পুলক বিশ্বাস
নীলয় সেনের জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের স্তর থেকে, কিন্তু এবার তার গবেষণার পথ তাকে নিয়ে এল বাস্তবের ভেতরে জমে থাকা সময়ের ধুলোয় ঢাকা রহস্যে। কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে দীর্ঘ ভ্রমণের পর যখন মুর্শিদাবাদের মাটিতে পা রাখল, তার চোখের সামনে খুলে গেল এক অচেনা অথচ পরিচিত ইতিহাসের দরজা। রেলস্টেশনের পুরনো কাঠের বেঞ্চ, দেওয়ালে ঝুলে থাকা ম্লান বিজ্ঞাপন, আর মানুষের চেনা-অচেনা মুখগুলোর ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে যেন অনুভব করছিল—এই শহর কেবল ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি এক অদৃশ্য সময়ের ভাণ্ডার, যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি পথ, প্রতিটি গাছ লুকিয়ে রেখেছে গল্প। মুর্শিদাবাদকে বলা হয় বাংলার মুঘল রাজধানীর উত্তরসূরি, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সাক্ষী, আর নীলচাষিদের অভিশপ্ত কাহিনির আধার। নীলয়ের গবেষণা মূলত নীলকরদের অত্যাচার নিয়ে, কিন্তু গভীরে তার কৌতূহল ছিল এমন কাহিনি খুঁজে বের করা যা কখনো লিখিত হয়নি, যা কেবল মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে। তাই যখন সে শুনল মুর্শিদাবাদের এক প্রাচীন নীলকুঠি আছে, যেখানে আজও কেউ ঢুকতে সাহস করে না, তখনই তার মনে হল—সেখানেই হয়তো লুকিয়ে আছে ইতিহাসের প্রকৃত উত্তর। সে মাথার ভেতরে স্থির করল, যত ভয়ই থাকুক, যত সতর্কবার্তাই দিক মানুষ, সে সেখানে পা রাখবেই। কারণ প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে সত্য উদ্ঘাটনের লোভ তার কাছে ভয়কে অতিক্রম করার মতোই শক্তিশালী।
গ্রামের ভিতরে ঢোকার পর তার দৃষ্টি আটকে গেল সেই প্রাচীন কুঠির দিকে, যা গ্রামের মানুষ দূর থেকে আঙুল তুলে দেখায় কিন্তু কাছে যেতে চায় না। কুঠির বাইরের দেওয়াল ভেঙে পড়া, জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা আর ঝুলে থাকা বটের শিকড় যেন তার ভেতরের অন্ধকারকে লুকিয়ে রেখেছে। লোকেরা তাকে ঘিরে সাবধান করতে লাগল—“ওই কুঠিতে কেউ থাকে না, থাকলেও সে মানুষ নয়।” নীলয় প্রথমে হাসিমুখে তাদের ভয়কে উপেক্ষা করলেও, যখনই দেখল বৃদ্ধাদের চোখে একরাশ আতঙ্কের ছায়া, তখন বুঝতে পারল, এ ভয় শুধু কুসংস্কার নয়, এর ভেতরে কোনও না কোনও বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। এক বৃদ্ধ লোক বলল, তার দাদার সময় নাকি কিছু যুবক মজা করতে গিয়ে কুঠির ভেতরে ঢুকেছিল, তারপর থেকে তাদের একজন আর কোনওদিন ফিরে আসেনি। আরেকজন বলল, চাষিরা নাকি রাতে কুঠির পাশ দিয়ে গেলে কানে অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পায়—কেউ চিৎকার করছে, কেউ শৃঙ্খলের ঝনঝনানি বাজাচ্ছে। এসব গল্প শুনতে শুনতে নীলয়ের ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হল—একদিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মানসিকতা, যা সবকিছু যুক্তির আলোয় দেখতে চায়, আর অন্যদিকে মানুষের অভিজ্ঞতার ভৌতিক গল্প, যা তাকে শিহরিত করে তুলছে। কিন্তু তবুও সে স্থির রইল—তার কাজ হলো এই কাহিনিগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা সত্যকে খুঁজে বের করা। হয়তো ভয় সত্যিই কেবল মনস্তাত্ত্বিক ছায়া, আর হয়তো এর আড়ালে আছে এক ভিন্ন মাত্রার বাস্তবতা, যা সে আগে কোনওদিন জানেনি।
হোটেলে পৌঁছানোর পর নীলয় নিজের নোটবুক খুলে বসে গেল। প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাহিনি, প্রতিটি সতর্কবার্তা সে লিখে রাখল যেন কোনও সূত্র বাদ না পড়ে। তার মনে হচ্ছিল, ইতিহাস মানেই কেবল শুষ্ক দলিল নয়, মানুষের ভেতরে জমে থাকা স্মৃতি, যন্ত্রণাও ইতিহাসের অংশ। রাতের আঁধারে মুর্শিদাবাদের নীরবতা যেন তাকে আরও গভীর টানে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সেই অচেনা কুঠির দিকে। জানলার বাইরে অন্ধকারে মাঝে মাঝে কুকুরের ডেকে ওঠা, দূরে রাতজাগা পাখির ডাক, আর বাতাসে দুলতে থাকা অদৃশ্য পাতার শব্দ—সবকিছু যেন একসঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করছিল এক আশঙ্কাজনক আবহ। গ্রামের মানুষ বারবার বলছে, “ওই কুঠি শান্ত নেই।” অথচ নীলয়ের মনে হচ্ছিল—শান্ত না থাকার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে গবেষণার প্রকৃত রত্ন। সে বুঝতে পারছিল, এই যাত্রা শুধু এক প্রত্নতত্ত্ববিদের পেশাগত অনুসন্ধান নয়, এটি তার ব্যক্তিগত সাহসেরও পরীক্ষা। সত্যিই যদি কুঠি অশুভ হয়, তবে তার ভেতরে ঢোকার মূল্য হয়তো অনেক বেশি চড়া। কিন্তু যদি সে সেখান থেকে ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উদ্ধার করতে পারে, তবে সেটি হবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। সেই রাতেই, খাতা বন্ধ করার আগে, সে নীরবে লিখে রাখল—“আগামীকাল আমি কুঠির সামনে দাঁড়াবো।”
পরদিন সকালেই নীলয় তার সহকর্মী অদিতি মুখার্জীর সঙ্গে রওনা দিল কুঠির দিকে। অদিতি কলকাতা থেকে এসেছে বিশেষভাবে নীলয়ের সঙ্গে কাজ করতে, কারণ নীলচাষ ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে তারও গভীর আগ্রহ ছিল। দু’জনেই নিরুত্তাপ আকাশের নিচে গ্রামের সরু পথ ধরে হাঁটছিল। দূরে কুঠির ছায়া ক্রমশ বড় হতে হতে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল—এক বিশাল দেহী স্থাপনা, যা সময়ের ভারে ভেঙে পড়লেও এখনও দাঁড়িয়ে আছে অবিচল। ভগ্নপ্রায় দেওয়ালে শ্যাওলা জমে সবুজ-কালো রঙে ঢেকে গেছে, জানালার কাঠগুলো মড়মড় শব্দে বাতাসে কাঁপছিল, আর লতাপাতা যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছিল ইটের গাঁথুনি। কুঠির বিশাল লোহার গেট মরচেধরা হলেও এখনও কেমন এক ভয়ঙ্কর দৃঢ়তায় বন্ধ হয়ে আছে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়েই অদিতি হালকা শিহরিত কণ্ঠে বলল, “নীলয়, তুমি নিশ্চিত তো? ভেতরে গেলে যদি—” বাকিটা সে শেষ করতে পারল না। নীলয় চোখের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল, “গবেষণার জন্য যদি ভয় পেতে হয়, তাহলে প্রত্নতত্ত্ববিদ হওয়া বৃথা। ভিতরে না গেলে আমরা কখনওই জানব না এখানে কী ঘটেছিল।” তার গলায় আত্মবিশ্বাস থাকলেও অন্তরের ভেতরে যে কেমন হালকা দমচাপা ভয় কাজ করছিল, তা অদিতি তার চোখে পড়তে পেরেছিল। অবশেষে কড়কড় শব্দ তুলে যখন গেট খোলা হল, তখনই যেন এক অদৃশ্য হাওয়া তাদের শরীর ঘিরে ফেলল—শীতল, ভারী, আর একেবারেই অস্বাভাবিক।
কুঠির ভেতরে পা রেখেই তারা বুঝতে পারল এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি ইতিহাসের রক্তমাখা সাক্ষ্য। বিশাল উঠোনের চারপাশে ঘিরে থাকা ঘরগুলো একসময় হয়তো জৌলুসে ভরা ছিল, এখন সেগুলো কেবল ধ্বংসস্তূপ। দেয়ালের ফাটল দিয়ে ঝরে পড়ছে মাটি, মেঝেতে ছড়িয়ে আছে পুরনো কাঠের টুকরো আর ধুলোয় ঢেকে যাওয়া আসবাব। এক কোণে তারা খুঁজে পেল মরচেধরা লোহার শিকল, যেগুলো হয়তো বন্দিদের বেঁধে রাখার জন্য ব্যবহার হতো। নীলয় হাত দিয়ে শিকল ছুঁয়ে দেখল, অদ্ভুত ঠান্ডা লাগল তার গায়ে। অদিতি কিছু পুরনো নথি আবিষ্কার করল, হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের পাতায় ইংরেজি হাতের লেখায় কিছু নোট—চাষ, উৎপাদন, আর শাস্তির হিসাব লেখা ছিল। অদিতি থেমে গিয়ে বলল, “নীলয়, দেখো… এখানে শুধু চাষ নয়, মানুষের উপর অমানবিক নিপীড়নের রেকর্ডও রাখা হয়েছিল।” নীলয় মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখে ভেসে উঠছিল অতীতের এক দৃশ্য—চাষিদের আর্তনাদ, নীলকরদের নিষ্ঠুর হাসি, আর এই দেয়ালের ভেতর অগণিত অশ্রু আর রক্তের দাগ। কিন্তু হঠাৎই যেন বাতাস ভারী হয়ে এল, কুঠির অন্ধকার কোণ থেকে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল, যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। দুজনেই কেঁপে উঠল, চারপাশে তাকাল, কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। তবু মনে হল, যেন কুঠির ভেতরে তাদের উপস্থিতি কেউ লক্ষ করছে।
সেই সময়েই উপস্থিত হলেন মহাশ্বেতা দেবী, কুঠির রক্ষক। এক অতি বৃদ্ধা, শরীর জর্জরিত, চুল সাদা হয়ে কাঁধে নেমে এসেছে, চোখ দুটো গভীর গর্তের মতো। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন কুঠির অন্ধকার করিডরের শেষে, যেন অদৃশ্য থেকে হঠাৎ প্রকাশ পেলেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল ভাঙা অথচ অদ্ভুত শক্তিশালী, তিনি বললেন—“যা লুকানো আছে, তাকে ঘুমোতে দাও।” অদিতি ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলেও নীলয় এগিয়ে গিয়ে শান্ত স্বরে বলল, “আমরা গবেষক, ইতিহাস জানতে চাই। আপনার ভয় আমরা বুঝি, কিন্তু সত্যকে চাপা রাখা ঠিক নয়।” বৃদ্ধা গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালেন তাদের দিকে, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “সত্য? যে সত্য রক্তে লেখা, যে সত্য মৃতদের চিৎকারে বাঁধা, সেই সত্য যদি তোমরা খোঁজো, তবে মনে রেখো—তোমাদের শান্তি থাকবে না।” কথা শেষ করে তিনি আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন, যেন তিনি আদৌ এসেছিলেন কি না, তা নিয়েই সন্দেহ থেকে যায়। নীলয় ও অদিতি দুজনেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তাদের বুকের ভেতর অদ্ভুত ধাক্কা লাগছিল। নীলয় খাতা বের করে অদ্ভুত বাক্যটি লিখে রাখল—“যা লুকানো আছে, তাকে ঘুমোতে দাও।” সে জানত, এই সতর্কবার্তার ভেতরে কোনও গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু একই সঙ্গে সে বুঝে ফেলেছিল—এই কুঠি তাকে সহজে ছেড়ে দেবে না। এর ভেতরে এমন কিছু আছে, যা শুধু ইতিহাস নয়, এক ভিন্ন অন্ধকার বাস্তবতার দ্বারও উন্মোচন করে দেবে। আর সেই দ্বার একবার খুলে গেলে তার জীবন আর কখনও আগের মতো থাকবে না।
কুঠির করিডরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নীলয়ের চোখ হঠাৎ আটকে গেল এক অদ্ভুত চিহ্নে। দেয়ালের ধূসর পাথরে শ্যাওলা জমে সবকিছু ঢেকে গেলেও, একটি জায়গায় আঁচড়ের মতো দাগ কেটে রাখা ছিল এক অচেনা প্রতীক। সেটা প্রথমে মনে হল কোনও ইংরেজি অক্ষরের মতো, কিন্তু ভালো করে তাকাতেই বোঝা গেল—এটি একধরনের সাঙ্কেতিক চিহ্ন, হয়তো কারও হাতে খোদাই করা। নীলয়ের গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট হল, এটি কেবল কাকতালীয় নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে রাখা কোনও সূত্র। অদিতি কাছে এসে বলল, “তুমি কি মনে করছ এটা কোনও গোপন চিহ্ন?” নীলয় কিছুক্ষণ নীরব থেকে দেয়ালে হাত বুলিয়ে দেখল। তখনই বুঝতে পারল, চিহ্নটির চারপাশের ইটের গাঁথুনিতে সামান্য ফাঁক আছে। সে হাত দিয়ে ঠেলতেই শুনতে পেল ভেতরে ফাঁপা আওয়াজ। তার বুকের ভেতর ধক করে উঠল—এখানে কোনও চাপা জায়গা আছে। বহু চেষ্টার পর যখন তারা ভাঙা ইট সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হল, তখন গা শিউরে ওঠার মতো শব্দে ধীরে ধীরে খুলে গেল এক চাপা দরজা। বাতাসের সঙ্গে বেরিয়ে এল শ্যাওলা আর সেঁতসেঁতে গন্ধে ভরা অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া, যা যেন ভেতরে বহু বছর ধরে জমে ছিল। অদিতি আতঙ্কিত গলায় ফিসফিস করে বলল, “নীলয়… এটা কি আমাদের খোলা উচিত?” কিন্তু নীলয়ের চোখে তখন কেবল অদম্য কৌতূহল। সে ধীরে ধীরে টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে আলো ফেলল।
চাপা দরজার ওপাশে ছিল এক অচেনা ঘর, যেখানে কোনও আলো পৌঁছায়নি হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। ঘরের ভেতরে পা রেখেই দুজনেই বুঝতে পারল তারা এমন এক স্থানে এসেছে যা এই কুঠির আসল অন্ধকার ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। মেঝেতে ধুলো জমে পুরু স্তর তৈরি হয়েছে, বাতাস এতটাই ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। চারদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ধুলোয় ঢাকা কয়েকটি পুরনো বাক্স, যেগুলো মরচেধরা লোহার তালায় আটকানো। কোণায় হেলান দিয়ে রাখা আছে কিছু মরচে ধরা হাতিয়ার—চাবুক, শিকল, লোহার দণ্ড—যেগুলো যে কেবল চাষিদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের স্মারক, তা সহজেই বোঝা যায়। অদিতি চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল, “এগুলো… এগুলো কেবল ইতিহাস নয়, এগুলো রক্তাক্ত অতীতের নিদর্শন।” নীলয়ের টর্চলাইটের আলো হঠাৎ থেমে গেল দেয়ালে ঝোলানো এক বিশাল প্রতিকৃতির সামনে। ছবিটি ছিল এক ইংরেজ নীলকর পরিবারের, যাদের চোখগুলো আঁকা হলেও যেন জীবন্ত মনে হচ্ছিল। সেই দৃষ্টির শীতলতা নীলয়ের ভেতর কেমন এক অস্বস্তি জাগাল। ছবির নিচে ইংরেজি হরফে লেখা নামগুলো প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তারা এই কুঠির মালিক। ঘরের ভেতর এমনভাবে সবকিছু সাজানো ছিল যেন এটি ছিল কেবল একটি গোপন কক্ষ নয়, বরং এক নিষ্ঠুর ক্ষমতার প্রতীক। অদিতি একসময় ধীরে বলল, “এই ঘরটা হয়তো ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল… যেন কেউ জানতেই না পারে এখানে কী ঘটত।” নীলয় মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, তার ভেতরে যেন প্রবলভাবে বেজে উঠছিল অতীতের প্রতিধ্বনি—আর্তচিৎকার, শিকলের শব্দ, আর শূন্য দেয়ালে ঠেকে প্রতিধ্বনিত হওয়া কান্না।
সেই দিন থেকেই কুঠির ভেতরে শুরু হল একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা। প্রথম রাতে, যখন নীলয় নিজের খাতায় নোট লিখছিল, তখন সে স্পষ্ট শুনতে পেল করিডর দিয়ে কারও পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই চারপাশ ফাঁকা—শুধু বাতাসের হালকা দোল আর দেওয়ালের ফাটল দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া। অদিতিও মাঝরাতে চমকে উঠল, কারণ জানলার বাইরে থেকে সে শুনেছিল শিকলের ঝনঝনানি। গ্রামের লোকেরা যখন জানতে পারল তারা লুকানো ঘরে ঢুকেছে, তখন থেকেই তারা আতঙ্কিত হয়ে উঠল। বৃদ্ধা মহাশ্বেতা দেবী আবারও উপস্থিত হলেন এবং ফিসফিস করে বললেন, “তোমরা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছ… এখন সে জেগে উঠবে।” তার চোখে এমন আতঙ্ক ছিল যে অদিতির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কিন্তু নীলয়ের ভেতরে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল—ভয়, বিস্ময়, আর এক অদম্য আকর্ষণ। সে বুঝে গিয়েছিল, এই অদ্ভুত শব্দ আর অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো কেবল কুসংস্কার নয়। কিছু একটার সূত্র খুলে গেছে, কিছু একটার দরজা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, আর সেই থেকেই কুঠির অন্ধকার যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। ইতিহাসের ভেতর থেকে জেগে ওঠা এই ভয়ঙ্কর সত্যকে এড়ানো আর সম্ভব নয়। নীলয় জানত, এই আবিষ্কার তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে—কিন্তু সেটা আলোর পথে নাকি আরও গভীর অন্ধকারের দিকে, তা তখনও তার অজানা রয়ে গেল।
গ্রামের সকালের হাওয়া তখনও কুয়াশায় ভরা। মুর্শিদাবাদের গলিপথ ধরে হাঁটছিলেন নবকুমার ঘোষ, স্থানীয় গাইড যিনি নীলয়কে প্রথম দিন থেকেই নীলকুঠি ঘুরে দেখাতে সাহায্য করেছিলেন। মুখে তাঁর চিরচেনা ধূর্ত হাসি, হাতে বাঁশের লাঠি। কিন্তু হঠাৎ করেই সকালের সেই সাধারণ রুটিন এক ভয়ঙ্কর ঘটনার মোড় নেয়। গ্রামের লোকেরা দূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে—নবকুমার পড়ে গেছেন রাস্তার ধারে! দৌড়ে গিয়ে দেখা গেল, তাঁর চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে আছে, মুখে জমাট বাঁধা ভয়ের ছাপ। শরীরে কোনো স্পষ্ট আঘাত নেই, তবে গলা যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে চেপে ধরা হয়েছে। গ্রামের মানুষরা সঙ্গে সঙ্গে কানাকানি শুরু করল—“ও কুঠির অভিশাপ লেগেছে।” এমনকি যারা যুক্তিবাদে বিশ্বাস করত, তারাও আতঙ্কে কেঁপে উঠল। অদিতি আর নীলয়ও খবর পেয়ে ছুটে এলেন, তাঁদের চোখে প্রথমবারের মতো ভয় জেগে উঠল। নীলয়ের মনে প্রশ্ন ঘুরতে লাগল—এটা কি কেবল কাকতাল, নাকি সত্যিই কুঠির অন্ধকার থেকে কিছু বেরিয়ে এসেছে?
পুলিশের গাড়ি দুপুর নাগাদ এসে দাঁড়াল গ্রামের মোড়ে। অফিসার সুভাষ মন্ডল, বয়সে চল্লিশের কোঠায়, দৃঢ় চেহারা, ঠোঁটে দৃঢ় রেখা, সঙ্গে তাঁর দুই সিপাহী। ঘটনাস্থল ঘিরে দাঁড়ানো জনতার ফিসফাস থামাতে তিনি গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন—“কোনো ভূত নেই, যা হয়েছে তা মানুষ করেছে।” কিন্তু নবকুমারের মৃতদেহ পরীক্ষা করতে গিয়ে সুভাষ নিজেও ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন। কোনো ধারালো অস্ত্র, বিষ, বা আঘাতের চিহ্ন নেই। অথচ শরীরের ভঙ্গি বলছে ভেতর থেকে এক অকথ্য আতঙ্ক তাঁকে গ্রাস করেছিল। নীলয় সুভাষকে সব খুলে বলল—নীলকুঠির ভেতরে লুকানো ঘর, প্রতিকৃতি, অদ্ভুত শব্দ। সুভাষ কিছুক্ষণ চুপ করে শোনার পর হেসে বললেন, “এইসব অলৌকিক কাহিনিতে আমি বিশ্বাস করি না। তবে খুনের পেছনে কারও স্বার্থ আছে, সেটা বের করবই।” তাঁর আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি লোকেদের কিছুটা আশ্বস্ত করলেও, গ্রামের মাটির গন্ধে মিশে থাকা আতঙ্ক সহজে কাটল না। মহাশ্বেতা দেবী, কুঠির রক্ষক, সবার সামনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বললেন—“ওই কুঠির ভেতরে ঘুম ভাঙানো হয়েছে। এখন মৃত্যু আরেকটা ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াবে।” তাঁর কণ্ঠে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যা সকলকে স্তব্ধ করে দিল।
সন্ধ্যা নামতেই গ্রাম জুড়ে আতঙ্ক যেন আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল। প্রতিটি বাড়ির দরজা আগেভাগেই বন্ধ হয়ে গেল, আঙিনায় আলো জ্বালানো হলো, যেন অদৃশ্য অন্ধকারকে প্রতিহত করার এক মরিয়া চেষ্টা। নীলয় ও অদিতি নিজেদের মধ্যে বিতর্ক চালালেন—এটা কি সত্যিই অতিপ্রাকৃত, নাকি কুঠির ইতিহাসকে আড়াল করে কেউ কোনো ষড়যন্ত্র করছে? নীলয়ের বৈজ্ঞানিক মন সবসময় যুক্তির দিকেই ঝুঁকে থাকে, কিন্তু নবকুমারের মৃতদেহ তাঁর যুক্তিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করছে। সুভাষ মন্ডল meanwhile তদন্ত শুরু করলেন, গ্রামবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, কিন্তু সবাই একই কথা বলল—“ও কুঠির অভিশাপ।” রাতের অন্ধকারে, যখন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখনও কুঠির ভেতর থেকে হাওয়ার সঙ্গে মিশে আসে অদ্ভুত গুঞ্জন, ধাতব শব্দ, যেন কেউ কোথাও শিকল টেনে হাঁটছে। নীলয় জানে, এই মৃত্যুই কেবল শুরু। সামনে আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে, আর কুঠির অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সেই অশুভ শক্তি এখন আর ঘুমোতে রাজি নয়।
***
নীলকুঠির ভেতরে সেই দিন অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এসেছিল। সকালবেলা কুয়াশা কেটে গেলেও কুঠির চারপাশে যেন এক অদৃশ্য অন্ধকার ঘনিয়ে ছিল। নীলয় ও অদিতি সাহস সঞ্চয় করে আবারও কুঠির ভেতরে প্রবেশ করল। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ধুলো জমে ছিল, দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছিল, আর কোথাও কোথাও বাদুড়ের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। নীলয় তার নোটবুক খুলে প্রতিটি কোণার ছবি তুলতে শুরু করল, আর অদিতি পুরনো নথিপত্র হাতে নিয়ে পড়ছিল। হঠাৎই নীলয়ের চোখ আটকে গেল এক দেয়ালে, যেখানে ফাটল ধরেছিল। সে টর্চ জ্বালিয়ে কাছে গিয়ে দেখে আঁকাবাঁকা দাগ—যেন শুকনো লালচে কালি দিয়ে লেখা হয়েছে কিছু শব্দ। কিন্তু আলো পড়তেই স্পষ্ট হলো—সেটি রক্তের মতো দাগে লেখা ভয়ঙ্কর বার্তা: “এখনও দেরি হয়নি, চলে যাও।” মুহূর্তেই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল, যেন বাতাসও থমকে গেছে। নীলয়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো, বুকের ভেতর অজানা ভয়ের কাঁপুনি। অদিতি দ্রুত এগিয়ে এসে দেয়াল দেখে অবাক হয়ে বলল, “এটা নিশ্চয়ই কারও ষড়যন্ত্র। ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে।” কিন্তু নীলয়ের চোখের দৃষ্টি কাঁপছিল—সে যেন বুঝতে পারছিল, এখানে কিছু একটা অতিপ্রাকৃত উপস্থিতি রয়েছে।
অদিতি যতই যুক্তি দেখাক না কেন, তার নিজের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের অভাব ফুটে উঠছিল। সে বলল, “দেখো, এসব হয়তো কোনো দুষ্ট লোক করেছে। গ্রামবাসীদের ভয়ের সুযোগ নিয়ে তারা চাইছে কেউ এখানে গবেষণা না করুক।” কিন্তু তার নিজের হাত কাঁপছিল, ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল। নীলয় চুপচাপ দেয়ালের লেখাটা স্পর্শ করতে এগোল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত এক ঠান্ডা অনুভূতি তার হাত বেয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সে যেন শুনতে পেল দেয়ালের ওপাশ থেকে মৃদু শব্দ—কারও হাঁপানোর বা গোঙানির মতো। অদিতি তাকে টেনে সরিয়ে নিল, “পাগল হয়ো না নীলয়! এটা বিপজ্জনক।” নীলয় ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা জ্বলছিল। সে বলল, “আমি জানি, এর পেছনে কেবল মানুষের খেলা নেই। ইতিহাসের অন্ধকার সত্যিই হয়তো জেগে উঠছে। সেই সত্যকে না খুঁজে বের করলে এই কুঠির রহস্য কখনো প্রকাশ পাবে না।” বাইরে তখন মেঘ জমে গিয়েছিল, আকাশ কালো হয়ে আসছিল। ভাঙা জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে যেন সেই লেখাগুলোকে আরও ভয়ানক করে তুলছিল।
দুজনেই কুঠির বাইরে বেরিয়ে এল কিছুক্ষণ পরে। অদিতি চুপচাপ হাঁটছিল, কিন্তু তার মুখের ভয় লুকোনো যাচ্ছিল না। দূরে শ্মশানপাড়ার দিকে কাকের ঝাঁক উড়ে গেল, আর গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়ল ফিসফাস—“কুঠি আবার কথা বলছে।” নীলয় দূর থেকে সেই দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যে ভয়ই আসুক না কেন, সে এখান থেকে সরে যাবে না। রক্তে লেখা বার্তাটি যেন এক চ্যালেঞ্জ, এক আহ্বান—অজানার মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য। অদিতি একসময় থেমে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল, “নীলয়, আমরা হয়তো এমন কিছুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি যেটা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। তোমার কৌতূহল ঠিক আছে, কিন্তু যদি এই অভিশাপ সত্যি হয়?” নীলয় গভীর নিশ্বাস নিয়ে উত্তর দিল, “যদি সত্যিই অভিশাপ থাকে, তবে ইতিহাসের নথিতে তার ছাপও থাকবে। আমি তার প্রমাণ চাই। ভয়কে অন্ধকারেই ফেলে রাখলে সত্যি কখনো আলোয় আসবে না।” দূরে বজ্রপাত হলো, আকাশ কেঁপে উঠল। কুঠি দাঁড়িয়ে রইল কালো ছায়ার মতো—আর সেই দেয়ালে রক্তের মতো লেখা বার্তা যেন প্রতিটি মুহূর্তে নীলয়কে আরও কাছে ডাকছিল অজানা অন্ধকারের গভীরে।
***
নীলকুঠির ঘন অন্ধকারে মোমবাতির আলো কাঁপতে কাঁপতে যেন ইতিহাসের প্রতিটি পরত খুলে দিচ্ছিল। বৃদ্ধা মহাশ্বেতা দেবী সেদিন অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে নীলয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, তার চোখে যেন শতাব্দীর ব্যথা জমাট বেঁধে আছে। ধীরে ধীরে তিনি ফিসফিস করে বলেন—“এখানে যারা মরেছে, তাদের হাড় মিশে গেছে মাটিতে। তুমি যে লুকানো ঘর খুলেছো, তার নীরবতা আসলে এক দীর্ঘ চিৎকার।” কথাগুলো উচ্চারণ করার সময় তার গলায় যেন কাঁপুনি ছিল, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। সেই মুহূর্তে নীলয়ের বুকের ভেতর কেমন এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। মোমবাতির আলোয় দেয়ালের ছায়া যেন নড়ে উঠল, যেন অদৃশ্য কিছু হাত বাড়িয়ে আসছে অন্ধকারের বুক থেকে। অদিতি চুপচাপ বসে ছিল, তবে তার মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। নীলয় তখনও স্থির চোখে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে রইল, কারণ সে জানত, এই কাহিনি কেবল ভৌতিক নয়—এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের এক রক্তাক্ত দলিল, যা খুঁজে বের করাই তার দায়িত্ব।
পরের দিন ভোরে নীলয় কুঠির পুরনো নথিপত্র ও দলিল ঘাঁটতে বসে। হলদেটে হয়ে যাওয়া কাগজের পাতা ও ছেঁড়া খাতার ভেতর থেকে উঠে আসে বিভীষিকার গল্প। সে জানতে পারে, এই কুঠি শুধু নীলচাষিদের জমি দখল করার কেন্দ্র ছিল না, বরং এখানে গোপনে বন্দিদের আটকে রাখা হতো। যেসব চাষি নীল চাষে অস্বীকৃতি জানাতো বা বিদ্রোহ করার চেষ্টা করত, তাদের এই অন্ধকার ঘরে টেনে আনা হতো। এখানে চলত অকথ্য নির্যাতন—লোহার শিকল, মরচেধরা হাতিয়ার, আর খাঁচার মতো ছোট কুঠুরি। দলিলে উল্লেখ আছে, অনেক বন্দির খোঁজ আর কখনও পাওয়া যায়নি। হয়তো তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছিল এই দেয়ালের ভেতরেই। নীলয়ের মনে হতে লাগল, দেয়ালের ফাটল, কুঠির ভেজা গন্ধ, কিংবা রাতের বেলা শোনা অদ্ভুত শব্দগুলো—সবই যেন সেই বন্দিদের জমে থাকা যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি। অদিতি যদিও এসবকে কুসংস্কার বলে ব্যাখ্যা করছিল, তবু তারও শরীর শিউরে উঠছিল প্রতিটি পাতার অক্ষরে অক্ষরে লুকিয়ে থাকা আতঙ্ক দেখে।
দিন যত এগোতে লাগল, নীলয়ের কৌতূহল আরও গভীর হতে থাকল। সে বুঝল, মহাশ্বেতা দেবীর সতর্কবাণী শুধু ভয়ের গল্প নয়—এটি এক ইতিহাসের সাক্ষ্য, যা গোপনে আজও শ্বাস নিচ্ছে এই কুঠির ভেতর। রাতে যখন বাতাসে বাঁশপাতার শব্দ ভেসে আসে, নীলয় তখন মনে করে যেন একসঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠ চিৎকার করছে, যেন অদৃশ্য কেউ বলছে—“আমাদের কাহিনি লিখে যাও।” ধীরে ধীরে নীলয় উপলব্ধি করল, তার গবেষণা কেবল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান নয়, বরং অতীতের সঙ্গে এক আত্মিক সংলাপ। প্রতিটি দলিল, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অদ্ভুত আওয়াজ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ইতিহাসের অন্ধকারতম গহ্বরে। অদিতি যতই যুক্তির কথা বলুক, নীলয় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে সত্যিই এই কুঠির দেয়ালের ভেতর চাপা পড়ে আছে এমন কিছু, যা শুধু ইতিহাসের নথি নয়, বরং মৃতদের আত্মার বেদনাময় সাক্ষ্য। আর সেই সত্য প্রকাশ করাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য।
***
রণজয় দত্ত কলকাতার এক খ্যাতনামা সাংবাদিক, যিনি সত্য উদঘাটনে নির্ভীক বলে পরিচিত। নবকুমারের রহস্যময় মৃত্যুর খবর যখন পত্রিকায় আসে, তখনই তার কৌতূহল জেগে ওঠে। বহু বছর ধরে সে কলকাতার নানা অদ্ভুত ঘটনাকে খুঁজে বের করেছে, কিন্তু মুর্শিদাবাদের নীলকুঠির গল্প তাকে আলাদা করে টানল। গ্রামে পৌঁছে সে প্রথমেই লক্ষ্য করে—লোকজন ভয় এবং অস্বস্তিতে চুপচাপ আছে, যেন তারা কিছু বলতে চাইলেও অজানা আতঙ্ক তাদের ঠোঁট সেলাই করে দিয়েছে। রণজয় সঙ্গে এনেছে তার ক্যামেরা ও সরঞ্জাম, কারণ সে জানে যে দৃশ্যই মানুষের মনে বিশ্বাস জাগাতে পারে। নীলয় ও অদিতির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সে বুঝতে পারে, তারা ইতিমধ্যেই গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে এই কুঠির রহস্যে। রণজয় দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেয়, “আমি সবকিছু ক্যামেরায় ধরে আনব—যা-ই ঘটুক না কেন।” তার আত্মবিশ্বাস যেন কিছুটা কুঠির গা-ছমছমে নীরবতার সঙ্গে সংঘাত তৈরি করে। রাত নামতেই রণজয় কুঠির ভেতরে প্রবেশ করে, প্রতিটি কোণ, প্রতিটি দেয়ালের ফাটল, আর লুকোনো কক্ষের ভেতরকার শূন্যতা ক্যামেরায় বন্দি করতে শুরু করে। কিন্তু তার চোখে পড়ে এক অদ্ভুত বিষয়—লেন্স যতই ঘোরায়, কিছু অস্পষ্ট ছায়া যেন নড়াচড়া করছে, যা খালি চোখে বোঝা যাচ্ছে না।
প্রথমে রণজয় ভাবে, হয়তো আলো আর অন্ধকারের খেলা, হয়তো কুয়াশা কিংবা বাতাসে নড়াচড়া করা ধুলো। কিন্তু যখন সে ফুটেজ দেখতে শুরু করে, তখনই দেখা যায়—এক নারী অবয়ব, চোখে অস্বাভাবিক শূন্যতা, ঠোঁটে ম্লান এক হাসি, ধীরে ধীরে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। রণজয়ের শরীর শিউরে ওঠে। সে আবার কুঠির অন্দরমহল ঘুরতে থাকে, বারবার ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দেয়ালের ছবি তোলে। প্রতিবার ছবিতে নতুন কিছু ভেসে ওঠে—কখনও রক্তমাখা হাতের ছাপ, কখনও পুরনো প্রতিকৃতির চোখে অস্বাভাবিক দীপ্তি, আবার কখনও অদ্ভুত ছায়া যেন তার পেছন পেছন চলেছে। অদিতি প্রথমে তাকে বোঝাতে চায় যে এসব নিছক ভ্রম, কিন্তু নীলয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে; তার মনে হয় কুঠির ইতিহাস নিজেই নিজেদের জানান দিচ্ছে। রণজয়ের কণ্ঠে তখন আর স্বাভাবিক দৃঢ়তা নেই। সে বলতে শুরু করে, “এটা আর সাধারণ তদন্ত নয়, এ যেন এক অজানা শক্তি ক্যামেরার ভেতর দিয়ে কথা বলছে।” তবুও তার সাংবাদিকসুলভ একগুঁয়ে মানসিকতা তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যায়। রাত বাড়তে থাকলে কুঠির ভেতরের অন্ধকার যেন আরও ভারী হয়ে ওঠে।
হঠাৎ এক মুহূর্তে ক্যামেরার আলো নিভে যায়। ঘন নীরবতায় ভেসে আসে করুণ ক্রন্দনের শব্দ, যা দেয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। রণজয় আতঙ্কে ক্যামেরা চালু করার চেষ্টা করে, আর তখনই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য—শৃঙ্খল বাঁধা কিছু মানুষের ছটফটানি, তাদের চোখে অদ্ভুত ভয়, আর পিছন থেকে হেসে ওঠা এক নীলকরের ছায়ামূর্তি। সেই হাসি এতটাই শীতল যে, উপস্থিত সবাই শিউরে ওঠে। রণজয় ক্যামেরা নামিয়ে ফেলে, কিন্তু শব্দ থামে না। অদিতি কাঁপা গলায় বলে ওঠে, “এটা কি ইতিহাসের বন্দি আত্মারা?” নীলয়ও আর কিছু বলতে পারে না। হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে আসে, জানলার কপাট নিজেরাই দপ করে বন্ধ হয়ে যায়। রণজয়ের মনে হয়, কুঠির ভেতর কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের উপস্থিতি মেনে নিতে পারছে না। তবুও সে শেষ চেষ্টা করে ক্যামেরা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগোয়, যেন প্রমাণ সংগ্রহ করেই ছাড়বে। কিন্তু সে জানত না, এই রাতের পর তার ক্যামেরা শুধু রহস্য নয়, এক ভয়াল অভিশাপও বন্দি করে রাখবে—যা আর কখনও সহজে মুক্তি পাবে না।
***
রাতের ঘন অন্ধকারে যখন হাওয়ায় নিস্তব্ধতার ভার নেমে এসেছে, তখনই ঘটল দ্বিতীয় খুন। রণজয়ের সহকর্মী অমিতাভকে পাওয়া গেল কুঠির ভেতর এক করুণ দৃশ্যে—তার দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা ক্যামেরার অংশ আর টর্চলাইটের ভগ্ন কাচ। পুলিশ এসে দেহ পরীক্ষা করল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—কোনও সোজাসুজি অস্ত্রের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। যেন অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। লোকেরা বলতে লাগল—“এখন অভিশাপের পথ আর বন্ধ নেই। যাকে পাবে, তাকেই গিলে খাবে এই কুঠি।” সুভাষ মন্ডল পুলিশের সব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েও হত্যার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। অন্যদিকে নীলয় মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে চারপাশ দেখছিল। দেয়ালে রক্তের ছিটে, মেঝেতে পায়ের চিহ্ন, আর হাওয়ায় ভেসে থাকা এক ধরণের লোহাযুক্ত গন্ধ যেন তাকে বারবার মনে করাচ্ছিল—এই রহস্যের শেকড় বহু পুরনো, যা কেবল মানবহাতের নয়।
অদিতি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সে একদিকে যুক্তির জাল বুনতে চাইছিল, কিন্তু চোখের সামনে এতগুলো অস্বাভাবিক ঘটনা দেখে নিজেকেও বিশ্বাস করাতে পারছিল না। “এটা হয়তো খুনিদের কাজ, অভিশাপ নয়”—সে বলল নীলয়কে। কিন্তু নীলয় গভীরভাবে উত্তর দিল—“অতীত সবসময় বর্তমানকে তাড়া করে। এই নীলকুঠির দেয়ালে যে রক্ত মিশে আছে, তা হয়তো আজও শান্ত হয়নি।” তার কথায় এক ধরণের দৃঢ়তা ছিল, যেন সে মৃত্যুর ভেতর দিয়েই সত্য উদঘাটনের সংকল্প নিয়েছে। মহাশ্বেতা দেবীও এসে দাঁড়ালেন নিঃশব্দে, তাঁর চোখে এক অদ্ভুত আলো। তিনি ধীরে ধীরে বললেন—“দ্বিতীয় মৃত্যু মানে শিকল ভেঙে গেছে। এখন আর থামবে না।” গ্রামের লোকজন যেভাবে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল এই মৃত্যু কেবল একজন মানুষের নয়, বরং গোটা গ্রামজুড়ে এক অভিশপ্ত শ্বাসরুদ্ধকর বার্তা।
কিন্তু নীলয় থামল না। সে জানত, এই খুনের রহস্য যদি না উন্মোচিত হয়, তবে মৃত্যুর মিছিল আরও লম্বা হবে। সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল—অভিশাপ নয়, এই খুনগুলোর আসল কারণ খুঁজে বের করবেই। “খুন যে-ই করুক, তার শেকড় এই নীলকুঠির অতীতেই লুকোনো আছে”—সে বলে উঠল। এই কথাই যেন তার পথচলার অঙ্গীকার হয়ে দাঁড়াল। কুঠির ভেতর লুকানো ঘর, মরচেধরা হাতিয়ার, প্রতিকৃতির রহস্য—সব কিছুই মিলিয়ে যেন এক অদ্ভুত ধাঁধা তৈরি করেছে, আর সেই ধাঁধার উত্তর হয়তো এই রক্তাক্ত ঘটনার ভেতরেই লুকিয়ে আছে। রাত যত গভীর হচ্ছিল, নীলয় অনুভব করছিল—সে যেন এক ভয়ঙ্কর খেলার অংশ হয়ে গেছে, যেখানে প্রতিটি মৃত্যু তাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অজানা সত্যের দিকে।
***
লুকানো ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই নীলয় ও অদিতির হৃদস্পন্দন যেন বেড়ে গেল কয়েক গুণ। ম্লান আলোয় কুয়াশার মতো ধুলো ভেসে বেড়াচ্ছিল, আর ঘরের প্রতিটি কোণে এক অনির্বচনীয় অস্বস্তি চাপা ছিল। ঘরের গভীরে একটি পুরোনো বাক্সের ভেতর তারা খুঁজে পায় একটি জীর্ণ চামড়ার বাঁধাই ডায়েরি। কাগজগুলো হলদেটে হয়ে গেছে, অক্ষরগুলো কোথাও ঝাপসা, কোথাও ছেঁড়া, কিন্তু পড়তে পড়তে তাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। সেখানে লেখা ছিল এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস—কুঠির মালিক ইংরেজ নীলকর কীভাবে স্থানীয় কৃষকদের প্রতারণা, শোষণ আর নির্মম নির্যাতনের ফাঁদে ফেলেছিল। ডায়েরির পাতায় একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা লিপিবদ্ধ ছিল, কারও হাড় কুড়েঘরে ফেলে দেওয়া হয়েছে, কারও নামের পাশে লিখা—“অদৃশ্য।” সেই অদৃশ্যরা কারা ছিল, তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের ব্যথা যেন মিশে আছে ঘরের নীরবতার সঙ্গে। নীলয় ও অদিতির মনে হলো, তারা ইতিহাসের এক জ্বলন্ত ক্ষত হাতে তুলে নিয়েছে, এমন এক ক্ষত, যেটি গ্রামবাসীর রক্তে আর চোখের জলে ভিজে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
কিন্তু শুধু ইংরেজ শোষণের কাহিনি নয়, ডায়েরির শেষ অংশে উন্মোচিত হলো আরও ভয়ঙ্কর সত্য। সেখানে লেখা ছিল এক বিশ্বাসঘাতক স্থানীয় সহযোগীর নাম, যে ইংরেজদের হাত ধরে নিজের ক্ষমতা বিস্তার করেছিল। পাতার পর পাতায় সেই নাম ভেসে উঠতেই নীলয়ের শ্বাস আটকে এলো, কারণ সেই নাম আজও গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিধ্বনিত। অদিতির চোখে পড়ল এক জায়গায় লেখা—“যতদিন পর্যন্ত এ সত্য লুকিয়ে থাকবে, ততদিন তার বংশধররা অপরাধ ঢেকে রেখে শাসন করবে।” এ যেন শুধু অতীতের নয়, বর্তমানেরও এক কুৎসিত মুখোশ। হঠাৎই মনে হলো, এই সাম্প্রতিক খুন, ভয়াবহ ঘটনাগুলো কেবল কোনো অতৃপ্ত আত্মার কাজ নয়; বরং জীবিত মানুষের লোভ, ক্ষমতা আর অপরাধ লুকোনোর এক গভীর ষড়যন্ত্র। গ্রামের সেই প্রভাবশালী মানুষ, যাকে সবাই ভক্তিভরে মাথা নত করে অভিবাদন জানায়, হয়তো তারই ছায়ায় চলছে এই অভিশপ্ত খুনোখুনি। বাইরে বাতাস হাহাকার তুলছিল, আর ডায়েরির অক্ষর যেন জীবন্ত হয়ে উঠে তাদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলছিল—“সত্য প্রকাশ করো।”
নীলয় দাঁতে দাঁত চেপে দৃঢ় হলো। ভয়, আতঙ্ক, গ্রামবাসীর কুসংস্কার—কিছুই তাকে আর আটকে রাখতে পারবে না। সে জানত, এ লড়াই শুধু কুঠির অভিশাপের রহস্যভেদ নয়, বরং ইতিহাসের রক্তমাখা অন্যায়ের বিচার। অদিতি তার চোখে পড়া অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখে কেঁপে উঠল, তবুও পাশে দাঁড়াল, কারণ সেও অনুভব করছিল যে সত্য লুকিয়ে রাখা মানেই নতুন নতুন মৃত্যু, নতুন নতুন রক্তপাত। তারা বুঝতে পারল, কুঠির ভেতরের অতৃপ্ত আত্মা যেমন ন্যায় চাইছে, তেমনি আজকের অপরাধের শিকড়ও লুকিয়ে আছে সেই অতীতের বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যেই। তাদের সামনে এখন স্পষ্ট—গ্রামের মুখোশধারী সেই প্রভাবশালী মানুষই হলো বর্তমান রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। দরজার বাইরে হঠাৎ ভেসে এলো মানুষের হাঁটাহাঁটির শব্দ, কারও ফিসফিসানি, যেন কেউ নজর রাখছে। নীলয় ফিসফিস করে বলল, “আমরা সত্যের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি, অদিতি… এবার লড়াইটা শেষ করতে হবে।” ঘর অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের মনে জ্বলে উঠছিল আগুনের মতো আলো—ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞার আলো।
***
রাতটা ছিল নিঃশব্দ অথচ অস্বাভাবিক ভারী। নীলকুঠির ভেতরে ঢোকার মুহূর্তেই নীলয় অনুভব করল চারদিক যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতির হাত শক্ত করে ধরা থাকলেও তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি আরও জোরালো হচ্ছিল। মশালের আলোয় ভিজে ওঠা দেয়ালে আগের খুনের রক্তের ছাপ এখনও স্পষ্ট—যেন দেয়াল নিজেই সেই মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরে আছে। হঠাৎ দূরে কোথাও একটা ভারী দরজা কেঁপে উঠল, তারপর শোনা গেল পায়ের শব্দ। নীলয় বুঝল এ-যাত্রা তাকে আর ভয় পেয়ে পিছু হটার সুযোগ দেবে না। অতীতের যেসব অদৃশ্য ছায়া এতদিন কেবল শীতল হাওয়া হয়ে তার গায়ে লেগে থাকত, আজ তারা একে একে মুখ তুলে দাঁড়িয়েছে। ঘরের কোণে রাখা পুরনো একটি আয়নায় ঝলক মেরে উঠল কালো ছায়া, আর অদিতি কেঁপে উঠে ফিসফিস করে বলল, “ওটা মানুষ নয়, ওটা অন্য কিছু…”। তবু নীলয় দৃঢ় কণ্ঠে জানাল—আজ আর ভয় নয়, আজ শুধু সত্য। সে জানত, এই সত্যকে প্রকাশ করার জন্য হয়তো তাকে জীবন পর্যন্ত দিতে হতে পারে।
অন্ধকারের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল রহস্যময় মানুষটি—যার মুখ আধো অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু চোখের দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ আর রক্তপিপাসু। সে-ই ছিল এই দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের নেপথ্যের খুনে মুখ। তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল যেন অদৃশ্য আরেকটি শক্তি, অতীতের সব রক্তাক্ত আর্তনাদের প্রতিচ্ছবি। নীলয় প্রথমবার স্পষ্ট করে বুঝতে পারল—এখানে মানুষ আর অমানুষ, ইতিহাস আর বর্তমান, সব একাকার হয়ে গেছে। সেই মানুষটি চিৎকার করে উঠল, “তুমি কিছুই পারবে না বদলাতে, এই কুঠি কারও মুক্তি দেয় না।” কিন্তু নীলয় নিজের হাতে ধরা ডায়েরিটি তুলে ধরে বলল, “সত্য একবার প্রকাশ পেলে আর কখনও লুকিয়ে রাখা যায় না।” পর মুহূর্তেই তীব্র লড়াই শুরু হয়ে গেল। মশালের আগুন ছিটকে পড়ল দেয়ালে, অদৃশ্য ছায়াগুলো যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ঘিরে ধরল চারদিক। অদিতি প্রাণপণে লড়াই করছিল নীলয়ের পাশে দাঁড়িয়ে, কিন্তু সংঘর্ষের মধ্যে হঠাৎ এক আর্তনাদ—আর একজন প্রাণ হারাল সেই কুঠির দেয়ালের ভেতরে। রক্ত, ধোঁয়া আর ছায়ার মিশ্রণে পুরো পরিবেশ যেন এক প্রাচীন অভিশাপের গহ্বরে ডুবে যাচ্ছিল।
শেষ মুহূর্তে নীলয় সেই রহস্যময় মানুষটিকে হার মানাতে সক্ষম হলেও তার চোখে স্পষ্ট ছিল ভয়—কারণ অদৃশ্য শক্তিটি তখনও থামেনি। কুঠির দেয়াল যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল, অতীতের অপরাধের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে গেল রাতের আঁধারে। বাইরে ভোরের প্রথম আলো ফুটছিল, কিন্তু কুঠির ভেতর তখনও এক অদ্ভুত নীরবতা। অদিতির চোখে অশ্রু, নীলয়ের হাতে রক্তের দাগ—তাদের চোখে শুধু একটাই প্রশ্ন, এ কি শেষ? তারা সত্যকে উন্মোচন করেছে, ইতিহাসের রক্তাক্ত কাহিনি প্রকাশ করেছে, কিন্তু অভিশাপ কি ভেঙেছে? নাকি অন্ধকার কেবল ক্ষুধার্ত হয়ে নতুন শিকার খুঁজতে শুরু করবে? শেষ দৃশ্যে নীলয় ক্লান্ত চোখে তাকাল সেই লুকানো ঘরের দিকে—দরজাটা নিজে থেকেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। আর সেই মুহূর্তে মনে হল, হয়তো কুঠির ভেতর এখনও বেঁচে আছে অদৃশ্য ছায়ারা, যারা অপেক্ষা করছে আরেকটি রাতের, আরেকটি প্রাণের। গল্প শেষ হলেও অন্ধকারের রহস্য রয়ে গেল খোলা প্রান্তে—যেখানে মৃত্যু আর ইতিহাস হাত ধরাধরি করে এখনও হাঁটছে নীলকুঠির ভেতর।
****
				
	

	


