Bangla - ভ্রমণ

নীলকণ্ঠের দ্বীপ

Spread the love

সৌরদীপ মুখোপাধ্যায়


পর্ব ১ : যাত্রার প্রথম সকাল

ভোর পাঁচটা নাগাদ কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর–এর চতুর্থ নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাতে শক্ত করে ধরা ছিল এক পুরনো খাতা—যে খাতায় আমি এতদিন যাবৎ সব ভ্রমণকাহিনি লিখে রেখেছি। শৈশব থেকেই সমুদ্রের প্রতি আমার অদ্ভুত টান, অথচ যতবার সমুদ্র দেখেছি, তা সবই দীঘা কিংবা পুরীর মতো চেনা জায়গায়। এবার প্রথমবার আন্দামান। নামটা শুনলেই আমার কানে বাজে নীল জলের ফিসফিস, ঝড়ের রাতে ইংরেজ জাহাজের ঘণ্টাধ্বনি আর অন্ধকার সেলের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া বন্দিদের আর্তনাদ।

চেক-ইন শেষে বিমানে উঠে বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছিল। আমার পাশের সিটে ছিলেন এক বৃদ্ধ দম্পতি—দু’জনেই পোর্ট ব্লেয়ারের বাসিন্দা। ভদ্রলোকের নাম সুব্রত মুখার্জি, তিনি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, একসময় আন্দামান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়াতেন। ভ্রমণলেখকের কৌতূহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
“আন্দামানের ইতিহাস বলতে আমরা শুধু সেলুলার জেলকেই বুঝি। এর বাইরে কিছু আছে?”
ভদ্রলোক মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
“সেলুলার জেলই আন্দামানের পরিচয় হয়ে গেছে বটে, কিন্তু দ্বীপে আরও কত অজানা গল্প আছে—যদি খুঁজতে পারেন, অবাক হবেন।”

কথা শেষ হতে না হতেই বিমানের জানালা দিয়ে দেখা গেল সমুদ্র। গভীর নীল জলরাশি, তাতে সোনালি সকালের আলো ঝিলমিল করছে। যেন কারও ছড়িয়ে দেওয়া রুপোর পাত।

পোর্ট ব্লেয়ারে নামতেই কানে এল ভিন্ন এক হাওয়া। আর্দ্র, নোনাভাবমাখা, অথচ গন্ধে কাঁচা সবুজের সতেজতা। বিমানবন্দর থেকে শহরের পথে ট্যাক্সিতে উঠলাম। ড্রাইভারের নাম সঞ্জীব। সে আমাকে দেখেই বলল,
“দাদা, প্রথমবার আসছেন বুঝি?”
আমি হেসে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, লিখি কিছু ভ্রমণের উপর।”
“তাহলে তো অনেক জায়গায় নিয়ে যাব আপনাকে। তবে সাবধান—এই দ্বীপে রহস্যও আছে।”

তার কথায় হেসে ফেললাম, কিন্তু বুকের ভেতর যেন অজান্তেই শিরশির করে উঠল।

হোটেলে ব্যাগ রেখে সোজা চলে গেলাম সেলুলার জেলের দিকে। রাস্তার দুই ধারে ছিল খেজুরগাছ, লালচে কাঠের ঘর আর দূরে নীল সমুদ্রের ঝলক। সেলুলার জেলের বিশাল ফটকের সামনে পৌঁছতেই শরীর কেমন শীতল হয়ে এল। লাল ইটের দেয়াল, লম্বা করিডর আর সারি সারি সেল—ইতিহাসের হাহাকার যেন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে।

একজন স্থানীয় গাইড আমাকে কাছে টেনে বলল,
“স্যার, এখানে শুধু কারাবাস হয়নি, এখানে স্বপ্ন গড়া হয়েছিল। কত মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য।”
আমি শুনছিলাম মনোযোগ দিয়ে, কিন্তু হঠাৎই মনে হল করিডরের একদম শেষে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যেই তা মিলিয়ে গেল বাতাসে। গাইড কিছুই টের পেল না, কিন্তু আমার বুক কেঁপে উঠল।

সন্ধেবেলায় হোটেলে ফিরে খাতা খুলে লিখতে বসলাম। কলম বারবার এক জায়গায় এসে থেমে যাচ্ছিল—
এই দ্বীপে রহস্য আছে। হয়তো আমি তার মুখোমুখি হব।”

রাত নামল দ্রুত। জানালার বাইরে সমুদ্রের শব্দ। ঢেউয়ের ভেতর যেন কারও ডাক শুনতে পাচ্ছি—
“এসো… নীলকণ্ঠের দ্বীপে…”

পর্ব ২ : অরণ্যের মানুষ

পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙল সমুদ্রের গর্জনে। হোটেলের জানালা খুলতেই সামনে দেখা গেল একরাশ রোদ ছড়িয়ে পড়ছে নীল জলের ওপর। পোর্ট ব্লেয়ারের রাস্তাগুলো তখনও আধোঘুমে। আমি নাস্তা সারতেই হাজির হল সঞ্জীব, আগের দিনের ট্যাক্সিচালক।
“আজ আপনাকে নিয়ে যাব চিড়িয়া টাপু, আরেকটু ভেতরে গেলে স্থানীয় জনজাতিরা আছে। তবে সাবধানে যাবেন, সবাই কথা বলতে চায় না,” সে বলল।

ট্যাক্সি শহর ছাড়তেই চারপাশ বদলে গেল। পাকা রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়লাম অরণ্যের পথ ধরে। বিশাল সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে আসছিল ভেজা মাটির গন্ধ। হঠাৎ মনে হল, এ জঙ্গলের প্রতিটি পাতাই যেন বহু বছরের পুরনো রহস্য ফিসফিস করছে।

চিড়িয়া টাপু পৌঁছে সঞ্জীব গাড়ি থামাল। বলল,
“আপনি কিছুটা হেঁটে গেলে ‘জারওয়া’ জনজাতির লোকদের দেখা পেতে পারেন। তবে ওরা খুব সতর্ক। ছবি তুলবেন না, প্রশ্নও বেশি করবেন না।”

আমি খাতা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সূর্যের আলো গাছের ফাঁক গলে এসে পড়ছিল শরীরে। হঠাৎই দূরে দু’জন মানুষকে দেখলাম—গা-ভর্তি ছোপছোপ রঙ মাখা, হাতে লম্বা বাঁশের বর্শা। তারা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।

আমি বুকের ভেতর ধুপধাপ শব্দ সামলে হাত তুলে নমস্কার জানালাম। একজনের গলায় ছিল শঙ্খের মালা, অন্যজনের কোমরে পশমের মতো কাপড়। তারা এক অদ্ভুত ভাষায় কিছু বলল, আমি বুঝতে পারলাম না। তবে তাদের চোখে আক্রমণ নেই, বরং কৌতূহল।

একসময় একজন আঙুল তুলে আমার খাতার দিকে ইশারা করল। আমি পাতাগুলো ওদের দেখালাম। সেখানে লেখা ছিল সমুদ্র, দ্বীপ, ইতিহাস—সব বাংলায়। অচেনা অক্ষর দেখে তারা হাসল। তারপর একজন হাতে থাকা লাঠি দিয়ে মাটিতে একটা নকশা আঁকতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে বুঝলাম, এটা দ্বীপের মানচিত্র। মাঝখানে একটা জায়গা চিহ্নিত করল সে, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠল—
“নীল… কণ্ঠ।”

আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। দ্বীপের নাম এভাবেই আমার খাতায় লেখা ছিল—নীলকণ্ঠের দ্বীপ।” ওরা কি সেই একই রহস্য জানে?

আমি জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ বনভূমির দিক থেকে অদ্ভুত ঢোলের শব্দ ভেসে এল। তারা দু’জন একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর দ্রুত জঙ্গলের ভেতরে মিলিয়ে গেল। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম।

সঞ্জীব আমাকে ফিরিয়ে আনার পথে বলল,
“দাদা, এরা অনেক পুরনো। বাইরের লোককে কিছুই জানাতে চায় না। তবে ওরা যে শব্দটা বলল, সেটাই রহস্য।”

সেদিন রাতে হোটেলে বসে আমি মানচিত্রটা আঁকতে চেষ্টা করলাম। মাটিতে আঁকা চিহ্নটা যেন সমুদ্রের মাঝে কোনো দ্বীপের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। আর সেই সঙ্গে মনে পড়ছিল তাদের উচ্চারণ করা শব্দ—
“নীল… কণ্ঠ…”

পর্ব ৩ : সেলের ভেতর ছায়া

সকালে আবার সেলুলার জেলের দিকে পা বাড়ালাম। আগের দিনের অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে গ্রাস করেছিল। মনে হচ্ছিল, লাল ইটের দেওয়ালগুলো শুধু ইতিহাস নয়, কোনো অচেনা গোপনীয়তাও ধরে রেখেছে।

জেলের প্রবেশপথে আজ অন্য একজন গাইড পেলাম। নাম রমেন। বয়স্ক, চোখদুটো গভীর অথচ তীক্ষ্ণ। তিনি বললেন,
“আপনি লেখক? তাহলে খেয়াল রাখবেন—এই জেলের দেয়াল কথা বলে। সবাই শোনে না, তবে যার শোনার কথা, সে শুনবেই।”

কথাটা শুনে আমার শরীরে হালকা শিহরণ বয়ে গেল।

জেলের ভেতর ঢুকতেই দেখা গেল লম্বা করিডর, একটার পর একটা সেল। লোহার দরজা, ম্লান আলো। রমেন একেকটা সেলের সামনে দাঁড়িয়ে বন্দিদের গল্প বলতে লাগলেন—কীভাবে তারা নির্যাতিত হতো, কীভাবে দিন কেটেছে একচিলতে জানালার আড়ালে।

আমি খাতায় লিখতে লিখতে হঠাৎ থেমে গেলাম। করিডরের এক কোণে অদ্ভুত কিছুর শব্দ পেলাম—মনে হল চেন টেনে আনা হচ্ছে। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম, একদম শেষের সেলটা আধখোলা। অথচ সেখানে দর্শনার্থীদের ঢোকার অনুমতি নেই।

গাইড বললেন,
“ওই সেলটাই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। একবার সেখানে কেউ ঢুকলে সহজে বেরোতে চাইত না।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কেন?”
রমেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“কারও কারও মতে, সেখানে এখনও বন্দিদের আত্মা ঘোরে।”

আমি আর দেরি করলাম না, এগিয়ে গেলাম সেই সেলের সামনে। ভেতরে তাকাতেই মনে হল দেয়ালের গায়ে আঁচড় কাটা কিছু অক্ষর আছে। আমি মোবাইলের আলো ফেলতেই স্পষ্ট হল—
“NEEL KANTH”

ইংরেজি হরফে লেখা এই দুটি শব্দ আমাকে স্তব্ধ করে দিল। শত বছরের পুরনো বন্দিদের সেলের ভেতর এই নাম কীভাবে এল?

রমেন কাঁপা গলায় বললেন,
“এই নামটা আমি বহুবার দেখেছি, কিন্তু এর মানে কেউ জানে না। আপনার যদি সাহস থাকে, ভেতরে গিয়ে দেখুন।”

আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সেলের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, দেওয়ালের আর্দ্রতা নাকে লাগছে। মেঝেতে হাত বুলাতেই ঠান্ডা ধাতব কিছু পেলাম। তুলে দেখি মরচে ধরা লোহার এক টুকরো। তাতে অক্ষরে খোদাই করা—
“1891, Port Blair”

তারপর হঠাৎই কানে ভেসে এল এক ফিসফিস আওয়াজ—
“সাগরের নিচে যা হারিয়েছে… তাই নীলকণ্ঠ…”

আমি চমকে উঠে তাকালাম। সেলের ভেতর কেউ নেই, শুধু ছায়া নড়ছে দেওয়ালে।

বাইরে বেরোতেই রমেন বললেন,
“দেখলেন তো? সবাই দেখে না, সবাই শোনেও না। আপনাকে ডেকেছে ওরা।”

সেদিন রাতেই খাতায় লিখলাম—
সেলুলার জেলের ভেতর নীলকণ্ঠ নামটা লেখা আছে। এই রহস্যের সূত্র হয়তো সমুদ্রের তলায়।”

পর্ব ৪ : নীলের গভীরে

সেলুলার জেলের অভিজ্ঞতার পর মনে হচ্ছিল, সমস্ত সূত্রই যেন সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমাকে। তাই ঠিক করলাম ডাইভিং করব। পোর্ট ব্লেয়ারের আবেরডিন বাজারে খোঁজ নিয়ে পেলাম এক ডাইভিং প্রশিক্ষক—নাম সায়ন। চেহারায় রোদে পোড়া, চোখদুটো সমুদ্রের মতো গভীর।

সায়ন প্রথমে দ্বিধা করছিল,
“দাদা, আপনি লেখক মানুষ, শখ করে ডুব দিলে বিপদে পড়তে পারেন।”
আমি তাকে সেলের ভেতর পাওয়া অদ্ভুত লেখার কথা বলতেই সে থমকে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আচ্ছা, কাল সকালে আপনাকে নিয়ে যাব। তবে মনে রাখবেন—যা দেখবেন, সবাই দেখে না।”

পরদিন ভোরে আমরা ছোট্ট বোটে চেপে সমুদ্রের দিকে রওনা দিলাম। আকাশ নীল, হাওয়া হালকা, আর সমুদ্রের ঢেউ যেন ধীরে ধীরে ডাক দিচ্ছিল। সায়ন আমাকে স্নরকেল, অক্সিজেন ট্যাঙ্ক, ফ্লিপার সব বুঝিয়ে দিল।

বোট থেকে ঝাঁপ দিতেই মনে হল আমি এক অজানা জগতে ঢুকে পড়েছি। নীল জল কেমন অদ্ভুত স্বচ্ছ, চারপাশে রঙিন মাছ ঘুরছে, প্রবাল পাথরের ঝলক। আমি যত নিচে নামছিলাম, ততই আলো ফিকে হতে লাগল। গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর চাপা ভয় আর উত্তেজনা বাড়ছিল।

হঠাৎই চোখে পড়ল—একটা ভাঙা কাঠামো। যেন বিশাল কোনো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। মরচে ধরা লোহা, ভাঙা কেবিন, আর স্রোতের টানে দুলছে। কাছে যেতেই দেখা গেল লোহার গায়ে খোদাই করা একটি নাম—
“SS Neelkanth”

আমার শরীর কেঁপে উঠল। এটা কি কেবল কাকতালীয়? নাকি সেই নামই, যা সেলের ভেতরও লেখা ছিল?

সায়ন ইশারায় আমাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছিল, কিন্তু আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। জাহাজের ভেতরে ঢোকার মুখে একটা মরচে ধরা ঘণ্টা ঝুলে আছে। ঢেউয়ের টানে সেটি খানিকটা দুলছিল, আর মনে হচ্ছিল গভীর থেকে কারও কান্না ভেসে আসছে।

আমি হাত বাড়িয়ে ঘণ্টাটায় ছোঁয়ার মুহূর্তেই হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল এক দৃশ্য—
ইংরেজ পোশাক পরা কয়েকজন লোক জাহাজে বন্দি ভারতীয়দের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার, রক্ত, বন্দুকের শব্দ। আর দূরে সমুদ্রের গর্জনের ভেতর একজন বন্দি ফিসফিস করে বলছে—
“নীলকণ্ঠ আমাদের রক্ষা করবে…”

আমি চমকে উঠে দেখলাম আবার সমুদ্রের ভেতরেই আছি। সায়ন জোরে হাত ধরে আমাকে উপরে টেনে তুলল। আমরা যখন পানির ওপরে উঠলাম, তখন আমার বুক ধড়ফড় করছে।

বোটে উঠে সায়ন গম্ভীর গলায় বলল,
“আপনি যা দেখেছেন, ওটা স্বপ্ন নয়। এই জাহাজের ইতিহাস আছে। বহু বছর আগে এক বিদ্রোহ হয়েছিল, কিন্তু তার কথা কারও জানা নেই। হয়তো আপনাকেই সেটা খুঁজে বের করতে হবে।”

সেদিন রাতে খাতায় লিখলাম—
সমুদ্রের তলায় যে জাহাজ ডুবে আছে, তার নামও নীলকণ্ঠ। সেই রহস্যই হয়তো আমাকে ডেকে চলেছে।”

পর্ব ৫ : আর্কাইভের ধুলো

সমুদ্রের তলায় SS Neelkanth–এর নাম দেখার পর আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। বুঝলাম, ইতিহাসের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এই রহস্যের চাবিকাঠি। তাই সোজা চলে গেলাম পোর্ট ব্লেয়ারের সরকারি আর্কাইভ ভবনে।

পুরনো দালান, দেয়ালে নোনাভাবের দাগ, ঘরে ঢুকতেই গন্ধ পেলাম ধুলো আর সেঁতসেঁতে কাগজের। ভেতরে বসে ছিলেন সাদা চুলের এক বৃদ্ধ—চশমার কাচ ঘোলা, টেবিলে ছড়িয়ে থাকা ফাইলের ভিড়ে যেন হারিয়ে গেছেন। নাম জানতে চাইলাম, মৃদু হেসে বললেন,
“অরুণ কান্তি দে। সবাই আমাকে আর্কাইভের পাহারাদারই বলে।”

আমি খাতায় লেখা ‘SS Neelkanth’-এর নামটা দেখালাম। অরুণবাবুর চোখ চকচক করে উঠল।
“এ নাম তো আমি বহু বছর আগে একবার শুনেছিলাম। ১৮৯০-এর দশকে আন্দামানের উপকূলে এক ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজ ডুবেছিল। কিন্তু শোনা যায়, সেটি শুধু মালবাহী ছিল না—গোপনে সেখানে বন্দি স্বাধীনতাকামী কিছু তরুণকেও নিয়ে আসা হচ্ছিল।”

আমার বুক ধড়ফড় করে উঠল।
“তাহলে জাহাজডুবির সঙ্গে বন্দিদের ইতিহাসও জড়িয়ে?”
অরুণবাবু ধীরে ধীরে ফাইল উল্টাতে লাগলেন। একসময় একটা ছেঁড়া পাতা বার করলেন। সেখানে ইংরেজিতে কালি-ঝাপসা রিপোর্ট—

“…The vessel ‘SS Neelkanth’ sank during a storm. No survivors recorded. Rumour: rebels onboard. Confidential— not to be reported.”

আমি চুপ করে পড়ছিলাম, কিন্তু গলা শুকিয়ে আসছিল।
“এরপর?”
অরুণবাবু নিঃশ্বাস ফেললেন।
“এরপর কেউ আর খোঁজ রাখেনি। ইতিহাসের বইয়ে এ ঘটনার উল্লেখ নেই। হয়তো ব্রিটিশরা ইচ্ছে করেই চাপা দিয়ে দিয়েছে।”

তারপর তিনি ফিসফিস করে বললেন,
“কিন্তু শোনা যায়, জাহাজের একটা ঘণ্টা বেঁচে আছে—যেটা বাজলেই মৃত বন্দিদের আত্মা সাড়া দেয়। আপনি যদি সেটার সামনে যান, তবে হয়তো সত্যিটা নিজেই মুখ খুলবে।”

আমি থম মেরে দাঁড়ালাম। ঘণ্টাটার কথা তো আমি ইতিমধ্যেই দেখেছি। সমুদ্রের ভেতর সেই মরচে ধরা ঘণ্টা এখনো দুলছে।

বেরোবার সময় অরুণবাবু আমাকে একটা হলুদ খামে ভরা নকশা দিলেন।
“এটা জেলের ভেতর থেকে উদ্ধার হয়েছিল বহু বছর আগে। দেখুন তো, কাজে লাগে কিনা।”

হোটেলে ফিরে খামটা খুলতেই দেখি নকশায় একটা দ্বীপ আঁকা। মাঝখানে বড় অক্ষরে লেখা—
“Neelkanth Point”

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। মানচিত্রে চিহ্নিত সেই জায়গাটাই কি সেই দ্বীপ, যেটার কথা জনজাতিরা বলছিল?

রাত গভীর হলো। জানালার বাইরে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে মনে হল কেউ যেন অদৃশ্য কণ্ঠে বলছে—
“এসো… আমাদের গল্প শুনতে…”

পর্ব ৬ : নিষিদ্ধ দ্বীপের পথে

ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি। খামে পাওয়া সেই মানচিত্র টেবিলের উপর মেলে রেখে একবার আরেকবার চোখ বুলাচ্ছিলাম। মাঝখানে স্পষ্ট লেখা—“Neelkanth Point.” মনে হচ্ছিল, পুরো আন্দামান যেন আমাকে ওই বিন্দুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সায়নের কাছে গিয়ে মানচিত্র দেখালাম। সে অনেকক্ষণ নীরব থেকে বলল,
“ও জায়গাটা নিয়ে অনেক কাহিনি আছে। মৎসজীবীরা বলে, যে সেখানে গেছে সে আর ফিরে আসেনি।”
আমি জেদ ধরে বললাম,
“আমাকে যেতেই হবে। আমার কলম ওই রহস্য না খুঁজে থামতে পারবে না।”

অবশেষে সায়ন রাজি হলো, তবে শর্ত দিল—“যা-ই ঘটুক, ভয় পেয়ে যেন মাঝপথে ফিরে না আসেন।”

ছোট্ট মোটরবোটে করে আমরা সাগরে নামলাম। পোর্ট ব্লেয়ারের পরিচিত গন্ধ, বাজার, মানুষের ভিড় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল পেছনে। চারপাশে শুধু অসীম সমুদ্র। ঢেউ কখনও শান্ত, কখনও উত্তাল। নীল জলের মাঝে অচেনা ছায়া ভেসে উঠছিল বারবার—কখনও বড় মাছ, কখনও হয়তো কোনো ডুবে যাওয়া কাঠামোর আভাস।

ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ দূরে দেখা গেল ছোট্ট এক দ্বীপ—ঘন সবুজে ঢাকা, কুয়াশায় মোড়া। দূর থেকে যেন গাঢ় অন্ধকার ছায়ার মতো। সায়ন ফিসফিস করে বলল,
“ওই তো Neelkanth Point।”

বোট ভিড়তেই অনুভব করলাম অদ্ভুত নীরবতা। পাখির ডাক নেই, মানুষের সাড়া নেই। শুধু ঢেউ ভাঙার শব্দ আর গাছের পাতার ফিসফাস।

আমরা অরণ্যের ভেতরে ঢুকলাম। মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে আছে, বাতাসে নোনাভাব আর শ্যাওলার গন্ধ। একটু এগোতেই হঠাৎ দেখলাম গাছের গায়ে খোদাই করা অদ্ভুত কিছু চিহ্ন—ত্রিভুজ, বৃত্ত, আর মাঝখানে এক ধরনের পাখির ছবি। সায়ন কপালে হাত ঠেকাল,
“এগুলো ওদের টোটেম। মানে জনজাতির নিষিদ্ধ চিহ্ন।”

কিছুদূর যেতেই অদ্ভুত শব্দ কানে এল—ঢোলের মতো, কিন্তু গভীর, যেন মাটির ভেতর থেকে ভেসে আসছে। শব্দটা বাড়তে লাগল, আবার মিলিয়ে গেল।

আমরা থমকে দাঁড়ালাম। হঠাৎই ঝোপ সরিয়ে একদল মানুষ বেরিয়ে এলো। চেহারায় আঁকা লাল-কালো রঙ, হাতে বর্শা। তারা আমাদের ঘিরে ফেলল। চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছিল।

আমি বুকের ভেতর সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
“আমি লেখক। শুধু গল্প খুঁজছি।”

তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এল। বয়সে প্রবীণ, গলায় শঙ্খের মালা। সে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর মাটিতে হাত দিয়ে কিছু অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করল—
“নীলকণ্ঠ… আমাদের অভিশাপ…”

শব্দগুলো শুনে পুরো শরীর কেঁপে উঠল। এ দ্বীপে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে, যা ইতিহাস মুছে দিয়েছে, অথচ মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে অভিশাপ হয়ে।

সেদিন রাতে খাতায় লিখলাম—
“Neelkanth Point শুধু মানচিত্রের নাম নয়, এটি এক নিষিদ্ধ দ্বীপ। অরণ্যের মানুষরা ভয় পায়। কেন?”

পর্ব ৭ : অরণ্যের হৃদয়ে

জনজাতির প্রবীণ মানুষটি যখন বলল নীলকণ্ঠ… আমাদের অভিশাপ”, তখন অদ্ভুত এক শীতলতা বয়ে গেল শরীরজুড়ে। তার চোখে ভয় ছিল, আবার এক অদৃশ্য দায়ও যেন চাপা ছিল। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সে আমাদের ইশারা করল তাকে অনুসরণ করতে।

আমরা গাছপালার ফাঁক দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। পাখির ডাক নেই, কেবল অদ্ভুত হাওয়া বইছে। কিছুক্ষণ পর অরণ্য ফাঁকা হয়ে এল, আর মাঝখানে দেখা গেল এক পাথরের বেদি। বেদির গায়ে শ্যাওলা জমেছে, কিন্তু তাতে স্পষ্ট খোদাই করা এক পাখির ছবি—লম্বা ঠোঁট, নীল পালক আঁকা। নিচে ইংরেজি হরফে লেখা—
“1891 – Neelkanth.”

আমি হতবাক হয়ে বেদির চারপাশে ঘুরতে লাগলাম। সায়ন চাপা গলায় বলল,
“দাদা, এটা ব্রিটিশ আমলের কোনো স্মৃতিচিহ্ন মনে হচ্ছে।”

প্রবীণ জনজাতি মানুষটি বেদির সামনে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল। ঢোলের শব্দ আবার শোনা গেল, যেন মাটির ভেতর থেকে ভেসে আসছে।

হঠাৎই বেদির চারপাশে মাটি কেঁপে উঠল। আমি চোখ মুছে দেখলাম—বেদির ফাঁক দিয়ে স্রেফ ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ধোঁয়ার ভেতর যেন ভেসে উঠছে মুখ—অতীতের মুখ, বন্দিদের মুখ। তাদের চোখে যন্ত্রণা, ঠোঁটে ফিসফিসানি—
“আমাদের মুক্ত করো…”

আমি চমকে উঠলাম। সায়ন আমার কাঁধ শক্ত করে ধরল।
“চলুন এখান থেকে। এই জায়গাটা অভিশপ্ত।”

কিন্তু আমার পা যেন নড়ছিল না। ধোঁয়ার ভেতর আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম সেই জাহাজ—SS Neelkanth—ঝড়ের রাতে ডুবে যাচ্ছে, বন্দিদের আর্তচিৎকার আকাশ ছিঁড়ে ফেলছে। আর জাহাজের ডেকে একজন তরুণ দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চিৎকার করছে—
“নীলকণ্ঠ আমাদের রক্ষা করো!”

অচানক সব মিলিয়ে গেল। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়লাম। প্রবীণ জনজাতি মানুষটি কাছে এসে কাঁপা গলায় বলল,
“তুমি ওদের ডাক শুনেছো। এই দ্বীপে যে প্রবেশ করে, সে আর আগের মতো থাকে না।”

আমরা ফিরে আসার পথে আকাশ কালো হয়ে গেল। হঠাৎ প্রবল ঝড় উঠল, ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছিল। আমি মনে মনে শুধু একটাই ভাবছিলাম—এই রহস্য কি কেবল অভিশাপ, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ভারতের স্বাধীনতার কোনো অজানা ইতিহাস?

সেদিন রাতে হোটেলে ফিরে খাতায় লিখলাম—
নীলকণ্ঠ শুধু এক জাহাজ নয়, এক প্রতীক। দ্বীপের মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে সেই প্রতীকের ইতিহাস।”

পর্ব ৮ : মাটির নিচের দরজা

ঝড় থেমে যাওয়ার পরেও মনটা অস্থির হয়ে ছিল। জনজাতির প্রবীণ মানুষটির চোখে যে ভয় দেখেছিলাম, তা যেন আমাকে তাড়া করে ফিরছিল। পরদিন আবার সায়নকে নিয়ে রওনা দিলাম সেই দ্বীপের দিকে। এবার আমার হাতে শুধু মানচিত্র নয়, সঙ্গে ছিল একরাশ কৌতূহল আর অদম্য তাগিদ।

অরণ্যের ভেতরে ঢোকার পর আমরা সোজা পৌঁছে গেলাম সেই পাথরের বেদির সামনে। সকালের আলোয় বেদিটা যেন আরও বেশি রহস্যময় দেখাচ্ছিল। আমি হাত বুলিয়ে খোদাই করা অক্ষরগুলো স্পর্শ করলাম। হঠাৎ আঙুলের নিচে কেমন যেন ফাঁপা অনুভূতি পেলাম। মাটিতে টোকা দিতেই শব্দ এল খালি পেটের মতো।

“সায়ন, এখানে কিছু আছে,” আমি ফিসফিস করে বললাম।

আমরা মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে এল মরচে ধরা এক লোহার আংটা। আংটা টেনে তুলতেই দেখা গেল পাথরের নিচে কাঠের তৈরি একটা দরজা। দরজাটা বন্ধ, কিন্তু সায়নের হাতে থাকা ছোট্ট রড দিয়ে চেপে ধরতেই সেটা কঁকিয়ে খুলে গেল।

নিচে নামার জন্য সরু সিঁড়ি। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ—আর্দ্রতা, শ্যাওলা আর মাটির ঘ্রাণ মিশে আছে। নিচে নামতেই চোখে পড়ল দীর্ঘ করিডর, দু’পাশে সারি সারি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষ যেন ছোট্ট সমাধি। দেয়ালে পোড়া মশালের দাগ, আর কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের মতো দাগ।

আমরা টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল দেয়ালে খোদাই করা অদ্ভুত অক্ষর। অনেকটা সংস্কৃতের মতো, তবে বিকৃত। সায়ন চুপ করে রইল, আমি খাতায় যতটা পারলাম নকল করে নিলাম।

করিডরের শেষে গিয়ে দেখি এক বিশাল কক্ষ। মাঝখানে রাখা পাথরের ফলক। ফলকের ওপর স্পষ্ট লেখা—
“Here lies the martyrs of Neelkanth, 1891.”

আমার বুক কেঁপে উঠল। তাহলে সত্যিই জাহাজডুবির পর বন্দিদের মৃতদেহ এখানে আনা হয়েছিল? ইতিহাস যেটা মুছে দিয়েছে, সেই কাহিনি এখনো মাটির নিচে শুয়ে আছে।

হঠাৎই কক্ষের ভেতর ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। টর্চের আলো কেঁপে উঠল। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম ফিসফিসানি—
“আমাদের গল্প লিখে যাও… আমাদের নাম ফিরিয়ে দাও…”

সায়ন ভয় পেয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল। আমি শেষবারের মতো ফলকটায় হাত রাখলাম। পাথরের ভেতর থেকে যেন কেঁপে উঠল শত শত হৃদস্পন্দন।

আমরা দ্রুত বাইরে বেরোলাম। সূর্যের আলোয় চোখ ঝলসে গেল। কিন্তু বুকের ভেতর তখনও গমগম করছিল সেই কণ্ঠস্বর।

সেদিন রাতে খাতায় লিখলাম—
মাটির নিচে লুকিয়ে আছে নীলকণ্ঠ জাহাজের বিদ্রোহীদের সমাধি। তাদের আত্মা চাই মুক্তি, আর তাদের ইতিহাস চাই প্রকাশ।”

পর্ব ৯ : চাপা দেওয়া ষড়যন্ত্র

নিষিদ্ধ দ্বীপের ভেতরে সমাধিক্ষেত্র দেখে আসার পর আমার ভেতর থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল। বুঝতে পারছিলাম, এটা শুধু এক জাহাজডুবি নয়—এর ভেতরে আছে এক চাপা দেওয়া ইতিহাস।

অরুণ কান্তি দে–র কথা মনে পড়ল। যিনি আর্কাইভে আমাকে প্রথম সূত্র দিয়েছিলেন। আবার ছুটলাম তাঁর কাছে। ধুলোমাখা টেবিলের ওপারে বসে তিনি যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন।

আমি যখন সমাধিক্ষেত্রের কথা বললাম, তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি টেবিলের নিচ থেকে একটা মোটা খাতা বের করলেন। খাতার পাতাগুলো ভঙ্গুর, কালি ফ্যাকাশে।
“এগুলো সরকারি নথি নয়,” তিনি ফিসফিস করে বললেন। “একজন ব্রিটিশ অফিসারের ব্যক্তিগত ডায়েরি। অনেক বছর আগে আমি উদ্ধার করেছিলাম।”

পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমি থমকে গেলাম। ইংরেজি হরফে লেখা—

“SS Neelkanth was used to transport rebel prisoners. The order came from Calcutta. But the storm was not an accident… we were instructed to sink it midway. None should survive. The world must never know.”

আমার হাত কাঁপছিল। আমি উচ্চারণ করলাম—
“মানে ব্রিটিশরা ইচ্ছে করেই জাহাজটা ডুবিয়েছিল?”
অরুণবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন,
“হ্যাঁ। এটাই ছিল আসল ষড়যন্ত্র। একদিকে বন্দিদের নির্মূল করা, অন্যদিকে বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে শেষ করে দেওয়া। আর সেই অপরাধকে ঝড়ের দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া।”

আমার বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল, তাদের নামই মুছে দেওয়া হয়েছিল ইতিহাস থেকে।

আমি আরও কয়েকটা পাতা পড়তে লাগলাম। সেখানে লেখা ছিল জাহাজের ঘণ্টার কথা—যেটা বাজলেই নাকি মৃত বন্দিদের আত্মা সাড়া দেয়। আবার নীলকণ্ঠ নামটারও উল্লেখ ছিল। এক অফিসার লিখেছিল,
“The rebels called upon their god ‘Neelkanth’ before drowning. Perhaps that’s why the ship earned the cursed name.”

হঠাৎই মনে পড়ল সমুদ্রের তলায় আমার দেখা সেই মরচে ধরা ঘণ্টার কথা। হয়তো ওটাই এই অভিশপ্ত ইতিহাসের একমাত্র জীবন্ত সাক্ষী।

অরুণবাবু শেষবারের মতো আমাকে সতর্ক করলেন।
“তুমি যত খুঁড়ছো, ততই বিপদের দিকে এগোচ্ছো। ব্রিটিশরা চলে গেছে, কিন্তু ওদের পাপ এখনও বেঁচে আছে এই দ্বীপে।”

আমি খাতাটা বন্ধ করে ফেললাম। জানতাম, আর পিছনে ফেরার উপায় নেই। সত্যিটা লেখার দায়িত্ব এখন আমার কাঁধেই।

রাতের বেলা হোটেলে বসে কলম হাতে লিখলাম—
“SS Neelkanth কেবল এক জাহাজ ছিল না, ওটা ছিল এক নরকযাত্রা। বিদ্রোহীদের আত্মা আজও মুক্তি চায়, আর সেই মুক্তির ভাষা লিখে রাখতে হবে আমাকেই।”

পর্ব ১০ : ঘণ্টার ডাক

শেষ কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেলুলার জেলের দেওয়ালে খোদাই করা নাম, সমুদ্রের তলায় ডুবে থাকা SS Neelkanth, অরণ্যের বেদি আর ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্র—সবকিছু যেন এক বিন্দুতে এসে মিশছিল। আর সেই বিন্দু ছিল সমুদ্রের তলায় ঝুলে থাকা মরচে ধরা ঘণ্টা।

সায়নকে বললাম,
“আমাকে আবার ওই জাহাজে যেতে হবে।”
সে বিস্মিত চোখে তাকাল।
“আপনি জানেন ওখানে যাওয়া কতটা বিপজ্জনক?”
আমি দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলাম,
“হয়তো, কিন্তু এ রহস্যের মুখোমুখি না হলে আমার লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”

পরদিন ভোরে আমরা আবার ছোট্ট বোটে সমুদ্রের দিকে রওনা হলাম। আকাশে তখনো কুয়াশা, সমুদ্রের জল অদ্ভুত শান্ত। মনে হচ্ছিল, এই শান্তির আড়ালেই লুকিয়ে আছে ঝড়।

জাহাজডুবির ধ্বংসাবশেষে পৌঁছেই ডুব দিলাম। নীল জল ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছিল। প্রবাল, মাছ আর ভাঙা লোহার কাঠামো পেরিয়ে আমি আবার পৌঁছলাম সেই ঘণ্টার কাছে।

ঘণ্টাটা যেন আজও অপেক্ষায় ছিল। মরচে ধরা শরীর, তবু সমুদ্রের স্রোতে হালকা দুলছে। আমি হাত বাড়িয়ে সেটাকে স্পর্শ করতেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠল অদ্ভুত শীতলতা।

অচানক সমুদ্রের ভেতর আলো ছড়িয়ে পড়ল। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য—শত বন্দি, শৃঙ্খল বাঁধা, চোখে ভয় অথচ ঠোঁটে অদম্য প্রতিজ্ঞা। তারা একসঙ্গে আকাশের দিকে চিৎকার করছে—
“নীলকণ্ঠ!”

তারপর ঢেউ আছড়ে পড়ছে, বন্দিদের চিৎকার ডুবে যাচ্ছে গর্জনের ভেতর, আর জাহাজ সমুদ্রের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।

আমার কানে ভেসে আসছিল ফিসফিসানি—
“আমাদের নাম লিখে রেখো… আমাদের বিস্মৃত কাহিনি যেন হারিয়ে না যায়…”

হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল। আমি শক্ত করে ঘণ্টাটা টেনে ধরলাম। আর মুহূর্তেই মনে হল তার ভেতর থেকে প্রতিধ্বনি উঠছে—কেবল ধাতব শব্দ নয়, যেন শত কণ্ঠ একসঙ্গে মুক্তির ডাক দিচ্ছে।

সায়ন পরে বলেছিল, পানির ওপর উঠে আসার পর আমি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসেছিলাম, চোখ ভেজা, মুখে ফ্যাকাশে এক অদ্ভুত আলো। আমি কেবল ফিসফিস করে বলেছিলাম—
“ওরা কথা বলেছে।”

হোটেলে ফিরে খাতায় লিখলাম—

“SS Neelkanth কোনো অভিশাপ নয়, ওটা ইতিহাসের এক চাপা দেওয়া অধ্যায়। সেই বন্দিদের আত্মা এখনও মুক্তি চায়, আর তাদের মুক্তির একমাত্র পথ হলো লেখা। আমি তাদের গল্প লিখব। আমি সেই ঘণ্টার ডাককে কাগজে তুলে ধরব।”

সেদিন রাতে জানালার বাইরে ঢেউ ভাঙার শব্দ যেন এক অদৃশ্য প্রতিজ্ঞার মতো বাজছিল। মনে হচ্ছিল, সমুদ্র আমাকে আশীর্বাদ করছে—
“তুমি আমাদের কণ্ঠ হয়ে ওঠো।”

WhatsApp-Image-2025-09-01-at-1.53.19-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *