Bangla - প্রেমের গল্প

নিষিদ্ধ রাত

Spread the love

অনিন্দিতা দিনের ব্যস্ততম কাজ শেষ করে অফিসের বাইরে আসে। রাস্তায় হঠাৎ বাতাসের আভাস কিছুটা শান্ত, কিছুটা খটখটে। তিনি পায়ের ধাপে হেঁটে যাচ্ছেন, মাথায় ঘুরছে আজকের অফিসের চাপ আর নির্দিষ্ট মিটিংগুলোর খুঁটিনাটি স্মৃতি। মন খালি করার জন্য চোখে পড়ল রাস্তায় একটি ছোট্ট ক্যাফে, যার বাইরে ধোঁয়াশা-ভরা জানালা আর নরম আলো যেন তাকে টেনে নিল। অনিন্দিতা ভিতরে ঢুকতেই প্রথমে মনে হয়, সে যেন ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছে। কাঠের ফার্নিচার, লো ফ্লোর লাইট, এবং কোমল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক—সবকিছু এক ধরণের সান্ত্বনা দেয়। তিনি নিজের হাতে মোবাইলটি নিয়ে একটু বসে পড়েন, কিন্তু চোখেরা অজান্তে তাকিয়ে থাকে অভ্যন্তরের দিকে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে, তার চোখ পড়ে একটি পরিচিত মুখে—সৌমেন। কলেজের সেই দিনগুলো মনে আসে—যেখানে হাসি, ছোট ছোট ছলে মজা, এবং চুপচাপ চোখের খোঁচা এক ধরণের অদৃশ্য সম্পর্ক গড়েছিল। সৌমেন এখনও আগের মতোই, শুধু চোখে বড় অল্প পরিবর্তন, একটু পরিপক্কতা। প্রথম মুহূর্তে দুজনেরই মৃদু বিস্ময় এবং অস্বস্তি, যেন কেউ ভুলেও মনে করতে চায়নি যে অতীত এমন একবার হঠাৎ জীবিত হতে পারে।

সৌমেনও অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য স্থবির হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় সেই সব দিন, যখন কলেজের গ্রন্থাগার, ক্যাম্পাসের ছোটো গলিপথ, এবং বিশেষ মুহূর্তগুলো তাদের হাসি আর চুপচাপ সংলাপের সাথে জড়িয়ে ছিল। আজকের সৌমেনকে দেখলে মনে হয় যেন সময় তাকে আরও গভীর করে তুলেছে, একটু নরম আর একইসাথে কিছুটা দূরের। অনিন্দিতার চোখের ভেতরেও সেই অতীতের ছায়া ভাসে। তিনি মনে মনে ভাবেন, ‘এ কি সত্যিই সৌমেন?’ বা হয়তো কেবল চোখের জাদু। দুজনের মধ্যে কিছু অমিল, কিছু অদ্ভুত উত্তেজনা তৈরি হয়। কথার কোনো দরকার নেই—শুধু চোখের দিকে তাকানো, হালকা হাসি, আর সেতু গড়ে ওঠা নিঃশব্দ স্মৃতির মধ্যে। অনিন্দিতা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কিছুটা উত্তেজিত, কিছুটা ভয় পায়—প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাকে পুরোনো আবেগের গভীরে টেনে নিয়ে যায়।

ক্যাফের নরম আলোতে, তারা দুজনেই আস্তে আস্তে এক টেবিলের পাশে বসে যায়। কথা শুরু হয় ছোট্ট অভিবাদন দিয়ে, ‘কেমন আছো?’—শব্দগুলোতে সেই সময়ের মৃদু চমক এবং অস্বস্তি মিলেমিশে একধরনের তীব্র অনুভূতি তৈরি করে। অনিন্দিতা লক্ষ্য করে, সৌমেনের হাসি এখনও একই রকম—উষ্ণ, কিন্তু কিছুটা নীরব। তারা একে অপরের চোখে তাকিয়ে অতীতের গল্পগুলো মনে করায়, যেখানে কোনো সরাসরি সংলাপ নয়, শুধু একে অপরের উপস্থিতি, চুপচাপ হাসি, এবং অদৃশ্য স্পর্শের অনুভূতি। সময় যেন থেমে যায়, অফিসের চাপ, ব্যস্ত শহরের শব্দ, এবং জীবনের অন্যান্য দায়-দায়িত্ব সব মুছে যায়। অনিন্দিতা হঠাৎ উপলব্ধি করে, কত বছর গিয়েছে, কিন্তু কিছু সম্পর্কের স্পর্শ এত গভীর যে বছর এবং দূরত্বও তাকে মুছে দিতে পারে না। ক্যাফের বাইরে রাস্তায় মানুষজন চলে আসে, কিন্তু ভিতরে দুজনের চোখের খোঁচা, অদ্ভুত উত্তেজনা, এবং স্মৃতির ঝড় যেন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এই প্রথম দেখা, এই প্রথম মুহূর্তের কম্পন, যেন একটি নীরব বার্তা দেয়—যে পুরোনো প্রেম, সময় এবং দূরত্বকে হার মানাতে পারে।

ক্যাফের ছোট্ট টেবিলে বসে তারা দুজনই প্রথমে কিছুটা নীরব থাকে, যেন অতীতের স্মৃতিগুলো তাদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কফির গরম কাপ দুজনের হাতে, বাতাসের ঠান্ডা এবং ক্যাফের নরম আলো এক ধরনের শান্তি তৈরি করছে। অনিন্দিতা চোখে চুম্বকীয় আকর্ষণ অনুভব করে—সৌমেনের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে সেই পরিচিত মৃদু হাসি, সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে যে একবার তাদের হৃদয়কে ছুঁয়েছিল। কথোপকথন শুরু হয় ছোট্ট ভ্রুক্ষেপ এবং সাধারণ অভিবাদনের মাধ্যমে, কিন্তু মুহূর্তে এটি প্রসারিত হয়ে যায় কলেজের দিনগুলোর গল্পে। তারা কথা বলে নাটকের রিহার্সালের গল্প, সেই গান যা একে অপরের মুখে গাইতেন, আর কিভাবে কখনো হাসি কখনো চোখের খোঁচা তাদের দিনগুলোকে বিশেষ করেছিল। অনিন্দিতা মনে মনে অবাক হয়—যতই বছর কেটে গেছে, সৌমেনের চোখের সেই আগুন, সেই গভীর অনুভূতি আজও অপরিবর্তিত। প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বিরামচিহ্নে যেন সেই অপ্রকাশিত আবেগ লুকিয়ে আছে। কফির কাপের ধোঁয়া, হালকা সুমধুর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, এবং তাদের কথা—সবকিছু একত্রে এক অদ্ভুত নীরব কম্পন সৃষ্টি করে, যা একে অপরের কাছে পুরোনো সম্পর্কের আবির্ভাবের চিহ্ন হিসেবে কাজ করে।

আড্ডার মধ্যেই তারা কলেজের হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো স্মরণ করে। অনিন্দিতা মনে করে, কেমন অবাক করা যে একটি সরল প্রশ্ন—‘তুমি কেমন আছো?’—কতটা গভীর অনুভূতির দরজা খুলতে পারে। সৌমেনও চোখে অদৃশ্য আবেগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়, যদিও সে মুখে তা প্রকাশ করে না। দুজনের কথোপকথন যেন ধীরে ধীরে অতীতের দিকে নেমে যায়, যেখানে তারা একে অপরকে চেনত, ভালোবাসত, কিন্তু কখনো পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারত না। অনিন্দিতা প্রথমবার উপলব্ধি করে, সৌমেন আজও তাকে একই আবেগে দেখছে—চোখে, মৃদু হাসিতে, এবং কখনো কখনো বিরক্তি আর হেসে ওঠার মাঝে। এই অনুভূতি তাকে অদ্ভুতভাবে উত্তেজিত করে, একদিকে অতীতের নরম ছোঁয়া, অন্যদিকে বর্তমানের বাস্তবতা। কথাগুলো মাঝে মাঝে থেমে যায়, শুধু একে অপরের উপস্থিতি, হালকা হাসি, এবং কফির কাপের ধোঁয়া—সবই যেন এক অদৃশ্য সংলাপ তৈরি করছে। তারা একে অপরকে দেখার চেষ্টা করে, যেমনটি কলেজের দিনগুলোতে হতো, আর অনুভব করে যে সময়, দূরত্ব, জীবনের ঘূর্ণন—সবই কিছুই তাদের সম্পর্কের গভীরতা কমাতে পারেনি।

বসার সময় তাদের মধ্যে এক ধরনের নিঃশব্দ বোঝাপড়া গড়ে ওঠে। অনিন্দিতা লক্ষ্য করে, সৌমেনের চোখে কখনোই কোনো বিরক্তি নেই, শুধুই আগ্রহ, স্মৃতি, এবং অপ্রকাশিত অনুভূতি। এই নীরব সংলাপ, এই ছোট্ট আড্ডার মুহূর্তগুলো, তাকে অতীতের মধুরতা এবং বর্তমানের উত্তেজনার মধ্যে বন্দী করে। তারা কথায় কথায় হারিয়ে যায়, সময় যেন থেমে যায়, অফিসের চাপ, শহরের হালকা হট্টগোল—সবকিছু দূরে। কফির কাপের মাঝে হাত রেখেই তারা অনুভব করে এক অদ্ভুত সমবেদনা—যে অনুভূতি দীর্ঘদিন ধরে অজান্তেই তাদের মধ্যে ছিল, কিন্তু কখনো সরাসরি প্রকাশ পায়নি। অনিন্দিতা হঠাৎ বুঝতে পারে, এই প্রথম তারা একে অপরকে সম্পূর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে দেখছে, এবং সেই চোখের মাধ্যমে এক অদ্ভুত সংযোগ, এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। দিনের আলো আস্তে আস্তে কমছে, ক্যাফের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, আর দুজনের মধুর নীরবতা, স্মৃতির ঝড়, এবং কফির কাপের ধোঁয়া—সবই এক অদ্ভুত সমন্বয়ে তাদের সম্পর্ককে নতুন রূপ দিচ্ছে।

অনিন্দিতা অফিসের দিনের ক্লান্তি ভুলে এক অস্থির মন নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিল। পথের ধুলো এবং শহরের হালকা কোলাহল তার মনকে আরও অচল করে দিচ্ছিল। আজকের কফি আড্ডার স্মৃতি, সৌমেনের চোখের গভীরতা, আর সেই অদ্ভুত নীরব কম্পন—সবকিছু তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঘরে ঢুকেই স্বাভাবিকতার চেষ্টায় হাসি ফোটায়, স্বামীকে স্বাগত জানায়, কিন্তু মনে মনে সে এক অদৃশ্য ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করছিল। সংসার, পরিবারের দায়িত্ব, জীবনযাত্রার নিয়ম—সবকিছু এতটাই ভারী মনে হচ্ছিল যে, ভিতরের আবেগ, যা দীর্ঘদিন চুপচাপ দমিয়ে রাখা হয়েছিল, হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। অনিন্দিতা অনুভব করছিল, এই আবেগ আর শুধু চোখে বা স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকছে না; এটি ধীরে ধীরে তার সমস্ত শরীর, মনে এবং হৃদয়ে প্রভাব ফেলছে।

সন্ধ্যার আলো তার ঘরে এসে পড়ে, এবং অনিন্দিতা ডায়েরি খুলে বসে। কলম হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি অদ্ভুত রক্তিম উত্তেজনা অনুভব করে। লেখা শুরু হয় ছোট ছোট শব্দে, প্রথমে দ্বিধান্বিত, তারপর একরাশ আবেগের স্রোত হয়ে বইতে থাকে। সে লিখতে থাকে সৌমেনের চোখের কথা, তাদের হাসি, কথা বলার মধ্যকার অদ্ভুত নীরবতা। প্রতিটি লাইন যেন তার নিজের চেপে রাখা অনুভূতির আকার নেয়। সে অনুভব করে, কতটা গভীর এবং তীব্র এই আবেগ—যা সংসারের শান্ত নিয়ম, দৈনন্দিন জীবনের দায়িত্ব, এবং সামাজিক বাধার ভেতর চাপা পড়ে ছিল। কলমের প্রতিটি স্পর্শে তার মন কিছুটা মুক্ত হয়, যেন ভেতরের ঝড়ের চাপ কমছে। ডায়েরির পাতায় লেখা শব্দগুলো তার মনে এক অদৃশ্য সংলাপ তৈরি করে—যা সে কখনো মুখে বলতে পারত না। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেন তার নিজস্ব আত্মার আভাস, যা শুধু কলম এবং কাগজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

রাত গভীর হতে হতে ঘরের নিরবতা ঘিরে ধরে। অনিন্দিতা ডায়েরি বন্ধ করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিন্তু মনে মনে ঝড় এখনও থামেনি। আবেগ, আগ্রহ, নস্টালজিয়া—সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে পড়ে। স্বামী পাশে বসে টিভি দেখে, সংসারের ছোট ছোট কাজ চলছে, কিন্তু তার মন আর তার হৃদয় অন্য কোথাও। সে বুঝতে পারে, এই অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা একদিন তাকে নতুন সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ঝড়ের মতো আবেগ, যা দীর্ঘদিন ভেতরে জমে ছিল, আজ এক অপ্রত্যাশিত সন্ধ্যার অভিজ্ঞতায় ভেঙে পড়েছে। অনিন্দিতা গভীরভাবে উপলব্ধি করে যে, এই গোপন ঝড়ের প্রভাবে তার জীবন আর আগের মতো শান্ত থাকবেনা; অতীতের স্মৃতি, প্রাক্তন প্রেম, এবং নিজের অপ্রকাশিত আবেগ তার ভেতরে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে, যা হয়তো ধীরে ধীরে জীবনের নতুন অধ্যায় খুলে দেবে।

সোমবারের বিকেল, অনিন্দিতা ঘরে বসে কফির কাপ হাতে ডায়েরি ফেরত পড়ছিল, তখন ফোনের স্ক্রিনে দেখা গেল অজানা নাম: সৌমেন। তার হৃৎপিন্ত দ্রুত গতিতে কম্পিত হল, যেন অচেনা আগুনে ছুঁয়ে যাচ্ছে। প্রথমে সে দ্বিধাগ্রস্ত, ফোন ধরবার আগে হাত থমকে গেল, মনে মনে নানা ভাবনা কাজ করতে লাগল—‘কেন এত বছর পরে?’, ‘আমার জীবনে কি এটি ঠিক?’। কিন্তু তীক্ষ্ণ কৌতূহল এবং সেই নীরব আকর্ষণ অবশেষে তাকে ফোন ধরতে বাধ্য করল। ‘হ্যালো… অনিন্দিতা?’ সৌমেনের কণ্ঠে সেই পুরনো কোমলতা, একটু নরম, কিন্তু একইসাথে অদ্ভুত উত্তেজনা। প্রথম কয়েক মুহূর্ত নীরবতার, ছোট্ট হাসি এবং হালকা ভ্রমণে কেটে যায়, যেন এক অদ্ভুত সেতু তৈরি হচ্ছে অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে। অনিন্দিতার মনে হলো, এই কণ্ঠই যেন তাকে দিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলিয়ে দিতে পারছে, আবারও সেই ছাত্রজীবনের মধুর, নিরীহ আকর্ষণে ফিরিয়ে দিচ্ছে।

প্রথম কয়েক ফোন কলের পর, তারা ধীরে ধীরে নিয়মিত কথা বলা শুরু করে। সকাল-বিকেল, অফিসের বিরতি বা রাতের একাকী মুহূর্তগুলো—সবখানে ছোট্ট ফোন কলের ছায়া ঘন হতে থাকে। কথার মধ্যে শুরু হয় ছোটখাটো হাসি, স্মৃতিচারণ, সেই নাটকের দিনগুলো, কলেজের প্রিয় গান, আর কখনও কখনও এক অদ্ভুত সঙ্গমের ইঙ্গিত। প্রতিটি কল যেন একটি ধীরে ধীরে জমে ওঠা আবেগের নদী, যা প্রথমে ছোট, শান্ত, তারপর গভীর হয়ে ওঠে। অনিন্দিতা লক্ষ্য করে, কথোপকথনের মধ্যে সৌমেনের হালকা টোন, হাসির আভাস, এবং মাঝেমধ্যেই ছলনা-মিশ্রিত উত্তেজনা তার নিজের হৃদয়কে অস্থির করে তুলছে। প্রতিটি কথায় আছে অপ্রকাশিত আকর্ষণ, অদ্ভুত রোম্যান্সের ঝিলিক। অনিন্দিতা বুঝতে পারে, এই কলগুলো শুধু কথার বিনিময় নয়—এটি তাদের মনের মধ্যে পুনঃসংযোগ, যেখানে বছরের পুরনো অনুভূতি আজও তীব্র এবং সতেজ।

এক মাসের মধ্যে তাদের ফোন কলের সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা পায়। সাধারণ আলাপ, দিনের ছোট খবরে শুরু, ধীরে ধীরে রাতের গভীর চুপচাপ মুহূর্তে পৌঁছে, যেখানে তারা একে অপরের অনুভূতি, চিন্তা, এবং গোপন আকাঙ্ক্ষা ভাগ করে নেয়। অনিন্দিতা প্রায়শই নিজেকে এমন অবস্থায় খুঁজে পায়, যেখানে কলের সময় তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হয়, শরীর অজান্তেই উত্তেজিত হয়, এবং মুখে এক অদ্ভুত হালকা হাসি। সৌমেনও নিজের দিক থেকে একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়—হালকা কণ্ঠস্বর, ক্ষুদ্র বিরাম, ছোট্ট হাসির আভাস, সবই যেন এক ধরণের নীরব কামনার সংকেত। প্রতিটি ফোন কলের পরে অনিন্দিতা গভীরভাবে অনুভব করে যে, এই গোপন সুর, এই ক্ষুদ্র প্রতিশ্রুতি, এবং এই অদৃশ্য বন্ধন তার জীবনের স্থির ছন্দকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করছে। সংসার, সামাজিক নিয়ম, দায়িত্ব—সবকিছু যেন পেছনে চলে যাচ্ছে, আর তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন, অদৃশ্য, কিন্তু তীব্র আবেগের জগৎ। প্রতিটি ফোন কল এখন শুধু কথোপকথন নয়; এটি একটি নীরব যাত্রা, যেখানে অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের আকর্ষণ, এবং ভবিষ্যতের অদৃশ্য কামনা একত্রিত হয়ে তার ভেতরে ঝড় তুলছে।

এক সন্ধ্যায়, শহরের আলো-আঁধারিতে অনিন্দিতা এবং সৌমেন আবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। দিনের ক্লান্তি, অফিসের চাপ, সংসারের দায়িত্ব সবকিছু কিছুক্ষণ পেছনে রেখে তারা দুজনেই এক অদ্ভুত উত্তেজনা নিয়ে ক্যাফেতে পৌঁছায়। প্রথমে সাধারণ কফির কাপ, ছোট্ট আড্ডা, কিন্তু চোখের চাওয়া আর নীরব স্পর্শ যেন আগের মতোই তীব্র। কথোপকথন মাঝে মাঝে থেমে যায়, শুধু চোখের মাধ্যমে বোঝাপড়া, হালকা হাসি, আর নিঃশব্দ আবেগের আদান-প্রদান হয়। কিন্তু আজকের রাত একটু ভিন্ন—যেমনটা তারা কলেজের দিনগুলোর স্মৃতিতে অনুভব করত। অনিন্দিতা মনে করে, এই মুহূর্তগুলো যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে পুরোনো আবেগ, দীর্ঘদিন দমিয়ে রাখা কামনা, এবং নীরব আকর্ষণ একত্রিত হয়ে তাদের মধ্যে গভীর কম্পন সৃষ্টি করছে। কফির গরম কাপ, ধোঁয়া ওঠা বাতাস, এবং শহরের দূর থেকে আসা ট্রাফিকের হালকা আওয়াজ—সবই যেন তাদের এক অদৃশ্য সেতুতে বেঁধে দিচ্ছে।

কথা শেষ করার পর তারা গাড়িতে বসে শহরের নির্জন রাস্তায় ঘুরতে বের হয়। গাড়ি ধীরগতিতে চলতে থাকে, এবং কলকাতার আলো-আঁধারিতে পুরনো প্রেমের ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। রাস্তার পাশের হালকা বাতির নরম সোনালি ছায়া, দূরের ট্রাফিক লাইটের লাল-সবুজ ঝলক, আর বাতাসের সঙ্গে হাওয়ায় ভেসে আসা পুরোনো দিনের গান—সবই তাদের অনুভূতিকে তীব্র করে। অনিন্দিতা এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করে, মনে মনে নিজের ভিতরের আবেগকে ছেড়ে দিতে চায়, কিন্তু সামাজি নিয়ম এবং স্বামীর অবস্থান তাকে সাময়িক থামিয়ে রাখে। সৌমেনও একইভাবে—চোখে অদৃশ্য তীব্র আকর্ষণ, মাঝে মাঝে হালকা হাসি, আর হাতে হালকা স্পর্শ। তারা শুধু কথা বলছে না, বরং একে অপরের নীরব উপস্থিতি, চোখের খোঁচা, এবং নিঃশব্দ সংযোগে মুগ্ধ। শহরের বাতাস যেন তাদের আবেগকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে, এবং গাড়ির চলার সঙ্গে সঙ্গে অতীত এবং বর্তমানের অনুভূতি একত্রিত হচ্ছে।

রাত গভীর হতে হতে, তারা হঠাৎ একটি সরু সড়কে থামল। গাড়ির হেডলাইটের হালকা আলো তাদের মুখকে আলোকিত করছে, এবং এক অদ্ভুত নীরবতা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। অনিন্দিতা লক্ষ্য করে, তার হৃদয় অস্থির, উত্তেজিত, আর এক ধরণের অপ্রকাশিত কামনা জাগ্রত। সৌমেনের চোখে আগের মতোই সেই গভীর আকর্ষণ, আর মাঝে মাঝে হালকা টান, যা শুধু চোখের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, বলতে চায় অনেক কিছু, কিন্তু একসাথে নিরবতা উপভোগ করে। শহরের দূরের শব্দ, গাড়ির হালকা ঝাঁকুনি, এবং বাতাসের গন্ধ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রোম্যান্সের পরিবেশ সৃষ্টি করে। অনিন্দিতা বুঝতে পারে, এই রাত, এই মুহূর্ত, আর এই শহরের আলো-আঁধারি যেন পুরোনো প্রেমকে আবার জীবন্ত করে তুলেছে। কলকাতার সেই নির্জন রাস্তা, যেখানে তারা শুধু একে অপরের চোখে চোখ রাখে, কথার বাইরে অনুভূতি ভাগ করে, আর হালকা স্পর্শে অদৃশ্য কামনার ইঙ্গিত দেয়—সবই তাদের আবেগকে আরও ঘন এবং তীব্র করে তোলে। এই রাতের দেখা, এই গাড়ির নীরব যাত্রা, যেন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে পুরোনো প্রেম এবং গোপন আবেগ আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে, এবং তাদের মনে এক অদৃশ্য, কিন্তু গভীর সংযোগ তৈরি করে।

গাড়ি শহরের নির্জন রাস্তায় ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, কিন্তু ভিতরে যে নীরবতা বিরাজ করছে, তা যেন সময়ের সাথে স্থির হয়ে গেছে। অনিন্দিতা হাত ধরে কফির কাপ রাখা, কিন্তু চোখ হঠাৎ সৌমেনের দিকে ফিরে যায়। তার হৃদয় এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ধুকপুক করছে, আর মনে মনে সে জানে—আজকের রাত অন্য যে কোনো রাতের মতো নয়। দীর্ঘক্ষণ নীরবতার পরে, সৌমেন হালকা কণ্ঠে বলে, “অনিন্দিতা… তোমার সঙ্গে আবার কথা বলার পর, মনে হচ্ছে কিছুটা স্বস্তি পাই। কলেজের সেই সবদিনগুলো… কেমন যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে।” অনিন্দিতার চোখে অদ্ভুত রঙের ঝিলিক, এবং ধীরে ধীরে হালকা হাসি ফুটে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে তাদের মধ্যে যে উত্তেজনা জমে আছে, তা আর দমন করা যায় না; চোখের ভাষা, নিঃশব্দ হাসি, আর হালকা শ্বাসপ্রশ্বাস—সবই এক ধরনের অদৃশ্য সংযোগের বার্তা বহন করছে।

সৌমেনের কথার পর, অনিন্দিতা ধীরে ধীরে তার নিজের ভেতরের আবেগ প্রকাশ করতে শুরু করে। “আমি… আজও মনে করি, সেই কলেজের দিনগুলোর ভালোবাসা শুধু সময়ের মধ্যে হারায়নি। তা এখনও বেঁচে আছে। শুধু আমি কখনো কাউকে বলিনি।” শব্দগুলো গায়ে লাগা কুয়াশার মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায়। সৌমেনও তার দিকে তাকিয়ে একইভাবে স্বীকার করে, “আমিও। সেই সময়ের অনুভূতি, যে আনন্দ আর উত্তেজনা আমরা কখনো প্রকাশ করতে পারিনি, তা এখনও আমার ভেতরে আছে।” দুজনের চোখ একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে, এবং সেই চোখের দৃষ্টিতেই প্রকাশ পায় দীর্ঘদিনের গোপন কামনা। নীরবতা আর উপস্থিতির মধ্যেই যেন এক অদ্ভুত উত্তেজনা জাগে, যা কথার চেয়ে গভীর। তাদের হাত হালকাভাবে ছুঁয়ে যায়, কিন্তু শব্দের প্রয়োজন নেই—চোখের ভাষাই যথেষ্ট।

রাত গভীর হতে হতে শহরের বাতি ধীরে ধীরে আলো-আঁধারির খেলা চালায়, আর গাড়ির নরম আলো তাদের মুখকে মৃদু আলোকিত করে। অনিন্দিতা এবং সৌমেন একে অপরের চোখে তাকিয়ে অনুভব করে, যে এই মুহূর্তে তাদের অনুভূতি আর নিয়ম, সমাজ, বা দায়িত্ব দ্বারা বাঁধা নেই। তারা এক অদ্ভুত শান্তি এবং উত্তেজনার সংমিশ্রণে হারিয়ে যায়, যেখানে প্রতিটি দৃষ্টিপাত, প্রতিটি নিঃশ্বাস, আর প্রতিটি মৃদু স্পর্শ একটি অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি বহন করে। কলেজের সেই নীরব ভালোবাসা আজকের রাতের আলো-আঁধারিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে, এবং তারা দুজনেই বুঝতে পারে, যা কখনো বলা যায়নি, আজ তা চোখের ভাষা এবং নীরব সংযোগের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই অপ্রকাশিত স্বীকারোক্তি, এই গোপন আবেগ, তাদের মধ্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে—যেখানে পুরোনো প্রেম, দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা কামনা, এবং নিঃশব্দ আবেগ একত্রিত হয়ে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করে, যা এখন শুধুই তাদের।

শহরের নির্জন এক পার্কিং স্পটে গাড়ি থেমে যায়। বাইরে কেবল দূরের বাতির হালকা ঝলক এবং সামান্য ট্রাফিকের দূরবর্তী শব্দ ভেসে আসে। গাড়ির ভিতরে অনিন্দিতা এবং সৌমেনের নিঃশব্দ উত্তেজনা যেন স্থির হয়ে গেছে। চোখে চোখ রেখে তারা একে অপরের দিকে তাকায়, আর দীর্ঘ সময় ধরে চেপে রাখা আবেগ ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। অনিন্দিতার হাত অজান্তেই সৌমেনের দিকে এগোয়, আর সৌমেনও হালকা স্পর্শের জন্য অপেক্ষা করে। প্রথমে তা শুধু হাতের নরম ছোঁয়া, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তা গভীর এবং তীব্র হয়ে ওঠে। অন্ধকার এবং পার্কিং স্পটের নির্জনতা যেন তাদের সাহস যোগায়, যেখানে কোনো চোখ নেই, কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই—শুধু দু’জনের মধ্যে জন্ম নেওয়া গোপন আবেগ।

ছোঁয়া থেকে শুরু হওয়া উত্তেজনা ক্রমশ বিস্ফোরণের আকার নেয়। অনিন্দিতার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হয়, শরীর অজান্তেই উত্তেজিত হয়, আর সৌমেনের কণ্ঠে হালকা শ্বাসফাসের মতো শব্দ বেরোতে থাকে। তারা বুঝতে পারে, এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে শুধুই এক গভীর আকর্ষণ, দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা কামনা এবং নীরব ভালোবাসা—কথার প্রয়োজন নেই। হাতের ছোঁয়া, গালে হালকা স্পর্শ, এবং মাঝে মাঝে নিঃশব্দ হেসে ওঠা—সবই তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সংযোগ তৈরি করে। অনিন্দিতা অনুভব করে, এই স্পর্শ শুধু শারীরিক নয়; এটি তার ভিতরের অনুভূতি, দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা আবেগ, এবং অতীতের ভালোবাসাকে প্রকাশ করছে। সৌমেনও একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, চোখে আগের মতোই সেই গভীর আকর্ষণ, আর শরীরে সেই অদ্ভুত উত্তেজনা।

রাতের নিস্তব্ধতা, গাড়ির ভিতরের নরম আলো, এবং দূরের দূরের বাতি—সবই এই নিষিদ্ধ স্পর্শের দৃশ্যকে আরও ঘন এবং তীব্র করে তোলে। অনিন্দিতা এবং সৌমেন একে অপরের সঙ্গে হারিয়ে যায়, যেখানে সময়, শহর, সমাজ—সবকিছু দূরে। এক রাতের এই গোপন স্পর্শ তাদের মধ্যে বহু বছরের চেপে রাখা কামনাকে মুক্ত করে দেয়। প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি চাহনি যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তারা বুঝতে পারে, এই রাতের অভিজ্ঞতা শুধু একটি মুহূর্ত নয়; এটি তাদের মধ্যে এমন একটি গভীর সংযোগ তৈরি করেছে, যা আর কখনো আগে কখনো তারা অনুভব করেনি। নিষিদ্ধ স্পর্শের এই রাত, শহরের নির্জন পার্কিং স্পটে, তাদের আবেগ, আকর্ষণ, এবং কামনার এক একান্ত প্রকাশ হিসেবে জীবন্ত হয়ে ওঠে, যা তারা দু’জনেই চুপচাপ হৃদয়ে ধরে রাখে।

সকালের আলো ঘরের জানালার কাঁচ দিয়ে ধীরে ধীরে ভেসে আসে, আর অনিন্দিতার চোখ কুসুমভরে খুলে যায়। রাতের স্মৃতিগুলো এখন ঘরের চারপাশে একটি অদৃশ্য চাপের মতো চাপা পড়েছে। সৌমেনের সাথে পার্কিং স্পটে ঘটে যাওয়া নিষিদ্ধ স্পর্শের অনুভূতি এখনও তার শরীর ও মনে কম্পিত হচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আসে তীব্র অপরাধবোধ। স্বামী, সন্তান, সংসারের নিয়ম—সবই তার মনে এসে ভেঙে পড়ে, যেন একটি কঠিন সেতু তার হৃদয়ের ওপর গড়ে ওঠেছে। হৃদয় বলে—যা ঘটেছে তা ভুল, কিন্তু মনের গভীর অংশ জানে যে, এটি শুধু ভুল নয়; এটি তার চুপচাপ আবেগ এবং দীর্ঘদিন ধরে দমিয়ে রাখা কামনার প্রকাশ। অনিন্দিতা মৃদু শ্বাস ফেলে, নিজের হাতগুলো ধীরে ধীরে বুকের কাছে চেপে ধরে, যেন নিজেকে শান্ত করতে চায়। চোখ বন্ধ করে সে মনে মনে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে, “সবকিছু ঠিক আছে, এটা শুধু অনুভূতির স্বীকৃতি।”

কিন্তু সকালকে অস্বীকার করা যায় না। রান্নাঘর থেকে আসা শিশুর কোলাহল, স্বামীর নরম কণ্ঠে ‘সুপ্রভাত’—সবই তার মনে অপরাধের বোঝা চাপাচ্ছে। অনিন্দিতা নিজেকে প্রশ্ন করে, “আমি কি ঠিক করছি? কি আমি সঠিক পথে আছি?” প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়, তার ভালোবাসা এবং কামনা এখন শুধুই নিজের একান্ত, গোপন অভিজ্ঞতা, যা সংসারকে কোনোভাবেই ক্ষতি করতে চায় না। ডায়েরি খোলা, কলম ধরে লেখা—সবকিছু আবার সেই গভীর আবেগের সঙ্গে সংযুক্ত। সে বুঝতে পারে যে, এই আবেগ এবং কামনা তার অস্তিত্বের অঙ্গ, যা তাকে সম্পূর্ণ করে। অথচ সমাজ, দায়িত্ব, এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তাকে অন্যরকম চাপ দিয়ে দিচ্ছে, যা এই অনুভূতিকে গ্রহণ করা কঠিন করে তোলে। এই দ্বন্দ্ব তাকে ঘিরে রাখে, এবং প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস যেন তাকে অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে টানছে।

দিন এগোতে থাকে, কিন্তু অনিন্দিতার মন এখন এক অদৃশ্য সংঘাতের মধ্যে বন্দী। অফিসের কাজ, পরিবারের যত্ন, স্বামী এবং সন্তানের সঙ্গে সাধারণ কথোপকথন—সবকিছুই আজ তার মনে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু ভেতরে জানে, যা ঘটেছে তা কেবল প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের একটি অপ্রকাশিত অধ্যায়, যা তাকে তার সত্যিকারের আবেগের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। অপরাধবোধ এবং মুক্তির এই দ্বন্দ্ব তাকে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করে—যে নিজেকে অল্পক্ষণের জন্য হলেও সত্যিকারের অনুভূতির কাছে নিয়েছিল, তা কখনো ভুল নয়, বরং তার অস্তিত্বের স্বীকৃতি। অনিন্দিতা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, এই অভ্যন্তরীণ যাত্রা তাকে তার নিজের গভীরতা, কামনা এবং অনুভূতির সঙ্গে এক নতুন মাত্রায় পরিচয় করিয়েছে। অপরাধবোধ থাকলেও, সঙ্গে আছে সেই অদৃশ্য, গভীর প্রশান্তি—যা তাকে জানিয়ে দেয়, নিজের অনুভূতিকে বুঝতে পারা, কখনো কখনো নিষিদ্ধ হলেও, তার মানবিক জীবনের অংশ।

সৌমেনের মনে এক অদ্ভুত টান, এক অমোঘ আকর্ষণ বিরাজ করছে, কিন্তু সাথে আছে গভীর দ্বিধা। অনিন্দিতার সঙ্গে রাতের সেই গোপন অভিজ্ঞতা এবং দিনের ফোনালাপের উত্তেজনা তার মনে এক অদৃশ্য জটিলতা তৈরি করেছে। সে জানে, অনিন্দিতা তার জীবনের অংশ, এবং সে কখনো তাকে হারাতে চায় না। কিন্তু সঙ্গে রয়েছে অন্য একটি চিন্তা—কীভাবে তাদের সম্পর্ক এই মুহূর্তে সীমার মধ্যে রাখা যায়, যেন কাউকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে না হয়। কাজের ব্যস্ততা, সমাজের নিয়ম, অনিন্দিতার পরিবারের উপস্থিতি—সবকিছু তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সৌমেনের জন্য এই দ্বিধা শুধু একটি নৈতিক দুশ্চিন্তা নয়, বরং হৃদয়ের গভীর আবেগের প্রতিফলন, যেখানে সে চাইছে যে, এই সম্পর্কের উত্তেজনা এবং কামনা যেন অনিন্দিতার জীবনের নিয়ম এবং দায়িত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। সেই রাতের নিষিদ্ধ স্পর্শ এবং চোখের ভাষা তার মনের মধ্যে একটি জ্বলন্ত স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে, যা সে কখনো ভুলতে পারে না।

ফোনালাপের সময় সৌমেন লক্ষ্য করে, অনিন্দিতার কণ্ঠে অদ্ভুত নরমতা, কিন্তু মাঝে মাঝে হালকা দ্বিধা। সে নিজেও অনুভব করে, যে তাদের কথোপকথনগুলো আজ আগের মতো সহজ এবং আনন্দময় নয়—একটি অদৃশ্য চাপ, ভয়ের ছায়া এবং দ্বিধা ভেসে আসে। প্রথম কয়েকবার ফোনে কথা বলার সময় সে খুব সরলভাবে অনুভব করেছিল যে, এই মুহূর্তগুলো শুধু আনন্দ এবং উত্তেজনা বহন করছে, কিন্তু এখন তা আর শুধুই তেমন নয়। সে ভাবতে থাকে, কিভাবে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, যাতে তারা দুজনেই নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। প্রতিটি কলের মাঝে সৌমেন নীরবভাবে নিজের অবস্থান যাচাই করে, এবং অনুভব করে যে, যে আনন্দ এবং উত্তেজনা এক সময় এত সহজ ছিল, এখন তা একটি সূক্ষ্ম, নীরব দ্বন্দ্বের মধ্যে ঢেকে গেছে। অনিন্দিতার প্রতি আকর্ষণ তীব্র, কিন্তু দ্বিধার কারণে প্রতিটি কথা, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি বিরাম—সবই আরও মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হয়।

দিনের বাকি সময়ে সৌমেন নিজের মধ্যে এক অদৃশ্য যুদ্ধ অনুভব করে। অনিন্দিতা তার জীবনের অংশ, কিন্তু তার সুখ এবং নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সে জানে, যদি আবেগের ভেতর অতিরিক্ত ঝুঁকি নেয়, তবে অনিন্দিতার সংসার এবং সামাজিক জীবনের জন্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। সেই দ্বিধা তাকে এক ধরনের নীরবতার মধ্যে আবদ্ধ করে, যেখানে ফোনালাপগুলো হঠাৎ কমে যায়, কথার বিরাম দীর্ঘ হয়, আর প্রতিটি মৃদু হাসি এবং নিঃশব্দ বোঝাপড়া নতুন মানে পায়। সৌমেন বুঝতে পারে, আবেগ এবং আকর্ষণ, যতই তীব্র হোক না কেন, কখনো কখনো নীরবতা এবং সীমারেখা প্রয়োজন, যা তাকে এবং অনিন্দিতাকে উভয়কে নিরাপদ রাখবে। এই দ্বিধা, ভয়ের ছায়া এবং নীরবতা তাদের সম্পর্কের নতুন এক মাত্রা যোগ করে—যেখানে শুধু আবেগ নয়, সচেতনতা, দায়িত্ব এবং দু’জনের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সমঝোতার চাহিদা সমানভাবে বজায় থাকে।

১০

শহরের আলো-আঁধারিতে অনিন্দিতা এবং সৌমেন আবার দেখা করার জন্য একটি নির্জন ক্যাফের বাইরে মিলিত হয়। আজকের রাতটি ভিন্ন—নীরবতা, উত্তেজনা এবং দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা আবেগের মিশ্রণে গড়ে ওঠা উত্তেজনা তাদের ভেতর অদ্ভুতভাবে তীব্র। গাড়িতে বসে তারা শহরের ধীরে চলা রাস্তা ধরে যাত্রা শুরু করে, যেখানে বাতি-ঝলক এবং ট্রাফিকের দূরের শব্দ সবকিছু যেন এক অদৃশ্য চলচ্চিত্রের দৃশ্য। চোখে চোখ রেখে তারা নীরবভাবে একে অপরের উপস্থিতি অনুভব করে। গত কয়েক সপ্তাহের ফোনালাপ, রাতের গোপন দেখা, এবং একে অপরের প্রতি তাদের অপ্রকাশিত আকর্ষণ—সবই আজকের রাতকে অন্যরকম করে তুলেছে। অনিন্দিতা বুঝতে পারে, এই সম্পর্ক সামাজিক নিয়ম, সংসার এবং নৈতিকতার সীমারেখার বাইরে। কিন্তু ভেতরে সেই আবেগ এত তীব্র, এত সত্য, যে তাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। সৌমেনও একইভাবে অনুভব করছে—এই সম্পর্ক নিষিদ্ধ, কিন্তু এটিই তার জীবনের একমাত্র সত্যিকারের প্রেম।

গাড়ির ভিতরে ভেজা কাচের মধ্যে নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, এবং কাচের ওপর জমে থাকা শিশিরের মধ্যে তাদের নিঃশ্বাসের চিহ্ন আঁকা হচ্ছে। অনিন্দিতা ধীরে ধীরে তার আঙুল দিয়ে কাচে লিখে যায়—“আমরা আজও বেঁচে আছি।” সৌমেনের চোখে অদ্ভুত দীপ্তি, আর মনে মনে সে জানে, এই মুহূর্তে শুধু আবেগই নয়, বরং এক গভীর সংযোগ, দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা কামনা এবং একে অপরের প্রতি নিষিদ্ধ ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে। গাড়ির ভিতরের নীরবতা, শহরের বৃষ্টিধারা এবং কেবল দু’জনের মধ্যে থাকা বোঝাপড়া—সবই এক অদৃশ্য পর্দার মতো তাদের আবেগকে ঢেকে রাখছে। অনিন্দিতা বুঝতে পারে, এই রাত শুধু একটি শেষ দেখা নয়; এটি একটি স্বীকৃতি, যেখানে তারা স্বীকার করে যে, যত নিষিদ্ধ হোক না কেন, এই সম্পর্ক তাদের জীবনের একমাত্র সত্য।

নিশ্চল রাতের মাঝে তারা একে অপরের চোখে চোখ রেখে বুঝতে পারে যে, সীমারেখা, সামাজিক নিয়ম, এবং দায়িত্ব—সবকিছু থাকার পরেও এই আবেগ তাদের মধ্যে স্থায়ী। গাড়ির হালকা দোলা, বাতাসে ভেসে আসা গন্ধ, কাচের শিশিরে লেখা বার্তা—সবই একটি অদ্ভুত চূড়ান্ত মুহূর্ত তৈরি করে, যা তাদের কাছে শেষ রাতের মতো মনে হচ্ছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটি হয়তো নতুন যাত্রার সূচনা। অনিন্দিতা আর সৌমেন দুজনই জানে, এই নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যেই রয়েছে তাদের প্রকৃত অনুভূতি, যা সময় বা পরিস্থিতি কোনোভাবেই পরিবর্তন করতে পারবে না। গল্প শেষ হয় খোলা প্রশ্নে—এই রাত কি সত্যিই শেষ, নাকি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে তারা নিজেদের আবেগ এবং প্রেমের সত্যিকারের পরিচয় জানে এবং স্বীকার করেছে? এই প্রশ্নই গল্পের মধ্যে একটি স্থির এবং রহস্যময় ভাব রেখে যায়, যেখানে পাঠকই সিদ্ধান্ত নেবে—এটা শেষ নাকি নতুন শুরু।

***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *