প্রতীক দত্ত
অরিন্দম সেনের জীবনের দিনযাপন ছিল সুশৃঙ্খল, নিয়মমাফিক ও দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ এক সংসারের ছবি। সকালবেলা তার ঘুম ভাঙত অ্যালার্ম ঘড়ির একঘেয়ে শব্দে, তারপর দাঁত ব্রাশ, চায়ের কাপ, অফিসের ফাইল আর প্রতিদিনের সেই একই রুটিন। স্ত্রী স্নিগ্ধা যত্নে তার সকালের নাশতা তৈরি করত, সন্তান স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিত, আর ঘরজুড়ে যেন সবকিছু সুন্দর ছন্দে চলছিল। বাইরের চোখে অরিন্দম ছিল এক আদর্শ স্বামী ও দায়িত্বশীল বাবা। অফিসে সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য, আর পাড়াপড়শির চোখে এক স্থির-স্বভাবের মানুষ। কিন্তু এই নির্দোষ ছবির ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক অদৃশ্য ক্লান্তি, যা কাউকে জানানোর উপায় ছিল না। প্রতিদিন ঘরে ফেরার পর তিনি দেখতেন টিভির শব্দ, ছেলের হোমওয়ার্ক, স্ত্রীর রান্নাঘরের ব্যস্ততা—সবকিছুই যেন কোনো সাজানো নাটকের মতো, যেখানে তার নিজের কোনো আবেগ বা নতুনত্বের জায়গা নেই। সংসারের এই যান্ত্রিকতা তার ভেতরের উচ্ছ্বাসকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল। অরিন্দম বুঝতে পারছিল, জীবন তাকে বেঁধে রেখেছে দায়িত্বের শৃঙ্খলে, যেখানে তার হাসি কিংবা কান্না, স্বপ্ন কিংবা ভয়—কোনোটিরই আর আলাদা অস্তিত্ব নেই।
অন্যদিকে, রূপসা মিত্রের জীবনও ছিল বাইরের চোখে বেশ স্থিতিশীল। কলেজে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রভাষক, ছাত্রছাত্রীদের প্রিয়, বন্ধুমহলে প্রাণবন্ত। ক্লাসে কবিতা পাঠ করার সময় তার চোখে ঝিলিক ধরা পড়ত, অথচ ভেতরে তিনি জানতেন সেই ঝিলিক কেবল বাহ্যিক। তার স্বামী অরূপ ব্যস্ত ব্যবসায়ী, সবসময় ভ্রমণে, ফোন আর ইমেইলের দুনিয়ায় আবদ্ধ। সংসারে রূপসার প্রতি তার দায়িত্ব ছিল নির্দোষ, কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশে সে ছিল দুর্বল। বিয়ের প্রথম দিকের উষ্ণতা অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে, এখন কেবল সংসারের চালচিত্রটুকুই বাকি। রূপসা সন্ধ্যায় জানালার পাশে বসে কখনো বই পড়ত, কখনো খালি চেয়ে থাকত পদ্মার মতো বিস্তৃত শূন্যতায়। মনে হতো, জীবনের সবকিছু যেন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে—হাসি নেই, আনন্দ নেই, এমনকি দুঃখও নেই, আছে কেবল ফাঁকা এক নিঃসঙ্গতা। তার মনে হতো, সে যেন কেবলই স্ত্রী আর দায়িত্বশীল গৃহিণী, কিন্তু নারী হিসেবে তার যে আবেগ, যে আকাঙ্ক্ষা, যে গভীর ভালোবাসার চাহিদা—সেগুলো কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ধীরে ধীরে সে নিজের আবেগকে কবিতার লাইনে, ডায়েরির পাতায় আর নিস্তব্ধ রাতের নির্জনতায় চাপা দিতে শিখে নিয়েছিল।
অরিন্দম ও রূপসা—দুজনেই দুই ভিন্ন ঘরে বসে একই অভিজ্ঞতার ভারে নত হচ্ছিল। একে অপরকে চিনত না, তবুও তাদের ভেতরের নিঃশব্দ শূন্যতা যেন অদৃশ্য সুতোয় জড়িয়ে ছিল। বাইরের চোখে তারা দুজনেই ছিল সফল, দায়িত্বশীল ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। অথচ মনের গভীরে ছিল এক অসম্পূর্ণতার হাহাকার, যা কেবল তারাই বুঝতে পারত। সংসারের বাঁধনে তারা আটকানো, মুক্তির কোনো উপায় ছিল না, তবুও কোথাও যেন দুজনের জীবন সমান্তরালভাবে একই অনুভূতি বয়ে নিয়ে চলছিল। এই অধ্যায় যেন তাদের জীবনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, যেখানে দায়িত্ব আর বাস্তবতার মাঝখানে লুকিয়ে থাকে এক অদৃশ্য শূন্যতা। সেই শূন্যতাই ধীরে ধীরে তাদেরকে টেনে নেবে এক অপ্রত্যাশিত পথে—যেখানে নিষিদ্ধ হলেও প্রেম হবে একমাত্র সত্যি।
–
সেই দিনটিতে শহরের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বরে ছিল এক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন। অরিন্দম অফিসের রুটিন ভেঙে বিশেষ করে এসেছিল—বই আর কবিতার প্রতি তার গোপন ভালোবাসা তাকে এখানে টেনে এনেছিল। ভিড়ভাট্টার মধ্যে সে এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পেল, যেন অনেকদিন পর শ্বাস নেওয়ার মতো জায়গা পেয়েছে। চারদিকে কবি, লেখক আর সাহিত্যপ্রেমীদের ভিড়; স্টলে সাজানো নতুন বইয়ের গন্ধে ভেসে আসছিল এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস। অরিন্দম মানুষের ভিড়ের ভেতরেও নিঃসঙ্গভাবে হাঁটছিল, বইয়ের পাতায় ডুবে থাকার চেষ্টা করছিল। ঠিক তখনই এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা রূপসাকে তার চোখে পড়ে। রূপসা তার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে হাসি-আড্ডায় মগ্ন ছিল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে অরিন্দম যেন এক চাপা ক্লান্তির রেখা খুঁজে পেল। তাদের চোখ হঠাৎ করেই এক মুহূর্তের জন্য মিলিত হয়—না কোনো পূর্বপরিচয়, না কোনো শব্দ—তবুও দুজনেই অদ্ভুত এক অস্বস্তি অনুভব করে। অরিন্দমের মনে হলো, এই অপরিচিত নারীও কি তার মতোই নিঃশব্দ শূন্যতায় ভুগছে?
পরিচয়ের সূত্রপাত হয় বই নিয়ে আলোচনার ভেতর দিয়ে। রূপসা হাতে নিয়ে ছিল জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি সংকলন, আর অরিন্দম তাকিয়ে বলেছিল—“এই বইটা আমারও খুব প্রিয়।” এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। মুহূর্তেই কথোপকথন শুরু হয়ে যায়। তারা কথা বলতে থাকে কবিতার প্রতিচ্ছবি, শব্দের অন্তরালে লুকোনো যন্ত্রণার গল্প আর সাহিত্যের মুক্তির শক্তি নিয়ে। অরিন্দম অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, কত সহজে রূপসা তার মনের অব্যক্ত কথা বলে ফেলছে, যেন তাদের দীর্ঘদিনের পরিচয়। রূপসাও অনুভব করে, এই অপরিচিত মানুষটি তার কথার গভীরতা সত্যিই বোঝে। হাসি-ঠাট্টার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক নিঃশব্দ আকর্ষণ তারা দুজনেই টের পায়, যা শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় না। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে দুজনেই অস্বস্তি অনুভব করছিল—এভাবে কথা বলা কি ঠিক হচ্ছে? অথচ থেমে যাওয়া অসম্ভব। অরিন্দমের চোখে ঝলক দিচ্ছিল সেই হারিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাস, আর রূপসার কণ্ঠে ভেসে আসছিল এক চেপে রাখা আবেগের স্রোত। তারা দুজনেই বুঝতে শুরু করল, এই আকস্মিক আলাপ নিছক সৌজন্য নয়—এর ভেতরে আছে এক অদৃশ্য টান।
সম্মেলনের কোলাহলের মাঝেও তাদের চারপাশ যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্যরা বই কিনছিল, বক্তৃতা শুনছিল, ছবি তুলছিল, অথচ অরিন্দম আর রূপসার জন্য সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। অরিন্দম রূপসার হাসিতে খুঁজে পেল সেই আলো, যা তার সংসারে অনেকদিন ধরেই অনুপস্থিত। রূপসা অরিন্দমের চোখে দেখতে পেল এক ধরনের সহমর্মিতা, যা তার স্বামীর ব্যস্ত জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব কাজ করছিল—তারা জানত, এই আলাপ হয়তো সামাজিক দৃষ্টিতে খুব সাধারণ, কিন্তু তাদের মনের ভেতরে অন্য এক স্রোত বইতে শুরু করেছে। বিদায়ের মুহূর্তে তারা নম্বর বিনিময় করে নিল, যদিও দুজনেই ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল। কেউ কাউকে কিছু স্বীকার করল না, কিন্তু তারা দুজনেই জানত—এই অচেনা আলাপ তাদের জীবনের গতি পরিবর্তনের শুরু।
–
প্রথম সাক্ষাতের পর দিনগুলো যেন অরিন্দম আর রূপসার জীবনে নতুন এক ছন্দ এনে দিল। ফোন নম্বর বিনিময় থেকে শুরু হয়ে গেল হালকা শুভেচ্ছা বিনিময়, তারপর ধীরে ধীরে সেই শুভেচ্ছা রূপ নিল লম্বা আলাপে। একদিন রূপসা প্রস্তাব দিল, কাছের এক কফিশপে দেখা করার। অরিন্দমের মনে একদিকে দ্বিধা, অন্যদিকে অদম্য টান; শেষমেশ সে রাজি হয়ে যায়। সেই বিকেলে তারা দুজনেই কফিশপের এক কোণে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল টুপটাপ, আর ভেতরে তাদের কথা যেন এক অদৃশ্য উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল। তারা কথা বলছিল বই, কবিতা, জীবনের ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখ, কিন্তু আসলে কথাগুলো ছাপিয়ে যাচ্ছিল হৃদয়ের গভীর এক টান। অরিন্দম টের পেল, সে কত সহজে নিজের অস্থিরতা রূপসাকে খুলে বলতে পারছে, যা সে এতদিন কারও সঙ্গেই ভাগ করেনি। রূপসাও তার একাকীত্বের কথা জানাল, এমনভাবে যেন সে দীর্ঘদিন ধরে এ মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিল। তাদের হাসি, তাদের চুপ করে থাকা, এমনকি কফির কাপের ফাঁকে ছোট ছোট দৃষ্টিবিনিময়—সবই যেন গোপন এক সুর বয়ে আনছিল।
এরপর থেকে দেখা করাটা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অভ্যাস হয়ে দাঁড়াল। কখনো কলেজ ছুটির পর রূপসা লাইব্রেরির শান্ত কোণে অপেক্ষা করত, কখনো অফিস ফাঁকি দিয়ে অরিন্দম চলে আসত তার সঙ্গে কফির টেবিলে বসতে। তাদের আলাপচারি ধীরে ধীরে আরও ব্যক্তিগত হয়ে উঠল—শৈশবের স্মৃতি, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা, আর অন্তরের সেই গভীর শূন্যতার কথা। একসময় তারা দুজনেই বুঝে গেল, একে অপরের কাছে তারা কেবল কথোপকথনের সঙ্গী নয়—বরং এমন একজন, যে ভেতরের শূন্যতাকে সত্যিই বোঝে। এই ঘনিষ্ঠতায় তারা দুজনেই এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পেল, কিন্তু সেই শান্তির ভেতরেই লুকিয়ে ছিল ঝড়। প্রতিবার দেখা হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে তাদের মনে জেগে উঠত অস্বস্তি, অপরাধবোধ—তারা জানত, এ সম্পর্ক নিষিদ্ধ, সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু যতই তারা দূরে থাকার চেষ্টা করুক, হৃদয়ের টান তাদের আবারও একে অপরের কাছে টেনে আনত।
অরিন্দমের ভেতরে দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়তে লাগল। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সে স্ত্রী ও সন্তানের সামনে বসে থাকত, কিন্তু মনে হতো সে যেন অন্য কোথাও পড়ে আছে—রূপসার কথায়, রূপসার চোখে। রূপসাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল নিজের ভেতরের লুকানো আবেগ চাপা দিতে দিতে। প্রতিটি সন্ধ্যায় জানালার পাশে বসে থাকতে থাকতে তার মনে পড়ত কফিশপের আলো, অরিন্দমের হালকা হাসি আর লাইব্রেরির নিস্তব্ধতায় ভাগ করে নেওয়া মুহূর্তগুলো। তারা দুজনেই জানত, এ সম্পর্ক যদি প্রকাশ পায় তবে তা ভীষণ বিপজ্জনক, পরিবার, সমাজ—সবকিছু ভেঙে পড়বে। তবুও সত্যিটা হলো, তারা আর ফিরে যেতে পারছিল না। যে টান তাদের একত্রে এনেছিল, সেটি এতটাই শক্তিশালী যে তা উপেক্ষা করা অসম্ভব। সেই নীরব টানই ধীরে ধীরে তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছিল—নিষিদ্ধ হলেও, এ প্রেমই যেন হয়ে উঠছিল তাদের একমাত্র সত্যি।
–
সন্ধ্যার আলো তখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, আকাশে নরম অন্ধকারের চাদর বিছিয়ে পড়ছিল, আর শহরের কোলাহল ভেদ করে এক কফিশপের নির্জন কোণে বসেছিল অরিন্দম ও রূপসা। অনেকবার দেখা হলেও, সেইদিন যেন তাদের কথোপকথন ভিন্ন রূপ নিল। শুরুটা ছিল স্বাভাবিক—বই, কবিতা, কলেজের গল্প, অফিসের চাপ—কিন্তু ধীরে ধীরে আলাপ ভেসে গেল গভীরতার দিকে। রূপসার চোখে যেন চাপা বেদনার ছায়া ঘন হয়ে উঠছিল। হঠাৎ সে থেমে গেল, কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলল—“তুমি জানো, আমি আসলে খুব একা।” অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তার বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। রূপসার কণ্ঠে এক অদ্ভুত ভাঙন ছিল, যা তার মনকে নাড়া দিল। রূপসা বলতে লাগল কেমন করে তার স্বামী ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় দিনরাত ডুবে থাকে, সংসারের প্রতি দায়িত্ব ঠিকই পালন করে, কিন্তু তার মনের পাশে এসে বসে না। “আমি চাইলেও হাসতে পারি না, আনন্দ পেলেও কারও সঙ্গে ভাগ করতে পারি না, আর দুঃখ পেলে পাশে কেউ নেই।” কথাগুলো বলতে বলতে রূপসার চোখ ভিজে উঠল। সে দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা নিঃসঙ্গতার বোঝা সেদিন প্রথমবার কারও সামনে ঝেড়ে ফেলল।
অরিন্দম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার নিজের ভেতরে জমে থাকা অস্থিরতা হঠাৎ করে ভাষা খুঁজে পেল। সে ধীরে ধীরে নিজের কথাগুলো খুলে বলতে শুরু করল—কীভাবে তার সংসার নিখুঁত হলেও প্রাণহীন, কীভাবে প্রতিদিন একই নিয়মমাফিক জীবনের ভেতর সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে। সে জানাল, স্ত্রীর প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু তবুও মনে হয়, তাদের সম্পর্ক শুধু দায়িত্বে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। “আমার হাসি, আমার কষ্ট—কিছুই যেন ওর কাছে পৌঁছায় না। আমি যতটা বাইরে থেকে স্থির, ভেতরে ততটাই অস্থির।” রূপসা চোখ ভিজে শুনছিল, আর অরিন্দম অনুভব করছিল এই প্রথম তার সমস্ত চেপে রাখা ক্লান্তি, সমস্ত অব্যক্ত যন্ত্রণাকে কেউ সত্যিই বুঝছে। সেই মুহূর্তে তারা দুজনেই যেন আড়ালহীন হয়ে পড়ল। না ছিল কোনো ভান, না ছিল কোনো মুখোশ—ছিল কেবল দুটি ক্লান্ত হৃদয়ের নিঃস্বীকার স্বীকারোক্তি। তাদের চোখে চোখ পড়তেই তারা বুঝল, এই অনুভূতিকে আর অস্বীকার করা যাবে না।
কফিশপের ভিড়, বাইরের গাড়ির শব্দ, এমনকি বৃষ্টির টুপটাপ শব্দও যেন দূরে মিলিয়ে গেল। তাদের চারপাশে তৈরি হলো এক অদৃশ্য বৃত্ত, যেখানে কেবল তারা দুজনেই আছে। রূপসা অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে বলল—“তুমি যদি না থাকতে, হয়তো আমি এভাবে বাঁচতে পারতাম না।” অরিন্দম এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল, তারপর আস্তে করে রূপসার হাতটা নিজের হাতে নিল। সেই স্পর্শে কোনো অশ্লীলতা ছিল না, ছিল কেবল গভীর আশ্বাস, অটুট বোঝাপড়া। দুজনের চোখে ভেসে উঠল অপরাধবোধ—তারা দুজনেই জানত, এই সম্পর্ক সমাজে কোনো জায়গা পাবে না। তবুও তারা বুঝে গেল, একে অপর ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। সেই দিন থেকে তাদের সম্পর্ক নতুন এক মাত্রা পেল। একসঙ্গে হাসা, কাঁদা, আবেগ ভাগ করে নেওয়া—সবকিছু মিলিয়ে তারা দুজনেই অন্ধকারের ভেতর আলো খুঁজে পেল। অপরাধবোধ থাকা সত্ত্বেও, তারা জানত এই আবেগই সত্যি, আর এই সত্যিকেই তারা আর এড়িয়ে যেতে পারবে না।
–
রূপসার মন যেন এক অচেনা ঝড়ে ভেঙে পড়ছে। অরূপের চোখে ধরা পড়ে তার অস্থিরতা—কোনো নির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও স্বামী টের পায় স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলছে কোথাও। সংসারের খুঁটিনাটি কাজ করতে গিয়ে রূপসা নিজেকে গোপন কোনো অপরাধে জড়ানো মানুষ মনে করে। অরূপের সরল দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে তার বুক কেঁপে ওঠে। সে ভাবে—অরিন্দমের প্রতি এই অদ্ভুত টানটা কি তবে তাকে ধ্বংস করে দেবে? সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে থাকা অবস্থায় তার মনে পড়ে যায় অরিন্দমের মুখ, তার কথাগুলো, আর সেই নীরব ঘনিষ্ঠতা। অথচ একই সময়ে মনে পড়ে যায় অরূপের স্নেহমিশ্রিত ছোট ছোট যত্ন। এই দ্বৈত অনুভূতি তাকে ভেতর থেকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। রূপসা নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে—এই সম্পর্কটা একদিন শেষ করতেই হবে। কিন্তু বুকের ভেতর একটা অসহ্য শূন্যতা আর অদৃশ্য আকর্ষণ তাকে বারবার দুর্বল করে ফেলে।
অন্যদিকে, অরিন্দমও নিজের সংসারের ভেতরে অদ্ভুত চাপা অস্বস্তি টের পায়। স্নিগ্ধা—যে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী—হঠাৎ করেই যেন আরো সতর্ক হয়ে উঠেছে। রান্নাঘরে, ঘরের কাজে, এমনকি কথোপকথনের মাঝেও সে বুঝতে পারে স্নিগ্ধার দৃষ্টিতে এক ধরনের অনুসন্ধান আছে। অরিন্দম ভয় পায়—কোথাও কি তার ভেতরের টানাপোড়েন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে? স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকাতে গিয়ে বুক কেঁপে ওঠে তার। অরিন্দম জানে, তার দায়িত্ব সংসারের প্রতি, সন্তানের প্রতি, আর সেই বন্ধনের প্রতি, যেটা বছরের পর বছর ধরে তাকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু একই সঙ্গে সে স্বীকার করে, রূপসার উপস্থিতি তার জীবনে এমন এক আবেগ জাগিয়েছে, যেটা বহু বছর ধরে চাপা পড়ে ছিল। অফিস থেকে ফেরার পর স্নিগ্ধার সাধারণ কথাবার্তাও যেন তার কানে একঘেয়ে শোনায়, অথচ রূপসার সাথে মিনিট কয়েক কথা বললেই যেন সে নতুন আলোয় ভেসে ওঠে। এই দ্বন্দ্ব তাকে ভেতর থেকে চূর্ণ করে দিচ্ছে।
ক্রমে তাদের দেখা-সাক্ষাৎও পাল্টে যায়। আগে যে আনন্দ, হাসি আর হালকা কথোপকথন ভরা থাকত, এখন সেখানে অস্বস্তি আর ভারী নীরবতা জায়গা করে নেয়। রূপসা একদিন অরিন্দমকে সরাসরি বলে—“আমাদের আর দেখা করা উচিত নয়।” তার চোখে জল, কণ্ঠে দ্বিধা। অরিন্দম কোনো উত্তর দিতে পারে না, শুধু চুপ করে থাকে। সে জানে রূপসা ঠিক বলছে, তবুও ভেতরের টান অস্বীকার করা অসম্ভব। দুজনের মাঝখানে তৈরি হয় এক অদৃশ্য দূরত্ব। দেখা হলেও তারা খুব বেশি কিছু বলে না, শুধু দৃষ্টির বিনিময়ে একে অপরের ভেতরের ভাঙন পড়ে নেয়। এই অস্থিরতা তাদের দুজনকেই ভীষণ একা করে তোলে। রূপসা সংসারের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পায় না, আর অরিন্দমও নিজের দায়িত্বের ভারে ডুবে থেকেও রূপসার অভাব কাটিয়ে উঠতে পারে না। তাদের জীবন যেন এক গভীর দ্বন্দ্বে আটকে পড়ে, যেখানে আকাঙ্ক্ষা আর দায়িত্বের মাঝখানে তারা প্রতিদিন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে, অথচ কেউই বেরিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না।
–
সেদিন বিকেলের দৃশ্যটা রূপসার কাছে আজও স্পষ্ট। অরিন্দমের সঙ্গে দেখা করার জন্য সে একটা অজুহাত বানিয়ে বেরিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ অরূপ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অরূপের বিস্মিত দৃষ্টির মুখোমুখি হয়ে রূপসার বুক কেঁপে ওঠে। সে জানে, কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে কিংবা ফোন বেজে উঠলে সবকিছু ফাঁস হয়ে যেতে পারত। যদিও অরূপ সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করেনি, তবুও তার চোখে যে সন্দেহের ছায়া নেমে এসেছিল, সেটা রূপসাকে ভিতরে ভিতরে ভেঙে দিয়েছিল। রাতে শুয়ে থাকতে থাকতে সে বারবার ভাবছিল—এভাবে চলতে থাকলে শুধু তার নিজের জীবন নয়, সন্তানের জীবনও ধ্বংস হয়ে যাবে। সমাজ, পরিবার, আত্মীয়স্বজন—সবাই যদি একদিন জানে, তবে তারা আর কোনোদিন মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে না। অথচ মনের ভেতর অরিন্দমের প্রতি যে অদৃশ্য টান, সেটাকে অস্বীকার করার মতো শক্তি তার নেই। রূপসার চোখে জল এসে যায়, সে জানে—এই সম্পর্কের যাত্রা মানেই ভয়ঙ্কর এক সীমানার দিকে ধাবিত হওয়া।
অন্যদিকে অরিন্দমও সেই দিন ভয়াবহ এক আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যায়। স্নিগ্ধা একদিন হঠাৎ তার মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে কয়েকটা মেসেজ দেখতে গিয়ে থমকে যায়। যদিও সেগুলো সরাসরি কিছু প্রকাশ করেনি, তবুও অরিন্দম বুঝতে পারে—আর কিছুদিনের মধ্যে স্নিগ্ধা তার অস্থিরতার আসল কারণ আঁচ করে ফেলবে। তার বুকের ভেতর হিমশীতল এক ভয় জমতে থাকে। সে ভাবে—যদি সত্যি একদিন স্নিগ্ধা তাকে প্রশ্ন করে, যদি সন্তানরা জানে, তবে সে মুখ দেখাবে কোথায়? অফিসে, সমাজে, পরিবারে—সব জায়গায় তার অবস্থান ভেঙে পড়বে। রাতে স্নিগ্ধার পাশে শুয়ে থাকা অবস্থায় তার মনে হয়, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধ সে করছে। কিন্তু পরক্ষণেই রূপসার মুখ ভেসে ওঠে—তার দুঃখী চোখ, অবহেলায় ভরা সংসার আর তার ভেতরের নিঃসঙ্গতা। অরিন্দম বোঝে, তারা দুজনেই একই শূন্যতায় ডুবে আছে, আর সেই শূন্যতা থেকেই তাদের সম্পর্কের জন্ম। কিন্তু এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখা মানেই একদিন ধরা পড়া, আর ধরা পড়া মানেই ভয়াবহ ভাঙন।
ক্রমে দুজনের আলাপচারিতায় আতঙ্কের ছায়া নেমে আসে। আগে যেখানে বই, কবিতা, কিংবা জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে তারা হেসে কথা বলত, এখন সেখানে ভর করে থাকে নীরবতা আর ভয়। একদিন রূপসা কফিশপে বসে অরিন্দমকে বলে, “আমরা কি তবে শেষ করে দেব? এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে বাঁচা যায় না।” অরিন্দম চুপ করে তাকিয়ে থাকে, তার বুকের ভেতর ঝড় বইছে। সে জানে রূপসা ঠিক বলছে, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শক্তি তার নেই। দুজনেই অনুভব করে—তারা এমন এক সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে হয় আলাদা হতে হবে, নয়তো এমন ঝুঁকি নিতে হবে যার শেষ ভয়াবহ। চারপাশের পৃথিবী তখনও তাদের কিছু বুঝতে পারছে না, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের অপরাধবোধ আর ভয়ের ফাঁদে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। এই ভাঙনের সীমানায় দাঁড়িয়ে তারা উপলব্ধি করে—ভালোবাসা শুধু আলো নয়, কখনো কখনো অন্ধকারের মতোই গ্রাস করে নেয়, এমন এক গভীরতায় যেখানে থেকে ফেরার রাস্তা নেই।
–
শেষপর্যন্ত অরিন্দম আর রূপসা দুজনেই বুঝে যায়—তাদের পথচলা একইসঙ্গে সম্ভব নয়। একদিন বিকেলে লাইব্রেরির পুরোনো বারান্দায় বসে তারা দীর্ঘ সময় ধরে নীরবে থাকে, যেন ভাষার আর কোনো প্রয়োজন নেই। রূপসার চোখে জল চিকচিক করে, অরিন্দম তার দিকে তাকিয়ে বোঝে—এই ভালোবাসাকে নিয়ে এগোনো মানে কেবল ভাঙন, অপমান আর অস্থিরতা। তারা সিদ্ধান্ত নেয়—শারীরিকভাবে আর দেখা হবে না। তবুও তাদের মনের ভেতরের আবেগ নিঃশেষ হয় না। রূপসা হালকা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “আমাদের ভালোবাসাটা হয়তো ভুল, কিন্তু মিথ্যে নয়।” অরিন্দম কোনো উত্তর দেয় না, শুধু তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই মুহূর্তে তারা দুজনেই বোঝে—সমাজের নিয়ম মানতে হবে, সংসারের দায় মেনে নিতে হবে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে যে অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়েছে, তাকে কখনো ভাঙা যাবে না।
সময় গড়ায়, দিন পাল্টায়। অরিন্দম ফিরে যায় তার সংসারে, স্নিগ্ধার নির্লিপ্ত যত্ন আর সন্তানের হাসির ভেতরে নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। রূপসাও তার ঘরে ফিরে যায়—অরূপের সঙ্গে কথাবার্তায় আবারো স্বাভাবিকতার মুখোশ আঁকে। বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও ভেতরে তাদের দুজনের মন ছুঁয়ে থাকে অদৃশ্য কোনো স্রোত। মাঝেমাঝে ফোনে হঠাৎ কল কেটে দেওয়া, কিংবা কোনো মেসেজ লিখে মুছে ফেলা—এসব ছোট ছোট মুহূর্তই মনে করিয়ে দেয় যে তারা একে অপরের অস্তিত্বের ভেতরে এখনো বেঁচে আছে। সমাজ হয়তো মনে করে তারা আলাদা হয়ে গেছে, সংসারও ভাবে সবকিছু আগের মতো চলছে, কিন্তু বাস্তবে তারা দুজনেই জানে—এই সম্পর্ককে শেষ করা যায়নি, শুধু চোখের আড়ালে সরিয়ে রাখা হয়েছে।
বছর কেটে গেলে একদিন হয়তো কোনো ভিড়ভাট্টার মাঝে তাদের দেখা হয়ে যাবে—তখন হয়তো কথা হবে না, শুধু দৃষ্টির ভেতরেই লুকিয়ে থাকবে হাজারো অপ্রকাশিত শব্দ। তারা জানে, সমাজের চোখে এই সম্পর্ক নিষিদ্ধ, কিন্তু নিজেদের হৃদয়ের ভেতরে এটাই সবচেয়ে সত্যি। এই সত্যি তাদের অপরাধবোধে ভরিয়ে তোলে, আবার একই সঙ্গে গভীর শান্তিও দেয়—কারণ তারা বুঝে গেছে, ভালোবাসা সবসময় পাওয়া নয়, কখনো কখনো শুধু বেঁচে থাকা। অরিন্দম আর রূপসার গল্প তাই শেষ হয় না কোনো সুখী মিলনে বা করুণ বিচ্ছেদে; শেষ হয় এক অনন্ত টানে, যেখানে নিষিদ্ধতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে চিরসত্য এক ভালোবাসা—যা সমাজ স্বীকার করবে না, কিন্তু তাদের হৃদয় সারাজীবন বহন করবে।
***