Bangla - প্রেমের গল্প

নীলকন্ঠের প্রতিশ্রুতি

Spread the love

সৌমিতা রায়


শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের সকাল যেন মাটির গন্ধ, রঙের খেলা আর সুরের মায়ায় মোড়া এক অলৌকিক প্রভাত। ফাল্গুনের হাওয়া যেন হাতের তালুর মতো কোমল, তবু তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ধরণের উচ্ছ্বাস যা আকাশের নীলকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। আঙিনায় গাছের গায়ে গায়ে হলুদ-কমলা ফুলের মালা ঝুলছে, পথের ধারে আলপনার নকশা, আর সকালবেলার আলোতে লাল মাটির পথ যেন আরও গাঢ় রঙে রাঙিয়ে উঠেছে। কিরণময়ী বাবার দোকানে বসে রঙিন পোড়ামাটির গয়না সাজাচ্ছে—গোলাপি আর সবুজ রঙের কানের দুল, মাটির মালা, ছোট ছোট পায়েলের মতো নকশা করা ব্রেসলেট। বাবার হাতে তৈরি গয়নার উপর তার নিজের আঁকা নকশা উৎসবের ক্রেতাদের চোখে আলাদা করে ধরা দেয়। দোকানের সামনে মানুষের ভিড় ধীরে ধীরে বাড়ছে—শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী, দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটক, বিদেশি ভ্রমণপ্রেমী, আর কাছাকাছি গ্রামের মানুষ—সবাই মিলেমিশে যেন এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাসের ঢেউ তুলেছে। হাওয়ায় গুলঞ্চ ফুলের ঘ্রাণ, চা আর গরম জিলিপির গন্ধ একসঙ্গে মিশে এক উৎসবের গন্ধ তৈরি করেছে। দূরে খোলা মঞ্চে প্রস্তুতি চলছে বসন্ত উৎসবের নৃত্য ও গানের অনুষ্ঠানের, মাইক্রোফোনে সুর মেলানোর শব্দ ভেসে আসছে, আর তার সাথে মিশে আছে ঢোল আর করতালের ছন্দ।
ভিড়ের মধ্যে কিরণময়ীর চোখ প্রায়ই চলে যাচ্ছে রঙের খেলায় মেতে ওঠা মানুষদের দিকে—কে যেন কাউকে গালে হালকা করে আবির মাখিয়ে দিচ্ছে, কেউ গলায় মালা পরিয়ে ছবি তুলছে। তবু এই আনন্দমুখর দৃশ্যের মাঝেও তার মন বারবার থমকে যাচ্ছে সেই অপরিচিত সুরে, যা হঠাৎ করেই ভিড়ের শব্দ ভেদ করে এসে তার কানে বাজছে। এটা উৎসবের মঞ্চের মাইক্রোফোন থেকে নয়, কোনো ব্যান্ড দলের বাজনা থেকেও নয়—বরং যেন কোনো এক নিঃশব্দ কোণ থেকে আসছে। সুরে এমন এক অদ্ভুত গভীরতা যে, মনে হয় তার মধ্যে রঙিন আলো ঢেউ খেলছে, কিন্তু সেই আলোর গভীরে কোথাও যেন অন্ধকারের আভাস। কিরণময়ী হাতের কাজ থামিয়ে কিছুক্ষণ শুনতে থাকে। সুরটা খুব ধীরে ধীরে শুরু হয়, তারপর ধীরে ধীরে তীব্র হয়, আবার মিলিয়ে যায়। তার মনে হয়, যেন এই সুর সে আগে কোথাও শুনেছে, কিন্তু মনে করতে পারে না কোথায়। আশেপাশের মানুষদের দিকে তাকায়, কেউ কি এই সুর খেয়াল করছে? কিন্তু সবার মুখে হাসি, রঙের খেলা আর কেনাকাটার উত্তেজনা—মনে হয় তারা কেউই কিছু শুনছে না। অদ্ভুতভাবে এই মুহূর্তে কিরণময়ীর মনে হয়, পুরো ভিড়ের মাঝখানেও সে একা—শুধু সে-ই এই সুর শুনতে পাচ্ছে।
কিরণময়ী অজান্তেই দোকান ছেড়ে কিছুটা দূরে হাঁটা শুরু করে, সুরের টানে। দোকানের পাশে লাল মাটির সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে ভিড় থেকে একটু সরে আসে। চারপাশে গাছের ডালে ডালে পাখির ডাক, আবিরের গন্ধ, আর ফাল্গুনের হাওয়া—সব মিলিয়ে দৃশ্যটা যেন স্বপ্নের মতো হয়ে ওঠে। সুরটা আরও পরিষ্কার হচ্ছে, আর তার মধ্যে এখন কিরণময়ী একধরণের বেদনা অনুভব করতে পারে—যেন কেউ তার সমস্ত কষ্ট, একাকীত্ব আর আশা মিশিয়ে গাইছে। অবশেষে সে এসে দাঁড়ায় এক পুরনো বটগাছের নিচে। গাছের গুঁড়ির পাশে বসে আছে এক যুবক, হাতে গিটার, চোখ আধো বন্ধ, আর ঠোঁটে সেই সুর। গলায় ঝুলছে নীলকন্ঠ পাখির পালক বাঁধা একটি ছোট্ট লকেট, যা রোদে চকচক করছে। কিরণময়ীর শ্বাস যেন আটকে যায়—সে বুঝতে পারে, এ সুর শুধু সংগীত নয়, এ যেন এক ডাক, যা তার মনের গভীরে ঢুকে গেছে। সেই মুহূর্তে বসন্ত উৎসবের রঙ, গন্ধ, আলো সব ম্লান হয়ে যায়—শুধু থেকে যায় সেই সুর, আর সেই অচেনা যুবকের উপস্থিতি, যা তার জীবনের গল্প বদলে দিতে চলেছে।
***
উৎসবের ভিড় থেকে খানিকটা দূরে, পুরনো বটগাছের ছায়ায় বসে থাকা পথসঙ্গীতশিল্পীটির উপস্থিতি যেন পুরো দৃশ্যের সাথে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য তৈরি করেছিল। চারপাশে আবিরের রঙ, হাসির কোলাহল, মঞ্চে গানের প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে যেখানে উচ্ছ্বাসের ঢেউ, সেখানে এই এক যুবক চুপচাপ বসে গাইছে এক গভীর সুর। তার হাতে পুরনো কাঠের গিটার, আঙুলের ছোঁয়ায় তারগুলোতে জন্ম নিচ্ছে এমন এক সুর যা সরাসরি হৃদয়ে আঘাত করে। গলায় ঝুলছে ছোট্ট এক লকেট, তাতে বাঁধা নীলকন্ঠ পাখির একটি পালক—হাওয়ায় নড়ে নড়ে রোদে চকচক করছে। কিরণময়ী দাঁড়িয়ে শুনতে থাকে, মনে হয় এই সুর তার কোথাও আগে শোনা, হয়তো কোনো স্বপ্নে, কিংবা এমন এক মুহূর্তে যখন তার নিজের মন খুব একলা ছিল। ছেলেটির চোখ আধো বন্ধ, মুখে এমন এক শান্ত-দুঃখী অভিব্যক্তি যেন সে এই ভিড়ের অংশ নয়, বরং কোথাও অনেক দূরের এক জগতে ডুবে আছে। গান শেষ হলে চারপাশে হাততালির কোনো শব্দ হয় না—কারণ এখানে কেউ শোনার জন্য নেই, সবাই উৎসবের মঞ্চ বা বাজারের দিকে ব্যস্ত। কিন্তু কিরণময়ীর মনে হয়, সে যেন একা এই সঙ্গীতের সাক্ষী, আর এই মুহূর্তের একমাত্র প্রাপক।
গান শেষ হওয়ার পর কিরণময়ী ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, যেন টেনে নিচ্ছে কোনো অদৃশ্য সুতো। ছেলেটি চোখ খুলে তাকায়, তার চোখ গভীর কালো, তবু তাতে এক অদ্ভুত স্বচ্ছতা। কিরণময়ী হালকা হাসি দিয়ে বলে, “আপনার গানটা… কোথায় যেন শুনেছি মনে হচ্ছে।” ছেলেটি মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “হয়তো শুনেছেন, হয়তো শোনেননি। কিছু গান সময়ের আগেই মানুষের মনে পৌঁছে যায়।” কিরণময়ী নাম জানতে চাইলে সে বলে, “আমাকে নীলকন্ঠ বলেই ডাকুন।” নামের সাথে সাথে কিরণময়ীর দৃষ্টি চলে যায় লকেটের দিকে, যেখানে নীলকন্ঠ পাখির পালকটা নড়ছে। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করে, “এ পালকটা কেন?” ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে গিটার ঠিক করতে থাকে, তারপর বলে, “এটা আমার সঙ্গে অনেক দূর থেকে এসেছে, এর গল্প একদিন বলব… যদি বলার সময় আসে।” কথায় এক অদ্ভুত রহস্যময়তা, যেন প্রতিটি বাক্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরেকটা গল্প, যা সে এখনই বলতে চায় না। কিরণময়ী বুঝতে পারে, সে নিজের কথা গোপন রাখছে, তবু তার চোখে এমন কিছু আছে যা একবার দেখলে ভুলে যাওয়া যায় না।
কিরণময়ী ও নীলকন্ঠের মধ্যে কথোপকথন খুব সংক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু সেই সংক্ষিপ্ততায়ও যেন এক ধরনের অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে যায়। নীলকন্ঠ বলে, সে বছরের এই সময়ে বিভিন্ন উৎসবে ঘুরে গান গায়, তারপর আবার চলে যায় অন্য কোথাও—কোথায়, তা সে জানায় না। তার কণ্ঠে যখন কথা মেশে, তখনও মনে হয় সুর যেন থেকে যাচ্ছে। কিরণময়ী চেষ্টা করে জানতে, সে কোথায় থাকে, কতদিন এখানে থাকবে, কিন্তু নীলকন্ঠ হাসি দিয়ে বিষয়টা এড়িয়ে যায়। শুধু বলে, “উৎসব শেষ হলেই আমায় চলে যেতে হবে।” কেন যেতে হবে—এই প্রশ্ন কিরণময়ী করতেই চেয়েছিল, কিন্তু তার আগেই ছেলেটি গিটার হাতে নিয়ে আবার বাজানো শুরু করে। এবার গানটা আরও বিষণ্ণ, যেন বিদায়ের আভাস বহন করছে। চারপাশের ভিড়ের আওয়াজ, রঙের ছড়াছড়ি, বিক্রেতার ডাক—সব মিলিয়ে কিরণময়ীর কাছে এই মুহূর্তটা একদম স্থির হয়ে যায়, শুধু গিটার আর গানের সুর ভাসতে থাকে। তার মনে হয়, এই মানুষটির জীবনে এমন কিছু আছে যা তাকে দূরে নিয়ে যায়, যা তার চোখে গভীর ছায়া ফেলে। আর সেই রহস্যই হয়তো কিরণময়ীকে তার দিকে আরও টেনে নিচ্ছে, যদিও সে জানে না—এই টান তাকে কোথায় নিয়ে যাবে।
***
বসন্ত উৎসবের দিনগুলো যেন কিরণময়ীর জীবনে হঠাৎ এক রঙিন ক্যানভাসের মতো খুলে গেল, যেখানে প্রতিদিন নতুন রঙ, নতুন সুর, আর নতুন মুখের আবির্ভাব ঘটছে—তবুও সেই ক্যানভাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙ হয়ে রইল নীলকন্ঠের উপস্থিতি। প্রথম আলাপের পর থেকেই দু’জনের মধ্যে এক অদ্ভুত স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি হয়, যেন তারা বহুদিনের পরিচিত। উৎসবের সকালে কিরণময়ী দোকানের কাজ শেষ করেই নীলকন্ঠকে খুঁজতে বেরোত, আর ছেলেটি প্রায়শই বটগাছের তলায় গিটার নিয়ে বসে থাকত। কখনও সে গাইত লোকগীতি, কখনও নিজের লেখা সুর, যার কথা কিরণময়ীর মনে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিধ্বনিত হতে পারত। দুপুরের দিকে তারা একসঙ্গে গ্রাম মেলার চা দোকানে বসত, যেখানে ধোঁয়া ওঠা মাটির কাপের চায়ের সাথে মিশে থাকত গুড়ের মিষ্টি গন্ধ, আর পেছনে চলত ঢোলের শব্দ বা বাঁশির সুর। মাঝে মাঝে তারা নদীর ধারে হাঁটতে যেত, যেখানে গুলঞ্চ ফুলে ভরা গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পড়ত নদীর জলে, আর নীলকন্ঠ হঠাৎ করেই গান ধরত—সেই গান যেন নদীর স্রোতের সাথে মিলেমিশে যেত। কিরণময়ী এসব মুহূর্তে বুঝতে পারত, সে শুধু একজন পথসঙ্গীতশিল্পীর সাথে সময় কাটাচ্ছে না—সে এমন কারও সাথে হাঁটছে, যার সুর আর নীরবতা সমান গভীর।
তবে যতই কিরণময়ী নীলকন্ঠের কাছাকাছি আসতে থাকে, ততই সে অনুভব করতে শুরু করে যে ছেলেটির হাসির আড়ালে আছে এক ধরণের বিষণ্ণতা, যা কোনো উৎসবের রঙে ঢাকা যায় না। অনেক সময় গান গাওয়ার পর নীলকন্ঠ চুপচাপ দূরে তাকিয়ে থাকত, যেন স্মৃতির কোনো অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। কিরণময়ী জিজ্ঞেস করলে সে সহজভাবে বলত, “কিছু না, শুধু ভাবছিলাম।” কিন্তু সেই “কিছু না”-র ভিতরে যে গভীর কিছু আছে, তা কিরণময়ীর অগোচর থাকত না। একদিন সন্ধ্যাবেলায় তারা নদীর ধারে বসে ছিল, তখন কিরণময়ী হঠাৎ লক্ষ্য করে, নীলকন্ঠ তার গলায় ঝুলন্ত নীলকন্ঠ পাখির পালকটা আঙুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে, মুখে এক ধরনের দ্বিধা। সে পালকটা নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই চুপ করে যায়, যেন কথাটা না বললেই ভালো হবে। সেই মুহূর্তে কিরণময়ীর মনে হয়, নীলকন্ঠের জীবন যেন কোনো অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা, আর সে নিজেও অজান্তেই সেই রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়ছে।
উৎসবের শেষের দিকে এই টানাপোড়েন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে আছে উৎসবের আনন্দ—রঙের খেলা, গান, নৃত্য, আলোয় ভরা সন্ধ্যা—অন্যদিকে আছে নীলকন্ঠের চোখের গভীরতা, যেখানে কোনো অদেখা ভয় ও দুঃখ লুকিয়ে আছে। কিরণময়ী অনেকবার চেয়েছে তার গল্পটা জানতে, তার অতীত আর যাত্রাপথের কথা শুনতে, কিন্তু নীলকন্ঠ সবসময় বিষয়টা এড়িয়ে যায়। তবু সেই এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেও আছে এক ধরণের যত্ন, যেন সে কিরণময়ীকে কোনো অজানা বিপদ থেকে রক্ষা করছে। এই মিলন আর দূরত্বের দ্বন্দ্বে কিরণময়ীর মন কখনো আনন্দে ভরে ওঠে, আবার কখনো অকারণেই ভারী হয়ে যায়। উৎসবের শেষ রাত ঘনিয়ে আসছে, আর তার ভেতরে জমে উঠছে এক আশঙ্কা—নীলকন্ঠ কি সত্যিই এখানে থাকবে, নাকি সে হঠাৎ করেই হারিয়ে যাবে, যেমন রহস্যময়ভাবে এসেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর তখনও তার অজানা, কিন্তু সে অনুভব করছিল, উৎসবের আলো নিভে গেলে হয়তো তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে এই সুর, এই চোখ, এই মানুষ।
***
বসন্ত উৎসবের শেষ রাতটি শান্তিনিকেতনে অন্য সব দিনের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে—চারপাশে আবিরের শেষ রঙ, গানের শেষ সুর, নাচের শেষ তাল মিলিয়ে এক প্রকার বিদায়ের আভাস নিয়ে আসে। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই কিরণময়ীর মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল। দোকানের কাজ শেষ করে, বাবাকে বলল—সে একটু বাইরে যাবে। উদ্দেশ্য ছিল সোজা নীলকন্ঠের কাছে যাওয়া, কারণ শেষ রাতের এই উৎসব সে তার সাথে কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু বটগাছের তলায়, যেখানে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় নীলকন্ঠকে পাওয়া যেত, আজ অদ্ভুতভাবে ফাঁকা। কিরণময়ী চারপাশে তাকায়—গিটার নেই, তার পরিচিত কণ্ঠের কোনো সুর নেই। প্রথমে মনে হলো হয়তো সে মেলার কোনো অন্য অংশে আছে। তাই সে ভিড় ঠেলে ঠেলে আলোর সাজে সাজানো মাঠ ঘুরে বেরোল, নাচের মঞ্চের কাছে গেল, চা দোকান ঘুরল, এমনকি নদীর ঘাটেও গেল—কোথাও নেই। প্রতিটি জায়গায় মানুষের ভিড়, আনন্দ, হাসি—কিন্তু তার চোখ যেন শুধু এক মুখ খুঁজছে। যত সময় যাচ্ছিল, কিরণময়ীর ভেতরের অস্থিরতা ততই বাড়ছিল, যেন উৎসবের উচ্ছ্বাস তার কাছে অর্থহীন হয়ে গেছে।
রাত যত গভীর হতে লাগল, কিরণময়ীর খোঁজা ততই মরিয়া হয়ে উঠল। একসময় সে নদীর ধারে চলে এলো, যেখানে তারা প্রায়ই সন্ধ্যার পর বসত। নদীর কালো জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি ভেসে আছে, চারপাশে হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে, কিন্তু কোথাও নীলকন্ঠের চিহ্ন নেই। কিরণময়ী দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, মনে মনে আশা করল—হয়তো সে হঠাৎই কোনো দিক থেকে এসে ডাক দেবে। কিন্তু ডাক আসেনি। বরং তার চোখ পড়ল ভেজা বালির ওপর কিছু একটা চকচক করছে—গিয়ে দেখল, সেটি একটি নীলকন্ঠ পাখির পালক। এটি গলার লকেট থেকে ছিঁড়ে পড়েছে কিনা, নাকি আলাদা করে রেখে যাওয়া হয়েছে—বুঝতে পারল না। সে হাতের মুঠোয় পালকটা ধরে রাখল, অনুভব করল যেন এই ছোট্ট জিনিসটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক বিশাল শূন্যতা। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো, নীলকন্ঠের হাসির আড়ালের বিষণ্ণতা, হঠাৎ বিষণ্ণভাবে গানের শেষ হওয়া—সব যেন আজকের এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার জন্যই ছিল। নদীর ধারে একা দাঁড়িয়ে, কিরণময়ীর মনে হচ্ছিল—উৎসবের সব আলো নিভে গেছে, আর তার ভেতরে জমে উঠেছে এক ঘন অন্ধকার।
রাতের বাকি সময়টা সে প্রায় নির্বাক অবস্থায় কাটাল। বাড়ি ফিরে বাবাকে কিছুই বলল না, শুধু পালকটা নিজের আলমারির ছোট্ট কাঠের বাক্সে রেখে দিল। বাইরে থেকে উৎসবের শেষ গান ভেসে আসছিল, কিন্তু তার কাছে সবকিছু যেন দূরের এক প্রতিধ্বনি—যার সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। ঘুম আসেনি, বরং নীলকন্ঠের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত তার মনে বারবার ভেসে উঠছিল—চা দোকানের হাসি, নদীর ধারে হাঁটা, সেই চোখের গভীরতা, আর গলায় ঝুলে থাকা পালক। এখন কেবল সেই পালকই রয়ে গেছে, বাকিটা যেন কোনো অদ্ভুত জাদুর মতো মিলিয়ে গেছে। কিরণময়ী বুঝতে পারছিল, এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া হয়তো কাকতালীয় নয়—এর পেছনে কোনো গল্প আছে, কোনো বাঁধন, যা নীলকন্ঠকে ধরে রেখেছিল, আর সেই বাঁধনই তাকে আবার দূরে নিয়ে গেছে। তার মনে দৃঢ় হয়ে উঠছিল একটাই অনুভূতি—এই রহস্য না জানা পর্যন্ত তার মন শান্তি পাবে না, সে যেখানেই থাকুক না কেন, নীলকন্ঠকে আবার খুঁজে পেতেই হবে।
***
শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব শেষ হওয়ার পর দিনগুলো কিরণময়ীর কাছে যেন ধূসর হয়ে গিয়েছিল। দোকানের কাজ আগের মতো চললেও তার মন সর্বক্ষণ কোথাও অন্যত্র ঘুরে বেড়াত—নীলকন্ঠের হারিয়ে যাওয়ার রহস্যের চারপাশে। এক বিকেলে, যখন সে বাবার সাথে দোকান গোছাচ্ছিল, তখন দোকানে প্রবেশ করলেন শশাঙ্ক মুখার্জি—স্থানীয় এক সুপরিচিত লোকসংগীত গবেষক। শান্ত, গভীর চোখের মানুষটি প্রায়ই গ্রামীণ শিল্পীদের সাথে মেলামেশা করতেন, তাদের গান সংগ্রহ করতেন, আর পুরনো কাহিনি লিখে রাখতেন। তিনি কিরণময়ীর বাবার পুরনো পরিচিত, তাই বসে চা খেতে খেতে আলাপ শুরু হল। কথার ফাঁকে শশাঙ্ক হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি নীলকন্ঠ নামের কোনো ছেলেকে চিনতে?” প্রশ্নটি শুনে কিরণময়ীর হাত থেমে গেল, কাপের গরম ধোঁয়া তার গালে লাগলেও সে টের পেল না। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “চিনি… কিন্তু আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?” শশাঙ্কের মুখে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য ফুটে উঠল, যেন তিনি এমন কিছু বলতে যাচ্ছেন যা হালকা ভাবে বলা যায় না।
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “নীলকন্ঠ নামটা কেবল একটা নাম নয়—এটা এক পুরনো পরিবারের ইতিহাসের অংশ। সেই পরিবার এই অঞ্চলেরই ছিল, কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের জীবনকে তাড়া করে ফিরেছে এক অদ্ভুত অভিশাপ।” কিরণময়ী চোখ বড় করে শুনছিল। শশাঙ্ক বললেন, বহু বছর আগে এই পরিবারে এক যুবক গ্রামের এক বিধবার প্রেমে পড়েছিল, যা তৎকালীন সমাজ মেনে নিতে পারেনি। শাস্তি হিসেবে গ্রামের প্রবীণরা তাদের আলাদা করে দেয়, আর সেই বিধবা শোকে-দুঃখে মৃত্যুর আগে অভিশাপ দিয়ে যায়—যাতে এই পরিবারের পুরুষরা বসন্তের সময় কখনোই প্রিয়জনের সাথে থাকতে না পারে। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে, যখন উৎসবের সময় আসে, তখন এই পরিবারের পুরুষরা অদ্ভুত এক অস্থিরতায় ভুগতে থাকে, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাদের দূরে ঠেলে নিয়ে যায়। তাই তারা স্বেচ্ছায় গ্রাম ছেড়ে চলে যায়, ফিরে আসে কেবল ঋতু বদলের পর, যখন পলাশের আগুন নিভে যায়। শশাঙ্ক বললেন, “এই কাহিনি লোকগান, পালা আর কথিত ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে—আর নীলকন্ঠ নামটা সেই পরিবারের পুরুষদের প্রায় সবার সাথেই জড়িয়ে থাকে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।”
কিরণময়ীর বুকের ভেতর যেন কাঁপুনি দিয়ে উঠল। সে হঠাৎ বুঝতে পারল, নীলকন্ঠের আচরণের সাথে এই কাহিনির মিল অনেক—তার চোখের গভীরতা, অকারণ বিষণ্ণতা, আর বসন্ত উৎসবের শেষ রাতে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া। শশাঙ্ক বললেন, “তুমি যদি তাকে সত্যিই চিনে থাকো, তাহলে জেনে রাখো, সে হয়তো এখন অনেক দূরে—কিন্তু পালিয়ে যায়নি, বরং কোনো অদৃশ্য বাঁধনে জড়িয়ে আছে।” কিরণময়ীর মনে হল, এই কথাগুলো যেন তার ভেতরের সন্দেহের জালে একটি সুস্পষ্ট আকার এনে দিল। কিন্তু সেই আকারের সাথে সাথে এক নতুন তৃষ্ণাও জন্ম নিল—যদি সত্যিই এটা অভিশাপ হয়, তবে কি এর কোনো উপায় নেই? নাকি নীলকন্ঠের ভাগ্য চিরকাল বসন্তের সাথে শুরু হয়ে বসন্তের সাথেই শেষ হবে? সে বুঝতে পারল, এই রহস্যের মূলে পৌঁছাতে হলে তাকে শুধু অপেক্ষা নয়, খোঁজও চালাতে হবে—এমনকি তা যদি তাকে সেই পুরনো কাহিনির অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায় তবুও।
***
শশাঙ্ক মুখার্জির কণ্ঠে সেই বিকেলে দোকানের ছোট্ট ঘরটি যেন অতীতের এক গহ্বর খুলে দিল। বাইরের আলো ফিকে হয়ে আসছিল, আর ভেতরে তার গাম্ভীর্যমাখা গল্প কিরণময়ীর মনকে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে ফেলছিল। তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—দুইশো বছর আগে শান্তিনিকেতন তখনও আজকের মতো উৎসব ও শিল্পের আধার হয়ে ওঠেনি, বরং এক গ্রামীণ রাজত্বের অন্তর্গত ছিল। এখানকার জমিদারের একমাত্র ছেলে প্রেমে পড়ে এক সাধারণ কুমারের মেয়ের—একজন গরিব মৃৎশিল্পী, যার হাতের কাজ ছিল অনন্য। সেই মেয়েটির সৌন্দর্য যেমন মানুষকে মুগ্ধ করত, তেমনি তার গান ও হাসি গ্রামের বাতাসে এক অন্যরকম আবেশ আনত। কিন্তু জমিদারের পরিবার এই সম্পর্ককে মানতে পারেনি—তাদের কাছে এটি ছিল রক্তের অপমান। তবুও, ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, একদিন সে সমস্ত সামাজিক বাধা ভেঙে মেয়েটিকে বিয়ে করবে। বসন্ত উৎসবের আগের রাতে তারা গোপনে নদীর ধারে দেখা করত, ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনত। কিন্তু ভাগ্যের অন্য পরিকল্পনা ছিল—উৎসবের ঠিক শেষ রাতে, সেই ছেলে হঠাৎ মেয়েটির কাছে না এসে অন্য এক জমিদার কন্যাকে বিয়ে করে ফেলে, পরিবারের চাপে।
বিশ্বাসঘাতকতার সেই আঘাত মেয়েটিকে ভিতর থেকে ভেঙে দেয়। বসন্ত উৎসবের শেষ দিনের ভিড়ের মধ্যেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়, আর পরদিন সকালে নদীর ঘাটে পাওয়া যায় তার নিথর দেহ। গ্রামের প্রবীণরা বলত, সে নিজেই প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু অন্যরা বিশ্বাস করত—তার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল আর সেই ভাঙন তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। মৃত্যুর আগে, এক সাক্ষী জানায়, মেয়েটি অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল—“এই বংশের কোনো পুরুষ বসন্তের শেষ রাত শান্তিনিকেতনে কাটাতে পারবে না। যদি কাটায়, তবে তার মৃত্যু অবধারিত।” কথাটি এতটাই গভীরভাবে মানুষের মনে ছাপ ফেলেছিল যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই পরিবারের পুরুষরা বসন্তের সময় গ্রাম ছেড়ে চলে যেত, যেন অদৃশ্য কোনো ছায়া তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অভিশাপটিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল এক বিশ্বাস—মেয়েটির আত্মা এখনও শান্ত হয়নি, আর সে নিজের প্রেমের প্রতীক হিসেবে রেখে গিয়েছে একটি নীলকন্ঠ পাখির পালক। সেই পালক নাকি তার আত্মার প্রতীক, যা অভিশপ্ত বংশের পুরুষদের কাছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে গেছে, যেন তারা কখনো না ভোলে কী হারিয়েছে।
শশাঙ্কের কথায় কিরণময়ীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে স্পষ্ট মনে করতে পারল—নীলকন্ঠের গলায় ঝুলে থাকা ছোট্ট লকেটটি, যার ভেতরে বাঁধা ছিল নীলকন্ঠ পাখির পালক। এখন বুঝতে পারছিল, সেটি শুধু অলংকার নয়, বরং অতীতের এক অভিশাপের সাক্ষ্য। শশাঙ্ক বললেন, “যখনই বসন্তের শেষ রাত আসে, সেই পালক যেন ভারী হয়ে ওঠে, আর যার কাছে থাকে, সে এক অদৃশ্য ডাকে সাড়া দিয়ে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যায়—মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য।” কিরণময়ীর মনে এক ঝড় বইতে লাগল—নীলকন্ঠ কি তাই পালিয়ে গিয়েছিল? নাকি তাকে সত্যিই টেনে নিয়ে গিয়েছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি? সে বুঝতে পারল, এই গল্প কেবল লোককথা নয়, বরং নীলকন্ঠের জীবনের গভীরে প্রোথিত সত্য। সেই মুহূর্তে তার মনে দৃঢ় হল এক সিদ্ধান্ত—যদি এই অভিশাপ ভাঙার কোনো উপায় থাকে, তবে সেটি খুঁজে বের করতেই হবে, যতই পুরনো ইতিহাসের অন্ধকারে নামতে হোক না কেন।
***
শীতের ভোরে কুয়াশা মাখা বাতাস ভেদ করে কিরণময়ী রওনা দিল। তার হাতে শুধু একটি ছোট কাপড়ের ব্যাগ, ভিতরে কয়েক সেট কাপড়, বাবার দেওয়া সামান্য টাকা আর নীলকন্ঠের রেখে যাওয়া পাখির পালক—যা সে কাগজে মুড়ে নিজের কাছে রেখেছে যেন ভরসার তাবিজ। প্রথম গন্তব্য ছিল বর্ধমানের রেলস্টেশন। স্টেশন চত্বরে কোলাহল, ভাঁপওলা চা, কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো যাত্রী, আর মাইকের ভাঙা ঘোষণার শব্দ। কিরণময়ী লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগল—নীলকন্ঠ নামে কোনো পথগায়ককে চেনে কি না। বেশিরভাগ মাথা নাড়ল, কেউ কেউ ভেবে বলল, “হয়তো শুনেছি, কিন্তু ঠিক মনে নেই।” একজন বৃদ্ধ চা-ওয়ালা বলল, “ক’মাস আগে এক ছেলেকে দেখেছিলাম, গলায় লকেট ঝুলছিল, গানের গলা ছিল অসাধারণ—কিন্তু সে তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিল।” এই এক ঝলক তথ্য কিরণময়ীকে নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিল। সে জানত, নীলকন্ঠ তার গান দিয়ে মানুষের মনে চিহ্ন রেখে যায়—তাই গানই হবে তার খোঁজের মানচিত্র।
বর্ধমান থেকে সে নদীর পাড়ের ছোট ছোট গ্রামে ঘুরতে লাগল। প্রতিটি গ্রামে হাট বসে, যেখানে গরম পাটিসাপটা, তেলেভাজা আর গুড়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে ঢোলক আর একতারা বাজনার সুর। কিরণময়ী সেসব আসরে চুপচাপ বসে গায়ক-বাদকের গান শুনত, আশা করত, হঠাৎ কোনো পরিচিত সুর বা গলার স্বর তাকে চমকে দেবে। অনেকেই তাকে নীলকন্ঠের মতো দেখতে বা শোনাতে পারে এমন কিছু গায়কের কথা বলল, কিন্তু কিরণময়ী বুঝে নিত—তারা সে নয়। কেউ কেউ বলল, “সে গানের মধ্যে যেন বেদনার স্রোত ছিল, এমন সুর যা শোনার পর মনে হয়, কাউকে হারিয়ে ফেলেছো।” এসব বর্ণনা তার মনকে কাঁপিয়ে দিত, কারণ সেই অনুভূতিই তো সে প্রথম উৎসবে নীলকন্ঠের গান শুনে পেয়েছিল। নদীর ঘাটে বসে এক বৃদ্ধ মৎস্যজীবী বলল, “সে একবার এখানে গান গেয়েছিল, নদীর জলও যেন থেমে শুনছিল। তারপর আবার দেখি নাই।” প্রতিটি সাক্ষাৎ যেন এক টুকরো গল্প দিত, কিন্তু পুরো ছবিটা ধোঁয়াশায় ঢেকে থাকত।
শীতের হাটগুলোতে কিরণময়ী অনেক লোকের সাথে আলাপ করল—লোকসঙ্গীতের পুরনো শিল্পী, বাউল, কবিয়াল, এমনকি ভ্রাম্যমাণ জাদুকরও। অনেকেই নীলকন্ঠের গান শুনে মুগ্ধতার কথা বলল, কেউ তার গান মনে করে চোখ ভিজিয়ে ফেলল, কিন্তু ঠিকানা বলতে কেউ পারল না। একসময় মনে হল, নীলকন্ঠ যেন তার নিজের গান হয়ে গেছে—যা শোনা যায়, অনুভব করা যায়, কিন্তু ধরা যায় না। প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি আসর, প্রতিটি মানুষের স্মৃতিতে সে একটুকরো করে রয়ে গেছে, কিন্তু কোথাও সম্পূর্ণ নয়। দিন শেষে, কিরণময়ী যখন রাতের হাটের শেষ আলো আর খোলা আকাশের নিচে একা বসে থাকত, তার মনে হত—নীলকন্ঠকে খুঁজে পাওয়া মানে শুধু একজন মানুষকে খুঁজে পাওয়া নয়, বরং সেই গান, সেই অভিশাপ, আর সেই প্রেমের অদৃশ্য সুতোকে জোড়া লাগানো। তবু সে থামল না—কারণ সে জানত, একদিন এই সুর তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে, যত দূরেই হোক না কেন।
***
শীতের কুয়াশা মাখা সকালের মতোই সেই নদীপারের গ্রামটি ছিল নীরব, যেন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগসূত্র অনেক আগেই ছিন্ন হয়েছে। কিরণময়ী মাটির সরু পথ ধরে এগোতে এগোতে অনুভব করল, গ্রামটিতে প্রবেশ করলেই বাতাসের গন্ধ বদলে যায়—এখানে এক অদ্ভুত ভারী আবহ আছে, যেন নদীর ধারে জমে থাকা কুয়াশার মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো অজানা রহস্য। বাড়িগুলো পুরনো, কাঁচা দেওয়ালে সময়ের দাগ, আর উঠোনে শীতের শুকনো পাতা জমে আছে। নদীর ঘাটে পৌঁছে সে দেখল, এক বাঁশের বেঞ্চে বসে আছে নীলকন্ঠ—অবিন্যস্ত চুল, গায়ে পুরনো উলের চাদর, চোখে ক্লান্তি আর ভয় মেশানো দৃষ্টি। সেই চোখ দেখে কিরণময়ীর বুক হঠাৎ কেঁপে উঠল—এই তো সেই সুরের মানুষ, কিন্তু আজ সে যেন ভেঙে পড়া প্রাচীন বাড়ির মতো, যার ভিতরের আলো নিভে এসেছে।
নীলকন্ঠ প্রথমে তাকে দেখে বিস্মিত হল, তারপর চোখ নামিয়ে নিল, যেন কোনো ভুল করে ফেলেছে। কিরণময়ী কাছে গিয়ে তার হাত ধরল, কিন্তু সেই হাত ঠান্ডা ও কাঁপছিল। ধীরে ধীরে নীলকন্ঠ বলতে শুরু করল—“তুমি কেন এসেছো? এটা এমন জায়গা নয় যেখানে তোমার আসা উচিত।” কিরণময়ী জেদ করে জবাব দিল, “তুমি না বললেও আমি জানতাম তোমাকে খুঁজে পাবো। তুমি পালিয়েছো কেন?” তখন নীলকন্ঠ ভাঙা গলায় বলল, “কারণ, যদি আমি বসন্তের রাত শান্তিনিকেতনে কাটাই, তবে আমি বাঁচব না। অভিশাপ আমার রক্তে, আমার নিশ্বাসে, আমার প্রতিটি সুরে লুকিয়ে আছে। প্রতি বছর উৎসবের সময় আমি চলে যাই—যেন মৃত্যুর হাত থেকে পালাতে পারি। কিন্তু এবার… এবার শরীর আর মন দুটোই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।” তার কণ্ঠে এমন এক গভীর হাল ছেড়ে দেওয়া অনুভূতি ছিল যে, কিরণময়ীর মনে হল, সে শুধু ভয়ে নয়, দীর্ঘ একাকীত্ব আর অভিশাপের ভারে ভেঙে পড়েছে।
কিরণময়ী তখন প্রথমবার বুঝল, নীলকন্ঠের হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই বিষণ্ণতা কেবল স্মৃতি নয়—বরং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এক শৃঙ্খল, যা সে কাটাতে পারছে না। সে অনুভব করল, এই ছেলেটি সারাজীবন পালিয়ে এসেছে, কিন্তু পালানোর পথও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। নদীর ওপারে সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা সরছিল, কিন্তু তাদের চারপাশের বাতাসে ভয়ের ছায়া এখনও ঘন। নীলকন্ঠ বলল, “আমি যদি এবারও পালাই, হয়তো বেঁচে যাব, কিন্তু কতদিন? একদিন তো অভিশাপ আমায় ধরবেই।” কিরণময়ী তার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তুমি পালিয়ে নয়, মুখোমুখি হয়ে বাঁচতে পারো। আমি তোমার পাশে থাকব।” তার কণ্ঠে এমন অটল দৃঢ়তা ছিল যে, নীলকন্ঠ এক মুহূর্ত চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন প্রথমবার কেউ তার ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করতে চায়। সেই মুহূর্তে কিরণময়ীর মনে হল—অভিশাপ ভাঙতে হলে কেবল অতীতের অন্ধকারে আলো জ্বালানো নয়, বরং মৃত্যুভয়ের সীমানা পেরিয়ে দাঁড়াতে হবে।
***
নদীর ধারের সেই নির্জন বিকেলে কিরণময়ী ও নীলকন্ঠ একে অপরের মুখোমুখি বসে ছিল—দু’জনের মাঝে শুধু এক ছোট্ট কাঠের বেঞ্চ আর বাতাসে নদীর কুলুকুলু ধ্বনি। কিরণময়ীর চোখে কোনো দ্বিধা ছিল না; বরং তাতে ছিল এক অদম্য জেদ, যা নীলকন্ঠের ক্লান্ত ও ভীত দৃষ্টি ধীরে ধীরে ভেদ করে প্রবেশ করছিল। সে ধীরে কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল, “তুমি সারা জীবন অভিশাপ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছ, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, পালিয়ে কোনো দিন মুক্তি মেলে না। এবার আমরা একসঙ্গে দাঁড়াবো—যে কোনো পরিণতি আসুক।” নীলকন্ঠ কেঁপে উঠল; সে কখনও কাউকে এই কথাগুলো বলতে শোনেনি। অভিশাপের গল্প তার জীবনের ছায়া হয়ে থেকেছে শৈশব থেকে—যে ছায়া তার বাবা, দাদার জীবন গ্রাস করেছে। সে জানত না এই ছায়াকে ভাঙা যায় কি না, কিন্তু কিরণময়ীর কণ্ঠে যে নিশ্চয়তা ছিল, তাতে তার বুকের গভীরে বহু বছর ঘুমিয়ে থাকা আশার কণা যেন নড়ে উঠল। নদীর জলে প্রতিফলিত সোনালি সূর্যাস্তের আলোতে নীলকন্ঠ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল—এটাই হবে তাদের প্রতিজ্ঞা।
তারা সিদ্ধান্ত নিল, বসন্ত উৎসবের শেষ রাতে তারা শান্তিনিকেতনে থাকবে—সেই রাত, যা নীলকন্ঠের বংশের জন্য মৃত্যুর রাত্রি বলে মানা হয়। নীলকন্ঠ জানত, এই সিদ্ধান্ত তার জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে, কিন্তু কিরণময়ীর হাত ধরে সে অনুভব করল, ভয়কে ছাড়া জীবন মানে কেবল শূন্য পথচলা। কিরণময়ী বলল, “আমরা যদি মরতেও হই, তবে পালিয়ে নয়, লড়াই করে মরব। আর যদি বেঁচে যাই, তবে প্রমাণ হবে অভিশাপ কেবল গল্প, বাস্তব নয়।” তার কণ্ঠে এমন অটল সাহস ছিল যে, নীলকন্ঠের মনে হল—হয়তো এই মেয়েটিই সেই আলো, যা শত বছরের অন্ধকারে প্রবেশ করতে পারে। তারা পরিকল্পনা করল—শেষ দিনের ভিড়, রঙের উৎসব, গানের আসরের মাঝেই তারা থাকবে একসঙ্গে, এক মুহূর্তের জন্যও আলাদা হবে না। নীলকন্ঠ তার লকেট থেকে নীলকন্ঠ পাখির পালক খুলে কিরণময়ীর হাতে দিল, যেন এ প্রতীকী ঘোষণা—এই জীবন, এই ভাগ্য, আজ থেকে আর কেবল তার নয়।
সেই রাত নদীপারের আকাশে চাঁদ উঠেছিল ফিকে রুপালি আলো নিয়ে। কিরণময়ী ও নীলকন্ঠ চুপচাপ বসে নদীর জল দেখছিল—তাদের মাঝে কোনো শব্দের প্রয়োজন ছিল না, কারণ দু’জনের মনেই ছিল আসন্ন রাতের ওজন। দূরে কোনো গ্রাম্য গায়ক একতারা বাজিয়ে গাইছিল এক পুরনো বাউল গান, যার সুরে মিশে ছিল ভ্রমণ, হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে আসার গল্প। নীলকন্ঠ সেই সুরের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “যদি কিছু হয়… তুমি গানটাকে মনে রেখো।” কিরণময়ী তার হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল, “যদি কিছু হয়, তবু তোমাকে খুঁজে নেব—এই জীবন না হলে, অন্য জীবনে।” সেই কথার মধ্যে ছিল এমন এক অটল প্রতিশ্রুতি যে, নীলকন্ঠ প্রথমবার অনুভব করল—অভিশাপকে পরাস্ত করার শক্তি হয়তো মানুষের মনেই লুকিয়ে থাকে। সেই রাতে তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ প্রতিজ্ঞা করল—যে রাত তাদের পরীক্ষা নেবে, সেই রাত তারা একসঙ্গে, নির্ভয়ে মুখোমুখি হবে।
***
শান্তিনিকেতনের শেষ রাত ছিল বসন্তের রঙে ভিজে থাকা এক অদ্ভুত স্বপ্নের মতো—রাস্তায় আলোর মালা, দোলনাচের গান, দূরে দৌলতপুরের ঢাকের তালে মিলিয়ে মিশে যাচ্ছে মানুষের হাসি-খুশির গুঞ্জন। কিরণময়ী ও নীলকন্ঠ ভিড়ের মাঝেই বসেছিল, তার গলায় একতারা, আর কিরণময়ীর কণ্ঠে তার সঙ্গে মিলিয়ে সুর। তাদের গান যেন উৎসবের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছিল, ভিড়ের লোক থেমে শুনছিল, কেউ হাততালি দিচ্ছিল, কেউ গানের সুরে রঙ ছুঁড়ছিল আকাশে। নীলকন্ঠের চোখে ছিল এক অদ্ভুত দীপ্তি—ভয় এবং সাহসের মিশ্র আলো—যেন সে জানে, প্রতিটি সুরের সঙ্গে সময় এগিয়ে যাচ্ছে সেই মুহূর্তের দিকে, যা তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই চারপাশের হাওয়ায় যেন অদ্ভুত ভারী ভাব নেমে আসছিল; উৎসবের হাসি ধীরে ধীরে যেন চাপা হয়ে যাচ্ছিল এক অজ্ঞাত নিস্তব্ধতায়।
প্রথমে বাতাসে এক হালকা শিরশিরানি, তারপর দূরের আকাশে নীলাভ ঝিলিক—যেন অদেখা কোনো আগুন হঠাৎ জ্বলে উঠল। মাটির ধুলো উড়িয়ে ঝড় আসতে শুরু করল, দোকানের ঝুলন্ত লণ্ঠন দুলে উঠল, রঙের গুঁড়ো বাতাসে ছড়িয়ে আকাশে মিশে গেল। গাছের ডালে কোথা থেকে যেন নীলকন্ঠ পাখির করুণ ডাক শোনা গেল—একবার, দু’বার, তারপর যেন শত শত কণ্ঠ একসঙ্গে সুর তোলে। কিরণময়ী নীলকন্ঠের হাত শক্ত করে ধরল; সে অনুভব করল, তার আঙুলের ফাঁকে আঙুল যেন ঠান্ডা ও ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু নীলকন্ঠ ছাড়ল না। হঠাৎ ভিড়ের মাঝখানে আলো নিভে গেল, চারপাশে শুধু সেই নীল আলোর ঝলকানি ও ঝড়ের গর্জন। কিরণময়ীর মনে হল, তারা যেন উৎসবের মধ্যে নয়, বরং সময়ের এক সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে অতীত ও বর্তমান মিলেমিশে এক অদৃশ্য বিচার করছে। নীলকন্ঠ তার চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বলল, “শেষ মুহূর্ত—আমার হাত ছাড়ো না।” সেই কণ্ঠে ছিল অনুরোধ নয়, বরং এক গভীর আত্মসমর্পণ।
ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই ঝড় থেমে গেল, নীলাভ আভা মিলিয়ে গেল, পাখির ডাক থেমে নরম সকালের সুরে পরিণত হল। চারপাশের মানুষ যেন আগের রাতের কোনো অদ্ভুত ঘটনার স্মৃতি ছাড়াই আবার উৎসবের রঙে ফিরে গেল। কিন্তু কিরণময়ী ও নীলকন্ঠ জানত—তারা কিছু পেরিয়ে এসেছে, যা অন্য কেউ বুঝবে না। তারা দুজনই বেঁচে আছে, তাদের নিঃশ্বাসে কোনো শীতলতা নেই, চোখে আবার স্বাভাবিক আলো। কিরণময়ী নীলকন্ঠের গলায় হাত দিয়ে দেখল—লকেটটা এখনও আছে, কিন্তু তার ভিতরের নীলকন্ঠ পাখির পালক নেই, যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারা দুজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কারও ঠোঁটে কোনো প্রশ্ন বা উত্তর নেই। এটা কি অভিশাপ ভাঙার চিহ্ন, নাকি কোনো নতুন প্রতিশ্রুতির শুরু—তা তারা জানে না। শুধু নদীর ওপারে সূর্যের আলো যখন সোনালি হয়ে উঠছিল, তখন তাদের চোখে ছিল একই দৃঢ়তা—যা-ই হোক, এবার তারা পালাবে না, একসঙ্গে পথ চলবে, যতদিনই সেই পথ হোক।
***

1000054275.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *