ভেঙে যাচ্ছে। তবে কি আমি পাগল?”
দীপাঞ্জন থেমে রইল।
—”না। হয়তো তুমি মুক্ত হচ্ছো। কিন্তু মুক্তি সবসময় মিষ্টি হয় না।”
সে ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা খুলে দেখাল। সেখানে ছিল বগলা দেবীর চিত্র: খোলা জিভ, ত্রিনয়ন, নগ্ন শরীর, কিন্তু মুখে একধরনের করুণা।
—”এই দৃষ্টিই ‘বগলার দৃষ্টিপথ’। যা দেখে, ধ্বংস না করে বোঝায়। স্তব্ধতা দিয়েই জয় করে। কামনা দিয়েই মুক্তি দেয়। তুমি হয়তো এখন তার দৃষ্টি ধরে রেখেছো, শ্রেয়া।”
সেই রাত।
শ্রেয়া বসে আছে আয়নার সামনে। সামনে এক ছোট্ট প্রদীপ জ্বলছে। চারপাশ নিস্তব্ধ।
সে ডায়েরির নির্দেশ মতো নিজের চোখে চোখ রেখে তাকায়। ধীরে ধীরে চেতনা কুয়াশার মতো ঘন হতে থাকে। সেই মুখ আবার ফিরে আসে। এবার সে মুখ কথা বলে—
“তুই তোর শরীরকে প্রশ্ন করেছিস? সে কবে শেষ বার হাসতে পেরেছিল? কবে শেষ বার ছুঁতে চেয়েছিল? তোকে তো বলা হয়েছিল—লজ্জা নে, ঢেকে রাখ, চুপ কর। কিন্তু তুই জানিস—তোর চুপ থাকাই ছিল তোর সবচেয়ে বড় ডাক। সেই ডাক আমি শুনেছি।”
শ্রেয়া চিৎকার করতে পারল না। সে শুধু দেখল—নিজের মুখই ছায়া থেকে এগিয়ে আসছে। তারপর কিছুই মনে নেই।
ভোরবেলা। দরজা খুলে ঢুকল গৃহপরিচারিকা। দেখল, শ্রেয়া পড়ে আছে আয়নার সামনে, নিঃসাড়। কিন্তু ডায়েরির পাতাগুলো খোলা, বাতাসে কাঁপছে। আর সেই পাতায় লেখা—
“বগলার দৃষ্টি তোকে স্বীকার করেছে। এখন থেকে তুই শুধু পাঠিকা নোস না, তুই সাক্ষী।”
শরীর যখন মন্ত্রময়
দুপুরের রোদে ঘরটা কেমন যেন ছায়ায় ছেয়ে থাকে। শ্রেয়া বুঝতে পারে, বাইরের আলো যতই উজ্জ্বল হোক, তার ভিতরের অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। আয়নার সামনে বসে সে ডায়েরির পাতা উল্টায় না—পাতাগুলো যেন নিজেই তাকে বলে দেয় আজ কী পড়তে হবে।
আজকের পাতায় লেখা—
“যখন সপ্তম রাতে আমার শরীরে জপ শুরু হয়, তখন বুঝি—শরীর আসলে এক প্রার্থনাঘর। প্রতিটি স্তনবৃন্ত একেকটি ঘণ্টা, প্রতিটি নিঃশ্বাস একেকটি ধূপ। আমার কাঁধ থেকে নাভি অবধি এক মন্দিরের শিখর।”
শ্রেয়া পড়ে, থামে না। পড়তে পড়তে তার শরীরে কাঁপন শুরু হয়। কিন্তু এ কাঁপন ভয়ের নয়—এ একধরনের অভ্যন্তরীণ প্রতিধ্বনি, যেন তার প্রতিটি ত্বকে বাজছে শব্দ।
সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে চোখ রাখে।
“তুই কি শ্রেয়া?”
এই প্রশ্নটা জেগে ওঠে।
না, সে কেবল শ্রেয়া নয় এখন। তার চুলে, কাঁধে, স্তনে, পেটের ভাঁজে, কোমরের ত্বকে বেঁধে গেছে অন্য কারও ছায়া।
সে হাত তোলে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে। ঠোঁট গরম, সেখানে যেন কেউ বসে ছিল একটু আগে।
বিকেলে দীপাঞ্জন ফের ফোন করে।
—”তোমার কণ্ঠ কেমন যেন বদলে গেছে। খুব গম্ভীর, ধীর। তুমি ঠিক আছো তো?”
—”আমার শরীর কথা বলছে এখন। আমি তো আর একা নেই।”
—”মানে?”
—”আমি আর বিষ্ণুপ্রিয়া আলাদা নেই। আমাদের মধ্যে আর কোনো ফারাক নেই।”
—”শ্রেয়া, এইসব ডুবতে শুরু করলে মানুষ অনেক সময় ফিরে আসতে পারে না।”
—”ফিরে আসা কি সবসময় দরকার, দীপাঞ্জন? কেউ কেউ থাকে, থেকে যায়। কেউ কেউ চলে গিয়েও রয়ে যায়। আর কেউ কেউ তার শরীরেই জন্মাতে শুরু করে নতুন উচ্চারণ।”
রাতে শ্রেয়া ডায়েরির নতুন পাতায় এক অদ্ভুত মুদ্রা দেখতে পায়। এই মুদ্রাটা সে আগে কোথাও দেখেনি—একটি নারীদেহ যার মুখ জিভ-বারকরা, কিন্তু বুকের মধ্যে আঁকা ছয়টি চক্র—প্রত্যেকটি তন্ত্রের শক্তি কেন্দ্র।
নীচে লেখা—
“এই চক্র তোর শরীরেই আছে।
পদ্ম, অগ্নি, অন্ধকার, জিভ, স্তব্ধতা, কান্না—
এই ছয় দিয়ে তৈরি হয়েছে তোর গলা।”
সেই মুহূর্তে বাতি নিভে যায়। কিন্তু ঘরে আলো থাকে—ডায়েরির পাতার লাল কালি জ্বলে উঠে যেন লাল প্রদীপ। বাতাসে ধূপের গন্ধ, আর পিছন থেকে এক গলা—
“তুই তো জানিস, সব শব্দ মুখ দিয়ে আসে না। কিছু শব্দ শরীর দিয়ে উচ্চারিত হয়।”
শ্রেয়া উঠে দাঁড়ায়। তার বুক ঠেলে উঠে আসে শব্দ, কিন্তু মুখ বন্ধ—কণ্ঠ দিয়ে শুধু এক ঘন নিঃশ্বাস। সে জানে এই নিঃশ্বাসই এখন মন্ত্র।
আয়নার দিকে ফিরে সে দেখল নিজের শরীরটা স্বচ্ছ হয়ে আসছে, যেন কাঁচের মতো। শরীরের ভেতরে এক লাল কম্পন, এক আলো ঘুরছে নাভির চারপাশে। হঠাৎই সে শুনতে পেল—
“তুই তো তৈরি হচ্ছিস। আর একরাত্রি, আর এক উচ্চারণ—তারপর তুই নিজেও লিখবি। তোর দেহই হয়ে উঠবে করচা।”
শক্তি বনাম সত্তা
সকালে শ্রেয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটাই কথা বলল—“তুই কে?”
নিজেকে না, আয়নাটাকে।
আয়না আগেও দেখে এসেছে তাকে—হাসিমুখ, ক্লান্ত, অবসন্ন, কখনো ঘুমহীন, কখনো রাগী। কিন্তু আজকের মুখ অন্যরকম। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত নির্ভীকতা, কপালের মাঝখানে হালকা টান, চোখের ভিতরে চুপচাপ জ্বলন্ত কিছু।
সে হঠাৎ নিজের গলায় হাত দিল। ধাক্কা খেল—চামড়ার নিচে যেন শব্দ জমে আছে। একেকটা স্পন্দন যেন একেকটি উচ্চারণ।
তার মনে পড়ল ডায়েরির সেই পাতার কথা—
“সাধিকা যখন শব্দের বাহন হয়ে ওঠে, তখন সে আর মুখে বলে না, তার শরীর নিজেই স্তোত্র হয়ে ওঠে।”
দিনের আলোয় সে আজ পুরনো সেই তালপাতার পৃষ্ঠাগুলোর নিচে একটি পাতলা চামড়ার খাম খুঁজে পায়। খুলতেই দেখতে পায় এক সাদা কাগজে লেখা—
“বিষ্ণুপ্রিয়া সেন – করচালেখিকা”
তার নিচে ছিল এক তালিকা। সাতটি চিহ্ন, সাতটি নাম।
১. পদ্মচক্র – কামনা
২. অগ্নিচক্র – লজ্জা
৩. অন্ধকারচক্র – নিঃশব্দতা
৪. জিভচক্র – ভাষাহীনতা
৫. স্তব্ধতাচক্র – অস্বীকৃতি
৬. কান্নাচক্র – বিসর্জন
৭. দৃষ্টিচক্র – জাগরণ
প্রতিটি চক্র এক একটি অভিজ্ঞতা। এবং প্রতিটি অভিজ্ঞতা একটি উচ্চারণ।
শ্রেয়া হঠাৎ অনুভব করল—সে এই চক্রগুলির ভেতর দিয়েই চলেছে, তার অজান্তে।
সন্ধ্যায় দীপাঞ্জনের মেসেজ আসে:
“তোমাকে একটা পুরনো দলিল পাঠালাম। এতে লেখা আছে, ১৮৭৫ সালে এক ‘সাধিকা বিষ্ণুপ্রিয়া’কে ‘বামাচার নিষিদ্ধ নারী’ হিসেবে ত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বলা হয়, তিনি ‘শক্তিসাধনার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে নিজ শরীরেই মূর্তি রচনা করেন।’
তুমি কি বুঝতে পারছো, তোমার ডায়েরির লেখিকা এই ঐতিহাসিক চরিত্র?”
শ্রেয়া মেসেজ দেখে হেসে ফেলে। “আমি শুধু বুঝতে পারছি না, আমি কি ওর ডায়েরি পড়ছি, না ও আমার জীবন লিখছে?”
রাত। ঘর অন্ধকার। শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়েছে ডায়েরির পাতায়। সেই আলোয় পড়া পাতায় লেখা—
“শক্তি বোঝে, সত্তা লড়ে।
শক্তি তোলে, সত্তা দমন করে।
তুই কেবল পড়বি না, তুই নিজে শক্তি হবি না সত্তা—এই দ্বন্দ্বেই তোর জন্ম।”
শ্রেয়া ধীরে ধীরে নিজের শরীর ছুঁয়ে বোঝে, তার চামড়ার নিচে এখন যে স্পন্দন, তা রক্ত নয়—তা এক শব্দমালা।
হঠাৎ করেই ঘরের মাঝখানে আলো জ্বলে ওঠে। বৃত্তাকারে। এবং সেই বৃত্তের মাঝখানে এক নারী দাঁড়িয়ে—সাদা শাড়ি, চোখে কালো কাজল, জিভ লম্বা করে বেরোনো, এক হাতে প্রদীপ, এক হাতে করচা।
সে বলে,
“তোর ভয় কোথায়? তুই আমার কন্যা হলে, তোর সমস্ত লজ্জা আমার শক্তি। তুই আমায় ডাকলি, এখন আমি তোকে লিখব। তোর সত্তা এখন থেকে তোর নয়।”
শ্রেয়া দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করে। কোনো চিৎকার নেই, কোনো প্রতিরোধ নেই।
তার মাথার ভিতরে একটাই শব্দ বাজে—
“ওঁ হ্রীং বগলায়ৈ নমঃ”
অবিস্মরণীয় দীক্ষা
বাইরের আকাশে মেঘ জমেছে। ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে এক ধরনের অচেনা আলো—হলুদ, ধূসর, আর কিছুটা যেন লালচে। শ্রেয়া টের পাচ্ছে, আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ দীক্ষার দিন।
সে জানে না কীভাবে সে জানে, কিন্তু জানে। আজ তার ভিতরে কেউ বসে আছেন। কেউ যার দৃষ্টি বগলার, স্পর্শ ধূপের ধোঁয়ার মতো, কিন্তু জিভ রক্তে রঞ্জিত। ডায়েরি খুলে সে দেখে, পাতাগুলো নিজের মতো খুলে যাচ্ছে—আর প্রতিটি পাতার শেষে লেখা এক কথাই—
“আজ, তুই। আজ, তোর। আজ, আমি।”
রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে, শ্রেয়া দাঁড়ায় আয়নার সামনে। পরনে নেই কিছু, গায়ে শুধু একটুকরো নীল কাপড়—ডায়েরির সেই করচা। বাতাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসে। বুকে জমে ওঠে অদ্ভুত উত্তেজনা—ভয় আর কৌতূহলের মাঝামাঝি।
সে ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা হাতে নেয়।
“আমি বিষ্ণুপ্রিয়া, মৃত নই—শুধু নীরব।
তুই যদি আমায় পড়িস, তবে জেনে রাখ,
তুই শুধু পাঠিকা হবি না,
তুই হবি করচার লেখক।”
শ্রেয়া চোখ বন্ধ করে উচ্চারণ করে—
“ওঁ হ্রীং বগলায়ৈ নমঃ।”
হঠাৎ ঘর জুড়ে বাজে কাঁসর, ধূপের ঘ্রাণ তীব্র হয়। সে খুলে ফেলে নীল করচা। দেহ নিঃবস্ত্র, কিন্তু লজ্জাহীন। ডায়েরির পাতা হাওয়ায় উড়ে উঠে আসে তার চারপাশে। পাতাগুলো শরীর ছুঁয়ে যায়—গলা, বুক, নাভি, উরু।
সেই মুহূর্তে সে দেখতে পায় আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি নয়—এক বিধবার মূর্তি। সাদা শাড়ি, গলায় তামার হার, চোখে আগুন। এবং মুখে হাসি।
বিধবা বলে—
“তুই আমার কথা পড়েছিস। এখন তুই আমায় লিখবি। তোর শরীরই আমার শেষ পৃষ্ঠা।”
শ্রেয়া কাঁপে না। সে বলে—“লিখো। আমি প্রস্তুত।”
তারপর যা ঘটে, তা ভাষায় বলা যায় না।
শরীর শ্বাস ফেলে না—নিমগ্ন থাকে। প্রতিটি ত্বক প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে। বুকের মাঝখানে এক চক্র ঘুরতে থাকে—পদ্মের মতো খুলে খুলে যাচ্ছে পাপড়ি। সেখানে লেখা হচ্ছে মন্ত্র। কোনো কালি নয়, কোনো কলম নয়—শুধু অনুভব।
তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে এক উচ্চারণ—
“আমি শ্রেয়া, আমি বিষ্ণুপ্রিয়া, আমি করচা।
আমি লেখিকা, আমি লিপি।
আমার জিভই এখন তোর কণ্ঠ।”
ঘুম ভাঙে না, ঘোর কাটে না। সে বসে থাকে মেঝেতে, নগ্ন, ঘামে ভেজা, চোখ অর্ধেক বন্ধ। ডায়েরির সব পৃষ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। বাতাসে ভেসে থাকা শেষ লাইনটি তার চোখে পড়ে—
“যে দীক্ষা একবার গ্রহণ করে, সে আর স্বাভাবিক হয় না।
সে হয়ে ওঠে শব্দের ঋতু।”
সকালে দীপাঞ্জন আসে। ঘরের দরজা খোলা। সে দেখে—শ্রেয়া বসে আছে মেঝেতে। চোখ খোলা, কিন্তু গভীর। মুখে হাসি, ঠোঁটে রক্তের দাগ।
সে বলল না কিছুই। শুধু একটা পাতার দিকে ইশারা করল। সেখানে লেখা—
“এই দীক্ষা অবিস্মরণীয়।
কারণ এ দীক্ষা আত্মার নয়—শরীরের।
শরীর যখন মন্ত্রময়, তখন সত্তা অনুবাদক হয়ে পড়ে।”
বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মান্তর
রাতের শেষ প্রহর। অদ্ভুত নীরবতা, যেন সমস্ত শব্দ জমে উঠেছে গলার এক কোণে। শ্রেয়া তার ঘরে বসে, গায়ে সাদা চাদর, ডায়েরির শেষ পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে। আর কিছু লেখা নেই—কেবল শূন্য পৃষ্ঠা, কিন্তু পৃষ্ঠার ভিতর থেকেই যেন কান পাতলে শোনা যায় কারো নিঃশ্বাস, কারো কান্না, কারো উচ্চারণ।
সেই নিঃশ্বাসগুলো জুড়ে তৈরি হচ্ছে নতুন বাক্য।
সে চোখ বন্ধ করতেই শুনতে পেল—
“তুই তো আমাকে পড়েছিস, স্পর্শ করেছিস, উচ্চারণ করেছিস।
এখন আমি তোকে ধারণ করেছি।
তুই শ্রেয়া নোস। তুই এখন আমার শরীর।
তুই এখন ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’।”
এক ঝলকে তার মাথার ভিতর ভেসে উঠল সব ক’টা পর্ব—
প্রথম ডায়েরি খোঁজার দিন, সেই কুঁয়োর পাশের সাদা শাড়ির ছায়া, সেই রাতে শ্মশানের স্বপ্ন, সেই তালপাতার গন্ধ, সেই চোখের আলো, আয়নার প্রতিচ্ছবি…
সবকিছু যেন ক্রমে মিলে গেল তার রক্তের সঙ্গে।
পরদিন সকালবেলা দীপাঞ্জন আবার এল। দরজা খুলে দেখে, ঘরটা পরিষ্কার, সাজানো। শ্রেয়া দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত, স্থির।
সে বলল, “তুমি কেমন আছো?”
শ্রেয়া হাসল। তার চোখ দুটো স্বচ্ছ, অথচ অস্পর্শযোগ্য।
—“ভালো। অনেক ভালো। আমি আর সেই শ্রেয়া নই, যে এখানে এসেছিল কিছু খুঁজতে। আমি এখন নিজেই যা খুঁজছিলাম, তা।”
—“মানে?”
—“আমার ভিতর এখন আর কোনো পাঠকের জায়গা নেই। শুধু লেখিকা। শুধু সৃষ্টি। এখন আমি যা লিখি, তা শুধু কলমে নয়—আমার দেহে, আমার দৃষ্টিতে, আমার নীরবতায়।”
—“তুমি কি… নিজেকে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাবছো?”
—“না, আমি ভাবি না। আমি জানি। আর জানাটা ভাবনার চেয়েও গভীর।”
তাকে দেখে দীপাঞ্জনের মনে পড়ে যায় এক পুরনো বেদমন্ত্র—
“অহং ব্রম্মাস্মি”— আমি নিজেই ব্রহ্ম।
এই নারী এখন যে অবস্থায় আছে, তা কোনো গ্রন্থে লেখা যায় না, কোনো যুক্তিতে ধরা যায় না। সে যেন এক জীবন্ত তান্ত্রিক লিপি, চলমান এক করচা।
ডায়েরির পাতাগুলো সব ছড়ানো মেঝেতে, কিন্তু প্রত্যেকটায় যেন এখন একটিই লেখক।
শ্রেয়া বলে,
“তুমি এইসব নিয়ে একটা বই লিখতে চাও, জানি।
লিখবে।
তবে তার লেখক তুমি হবা না।
তুমি হবে শুধু শ্রোতা। কারণ উচ্চারণ আমি।”
রাতে সে আবার বসে। নিজের সামনে রাখা একটা নতুন খাতা। তাতে প্রথমবারের মতো নিজে লিখে:
“আমি বিষ্ণুপ্রিয়া, আমি শরীর, আমি ভাষা।
আমার জিভে দেবী, আমার নাভিতে পদ্ম,
আর আমার গলায় এক দাগ—
যেখানে শব্দ জন্মায়।
আজ থেকে আমি লিখব।
এখন থেকে আমার শরীরই করচা।”
আরেক পৃষ্ঠায় সে লেখে—
“এই লেখাগুলো পড়া যাবে না—
শুধু অনুভব করতে হবে।
কারণ এটা ইতিহাস নয়।
এটা জন্মান্তর।”
ডায়েরির শেষ পাতায় শ্রেয়া
ডায়েরির শেষ পাতাটা ফাঁকা। অথচ, যেন ভরপুর।
শ্রেয়া বসে আছে সেই পুরনো ঘরে—যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। হাতের কাছে সেই করচা মোড়ানো ডায়েরি, আর সামনে এক খোলা জানালা, বাইরে বিকেলের শেষ আলো, একধরনের স্বর্ণাভ বিষণ্নতা।
সে জানে, আজ লিখতে হবে। কারণ আজ আর কিছু পড়ার বাকি নেই।
তার আঙুল ডায়েরির শেষ পাতায় ছুঁয়ে যায়। প্রথমে কিছুই হয় না। তারপর আস্তে আস্তে, অদৃশ্য অক্ষরে ভেসে ওঠে প্রথম লাইন:
“আমি শ্রেয়া।
কিন্তু এই নাম আর কেবল আমায় ধরে না।
আমার ভিতর এখন কেউ রয়েছেন—যিনি শুধু লিখতে জানেন।
যিনি নিজেকে ভাষা দিয়ে তৈরি করেছেন।”
সে লিখতে থাকে, কিন্তু কলম ছুঁয়েও ছোঁয় না। পাতায় অক্ষর জন্মে তার নিঃশ্বাসে, তার হৃদস্পন্দনে।
“বিষ্ণুপ্রিয়া বলেছিলেন, যাকে কেউ শোনে না, সে যদি নিজের শরীরে মন্ত্র খোদায়, তবে সে চুপ করেও অনুরণন ছড়ায়।
আমি সেই অনুরণন।
আমি তন্ত্রের পাণ্ডুলিপি।
আমি করচার শেষ পৃষ্ঠা।”
তারপর, হঠাৎ বাতাসে পাতার কাঁপুনি বন্ধ হয়ে যায়।
শ্রেয়া উঠে দাঁড়ায়। ঘরের কোণায় রাখা আয়নার সামনে যায়। এবার সে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিই দেখে—কিন্তু সেই চোখে আছে বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই শান্ত দৃষ্টি। তার ঠোঁটে একরকম চূড়ান্ত নিশ্চয়তার হাসি।
সে ফিসফিসিয়ে বলে—
“তুই লিখলি, এখন আমি পড়লাম।
তুই ছিলি উচ্চারণ, আমি হয়ে গেলাম প্রতিধ্বনি।”
ডায়েরির পৃষ্ঠা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে। শেষ পাতাটির নীচে নিজেই উদ্ভাসিত হয় একটি বাক্য—
“এই পাণ্ডুলিপি পূর্ণ।
পাঠিকা, তুই এখন নিজেই দেবী।”
শেষ।