Bangla - প্রেমের গল্প

নীরব চিঠির প্রণয়

Spread the love

অস্মিতা ঘোষ


অধ্যায় : স্মৃতির পুরনো খাতায়

শহরের এক কোণে অর্ধেক ভেঙে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া কোলাহলমুক্ত বাড়িটি ছিল একসময় ‘কলকাতা কলেজ অব আর্টস’-এর পুরনো ভবন। এখন তার গায়ে ধুলো জমে, গায়ে গায়ে শ্যাওলা, আর ভেতরে জমে থাকা স্মৃতি। ঠিক তেমনই একটা সকালের কথা। ডিসেম্বরের মিঠে রোদে কাঠের জানালার ফাঁক গলে আলো পড়ে সাদা পাথরের করিডোরে। আর করিডোর জুড়ে পা ফেলে হাঁটছে এক মধ্যবয়সী পুরুষ – সুদীপ্ত সেন।

সুদীপ্ত এখন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় সিনিয়র কনসালট্যান্ট। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে—চুলে পাক ধরেছে, মুখে পরিণত এক বিষণ্নতার রেখা, কিন্তু চোখদুটি এখনও সেই রকমই স্বপ্নময়। বহুদিন পর ফিরেছে কলেজে—প্রাক্তনী মেলা উপলক্ষে। অথচ এই ফেরাটাও কেমন যেন টানাপড়েনের ছিল। একদিকে স্মৃতি ডাকছিল, অন্যদিকে সেই এক চেনা ভয়, সেই এক পুরনো নাম—নন্দিনী।

“যদি আসে সে…?”
এই প্রশ্নটিই বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাকে।

২০০৩ সালে, এই কলেজেই ছিল তাদের প্রথম দেখা। সেমিনার ঘরে দুজনেই ছিল ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ ক্লাসে। সুদীপ্ত তখন সদ্য সাহিত্যের পাঠ ফেলে ভিজুয়াল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। আর নন্দিনী? সে ছিল যেন রঙের কবি—ক্যানভাসে আঁকত কিন্তু কাব্য করত রঙ দিয়ে।

প্রথম আলাপে নন্দিনী একদিন বলেছিল, “তুই কবি, তোর শব্দে মন ভেজে। আমি চুপচাপ থাকি, ছবি আঁকি। কিন্তু যদি তোকে ভালোবাসি, আমি লিখে ফেলব… একশোটা চিঠি—তোর নামে।”

তারা কেউ কাউকে বলেনি, ‘ভালোবাসি।’
তারা শুধু চিঠি লিখত, কিন্তু কোনো দিন দেয়নি।

পুরনো লাইব্রেরির দোতলার কর্নারে রাখা সাদা রঙের ছোট্ট লকারটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সুদীপ্ত। তখন কলেজে এক গোপন খেলা ছিল—কে কার লকারে চিঠি রেখে যায়, কে পড়ে, কে মুখে না বলেই কথা শেষ করে দেয়।
নন্দিনী তার লকারে কত চিঠি রেখে গেছে কে জানে! আর সেও…

“দাদা, চাবিটা নিন,” পিছন থেকে গার্ড বলল।
সুদীপ্ত লকারের চাবি নিয়ে ধীরে ধীরে খুলে দেখল—ভেতরে এখনও পড়ে আছে হলুদ হয়ে যাওয়া কয়েকটা খাম।
কিছু চিঠি তার লেখা—“To N”—লেখা আছে।
কিছু চিঠিতে শুধু একটা ফুল আঁকা, তলায় লেখা, “তুই বুঝবি…”

হাত কাঁপছে। চিঠির গন্ধে ভেসে আসছে কলেজের সেই পিচঢালা রাস্তা, লাইব্রেরির পিছনের গোধূলি, বৃষ্টির পরের কফির কাপ, আর একটা অপ্রকাশিত প্রেম।

পিছন থেকে একটা মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—“সুদীপ্ত?”

সে ঘুরে দাঁড়ালো।

সময় থেমে গেল যেন।

সামনে দাঁড়িয়ে নীল শাল জড়ানো এক নারী। চুলে ছোঁয়া পাক, মুখে নরম আত্মবিশ্বাসের রেখা, চোখে সেই পুরনো উষ্ণতা।
নন্দিনী।

অনেক বছর কেটে গেছে। অনেক শহর, অনেক জীবন…
তবু তারা যেন এক মুহূর্তে ফিরে গেল সেই দিনে, যেদিন কেউ কিছু বলেনি, শুধু হেসেছিল।
চোখের ভাষায় যা ছিল, তা আজ শব্দে বলার সময় এসেছে।

“তুই এসেছিস?” সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল কাঁপা গলায়।
নন্দিনী হাসল। বলল, “তুই তো বলেছিলি… একটা চিঠি হারালে তুই পুরো প্রেমটা হারিয়ে ফেলিস। তাই এলাম… দেখি এখনও খুঁজিস কিনা।”

দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, লকারে জমে থাকা কাগজের পাতাগুলোর মাঝে, যাদের শব্দ আজও বেঁচে আছে।

বাইরে বিকেলের আলো নামছে। করিডোরের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ছে।

চিঠিগুলো যেন আর নীরব নয়।

 

অধ্যায় : পোস্টমার্ক বিহীন প্রেম

সুদীপ্ত আর নন্দিনী পাশাপাশি বসে আছে পুরনো লাইব্রেরির পেছনের ঘরে, যেখানে কাচভাঙা জানালার পাশে একটুকরো মলিন সোফা এখনও জায়গা নিয়ে আছে। বাইরে পড়ন্ত রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে গাছের পাতাগুলোকে। কলেজ আজও আছে, কিন্তু সময়টা যেন ধরা নেই।

নীরবতা ছিল না, বরং যেন একটা শব্দের অভাব পূরণ হচ্ছিল অজস্র অপ্রকাশিত বাক্যে।
নন্দিনী হাতে তুলে নিল একটা চিঠি। সাদা খাম। উপর লেখা, To N – When it rained that evening

সে আস্তে করে চিঠিটা খুলল। পড়তে পড়তে তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটল।

“তুই লিখেছিলি, ‘যেদিন বৃষ্টি নামল আর আমার পাশে ছাতা ছিল না, তুই কাঁধে হাত রেখেছিলি। তখন আমি ঠিক করেছিলাম, তোর নামে একশোটা চিঠি লিখব।’… জানিস, ঠিক ওইদিন থেকেই আমিও লিখতে শুরু করেছিলাম।” নন্দিনী বলল।

সুদীপ্ত চুপ।

সে জানে, সময় যত এগিয়েছে, তত তারা নিজেদের গভীরতম অনুভবগুলো কেবল কাগজে বন্দি রেখেছিল। কারণ দুজনেই ভয় পেত, মুখে বললে যদি সব হারিয়ে যায়?

“কেন বলিসনি?”
প্রশ্নটা খুব সহজ, কিন্তু উত্তর কঠিন।

সুদীপ্ত বলল, “ভয় পেতাম। তোকে হারানোর চাইতে তোকে চিঠির পাতায় রাখা নিরাপদ মনে হত। বাস্তবে ভালোবাসলে ভেঙে যেতে পারত, কাগজে চিরস্থায়ী থাকত।”

নন্দিনী একবার চোখ বন্ধ করল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাও তুই জানতিস না—আমি একদিন এসেছিলাম তোকে বলতে।
আমার ব্যাগে ছিল সব চিঠি। তোর লকারে রাখার জন্য… কিন্তু সেদিন তুই ছিলি না। আর তারপর আমি কলকাতা ছেড়ে দিলাম।”

সুদীপ্ত অবাক হয়ে তাকাল। “কেন গেলি তুই হঠাৎ?”

নন্দিনীর গলায় কষ্টের ছায়া: “বাড়িতে বিয়ে ঠিক করেছিল। আমি রাজি ছিলাম না। তোর কথা বলিনি কারণ তুই কিছু বলিসনি। তাই ভেবেছিলাম, এই প্রেমটা শুধু আমিই অনুভব করি হয়তো।”

একটা অদৃশ্য দেয়াল যেন আচমকা ভেঙে পড়ল।

চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন সময় রিভাইন্ড হতে লাগল।
তারা দুজনেই জানে—এই মুহূর্ত, এই দুপুর, এই লকারের ধুলো—সবই সাক্ষী এক অসমাপ্ত প্রেমের।

“তোর চিঠিগুলো?”
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল।

নন্দিনী ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে বের করল এক বান্ডিল হলুদ খাম। তাতে তার হাতের লেখা।

“To S.”
“সেই পুজোর রাতের কথা…”
“যখন তুই গান গাইছিলি ছাদের উপর…”

চোখে জল চলে এল সুদীপ্তর।
সে বলল, “আমরা যদি তখন একবার সাহস করে বলতাম… একটা কথা… শুধু একবার…”

নন্দিনী হাত ধরে বলল, “তাহলে হয়তো আজকের এই মুহূর্ত থাকত না। আমরা তখন পেতাম হয়তো সময়কে, কিন্তু চিঠিগুলো হারিয়ে যেত। এখন আমাদের কাছে আছে একশোটা প্রেমের কবিতা… পোস্টমার্ক বিহীন, ঠিকানাবিহীন।”

বাইরে সন্ধে নামছে।
কলেজ চত্বর থেকে ভেসে আসছে সান্ধ্য মেলার সুর।

সুদীপ্ত বলল, “চল, আজ একসাথে এক কাপ কফি খাই। কলেজের পেছনের মোড়ে… যেখানে প্রথমবার তুই আমার কবিতা পড়ে হেসে উঠেছিলি।”

নন্দিনী মৃদু হেসে বলল, “আর আমি বলেছিলাম—এই কবির প্রেমে পড়ব, যদি সে আমায় লিখে দেয় একশোটা চিঠি।”

“তাহলে এখন পড়ে ফেল?”
“না… এখন চিঠিগুলো নয়, আমি তোকে পড়তে চাই… এবার সামনাসামনি।”

তারা হাঁটতে শুরু করল, পাশাপাশি।
পায়ের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলোর মতোই পেছনে রয়ে গেল সময়…
আর সামনে এগিয়ে চলল এক নতুন চিঠি—যেটা তারা দুজনে একসাথে লিখবে।

 

অধ্যায় : ফের দেখা, নতুন চোখে

কলেজের পেছনের গলিটা এখনও অনেকটাই আগের মতোই আছে—একটু ছোপ ছোপ দেয়ালে আগাছার দাগ, রিক্সাওয়ালাদের বিরক্তিকর হর্ন, আর সেই পুরনো টি-স্টলটা—“শ্যামল কাকুর চা ঘর।” যদিও এখন চালায় তার ছেলে, কুশল।

সুদীপ্ত আর নন্দিনী পাশাপাশি বসে, হাতে ধরা দু’কাপ কুলহড়ের চা। এক পাশে রাখা কিছু আধপোড়া বিড়ি, অন্যদিকে একটা রেডিও টেপ—পুরনো গান বাজছে মৃদুস্বরে।

“এখনও গাইতে পারিস?”
নন্দিনী প্রশ্ন করল হঠাৎ।

সুদীপ্ত একটু হাসল, মাথা নাড়ল। “একটা সময় ছিল, গান গাইতাম শুধু তোকে শোনাব বলে। এখন অফিসের মিটিংয়ে প্রেজেন্টেশন দিই, তাতে তাল লাগে না।”

নন্দিনী হেসে ফেলল। “তোর সেই ‘নীল শালুক’ গানটা মনে আছে?”
“মনে থাকবে না?” সুদীপ্ত বলল, “ওই গানটা গেয়েই তো তোর থেকে প্রথম চিঠি পেয়েছিলাম।”

ওরা দুজনেই বোঝে, কথা যত এগোয়, মনে হয় যেন নতুন করে পরিচয় হচ্ছে। সময় বদলেছে, কিন্তু অনুভব? সেটা এখনও প্রগাঢ়।

“তুই তো পেশাদার আর্ট ডিরেক্টর হতে চেয়েছিলি?”
নন্দিনী জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, চেয়েছিলাম। তারপর বাবার অসুস্থতা, সংসারের দায়, বাস্তবতা—সব মিলিয়ে স্বপ্নকে কিছুটা ঘষেমেজে ছোট করে ফেললাম। এখন বিজ্ঞাপন কনসালটেন্সি করি… টাকা আছে, কিন্তু সময় নেই।”
তার স্বরে একধরনের চাপা ক্লান্তি।

নন্দিনী চুপচাপ শুনল। তারপর আস্তে বলল, “আমি বিয়ে করেছিলাম। মুম্বাই চলে গিয়েছিলাম। স্বামী ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার… ভীষণ ভালো মানুষ, কিন্তু প্রেমের ভাষা জানতেন না। সাত বছর পর ডিভোর্স হয়ে গেল। এখন আমি শান্তিনিকেতনে থাকি, পেইন্টিং আর থেরাপির কাজ করি।”

সুদীপ্তর মনে হল, ওর জীবনের ছায়াগুলো যেন আজ এক ঝলক দেখে ফেলল।
তাদের দুজনের জীবনেই ভালোবাসা ছিল, কিন্তু ভাষাহীন।
চিঠিগুলো ছিল, কিন্তু পোস্ট হয়নি।
কথাগুলো ছিল, কিন্তু কেউ বলেনি।

“তুই কি আবার কলকাতায় ফিরবি?”
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল।

নন্দিনী কুলহড়ের শেষ চুমুকটা নিয়ে বলল, “চিন্তা করিনি এখনো। তবে আজকের এই দেখা… জানি না কেন, মনে হচ্ছে কিছু বদলে দিতে পারে।”

একটা অদ্ভুত শূন্যতা নেমে এল তাদের মাঝখানে।
কিন্তু সেটা আর আগের মতো অস্বস্তিকর নয়। বরং, তা যেন এক গভীরতার লক্ষণ।

সুদীপ্ত ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট ডায়েরি বের করল। “তোর জন্য এনেছি,” বলল।

ডায়েরিটার নাম: The Letters We Never Mailed
ভিতরে তার হাতে লেখা কবিতা, কিছু চিঠির কপি, আর মাঝে মাঝে আঁকা কয়েকটা স্কেচ।
“এগুলো তখন লিখেছিলাম যখন তুই চলে গেলি। কখনো ভাবিনি তুই পড়বি।”

নন্দিনী ডায়েরি খুলে চোখ রাখতেই তার দৃষ্টিতে নেমে এল এক ছায়া। “তুই… এত কিছু রেখে দিয়েছিলি?”

“ভেবেছিলাম, একদিন তুই ফিরে আসবি। হয়তো না বলেই, শুধু পড়তে। এবার বলার সময়।”

চোখের কোনে জল চিকচিক করছিল নন্দিনীর, কিন্তু সে চেপে গেল। “তাহলে আমি এবার বলি?”
সে ডায়েরির শেষ পাতায় কলম চালাল—
“Dear S,
এই চিঠিটা প্রথমবার মুখে বলার মতো লিখছি। তুই এখনও সেই সুদীপ্ত, যে এক কাপ চায়ে রং মেশায় প্রেমের ছায়া, আর আমি এখনও সেই নন্দিনী, যে ভালোবাসার রং খুঁজে বেড়াই ক্যানভাসের মাঝে। এবার না হয়… একসঙ্গে আঁকি?”

সুদীপ্ত তাকিয়ে রইল।
চিঠিটা পোস্ট হল না,
কারণ এবার পাঠানো দরকার নেই।

চিঠিটা এবার জীবনের এক অধ্যায়ে লেখা হল—
একটা অধ্যায়, যেটা তারা একসঙ্গে পড়বে।

 

অধ্যায় : চিঠির পাতায় লেখা সন্ধে

সন্ধ্যার আলোর গায়ে সোনালি রঙ লেগেছে। কলেজ প্রাঙ্গণে প্রাক্তনীদের মেলার ব্যানার ফড়ফড় করে উঠছে হালকা বাতাসে। দূরে অস্থায়ী মঞ্চে কেউ গিটার বাজাচ্ছে। গলায় ভেসে আসছে রবীন্দ্রনাথ—“আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদলদিনে…”

আর পুরনো লকার ঘরের নির্জন কোণে, সুদীপ্ত আর নন্দিনী বসে আছে—দুজনে, কাঁথার মতো পুরনো চেনা এক নীরবতার নিচে।
সামনে ছড়িয়ে আছে সেই চিঠিগুলি।
কিছু খাম চিড়েছে, কিছুতে কালির ছাপ ঘোলা হয়ে গেছে, কিন্তু শব্দগুলো এখনও তাজা।

নন্দিনী প্রথম যে চিঠিটা খুলল, তাতে লেখা:

**“৩১শে আগস্ট, ২০০৪
নন্দিনী,
সেদিন তুই বললি, প্রেম মানে আঁকা—তাহলে আমি শব্দের তুলিতে তোকে আঁকতে চাই। তুই হাঁটছিলি করিডোর দিয়ে, আর আমি দূর থেকে লিখে ফেললাম,
‘সে হেঁটে যায় ছায়ার ভিতর দিয়ে, অথচ ছায়াটাও পায় পায়ের শব্দ।’
জানি, এভাবে লেখা কিছুই তোকে দেওয়া হয় না।
তবু রেখে গেলাম এক কপি আমার খাতায়।
– স.”

নন্দিনী একবার চোখ বন্ধ করল। যেন সেই করিডোরের শব্দ এখনো কানে বাজে।

“আমি খেয়াল করতাম,” সে বলল, “তুই কোন দিকে তাকিয়ে কবিতা লেখিস, আর কখন যেন নিজের মধ্যে ঢুকে যাস।”

সুদীপ্ত হাসল।
সে খুলে দেখাল আরেকটা চিঠি—তাতে একটা ছোট্ট রঙিন স্কেচ।
দুটো চেয়ার, এক টুকরো আকাশ, আর একটা কফির কাপ।
নীচে লেখা: তোর পাশে বসা আমার সবচেয়ে নাবলা কবিতা।

“এইটা কবে লিখেছিলি?”
নন্দিনী জিজ্ঞেস করল।

“যেদিন তোকে প্রথম হাত ধরে টানতে ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু করিনি,” সুদীপ্ত বলল।
তার গলায় কোনো নাটকীয়তা নেই—শুধু একটা সৎ স্বীকারোক্তি।

“তুই জানিস, আমি তোকে কখনো ছুঁতেই পারিনি—সেইভাবে। কিন্তু তোর পাশে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হত, ভালোবাসা মানে হয়তো এই, না ছুঁয়ে পাশে থাকা।”

নন্দিনী তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।

তারপর বের করল তার নিজের একটা চিঠি।
তার লেখা চেনা অক্ষরে:

**“১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৫
সুদীপ্ত,
তুই আমার দিকে তাকিয়ে আছিস, আর আমি তোকে দেখছি না এমন ভান করছি। জানি, তুই দেখছিস, আর আমি লুকোচ্ছি। এই লুকোচুরির মধ্যে প্রেমের এত জটিলতা কোথা থেকে আসে?
আমি তোকে চিঠি লিখি, কারণ সামনাসামনি বললে গলা কেঁপে যায়। তুই যদি কখনো আমার চিঠিগুলো পড়ে, জেনে নিস—আমি চেয়েছিলাম তোকে। আজও চাই।
– ন.”

চোখের কোণে জল জমেছিল দুজনেরই।

তারা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।

চিঠিগুলোর পাতার ফাঁকে যেন আবার সময় ঘুরছে।
একেকটা খাম খুললেই খুলে যাচ্ছে একটা নির্দিষ্ট মুহূর্ত—যেখানে ভেজা রাস্তা, হাওয়ায় উড়তে থাকা স্কার্ফ, বা লাইব্রেরির টেবিলে রাখা বাদামী কফির কাপ—সব ফিরিয়ে আনছে।

“তুই জানিস, এই চিঠিগুলো পড়ার সময় আমার মনে হচ্ছে যেন আমরা সময়কে ধরা দিচ্ছি আবার,” সুদীপ্ত বলল।

নন্দিনী বলল, “তুই কি ভাবিস… প্রেম শেষ হয়?
চিঠি পুরনো হয়, ঠিকানা বদলায়, মানুষ বদলে যায়… কিন্তু অনুভব?”

সুদীপ্ত বলল ধীরে, “যদি সেটা সত্যি হয়, তবে তার মেয়াদ থাকে না।”

সেই সন্ধেয় তারা একের পর এক চিঠি খুলল।
হাসল, কাঁদল, স্তব্ধ হয়ে রইল।

আর প্রতিটা চিঠি এক একটি আলাদা চশমার মতো—যা দিয়ে তারা নিজেদেরকেই নতুন চোখে দেখতে শিখল।

চিঠিগুলো কেবল লেখা নয়, চিঠিগুলো ছিল আত্মা।
আর সেই আত্মার গল্প আজ তারা দুজন একসাথে পড়ছে।

 

অধ্যায় : যে চিঠিটা কোনোদিন পাঠানো হয়নি

রাত গড়িয়ে এসেছে। কলেজ চত্বর ধীরে ধীরে নিঃসাড় হয়ে পড়ছে। মেলা প্রায় গুটিয়ে গেছে, কিন্তু সুদীপ্ত আর নন্দিনী এখনো রয়ে গেছে পুরনো লাইব্রেরির ভিতর সেই কাঠের বেঞ্চে, সামনে ছড়িয়ে থাকা চিঠির পাতায়।

চিঠির বান্ডিল প্রায় শেষ। একটার পর একটা তারা খুলে চলেছে, পড়ছে, শোনাচ্ছে একে অপরকে, যেন হারিয়ে যাওয়া এক যুগের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করছে তারা।

সুদীপ্ত খামের নিচে হাত রেখে টান দিতেই একটা ভাঁজ করা চিঠি বেরোল—কোনো খামে নয়, নীলচে পাতায় লেখা, ভাঁজে ভাঁজে কালি ছড়িয়ে যাওয়া। অন্য চিঠিগুলোর মতো পরিষ্কারভাবে তারিখ লেখা নেই। শুধু উপরের কোণে একটি রেখা টানা—তাতে লেখা:
পাঠানোর জন্য নয়

নন্দিনী চুপ করে বসে। তার দৃষ্টিতে একচিলতে অস্বস্তি।
সুদীপ্ত ধীরে ধীরে খুলে চিঠিটা পড়া শুরু করল।

সুদীপ্ত,
এই চিঠিটা পাঠাব না। কারণ পাঠালে সব বদলে যেতে পারে। পাঠালে তুই হয়তো ফিরে তাকাবি, আবার হয়তো সম্পূর্ণ ভুল বুঝবি।
আমি তোর কবিতায় নিজের ছবি দেখি। আমি তোর নাবলা কথায় নিজের ভালোবাসা খুঁজি।
কিন্তু আমি তোকে কখনো দাবি করতে পারি না, কারণ তুই কোনোদিন কিছু বলিসনি।
আমি চলে যাচ্ছি। হ্যাঁ, সত্যিই। আমাকে বিয়ে করতে হবে। না চাইতেই।
আর আমি জানি, তুই যদি আজ কিছু বলিস, আমি থেমে যাব। তাই চিঠিটা শুধু লিখে রাখলাম, যেন তোকে জানাতে পারিআমি তোকে ভালোবেসেছিলাম।
হয়তো আজও বাসি।
নন্দিনী

চিঠির শেষে কালি ফুরিয়ে গিয়েছিল যেন।
শেষ শব্দটা আধো লেখা, একটা অসমাপ্ত ভালোবাসার মত।

ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা।
কোনো শব্দ নেই, শুধু নীলচে পাতার কালি শুকনো।

সুদীপ্ত মাথা নিচু করে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।

তারপর সে বলল, গলায় অস্পষ্টতা নিয়ে—
“এই চিঠিটা যদি তুই পাঠাতে…?”

নন্দিনী আস্তে বলল, “তাহলে আমি হয়তো থেকে যেতাম। হয়তো তুই হাত ধরতিস। হয়তো আমরা এই লাইব্রেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে যেতাম অনেক বছর ধরে। কিন্তু তখন যদি সবকিছু ভেঙে যেত?”

সুদীপ্ত বলল, “ভেঙে যেতেও পারত, গড়ে উঠতেও পারত। কিন্তু আমরা তো কখনো চেষ্টা করিনি।”

চিঠিটা এখন আর নিছক চিঠি নয়। এটা এক অপূর্ণ জীবনের সাক্ষ্য—যেটা সময়ের ভাঁজে জমে ছিল, ধুলোয় ঢাকা ছিল, আর আজ চোখের সামনে খোলা হয়েছে।

নন্দিনী ধীরে চিঠিটা তার দিকে টেনে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরল। তার চোখে জল। বলল, “তুই জানিস, এই চিঠিটা আমায় তোর থেকেও বেশি তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কারণ জানি, তোকে বলিনি বলে শুধু তোকে হারাইনি, নিজেকেও হারিয়েছিলাম।”

সুদীপ্ত হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। বলল, “এখন যদি বলিস, আমি শুনব। এবার আমি পালাব না।”

নন্দিনী তার দিকে তাকাল, চোখে অনেক বছরের কথা জমে উঠেছে। বলল, “তুই কি এখনও ভালোবাসিস আমাকে?”

সুদীপ্ত মৃদু হাসল। “তুই তো জানিস, ভালোবাসা একবারই হয়। আর যদি সত্যি হয়, সেটা কখনো শেষ হয় না।”

রাত বাড়ছে।

আকাশে তারারা ফুটছে, আর নিচে লাইব্রেরির জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছে চিঠির পাতায়।

যে চিঠিটা কোনোদিন পাঠানো হয়নি, সেটা আজ পড়ে নেওয়া হল।
আর সেই না-পাঠানো শব্দগুলোর মধ্যে থেকেই শুরু হতে চলেছে জীবনের নতুন অধ্যায়।

 

অধ্যায় : চিঠির বদলে চোখের ভাষা

রাত তখন একেবারে গভীর। কলেজের মূল ভবনের লাইট নিভে গেছে, কেবল লাইব্রেরির পেছনের ঘরটিতে টিমটিমে আলোয় জ্বলছে একটা টেবিল ল্যাম্প। বাতাসে শীতে মিশে আছে পুরনো বইয়ের গন্ধ আর নীরব চিঠির অভিমান।

নন্দিনী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। দূরের অন্ধকারে কুয়াশা জমে উঠেছে ধীরে ধীরে। নিচের মাঠে কিছু ছায়াময় আলো-আঁধারিতে হারিয়ে যাচ্ছে শব্দহীনতায়।
সুদীপ্ত পেছন থেকে এসে দাঁড়াল তার পাশে।
কিছুক্ষণের জন্য দুজনেই চুপ।

চিঠির এত শব্দ, এত বাক্য, এত ‘না-বলা’—সব মিলিয়ে যেন তারা আর কিছু বলতেই পারছিল না।

হঠাৎ নন্দিনী বলল, “জানিস, ভালোবাসা নিয়ে আমি একটা জিনিস বুঝেছি। আমরা ভাবি—ভালোবাসা মানেই কথা বলা। কিন্তু আসলে, কখনো কখনো, ভালোবাসা চুপ করে থাকা।”

সুদীপ্ত একমত হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “আর সেই চুপ করে থাকাটা এত গভীর হয়, যে শব্দ হয়ে উঠতে চায়—কিন্তু ভয় পায়। যেন শব্দ বললেই সে বাস্তব হয়ে যাবে, আর আমরা আর কল্পনার ভিতর লুকিয়ে থাকতে পারব না।”

নন্দিনী ধীরে ফিরে তাকাল। তার চোখে ছিল সেই পুরনো দৃষ্টিটা, যেটা একসময় লাইব্রেরির সিঁড়ির ধারে বসে থেকেছে, চুপচাপ শুনেছে সুদীপ্তর কবিতা, আর মনে মনে বলেছে—”আমি তোকে ভালোবাসি।”

এই প্রথম, এই মুহূর্তে, মুখে কোনো শব্দ ছিল না, তবু সবকিছু বোঝা যাচ্ছিল।

সুদীপ্ত তার দিকে এগিয়ে এল। খুব ধীরে, যেন শব্দ না হয়।

তারা দাঁড়িয়ে রইল মুখোমুখি।

তাদের মাঝে কেবল চোখের ভাষা।

তাদের চোখে ছিল—

—যে অভিমান বোঝে,
—যে অপেক্ষার কষ্ট বোঝে,
—যে ‘তুই কেন বলিসনি’ আর ‘আমি কেন পালালাম’– এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে।

সুদীপ্ত তার হাতটা বাড়িয়ে নন্দিনীর আঙুল ছুঁয়ে বলল, খুব আস্তে, যেন তার কণ্ঠও শোনে না, কেবল হৃদয় শুনে—

“আমি আজও তোকেই খুঁজি… প্রতিটা শব্দে, প্রতিটা মুখে, প্রতিটা গানের পেছনে… কিন্তু জানি, কেউ তোকে ছুঁতে পারে না।”

নন্দিনীর চোখের কোণে আবার ভিজে উঠল আলো।
সে বলল, “তুই জানিস, আমি তোকে খুঁজতাম বাতাসে… তোর কবিতার গন্ধে… আর প্রতিবারই মনে হত—তুই যদি হঠাৎ চলে এসে বলিস, ‘এই তো আছি…’”

সুদীপ্ত এবার কোনো শব্দ বলল না।
সে কেবল এগিয়ে এসে খুব হালকা করে নন্দিনীর কপালে চুমু খেল—
যেমন কেউ কোনো না-পাঠানো চিঠির মুখবন্ধে সিল মারে।

একটি অজানা শান্তি ভেসে এল ঘরে।

চিঠিগুলোর প্রয়োজন ছিল—কারণ তখন চোখ কিছু বলতে পারত না।
আজ চিঠির বদলে চোখই বলে ফেলল সব।

নন্দিনী বলল, “আমরা এবার কি নতুন করে শুরু করতে পারি?”
সুদীপ্ত জবাব দিল, “হ্যাঁ। তবে এবার শব্দ দিয়ে নয়—প্রতিদিনের নীরবতা দিয়ে। চায়ের কাপ দিয়ে, হাওয়ায় উড়তে থাকা স্কার্ফ দিয়ে, কিংবা একসাথে বসে থাকা নীরব দুপুর দিয়ে।”

তারা একসাথে লাইব্রেরির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল।
পেছনে পড়ে রইল শত শত চিঠি—যা আর দরকার নেই।

সামনে হাঁটছে দুজন মানুষ—যারা একে অপরকে ভালোবেসেছে বহু বছর, বহু বাক্যে, বহু ভয় আর নীরবতার ভিতর দিয়ে।

এবার তারা শুরু করল—চোখের ভাষায় লেখা এক নতুন চিঠি।

 

অধ্যায় : ভোরবেলা একসাথে

রাত পেরিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।
কলকাতার শীতের সকালে রোদের বদলে আগে আসে ধোঁয়াশা।
আকাশ এখন ধূসর, হালকা নীলের ছোঁয়া।

কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সুদীপ্ত আর নন্দিনী।
চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে নীরবতা, যেন গোটা শহর এখনো ঘুমচ্ছে, আর শুধু ওরা দুজন জেগে আছে—নিজেদের জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরুর সাক্ষী হয়ে।

সুদীপ্তর গায়ে একখানা মোটা সোয়েটার, চোখে ক্লান্তি থাকলেও মুখে প্রশান্তি।
নন্দিনী ওড়না জড়িয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে গরম কফির কাচের কাপ।
তারা কেউ তাড়া করছে না। কেউ ফোনে তাকাচ্ছে না।
সময় যেন হিম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে।

“ভোর দেখিস অনেকদিন পর,” সুদীপ্ত বলল হেসে।

“ভোর মানেই তো নতুন দিনের সম্ভাবনা,” নন্দিনী মৃদুস্বরে বলল, “আর আজকের ভোরটা মনে হচ্ছে ঠিক আমাদের জন্যই এসেছে।”

রাস্তায় তখন ধীরে ধীরে দোকান খোলা শুরু হয়েছে। এক কোণে শোনাচ্ছে রেডিওতে পুরনো গান—
আহা, আজি এই বসন্তে…”

সুদীপ্ত হঠাৎ বলল, “তুই জানিস, আমি একটা চিঠি আজও লিখিনি।”

নন্দিনী অবাক, “তুই? না-লিখে থাকা মানে কী?”

“হ্যাঁ,” সুদীপ্ত হেসে বলল, “আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটা এখনও লেখা হয়নি—যেটা আমি লিখতে চাই আজ, তোকে নিয়ে, তোকে পাশে রেখে।”

নন্দিনী বলল, “তবে লিখ এবার।
কিন্তু মনে রাখিস, এবার চিঠিটা পোস্ট করতেই হবে।”

ওরা হাঁটতে শুরু করল, ধীরে ধীরে, পাশের ছোট্ট বেকারির দিকে।
সেখানে আগে কলেজ পড়াকালীন তারা যেত। এখনো সেই টিনের চাল, সেই কাঠের বেঞ্চ, শুধু মালিকের বয়স বেড়েছে।

তারা দু’কাপ হট চকোলেট নিল—ঠিক যেমনটা নন্দিনী খেত বরাবর।

“তুই কি ভাবিস, আমাদের এই বয়সে, এতকিছুর পর… সত্যিই শুরু করা যায়?”
নন্দিনী একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল।

সুদীপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভালোবাসা বয়স দেখে না, নন্দিনী।
এটা চিঠির মতো—যে কোনো সময় লেখা যায়, যে কোনো খামে ভরা যায়…
আর যদি সত্যিই মনের ঠিকানায় পাঠাই, সেটা একদিন পৌঁছবেই।”

তাদের কথার মাঝে বেকারির জানালার বাইরে ধরা পড়ল সূর্যের প্রথম আলোর রেখা।

হঠাৎ করে যেন সব কিছু আলোকিত হয়ে উঠল।
নন্দিনী সেই আলোতে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল, “তুই জানিস, আমার ছবির প্রথম আলোটা সবসময় নীল হয়। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে—এই প্রথম আলোটা গোলাপি।”

সুদীপ্ত হেসে বলল, “তাহলে তোর নতুন ছবির প্রথম রঙ আমিই হবো?”

নন্দিনী চুপ করে রইল। তারপর ধীরে মাথা নাড়ল।

“চল,” সে বলল, “আজ আমরা আর কোনো চিঠি নয়—একটা গল্প শুরু করি।
সেই গল্পে আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে লিখব—সাথে থেকে।
তুই কবিতা লিখবি, আমি ছবি আঁকব… আর বাকি গল্পটা চলবে আমাদের চোখের ভাষায়।”

পাশের টেবিলে রাখা ছিল একটা ছোট্ট ন্যাপকিন।

সুদীপ্ত সেই ন্যাপকিনে কলম দিয়ে এক লাইন লিখল:

“To N—This time, I won’t let you go.”

আর নন্দিনী পাশে লিখল:

“To S—This time, I’m staying.”

ভোরবেলার আলোয় চিঠি আর দরকার নেই।

কারণ তারা এবার একে অপরকে ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছে।

 

অধ্যায় : যেখানে চিঠি শেষ, সেখানেই শুরু

কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে আসার পর দুইজনের জীবন হঠাৎ যেন নতুন ছন্দে বাঁধা পড়ল।
তারা আর প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, বরং চিঠির ভাষা থেকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানো দুই পূর্ণবয়স্ক মানুষ, যাদের পেছনে ছিল জীবন, সামনে আছে প্রশ্ন।

নন্দিনী ফিরে গেল শান্তিনিকেতনে। তার নিজের ছোট্ট একটি থেরাপি স্টুডিও আছে, যেখানে সে শিশুদের আর্ট থেরাপি শেখায়, বিকেলে নিজে আঁকে।
সুদীপ্ত ফিরল তার কলকাতার বাড়িতে—বেশ সাজানো সংসার, ছেলে অয়ন, আর দূরে দূরে থাকা স্ত্রী শ্রেয়া, যার সঙ্গে সম্পর্কটা কেবল দায়িত্বের দড়িতে টিকে আছে।

প্রথম সপ্তাহে তারা দিনে দুবার কথা বলত—সকালবেলা নন্দিনীর বেলুন আঁকা মেসেজ, আর রাতে সুদীপ্তর কবিতার এক লাইনের ভেসে আসা ছবি।

কিন্তু সময়টা বড় অদ্ভুত।
কখনো সে তোমার পাশে এসে দাঁড়ায়, আবার হঠাৎ প্রশ্ন তোলে।

একদিন শ্রেয়া আচমকা বলল, “তোমার চোখের ভাষা পাল্টে গেছে, সুদীপ্ত।
তুমি আবার কবিতা লিখছ?
না কি কারও জন্য লিখছ?”

সুদীপ্ত চুপ করে ছিল।
সে শ্রেয়াকে কোনোদিন ঠকায়নি। শুধু ভালোবাসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, কখন সেটা নিজেও জানে না।

অন্যদিকে, শান্তিনিকেতনে নন্দিনীর পাশের বাড়ির মাসিমা হঠাৎ বলে ফেললেন, “এই বয়সে আবার চিঠিপত্র? বিয়ে হয়নি বুঝলাম, তাই বলে এখন আবার প্রেম?”

নন্দিনী প্রথমে রেগে গিয়েছিল।
তারপর নিজেকেই জিজ্ঞেস করেছিল, “আমি কি প্রেম করছি, না কি নিজেকে ফিরে পাচ্ছি?”

একদিন রাতে, ভিডিও কলে, নন্দিনী বলল, “আমরা আবার কি ভুল করছি, সুদীপ্ত?”

সুদীপ্ত তাকিয়ে বলল, “না। এবার আমরা সত্যি করছি। শুধু বুঝে নিচ্ছি, ভালোবাসা মানে কেবল চিঠি নয়—মানে বোঝাপড়া, লড়াই, স্বপ্ন, আর নিজেকে গ্রহণ করা।”

নন্দিনী বলল, “তোর ছেলে জানে?”

“না, এখনও না। কিন্তু জানবি তো, অয়ন আমার মতো নয়। ওর চোখে বিচার কম, কৌতূহল বেশি। আমি ঠিক বলে দেব একদিন।”

“আর শ্রেয়া?”
এই প্রশ্নটা যেন বাতাসে থমকে থাকল।

সুদীপ্ত ধীরে বলল, “শ্রেয়া জানে আমরা একে অপরকে ছুঁতে পারি না আর।
সে নিজে থেকেও নেই অনেকদিন।
তবে হ্যাঁ, আমাদের বিয়েটা একটা ছায়া। সেই ছায়া পেরিয়ে আসা সহজ নয়।”

নন্দিনী বলল, “তাহলে চল…
তুই যদি সাহস করিস, আমিও করব।
আমাদের চিঠিগুলো এবার জীবনের পাশে রাখি—not for nostalgia, but for now.”

তাদের কথোপকথনে একধরনের পরিণত ভালোবাসা ফুটে উঠল—যেখানে না-পাওয়া, দায়বদ্ধতা আর আত্মা খুঁড়ে নেওয়ার কষ্টও আছে, কিন্তু সঙ্গে আছে একসাথে হেঁটে চলার ইচ্ছেও।

সেই রাতে তারা দুজনেই একটা চিঠি লিখল—একসঙ্গে, গুগল ডকে।
তার নাম দিল:

“Chapter One: Where We Begin”

এই গল্পের আগেও অনেক গল্প ছিল।
কিন্তু এখন যে চিঠিটা আমরা লিখছি,
সেটা জীবনের জন্য।
এখন থেকে আমরা বলব।
এবার আর খামে ভরে রেখে দেব না।

– S & N

 

অধ্যায় : ভবিষ্যতের ঠিকানায়

বসন্ত এসে গেছে।
শহরের রাস্তায় কাশফুলের মতো গন্ধ ছড়াচ্ছে পলাশ, আর বাতাসে একটা নরম উষ্ণতা—যা মনে করায় নতুন শুরুর ইঙ্গিত।

সুদীপ্ত তার ল্যাপটপে বসে কবিতার লাইন সাজাচ্ছিল। এখন সে আর শুধুই অফিসের কনসালট্যান্ট নয়, সপ্তাহে দুদিন সে অনলাইনে “Creative Expressions” নামে একটা ছোট্ট ক্লাস নেয়। নিজের কবিতাগুলো পড়ে শোনায়, আর শোনে অনাগত কবিদের কাঁচা কথাগুলো।

আর নন্দিনী? সে শান্তিনিকেতনে তার স্টুডিওর নাম দিয়েছে “Chithi”—the Art of Feeling”
দেয়ালে দেয়ালে তারা লাগিয়েছে কিছু পুরনো চিঠির ফ্রেম—কিছুটা তাদের স্মৃতি, কিছুটা থেরাপি।
প্রতি মাসে একদিন, সেখানে একটা “Open Letter Session” হয়—যেখানে মানুষরা সেই চিঠি পড়ে শোনায় যা তারা কাউকে কখনো পাঠাতে পারেনি।

এভাবেই তারা দুজন মুছে দিচ্ছে লুকোনো ভালোবাসার লজ্জা।

একদিন সন্ধ্যাবেলা, ভিডিও কলে, সুদীপ্ত বলল—
“তুই জানিস, আমি ভাবছি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আসব তোদের ওখানে। অয়নকে নিয়েই। ওর একটা প্রজেক্ট আছে—‘Urban Life Through Rural Lens’। ওর ছবির জন্য শান্তিনিকেতনের আলো দরকার।”

নন্দিনী চমকে বলল, “তুই ওকে সব বলেছিস?”

সুদীপ্ত মাথা নাড়ল।
“বলেছি। প্রথমে থমকে গিয়েছিল, তারপর বলল,
‘তোমরা দুজন যদি একে অপরকে এখনো ভালোবাসো, তবে সেটা ভুল হতে পারে না।
শুধু দেরি হয়ে গেছে—তাই রাগ করেছি।’”

নন্দিনীর গলায় কাঁপুনি এল।
সে বলল, “একটা সময় ছিল যখন আমরা নিজেদের জন্য ভালোবাসতাম। এখন যেন আমরা সময়কে ভালোবাসি। ওই সময়টাকেই আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই।”

“আর এখন,” সুদীপ্ত বলল, “আমি চাই, আমরা ভবিষ্যতের ঠিকানায় লিখি—একটা নতুন চিঠি, যেটা কেউ পড়বে না, শুধু আমরা বাঁচব।”

পরের সপ্তাহেই তারা দেখা করল।
নন্দিনীর স্টুডিওর বাইরে বসে সন্ধের আলোয় তারা প্ল্যান করল—

  • শান্তিনিকেতনের পাশে একটা ছোট্ট বাড়ি নেবে তারা—যেখানে দুটো ঘর, একটা পাখির বাসা, আর একটা বারান্দা থাকবে।
    ● তারা একসঙ্গে একটি বই লিখবে—নামের প্রস্তাব দিল সুদীপ্ত: “Where the Letters Slept”
    ● মাসে একদিন তারা সেই সব মানুষকে আমন্ত্রণ জানাবে, যারা তাদের জীবনের কোনো না-পাঠানো চিঠি নিয়ে আসে। তারা শুনবে, বুঝবে, পাশে বসবে।

এবার আর ভালোবাসাটা কেবল নিজেদের মধ্যে আটকে নেই—এবার তা ছড়িয়ে দিতে চায় অন্যদের মধ্যে, যারা হয়তো এখনো সাহস করে বলতে পারে না।

সেই রাতে তারা একসাথে শেষবারের মতো সেই পুরনো চিঠিগুলোর বান্ডিল খুলল।
সুদীপ্ত বলল, “আমরা এবার এগুলোকে মাটিতে পুঁতে দেব। ঠিক আমাদের বাড়ির উঠোনে।”

নন্দিনী বলল, “তাই করব।
কারণ চিঠি যেমন বীজ, তেমনি তার শব্দগুলো মাটি চায়।
তবে এবার আমরা পড়ব না—তারা গাছ হয়ে উঠবে।”

তারা একসাথে সেই চিঠিগুলোকে বাঁধল, আর এক ঝড়ভেজা রাতে মাটির নিচে পুঁতে দিল।
উপরে বুনল একগুচ্ছ বেলি ফুলের চারা।

চিঠির কালি মিশে যাবে মাটিতে।
তাদের ভালোবাসা গন্ধ হয়ে ফুটবে।

এটাই তাদের ভবিষ্যতের ঠিকানা।

 

অধ্যায় ১০: শেষ চিঠি, শুরু প্রেম

শান্তিনিকেতনের আকাশে গোধূলির রং।
কাঁচা রাস্তার ধারে বসে থাকা একটা ছোট্ট কাঠের বাড়ির উঠোনে বেলি ফুলের গাছ মাথা দুলিয়ে যেন বাতাসকে বলে—এখানে চিঠি পোঁতা আছে, শব্দের বীজ, প্রেমের মূল।

সেই বাড়ির বারান্দায় বসে আছে দুজন—সুদীপ্ত আর নন্দিনী।
চা আর পাঁউরুটি, পায়ের নিচে একজোড়া বেড়ালের কৌতূহলী চোখ, আর সামনে ধূসর হয়ে আসা দিগন্ত।

সুদীপ্ত আজ একটা নতুন খাতা খুলেছে।
তাতে লেখা থাকবে শেষ চিঠিটা—যেটা কেউ কাউকে পাঠাবে না।
কারণ এবার আর পাঠানো দরকার নেই।
এটা শুধু লেখা হবে, তাদের দুজনের মধ্যে জীবন্ত থেকে যাবে।

সে লিখতে শুরু করল—

**“প্রিয় নন্দিনী,
আজ লিখছি শেষ চিঠিটা।
শেষ বলছি, কারণ এরপর আমি তোকে আর লিখে কিছু বলতে চাই না—
এবার শুধু বাঁচতে চাই তোকে নিয়ে।

তুই হয়তো বলবি, জীবন তো এত সহজ নয়।
ঠিক, কিন্তু তুই যদি পাশে থাকিস, তবে জটিলতাও কবিতা হয়ে যায়।

আজ আর তোকে ‘ভালোবাসি’ বলছি না।
বরং বলছি, আজ থেকে আমি ভালোবাসবো—প্রতিদিন।
সকালে তোকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে,
দুপুরে তোর প্যালেটের রঙে চোখ রেখে,
রাতে তোকে ছুঁয়ে নয়, পাশে থেকে।

এই চিঠি কোনো ক্যানভাসে টাঙাবো না।
এটা গলিতে হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রেমপত্র নয়।
এটা আমাদের জীবনের দৈনিক—
প্রতিদিনের বেঁচে থাকার গল্প।”*

লেখা শেষ করে সুদীপ্ত খাতাটা বন্ধ করল।
নন্দিনী পাশে বসে চুপচাপ দেখছিল। তারপর ধীরে বলল—

“তুই জানিস, তোকে নিয়ে আমি একটা নতুন ছবি আঁকছি।”

“আমাকে নিয়ে?”
সুদীপ্ত হেসে প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ। ছবিটার নাম রেখেছি—‘Unposted’.
ছবিতে তুই নেই।
আছে কেবল একটা বারান্দা, একটা খোলা খাতা, আর একটা সাদা খাম—খোলা মুখে।
মানে, চিঠি শেষ নয়। এখনো সে লিখছে।”

সুদীপ্ত তার হাত ধরল।
এবার আর কোনো ভয় নেই।
না হারানোর, না বলার, না সাহসের।

আকাশে তখন প্রথম তারা জ্বলছে।
তাদের চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই তারা, সেই আলোকরেখা—যা কখনো একা আসে না।

বারান্দার কোণায় রাখা সেই পুরনো টাইপরাইটার, যেটা দিয়ে একসময় সুদীপ্ত কবিতা টাইপ করত, আজও ঠিকঠাক কাজ করে।

নন্দিনী আস্তে গিয়ে বসে, আর টাইপ করতে শুরু করে—

“This is not the end of a story.
This is where we live it.”

তারা জানে, কোনো প্রেম সত্যিকারের শেষ হয় না।
চিঠির মতো, সে ঘুরে ঘুরে আবার ফিরে আসে,
আবার লেখা হয়।

আর একদিন, হয়তো বহু বছর পর,
কেউ হঠাৎ খুলে ফেলবে সেই টাইপরাইটারটা,
পাবে কাগজে লেখা—

যেখানেই থেমে গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই তো প্রেম শুরু হয়েছিল।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-21-at-3.57.53-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *