Bangla - তন্ত্র

নীলমণির সাধনা

Spread the love

অরিন্দম সেন


পর্ব ১

কলকাতার শীতের সন্ধ্যে নেমে এসেছে। উত্তরের বাতাসে ভেসে আসছে কুয়াশার গন্ধ, যেন বাতাসও জানে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। অরিন্দম মিত্র, ইতিহাসের তরুণ গবেষক, কাঁধে পুরোনো ব্যাগ ঝুলিয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে বেরোতেই মোবাইলটা কাঁপল। অচেনা নাম্বার, তবুও ধরল। ওপার থেকে গম্ভীর গলায় এক বৃদ্ধ বলল—“আপনি যদি সত্যিই প্রাচীন তন্ত্রচর্চার ইতিহাস খুঁজতে চান, তবে আজ রাতেই শ্যামপুর জমিদারবাড়িতে চলে আসুন। নীলমণি আপনাকে ডাকছে।” শব্দটা কানে পৌঁছতেই বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। নীলমণি—যেটা নিয়ে সে শুধু বইয়ের ফুটনোটে পড়েছে, কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারেনি। তবুও নাম্বারটা কেটে দেওয়ার বদলে হাত কেঁপে উঠল।

শ্যামপুরের জমিদারবাড়ির কাহিনি শহরে লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়। একসময় যজ্ঞমণ্ডপে রক্তবলির প্রথা চলত, এমনকি এক তান্ত্রিকের মৃত্যু নিয়েও অগণিত গুজব। অরিন্দম জানত এ সব গল্প কুসংস্কারের ফল, তবুও কোথাও না কোথাও মনে হচ্ছিল—যদি সত্যিই কিছু থাকে? এই ভাবনায় সে সিদ্ধান্ত নিল, আজই যাবে। বন্ধুরা হলে হয়তো বলত সে পাগল, কিন্তু গবেষণার নেশা আর অজানার ডাক একসাথে তাকে টেনে নিল।

লোকাল ট্রেনে শ্যামপুর নামার সময় রাত প্রায় দশটা। স্টেশন প্রায় ফাঁকা, দোকানপাট গুটিয়ে নিয়েছে সবাই। কুয়াশার ভেতর দিয়ে দপদপে আলোয় ঝুলছে কেরোসিনের বাতি। রিকশাওয়ালা দুলে দুলে বলল—“ওইদিকে যাবেন না বাবু, জমিদারবাড়ি তো ভাঙাচোরা, ভূতের ঠাঁই।” অরিন্দম এক গাল হেসে বলল—“ভূত নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুক কাঁপছিল।

জমিদারবাড়ির ধ্বংসপ্রায় ফটকে পৌঁছতেই এক অদ্ভুত গন্ধে শ্বাস আটকে গেল। মনে হল ধূপ আর পচা ফুলের গন্ধ মিশে আছে। ভেতরে ঢুকতেই কাঠের দরজা কেঁপে উঠল, যেন দীর্ঘদিন কেউ হাত দেয়নি। উঠোনে চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে, ভাঙা কলসির পাশে ঝিমোচ্ছে কাক। আচমকা বাতাসে মৃদু মন্ত্রধ্বনি ভেসে এল। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝা গেল না, তবুও স্পষ্ট—“ওঁ ক্রীঁ চামুণ্ডায়ৈ নমঃ।”

অরিন্দম কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি ভেঙে উঠল। ভেতরের হলঘরে ঢুকে হঠাৎ আলো ঝলসে উঠল—মশালের। চোখ সয়ে আসতেই দেখল, এক বৃদ্ধ বসে আছে কালো ধুতি পরে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, চোখে লাল সিঁদুরের দাগ। বৃদ্ধই বোধহয় ফোন করেছিল। সে গম্ভীর স্বরে বলল—“আমি অচিন্ত্যনাথ। নীলমণি দেবীর রত্ন এখনও এখানে লুকোনো আছে। তবে যাকে সে বেছে নেয়, শুধু তার হাতেই ধরা দেয়। আপনি কি প্রস্তুত?”

অরিন্দম কিছু বলতে গিয়েও গলা শুকিয়ে গেল। কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে একটা পিতলের থালা তার সামনে এগিয়ে দিল। তাতে সিঁদুর, ধূপ আর একখানি মলিন শাস্ত্রখণ্ড রাখা। অরিন্দম বইটা হাতে নিতেই হঠাৎ হলঘরের দেয়ালে ছায়ারা নড়েচড়ে উঠল, যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। মন্ত্রের গুঞ্জন বেড়ে গেল, বাতাস ভারী হয়ে এল, আর সে অনুভব করল অচেনা শক্তি তার শরীর ঘিরে ধরছে।

কানে ভেসে এল বৃদ্ধের গলা—“এখন থেকে পালাবার রাস্তা নেই। নীলমণি যদি আপনাকে গ্রহণ করে, আপনার জীবন আর আগের মতো থাকবে না।”

অরিন্দমের চোখের সামনে অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করল, আর বুকের ভেতর থেকে এক অজানা আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে গেল সেই রত্নের অদৃশ্য আলোয়…

পর্ব ২

অরিন্দম বুঝতে পারছিল না সে স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যিই ঘটছে সব। বুকের ভেতর ঢাকের মতো শব্দ বাজছে, চারপাশের দেয়াল কেঁপে উঠছে যেন। অচিন্ত্যনাথ মশালটা উঁচু করে ধরে মৃদুস্বরে মন্ত্র পড়ছিল। শাস্ত্রখণ্ডে অরিন্দমের হাত রাখা, আর সেই মুহূর্তে বইয়ের অক্ষরগুলো যেন জ্বলে উঠল লালচে আলোয়। হঠাৎ তার ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের মতো একটা শিহরণ বয়ে গেল। সে মনে করতে লাগল, কোথাও যেন আগে এসেছিল এই জায়গায়, এই গন্ধ, এই শব্দ—সবই অদ্ভুতভাবে পরিচিত।

“দেখছ তো?” বৃদ্ধ বলল, গলায় অনিবার্য এক গর্ব। “এটা সবার সঙ্গে হয় না। নীলমণি তোমাকে ডেকেছে।”

অরিন্দম ভয়ে ভয়ে বলল, “কিন্তু এটা তো গবেষণার বিষয় ছিল আমার কাছে। ইতিহাসের একটা অধ্যায় মাত্র।”

অচিন্ত্যনাথ থেমে গেল। চোখে তীব্র আলো জ্বলে উঠল। “ইতিহাস আর বর্তমান আলাদা নয়, বাবু। যারা শক্তিকে চেনে, তারা জানে সময় এক অন্তহীন নদী। তুমি কেবল তার স্রোতে ভেসে পড়েছ।”

বৃদ্ধ তাকে ইশারায় এগোতে বলল। হলঘরের শেষপ্রান্তে একটা কাঠের দরজা। দরজা খোলার সাথে সাথেই শীতল বাতাস আছড়ে এল। ভেতরে একটা লম্বা করিডর, দেয়ালে ভাঙা ছবি, মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শুকনো প্রদীপ। করিডরের শেষে একটা সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে, অন্ধকারে তল দেখা যায় না। মশালের আলোয় ছায়া যেন নাচছিল।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অরিন্দম অনুভব করছিল একটা অদৃশ্য চাপ। শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। যেন বাতাসে কারও অদৃশ্য দৃষ্টি তার গলা চেপে ধরছে। তবুও অচিন্ত্যনাথের পেছনে পা ফেলল। নিচে নেমে এল এক বিশাল ভাণ্ডারঘরে। মাঝখানে পাথরের আসনে রাখা একটা বন্ধ লোহার সিন্দুক। তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে পঁচা ফুল, শুকনো রক্তের দাগ, আর ভাঙা খুলি।

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বলল, “এই সিন্দুকের ভেতরেই আছে নীলমণি। কিন্তু সতর্ক থাকো—এর শক্তি যেমন আশীর্বাদ, তেমনই অভিশাপ। শুধু যোগ্য মানুষই একে ধারণ করতে পারে।”

অরিন্দম এগিয়ে গেল। সিন্দুকের গায়ে খোদাই করা চিহ্নগুলো চোখে পড়ল—ত্রিভুজ, চক্র আর অদ্ভুত প্রাণীর অবয়ব। হাত রাখতেই চিহ্নগুলো লাল আলোয় ঝলসে উঠল। তার মাথার ভেতর যেন কণ্ঠস্বর বাজল—“আমি আছি, আমি অপেক্ষা করছি।”

হঠাৎ করেই মশালের আলো দপদপ করে নিভে এল। ঘরটা অন্ধকারে ডুবে গেল। কেবল সিন্দুকের দিক থেকে আসছে ফিকে নীলচে আভা। অরিন্দমের হাত কেঁপে উঠল, বুক ধকধক করছে। সে বুঝতে পারল, এ শুধু কোনো রত্ন নয়, এ এক জীবন্ত শক্তি।

ঠিক সেই সময় ওপরে থেকে ভেসে এল মৃদু শব্দ—মহিলা কণ্ঠ। যেন কেউ ডাকছে, “অরিন্দম…অরিন্দম…”। অরিন্দম চমকে উঠল। এই নির্জন ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে কে তাকে ডাকছে? কণ্ঠটা অচেনা হলেও অদ্ভুতভাবে মায়াময়।

অচিন্ত্যনাথ মাটিতে বসে পড়েছে, চোখ বুজে মন্ত্রপাঠ শুরু করেছে। সে যেন কিছুই শুনছে না। অরিন্দম একা দাঁড়িয়ে রইল সিন্দুকের সামনে, কণ্ঠস্বর ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে—“আমাকে মুক্তি দাও…”

অরিন্দম বুঝল, রাতটা শেষ হবে না সহজে। যে পথ সে বেছে নিয়েছে, তার শুরু মাত্র হলো।

পর্ব ৩

নীচতলার ভাণ্ডারঘর এখন প্রায় নিস্তব্ধ। শুধু সিন্দুক থেকে আসা নীলচে আলো অন্ধকারকে কেটে ফিসফিস করছে। অরিন্দম থরথর করে দাঁড়িয়ে, বুকের ভেতর ঢাক বাজছে। কণ্ঠস্বরটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে—একজন নারীর কণ্ঠ, অদ্ভুতভাবে কোমল অথচ শীতল। “আমাকে মুক্তি দাও…” সে যেন কান পেতে আছে, অরিন্দমের নাম উচ্চারণ করছে, প্রতিটি ধ্বনি তার শরীরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল।

অরিন্দম এক পা এগিয়ে গেল সিন্দুকের দিকে। কিন্তু তখনই অচিন্ত্যনাথ হঠাৎ চোখ খুলে গর্জে উঠল—“থামো!” তার গলা যেন বজ্রপাতের মতো। “শোনো না ওই ডাক। ওরাই তোমাকে বিভ্রান্ত করবে। নীলমণির রত্নের শক্তি শত্রুদেরও আছে। তারা তোমাকে ভুলপথে টানতে চাইছে।”

অরিন্দম কেঁপে উঠল। “কিন্তু ওর কণ্ঠ এত…মানবীয়! এত যন্ত্রণায় ভরা…”

অচিন্ত্যনাথ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। “যন্ত্রণাই ওদের হাতিয়ার। তন্ত্রমণ্ডলের গভীরে অশুভ শক্তি লুকিয়ে থাকে। তুমি যদি আজ এক মুহূর্তের দুর্বলতা দেখাও, তুমি শেষ।”

কিন্তু ঠিক তখনই সিন্দুকের গায়ে হাত রাখতেই অরিন্দমের মাথায় তীব্র একটা ছবি ভেসে উঠল। সে যেন দেখল—শ্যামপুরের জমিদারবাড়ির উঠোনে রাতের যজ্ঞ। আগুনের চারপাশে কালো পোশাক পরা তান্ত্রিকরা বসে আছে, আর মাঝখানে এক তরুণী, লাল শাড়ি পরা, চোখ ভিজে আছে ভয় আর অশ্রুতে। তার গলায় রাখা হচ্ছে ধারালো ছুরি। চারপাশে মন্ত্রধ্বনি—“ওঁ ক্রীঁ চামুণ্ডায়ৈ নমঃ।” ছুরির ঝলকে সেই তরুণীর চোখের জল আর ভয়াবহ চিৎকার একসাথে মিশে যাচ্ছে।

অরিন্দম হাঁফ ছাড়ল, চোখে জল চলে এল। “আমি তাকে দেখেছি! ও-ই আমাকে ডাকছে। ওর আত্মাই কি আটকে আছে এই সিন্দুকে?”

অচিন্ত্যনাথ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি যা দেখছ, সেটা বিভ্রম হতে পারে। অথবা সত্যিও হতে পারে। কিন্তু মনে রেখো, নীলমণি সহজে কাউকে মুক্তি দেয় না।”

হঠাৎ ঘরের বাতাস ভারী হয়ে এল। চারপাশের দেয়াল থেকে যেন ছায়াগুলো খুলে এসে নড়তে শুরু করল। সেগুলো মানুষের অবয়ব নিচ্ছে—অর্ধেক নারী, অর্ধেক আগুন, চোখ জ্বলছে লাল আলোয়। তারা ধীরে ধীরে অরিন্দমকে ঘিরে ধরল। কণ্ঠস্বরগুলো একসাথে উঠল—“আমাদের মুক্তি দাও…আমাদের মুক্তি দাও…”

অরিন্দম ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল, কিন্তু ছায়ারা আরো কাছে এলো। তাদের মুখের ভেতর থেকে বেরোচ্ছে যন্ত্রণার ধোঁয়া, আর সেই ধোঁয়া অরিন্দমের গলা চেপে ধরছে। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।

অচিন্ত্যনাথ তখন বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে মন্ত্রপাঠ শুরু করল। তার রুদ্রাক্ষের মালা ঝিকমিক করে উঠল, আর বাতাসে মন্ত্রের শব্দ যেন আগুনের স্রোত। ছায়ারা কেঁপে উঠল, কেউ কেউ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। কিন্তু কিছু শক্তি থেকে গেল, তারা যেন সহজে ছাড়বে না।

অরিন্দম হাঁপাতে হাঁপাতে সিন্দুকের গায়ে হাত রেখে বলল—“যদি সত্যিই কারও আত্মা এখানে বন্দি থাকে, আমি তাকে মুক্ত করব। আমি কেবল ইতিহাস খুঁজতে আসিনি, আমি সত্য খুঁজছি।”

সেই মুহূর্তে সিন্দুকের তালা নিজে থেকেই কেঁপে উঠল। ধাতব শব্দে প্রতিধ্বনি হল ঘরে। অচিন্ত্যনাথ চমকে উঠে চিৎকার করল—“না! তুমি বোঝো না এর পরিণতি!”

কিন্তু অরিন্দম আর পিছিয়ে গেল না। তালা ভেঙে গেল এক অদ্ভুত গর্জনে। আর সিন্দুকের ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ল প্রবল নীল আভা—যেন আকাশের বজ্রপাত এসে মাটির নিচে গুমরে উঠল।

ঘরটা কেঁপে উঠল, মশাল নিভে গেল, আর চারপাশে কেবল সেই নীল আলো ভরে গেল।

অরিন্দম অনুভব করল—এটা আর কেবল রত্ন নয়, এটা জীবন্ত এক সত্তা, যে তার বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছে।

পর্ব ৪

নীল আলো যেন ঘরটাকে গ্রাস করে ফেলল। অরিন্দমের চোখ ঝলসে উঠল, বুকের ভেতর তীব্র জ্বালা, মাথায় গুঞ্জন করছে অচেনা মন্ত্র। সে হাত দিয়ে কানে চাপা দিতে চাইলো, কিন্তু শব্দগুলো তার মগজের ভেতর থেকেই আসছে। “আমি মুক্তি চাই… আমি জন্ম চাই… আমি আগুন চাই…” কণ্ঠগুলো একসাথে ফিসফিস করছে, যেন হাজারো আত্মা একই সঙ্গে তার শিরায় বইতে শুরু করেছে।

অচিন্ত্যনাথ আতঙ্কে চিৎকার করল—“তুমি কী করলে! তুমি জানো না, এই সিন্দুক শুধু রত্নের ভাণ্ডার নয়, এটা কারাগার। শত শত বছরের বন্দিত্ব ভেঙে দিলে!” বৃদ্ধ মন্ত্রপাঠে ফের মন দিল, মালার দানা আঙুলে ঘোরাচ্ছে, ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু তার কণ্ঠ কাঁপছে ভয় আর অসহায়তায়।

সিন্দুকের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উঠল এক ঝলসানো শিখা। শিখার মাঝখানে যেন এক নারীর অবয়ব ফুটে উঠছে—লাল শাড়ি, দীর্ঘ চুল, চোখে নীল আগুন। অরিন্দমের দৃষ্টি তার চোখে গিয়ে আটকে গেল। এ যেন সেই তরুণী যাকে সে দেখেছিল ভ্রমের মধ্যে—যজ্ঞমণ্ডপে বলির ছুরির সামনে দাঁড়ানো। তার ঠোঁট নড়ল, শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল—“তুমি আমাকে চিনেছ, অরিন্দম। তুমি-ই আমার মুক্তি।”

অরিন্দম স্তব্ধ। তার মনে হচ্ছিল এ কণ্ঠ চেনা, কোথাও থেকে সে এই ডাক বহুদিন ধরে শুনে এসেছে। কিন্তু কবে? কোথায়? সে উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না।

অচিন্ত্যনাথ ছুটে এসে তার কাঁধ চেপে ধরল। “শোনো না ওর কথা! এরা অপদেবতা। এরা তোমাকে ব্যবহার করবে। নীলমণি মানে শক্তি, কিন্তু সেই শক্তি শুদ্ধ হলে তবেই আশীর্বাদ, নইলে অভিশাপ। তুমি ধ্বংস হবে, বাপু, ধ্বংস হবে!”

কিন্তু অরিন্দম অনুভব করল অন্য কিছু। নারীর চোখের ভেতর যন্ত্রণা, অব্যক্ত অভিশাপ আর অদ্ভুত মায়া। সেই চোখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারল না সে। তার বুক থেকে বেরিয়ে এল কথাগুলো—“তুমি কে?”

নারীর ঠোঁট কাঁপল, মৃদু হাসি ফুটল। “আমি বন্দিনী। আমি সেই তান্ত্রিকের বলি, যার রক্তে এই রত্ন জন্ম নিয়েছিল। আমার আত্মা আটকে আছে এই অন্ধকারে। শতাব্দী ধরে কেউ শোনেনি আমার আর্তি। তুমি প্রথম শুনেছ। তাই তুমি-ই আমার মুক্তিদাতা।”

বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। ঘরের কোণে অগণিত ছায়া আবার ঘনীভূত হতে লাগল। তারা নারীর চারপাশে ঘিরে ধরল, যেন ওকে আটকে রাখতে চাইছে। তাদের চোখে লাল আগুন, গলা থেকে কাঁপা কাঁপা চিৎকার—“না! ও বেরোতে পারবে না!”

অরিন্দমের হাত সিন্দুকের প্রান্তে শক্ত হয়ে রইল। বুকের ভেতর দ্বন্দ্ব—কাকে বিশ্বাস করবে? অচিন্ত্যনাথের সতর্কবাণী, না এই নারীর আর্তি?

ঠিক সেই সময়, সিন্দুকের তলদেশ থেকে বেরোল এক ফাঁপা শব্দ। মাটি ফেটে গিয়ে উঠে এল কালো ধোঁয়া, গন্ধে পচা মাংসের মতো। ধোঁয়ার ভেতর থেকে আরেকটা অবয়ব—এবার পুরুষ, চোখে উন্মাদ হিংসা। সে গর্জন করে উঠল—“ও আমার বন্দিনী! কেউ ওকে ছুঁতে পারবে না!”

অচিন্ত্যনাথ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “দেখছিস? এই হচ্ছে আসল অভিশাপ। নীলমণি শুধু শক্তি নয়, নরক আর স্বর্গের মিলিত দ্বার। একবার যদি খোলে, আর বন্ধ হয় না।”

অরিন্দম দাঁড়িয়ে রইল দ্বিধার সীমানায়। সামনে বন্দিনী নারী—যন্ত্রণা আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। পেছনে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্যনাথ—ভয় আর অভিশাপের সতর্কবার্তা। আর অন্ধকার থেকে উঠে আসা দানবীয় পুরুষ—আতঙ্ক আর শত্রুতার প্রতীক।

তার কানে আবার ভেসে এল ফিসফিসানি—“আমাকে মুক্তি দাও… আমি তোমার। তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না।”

অরিন্দম বুঝল, এই রাত আর শুধু গবেষণার অভিযান নয়। এ তার নিয়তির ডাক।

পর্ব ৫

ভাণ্ডারঘরের বাতাস যেন জমাট হয়ে আসছে। অরিন্দম দাঁড়িয়ে আছে ত্রিধারার সামনে—মুক্তির আর্তনাদ, সতর্কবার্তা আর অভিশপ্ত ক্রোধ। নীল আলোর স্রোত তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মশালের ছাই উড়ে উঠে ধুলো হয়ে ভাসছে। চোখের সামনে নারী আর পুরুষের অবয়ব একে অপরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে—একজন আকুতি জানাচ্ছে, আরেকজন হিংসায় কাঁপছে।

নারী মৃদু স্বরে বলল, “অরিন্দম, আমাকে বিশ্বাস করো। আমি বন্দি ছিলাম, অন্যায়ভাবে বলি দেওয়া হয়েছিল। আমার রক্ত দিয়েই এই রত্নকে পূজিত করেছিল তান্ত্রিকেরা। আমার আত্মা মুক্তি না পেলে এই শক্তি শান্ত হবে না।”

পুরুষ গর্জে উঠল—“ও মিথ্যে বলছে! ওর আত্মা নরকের। যদি মুক্তি পায়, পৃথিবী জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে। ওকে এখানে থাকতে দাও, বন্দী থাকাই এর নিয়তি।”

অচিন্ত্যনাথ কণ্ঠ চড়িয়ে উঠল, “শোনো, এরা দুই বিপরীত শক্তি। একজন ত্যাগিনী, অন্যজন অভিশপ্ত সাধক। যুগ যুগ ধরে এদের টানাপোড়েনেই নীলমণির শক্তি রয়ে গেছে। তুমি যদি ভুল সিদ্ধান্ত নাও, সমগ্র দেশ জ্বলে উঠবে।”

অরিন্দমের কপালে ঘাম ঝরে পড়ছিল। সে চাইলেও নিরপেক্ষ থাকতে পারছে না। নারীর চোখের যন্ত্রণা তাকে টেনে নিচ্ছে, আবার পুরুষের ক্রোধ ভয় ধরাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার ছবিগুলো ভেসে উঠল তার মনে।

সে দেখল, অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে দাঁড়িয়ে তান্ত্রিকেরা, আর মাঝখানে ওই নারী, গলায় ছুরি রাখা। পাশে দাঁড়িয়ে উন্মাদ সাধক—চোখে রক্ত, মুখে উন্মাদ হাসি। সে-ই তো এই পুরুষ! নারী চিৎকার করেছিল, মুক্তি চেয়েছিল, আর কেউ শুনেনি। অরিন্দমের বুকের ভেতর হাহাকার উঠল। সে ফিসফিস করে বলল—“আমি আর তোমাকে একা থাকতে দেব না।”

বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠল—“না! তুমি কিছু বুঝতে পারছ না!” কিন্তু অরিন্দম হাত বাড়িয়ে দিল সিন্দুকের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে নীল আলো তার হাত ঘিরে ধরল, শরীর শিউরে উঠল। নারীর অবয়ব ধীরে ধীরে মুক্ত হয়ে আসতে লাগল ধোঁয়ার বাঁধন থেকে।

পুরুষ গর্জে উঠল, ছায়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল অরিন্দমের দিকে। কিন্তু অচিন্ত্যনাথ তখন সমস্ত শক্তি দিয়ে মন্ত্রপাঠ শুরু করল। ঘর ভরে উঠল বজ্রনিনাদের মতো শব্দে। পুরুষের ছায়া কেঁপে উঠল, কিন্তু থামল না। অরিন্দম বুঝতে পারল, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে—শক্তির, নিয়তির আর বিশ্বাসের।

নারী আলোর কণায় পরিণত হয়ে অরিন্দমের দিকে এগিয়ে এল। সে মৃদুস্বরে বলল—“আমার সঙ্গে এসো।” অরিন্দমের বুক থেকে যেন শ্বাস বেরিয়ে গেল, চোখ আধো বুজে এল। আলোর কণা তার শরীরে মিশে যেতে লাগল, রক্তে প্রবাহিত হতে লাগল আগুন আর শান্তি একসাথে।

অচিন্ত্যনাথের গলা ফেটে রক্ত বেরোল, সে মাটিতে বসে পড়ল। “তুমি অভিশাপ ডাকলে, বাপু… তোমার জীবন আর আগের মতো থাকবে না।”

সেই মুহূর্তে ভাণ্ডারঘর কেঁপে উঠল। মাটি ফেটে গেল, দেয়াল থেকে ধুলো ঝরে পড়ল। বাইরে থেকে হাহাকার ভেসে আসছে, যেন শত শত আত্মা মুক্তির আর্তনাদ করছে।

অরিন্দম বুঝল—সে এক অচেনা পথে পা দিয়েছে। এখন আর ফেরার রাস্তা নেই।

পর্ব ৬

ভাণ্ডারঘরের ছাদ ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছে। মাটির নিচ থেকে যে হাহাকার উঠছে, তা শুধু শব্দ নয়, যেন হাজারো আত্মার কণ্ঠ। অরিন্দম দাঁড়িয়ে আছে সিন্দুকের সামনে, শরীরে নীল আভা জ্বলজ্বল করছে। তার চোখে সেই নারীর ছায়া—যন্ত্রণা আর মুক্তির প্রতিচ্ছবি।

অচিন্ত্যনাথ মাটিতে কাতর হয়ে পড়ে আছে। মুখ থেকে রক্ত ঝরছে, তবুও সে থেমে যায়নি। কণ্ঠ রুদ্ধ হলেও মন্ত্রপাঠ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি অক্ষর যেন আগুন হয়ে বেরোচ্ছে। কিন্তু অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর থেকে অন্য এক সুর ভেসে আসছে—অচেনা অথচ পরিচিত। সেই নারীর কণ্ঠ, গভীর, কোমল, মায়াময়।

“আমাকে মুক্ত করেছ তুমি, অরিন্দম। এখন তোমার জীবন আমার সঙ্গে বাঁধা পড়ল। তুমি আর শুধু মানুষ নও, তুমি আমার বাহক।”

অরিন্দম হতবাক। “বাহক মানে? তুমি কে? সত্যিই কি কেবল বলির শিকার?”

নারীর চোখ নীল শিখার মতো জ্বলল। “আমি শুধু বলির শিকার নই, আমি সেই শক্তি যার রক্তে এই রত্নের জন্ম। তান্ত্রিকরা আমার শরীরকে ব্যবহার করেছিল, কিন্তু আমার আত্মা অগ্নিতে মিশে গিয়েছিল। শতাব্দী ধরে আমি বন্দি। আজ তুমি আমাকে মুক্ত করেছ। এখন আমরা এক।”

পুরুষ অবয়ব তখনও ধোঁয়ার ভেতরে ছটফট করছে। তার চোখ লাল আগুনে পুড়ছে। “না! এ আমার শক্তি! এ আমার সৃষ্টি! আমি ছাড়া কেউ একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।”

অচিন্ত্যনাথ শেষ শক্তি জড়ো করে উঠে দাঁড়াল। কাঁপা গলায় বলল, “অরিন্দম, শুনো! তুই এখনো থামতে পারিস। এই নারীর শক্তি যেমন আলোক, তেমনই অগ্নি। একবার যদি তুই তাকে ধারণ করিস, তোর জীবনে শান্তি থাকবে না। ও তোকে গ্রাস করবে।”

অরিন্দমের ভেতর দ্বন্দ্ব চলছিল। কিন্তু ঠিক তখনই তার কানে আবার শোনা গেল—হাজারো মানুষের আর্তনাদ, মুক্তির ডাক। অরিন্দমের বুক ভারী হয়ে উঠল। যদি সে পিছিয়ে যায়, তবে এই আত্মারা চিরকাল বন্দি থেকে যাবে।

সে ফিসফিস করে বলল, “আমি ভয় পাই না। যদি এ অভিশাপও হয়, তবুও সত্য জানার দায়িত্ব আমার।”

নারীর অবয়ব তার বুকে মিশে গেল। শরীর শিউরে উঠল, শিরায় শিরায় আগুন বইতে লাগল। চোখের সামনে আলো আর অন্ধকারের ঢেউ উঠল। সে যেন একসাথে হাজারো জীবন দেখতে পেল—বলির রাত, যজ্ঞের আগুন, মৃত্যুর চিৎকার, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

অচিন্ত্যনাথ ভেঙে পড়ল মাটিতে, ফিসফিস করে বলল, “তুই এখন এক নতুন অধ্যায়ের শুরু করলি। কিন্তু মনে রাখিস, শক্তি কখনো একার হয় না—তার সঙ্গে আসে দায় আর বিপদ।”

ভাণ্ডারঘর হঠাৎ তীব্র শব্দে ফেটে গেল। সিন্দুক ভাঙা, ছায়ারা মিলিয়ে যাচ্ছে, শুধু নীল আলো অরিন্দমের শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে। সে বুঝল—এখন থেকে তার জীবন কেবল তার নিজের নয়, তার সঙ্গে বাঁধা রইল এক শক্তি, এক আত্মা, এক রহস্যময় নিয়তি।

আর বাইরে, জমিদারবাড়ির উঠোনে বাতাস কেঁপে উঠল। দূরের গ্রাম থেকে কুকুরের হাহাকার ভেসে এল। মনে হলো, রাতের আকাশও জানে—কিছু ভয়ংকর জন্ম নিয়েছে।

পর্ব ৭

শ্যামপুর জমিদারবাড়ির ভাণ্ডারঘর থেকে বেরোবার সময় ভোরের আলো ফুঁড়ে আসছিল। অরিন্দমের শরীর ক্লান্ত, চোখ রক্তবর্ণ, তবুও বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত তেজ। সে জানে, কিছু একটা বদলে গেছে তার ভেতরে। নারীর কণ্ঠ এখনও তার মগজে ফিসফিস করছে—“তুমি আমার বাহক, অরিন্দম। তোমাকে ছাড়া আমি অস্তিত্ব পাব না।”

অচিন্ত্যনাথকে কাঁধে করে উঠোনে এনে বসাল সে। বৃদ্ধের নিঃশ্বাস তখন ক্ষীণ, মুখে যন্ত্রণা। “আমি চেষ্টা করেছিলাম… তুই যাতে এ শক্তির শিকার না হোস। কিন্তু তুই শোনিসনি।” কণ্ঠে হতাশা আর অদ্ভুত করুণার সুর।

অরিন্দম বলল, “আমি আর পিছু হটতে পারি না। এখন বুঝতে হবে এ শক্তি আসলে কী। নাহলে শুধু আমিই নয়, অন্যেরাও বিপদে পড়বে।”

অচিন্ত্যনাথ কষ্টে হেসে উঠল। “শক্তিকে বোঝা সহজ নয়। যারা বোঝার চেষ্টা করেছে, তারা শেষমেষ পুড়ে ছাই হয়েছে। নীলমণি আশীর্বাদও বটে, আবার অভিশাপও।”

বৃদ্ধের কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ হাওয়া কেঁপে উঠল। উঠোনের প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ থেকে ঝরে পড়ল শুকনো পাতা। অরিন্দমের কানে ভেসে এল সেই নারীর কণ্ঠ—“আমি তোমার পাশে আছি। ভয় পেয়ো না।” তার শরীরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের মতো স্রোত বয়ে গেল।

অরিন্দম চুপচাপ মাথা নিচু করল। সে জানে, এই উপস্থিতি আর কেবল বিভ্রম নয়, সত্যি।

গ্রামে ফেরার পথে সে দেখল, মানুষজন তাকে কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে। কয়েকজন ফিসফিস করছে—“ওই তো শহরের গবেষক, রাতে জমিদারবাড়িতে গেছিল। ভোরে ফিরছে কেমন চোখ লাল করে…” গ্রামের ভেতর গুজব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

রাতে বাড়িতে ফেরার পর অরিন্দম আয়নায় নিজের দিকে তাকাল। তার চোখে যেন অন্যরকম জ্যোতি। সে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু সেই ভয়ের মধ্যেও এক অদ্ভুত টান। কানে আবার ফিসফিস—“তুমি আর আমি আলাদা নই।”

সেই রাতে স্বপ্নে সে আবার যজ্ঞমণ্ডপে হাজির হল। আগুনের চারপাশে তান্ত্রিকরা বসে আছে, আর মাঝখানে সেই নারী। এবার সে ভয়ে কাঁপছে না, বরং অরিন্দমকে দেখে হাত বাড়াচ্ছে। তার ঠোঁট থেকে বেরোচ্ছে মন্ত্র—কিন্তু এ মন্ত্র কোনো অশুভ নয়, বরং শান্তির। অরিন্দম তার হাত ধরতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই আগুনের ভেতর থেকে পুরুষ অবয়ব গর্জে উঠল—“এ আমার সৃষ্টি, এ আমার বন্দিনী! তুমি ওকে ছুঁতে পারবে না!”

অরিন্দম ঘুম ভেঙে উঠে হাঁপাতে লাগল। জানলার বাইরে তখন চাঁদের আলোয় শহর নীরব। বুকের ভেতর সেই একই প্রশ্ন ঘুরছে—সে কি সত্যিই মুক্তির পথে পা দিল, নাকি এক অভিশপ্ত খেলার পুতুল হয়ে গেল?

আর দূরে, কোথাও অদৃশ্য অন্ধকারে, পুরুষ অবয়বের গর্জন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। খেলা তো এখনো শুরু।

পর্ব ৮

কলকাতায় ফেরার পর অরিন্দমের জীবন স্বাভাবিক থাকল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে বসে কাজ করলেও বারবার তার মনের ভেতর ভেসে উঠছিল সেই নারী—যজ্ঞমণ্ডপের শিখার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা, মুক্তির আর্তিতে ভরা চোখ। রাত নামলেই অরিন্দমের শরীরে নীল আভা জ্বলে উঠত, যেন রক্তের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য আগুন বইছে।

গবেষণার নাম করে সে বহু পুরোনো দলিল খুঁজতে লাগল। এক জায়গায় পেল ‘চামুণ্ডা তন্ত্র রহস্য’ নামে একটি বিরল পুঁথি। সেখানে লেখা—“নীলরত্নে দেবীর ছায়া বন্দি। যিনি একে জাগ্রত করেন, তার জীবনে দেবী ও অসুরের দ্বন্দ্ব অনিবার্য।” অরিন্দম পড়তে পড়তে বুঝতে পারল, এ কেবল ঐতিহাসিক নথি নয়, বরং সতর্কবার্তা।

ঠিক তখনই কানে ভেসে এল ফিসফিসানি—“তুমি সঠিক পথে আছ, অরিন্দম। ওরা যা-ই বলুক, আমি দেবী, আমি আলো।” কণ্ঠটা কোমল, কিন্তু বুকের গভীরে দোলা দেয়। অরিন্দমের সন্দেহ হল, তবে কি সত্যিই সে কোনো দেবীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে? নাকি সবই অশুভ বিভ্রম?

দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু শহরে অদ্ভুত ঘটনাও শুরু হলো। এক রাতে দক্ষিণ কলকাতার এক বাড়িতে হঠাৎ আগুন লেগে যায়—কেউ জানে না কীভাবে। আগুন নেভানোর পর খুঁজে পাওয়া গেল পাথরের মতো শক্ত হয়ে যাওয়া এক মৃতদেহ, যার চোখে নীল আভা জ্বলছিল। সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো—“অলৌকিক আগুনের ছায়া?”

অরিন্দম খবরটা পড়তেই বুক কেঁপে উঠল। সে বুঝল, তার ভেতরের শক্তিই হয়তো শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। আয়নায় তাকিয়ে সে দেখল, তার চোখের ভেতরেও সেই একই আভা।

রাতে আবার স্বপ্নে হাজির হলো পুরুষ অবয়ব। আগুনের ভেতর থেকে সে গর্জে উঠল—“তুই আমার শক্তি চুরি করেছিস। তুই যদি ফিরিয়ে না দিস, এই শহর আমি জ্বালিয়ে দেব।” তার চোখ থেকে আগুন বেরোচ্ছে, চারপাশে হাহাকার।

অরিন্দম ঘুম ভেঙে উঠে হাঁপাতে লাগল। কানে তখনও নারীর কণ্ঠ—“ভয় পেয়ো না। আমি তোমার সঙ্গে আছি। তুমি-ই একমাত্র যাকে আমি বেছে নিয়েছি।”

অরিন্দম জানত, এ পথ আর সহজ হবে না। দেবী আর অসুর, মুক্তি আর অভিশাপ—সব তার ভেতরে একসাথে জন্ম নিচ্ছে। এখন তাকে বেছে নিতে হবে, সে কাকে বিশ্বাস করবে।

আর দূরের অন্ধকারে, আগুনের গর্জন শহরকে ঘিরে আসছিল।

পর্ব ৯

কলকাতার আকাশে সেই রাতে অদ্ভুত এক অস্থিরতা ছিল। হাওয়ায় ধোঁয়ার গন্ধ, অচেনা ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, কুকুররা হঠাৎ একসাথে হুক্কাহুয়া করে উঠছিল। অরিন্দম জানল, সময় এসে গেছে—পুরুষ অবয়ব আর অপেক্ষা করবে না।

রাত তিনটের দিকে হঠাৎ তার ঘরের জানালা দপ করে খুলে গেল। হিমেল হাওয়া ভেতরে ঢুকে কাগজপত্র উড়িয়ে দিল। কানে ভেসে এল গর্জন—“অরিন্দম! তুই আমার শক্তি কেড়ে নিয়েছিস। ফিরিয়ে দে, নইলে শহর ছাই হয়ে যাবে।”

অরিন্দম বুক চেপে ধরল। তার ভেতর থেকে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল নারীর কণ্ঠ—“ভয় পেয়ো না। আমি আছি। আমার শক্তি এখন তোমার মধ্যে। সে যতই চেষ্টা করুক, সে আমাকে আর বন্দি রাখতে পারবে না।”

হঠাৎ অরিন্দমের চোখের সামনে ঘরটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে আছে হুগলীর তীরে, চারপাশে আগুনের কুণ্ডলী। নদীর ঢেউ লালচে, যেন রক্তে ভরা। সামনে সেই পুরুষ অবয়ব, কালো ধোঁয়ায় মোড়া, চোখে নরকের আগুন। চারপাশে মন্ত্রপাঠের প্রতিধ্বনি, কিন্তু সেটা ভয়ের, ধ্বংসের।

পুরুষ অবয়ব গর্জে উঠল—“তুই যদি আমার শক্তি না ফিরিয়ে দিস, এ শহর আমি গিলে খাব।” সে হাত বাড়াতেই নদীর জল ফুঁসে উঠল, ঢেউ আছড়ে পড়ল, আর অরিন্দমের চারপাশে আগুনের বলয় তৈরি হলো।

অরিন্দম ভেতরে নারীর কণ্ঠ শুনল—“তাকে থামাও। তুমি যদি ভয় পাও, সে জয়ী হবে। মনে রেখো, তুমি শুধু গবেষক নও, তুমি এখন আমার বাহক। তোমার ভেতরে আমার রক্ত, আমার আগুন।”

অরিন্দম চোখ বন্ধ করল। তার বুক থেকে বেরোতে লাগল নীল আলো, হাতের আঙুল জ্বলে উঠল আগুনের মতো। সে উচ্চারণ করল সেই মন্ত্র, যা স্বপ্নে বহুবার শুনেছিল—কিন্তু এবার তার কণ্ঠ দৃঢ়, শক্ত।

“ওঁ ক্রীঁ চামুণ্ডায়ৈ নমঃ…”

আলো বিস্ফোরণ ঘটাল চারপাশে। নদীর ঢেউ স্তব্ধ হয়ে গেল, আগুনের বলয় গলে মাটিতে মিশে গেল। পুরুষ অবয়ব কেঁপে উঠল, গর্জন করল—“না! এটা অসম্ভব! তুই শুধু মানুষ!”

অরিন্দম চোখ খুলল। তার ভেতর থেকে এক ঝলসানো শক্তি ছড়িয়ে পড়ল, সরাসরি আঘাত করল সেই অবয়বের বুকে। মুহূর্তে চারপাশের ধোঁয়া কেটে গেল, অবয়ব ছটফট করে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

কিন্তু মিলিয়ে যাওয়ার আগে তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো—“আমি শেষ হইনি… আমি আবার ফিরব… তোমার রক্তেই।”

অরিন্দম হাঁপাতে লাগল। নদীর ধারে শুধু চাঁদের আলো, আর তার শরীর জ্বলছে নীল শিখায়। নারীর কণ্ঠ তখন কোমলভাবে ফিসফিস করল—“তুমি পেরেছ। কিন্তু মনে রেখো, যুদ্ধ শেষ হয়নি। তুমি যতদিন বাঁচবে, ততদিন এই দ্বন্দ্ব চলবে।”

অরিন্দম আকাশের দিকে তাকাল। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু সে জানল, তার ভেতরে রাতের আগুন চিরকাল বেঁচে থাকবে।

পর্ব ১০

ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হুগলীর ঢেউ শান্ত হয়ে এলো। শহর তখনও ঘুমিয়ে, কিন্তু অরিন্দম জানত রাতের ভেতর যে যুদ্ধ সে লড়েছে, তার প্রতিধ্বনি ঢেউয়ের নিচে রয়ে গেছে। শরীর নিস্তেজ, চোখে রক্তচাপ, তবুও বুকের ভেতরে আগুনের মতো নীল আলো জ্বলছে।

সে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হাঁটতে লাগল। রাস্তার ধারে দোকান খোলার প্রস্তুতি, ছেলেপুলে স্কুলের ইউনিফর্ম পরে বেরোচ্ছে—সবকিছু যেন স্বাভাবিক। কিন্তু অরিন্দম জানে, তার জীবন আর কখনো স্বাভাবিক হবে না।

লাইব্রেরির নিস্তব্ধ কোণে বসে সে ‘চামুণ্ডা তন্ত্র রহস্য’ পুঁথি খুলল। পাতার ভেতর লেখা—“যে নীলমণিকে জাগ্রত করে, তার ভেতর আলো ও অন্ধকার দুই-ই বাসা বাঁধে। মুক্তির সঙ্গে আসে দায়, শক্তির সঙ্গে আসে দ্বন্দ্ব।” অরিন্দম বইয়ের ওপর হাত রাখল, বুঝল এ আর কেবল গবেষণার বিষয় নয়, এ তার নিয়তি।

রাত নামতেই আয়নায় নিজের মুখ দেখল। চোখের গভীরে এখন অন্য এক সত্তা। কানে ভেসে এল নারীর ফিসফিস—“তুমি আমাকে মুক্ত করেছ, অরিন্দম। কিন্তু আমি এখন তোমার ভেতরেই আছি। তোমার রক্তে, তোমার নিঃশ্বাসে, তোমার স্বপ্নে।”

অরিন্দম নিঃশব্দে বলল, “তুমি দেবী না অভিশাপ, আমি জানি না। কিন্তু যতদিন বাঁচব, সত্য খুঁজব।”

ঠিক তখনই ঘরের বাতি নিভে গেল। চারপাশ অন্ধকার। জানলার বাইরে অশুভ ছায়া নড়ল। পুরুষ অবয়বের গর্জন প্রতিধ্বনিত হলো—“আমি শেষ হইনি। আমি তোমার রক্তেই বাঁচব।”

অরিন্দম চোখ বন্ধ করল, বুকের ভেতর শক্ত করে ধরল আগুনকে। সে জানে, এ দ্বন্দ্ব আজীবনের। মুক্তি আর অভিশাপ, দেবী আর অসুর—সব এখন তার ভেতরেই।

রাতের নীরবতা ভেদ করে শোনা গেল মৃদু মন্ত্রধ্বনি। হয়তো বাতাসের খেলা, হয়তো নিয়তির ডাক। কিন্তু অরিন্দম জানল—নীলমণির সাধনা এখনো শেষ হয়নি, বরং এ এক অন্তহীন যাত্রার শুরু।

WhatsApp-Image-2025-09-04-at-6.12.32-PM-1.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *