Bangla - প্রেমের গল্প

নীলপাহাড়ের নিচে তোমায় খুঁজে

Spread the love

ঋতুপর্ণা চৌধুরী


পর্ব ১: সেই দিনের আলো

নীলপাহাড়ের গায়ে রোজ সন্ধ্যে নামে অদ্ভুত এক নরম রঙে। যেন আকাশ নিজেই তার ক্লান্তি গায়ে মেখে পাহাড়ের কোলে শুয়ে পড়ে। সেই রঙের নাম কেউ জানে না, কিন্তু ঊর্মির চোখে সে রঙের ছায়া আজও লেগে থাকে, বছর পেরিয়ে গেছে তবু।

শিলারি-গাঁওয়ের গায়ে ছোট্ট কাঠের হোমস্টের বারান্দায় বসে সে দিনভর বই পড়ে। কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠায় শব্দগুলো যেন আবছা হয়ে আসে — যেন বই পড়ছে না, বরং অতীতের পাতাগুলোতেই বারবার হারিয়ে যাচ্ছে।

তিন বছর আগে ঠিক এই জায়গাতেই প্রথম দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে — অয়ন।

অয়ন, পুরো নাম অয়ন সেনগুপ্ত, ছিল উত্তর কলকাতার ছেলে। পলিটেকনিক কলেজে পড়ায়, কবিতা লেখে, আর কথায় কথায় চোখে ঝরে পড়ে হাসির রেখা। ঊর্মির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল এক প্রাতিষ্ঠানিক ওয়ার্কশপে, যেখানে শিক্ষকদের ‘মাইন্ডফুলনেস’ আর ‘স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট’ শেখানো হচ্ছিল। উর্মি ছিল সেখানে একজন অংশগ্রহণকারী।

তাদের প্রথম কথোপকথনটা হয়েছিল এক কাপ লাল চা আর গরম মোয়ার আড়ালে।

“আপনার নামটা খুব সুন্দর, আপনি কি উর্মি সেন?”
“না, উর্মি ধর। কিন্তু নামটা মনে রাখার জন্য ধন্যবাদ।”
“উর্মির মানে তো তরঙ্গ, আমি জলভীতু…তাই এই নামে ভয়ও লাগে আবার টানে ও।”

সে বলেই হেসে ফেলেছিল, একটা নরম, পাথরের মতো ভারী অথচ হাওয়ার মতো হালকা হাসি।

ঊর্মির খুব অদ্ভুত অভ্যাস — সে কারও চোখে তাকিয়ে কথা বলতে ভয় পায়। কিন্তু অয়নের চোখে একটা নির্ভরতা ছিল, যা তাকিয়ে থাকার সাহস জুগিয়েছিল তাকে।

ওয়ার্কশপ শেষ হয়েছিল পাঁচদিনে। কিন্তু সেই পাঁচদিন যেন পাঁচটা ছোট ছোট জীবন। একদিন তারা হাঁটতে গিয়েছিল বনজোড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে, একদিন একসাথে লুকিয়ে বসেছিল খুমার কাছে, একদিন বর্ষায় ভিজে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিল গরম মোমোর দোকানে।

শেষদিনের সন্ধ্যায় অয়ন বলেছিল, “তুমি জানো, এই পাহাড়ে একটা পাথর আছে, যা নাকি হারানো প্রেম ফিরে আনে। যদি দু’জন মিলে সেটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করে, তাহলে তারা আর কখনও আলাদা হয় না।”

ঊর্মি হেসে বলেছিল, “তুমি এসব ফালতু বিশ্বাস করো?”

অয়ন একটুও হাসেনি। “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। সেটা ফালতু নয়।”

তাদের মাঝে কোনও চুম্বন হয়নি, কোনও শারীরিক স্পর্শও নয়। শুধু কথায়, নীরবতায়, পাহাড়ের হাওয়ায় একে অপরের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল তারা।

কিন্তু ফেরার ট্রেনের আগে ঊর্মি একটা চিঠি রেখে দিয়েছিল অয়নের হাতের মুঠোয় —
আমি সংসার ছেড়ে আসতে পারবো না। আমার ছয় বছরের একটা মেয়ে আছে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগলো, কিন্তু এটুকুই। তুমি এগিয়ে যাও, আমার জায়গা এখানে, এই জীবনেই।”

তারপর কেটে গেছে তিন বছর।

অয়ন একবারও ফোন করেনি। না মেসেজ, না চিঠি। উর্মি একবার চেয়েছিল খোঁজ নিতে, কিন্তু সাহস হয়নি।

এবার ফিরে এসেছে সেই পাহাড়ে। মনে হচ্ছিল, একটা অসমাপ্ত ছবিকে ফের রঙ করতে হবে।

হোমস্টের মালিক বীরেনদা বলল, “দিদি, কাল একজন অতিথি আসবে — সেও একা। আপনি তো লেখালেখি করেন, ওও নাকি কবিতা লেখে।”

ঊর্মির বুক ধড়াস করে উঠল, কিন্তু নামটা শোনার আগেই সে আবার নিজেকে সামলে নিল।

পরদিন সকালবেলা সে যখন লালচা নিয়ে বারান্দায় বসে পাহাড়ের নিচে রোদ নামা দেখছিল, তখন পায়ের শব্দে ফিরে তাকালো।

সামনে দাঁড়িয়ে সেই চেনা মানুষটি — অয়ন।

হাল্কা দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, গায়ে অফ হোয়াইট কুর্তা আর কাঁধে একটা খাকি ব্যাগ।

তার চোখে অবাক ভাব নেই, বরং একরাশ ক্লান্তি আর রোদে পোড়া মায়া।

ঊর্মি উঠে দাঁড়াল না। শুধু বলল, “তুমি এসেছো?”

অয়ন বসে পড়ল চুপচাপ। বলল, “তুমি এখনও লাল চা খাও?”

ঊর্মি কিছু বলল না।

অয়ন তখন একটা ছোট খামে ভাঁজ করা কাগজ বের করল — “তোমার রেখে যাওয়া চিঠিটা এখনও আছে আমার কাছে। প্রতিদিন পড়েছি।”

ঊর্মি কাঁপতে কাঁপতে চোখ নামিয়ে নিল।

অয়ন বলল, “তুমি একবারও জানতে চাওনি আমি কেমন আছি?”

ঊর্মির ঠোঁট কাঁপল। “চাইনি…কারণ আমি জানতাম, জানলে ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে।”

অয়ন মাথা নোয়াল, খুব আস্তে।

পাহাড়ের পেছনে তখন সূর্য ঢলছে। সেই অদ্ভুত নরম রঙ, আবার ফিরেছে আকাশে।

ঊর্মি চুপ করে বলল, “এইবার আমি এসেছি কিছু বলার জন্য।”

অয়ন তাকাল। “কি?”

ঊর্মি বলল, “এই পাহাড়টা না, ওর বুকের নিচে একটা পাথর আছে, শুনেছি যারা সেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করে, তাদের আর আলাদা হতে হয় না।”

অয়ন বলল, “তুমি বিশ্বাস করো?”

ঊর্মি তাকিয়ে বলল, “এইবার করি। কারণ তোমাকে বিশ্বাস করি।”

পর্ব ২: প্রতিজ্ঞার পাথর

অয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। পাহাড়ের গায়ে সূর্যের আলো তখন একটু একটু করে হালকা হয়ে আসছে। বারান্দায় দু’জনেই বসে, কিন্তু চারপাশে যেন সময় থমকে গেছে। গরম লাল চায়ের ধোঁয়া আর বাতাসে ভেসে আসা পাইন পাতার গন্ধ ছাড়া কোনও শব্দ নেই।

“তুমি কি জানো পাথরটা কোথায়?” অয়ন জিজ্ঞেস করল।

ঊর্মি একবার মুখ তুলে তাকাল, তারপর মাথা নাড়ল। “জানি না। শুধু জানি, বীরেনদা বলেছিল ওখানে গেলে লোকেরা প্রার্থনা করে, কিছু বলে না—শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় একটা কথা মন থেকে বার করলেই, পাহাড় তা ধরে ফেলে।”

অয়ন হেসে ফেলল, কিন্তু সে হাসিতে কোনও ব্যঙ্গ ছিল না, ছিল একধরনের প্রশ্রয়। “তাহলে চল, আজই খুঁজে বের করি। প্রতিজ্ঞা যদি করতেই হয়, একদম সন্ধ্যার আলোয় করব।”

ঊর্মি অবাক হয়ে বলল, “তুমি এত নিশ্চিন্ত কেন? তুমি তো—”

“তোমায় ভুলিনি, ঊর্মি। কোনওদিন না।” অয়নের গলা ভারী হয়ে এল। “তুমি বলেছিলে সংসার ছাড়তে পারবে না, আমি কোনওদিন চেয়েওনি সেটা। কিন্তু আমি অপেক্ষা করেছিলাম, জানি না কিসের জন্য। হয়ত একদিন এই পাহাড়েই আমরা আবার একসাথে বসে থাকব, ঠিক এইরকম।”

ঊর্মির চোখ ছলছল করছিল। সে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল। “চলো তবে।”

পাহাড়ের গায়ে যে পাথরটা রয়েছে, তার নাম কেউ ঠিক জানে না। তবে লোকমুখে শোনা যায়, তাকে বলা হয় ‘প্রতিজ্ঞার পাথর’। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার আভা দেখা যায়, আর মাঝে মাঝে নাকি মেঘ নেমে এসে চোখের জল মুছে দেয়।

বীরেনদা বলল, “পাহাড়ের বাঁক ঘুরে পুরোনো গুমটির পাশ দিয়ে গেলে একটা সরু পথ নামছে, সেখানেই ওই জায়গাটা। এখন গেলে সন্ধ্যে নামার আগেই পৌঁছে যাবেন।”

অয়ন আর ঊর্মি হাঁটতে শুরু করল। তিন বছরের ব্যবধান, অথচ শরীরের ছায়া যেন ঠিক আগের মত পাশে পাশাপাশি চলেছে। অয়ন মাঝে মাঝে ঝোপ সরিয়ে ধরছে ঊর্মির পথ, আর ঊর্মি একটু একটু করে তার নীরবতার ভেতর খুঁজে নিচ্ছে নিজের পুরনো কথাগুলো।

“তোমার মেয়ে কেমন আছে?” অয়ন হঠাৎ প্রশ্ন করল।

ঊর্মি একটু থমকে বলল, “অভিরা ক্লাস ফাইভে পড়ে। খুব চঞ্চল, বাবার মত। ও এখন তার দিদার বাড়ি আছে। আমি এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে এসেছি।”

“তুমি এখনো কবিতা লেখো?”

“লিখি, মাঝে মাঝে। কিন্তু ওগুলো তোমার মত ছাপা হবার মত নয়। নিজের জন্যই রাখি।”

“তোমার নিজের জন্য যা কিছু ছিল, সেগুলো আমিও খুঁজতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে সেখান থেকে ছেঁটে দিয়েছিলে।”

ঊর্মি থেমে গেল হঠাৎ। “আমার ভেতর ভয় ছিল, অয়ন। সংসার ভাঙলে সমাজ কাঁদে না, মেয়েরা কাঁদে। মা হতেও চাই, প্রেমিকাও। কিন্তু সেই সময় তোমাকে বলার সাহস ছিল না। আজ আছে। আজ এই পাহাড়ই হয়তো সাহস দিয়েছে।”

অয়ন মাথা নিচু করে থাকল। তাদের সামনে তখন পাথরের ঢিবি ভেসে উঠেছে — পাইনগাছ আর ছোট ছোট বুনোফুলে ঘেরা এক খোলা জায়গা, মাঝখানে বিশাল এক মসৃণ পাথর। যেন কোনও দৈত্য হাত দিয়ে মাটি ঘষে রেখে গেছে।

সন্ধ্যের আলো এসে পাথরের গায়ে পড়ে যেন অদ্ভুত এক দীপ্তি ছড়াচ্ছে। ঝিরঝিরে হাওয়া, আর দূরের বনের মধ্যে পাখিদের চিৎকার।

তারা দুজন একসঙ্গে দাঁড়াল পাথরের সামনে।

অয়ন বলল, “তোমার এখনও ভয় করে?”

ঊর্মি বলল, “করলেও তো দাঁড়িয়েছি।”

অয়ন চোখ বন্ধ করল। “তবে বলো। একসাথে বলি, মনের কথা।”

ঊর্মি ফিসফিসিয়ে বলল, “আমি চাই তুমি পাশে থাকো। প্রেম যদি পাপ হয়, আমি সেই পাপে ডুবি। কিন্তু আজ আর পালাব না।”

অয়ন বলল, “আমি চাই তোমার সবটুকু—তোমার ভয়, তোমার দায়িত্ব, তোমার ক্লান্তি—সবটা নিয়ে পাশে থাকতে। আমি তোমায় দাগমুক্ত ভালোবাসা দিতে পারব না, কিন্তু সত্যি দিতে পারব।”

তারা একসাথে হাত ছুঁয়ে ফেলল পাথরের ওপর।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ঠান্ডা বাতাস এল পাহাড়ের কোণ ঘেঁষে। যেন কারও চোখের জল মুছে দিয়ে বলল — এইবার সত্যিই বলা হয়ে গেছে সব।

পথে ফেরার সময় তারা কিছু বলল না। দু’জনের চুপ থাকা একসাথে চলছিল — যেন শব্দ ছাড়াও সব কিছু বলা যায়।

হোমস্টেতে ফিরে বীরেনদা চা দিয়ে বলল, “আপনাদের মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে পাহাড়ে কিছু রেখে এলেন!”

অয়ন হাসল, ঊর্মিও।

ঊর্মি ঘরের ভিতরে গিয়ে মোবাইল খুলে মেয়ের ছবি দেখল। ছোট্ট অভিরা হাসছে, দাঁত বের করে।

সে মোবাইলটা অয়নের দিকে বাড়িয়ে বলল, “চেনো? এ আমার জীবন। আর এখন থেকে আমাদের।”

অয়ন ফোনটা হাতে নিল, তারপরে বলল, “তোমার মেয়েকে দেখেই বুঝলাম, তুমি কাউকে অস্বীকার করতে পারো না। তোমার প্রেম, তোমার মায়া—সবকিছু একসঙ্গে বয়ে বেড়াও। আমি সেই নদীর তীরে বসে থাকতে চাই।”

ঊর্মি চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্ত।

পাহাড় তখন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। নিচে শহরের আলো জ্বলে উঠছে একে একে।

তবে এই আলোটা যেন আলাদা — এর মধ্যে কোনও কৃত্রিমতা নেই।

এ এক নির্জন দীপ্তি — যেখানে দু’টি হারানো পথ আবার মিলে গেছে।

পর্ব ৩: ছায়ার নিচে ভালোবাসা

রাতটা কুয়াশায় ভিজে গিয়েছিল। পাহাড়ি হাওয়ায় জানালার পর্দা নড়ছিল টুকটুক করে, আর ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের আলমারির ছায়া মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

ঊর্মি ঘুমোতে পারছিল না। অয়ন পাশের ঘরে, খুব কাছে অথচ এখনো ঠিক ততটাই দূরে—যতটা দূরত্বে সে তাকে রেখেছিল এতদিন।

আলোর সুইচটা বন্ধ, শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে থেকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। সে চুপচাপ জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নিচে পুরো গ্রাম ঘুমোচ্ছে, মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে, দূরের গাছে বাঁশির মত হাওয়া বেজে উঠছে।

এই পাহাড়ে এসে যেন সব শব্দ বদলে গেছে। শহরে যেখানে শব্দ মানেই যান্ত্রিক গতি, এখানে শব্দ মানে সময়ের ভাঁজে মিশে থাকা অনুরণন।

কিন্তু মনে শান্তি নেই। আজকের সেই প্রতিজ্ঞার পাথরে দাঁড়ানো মুহূর্তটা বারবার মনে আসছে।

অয়ন তো সহজেই বলে দিল—“তোমার সবটুকু নিয়ে পাশে থাকতে চাই।”
তবু সেই সাহসটা কি আজও উর্মির নিজের ভেতর জন্ম নিয়েছে?

সে ভাবল অভিরার কথা। তার মেয়েটার যদি কোনওদিন জানতে হয়—মা প্রেমে পড়েছিল, আর সেই প্রেম কোনও মসৃণ পথ ধরে হাঁটেনি, তখন কি অভিরা তার দিকে একইরকম ভালোবাসার চোখে তাকাবে?

তবু হয়তো কোনও কিছু না বলেও সম্পর্ক তৈরি হয়। ঠিক যেমন অভিরা জন্মানোর পর প্রথমবার মাকে দেখে বলেছিল না কিছুই—তবু দু’জনে জড়িয়ে ধরেছিল একে অপরকে।

একটা মৃদু টোকা।

ঊর্মি পিছনে তাকাল। দরজার ফাঁক দিয়ে অয়ন দাঁড়িয়ে। হালকা মেরুন সোয়েটার, চোখে চশমা নেই। একটু ভেতরে এসে বলল, “ঘুমোচ্ছো না দেখেই এলাম। ভাবছিলে?”

ঊর্মি বলল, “ঘুম আসছে না। তুমি?”

“তুমিই তো বলেছিলে—তোমার কাছে ফেরা মানে শুধু রোমান্স নয়, মানে বাস্তবের দায়। আমি সেই বাস্তবটা ভাবছিলাম। তোমার মেয়ে, তোমার পরিবার, সমাজ—এতকিছুর মধ্যেও তুমি আজ এই পাহাড়ে ফিরে এসেছো, সেটা তো ছোট কথা নয়।”

ঊর্মি জানালার ধারে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। “আমি বুঝতে পারছি, আমার ভেতর আর পালানোর কোনও জায়গা নেই। আমি নিজেকেই বারবার ভুল বুঝেছি। বলেছি—এই ভালবাসা টিকবে না। কিন্তু টিকে গেছে, বছরের পর বছর পেরিয়ে, সময়ের দেয়াল ডিঙিয়ে। তখন বুঝলাম, আমি যতটা সাহসী ভেবেছিলাম নিজেকে, আসলে তার চেয়েও বেশি ভীতু ছিলাম। এবার সেই ভীতু মেয়েটাকে ছেড়ে আসতে চাই।”

অয়ন তার সামনে এসে দাঁড়াল। খুব আস্তে বলল, “তোমাকে কেউ ছাড়তে বলছে না। শুধু নিজের থেকে পালাতে নিষেধ করছি।”

ঊর্মির গলা কাঁপছিল। “তুমি কি বিশ্বাস করো, দ্বিতীয় সুযোগ আসলে সেটা কাজে লাগাতে হয়?”

অয়ন বলল, “না। আমি বিশ্বাস করি, প্রথম ভুলটাকে ক্ষমা করতে হয় নিজেকে। তাহলেই দ্বিতীয়টা হয় সুযোগ নয়, ঘর।”

ঊর্মির চোখ ভিজে গেল।

অয়ন একটু এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। “আমি তো এখনও কিছু চাইনি। শুধু বলেছি, আমি পাশে থাকতে চাই। তুমি যদি একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝো—তুমি একা, তবু পাশে কেউ থাকলে ভালো লাগত, তখন শুধু একটা বার্তা দিয়ো।”

ঊর্মি তার চোখের জল আটকে রাখতে পারল না।

অয়ন হালকা হেসে বলল, “আমি তো কবি, ঊর্মি। আমি অপেক্ষায় ভালোবাসা খুঁজি, না-পাওয়ার মধ্যে আশা রাখি। কিন্তু তোমার এই ফিরে আসাটা আমার কবিতার সেরা লাইন হয়ে থাকবে।”

সকালবেলা হোমস্টের বারান্দায় আবার সেই পরিচিত দৃশ্য। চায়ের কাপের ধোঁয়া, পাখির ডাক, আর উর্মি বসে আছে একা।

অয়ন আগেই বেরিয়ে পড়েছে—বীরেনদার সঙ্গে হাইকিং-এ গেছে।

ঊর্মি একটা খাতা খুলে লেখে—

আমি যদি পথ হই,
তুমি কি হয়ে থাকবে হাঁটার ইচ্ছে?
আমি যদি ভুল হই,
তুমি কি শিখবে ক্ষমা করতে?”

ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। মা’র ফোন।

“উর্মি, সব ঠিক আছে তো?”

“হ্যাঁ মা। কেমন আছো?”

“ভালোই আছি। অভিরা কাকুর বাড়ি গেছে দুপুর থেকে। তোকে খুব মিস করছে।”

ঊর্মির বুক ধক করে উঠল। “আমি কালকেই ফিরবো মা।”

“তা…ওকে একটা কথা বলেছিলাম, ও নাকি জিজ্ঞেস করেছে, ‘মা কি পাহাড়ে গিয়ে প্রেমে পড়েছে?’”

ঊর্মির গলা শুকিয়ে এল। “তুমি এসব বললে?”

“না রে, আমি তো হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। তবে ও বড় হচ্ছে, ও সব টের পায়। আর তুই যদি মন থেকে কিছু ঠিক করে থাকিস, তবে আমি কিছু বলবো না।”

ঊর্মির মুখ থেমে গেল। একটাও শব্দ বেরোল না।

ফোন রেখে সে নিজের বুকের ধ্বনি শুনল। পাহাড়ের বাতাস থেমে গেছে যেন।

অয়ন তখন ফিরছে বীরেনদার সঙ্গে। হাতে বনফুল, গায়ে ঘাম, চোখে খুশির দীপ্তি।

ঊর্মিকে দেখে সে থমকে গেল। বলল, “সব ঠিক?”

ঊর্মি উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, “আমি কাল ফিরে যাচ্ছি।”

অয়ন কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।

ঊর্মি বলল, “তবে এবার পালাচ্ছি না। তোমাকে জানিয়ে যাচ্ছি। এই ফিরে যাওয়া কোন আলাদা জীবন নয়, বরং এই জীবনেরই একটা সিদ্ধান্ত।”

অয়ন বলল, “তুমি আর আসবে?”

ঊর্মি একটু হাঁটল তার দিকে, তারপর বলল, “আমি এসেছিলাম নিজেকে ক্ষমা করতে, সেটা পেরেছি। এখন চাই, জীবনটা ফের তোমার পাশে সাজাতে। হয়তো একদিন আমি ফিরে আসব, অভিরাকে নিয়েই।”

অয়ন হেসে ফেলল। “তাহলে আমার জন্য একটা কবিতা রেখে যাবেন, ম্যাডাম?”

ঊর্মি চুপ করে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিল।

সেখানে লেখা ছিল—

যদি আবার দেখা হয়,
তুমি পাশে হাঁটো, কথা বলো না।
শুধু বোঝাতে দিও—
ভালোবাসা থেমে থাকেনি।”

পর্ব ৪: ফেরার পথে যেটুকু রয়ে গেল

ঊর্মি যখন শিলারি-গাঁও থেকে নিচের শহরের দিকে নামছিল, তখন সকালের রোদ এখনও পুরোপুরি ফোটেনি। পাথরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, যেন সে কোনও দৃশ্যের মধ্য দিয়ে নয়, বরং নিজের ভিতরের স্তব্ধতা ভেঙে হাঁটছে।

তার ট্রেকিং ব্যাগের ভিতরে, অয়ন তাকে উপহার দিয়েছিল এমন একটা কবিতার খাতা। কাঠের বাঁধাই, প্রথম পাতায় অয়নের হাতের লেখা:
ভালোবাসা যদি পাহাড় হয়, তুমি তার ছায়া হয়ে থেকো—দূরে, শান্ত, অথচ ঠিক পাশে।”

ঊর্মি জানে—এই যাত্রা শেষ নয়। বরং এটা একটা বিরতি। একটা ইশারা। হয়তো ভবিষ্যতের জন্য কোনও সেতু।

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সে শেষবারের মতো ফোনটা বের করল।

একটা মেসেজ লিখল:
আমি ফিরছি, কিন্তু তোমাকে রেখে যাচ্ছি না। বরং মনে করে রেখো—আমার প্রতিটি নীরবতা আসলে তোমারই ঠিকানা।”

অয়ন উত্তর দিল না। কিন্তু সে জানে, উত্তর সবসময় শব্দে আসে না।

বাস যখন পাহাড়ি রাস্তায় নামতে শুরু করল, তখন জানালার পাশে বসে উর্মি একটানা তাকিয়ে রইল বাইরে। সেই সব দৃশ্য যেগুলোতে তারা একসঙ্গে হেঁটেছিল, সেই বনপথ, সেই কাঠের সাঁকো, সেই মোড়—সবকিছু যেন তার চোখের সামনে দিয়ে স্লাইড শোর মত ভেসে যাচ্ছিল।

কিন্তু তার ভিতরে কোনও কান্না নেই, কোনও ছেঁড়া অনুভব নয়।

এইবার সে সাহস নিয়ে ফিরছে।

কলকাতায় ফিরে আসার পর জীবন যেন কিছুটা গতি হারিয়ে ফেলেছিল, আবার নতুন ছন্দও পেয়েছিল।

অভিরা দৌড়ে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে বলেছিল, “তুমি এতদিন কোথায় ছিলে মা? আমি খুব মিস করছিলাম।”

ঊর্মি শুধু বলেছিল, “একটা পাহাড়ে গেছিলাম, যেখানে মেঘ মাটিতে নামে, আর ভালবাসা পাহাড়ের কোলে ঘুমায়।”

অভিরা হেসে বলেছিল, “তুমি পাগল হয়ে গেছো।”

অভিরার কথায় যে হাসি ছিল, সেটাই ঊর্মিকে টেনে এনেছিল তার সিদ্ধান্তে। সে এখন জানত, কোনও সম্পর্কেই পুরোটাই দিতে হয় না; বরং যে জায়গাটুকু রাখা যায় নিঃশব্দে, সেখানেই থাকে গভীরতা।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সে হঠাৎ তার কলেজের পুরনো কলিগদের সঙ্গে দেখা করতে গেল।

ক্যাফেটেরিয়া ছিল চিরচেনা—সাদা টিউবলাইট, কাঠের চেয়ার, আর দেওয়ালে একপাশে ঝুলে থাকা Notice Board।

সুব্রতদা জিজ্ঞেস করল, “উর্মি, কী খবর? কোথায় গেছিলে, ফেসবুকে তো ছবিও দিসনি?”

ঊর্মি একটু হেসে বলল, “নিজেকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। এবার মনে হচ্ছে, কিছুটা পেয়েও এসেছি।”

নন্দিনী মুচকি হেসে বলল, “কে? কেউ পেয়েছো নাকি?”

ঊর্মি চুপ করে রইল। তার মুখের সেই নরম গাম্ভীর্যে কেউ আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

তবে সন্ধ্যের শেষে সুব্রতদা শুধু বলল, “যদি ভালোবাসা পেয়ে থাকো, তাহলে ছেঁড়ে এসো না। এই শহরে শুধু কাজ আর দায় দিয়ে মানুষ বাঁচে না।”

সেই রাতে ঘরে ফিরে ঊর্মি ফোন খুলে দেখল অয়ন একটি কবিতা পাঠিয়েছে—

তুমি যদি থাকো শহরের ভিড়ে,
আমি হব ট্রামলাইন—
কখনও চলে না, তবু রয়ে যায়
তোমার পায়ের নিচে, নীরবে।”

ঊর্মি ফোনটা বালিশের নিচে রাখল।

এবার তার কোনও তাড়া নেই। অয়নও জানে—এই ভালবাসা কোনও রোলারকোস্টার নয়, এটা ধীর গতির মেঘে মোড়া ট্রেন, যেখানে একে অপরের পাশে বসে থাকা সবচেয়ে বড় সংলাপ।

পরদিন সকালে সে অফিসে গিয়েই ছুটি চাইল—পরের মাসে এক সপ্তাহের।

সিনিয়র ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “ফের ছুটি নেবে?”

ঊর্মি বলল, “হ্যাঁ। একবার পাহাড়ে গিয়ে শিখে এসেছি—কখন থামতে হয় সেটা না জানলে ছুটে চলা বৃথা। এবার একটু মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাব।”

“কোথায়?”

“হয়তো আবার সেই পাহাড়ে।”

কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। কলকাতার ব্যস্ততা, মেয়ের স্কুল, অফিস, টিউশন—সবকিছুর মধ্যেও ঊর্মির মনে সবসময় একটা গান বেজে চলে—
তুমি আসবে বলেই আমি রোজ জানালা খুলি,
আকাশ দেখি, আর চুপ করে ভালোবাসি…”

অভিরাকে নিয়ে যখন ঊর্মি ফের শিলারি-গাঁওয়ে পৌঁছাল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

হোমস্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অয়ন তাদের দেখে এগিয়ে এল—হাত বাড়িয়ে দিল অভিরার দিকে।

“তুমি অঙ্ক জানো?”

অভিরা অবাক হয়ে তাকাল। “হ্যাঁ, একটু একটু। কেন?”

“তবে তোমার জন্য একটা অঙ্ক আছে—যদি X মানে হয় তোমার মা, আর Y মানে আমি, তাহলে X+Y মানে কী?”

অভিরা মাথা চুলকে বলল, “তিনজন মিলে একটা পরিবার?”

অয়ন হেসে ফেলল। “ঠিক বলেছো। এবার চল, তোমাদের ঘর দেখাই।”

ঊর্মি চুপচাপ তাকিয়ে রইল—এই দৃশ্যটা কোনও নাটক নয়, কোনও গল্পও নয়। এটা তার সাহসের ফল, সময়ের কাছে স্বীকারোক্তি, আর একটা অপেক্ষার মর্যাদা।

যেখানে কেউ কারও ওপর দাবী করে না, তবু একে অপরের আশ্রয় হয়ে থাকে।

পর্ব ৫: নতুন ছাদের নিচে

হোমস্টের কাঠের ঘরটায় ঢুকে অভিরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ছাদটা ঢালু কাঠের, দেয়ালে ঝুলছে রঙিন তিব্বতি প্রার্থনাপতাকা, এক কোণে রাখা ছোট্ট একটা হারমোনিয়াম আর জানালার পাশে একটা মোমের বাতি—যেটার শিখাটা ধরা যাচ্ছে না কিন্তু ঠিকরে পড়ছে সারা ঘরে।

অয়ন পেছন থেকে বলল, “এই ঘরটা আমার সবথেকে প্রিয়। কারণ এখানেই আমি প্রথমবার তোমার মায়ের কবিতা শুনেছিলাম।”

ঊর্মি একটু হেসে বলল, “তুমি ওকে অত কিছু বোলো না, মাথায় উঠবে।”

অভিরা বলল, “না না, আমিও তো কবিতা লেখার চেষ্টা করি। একদিন তোমাকে শুনাবো।”

“তাহলে তো আমাদের এখন থেকেই রিহার্সাল শুরু করতে হবে!”—অয়ন বলেই হারমোনিয়ামটায় সুর ধরে বাজাতে লাগল, গলা ভেজাতে ভেজাতে।

ঊর্মির মনে হল—এই ঘরটা, এই পাহাড়টা যেন তাদের মনের ভিতরকার অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষার মতো। সময়ের থেকে ধার করা এক চুপচাপ দুপুর, যেখানে কেউ কাউকে কিছু বোঝাতে চাইছে না, শুধু পাশে থাকতে চাইছে।

বিকেলবেলা তারা তিনজন পাহাড়ের ধারে ঘুরতে বেরোল। অভিরা ছোটো ছোটো গাছের নাম জিজ্ঞেস করছিল—অয়ন সবকিছুতেই গল্প জুড়ে দিচ্ছিল।

“এই গাছটার নাম জানো?”

“না।”

“এটা হচ্ছে ‘অপেক্ষা’ গাছ। এর ডালে যে পাখি বসে, সে নাকি একটা মানুষকেও চেনে না, শুধু একটা চিঠি খোঁজে যা কখনও আসে না।”

অভিরা বলল, “তাহলে আমরা কি সেই চিঠির জন্য অপেক্ষা করছি?”

অয়ন উত্তর দিল না, শুধু মুচকি হেসে হাত রাখল তার ছোট্ট কাঁধে।

ঊর্মি তখন একটু পেছনে, একটা পাইনগাছের নিচে দাঁড়িয়ে—তাকিয়ে দেখছিল অয়ন আর তার মেয়ের কথোপকথন।

এই ছবিটা তার কল্পনার নয়, বাস্তবের। এই বাস্তব এতদিন পর সে নিজের হাতে সাজাতে পারছে, তাও কোনও নাটক না করেই।

সে বুঝল, হয়তো সম্পর্ক মানে সবসময় আগুনে ঝাঁপ দেওয়া নয়। অনেক সময় সম্পর্ক মানে—শুধু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ঝড় থেমে গেলে আবার হাত ধরে চলা।

রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে হোমস্টের রান্নাবান্না নিয়ে মজা চলছিল।

অভিরা বলল, “এই আলুটা এমন কেন? ঘরের মত?”

অয়ন বলল, “ওটা হচ্ছে পাহাড়ি আলু। ওরা নিচু জিনিসে অভ্যস্ত না। তাই একটু শক্ত।”

ঊর্মি হাসতে হাসতে বলল, “এই মেয়ে তোকে একদিন না খাইয়ে ছাড়বে।”

অয়ন হেসে বলল, “আমি রেডি। আজকালকার ছোটরা যে কী ভয়ংকর, তা তোমার এই মেয়ের সঙ্গে ঘুরলেই বোঝা যায়!”

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে তারা একসঙ্গে বারান্দায় বসল। উপরে তারা, নিচে দূরের লাইটগুলো টিমটিম করছে।

অয়ন হঠাৎ বলল, “তুমি কি আবার ফিরবে শহরে?”

ঊর্মি বলল, “হ্যাঁ, তবে এবার একা ফিরব না। এবার আমার পাশে থাকবে একটা বোঝা নয়—একটা বিশ্বাস।”

“আর একটা মেয়ে, যে এখনই বুঝে গেছে—চিঠি আসুক আর না-ই আসুক, অপেক্ষা করতে হয়।”

তারা চুপ করে থাকল।

তারা জানে, আগামী দিনগুলো সহজ হবে না। অভিরার বাবা, সমাজের চাহিদা, নিজেদের কাজ, মানসিক টানাপোড়েন—সবই থাকবে।

কিন্তু এবার একটা ছাদ তৈরি হয়েছে। হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে যাবে, ঝড়ে উড়ে যাবে টিন, তবু সেই ছাদের নিচে এই তিনজনের গল্পটা চলতে থাকবে।

হয়তো শহরে ফিরেও পাহাড়টা তাদের ভিতরে থেকে যাবে।

আর একদিন—কোনও ঝড়ের রাতে বা চুপচাপ সকালে, তারা আবার ফিরে আসবে এখানেই, এই নীলপাহাড়ের নিচে।

পর্ব ৬: নদীর মত করে ফিরে আসা

কলকাতায় ফিরে এসে জীবন ঠিক আগের মতোই চলতে লাগল—আলোর গলি, ব্যস্ত ট্রাফিক, ছুটে চলা রুটিন। কিন্তু এইবার একটা পার্থক্য ছিল—ঊর্মির মনে প্রতিদিন একটা ছোট্ট পাহাড় ছিল, যার ঢালু বুকে সে রাতে ঘুমোতো, আর সকালে উঠেই হাওয়ার ছোঁয়া পেত ভেতরে ভেতরে।

অভিরা স্কুলে ফিরে গেছে। তার বন্ধুরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি পাহাড়ে গিয়ে কী শিখলে?”

অভিরা একদিন উত্তর দেয়, “ভালোবাসলে বলতে হয়। না বললে কেউ বুঝতে পারে না।”

ঊর্মি ওর এই কথাটা শুনে একদিন দাড়িয়ে গিয়েছিল বারান্দায়। ভেতরে কোথাও গলা বেয়ে কান্না উঠে আসছিল, কিন্তু সে চেপে রেখেছিল।

তিন বছর আগেও সে ভালবেসেছিল, কিন্তু ভয় পেয়েছিল। আজ ভালবেসে সে কাউকে শিখিয়েছে—ভয়কে মুছে ফেলার নামই সাহস।

সন্ধেবেলা অয়ন হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি পাঠায়—হোমস্টের বারান্দায় রাখা সেই পুরনো হারমোনিয়াম, পাশে বীরেনদার ক্যামেরার তিন পাটি ছবি, আর কাঞ্চনজঙ্ঘার পেছনে রং মাখা আকাশ।

সাথে একটা ক্যাপশন:
এখানে সব আছে, শুধু তোমরা নেই।”

ঊর্মি ফোনটা বুকের কাছে চেপে ধরে।

একটা উত্তর টাইপ করে—
থাকবো। সময় লাগবে, কিন্তু এবার সত্যিই ফিরে আসব। ঠিক মত, ঠিক দিনে।”

সেই দিনটা আসে বসন্তের শুরুতে।

ঊর্মি অফিস থেকে ছুটি নেয়, অভিরার পরীক্ষার পরে একটা দীর্ঘ ট্রিপ প্ল্যান করে।

কিন্তু এইবার সে শুধু অতিথি হয়ে যাচ্ছে না, এইবার সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরছে।

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, অভিরা বলে, “আমরা কি এবার সেখানে থেকে যাব?”

ঊর্মি মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “হয়তো। যদি তুমি আর আমি দুজনেই চাই।”

বাসের জানালা দিয়ে পাহাড় যখন কাছে আসে, তখন মনটা কেমন ধক করে ওঠে। সেই চেনা গন্ধ, সেই পাথুরে ঘ্রাণ, ঝিরঝিরে বাতাসে সেই একটুকরো অতীত।

হোমস্টেতে পৌঁছে দেখে অয়ন বারান্দায় বসে আছে। তাকে দেখে ওর মুখে একটা শান্তি খেলা করে, যেন এতদিন ধরে জমে থাকা ক্লান্তি এবার ঘুমোতে পেরেছে।

“ফিরলে?”

ঊর্মি একটাও কথা না বলে ওর পাশে গিয়ে বসে।

“কেন ফিরলে?”

ঊর্মি হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরে বলে, “এইবার পালাতে নয়, থাকতে। এই বারান্দায়, এই পাহাড়ে, তোমার পাশে।”

অয়ন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। “তাহলে একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“চলো, এই হোমস্টেটা আমরা চালাই। বীরেনদা তো বলেই দিয়েছে—এবার অবসর নিতে চান। আমি পাহাড়ে থাকব, কবিতা লিখব, তুমি অতিথিদের গল্প শোনাবে, অভিরা সকালে পাইনগাছ গুনবে।”

ঊর্মি বলল, “তাহলে পাহাড়টা এবার কেবল ছুটি কাটানোর জায়গা নয়, আমাদের ঘর হয়ে উঠবে?”

“আর ভালবাসা হবে তার দেয়াল, আর বিশ্বাস ছাদ।”

ঊর্মি চুপ করে থাকে।

তারপর বলে, “চলো। তবে এই ঘর, এই পাহাড়, এই গল্প—সব মিলে একটা নদী বানাই। যে নদী শুধু বয়ে যায় না, ফেরেও। ঠিক যেমন আমি ফিরেছি। ঠিক যেমন তুমি অপেক্ষা করেছিলে।”

পর্ব ৭: পাথরের গায়ে লেখা স্বপ্ন

বীরেনদার মুখে একগাল হাঁসি। হোমস্টের ছাদে বসে সে বলল, “তোরা নিতে চাইছিস? পুরোটাই? খাবারদাবার, অতিথি, ঘরের কাজ—সব?”

অয়ন বলল, “হ্যাঁ দাদা, শুধু চারটে দেয়াল নয়, এই জায়গাটার গল্পটা আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। এবার সেই গল্পটা আমরা চালিয়ে নিতে চাই।”

বীরেন হেসে বলল, “তা হলে তো আমার আর কাজ নেই! আমি পাহাড়ের অন্যধারে গিয়ে টুকটাক দিন কাটাব। তবে মাঝে মাঝে এসে দেখে যাব—সেই পুরনো গন্ধটা ঠিক রাখছ তো?”

ঊর্মি এক মুঠো ধুলো নিয়ে বলল, “এই গন্ধটা আমাদের রক্তে ঢুকে গেছে দাদা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

তারা যখন হোমস্টের মালিকানা নিতে শুরু করল, তখন এক নতুন যুদ্ধ শুরু হল—সরঞ্জাম, মজুত তালিকা, পুরনো বুকিং খাতা, বিল খাতা, স্টাফদের ডিউটি রোস্টার।

অয়ন মাঝে মাঝে বলত, “দেখছো তো ঊর্মি, পাহাড়ে থাকার মানে শুধু মেঘে ঘেরা রোমান্স নয়, এখানে লাউ কাটাও করতে হয়, গ্যাস সিলিন্ডার তুলতেও হয়!”

ঊর্মি হেসে বলত, “ভালোবাসার ছায়ায় যেমন কবিতা থাকে, তেমনই কেচো-মাটি-জলও থাকে। সবকিছু মিলে সম্পর্ক তৈরি হয়।”

তারা একসঙ্গে ঘর সাজালো। জানালায় নীল পর্দা, গাছপালা ঘিরে নাম লেখা চিহ্ন, পুরনো চায়ের কেটলি দিয়ে টেবিল ল্যাম্প বানানো হল।

আর বারান্দার ঠিক মাঝখানে একটা কাঠের ফলক ঝুললো—
নীলপাহাড় হোমস্টে: যেখানে ভালবাসা ঘর পায়।

অভিরা খুব খুশি। সে নিজের ছোট্ট এক কোণ বানিয়েছে—যেখানে সে ছবি আঁকে, খাতা লেখে আর মাঝে মাঝে অয়নকে গিয়ে বলে, “তুমি তো কবি, বলো তো—‘রোদ’ মানে কী?”

অয়ন তার প্রশ্নের উত্তর দেয়, “রোদ মানে আলো নয়, এটা হচ্ছে সাহস। যা কুয়াশাকে পেছনে ফেলে সামনে আসে।”

ঊর্মি অবাক হয়ে দেখে, কীভাবে ওদের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত শিকড় গাঁথা গাছের মতো হয়ে উঠছে—যার মাটিটা একে অপরের ভেতরে।

একদিন বিকেলে একদল নতুন অতিথি এল। ওরা শহরের ছেলেমেয়ে, একেবারে ব্যস্ত কর্পোরেট জগত থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়েছে।

একজন বলল, “এই হোমস্টের ইতিহাস কী? এত শান্ত, এত অন্যরকম লাগছে।”

অয়ন বলল, “এই বাড়ির দেওয়ালে ক্যানভাস নেই, কিন্তু প্রতিটা ইঁটেই একটা করে গল্প আছে। যেমন ধরুন—এই দরজার ঠিক বাইরে, একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল একদিন। কারণ সে বুঝেছিল, ভালোবাসা পাওয়ার থেকেও বেশি কঠিন—ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দেওয়া।”

অতিথিরা চুপ করে শুনছিল।

ঊর্মি তখন কিচেনে দাঁড়িয়ে এক কাপ লাল চা বানাচ্ছিল, মনে মনে ভাবছিল—এই গল্পটা যদি কখনও লেখা হয়, তাহলে তার নাম কী হবে?

হয়তো পাথরের গায়ে লেখা স্বপ্ন”

সন্ধেবেলা তারা তিনজন একসাথে বারান্দায় বসে। আকাশে তারা নেই, কিন্তু মেঘের মধ্যে আলো লুকিয়ে আছে।

অভিরা হঠাৎ বলে, “মা, তুমি কি মনে করো, আমরা সুখে আছি?”

ঊর্মি একটু চমকে যায় প্রশ্নে।

অয়ন কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।

ঊর্মি বলে, “সুখ মানে তো একরকম না। আগে ভাবতাম, সুখ মানে নিশ্চিন্তে ঘুমানো। এখন জানি, সুখ মানে—যখন ভোর রাতে হঠাৎ জেগে উঠেও দেখো, পাশে পরিচিত নিঃশ্বাস আছে। যখন জানো, তুমি একা নও।”

অভিরা মাথা নাড়ে, যেন সে বুঝেছে।

এইবার সত্যিই যেন তারা তিনজন—একটা সম্পূর্ণ বৃত্ত হয়ে গেছে।

একটা অসমাপ্ত কবিতা নয়, বরং একটা নতুন জীবন, যেটা লেখা হচ্ছে প্রতিদিন পাহাড়ের বাতাসে, ভালবাসার ছায়ায়।

পর্ব ৮: সন্ধ্যের আলোয় লেখা চিঠি

হেমন্তের শেষদিক। পাহাড়ে রোদের আয়ু ছোট হয়ে এসেছে, আর বিকেলের পরে বাতাসে হালকা শিরশিরে ঠান্ডা।

নীলপাহাড় হোমস্টের বারান্দায় বসে অয়ন কাঠের একখণ্ডে কিছু খোদাই করছিল—ছোট্ট কাঠের ফলক, তাতে হাত দিয়ে হরফ কেটে বের করছিল:
ভালোবাসার ঠিকানা সময়ের বাইরে হয়।”

ঊর্মি চুপ করে পাশে বসেছিল, হাতে কাগজ, তাতে কয়েক লাইন লেখা।

“অয়ন,” সে হঠাৎ বলল, “একটা চিঠি লিখেছি। কাউকে পাঠাব না, শুধু নিজের জন্য।”

“আমাকে পড়াবে?”

“না, তুমি চোখ বন্ধ করো। আমি পড়ে শোনাব।”

অয়ন চোখ বন্ধ করল। বাতাসে ঝিরঝিরে পাইন পাতার শব্দ। দূরের পাহাড়ে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে কিনা, বোঝা যায় না—তবে শব্দের ফাঁকে ফাঁকে যেন খুব আলতো করে একটা সুর বাজছে।

ঊর্মি পড়তে শুরু করল—

প্রিয় সেই “আমি” যাকে অনেকদিন আগেই ফেলে এসেছি,

তুমি কি এখনও ভেবো, প্রেম মানেই পালিয়ে যাওয়া?

তুমি কি এখনও রাতের আকাশ দেখে ভাবো, যদি কেউ এসে পাশে বসত, হয়তো ভয় কেটে যেত?

তুমি কি এখনও তোমার নিজের ইচ্ছেগুলোকে সংসারের গুল্মে লুকিয়ে রাখো?

আজ আমি পাহাড়ে বসে আছি। আমার পাশে এক কবি, যে আর শুধু কবিতা লেখে না—আমার ক্লান্তি দেখে চুপ করে গরম জল গরম করে দেয়। আমার সামনে এক মেয়ে, যার চোখে এতটা প্রশ্ন, অথচ আমার উত্তরগুলোতে সে বিশ্বাস করে।

আজ আমি জানি, প্রেম মানে পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং ফিরে আসা। নিজেকে, সাহসকে, জীবনের দাবিকে আগলে ফিরে আসা।

আজ আমি জানি, আমি আর সেই আগের “আমি” নেই।

আমি এখন এক পাহাড়ি ঘরের ভিতরে নিজের চিহ্ন রেখে এসেছি—চায়ের কাপে, পর্দার ভাঁজে, অতিথির গলার স্বরে, আর অয়নের কবিতার পাতায়।

তুমি যদি কখনও ফিরে আসতে চাও,
এই ঘরের জানালাটা খোলা থাকবে।

ভালো থেকো।

তোমার বর্তমান

অয়ন চোখ খুলল না। শুধুই বলল, “তুমি নিজের সঙ্গে যখন কথা বলো, তখন শব্দগুলো এত বেশি সত্যি হয়ে যায়।”

ঊর্মি হাসল। “এগুলো সত্যি হতেই হতো। এতদিন ধরে যে চেপে রেখেছিলাম।”

অয়ন বলল, “তবে এবার একটা কবিতা আমিও শোনাই?”

“শোনাও।”

অয়ন নিজের খাতাটা বের করল—পুড়তে থাকা কাঠের ঘ্রাণের সঙ্গে মিশে সেই কাগজের পাতার শব্দও এক ধরনের সুর হয়ে উঠল।

যদি একদিন ঘর না থাকে,
থাকে শুধু চারদিকে পাহাড়ের নির্জনতা,
তবু তুমি হাত রাখো আমার বুকে—
দেখবে, একেকটা ধ্বংসস্তূপের ভিতরেও ধুকধুক করে বেঁচে থাকে স্বপ্ন।”

ঊর্মির চোখ ঝাপসা হয়ে এল।

“এই কবিতাটা আমার কাছে ছিল, যখন তুমি ছিলে না,” অয়ন বলল আস্তে।

“আর এখন?”

“এখন আমি শুধু চাই, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে এই কবিতাটা তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে পড়তে পারি।”

ঊর্মি উঠে দাঁড়াল। বারান্দার রেলিং ধরে পাহাড়ের দিকে তাকাল—নীচে সবুজের ছোপ, অনেক দূরে কুয়াশায় ঢাকা কিছু বাড়ির আলো, আর তার ওপরে একফালি চাঁদ।

“আমাদের গল্পটা সিনেমার মতো নয়, তাই না?”

“না। আমাদের গল্পটা সেইসব চিঠির মতো—যেগুলো কখনও পোস্ট করা হয় না, তবু বুকের মধ্যে ঠিক পৌঁছে যায়।”

ঊর্মি ঘুরে তাকাল, “তাহলে আজকের তারিখটা লিখে রাখো। কারণ আজ আমরা আমাদের গল্পটাকে পুরোদস্তুর সত্যি করলাম।”

“কীভাবে?”

“আজ থেকে এই হোমস্টে শুধু হোমস্টে নয়, এটা হবে একটা চিঠির ঠিকানা। যারা পালিয়ে যেতে আসে, তারা যেন এখানে এসে বুঝতে পারে—প্রেমে ফেরা যায়। সাহস নিয়ে, চোখে চোখ রেখে।”

অয়ন শান্তভাবে বলল, “তাহলে এই গল্পের নামটা বদলে দিই?”

“না, ‘নীলপাহাড়ের নিচে তোমায় খুঁজে’—এই নামটাই ঠিক আছে। কারণ আমি তো সেইখানেই তোমায় খুঁজে পেয়েছিলাম।”

পর্ব ৯: ভালোবাসার অতিথি

নতুন অতিথিরা এসেছেন শহর থেকে—দুজন মধ্যবয়সী মানুষ, বিয়ে হয়েছে পঁচিশ বছর আগে, এখন সন্তানরা বিদেশে। কথাবার্তায় বোঝা যায়, তাদের মধ্যে অনেকটাই দূরত্ব, এমন এক নিঃশব্দ বিবাহিত জীবনের জোড়, যা কাগজে আছে, কিন্তু চোখে নেই।

ঊর্মি তাদের বরাদ্দ ঘর দেখিয়ে বলল, “আপনারা চাইলে হাইকিং, বনভোজন বা ভ্যালি ট্রেক করতে পারেন। আমরা নিজেরা ব্যবস্থা করে দিই।”

তবে তারা কিছুতেই উৎসাহী নয়। বরং রোজ বিকেলে বারান্দায় বসে চুপ করে থাকেন, একে অপরের পাশেই, অথচ পাশে না।

একদিন সন্ধ্যায় অয়ন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঊর্মি, ভালোবাসা নীরব হয়ে গেলে সম্পর্কটা কি শুধু দায় হয়ে যায়?”

ঊর্মি তখন চায়ের কাপ হাতে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। বলল, “ভালোবাসা একসময় নিশ্চুপ হয়, ঠিকই। কিন্তু তা বলে সম্পর্কটা মরে না। কিছু সম্পর্কের আত্মা চলে যায়, তবু শরীর থেকে যায়। কেউ কেউ সেই শরীরকেই ভালবাসে।”

“তুমি কি শুধু আত্মা খোঁজো, না শরীর?”

ঊর্মি একটু থেমে বলল, “আমি এখন বিশ্বাস করি, সম্পর্ক মানে শুধু দু’জনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা নয়। অনেক সময় দু’জনেই একই দিকে তাকিয়ে থাকলে, সেটা আরও বড় হয়ে ওঠে।”

পরদিন দুপুরে সেই অতিথি মহিলা—মধুবালাদেবী—কিচেনে এসে দাঁড়ালেন। খুব সাবধানে বললেন, “একটা কথা বলবো?”

ঊর্মি অবাক হয়ে বলল, “অবশ্যই, বলুন।”

“এই পাহাড়ে এসে একটা কথা খুব তাড়িয়ে বেড়ায়—আমি যেন নিজের ভেতরের একটা দরজা খুলে বসে আছি। এতদিন ধরে সংসার, সন্তান, সময়—সবকিছু সামলে চলেছি। কিন্তু নিজের কথা তো বলাই হয়নি কখনও। আপনারা এখানে থাকেন, একসাথে—দেখে খুব ভাল লাগে।”

ঊর্মি হালকা হাসল, “আমরাও ভুল করেছি, পালিয়েছি, কেঁদেছি। এই পাহাড় আমাদের একজায়গায় এনে বসিয়েছে, ঠিক করার সুযোগ দিয়েছে।”

মধুবালাদেবী আস্তে বললেন, “তবে কি এবার আমরাও একটু কথা বলবো?”

ঊর্মি মাথা নেড়ে বলল, “এই হোমস্টের নিয়ম—যারা ভালবাসা হারিয়ে ফেলে, তারা এখানে এসে আবার খুঁজে পায়। আপনারা শুধু চুপ করে থাকবেন না, বারান্দার পাশে পাথরের বেঞ্চে বসে কিছু বলুন একে অপরকে। পাহাড় শুনে রাখবে।”

সন্ধ্যেবেলা পাহাড়ে হালকা কুয়াশা নেমেছে। বারান্দার সেই পাথরের বেঞ্চে মধুবালাদেবী আর তার স্বামী বসে আছেন। কেউ কিছু বলছেন না, কিন্তু চোখে একরকম সজাগতা, যেন কথা জমে আছে ঠোঁটের কিনারে।

ঊর্মি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে। তারপর অয়নকে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি জানো, এখানে যারা আসে, তাদের অনেকেই ফিরে গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করে?”

অয়ন জবাব দিল, “আমরা তো সেই গল্পের সাক্ষী। এখন শুধু চাই—এই বাড়িটা চুপ করে বসে থাকুক। তার ছাদ, তার কাঠের দরজা, তার মেঝে—সব যেন গল্প ধরে রাখতে পারে।”

ঊর্মি বলল, “তাহলে এটা শুধু হোমস্টে নয়, এটা একটা চিঠির খাম, যেখানে প্রত্যেক অতিথি নিজের নাম লেখে, এবং প্রতিদিন নতুন করে সম্পর্কের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়।”

অয়ন একটু হেসে বলল, “তোমার কথাগুলো শুনে কখনও কখনও আমার মনে হয়, তুমি কবি, আর আমি শুধু শ্রোতা।”

ঊর্মি বলল, “না, আমি শুধু তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক পাহাড়ি মেয়ে, যে অনেক দেরিতে বুঝেছে—ভালবাসা শুধু পাওয়ার জন্য নয়, বরং ফিরিয়ে আনার জন্যও লড়ে যেতে হয়।”

(চলবে…)

পর্ব ১০: যেখানে গল্প শেষ হয় না

বসন্ত চলে গেছে, গ্রীষ্মও এখন পাহাড়ের গায়ে নরম পা ফেলে হাঁটছে। চারদিকে সবুজ ঘন হয়েছে, পাইনগাছের ভেতর দিয়ে হাওয়া যখন চলে যায়, তখন মনে হয় পাহাড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

নীলপাহাড় হোমস্টের বারান্দায় একটা সাদা কাপড়ের পট্টি টাঙানো হয়েছে—তাতে নতুন কালি দিয়ে লেখা হয়েছে:
তোমার গল্প এখানে রেখে যাও, হয়তো কেউ পড়ে ফেলবে। হয়তো তুমি নিজেই নতুন করে পড়ে ফেলবে।”

অভিরা এখন নিজের ছোট্ট এক লাইব্রেরি বানিয়েছে। পুরনো বই, পর্যটকদের ফেলে যাওয়া ডায়েরি, আর তার নিজের আঁকা পাতা—সব কিছু মিলে এক রহস্যময় কোণ। সে মাঝে মাঝে অয়নকে বলে, “তুমি কি জানো, একটা গল্প যদি অনেকদিন না পড়া হয়, সে অভিমান করে?”

অয়ন হেসে বলে, “তাহলে আমরা প্রতিদিন অন্তত একটা গল্প পড়ে ফেলি। যেটা লেখা হয়নি, সেটাও।”

ঊর্মি তখন রান্নাঘরে। হাতে লালচা, নতুন অতিথিদের জন্য। কিন্তু মনে মনে সে চুপ করে কানে শুনছে সেই হাসির শব্দ, সেই কথোপকথনের টুকরো টুকরো অংশ, যেগুলো মিলে তার নতুন সংসারের ঘরদোর গড়ে উঠছে।

সন্ধ্যাবেলা তারা তিনজন—অয়ন, ঊর্মি, অভিরা—হেঁটে চলেছে পাইনবনের ভেতর দিয়ে।

অভিরা হঠাৎ থেমে বলল, “মা, তুমি কি জানো, আমি কাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি?”

ঊর্মি বলল, “কাকে?”

“এই পাথরগুলোকে। কারণ ওরা চুপ করে থাকে, কিন্তু কখনও পালায় না।”

অয়ন হেসে বলল, “তাহলে আমাদের ভালোবাসাও ওই পাথরের মতো—নড়বে না, পালাবে না, শুধু থাকবে।”

ঊর্মি চুপ করে দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল। এই ছোট্ট পরিবারের প্রতিটি মুহূর্ত যেন একেকটা কবিতা, যেগুলো সে আগে কখনও লেখেনি, শুধু কল্পনা করেছিল।

রাত নামলে বারান্দায় আলো জ্বলে ওঠে। অতিথিরা চা খেতে খেতে তাদের গল্প বলে, কেউ পুরনো প্রেমিকের কথা তোলে, কেউ ফেলে আসা শহরের। কেউ বলে, “এখানে এসে মনে হচ্ছে নিজের জীবনের সঙ্গে আবার আলাপ হচ্ছে।”

ঊর্মি তাদের চুপচাপ শোনে। কখনও মাঝেমধ্যে বলে, “নিজের গল্প শেষ মনে হলে পাহাড়ে আসুন। এখানে শেষ হয় না, শুধু পথ বদলায়।”

অয়ন তখন হারমোনিয়াম নিয়ে বসে থাকে এক কোণে। ধীরে ধীরে গলায় সুর তোলে, কোনও দিনের, কোনও রাত্রির।

আর মাঝেমাঝে চুপ করে উঠে দাঁড়ায়, আকাশের দিকে তাকায়।

পাহাড়ের কুয়াশার ভেতর দিয়ে ভেসে আসে একটুকরো আলো।

একদিন, ঊর্মি নিজের চিঠির খাতা খুলে লিখে—

এই হোমস্টেটা যেন একটা পায়ের ছাপ হয়ে থাকে, যেখানে আমি ফিরে এসেছিলাম নিজের কাছে।
তুমি যদি কখনও এই বারান্দায় এসে দাঁড়াও, বুঝে নিও—ভালোবাসা কখনও হারায় না।
সে শুধু অপেক্ষা করে, সেই মানুষটার জন্য যে ফিরবে, কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার কড়াটা নাড়বে, আর বলবে—‘তুমি আছো তো?’
হ্যাঁ, আমরা এখানে আছি।
সবসময় থাকব।
নীলপাহাড়ের নিচে।”

গল্প এখানেই শেষ হতে পারত।

কিন্তু শেষ হয় না।

কারণ, যারা একবার ফিরে আসে, তারা আবার চলে যায়, আবার ফিরে আসে।

আর এই বাড়িটা চুপ করে বসে থাকে, চারপাশে সবুজ ছড়িয়ে, কুয়াশা মেখে, শব্দ জমিয়ে।

নতুন প্রেম, পুরনো যন্ত্রণা, সাহস, আস্থার শিকড় নিয়ে

একটা ছোট্ট হোমস্টে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

যেখানে ভালবাসা ঠিকানা খুঁজে পায়।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-08-at-3.31.33-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *