Bangla - ভূতের গল্প

নিসর্গপুরের নীলকণ্ঠ

Spread the love

নির্মাল্য সেনগুপ্ত


এক
পাথুরে পাহাড়, দূরের শাল-পলাশের বন আর উষার কুয়াশায় মোড়ানো পথ ধরে যখন অভিজিৎ আর রোহনের জিপটা ঢুকছিল পুরুলিয়ার নিসর্গপুরে, তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর প্রায়। ঝিরঝিরে হাওয়ায় পাতা কাঁপছিল, গাছের ছায়া রাস্তার উপর ভেসে বেড়াচ্ছিল নিরবে। অভিজিৎ জানালা দিয়ে মাথা বের করে ভিডিও করছিল, ক্যামেরার সামনে হাসি ঝলমল করে বলছিল, “ওয়েলকাম টু দ্য আনচার্টেড, বন্ধুরা! আজ আমরা এসেছি পশ্চিমবঙ্গের এক রহস্যময় গ্রামে, যার নাম নিসর্গপুর। এখানে প্রতি পূর্ণিমায় পাহাড় থেকে শোনা যায় রুদ্রতাণ্ডবের ধ্বনি, আর বলে হয়, শত বছর আগে এখানে এক নীলকণ্ঠ সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন… কেউ তাঁর ধ্যানভঙ্গ করলে আর ফিরতে পারে না। সত্যি? না গুজব? চলুন, খুঁজে দেখি!” রোহন পাশে বসে হেসে বলল, “আর যদি সত্যি হয়? তাহলে আমরা ভিডিওটা আপলোড করব কে?” অভিজিৎ ঠাট্টা করে বলল, “গল্পটা তো ভাইরাল হবে!” তাদের গন্তব্য ছিল গ্রামের একমাত্র পুরনো বিশ্রামঘর, যেটা নাকি ব্রিটিশ আমলের, এখন ভগ্ন দশায় দাঁড়িয়ে, তবে গ্রামের পঞ্চায়েত তা ঘুরতে আসা পর্যটকদের থাকার জন্য চালু রেখেছে। জায়গাটার চারপাশে পাহাড় বেষ্টিত, যেন এক অলিখিত ক্যানভাসে আঁকা প্রকৃতির নিঃশব্দ চিত্র। চারদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যায় পাখির ডাক বা শুকনো পাতার উপর পায়ের শব্দ।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে নিসর্গপুরে যেন একটু বেশিই তাড়াতাড়ি। পশ্চিমের আকাশ রক্তিম হতে না হতেই ঠান্ডা বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে অভিজিৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, ক্যামেরায় সূর্যাস্ত ধরতে চেয়েছিল। তখনই প্রথম দেখা নন্দিনীর সঙ্গে—সাদামাটা শাড়ি পরা, হাতে বই, চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। সে নিজে এসে পরিচয় দিল, “আমি নন্দিনী পাল। এই গ্রামের স্কুলে পড়াই। শুনেছি, আপনারা ভিডিও করতে এসেছেন পাহাড়ে?” অভিজিৎ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ, পুরোনো লোককথা নিয়ে ভিডিও করি। শুনেছি এখানে একটা নীলকণ্ঠ সন্ন্যাসীর কাহিনি আছে।” নন্দিনী তার গলা নিচু করে বলল, “কাহিনি নয়, ইতিহাস। আর ইতিহাসের মধ্যে যা থেকে যায়, তার সবটা সব সময় বোঝা যায় না। আপনি পাহাড়ে যেতে চাইছেন পূর্ণিমার রাতে? সাবধানে যান। এখানে প্রকৃতি নীরব, কিন্তু সে দেখেও সব মনে রাখে।” রোহন পিছন থেকে হেসে বলল, “আপনি কি বলছেন, প্রকৃতি আমাদের ভয় দেখাবে?” নন্দিনী মৃদু হাসল, কিন্তু চোখে ছিল গভীর সতর্কবার্তা। এরপর নন্দিনী সরে গেল, আর অভিজিৎ ও রোহন ঘরে ফিরে ভিডিওর স্ক্রিপ্ট সাজাতে লাগল। অভিজিৎ যতই যুক্তিবাদী হোক, তার ভেতরে এক চাপা শিহরণ কাজ করছিল—এই গ্রামের গভীর নির্জনতা, গ্রামের মানুষের চোখে চাপা আতঙ্ক, আর পাহাড়ের দিকে তাকালেই যেন কেমন এক অজানা স্রোত বুকের ভিতর দুলে উঠছিল।
রাত বাড়তেই অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা গ্রামটাকে ঘিরে ধরল। চাঁদের আলোয় পাহাড় যেন দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল নীরব দেবতা হয়ে, যার অস্তিত্ব শুধু অনুভব করা যায়, বোঝা যায় না। অভিজিৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে তার সাবস্ক্রাইবারদের লাইভ জানাচ্ছিল, “এই সেই নিসর্গপুর। পাহাড়টা এখনো নিঃশব্দ। কাল পূর্ণিমা, আমরা উঠে যাব ওপরে। আপনি কি বিশ্বাস করেন, শত বছর ধরে ধ্যানমগ্ন কেউ এখনো সেখানে আছেন? আপনারা কমেন্টে জানান…” ঠিক সেই সময় হালকা একটা শব্দ আসে দূর থেকে—একবার, তারপর নিঃশব্দ। অভিজিৎ ক্যামেরা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে, আবার সেই শব্দ—কোনো তাল নয়, কিন্তু ছন্দ আছে, যেন দূর থেকে কেউ মৃদু তাণ্ডব তালে মাটিতে পা ফেলছে। রোহন জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে, “কিরে? তোরা কিছু শুনলি?” অভিজিৎ মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, একটা তালমতো শব্দ… যেন পায়ের আওয়াজ।” তারা দু’জন একসঙ্গে চুপ করে থাকল মিনিট দশেক, কিন্তু আর কোনো শব্দ এল না। হঠাৎ বাতাস জোরে বইতে লাগল, যেন পাহাড় থেকে কিছু ছুটে আসছে নীচের দিকে। গাছের ডালপালা একটানা নড়ে উঠল, আর বিশ্রামঘরের বাইরের বাতিটা এক মুহূর্তের জন্য নিভে গেল। অভিজিৎ বলল, “কাল রাতে কিছু একটা হবে। আমি সেটা ক্যামেরায় ধরব। যতই ভয়ঙ্কর হোক—সত্যি জানতেই হবে।” আর নিসর্গপুরের নিশ্বাস যেন আটকে রইল—পূর্ণিমার আগের রাতে, পাহাড়ের চূড়ায় এক অজানা চোখের দৃষ্টি যেন অপেক্ষা করছিল পরের দর্শনার্থীর জন্য।
দুই
পরদিন সকালটাও ছিল যেন পাহাড়ের নিঃশ্বাসে মোড়া—ঠান্ডা হাওয়া, মেঘে ঢাকা সূর্য, আর দূরের কোকিলের ডাক। অভিজিৎ উঠে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা আর গিম্বল বের করল, রোহন তখনও ঘুমচোখে বিছানায় পড়ে। বাইরে বেরিয়ে সে দেখে, নন্দিনী আগেই উপস্থিত—হাতে এক পুরনো বই আর মাটির কাপের চা। সে হাসিমুখে বলে, “ভ্রমণকারীরা আজ দেরি করছে দেখি!” অভিজিৎ হেসে উত্তর দেয়, “আমার তো ঘুম উড়ে গেছে কাল রাতের সেই আওয়াজ শুনে। আপনি কি জানেন, সেটা কী ছিল?” নন্দিনী তার বইয়ের পাতা ওল্টায়, “শব্দ অনেক রকমের হয়। মানুষ সব আওয়াজের মানে জানে না। কিন্তু নিসর্গপুরে প্রতিটি আওয়াজের একটা অতীত আছে।” অভিজিৎ ক্যামেরা অন করে বলে, “আপনি আমার ভিডিওতে বলতে চান কিছু? ইতিহাসের ব্যাখ্যা যিনি দিতে পারেন, সেই কণ্ঠটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।” কিন্তু নন্দিনী ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে, “সব কথা সবাই শোনার জন্য নয়। কিছু কথা শুধু উপলব্ধির জন্য।” সে বই খুলে এক পাতায় ছবি দেখায়—এক ধ্যানস্থ সন্ন্যাসী, যার কণ্ঠে গভীর নীল রেখা, কপালে ভস্ম আর চোখ বন্ধ। “এই প্রতিকৃতি এই গ্রামের স্কুল লাইব্রেরিতে আছে ১৯১১ সাল থেকে। বলে হয়, তিনি এক সিদ্ধপুরুষ ছিলেন, পাহাড়ে ধ্যান করতেন। কেউ তাঁকে বিরক্ত করলে আর জীবিত ফিরতো না।” অভিজিৎ গম্ভীর হয়। শীতল বাতাস যেন ঘাড়ে হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল—“জেনে ফেললে ফিরতে পারবে তো?”
দুপুরে তারা হাঁটতে বের হয় গ্রামের শেষপ্রান্তের দিকে। এখানেই উঠে গেছে পাহাড়ের টানানো পথ। জায়গাটা জনমানবহীন, শুধু মাঝে মাঝে শুকনো পাতায় ঘোড়া কিংবা গরুর পায়ের ছাপ দেখা যায়। অভিজিৎ ক্যামেরা হাতে রাস্তার প্রতিটি বাঁক ধরে ধরে ফুটেজ নিচ্ছিল, আর রোহন ড্রোন ওড়ানোর চেষ্টা করছিল। হঠাৎ ড্রোনের ক্যামেরায় ধরা পড়ে—দূরের পাহাড়চূড়ার গায়ে একটা ঝলমলে নীল আলো! ঠিক যেন কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে আলো ছুঁড়ছে, আবার হঠাৎ মিলিয়ে যাচ্ছে। তারা দু’জনে থমকে যায়, ড্রোনের স্ক্রিন জুম করে দেখে—কোনো মানবসদৃশ ছায়া, ধোঁয়ার মতো আবছা, কিন্তু পরিষ্কার একটা নীল কণ্ঠের আভা। রোহন বলে, “ভাই, এটা কেউ ডিভাইস দিয়ে করতেছে না তো?” অভিজিৎ কাঁধ ঝাঁকায়, “এমন টেকনোলজি এখানে থাকবে? ওই পাহাড়ে তো লোকও থাকে না।” নন্দিনী ততক্ষণে এসে পড়েছে। সে ড্রোনের স্ক্রিন দেখে চোখ সরিয়ে নেয়, গলায় একটা অদ্ভুত কাঁপুনি নিয়ে বলে, “তোমরা যা দেখছ, ওটা তাঁর উপস্থিতির ইঙ্গিত মাত্র। পূর্ণিমার আগের দিন যদি তিনি দেখা দেন, মানে কিছু ঘটতে চলেছে।” রোহন ফিসফিস করে বলে, “ভাই, চল ঘরে ফিরি।” কিন্তু অভিজিৎ এখন আরও বেশি উত্তেজিত—“এইটাই তো প্রমাণ! আমি কাল রাতে ওখানে যাব, একা হলেও।”
সন্ধ্যার সময় হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে আসে। বিশ্রামঘরের ছাদের টিন যেন কাঁপতে শুরু করে। নীচে একটা ছায়া সরে যেতে দেখা যায় জানালার ধারে। অভিজিৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায়—দূরে পাহাড়ের গায়ে হালকা নীল আলোর রেখা। ঠিক তখনই নন্দিনী এসে দাঁড়ায় তার পাশে। সে বলে, “তুমি বুঝছো না, অভিজিৎ। ওরা কারা জানো না, ওঁরা কী চায় জানো না, শুধু ক্যামেরা আর ক্লিক দিয়ে এই সব ধরা যায় না। ওঁরা আমাদের মতো নয়।” অভিজিৎ গলার স্বরে জেদ এনে বলে, “তাই তো জানতে চাইছি। যদি সত্যিই কোনো অলৌকিক শক্তি থাকে, তবে প্রমাণ থাক। ক্যামেরা সত্য লুকোয় না।” নন্দিনী চোখ বন্ধ করে বলে, “কিছু সত্য এত পুরোনো হয় যে তাকে ধরা মানেই তাকে জাগানো। ও ঘুমাচ্ছে, কিন্তু ঘুমটা ভারী। জাগিয়ে ফেললে শুধু তুমি নয়, গোটা নিসর্গপুর শূন্য হয়ে যাবে।” হঠাৎ হাওয়ার গতি বেড়ে যায়, বিশ্রামঘরের পাশে রাখা একটা খালি বালতিও গড়িয়ে পড়ে। অভিজিৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে—তার ভেতরে যেন দুই সত্তা যুদ্ধ করছে, যুক্তির কণ্ঠ বলে ‘এটা মিথ’, আর হৃদয় বলে ‘তুমি যে দাঁড়িয়ে আছ, সেটা কি শুধু কল্পনা?’ এবং দূরের পাহাড়, রাতের অন্ধকার আর সেই নীল আভা যেন একটা অনন্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তার দিকে—“তুমি সত্যিই জানতে চাও, আমি কে?”
তিন
পরদিন সকালে গ্রামের ভেতরের পুরোনো পুকুরের ধারে বসে থাকা এক বৃদ্ধার কাছে অভিজিৎ ও রোহন পৌঁছায়—তার নাম রাধারাণী, বয়স পঁচাশি পেরিয়েছে। সাদা ধুতি-শাড়ি পরা, কপালে ভস্ম, মুখে গাঢ় বলিরেখা, কিন্তু চোখে ছিল এমন এক দীপ্তি, যা কেবল বহু অভিজ্ঞতা আর না-বলা গল্প ধারণ করতে পারে। নন্দিনী সঙ্গে ছিল। সে ফিসফিস করে বলে, “রাধারাণী দিদিমা এই গ্রামের সবচেয়ে পুরনো মানুষ। অনেকেই বলে, উনি একসময় সন্ন্যাসীর সেবিকা ছিলেন।” অভিজিৎ সম্মান জানিয়ে বসে পড়ে। ক্যামেরা বন্ধ, গলা নরম। সে বলে, “দিদিমা, আমি শুনেছি এখানে এক নীলকণ্ঠ সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন ছিলেন পাহাড়ের চূড়ায়। আপনি কি জানেন সেই গল্প?” বৃদ্ধা মুখ না তুলে বলে, “গল্প নয়, ও আমার দেখা… আমি ছিলাম তখন মেঘমালা… আমার বয়স ছিল চোদ্দ। আমার বাবা ছিলেন গুহার নীচে থাকা আশ্রমের রক্ষক। প্রতি পূর্ণিমায় তিনি পাহাড়ে উঠতেন ঘি, দুধ আর বেলপাতা নিয়ে।” হঠাৎ তার চোখ কাঁপে, ঠোঁট নড়ে ওঠে, “সেই রাতে প্রথমবার আমি দেখেছিলাম—তাঁকে। বসে আছেন ত্রিশূল হাতে, চোখ বন্ধ, গলা নীলাভ… যেন আগুন জ্বলছে কণ্ঠের ভিতর।”
তার চোখ দুটো তখনও যেন ফিরে গেছে সেই রাতে। “আমার বাবা বলতেন, ওনার ধ্যান চলছে ত্রিকাল ধরে। কেউ স্পর্শ করলে তা হবে পাপ, মহাপাপ। কিন্তু গ্রামের এক জমিদারপুত্র সেই রাতে সাহস করে গিয়েছিল ধূপ জ্বালাতে, গাঁজা খেতে খেতে হাসছিল, বলেছিল ‘ধ্যান করতে এসেছ নাকি ভূত দেখাতে?’ আমরা পাহাড়ের নিচে তখন দেখেছিলাম আলো… প্রথমে নীল, তারপর লাল, তারপর কালো। ঝড় উঠেছিল এমন যে আমাদের আশ্রমের চাল উড়ে গেছিল। সকালে আমরা শুধু পাই এক টুকরো জামা, আর পাহাড়ের পাথরে আঁকা হয়ে গিয়েছিল এক অদ্ভুত মুখ—যেন সে ভয় আর বিস্ময়ে চিরতরে বন্দী।” রাধারাণী থেমে যায়। বাতাস কেমন ভারী হয়ে পড়ে, যেন শব্দগুলো নিজের ভারেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। রোহন ফিসফিস করে বলে, “আপনি বলছেন, মানুষ পাথরে পরিণত হয়েছিল?” বৃদ্ধা মাথা নাড়েন, “মানুষ নয়, অহংকার।”
নন্দিনী ধীরে অভিজিৎ-এর দিকে তাকিয়ে বলে, “এই গল্প কেউ ক্যামেরায় ধরতে পারবে না। এটা শুধু শোনার জন্য, উপলব্ধির জন্য।” কিন্তু অভিজিৎ ঠিক করে ফেলেছে—সে পাহাড়ে উঠবেই, এবং সত্যটা ক্যামেরায় ধরবেই। দুপুরে তারা বিশ্রামঘরে ফিরে এসে ড্রোন ফুটেজ আবার রিভিউ করে—একটা মূহুর্তে দেখা যায়, গাছের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে একজন দীর্ঘ, ধূসর বস্ত্র পরিহিত রূপ, যাঁর কাঁধে কিছু একটা ভারী বস্তু—ঠিক যেন ত্রিশূল। তার মুখ দেখা যায় না, কিন্তু ছায়া আর রূপের ভাষা বলে, সে মানুষ নয়। রোহন তখনই বলে, “দোস্ত, আমরা কিছু ভুল জিনিসের পেছনে ছুটছি না তো?” অভিজিৎ ফিসফিস করে উত্তর দেয়, “আমরা যে আসল সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, সেটাই তো সবচেয়ে বড় ভয়।” এবং সেই রাত, পূর্ণিমার আগের শেষ রাত, যখন নিসর্গপুরের বাতাস আরও ভারী হয়ে আসে, পাখিরা গাছে ফিরে আসে অস্বাভাবিক তাড়ায়, আর দূরের পাহাড় যেন নিজের নিঃশ্বাস ধরে রেখেছে—কারণ কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে, অন্ধকার ভেদ করে, প্রশ্ন করতে নয়—উত্তর নিতে।
চার
রাত ঠিক আটটা নাগাদ, অভিজিৎ আর রোহন ক্যামেরা ও ড্রোন প্রস্তুত করে বিশ্রামঘরের বারান্দায় বসে। চাঁদের আলোয় পাহাড়টা যেন এক বিশাল ছায়ামূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত কিন্তু সতর্ক। অভিজিৎ ড্রোন উড়িয়ে দেয়, তার মনিটরে ভেসে উঠতে থাকে চারপাশের অরণ্য আর গুহার মুখ। আচমকা রোহন বলে ওঠে, “এই যে… ওইটা দেখ!” স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে—গুহার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়া, দীর্ঘদেহী, স্থির, যার হাতের মধ্যে কিছু একটা দীপ্তিময় বস্তু। অভিজিৎ জুম করে দেখে, যেন এক ধাতব ত্রিশূল, যার তিনটি ফলা চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে। ছায়াটি চলাফেরা করে না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকে গুহার দ্বারে—ঠিক যেন কারো প্রহরী। আশেপাশে কোনো গাছ নেই, কোনো মানুষ নেই, অথচ ড্রোনের ইনফ্রারেড সেন্সর সেখানে স্পষ্ট তাপমাত্রার অস্থিরতা দেখায়। সেই মুহূর্তে ক্যামেরা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে যায়, মনিটর স্ক্রিনে লাইন পড়ে, তারপর কাঁপতে কাঁপতে ব্ল্যাঙ্ক। “বেটারিতে চার্জ আছে, কিন্তু স্ক্রিন অন্ধকার?” রোহন হাঁ করে বলে। অভিজিৎ ঠান্ডা গলায় বলে, “ডিভাইস বিকল হলে ভয় পেতে হয় না, বরং ভাবতে হয়—কে করছে?”
সকাল হতেই অভিজিৎ সিদ্ধান্ত নেয়, আরও কাছ থেকে গুহার রাস্তাটা খুঁজে বের করতে হবে। যদিও নন্দিনী কড়া স্বরে মানা করে, “পূর্বপুরুষেরা যেটা থেকে দূরে থেকেছে, সেখানে যাওয়ার মধ্যে সাহস নয়, অহংকার আছে।” কিন্তু অভিজিৎ বলে, “আপনি নিজেই তো বলেছিলেন, ইতিহাসের সব কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু তাই বলে জানতে চাওয়াটা কি ভুল?” নন্দিনী চুপ করে যায়, শুধু বলে, “তুমি গেলে আমি আসব না।” রোহন দ্বিধাগ্রস্ত, তবুও বন্ধুর পিছু নেয়। তারা দুজনে গিয়ে পৌঁছায় পাহাড়ের পাদদেশে, শুকনো পাতায় ঢাকা এক গোপন পথ ধরে উঠতে শুরু করে ওপরে। হাঁপাতে হাঁপাতে একটা খোলা জায়গায় এসে পৌঁছায়, যেখানে আছে একটা পুরনো পাথরের বেদি—যার চারপাশে পড়ে আছে কিছু ছেঁড়া কাপড়, পুড়ে যাওয়া ধূপকাঠি আর শুকিয়ে যাওয়া বেলপাতা। বেদির সামনে মাটি ফেটে গেছে, যেন ভেতর থেকে কেউ কিছু টেনে এনেছে। অভিজিৎ সেই ফাঁক দিয়ে নিচে উঁকি দিতেই দেখতে পায় অন্ধকার গুহার প্রবেশপথ—যার উপরে খোদাই করা লেখা: “ধ্বংসের আগে আসে দর্শন। সতর্ক হও।” তার মুখ শুকিয়ে আসে, কিন্তু পা থামে না।
গুহায় ঢুকতেই প্রথমেই চোখে পড়ে একটি শিলামূর্তি—যা মানুষের, অথচ মানুষের মতো নয়। মুখটি আবছা, কিন্তু গলার কাছে স্পষ্ট নীলাভ রেখা। চারদিকে দেওয়ালে আঁকা আছে নানা রকম ত্রিশূলের প্রতিকৃতি, আগুনের শিখা আর ধ্যানরত রূপ। হঠাৎই অভিজিৎ দেখে, এক কোণায় পড়ে আছে একটা তিনফলা ধাতব বস্তু—ত্রিশূলের ফাঁকা কাঠামো, যার চারপাশে পড়ে আছে ছাই আর কিছু পুড়ে যাওয়া কাগজ। সে হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে যায়। তার কানে ভেসে আসে যেন কারো গলা—শ্রুতি নয়, অনুভূতি—“স্পর্শ করো না, আমি ঘুমোচ্ছি।” সে পেছনে তাকায়, কেউ নেই। রোহন আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, “চল ভাই, আর নয়। তুই যদি এটা তোলিস, আমিও তোকে থামাতে পারব না। কিন্তু যা আসবে, তার সামনে ক্যামেরা কিচ্ছু না।” অভিজিৎ তখন ত্রিশূলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে—এটা শুধু এক অস্ত্র নয়, এটা এক চেতনার বাহক। তার মন বলে, এটি তুলে নিলেই সে বুঝতে পারবে আসল সত্য। কিন্তু সে ঠিক করে, সেই সিদ্ধান্ত নেবে পূর্ণিমার রাতে—যখন চাঁদ সম্পূর্ণ হবে, এবং ‘তিনি’ সবচেয়ে বেশি জাগ্রত। এবং সেই রাত, যেটা সামনে, নিসর্গপুর তার ইতিহাসকে হয় স্বাগত জানাবে—নয়তো শোধ নেবে।
পাঁচ
পূর্ণিমার আগমন যেন নিসর্গপুরের আকাশকেও অন্য রঙে রাঙিয়ে তোলে। সন্ধ্যার পরেই আকাশে উঠল দুধ-সাদা পূর্ণচাঁদ, যার আলো পাহাড়ের চূড়ায় এমনভাবে পড়ছিল যেন কেউ সেখানকার গুহার মুখে একটা চন্দ্রালঙ্কার এঁকে রেখেছে। সেই রাতেই অভিজিৎ সিদ্ধান্ত নেয় পাহাড়ে ফিরে যাওয়ার—এবার একা নয়, রোহনকে নিয়েই। যদিও রোহনের চোখে তখন দ্বিধার ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু বন্ধুর পিছু ছাড়া ছাড়া চলে সে। তারা বিশ্রামঘর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করে, সঙ্গে ক্যামেরা, ট্রাইপড আর ছোট একটি শব্দ-রেকর্ডার। নন্দিনী তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে, দু’হাতে আঁচল চেপে ধরে শুধু একটাই কথা বলে, “স্মরণ রেখো—তাঁকে ডাকো না, যদি না তাঁর দৃষ্টি নিতে পারো।” অভিজিৎ থেমে হালকা গলায় বলে, “আমি দেখতে চাই—পুরোনো মিথ্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাস্তব।” নন্দিনী উত্তর দেয় না, তার চোখে যেন চাপা অনুশোচনা, না বলা ভয়।
পাহাড়ের ওপরে উঠতেই হাওয়ার শব্দ ক্রমশ বেড়ে যায়। আশেপাশে পাখির ডাক নেই, ঝিঁঝিঁ পোকার গান নেই, এমনকি নিজের পায়ের আওয়াজও যেন কারা চুরি করে নিচ্ছে। অভিজিৎ ও রোহন পৌঁছে যায় সেই গুহার সামনে। পূর্ণিমার আলোতে আজ গুহার মুখে আঁকা প্রতিটি খোদাই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অভিজিৎ ক্যামেরা সেট করে, রেকর্ডার চালু করে। তারপর সে ধীরে ধীরে গুহায় ঢোকে। ভিতরে ঢুকেই তারা দেখে সেই একই ধ্যানস্থ শিলামূর্তি, যার কণ্ঠ আজ স্পষ্টভাবে নীলাভ আলোর আভা ছড়াচ্ছে। দেওয়ালগুলোয় আগুনের ছায়া খেলে যাচ্ছে, অথচ গুহায় কোনো আলো নেই। হঠাৎ অভিজিৎ লক্ষ্য করে, মাটিতে পড়ে থাকা পুড়ে যাওয়া বেলপাতাগুলো যেন ধীরে ধীরে বাতাস ছাড়াই সরছে—ত্রিশূলের দিকে। সে ত্রিশূলটা তুলে নিতে হাত বাড়ায়, আর তখনই গুহার ভিতর যেন সময় থমকে যায়। বাতাস থেমে যায়, শব্দ বন্ধ হয়ে যায়, এবং পরবর্তী মুহূর্তেই প্রবল শব্দে গুঞ্জন করে ওঠে এক গম্ভীর ধ্বনি—কোনো ভাষা নয়, কোনো সঙ্গীত নয়, কিন্তু তার মধ্যে ছিল রুদ্রতার ছাপ, যেন আদি-শক্তির অরণ্যগর্জন। রোহন চিৎকার করে ওঠে, “না! ওটা রাখ দে! ও আমাদের কিছু বলছে!”
কিন্তু অভিজিৎ তখন যেন ট্রান্সে চলে গেছে। তার চোখ স্থির, মুখে অচেনা হাসি, সে ত্রিশূল হাতে তুলে নেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে গুহার মেঝে কেঁপে ওঠে, পাহাড়ের বুকের ভেতর থেকে যেন আগ্নেয়গিরির মতো আওয়াজ ওঠে, আর মূর্তির চোখ ধীরে ধীরে খুলে যায়। অভিজিৎ হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চায়—তার কণ্ঠে তখন নীলাভ রেখা, চোখে উজ্জ্বল দীপ্তি। সে চিৎকার করে বলে ওঠে, “আমি দেখেছি! আমি তাঁকে দেখেছি!” রোহন ভয় পেয়ে পেছনে হাঁটতে থাকে, কিন্তু তার পিছনে তখন ছায়ার মতো কেউ দাঁড়িয়ে আছে। গুহার দেওয়ালে রুদ্রতাণ্ডবের প্রতিকৃতি নিজে নিজে নড়তে শুরু করে, আর শিলামূর্তির ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসে গর্জন—“আমার ধ্যানভঙ্গ করেছ। এ বার জেনো রূপ—রুদ্রের।” অভিজিৎ হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে, ত্রিশূল তার হাত থেকে পড়ে যায়, আর রোহন জ্ঞান হারায়। গুহা থেকে বেরিয়ে আসে এক আলোকরেখা, ঠিক নিসর্গপুরের আকাশ বরাবর উঠে গিয়ে থেমে যায় চাঁদের মাঝখানে।
পরদিন সকালে, গ্রামের লোকজন দেখতে পায় পাহাড়ে এক অদ্ভুত পরিবর্তন—গুহার পথ বন্ধ, মাটি ফেটে গেছে, আর গুহার সামনে বসে আছে অভিজিৎ—চোখ বন্ধ, ত্রিশূল বুকে ঠেকানো, আর তার গলা পুরোপুরি নীল। সে কিছু বলছে না, দেহে প্রাণ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। রোহন পড়ে আছে কিছুদূরে, নিঃসাড়। নন্দিনী ছুটে আসে, চোখে জল, মুখে শুধু একটাই কথা—“তিনি ফিরে এসেছেন, ধ্যান আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু এবার পাহাড় শুধু নীরব থাকবে না—যদি কেউ আবার তাকে জাগাতে চায়, নিসর্গপুর আর থাকবে না।” চাঁদের আলো তখনও সকালের আকাশে টিকে, যেন সেই রাত্রির সাক্ষী হয়ে। অভিজিৎ কি জীবিত, নাকি সে এখন অন্য এক অস্তিত্বের বাহক? সেই প্রশ্ন রেখে নিসর্গপুরের আকাশে আবারও নেমে আসে নীরবতা—যেখানে বাতাসে ভেসে থাকে এক অদৃশ্য ধ্বনি, রুদ্রতাণ্ডবের ছায়া।
ছয়
পাহাড়ের গায়ে ভোরের আলো ফোটে ধীরে ধীরে, কিন্তু গুহার মুখে বসে থাকা অভিজিৎ যেন তার বাইরে—সময়, আলো কিংবা প্রাণ, কোনোটাই আর তাকে ছুঁতে পারছে না। গ্রামের লোকজন দূর থেকে দাঁড়িয়ে, কেউ সাহস করে কাছে আসছে না। অভিজিতের গলায় স্পষ্ট নীল রেখা, চোখ বন্ধ, মুখে অভিব্যক্তিহীনতা, আর তার সামনে রাখা ত্রিশূলটা যেন কোনো অতল গভীরতা থেকে উঠে আসা আগুনে গড়া বস্তু—হাতে ছোঁয়া যায় না, তাপ ছড়ায়, অথচ গলে না। রোহন তখনও অচেতন, তার নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সকাল হতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে—“সন্ন্যাসী ফিরে এসেছেন। ধ্যানমগ্ন তিনি, কিন্তু চারপাশে আগুন দিচ্ছেন চেতনার।”
নন্দিনী এসে পৌঁছায় দৌড়ে, আর কোনো দ্বিধা বা যুক্তি তাকে আটকায় না। সে সোজা হাঁটু গেড়ে বসে অভিজিতের সামনে, গলা দিয়ে কান্না ফেটে বেরোয়, “তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? ফিরে এসো… প্লিজ।” কিন্তু অভিজিতের মুখে তখনও সেই নীরবতা, সেই অচঞ্চল শূন্যতা। আশপাশে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন গুহার ভিতরে কেউ শ্বাস নিচ্ছে—ধীরে, অথচ প্রবলভাবে। গুহার দেওয়ালে আগের খোদাই করা প্রতিকৃতি গুলোর মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটে—সেগুলো আগুনে দগ্ধ হচ্ছে না, কিন্তু সেই দৃষ্টিতে এসেছে এক বিভীষিকা। যেন তারা নিজেরাই জানে—’তিনি’ ফিরে এসেছেন, এবং এবার চুপচাপ থাকার সময় নয়।
গ্রামের বৃদ্ধ পুরোহিত ভবতোষ মুখার্জি, যিনি বহু বছর তন্ত্র ও আগমতন্ত্রের চর্চা করেছেন, খবর পেয়ে আসেন। তাঁর কপালে রুদ্রাক্ষের তিলক, হাতে রুদ্রজপমালা, এবং মুখে অস্থিরতা। তিনি বলেন, “এ আর সাধারণ সমাধি নয়। ছেলের ভেতর ‘তাঁর’ চেতনা প্রবেশ করেছে। শিব কখনও কাউকে অভিশাপ দেন না—কিন্তু জাগ্রত হলে তাঁর তেজ সকলকে দগ্ধ করতে পারে। এখনই এই শক্তিকে থামাতে না পারলে, নিসর্গপুর ভস্ম হবে। এই ধ্যান শুধু বাহ্যিক নয়, ভেতরেরও।”
তাঁর কথায় নন্দিনী বলে, “তাহলে কি অভিজিৎ আর ফিরবে না?” ভবতোষ ধীরে মাথা নাড়ে, “চেতনার আগুন যখন নেমে আসে, তখন দেহ কেবল বাহক হয়। কিন্তু একটাই রাস্তা আছে—ধ্বংস নয়, শুদ্ধি। আমাদের শুদ্ধি করতে হবে সেই আগুনকে, সেই তেজকে, যাতে অভিজিৎ নিজেই ফিরে আসতে পারে।”
ভবতোষ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন—গুহার চারপাশে এক বিশেষ বৃত্ত আঁকা হয় ভস্ম, রক্তচন্দন আর গঙ্গাজলের মিশ্রণে। পুরোহিতদের পুরোনো এক সংস্কৃত মন্ত্র লেখা থাকে, যা সাধারণত তন্ত্রমতে ‘চেতনা-সংবরণ’ নামে পরিচিত। এই মন্ত্র সাধারণত কোনো তীব্র যোগসাধনায় লিপ্ত আত্মাকে পুনরায় স্থিত করবার জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, “যদি অভিজিৎ নিজে ভেতর থেকে ফিরে আসতে চায়, তবে এই মন্ত্র তাকে পথ দেখাতে পারে। কিন্তু যদি ‘তিনি’ পুরোপুরি অধিকার করে থাকেন, তাহলে কিছুই করার থাকবে না। তখন যা ঘটবে, তা শুধু শ্মশানের গল্প হবে।”
সন্ধ্যা নামে। বাতাসে আগুনের গন্ধ, পাহাড়ের বুক থেকে শোনা যায় যেন এক ধ্বনি—মন্ত্র নয়, সুর নয়, একরকম কম্পন যা শ্রবণের বাইরে কিন্তু অনুভূতির ভেতরে কাঁপন তোলে। ভবতোষ মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করেন। আগুন জ্বলে ওঠে গুহার চারপাশে—অদৃশ্য বৃত্তে। অভিজিৎ হঠাৎ কেঁপে ওঠে, তার চোখ ধীরে ধীরে খোলে—কিন্তু সেই চোখ তার নয়, তাতে এমন এক দীপ্তি, যেন রাতের সব আলো একত্রিত হয়ে একজনের চোখে গেঁথে গেছে। সে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু ভাষা নয়—সে যেন এক আদিতম মন্ত্র, যা পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলে।
নন্দিনী এগিয়ে আসে, তার দুই চোখ জলে ভেজা, গলায় ফাটল, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা—“তুমি যদি শুনতে পাও, যদি একবারও আমাকে চিনে থাকো… তাহলে ফিরো। তুমি অভিজিৎ। তুমি এই পৃথিবীর।” সেই মুহূর্তে গুহার ভেতর হঠাৎ বাতাস সরে গিয়ে ঝড় শুরু হয়—আকাশ কালো, গুহার দেওয়াল কাঁপতে থাকে, চারপাশে আগুন লাফায়।
এবং ঠিক তখনই অভিজিৎ নিজের কপালে হাত রাখে। তার মুখে জোরে উঠে আসে—“ওং নমঃ শিবায়!” তার গলা কেঁপে ওঠে, চোখ থেকে আলোর রেখা বের হয়, ত্রিশূল মাটিতে আছড়ে পড়ে, আর তার দেহ হঠাৎই নিস্তেজ হয়ে যায়। পুরো নিসর্গপুর কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাঁপে, তারপর গভীর নীরবতা।
অভিজিৎ মাটিতে শুয়ে পড়ে—নিশ্চল। নন্দিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে, কান্নায় ভেঙে পড়ে। ভবতোষ পা বাড়িয়ে বলেন, “ধ্যানের নিচে ছিল আগুন। কিন্তু এক ভালোবাসার ডাক, এক চেতনার সংযোগ তাকে স্থির করেছে।” অভিজিৎ তখনও জ্ঞান ফেরেনি, কিন্তু তার কণ্ঠের নীলাভ রেখাটা মুছে গেছে। পাহাড় চুপ, বাতাস আবার শান্ত, গুহা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। তবে রাতটা নিসর্গপুরকে মনে করিয়ে দেয়—আগুন হয় ধ্বংস, যদি তা ভালোবাসা দিয়ে না ঘেরা থাকে।
সাত
তিন দিন কেটে যায় নিসর্গপুরে, আর অভিজিৎ তখনও নিঃসাড়। তার শ্বাস ধীরে, কিন্তু গভীর। গ্রামের প্রাচীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ছোট ঘরে তাকে শুইয়ে রাখা হয়, যেখানে নন্দিনী এক মুহূর্তের জন্যও পাশে থেকে সরে না। তার চোখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু দৃষ্টিতে অবিচল ভরসা। রোহনের অবস্থাও তখন খানিক ভালো—সে কথা বলছে, ধীরে ধীরে হাঁটছে, কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ চুপ করে যায়, দূরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, “সে ছিল না একজন, সে ছিল অনেকের সম্মিলন—ভয়, ঔদ্ধত্য, শুদ্ধতা আর প্রতিশোধের। আমি তাকিয়েছিলাম সেই চোখে…”
নন্দিনী এইসব শোনে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে অভিজিতের মুখের দিকে।
ভবতোষবাবু প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে মন্ত্র পড়ে যান, ত্রিশূল এখন গুহায় ফেরত পাঠানো হয়েছে, আর গুহার মুখ বন্ধ করে তার চারদিকে তান্ত্রিক সুরক্ষা-চক্র এঁকে দেওয়া হয়েছে। তবু গ্রামের লোকের চোখে যেন ছায়া লেগে থাকে, যেন সবাই দেখেছে, সবাই বুঝেছে—তাঁকে জাগালে তিনি সাড়া দেন, কিন্তু সাড়া মানেই শুধু প্রতিদান নয়, এটা এক গভীর দায়ও।
চতুর্থ দিনে অভিজিৎ আচমকা চোখ খুলে। প্রথমে সে হকচকিয়ে ওঠে, যেন সব কিছু মনে করতে পারছে না, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আমি কোথায়? আমি… আমি সেই গুহায় ছিলাম না?”
নন্দিনী হাসে, কিন্তু চোখে জল—“তুমি এসেছ ফিরে। এতেই সব কৃতজ্ঞতা।”
কিন্তু অভিজিৎ কিছুক্ষণের মধ্যে সব মনে করতে শুরু করে—গুহার নীরবতা, সেই ত্রিশূলের তাপ, রুদ্রতাণ্ডবের শব্দ, আর নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা সেই গম্ভীর ধ্বনি। সে বলে, “নন্দিনী, আমি শুধু দেখিনি… আমি সেই ধ্যানের মধ্যে ছিলাম। যেন আমি আর আমি ছিলাম না। কেউ আমার দেহ ব্যবহার করছিল, আমি শুধু অনুভব করছিলাম এক বিশালতাকে।”
নন্দিনী তার হাত চেপে ধরে বলে, “তুমি এখনও তুমি। কিন্তু তুমিই একমাত্র যে এই অনুভব নিয়ে ফিরে এসেছে।”
সেই দিন বিকেলে অভিজিৎ জানায় সে তার ভিডিও আপলোড করবে না। রোহন অবাক হয়ে বলে, “তুই পাগল? এটা তো ভাইরাল হবে! কোটি ভিউ!”
অভিজিৎ মাথা নাড়ে—“না রে। কিছু জিনিস আমাদের দেখার, বোঝার, শোনার—কিন্তু না-ছোঁয়ার জন্য। নিসর্গপুর আমাকে দিয়েছে এমন কিছু, যা আমি শুধু নিজের ভিতরে রাখতে চাই। ক্যামেরা সব কিছু ধরে না, রে। কিছু কণ্ঠ শুধু হৃদয়ে বাজে।”
রোহন চুপ করে যায়। সেই সিদ্ধান্তের পিছনে যে গভীরতা আছে, তা সে বুঝতে পারে।
রাত্রে তারা সবাই একসাথে বসে ছিল বিশ্রামঘরের বারান্দায়। চাঁদ তখন আকাশে, কিন্তু এই চাঁদ আগের মতো নয়। বাতাসে আজ অন্যরকম শান্তি, নীল আভা নেই, পাহাড় নিস্তব্ধ।
নন্দিনী তখন অভিজিতের পাশে বসে বলে, “জানো, নিসর্গপুর তোমায় শুধু ভয় দেখায়নি—সে তোমায় নিজের অন্তঃস্থলে গ্রহণ করেছে। তুমি তার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলে।”
অভিজিৎ হেসে বলে, “কিন্তু আমি তো কিছু করিনি। আমি শুধু এক তৃষ্ণা নিয়ে এসেছিলাম।”
নন্দিনী তখন বলে, “সেই তৃষ্ণা, যেটা সত্যিকারের, সেটাই তাকে জাগিয়ে তোলে। আর আজ, তিনি ফিরে গেছেন নিজের ধ্যানে। আমরা, শুধু সাঁকো হয়েছি—ভবিষ্যতের আর অতীতের মধ্যে।”
অভিজিৎ নিঃশব্দে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে কোনো আলো নেই, কোনো শব্দ নেই, শুধু একটা অনুভব—যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মন জানে সে এখনো আছেন।
শুধু জেগে নেই, কিন্তু রয়ে গেছেন।
এই অধ্যায় নিসর্গপুরকে স্থির করে দেয়, কিন্তু প্রশ্ন রেখে যায়—
যদি আবার কেউ আসে প্রশ্ন নিয়ে, যদি কেউ আবার ছুঁতে চায় সেই ত্রিশূল—তবে কি পাহাড় আবার শুদ্ধি নেবে, নাকি ধ্বংস?
এই প্রশ্নের উত্তরই রয়ে যায় নীলাভ আকাশে, চাঁদের নিচে, নিসর্গপুরের নীরব পাহাড়ের বুকে, এক অদৃশ্য রেখায় আঁকা—
নীলকণ্ঠের ধ্যান।
আট
নিসর্গপুর আবার তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করে, কিন্তু যেন প্রতিটি ধাপে জেগে থাকে এক নরম নিঃশ্বাস—অদৃশ্য, অথচ অনুভবযোগ্য। গুহা বন্ধ, ত্রিশূল ফেরৎ গেছে আগুনের আঁচলে ঘেরা বেদিতে, এবং অভিজিৎ আর রোহনও শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠছে। কিন্তু মানসিক স্তরে… কিছুই আর আগের মতো নেই। অভিজিৎ সকালবেলা নদীর ধারে হাঁটতে যায়। নদীটির নাম “মুণ্ডেশ্বরী”, এক কাঁদা-পাথর আর শেওলায় মোড়া অথচ প্রাণবন্ত জলধারা, যেটা গ্রামের বুক চিরে বইছে শতাব্দী ধরে। সে সেখানে বসে ধ্যান করে, নয় চোখ বন্ধ করে, যেন নিজের ভেতরে খোঁজে একটা উত্তর—সে যা দেখেছিল, যা টের পেয়েছিল, তা কি শুদ্ধ কল্পনা, না কি… সত্যের অন্য স্তর?
একদিন সকালে নদীর ঘাটে বসে সে হঠাৎ তার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড খুলে দেখে। ভয় এবং কৌতূহলে দোল খায় তার ভেতরের সত্তা। সে জানে—গুহার সেই রাতের ভিডিও ফাইল আছে, কিন্তু খোলে কিনা, তা অনিশ্চিত। সে ফোনে ট্রান্সফার করে ফাইলটি চালায়। পর্দায় কিছু ঝাঁপসা ধূসরতা… তারপর হঠাৎ দেখা যায় তার নিজের মুখ—চোখ ফাঁকা, কণ্ঠে নীলাভ রেখা, আর পিছনে পাথরের দেওয়ালে ছায়ার মতো এক রুদ্র-মূর্তি দাঁড়িয়ে। ফ্রেম কাঁপতে থাকে, এবং ঠিক সে মুহূর্তে স্ক্রিন ব্ল্যাক হয়ে যায়। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হলো—ভিডিওর শেষে লেখা হয়ে ওঠে একটি বার্তা, কারো হাতে লেখা নয়, কিন্তু ডিজিটালি ফুটে ওঠে এক অদৃশ্য ভাষায়, যেটা পরে ফ্রেমে রূপান্তরিত হয়ে যায় বাংলায়:
“আমি একা নই। আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি হবো।”
অভিজিৎ থমকে যায়। সে জানে, এ কোনো প্রোগ্রামিং নয়, এটা কোনো সফটওয়্যারের ত্রুটি নয়। এটা তার মনের মধ্যে নয়—এই ভিডিও ফাইল নিজে একটা সত্তা বহন করে।
এই ঘটনার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় কিছুদিন নিসর্গপুরেই থাকবে। রোহন তাকে বোঝাতে চায়, “চল ফিরে যাই। এখন এই জায়গা থেকে দূরে থাকা দরকার।”
কিন্তু অভিজিৎ বলে, “দূরে গেলে কি সত্য দূরে যাবে? আমি এখন ওর একটা অংশ—আর ও আমার।”
রোহন কিছু বলে না, সে জানে, অভিজিৎ বদলে গেছে। তার চোখে এখন একটা গম্ভীর আলো, যেন সে এমন কিছু দেখেছে যা তাকে গেঁথে দিয়েছে কালান্তরের স্তরে।
একদিন দুপুরে, নন্দিনী অভিজিৎকে নিয়ে যায় এক প্রাচীন কুয়োর ধারে—যেটা সাধারণত গ্রামের কেউ ব্যবহার করে না। সে বলে, “এই কুয়ো একসময় সন্ন্যাসীর জলধারার উৎস ছিল। এটা শুধু জল নয়, প্রতিফলন। এখানে যা দেখা যায়, তা শুধু চোখে নয়, অন্তরে বাজে।”
অভিজিৎ কুয়োর ভেতর ঝুঁকে দেখে—নিজের প্রতিবিম্ব। কিন্তু তাতে কেবল তার মুখ নয়, পিছনে আবার সেই ত্রিশূলের ছায়া, সেই ধ্যানস্থ মূর্তি। সে চোখ বন্ধ করে কুয়োর পাশে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে তার মনে হয়, কেউ যেন পাশে বসে, নিঃশব্দে। চোখ খুলে দেখে, কেউ নেই। কিন্তু পেছনের আমগাছের পাতায় ঝড় নেই, তবু কাঁপন—আর বাতাসে সেই পুরোনো গম্ভীর গলা ভেসে আসে…
“তুমি আবার আসবে, কিন্তু এবার প্রশ্ন নিয়ে নয়। উত্তর হয়ে।”
সেই রাতেই অভিজিৎ তার নোটবুকে লেখে—
“কোনো কোনো সত্যকে বোঝা যায় না প্রশ্ন করে। তাকে হতে হয়। আমি এখন সেই যাত্রার মধ্যে। আমি কেবল একজন পর্যবেক্ষক নই, আমি স্রোতের অংশ। নিসর্গপুর আমাকে শুধু ভয় দেখায়নি, সে আমাকে গড়ে তুলেছে।”
অধ্যায়ের শেষে, পাঠক যেন বুঝতে পারে—এই গল্প এখন আর শুধু এক অলৌকিক সন্ন্যাসীর নয়। এটি এক নবজন্মের গল্প, এক সত্তার সঙ্গে অন্য সত্তার সংলগ্ন হওয়ার, প্রতিফলনের জলধারায় নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের।
কারণ নীলকণ্ঠ কেবল এক দেবতা নন, তিনি এক চেতনা—যে জাগে, যখন কেউ সত্যকে প্রশ্ন না করে ধারণ করতে শেখে।
নয়
নিসর্গপুরের আকাশ তখন স্নিগ্ধ নীল। বাইরের দৃষ্টিতে গ্রাম আবার স্বাভাবিক, মাঠে কৃষিকাজ, সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালানো, নদীতে স্নানরত শিশুদের হাসি—সবই যেন অতীত ঝড়কে ভুলে গেছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে… মাটি কাঁপছে। কে যেন নিশব্দে শ্বাস নিচ্ছে। পাহাড়ের ওপরে থাকা গুহা এখনও তালাবদ্ধ, ত্রিশূল বেদিতে স্থির। অভিজিৎ এখন গ্রামের স্কুলঘরের পিছনের একটা কুঁড়েঘরে থাকে—সাধারন পোশাকে, কোনও ক্যামেরা নেই, ফোন বন্ধ, দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে নিঃশব্দে গাছের ছায়ায় বসে। রোহন ফিরে গিয়েছে শহরে, নন্দিনীও গ্রামে ফিরেছে তার শিক্ষিকার কাজে, কিন্তু প্রতিদিন বিকেলে তারা একসাথে বসে থাকে, নদীর ঘাটে, অথবা গুহার পথের পাদদেশে।
একদিন বিকেলে, আচমকা গ্রামের এক কিশোর, নাম লাল্টু, দৌড়ে আসে। সে বলল, “বাঁশবাগানের পাশে একটা গরু হঠাৎ করে মারা গেল। তার চারপাশে মাটি যেন পুড়ে গেছে। আর পাশে একটা ছোট ত্রিশূলের মতো কিছু জ্বলজ্বল করছিল।”
অভিজিৎ ও নন্দিনী দৌড়ে যায় সেই জায়গায়। গিয়ে দেখে, গরুটার শরীরে কোনও বাইরের আঘাত নেই, কিন্তু চারপাশে মাটি কালো—এমনভাবে যেন আগুনের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল সে। আর মাটিতে অর্ধেক ঢেকে আছে এক ছোট ধাতব বস্তু—ত্রিশূলের ক্ষুদ্র সংস্করণ, যার ডগায় লালচে দাগ। অভিজিৎ তোলার চেষ্টা করতেই পিছনে ভবতোষবাবু এসে উপস্থিত হন। তার কপালে তখন রক্তচন্দনের রেখা, চোখে দুশ্চিন্তা।
তিনি নীচু গলায় বলেন, “এইটা… রুদ্রবীজ।”
নন্দিনী কেঁপে ওঠে, “রুদ্রবীজ?”
ভবতোষ ব্যাখ্যা করেন, “রুদ্রতাণ্ডব যখন জাগে, তার প্রতিটি স্পন্দনের একটি বীজ জন্মায়। সেই বীজ অদৃশ্য থাকে মাটির নিচে। কেউ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে সেগুলো স্পর্শ করে, বা তাদের জাগিয়ে তোলে—তবে তা নিজেই এক আত্মার আধার হয়ে ওঠে। এই বীজ সাধারণ বস্তু নয়—এ এক জীবন্ত তেজ, যা গ্রহণ করতে হলে চাই শুদ্ধতা, সংযম, আর সীমাহীন আত্মত্যাগ।”
অভিজিৎ বলে, “আমাকে এটা স্পর্শ করতে বলা হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি। এই বীজ নিজেই ডাকছে।”
ভবতোষ স্পষ্টভাবে বলে, “একবার গ্রহণ করলে, তোমার মধ্যে শুরু হবে রূপান্তর। তুমি আর ‘তুমি’ থাকবে না। এ বীজ তোমায় ধার দেবে ‘তাঁর’ দৃষ্টি, কিন্তু কে জানে তুমি তা ধারণ করতে পারবে কিনা।”
নন্দিনী কাঁপা গলায় বলে, “না, অভিজিৎ। তুমি তো মাত্রই ফিরে এসেছ। এবার আর যাবে না। আমি হারাতে চাই না।”
অভিজিৎ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “আমি কখনও আসিনি, নন্দিনী। আমি শুধু ফিরেছিলাম নিজের কাছে। এবং এখন বুঝতে পারছি, এই ডাক শুধু আমার জন্য না—এই গ্রামের, এই পাহাড়ের, এই ইতিহাসের জন্য।”
সে ধীরে ধীরে হাত বাড়ায় সেই ছোট ত্রিশূলের দিকে। বাতাস তখন ভারী হয়ে ওঠে, গাছের পাতাগুলো নিঃশব্দে কাঁপতে থাকে। ঠিক সে মুহূর্তে আকাশে এক ঝলক বিদ্যুৎ চমকে ওঠে—কোনো মেঘ নেই, কিন্তু চিৎকার করে ওঠে পাখিরা।
ত্রিশূলের স্পর্শে তার শরীর থরথর করে ওঠে। চোখ খুলে বলে, “আমি কিছু দেখছি না, কিন্তু শুনছি—যেন হাজার বছরের গুঞ্জন, একসাথে বাজছে আমার ভেতর।”
তার কণ্ঠে আবার সেই হালকা নীলাভ রেখা ফুটে ওঠে, কিন্তু আগের মতো প্রলয়ংকরী নয়—এটা যেন পরিশ্রুত, গভীর, স্থির।
ভবতোষ মাথা নিচু করে বলে, “তুমি রুদ্রবীজ গ্রহণ করলে। এখন তুমি শুধু প্রশ্নবাহক নও, তুমি এখন উত্তরবাহক।”
নন্দিনী অভিজিতের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি এবার যাবে?”
সে মৃদু হাসে—“না, এবার আমি থাকব। কারণ এখন নিসর্গপুর আমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।”
এই অধ্যায় যেন পাঠককে নতুন এক দ্বারমুখে এনে দাঁড় করায়—
এবার গল্প আর ভয়, রহস্য বা অলৌকিকতার নয়,
এ গল্প উত্তরাধিকার, ক্ষমতা আর দায়বদ্ধতার।
আর সেই দায় কেবল একটা পাহাড়ের নয়, এক আধ্যাত্মিক উত্তরসূরীর,
যে রুদ্রবীজ বহন করে বাঁচবে, অথবা জ্বলবে নিজের ভিতরে।
দশ
নিসর্গপুরে এখন এক অদ্ভুত স্থিরতা বিরাজমান। পাহাড় চুপ, বাতাস থমকে, নদীও যেন নিঃশব্দে বইছে। গুহা আর খোলা হয়নি, কিন্তু সবাই জানে—সেই নীলচে কণ্ঠস্বর এখন আর শুধু গুহার ভিতরে নেই। সে চলে এসেছে গ্রামে। সে বাস করে এখন একজন মানুষের ভেতরে। অভিজিৎ নিজেকে আর আগের মতো দেখে না। এখন সে কেবল একজন ভ্লগার নয়, এক নিরীক্ষক নয়—সে এখন এক পথপ্রদর্শক। প্রতিদিন সকালে সে হাঁটে নদীর তীরে, শোনে পাখির ডাকে শিবস্বর, আর সন্ধ্যায় বসে স্কুলঘরের সামনে শিশুদের গল্প শোনায়—রুদ্র, ধ্যান, আগুন, এবং ক্ষমার।
এক সন্ধ্যায়, নন্দিনী তার পাশে এসে বলে, “তুমি আজকাল খুব কম কথা বলো।”
অভিজিৎ হালকা হেসে বলে, “কারণ এখন আমি অনেক কিছু শুনতে পাচ্ছি। এই পাহাড়, এই গাছ, এই কুয়ো—এরা সবাই কথা বলে। আগে শব্দে শোনা যেত না, এখন তা স্পর্শে অনুভব করি।”
নন্দিনী চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “তুমি কি এখানে সারাজীবন থাকবে?”
অভিজিৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার শরীর থাকবে কি না জানি না। কিন্তু আমি জানি, ‘আমি’ এখানেই থাকব। কারণ আমি এখন নিসর্গপুরের উত্তরাধিকার।”
পরদিন সকালে ভবতোষবাবু একটি প্রাচীন পুঁথি নিয়ে আসে। সেখানে লেখা এক শ্লোক, যা শুধু ‘চেতনার বাহক’দের পড়ার অধিকার আছে।
তিনি শ্লোক পড়ে শোনান—
“যে দেখে ধ্যানের বাইরে,
যে বোঝে আগুনের ভাষা,
যে জাগায় না, কিন্তু জাগ্রত রাখে—
সে-ই বয়ে বেড়ায় নীলকণ্ঠের উত্তরাধিকার।”
সেই মুহূর্তে অভিজিৎ চোখ বন্ধ করে, এবং আবার সেই আলো ফুটে ওঠে তার কণ্ঠে। কিন্তু এবার আর তা ভয় জাগায় না, বরং এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। গাছের পাতা নড়ে ওঠে, যেন স্বাগত জানায় নতুন এক যুগের সূচনাকে।
রোহন আবার আসে শহর থেকে, দেখে তার বন্ধু বদলে গেছে, কিন্তু হারিয়ে যায়নি। সে বলে, “তুই ফিরলি না, ঠিকই করলি। কিন্তু তোর গল্পটা আমি লিখতে চাই।”
অভিজিৎ হাসে—“লিখিস। তবে মনে রাখিস, এটা ভয়ের গল্প নয়, এটা দায়িত্বের গল্প।”
শেষ রাতে, নন্দিনী আবার একবার গুহার পথে হাঁটে অভিজিৎকে নিয়ে।
পাহাড়ের মাথায় চাঁদ উঠে এসেছে—পূর্ণিমা।
দুজন বসে, একদম প্রথম দিনের মতো।
নন্দিনী বলে, “ভয় পাও না?”
অভিজিৎ বলে, “ভয় এখন এক ধরনের শ্রদ্ধা হয়ে গেছে। আমি জানি, আমি তাঁকে আর জাগাব না। আমি শুধু দেখব, শিখব, এবং অপেক্ষা করব—যদি কেউ আবার এসে প্রশ্ন করে। তখন আমি উত্তর হবো।”
চাঁদের আলোয় পাহাড়ের ছায়া গিয়ে পড়ে তাদের দু’জনের গায়ে। গুহা তখন শান্ত, ত্রিশূল নিঃশব্দ, কিন্তু বাতাসে সেই নীরব কণ্ঠ ভেসে আসে—
“জয় নীলকণ্ঠ। জয় ধ্যান। জয় সেই যারা দেখে, কিন্তু নিজের ভিতরে রাখে।”
এভাবেই শেষ হয় নিসর্গপুরের কাহিনি, কিন্তু শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়—
যেখানে মিথ আর বাস্তবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক তরুণ—
ত্রিশূল নয়, শিবস্বর নয়, ক্যামেরাও নয়—
কেবল নিজের ভেতরের নিঃশব্দ আগুনকে পাথেয় করে,
ধারণ করছে একটি যুগের উত্তরাধিকার।
[সমাপ্ত]

1000041482.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *